বিষাণগড়ের সোনা – ২০

২০

নেহাত যদি না স্মৃতিভ্রংশ হয়, তা হলে জীবনের যে-ক’টা তারিখ একেবারে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমার মনে থাকবে, তার মধ্যে একটা নিশ্চয় ছেচল্লিশ সালের দোসরা জুলাই। আজ বুঝতে পারি যে, আমাকে ঘিরে কী ভয়ংকর বিপদের জাল সে-দিন ছড়ানো হয়েছিল, আর কী নির্বোধের মতো সেই জালের দিকে আমি এগিয়ে গিয়েছিলুম। কাজটা যে নির্বোধের মতোই করেছিলুম, তাতে সন্দেহ কী। একটু যদি সতর্ক হতুম, আর কিছু না হোক্, যদি কাউকে সঙ্গে নিয়ে আগরওয়ালজির দোকানে যেতুম, তা হলে নিশ্চয় অত বড় বিপদে আমাকে পড়তে হত না। 

সেদিনও যথারীতি দশটায় দফতরে গিয়েছি, কাজও করেছি একটা পর্যন্ত। তারপর মিশ্রজির ফ্ল্যাটে দুপুরের খাওয়া সেরে দুটোয় যখন আবার দফতরে ফিরে আসি, তখন মুরারি বলল, “কিছু বিল্ডিং মেটেরিয়াল কিনবার ছিল, তার অর্ডার কিন্তু এখনও দেওয়া হয়নি। এদিকে পরশু থেকে তো কাজ শুরু হচ্ছে, তার মধ্যে যদি মাল না পড়ে তো মিস্ত্রি-াজুরকে বসিয়ে রাখতে হবে।” 

কথাটা আমার মনেই ছিল না। বললুম, “ঠিক আছে, দরকার তো আপাতত ইট, বালি আর সিমেন্ট, রামসেবকজির গদিতে যদি ফোন করি তো আজ রাত্তিরেই। উনি ডেলিভারি দেবেন। কিন্তু তাঁর আগের বারের মালের বিল তো দেখলুম; আমার ধারণা তিনি গম একটু বেশি নিচ্ছেন। সত্যিই নিচ্ছেন কি না, সেটা একবার যাচাই করে দেখা দরকার। তা তুমি একটা কাজ করো। বাজারে তো বিল্ডিং মেটেরিয়ালের আরও দু-তিনজন ডিলার রয়েছে, তাদের কাছে চলে যাও। জেনে এসো, তারা কী দামে বিক্রি করে।”

মুরারি তবু তার চেয়ার ছেড়ে উঠল না। বলল, “আমাদের এস্টেট ম্যানেজার যে রামসেবকজির বন্ধু, সেটা জানেন তো?” 

বললুম, “কে কার বন্ধু, তা আমি জানি না। জানবার কোনও দরকার আছে বলেও মনে করি না। তোমাকে যা করতে বলছি, করো। বাজারে চলে যাও, এক-নম্বর ব্রিক, মাঝারি-দানার বালি আর পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট কে কী দামে বিক্রি করছে, জেনে এসো। দেরি কোরো না, সাইকেল নিয়ে যাও, চারটের মধ্যে ফিরে আসবে।” 

কথাটা কি একটু কঠিন গলায় বলেছিলুম? কী জানি। মুরারি অবশ্য আর গড়িমসি করল না, দফতর থেকে তার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। 

ফিরে এল সওয়া চারটের সময়। কোটেশানগুলি সে একটা চিরকুটে লিখে এনেছিল, সেটা আমার টেবিলের উপরে রেখে বলল, “এই নিন আপনার কোটেশান। …ও হ্যাঁ, মার্কেট রোডে আগরওয়ালজির সঙ্গে দেখা হল। বললেন যে, আপনার সঙ্গে কী একটা জরুরি কথা আছে, আজই যদি তাঁর দোকানে একবার যান তো বড় ভাল হয়। তিনিই আসতেন, তবে তাঁর বাতের ব্যথাটা আবার বেড়েছে, তাই আসতে পারছেন না।” 

বাতের ব্যথা বাড়াটা মনে হল স্রেফ একটা ওজর ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে সর্সোতিয়ার ধারে তিন-তিনটে লাশ পড়ে ছিল, এই খবরটা চাউর হবার সঙ্গে-সঙ্গেই গোটা শহর জুড়ে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে যে, বিকেলের দিকে কেউ বড় আর ঘর থেকে বেরোতেই চায় না। দোকানপাট আগে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকত, কিন্তু ক’দিন ধরেই দেখছি যে, পাঁচটা বাজার সঙ্গে-সঙ্গেই দোকানে-দোকানে ঝাঁপ পড়ে যায়। সন্ধের দিকে তো রাস্তাঘাট একেবারে খাঁখাঁ করতে থাকে। আগরওয়ালজিও সম্ভবত ভয় পেয়েছেন। এলে তো দোকান বন্ধ করে তারপর তাঁকে আসতে হয়। তাও নাহয় এলেন, কিন্তু ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেতে পারে। তার উপরে আবার সর্সোতিয়ার ধার দিয়ে ফিরতে হবে। খুব সম্ভব সেই কথা ভেবেই তিনি আসছেন না। কিন্তু তা না-ই আসুন, ফোন তো একটা করতে পারতেন। যা আমি জানতে চেয়েছিলুম, ফোনে সেটা জানিয়ে দিলেই তো মিটে যায়। 

ফোন অবশ্য আমিও করতে পারি। কিন্তু করলুম না। মনে হল, যাই, ভদ্রলোকের যখন এতই মৃত্যুভয়, তখন আমিই গিয়ে দেখা করে আসি। ব্যাপারটা আসলে আর কিছুই নয়, প্যালেসের রানি-মহলের জন্যে কিছু ফার্নিচার বানাবার কাজ চলছে। তার জন্যে ভাল-জাতের সিড সেগুন চাই। ঠিকমতো সিড না-হলে কিছুদিন পরেই কাঠ অল্পবিস্তর বেঁকে যায়। ছুতোরমিস্ত্রিদের ভাষায় ‘রেগে যায়’। যে-তক্তার দৈর্ঘ্য যত বেশি, তার রেগে যাওয়ার আশঙ্কাও তত বেশি। এদিকে দুখানা পালঙ্কের ফ্রেমের জন্যে বেশ লম্বা খানকয় প্ল্যাঙ্কের দরকার হচ্ছে; জোড়া-না-দেওয়া সিঙ্গল প্ল্যাঙ্ক চাই, কিন্তু রাগী কাঠ হলে চলবে না। তা সুরজপ্রসাদ আগরওয়ালের যেমন গয়নার দোকান রয়েছে, তেমনি আবার কাঠেরও তিনি মস্ত কারবারি। দিন দুই আগে তাই কথাটা তাঁকে জানিয়েছিলুম। জিজ্ঞেস করেছিলুম, সাইজমতো এইরকম কিছু তক্তা তিনি আমাদের দিতে পারবেন কি না। 

আগরওয়ালজি বুঝে গিয়েছিলেন যে, আমার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা চলে, তাতে তাঁর কোনও ক্ষতি হবার ভয় নেই। তাই হেসে বললেন, “দেখছেন তো, রাজবাড়ির ফার্নিচার, তাতেও এখুন আর বার্মা-টিকের খোঁজ হচ্ছে না, সি.পি.র সেগুন দিয়েই কাজ চলছে। তো বারিষ নেমে যাবার পরে তো আমি গয়নার দুকানে বসছি, স-মিলে বসছে আমার লেড়কা। তার কাছে খবর করব, স্টকে যদি সিজন-করা কিছু মাল থাকে তো আপনারা পেয়ে যাবেন।” 

মুরারির কথা শুনে মনে হল, আগরওয়ালজি বোধহয় তাই নিয়েই কিছু বলতে চান। হাতের কাজটা সেরে নিয়ে চারটে পঁয়ত্রিশ নাগাদ একটা সাইকেলে চেপে আমি প্যালেস থেকে বেরিয়ে পড়লুম। 

মার্কেট রোডে যখন পৌঁছলুম, তখনও পাঁচটা বাজতে মিনিট দুই-তিন বাকি। অথচ তারই মধ্যে দেখলুম, দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আগরওয়ালজিও তাঁর দোকানের সামনের স্টিলের শাটার নামিয়ে তাতে তালা লাগাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে শাটারটাকে আবার ঠেলে উপরে তুলে দিয়ে বললেন, “রাম রাম চাটার্জিসাব, আসুন, আসুন।” 

বলতে-বলতেই শাটারের পিছনের কোলাপসিবল গেটও তিনি খুলে ফেলেছিলেন। ফলে আমাকে দোকানের মধ্যে ঢুকতেই হল। আগরওয়ালজি ফ্যান চালিয়ে দিয়ে বললেন, “তারপর চাটার্জিসাব, খবর কী?” 

বললুম, “খবর তো আপনার কাছে। তা এত সকাল-সকাল দোকান বন্ধ করছিলেন যে?”

“আমি কি আর একা করছি?” আগরওয়ালজি ম্লান হেসে বললেন, “সবাই করছে। তো কাউকে দোষ দেবারও তো উপায় নেই। অবস্থা দেখছেন না? ব্যাবসা এবারে লাটে উঠবে।” 

“আরে না, দু’দিন যাক্, দেখবেন আবার সব নর্মাল হয়ে এসেছে। …ও হ্যাঁ, সেই কাঠের কী হল? “

“অত ভাল মাল আমার স্টকে নেই। লেড়কাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তা সে বলল, যে মাল আছে, তাতে গেরান্টি দিতে পারব না। তবে হ্যাঁ, মুলুকচাদজির স্টকে আছে, ওখানে একবার খবর করুন।” আরও দু-একটা কথার পরে উঠে পড়লুম। বললুম, “আপনিও তো বাড়ি যাবেন। চলুন, খানিকটা পথ একসঙ্গে যাওয়া যাক।” 

আগরওয়ালজি হেসে বললেন, “দুকান যখন ফের খুলেছি, তখন আরও দু-একটা কাজ সেরে তারপর যাব। আপনি এগোন চাটার্জিসাব।” 

দোকান থেকে বেরিয়ে দেখলুম, রাস্তায় একটাও লোক নেই। হাতঘড়ির দিকে তাকালুম। সওয়া পাঁচটা। এই সময়ে মার্কেট রোডে ভিড় জমে যায়। আজ একেবারে খাঁ-খাঁ করছে। 

একটা ব্যাপারে আমার ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। মুরারি বলল, আজ যখন তাকে কয়েকটা জিনিসের দাম জানবার জন্যে বাজারে পাঠাই, তখন মার্কেট রোডে আগরওয়ালজির সঙ্গে তার দেখা হয়। শুধু দেখা নয়, কথাও হয়েছিল। আগরওয়ালজিকে সে-কথা বলতে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, মুরারির সঙ্গে আজ কেন, গত এক হপ্তার মধ্যে তাঁর কথা হয়নি। মুরারি তা হলে অমন কথা কেন বলল? আজ তো দফতর ছুটি হয়ে গেছে, কাল তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। 

বাড়ি ফিরে ভাল করে স্নান করলুম। তারপর চা-বিস্কুট খেয়ে, চিঠি লিখলুম কয়েকটা। সর্সোতিয়ার ধারে যখন বেড়াতে বার হলুম, তখন সাড়ে ছটা। লছমির একটু জ্বরমতো হয়েছে, তাকে তাই সঙ্গে আনিনি। 

ভাদুড়িমশাই এলেন সাতটা নাগাদ। সর্সোতিয়ার ধারে আজকাল আর বিশেষ ভিড় জমতে দে না। ভ্রমণবিলাসীদের অনেকেরই উৎসাহে ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে। গোনাগুনতি আমরা ক’জন কয়েকটা বেঞ্চি দখল করে বসে থাকি। ভাদুড়িমশাই তাঁর সাইকেলটাকে একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আমার পাশে এসে বসলেন। ভদ্রলোককে একটু চিন্তিত মনে হল। কিন্তু তা নিয়ে কিছু বলবার ‘আগেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আজ আগরওয়ালজির গয়নার দোকানে গিয়েছিলেন?” 

“হ্যাঁ।” 

“কখন গিয়েছিলেন?”

“পাঁচটার সময়।” 

“সেখান থেকে কখন বেরিয়ে আসেন?”

“সওয়া পাঁচটায়। কেন, কী হয়েছে?” 

স্থির চোখে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়িমশাই, তারপর মৃদু গলায় বললেন, “সুরজপ্রসাদ আগরওয়াল হ্যাজ বিন মার্ডারড।” 

কথাটা শুনবামাত্র আমার হৃৎপিণ্ড যেন একটা লাফ মেরে হঠাৎ গলার মধ্যে এসে আটকে গেল। কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলুম না, তারপর অনেক কষ্টে বললুম, “সে কী!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ। স্কাল একেবারে স্ম্যান্ড। ভারী একটা পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। দোকানঘরের মধ্যেই সেটা পাওয়া গেছে। তবে কিনা রক্তমাখা পাথরটা পাওয়া গেছে বলেই যে তাতে খুনি। স্পিার-প্রিন্ট পাওয়া যাবে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। হাতে দস্তানা পরে যদি সে ওটা ব্যবহার করে থাকে, তো পাওয়া যাবে না।” 

“খুনটা কখন হল?” 

“পৌনে ছ’টায়। সেটা ফিক্স করা শক্ত হয়নি। তার কারণ, পাশের দোকান ওষুধের। এখানকার আইন তো জানেন, আর-সব দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও ওষুধের দোকান রাত আটটা পর্যন্ত এখানে খোলা রাখতেই হয়। আগরওয়ালজির চিৎকার শুনে ওষুধের দোকানের দুর্জন কর্মচারী তক্ষুনি ছুটে এসেছিল। তখন ঠিক পৌনে ছ’টাই বাজে। গয়নার দোকানের শাটার আর কোলপসিবল গেট খোলাই ছিল। কাঠের দরজাটাও ধাক্কা মারতেই খুলে যায়। অর্থাৎ সেটাও ভেজানো ছিল মাত্র, ভিতর থেকে তাতে খিল কিংবা ছিটকিনি দেওয়া ছিল না। ভিতরে ঢুকে তারা দেখতে পায় যে, আগরওয়ালজি মেঝের উপরে পড়ে আছেন। তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তারা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ আসে ছ’টা নাগাদ। আমিও সেইখান থেকেই আসছি।” 

বললুম, “চিৎকার শুনেই তো পাশের দোকানের লোকেরা ছুটে গিয়েছিল বলছেন, খুনি তা হলে পালাল কী করে?” 

‘পুলিশের ধারণা দোকানঘরের পিছন দিককার দরজা দিয়ে পালিয়েছে।” 

“পুলিশ কাউকে সন্দেহ করছে” 

সরাসরি আমার প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “মুশকিলটা কী হয়েছে জানেন কিরণবাবু, পাঁচটার সময় যে আপনি আগরওয়ালজির দোকানে ঢুকেছিলেন, পাশের দোকানের এই লোক দুটি তা দেখেছে, কিন্তু কখন আপনি বেরিয়ে আসেন, তা তারা দেখেনি। ফলে এখন পুলিশের ধারণা হয়েছে যে, ইউ ওয়্যার দি লাস্ট পার্সন টু সি হিম অ্যালাইভ।” 

“ওরা কি আমাকেই খুনি বলে সন্দেহ করছে নাকি?” 

“বিচিত্র নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দোকান থেকে বেশ কিছু গয়না নাকি লোপাট হয়েছে। সেটাকেই যদি মোটিভ হিসেবে দাঁড় করায় তো আমি অবাক হব না। কিন্তু একটা কথা ইতিমধ্যে আমার জানা দরকার। আজ পাঁচটার সময় আগরওয়ালজির কাছে আপনি গিয়েছিলেন কেন?” 

