বিষাণগড়ের সোনা – ১৫

১৫ 

পামেলাকে দেখে আমি যে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম, সে-কথা বলা-ই বাহুল্য। অন্ধকারে আমার কোয়ার্টার্সের মধ্যে এইভাবে তিনি বসে আছেন কেন? রাত তো কম হয়নি। এত রাতে আমার কাছে তাঁর আবার কী দরকার পড়ল? 

বলতুম, “কী ব্যাপার? আপনি এখানে?” 

পামেলা হাসলেন। বললেন, “খুব অবাক হয়ে গেছেন, তা-ই না?” 

“হওয়াই তো স্বাভাবিক। আলো জ্বালেননি কেন?” 

“আপনি গেছেন প্যালেসে, অথচ আপনার কোয়ার্টার্সে আলো জ্বলছে, এইটে দেখে মিশ্রজি হয়তো দোতলায় উঠে আসতে পারতেন। সেটা আমি চাইনি।’ 

“আলো না-জ্বেলে তা হলে ভালই করেছেন। কিন্তু দরকারটা কী?”

“সেটা বলবার আগে বরং আপনাকেই একটা প্রশ্ন করি। প্যালেসে আপনার ডাক পড়েছিল কেন?” 

একে তো মনটা একটু খিঁচড়েই ছিল, তার উপরে এটাও বুঝতে পারছিলুম যে, যে-কোনও কারণেই হোক, ইতিমধ্যেই আমি কিছু-লোকের বিষনজরে পড়েছি, সুতরাং এই চাকরিটার মেয়াদ আর খুব বেশিদিনের নয়। তা হলে আর কোনও কথা গোপন করে লাভ কী। কিন্তু পামেলা তো শুনেছি, এখানকার পোলিটিক্যাল অফিসার রিচার্ড উইলসনের বোন, এঁকে যদি সব কথা খুলে বলি তো ইনি যে আজই সে-কথা এঁর ভাইয়ের কানে তুলে দেবেন না, তারও তো নিশ্চয়তা নেই। তিক্ততা তাতে বাড়বে বই কমবে না। তা হলে? 

পামেলা নিশ্চয়ই আমার দ্বিধার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন, “আপনার সংকোচের কোনও কারণ নেই। সব কথা আমাকে খুলে বলুন। আসলে আমিও আপনাকে দু-একটা কথা বলব বলেই এসেছি, কিন্তু তার আগে আপনার কথাটা আমার জানা দরকার। …না না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি কথা দিচ্ছি, যা বলবেন, তা শুধু আমিই জানব, অন্তত আমার কাছ থেকে আর কেউ তা কখনও জানবে না।” 

কী জানি কেন, মনে হল, ইনি আমার সঙ্গে কোনও ছল-চাতুরির খেলা খেলতে আসেননি, এঁকে বিশ্বাস করা চলে। প্যালেসে আজ যা-যা ঘটেছে, সবই তাই খুলে বললুম। এমনকি, যার থেকে সবকিছুর সূচনা, সে-সব ঘটনার কথাও বাদ লিম না। 

পামেলা সব শুনে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “কুলদীপ খুব রেগে গিয়েছে, কেমন?” 

“একা ওঁর কথা বলছেন কেন, রেগে রয়েছেন তো মনে হল সবাই। তফাত শুধু এই যে, কুলদীপ সিং যেখানে চেঁচিয়ে তাঁর রাগটা প্রকাশ করছেন, ওঁরা সেখানে চেঁচাচ্ছেন না। মিঃ উইলসন চালাক মানুষ, সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন যে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে আমার মুখ বন্ধ করা যাবে না। তাই গলার পর্দা উঁচুতে না-তুলে জানিয়ে দিলেন যে, মুখ না খোলাটাই আমার পক্ষে নিরাপদ হবে। প্রোমোশানের কথাটা তো রানি-মা’র কাছে আগেই আমি শুনেছিলুম। তা হঠাৎ যে কেন এই প্রোমোশান আমাকে দেওয়া হল, একই সঙ্গে সেটাও আমাকে জানিয়ে দিতে ভোলেননি।” 

“কতভাবেই যে একটা লোককে চুপ করিয়ে রাখা যায়!” 

“আমাকে চুপ করাবার ব্যবস্থা হল প্রোমোশানের ঘুষ দিয়ে।” 

“অন্যভাবেও করা যেত।” পামেলা রহস্যময় হাসলেন। “তবে আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা ভাল হত না। তার চেয়ে বরং এ অনেক ভদ্র ব্যবস্থা।” 

“বিলক্ষণ। কিন্তু কেন যে আমার মুখ বন্ধ করাবার জন্যে মাসে-মাসে এঁরা আমাকে বাড়তি আরও দেড়শো টাকা করে দিয়ে যাবেন, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কী, না ছোট রাজকুমার লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তিনটে কুকুর মেরেছেন, এটা আমাকে চেপে যেতে হবে। কেন, কেউ এ-কথা জানলে কী ক্ষতি হত তাঁর?”

