বুদ্ধং শরণং

বুদ্ধং শরণং

সারিপুত্ত ও মাহমৌদগল্যায়নের পূতাস্থি প্রায় এক শতাব্দীর পর পুনরায় তাঁদের সমাধিস্থলে রক্ষিত হচ্ছে।

প্রায় এক শ বছর পূর্বে সাঁচির স্তূপের উপর থেকে নিচের দিকে সুড়ঙ্গ কেটে তলার দিকে দুটি পেটিকা পাওয়া যায় এবং তাদের উপরের লেখা থেকে সপ্রমাণ হয় যে, পেটিকা দুটিতে এই দুই মহাস্থবিরের দেহাবশেষ রক্ষিত আছে। আপাতদৃষ্টিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এই দুই মহাপুরুষের দেহাস্থি বের করা বর্বরতা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সে যুগের তার সত্যই একান্ত প্রয়োজন ছিল। সে যুগে বিদেশি শাসনকর্তারা এই ত্রিভুবনে আমাদের যে কোনও গৌরবস্থল থাকতে পারে সেকথা আদপেই স্বীকার করতে চাইতেন না শুধুমাত্র একটি বিষয়ে তাঁরা আমাদের বাহাদুরির শাবাশি দিতে অকুণ্ঠ ছিলেন, সে নাকি আমাদের কল্পনাশক্তি উদ্দাম উচ্ছল কল্পনাপ্রবণতা। এই ‘প্রশস্তি’ দিয়ে তার পরমুহূর্তেই তাঁরা তার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে বলতেন, ‘এদের বুদ্ধ, এদের আনন্দ, সারিপুত্ত মৌদগল্যায়ন, জনপদকল্যাণী সবই এদের কল্পনাপ্রসূত– অভদ্র ভাষায় গাঁজা-গুল।

দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ ইংরেজ পণ্ডিতগণ এ মতে ঠিক সায় দিতেন না বলেই সাঁচির স্তূপ খুঁড়ে এই দুই শ্রমণের দেহাস্থি বের করা হয়েছিল। পেটিকা দুটি না বেরোলে আমাদের আরও কতখানি এবং কতদিন ধরে গালাগাল খেতে হত তার ঠিক হিসাব করা কঠিন।

তার পর এই দুই পেটিকা বিলেতে প্রায় এক শ বছর বাস করার পর বহু দেশে বহু লক্ষ নরনারীর সশ্রদ্ধ অভিবাদন পেয়ে আবার সাঁচিতে ফিরে এসেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, খোঁড়া না হয় হয়েছিল, কিন্তু পেটিকা দুটি বিলেতে নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

সেখানেও এঁদের জীবনের মাহাত্ম্য এক অদৃশ্য ইঙ্গিত দেখায়। এদের দেহাস্থি যদি একদা বিদেশে না যেতেন তবে তাদের দেশে ফিরে আসার উপলক্ষ নিয়ে এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারত না এবং আজ সচিতে তার চরম উৎসব উপলক্ষে এতগুলো দেশের গুণী, জ্ঞানী, সাধু, তাপস একত্র হয়ে তাঁদের জীবন-মাহাত্ম কীর্তন করে, এক হয়ে তাঁদের জীবনাদর্শের স্মরণে পৃথিবীতে পুনরায় শান্তির বাণী প্রচার এবং প্রসার করতে নবীনভাবে অনুপ্রাণিত হতেন না।

এখানে ঈষৎ একটি অপ্রিয় মন্তব্য করে দ্বিতীয় প্রস্তাব আরম্ভ করি।

এ দেশের সরস্বতীপূজা, দুর্গাপূজা যে আজ জাকজমক আর বাহ্যাড়ম্বরেই শেষ হয় সেকথা বাঙলা দেশের বিচক্ষণ লোমাত্রেই স্বীকার করে নিয়েছেন, তাই সঁচির উৎসব যে বাগাড়ম্বরেই শেষ হতে পারে, সে ভয় আমাদের সম্পূর্ণ অমূলক না-ও হতে পারে। তাই প্রশ্ন, সাচিতে সমবেত মনীষীগণ যে একবাক্যে শপথ গ্রহণ করলেন, পৃথিবীতে পুনরায় শাক্যমুনির শান্তিবাণী প্রচারিত হোক, তার সম্ভাবনা কতটুকু?

