হাদীস নং ৩৬২৫
ইয়াহইয়া ইবনে বুকাইর রহ……….নবী সহধর্মিণী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার মাতা পিতাকে কখনো ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন পালন করতে দেখিনি এবং এমন কোন দিন অতিবাহিত হয়নি যেদিন সকালে কিংবা সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়ীতে আসেননি। যখন মুসলামানগণ (মুশরিকদের নির্যাতনে) অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন, তখন আবু বকর রা. হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। অবশেষে বারকুল গিমাদ (নামক স্থানে) পৌঁছলে ইবনে দাগিনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। সে ছিল তার গোত্রের নেতা। সে বলল, হে আবু বকর, কোথায় যাচ্ছেন? উত্তরে আবু বকর রা. বললেন, আমার স্বজাতি আমাকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি মনে করছি, পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াব এবং আমার প্রতিপালকের ইবাদত করব। ইবনে দাগিনা বলল, হে আবু বকর রা. আপনার মত ব্যক্তি (দেশ থেকে) বের হতে পারে না এবং বের করাও হতে পারে না। আপনি তো নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের মেহমানদারী করে থাকেন এবং সত্য পথের পথিকদের বিপদ আপদে সাহায্য করেন। সুতরাং আমি আপনাকে আশ্রয় দিচ্ছি, আপনাকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতার অঙ্গীকার করছি। আপনি ফিরে যার এবং নিজ শহরে আপনার রবের ইবাদত করুন। আবু বকর রা. ফিরে এলেন। তাঁর সঙ্গে ইবানে দাগিনাও এল। ইবনে দাগিনা বিকেল বেলা কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নিকট গেল এবং তাদের বলল, আবু বকরের মত লোক দেশ হতে বের হতে পারে না এবং তাকে বের করে দেওয়া যায়না। আপনারা কি এমন ব্যক্তিকে বের করবেন, যে নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করে দেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, অক্ষমদের বোঝা নিজে বহন করেন, মেহমানের মেহমানদারী করে থাকেন ন্যায় পথে থাকার দরুন বিপদ আপদে সাহায্য করেন। ইবনে দাগিনার আশ্রয়দান কুরাইশগণ মেনে নিল, এবং তারা ইবনে দাগিনাকে বলল, তুমি আবু বকরকে বলে দাও, তিনি যেন তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করেন। সালাত তথায়ই আদায় করেন, ইচ্ছা মাফিক কুরআন তিলাওয়াত করেন। কিন্তু এর দ্বারা আমাদের যেন কষ্ট না দেন। আর এসব যেন প্রকাশ্যে না করেন। কেননা, আমরা আমাদের মেয়েদের ও ছেলেদের ফিতনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করি। ইবনে দাগিনা এসব কথা আবু বকর রা.-কে বলে দিলেন। সে মতে কিছুকাল আবু বকর রা. নিজের ঘরে তাঁর রবের ইবাদত করতে লাগলেন। সালাত প্রকাশ্যে আদায় করতেন না এবং ঘরেই কোরআন তিলওয়াত করতেন। এরপর আবু বকরের মনে (একটি মসজিদ নির্মাণের কথা) উদিত হল। তাই তিনি তাঁর ঘরের পাশেই একটি মসজিদ তৈরী করে নিলেন। এতে তিনি সালাত আদায় করতে ও কুরআন পড়তে লাগলেন। এতে তার কাছে মুশরিক মহিলা ও যুবকগণ ভীড় জমাতে লাগল। তারা আবু বকর রা.-এর একাজে বিস্মিত হত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবু বকর রা. ছিলেন একজন ক্রন্দন শীল ব্যক্তি, তিনি যখন কুরআন পড়তেন তখন তাঁর চোখের অশ্রু সামলিয়ে রাখতে পারতেন না। এ ব্যাপারটি মুশরিকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের আতঙ্কিত করে তুলল এবং তারা ইবনে দাগিনাকে ডেকে পাঠান। সে এল। তারা তাকে বলল, তোমার আশ্রয় প্রদানের কারণে আমরাও আবু বকরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম এই শর্তে যে, তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর ঘরে করবেন কিন্তু