“তাও বুঝতে পারছেন না? মস্ত ক্ষতি হত। লোকে জেনে যেত যে, রূপ একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। আর দিল্লির কানে সেই কথাটা একবার পৌঁছে গেলেই হত সর্বনাশ। ববিকে বঞ্চিত করে তার ছোট ভাইকে সিংহাসনে বসাবার জন্য প্যালেস থেকে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে তো, তখন আর সেটা সম্ভব হত না।” 

আমার যেন ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। বললুম, “ববি… মানে আপনি কি বড় কুমারবাহাদুরের কথা বলছেন?” 

পামেলা বললেন, “হ্যাঁ। তাকে তো আপনি দেখেছেন। যদ্দুর জানি, আপনার আলাপও হয়েছে তার সঙ্গে। অবশ্য প্যালেসের নতুন কেয়ারটেকার এসে পৌঁছেছেন শুনে প্রথম রাত্তিরেই সে যেভাবে এসে আপনার সঙ্গে আলাপ জমাবার চেষ্টা করেছিল, তা বোধহয় আপনার পক্ষে বিশেষ স্বস্তিজনক হয়নি।” 

বললুম, “ওরেব্বাবা, সে তো এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।” 

“খুব ভয় পেয়েছিলেন?” 

“পেয়েছিলুম বই কি! বন্দুক উঁচিয়ে উনি আমার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, আর আমি ভয় পাব না?” 

“তারপরে আর এসেছিল?” 

“এসেছিলেন। রানি-মা যেদিন ডেকে পাঠান, সেইদিন তাঁর কাছ থেকে ঘুরে এসে দেখি, বড় কুমারবাহাদুর আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। বললেন যে, আমি যদি মুরারিপ্রসাদের ধড়মুণ্ডু আলাদা করে দেব বলে তাঁকে কথা দিই, তো সেই মহৎ কাজের জন্যে তাঁর তলোয়ারটা তিনি এক্ষুনি আমাকে দিয়ে দিতে রাজি আছেন। পাঁচ হাজার টাকা ইনামও আমার মিলবে। তবে হ্যাঁ, কাটা মুণ্ডুটা তাঁকে দেখাতে হবে, তা নইলে তিনি এক কানাকড়িও দেবেন না।” 

“শুনে কী মনে হল আপনার?” 

যা মনে হয়েছিল, তা বলাটা খুব নিরাপদ হবে কি না, বুঝতে পারছিলুম না। তাই পামেলার কথা জবাব না দিয়ে বললুম, “ওই যা, আপনাকে এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে বলা হয়নি। এখানে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই, তবে হালে একটা স্টোভ কিনেছি, কিছু চা-পাতা, কনডেন্সড মিল্ক আর চিনিও স্টকে আছে। অনুমতি করেন তো স্টোভটা ধরিয়ে জল বসিয়ে দিই।” 

পামেলা উইলসন খর চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “মিঃ চ্যাটার্জি, আমি নিশ্চয় এত রাতে আপনার এখানে চা খেতে আ। `নি। যা বলছিলেন, বলুন।” 

“কী বলব। বড় রাজকুমার তো হুকুম দিলেন, যাও, ঘ্যাঁচ করে ওর যুণ্ডুটা কেটে নিয়ে এসো। শুনে আমি পড়লুম আতান্তরে। কী আর করি, হাত জোড় করে বললুম, কুমারবাহাদুর, আপনি যখন বলছেন তখন মুণ্ডু নিশ্চয় কাটাই উচিত। কিন্তু কাটি কী করে, আমি তো তরোয়াল চালাতেই জানি না।” 

ভেবেছিলুম, আমার যুক্তি শুনে পামেলার মুখে হয়তো হাসি ফুটবে। কিন্তু ফুটল না। যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সেইভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল, “কথা ঘোরাবার চেষ্টা করছেন কেন মিঃ চ্যাটার্জি? আপনি কি আমার প্রশ্নটার জবাব দিতে চান না?”

বললুম, “যাচ্চলে, প্রশ্নটা তো মনেই নেই।” 

“বেশ, তা হলে মনে করিয়ে দিচ্ছি। দু’দিন তো ববিকে আপনি দেখলেন, তার কথাও শুনলেন। তা দেখে-শুনে আপনার কী মনে হল?” 

আবার এড়িয়ে গেলুম প্রশ্নাকে। বললুম “কী আর মনে হবে, রাজ-রাজড়ার ব্যাপাব, তাঁরা তো এই ধরনের কথাই বলে থাবে ন, তাতে অবাক হলে চলবে কেন?” 

পামেলার চোখ একটু অগেও জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ সেই চোখের দৃষ্টি যেন নিবে গেল। স্নান গলায় তিনি বললেন, “বুঝতে পেরেছি, আপনি কিছু বলতে চান না। ঠিক আছে, তা হলে বরং আমিই বলি, কেমন? প্রথম দিনই বকে আপনার পাগল বলে সন্দেহ হয়েছিল, আর দ্বিতীয় দিন যখন তার কথা শুনলেন, তখন আপার সন্দেহটা একেবারে পাকা হয়ে গেল, আপনি বুঝে গেলেন যে, সে পাগলই বটে। অর্থাৎ কিনা বিষাণগড়ের দুই কুমারই ঘোর উন্মাদ। কী, ঠিক বলছি তো?” 