“মুরারিকে আজ দুপুরে বাজারে পাঠিয়েছিলুম। সে ফিরে এসে বলল, মার্কেট রোডে আগরওয়ালজির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তখন আগরওয়ালজি তাকে নাকি বলেন যে, আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কথা আছে, আমি যেন তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করি। কিন্তু মজা কী জানেন, পাঁচটার সময় আমি যখন তাঁর দোকানে গেলুম, তখন তিনি বললেন যে, মুরারির সঙ্গে তাঁর অমন কোনও কথা হয়নি।” 

“তাই?” ভাদুড়িমশাই তীব্র চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই তাঁর দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। বললেন, “পুলিশের কথা শুনে মনে হল, দে উইল গেট ইন টাচ উইথ ইউ।” 

“কী বলব তাদের?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এটা কি একটা প্রশ্ন হল? যা সত্যি, তাই-ই বলবেন। …নিন, এবারে বাড়ি যান, আর রাত করবেন না।” 

বাড়িতে ফিরে মিশ্রজিকে জানালুম কী হয়েছে। তিনি স্থির হয়ে সব শুনলেন, কিন্তু কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন, “দোষ যখন তোর নয়, তখন ভয় পান না বেটা, সব ঠিক হয়ে যাবে।” 

পরদিন দফতরে গিয়ে মুরারির দেখা পাওয়া গেল না। এগারোটা নাগাদ নারায়ণ ভার্মা এসে জানালেন যে, মুরারি অসুস্থ, দফতর থেকেই জ্বর নিয়ে কাল বাড়ি ফিরেছিল, দিন পাঁচ-সাতের মধ্যে যে কাজে আসতে পারবে, এমন সম্ভাবনা নেই। 

একটার সময় লাঞ্চ ব্রেক। খাতা-পত্তর গুছিয়ে রেখে উঠবার উপক্রম করছি, এমন সময় বেয়ারা এসে খবর দিল, দেওয়ানজি ডেকে পাঠিয়েছেন। কপুরসাহেবের ঘরে ঢুকতে তিনি বসতে বললেন। তারপরই প্রশ্ন করলেন, “কী ব্যাপার বলুন তো, পুলিশ আপনার খোঁজ করছে কেন?” 

কাল দুপুর থেকে যা-যা হয়েছে, কোনও কথাই বাদ দিলুম না। কপুরসাহেব সব শুনলেন। তারপর বললেন, “অর্জুন প্রসাদকে কে তাতাচ্ছে, তা আমার জানা নেই। মুরারিও হতে পারে, আর-কেউও হতে পারে। তবে অর্জুন যা ‘লল, তাতে এটা বোঝা শক্ত নয় যে, একটা মিথ্যে-মামলায় সে আপনাকে জড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না। অর্জুন যদি আপনাকে অকারণে হ্যারাস করে, তো আই ওন্ট টেক ইট লায়িং ডাউন। আমার লোকের গায়ে হাত দিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ এখানে নিস্তার পায়নি। অর্জুনও পাবে না। আই শ্যাল কাট হিম ডাউন টু হিজ প্রপার সাইজ।” 

থানার লোক এল বিকেলবেলায়। বাড়িতে ফিরে স্নান করে, চা খেয়ে, সদ্য একটা থ্রিলার নিয়ে ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিয়েছি, দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে চিনতে অসুবিধে হল না। সর্সোতিয়ার ধারে সেদিন অর্জুন প্রসাদের যে দুই অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখেছিলুম, তাঁদেরই একজন। 

ঘণ্টাখানেক ধরে তিনি আমাকে জেরা করলেন। প্রথম দিকে সবই মামুলি প্রশ্ন। আগে কোথায় ছিলুম, কী কাজ করতুম, বিষাণগড়ে কবে এসেছি, সুরজপ্রসাদ আগরওয়ালের সঙ্গে কবে থেকে আলাপ, তাঁর কাছে কাল কেন গিয়েছিলুম ইত্যাদি। প্রসঙ্গত মুরারিরও কথা উঠল। তারই কথায় যে আমি আগরওয়ালজির সঙ্গে দেখা করতে যাই, তাও জানিয়ে দিলুম। দেখলুম, তাঁর প্রশ্নের উত্তরে যা-যা বলছি, সবই তিনি একটা খাতায় টুকে নিচ্ছেন। একসময়ে তিনি খাতাটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একেবারে আচমকা যে প্রশ্নটা করলেন আমাকে, তাতে আমার মাথাটা একেবারে ঝিমঝিম করে উঠল। 

“গয়নাগুলো কোথায় রেখেছেন?” 

কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, “কীসের গয়না?” 

পুলিশ অফিসারটি চতুর হেসে বললেন, “দেখুন মিঃ চ্যাটার্জি, বোকা সেজে আপনি পার পাবেন না। আগরওয়ালজির দোকান থেকে কাল যা-যা আপনি সরিয়েছেন, তার সবই আমরা খুঁজে বার করব।” 

তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত। জুলাই মাসের ক’টা দিন যে কীভাবে কাটল তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। রোজই পুলিশ আসে, রোজই চেষ্টা করে আমাকে দিয়ে খুনের কথাটা স্বীকার করিয়ে নিতে। তার উপরে আবার সাত তারিখে যে পুলিশ অফিসারটি এসেছিলেন, তাঁর কাছে শুনলুম, মুরারি নাকি থানায় গিয়ে লিখিতভাবে জানিয়ে এসেছে যে, সুরজপ্রসাদ আগরওয়াল আমাকে দেখা করতে বলেছেন, দোসরা জুলাই তারিখে এমন কথা সে আমাকে বলেনি। 

আট তারিখে দফতরে বসে কাজ করছি, এমন সময় ভাদুড়িমশাইয়ের ফোন এল। “লিভ্ দ্য প্যালেস ইমিডিয়েটলি অ্যান্ড গো টু ডঃ সিদ্দিকি’জ হাউস।” 

চারটে বাজে। খাতাপত্র আলমারিতে তুলে রেখে দফতর থেকে বেরিয়ে পড়লুম। 

ডঃ সিদ্দিকির বাড়িতে পৌঁছে বোঝা গেল, আমার জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। গেস্ট-হাউসের পাশের বাড়িটাই ডঃ সিদ্দিকির। সামনে বাগান। বাগানের পিছনে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। ডঃ সিদ্দিকি তাঁর একতলার বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “ভিতরে আসুন।” 

এ-বাড়িতে আগেও বার কয়েক এসেছি। একতলায় কেউ থাকে না। সামনে ড্রইং রুম, পিছনে লাইব্রেরি। ভদ্রলোক আমাকে তাঁর লাইব্রেরি-রুমে নিয়ে বসালেন। বললেন, “আপনি যে এখানে এসেছেন, তা কেউ জানে না তো?” 

“না। কাউকে কিছু বলিনি।” 

“এই বাড়িতে ঢুকবার সময় কেউ দেখেওনি আপনাকে?” 

“না।” 

“আর ইউ শিওর?” 

“অ্যাবসলুটলি। পথ একেবারে ফাঁকা ছিল।” 

মনে হল, ভদ্রলোক এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, “আপনাকে এখন ঘণ্টা কয়েক এখানেই থাকতে হবে। ঘর ছেড়ে বাইরে যাবেন না, নিষেধ আছে। মিঃ ভাদুড়ি ন’টার আগে আসবেন না। আপনি বসে-বসে বই পড়ুন। খানকয় ম্যাগাজিন রয়েছে, তাও দেখতে পারেন। উপরে গিয়ে আমি আপনার চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।” 

কেন যে ভাদুড়িমশাই এখানে আসতে বললেন আমাকে, বুঝে উঠতে পারছিলুম না। চতুর্দিকে অজস্র বই। তার মধ্যে কল্হণের রাজতরঙ্গিণীর যে তর্জমা সার্ মার্ক অরেল স্টাইন করেছিলেন, সেটাও চোখে পড়ল। বইখানা টেনে নিয়ে পড়তে বসে গেলুম। 

চা এল। আটটা নাগাদ এসে গেল রাতের খাবারও। এইটুকু শুধু বুঝতে পারছিলুম যে, একটা কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই ঘটেছে, কিন্তু সেটা যে কী, অনেক ভেবেও তার কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিলুম না। ডঃ সিদ্দিকি এর মধ্যে একবার লাইব্রেরি-রুমে এসেছিলেন। বললেন, “রোজই তো একবার সর্সোতিয়ার ধারে হাঁটতে যাই। আজও তাই যাওয়া দরকার। নইলে লোকের মনে সন্দেহ হবে হয়তো।” 

বললুম, “ব্যাপারটা কী বলুন দেখি।” 

ডঃ সিদ্দিকি আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দিলেন না। সামান্য হাসলেন মাত্র। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

ভাদুড়িমশাই এলেন সওয়া ন’টায়। হাতে ছোট একটা সুটকেস। বললেন, “একা একা হাঁফিয়ে উঠেছেন বুঝি?” 

বললুম, “সেটা কি খুব অস্বাভাবিক? কিন্তু ব্যাপারটা কী?” 

“ব্যাপার আর কিছুই নয়, আপনার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেছে। অর্জুন প্রসাদের লোকেরা পাঁচটা নাগাদ প্যালেসে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই তো আপনি প্যালেস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তাই সেখানে আপনাকে পায়নি। তারা এখন চতুর্দিকে একেবারে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আপনাকে।” 

“আপনি জানতেন যে, আজ অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বেরুবে?” 

“জানতুম বই কি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওয়ারেন্ট যে মোটামুটি সাড়ে-চারটের সময় সই হবে, তাও জানতুম। অবাক হচ্ছেন কেন? থানাতেও আমার লোক আছে না? সে-ই জানিয়ে দিয়েছিল। আসলে মুরারি কাল থানায় গিয়ে ওই যে স্টেটমেন্ট দিয়ে এল, তখনই ঠিক করা হয় যে, আজ আপনাকে গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু সে-কথা যাক, গেস্ট-হাউসটা আজ আমাদের কোম্পানির নামে বুক্ড থাকবার কথা। সেটা ঠিক আছে তো?” 

“তা আছে।” 

“চমৎকার। তা হলে আরও ঘণ্টাখানেক আপনি বইপত্তর পড়ুন। মোটামুটি সাড়ে দশটায় আমরা গেস্ট-হাউসে গিয়ে ঢুকব।” 

বইপত্তরে মন বসাব, এমন অবস্থা তখন আমার নয়। তা ছাড়া, পুলিশের হাত থেকে অন্তত আজকের রাত্রিটার জন্যে যে ভাদুড়িমশাই আমকে দূরে রাখতে চান, সেটা বুঝতে পারলেও একটা অস্বস্তির কাঁটা আমার মনের মধ্যে খচখচ করছিল। ভাবছিলুম যে, মিশ্রজিকে তো আমি কিছুই বলে আসিনি, তিনি কী ভাবছেন! একে তো পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করবার জন্যে সেখানে গিয়েছিল, তাতেই তিনি ঘাবড়ে গিয়েছেন নিশ্চয়, তার উপরে যদি আবার রাত্তিরে না ফিরি, তো তাঁর উদ্বেগের সীমা থাকবে না। তাঁকে একটা খবর দিতে পারলে হত। 

ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি হেসে বললেন, “কে বলল খবর দেওয়া হয়নি! আপনি যে আজ রাত্তিরে আপনার কোয়ার্টার্সে ফিরবেন না, চাই কী কয়েকটা দিনই এখন না-ফিরতে পারেন, তা তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” 

“কে জানাল? আপনি?” 

“আমি কেন জানাতে যাব? আপনাকে তো আগেই বলেছি, প্যালেসেও আমাদের লোক আছে। সে-ই জানিয়েছে।” 

“লোকটা কে বলুন তো?” 

“তা জেনে আপনার কী চতুর্বর্গ লাভ হবে? আপাতত শুধু এইটুকু জেনে রাখুন যে, কাম্বারল্যান্ড ইনসিওরেন্স এখানে মোটা টাকার কাজ-কারবার করে। তা সেই কাজে যাতে কেউ বাগড়া দিতে না পারে, তার জন্যে সর্ব ঘাঁটিতেই কিছু-না কিছু লোককে তাদের হাতে রাখতে হয়। তেমন লোক প্যালেসে আছে, থানায় আছে, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টেও আছে। যা আমাদের জানা দরকার, তারাই তা জানিয়ে দেয়, আর তার জন্যে টাকাও পায় নিয়মিত। আপনাদের তো অর্থবল কম, তাই আর্মি মেনটেন করেন না। কিন্তু তা যদি করতেন, তো সেখানেও কাম্বারল্যান্ড কোম্পানির লোক থাকত। আর-কিছু জানতে চান?” 

ক্লিষ্ট হেসে বললুম, “না। যা বলেছেন, তা-ই যথেষ্ট। কিন্তু একটা কথা ভাবছি। এই যে আটুই জুলাইয়ের জন্যে গেস্ট হাউসটা আপনি বুক করতে বলেছিলেন, তখনই কি আপনি জানতেন যে, ঠিক আজই আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে?” 

“না, তা জানতুম না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওটা একটা কোইনসিডেন্স। তবে কিনা তাতে আপনার ভালই হল, অন্তত আজ রাত্তিরের জন্য দিব্যি আপনি ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবেন।” 

বললুম, “সে না হয় আজকের জন্যে একটা ব্যবস্থা হল। কাল কী হবে?” 

“কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। উই শ্যাল ক্রস দ্যাট ব্রিজ হোয়েন উই কাম টু ইট। আপাতত ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। উপায় একটা হবেই। … একটা কথা বলুন দেখি, এই যে গত কয়েকদিন ধরে পুলিশ রোজ প্যালেসে গিয়ে আপনাকে জেরা করছে, এতে ওখানকার রিঅ্যাকশানটা কী?” 

“সে আমি কী করে বলব, মুখে তো সবাই ‘আহা উহু’ করছে, কিন্তু সহানুভূতিটা সত্যি কি না কে জানে। এই ক’মাসে কম লোককে তো চটাইনি। সবচেয়ে বেশি চটিয়েছি এস্টেট ম্যানেজারকে। যে-ক’জন সাপ্লায়ারের কাছ থেকে তিনি মাল নিচ্ছিলেন, প্রতিটি আইটেমে তারা বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দাম নিত। তাদের আমি ভাগিয়ে দিয়েছি। ফলে তিনি এখন মহা খাপ্পা। তবে হ্যাঁ, এস্টেট-ম্যানেজারের পেটোয়া লোকদের ভাগিয়ে আমি যে নতুন জনাকয় সাপ্লায়ারের কাছ থেকে মাল নিতে চাই, দেওয়ানজি তা শুনে একটুও অখুশি হননি। যেভাবে আমি খৰ্চা কমাচ্ছি, তিনি বরং তার প্রশংসাই করলেন।” 

“বটে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ তো খুবই ভাল কথা। তা আপনার পিছনে যে পুলিশ লেগেছে, তা নিয়ে তিনি বললেন কিছু?” 

“তাও বললেন বই কী। বললেন, অর্জুন প্রসাদ যদি আমাকে মিথ্যে একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে দেয় তো তিনিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না, তাকে তিনি শায়েস্তা করে ছাড়বেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, এ তো আরও ভাল খবর। সার ত্রিবিক্রিম কপুর যখন আপনার পাশে রয়েছেন, তখন আর আপনার ভাবনা কী। রাইট নাউ হি হিজ দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল ম্যান ইন বিষাণগড়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কিরণবাবু, স্বয়ং দেওয়ানজি যে আপনার সহায়, পুলিশ তা নিশ্চয় জানে না, জানবামাত্র তারা লেজ গুটিয়ে পালাবে।” 

ঠিক এই সময়েই ডঃ সিদ্দিকি এসে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, “সাড়ে দশটা বাজে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “গেস্ট হাউসের খবর কী?” 

ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “দোতলা থেকে সেটাই তো দেখছিলুম। ন’টার মধ্যে ওখানে সমস্ত ঘরের আলো নিভে গেছে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স, দরোয়ানের ঘর, সব অন্ধকার। সবাই ঘুমোচ্ছে, মনে হয়।”

“ঘুমটা আর-একটু পাকুক। আমি এগারোটা নাগাদ গেস্ট-হাউসে ঢুকব। তখন দরোয়ান এসে গেট খুলে দিলেও অন্যদের ঘুম আশা করি ভাঙবে না। তবে আমি যদিও গেট দিয়ে ঢুকব, মিঃ চ্যাটার্জি ঢুকবেন পাঁচিল ডিঙিয়ে।” 

আমার মুখে সম্ভবত একটু উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। ডঃ সিদ্দিকি সেটা লক্ষ করে থাকবেন। বললেন, “ভয়ের কিছু নেই, উই হ্যাভ এ কমন বাউন্ডারি-ওয়াল, পিছনের দিকে সেটা তেমন উঁচু নয়, সহজেই আপনি সেটাকে টপকে ওদিকে চলে যেতে পারবেন। মোট কথা, সামনের গেট দিয়ে আপনার ঢোকা চলবে না। আপনার নামে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, দরোয়ানও হয়তো সেটা জানে। সে যদি আপনাকে চিনে ফেলে তো বিপদ হবে।” 

আমি আর কথা বাড়ালুম না। গেস্ট-হাউস বুকিংয়ের কাগজটা সঙ্গেই ছিল, সেটা ভাদুড়িমশাইকে দিয়ে বললুম, “দরোয়ান আপনাকে চেনে, বুকিংয়ের কাগজ-টাগজ তাই হয়তো দেখতে চাইবে না, তবু ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী, এটা সঙ্গে রাখুন।” 

কাগজখানা পকেটে রেখে, স্যুটকেস হাতে নিয়ে, সামনের দরজা দিয়ে ভাদুড়িমশাই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, “কিরণবাবু, একটা কথা মনে রাখুন। ডঃ সিদ্দিকির সঙ্গে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে পাঁচিলের ধারে আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন। গেস্ট হাউসের সামনে আমি আমার গাড়ির হর্ন বাজাব, তারপর গেটে যে কলিং বেল রয়েছে, সেটাই টিপব। ওদিক থেকে আপনি খেয়াল রাখবেন দরোয়ান কখন এসে গেট খুলে দেয়। যখন গেট খুলবে, আপনি তার শব্দ শুনতে পাবেন। ধরে নিতে পারেন, বাড়ির পিছন দিকে তখন তার নজর থাকবে না। ঠিক তখনই পাঁচিল টপকে গেস্ট হাউসের কম্পাউন্ডের মধ্যে লাফিয়ে পড়বেন। বৃষ্টি হওয়ায় মাটি ভিজে রয়েছে, সুতরাং আপনি লাফিয়ে পড়লেও শব্দ হবার ভয় নেই।” 

“লাফিয়ে পড়ে তারপর আমি কী করব?” 

“কিচ্ছু করতে হবে না। গেস্ট-হাউসের পিছন-দিককার জমিতে কম্পাউন্ড-ওয়ালের ধারে, ঝুপসি-মতো কয়েকটা গাছ রয়েছে। তারই কোনও-একটার আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবেন। ধরে নিচ্ছি, দরোয়ানের ফের ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হবে না। ওইটুকু সময় আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।” 

“তারপর?” 

“গেস্ট-হাউসের পিছনেই রয়েছে লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি। বাথরুম পরিষ্কার করবার জন্য জমাদাররা ওই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠে। বাইরের যে দরজা দিয়ে তারা দোতলার বাথরুমে ঢোকে, সেটা আমি ভিতর থেকে খুলে রাখব। তা হলে আর অসুবিধে কী, আমি গিয়ে গেস্ট-হাউসে ঢুকবার মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে ওই স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে আপনি দোতলায় উঠে আসবেন।” 

ভাদুড়িমশাই বেরিয়ে গেলেন। ডঃ সিদ্দিকি তাঁর বাড়ির পিছন-দিকে নিয়ে গেলেন আমাকে। কম্পাউড-ওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার একটু বাদেই শুনতে পেলুম গাড়ির হর্ন। কলিং বেলও প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বেজে উঠল। তারও মিনিট খানেক পরে যে শব্দটা শোনা গেল, তাতে বুঝতে পারলুম যে, গেস্ট-হাউসের লোহার গেটটা খুলে দেওয়া হচ্ছে। পরক্ষণেই আমি পাঁচিল টপকে গেস্ট-হাউসের কম্পাউন্ডের মধ্যে লাফিয়ে পড়লুম। নরম মাটি, কোনও শব্দ হল না। 

কাজগুলি হয়ে যাচ্ছিল একেবারে ঘড়ির কাঁটার মতো। গেস্ট-হাউসের একতলায় আর দোতলায় কয়েকটা আলো জ্বলে উঠেছিল, তারপরে আবার নিভেও গিয়েছিল খানিক বাদে। গোটা বাড়িটা একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবার পরেও মিনিট দশ-পনেরো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম আমি। তারপর যখন মনে হল যে, কেউ আর কোথাও জেগে নেই, তখন গাছের আড়াল থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পড়লুম। 

বাথরুমের বাইরের দিকের দরজাটা ভাদুড়িমশাই খুলে রেখেছিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখলুম, হাতে একটা পেনসিল-টর্চ নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে অাছেন। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, “অলো জ্বালবেন না। দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকুন ‘ চান তো একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন।” 

“আপনি ঘুমোবেন না?”

“আমাকে এখুনি আবার বেরুতে হবে।” 

“কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই রহস্যময় হাসলেন। বললেন, “সর্সোতিয়ার ধারে। বলেছিলুম না রাত জেগে আজ সর্সোতিয়ার বাহার দেখব? তা সেটা একেবারে নদীর ধারে বসে দেখতে চাইছি। বাস্, এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন নয়। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। বাইরে যা-ই ঘটুক, ঘর থেকে বেরুবেন না। এমনকি, বারান্দাতেও যাবেন না। নিন, শুয়ে পন।” 

স্যুটকেস থেকে ছাইরঙের একটা ম্যাকিনটশ বার করে সেটা গায়ে চাপিয়ে নিঃশব্দে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেডিয়াম-লাগানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, বারোটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। 

শুয়ে ছিলুম। কিন্তু ওই অবস্থায় কি কারও ঘুম আসা সম্ভব? ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে লাগলুম। ভাবতে লাগলুম বাবা-মা আর ভাইবোনের কথা। মিশ্রজি, লছমি আর যমুনাদিদির কথা। রানি-মা, পামেলা আর কুলদীপের কথা। সার ত্রিবিক্রম কপুরের কথা। একমাত্র তিনিই পারেন এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে। ষড়যন্ত্র যে একটা চলছে, তাতে তো আর সন্দেহ নেই। তা নইলে আর মুরারি ওই মিথ্যে স্টেটমেন্ট দেবে কেন? কিন্তু মুরারির স্টেটমেন্ট যে মিথ্যে, দেওয়ানজি কি তা জানেন? 

ভাদুড়িমশাই-ই বা পুলিশকে মিথ্যে কথা বলতে গেলেন কেন? কেন বললেন যে, ২৮ জুন তারিখের ভোরবেলায় তিনি সর্সোতিয়ার ধারে যে-তিনজন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন তখনও বেঁচে ছিল? মরবার আগে সে যে দু-একটা কথা বলে গিয়েছিল তাঁকে, তাও তো মিথ্যে। নাকি মিথ্যে নয়? সত্যিই সে ওইসব কথা বলেছিল নাকি? যা বলেছিল, অন্তত যা বলেছিল বলে পুলিশকে ভাদুড়িমশাই জানিয়েছেন, তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ‘হলদে পাথর… দশ দিন বাদে আবার আসবে … এই খানে… মাঝরাত্তিরে … মরবে … বারণ করো’। 

হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মাথায়। আঠাশে জুন লোকটা বলেছিল ‘দশ দিন বাদে আবার আসবে’। আজ আটুই জুলাই। তার মানে তো সে আজকের কথাই বলেছিল। কিন্তু কে আসবে? কে মরবে? কাকে বারণ করা হবে? 

আর শুয়ে থাকতে পারলুম না। ভাদুড়িমশাই বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু তখন আর কোনও নিষেধ মান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানা থেকে নেমে, দরজা খুলে, নিঃশব্দে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। 

২১

গেস্ট-হাউসের দোতলার বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। নীচে ড্রাইভওয়ে, তার দু’পাশে লন। যে গেট দিয়ে এই বাড়িতে ঢুকতে হয়, সেটা খোলা। গেটের সামনে প্যালেস রোড। রাস্তার এদিকে, এই গেস্ট-হাউসের মতো পরপর কয়েকটা বাগানওয়ালা বাড়ি। বাঁ দিকে ডঃ সিদ্দিকির বাড়ির দোতলার একটা ঘরে এতক্ষণ আলো জ্বলছিল, একটু আগে নিবেছে। ডাইনে যমুনাপ্রসাদ উপাধ্যায়ের বাংলো। বাড়িটা সেই সন্ধে থেকেই অন্ধকার। ভদ্রলোক সম্ভবত তাঁর ছেলের কাছে ফিরে গেছেন। 

প্যালেস রোডের ওদিকে একটাও বাড়ি নেই। গোটাকয়েক ঝুপড়িমতো দোকানঘর ছিল, পানবিড়ি সিগারেটের দোকান, ক’দিন আগে পুলিশের লোকেরা এসে সেগুলো ভেঙে দিয়েছে। ফলে রাস্তার একটা ধার এখন একেবারে ফাঁকা। শুধু সারি-সারি কিছু গাছ আর দূরে-দূরে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট যেমন এদিকে, তেমন ওদিকেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এখন শুক্লপক্ষ, তাই ল্যাম্পপোস্টের মাথায় আলো জ্বলছে না। চাঁদ উঠেছে, কিন্তু আকাশটা মেঘলা, তাই জ্যোৎস্নার তেমন জোর নেই। 

মেঘ অবশ্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে না, ঝোড়ো হাওয়ায় যেমন মুখের আঁচল সরে যায়, ঠিক তেমনি চাঁদের মুখের উপর থেকে মেঘ মাঝে-মাঝে সরে যাচ্ছে। যখন সরে যায়, চাঁদটা তখন হঠাৎ আর-একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জ্যোৎস্নারও জোর বেড়ে যায় অনেকখানি। তাতে রাস্তার ওদিকটা খানিক স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে। বোঝা যায়, রাস্তার ও-ধারের খানিকটা জমি সমতল, কিন্তু তারপরেই সেই জমি হঠাৎ ঢালু হয়ে নীচে নেমেছে। জমির শেষে একটা নদীর চিকচিকে জল আর নদীর পাড়ের ঝুপসি একটা গাছও তখন স্পষ্ট দেখা যায়। একটু নজর করে দেখলে এটাও তখন বোঝা যায় যে, গাছের নীচে নদীর দিকে মুখ করে একটি মানুষ একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

মানুষটি যে ভাদুড়িমশাই, তা আমি জানি। খানিক আগে, রাত বারোটা নাগাদ, এই গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে তিনি সর্সোতিয়া নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পুলিশ যে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, তা আমি জানি। কিন্তু তবু, ঝুঁকি আছে জেনেও, আমি তাঁর সঙ্গে যেতে চেয়েছিলুম। তিনি নেননি। এমনকি, বারান্দায় এসে দাঁড়াতেও তিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ঘর থেকে বার না-হওয়াই ভাল। যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসছেন, ততক্ষণ যেন আমি ঘরের মধ্যেই চুপচাপ শুয়ে থাকি। তা আধ ঘণ্টার মতো তা আমি ছিলুমও। কিন্তু তারপরে আর পারিনি। উদ্বেগ আর কৌতূহল এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, বুঝবার জন্যে বিছানা ছেড়ে পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। 

তা এখানেও প্রায় আধঘণ্টা আমি দাঁড়িয়ে আছি। হাতঘড়ির রেডিয়াম-ডায়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত একটা বাজতে পাঁচ। চারদিক একেবারে স্তব্ধ। শুধু গাছপালার ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাওয়ার ঝর্ঝর্ শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ কোথাও নেই। চাঁদটা আবার মেঘের আঁচলে মুখ ঢেকেছে। তাই ভাল করে এখন আর কিছু ঠাহরও করা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতেই একটা সময় মনে হল যে, ভাদুড়িমশাই যা-ই ভেবে থাকুন, আজ আর কিছু ঘটবে না। তা হলে আর এইভাবে রাত জেগে লাভ কী? এমনও একবার ভাবলুম যে, ঢের হয়েছে, আর নয়, এবারে নীচে নেমে যাই, রাস্তাটা পার হয়ে ভাদুড়িমশাইকে গিয়ে বলি, ও-সব নদীর বাহার-টাহার দেখা যে স্রেফ বাজে কথা তা আমি জানি; কেউ আসবে না, লোকটা স্রেফ প্রলাপ বকছিল; চলুন, উপরে গিয়ে শুয়ে পড়া যাক। 

ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘটা আবার সরে গেল। আর চোখ ফিরিয়ে নদীর দিকে তাকানো মাত্র আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, ঢালু জমি বেয়ে আর-একটা লোক নদীর দিকে নেমে যাচ্ছে। ভাদুড়িমশাইকেও চোখে পড়ল। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনও ঠিক সেইভাবেই তিনি—একেবারে নিষ্প্রাণ একটা মূর্তির মতো—নদীর দিকে চোখ রেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনের লোকটিকে তিনি দেখতে পাননি। 

একবার ভাবলুম, চেঁচিয়ে উঠি। কিন্তু গলা দিয়ে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ পর্যন্ত বার হল না। তা হলে কি ছুটে নীচে নেমে যাব? কিন্তু নড়তে গিয়ে মনে হল, আমার পা দুখানাকে কেউ গজাল ঠুকে মেঝের সঙ্গে আটকে রেখেছে। বুঝতে পারলুম না, যা দেখছি তা সত্যি, নাকি ভয়ঙ্কর কোনও দুঃস্বপ্ন! 

কালো আংরাখায় সর্বাঙ্গ ঢাকা, লোকটি ওদিকে নিঃশব্দে নামছে। ভাদুড়িমশাই আর তার মধ্যে ব্যবধান যখন বড়জোর হাত দুয়েকের, তখন আর সে এগোল না। দাঁড়িয়ে গিয়ে আংরাখার ভিতর থেকে তার ডান হাতখানা বার করে আনল। জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করে উঠল একটা ছোরার ফলা। 

ছোরাটা কিন্তু নেমে এল না। তার আগেই, ধাতুতে-ধাতুতে ঠোকাঠুকি হলে যেমন হয়, সেইরকম, কিন্তু তার চেয়ে অনেক জোরালো, শব্দ হল একটা, আর একই সঙ্গে দেখতে পেলুম যে, আংরাখায়-ঢাকা লোকটার হাতের ছোরা তার হাত থেকে উড়ে গিয়ে বেশ কিছুটা দূরে, ঘাসজমির উপরে ছিটকে পড়ল। 

নদীর দিকে মুখ করে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, ততক্ষণে তিনিও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এ কী, তিনি তো ভাদুড়িমশাই নন, তিনি ডঃ সিদ্দিকি। ভাদুড়িমশাই তা হলে কোথায় গেলেন?

হঠাৎই স্বর ফুটল আমার গলায়। চিৎকার করে উঠলুম, “ভাদুড়িমশাই!” আমার সেই বিমূঢ় অবস্থাটা ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। তা নইলে আর এক-এক লাফে সিঁড়ির তিনটে-চারটে ধাপ টপ্‌কিয়ে নীচে নামলুম কী করে, আর এক ছুটে রাস্তা পেরিয়ে ডঃ সিদ্দিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোই বা কী করে সম্ভব হল? 

অন্য আর কোনও দিকেই আমার তখন খেয়াল ছিল না। দু’হাতে ডঃ সিদ্দিকিকে আঁকড়ে ধরে বিকৃত গলায় বললুম, “ভাদুড়িমশাই কোথায়?”

“এই তো আমি!” 

চমকে বাঁ দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলম, কিছু-একটা জিনিসকে হাতে নিয়ে, ঘাসের উপর দিয়ে ভাদুড়িমশাই এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, “সেই ছোরাটা। রুমালে জড়িয়ে তুলে এনেছি। আমাদের কারও আঙুলের ছাপ এতে না-থাকাই ভাল।” 

বললুম, “ছোরাটা যার, আলখাল্লা-পরা সেই লোকটা কোথায়?”

“ওই তো আমার পিছন-দিকে। কেন, দেখতে পাননি?” 

দেখব কী, উপর থেকে যখন ছুটে নেমে আসি, তখন কি আর কোনও জ্ঞানগম্যি ছিল আমার! যাঁকে ভাদুড়িমশাই ভেবেছিলুম, আসলে তিনি যে ডঃ সিদ্দিকি, এইটে দেখেই এত বিভ্ৰান্ত বোধ করেছিলুম যে, নজর করে সবকিছু দেখবার মতো অবস্থাই তখন আমার ছিল না। 

এবারে পিছন ফিরে দেখলুম, হাত কয়েক দূরে আলখাল্লা-পরা সেই লোকটা সটান ঘাসের উপরে পড়ে আছে। তার মুখও দেখলুম কালো কাপড়ে ঢাকা। 

বললুম, “লোকটা কি মরে গেছে?” 

