বিষাণগড়ের সোনা – ৫

৫ 

পাঠক-পাঠিকারা বোধহয় বুঝতে পেরেছেন যে, মাঝে-মাঝেই যেমন আমি এই সময়কার কথা তাঁদের বলব, তেমন আবার মাঝে-মাঝেই ফিরে যাব সেই ১৯৪৬ সালের কথায়। যেতেই হবে। কেন না, এই সময়ের সঙ্গে যেমন আমার স্বপ্নের একটা স্পষ্ট যোগসম্পর্ক রয়েছে, ঠিক তেমনই এখন যা ঘটছে আর তখন যা ঘটেছিল, তার মধ্যেও একটা যোগসূত্র হয়তো থাকতে পারে। সত্যিই আছে কি না, আমার পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। ভাদুড়িমশাই থাকলে হয়তো বলতে পারতেন, কিন্তু শ্যামনিবাসের হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের পরে সেই যে তিনি কলকাতা ছেড়েছেন, তারপরে যদিও বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, ইতিমধ্যে তিনি আর কলকাতায় আসেননি। দিন কয়েক আগে কৌশিককে ফোন করেছিলুম, সে বলল, মামাবাবু এখন কী একটা কিডন্যাপিংয়ের কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত, খুব শিগগির তাঁর আর কলকাতা আসবার আশা নেই। 

এখন নভেম্বর মাস। গতমাসে বাসন্তী আর পারুল পুরী থেকে বেড়িয়ে এল। আমার যাওয়া হল না। বাসন্তী অনেক করে বলেছিল, কিন্তু কাজের তখন এমন চাপ যে, কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারিনি। পরে ওদের কাছে গল্প শুনে মনে হল যে, দূর ছাই, কাজকর্ম শিকেয় তুলে রেখে আমিও ওদের সঙ্গে চলে গেলেই পারতুম। শুধু যে পুরীতেই ওরা ছিল, তা নয়। ওরই মধ্যে ভুবনেশ্বর, কোনারক আর চিল্কা থেকেও ঘুরে এসেছে। পুরীতেও ওরা আনন্দ নেহাত কম করেনি। সবচেয়ে বড় আনন্দ ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি করা। তোসালি স্যান্ডস্ তো পুরীর খুব কাছেই। সেখানেও একদিন গিয়েছিল। পারুলের গল্প তো শেষই হতে চায় না। “জানো বাবা, তোমার যখন পাঁচ বছর বয়েস, আর বড়পিসির বয়েস সাত, তখন তোমরা দাদু আর দিদার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্দুরের ধারে যে বাড়িটায় ছিলে, সেটাও এবারে দেখে এলুম।” 

“বলিস কী, বাড়িটার নাম কী বল তো?” 

“সিন্ধু-বেলা। তোমার কাছে কত গল্প শুনেছি তো, নামটা ভুলে যাইনি। তা ঠিক করেছিলুম যে, এবারে পুরী গিয়েই বাড়িটা খুঁজে বার করব।” 

“এখন যারা থাকে, তাদের সঙ্গে আলাপ হল?” 

“না, বাবা। আসলে কেউই ছিল না যে। থাকবেই বা কী করে, বাড়িটার যা অবস্থা হয়েছে না, দেখলে দুঃখ হয়। জানলা-দরজার পাল্লা নেই, মেঝের উপরে এক-হাঁটু বালি। তোমার কাছে শুনেছি যে, বাড়ির সামনে সুন্দর একটা বাগন ছিল, তাতে অনেক ফুলগাছ ছিল। সে-সব কিছু এখন নেই, কম্পাউন্ড-ভর্তি শুধু ফণীমনসার ঝাড়। গেটের পিলার থেকে নামের ট্যাবলেটটা কিন্তু খসে পড়েনি। ওই ট্যাবলেট দেখেই তো বাড়িটা চিনলুম।” 

‘সিন্ধু-বেলা’র সঙ্গে বত যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। শুধু ওই বাড়িটা কেন, গোটা পুরী জুড়েই ছড়িয়ে আছে আমার ছেলেবেলার স্মৃতি। অথচ বাসন্তী আর পারুল সেখানে গেল, শুধু আমারই যাওয়া হল না। একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম, পারুলের কথায় চটকা ভেঙে গেল। 

“কী অত ভাবছ, বাবা?” 

“কিচ্ছু না, তোর মা’কে বল্, এবারে আমি চান করতে যাব।” 

“আজ এত তাড়াতাড়ি?” 

বললুম, “ইলেকশন এসে পড়ল না? অফিসে তাই কাজ বেড়েছে। একটু তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে।” 

স্নান করে, খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম। 

অফিসে গিয়ে প্রথমেই যা করি, ফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে পি. বি. এক্স.-এর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলুম, “কেউ ফোন করেছিল?” 

“দুজন ফোন করেছিলেন। একজন পার্ক সার্কাস থেকে আর একজন বালিগঞ্জ থেকে।” 

“কিছু বললেন?” 

“পার্ক সার্কাস থেকে যিনি ফোন করেছিলেন, আপনি নেই শুনে তিনি বললেন যে, ঘণ্টাখানেক বাদে আবার ফোন করবেন।” 

“নাম জিজ্ঞেস করেছিলে?” 

“করেছিলুম। বললেন না।” 

বিরক্তিকর ব্যাপার। যাঁরা ফোন করেন, নাম জানাতে তাঁদের এত আপত্তি কেন, বুঝি না। বিরক্তি গোপন করে জিজ্ঞেস করলুম, “আর যিনি বালিগঞ্জ থেকে ফোন করেছিলেন?” 

“তাঁর নাম আমি লিখে রেখেছি। কৌশিক সান্যাল। বললেন যে, এখন ঘণ্টা দুয়েক তিনি বাড়িতেই থাকবেন। অফিসে এসে আপনি যদি তাঁকে ফোন করেন তো খুব ভাল হয়। কী নাকি একটা মেসেজ আপনাকে দেবার আছে।” 

পকেট থেকে নোটবই বার করে কৌশিকের টেলিফোন নম্বরটা দেখে নিলুম, তারপর পি.বি.এক্স.কে বললুম নম্বরটা ডেকে দিতে। 

মিনিট পাঁচেক বাদেই টেলিফোন বেজে উঠল। 

“হ্যালো…” 

লাইনের ওদিকে কৌশিকের গলা পেয়ে বললুম, “কী ব্যাপার? ফোন করেছিলে কেন? “

“আপনাকে একটা খবর দেবার ছিল।” 

“কী খবর?” 

“মামাবাবুর খবর।” 

“ভাল খবর তো?” 

“সেটা নিজে এসেই দেখে যান।” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কী,” উৎফুল্ল গলায় কৌশিক বলল, “মামাবাবু এখন কলকাতায়। বাঙ্গালোর থেকে কী একটা কাজে দিল্লি গিয়েছিলেন। কাল রাত্তিরের ফ্লাইটে সেখান থেকে কলকাতায় এসেছেন।” 

“কয়েকটা দিন থাকবেন তো?” 

“না। থাকার নাকি উপায় নেই। কাল বিকেলের ফ্লাইটে মাদ্রাজ যাচ্ছেন। সেখান থেকে রাত্তিরের ট্রেন ধরে পরশু ভোরবেলায় বাঙ্গালোর পৌঁছবেন। বললেন, না-ফিরলেই নয়।” 

“তা হলে?” 

“তা হলে আর কী, বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে আসুন।” 

“ফোনটা একবার ভাদুড়িমশাইকে দাও তো।” 

“মামাবাবু একটু কাজে বেরিয়েছেন।” কৌশিক বলল, “তবে তিনটের মধ্যেই ফিরবেন। আমাকে বিশেষ করে বলে গিয়েছেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আপনি আসবেন কিন্তু কিরণমামা।”

বললুম, যাব। তারপর ফোন নামিয়ে রেখে লেখার প্যাডটা টেনে নিলুম। বিরোধী মোর্চা নিয়ে হাজার দেড়েক শব্দের মধ্যে একটা লেখা তৈরি করে দেবার কথা, কালকের এডিট পেজে বেরুবে। লাইব্রেরি থেকে দরকারি ক্লিপিংগুলো আনিয়ে রেখেছি। লেখাটা চারটের মধ্যেই শেষ করা দরকার। নয়তো রাস্তায় বেরিয়ে ট্রাফিক-জ্যামে আটকে যেতে পারি, তা হলে আর সন্ধের আগে কৌশিকের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতে পারব না। 

কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাটে লিখব, তার উপায় কী। সবে প্রথম প্যারাগ্রাফটা শেষ করেছি, টেলিফোন বেজে উঠল। পি.বি.এক্স-এর মেয়েটি বলল, “পার্ক সার্কাস থেকে সেই ভদ্রমহিলা আবার ফোন করেছেন। দেব?” 

‘ভদ্রমহিলা’ শুনে একটু অবাক লাগল। পরক্ষণে বললুম, “দাও।” 

গলা শুনে বয়স মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। টেলিফোন যাঁর গলা ভেসে এল, তাঁর বয়স সম্ভবত তিরিশের বেশি হবে না। 

“আমি কি মিঃ কিরণ চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা বলছি?” 

“হ্যাঁ।” 

“আমি দিল্লিতে থাকি। এখানে জিয়োলজির উপরে একটা অল-ইন্ডিয়া সেমিনার হচ্ছে, জানেন নিশ্চয়?” 

“জানি… মানে কাগজে যা বার হচ্ছে, সেইটুকুই জানি, তার বেশি কিছু জানি না।” 

“তাতে আমার একটা পেপার পড়বার ছিল। আসলে সেই জন্যেই আমি কলকাতায় এসেছিলুম। কালই আবার দিল্লি ফিরে যাব। কিন্তু তার আগে আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।” 

“কী নাম আপনার?”

“সরস্বতী ভট্টাচার্য। আমাকে আপনি চিনবেন না…” 

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি কি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ান?” 

“তা পড়াই, কিন্তু তাতে কী হল?” 

“মাইসোরের কোলারে যেমন আছে, তেমনি মধ্যপ্রদেশেও যে সোনার খনি থাকা সম্ভব, এমনকি সেখানকার গোল্ড ডিপজিট যে কোলারের চেয়ে অনেক বেশি হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়, আপনার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কি বছর দুয়েক আগে খুব হইচই হয়েছিল?” 

সরস্বতী হাসলেন। তারপর হালকা গলায় বললেন, “ও, দ্যাট ওঅজ এ মাইনর ম্যাটার… নাথিং টু রাইট হোম অ্যাবাউট। অ্যান্ড, এনিওয়ে, আই ওঅজ প্রুড রং। কিন্তু সে-কথা থাক। আসলে যা বলতে চাইছিলুম… আপনার সঙ্গে এখনও আমার পরিচয় হয়নি, তবে আমার মা’কে হয়তো আপনি চিনবেন।” 

“কী নাম তাঁর?” 

“লক্ষ্মী দেবী। … মনে পড়ছে?”

“লক্ষ্মী… লক্ষ্মী….” নামটাকে কয়েকবার বিড়াবড় করে আওড়ালুম, কিন্তু কিছুই মন পড়ল না। বিভ্রান্ত হয়ে বললুম, “না তো।” 

“সে কী,” সরস্বতী ভট্টাচার্য বললেন, “মা তো বললেন, নাম বললেই আপনি তাঁকে চিনতে পারবেন।” 

আমতা-আমতা করে বললুম, “কোথাও কোনও ভুল হয়নি তো?” 

“তা কী করে হবে? আচ্ছা, আপনি তো গল্পও লেখেন, তাই না?”

“তা লিখি।” 

“তা হলে তো ভুল হবার কথা নয়। কিছুদিন আগে দিল্লির একটা হিন্দি ম্যাগাজিনে আপনার একটা গল্পের তর্জমা বেরিয়েছিল। তাতে লোক পরিচিতিতে বলা হয়েছিল যে, আপনি খবরের কাগজে কাজ করেন। মা তো তাই দেখেই বললেন, এ নিশ্চয়ই আমাদের চাচাজি। আচ্ছা, আপনি কি কখনও বিষাণগড়ে ছিলেন?” 

চাচাজি… বিষাণগড়….লক্ষ্মী! নিমেষে একট’ পর্দা যেন সরে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল পাঁচ-বছরের ফুটফুটে একটা বাচ্চা-মেয়ের মুখ।

বললুম, “তুমি কি….তুমি কি লছমির মেয়ে?” 

“হ্যাঁ,” ওদিক থেকে সহাস্য উত্তর তেসে এল। “গাইড দেখে আপনার বাড়িতেও ফোন করবার চেষ্টা করেছিলুম। লাইন পাইনি। ভাগ্যিস সেই হিন্দি কাগজটায় যেখানে আপনি কাজ করেন সেই কাগজের ক্রমটাও দেওয়া হয়েছিল। তাই বাড়ির লাইন না পেয়ে কাগজের লাইনটা ধরতে চেষ্টা করলুম। কিন্তু লাইন যদি বা পেলুম, আপনাকে পাওয়া গেল না।” 

“তখনও আমি অফিসে এসে পৌঁছুইনি যে!”

“এখন কতক্ষণ থাকবেন?”

“চারটে পর্যন্ত।” 

“ঠিক আছে, তার মধ্যেই আমি যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে একবার দেখা হওয়াটা খুব দরকার।” ভেবে দেখলুম, এর মধ্যে যদি সরস্বতী আসে, লেখাটা তা হলে শেষ করতে পারব না। বললুম, “তোমাকে আসতে হবে না। বিকেলটা তুমি কি ফ্রি আছ?” 