এবারও আমি কোনও উত্তর দিলুম না। পামেলা বললেন, “কিন্তু না, মিঃ চ্যাটার্জি, আপনার ধারণাটা ঠিক নয়। এই দু’ জনের একজন পাগল ঠিকই, কিন্তু অন্যজন একেবারে স্বাভাবিক। … হ্যাঁ, আমি ববির কথা বলছি। বি পাগল নয়। এ টোটালি হার্মলেস ইয়াং ম্যান, হি উড়নট ইভন কিল এ ফ্লাই। ও শুধু এইসব কথা বলে লোককে চমকে দিতে চায়। কিন্তু লোকে তো তা বোঝে না, তারা ওকে পাগল ভেবে বসে’ তাতে অবশ্য ববিকে যাঁরা হটাতে চান, সেই দলটার খুব সুবিধে হয়ে গেছে। ডিকিকে তাঁরা বোঝাতে পেরেছেন যে, বড়কুমার পাগল, তাই ছোটকুমার রূপেরই সিংহাসনে বসা উচিত।” 

“ডিকি মানে…” 

“রিচার্ড উইলসন। বিষাণগড়ের পোলিটিক্যাল অফিসার। এ-রাজ্যে সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের প্রতিনিধি। অর্থাৎ আমার দাদা। …কেন, আপনি এ-কথা জানতেন না?” 

“জানতুম। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। আপনি তো পোলিটিক্যাল অফিসারের বোন, আর তাই প্যালেসে এই যে ক্ষমতা-দখলের খেলা চলছে, এ-খেলায় তিনি যে-পক্ষে আছেন, আপনারও তো সেই পক্ষেই থাকবার কথা। অথচ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে, আপনি রয়েছেন তাঁর উল্টোদিকে এটা কী করে হয়?” 

“না-হবার কী আছে!” অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে পামেলা বললেন, “ডিকি যেহেতু অন্যায় করছে, অতএব আমাকেও অন্যায় করতে হবে? আমি আমার নিজের বিবেক-বুদ্ধিমতো চলতে পারব না? এই অন্যায়টা আমি মেনে নেব?” 

এমনভাবে পামেলা কথা বলছিলেন বে, আবারও আমার মনে হল যে, এই মহিলা আমার সঙ্গে সত্যিই হয়তো কোনও চালাকির খেলা খেলতে আসেননি। মনে হল, এঁর যেটা বলবার কথা, অন্তত এখনও পর্যন্ত তা উনি খোলাখুলি আমাকে জানিয়েছেন। আর তাই, আমি যা ভাবছি, তাও হয়তো এঁকে খোলাখুলি জানানো যায়। 

বললুম, “ন্যায়-অন্যায়ের কথা এ-সব ব্যাপারে যত কম বলা যায়, ততই ভাল। একে তো আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলির কোনওটাই যে খুব ন্যায়ের পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আমার মনে হয় না, তার উপরে আবার এইসব ছোটখাটো নেটিভ স্টেটগুলির তো কথাই নেই, এদের প্রায় প্রত্যেকটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঘোর অন্যায়ের পথে। বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, এই বিষাণগড়ের কথাই ধরুন। শুনছি, এখানকার রাজারা মূলত রাজস্থানের লোক, সেখানকার রাজবংশের সঙ্গেই এঁদের বিয়ে-শাদি হয়, এঁদের ধমনীতে রাজপুত-রক্তধারা বইছে। ছোট রানি-মা অবশ্য পঞ্জাব থেকে এসেছেন, কিন্তু সেখানকার যে ছোট একটা রাজ্য থেকে এসেছেন, সেটাও হিন্দু-রাজার রাজ্য, আর সেখানকার রাজাও যে রাজপুত, এই সহজ কথাটা ভুলে যাবেন না। তো প্রশ্ন হচ্ছে এটা তো রাজস্থান নয়, তার কাছাকাছি এলাকাও নয়, একেবারে ষোলো-আনা আদিবাসী-অঞ্চল, তা হলে হঠাৎ এখানে এই রাজপুত-রাজবংশের উদ্ভব হল কী করে?” 

“আপনার কী মনে হয়?” 

“আমার কী মনে হয়, সেটা একটু বাদেই বলব। তার আগে বলি, হিন্দুদের তীর্থ তো গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে, যেমন উত্তর দক্ষিণ আর পশ্চিম, তেমনি পূর্ব ভারতেও রয়েছে এমন অনেক বিখ্যাত মন্দির, হাজার-হাজার লোক যেখানে পুজো দিতে আসে। সেকালেও আসত। এই যেমন পুরীর জগন্নাথ মন্দির। সেকালেও বিস্তর লোক আসত ওখানে। রাজা-রাজড়ারাও আসতেন বই কী। তো ধরুন রাজস্থান কি পঞ্জাব কি ওইরকমই কোনও জায়গার এক রাজামশাইয়ের বুড়ো খুড়ো কি বুড়ি-মা’র তীর্থদর্শনের সাধ হয়েছ। ধরুন, কাছেপিঠে যে-সব তীর্থক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলি তাঁর দেখা হয়ে গেছে, এবারে তিনি পুরীতে এসে জগন্নাথ-দর্শন করতে চান। তা তিনি তো আর একা আসবেন না, সঙ্গে বিস্তর লোকলস্কর পাইক-পেয়াদাও থাকবে। আর হ্যাঁ, থাকবে একজন জাঁদরেল গোছের দলপতিও। তো, অনেক ক্ষেত্রে যেমন সৈন্যবাহিনীর কাউকে দলপতি করে পাঠানো হত, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আবার দলপতি করে পাঠানো হত রাজামশাইয়ের মেজো, সেজো কি ছোটভাইকে।” 