সে শর্ত তিনি লংঘন এবং নিজ গৃহের পাশে একটি মসজিদ তৈরী করে প্রকাশ্যে সালাত ও তিলাওয়াত আরম্ভ করেছেন। আমাদের ভয় হচ্ছে, আমাদের মহিলা ও সন্তানরা ফিতনায় পড়ে যাবে। কাজেই তুমি তাকে নিষেধ করে দাও। তিনি তাঁর রবের ইবাদত তাঁর গৃহে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করলে, তিনি তা করতে পারেন। আর যদি তিনি তা অস্বীকার করে প্রকাশ্যে তা করতে তা করতে চান তবে তাকে তোমার আশ্রয় প্রদান ও দায় দায়িত্বকে প্রত্যার্পণ করতে বল। আমরা তোমার আশ্রয় প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করাকে অত্যন্ত অপছন্দ করি, আবার আবু বকরকেও এভাবে প্রকাশ্যে ইবাদত করার জন্য ছেড়ে দিতে পারিনা। আয়েশা রা. বলেন, ইবনে দাগিনা এসে আবু রা. কে বলল, আপনি অবশ্যই জানেন যে, কী শর্তে আমি আপনার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম। আপনি হয়ত তাকে সীমিত থাকবেন অন্যথায় আমার জিম্মাদারী আমাকে ফিরত দিবেন। আমি এ কথা আদৌ পছন্দ করিনা যে আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং আমার আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অফবাদ আরববাসীর নিকট প্রকাশিত হউক। আবু বকর রা. তাকে বললেন, আমি তোমার আশ্রয় ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি আমার আল্লাহর আশ্রয়ের উপর সন্তুষ্ট আছি। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান (স্বপ্নে) দেখান হয়েছে। সে স্থানে খেজুর বাগান রয়েছে এবং তা দুইটি প্রস্তরময় অবস্থিত। এরপর যারা হিজরত করতে চাইলেন, তা!রা মদীনার দিকে হিজরত করলেন। আর যারা হিজরত করে আবিসিনিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, তাদেরও অধিকাংশ সেখান থেকে ফিরে মদীনায় চল আসলেন। আবু বকর রা. ও মদীনায় দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি অপেক্ষা কর। আশা করছি আমাকেও অমুমতি দেওয়া হবে। আবু বকর রা. বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান ! আপনিও কি হিজরতের আশা করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচার্য লাভের জন্য নিজেকে হিজরত থেকে বিরত রাখলেন এবং তাঁর নিকট যে দুটি উট ছিল এ দুটি চার মাস পর্যন্ত (ঘরে রেখে) বাবলা গাছের পাতা (ইত্যাদি) খাওয়াতে থাকেন। ইবনে শিহাব উরওয়া রা. সূত্রে আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ইতিমধ্যে একদিন আমরা ঠিক দুপুর বেলায় আবু বকর রা. এর ঘরে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আবু বকরকে সংবাদ দিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা ঢাকা অবস্থায় আসছেন। তা এমন সময় ছিল যে সময় তিনি পূর্বে কখনো আমাদের এখানে আসনেনি। আবু বকর রা তাঁর আগমন বার্তা শুনে বললেন, আমার মাতা-পিতা তাঁর প্রতি কুরবান। আল্লাহর কসম, তিনি এ সময় নিশ্চয় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কারণেই আসছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছে (প্রবেশের) অনুমতি চাইলেন। তাকে অনুমতি দেয়া হল। প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে বললেন, এখানে অন্য যারা আছে তাদের বের করে দাও । আবু বকর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি কুরবান, এখানেতো আপনারই পরিবার। তখন তিনি বললেন, আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবু বকর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান ! আমি আপনার সফর সঙ্গী হতে ইচ্ছুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঠিক আছে। আবু বকর রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমার পিতা-মাতা কুরবান! আমার এ দুটি উট থেকে আপনি যে কোন একটি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ঠিক আছে) তবে মূল্যের বিনিময়ে। আয়েশা রা. বলেন, আমরা তাদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা দ্রুততার সহিত সম্পন্ন করলাম এবং একটি থলের মধ্যে তাদের খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে দিলাম।