“তা আছি।” 

“তা হলে এক কাজ করো, তোমার ঠিকানাটা আমায় দাও। সাড়ে চারটে নাগাদ সেখান থেকে তোমাকে তুলে নিয়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে যাব। তারপর আবার আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই তোমাকে পৌঁছে দেব তোমার ঠিকানায়।”

সরস্বতীর ঠিকানাটা জেনে নিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলুম। 

কিন্তু তক্ষুনি যে আবার লেখায় মন দিতে পারলুম, তা নয়। প্রায়ই আজকাল সেই স্বপ্নটা দেখি। কালও দেখেছি। ছেচল্লিশ সালের ভয়ঙ্কর একটা রাত্রির স্মৃতি এই যে এত বছর বাদে আবার হঠাৎ আমার ঘুমের মধ্যে এসে হানা দিতে শুরু করেছে, কিছুতেই সে যেন আর বিদায় নিতে চাইছে না। দিনের বেলাতেও নিষ্কৃতি নেই। রাত্তিরে যেমন স্বপ্ন দেখি, দিনেও তেমন নানান কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে বিষাণগড়ের কথা মনে পড়ে যায়। রানি-মা, কুলদীপ সিং, পামেলা, গঙ্গাধর মিশ্র, শিউশরণ ত্রিপাঠী, ডিকি উইলসন, ডক্টর সিদ্দিকি, নারায়ণ ভার্মা, রূপেন্দ্র সিং, ত্রিবিক্রম কাপুর, ববি—কত মানুষ, কত রকমের চরিত্র, কত স্বার্থের টানাপোড়েন! একের পর এক মুখগুলি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে এমন আরও অনেকের কথা, যাদের মুখের আদল আমার স্মৃতিতে ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছিল। 

সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে গঙ্গাধর মিশ্রের নাতনি লছমিকে। 

মিশ্রজি ছিলেন বিষাণগড়ের রাজপুরোহিত। রাজবাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে বাইরের লোক নেহাত কম থাকত না। প্যালেসের কেয়ারটেকার হিসেবে যেমন আমি সেখানে আশ্রয় পেয়েছিলুম, তেমনি গার্ডেনার, বাজার-সরকার আর গভর্নেস থেকে শুরু করে একগাদা দাসদাসী ছিল সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। থাকত গোয়ানিজ কুক ড্যানিয়েল আর পৈতেধারী ব্রাহ্মণ পাচক জনার্দন বাজপেয়ী। ধোবি, সহিস, ড্রাইভার, দরোয়ান আর পাইক-পেয়াদাও কম ছিল না। ছিলেন মিশ্রজিও। রাজবাড়ির পশ্চিম-দিকে, কম্পাউন্ডের উঁচু পাঁচিলের পাশে, যে ছোট্ট বাড়িটার দোতলায় দু’খানা ঘর আমি আমার কোয়ার্টার্স হিসেবে পেয়েছিলুম, মিশ্রজি তাঁর স্ত্রী, পুত্রবধূ আর নাতনিকে নিয়ে তারই একতলায় থাকতেন। 

আমাকে যখন প্রথম দেখেন, মিশ্রজি যে তখন একটু চমকে উঠেছিলেন, আজও তা আমি ভুলিনি। চমকে উঠবার কারণ ছিল। কিন্তু সেই মানুষটির স্নেহের বন্ধনও ছিঁড়তে হয়েছিল আমাকে। তখন আর আমার কিছু করবার ছিল না। যে লছমিকে প্রায় সারাদিনই আমার কোলে কিংবা পিঠে চড়ে ঘুরতে দেখা যেত, সেও বলেছিল, “যেয়ো না, চাচাজি, যেয়ো না।” কিন্তু তবু একদিন আমাকে বিষাণগড় থেকে চলে আসতে হয়েছিল। 

লছমি তখন নেহাতই ছোট্ট একটা মেয়ে। কিন্তু সে তো বিয়াল্লিশ বছর আগেকার কথা। ছোট্ট সেই মেয়েটার বয়েস তা হলে এখন আটচল্লিশ। তার মেয়ে এখন দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। কী যেন নাম বলল? ও হ্যাঁ, সরস্বতী। লক্ষ্মার মেয়ে সরস্বতী! তাজ্জব ব্যাপার! ঠাকুর দেবতার নামে নাম রাখতে গিয়ে কি এরা তাদের সম্পর্কের কথা ভুলে যায় নাকি? 

হাতের কাজটা যেমন করেই হোক সাড়ে তিনটের মধ্যে চুকিয়ে দেব ভেবেছিলুম। হল না। লেখা শেষ হতে-হতে সওয়া চারটে বেজে গেল। চটপট সেটা প্রেসে পাঠিয়েই বেরিয়ে এলুম অফিস থেকে। ঝাউতলা রোডের যে ঠিকানাটা সরস্বতী দিয়েছিল, সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে পাঁচটা।

যে-বাড়ির ঠিকানা, গাড়ির থেকেই চোখে পড়েছিল যে, তার ঠিক সামনেই একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সরস্বতী ভট্টাচার্য বলে এই বাড়িতে কেউ থাকে কি না, জিজ্ঞেস করতে মেয়েটি বলল, “আমিই সরস্বতী। আপনি নিশ্চয় মিঃ চ্যাটার্জি, তাই না!”

“হ্যাঁ।” 

“একটু নামবেন না? এটা সুমঙ্গলের… আই মিন আমার স্বামীর দাদার বাড়ি। উপরে এসে এক কাপ চা যদি খান, সবাই খুব খুশি হবেন। আমার স্বামী অবশ্য আসেননি, হি ইজ ইন দিল্লি, তবে আর সবাই তো আছেন, একটু বসবেন না?” 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললুম, “ও-সব আর একদিন হবে, এখন উঠে পড়ো তো, উই আর অলরেডি লেট।” 

দরজা খুলে দিতেই সরস্বতী গাড়িতে উঠে পড়ল। বলল, “যাচ্ছেন তো আপনার বন্ধুর বাড়িতে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনাদের কথা বলতে কোনও অসুবিধে হবে না তো?” 

বললুম, “একটুও না। আসলে যাঁর কাছে যাচ্ছি, তোমার মা’কে আর তোমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমাকে তিনিও খুব ভালই চিনতেন। তাঁর কাঁধেও তো লছমি কিছু কম চাপেনি। কেন, ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শোনোনি তোমার মায়ের কাছে?” 

“আমরা কি… আমরা কি মিঃ চারুচন্দ্র ভাদুড়ির কাছে যাচ্ছি?” 

বললুম, “হ্যাঁ।” 

সরস্বতী হাসল। বলল, “ভালই হল। ওঁর সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি। তবে আপনাকে যা জানাতে চেয়েছিলুম, সেটা ওঁকেও জানানো দরকার।” 

সরস্বতীর বয়স মনে হল তিরিশের নীচেই। লছমির গায়ের রং ছিল দুধে-আলতায়, সরস্বতী সেটা পায়নি। শ্যামলা রং, গড়ন ছিপছিপে, চোখ দুটি টানা-টানা। শুধু ওই চোখের মধ্যেই লছমিকে যেন খানিকটা খুঁজে পাওয়া যায়। তাও মায়ের চোখের নীলচে রংটা পায়নি। বাদবাকি কোথাও কিছু মিল নেই। এমনকি চুলেও না। লছমির চুল ছিল কোঁকড়া। সরস্বতীর চুল একেবারে সিধে, সেখানে একটা ভাঁজ পর্যন্ত চোখে পড়ল না। মুখখানা অসম্ভব ধারালো; দেখলেই বোঝা যায় যে, এ মেয়ে খুব সাধারণ নয়, আর-পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু অন্য রকমের। 

যতীন বাগচি রোডে যাব। গড়িয়াহাট-রাসবিহারীর মোড় থেকে ডাইনে বেঁকে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে গেলে সুবিধে হত, কিন্তু তাতে জ্যামে আটকে যাবার সম্ভাবনা। গুরুসদয় দত্ত রোড ধরে এগিয়ে গিয়ে তাই বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরলুম। এ-রাস্তায় এখনও গাড়ির তত ভিড় হয়নি, সরাসরি দক্ষিণে গিয়ে হাজরা রোড পেরিয়ে দেশপ্রিয় পার্কের পাশ দিয়ে রাসবিহারীতে পড়তে কোনও সমস্যা নেই। তারপর ত্রিকোণ পার্কের দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই যতীন বাগচি রোড। 

গাড়ি আমি আস্তে চালাই। সরস্বতীর সঙ্গে কথা বলতে তাই কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। কথায়-কথায় জানা গেল যে, সরস্বতীর স্বামী সুমঙ্গনও অধ্যাপক। সেও দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। তবে তার বিষয় আলাদা। জিওলজি নয়, জিওগ্রাফি। 

“তোমার মা এখন কোথায় সরস্বতী?” 

“কোথায় আবার, আমার কাছেই।” সরস্বতী ম্লান হাসল। “আপনি বোধহয় জানেন যে, আমার মায়ের বয়েস যখন মাত্র পাঁচ, তখনই তাঁর বাবাকে তিনি হারিয়েছিলেন।”

“জানব না কেন, আমি যেদিন বিষাণগড়ে পৌঁছই, তার মাসখানেক আগে তিনি মারা যান। নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। তোমার মায়ের দাদুর কাছে অন্তত সেই কথাই শুনেছি।” 

“মায়ের দাদু কেমন মানুষ ছিলেন?” 

গঙ্গাধর মিশ্রের চেহারা যেন চকিতে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ পুরুষ। কপালে চন্দনের ফোঁটা, পরনে রেশমি থান, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, বুকের উপরে পৈতে ঝুলছে, হাতে কমন্ডলু, পায়ে খড়ম, –নদীর ঘাটে স্নান সেরে সূর্যবন্দনার মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তিনি ফিরে আসছেন। দোতলার বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম। হঠাৎ উপর দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন তিনি, আর দেখবামাত্র চমকে উঠলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে তিনি একতলায় তাঁর কোয়ার্টার্সের মধ্যে ঢুকে গেলেন। 

তার ঠিক আগের রাত্রে আমি বিষাণগড়ে পৌঁছেছি। একই বাড়িতে থাকতুম বটে, কিন্তু সে রাত্রে আর তাঁর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি। পরদিন সকালে সেই তাঁকে আমি প্রথম দেখলুম। পরে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযোগ হয়। আমি চট্টোপাধ্যায় বংশের সন্তান, অথচ পৈতে ধারণ করি না, এইটে দেখে গঙ্গাধর মিশ্র বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “বেটা, তোমাকে আর কী বলব, দোষ তো তোমার একার নয়, দোষ এই জমানার, এই কল্যুগের।” তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “পুরন্দর আমার একমাত্র ছেলে, সেও যজ্ঞোপবীত পরত না। তা হলে আর অন্যকে কী করে দোষ দেব?” 

পুরন্দরের কথা সেই আমি প্রথম শুনি। এও শুনি যে, তিনি সর্সোতিয়ার জলে ডুবে মারা যান। আরও মর্মান্তিক ব্যাপার, মৃতদেহটা গঙ্গাধর মিশ্রের চোখেই প্রথম পড়ে। যেমন রোজ করেন, তেমন সেদিনও ভোরবেলায় স্নান করতে গিয়ে গঙ্গাধর মিশ্রই নাকি দেখতে পান যে, রাজবাড়ির ঘাটের কাছে আধডোবা একটা পাথরের চাঙড়ে তার ছেলের মৃতদেহ আটকে রয়েছে। মাথাটা একেবারে থ্যাঁতলানো। 

ডাক্তার এলেন। লাশ পরীক্ষা করলেন। তারপর রায় দিলেন, “মনে হচ্ছে এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। সম্ভবত জলে নামবার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে পথরে চোট লেগে মাথা ফেটেছে।” 

রাজবাড়ির ডাক্তার। তাঁর কথার উপরে কে কথা বলবে। আর তাই শেষ-রাত্তিরে পুরুন্দরের হঠাৎ জলে নামবার দরকার হল কেন, এই প্রশ্নটা কাউকে কাউকে একটু বিচলিত করেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কেউ মুখ খোলেনি। 

এ হল জানুয়ারি মাসের ঘটন’। অর্থাৎ আমি গিয়ে বিষাণগড়ে পৌঁছবার এক মাস আগের ব্যাপার। পুরন্দর বিয়ে করেছিলেন। তাঁর বউ আর একটি মেয়ে রয়েছে। প্রথম পরিচয়ের দিনই গঙ্গাধর মিশ্র তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা আমাকে জানান; সব জানিয়ে তারপর বলেন যে, সবচেয়ে মুশকিল হয়েছে তাঁর পাঁচ বছরের নাতনি লছমিকে নিয়ে। “বউমা তাঁর শোক কিছুটা সামলে নিয়েছেন বটে, কিন্তু বাপ মরবার পর থেকেই লছগি একেবারে গুম মেবে গেছে।” হাসিখুশি ছটফটে মেয়ে, সেদিন থেকে সে আর নাকি একটা কথাও কারও সঙ্গে বলছে না। 

“এ পেনি ফর ইয়ার থট্স!” 

গাড়ি চালাতে-চালাতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম। সরস্বতীর কথায় চমক ভাঙল। লজ্জিত গলায় বললুম, “ও হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে?” 

“আমার মায়ের দাদু গঙ্গাধর মিশ্রের কথা বলছিলুম। মানুষটি তিনি কেমন ছিলেন?”

“শুনেছি তো এককালে খুবই তেজি মানুষ ছিলেন। রানি-মা, দেওয়ান, রাজবাড়ির ম্যানেজার, কাউকেই নাকি ছেড়ে কথা বলতেন না। তবে কিনা আমি যখন দেখি, তখন তো তিনি সদ্য তাঁর ছেলেকে হারিয়েছেন, তাঁর অবস্থা তখন ঝড়ে-ভাঙা শালগাছের মতো।” 

সরস্বতী বিষণ্ণ হাসল। বলল, “বড্ড বেশি প্রাচীনপন্থী ছিলেন, না?”

বললুম, “সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে কিনা খুব একটা অসহিষ্ণু ছিলেন বলে অন্তত আমার কখনও মনে হয়নি। আমি তো বলতে গেলে ব্রাহ্মণ বংশের কুলাঙ্গার, আচার-বিচার জাতপাত কিছু মানি না, না করি সন্ধ্যা: আহ্নিক, না পরি পৈতে, তাও আমাকে ভালবাসতেন।” 

“আপনার কথা আলাদা। আপনাকে যে ভালবাসতেন, তার একটা কারণ ছিল। আমার মায়ের কাছে অন্তত সেইরকমই শুনেছি।” 

গুরুসদয় দত্ত রোড থেকে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোৎ ধরে দক্ষিণে চলেছি। পিছন থেকে একটা মিনিবাস ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছিল। স্পিড কমিয়ে, যতটা সম্ভব রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে, জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেটাকে এগিয়ে যেতে বললুম। তারপর আবার স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে, গিয়ার পালটে সরস্বতীকে জিজ্ঞেস করলুম, “মায়ের কাছে কী শুনেছ?” 

“আপনি জানেন না?”

“মনে তো হয় জানি। তবু তোমার মুখ থেকেই শোনা যাক।” 

“আপনাকে দেখতে অনেকটা….”