“তাতে কী হয়েছে? সে তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।” 

হেসে বললুম, “স্বাভাবিক তো বটেই, তবে কিনা তীর্থদর্শনের পালা সাঙ্গ হবার পরে কিন্তু এই দলপতিদের অনেকেই আর দেশে ফিরে যেতেন না।” 

“কেন?” 

“তাও বুঝতে পারছেন না? ছোটখাটো সেনাপতিই হোক আর রাজামশাইয়ের ভাই-ই হোক, এমনিতে তো তাঁদের রাজা হবার কোনও সম্ভাবনাই নেই, অথচ রাজা সবার শখ রয়েছে ষোলো আনা। তাই কিছু লোককে সঙ্গে দিয়ে বৃদ্ধ খুড়োমশাই কি বুড়ি রানি-মাকে তাঁরা দেশে পাঠিয়ে দিতেন, আর বাছাই করা কিছু লোককে নিয়ে এই দূর-বিদেশেই যিনি যতটা পারেন জায়গা-জমি দখল করে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন নতুন একটা রাজবংশ। কাজটা যে খুব কঠিন ছিল, তাও তো নয়। সবই তো জঙ্গুলে জায়গা, থাকবার মধ্যে আছে কিছু আদিবাসী। তাদেরও অবশ্য রাজা ছিল, কিন্তু সেই জংলি রাজাকে তাড়িয়ে দিয়ে তাঁর জায়গা-জমি কেড়ে নেওয়া কি খুব শক্ত কাজ? একটু খোঁজ নিন, তা হলেই জানতে পারবেন যে, এখানকার রাজপুত্র-রাজ্যগুলির কোনওটাই খুব প্রাচীন নয়। এই বিষাণগড়ের রাজবংশের বয়সই বা কত হবে মিস উইলসন? মেরেকেটে দুশো কি আড়াইশো বছর। এখানেও নিশ্চয় এক আদিবাসী-রাজা ছিলেন, বাইরে থেকে এসে অন্যায়ভাবে খাঁন জায়গা-জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। তো এই হচ্ছে ব্যাপার। আজ তা হলে হঠাৎ ন্যায়-অন্যায়ের কথা উঠছে কেন? তাও বুঝতুম যদি এঁরা সত্যিকারের স্বাধীন রাজা হতেন। কিন্তু তা তো এঁরা নন, সিংহাসনে যে-ই বসুক, রাজ্য তো আসলে আপনারা অর্থাৎ ইংরেজরাই চালাবেন।” 

পামেলা স্থির চোখে আমাকে দেখছিলেন। এবারে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন, “আপনার কাছে এসে বোধ হয় আমি ভুলই করেছি। কী জানি কেন আমার “নে হয়েছিল যে, আপনি হয়তো ‘নামাকে সাহায্য করবেন। এটা আরও মনে হয়েছিল রূপকে সেদিন কীভাবে আপনি বাধ’ দিয়েছিলেন তা জানবার পর। ঠিক আছে, আমি তা হলে উঠি। 

বললুম, “উঠবেন না, বসুন। আমি কিন্তু এমন কথা এখনও বলিনি যে, যে আপনাকে আমি সাহায্য করব না। তবে কিনা আমি যা বিশ্বাস করি, তাও তো আপনাকে জানানো দরকার।” 

“কী বিশ্বাস করেন আপনি?” 

“বিশ্বাস করি যে, বিষাণগড়ের সিংহাসনে কে বসল আর কে না-বসল, তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কোনও দরকার করে না। কেন করে না জানেন? লাগামটা তো আপনাদের হাতে। আর তাই ববি আর রূপের মধ্যে যে-ই রাজা হোক, তাতে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। ইট ওন্ট মেক এনি রিয়েল ডিফারেন্স।” 

“বাট ইট উইল।” 

এমন তীব্র স্বরে, এমন কেটে-কেটে এই শব্দ তিনটিকে উচ্চারণ করলেন পামেলা যে, আমি চমকে গেলুম। বললুম, “এ-কথা কেন বলছেন?” 

“এইজন্য বলছি যে, ববিকে আমি ওর তিন বছর বয়েস থেকে দেখছি।” 

“আর রূপকে?” 

