বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

একটা অজ্ঞাত, অপার্থিব বিপদের আশঙ্কায় সকলের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল!

এতকালের বদ্ধ আলোহারা বায়ুহারা সুড়ঙ্গপথ, সমাধির চেয়েও যা সুরক্ষিত ও সুদুর্গম, তার মধ্যে বস্তা টেনে শব্দের সৃষ্টি করছে কে বা কারা? আর এদিকেই বা এগিয়ে আসছে কেন? যার মধ্যে জীবন্ত জীবের আবির্ভাব অসম্ভব, সেখানে এ কী অভাবিত ব্যাপার?

জয়ন্ত চুপিচুপি বললে, ‘মানিক, ব্যাপার বড়ো সুবিধার নয়, বন্দুক তৈরি রাখো!’ সুড়ঙ্গপথের ভিতরে তার চুপিচুপি কথাই শোনাল চিৎকারের মতো!

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, বন্দুকই তৈরি রাখবে বটে! এই পাতালপুরে কোন কুম্ভকর্ণের বেটা কত শত বৎসর ধরে ঘুমিয়ে ছিল, মজার মজার স্বপ্ন দেখে আরাম করছিল, এখন অসময়ে এখানে অনধিকার প্রবেশ করে আমরা তার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম! বন্দুক ছুড়ে করবে কী? বন্দুকের গুলিও তো হজমি গুলির মতো কপ কপ করে গিলে ফেলবে!’

জয়ন্ত ও মানিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল!

বস্তা টানার মতো শব্দ ক্রমেই বেড়ে উঠেছে! সেই সঙ্গে আরও একটা বেয়াড়া আওয়াজ শোনা যেতে লাগল৷ কে যেন মাটির উপরে দুম দুম করে খুব ভারী ভারী জিনিস আছড়ে ফেলছে অত্যন্ত অধীর ভাবে!

জয়ন্ত এসব শব্দের হদিস খুঁজে পেলে না! এ যেন কার আস্ফালনের শব্দ!

অমলবাবু রুদ্ধশ্বাসে বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, সেকালে গুপ্তধন রক্ষা করবার জন্যে যক রাখা হতে বলে প্রবাদ শুনেছি! তা কি তবে সত্য? যে আসছে সে কি যক?’

জয়ন্ত বললে, ‘পদ্মরাগ বুদ্ধ হচ্ছেন অহিংসার দেবতা! এখানে যক রাখা মানে একটি জীবের প্রাণবধ করা৷ কোনো বৌদ্ধ পুরোহিত সে মহাপাপ করতে পারেন না৷ যকের কথা সত্য কি না জানি না,-সত্য না হওয়াই সম্ভব, তবে সত্য হলেও এখানে যক কেউ রাখেনি৷’

-‘তবে ও কে আসছে?’

-‘ভগবান জানেন!’

এইবার ভীষণ একটা গর্জন শোনা গেল! বদ্ধ সুড়ঙ্গের আবহাওয়ায় বিকৃত হয়ে সেই ভয়াবহ ধ্বনি এমন অদ্ভুত শোনাল যে, সেটা কীসের গর্জন কিছুই বোঝা গেল না৷

সুন্দরবাবু হাল ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘হুম ক্রমাগত চমকে চমকে আজ মারা পড়ব নাকি? আমার আর সহ্য হচ্ছে না-চললুম আমি উপরে! এর চেয়ে ওপরের অন্ধকারে বসে ভয় পাওয়া ভালো, বনের বাঘ-ভাল্লুকের পেটে যাওয়া ভালো!’ তিনি সুড়ঙ্গমুখের দিকে চোঁচা দৌড় মারলেন৷

সুড়ঙ্গপথের অনেক দূরে, যেখানকার নিরেট অন্ধকারের গায়ে ঠেকে লন্ঠনের আলো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, সেইখানে ফুটে উঠল বিদ্যুৎখণ্ডের মতো দুটো জ্বলন্ত চক্ষু! সে বিচিত্র চোখ নিষ্পলক, তার আগুন একবারও নিবছে না!

জয়ন্ত বললে, ‘আজ আর গোঁয়ারতুমি করা নয়! মানিক আজ আমাদের ফিরতেই হবে-এখনও সময় আছে! সকলে মিলে পরামর্শ করে কাল সকালে আবার ফিরে আসা যাবে! চলো, আমরা বাইরে যাই!’

-‘কিন্তু ওসব কীসের শব্দ, ও কার গর্জন ও কার চোখ কিছুই তো বোঝা গেল না!’

-‘বুঝতে গেলে প্রাণ দিতে হয়! শিগগির উপরে চলো!’