“আরে না মশাই, হাতের ছোরাটা ছিটকে যাওয়ায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল; তো সেই অবস্থায় আর খুব-একটা দাওয়াই দেবার দরকার হয়নি, পিছন থেকে ছুটে এসে মাথার উপর রিভলভারের বাট দিয়ে একটা ঘা মারতেই বাবুমশাই অজ্ঞান হয়ে গেলেন।” 

“কোত্থেকে ছুটে এলেন আপনি?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমার কথা গেরাহ্যি না করে তো দিব্যি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন, আর আমি যে সারাক্ষণ কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলুম, সেটাই আপনার চোখে পড়ল না? আমি তো রাস্তার এ-দিকে আসিইনি, ডঃ সিদ্দিকিকে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে তারপর গেস্ট-হাউসেরই গেটের পিলারের পিছনে দাঁড়িয়ে ওঁর উপরে নজর রাখছিলুম। তা গুলি চালিয়ে ছোরাটাকে কী রকম উড়িয়ে দিলুম, সেটা দেখলেন তো?” 

ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “ভাগ্যিস মেঘ কেটে গিয়ে জ্যোৎস্নার জোরটা তখন বেড়ে গিয়েছিল, নইলে ও-গুলি ছোরায় লাগত না অমার মাথায় লাগত, তার ঠিক কী! বাপ রে, ভাবতে এখনও আমার বুক কাঁপছে!” 

বললুম, “খুব জোরে ঠন করে একটা শব্দ হল, সেটা শুনেছিলুম, কিন্তু গুলির শব্দ তো পাইনি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করে পাবেন। রিফ্লভারে সাইলেন্সার লাগানো রয়েছে না?”

কথা বলতে-বলতেই তাঁর স্যুটকেস খুনে রুমালে জড়ানো ছোরাটা তার মধ্যে রেখে দিলেন ভাদুড়িমশাই। ম্যাকিনটশের পকেট থেকে রিভলভারটাও বার করেছিলেন, কিন্তু কী যেন ভেবে নিয়ে সেটা আর স্যুটকেসে ঢোকালেন না। সেটা পকেটে পুরে স্যুটকেস বন্ধ করলেন। তারপর মাটিতে পড়ে-থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর দেরি করা ঠিক নয়, একটু বাদেই এঁর জ্ঞান ফিরে আসবে। এবারে এঁকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া যাক। কিরণবাবু যা হল্লা জুড়ে দিয়েছিলেন, কেউ কিছু না টের পেয়ে থাকলে বাঁচি।” 

ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “চলুন। আমার লাইব্রেরি-ঘর তো খোলাই আছে। এ-ভদ্রলোক আমার বাড়িতে কখনও ঢোকেননি, তাই জ্ঞান ফিরলেও বুঝতে পারবেন না যে, কোথায় এসেছেন।” 

“বাড়ির লোকজনেরা ভয় পেয়ে যাবেন না তো?” 

“লোক থাকলে তো ভয় পাবে।” ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “কেউ নেই। থাকবার মধ্যে গিন্নি ছিলেন, তো তিনি এখন দেরাদুনে তাঁর মেয়ের কাছে আছেন। কাজের লোকদেরও দুপুরের পরেই আজ ছুটি করে দিয়েছি।” 

“বাঃ, তা হলে তো ভালই হল। চলুন, তা হলে আপনার বাড়িতেই যাওয়া যাক।” ঘাসের উপর থেকে অজ্ঞান মানুষটিকে ভাদুড়িমশাই তাঁর কাঁধে তুলে নিলেন। তারপর স্যুটকেসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আসুন।” 

ডঃ সিদ্দিকির লাইব্রেরি-ঘরে একটা ডিভানের উপরে মানুষটিকে শুইয়ে দেওয়া হল। আমার পক্ষে আর কৌতূহল চেপে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ডঃ সিদ্দিকিকে জিজ্ঞেস করলুম, “কে লোকটা?”

খুব নিচু গলায় প্রশ্নটা করেছিলুম, কিন্তু ভাদুড়িমশাই তবু শুনতে পেয়ে গেলেন। মুখ না-ফিরিয়ে বললেন, “জিজ্ঞেস করবার দরকার কী, নিজের চোখেই দেখুন।” 

এক ঝটকায় লোকটির মুখের কাপড় সরিয়ে দিলেন ভাদুড়িমশাই। আর মুখখানা দেখবা মাত্ৰ আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। ডিভানের উপরে অজ্ঞান যে মানুষটিকে সটান শুইয়ে রাখা হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, বিষাণগড়ের দেওয়ান সার ত্রিবিক্রম কপুর। 

২২

সার ত্রিবিক্রমের জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে এল আর আধঘণ্টা বাদে। রাত তখন প্রায় দুটো। তৎক্ষণাৎ তিনি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “উঠবার চেষ্টা করবেন না। আমার হাতে এই যে রিভলভারটা দেখছেন, এতে সাইলেন্সার লাগানো আছে।” 

ধপ করে আবার বসে পড়লেন সার ত্রিবিক্রম। শুকনো গলায় বললেন, “আপনারা কারা?”

“এও কি একটা প্রশ্ন হল?” ভাদুড়িমশাই ধারালো হেসে বলেন, “আমাকে আপনি খুব ভালই চেনেন। আমি চারুচন্দ্র ভাদুড়ি, কাম্বারল্যান্ড ইনসিওরেন্স কোম্পানির বিষাণগড় ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। আর, এঁকেও আপনার না-চিনবার কথা নয়, ইনি আপনাদের প্যালেসেই কাজ করেন। মিঃ কিরণকুমার চ্যাটার্জি। তবে হ্যাঁ, এই যে মাঝবয়সী ভদ্রলোকটি, এঁকে আপনি চেনেন না। তা চিনবার কোনও দরকারও আপাতত আপনার নেই।” 

মাঠের উপরে যেমন মেঘ আর রোদ্দুর একইসঙ্গে খেলা করে বেড়ায়, মানুষের মুখের উপরেও যে তেমন ভয় আর ক্রোধ একই সঙ্গে খেলে বেড়াতে পারে, আগে তা আমার জানা ছিল না। সার ত্রিবিক্রমের মুখে কিন্তু আজ একই সঙ্গে এই দুটোই দেখতে পেলুম। মনে হল, একদিকে যেমন তিনি ভীষণ ভয় পেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি আবার রেগেও গিয়েছেন প্রচণ্ড। চাপা গলায় বললেন, “আমাকে আপনারা এখানে আটকে রেখেছেন কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না-আটকে উপায় ছিল না যে!…না না, ভয়ের কিচ্ছু নেই, সকাল হবার আগেই আমরা আপনাকে ছেড়ে দেব, স্বচ্ছন্দে আপনি প্যালেসে ফিরে যেতে পারবেন, কেউ কিছু জানতে পারবে না। তা এবারে বরং আমিই একটা প্রশ্ন করি। রাত একটায় আপনি আজ সর্সোতিয়ার ধারে গিয়েছিলেন কেন? তাও বিচ্ছিরি ওই আলখাল্লায় নিজেকে ঢেকে নিয়ে? তাও আবার হাতে একটা ছোরা নিয়ে? …কোনও কাজ ছিল?” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর, সার ত্রিবিক্রম কোনও জবাব দিচ্ছেন না দেখে বললেন, “বুঝতে পারছি, আপনি মুখ খুলবেন না। ঠিক আছে, উত্তরটা তা হলে আমিই দিই, কেমন? পুলিশের বড় কর্তা অর্জুন প্রসাদ যে আপনার মস্ত শাকরেদ, মিঃ চ্যাটার্জি তা না জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি। সত্যি বলতে কী, সেইজন্যেই মিঃ প্রসাদকে সেদিন আমি একটা খবর খাইয়ে দিয়েছিলুম। কী খবর, না আঠাশে জুন ভোরবেলায় সর্সোতিয়ার ধারে যাদের আমি পড়ে থাকতে দেখেছিলুম, সেই তিনজন ট্রাইবাল মানুষের একজন তখনও বেঁচে ছিল; আর মরবার আগে কয়েকটা কথা সে বলেও গিয়েছিল আমাকে। কী কথা, না ‘হলদে পাথর… দশদিন বাদে আবার আসবে…এইখানে… মাঝরাত্তিরে…মরবে…বারণ করো’। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মিঃ প্রসাদকে এই খবরটা আমি খাইয়েছিলুম কেন?” 

সার ত্রিবিক্রমের চোখ দুটো হঠাৎ রাগে জ্বলজ্বল করে উঠল। কিন্তু তাঁর গলার পর্দা একটুও উপরে উঠল না। সেই একই রকমের চাপা গলায় তিনি বললেন, “কেন? আমাকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে?” 

“বা রে, দোষটা কি শুধু আমার? আপনি আমার এই বন্ধুটিকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেননি? অথচ ওঁর অপরাধটা কী? না আপনার আর এস্টেট-ম্যানেজারের পেটোয়া সাপ্লায়ারদের উনি ব্ল্যাকলিস্ট করেছিলেন। আরে বাবা, বাজার দরের চেয়ে যে তারা বেশি দাম নেয় স্রেফ আপনাদের দুজনের পেট ভরাবার জন্যে, তা তো আর মিঃ চ্যাটার্জি জানতেন না। মিঃ চ্যাটার্জির আর-একটা দোষ, তিনি বড় গোলমেলে সব প্রশ্ন তোলেন। এই যেমন, তিনজন ট্রাইবালের হঠাৎ জঙ্গল থেকে শহরে আসবার কী দরকার পড়ল, পুলিশ কেন তা নিয়ে কোনও খোঁজখবর করছে না। বুঝুন ব্যাপার, মিঃ চ্যাটার্জি এমন সরল লোক যে, তা নিয়ে খোঁজখবর করতে গেলে যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে, তাও উনি বুঝতে পারেননি। কিন্তু আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ-লোককে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। একে তো ইনি পুরনো সাপ্লায়ারদের ভাগিয়ে দিয়ে আপনাদের একটা রেগুলার ইনকামের পথ বন্ধ করতে চলেছেন, তার উপরে আবার এমন গোলমেলে সব কথা বলছেন, যাতে কিনা আপনারা বিপদে পড়ে যেতে পারেন। বাস্, আপনারও খেল অমনি শুরু হল। সুরজপ্রসাদ আগরওয়ালের মার্ডারটা যে একটা চমৎকার ট্র্যাপ, তাতে আর সন্দেহ কী। মুরারিকে দিয়ে আপনি ফাঁদটা পাতলেন, আর আমার বন্ধুটিও গিয়ে ঢুকে পড়লেন তার মধ্যে।” 

এতক্ষণ আমার মুখ দিয়ে কোনও কথাই সরছিল না। এবারে মৃদু গলায় বললুম, “আমারই বোকামি। আগরওয়ালজির সঙ্গে যে মুরারির দেখাই হয়নি, একটা ফোন করলেই সেটা জানা যেত।”

কথাটা শুনে হেসে ফেললেন ভাদুড়িমশাই। তারপর সার ত্রিবিক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হলেই বুঝুন কীরকম মানুষ উনি! আগরওয়ালজির বাড়ি, স-মিল, আর গয়নার দোকানের ফোনের লাইন যে সেদিন সকালবেলাতেই আপনি কাটিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা পর্যন্ত মিঃ চ্যাটার্জি জানেন না। তো সে-কথা থাক। অর্জুন প্রসাদকে ওই খবরটা কেন খাইয়েছিলুম, সেটা এখনও বলা হয়নি। আসলে আমি জানতুম যে, খবরটা যদিও মিথ্যে, তবু ওটাকেই সত্যি ভেবে নিয়ে থানায় পৌঁছেই খবরটা সে আপনার কানে পৌঁছে দেবে। বাস্, আপনিও ধরে নিলেন যে, সত্যিই বুঝি মরবার আগে একজন ট্রাইবাল ওই কথাগুলো আমাকে বলে গিয়েছিল। কী বলেছিল সে? না ‘হলদে পাথর … দশ দিন বাদে আবার আসবে… এইখানে … মাঝরাত্তিরে।. মরবে… বারণ করো’। আপনি ওই কথাগুলোর কী অর্থ করলেন? না যে-অর্থ আপনি করবেন বলে আমি আশা করেছিলুম। আপনি ধরে নিলেন, দশদিন বাদে আবার কেউ হলদে পাথর নিয়ে মাঝরাত্তিরে সর্সোতিয়ার ধারে আসবে। কিন্তু যে আসবে, সেও মারা পড়বে, যেমন কিনা ওরা তিনজন মারা পড়েছে। সুতরাং তাকে যেন আসতে বারণ করা হয়।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আঠাশে জুন থেকে দশদিন বাদে। তার মানে আটুই জুলাই। আজ সেই তারিখ। আমি তো আশাই করছিলুম যে, আজ মাঝরাত্তিরে কেউ হলদে পাথর নিয়ে জঙ্গল থেকে এখানে আসবে বলে আপনি ধরে নেবেন, আর তার কাছ থেকে সেই পাথর কেড়ে নেবার জন্যে ঠিক সেই সময়েই এই সর্সোতিয়ার ধারে আপনার আবির্ভাব হবে। হলদে পাথর! কথাটা খুব ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করেছিলুম, সার ত্রিবিক্রম। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা যে সোনাকে হলদে পাথর বলে, তা যেমন আপনি জানেন, তেমন আমিও জানি। সেইসঙ্গে আমি এটাও জানি যে, হলদে পাথরের লোভে আপনি না-করতে পারেন, এমন কাজ নেই। মানুষও খুন করতে পারেন, তাই না? এই যেমন আঠাশে জুন তারিখে ওই মানুষ তিনটিকে আপনি খুন করেছেন।” 

“বাজে কথা!” সার ত্রিবিক্রম বললেন, “কাউকেই আমি খুন করিনি।” 

ভাদুড়িমশাই নিরুত্তাপ গলায় বললেন, “আমার ধারণা, করেছেন। তবে হ্যাঁ, একবার চিৎকার করে উঠবারও সুযোগ না-দিয়ে একা তো আর তিন-তিনজন লোককে খুন করা সম্ভব নয়, আর-কেউ আপনার সঙ্গে ছিল নিশ্চয়। সে কে? মুরারি, না অর্জুন প্রসাদ? … ছিল, সার ত্রিবিক্রম, কেউ একজন ছিল। পুরন্দর মিশ্রকে মারবার জন্যে অবশ্য আর কারও সাহায্যের দরকার আপনার হয়নি।” 

“বাজে কথা! সব বাজে কথা!” চাপা গলায় সার ত্রিবিক্রম আবার গর্জে উঠলেন, “ইউ হ্যাভ বিন অ্যালেজিং থিংস দ্যাট হ্যাভ অ্যাবসলুটলি নো এগজিসটেন্স এক্সেপ্ট ইন ইয়োর ইমাজিনেশান।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো আর এ-সব প্রমাণ করতে পারব না। কিন্তু আমি জানি যে, সব ক’টা খুনের পিছনেই আপনি ছিলেন। কাউকে নিজে খুন করেছেন, কাউকে খুন করিয়েছেন লোক লাগিয়ে। হরদেওকে অবশ্য সোনার লোভে খুন করা হয়নি। তার মনিব শিউশরণ ত্রিপাঠী তো পুরনো আমলের লোক, আপনার উপরে তিনি বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না। সম্ভবত আপনার কিছু-কিছু কীর্তিকলাপের খবরও তিনি রাখতেন। মিঃ চ্যাটার্জিকে সে-সব হয়তো জানাতেনও তিনি। কিন্তু মুরারি হঠাৎ এসে পড়ায় আর জানাতে পারেননি। তবে কিনা তিনিও বড় মারাত্মক একটা ভুল করলেন; মুরারির সামনেই মিঃ চ্যাটার্জিকে বলে বসলেন যে, যা-কিছু তিনি জানেন, তা একটা কাগজে লিখে হরদেওয়ের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। মুরারি কি আর সেই দিনই খবরটা আপনার কানে পৌঁছে দেয়নি? বাস, তক্ষুনি লেখা হয়ে গেল হরদেওয়ের ডেথ-ওয়ারেন্ট! হরদেও খুন হয়ে গেল, বিষাণগড় ছেড়ে চলে যাবার আগে শিউশরণজি যে-কাগজখানা তার হাত দিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা আর মিঃ চ্যাটার্জির কাছে এসে পৌঁছল না।” 

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “হরদেওকে আপনি হয়তো নিজের হাতে খুন করেননি, তবে আমার বিশ্বাস, পুরন্দরকে নিজেই মেরেছিলেন। সত্যি, সোনার লোভে আপনি না-করতে পারেন এমন কোনও কাজই নেই।” 

ডঃ সিদ্দিকি এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। এবারে চমকে উঠে বললেন, “সে কী, পুরন্দরের সঙ্গে সোনার কী সম্পর্ক?” 