“আমি যখন ববির গভর্নেস হয়ে এই প্যালেসে আসি, রূপের বয়েস তখন দেড় কি দু’বছর। রূপ আর-একটু বড় হবার পর ওর দায়িত্বও আমার হাতে এসে যায়। দুজনকেই আমি সমান আদর দিয়েছি, শাসনও কাউকে কিছু কম করিনি। ববি মা-হারা ছেলে, রূপের মা আছে। কিন্তু তাই বলে যে রূপকে আমি কিছু কম ভালবাসতুম, তা তো নয়। অথচ একটু যখন বড় হল ওরা, তখনই আমি বুঝতে পারলুম যে, দুই ভাইয়ের স্বভাব একেবারে দুই রকমের। ববি সাহসী, রূপ ভিতু। ববি উদার প্রকৃতির ছেলে, রূপ স্বার্থপর। তা ছাড়া ও খুব নিষ্ঠুরও বটে। বাগানে বেড়াতে বেড়াতে লক্ষ করতুম যে, দু’ভাই-ই ফড়িং আর প্রজাপতি ধরবার জন্যে সমানে দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু ববি যেমন সেগুলিকে ধরেই আবার উড়িয়ে দিচ্ছে, রূপ তা করছে না। সে সেগুলিকে পিষে পিষে মারছে। এই যে নিষ্ঠুরতা, বয়েস বাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে এটা আরও বেড়ে যায়। বাট দেন হি ইজ আ কাওয়ার্ড। আর তাই মারবার জন্যে এমন প্রাণীকে ও বেছে নেয়, বাধা দেওয়ার ক্ষমতাই যার নেই। কিছুদিন আগেই ও হাতুড়ি মেরে একটা সিয়ামিজ বেড়ালের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। রানি-মা’র বেড়াল, কলকাতার এক ডিলারের কাছ থেকে একজোড়া আনানো হয়েছিল, তার একটা তো তাঁর ছেলের হাতে মরল, বাকিটা সারাদিন এখন বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর কী যে কাতরভাবে ডাকছে, সে আর বলবার নয়। কিচ্ছু খায় না, খেতে দিলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, মনে হচ্ছে না-খেয়েই সেটা এবার মারা পড়বে। এমন সুন্দর প্রাণীকে কেউ মারতে পারে, তা আমি স্বচক্ষে না-দেখলে বিশ্বাস করতুম না। তারপর তো তিনটে ড্যাশুন্ডকেও মারল। কিন্তু ওই যে বললুম, হি ইজ আ কাওয়ার্ড। তাই মারতে হলে বেড়াল কি ড্যাশুন্ডকেই মারবে। বাড়িতে একজোড়া ডালম্যাশিয়ান কুকুরও তো রয়েছে, কিন্তু কই, তাদের ঘাঁটাবার মতো সাহস তো হয় না।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন পামেলা। তারপর বললেন, “দয়া করে ভাববেন না যে, আমি বায়াস্ড। না, তা আমি নই। ডিকি এখানে পোলিটিক্যাল অফিসার হয়ে আসবার অনেক আগে থেকেই আমি এদের দেখছি। তেইশ বছর বয়েসে গভর্নেস হয়ে এই রাজবাড়িতে আমি এসেছিলুম, আর আজ আমার বয়েস সাঁইত্রিশ। চোদ্দ বছর ধরে এই ছেলে দুটোকে আমি দেখছি। তাই আজ আমি একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যে, দেয়ার ইজ আ স্ট্রিক অভ্ ম্যাডনেস ইন রূপ। অথচ ববিকে পাগল বানিয়ে ওকেই কিনা রাজা বানাবার চেষ্টা চলছে। ও যদি সিংহাসনে বসে তো বিষাণগড়ের দুর্গতির আর সীমা থাকবে না, হোয়্যারঅ্যাজ ববি উইল মেক অ্যান একসেলেন্ট রুলার। আমি তো ওকে ভাল করেই জানি, যত রকমের কন্সট্রেন্টই থাক্ না কেন, প্রজাদের যাতে মঙ্গল হয়, তার জন্যে ও সত্যি কিছু করবে।” 

বললুম, “ইচ্ছে থাকলেই কি আর এই সেট্‌-আপে তা করা যায়?” 

“কেন যাবে না?” পামেলা বললেন, “ইউ মাস্ট হ্যাভ হার্ড অভ্ সার্ সয়াজি রাও গায়কোয়ার অভ্ বরোদা অ্যান্ড মহারাজা মাধব রাও সিন্ধিয়া অভ্ গোয়ালিয়র। এই সেট্-আপের মধ্যেও কি তাঁরা তাঁদের প্রজাদের জন্যে কিছু কম কাজ করেছেন? না মিঃ চ্যাটার্জি, যাঁর কাজ করবার ইচ্ছে থাকে, হাজার বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তিনি ঠিকই তাঁর কাজ করে যান। তাবৎ দোষ ইংরেজদের ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। আপনারা দেখে নেবেন, যদি সিংহাসন পায়, তা হলে ববিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।” 

হেসে বললুম, “ঠিক আছে, মেনে নিচ্ছি যে, ববি হাত গুটিয়ে বসে থাকার ছেলে নয়, সুযোগ পেলেই ও আস্তিন গুটিয়ে কাজে নেমে পড়বে। কিন্তু তা হলে ও অমন উল্টোপাল্টা কথা বলে কেন? ও-সব কথা শুনলে তো লোকে ওকেই পাগল ভাববে। 

“আমি তো বলেছি, ও ওইরকম কথা বলে লোকজনকে চমকে দিতে ভালোবাসে। কিন্তু সেটাও আসল কারণ নয়।” 

“আসল কারণটা কী?”