সকলে দ্রুতপদে উপরে উঠে দেখলে, ভাঙা বেদির গায়ে হেলান দিয়ে মড়ার মতো হলদে মুখে সুন্দরবাবু চুপ করে বসে আছেন৷

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, আজ আপনারই জয়জয়কার! পলায়নে আপনি হয়েছেন আমাদের পথপ্রদর্শক৷’

সুন্দরবাবু তখন উত্তর দেবারও শক্তি ছিল না৷

জয়ন্ত বললে, ‘আমাদের এখানে থাকাও নিরাপদ নয়৷ সুড়ঙ্গের মুখ খোলা, দপদপে চোখ দিয়ে যে আমাদের দেখেছে সে এখানেও খুঁজতে আসতে পারে! চলো, আমরা মন্দিরের পিছনে বনের ভিতরে যাই৷ আজকের রাতটা গাছের উপরে উঠেই কাটাতে হবে!’

অমলবাবু বললেন, ‘তার চেয়ে পাথরগুলো আবার যথাস্থানে রেখে গর্ত আবার বন্ধ করে দিলে কি হয় না?’

-‘না৷ পাথর তো এখন আর গেঁথে দেওয়া সম্ভব নয়! সুড়ঙ্গে যার সাড়া পেয়েছি তার আকার নিশ্চয়ই অসাধারণ! ওই আলগা পাথরগুলো তার এক ধাক্কায় হুড়মুড় করে ঠিকরে পড়বে!’

সুন্দরবাবু এতক্ষণে ভাষা পেয়ে বললেন, ‘জয়ন্তের প্রস্তাবই যুক্তিসংগত৷ পথ খোলা পেলে ও দানবটা হয়তো গর্ত ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতেও পারে!’

জয়ন্ত বললেন, ‘ভগবান করুন, আপনার অনুমানই যেন সত্য হয়! ও পাপ বিদেয় হলে তো সব ল্যাঠা চুকে যায়!’

সুড়ঙ্গের গর্ভ ভেদ করে আবার একটা বুকের-রক্ত-ঠান্ডা-করা গভীর গর্জন বাইরে ছুটে এল!

সে গর্জনের সঙ্গে জড়ানো রয়েছে যেন বিষম ক্রোধ ও বিপুল ক্ষুধার ভাব! যেন আসন্ন মৃত্যুর গর্জন, শুনলেই বুকের ভিতরে জীবনের স্পন্দন স্তম্ভিত হয়ে যায়!

জয়ন্ত সচকিত কন্ঠে বললে, ‘সে আসছে, সে আসছে! তোলো সব তল্পিতল্পা, ছোটো বনের দিকে!’

রাত তখন বেশি নয়, কিন্তু এরই মধ্যে বনবাসিনী নিশীথিনীর নিদুটিমন্ত্রে চতুর্দিকের নির্জনতা যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে৷ আকাশে চাঁদ নেই, অন্ধকারের সাম্রাজ্য আজ অপ্রতিহত৷ বাতাস যেন কাঁদতে কাঁদতে বয়ে আনছে দূর বনের আর্তধ্বনি৷

মন্দিরের পিছনে একটি ছোটো মাঠ৷ তারপর আবার অরণ্য৷

সেইদিকে এগুতে এগুতে জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সঙ্গে বিষাক্ত বাষ্পের বোমা এনেছিলুম!’

-‘কেন বলো দেখি?’

-‘কাল সকালে সুড়ঙ্গের মধ্যেই বোমা ছুড়ে দেখব কোনো ফল হয় কি না৷’

-‘যদি ফল না হয়? যদি ওটা কোনো জীব না হয়?’

-‘মানে?’

-‘ওঠা কোনো ভৌতিক কাণ্ড হওয়া কি অসম্ভব?’

-‘মানিক, শেষটা তুমিও কি সুন্দরবাবুর দলে ভিড়তে চাও?’

-‘ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে পৃথিবীর কোনো জীব বাঁচতে পারে?’

-‘না পারাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু ও যে পেরেছে, হয়তো তারও এমন কোনো স্বাভাবিক কারণ আছে, যা আমাদের অজানা৷ ভূতের কথা মনেও এনো না মানিক! ভূতের গল্প পড়তে ভালো লাগে, কারণ অসম্ভবের দিকে মানুষের টান থাকে৷ কিন্তু ভূত নেই৷’

বোধ হয় তখন শেষ-রাত৷ আকাশে চাঁদের আভাস জেগেছে মাত্র৷ গাছের উপরে সকলে বসেছিল অর্ধনিদ্রিত ও অর্ধজাগ্রত অবস্থায় কিন্তু তা সত্ত্বেও সুন্দরবাবু নাসিকা রাত্রির স্তব্ধতা দূর করবার জন্যে কম চেষ্টা করছিল না৷ এমনকী মানিকের মত হচ্ছে, তাঁর নাকের ডাকাডাকিতে ভয় পেয়ে সে গাছের সব পাখি ও বানর তো দূরের কথা, এমনকী ভূত-পেতনিরাও নাকি অন্য গাছের সন্ধানে পালিয়ে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে!