এ আশা দুরাশা যে পৃথিবীতে বহু লোক এখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করবে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এ পর্বের প্রধান পুরোহিত পণ্ডিতজি, শ্যামাপ্রসাদ এবং রাধাকৃষ্ণণ বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা কিংবা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেননি। তাই আজ যদি আমরা সবাই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ না করেও বুদ্ধদেবের শিক্ষা জীবনে সফল করবার চেষ্টা করি তা হলে আমরা কপটাচারী একথা বলা অন্যায় হবে।

আমার মনে হয়, ধর্মপরিবর্তনের যুগ আর নেই। একদা এ পৃথিবীতে অন্য ধর্মের তত্ত্ব এবং সার অনুসন্ধান করতে হলে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ এবং সে সমাজে সম্পূর্ণ প্রবেশ না করে সে ধর্মের ফললাভ করার কোনও পন্থা উন্মুক্ত থাকত না– কারণ তখন প্রত্যেক ধর্ম আপন আপন সঙ্কীর্ণ গণ্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ থাকত। আজ সর্ব ধর্মগ্রন্থ অনায়াসলভ্য, আজ আমরা অন্য ধর্মের সাধুসজ্জনদের সহবাস করতে পারি, ভিন্ন ভিন্ন সমাজের দোষগুণ আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করে নিতে পারি। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য, এ কর্ম সহজ, সরল করে দেওয়াও বটে। সুতরাং আজ আর ধর্ম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; আজ হিন্দু খ্রিস্টান না হয়েও আপন সমাজে অস্পৃশ্যতা বর্জন করতে পারে, মুসলমান হিন্দু না হয়েও শঙ্করদর্শন মেনে নিয়ে জীবন সে ধারায় চালাতে পারে।

শান্তির বাণী তো সব ধর্মই প্রচার করেছে : তাই এখন প্রশ্ন, শান্তির বাণীর জন্য বৌদ্ধধর্মের কাছেই হাত পাতবার প্রয়োজন কী?

প্রয়োজন এই, প্রত্যেক ধর্মই কোনও না কোনও এক কিংবা একাধিক নীতির ওপর জোর দিয়েছে বেশি। বৌদ্ধধর্ম সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য (কেন দিয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর তৎকালীন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বিজড়িত) এবং তারই ফলে মৌর্যযুগে তাবৎ ভারতবর্ষ পৃথিবীর ইতিহাসে একদিন অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে দেখা দিয়েছিল। সারিপুত্ত, মহামৌদগল্যায়ন প্রমুখ শ্ৰমণ যদি আপন প্রাণ হাতে নিয়ে প্রদেশ হতে প্রদেশান্তরে শান্তির বাণী প্রচার না করতেন (জাতকে বারবার দেখতে পাই যে-কোনও দেশ বা প্রদেশের প্রত্যন্ত প্রদেশে যাওয়ার অর্থ সে-যুগে ছিল আপন প্রাণ নিয়ে খেলা করা) তা হলে প্রদেশ-প্রদেশের সীমান্তরেখা বিলীন হত না এবং ফলে ঐক্যবদ্ধ অবিচ্ছিন্ন ভারত কবে সেরূপ নিত এবং আদৌ নিত কি না– আজ তার কল্পনা করা যায় না।

এবং এইখানেই তথাগতের প্রেম এবং মৈত্রী অভিযানের শেষ নয়– আরম্ভ মাত্র। পুনরায় বলি, আরম্ভ মাত্র।

তার পর এই বৌদ্ধবাণীর কল্যাণেই সিংহল গমন সহজ হল, দুর্ধর্ষ আফগানিস্তানের সঙ্গে মিত্রতা-সূত্রে বদ্ধ হল, (কাবুলের গ্রিক, বৌদ্ধ হয়ে গিয়ে গান্ধার শিল্প নির্মাণে সাহায্য করল এবং আজ যে আমরা প্রভু বুদ্ধের মূর্তি দেখে শান্তিরসে পূর্ণ হই, তার গোড়াপত্তন করে এই গ্রিকরাই), দুর্লজ্জ হিন্দুকুশ অতিক্রম করে বৌদ্ধ শ্ৰমণরা বামিয়ান পৌঁছলেন (সেখানকার বুদ্ধমূর্তি পৃথিবীর আর যে কোনও বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ মূর্তির চেয়ে উচ্চ), তার পর বর্বর তাতার তুর্কন পর্যন্ত বৌদ্ধ মন্ত্র গ্রহণ করল, সর্বশেষে তখনকার দিনের সবচেয়ে সভ্যদেশ চীন পর্যন্ত তথাগতের শরণ নিল!