“গঙ্গাধর মিশ্রের সেই ছেলের মতন, এই তো?” সরস্বতীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললুম, “এটা তার জানব না কেন? অনেককেই তো ও-কথা বলতে শুনেছি। আর তা-ছাড়া পুরন্দর মিশ্র অর্থাৎ লছমির বাবার ফোটোগ্রাফ যে আমি দেখিনি, তাও তো নয়।” 

“দেখে কী মনে হয়েছিল আপনার?” 

“মনে হয়েছিল যেন ওটা আমারই ফোটোগ্রাফ। যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে দেখছি।” 

“তা-ই?” 

“তা-ই। তফাত যে একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়। ছিল। বেশ বড় দুটো তফাত ছিল। তাঁর রং ছিল ফর্সা, আর আমার রং যে কালো, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। তা ছাড়া তাঁর কপালে একটা জড়ুল ছিল, আমার সেটা নেই। দু’জনের হাইটেরও কিছু ফারাক থাকতে পারে। তবে সব-মিলিয়ে মিলটাই ছিল চোখে পড়বার মতো।” 

অস্ফুট গলায় সরস্বতী বলল, “মিলটা আমার মায়ের চোখেও পড়েছিল।” 

বললুম, “চোখে পড়েছিল বললে খুব কমই বলা হয়, সরস্বতী। পাঁচ বছরের মেয়ে, বোধবুদ্ধি হয়নি, লছমি বোধহয় ভেবেছিল যে, তার বাবাই আবার ফিরে এসেছে। নয়তো তার বাবার মৃত্যুর পরে যে-মেয়ে পুরো একটা মাস কারও সঙ্গে কোনও কথাই বলেনি, আমি গিয়ে গঙ্গাধর মিশ্রের কোয়ার্টার্সে ঢুকবামাত্র সে ঘরের এক কোণ থেকে ছুটে এসে ‘বাবুজি’ বলে আমাকে আঁকড়ে ধরবে কেন?” 

“মা যে ভুল করে আপনাকে বাবুজি ভেবেছিলেন, এটা কেউ তাঁকে বলে দেয়নি?” 

“তা কেন বলে দেবে না, আমি বলে দিয়েছিলুম। তক্ষুনি-তক্ষুনি অবশ্য বলিনি, সেটা সম্ভবও ছিল না, তবে প্রথম সুযোগেই তাকে বুঝিয়ে বলেছিলুম যে, আমি বাবুজি নই, বাবুজির ছোট ভাই, তার চাচা। তবে হ্যাঁ, বাবুজি তো বাইরে গেছেন, এখন অনেকদিন আসতে পারবেন না, তাই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাতে লছমিকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াতে পারি, তার সঙ্গে ‘ইক্কড় মিক্কড়’ খেলতে পারি, ‘এক খেলাড়ি আয়া থা, উ এক বান্দর লায়া থা’র ছড়াটা তাকে শোনাতে পারি, আর হ্যাঁ, যাতে কিনা অনেক-অনেক গল্প তাকে বলতে পারি।” 

হাজরা রোড ধরে একটা মিছিল যাচ্ছে। মাডক্স স্কোয়ারের পুব দিক দিয়ে মোড়ের কাছে এসে পড়েছিলুম, সেখানে খানিকক্ষণের জন্যে আটকে যেতে হল। একটা সিগারেট ধরিয়ে সরস্বতীকে বললুম, “কিছু বলছ না যে?” 

‘আমার দাদামশাইয়ের সঙ্গে কিন্তু আরও একটা ফারাক ছিল আপনার। বয়সেও তিনি আপনার চেয়ে বছর-সাতেকের বড় ছিলেন।” 

হেসে বললুম, “জানি। সাত বছরের নয়, ন’বছরের। কিন্তু পুরন্দর মিশ্রের মুখে এক ধরনের সারল্য ছিল। এমন সারল্য, যা শুধু শিশুদের মুখেই দেখা যায়। ফলে বয়েসের তুলনায় তাঁকে ছোট দেখাত। কথাটা অন্যদের মুখে শুনেছিলুম। ফোটো দেখে আমার নিজেরও মনে হয়েছিল যে, কথাটা মিথ্যে নয়।” 

“মানুষটা তিনি কেমন ছিলেন?” 

“পুরন্দর মিশ্রের কথা জিজ্ঞেস করছ?” 

“হ্যাঁ।” 

“তা আমি কী করে বলব? আমি তো তাঁকে দেখিইনি। তবে হ্যাঁ, অন্যদের কাছে তাঁর কথা কিছু-কিছু শুনেছি বটে। যা শুনেছি, তাতে মনে হয়, যেমন চেহারায় তেমন স্বভাবেও তিনি ছিলেন শিশুদেরই মতো। কোনও ঘোরপ্যাচের ধার ধারতেন না। সরল স্বচ্ছ চরিত্রের মানুষ। কারও কাছে তাঁর সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা শুনিনি।” 

সরস্বতী বলল, “কিন্তু মায়ের দাদু যে তাঁর ছেলের উপরে খুব প্রসন্ন ছিলেন না, সেটা জানেন তো?” 

“তাও জানি। গঙ্গাধর মিশ্র নিজেই সে-কথা আমাকে বলেছেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর ছেলে টোলে পড়বে, সংস্কৃত শিখবে, তারপর পুজো-আচ্চার তাবৎ বিধি-ব্যবস্থা বুঝে নিয়ে তাঁরই মতন বিষাণগড়ের রাজ-পুরোহিত হবে। তা ছেলে গেল ম্লেচ্ছ ভাষা ইংরেজি শিখতে। গঙ্গাধর মিশ্র তাই অপ্রসন্ন তো হতেই পারেন।” 

“ছেলে কিন্তু ইংরেজির পাঠও শেষ করলেন না। ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে বি. এ. পড়তে পড়তে হঠাৎ একদিন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে রায়পুর থেকে বিষাণগড়ে ফিরে এলেন। কিন্তু ফিরে এসে তো কিছু একটা করবেন, তা-ই বা করলেন কই। দেওয়ানজি তাঁকে কাঠের ব্যাবসা করতে বলেছিলেন। করেননি। রানি-মা তাঁকে রাজ-এস্টেটে চাকরির অফার দিয়েছিলেন। নেননি।” 

বললুম, “শুনেছি। মনে হয়, মানুষটি খুব সংসারী প্রকৃতির ছিলেন না। 

সরস্বতী হাসল। বলল, “দাদামশাই যখন মারা যান, মা তো তখন নেহাতই শিশু। বয়েস মাত্ৰ পাঁচ বছর। মা তাঁর বিষয়ে খুব-একটা কিছু বলতে পারেননি, পারা সম্ভবও নয়। তবে দিদিমার কাছে অনেক গল্প শুনেছি।” 

“তোমার দিদিমাকে প্রথম-প্রথম আমি ‘ভাবি’ বলতুম। আর তিনি আমাকে ‘ভাইয়া’। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিলেন। একদিন বললেন, তাঁর নিজের কোনও ভাই নেই, তাই আমি যদি তাঁকে ‘দিদি’ বলে ডাকি, তো তিনি খুব খুশি হবেন। সেইদিন থেকেই তাঁকে “দিদি” বলতে শুরু করি। বড় ভালমানুষ ছিলেন। তা তিনি এখন কোথায়?” 

“যেমন মা, তেমন দিদিমাও এখন আমার কাছেই থাকেন?” 

“তোমার বাবা?” 

সরস্বতী আবার হাসল। ম্লান হাসি। বলল, “মায়ের সঙ্গে আর তো কোনও মিল নেই আমার, কিন্তু এইখানেই একটা মস্ত মিল। আমিও একেবারে ছেলেবেলাতেই আমার বাবাকে হারিয়েছি। ঠিক ওই পাঁচ বছর বয়সেই।” 

মিছিল শেষ হয়েছে, সামনের গাড়িগুলি নড়তে শুরু করেছে। আমিও গাড়িতে স্টার্ট দিলুম। হাজরা ক্রস করে দেশপ্রিয় পার্কের পুব দিক দিয়ে রাসবিহারীতে পড়ে টার্ন নিলুম বাঁ দিকে। তারপর ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের কাছে ট্রাম-লাইন পেরিয়ে বললুম, “পুরন্দর মিশ্র সম্পর্কে তোমার দিদিমার কাছে কী শুনেছ?” 

“শুনেছি যে, দাদামশাই বড় খেয়ালি মানুষ ছিলেন। তাঁর স্বভাবটাই ছিল বাউন্ডুলে। অথচ কোনও বদ-খেয়াল যে ছিল, তা নয়। শুনেছি বাড়ি থেকে মাঝে-মাঝে বেরিয়ে যেতেন, আর একবার যেতেন তো পনেরো-কুড়ি দিনের মধ্যে ফিরতেন না।” 

“কোথায় যেতেন?”

“বিশেষ-কোথাও না। স্রেফ পাহাড়ে আর জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। এই নিয়ে দিদিমা কোনও অনুযোগ করলে কী বলতেন জানেন?” 

“কী বলতেন?” 

“বলতেন যে, মানুষের কথা শুনতে-শুনতে এক-এক সময় তাঁর হাঁফ ধরে যায়। তখন জঙ্গল তাঁকে টানতে থাকে, নদী তাঁকে টানতে থাকে, পাহাড় তাঁকে টানতে থাকে। তাই তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। জঙ্গলে গিয়ে গাছপালার কথা শোনেন। নদীর ধারে বসে জলের কথা শোনেন। পাহাড়ে গিয়ে পাথরের কথা শোনেন।” 

“বলো কী! এ তো সংসারী মানুষের কথা নয়, সরস্বতী, এ তো কবিতার মতো শোনাচ্ছে।” 

“অথচ দাদামশাই কখনও এক-লাইনও কবিতা লেখেননি। তাঁর ওই বাউণ্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ানো নিয়ে দিদিমা যখন খুব বেশি রেগে যেতেন, তখন নাকি হেসে বলতেন যে, ঘুরে না বেরিয়ে তার উপায় কী, তাঁর প্রেমিকা নাকি ওই পাহাড়ে কোথাও বন্দী হয়ে আছে, যতক্ষণ না তাকে খুঁজে বার করতে পারছেন, তাকে মুক্তি দিতে পারছেন, ততক্ষণ তাঁর শান্তি নেই।” 

“এসব-কথা তুমি কোথায় শুনলে?” 

সরস্বতী হাসল। বলল, “আমার দিদিমা’র কাছে। দাদামশাই তো খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, তা মজা করবার জন্যে ওই প্রেমিকার কথা বলে মাঝে-মাঝেই তিনি দিদিমাকে খুব রাগিয়ে দিতেন। বলতেন, তাঁর প্রেমিকার মতন সুন্দরী নাকি দেখাই যায় না। একেবারে কাঁচা হলুদের মতন তাঁর গায়ের রং।” 

যতীন বাগচি রোড এসে গিয়েছিল। ডাইনে ঘুরে বিবেকানন্দ পার্কের কাছাকাছি পৌঁছে একটু ফাঁকামতো একটা জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করলুম। তারপর সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে বললুম, “আমরা পৌঁছে গেছি।” 

“নামব?” 

“নামবে তো বটেই, এত অস্বস্তি বোধ করছ কেন? ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে তোমার এখনও আলাপ হয়নি, কিন্তু দেখো, তোমার পরিচয় পেলে তিনি খুব খুশি হবেন। লছমিকে তো তিনিও কিছু কম স্নেহ করতেন না।” 

সরস্বতী গাড়ি থেকে নোে এল। বলল, “চলুন।” 

জানলার কাচ তুলে, গাড়ি লক করে সরস্বতীকে নিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় উঠতে-উঠতে বললুম, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তোমরা তো আসলে ইউ. পি.র লোক, তা হলে এত ভাল বাংলা তুমি শিখলে কোথায়?”

সরস্বতী এবারে ঝরঝর করে হেসে বলল, “বা রে, আমি বাঙালি-বাড়ির বউ না? আমার দাদামশাইরা ইউ. পি.’র লোক ঠিকই, ওদিকে আমার বাবাও দিল্লির লোক, চাকরিও করতেন দিল্লিতে, ফলে আমিও দিল্লিতেই পড়ালেখা করেছি, কিন্তু আমার বিয়ে যে হয়েছে এক বাঙালি ভট্চাজের সঙ্গে, সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? বিয়ের পরে সুমঙ্গলই আমাকে বাংলা শিখিয়েছে। বলুন, আমি যে অবাঙালি, আমার কথা শুনে সেটা বোঝা যায়?” 