আচম্বিতে উপর-উপরি দু-দু-বার বন্দুকের শব্দে সকলের তন্দ্রা গেল ছুটে!

সুন্দরবাবু বেজায় চমকে বিনা বাক্যব্যয়ে ঝুপ করে ডাল থেকে পড়ে গেলেন৷ কিন্তু তিনি বিলক্ষণ হুঁশিয়ার ব্যক্তি বলে ধরাতলে অবতীর্ণ হবার আগেই খপ করে আর একটা ডাল ধরে ফেলে শূন্যে দুলতে ও ঝুলতে লাগলেন৷

রাতের মর্ম ভেদ করে নানা কন্ঠের চিৎকার ও আর্তনাদ দূর থেকে ভেসে এল! কারা যেন ভয়ানক আতঙ্কে চিৎকার করছে এবং দারুণ যাতনায় কাঁদছে৷

-‘জয়! জয়!’

-‘কী মানিক?’

-‘শুনেছ?’

-‘হুঁ!’

-‘আমাদের এখন কী করা উচিত?’

-‘চুপ করে এইখানে বসে থাকা উচিত৷ এ অরণ্য এখন মৃত্যুর রাজ্য, নীচে নামলেই মরব৷’

-‘কিন্তু ও কীসের গোলমাল?’

-‘কাল সকালে বুঝতে পারব৷ এখন আর কথা কয়ো না৷ কথা কইলেই হয়তো বিপদকে ডেকে আনা হবে৷’

নীচের ডাল থেকে করুণস্বরে শোনা গেল, ‘হুম! কিন্তু আমাকে যে কথা কইতেই হবে! গাছের ডাল ধরে আমি ঝুলছি৷ তোমরা সাহায্য না করলে আমি আর বেশিক্ষণ পারব না!’

অমলবাবুর সঙ্গে মানিক কোনোরকমে ডাল বেয়ে সুন্দরবাবুর কাছে-অর্থাৎ মাথার উপরে গিয়ে হাজির হল! মানিক বললে, ‘বৈজ্ঞানিকের মতে, আমাদের পূর্বপুরুষরা গাছের ডাল ধরে ঝুলতে পারতেন৷ সে অভ্যাস ভুলে গিয়ে আপনি ভালো করেননি সুন্দরবাবু!’

ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে সুন্দরবাবু বললেন, ‘মানিক, তোমার ঠাট্টা শুনলে অঙ্গ জ্বলে যায়! নাও, এখন আমাকে টেনে তুলবে, না বচন শোনাবে?’

উপর থেকে জয়ন্তের বিরক্ত ও গম্ভীর স্বর শোনা গেল, ‘ফের কথা কয়!’

দূরের কোনো গোলমাল আর শোনা যায় না৷ শব্দগুলো যেন স্তব্ধতা সাগরের মধ্যেই কয়েক খণ্ড ইষ্টকের মতো পড়েই ডুবে কোথায় তলিয়ে গেল! এখন শুধু কালো রাত করছে থমথম, মুখর ঝিল্লি করছে ঝিমঝিম, বনের গাছ করছে মরমর! এবং ম্লান খণ্ড চাঁদ নিবুনিবু চোখে করছে উষার কোলে মৃত্যুর অপেক্ষা! . . .

গাছে গাছে পাখির দল বনভূমির সবুজ জগতে দিকে দিকে উচ্ছ্বসিত আনন্দে রটিয়ে দিলে-জাগো লতাপাতা, জাগো ফলফুল, জাগো অলি-প্রজাপতি! পূর্বের শোভাযাত্রায় দিবারানির সোনার মুকুট দেখা দিয়েছে! জাগো সবাই!

সকালের প্রথম আলো কী শান্তিময়! সকালের নতুন বাতাস কী মিষ্টি! এই পৃথিবীতে কখনো যে কালো-কুৎসিত ভয়ময় রাত ছিল, তার কথা যেন মনেও পড়ে না!

সকলে একে একে গাছ ছেড়ে আবার মাটি-মায়ের কোল পেয়ে আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আগে স্টোভে চড়িয়ে দাও চায়ের কেটলি! কী জানি বাবা, যে জায়গায় যাচ্ছি, জীবনে হয়তো আর চা খেতে হবে না! ওহে, এয়ারটাইট টিনে তোমরা রসগোল্লা আর সন্দেশ এনেছিলে না? হুম, ক্ষমা-ঘৃণা করে গোটা দশ-বারো আমার দিকে ছুড়ে মেরো!’

জয়ন্ত বললে, ‘ঠিক কথা, আমি সুন্দরবাবুকে সমর্থন করি৷ ভালো ব্রেকফাস্ট মানুষের সাহস আর শক্তিকে দু-গুণ করে তোলে! মানিক, নিয়ে এসো রসগোল্লা-সন্দেশের টিন!’

জয়ন্তের কাঁধে হাত রেখে সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত ভায়া, এইজন্যেই তো তোমার সঙ্গে আমার বেশি ভাব! খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তোমার মতো মনের মানুষ দুর্লভ!’ . . .

