বুখারি হাদিস নং ২৭৩৯ – ইসলাম ও নবুওয়াতের দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহবান আর মানুষ যেন আল্লাহ ছাড়া তাদের পরস্পরকে রব হিসেবে গ্রহণ না করে।

হাদীস নং ২৭৩৯

ইবরাহীম ইবনে হামযা রহ……..ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়সারকে ইসলামের প্রতি আহবান সম্বলিত চিঠি লেখেন এবং দেহইয়া কালবীর রা.-এর মারফত সে চিঠি পাঠান এবং তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন যেন তা বুসরার গভর্নরের কাছে অর্পণ করেন, যাতে তিনি তা কায়সারের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। আল্লাহ যখন পারস্যের সৈন্যবাহিনীকে কায়সারের এলাকা থেকে হটিয়ে দেন, তখন আল্লাহর অনুগ্রহের এই শুকরিয়া হিসাবে কায়সার হিমস থেকে পায়ে হেটে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করেন। এ সময় তাঁর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিঠি এসে পৌঁছলে তা পাঠ করে তিনি বললেন যে, তাঁর গোত্রের কাউকে খোঁজ কর যাতে আম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারি। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আবু সুফিয়ান রা. আমাকে জানিয়েছেন যে, সে সময় আবু সুফিয়ান রা. কুরাইশদের মধ্যে সন্ধির বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ায় ছিলেন। এ সময়টি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কাফির কুরাইশদের কিছু লোকের সঙ্গে বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ায় ছিলেন। এ সময়টি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কাফির কুরাইশদের মধ্যে সন্ধির যুগ। আবু সুফিয়ান রা. বর্ণনা করেন যে, কায়সারের সেই দূতের সঙ্গে সিরিয়ার কোন স্থানে আমাদের দেখা হলে সে আমাকে আমার সঙ্গী-সাথীসহ বায়তুল মুকাদ্দাসে নিয়ে গেল। তারপর আমাদের কায়সারের দরবারে হাজির করা হল। তখন কায়সার মুকুট পরিধান করে রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। রোমের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁর পার্শ্বে ছিলেন। তারপর তিনি তাঁর দোভাষীকে বললেন, তাদের জিজ্ঞাসা কর, যিনি নিজেকে নবী বলিয়া দাবী করেন, এদের মধ্যে তাঁর নিকটাত্মীয় কে? আবু সুফিয়ান রা. বললেন, আমি বললাম, বংশের দিক দিয়ে আমি তাঁর সর্বাধিক নিকটতম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ও তাঁর মধ্যে কি ধরনের আত্মীয়তা রয়েছে? আমি বললাম, তিনি আমার চাচাতো ভাই। সে সময় উক্ত কাফেলায় আমি ছাড়া আবদ মানাফ গোত্রের আর কেউ ছিল না। কায়সার বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। তারপর বাদশাহর নির্দেশে আমার সকল সঙ্গীকে আমার পেছনে কাঁধের কাছে সমবেত করা হল। এরপর কায়সার দোভাষীকে বললেন, লোকটির সাথীদের জানিয়ে দাও, আমি তার কাছে সেই লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই, যিনি নবী বলিয়া দাবী করেন। যদি সে মিথ্যা বলে, তবে তোমরা তার প্রতিবাদ করবে। আবু সুফিয়ান রা. বলেন, আল্লাহর কসম! আমি যদি এ ব্যপারে লজ্জাবোধ না করতাম যে, আমার সাথীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে, তাহলে তাঁর প্রশ্নের জবাবে নবী সম্পর্কিত কিছু (মিথ্যা) কথা বলতাম। কিন্তু আমি লজ্জাবোধ করলাম যে, আমার সঙ্গীরা আমি মিথ্যা বলছি বলে প্রচার করবে। ফলে আমি সত্যই বললাম। তারপর তিনি তাঁর দোভাষীকে বললেন, জিজ্ঞাসা কর, তোমাদের মধ্যে নবীর বংশ মর্যাদা কিরূপ? আমি বললাম, আমাদের মধ্যে তিনি উচ্চ বংশীয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর বংশের অন্য কোন লোক কি ইতিপূর্বে এরূপ দাবী করেছে? জবাব