বললুম, “খুব খেয়াল করে শুনলে তবেই বোঝা যয়। ‘পড়ালেখা’ না-বলে যদি ‘লেখাপড়া’ বলতে, তা হলে কিন্তু তাও যেত না।” 

দোতলায় উঠে এসে কলিং বেল টিপলুম। 

কৌশিক এসে দরজা খুলে দিল। দেখলুম, ভাদুড়িমশাই আর অরুণ সান্যাল তার একটু পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। মালতীও তার রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল।

ভিতরে ঢুকে বললুম, “সরস্বতী, পরিচয়ের পালাটা আগে চুকিয়ে নেওয়া যাক।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিচ্ছু দরকার নেই। সরস্বতীকে আমরা সবাই চিনি। ও এর আগে দু’বার এই ফ্ল্যাটে এসেছে।” 

৭ 

ভিরিন্ডি থেকে লাইট রেলওয়ের ট্রেন ঠিক দেড়টাতেই ছেড়েছিল। ছোট-মেসোমশাই বলেছিলেন, ওখান থেকে বিষাণগড় খুব দূরে নয়, তবে কিনা লাইট রেলওয়ের ট্রেন তো, ঢিকুস-ঢিকুস করে চলে, পৌঁছতে পৌঁছতে তা প্রায় পাঁচ-ছ ঘণ্টা লেগে যাবে। তা তিনি কিছু বাড়িয়ে বলেননি। এ লাইনের গাড়ি দেখলুম নামেই রেলগাড়ি, আসলে গোরুর গাড়িরও অধম। কোথাও একবার থামে তো নড়তে চায় না, আর যদি-বা নড়ে তো এগোতে চায় না একেবারেই। 

দু’দিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। তারই মধ্যে একটু-আধটু ফাঁকা জায়গা কি দু-চারটে কুঁড়েঘর মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট বাদে বাদে স্টেশনও আসে এক-একটা। দু’চারজন লোক সেখান থেকে ট্রেনে ওঠে, দু’চারজন যাত্রী সেখানে নেমেও যায়। 

যাত্রীদের মধ্যে চোদ্দো-আনাই আদিবাসী। অধিকাংশেরই ঊর্ধ্বাঙ্গ একেবারে অনাবৃত, আর নিম্নাঙ্গেও অনেকেরই নিতান্ত একটি লেংটি ছাড়া আর কিছুই নেই। পুরোপ্রস্ত জামা-কাপড় পরা যাত্রীর সংখ্যা নামমাত্র। তাদের মধ্যে মাকড়ি-পরা, কপালে চন্দনের তিলক আঁকা, পাগড়িওয়ালা জনাকয় মানুষও চোখে পড়ল। দেখেই বোঝা যায় যে, এরা কারবারি লোক। সম্ভবত মারোয়াড়ি। টাকা কামাবার ধান্দায় এই জঙ্গলে এসে ব্যাবসা ফেঁদেছে। 

ভিরিন্ডি থেকেই এই রকমের একজন মানুষকে আমার সঙ্গী হিসেবে পাই। যে-কামরায় উঠেছিলুম, আমার খানিক আগেই তিনি তার একটা বেঞ্চির একধারে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে নিজের জায়গা ছেড়ে আমার পাশে এসে বসলেন। ভদ্রলোকের নাম সুরজপ্রসাদ আগরওয়াল। বয়েস বছর পঞ্চাশেক বিষাণগড়ের মার্কেট রোডে এঁর গয়নার দোকান আছে। তা ছাড়া কাঠের কারবারেও টাকা লাগিয়েছেন, তার সূত্রে মাঝে-মাঝে জঙ্গলে বেরিয়ে পড়তে হয়। একা দু’দিক সামলাতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে গয়নার দোকানের দায়িত্ব পুরোপুরি ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজে শুধুই কাঠের কারবার দেখেন। শাল-সেগুনের জঙ্গল ইজারা নেন, লোক লাগিয়ে গাছ কাটান, মস্ত-মস্ত গাছের গুঁড়ি ওয়াগন আর ট্রাকে বোঝাই হয়ে হরেক শহরে পৌঁছে যায়। তবে লোকাল ডিমান্ডও কিছু আছে তো, সেটা মেটাবার জন্যে বছর কয়েক হল বিষাণগড়ে একটা স-মিল্‌ বসিয়েছেন। কিছু গুঁড়ি সেই মিল-এ যায়। রোদ খেয়ে আর জলে ভিজে গাছের কাঁচা গুঁড়ি সেখানে সিজন্ড হয়। তারপরে সেই গুঁড়ি চেরাই করে বসানো হয় তক্তা আর দরজা-জানলার ফ্রেম। 

আগরওয়ালজির কাছেই জানা গেল যে, যেমন ফার্নিচার তেমন জানলা-দরজার পাল্লা বানাতে হলেও নাকি শালকাঠে বিশেষ সুবিধে হয় না, তার জন্যে সেগুন চাই। 

“শালকাঠ দিয়ে তবে কী হয়?” 

“কেন, দরজা-জানলার পাল্লা না হোক, তার ফ্রেম হয়। বড়লোকের পালঙ্ক না হোক, গরিব লোকের তক্তাপোষ হয়। বয়েল-গাড়ির চাকা হয়। শাল কাঠ আরও অনেক কাজে লাগে।” 

“যেমন?” 

আগরওয়ালজি বুঝে গিয়েছিলেন যে, কাঠের ব্যাপারে আমি বলতে গেলে প্রায় কিছুই জানি না। তাই কৃপার হাসি হেসে বললেন, “বাবুজি, আপনারা আংরেজি পড়েছেন, দো-চারঠো পাশ ভি করেছেন, কিন্তু কিতাবের বাইরে কুছু আপনারা দেখেননি। বাবুজি, ক’টা লোক আর দালান-কোঠা থাকে? বেশির ভাগ লোকই তো থাকে কাঁচা মাটির বাড়িতে। তো তার জন্যেও খুঁটি চাই। আপনাদের বংগাল-মুল্লুকে তো আমি ছিলুম, তখন সেখানে বাঁশের খুঁটির চল্ দেখেছি। তা এদিকে বাঁশঝাড় কোথায়? ঘরের চালটাকে ধরে রাখবার জন্যে এখানে শালের খুঁটির দরকার হয়। সে-সব অবশ্য ভাল জাতের শাল নয়, ওই যাকে এদিকে শলাই বলে, সেই জিনিস আর কি। সেও শালগাছই, তবে খুব ইনিফিরিয়র কোয়ালিটির।” 

নিজের অজ্ঞতাকে খানিকটা অন্তত চাপা দেবার জন্যে বললুম, “এককালে খুব বার্মা-টিকের নাম শুনেছি।” 

আগরওয়ালজি এতক্ষণ মৃদু-মৃদু হাসছিলেন, আমার কথা শুনে এ বারে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। বললেন, “ভুলে যান, বাবুজি, ভুলে যান। যুদ্ধের আগে বার্মা থেকে ও-জিনিস কুছু-কুছু আসত বটে, কিন্তু আমদানি এখন বিলকুল বন্ধ হয়ে গেছে। আর বন্ধ না হলেই বা কী হত? ও-জিনিস কিনত কে? বার্মা-টিক হল সেগুনের রাজা, কিন্তু যা দাম, রাজা-উজির ছাড়া ও- কাঠ ছোঁবার মতন পয়সা কারও নেই। তো বাবুজি, ইন্ডিয়া নাকি এবার স্বাধীন হবে?” 

বললুম, “মনে তো হয়।” 

এ হল ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। বাতাসে তখন স্বাধীনতার দু’চার ঝলক অগ্রিম সৌরভ মাঝে-মাঝে পাওয়া যাচ্ছিল বটে, কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীন। তো দেড়-বছর পরের ব্যাপার, ইন্টেরিম ক্যাবিনেটও তখনও পর্যন্ত গড়া হয়নি। আর দেশীয় রাজ্যগুলির মার্জার তো আরও অনেক পরের ঘটনা। 

সত্যি বলতে কী, পিছনে তাকিয়ে আজ যখন আমি বিষাণগড়ের কথা ভাবি, তখন এই কারণেই সেখানকার কাঠের কারবারি সুরজপ্রসাদ আগরওয়ালকে এজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা মানুষ বলে আমার মনে হয়। দেশ এবারে স্বাধীন হবে, অন্তত তার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, আমার মুখে শুধু এইটুকু শুনেই আগরওয়ালজি সেদিন বলেছিলেন, “তা হলে তো ব বুজি হয়েই গেল, রাজারাও তখন আর বার্মা-টিক ছুঁতে পারবে না। সিপি-টিকও ছুঁতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।” 

শুনে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “একথা বলছেন কেন? স্বাধীন তো হবে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, তাতে নেটিভ স্টেটগুলোর গায়ে তো আঁচড় লাগবার কথা নয়। তা হলে?” 

আগরওয়ালজি আবার এক দফা হেসে বললেন, “ছোড়িয়ে, বাবুজি, ছোড়িয়ে। তামাম দেশ আজাদ হয়ে গেল আর এই নেটিভ স্টেটগুলার রাজা অওর নবাবদা তবু সিংহাসনে আরামসে বসিয়ে রইলেন, তাও কি হয় নাকি? না বাবুজি, তা হয় না। আজাদির লড়াই তখন ইখানেও খুব জোর চলবে। কংগ্রেস তো ইখানেও আছে, তারা ছোড়বে না।” 

বললুম, “আপনার কথা শুনে আমার রণজিৎ সিংয়ের কথা মনে পড়ছে, অবশ্য উলটো দিক দিয়ে।” 

“রণজিৎ সিং কে বাবুজি?” 

“জবরদস্ত এক শিখ রাজা। ম্যাপে তো ইংরেজদের দখল-করা জায়গাগুলো লাল-রঙে দাগিয়ে দেখানো হয়। তা ইংরেজরা যখন এ-দেশে তাদের রাজ্যবিস্তার করছিল, তখন ভারতবর্ষের ম্যাপে একদিন লাল-রঙ-করা জায়গাগুলো দেখে তিনি বলেছিলেন, সং লাল হো জায়েগা। আপনি অবশ্য উলটো দিক থেকে একই কথা বলছেন। আপনার কথা হল, ‘সব নাল একইসঙ্গে খতম হো জায়েগা।’ তাই না? 

আগরওয়ালজি আবার হাসলেন। বললেন, “ঠিক বাত। বিলকুল ঠিক বাত। এই যে সব রাজা দেখছেন, এরা তো সব কাঠের পুলি। ইংরেজ যদি চলে যয় তো পুলিগুলানকে কে বাঁচিয়ে রাখবে? কোই বাঁচাবে না, বাবুজি, কোই বাঁচাবে না।” 

গাড়ির গতি এমনিতেই কম। সেটা আরও কমে যাওয়ায়ঝতে পারছিলুম যে, একটা-কোনও স্টেশন আসছে। আগরওয়ালজি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, “সামনেই ঝিংড়া টিশান। ইখানে নেমে যাব। আজ আর বিষাণগড়ে ফিরছি না, ইখানে একটা জঙ্গলের ইজারা নিয়ে কথা বলবার আছে। কথাবার্তা মিটিয়ে রাতটা ইখানেই কাটাতে হবে, তারপর কাল আবার এই ট্রেনে আমি ফিরব। তো বাবুজি, আপনার কথা তো কিছুই জানা হল না।” 

“কী কথা?” 

“আপনি বিষাণগড়ে যাচ্ছেন কেন? সির্ফ বেড়াতে?” বললুম, “না, না, আমি চাকরি করতে যাচ্ছি।” 

“কিসের চাকরি? এই রেল-কোম্পানির?” 

“না, আমি বিষাণগড়ের রাজ-এস্টেটে কাজ করব। প্যালেসের কেয়ারটেকার।” 

শুনে চোখ গোল হয়ে গেল আগরওয়ালজির। দুই হাতে দুই কানের লতি ছুঁয়ে জিভ কেটে,হাত জোড় করে বললেন, “সিয়ারাম, সিয়ারাম, তবে তো ভারী গলতি হয়ে গেল!”

“কিসের গলতি?” 

“ওই যে রাজাদের সব পুলি বললাম। আরে ছি ছি, খুব খারাপ কাজ করেছি। আমি কাজ-কারবার করি, ই-সব কথা যদি রানি-মা জানতে পারে তো আমার কারবার লাটে উঠবে।” 

“আরে জানতে পারবে কেন?” আগরওয়ালজিকে অভয় দিয়ে বল।ম, “কথা যা হয়েছে, সে তো আপনার আর আমার মধ্যে হয়েছে। নিশ্চিন্ত থাকুন, অন্য কেউ এ-সব কথা জানতে পারবে না।” 

শুনে আগরওয়ালজির মুখে আবার হাসি ফুটল। ট্রেন থেমেছে। তিনি নেমে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বললেন, “আপনার সঙ্গে টর্চ আছে বাবুজি?” 

বললুম, “না।” 

আগরওয়ালজি তাঁর ব্যাগ থেকে একটা টর্চ বার করে বললেন, “এটা রাখুন। এই লাইনের গাড়িতে আলোর ব্যবস্থা নেই। একটু বাদেই অন্ধকার হয়ে যাবে তো, তখন টর্চ না থাকলে অসুবিধায় পড়বেন। না না, ডাকু-উকুর ভয় নেই, ইখানকার লোকজন খুব ভাল। …আচ্ছা, তা হলে চলি বাবুজি। রাম রাম।” 

আগরওয়ালজি নেমে গেলেন। 

ফেব্রুয়ারি মাস। দিন এখনও বিশেষ বড় হয়ে ওঠেনি। সারা দুপুর রোদ্দুরে সব ঝলমল করছিল, কিন্তু বিকেল না হতেই সূর্য ক্রমে নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল, আর তার খানিক বাদেই সন্ধেটাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল অন্ধকার। জঙ্গলের উঁচু-উঁচু গাছপালার আড়ালে অস্তাভ সূর্য যে কখন কীভাবে গা-ঢাকা দিয়ে হারিয়ে গেল, তার টেরও পাওয়া গেল না। শীত করছিল। তাই টর্চ জ্বেলে সুটকেস থেকে আলোয়ানটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলুম। ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢেলে নিলুম খানিকটা। কিন্তু মুখে দিয়েই বুঝলুম যে, ফ্লাস্কটা সুবিধের নয়, চা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিছু করবারও নেই। অগত্যা চুপচাপ বসে-বসে দেখতে লাগলুম যে, কামরার মধ্যে গোটাকয়েক জোনাকি ওড়াউড়ি করছে। তা ছাড়া, যেমন ভিতরে, তেমন বাইরেও একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। 

ছোট-মেসোমশাই বলেছিলেন, ভিরিন্ডি থেকে বিষাণগড়ে পৌঁছতে পাঁচ-ছ ঘণ্টা লাগবে। আসলে আরও একঘণ্টা বেশি লাগল। ভিরিণ্ডি থেকে দেড়টায় ট্রেন ছেড়েছিল। সেই ট্রেন যখন বিষাণগড়ে পৌঁছল, রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে। 

নতুন জায়গামাত্রেরই কিছু না কিছু রহস্য থাকে। তার ওপরে যদি রাত্তিরে সেখানে পৌঁছই, তা হলে তার রহস্য যেন আরও হাজারগুণ বেড়ে যায়। ছোট্ট স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম মাত্র একটাই, তাও খুব নিচু, রেলের লাইন থেকে তার উচ্চতা বোধহয় এক ফুটের বেশি হবে না। আলো অবশ্য এখানে কিঞ্চিৎ বেশি। তার কারণ, একে তো এটাই এই লাইনের টার্মিনাস স্টেশন, তার উপরে আবার বিষাণগড় স্টেটের এটাই রাজধানী। রাজ্য আর রাজধানীর একই নাম। 

অনেকক্ষণ তো অন্ধকারে ছিলুম, তাই আলোর রাজ্যে পৌঁছে প্রথমে চোখ একটু ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। প্ল্যাটফর্মের উপরে পরপর কয়েকটা ব্যতিস্তম্ভ। তার কাচের ঘেরাটোপের মধ্যে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে। জিনিসপত্র বলতে আমার নেহাতই একটা সুটকেস, একটা শতরঞ্জি, একটা হাওয়া-বালিশ আর সদ্য পাওয়া সেই টর্চ। সেগুলি গুছিয়ে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছিলুম, তারপর ধীরেসুস্থে বাইরে বেরোবার গেটের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় একটা বাতিস্তম্ভর তলা থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিশ্চয় চ্যাটার্জি-বাবু!”