প্রাতরাশ শেষ করে সকলে আবার ভাঙা মন্দিরের দিকে অগ্রসর হল, সুন্দরবাবু আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বার কয়েক ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে চেঁচিয়ে নিলেন!

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু, শ্রীদুর্গার কান দু-টি কালা নয়, অমন বিকটস্বরে না চ্যাঁচালেও তিনি শুনতে পাবেন!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এই! ঠাট্টা শুরু হল তো? আচ্ছা মানিক, তুমি আমার পিছনে এত লাগো কেন বলো দেখি?’

মানিক মুচকি হেসে বললে, ‘আপনাকে বেশি ভালোবাসি কিনা!’

জয়ন্ত তার প্রিয় বাঁশের বাঁশিটি বার করেছে এবং ভৈরবী রাগিনীর লীলায় প্রভাতকে আরও সুন্দর করে তুলে মাঠের উপর দিয়ে সবার আগে এগিয়ে চলেছে!

মাঠে ফুটেছে অজস্র ঘাসের ফুল-কেউ সাদা, কেউ হলদে৷ আশেপাশে ঘুরে ফিরে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে খুব ছোটো জাতের একরকম প্রজাপতি৷ মাঝে মাঝে তাদের কাছে বাহাদুরি নেবার মতলবে গঙ্গাফড়িং হাই জাম্পের নানান কায়দা দেখাচ্ছে!

মাঠ পার হয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে জয়ন্ত মন্দিরের দরজার উপরে উঠল৷ বাঁশিতে বাজছিল তখন কোনো গানের অন্তরা, কিন্তু হঠাৎ তার সুর বোবা হয়ে গেল একেবারে!

মানিক দূর থেকেই লক্ষ করলে, জয়ন্ত বাঁশিটি তাড়াতাড়ি পকেটে পুরে, পিঠে বাঁধা বন্দুকটা নামিয়ে নিলে! দেখেই সে ঝড়ের বেগে ছুটল!

সুন্দরবাবু বুঝলেন, আবার কোনো অঘটন ঘটেছে! একটা দুঃখের নিশ্বাস ফেলে সঙ্গীদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরাও ছুটে এসো!’ -বলেই তিনি দৌড়োতে লাগলেন!

অমলবাবু একান্ত নাচারের মতন বললেন, ‘হে ভগবান, আবার কী হল? আর যে পারি না!’

মন্দিরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সকলে যে বীভৎস দৃশ্য দেখলে, ভাষায় তা ঠিকমতো বর্ণনা করা অসম্ভব!

মন্দিরের মেঝের উপরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পড়ে রয়েছে বিরাট এক অজগর সাপ! এত বড়ো অজগর দেখা যায় না বললেই হয়-লম্বায় সে হয়তো ত্রিশ ফুটের কম হবে না এবং দেহও তার অসম্ভব রকম মোটা!

কিন্তু এই ভয়াবহ দৃশ্য অধিকতর ভয়ংকর হয়ে উঠেছে আর এক অভাবিত কারণে! অজগরের বিপুল কুণ্ডলীর ভিতরে প্রায় রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে রয়েছে দুটো মানুষের মৃতদেহ! . . . তৃতীয় একটা দেহ অজগরের ল্যাজের কাছে মেঝের উপরে হাত-পা ছড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে-তার মাথাটা একেবারে চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে এবং তার পাশে পড়ে একটা ভাঙা বন্দুক!

অজগরটাও বেঁচে নেই-তারও মাথা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে৷

মন্দিরের ভিতরে যেদিকে তাকানো যায় সেইদিকে রক্ত আর রক্ত! কোথাও পড়ে আছে চাপ চাপ রক্ত, কোথাও আঁকাবাঁকা রক্তের ধারা! রক্তের ফিনকি মন্দিরের দেওয়ালেও গিয়ে লেগেছে! এত রক্ত অমলবাবু এক জায়গায় কখনো দেখেননি,-তাঁর মাথা ঘুরে গেল, প্রায় অজ্ঞানের মতো তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন!

অনেকক্ষণ স্তম্ভিতের মতন দাঁড়িয়ে থাকবার পর জয়ন্ত ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললে, ‘তাহলে কাল আমরা এই অভাগাদেরই আর্তনাদ শুনেছিলুম?’

মানিক বললে, ‘তা ছাড়া আর কী!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘কিন্তু কে এরা?’

জয়ন্ত বললে, ‘বুঝতে পারছেন না? এরা যে আমাদেরই বন্ধু! আপনাদের গুলি খেয়েও এদের আশ মেটেনি, পদ্মরাগ বুদ্ধের উপরে এদের এত ভক্তি যে, আমরা কী করছি দেখবার জন্যে রাত্রে মন্দিরে এসে ঢুকেছিল!’