ভাদুড়িমশাই ফিরে তাকালেন না। কপুরসাহেবের উপর থেকে চোখ না সরিয়েই ডঃ সিদ্দিকিকে বললেন, “আপনি শুধু এইটুকুই শুনেছেন যে, পুরন্দর ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ, ঘরবাড়ি আর বউবাচ্চা ছেড়ে মাঝে-মাঝেই তিনি জঙ্গলে চলে যেতেন। কিন্তু জঙ্গলে যাবার কারণ হিসেবে ঠাট্টা করে তিনি কী বলতেন, তা আপনি জানেন না। কিন্তু আমি তা জানি, আর মিঃ চ্যাটার্জিও এতদিনে হয়তো জেনেছেন। পুরন্দর বলতেন, জঙ্গলে তিনি যান তাঁর প্রেমিকার টানে। যে প্রেমিকাকে কিনা বন্দি করে রাখা হয়েছে, আর যার গায়ের রং একেবারে কাঁচা হলুদের মতো। তা প্রথমদিন যখন পুরন্দর মিশ্রকে এটা আমি বলতে শুনি, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, এটা ঠাট্টা নয়, আসলে, তিনি কোনও স্ত্রীলোকের কথা বলছেন না। তা হলে কীসের কথা বলছেন? একটুখানি চিন্তা করতেই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। বুঝতে পারি যে, আসলে তিনি সোনার কথা বলছেন। সেই সোনা, যা মাটির তলায় কি পাহাড়ের স্তরে কি কোয়ার্জের খাঁজে বন্দি হয়ে থাকে। তবে সত্যি কথাই বলি, তাঁর প্রেমিকার গায়ের রং যে কাঁচা হলুদের মতো, এই কথাটাও যদি না তিনি জানাতেন, তা হলে হয়তো আসল রহস্যটা এত সহজে আমি ধরতে পারতুম না।” 

কপুরসাহেব ফুঁসে উঠে বললেন, “তা এ-সব কথার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?” 

“সম্পর্ক আর কিছুই নয়, সোনা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কপুরসাব, ইউ আর এ ভেরি ক্লেভার ম্যান, তাই পুরন্দর মিশ্র যা ঠাট্টা করে বলতেন, তার অর্থটা আপনিও ধরে ফেলেছিলেন। সোনার হদিসটা জানিয়ে দেবার জন্যে চাপও দিয়েছিলেন পুরন্দরের উপরে। কিন্তু তিনি হদিসটা কিছুতেই দিলেন না। ফলে একদিন রাত্তিরবেলায় প্যালেস কম্পাউন্ডের ঠিক বাইরে নদীর ঘাটে তাঁকে ডাকিয়ে আনলেন আপনি, আর তারপরেই লোকটার মাথা ফাটিয়ে নদীর জলে তাঁকে ভাসিয়ে দিলেন। ডেডবডিটা যে ঘাটের কাছে একটা পাথরে আটকে যায়, তাতে সুবিধেই হল আপনার। প্যালেসের ডাক্তারবাবুকে দিয়ে আপনি বলিয়ে নিতে পারলেন যে, ওই পাথরটাতে ধাক্কা খেয়েই বন্দর মিশ্রের মাথা ফেটেছে।” 

“বাজে কথা! ডাহা মিথ্যে কথা! অল বেসলেস অ্যালিগেশান্‌স! যা বলছেন তার প্রশাণ কী?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে-কথা পরে হবে। আপাতত অন্য-একটা প্রশ্ন করি। বড় কুমার শঙ্করনারায়ণকে বঞ্চিত করে ছোটকুমার রূপনারায়ণকে আপনি সিংহাসনে বসাতে চাইছেন কেন?”

“আমি একা চাইব কেন? সব্বাই চায়। সব্বাই জানে যে, ববি ইজ মেন্টালি আনস্টেবল্ অ্যাড শুড ইমিডিয়েটলি বি সেন্ট টু অ্যান অ্যাসাইলাম। হি ইজ ম্যাড, কমপ্লিটলি অফ হিজ রকার . “ 

“হুইচ ইজ এ ডেপিকেব্‌ল লাই!” ভাদুড়িমশাই শান্ত গলায় বললেন, “আমরা জানি, ববি পাগল নয়, হি ইজ অ্যাজ নর্মাল অ্যাজ এনি আদার ইয়াং ম্যান। স্রেফ আপনাদের ধোঁকা দেবার জন্যেই তাকে পাগলামির ভান করতে হত। হালে অবশ্য সেটাও আপনি টের পেয়ে যান, আর সেইজন্যেই স্রেফ প্রাণের ভয়ে প্যালেস ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাকে।” 

“কোথায় গেছে ববি?” 

“তার তো আঠারো বছর পূর্ণ হতে আর বাকি নেই। আর তাই সেইখানেই সে গেছে, যেখান থেকে ছ’মাস বাদেই বিষাণগড়ের সিংহাসন ফ্রেম করে সে ভাইসরয়ের কাছে চিঠি পাঠাতে পারবে। ফর ইয়োর ইনফরমেশান, আমিই তাকে রায়পুরে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছি। …কিন্তু সে-কথা থাক, যেটা আমি জানতে চাইছিলুম, সেইটে বরং বলুন। হতে পারেন আপনি দেওয়ান, কিন্তু সেও তো চাকরি ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি একজন চাকর মাত্র। মেবি এ ফ্যাট-স্যালারিড ওয়ান, বাট এ সার্ড্যান্ট অল দি সেম। তা হলে আর কে আপনার মনিব হবে, ববি না রূপ, তা নিয়ে আপনার এত চিন্তা কীসের? ববিকে মেন্টাল হোমে পাঠিয়ে রূপকে সিংহাসনে বসাবার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত কেন?”

কপুরসাহেবের চোখেমুখে রাগ যেন ফেটে পড়ছিল। কিন্তু তিনি একটা কথাও বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝতে পারছি, আপনি কিছু বলবেন না। কেন বলবেন না, তাও আমি জানি। কপুরসাহেব, ভুলে যাবেন না যে, এখানে পাঠাবার আগে বেশ কয়েক মাসের জন্যে আমাকে যেমন মাধোপুর, তেমনি ধুল্সর স্টেট থেকে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল। তা বিষাণগড় প্যালেসে আমাদের লোক রয়েছে, আর ধুল্সর প্যালেসে থাকবে না, তাও কি হয় নাকি? আছে কপুরসাহেব, সেখানেও আছে, আর তাই রূপেন্দ্রনারায়ণকে রাজা করবার জন্যে আপনার এই ব্যস্ততার কারণটাও আমি সহজেই বুঝতে পারি। … না না, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই, ধুল্সর প্যালেসের সেই স্ক্যান্ডালটার কথা আমি জানি ঠিকই, কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আর-কাউকে তা আমি জানাব না। কেন জানাব না জানেন? যেহেতু একজন ভদ্রমহিলারও মানসম্মান এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।” 

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িয়শাই। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃদুগলায় বললেন, “ভদ্রমহিলার জন্য আমার দুঃখ হয় অল্পবয়সে একটা ভুল করে ফেলেছিলেন, তার জন্যে তাঁর অনুশোচনার অন্ত নেই, অথচ সেই ভুলের মাসুল তাঁকে এখনও দিয়ে যেতে হচ্ছে। না, তাঁর যে এ-ব্যাপারে কোনও দোষ আছে, তা আমার মনে হয় না। যাকে পেটে ধরেছেন, তাকে কি আর তিনি ভালবাসেন না? বাসেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে যে তিনি আর-কারও ক্ষতি করতে চান, তা কিন্তু নয়। তাঁর সঙ্গে তো কতবারই কথা বলেছি আমি। কিন্তু প্রতিবারই এই ধারণা নিয়ে ফিরেছি যে, শি ইজ এ্যাড-ফিয়ারিং সেল্ফ রেসপেক্টিং উয়োম্যান। আপনার সে-ক্ষেত্রে না আছে ধর্মভয়, না আত্মসম্মানবোধ। থাকবেই কী করে? আপনার যে বড্ড বেশি লোভ। ছিলেন তো ধুল্সর প্যালেসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যেই সেখানকার ছোট রাজকুমারীর সঙ্গে ধূর্জটিনারায়ণের বিয়ে হল, অমনি সেই স্ক্যান্ডাল ফাঁস করবার ভয় দেখাতে শুরু করলেন আপনি। ভয় দেখাতে লাগলেন যে, কেলেঙ্কারির কথাটা এখানে সবাইকে বলে দেবেন। তাতে কাজও হল। ধূর্জটিনারায়ণ মারা যেতেই এখানে এসে আপনি শুরু করলেন আপনার খেল, পুরনো আমলের দেওয়ান আচারিয়াসাহেবকে হটিয়ে দিয়ে তাঁর চেয়ারটা দখল করতে আপনার বিশেষ দেরিও হল না। এদিকে আবার ডিকি উইলসন আপনার তাবৎ কুকর্মের সঙ্গী, ফলে তার সুপারিশে ‘সার’-খেতাবটাও দিব্যি আপনি বাগিয়ে নিয়েছেন।” 

রহস্যটা আমার কাছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। শুধু বুঝতে পারছিলুম না যে, কুলদীপ সিংয়ের কথাটা এখনও উঠছে না কেন। 

ভাদুড়িমশাই আর-একটা সিগারেট ধরালেন। লম্বা একটা টান মেরে, বেশ খানিকটা ধোঁয়া টেনে নিলেন তাঁর ফুসফুসের মধ্যে। তারপর গলগল করে সেটা বার করে দিয়ে বললেন, “কিন্তু কপুরসাব, তাতেও আপনার শান্তি নেই। প্যালেসের সোনাদানা কতটা কী আপনি হাতিয়েছেন জানি না, তবে জঙ্গলের সোনার দিকেও যে হাত বাড়িয়েছেন, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আরও আরও সোনা চাই আপনার, আর সেই সঙ্গে চাই আরও আরও ক্ষমতা। তা সেই সোনার জন্যে একটার পর একটা মানুষকে আপনি খুন করে চলেছেন, আর অন্যদিকে যে কিনা সত্যিই মেন্টালি আনস্টেবল, সেই ছোট কুমারের বকলমে ডিফ্যাক্টো রাজা হবার জন্য তাকেই বসাতে চাইছেন বিষাণগড়ের সিংহাসনে। নইলে যে আপনার ক্ষমতার খিদে মেটে না। কী, আমি কি ভুল বলছি?” 

সার ত্রিবিক্রমের মুখের উপরে এতক্ষণ ভয় আর ক্রোধ খেলা করে বেড়াচ্ছিল। তার বদলে এবারে যা ফুটে উঠল, একেবারে নির্ভেজাল ধূর্ততা ছাড়া তা আর কিছুই নয়। ব্যঙ্গের গলায় তিনি বললেন, “বাট ইউ কান্ট প্রুভ এনিথিং। কোনও প্রমাণই তো নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাকলেই বা কী হত! এটা নেটিভ স্টেট, এখানে পুলিশও আপনার, আদালতও আপনার। তাই ও-সব জায়গায় যাবার কথা আমি ভাবছিই না। আমি অন্য কথা ভাবছি। কিন্তু তার আগে বরং এই ছবিগুলো আপনি দেখুন।” 

পকেট থেকে বার করে একটা প্যাকেট তিনি সার ত্রিবিক্রমের দিকে ছুড়ে দিলেন। 

এটা কি পামেলার দেওয়া সেই প্যাকেট? জানি না। সেই প্যাকেটে যে কিছু ছবি ছিল, তা অবশ্য জানি, কিন্তু সেগুলি কীসের ছবি, তা আমার জানা নেই। ইচ্ছে করলে জানা যেত, কিন্তু পামেলার নিষেধ ছিল, তাই জানতে চাইনি। সেই ছবিগুলিই ভাদুড়িমশাই কপুরসাহেবকে দেখতে দিলেন কি না, কে জানে। আমি শুধু এটুকুই দেখলুম যে, প্যাকেট খুলে তার ভিতরের জিনিসগুলির উপরে চোখ বুলিয়েই সার ত্রিবিক্রমের মুখ একেবারে ছাইয়ের মতন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পরক্ষণেই তিনি ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলি কোথায় পেলেন আপনি?”

“তা বলব না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপাতত শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, এগুলি প্রিন্টের প্রিন্ট। মূল প্রিন্টগুলি একটা সিল্ড কভারে আমাদের দিল্লি-অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। দিল্লি-অফিস আমাকে জানিয়েও দিয়েছে যে, কভারটা সেখানে আমাদের লকারে তুলে রাখা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, কভারে কী আছে, তা তারা জানে না।” 

“এগুলি দিয়ে কী করবেন আপনি?” 

“বললুম তো, আমি অন্য ব্যবস্থার কথা ভাবছি। পুলিশের কাছে ধর্না দিয়ে লাভ নেই, তাদের আপনি কিনে রেখেছেন। তাই ভাবছিলুম যে, আইনটা এবারে নিজের হাতেই তুলে নেব। খুবই মূল্যবান ছবি তো, তাই দশটা প্রিন্ট করিয়ে রেখেছি। তার থেকে একটা সেট যদি রানি-মা’র কাছে পাঠিয়ে দিই, তো কেমন হয়?” 

কপুর সাহেবের মুখ থেকে সেই ধূর্ত হাসিটা অনেক আগেই মিলিয়ে গিয়েছে। রাগের আর চিহ্নমাত্র নেই, তার বদলে যে ফুটে উঠেছে, তা ভয়, শুধুই ভয়। ঘর্মাক্ত মুখ, কপালে অসংখ্য বলিরেখা, একজন জাঁদরেল মানুষের এমন বিধ্বস্ত চেহারা এর আগে আর কখনও দেখিনি। হাতের ছবিগুলিকে প্যাকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে-রাখতে তিনি বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি, আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চান?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে ব্ল্যাকমেল করে, তাকে পালটা ব্ল্যাকমেল করায় কোনও দোষ নেই, কপুরসাহেব। ইউ আর জাস্ট বিয়িং পেইড ইন ইয়োর ওউন কয়েন।” 

“কত টাকা চান আপনি?” 

“এক পয়সাও চাই না।” ভাদুড়িম। ই বললেন, “আসলে কয়েকজন মানুষকে আমি বাঁচাতে চাই। …না না, আমি ববির কথা ভাবছি না, নাউ দ্যাট হি ইজ ইন মাধোপুর, হি ক্যান ভেরি ওয়েল লুক আফটার হিমসেলফ। আমি ভাবছি অন্য কয়েকজনের কথা, অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ড মিঃ চ্যাটার্জি ইজ অফ কোর্স ওয়ান অত দেন। স্রেফ এঁদের কথা ভেবে দুটো স্টেটমেন্ট আমি তৈরি করে রেখেছি। তাতে সই করে দিন, তা হলেই এই দশ সেট ছবি আমি বিনামূল্যে আপনাকে দিয়ে দেব। তবে কিনা না-আঁচালে তো বিশ্বাস নেই, ওরিজিন্যাল প্রিন্টগুলো তাই ছ’মাসের আগে ফেরত পাবেন না।” 

“কী আছে ওই স্টেটমেন্ট দুটোতে?” 