এ দিকে বর্মা, শ্যাম, মালয়, যবদ্বীপ, বলীদ্বীপ ভূখণ্ড।

ভারতের মতো বিরাট দেশকে চীনের মতো বিশালতর দেশের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে এই বৌদ্ধ অভিযান যে মানবসভ্যতাকে কতখানি এগিয়ে দিল তার সুস্পষ্ট ধারণা দূরে থাক, তার কল্পনামাত্রও আজ আমরা করতে পারিনে। জানি পরবর্তী যুগে খ্রিস্টধর্ম আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত সাগর পর্যন্ত ভূখণ্ডকে এক করে দিয়েছিল, কিন্তু সে তো অসংখ্য দ্বন্দ্ব অগণিত সংগ্রামের ভেতর এবং আজও তার শেষ হয়নি।

ভারত-চীন, ভারত-তিব্বত এবং ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তা প্রধানত বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে। একথা বললে ভুল বলা হবে না যে, যেদিন ভারত বৌদ্ধধর্ম বর্জন করল (কেন করল, এবং না করলে তার গত্যন্তর ছিল কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ এবং এখানে অবান্তর), সেইদিন থেকেই ভারতের সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক ক্ষীণ হতে হতে একদিন সম্পূর্ণ লোপ পেল।

কিন্তু ভারত বৌদ্ধধর্ম বর্জন করেছে একথা ভুল। তথাগতের বাক্য, নীতি, অবদান (প্রাচীনার্থে), ধম্ম সনাতন হিন্দুধর্মের শিরা-উপশিরায় আজ এমনই মিশে গিয়েছে যে, তার বিশ্লেষণ অসম্ভব এবং অপ্রয়োজন।

পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণও আজ সেগুলো হিন্দুধর্ম থেকে বর্জন করতে সম্মত হবেন না। তাই আজ ব্রাহ্মণ শ্যামাপ্রসাদ, রাধাকৃষ্ণণ ও জওয়াহিরলালের শ্রমণাস্থি স্কন্ধে গ্রহণ কিঞ্চিত্মাত্র গুরুভার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।

এবং শুধু কি তাই? অমিতাভের বাণীতে কী অমিত অমৃত লুকানো রয়েছে যে, বর্তমান যুগে যেদিন তার বাণী ইয়োরোপে পৌঁছল সেদিন ফ্রান্সের বুর্নফ ইত্যাদি পণ্ডিতগণ আগ্রহের সঙ্গে সে বাণী গ্রহণ করলেন। ইয়োরোপের জনসাধারণও কী অদ্ভুত সাড়া দিল সে বাণী শুনে! ইয়োরোপ তখন আজকের চেয়ে বেশি ধর্মবিমুখ– বিগত দুই যুদ্ধ ইয়োরোপকে আবার আত্মার সন্ধানে তাড়া দিয়েছে– তবু তারা কী আগ্রহেই না বৌদ্ধ-ধর্মগ্রন্থ সংস্করণের পর সংস্করণ শেষ করল!

খোদ পরমেশ্বরকে বাদ দিয়ে, পাদরি-পুরুতের তোয়াক্কা না করেও ধর্মচর্চা করা যায়, একমাত্র নিজের ওপর নির্ভর করে, ক্রিয়াকাণ্ড বর্জন করে, তথাগতের উপদেশের সঙ্গে সাধনাগত অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিয়ে, তথাগত যেখানে আগত হয়েছেন সেখানে পৌঁছনো যায়, এ স্বপ্ন ইয়োরোপের কোনও জ্ঞানী কোনও গুণী দার্শনিকই দেখবার সাহস করেননি। বুদ্ধের অশ্রুতপূর্ব বাণী এক মুহূর্তেই ইয়োরোপের সামনে এক নবীন ভুবন আলোক দিয়ে জাজ্বল্যমান করে দিল।

তাই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে আজ ওই এক মহাপুরুষ-বুদ্ধদেব– যার পায়ের কাছে আজ সর্ব নাস্তিক সর্ব আস্তিক স্বধর্মভ্রষ্ট না হয়েও দীক্ষা গ্রহণ করতে পারে, ত্রিশরণ জপ করতে পারে :

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধর্মং শরণং গচ্ছামি
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ॥