অমলবাবু ক্ষীণকন্ঠে বললেন, ‘আমি চ্যান আর ইনকে চিনতে পেরেছি৷ বন্দুকের পাশের লোকটা হচ্ছে ইন, আর অজগরের কুণ্ডলীর ভিতরে মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে চ্যান৷ অন্য লোকটাকে চিনি না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ . . . সাপ কখনো গর্ত খোঁড়ে না, অন্য জীবের খোঁড়া গর্তে সে আশ্রয় নেয়৷ কোনো জন্তু উপর থেকে গর্ত খুঁড়ে পদ্মরাগ বুদ্ধের সুড়ঙ্গে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল৷ অজগর মহাপ্রভু সেই গর্ত দিয়ে ভিতরে ঢুকে তাকে ফলার করেন আর তারপর থেকে মনের সুখে সুড়ঙ্গেই বাস করতে থাকেন৷ কাল রাত্রে উনিই আমাদেরও ফলার করবার চেষ্টায় ছিলেন৷ কিন্তু আমরা আত্মত্যাগে রাজি না হওয়াতে উনি বেরিয়ে এসে আমাদের অভদ্রতায় অত্যন্ত বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হয়ে মন্দিরের ভিতরেই বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন, বা কোনো কোণ বেছে নিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়েছিলেন৷ তারপর তখন চ্যান আর ইন কোম্পানির রঙ্গালয়ে প্রবেশ৷ তাদের চোখ তখন আমাদের জন্যেই ব্যস্ত, অজগরকে তারা দেখতে পায়নি, কিন্তু অজগর তাদের দেখেই আক্রমণ করলে! চ্যান আর তার একজন সঙ্গী প্রথম আক্রমণেই তার কুণ্ডলীর ভিতরে ধরা পড়ল, ইনের হাতে ছিল বন্দুক, সে অব্যর্থ লক্ষ্যে অজগরের মাথা টিপ করে দু-বার বন্দুক ছুড়লে, সঙ্গেসঙ্গে অজগরের বিষম ল্যাজের ঝাপটায় তার মাথা আর হাতের বন্দুক গেল গুঁড়িয়ে! বাকি যারা ছিল তারা করলে সবেগে পলায়ন! ব্যাপারটা বোধ হয় অনেকটা এইরকমই হয়েছিল৷ . . . অর্থাৎ আমাদের মানুষ শত্রুর দল নিজেরাই আত্মবলি দিয়ে আমাদের অজগর শত্রুকে বধ করে আমাদের পথ সাফ করে দিয়েছে! ভগবানকেও ধন্যবাদ, চ্যান অ্যান্ড ইন কোম্পানিকেও ধন্যবাদ! আর ধন্যবাদ দিই পদ্মরাগ বুদ্ধদেবকে! তিনি সত্যই যদি থাকেন, তবে আমদের হস্তগত হলে তিনি বোধ করি খুশি হবেন!’

সুন্দরবাবু এতক্ষণ পরে ভরসা করে মন্দিরের ভিতরে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হুম! বেটা অজগর! তুমি আমাদেরই জলযোগ করবার ফিকিরে ছিলে বটে!’-বলেই তিনি মৃত অজগরের কুণ্ডলীর উপরে বন্দুক দিয়ে একটা আঘাত করলেন৷

এবং যেমন আঘাত করা, অমনি সঙ্গেসঙ্গে অজগরের মৃতদেহটা কুণ্ডলী পাকিয়ে লাফিয়ে উঠল!

সুন্দরবাবু মৃত অজগরের এমন কল্পনাতীত ব্যবহার আশা করেননি, তিনি ভয়ানক ভড়কে হঠাৎ পিছিয়ে আসতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে মস্ত ব্যায়ামবীরের মতো আশ্চর্য এক ডিগবাজি খেয়ে মেঝের উপরে সশব্দে আছাড় খেয়ে পড়লেন এবং ষাঁড়ের মতো স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে বাবারে, অজগরটা এখনও জ্যান্ত আছে যে রে, আমার প্রাণ গেল রে!’

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি সুন্দরবাবুকে অতি অনায়াসে মাটি থেকে শূন্যে তুলে নিয়ে সরে এল এবং তাঁকে আবার সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলে!

অজগরের দেহটা তখন ফুলে ফুলে উঠছে এবং কুণ্ডলীর পর কুণ্ডলী পাকাচ্ছে৷

সুন্দরবাবু মহা ভয়ে আর একবার সেইদিকে তাকিয়েই বেগে পলায়ন করতে উদ্যত হলেন৷ কিন্তু জয়ন্ত হাত ধরে তাঁকে টেনে রাখলে৷

সুন্দরবাবু পাগলের মতন বলে উঠলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও জয়ন্ত, আমাকে ছেড়ে দাও! আমি অজগরের খোরাক হতে চাই না!’

জয়ন্ত হেসে বললে, ‘সুন্দরবাবু, শান্ত হোন!’