আমার বোন আসমা বিনতে আবু বকর রা তার কোমর বন্ধের কিছু অংশ কেটে সে থলের মুখ বেঁধে দিলেন। এ কারণেই তাকে জাতুন নেতাক (কোমর বন্ধ বিশিষ্ট) বলা হত। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রা. (রওয়ানা হয়ে) সাও পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাঁরা সেখানে তিনটি রাত অবস্থান করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর রা. তাদের পাশেই রাত্রি যাপন করতেন। তিনি ছিলন একজন তীক্ষ্ম বুদ্ধসম্পন্ন তরুণ। তিনি শেষ রাত্রে ওখান থেকে বেরিয়ে মক্কায় রাত্রি যাপনকারী কুরাইশদের সহিত ভোর বেলায় মিলিত হতেন এবং তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করা হত তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, ও স্মরণ রাখতেন। যখন আধার ঘনিয়ে আসত তখন তিনি সংবাদ নিয়ে তাদের উভয়ের কাছে যেতেন। আবু বকর রা.-এর গোলাম আমির ইবনে ফুহাইরা তাদের কাছই দুধালো বকরীর পাল চড়িয়ে বেড়াত। রাত্রের কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে বকরীর পাল নিযে তাদের নিকটে যেত এবং তাঁরা দু’জন দুধ পান করে আরামে রাত্রিযাপন করতেন। তাঁরা বকরীর দুধ দোহন করে সাথে সাথেই পার করতেন। তারপর শেষ রাতে আমির ইবনে ফুহাইরা বকরীগুলো হাঁকিয়ে নিয়ে যেত। এ তিনটি রাতের প্রত্যেক রাতে সে এরূপই করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা. বনী আবদ ইবনে আদি গোত্রের এক ব্যকিএক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খিররীত পথ প্রদর্শক হিসাবে নিযুক্ত কাফির কুরাইশের ধর্মালম্বী। তাঁরা উভয়ে তাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাদের উট দুটি তার হাতে দিয়ে দিলেন এবং তৃতীয় রাত্রের পরে সকালে উট দুটি সাওর গুহার নিকট নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন। আর সে যথা সময়ে তা পৌঁছিয়ে দিল। আর আমির ইবনে ফুহাইরা ও পথপ্রদর্শক তাদের উভয়ের সঙ্গে চলল। প্রদর্শক তাদের নিয়ে উপকূলের পথ ধরে চলতে লাগল। ইবনে শিহাব রহ……….বলেন, আবদুর রাহমান ইবনে মালিক মুদলেজ আমাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনে মালিকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তার পিতা তাকে বলেছেন, তিনি সুরাকা ইবনে জুশুমকে বলতে শুনেছেন যে, আমাকে নিকট কুরাইশী কাফিরদের দূত আসল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রা. এ দুইজনের যে কোন একজনকে যে হত্যা করবে অথবা বন্দী করতে পারবে তাকে (একশ উট) পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিল। আমি আমার কওম বনী মুদলীজের এক মজলিসে বসা ছিলাম। সে বলল, হে সুরাকা, আমি এই মাত্র উপকূলের পথে কয়েকজন মানুষকে যেতে দেখলাম। আমার ধারণা, এরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহগামীগণ হবেন। সুরাকা বলেন, আমি বুঝতে পারলাম যে এর তারাই হবেন। কিন্তু তাকে বললাম, এরা তাঁরা নয়, বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ। এরা এই মাত্র আমাদের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। তারপর আমি কিছুক্ষণ মজলিসে অবস্থান করে (বাড়ী) চলে এলাম এবং আমার দাসীকে আদেশ করলাম, তুমি আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে যাও এবং অমুক টিলার আড়ালে ঘোড়াটি ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমি আমার বর্শা হাতে নিলাম এবং বাড়ীর পিছন দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বর্শাটির এক প্রান্ত হাতে ধরে অপর প্রান্ত মাটি সংলগ্ন অবস্থায় আমি টেনে নিয়ে চলছিলাম ঐ অবস্থায় বর্শার মাটি মাটি সংলগ্ন অংশ দ্বারা মাটির উপর রেখাপাত করতে করতে আমার ঘোড়ার নিকট গিয়ে পৌঁছলাম এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে তাকে খুব দ্রুত ছুটালাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। আমি প্রায় তাদের নিকট পৌঁছে গেলাম, এমন সময় আমার ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে আমাকে নিয়ে পড়ে গেল। আমিও তার পিঠ থেকে ঠিটকে পড়লাম। তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং তুণের দিকে হাত বাড়ালাম এবং তা থেকে তীরগুলি বের করলাম ও তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিলাম যে আমি তাদের কোন ক্ষতি করতে পারব কি না। তখন তীরগুলি দুর্ভাগ্যবশত এমনভাবে বেরিয়ে এল যে, ভাগ্য নির্ধারণের বেলায় এমনটি হওয়া পছন্দ করি না। আমি পুনরায় ভাগ্য পরীক্ষায় ফলাফল অমান্য করে অশ্বারোহণ করে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এত নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যে তাঁর তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি (আমার দিকে) ফিরে তাকাচ্ছিলে কিন্তু আবু বকর রা. বার বার তাকিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় হঠাৎ আমার ঘোড়ায় সামনের পা দুটি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে গেল এবং আমি তার উপর থেকে পড়ে গেলাম। তখন ঘোড়াটিকে ধমক দিলাম, সে দাঁড়াতে ইচ্ছা করল, কিন্তু পা দুটি বের করতে পারছিল না। অবশেষে যখন ঘোড়াটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল, তখন হঠাৎ তার সামনের পা দুটি যে স্থানে গেড়ে ছিল সে স্থান থেকে ধুয়ার ন্যায় ধূলি আকাশের দিকে উঠতে লাগল। তখন আমি তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারও যা আমার অপছন্দনীয় তাই প্রকাশ পেল। তখন উচ্চস্বরে তাদের নিরাপত্তা চাইলাম। এতে তাঁরা থেমে গেলেন এবং আম আমার ঘোড়ায় আরোহণ করে এলাম। আমি যখন ইত্যাকার অবস্থায় বার বার বাঁধাপ্রাপ্ত ও বিপদে পতিত হচ্ছিলাম তখনই আমার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ মিশনটি অচিরেই প্রভাব বিস্তার করবে। তখন আমি তাকে বললাম আপনা কওম আপনাকে ধরে দিতে পারলে একশ উট পুরস্কার ঘোষণা করেছে। মক্কায় কাফেরগণ তাঁর সম্পর্কে যে ইচ্ছা করেছে তা তাকে জানালাম। এবং আমি তাদের জন্য কিছু খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী পেশ করলাম । তাঁরা তা থেকে কিছুই নিলেন না। আর আমার কাছে এ কথা ছাড়া কিছুই চাইলেন না, আমাদের সংবাদ গোপন রেখ। এরপর আমি আমাকে একটি নিরাপত্তা লিপি লিখে দেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি আমির ইবনে ফুহাইরাকে আদেশ করলেন। তিনি একখন্ড চামড়ায় তা লিখে দিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা দিলেন। ইবনে শিহাব রহ বলেন, বলেন, উরওয়া ইবনে যুবাইর রা. আমাকে বলেছেন, পথিমধ্যে যুবাইরের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাত হয়। তিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া থেকে ফিরছিলেন। তখন যুবাইর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রা. কে সাদা রঙের পোশাক দান করলেন। এদিকে মদীনায় মুসলিমগণ শুনলেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। তাই তাঁরা প্রত্যহ সকালে মদীনার (বাইরে) হাররা পর্যন্ত গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন, দুপুরে