পামেলা আবার খরচোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে বললেন, “আসল কারণটা একমাত্র আমি জানি। ভেবেছিলুম, কাউকে সেটা জানাব না। কিন্তু যেমন আপনার তেমনি মিঃ ভাদুড়ির সাহায্য আমার পাওয়াই চাই। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আপনার আছে. মাঝে-মাঝে তিনি আপনার কাছে আসেনও। রানি-মা’র সঙ্গে কুলদীপের যে কথাবার্তা হয়, তাতে মাঝে-মাঝেই দেখেছি মিঃ ভাদুড়ির প্রসঙ্গ এসে যায়। ওঁদের কথাবার্তার সবটা আমি বুঝি না। তবে যেটুকু বুঝতে পারি, তাতে মনে হয়, মিঃ ভাদুড়ি মাস্ট বি আ ভেরি রিসোর্সফুল ম্যান; যে-কোনও কারণেই হোক, প্যালেসের লোকজনেরা সম্ভবত তাঁকে একটু খাতির করে। একটু ভয়ও পায়। আর তাই তাঁর সাহায্যও আমার পাওয়া দরকার। কী মনে হয় আপনার? সাহায্য করতে তিনি রাজি হবেন?”

“সেটা তো তাঁর ব্যাপার, আমি কী করে বলব?” 

“সাহায্য যদি না-ও করেন, আমি যে আদৌ তাঁর সাহায্যপ্রার্থী, সেটা তিনি ফাঁস করবেন না তো?”

“তা কেন করবেন? কোনও ভদ্রলোক তা কখনও করে?” 

“বাস্, এইটুকুই আমি জানতে চেয়েছিলুম।” পামেলা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “সে ক্ষেত্রে এই এতক্ষণ ধরে আমি যা-যা আপনাকে বলেছি, সবই আপনি তাঁকে বলুন। …না, শুধু বললেই যে হবে, তা নয়, তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখাও করিয়ে দিতে হবে।” 

“দু-চার দিনের মধ্যে?” 

“এত তাড়াতাড়ি নয়। কুলদীপ মাঝে-মাঝেই দিল্লি যাচ্ছে আজকাল। শুনছি একটা পিটিশান নিয়ে মে মাসেও একবার যাবে। তখন।” 

“বেশ, তা-ই হবে। কিন্তু একটা কথা আপনি এখনও বলেননি।” 

“ববি কেন পাগলামির ভান করে, এই তো?” আবার একটু চুপ করে রইলেন পামেলা। তারপর বললেন, “ও চায় যে, লোকে ওকে পাগল ভাবুক। কেননা…কেননা একমাত্র তা হলেই ও বেঁচে যাবে। বাট মিঃ চ্যাটার্জি, আই’ম অ্যাফ্রেড…আই’ম ভেরি মাচ অ্যাফ্রেড…” 

“কেন?” 

“আই থিংক দে হ্যাভ সিন থ্র হিজ গেম! আর সেইজন্যেই …”

“সেইজন্যেই কী?” 

“সেইজন্যেই এই প্যালেসে ও আর নিরাপদ নয়। যেমন করেই হোক, এখান থেকে ওকে সরে যেতে হবে।” 

“সরে কোথায় যাবে?” 

“কেন, রাজস্থানে, মাধোপুর স্টেটে। সেইখানেই তো ওর মামাবাড়ি। মাধোপুর ইজ আ মাচ বিগার স্টেট দ্যান বিষাণগড়। সেখানে ওর দাদামশাই এখনও বেঁচে। তা ছাড়া ওর মামারাও রয়েছেন।” 

“সেখানে গিয়ে ও কী করবে?” 

একেবারে অবাক হয়ে পামেলা খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এও কি একটা প্রশ্ন হল? দে আর ববি’জ ওউন পিপ্‌ল, অ্যান্ড অফকোর্স দে উইল লুক আফটার হিজ ইন্টারেস্ট। তাঁরা কি কিছু জানেন না ভেবেছেন? তাঁরা সবই জানেন। ববিকে যে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার চেষ্টা চলছে, তাও তাঁদের জানতে বাকি নে২। অ্যান্ড দে ওন্ট্ টেক ইট লায়িং ডাউন।” 

“এত সব তাঁরা জানলেন কী করে?” 

পামেলা হাসলেন। বললেন, “তা আমি বলব না। তবে একটা কথা জেনে রাখুন। আই ওয়ার্কড ইন মাধোপুর প্যালেস ফর টু ইয়ার্স। তাঁরাই সেখান থেকে আনাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন।” 

কথাটা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন পামেলা। আমার লেখার টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার এখানে মধ্যপ্রদেশের উপরে খানকয় বই রয়েছে দেখছি। আজকের জন্যে একখানা দিন তো।” 

“যেখানা খুশি নিয়ে যান।” 