-‘শান্ত হব? জ্যান্ত অজগরের সামনে শান্ত হব? হুম হুম হুম!’

-‘ভয় নেই সুন্দরবাবু! অজগরের প্রাণ না থাকলেও তার দেহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নড়েচড়ে, কুণ্ডলী পাকায়! অবশ্য তখনও ওই কুণ্ডলীর ভিতরে গিয়ে ঢুকলে কোনো জীবেরই রক্ষা নেই, কিন্তু সে আর তেড়ে এসে কারুকে ধরতে পারে না!’

সুন্দরবাবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে অজগরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বটে, বটে, বটে? তাহলে আমি আর পালাব না! কিন্তু আমার ভয়ানক লেগেছে! আমি ডিগবাজি খেয়ে পাথরের মেঝের ওপর আছাড় খেয়েছি-ঃউ!’

জয়ন্ত একপাশ দিয়ে এগিয়ে ভাঙা বেদির সুড়ঙ্গমুখের কাছে গিয়ে প্রসন্ন কন্ঠে বললে, ‘এখন দূরে যাক সমস্ত দুঃস্বপ্ন, চোখের সামনে জেগে উঠুক পদ্মরাগ বুদ্ধের প্রতিমা! হাতি সিং, সকালেই আবার জ্বালো রাতের আলো-কেননা পাতালে দিনও নেই রাতও নেই, আছে শুধু রন্ধ্রহীন অন্ধকার!’

হাতি সিংয়ের লোকজনেরা আলো জ্বাললে, সকলে আবার পাতালপুরীর সোপান দিয়ে নীচে নামতে লাগল-সঙ্গে সঙ্গে রবিকরোজ্জ্বল প্রভাতের সমস্ত রং আর সুর আর গন্ধের সঙ্গে ঘটল বিচ্ছেদ!

সুড়ঙ্গের সুদূর অন্ধকারের পানে তাকিয়ে সুন্দরবাবুর কানে কানে মানিক বললে, ‘আচ্ছা, অজগরের বিধবা বউ যদি ওখানে থাকে, তাহলে আপনি কী করবেন?’

সুন্দরবাবু চমকে উঠে খুব সন্দেহের সঙ্গে সুমুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমাকে আর নতুন ভয় দেখিয়ো না মানিক!’

অজগরের বিধবা বউয়ের সঙ্গে কারুর আর দেখা হল না বটে, কিন্তু নতুন এক নিরাশায় ভেঙে পড়ল সকলের মন৷

সোজা পথ, কোনো শাখা-প্রশাখা নেই৷ কিন্তু খানিকপরেই পথ গেল ফুরিয়ে৷ সুমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নিথর পাথরের দেওয়াল!

সকলে খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল৷

অমলবাবু ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, ‘এই পাথরের দেওয়ালে মাথা ঠুকে আমাদের সকল আশার আজ অস্ত হল!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘শেষটা যে এই হবে, আমি তা জানতুম! হুম, পদ্মরাগ বুদ্ধ না অশ্বডিম্ব বুদ্ধ! ধাপ্পা বাবা, ধাপ্পা!’

মানিক বললে, ‘তাহলে অকারণে এত কষ্ট করে এই সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছিল কেন?’

অমলবাবু বললেন, ‘এ হচ্ছে নাগরাজ্য, নাগ ছিল এখানকার প্রতীক! ওঙ্কারধামের ভাস্কর্যে সর্বত্রই তাই নাগমূর্তির ছড়াছড়ি! ভারতের অনেক তীর্থক্ষেত্রে যেমন পবিত্র কুমির পোষা হয়, বাংলাদেশে যেমন বাস্তুসাপকে ঠাঁই দেওয়া হয়, এই মন্দিরেও তেমনি সুড়ঙ্গ কেটে পবিত্র অজগরকে রাখা হয়েছিল!’

জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে মাথা নেড়ে বললে, ‘উঁহু আপনার যুক্তি মনে লাগছে না! যে অজগরকে মনে করা হয় পবিত্র, ভক্তরা সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করে তাকে কখনো কবর দিয়ে জ্যান্ত মারবার ব্যবস্থা করত না! . . . আমার মনে একটা সন্দেহ জাগছে! হাতি সিং, তোমার লোকজনদের এগিয়ে আসতে বলো! ভেঙে ফেলুক তারা এই পাথরের দেওয়াল! দেখা যাক দেওয়ালের ওপাশে কী আছে?’ বলেই সে রুপোর শামুকের নস্যদানি বার করে ঘন ঘন নস্য নিতে লাগল৷

মানিক জানত, জয়ন্ত খুশি হলে নস্য না নিয়ে পারে না! কিন্তু আপাতত আনন্দের বদলে সে আশঙ্কার কারণই খুঁজে পেলে৷ তাড়াতাড়ি বললে, ‘জয়, সেই পুকুরের কথা তোমার মনে অছে তো? পুকুরের কোণ থেকে যে পথটা মন্দিরে গিয়ে পৌঁছেছে, এই সুড়ঙ্গ আছে ঠিক তার নীচে৷ সুতরাং আমরা এখন হয়ত সেই পুকুরের পাশে বা নীচে এসে দাঁড়িয়েছি৷ দেওয়াল ভাঙলে সুড়ঙ্গের ভিতর হুড়হুড় করে জল ঢুকতে পারে! তখন আমাদের কী দশা হবে?’