রোদ প্রখর হলে তারা ঘরে ফিরে আসতেন। একদিন তারা পূর্বাপেক্ষা অধিক সময় অপেক্ষা করার পর নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। এমন সময় একজন ইয়াহূদী তার নিজ প্রয়োজনে একটি টিলায় আরোহণ করে এদিক ওদিক কি যেন দেখছিল। তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী সঙ্গীদেরকে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় মরীচিকাময় মরুভূমির উপর দিয়ে আগমন করতে দেখতে পেল। ইয়াহূদী তখন নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, হে আরব সম্প্রদায়! এইতো সে ভাগ্যবান ব্যক্তি-যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। মুসলিমগণ তাড়াতাড়ি হাতিয়ার তুলে নিয়ে এবং মদীনার হাররার উপকণ্ঠে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনি সকলকে নিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে বনী আমর ইবন আউফ গোত্রে অবতরণ করলেন। এদিনটি ছিল রবিউল আউওয়াল মাসের সোমবার। আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। আনসারদের মধ্য থেকে যারা এ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেন নি তাঁরা আবু বকর রা. এর কাছে সমবেত হতে লাগলেন, তারপর যখন রৌদ্রতাপ নবীজীর উপর পড়তে লাগল এবং আবু বকর রা. অগ্রসর হয়ে তাঁর চাদর দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপর ছায়া করে দিলেন। তখন লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে চিনতে পারল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে আউফ গোত্রে দশদিনের চেয়ে কিছু বেশী সময় অতিবাহিত করলেন এবং সে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা (কুরআনের ভাষায়) তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে সালাত আদায় করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটে আরোহণ করে রওয়ানা হলেন। লোকেরাও তাঁর সঙ্গে চলতে লাগলেন। মদীনায় (বর্তমান) মসজিদে নববীর স্থানে পৌঁছে উটটি বসে পড়ল। সে সময় ঐ স্থানে কতিপয় মুসলিম সালাত আদায় করতেন। এ জায়গাটি ছিল আসআদ ইবনে যুরারার আশ্রয়ে পালিত সাহল ও সুহাইল নামক দু’জন ইয়াতীম বালকের খেজুর শুকাবার স্থান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে উটটি যখন এস্থানে বসে পড়ল, তখন তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ, এ স্থানটিই হবে মানযিল। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বালক দুটিকে ডেকে পাঠালেন এবং মসজিদ নির্মাণের জন্য তাদের নিকট জায়গাটি মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয়ের আলোচনা করলেন। তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বরং এটি আমরা আপনার জন্য বিনামূল্যে দিচ্ছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে গ্রহণে অসম্মতি জানালেন এবং অবশেষে স্থানটি তাদের থেকে খরীদ করে নিলেন। তারপর সেই স্থানে তিনি মসজিদ নির্মাণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ নির্মাণকালে সাহাবা কেরামের সঙ্গে ইট বহন করছিলেন এবং ইট বহনের সময় তিনি আবৃত্তি করছিলেন এ বোঝা খায়বারের (খাদ্যদ্রব্য) বোঝা বহন নয়। ইয়া রব, এর বোঝা অত্যন্ত পুণ্যময় ও অতি পবিত্র। তিনি আরো বলছিলেন, ইয়া আল্লাহ! পরকালের প্রতিদানই প্রকৃত প্রতিদান। সুতরাং আনসার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুসলিম কবির কবিতা আবৃত্তি করেন, যার নাম আমাকে বলা হয়নি। ইবনে শিহাব রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কবিতাটি ছাড়া অপর কোন পূর্ণাঙ্গ কবিতা পাঠ করছেন বলে কোন বর্ণনা আমার কাছে পৌঁছেনি।