দিলাম, না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর এ নুবওয়াতের আগে কোন সময় কি তাকে মিথ্যার অভিযোগে তোমরা অভিযুক্ত করেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ কি বাদশাহ ছিল ? আমি বললাম, না। প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসারী হচ্ছে, না দুর্বল (শ্রেণীর) লোকেরা? আমি বললাম, বরং দুর্বলরাই। তিনি বললেন, এদের সংখ্যা কি বৃদ্ধি পাচ্ছে না কমছে? আমি বললাম, বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বললেন, তাঁর দীনে প্রবেশ করার পর কেউ কি সে দীনের প্রতি অপছন্দ করে তা পরিত্যাগ করেছে? আমি বললাম, না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেছেন? আমি বললাম, না। তবে আমরা বর্তমানে তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তির মেয়াদে আছি এবং আশঙ্খা করছি যে, তিনি তা ভঙ্গ করতে পারেন। আবু সুফিয়ান রা. বলেন, আমার বক্তব্যে এই কথা ব্যতীত এমন কোন কথা লুকানো সম্ভব হয়নি। যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে খাট করা হয় আর আমার প্রতি অপপ্রচারের আশংকা না হয়। কায়সার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি তাঁর বিরুদ্ধে এবং তিনি কি তোমাদের বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধ করেছেন ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাঁর ও তোমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল কি ? আমি বললাম, যুদ্ধ কুয়ার বালতির মত। কখনো তিনি আমাদের উপর বিজয়ী হন, কখনো আমরা তাঁর উপর বিজয়ী হই। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি বিষয়ে আদেশ করেন? আমি বললাম, তিনি আমাদের আদেশ করেন, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তাঁর সঙ্গে কিছুই শরীক না করতে। আমাদের পিতৃপুরুষেরা যে সবের ইবাদত করত, তিনি সে সবের ইবাদত করতে আমাদের নিষেধ করেন। আর তিনি আমাদের আদেশ করেন সালাত আদায় করতে; সাদকা দিতে, পূত পবিত্র থাকতে, চুক্তি পালন করতে এবং আমানত আদায় করতে। আমি তাকে এসব জানালে তিনি দোভাষীকে আদেশ দিলেন, তাকে বল, আমি তোমাদের মধ্যে তাঁর বংশ মর্যাদা সম্পর্কে জানতে চাইলে তুমি বলেছ যে, তিনি উচ্চ বংশীয়। সেরূপই রাসূলগণ, তাদের কাওমের উচ্চ বংশেই প্রেরিত হন। আমি তোমাদের নিকট জানতে চেয়েছিলাম যে, তোমাদের কেউ কি ইতিপূর্বে এ ধরনের দাবী করেছে? তুমি বললে, না। তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে যদি কোন ব্যক্তি এরূপ কথা বলে থাকত, তাহলে আমি বলতাম, লোকটি পূর্ব কথিত একটি কথারই কথারই অনুসরণ করছে। আমি জানতে চেয়েছি, তাঁর এ দাবীর পূর্বে কি তোমরা তাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলে? তুমি বলেছ, না। এতে আমি বুঝতে পেরেছি যে, যে ব্যক্তি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা বলেননি, তিনি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবেন, এমন হতে পারে না। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁর পিতৃ পুরুষদের কেউ কি বাদশাহ ছিলেন? তুমি বলেছ, না। আমি বলছি, যদি তাঁর পিতৃ পুরুষদের কেউ বাদশাহ থাকত, তাহলে আমি বলতাম, সে পিতৃ পুরুষদের রাজত্ব উদ্ধার করতে ইচ্ছুক। আম তোমার কাছে জানতে চেয়েছি যে, প্রভাবশালী লোকেরাই তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা? তুমি বলেছ, দুর্বলরাই। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের লোকেরাই রাসূলগণের অনুসারী হয়ে থাকে। আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি, তাদের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ, বাড়ছে। ঈমান এভাবেই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁর দীন গ্রহণ করার পর কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে তা পরিত্যাগ করেছে? তুমি বলেছ, না। ঈমান এরূপই হয়ে থাকে, যখন তা হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে, তখন কেউ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয় না। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, তিনি কি চুক্তি ভঙ্গ করেন? তুমি বলেছ, না। ঠিকই রাসূলগণ কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা কি কখনো তাঁর সাথে যুদ্ধ করেছ এবঙ তিনি কি কখনো তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছন? তুমি বলেছ? করেছেন। তোমাদের ও তাঁর মধ্যকার লড়াই কূপের বালতির মত। কখনো তোমরা তাঁর উপর জয়ী হয়েছ, আবার কখনো তিনি তোমাদের উপর জয়ী হয়েছেন। এভাবেই রাসূলগণ পরীক্ষিত হন এবং পরিণাম তাদেরই অনুকূল হয়। আমি আরো জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি তোমাদের কি কি বিষয়ে আদেশ করে থাকেন? তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের আদেশ করেন যেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কিছুই শরীক না কর। আর তিনি তোমাদের পিতৃপুরুষেরা যে সবের ইবাদত করত তা থেকে নিষেধ করেন আর তোমাদের নির্দেশ দেন, সালাত আদায় করতে, সাদকা দিতে, পূত পবিত্র থাকতে, চুক্তি পালন করতে, আমানত আদায় করতে। এসব নবীগণের গুণাবলী। আমি জানতাম, তাঁর আগমন ঘটবে। কিন্তু তিনি তোমাদের মধ্যে আগমন করবেন, সে ধারণা আমার ছিল না। তুমি যা যা বললে, তা যদি সত্য হয়, তবে অচিরেই তিনি আমার এই পায়ের নীচের জায়গার মালিক হয়ে যাবেন। আমি যদি আশা করতে পারতাম যে, তাঁর কাছে পৌছতে পারব, তবে কষ্ট করে তাঁর সাক্ষাতের চেষ্টা করতাম। যদি আমি তাঁর নিকট থাকতাম, তবে তাঁর পদযুগল ধুইয়ে দিতাম। আবু সুফিয়ান রা. বলেন, তারপর তিনি তাঁর পত্রখানি চেয়ে নিলেন। তা পাঠ করে শুনানো হল। তাঁতে ছিল:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি……..যারা হিদায়াতের অনুসরণ করে তাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক। আম আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। আপনি ইসলাম গ্রহণ করলে আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিফল দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে রোমের সমস্ত প্রজার পাপ আপনার উপর বর্তাবে। হে কিতাবীগণ ! এস এমন একটি কথার দিকে যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, যেন আমরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে রব হিসাবে গ্রহণ না করে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বল: তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম। আবু সুফিয়ান রা. বলেন, তার কথা শেষ হলে তার পার্শ্বের রোমের পদস্থ ব্যক্তিরা চিৎকার করতে লাগল এবং হৈ চৈ করতে লাগল। তারা কি বলছিল তা আমি বুঝতে পারিনি এবং নির্দেশক্রমে আমাদের বের করে দেয়া হল। আমি সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে এসে তাদের সাথে একান্তে মিলিত হয়ে, তাদের বললাম, নিশ্চয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে তো বিরাট আকার ধারণ করেছে। এই যে রোমের বাদশাহ তাকে ভয় করছে। আবু সুফিয়ান রা. বললেন, আল্লাহর কসম! এরপর থেকে আমি অপমানবোধ করতে লাগলাম এবং এ ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল যে, মুহাম্মদের দাওয়াত অচিরেই বিজয় লাভ করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তরে ইসলাম প্রবেশ করিয়ে দিলেন, অথচ তখনও আমি তা অপছন্দ করছিলাম।