“যে-কোনও একখানা দিন।” আবার হাসলেন পামেলা। “আমি যে আপনার এখানে এসেছিলুম, আর ছিলুমও যে অনেকক্ষণ, সেটা কি আর প্যালেসে কারও অজানা থাকবে ভেবেছেন? এ নিয়ে প্রশ্নও উঠবে। তখন একটা-কিছু কারণ দেখাতে হবে তো। বলব যে, এই বইখানার জন্যে এসেছিলুম।” 

যে-বইখানা এগিয়ে দিলুম, সেখানা হাতে নিয়ে চলে যেতে-যেতে দরজার কাছ থেকেই গামেলা আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। নিজের হাতব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করলেন তিনি, তারপর আমার দিকে সেটা ছুড়ে দিয়ে বললেন, “এটা সাবধানে রাখুন। ভিতরে কী আছে, তা যেন খুলে দেখতে যাবেন না। প্যাকেটটা কালই আপনার বন্ধুকে দিয়ে দেবেন। ওতে যা রইল, তা হয়তো পরে কখনও তাঁর কাজে লাগতে পারে।…আর হ্যাঁ, আর-একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার। আমি ইংরেজ নই। তবে ইংরেজদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে বটে।” 

হতভম্ব হয়ে বললুম, “সে কী, আপনি রিচার্ড উইলসনের বোন নন?” 

“বোন অবশ্যই।” রহস্যময় হেসে পামেলা বললেন, “তবে কিনা হাফ-সিস্টার। ডিকি অবশ্য সেটাও স্বীকার করতে চাইবে না। তা না-ই করুক, আমার তা নিয়ে কোনও নালিশ নেই।” 

আমি কিছু বলছি না দেখে পামেলা বললেন, “একটু ধাঁধা লেগে যাচ্ছে কেমন?”

বললুম, “তা তো লাগতেই পারে।” 

“ঠিক আছে, সবই তা হলে শুনুন। আমাদের বাবা এক, কিন্তু মা আলাদা। ডিকির বাবা যখন আর্মি-অফিসার হয়ে এ-দেশে আসেন, বউ-বাচ্চা তখন তাঁর সঙ্গে আসেনি। তার ফল যা হবার, তা-ই হল, এ-দেশি একটি মেয়ের সঙ্গে তিনি সংসার পেতে বসলেন। তবে কিনা ডিভোর্স পাননি তো, তাই বিয়েটা আর করা হল না। পেলেও করতেন কি না, সেটা অবশ্য সন্দেহের ব্যাপার। এখানকার সাহেবদের মহলে তা হতে ঘোর নিন্দে রটে যেত যে! তো এই হচ্ছে ব্যাপার। দয়া করে আর-কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।” 

পামেলা উইলসন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।” 

১৬ 

পরদিন সকালেই ভাদুড়িমশাইয়ের ফ্ল্যাটে গিয়ে সব কথা তাঁকে জানালুম। কিন্তু তিনি যে খুব বিস্মিত হয়েছেন, তা মনে হল না। দেখলুম তিনি হাসছেন। 

বললুম, “কী ব্যাপার বলুন তো? প্যালেসে নাকি আপনার খুব খাতির। শুনলুম, ওরা নাকি আপনাকে একটু ভয়ও করে। সত্যি?” 

ভাদুড়িমশাই আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দিলেন না। বললেন, “কিরণবাবু, মোটামুটি বছরখানেক হল আমি এখানে আছি। এর আগে আরও দু-দুটো জায়গায় আমি কাম্বারল্যান্ড ইনস্যুরেন্সের ব্রাঞ্জ ম্যানেজার ছিলুম। কোথায় ছিলুম জানেন?” 

“না তো।” 

‘পঞ্জাবের ধুল্সর আর রাজস্থানের মাধোপুরে।” 

“অর্থাৎ মহারাজা ধূর্জটিনারায়ণের দুই শ্বশুরবাড়ির স্টেটে?” 

“হ্যাঁ।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “কোম্পানির হেড অফিস তো লন্ডনে। সেখান থেকে দিল্লি-অফিসকে বলা হয়েছিল যে, বিষাণগড়ে যে একজন চৌখস লাক পাঠানো দরকার, এটা তাঁরাও জানেন, কিন্তু যাঁকেই সেখানে পাঠানো হোক, তার আগে অন্তত কিছুদিনের জন্যে তাঁকে যেন ধুল্সর আর মাধোপুর ব্রাঞ্চ থেকে ঘুরিয়ে আনা হয়।” 

শহরের পুব দিকে ছোট একটা পাহাড়। মার্কেট রোড থেকে একটা রাস্তা সেই পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। রাস্তাটার নাম হিলক রোড। সেইখানেই একটা বাড়ির একতলায় চলে কাম্বারল্যান্ড ইনস্যুরেন্সের ব্রাঞ্চ-অফিসের কাজকর্ম, আর দোতলায় এই কোয়ার্টার্স। ভাদুড়িশাই ন’টা নাগাদ একতলায় নামেন। 

কালুম, “একতলায় আপনার আপিসেও তো দু-চারবার এসেছি। তেমন কিছু ব্যস্ত আপিস বলে কখনও মনে হয়নি। আপনাদের বিজনেসের ভল্যুম নিশ্চয় এখানে খুব বেশি হবে না। তা হলে হঠাৎ একজন চৌখস লোক পাঠাবার দরকার হল কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার কথাটা একদিক থেকে সত্যি ঠিকই, আবার অন্য দিক থেকে সত্যি নয়। এখানে লাইফ ইনস্যুরেন্সের কাজ একেবারে যৎসামান্য, কিন্তু বার্গলারি, ডেকয়টি, ফায়ার ইত্যাদি বাবদেও তো আমরা বিমার ব্যবস্থা রেখেছি, তাতে যে ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালুর রিস্ক আমাদের কভার করতে হয়, এখানে তার টোটাল অঙ্কটা কত, তা আপনি ভাবতে পারেন?”