“একটায় লেখা আছে যে, বিষাণগড়ের দেওয়ানের চাকরিতে আপনি ইস্তফা দিচ্ছেন, উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট। আর অন্যটায় আপনি বিষাণগড় পুলিশের বড়কর্তা অর্জুন প্রসাদকে নির্দেশ দিচ্ছেন, মিঃ কিরণকুমার চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে যে ওয়ারেন্ট অভ অ্যারেস্ট ইস্যু করা হয়েছে, দ্যাট শুড বি উইথড্রন অ্যাট ওয়ান্‌স।” 

“যদি সই না করি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন কপুরসাহেব, মিথ্যে বলে লাভ নেই, সই যদি আপনি নাও করেন তো সেক্ষেত্রে ওই কুচ্ছিত ছবিগুলো আমি যশোমতী দেবীর কাছে পাঠাতে পারব না, আমার রুচিতে বাধবে। তা হলে আমি কী করব? না যার কাছ থেকে পেয়েছি, তাকেই ওগুলো ফেরত দিয়ে দেব। সে ওগুলো নিয়ে কী করবে, আমি জানি না। সে যদি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে তো করুক, দ্যাটস্ নান্‌ অভ মাই বিজনেস। আই শ্যাল জাস্ট ওয়াশ মাই হ্যান্ডস্ অভ ইট। আমার পথ আমি ঠিক করে রেখেছি। যা করব, তা অবশ্য আপনার পছন্দ হবে না, কিন্তু সেটা না-করেও আমার উপায় নেই।” 

রিভলভারটাকে এতক্ষণ বাঁ হাতে ধরে রেখেছিলেন ভাদুড়িমশাই, এবারে সেটা ডান হাতে নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কপুর সাহেবের চোয়াল দেখলুম ঝুলে পড়েছে। ভাঙা ফ্যাসফেসে গলায় তিনি বললেন, “কী করবেন আপনি?” 

একেবারে নিরুত্তেজভাবে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাকে মেরে ফেলব। কিন্তু এমনভাবে মারব, যাতে কেউ না বুঝতে পারে যে, এটা মার্ডার। কীভাবে সেটা করব, তাও জানিয়ে দিচ্ছি। প্রথমেই আপনার ঘাড়ের একটা জায়গায় আমি ছোট্ট একটা আঘাত করব। তাতে আপনার শরীরে ফোনও দাগ পড়বে না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনি জ্ঞান হারাবেন। সেই অবস্থায় একটা গাড়িতে তুলে এখান থেকে মাইল পনরো দূরে একটা জঙ্গুলে জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আপনার হাতের একটা শিরা আমরা কেটে দেব, সো দ্যাট ইউ ব্লিড টু ডেথ হোয়াইল ইউ আর স্টিল মানকনশাস। এইবার দেখুন, আপনার শরীরের পাশে আমরা কী রেখে দেব।” 

স্যুটকেসটা সোফার কাছেই দাঁড় করানো ছিল। সেটা খুলে রুমালে জড়ানা ছোরাটা বার করে আনলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “এইটে আপনার শরীরের পাশে পড়ে থাকবে। আপনারই ছোরা। আপনারই আঙুলের ছাপ রয়েছে এতে। আর তাই পুলিশ ধরে নেবে যে, এটা আত্মহত্যার ঘটনা।” 

এত স্থির, এত শান্ত অথচ একই সঙ্গে এত কঠিন গলায় ভাদুড়িমশাই এই কথাগুলি বলে গেলেন যে, আমি পর্যন্ত ভিতরে-ভিতরে শিউরে উঠলুম। কপুর সাহেবও বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ-সব নিতান্ত কথার কথা নয়। দেখলুম, তাঁর কপাল থেকে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। 

কয়েক পা এগিয়ে সার ত্রিবিক্রমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ভাদুড়িমশাই। বাঁ হাতের তালুটাকে আড়াআড়িভাবে তাঁর ঘাড়ের উপরে রেখে বললেন, “হ্যাঁ, এই জায়গায়। কিন্তু তার আগে আমি তিন পর্যন্ত গুনব। এক … দুই …”

‘তিন’ বলতে হল না। তার আগেই কপুরসাহেব বললেন, “স্টেটমেন্ট দুটো দিন, আমি সই করে দিচ্ছি।” 

স্টেটমেন্ট আর কলম ডঃ সিদ্দিকির কাছে ছিল। তিনি সেগুলি ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন। কাগজে সই হয়ে গেল। ভাদুড়িমশাই তাঁর স্যুটকেস খুলে বেশ বড় একটা প্যাকেট বার করে কপুরসাহেবের হাতে সেটা তুলে দিয়ে বললেন, “বাকি ন’টা সেট এর মধ্যে রইল। যে-সেটটা আপনাকে দিয়েছি, সেটাও এর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখুন। তবে হ্যাঁ, ওরিজিন্যাল প্রিন্টগুলি তো দিল্লিতে। সেটা এখন পাবেন না। বাই দ্য ওয়ে, দিল্লি অফিসকে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে রেখেছি, এই জুলাই মাসের মধ্যে যদি আমার কিংবা মিঃ চ্যাটার্জির কিংবা বিষাণগড় প্যালেসে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, তা হলে আবার সেই ওরিজিন্যাল ফোটো থেকে তিন সেট প্রিন্ট করিয়ে তারা যেন তিন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। একটা সেট আসবে ছোট রানি-মা’র কাছে, একটা সেট যাবে মাধোপুর স্টেটের মহারাজার কাছে, অ্যান্ড দি থার্ড সেট উইল গো টু মিঃ আচারিয়া। …ওহো, একটা কথা তো আপনাকে বলা-ই হয়নি। আপনার প্রিডিসেসর মিঃ আচারিয়া এখন ভাইসরয়ের খুবই কাছের মানুষ, অ্যান্ড হি উইল বি এক্সট্রিমলি হ্যাপি টু রিসিভ এ সেট অভ্ দিজ বিউটিফুল ফোটোগ্রাফ্‌স।” 

কপুরসাহেব ডিভান থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তার দরকার হবে না। সাতটা দিন সময় দিন আমাকে, তার মধ্যেই আমি বিষাণগড় থেকে চলে যাব। এবার কি আমি প্যালেসে ফিরতে পারি?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরাই আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। তবে তার আগে চোখ বেঁধে দেব আপনার, যাতে কিনা আপনি বুঝতে না পারেন যে, কোথায় এনে আপনাকে তোলা হয়েছিল।”

সেই ব্যবস্থাই হল। কিন্তু শুধু চোখ বেঁধে দিয়েই নিশ্চিন্ত হলেন না ভাদুড়িমশাই, ওই অবস্থাতেও বিস্তর রাস্তা ঘুরিয়ে তারপর কপুরসাহেবকে প্যালেসের কাছাকাছি একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন। রাত তখন প্রায় চারটে। 

বললুম, “আমি এখন কী করব?” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর পকেট থেকে একটা খাম বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এতে কিছু টাকা রইল। রেখে দিন। পরে শোধ করে দেবেন। এখন আমরা রায়পুর যাব। সেখান থেকে আপনি কলকাতার ট্রেন ধরবেন। আমি চিঠি লিখব আপনাকে। সে-চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত আপনি বিষাণগড়ে ফিরবেন না।” 

২৩ 

তেতাল্লিশটা বছর। তার মধ্যে একটা জায়গা যে কতখানি পালটে যেতে পারে, এবারে বিষাণগড়ে এসে সেটা বোঝা গেল। সেই যে ১৯৪৬ সালের আটুই জুলাই তারিখের শেষ-রাত্তিরে বিষাণগড় ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি, তার দিন সাতেক বাদে ভাদুড়িমশাইয়ের টেলিগ্রাম পেয়ে সেখানে আবার ফিরে গিয়েছিলুম ঠিকই, কিন্তু তার পরে আর খুব বেশিদিন সেখানে থাকা হল না। চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে এলুম ১৯৪৭ সালে। বাস, সেই যে ফিরে এলুম, তারপরে আর কখনও বিষাণগড়ে যাইনি। 

বিষাণগড় তখন ছিল নেহাতই শান্ত একটা শহর। সর্সোতিয়া নদীর দুই দিকে ছড়ানো সেই শহরে লোকজন খুব বেশি ছিল না। ব্যাবসা-বাণিজ্য ছিল নামমাত্র। নদীর পুব দিকটা তবু যা হোক কিছুটা জমজমাট, পশ্চিম দিকটা বলতে গেলে ফাঁকা। মার্কেট রোড আর প্যালেস রোডই তখন ছিল বিষাণগড়ের সবচেয়ে চওড়া সড়ক। অন্য সব রাস্তায় পাকা বাড়ির তুলনায় খাপড়ার চালের ঘরবাড়ি ছিল অনেক বেশি। দোকানপাট রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকত বটে, তবে সন্ধের পর থেকে আর কোনও রাস্তাতেই লোকজন বিশেষ চোখে পড়ত না। সন্ধে-রাতেই শহরটা যেন ঘুমিয়ে পড়ত। 

এবারে দেখলুম, সেই শহরের ভোল একেবারে পালটে গেছে। লাইট-রেলওয়ের খেলনা গাড়িতে উঠবার জন্যে আর আজকাল ভিরিন্ডি যাওয়ার দরকার হয় না, লোকসানের ধাক্কায় সেই রেলপথ কবেই তুলে দেওয়া হয়েছে, তার জায়গায় হয়েছে পিচ-ঢালা চওড়া রাস্তা, রায়পুর থেকে বাসে করেই তাই এখন সরাসরি বিষাণগড়ে চলে যাওয়া যায়। তাতে সময়ও লাগে অনেক কম। বিকেল চারটের মধ্যে বিষাণগড়ে পৌঁছে গেলুম। 

ভাদুড়িমশাই আমাকে রিসিভ করার জন্যে যদি না সেন্ট্রাল বাস টার্মিনালে হাজির থাকতেন, বাস থেকে নেমেই তা হলে বোধহয় আমার মাথাটা চন্ করে ঘুরে যেত। ছেলেবেলায় রিপ ভ্যান উইংকূলের গল্প শুনেছিলুম। কুড়ি বছর বাদে ঘুম থেকে উঠে তার যে অবস্থা হয়েছিল, আমার অবস্থাও তখন সেইরকম। যে-দিকেই তাকাই না কেন, সব কিছুই একেবারে অচেনা লাগে। বিষাণগড় স্টেট যে এখন মধ্যপ্রদেশের একটা জেলা, আর বিষাণগড় শহর তার সদর, তা অবশ্য জানতুম, কিন্তু তাই বলে যে ইতিমধ্যে তার এই চেহারা হয়েছে, তা আমার কল্পনায় ছিল না। 

রাস্তায় ভিড়; ধুলো উড়িয়ে, কানে-তালা-লাগানো হর্ন বাজিয়ে যাত্রিবোঝাই বাস আর মিনিবাস ছুটছে; লাউডস্পিকারে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে; সাইকেল, অটো রিকশা, মোটরসাইকেল আর স্কুটারে এখন পথঘাট একেবারে জমজমাট। বললুম, “ও মশাই, এ তো চেনাই যায় না।” 

ভাদুড়িমশাই বাঙ্গালোর থেকে ফোন করে জানিয়ে রেখেছিলেন যে, আমার একদিন আগেই তিনি বিষাণগড়ে পৌঁছবেন। ইতিমধ্যেই একটা দিন তাঁর কেটেছ এখানে, আর সেই কারণেই সম্ভবত এখানকার ভিড়ভাট্টায় তিনি একটু ধাতস্থ হয়েও উঠেছেন। বললেন, “সব জায়গারই এক হাল ব্যাঙ্গালোর আগে কত সুন্দর শহর ছিল, কিন্তু সেখানেও এখন রাস্তাঘাটে ভিড় সারাক্ষণ লেগেই আছে। তবে মিশ্রজি তো এখানে প্যালেস রোডেই বাড়ি করিয়েছিলেন, সেখানে দেখবেন নদীর ধারটা এখনও তত খারাপ হয়নি। …কিন্তু তা তো হল, যা আনতে বলেছিলুম, এনেছেন তো?” 

“তা এনেছি, যে-রকম আনতে বলেছিলেন, ঠিক সেইরকমই এনেছি। কিন্তু ব্যাপার কী বলুন তো, দুটো শিবলিঙ্গ দিয়ে কী হবে?” 

“দুটো নয়, তিনটে। একটা তো পুরন্দর মিশ্র জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিলেন, একটা আপনি কলকাতা থেকে নিয়ে এলেন, আর একটা আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে নিয়ে এসেছি।” 

“ওরে বাবা, তিনটে শিবলিঙ্গের দরকার হল কেন?” 

“দরকার হল, তার কারণ নাল্পে সুখমস্তি।” 

পথে আর কোনও কথা হল না। সেন্ট্রাল বাস স্টেশন থেকে একটা অটো-রিকশা নিয়েছিলুম, মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই সেটা প্যালেস রোডে মিশ্রজির বাড়ির সামনে আমাদের নামিয়ে দিল। 

বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, যেমন এ-রাস্তায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই থাকে। গাড়িতে বসেই লক্ষ করেছিলুম যে, ভিড় করে সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সুমঙ্গল, সরস্বতী, লছমি আর যমুনাদিদি ছাড়া আরও কয়েকজন ছিলেন, তবে তাঁদের আমি চিনতে পারলুম না। 

শীতের বিকেল। যমুনাদিদি বললেন, “ভিতরে চলো। একটু বাদেই সূর্য ডুবে যাবে। তখন যা ঠান্ডা পড়বে, সে তুমি ভাবতেও পারবে না।” 

দোতলা বাড়ি। তবে বড় নয়। ওপরে আর নীচে দুখানা করে ঘর। বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট মন্দির। কাল সকালে সেখানে বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হবে। সেই উপলক্ষে লোকজন নেহাত কম আসবে না শুনলুম। 

জিজ্ঞেস করলুম, “লোকজনদের বসানো হবে কোথায়?” 

সুমঙ্গল বলল, “কেন, বাড়ির সামনে আর পিছনে জায়গা তো কিছু কম নেই। ডেকরেটরের লোকজনেরা এই একটু আগে চলে গেল। তারা বাঁশ খাটিয়ে রেখে গেছে, কাল ভোরবেলায় এসে চাঁদোয়া টাঙিয়ে দেবে। শ দুয়েক চেয়ারের অর্ডার দিয়েছি। তাও কাল সকাল সাতটার মধ্যেই এসে যাবে। দশটার আগে তো আর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হচ্ছে না। তবে আর সমস্যা কী?”

একতলার বৈঠকখানায় বসে কথা হচ্ছিল। এ-বাড়িতে আসবাবপত্র কম; যা আছে, তাও পুরনো আমলের। তবে স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ঘাটতি নেই। তক্তপোশের উপরে জাজিম পাতা। তার উপরে গোল হয়ে বসে গল্প করছি আমরা। ইতিমধ্যে এক রাউন্ড চা আর পকোড়াও শেষ হয়েছে। ভাবছিলুম যে, সরস্বতীকে ভিতরে পাঠিয়ে আর-এক প্রস্ত চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না, এমন সময় লছমি এসে ঘরে ঢুকল। 

সুমঙ্গল বলল, “আর-এক কাপ করে চা হয় না?” 

লছমি বলল, “হয়, কিন্তু হবে না। যে-লোকটা ট্রেন জার্নি করে এসেছে, অন্তত তাকে এখন একটু ছেড়ে দাও তো। …চাচাজি, তুমি উঠে পড়ো। গরম জল রেডি, তুমি আর বসে থেকো না, চটপট স্নান করে নাও।” 

অগত্যা উঠতেই হল। লছমির সঙ্গে ভিতরে যেতে-যেতে বললুম, “তোর দেখছি সেই অর্ডার করার অভ্যাসটা এখনও যায়নি।” 

স্নান করে বেশ আরাম লাগছিল। তক্ষুনি আর নীচে নামলুম না। যমুনাদিদি তাঁর ঘর থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি, ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। আমাকে দেখে বললেন, “এসো ভাইয়া। তোমার কথাই হচ্ছিল। সুমঙ্গল নেহাতই ছেলেমানুষ, ওর উপরে তো সব ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। তা ভাদুড়িদাদা কালই এসে গিয়েছেন, আজ তুমিও এলে। কালকের কাজটা ঠিকমতো সামলে দাও।” 

বললুম, “ও নিয়ে এত ভাবনার কী আছে? সবই ঠিকমতো হয়ে যাবে, কিছুই আটকে থাকবে না। 

যমুনাদিদি বললেন, “কাল যাঁরা আসছেন, তাঁদের অনেকেই তো পুরনো আমলের লোক, যেমন আমার শ্বশুরমশাইকে তেমন তোমার দাদাকেও তাঁরা চিনতেন। দেখো ভাইয়া, তাঁদের আদর- আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না হয়। ভাদুড়িদাদা নানান কাজে ব্যস্ত থাকবেন, এদিকে সুমঙ্গল আবার তাদের চেনেই না, ওদিকটা তাই তোমাকেই দেখতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। কুলদীপ আর রানি-মা’ও কাল আসবেন কিন্তু। দিন কয়েক আগেই তাঁরা বিষাণগড়ে পৌঁছে গেছেন।” 

তাঁরা যে আসবেন, সে তো দিল্লি থেকে কলকাতায় আসবার পথেই ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে শুনেছিলুম। তাই আর অবাক হলুম না। জিজ্ঞেস করলুম, “এখানে তারা উঠেছেন কোথায়? প্যালেসে?” 