“হ্যাঁ। আপনি?” 

“আমার নাম নারায়ণ ভার্মা, আমি রাজবাড়ির মুনিম, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।” বলে পাশের লোকটিকে মুনিমজি একটা ধমক লাগিয়ে বললেন, “হা রে বুধন, উজবুকের মতন দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাবুজির হাত থেকে সামানগুলো নিম্ন গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গলার স্বর তিন পর্দা নামিয়ে বললেন, “গাড়ি নিয়ে এসেছি। চলুন… বাইরে গিয়ে উঠে পড়া যাক।” 

গাড়ি মানে মোটরকার নয়, টাঙ্গা। স্টেশনের চত্বর থেকে বেরিয়ে মিনিট দশ-বারো এ-রাস্তা সে-রাস্তা ঘুরে তারপর টাঙ্গা একটা নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছল। মুনিমজি বললেন, “নদীর ধার বরাবর এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এটাই প্যালেস রোড। এই রাস্তা ধরে সিধে যদি উত্তর দিকে হেঁটে যান, তা হলেই রাজবাড়িতে পৌঁছে যাবেন।” 

এতক্ষণ যে-সব রাস্তা দিয়ে এসেছি, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, জায়গাটা পাহাড়িয়া। সে-রকম চড়াই-উতরাই নেই ঠিকই, তবে কিনা একেবারে সমতলও নয়; জমি যে ঢেউ-খেলানো, গাড়ির মধ্যে বসেই তা আমি আন্দাজ করতে পারছিলুম। রাস্তায় কিছু-কিছু বাড়িঘরও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। অধিকাংশই খাপড়ার চালের বাড়ি। তার মধ্যে বেশির ভাগই অন্ধকার। রাস্তায় অনেক দূরে-দূরে ল্যাম্পপোস্ট, তাতে ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে বটে, কিন্তু এত কম পাওয়ারের বাল্ব যে, পথের অন্ধকার তাতে বিশেষ কাটছে না। 

প্যালেস রোডে এসে কিন্তু দেখলুম যে, ছবিটা একেবারে পালটে গেছে। এতক্ষণ আমরা নদীর পশ্চিম পারে ছিলুম, এখন ব্রিজ পেরিয়ে পুব পারে চলে এসেছি। আলোর জেল্লা এখানে অনেক বেশি। রাস্তাটাও এখানে এবড়ো-খেবড়ো নয়, একেবারে মসৃণ। রাস্তার একদিকে নদী, সে-দিকে কোনও বাড়িঘর দেখলুম না, অন্যদিকে কম্পাউন্ডওয়ালা চমৎকার সব বাড়ি। এটাই মনে হল শহরের শৌখিন এলাকা। মুনিমজিকে সে-কথা বলতে তিনি হাসলেন। তারপর বললেন, “রাস্তার ডানদিকে এই যে সব বাড়ি দেখছেন, এর বেশির ভাগই সরকারি বাংলো। রাজ-এস্টেটের নোকরির তো অনেক ধাপ আছে, তো কার ধাপ কত উঁচু, আর দরবারে কার কীরকম পজিশন, সেইটে বুঝে এ-সব বাংলো অ্যালট করা হয়।” 

“কে অ্যালট করেন?” 

“অ্যাদ্দিন তো ত্রিপাঠীজি অ্যালট করতেন, তিনি রিটায়ার করেছেন, এখন থেকে তাই আপনাকেই অ্যালট করতে হবে। এটা কেয়ারটেকারের বাড়তি কাজ। তা কাজটা তো আপনি খাতায়-কলমে করবেন, ডিসিশন তো আর আপনাকে নিতে হচ্ছে না। উপরে কলকাঠি নড়বে, নীচে হুকুম আসবে, আপনি সেই হুকুম তামিল করবেন, বাস্, মিটে গেল!” 

“অর্থাৎ উপরতলায় যে যত ধরাধরি করতে পারবে, তার তত ভাল বাংলো, কেমন?” 

মুনিমজি সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন, তাই কথাটার কোনও জবাব দিলেন না। তা ছাড়া, রাজবাড়ির ফটকে ইতিমধ্যে পৌঁছেও গিয়েছিলুম আমরা। ফটকের সামনে টাঙ্গা থামাতে পাহারাদার এগিয়ে এসে আমাদের নজর করে দেখল। মুনিমজিকে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে। মুনিমজি বললেন, “প্যালেসের কেয়ারটেকার, আজই এসেছেন, আউটহাউসের দোতলায় এঁরই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে।” 

ফটক খুলে দেওয়া হল। টাঙ্গা গিয়ে ভিতরে ঢুকল। বেশ রাত্তির হয়ে গিয়েছিল, তাই রাজবাড়ির চৌহদ্দি যে ঠিক কতটা, সেই সঙ্গে প্যালেসটাই বা কেমন ধাঁচের আর কতখানি ছড়ানো, সেটার কোনও স্পষ্ট ধারণা হল না। 

আউটহাউসের দোতলায় উঠে আমার কোয়ার্টার্স দেখে যে দারুণ খুশি হয়েছিলুম, এইটে এখনও স্পষ্ট মনে আছে। চমৎকার ফ্ল্যাট। পুরোপুরি ফার্নিশড। দুটো ঘর। একটা শোবার, একটা বসবার। শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুম। কিন্তু কিচেন নেই। মুনিমজিকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন, “কিচেনের কোনও দরকার তো আপনার হচ্ছে না। সকালবেলার বেড-টি থেকে শুরু করে রাতের খাবার, সবই তো রাজবাড়ির কিচেন থেকে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া হবে।” 

রানি-মা’র সঙ্গে দেখা করবার দরকার আছে কি না, তাও জিজ্ঞেস করেছিলুম। মুনিমজি বললেন, “কী করে দেখা করবেন? রানি-মা তো এখন পঞ্জাবে। হপ্তাখানেক বাদে ফিরবেন। তখন যদি আপনাকে ডেকে পাঠান, তো দেখা হবে। নিজের থেকে আপনি দেখা করতে যাবেন না, তার নিয়ম নেই।” 

“আমার কাজটা তা হলে কার কাছে বুঝে নেব?” 

“ত্রিপাঠীজি এসে কাল আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। আপনার আগে তিনিই ছিলেন এখানকার কেয়ারটেকার। জানুয়ারি মাসের শেষে তাঁর ছুট্টি হয়ে গেল। ইউ. পি.’র লোক, সেখানে ফিরে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু কাউকে দায়িত্বটা বুঝিয়ে না দিয়ে ফিরবেন কী করে? তাই দিন কয়েকের জন্যে রয়ে গেলেন।” 

“তার মানে তো তিনিই এই কোয়ার্টার্সে থাকতেন। এখন তা হলে আছেন কোথায়?” 

মুনিমজি হেসে বললেন, “এখানে তিনি কোনও দিনই থাকেননি। সির্ফ ওই কিচেনের জন্যেই থাকেননি। গোঁড়া বামুন তো, রাজবাড়ির কিচেনের খাবার তাই মরে গেলেও খানে না। বলতেন, ওখানে পঞ্চাশ জাতের ছোঁয়াছুঁয়ি, ওখানকার জল খেলেও তাঁর জাত যাবে। এদিকে এই কোয়ার্টার্সে তো কিচেন নেই, তা হলে রান্না করবেন কোথায়। বাধ্য হয়ে তাঁর জন্যে তাই আলাদা বাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।” 

“সে-বাড়ি কোথায়?” 

“প্যালেসের বাইরে। সেখান থেকে সকাল-সকাল দৃটি খেয়ে এখানে চলে আসতেন। তারপর সারা দিন এখানে কাজকর্ম করে আবার রাত্তিরে সেখানে ফিরে যেতেন। কিন্তু ওই যে বললুম, যতক্ষণ এখানে থাকতেন, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খেতেন না।” 

“এই কোয়ার্টার্সে অ্যাদ্দিন তা হলে কে থাকত?” 

“কেউ থাকত না। আপনি না আসা পর্যন্ত এটা খালি পড়ে ছিল।” মুনিমজি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আর নয়, অনেক রাত হল, এবারে চলি। যাবার আগে রাজবাড়ির কিচেনে বলে দিয়ে যাচ্ছি, আপনার রাতের খাবারটা ওরা এখানে পৌঁছে দেবে।” 

বললুম, “বড্ড ক্লান্ত বোধ করছি, রাতে আর কিছু খাব না। কাল থেকেই জার্নির ধকল চলছে তো, শরীর আর টানছে না, এবারে শুয়ে পড়ব।” 

“একেবারে লঙ্ঘন দেবেন? সেটা কি ঠিক হবে? বলেন তো হাল্কা কিছু খাবার, এই ধরুন ফল আর মিষ্টি পাঠিয়ে দিতে বলি।” 

“কিচ্ছু দরকার নেই,” হেসে বললুম, “আপনি অত উতলা হবেন না তো। ঘুম দিলেই শরীরটা একেবারে ঝরঝরে হয়ে যাবে।” 

“কিন্তু বেড-টি খান তো? সেটা কাল সকালে কখন দিয়ে যেতে বলব?” 

“ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে দিলেই চলবে।” 

“ঠিক আছে, সকাল ছ’টাতেই দিয়ে যাবে।” 

মুনিমজি চলে গেলেন। সিঁড়িতে তাঁর জুতোর শব্দ ক্রমে মিলিয়ে এল। বাথরুমের ভিতরটা তখনও দেখা হয়নি। জল আছে কি না জিজ্ঞেস করায় মুনিমজি বলেছিলেন, কিছু অসুবিধে নেই, চব্বিশ ঘণ্টাই জল পাওয়া যাবে। ভাবলুম, এত রাতে স্নান করাটা ঠিক হবে না, ভাল করে মুখহাত ধুয়ে এবারে টান হওয়াই ভাল। 

বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়েও কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। প্রথমে মনে হয়েছিল চোখের ভুল, কিন্তু তারপরেই বুঝলুম যে, তা নয়, ভিতরের দিক থেকে বাথরুমের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। 

জীবনে কখনও বন্দুক নিয়ে নাড়াচাড়া করিনি, কিন্তু দরজার আড়াল থেকে প্রথমেই যেটা বেরিয়ে এল, সেটা যে একটা বন্দুকের নল ছাড়া আর কিছুই নয়, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না। 

যার বন্দুক, সেও পরক্ষণে বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। সতেরো আঠারো বছর বয়সের একটি ছেলে। নতুন তামার-পয়সার মতো গায়ে। রঙ, থুতনির একটু উপরে বাঁ-গালে একটা কাটা দাগ, চোখ দুটি বড়-বড়, কিন্তু একটু রাগী ও অস্থির। মুখের গড়ন লম্বাটে, ধারালো। পরনে যোধপুরী ব্রিচেস আর বুক-খোলা শার্ট। গলায় লাল বুটিদার একটা রেশমি স্কার্ফ। 

ডান কাঁধে বন্দুকের কুঁদো, বাঁ হাতের তালুর উপরে নল, ট্রিগারে ডান হাতের তর্জনী, বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছেলেটি শোবার ঘরের মধ্যে এশে দাঁড়াল, তারপর মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে বন্দুকের নলটাকে সরাসরি আমার বুকের দিকে উঠিয়ে শুকনো গলায় বলল, “ডোন্ট মুভ! ফর, ইফ ইউ ডু, ইউ উইল গেট্‌ হার্ট!” 

সম্ভবত নিজের অজান্তেই এক-পা এগিয়ে গিয়েছিলুম। তৎক্ষণাৎ এক-পা পিছিয়ে এসে একেবারে নিশ্চল একটা পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে পড়লুম আমি। ছেলেটি একই রকমের শুকনো গলায় বলল, “দ্যাট্স বেটার। নাউ টেল মি, আর ইউ আ ফ্রেন্ড অর অ্যান এনিমি?” 

কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিলেই রেহাই মিলবে কি না, তাও না। তবু স্রেফ আত্মারক্ষার তাগিদে বললুম, “হোয়াই, আ ফ্রেন্ড অফকোর্স!” 

বন্দুক নামিয়ে নিল ছেলেটি। বলল, “ববি পানিশেস হিজ এনিমিজ, বাট দ্যাট্স নট দ্য ওলি থিং হি লাইক্স টু ডু। হি অলসো রিওয়ার্ডস হিজ ফ্রেন্ডস্। সিন্স ইউ আর আ ফ্রেন্ড, ইউ উইল বি রিওয়ার্ডেড।” 

ব্রিচেসের পকেট থেকে চকোলেটের মস্ত একটা স্ল্যাব বার করে আমার দিকে ছুড়ে দিল ছেলেটি। তারণর, যেন কোনও ষড়যন্ত্র করছে, এইভাবে, আমার কানের কাছে মুখ এনে, ফিসফিস করে বলল, “দ্যাট্স ফর দ্য প্রেজেন্ট। বাট থিংস আর লুকিং আপ। সিংহাসনটা এবারে ঠিক উদ্ধার করতে পারব, আর সিংহাসনে বসেই আমি কী করব জানো,… আই শ্যাল মেক ইউ মাই দিওয়ান। …কী, চুপ করে রইলে কেন? বলছি তো, ইংরেজের কুত্তা ওই কপুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে তোমাকেই আমার দেওয়ান করব। তাতেও খুশি নও?” 

একে তো আমার বোধবুদ্ধি একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল, তার উপরে আবার এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম যে, মুখ দিয়ে কোনও কথাই সরছিল না। তবু, যার হাতে বন্দুক, তার তাবৎ কথায় সায় দেওয়াই যে বুদ্ধিমানের কাজ, এই সহজ কথাটা তখনও নিশ্চয় ভুলে যাইনি; তাই, শুকনো ঠোঁটের উপরে বার কয়েক জিভ বুলিয়ে অস্ফুট গলায় বললুম, “ও ইয়েস, আই অ্যাম হ্যাপি…এক্সট্রিমলি হ্যাপি!” 