জয়ন্ত বললে, ‘সব দেওয়াল তো একসঙ্গে ভাঙা হবে না, জল ঢুকলে পালাবার ঢের সময় পাওয়া যাবে৷ . . . ভাঙো দেওয়াল!’

দেওয়ালের উপর পড়তে লাগল কুড়ুলের পর কুড়ুলের ঘা! শক্ত দেওয়াল! সহজে ভাঙা যায় না৷ অনেক কষ্টে একখানা পাথর সরানো হল৷

কিন্তু জল-টল কিছুই ভিতরে ঢুকল না৷ জয়ন্ত সেই ফাঁকটার ভিতরে হাত চালিয়ে অল্পক্ষণ কী অনুভব করলে৷ তারপর মহা উৎসাহে বলে উঠল, ‘চালাও কুড়ুল! সরাও পাথর! আমার সন্দেহ মিথ্যে নয়! এ সুড়ঙ্গ অকারণে কাটা হয়নি!’

মানিকও তাড়াতাড়ি সেই ফাঁকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেওয়ালের ওপাশে কাঠের মতো কী হাতে ঠেকছে! বোধ হয় দরজা!’

সুন্দরবাবু বিপুল কৌতূহলে বললেন, ‘অ্যাঁ 😕 বল কী! দরজা? আলিবাবার চল্লিশ দস্যুর রত্নগুহা চিচিং ফাঁক, চিচিং ফাঁক!’

ঠকাং! ঠকাং! ঠকাং! চলল সমানে কুড়ুলের পর কুড়ুল! খসে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে পাথরের পর পাথর! এক-একখানা পাথর খসে, আর নেচে নেচে ওঠে সকলের প্রাণ! . . .

দরজাই বটে! খুব বড়ো দরজা নয় ছোটো দরজা! তিন ফুটের বেশি উঁচু নয় কিন্তু বিলক্ষণ মজবুত! আগাগোড়া লোহার কিল মারা! পাথরের চেয়ে কঠিন! আর সেই দরজায় লাগানো রয়েছে একটা পুরোনো মস্ত পিতলের কুলুপ!

জয়ন্ত বললে, ‘কুলুপের ভিতরে বেশ করে তেল ঢেলে দাও! বহুকাল ও কুলুপে চাবি ঢোকেনি, তেলে না ভিজলে খুলবে না!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তেল তো ঢালছ, কিন্তু চাবি কোথায়?’

মানিক বললে, ‘আমার কাছে! নিশ্চয় সেই চাবিটা ওই কুলুপে লাগবে?’

জয়ন্ত রুপোর শামুকের নস্যদানি বার করে ঘন ঘন নস্য নিয়ে বললে, ‘কুলুপটা ভালো করে তেলে ভিজুক! ততক্ষণে আমরা আর-একবার চা তৈরি করলে নিশ্চয়ই কারুর আপত্তি হবে না? সন্দেশ আর রসগোল্লার টিন আর একবার বার করলে আপনি কি রাগ করবেন সুন্দরবাবু?’

সুন্দরবাবু ভুঁড়ির উপরে স্নেহভরে হাত বুলোতে বুলোতে একগাল হেসে বললেন, ‘রাগ! আমার এ ভুঁড়ি পর্বতপ্রমাণ সন্দেশ-রসগোল্লার স্বপ্ন দেখে! এ ভুঁড়ি কখনো পরিপূর্ণ হয় না! বিশ্বাস না হয়, আজকেই পরখ করে দেখতে পারো-হুম!’

মানিক স্বহস্তে দ্বিতীয় দফা চা তৈরি করতে বসল৷

অমলবাবু বললেন, ‘এইবারে পদ্মরাগ বুদ্ধের সব রহস্য টের পাওয়া যাবে!’

জয়ন্ত বললে, ‘হ্যাঁ, পদ্মরাগ মণির সঙ্গে বুদ্ধদেবের সম্পর্ক কী, এইবারেই তা জানতে পারব! অবশ্য এটা আমার জানা আছে যে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো পদ্মরাগ মণি ব্রহ্মদেশ ছাড়া আর কোথাও জন্মায় না! পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন বস্তু হচ্ছে হীরক, তারপরেই পদ্মরাগের স্থান৷ কিন্তু সমান ওজনের হীরকের চেয়ে পদ্মরাগ মণি বেশি মূল্যবান!’