যমুনাদিদি বললেন, “কামাল হ্যায়! প্যালেসকো তো হসপিটাল বানা দিয়া।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওঁরা গেস্ট হাউসে আছেন। যশোমতী দেবী তাঁর নাতিটিকেও নিয়ে এসেছেন শুনলুম।” 

“নাতি? কার ছেলে? ববির, না রূপের?” 

যমুনাদিদি বললেন, “লো, শুনো বাহ্! তুমি দেখছি কোনও খবরই রাখো না, ভাইয়া। বড় কুমার তো বিয়েই করেননি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি এখানে থাকতে-থাকতেই ববি অবশ্য সিংহাসন পেয়ে গিয়েছিল। তবে কিনা বুদ্ধিমান ছেলে তো, তাই খুব ভালই জানত যে, রাজাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। তা নিয়ে এতটুকু দুঃখও তার ছিল না। আপনি তো বিষাণগড় ছাড়লেন, আমিও তার কিছুদিন বাদে দিল্লি-অফিসে চলে যাই। তবে মাঝে-মাঝে এখানে আসতে হত। যখন আসতুম, তখন দেখাও হত ববির সঙ্গে। কিন্তু ওই যে বললুম, কক্ষনো তাকে আক্ষেপ করতে শুনিনি। এদিককার নেটিভ স্টেটগুলোকে এক করে দিয়ে যখন মধ্যভারত ইউনিয়ন করা হল, তখনও না, আবার সেই ইউনিয়নকে যখন মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল, তখনও না। কী বলত জানেন?” 

“কী বলত?” 

“বলত যে, মিশরের ফারুক যা বলেছে, সেটাই ঠিক। শেষ পর্যন্ত ওই তাসের চার রাজা আর ইংল্যান্ডের রাজা-ই থেকে যাবে, আর কোথাও কোনও রাজা থাকবে না। থাকার কোনও দরকারও নেই।”

জিজ্ঞেস করলুম, “প্যালেসটা হসপিটাল হল কবে থেকে?” 

“আপনি ভাবছেন, মধ্যভারত ইউনিয়ন লোপ পাবার পরে ওটা হয়েছে? মোটেই না। রাজা থাকতে-থাকতেই ববি ওখান থেকে এই প্যালেস-রোডের একটা বাংলো বাড়িতে উঠে এসেছিল। বিষাণগড় থেকে চলে যাবার আগে প্যালেসে ওই হাসপাতালের কাজও সে-ই শুরু করে দিয়ে যায়।” 

“ববি এখন কোথায়? 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো জানি না। দিল্লিতে একটা বাড়ি আছে বটে, তবে শুনেছি যে, সেখানেও বিশেষ থাকে না, নেটিভ স্টেটগুলির উপরে নাকি কী একটা বই লিখছে, তারই কাজে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়।” 

“আর রূপেন্দ্রনারায়ণ? তার কী খবর?” 

যমুনাদিদি বললেন, “রাজা হবার পরেই বড়কুমার তাঁর ভাইকে মায়ের সঙ্গে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসায় সে অনেকটা সুস্থ হয়েও উঠেছিল। তারপর সে ফিরে এল, বছর কয়েক বাদে বিয়েও হল তার। একটা ছেলেও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই সে ফের পাগল হয়ে যায়। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। শুনেছি, কখনও সে তার বউকে খুন করতে যেত, কখনও ছেলেকে। তারপরে তো নিজেকেই একদিন খুন করে বসল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিল।” 

রূপকে যেদিন প্রথম দেখি, সেইদিনই বুঝেছিলুম যে, ছেলেটা সুস্থ নয়। কী জানি কেন, সেই মুহূর্তে যতই রেগে গিয়ে থাকি, পরে একটু বেদনাও সেদিন বোধ করেছিলুম তার জন্য। সম্ভবত সেইজন্যই একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। খানিক বাদে বললুম, “রানি-মা এখন কোথায় থাকেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাকতে প্রথম থেকে তিনি ববির সঙ্গেই চেয়েছিলেন। কিন্তু ববি তো তার দিল্লির বাড়িতে থাকে না, সে তো শুধুই ঘুরে বেড়ায়। রানি-মা তাই ছোট ছেলেকে নিয়ে দিল্লিতে একটা আলাদা বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই আছেন। ছেলে নেই, কিন্তু ছেলের বউ তো আছে, নাতিও আছে। তাঁদের নিয়েই থাকেন। এখানে এসেছেন বটে, বিষাণগড়ের টানেই হয়তো এসেছেন, কিন্তু আমি যতদূর জানি, যশোমতী দেবী আর আজকাল বাইরে বিশেষ বেরোন না।” 

লছমি এসে বলল, “আর কত গল্প করবে তোমরা? এবারে ওঠো, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, তারপর শুয়ে পড়ো। কাল যে রাত্তির থাকতে-থাকতে উঠে পড়তে হবে, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন?” 

দোতলার দুটো ঘরের একটায় আমাদের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। ঘরের লাগোয়া একটা বারান্দাও রয়েছে দেখলুম। রাতের খাওয়ার পাট চুকে যাবার পরে সেখানে গিয়ে বসেওছিলুম একবার, কিন্তু এমন হাড় কাঁপানো শীত যে, বেশিক্ষণ সেখানে থাকা গেল না, ফের ঘরে এসে ঢুকলুম। ভাদুড়িমশাই একটা ইজিচেয়ারে বসে চুপচাপ একখানা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বইখানা সরিয়ে রেখে বললেন, “অনেক কথাই তো হল, কিন্তু কই, মুরারির কথা তো আপনি একবারও জিজ্ঞেস করলেন না?” 

বললুম, “ঠিক বলেছেন, ওর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলুম। তা মুরারি এখন কোথায়?” 

“আপনি এখানে থাকতে-থাকতেই তো ঘুষ নেবার দায়ে প্যালেসের চাকরি থেকে তাকে ঝিংড়ার জঙ্গল-মহলে ট্রান্সফার করা হয়। কিন্তু জঙ্গলে তার মন টিকবে কেন, চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কিছুদিন বাদেই সে বিষাণগড়ে তার বাবার কাছে ফিরে আসে। নারায়ণ ভার্মা তখন তাকে ব্যাবসায় লাগিয়ে দেন। তাতেও লালবাতি জ্বেলে সে রায়পুরে চলে যায়। শুনেছি সেখানে একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে খাতা লিখবার চাকরি পেয়েছিল। বছর খানেক সেই চাকরি করার পরে সেখান থেকেও বরখাস্ত। তারপর করছিল দালালির কাজ। সেটাই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। জমি বিক্রির আগাম হিসেবে কোন্ এক পার্টির কাছ থেকে নাকি হাজার কয়েক টাকা নিয়েছিল। পরে ধরা পড়ে যে, যাঁর জমি, মুরারির সঙ্গে তাঁদের কোনও কথাই হয়নি। ফলে মামলা হয়। আর তার ফলে যা হবার, তা-ই হয়েছে, মুরারি এখন জেল খাটছে।” 

“নারায়ণ ভার্মা টাকাটা দিয়ে দিলেন না?”

“ওইটেই তো মজা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথম দিকে ছেলেকে যিনি ক্রমাগত প্রশ্রয় দিয়েছেন, শেষদিকে তিনি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলেন। বাড়ি আর টাকা তিনি ছেলের বউয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন। তো মুরারি যখন বউয়ের কাছে এসে টাকার জন্যে কেঁদে পড়ল, তখন বউ যা বলল, সে একেবারে বাঁধিয়ে রাখার মতো।” 

“কী বলল মুরারির বউ?” 

“বলল, শ্বশুরের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আমি নিজের ছেলেকে পথে বসাতে পারব না।’ কালই এই গল্পটা আমি সুরজপ্রসাদ আগরওয়ালের ছেলের কাছে শুনলুম।” 

“সুরজপ্রসাদজির ছেলে? কেমন আছে তারা?”

“চমৎকার আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারাই তো এখন এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাবসাদার। আগে শুধু স-মিল আর জুয়েলারি শপ ছিল। এখন কী নেই? বাস, ট্রাক, মিনিবাস, তেলকল, কাপড়ের দোকান—কত আর বলব, এখানকার ব্যাবসা-বাণিজ্যের চোদ্দো আনা এখন তাদেরই হাতে।” 

“আর পামেলা?” 

“সেও ভাল আছে। আপনি বোধহয় জানেন না, ববি শুধুই হাসপাতাল করেনি, এখানে একটা কলেজও করে দিয়েছিল, আর একই সঙ্গে করে দিয়েছিল মেয়েদের একটা ইস্কুল। পামেলাই সেটা গড়ে তোলে। এখন সেখানে ছাত্রীর সংখ্যা কত জানেন? তা অন্তত হাজার খানেক তো বটেই।” 

“সেখানে গেলে পামেলার সঙ্গে দেখা হবে?” 

“আরে দুর মশাই,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সেখানে যাবেন কেন? সে তো কবেই রিটায়ার করেছে। তবে হ্যাঁ, বিষাণগড় ছেড়ে চলে যায়নি, এখানেই বাড়ি করে নিয়েছে একটা। দেখা যদি করতে চান, তো বাড়িতেও অবশ্য যেতে হবে না। আমার বিশ্বাস, সেও কাল এখানে আসবে। … কিন্তু না, আর কথা নয়, কলকাতা থেকে যা আনতে বলেছিলুম, সেটা এবারে আমাকে দিয়ে দিন। তারপর শুয়ে পড়ুন।” 

স্যুটকেস খুলে শিবলিঙ্গ বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে দিলুম। তিনি সেটিকে আলোর সামনে ধরে বললেন, “চমৎকার। ঠিক এইরকমই আনতে বলেছিলুম।” তারপর নিজের স্যুটকেস খুলে তার মধ্যে সেটিকে রেখে আবার তালা বন্ধ করলেন। 

মাত্র এক মুহূর্ত। কিন্তু স্যুটকেসের মধ্যে যে আরও একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে, তারই মধ্যে সেটা আমি দেখতে পেয়েছিলুম। বললুম, “ওটিই আপনি ব্যাঙ্গালোর থেকে নিয়ে এসেছেন, তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই রহস্যময় হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়েও রইলেন অনেকক্ষণ। কিন্তু কিছু বললেন না।

২৪

ছ’টায় ঘুম ভাঙল। গোটা বাড়ি তার অনেক আগেই জেগে উঠেছিল। একতলা থেকে যে-সব আওয়াজ আসছিল, তাতে বুঝলুম, ডেকরেটারের লোকজনেরাও কাজে লেগে গিয়েছে। 

লছমি এসে ঘরে ঢুকে বলল, “উঠে পড়ো চাচাজি, আর কত ঘুমোবে।” 

লেপের তলা থেকে মুখ বার করে বললুম, “ওরে বাবা, এখনও তো রাতই কাটেনি।”

“শীতকালে কি আর তাড়াতাড়ি রাত কাটে? বাথরুমে গরম জল রেখে এসেছি, চোখমুখ ধুয়ে নাও, তারপর নীচে গিয়ে দ্যাখো, বাগানময় লাইট জ্বেলে কীভাবে কাজ চলছে।” 

কুয়াশার আড়াল থেকে সূর্যদেবের উদয় হতে-হতে সাতটা বাজল। অথচ তারই মধ্যে দেখলুম, চাঁদোয়া খাটিয়ে তার তলায় মস্ত মস্ত দড়ির কার্পেট বিছিয়ে ঝপাঝপ চেয়ার পাতার কাজ চলছে। আটটার মধ্যেই ডেকরেটরের কাজ শেষ। খানিক বাদে পুরুত ঠাকুরও এসে গেলেন। ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়, কিন্তু চেহারায় ইতিমধ্যেই গাম্ভীর্যের ছাপ পড়েছে। শুনলুম ইনি দ্বারভাঙ্গার লোক, প্যালেস কম্পাউন্ডে যে শিবমন্দির রয়েছে, তার নিত্যপূজার ভার এখন নাকি এঁরই হাতে। এসে বললেন, “আটটার মধ্যে আসবার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু সকালবেলায় ওখানে যে পুজো হয়, সেটা না-সেরে তো আসতে পারি না, তাই একটু দেরি হয়ে গেল।” 

যমুনাদিদি বোধহয় সারারাত্তির দু’চোখের পাতা এক করেননি, লছমিও মনে হয় জেগেই ছিল, নইলে নিশ্চয় পুজোর জোগাড়যন্তর ভোরবেলার মধ্যে শেষ করা যেত না। পুরুতঠাকুর মন্দিরে গিয়ে ঢুকলেন। প্রাথমিক যে-সব বিধিনিষেধের ব্যাপার রয়েছে, তাতে মন দেবার আগে জানিয়ে দিলেন যে, বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হবে ঠিক দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে, শাস্ত্রমতে নাকি আজ সেটাই সবচেয়ে ভাল সময়। 

যশোমতী দেবী আসবেন জানতুম, কিন্তু, নাতিকে নিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যেই যে তিনি এসে পড়বেন, তা ভাবিনি। রানি-মাকে প্রথম যখন দেখি, তাঁর বয়স তখন বছর-পঁয়ত্রিশ। অসামান্যা রূপবতী ছিলেন। এমন রূপ, যার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে এসেছিল। আজ তাঁর বয়স প্রায় আশি, মাথা একেবারে ধবধবে সাদা, মুখে দুঃখের ছাপ বড় স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। শরীর অবশ্য এই বয়সেও সেই আগের মতোই ছিপছিপে আর সটান। চোখে আর ঠোঁটে যে এক টুকরো হাসি সবসময়ে লেগে থাকত, সেটাও একেবারে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বীকার করব, পাশ থেকে যদি না ভাদুড়িমশাই বলে দিতেন যে, ইনি কে, রানি-মা’কে তা হলে হয়তো দেখবামাত্র আমি চিনতে পারতুম না। 

আমন্ত্রিতদের মধ্যে প্রায় কেউই তখনও এসে পৌঁছননি। প্যান্ডেল একেবারে ফাঁকা। ওঁদের দুজনকে তাই বাড়ির মধ্যে একতলার বৈঠকখানায় নিয়ে এলুম। লছমি আর সুমঙ্গল সেখানে ডেকরেটরের পাওনা টাকা নিয়ে কথা বলছিল। রানি-মা’কে ঢুকতে দেখে লছমি তক্ষুনি এগিয়ে এসে জাজিমের উপরে তাঁদের বসাল। তারপর দুটো তাকিয়া এনে দুজনের দু’পাশে রেখে বলল, “আপনি যে সত্যি দিল্লি থেকে আসবেন, তা কিন্তু আমরা ভাবতেও পারিনি। মা তো কালই আপনাদের আসবার কথা শুনেছেন। বললেন যে, এ আমাদের মস্ত সৌভাগ্য।” 

যশোমতী দেবী মৃদু হেসে বললেন, “সৌভাগ্য তো আমার। তোমার দাদু ছিলেন আমাদের কুলপুরোহিত। তাঁর বাড়িতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তাও আমাদের উপাস্য দেবতা মহেশ্বরের বিগ্রহ, আর আমি আসব না, তাও হয় নাকি? এ তো আমারই মস্ত পুণ্য হল।” 

ছোট্ট শিবলিঙ্গটি দেখলুম বৈঠকখানা-ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রয়েছে। বললুম, “বিগ্রহ এখনও ঠাকুরঘরে রেখে আসোনি?” 