“ভেরি গুড। কিন্তু হুঁশিয়ার থেকো, একটু যদি অন্যমনস্ক হয়েছ, তো ডিকি তোমাকে শেষ করে দেবে। দ্যাটস হোয়াই আই অ্যাম নেভার অফ মাই গার্ড। ভাবতে পারো, দ্যাট বাস্টার্ড হ্যাজ বিন ট্রাইং টু সেন্ড মি টু অ্যান অ্যাসাইলাম? সেজ আই অ্যাম ম্যাড…অফ্ মাই রকার! বাট দেন হি ইজ অ্যান এনিমি, অ্যান্ড হি উইল বি পানিশ্ড্।” 

বলেই হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল ছেলেটি। তারপর বন্দুক ঘাড়ে তুলে, মার্চ করবার ভঙ্গিতে ‘লেফট্ রাইট…লেফট্ রাইট’ বলতে-বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

বিষাণগড়ের রাজবাড়িতে সেই আমার প্রথম রাত। জানলা-দরজায় খিল আর ছিটকিনি এঁটে দিয়েছিলুম, মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল বলে মাথায় ঘাড়ে আর কানের পিছনে বেশ ভাল করে জলও থাবড়ে নিয়েছিলুম, কিন্তু খানিক আগে যা ঘটে গিয়েছিল, তার ধকল যেন কাটতে চাইছিল না; মনে হচ্ছিল, এই যদি প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা হয়, তা হলে ভবিষ্যতে আরও কত দুর্ভোগ আমার কপালে লেখা আছে, তা কে জানে। 

একবার ভাবলুম চাকরিটা ছেড়ে দেব। রানি-মা তো পাঞ্জাবে গিয়েছেন, তিনি ফিরে আসবার আগেই পালাব এখান থেকে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলুম যে, সেটা সম্ভব নয়। আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, তায় বাড়ির বড় ছেলে, গোটা সংসার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তাই চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার বিলাস আমার একেবারেই সাজে না। তার উপরে আবার এত ভাল চাকরি। এখানে আমার থাকা-খাওয়া ফ্রি, অন্য খরচাও বলতে গেলে কিছুই নেই, যা মাইনে পাব তার প্রায় সবটাই তাই কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে পারব। সে ক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে যদি কলকাতায় ফিরে যাই, তো আমিই একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াব আমাদের সংসারে। 

এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, জানি না। ঘুম ভাঙল শেষ-রাত্তিরে। বিছানা থেকে উঠে, চোখে মুখে জল দিয়ে, দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। 

চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। পৃথিবীতে তখন অন্ধকারের রাজত্ব, কিন্তু আকাশের অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মিনিট কয়েক বাদেই আমার ডাইনে, পুবদিকের আকাশে, ফুটল আলতাপাটি শিমের রঙ। বাঁয়ে তাকালে একটা নদী চোখে পড়ে। দেখলুম তার কালো বুকে পড়েছে সেই হালকা-লালের ছায়া। গোটা রাজবাড়িটা এতক্ষণ যেন, বিশাল একটা জাহাজের মতন, অন্ধকার এক সমুদ্রের তলায় ডুবে ছিল। এবারে সেও তার গোটা শরীর নিয়ে একটু একটু করে সেই পাতালপুরীর অন্তরাল থেকে জলের উপরে ভেসে উঠতে লাগল। 

মন্দিরটাও চোখে পড়ল আবার। নদীর দিকে, প্যালেসের পশ্চিম-দিককার কম্পাউন্ড-ওয়ালের ধারে এই রাজবংশের উপাস্য দেবতা মহেশ্বরের মন্দির এতক্ষণ শেষ-রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে আ াগোপন করে ছিল; এখন, যতই অস্পষ্টভারে হোক, সেও ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। তার চূড়ার উপরকার ত্রিশূলটিকে নিশ্চয়ই সোনার জলে রং করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, নইলে সূর্যের প্রথম রশ্মির ছোঁয়া লাগবামাত্র ওই ত্রিশূল অমন ঝকমক করে উঠত না। 

তন্ময় হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে ছিলুম, হঠাৎ আমার চমক ভাঙল। মনে হল, কারও যেন গলা পাচ্ছি। একটু বাদে দেখতেও পেলুম তাঁকে। সূর্যবন্দনার স্তোত্র উচ্চারণ করতে-করতে, নদীর দিক থেকে, মন্দিরের পাশের ছোট একটা গেট পেরিয়ে দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রাজবাড়ির কম্পাউন্ডের ভিতরে এসে ঢুকলেন, তারপর মস্ত-মস্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমাদের এই কোয়ার্টার্সের দিকে। 

একটু কাছে আসতে বুঝতে পারলুম যে, মানুষটি মধ্যবয়সী। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, ধবধবে সাদা বুকের উপরে মোটা একটা পৈতে ঝুলছে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরনে পট্টবস্ত্র। বয়স মনে হল ষাটের কাছাকাছি। চুলে পাক ধরেছে কিন্তু শরীর যে এখনও রীতিমত মজবুত, সে তাঁর হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। 

কোয়ার্টার্সের সামনে এসে মানুষটি হঠাৎ চোখ তুলে উপরের দিকে তাকালেন একবার। আমাকে দেখতে পেলেন। মনে হল যেন চমকে উঠেছেন। কিন্তু কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে ধীরে-ধীরে একতলার কোয়াটার্সের মধ্যে ঢুকে গেলেন তিনি। 

রাজ-পুরোহিত গঙ্গাধর মিশ্র যে এই বাড়ির একতলায় থাকেন, মুনিমজির কাছে কাল রাত্তিরেই সে-কথা শুনেছিলুম। বুঝতে পারলুম যে, ইনিই মিশিরজি। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলম সাড়ে পাঁচটা বাজে। তার মানে, বেড-টি আসতে আরও আধ ঘণ্টা। ভাবলুম, তা হলে একবার যাই, মিশিরজির সঙ্গে আলাপ করে আসি। 

নীচতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল টিপতে যিনি এসে দরজা খুলে দিলেন, সেই বিধবা বউটির বয়স বছর তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। মনে হল, আমাকে দেখে তিনিও একটু চমকে উঠেছেন। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। মাথা নিচু করে বললেন, “আপনি….আপনি কি আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান?” 

বললুম, “হ্যাঁ। আমার নাম কিরণ চট্টোপাধ্যায়। কেয়ারটেকারের কাজ নিয়ে এখানে এসেছি। দোতলার ফ্ল্যাটে থাকি। ওঁর সঙ্গে কথা বলব।” 

মাথা নিচু করেই বউটি বললেন, “একটু দাঁড়ান, এক্ষুনি ওঁকে খবর দিচ্ছি।” 

দরজা খোলা। বাইরে আলো ফুটেছে, কিন্তু তাকিয়ে দেখলুম, ঘরের মধ্যে এখনও অন্ধকার। বাইরের এই ঘেরা-বারান্দাও এখনও পর্যন্ত সকালবেলার আলোর ছোঁয়া তেমন করে পায়নি, ছায়ার মধ্যে ডুবে রয়েছে। 

মিশিরজির জন্যে অপেক্ষা করছি, এমন সময় সেই অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে একেবারে হঠাৎই ছুটে বেরিয়ে এল একটি বাচ্চা মেয়ে, আর এসেই আমার দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল : বাবুজি! বাবুজি! 

কাল রাত্তিরেই আমার ফ্ল্যাটে একটা নাটক হয়ে গিয়েছে, তারপর সাত-সকালেই এই ব্যাপার। কিছুই ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছিলুম না, শুধু এইটুকু আন্দাজ করতে পারছিলুম যে, একটা কিছু গণ্ডগোল কোথাও ঘটেছে। সেটা যে কী, তা বুঝে উঠবার আগেই গঙ্গাধর মিশ্র এসে গেলেন। ব্যাপার দেখে তিনি যে খুব অবাক হয়েছেন, তা অবশ্য মনে হল না। বরং মনে হল যে, এমনটা যে ঘটতে পারে, তা তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। 

বাচ্চা-মেয়েটি আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরে তখনও সমানে কেঁদে যাচ্ছে। আস্তে-আস্তে আমার কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। তার মাথায় পিঠে সস্নেহে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “বাবুজি তো এসেই গেছে, দিদি, তা হলে আর তুই কাঁদছিস কেন? বুঝতেই তো পারছিস, বাবুজি অনেক দূর থেকে থেকে এসেছে, এখনও ওর আস্নান হয়নি। আগে আমি উপরতলা থেকে ওকে আস্নান করিয়ে আনি। বহোত থকে গেছে, থোড়া আরাম করতে দে। তুই ততক্ষণ তোর মা আর নানির সঙ্গে একটু কথা বল। এখনও তো কিছু খাসনি। দুধটা অন্তত খেয়ে নে। তারপর উপর থেকে এসে বাবুজি তোকে অনেক-অনেক কিস্সা শুনাবে।” 

মেয়েটি আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। অনেক বুঝিয়ে তাকে ভিতরে পাঠানো হল। বিধবা সেই বউটি ইতিমধ্যে আবার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে ভিতরে যেতে-যেতে মেয়েটি বলে গেল, “তাড়াতাড়ি আস্নান করে নাও বাবুজি। আমিও দুধ খেয়ে নিচ্ছি। তারপর তোমাকে অনেক-অনেক গল্প শোনাতে হবে।” 

মিশিরজি আমাকে নিয়ে উপরে উঠে এলেন। 

চা এল ঠিক ছ’টার সময়ে। চা, দুধ আর চিনির আলাদা-আলাদা পট, পেয়ালা, পিরিচ, ছাঁকনি, চামচ, সব ট্রে’র উপরে সুন্দর করে সাজিয়ে এনেছে। একটা মাঝারি সাইজের রেকাবিতে কিছু বিস্কুটও নিয়ে এসেছে দেখলুম। ব্রেকফাস্ট কখন দিতে হবে জিজ্ঞেস করতে বললুম, “আটটার আগে নয়।’ সেলাম করে কিচেনের লোকটি চলে গেল। 

মিশিরজিকে বললুম, “আপনিও চা খেয়ে নিন না। আমার সঙ্গে একটা এক্সট্রা কাপ আছে, কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছি।” 

গঙ্গাধর মিশ্র বললেন, “চায়ের নেশা আমার নেই, বাবুজি। তা ছাড়া, ন’টা নাগাদ আমি পুজোয় বসি, তার আগে আমি জল পর্যন্ত খাই না।” 

আমি আমার জন্যে চা ঢেলে নিলুম, তারপর তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বললুম, “ব্যাপার কী বলুন তো?”

“লছমির কথা জিজ্ঞেস করছেন তো?” মিশিরজি বিষণ্ণ হাসলেন, “সেটা বলব বলেই আপনার সঙ্গে উপরে উঠে এসেছি।” 

মিশিরজির কাছে সেদিন যা শুনেছিলুম, তার কথা আমি আগেই বলেছি। মাত্রই মাসখানেক আগে এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন তাঁর একমাত্র ছেলে পুরন্দর মিশ্র। নীচে আমি যাঁদের দেখেছি, তারা – পুরন্দরেরই বিধবা বউ আর মেয়ে। যমুনা আর লছমি। এই এক মাসে যমুনা যদি-বা তার শোক খানিকটা সামলে উঠতে পেরেছে, লছমি একেবারেই পারেনি। সে একেবারে গুম মেরে রয়েছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, হাসে না, খেলা করে না। এক্কেবারে বোবার মতন চুপ করে সারাক্ষণ বসে থাকে। রাত্তিরে ভাল করে ঘুমোয় না পর্যন্ত; যদি-বা ঘুমোয়, হঠাৎ-হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, আর তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে। 

“আজই ও প্রথম কথা বলল, বাবুজি। কেন বলল জানেন?” 

“কেন?” 

তখনই আমার কথার কোনও জবাব দিলেন না গঙ্গাধর মিশ্র। চুপ করে খানিকক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “রোজই আমি শেষরাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে সর্সোতিয়ায় স্নান করতে যাই। আজও স্নান সেরে ফিরে আসছিলুম। আপনি তখন দোতলার ওই সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। সেই আবছায়ার মধ্যে আপনার উপরে চোখ পড়বামাত্র আমি চমকে উঠি।” 

“সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম।” 

“কিন্তু কেন যে আমি চমকে উঠেছিলুম, তা আপনি বুঝতে পারেননি, বাবুজি। প্রায় সঙ্গে- ঙ্গেই আপনি নীচে নেমে এলেন। তখন আমার বউমা যমুনাও চমকে উঠল আপনাকে দেখে। আর লছমি যে কী কাণ্ড করল, সে তো আপনি নিজেই দেখলেন।” 

বুঝতে পারছিলুম যে, একটা কোনও জটিল রহস্যের গ্রন্থি ধীরে-ধীরে খুলে যাচ্ছে। কিন্তু রহস্য যে ঠিক কী, স্পষ্ট করে তখনও সেটা ঠাহর করা যাচ্ছিল না। বললুম, “কিন্তু ব্যাপারটা কী? আপনারাই বা চমকে উঠলেন কেন, আর লছমিই বা ওইভাবে ঘর থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল কেন?” 

গঙ্গাধর মিশ্র একদৃষ্টিতে জানলার দিকে তাকিয়ে, যেন-বা আত্মগতভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন। এবারে তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “মিথ্যে কথা বলব না, বাবুজি। পুরন্দরের সঙ্গে আপনার মিল যেমন অনেক, তেমন অমিলও নেহাত কম নয়। তার ছিল ফর্সা রঙ, আর আপনার রঙ ময়লা। মাথায় সে আপনার চেয়ে দু-এক ইঞ্চি খাটো ছিল। তার কপালে একটা মস্ত জড়ুল ছিল, আপনার নেই। কিন্তু সবে যখন রাত কেটেছে তখনকার সেই আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে আমরা আপনাকে দেখেছিলুম তো, তাই অমিলগুলো তত স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়েনি। হঠাৎ দেখে যেমন আমার, তেমন যমুনা আর লছমিরও মনে হয়েছিল যে, সেই মরা মানুষটাই যেন আবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবুজি, দুটো মানুষের মধ্যে মুখচোখের এমন মিল বড়-একটা দেখা যায় না।” 

“তাই-ই?” 

“তা-ই।” গঙ্গাধর মিশ্র বললেন, “আমাদের হিন্দিভাষায় একটা প্রবাদ আছে, ভগবান কখনও এক ছাঁচে দুটো মুখ তৈরি করেন না। কিন্তু বাবুজি, এখন তো আর অন্ধকার নেই, রোদ্দুর উঠেছে, কিন্তু এখনও এই যে আপনাকে দেখছি, আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে যেন পুরন্দরকে তৈরি করবার পর ভগবান তাঁর ছাঁচটা ভাঙতে ভুলে গিয়েছিলেন, সেই একই ছাঁচে আপনার মুখখানা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন।” 

মিশিরজি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “চলি, বাবুজি। বেলা হয়েছে। আমাকে এখন আহ্নিক করতে হবে, জপ করতে হবে। তারপর ন’টার সময় মন্দিরে যাব, পুজো করতে বসব।” 

আমিও উঠে দাঁড়ালুম। বললুম, “মিশিরজি, আমার বড় ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। ধাঁধাটা আপনি কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু একটা কথা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।” 

“কী বুঝতে পারছেন না, বাবুজি?” 