চায়ের পিয়ালা যখন খালি হল, সন্দেশ-রসগোল্লা যখন ফুরল, তখন মানিক সগর্বে বার করলে তার পকেটের চাবি এবং সেই চাবি ঢুকল কুলুপের গর্ভে এবং একবার ঘোরাতেই কুলুপ গেল খুলে!

সমস্ত গুহা চিৎকার-শব্দে পরিপূর্ণ করে জয়ন্ত বললে, ‘জয়, পদ্মরাগ বুদ্ধের জয়!’

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, ছোটো একটি ঘর৷ তার মেঝে, তার দেওয়াল, তার ছাত সব পাথরে গড়া৷ সুতীব্র আধুনিক আলোকের আঘাতে কতকাল পরে সেখানকার প্রাচীন ও নিবিড় অন্ধকারের মৃত্যু হল, তার হিসাব কেউ জানে না! ঘরে আর কোনো আসবাব নেই, কেবল মাঝখানে রয়েছে কোনো ধাতু দিয়ে গড়া একটি মাঝারি সিন্দুক!

জয়ন্ত ঘরের চারিদিক তাকিয়ে বললে, মানিক, দেখো! পাথরের ঘর, তবু স্যাঁৎসেতে৷ পাথরের জোড়ের ভিতর দিয়ে জল গড়াচ্ছে! ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছ?’

-‘পারছি, জয়! এই ঘরটা আছে সেই পুকুরের নীচে৷’

-‘এখন এটাও বুঝতে পারছ তো, নকশায় পুকুরের পশ্চিম কোণে সেই চিহ্নিত জায়গাটা কেন আঁকা হয়েছে? পুকুরের তলায় এই ঘরটা আছে, মন্দিরগামী রাস্তার তলায় এই সুড়ঙ্গটা আছে, বেদির তলায় সিঁড়ির সার আছে, নকশা দিয়েছে তারই ইঙ্গিত! সাধারণ লোকে নকশা দেখলেও কিছু বুঝতে পারত না-কিন্তু আমরা হচ্ছি অসাধারণেরও চেয়ে অসাধারণ! কারণ অসাধারণ লোক নকশার রহস্য বুঝতে পারলেও সুড়ঙ্গের দরজা ঢাকা পাথরের দেওয়াল দেখে ফিরে যেতে বাধ্য হত, কিন্তু আমরা ফিরে যাইনি৷ অতএব অনায়াসেই গর্ব করতে পারি! এখন তোলো ওই সিন্দুকের ডালা!’

সিন্দুকের ডালা তুলেই সকলে অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল! . . . সিন্দুকের ভিতরে লন্ঠনের আলো পড়বার আগেই তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এল যেন একটা সুতীব্র রক্তজ্যোতির ঝটকা! তারপরেই দেখা গেল টকটকে লাল ও জ্বলজ্বলে পাথরের তৈরি একটি অতি আশ্চর্য ও অতুলনীয় বুদ্ধমূর্তি সেখানে কারুকার্যে বিচিত্র সুবৃহৎ স্বর্ণপাত্রে শোয়ানো রয়েছে! মূর্তিটি দৈর্ঘ্যে একহাতের কম হবে না!

জয়ন্ত বিস্ময়-বিহ্বল স্বরে বললে, ‘মূর্তির সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন লাল আলো ঠিকরে পড়ছে, চোখে লাগছে ধাঁধা! এ মণিময় মূর্তি না হয়ে যায় না! না জানি এর দাম কত কোটি টাকা! মানিক মানিক! এ কি সত্য, না অসম্ভব স্বপ্ন?’

মানিক আবেগে নিরুত্তর হয়ে মূর্তির মণিময়, দীপ্ত ও মসৃণ গায়ে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল৷

দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতন করে সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! পদ্মরাগ মণি কেটে এত বড়ো মূর্তি তৈরি করা হয়েছে? পদ্মরাগ মণি এত বড়ো হয়!’

মানিক বললে, ‘না সুন্দরবাবু, অনেকগুলো পদ্মরাগ মণি একসঙ্গে জুড়ে শিল্পী এই মূর্তি গড়েছে৷ কিন্তু এমনি তার হাতের কায়দা যে, কোথাও জোড় ধরবার উপায়ই নেই!’

জয়ন্ত কিছু বললে না, অভিভূত প্রাণে মূর্তিটাকে সযত্নে তুলে সিন্দুকের উপর বসিয়ে দিলে৷ অপার্থিব আনন্দের মতো ঘোররক্তবর্ণ সেই মহামানব মূর্তির প্রভা যেন আধুনিক সমুজ্জ্বল আলোগুলোকেও লজ্জা দিতে লাগল!

সেই জ্যোতির্ময় মূর্তির সামনে দুই হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে অমলবাবু ভক্তিভরে বলে উঠলেন, ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি! ধর্মং শরণং গচ্ছামি! সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি!’

—–