লছমি বলল, “চাচাজি, আমি তো রেখে আসতেই চেয়েছিলুম। কিন্তু ঠাকুরমশাই বললেন, আগে তিনি জায়গাটাকে শুদ্ধ করে নেবেন। আরও নাকি কীসব কাজ রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠা তো দশটার আগে হবেও না, সে তো তুমিও শুনলে, তার আগে ভাল সময় নেই। তো বিগ্রহ ওখানে সাড়ে ন’টা নাগাদ পৌঁছে দিলেই হবে।” 

বললুম, “সরস্বতী কোথায়?” 

সুমঙ্গল বলল, “আর বলবেন না। ঠান্ডা লেগে বাচ্চাটার একটু জ্বর হয়েছে। বেশি নয়, একশো পয়েন্ট চার। কিন্তু বড্ড ঘ্যানঘ্যান করছে, সরস্বতী তাই নীচে নামতে পারছে না। বলল যে, প্রতিষ্ঠার সময় তো নামতেই হবে, তখন নামবে।” 

বললুম, “তা হলে এক কাজ করো। হয় লছমি কিংবা তুমি এখানে থাকো, আমি তা হলে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। একটু বাদেই তো সবাই আসতে শুরু করবেন।” 

যশোমতী দেবী বললেন, “কাউকে এখানে থাকতে হবে না। বলতে গেলে আমি তোমাদের ঘরের লোক, আমার সঙ্গে ভদ্রতা করার দরকার নেই। আমি বরং খানিকক্ষণ এখানে থাকি, তারপর লোকজন এসে গেলে সামনে গিয়ে বসব। কিরণ, তুমিও সামনে গিয়ে দাঁড়াও, লোকজন এসে পড়লে আমাকে খবর দিয়ো।” 

লোকজন ন’টা নাগাদ আসতে শুরু করল। তার খানিক বাদে ভিতরে গিয়ে রানি-মা’কে খবর দিলুম। তিনি বললেন, “তা হলে আর এখানে বসে থেকে কী হবে। চলো, বাইরে গিয়ে বসি। পুরনো আমলের কিছু লোকজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। অনেকদিন তো ওঁদের দেখিনি।” 

বাইরে এসে রানি-মা দারুণ খুশি। পুরনো আমলের বেশ কিছু লোক ইতিমধ্যে এসে পড়েছিলেন। তাঁদের অনেকে আবার রাজ-এস্টেটেই কাজ করতেন। রানি-মা’কে ঘিরে দাঁড়ালেন তাঁরা। জনার্দন আর ড্যানিয়েলও ছিল তাঁদের মধ্যে। দেখলুম, দুজনেই একেবারে থুথুড়ে বড়ো হয়ে গেছে। 

এসেছিলেন কুলদীপ আর পামেলাও। ভাদুড়িমশাই তাঁদের এনে রানি-মা’র কাছে বসিয়ে দিলেন। রানি-মা বললেন, “দীপ তো দিল্লিতেই থাকে। মাঝে-মাঝে আসেও আমার কাছে। পামেলাকেই বরং অনেক বছর বাদে দেখলুম। কেমন আছ তুমি পামেলা?” 

পামেলা হেসে বললেন, “যশ্, আমি তোমার চেয়ে দু’বছরের বড়। তা এই বয়সে আর কতটা ভাল থাকা যায়? বেঁচে যে আছি, এই যথেষ্ট।” 

রানি-মাও হাসলেন। তারপর বললেন, “অথচ দীপকে দ্যাখো। ও তো তোমার চেয়ে তিন বছরের বড়। কিন্তু এই বয়েসেও ব্যাবসার কাজে শুনি সমানে চক্কর মেরে বেড়ায়। আজ যদি কলকাতা যাচ্ছে তো কাল বোম্বাই। ও আর বুড়ো হল না।” 

শুনে কুলদীপ সিংও হেসে উঠলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। 

একটা ব্যাপার লক্ষ করছিলুম। যশোমতী দেবী আর কুলদীপ সিং যে পরস্পরকে ‘দীপ’ আর ‘যশ’ বলেন, সেটা জানা ছিল। কিন্তু পামেলাকে এই প্রথম আমি রানি-মা’কে ‘যশ্’ বলতে শুনলুম। তাতে বুঝলুম, দুজনের মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রয়েছে, বাইরের কাউকে পামেলা সেটা জানতে দিতে চাইতেন না। একান্তে যখন দেখা হত, পরস্পরকে তখন তাঁরা নাম ধরেই ডাকতেন হয়তো, কিন্তু চাকরি করতে হলে কতকগুলি কেতা তো মানতেই হয়, পামেলা সেই কেতাকে সবসময় মান্য করে চলতেন। কিন্তু আজ আর তিনি প্যালেসের বেতনভোগী কর্মচারী নন, তাই সেই কেতা মানবারও কোনও দরকার আর যেন তিনি বোধ করছেন না। 

সবাই হাসছিল। সবাই কথা বলছিল। শুধু যশোমতী দেবীর নাতিটি দেখলুম চুপচাপ বসে আছে। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের ছেলে, এই বুড়োর মজলিশে কাউকেই সে চেনে না, সেইজন্যেই সে হয়তো একটু অস্বস্তিবোধ করছিল। খানিক বাদে সে উঠে দাঁড়াল, রানি-মাকে বলল, “দাদিজি, তুমি বোসো, আমি বরং যাই।” 

রানি-মা বললেন, “ঠিক আছে, তুই তা হলে গেস্ট হাউসে চলে যা। আমি তো এক্ষুনি উঠতে পারব না। অনেক দিন বাদে এদের সঙ্গে দেখা হল, একটু কথা বলি। তা ছাড়া বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবে। সে-সব হোক, তারপরে যাব।” 

ছেলেটি চলে গেল। 

তারও খানিক বাদে সুমঙ্গল এসে বলল, “ভাইয়া, আপনি আর ভাদুড়িদাদা একটু ভিতরে আসুন।”

ভিতরে গিয়ে দেখি, বৈঠকখানা-ঘরে লছমি একেবারে পাথরের একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে বললুম, “ব্যাপার কী, এত গম্ভীর কেন?” 

লছমি একেবারে ফুঁপিয়ে উঠল। “সর্বনাশ হয়ে গেছে চাচাজি! বিগ্রহটা খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ এই কুলুঙ্গির মধ্যেই ছিল!” 

“সে তো আমিও দেখেছি। তা হলে গেল কোথায়? অন্য কোথাও সরিয়ে রাখিসনি তো?”

“কখন সরাব! আমি তো সেই তখন থেকে এ-ঘরে আর ঢুকিইনি! ঠাকুরঘরে বসে মা’কে সাহায্য করছিলুম।” 

সুমঙ্গল বলল, “তখন থেকে মানে কখন থেকে?” 

“সেই যখন রানি-মা তার নাতিকে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে এসে বসলেন তখন থেকে।” 

সুমঙ্গল বলল, “তার মানে এঁরা ছাড়া তখন থেকে বেশ-কিছুক্ষণ এ-ঘরে কেউ ছিলই না?” 

আমি বললুম, “তুমি বোধহয় খারাপ কিছু ভাবছ সুমঙ্গল। কিন্তু রানি-মা তো এখনও এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাননি, বাইরেই তিনি বসে আছেন।” 

সুমঙ্গল তাড়াতাড়ি বলল, “না না, আমি খারাপ কিছু ভাবছি না। তা ছাড়া ওঁরা কেন বিগ্রহ সরাবেন, ওটা নিয়ে ওঁরা করবেনই বা কী?”

বললুম, “দিদি জানে? 

লছমি বলল, “মা এখনও জানে না। সরস্বতীও জানে না। শুধু আমরা ক’জন জানি। তবে এক্ষুনি তো পুরুতঠাকুর বলবেন, বিগ্রহ নিয়ে এসো। তখন তো আর কিছু চেপে রাখা যাবে না। ভাবতেই তো আমার মাথা ঘুরছে।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “আপনি চুপ করে আছেন কেন? একটা কিছু বুদ্ধি দিন। রানি-মাকে গিয়ে ডিসক্রিটলি একবার জিজ্ঞেস করব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওঁকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। উনি কিছু জানেন বলেও মনে হয় না। যাকে জিজ্ঞেস করলে লাভ হত, সে তো একটু আগেই এখান থেকে চলে গেল।” 

হঠাৎ মনে হল, তাই তো, এ নিশ্চয় রানি-মা’র ওই নাতিটির কাজ। বললুম, “সে তো গেস্ট-হাউসে গেল। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করব?” 

“আমার ধারণা, সেখানেও তাকে পাবেন না। বিগ্রহ যদি সে সরিয়েই থাকে, তবে তারপরেও গেস্ট-হাউসে বসে থাকবে, এত নির্বোধ সে নিশ্চয়ই নয়।”

বললুম, “তা হলে এখন উপায়?” 

লছমির মুখ একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিল। অস্ফুট গলায় সে বলল, “কী হবে তা হলে?” 

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “বোকা মেয়ে, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিস, তাই না? আরে, তোদের বিগ্রহ ঠিকই আছে। যশোমতী দেবী তাঁর নাতিকে নিয়ে যখন এখান থেকে বেরিয়ে সামনে গিয়ে বসলেন, তার একটু বাদেই আমি আবার ওদিক থেকে এই বৈঠকখানা ঘরে এসেছিলুম। এসে মনে হল, বিগ্রহটিকে এখানে এইভাবে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না, তাই উপরে নিয়ে রেখে এলুম। এক্ষুনি আবার এনে দিচ্ছি। চলুন কিরণবাবু, উপর থেকে মহেশ্বরকে আবার নীচে নামানো যাক।”

লভূমির মুখে আবার হাসি ফুটেছে। বলল, “উঃ চাচাজি, কী ভয়ই যে পেয়েছিলুম।” 

আমার একটা খটকা লাগছিল। উপরে উঠতে-উঠতে ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “কই, আপনাকে তো তখন আমি একবারও এদিকে আসতে দেখিনি। গেটের দিকে সারাক্ষণ তো আপনি আমার পাশেই ছিলেন।” 

বিনা বাক্যে ভাদুড়িমশাই তাঁর স্যুটকেস খুলে তার ভিতর থেকে দুটি শিবলিঙ্গের একটিকে বার করে আনলেন। বললুম, “এটি তো আমি কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছি। আর অন্যটা তো আপনি এনেছেন বাঙ্গালোর থেকে। এঁদের বিগ্রহটি তা হলে কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি দেখছি একটা হাঙ্গামা না-বাধিয়ে ছাড়বেন না। একটু চুপ করে থাকুন তো, অত কথা বলবার দরকার কী। চুপচাপ সব দেখে যান।” 

স্যুটকেস বন্ধ করে আমার আনা বিগ্রহটি তিনি হাতে তুলে নিলেন। ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। দেখলুম, সিঁড়ির কাছে সরস্বতী দাঁড়িয়ে আছে। ভাদুড়িমশাইকে বলল, “আপনার কথামতো উপর থেকে গেটের দিকে লক্ষ্য রাখছিলুম। হ্যাঁ, সে-ই। একটু আগে বেরিয়েও গেল দেখলুম।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ঠিক আছে। তুই আর তা হলে উপরে বসে থাকবি কেন? ছেলেকে নিয়ে এবারে নীচে নেমে আয়।” 

তাঁর হাতের বিগ্রহটি দেখিয়ে সরস্বতী বলল, “এটিই তো ভাইয়া কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছেন?” 

“হ্যাঁ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চিন্ত থাক্, তফাতটা কেউ বুঝতে পারবে না।” 

আমার কিছুই বোধগম: হচ্ছিল না। সবই যেন হেঁয়ালির মতো লাগছিল। কিন্তু ভাদুড়িমশাই তো কথা বলতে নিষেধ করেছেন, তাই একেবারে চুপ করে রইলুম। 

নীচে নেমে শুনলুম, পুরুতঠাকুর বিগ্রহ পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। যে-সময়ে প্রতিষ্ঠা করার কথা, তার আর বিশেষ দেরি নেই। আমরা নামতে লছমি আর সুমঙ্গল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বিগ্রহটি সুমঙ্গলের হাতে তুলে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাও, সাবধানে এটিকে এবারে মন্দিরে পৌঁছে দিয়ে এসো।” 

.

বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজ সাড়ে দশটার মধ্যেই শেষ হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও বাকি ছিল আনুষঙ্গিক নানা অনুষ্ঠান, পূজা-পাঠ আর প্রসাদ বিতরণ। সে-সব মিটতে মিটতে একটা বেজে গেল। আমন্ত্রিতদের জন্যে চা, কফি আর শরবতের ব্যবস্থা ছিল, তবে যে-কেটারারকে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার লোকজনরা খুবই দক্ষ, আমাদের আর তাই সেদিকে নজর রাখার কোনও দরকারই হয়নি। বেশিরভাগ লোকজনই অবশ্য খানিক সময় বসে আর গল্পগুজব করে তারপর চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু এই একটা ব্যাপার লক্ষ করে খুব ভাল লাগল যে, সমস্ত কাজ মিটে না নাওয়া পর্যন্ত যশোমতী দেবী তাঁর চেয়ার ছেড়ে একবারও নড়লেন না। যাবার আগে বাড়ি। প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করলেন, প্রত্যেকের খোঁজখবর নিলেন, আমার সঙ্গেও কথা বললেন কিছুক্ষণ। বললেন, “কিরণ, তুমি তো শুনলুম মাঝে-মাঝে দিল্লি আসো, এবার এলে দেখা কোরো।” 

একটু আগেও বাড়ি যে একেবারে লোকজনে ভর্তি হয়ে ছিল, এখন আর তা বুঝবার উপায় নেই। ডেকরেটরের লোকেরাও দেখলুম, এরই মধ্যে চাঁদোয়া খুলতে শুরু করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করতে বলল যে, কালই আর-একটা বাড়িতে কী-একটা উৎসব রয়েছে, মালপত্র নিয়ে আজই সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করা দরকার। 

সুমঙ্গল বলল, “যাঃ, সব একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল!” 

আমি বললুম, “এবারে আমাকেও যেতে হবে। এখন তো বাসের খুব সুবিধে। রায়পুরে পৌঁছে মাঝরাত্তিরের ট্রেনটা যদি ধরতে পারি তো বেশ হয়।” 

লছমি বলল, “তুমি কি খেপেছ চাচাজি! এতই যদি তোমার ফিরবার তাড়া তো এলে কেন?” হেসে বললুম, “আসতে খুব ইচ্ছে হল, তাই এসেছি।” 

“কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করছে না, কেমন? দাঁড়াও, মা’কে ডেকে আনছি।” 

সত্যিই গিয়ে দিদিকে ডেকে আনল। দিদি বললেন, “কে ফিরে যেতে চাইছে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি নই। তিনদিনের আগে আমি ফিরছি না।” 

গতিক সুবিধের নয় দেখে বললুম, “আমিও কিন্তু এমন কথা বলিনি যে, আজই ফিরব। শুধু বলেছিলুম যে, ফিরতে পারলে ভাল হয়।” 

দিদি বললেন, “না ভাইয়া, ভাল হয় না। রাজবাড়ির এই ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়েছে যে, আপাতত দিন-সাতেক তিনি রোজকার পুজোর কাজটা চালিয়ে দেবেন, কিন্তু এর মধ্যে আর কাউকে ঠিক করে নিতে হবে আমাদের। তা তোমরা থাকতে-থাকতে সেটা ঠিক করে দাও, তারপর যেয়ো।” 

বললুম, “ঠিক আছে, তা-ই হবে। তা হলে বরং এক রাউন্ড চা হয়ে যাক।” 

লছমি বলল, “তোমরা বোসো, আমি তোমাদের চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। চা খেয়ে বরং সর্সোতিয়ার ধার থেকে একবার ঘুরে এসো। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আজ আর রান্নার পাট রাখা হয়নি। যেমন এ-বেলায় খেয়েছ, রাত্তিরে। তেমনি কিন্তু স্রেফ ফলমূল আর মিষ্টি খেয়ে থাকতে হবে।” 

চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। ভাদুড়িমশাই, আমি, সরস্বতী আর সুমঙ্গল। লছমি এল না, বাড়িতে সে মায়ের কাছে থেকে গেল। তা ছাড়া সরস্বতীর ছেলের ঘুম এখনও ভাঙেনি। জেগে উঠবার পরে দিদাকে দেখতে না পেলে সে কান্না জুড়ে দেবে।