“লছমিকে আমি কী বলব? প্রথম যখন দেখেছিল, তখন বুঝতে পারেনি, কিন্তু এখন তো ঠিকই বুঝতে পারবে যে, আমি ওর বাবুজি নই। ওকে কী বলে সান্ত্বনা দেব আমি?” 

মিশিরজি ম্লান হাসলেন। বললেন, “তা আমি আর এখন ভাবছি না। অনেক দিন বাদে মেয়েটা যে আবার কথা বলেছে, এই ঢের। .. আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, অনেক পড়ালিখা করেছেন, ওই বাচ্চা-মেয়েটাকে কি আর আপনি সব বুঝিয়ে বলতে পারবেন না?” 

কী আর বলব। আমার গলায় কিছু একটা আটকে গিয়েছিল। তাই কিছুই বলা গেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। 

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সেইসঙ্গে একটি শিশুকণ্ঠের উল্লসিত চিৎকার। “বাবুজি, ম্যায় দুধ পি লিয়া। কম সে কম দোঠো কিস্সা তো আভি শুনানেই পড়েগা তুমকো।” 

লছমি উপরে উঠে আসছে। হঠাৎ আমার হাত দুখানা জড়িয়ে ধরলেন মিশ্রজি। কাতর কণ্ঠে বললেন, “ভগবানই আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, বাবুজি। ওই দুধের বাচ্চাটাকে আপনি একটু বুঝিয়ে বলতে পারবেন না? পারতেই হবে। নইলে ওকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।” 

৯ 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে তো আমি অবাক। সরস্বতী এর আগেও দু’বার যতীন বাগচি রোডের এই ফ্ল্যাটে এসেছে? হতভম্ব হয়ে বললুম, “তার মানে?” 

“মানে আবার কী!” ভাদুড়ি ণাই হালকা গলায় বললেন, “এসেছে মানে এসেছে।” 

“অর্থাৎ আপনাকে ও চেনে?” 

“চেনে বই কী। শুধু আমাকে কেন, এ-বাড়ির সক্কলকেই ও চেনে। ও খুব ভালই জানে, মালতী আমার বোন, হার্ট-স্পেশালিস্ট অরুণ সান্যাল আমার ভগ্নীপতি, আর কৌশিক আমার ভাগ্নে। … এমন কী, কৌশিক যে খুব শিগগিরই সি. বি. আই.-এর কর্তা হতে চলেছে, সরস্বতীর তাও অজানা নেই।”

এবারে আমার চতুর্গুণ অবাক হওয়ার পালা। অনেক কষ্টে বললুম, “সে কী, আমি তো দেখছি কোনও খবরই রাখি না। তা এত অল্প বয়সে কি সেন্ট্রাল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশানসের কর্তা হওয়া যায় নাকি?” 

“আমি তো ওই সি. বি. আই. এর কথা বলিনি, আমি বলছি আর এক সি. বি. আই. এর কথা।” কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। বললুম, “যাচ্চলে, দেশে আবার আর-একটা সি.বি. আই. ক.ব গজিয়ে উঠল?” 

“নতুন করে গজায়নি, বেশ কয়েক বছর ধরেই তার কাজ চলছে। …বুঝতে পারছেন না, কেমন? আচ্ছা, বাঙ্গালোরে আমার যে গোয়েন্দা ফার্ম, তার নামটা আপনি জানেন তো?” 

“তা কেন জানব না। চারুচন্দ্র ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশানস্।” 

“অর্থাৎ সংক্ষেপে সেটাও সি.বি.আই.। তা-ই না?” 

“আরে, তাই তো! এটা তো কখনও ভেবে দেখিনি। বললুম, “তা কৌশিক কি এই প্যারালেল সি. বি. আই.তে জয়েন করছে নাকি?” 

“শুধু জয়েন করেছে বললে কমই বলা হবে। ভাবছি, ও যখন তৈরি হয়ে উঠেছে, তখন আর ভাবনা কী, ফার্মের পুরো দায়িত্ব ওর উপরে ছেড়ে দিয়ে এবারে আমি রিটায়ার করব। …কিন্তু এ কী, সবাই দাঁড়িয়ে কেন? চলুন কিরণবাবু, বসা যাক।” 

সবাই গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলুম বটে, কিন্তু আমার অস্বস্তি তবু যাচ্ছিল না। ভাদুড়িমশাই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, “সরস্বতীর কথা ভাবছেন তো? ওর কোনও দোষ নেই। আসলে আমিই একটু মজা করতে চেয়েছিলুম। তাই সরস্বতীকে আজ সকালেই ফোন করে বলেছিলুম যে, অনেক আগেই যে আমার সঙ্গে ওর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আপনার কাছে সেটা যেন চেপে যায়।” 

সবাই হাসছিল। এক সরস্বতী ছাড়া। সম্ভবত একটু বিব্রতই বোধ করছিল সে। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, মিঃ চ্যাটার্জি। বড়দা এমন করে হুকুম করলেন যে, বাধ্য হয়ে ওই মিথ্যে কথাটা বলতে হল। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।” 

ভাদুড়িমশাই চোখ পাকিয়ে বললেন, “এইয়ো পাজি মেয়ে, যেমন আমাকে তেমনি কিরণবাবুকেও তোর মা চাচাজি বলত, আর তুই কিনা ওঁকে মিঃ চ্যাটার্জি বলছিস? সম্পর্কে তো উনিও তোর দাদামশাই। যেমন আমাকে বড়দা বলিস, তেমনি ওঁকেও এখন থেকে দাদা বলবি। কিরণবাবু, বয়েসে আপনি আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট, তাই মেজদা বললে আপনার নিশ্চয় আপত্তি হবে না?” 

হেসে বললুম, “লছমির মা আমাকে ‘ভাইয়া’ বলতেন। অনেকদিন ওই ডাকটা শুনিনি। সরস্বতীও সেটাই বলুক। তাতেই আমি খুশি হব।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাস, মিটে গেল। সরস্বতী, তুই আর অত কাঁচুমাচু হয়ে থাকিসনে তো। কিরণবাবু বেরসিক নন, উনি খুব ভালই বুঝতে পারছেন যে, ইট’স এ হোয়াইট লাই, এতে দোষের কিছু নেই, মজা করবার জন্যে এমন মিথ্যেকথা সবাই বলে থাকে। তার উপরে নাতনি বলে কথা, দাদুকে নিয়ে মজা করবার জন্যে একটা মিথ্যে যদি বলেই থাকিস তো বেশ করেছিস। …আর হ্যাঁ, আপনাকেও বলি কিরণবাবু, সরস্বতী কিন্তু অনেক আগেই আপনার খোঁজ করেছিল।” 

“কবে?” 

উত্তরটা সরস্বতীই দিল। বলল, “গ্রীষ্মের ছুটিতে গত জুন মাসে আমরা কলকাতায় এসেছিলুম। আমরা মানে আমি আর সুমঙ্গল। এসেই আপনাকে ফোন করি। কিন্তু আপনি তখন কলকাতায় ছিলেন না। শুনলুম কী একটা কাজ নিয়ে নাকি বিদেশে গিয়েছেন।” 

বললুম, “হ্যাঁ, মাস কয়েকের জন্যে তখন বাইরে যেতে হয়েছিল বটে। তা তুমি আমার ফোন-নাম্বার পেলে কোথায়? ডিরেক্টরিতে?” 

“ডিরেক্টরি দেখবার দরকার হয়নি, ভাইয়া। বড়দা তো মাঝেমধ্যেই দিল্লি যান, আমাদের সঙ্গে দেখাও হয়। ওঁর কাছ থেকেই আপনার ফোন নাম্বারটা আমি নিয়ে রেখেছিলম।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “আর এই কথাটা অ্যাদ্দিন আপনি আমাকে জানাননি? “ চা নিয়ে মালতী ইতিমধ্যে ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকেছিল। সেন্টার টেবিলের উপরে ট্রেটা নামিয়ে রেখে বলল, “কোশিক, তুই গিয়ে জলখাবারের প্লেটগুলো নিয়ে আয়।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজের মেয়েটা আজ আসেনি কিরণদা। কাল জ্বর গায়ে বাড়ি গেল, এখন যে কতদিন আসবে না, কে জানে!” 

বললুম, “তা হলে আর জলখাবারের হাঙ্গামা করতে গেলে কেন? শুধু চা দিলেই তো হত।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি কী বলছিলেন কিরণবাবু?” 

“বলছিলুম যে, অনেকদিন ধরেই তো সরস্বতীদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ রয়েছে, তা হলে আমাকে সেটা জানাননি কেন?”

“ভেবেছিলুম আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। তাই চেপে গিয়েছিলুম।” 

“যোগাযোগটা হল কীভাবে?” 

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বলছি, সব বলছি। কিন্তু তার আগে আরও দু-একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে একটা সম্মেলন হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক সম্মেলন। এ-দেশের সব বিখ্যাত জিওলজিস্টরা তো তাতে যোগ দিয়েছিলেনই, স্পেশাল ইনভাইটি হিসেবে বিদেশের তা প্রায় জনা পাঁচ-ছয় নামজাদা ভূ-বিজ্ঞানীও সেখান হাজির ছিলেন। তা, বয়েস অল্প হলে কী হয়, আওয়ার সরস্বতী হ্যাজ অলরেডি মেড হার মার্ক ইন দিস ডিসিপ্লিন, তাই ওকেও সেখানে একটা পেপার পড়তে ডাকা হয়েছিল। ওর বিষয় ছিল “দি গোল্ড ডিপজিটস অত ইন্ডিয়া।” তা সেই পেপারটা নিয়ে খুব ইচই পড়ে যায়। ব্যাপারটা আপনার মনে আছে কিরণবাবু?”

বললুম, “স্পষ্ট মনে আছে। সেইজন্যেই তো সরস্বতী ভট্‌ট্চাজ নামটা আমার চেনা-চেনা লাগছিল। দুপুরে সরস্বতী যখন আমার অফিসে ফোন করে, তখনই তো কথাটা ওকে আমি জানিয়েছি।” 

“ভাল, ভাল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তো ওর যা বক্তব্য ছিল, তাও মনে আছে আপনার?” 

“আছে বই কী। সেই পেপারে ও বলেছিল যে, মধ্যপ্রদেশের নদীর বালি আর কয়েকটা জায়গার পাথর পরীক্ষা করে ওর মনে হয়েছে যে, যেমন মাইসোরে তেমন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার মাটির তলাতেও সোনার ডিপজিট থাকাই সম্ভব।” 

ভাদুড়িমসাই বললেন, “আরে মশাই, মাইসোরের কোলার তো নস্যি, সেখানকার ডিপজিট এমন কিছু মস্ত মাপের নয়। গোল্ড-মাইনের কথা বলতে গিয়ে ও তার নাম করেছিল মাত্র। শুধু এইটুকু বললে কি আর অত হত?” 

সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে কৌশিক বলল, “ঠিক কী বলেছিলেন আপনি?” 

সরস্বতী হেসে বলল, “সে তোমার মামাবাবুর কাছেই শোনো। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মাটির তলায় কোথায় কতটা সোনা রয়েছে, কোনও দেশেরই সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে কিনা যে-সব গোল্ড-ডিপজিটের হদিশ ইতিমধ্যে মিলেছে, তার ভিত্তিতে মোটামুটি একটা হিসেব সকলেরই আছে যে, কোন্ দেশের মাটিতে কতটা সোনা থাকা সম্ভব। তো সেই হিসেব অনুযায়ী এ-ব্যাপারে সবচেয়ে ধনী চারটি দেশ হল দক্ষিণ আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন সরস্বতীর ধারণা যদি সত্যি হয়, তো এতদিনকার সেই হিসেবটাই হয়তো উলটে যাবে।” 

কৌশিক বলল, “তার মানে?” 

“মানে অতি সহজ। সরস্বতী বলেছিল যে, ঠিকমতো যদি প্রসপেক্টিং করা হয়, তা হলে হয়তো দেখা যাবে যে, ভারতবর্ষে একমাত্র মধ্যপ্রদেশের মাটির তলাতেই যা মজুত রয়েছে, সেই সোনার পরিমাণ ওই চারটি দেশের যে-কোনওটির ডিপজিটের চাইতেই শুধু যে বেশি, তা নয়, অনেক অনেক বেশি। বাস্‌, দিল্লি কলকাতা বোম্বাই মাদ্রাজ, চার-চারটে মেট্রোপলিসের তাবৎ বড় কাগজে সরস্বতীর সেই পেপারের কথা ফলাও করে ছাপা হল। সেইসঙ্গে সম্পাদকীয় লিখে … আপনাদের ওই কী যে বলে … হ্যাঁ, জ্বালাময়ী ভাষায় গভর্নমেন্টের আদ্যশ্রাদ্ধ করে তারা বলতে লাগল যে, সরকার তো সর্ব ব্যাপারেই ঠুটো জগন্নাথ, সব কাজেই তাঁদের আঠারো মাসে বছর, কিন্তু এখন আর কালক্ষেপ করা চলবে না, অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে এবারে অবিলম্বে তাঁদের সর্বাত্মক অনুসন্ধানের—কী, বাংলাটা ঠিক হচ্ছে তো?—ব্যবস্থা করতে হবে। এমন কী, যে ইস্টার্ন কুরিয়ার প্রায় কোনও ব্যাপারেই ঝেড়ে কাসে না, সম্পাদকীয় নিবন্ধের প্রতিটি প্যারাগ্রাফে তিন-চারটে করে ইফ, বাট আর অলদো’ লেখে, তারাও এক্ষেত্রে লিখে বসল, ‘দ্য গভর্নমেন্ট ক্যানট—অ্যান্ড উই রিপিট, ক্যানট—এক্সপেক্ট টু রিসিভ দ্য নেশনস ইনডালজেন্স ইফ ইন দেয়ার সার্চ ফর দিস প্রেশাস মেটাল দে লিভ ইন আ সিঙ্গল স্টোন অভ্ মধ্যপ্রদেশ আনটার্নড।’ বুঝুন ব্যাপার!” 

বললুম, “ওরেব্বাবা, এ তো সেই বাচস্পতির ভাষা! দ্য হাব্বারফ্লুয়াস ইনফ্যাচুফুয়েশান অভ্ আকবর দ্য গ্রেট ডান্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজ্ড দ্য গবান্ডি অভ হুমায়ুন!” 

সরস্বতী হেসে বলল, “খবরের কাগজগুলোর কথা আর বলবেন না। একটা কিছু পেলেই হল, অমনি তারা এমন রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, সে আর কহতব্য নয়।” 

বললুম, “খবরের কাগজকে দোষ দিচ্ছ কেন? সরকারের কী করণীয়, সেটা তো তাদের বলাই উচিত।” 

সরস্বতী বলল, “বা রে, হুট বললেই কি এ-সব কাজে নেমে পড়া যায় নাকি? তা কক্ষনো যায় না। সবদিক থেকে তৈরি হয়ে, মানে পেপার-ওয়ার্ক শেষ করে, আর্থ টেস্টিং, সার্ভে, র‍্যান্ডম-স্যাম্পলিং ইত্যাদি তাবৎ ব্যাপারের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে, জিওলজিস্ট আর ফিল্ড ওয়ার্কারদের একটা নির্ভরযোগ্য টিম তৈরি করে, যে-যে জায়গায় কাজ চলবে, সেখানকার লোক্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে ইনভল্‌ভ করিয়ে তবে এ কাজে নামতে হয়। স্পটে যাতে কোনও হাঙ্গামা না হয়; তার জন্যে আগে থাকতেই নিতে হয় নানা প্রিকশনারি মেজার্স। সবচেয়ে বড় কথা, বেশ শক্তপোক্ত একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে তোলা চাই, তবে তো অনুসন্ধানের কাজটা ঠিকমতো এগোবে।” 

অরুণ সান্যাল এতক্ষণ কিছু বলেননি, এবারে বললেন, “এ তো অতি ন্যায্য কথা। প্রস্তুতি নেই, অথচ কোমর বেঁধে কাজে নামলুম, তাও কি হয় নাকি?” 

সরস্বতী বলল, “কিন্তু সেই প্রস্তুতির সময়টা সরকার পেল কোথায়? দে হ্যাড টু ড্র আপ আ প্ল্যান উইদিন দ্য শর্টেস্ট পসিবল টাইম অ্যান্ড স্টার্ট ওয়ার্ক অ্যাট ওয়ান্‌স।” 

কৌশিক বলল, “কেন?”

“তাও বুঝতে পারছ না? একে তো পঞ্জাবের ব্যাপারে সরকারের ক্রেডিবিলিটি তখন হুহু করে কমে যাচ্ছে। তার উপরে ‘দুর্নীতি দুর্নীতি’ বলে বিরোধী দলগুলি এমন চেঁচাচ্ছে যে, ও-সব ব্যাপার নিয়ে এমনিতে যারা মাথা ঘামায় না, তাদেরও অনেকে তখন ভাবতে শুরু করেছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। ওদিকে আবার শ্রীলঙ্কায় আর্মি পাঠিয়েও খুব-একটা সুবিধে হল না, অনেকেই বলতে লাগল যে, ওটা মোটেই সুবুদ্ধির কাজ হয়নি। তো এই অবস্থায় গোল্ড ডিপোজিটের ব্যাপারটা নিয়েও কাগজগুলো যখন তারস্বরে চেঁচাতে আরম্ভ করল, তখন ইট প্রুভ্ড টু বি দ্য প্রোভার্বিয়াল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। সরকার ঘাবড়ে গেল। দে উইল্টেড আন্ডার প্রেশার। তড়িঘড়ি তারা এই ডিসিশান নিল যে, ঢের হয়েছে, আর নয়, অন্তত এই একটা ব্যাপারে এক্ষুনি কাজ আরম্ভ করতে হবে, যেমন করেই হোক, প্রমাণ করতে হবে যে, ইটস আ গভর্নমেন্ট দ্যাট ওয়ার্কস।” 

কৌশিক বলল, “এই ব্যাপার?” 

“তা নয় তো কী!” সরস্বতী তিক্ত হেসে বলল, “সরকারকে আমি দোষ দেব না; পুয়োর পিপ্‌ল, দে ওয়্যার অলরেডি ইন আ টাইট স্পট, অ্যান্ড দে হ্যাড টু কাম আপ উইথ সামথিং ইন এ জিফি! আর তাই তড়িঘড়ি একটা টিম খাড়া করা হল, রাতারাতি তাঁরা একটা প্রোজেক্টের খসড়া বানিয়ে ফেললেন, সরকারের পেটোয়া এক বিজ্ঞানী সেই খসড়াটা সম্ভবত না-পড়েই অ্যাপ্রুভ করে দিলেন, আর তার মাস দেড়েকের মধ্যেই গোটাকয়েক লোকেশান ঠিক করে নিয়ে শুরু হয়ে গেল সানার ডিপজিট খুঁজে বার করবার কাজ। …তুমি হাসছ কৌশিক, কিন্তু আমি আবার বলছি, কাগজগুলো এমন ফিঙের মতন তখন সরকারের পিছনে লেগেছিল যে, এ ছাড়া তাদের কোনও গত্যন্তরও ছিল না। দে ওয়্যার লেফ্‌ট উইথ নো আদার অলটারনেটিভ।” 

আমি বললুম, “কিন্তু পেপারটা তো তোমার। লোকেশান বাছাইয়ের ব্যাপারে তোমাকে একবার কনসাল্ট করেছিল নিশ্চয়?” 

সরস্বতী বলল, “তা করেছিল বই কী। কিন্তু আমি বুঝেই গিয়েছিলুম যে, সরকার যে টাইম-শিডিউল করে দিচ্ছে, তাতে শুধু দৌড়ঝাঁপই সার হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। ফলে আমি এড়িয়ে গেলুম। চেনা এক ডাক্তারকে দিয়ে এই মর্মে একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলুম যে, আমার স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছে না, হাইপার টেনশানে ভুগছি, আমার পক্ষে এখন দিল্লি ছেড়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সরকারি কর্তারা তখন বললেন যে, বেশ তো, যেতে যদি না পারো তো যেয়ো না, কিন্তু কোন্ কোন্ জায়গায় খোঁজ চালানো দরকার, সেটা অন্তত বলে দাও।” 

বললুম, “দিয়েছিলে?” 

“না, তাও দিইনি।”

“কেন?” 

“প্রোজেক্ট সম্পর্কে কিছু-কিছু খবর আমার কানে এসেছিল। তাতে বুঝে গিয়েছিলুম যে, এতে কোনও কাজ হবে না। ভাইয়া, এটা ছেলেখেলা নয়। এ-সব কাজের একটা সুষ্ঠু পদ্ধতি থাকাই চাই। অথচ সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেই টের পেলুম যে, যে-দ্ধতিতে এঁরা কাজ করতে চলেছেন, তাকে কোনও সুষ্ঠু পদ্ধতি বলা চলে না। তার উপরে আবার এটাও জেনে গেলুম যে, এঁরা না নিয়েছেন কোনও প্রিকশনারি মেজার, না এ-কাজে লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশানকে ইনভল্ভ করাবার কথা ভেবেছেন। তা হলে? নির্দিষ্ট কয়েকটা লোকেশানের নাম কি আমি দিতে পারতুম না? পারতুম। তবু দিইনি। তার কারণ, এঁরা যে-লাইনের কথা ভাবছিলেন, আমি জানতুম যে, সেই লাইনে কাজ করতে গেলে টিমের লোকেরা বিপদে পড়বে।” 

“কীসের বিপদ?” 

অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল সরস্বতী। ঝাঁঝালো গলায় বলল, “ভাইয়া, ইউ ডোন্‌ আন্ডারস্ট্যান্ড। এই সহজ কথাটা ভুলে যাবেন না যে, এ-সব কাজ শহুরে এলাকায় হয় না, হয় জঙ্গলে-পাহাড়ে। কিন্তু জঙ্গল-পাহাড় বলেই আবার ভাববেন না যে, তার সবই একেবারে নির্জন জায়গা। সেখানেও মানুষ থাকে। লক্ষ রাখতে হয়, তারা যেন আমাদের ভুল না বোঝে, যেন রেগে না যায়, যেন না হস্টাইল হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে ভাব করতে হয়। তাদের বোঝাতে হয় যে, আমরা তাদের কোনও অনিষ্ট করতে আসিনি। তা নইলে কাজ এগোবে না, পদে-পদে বাধা আসবে।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইল সরস্বতী। তারপর বলল, “আমার কথাই ধরুন। র‍্যান্ডম-স্যাম্পলিংয়ের জন্যে মধ্যপ্রদেশের যে এলাকাটা আমি বেছে নিয়েছিলুম, সেটা ছিল পুরোপুরি ট্রাইবাল এরিয়া। সেখানে আমার কাজটা আমি আদৌ করতে পারতুম না, যদি না দিনের পর দিন চেষ্টা করে সেখানকার গরিব, নিরন্ন মানুষগুলোকে আমি বোঝাতে পারতুম যে, আমি তাদের শত্রু নই, বন্ধু। আমরা যারা শহর থেকে ও-সব জায়গায় যাই, তাদের ওরা বিশ্বাস করে না। কেনই বা করবে। একলব্যের গল্পটা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়? সেই মহাভারতের যুগ থেকে তো ওদের আমরা শুধু ঠকিয়েই আসছি। সভ্য-মানুষ দ্রোণাচার্য তাঁর ট্রাইবাল শিষ্যটির বুড়ো আঙুল কেড়ে নিয়েছিলেন, আর আমরাও সভ্য-মানুষরা কেড়ে নিচ্ছি ওদের জঙ্গল। শুধু ক্ষতি ছাড়া কোনও উপকার তো ওদের আমরা করি না। আর তাই আমাদের যে ওরা বিশ্বাস করে না, সেটাই তো স্বাভাবিক।” 

অরুণ সান্যাল বললেন, “কিন্তু তাই বলে ওই বিশাল ঐশ্বর্য মাটির তলার অন্ধকারেই রয়ে যাবে, এটাও তো ঠিক নয়। একটা কিছু উপায়ের কথা তো ভাবতে হবে।” 

সরস্বতী বলল, “উপায় যে নেই, তা তো নয়, দু’দুটো উপায় আছে। প্রথমত, যেখানে কাজ চলবে, স্থানীয় লোকেদের জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, সব কথা তাদের বুঝিয়ে বলা যায়। মানুষগুলোকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, একটা জরুরি কাজের জন্যে এই জায়গাটা সরকারের দরকার হয়েছে, কিন্তু তাই বলেই যে সরকার তাদের উচ্ছেদ করতে চাইছে, তা কিন্তু নয়। তারা যদি স্বেচ্ছায় সরে যায়, তবেই সরকার জায়গাটা নেবে, নইলে নেবে না। কিন্তু শুধু ওইটুকু বললেই চলবে না, পুরুষানুক্রমে যেখানে তারা রয়েছে, সেখান থেকে খুব বেশি দূরে যে তারা সরে যেতে চাইবে না, এই সহজ কথাটা সরকারকে মনে রাখতে হবে। জঙ্গলের মধ্যেই, এই ধরুন দশ-পনেরো মাইলের ভিতরেই, তাদের রিহ্যাবিলিটেশানের জন্যে এমন একটা জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যেটা তাদের পছন্দসই। তার কাছাকাছি নদী কিংবা ঝর্না থাকা চাই। যারা চাষবাসের কাজ জানে, তাদের জন্য জমির ব্যবস্থা করা চাই। তারা তো তাদের পুরনো ঘরবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, তাই নতুন জায়গায় তাদের মাথা গুঁজবার আশ্রয়টাও বানিয়ে দেওয়া চাই। সবচেয়ে বড় কথা, সরল ওই লোকগুলোর মনে এই বিশ্বাসটুকু জাগানো চাই যে, আমরা ওদের ঠকাতে চাই না, ওদের ক্ষতি করবার কোনও ইচ্ছেই আমাদের নেই, উই আর নট গোয়িং দেয়ার টু ডিসটার্ব দেয়ার লাইফ-প্যাটার্ন অর ‘ট্রু ডেসট্রয় দ্য সোশ্যাল সিস্টেম দ্যাট দে হ্যাভ ডেভেলাপ্‌ড ওভার দ্য সেঞ্চুরিজ ফর দেমসেল্ভস।” 

বললুম, “তো সেটা করা হল না কেন?” 

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সরস্বতী বলল, “সম্ভবত এইজন্যে হল না যে, তাতে অনেক কালক্ষয় হত। আর তা ছাড়া অন্য পথটাই তো সহজ, কর্তারা তাই সেই পথটাই ধরলেন। লোকেশান দখল করে, গাছপালা কেটে জায়গাগুলোকে একেবারে সাফসুতরো করে তুলবার ভার দেওয়া হয়েছিল ভোপালের এক কন্ট্রাকটরকে। এক দঙ্গল লাঠিয়াল নিয়ে সে একেবারে তৈরি হয়েই গিয়েছিল। বোমা-বন্দুকও ছিল নিশ্চয়। বেধড়ক পিটিয়ে সে ট্রাইবালদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়।” 

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সরস্বতী, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ক্লিষ্ট হেসে বলল, “তো এইরকমই যে হবে, তা আমি জানতুম।” 

“আর এইজন্যেই সম্ভবত যে-সব জায়গায় কাজ করলে গোল্ড ডিপজিটের হদিশ পাবার সম্ভাবনা রয়েছে, তার নাম তুমি জানাওনি, তাই না?”

“ঠিক তা-ই।” এতক্ষণে স্বাভাবিক হাসি ফুটল সরস্বতীর মুখে। বলল, “যদি জানাতুম, তা হলে কী হত জানেন?” 

কৌশিক বলল, “কী হত?” 

“কন্ট্রাকটরের গুণ্ডাবাহিনী গিয়ে সেখানকার ট্রাইবাল পপুলেশানকেও ঠিক ওই একইভাবে উচ্ছেদ করে ছাড়ত। এখন বলো কৌশিক, নিতান্ত নিঃসঙ্গ একটা শহুরে মেয়েকে যারা সব রকমে সাহায্য করেছে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস তাকে সব রকমের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছে, জেনেশুনে তাদের এই সর্বনাশটা আমি করতে পারি?”