“কত?” 

“বহু কোটি টাকা। আর তার সাড়ে পনরো আনা-ই হচ্ছে বিষাণগড় প্যালেসের।”

“বলেন কী মশাই?” 

“একটুও বাড়িয়ে বলছি না। এদের যে কী পরিমাণ জুয়েলারি রয়েছে, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। শুধু সোনার গয়না নয়, মণিমুক্তোও রয়েছে অজস্র। বেশি কথায় যাব ন।, আপাতত শুধু একটা হিরের কথা বলি। স্রেফ এই একটা হিরেরই ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু হচ্ছে দু’কোটি টাকা। আগে অবশ্য সওয়া কোটি টাকা দাম ধরা ছিল, কিন্তু গত বছর হঠাৎ ওঁরা বলে বসলেন যে, ওটার দাম এখন থেকে দু’কোটি টাকা ধার্য করা হোক। আমরা বললুম, প্রিমিয়ামও কিন্তু তার ফলে অনেক বেড়ে যাবে। তো ওঁরা তাতেও গররাজি হলেন না। বললেন, সে তো বাড়বেই, ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু যখন বাড়ছে, তখন প্রিমিয়াম তো বাড়তেই পারে। তা এরপরে আর কথা কী। তখন যিনি এখানে ব্রাঞ্চ-ম্যানেজার ছিলেন, তিনি ফর্ম এগিয়ে দিলেন, আর রাজবাড়ির তরফে যাঁকে ওকালতনামা দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছিল, তক্ষুনি সেই ফর্ম ফিল আপ করে সই করলেন তিনি। তাতে হিরেটার দাম লিখে দিলেন দু কোটি টাকা। 

আমার বাক্‌স্ফুর্তি হচ্ছিল না। ঢোক গিলে কোনওরকমে বললুম, “ওরেব্বাবা!” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মাথা ঘুরে যাচ্ছে তো? তা মশাই, মিথ্যে কথা বলব না, বিষাণগড়ের এই খবর শুনে মাথা ঘুরে গিয়েছিল আমাদের দিল্লি অফিসের কর্তাদেরও। দে স্মেল্ট এ র্যাট, অ্যান্ড ইনফর্মড লন্ডন।” 

“অর্থাৎ কিনা কোম্পানির সন্দেহ হল যে, এর মধ্যে একটা গণ্ডগোল রয়েছে, কেমন?” 

“সন্দেহ তো হতেই পারে। দেখুন মশাই, কোনও ক্লায়েন্ট যখন তার ইনসিওর-করা জি। সৈপত্রের মধ্যে কোনও একটা পার্টিকুলার আইটেমের দাম নিজের থেকেই হঠাৎ বাড়িয়ে দেয় তখনই আমরা সন্দেহ করি যে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। আমাদের সন্দেহ হয় যে, ইনসিওর-করা বস্তুটি এবারে হাপিস হবে, আর ক্লায়েন্ট সেই বাবদে আমাদের কাছ থেকে আরও বেশি অঙ্কের ওই টাকাটা ক্লেম করবে।” 

“কে হাপিস করবে?” 

“ক্লায়েন্ট নিজেই। কেন, নিজের পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারপর ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়েছে, এমন ঘটনার কথা কি কখনও শোনেননি নাকি? এ-সব ক্ষেত্রে কী করা হয়, তাও জানেন নিশ্চয়? পুড়ে যাওয়া পাটের যা দাম, তার চেয়ে ঢের বেশি দাম লিখিয়ে রাখা হয় কোম্পানির কাছে। আর এ-ক্ষেত্রে তো আগুন লাগাবারও দরকার হচ্ছে না। ক্লায়েন্ট নিজেই তার জিনিসটাকে কোথাও পাচার করে দেবে, তারপর সেটা যে চুরি হয়েছে, থানায় এই মর্মে ডায়েরি করিয়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছে ক্লেম করবে তার দাম।” 

“কিন্তু ক্লেমটা জেনুইন কি না সেটাও তো আপনারা তদন্ত করে দেখবেন?” 

“তা দেখব বই কী, নিশ্চয় দেখব। ইনকুয়ারির কথা বলছেন তো? সেটাও থারীতি হবে। কিন্তু সে-সব সত্ত্বেও যে ডিজঅনেস্ট ক্লায়েন্ট তার ক্লেম-করা টাকা অনেক ক্ষেত্রে পেয়ে যাবে, তাও ঠিক। পাবে, তার কারণ ইনকুয়ারি যাদের দিয়ে করানো হবে, তারা একটা আলাদা ফার্মের লোক হতে পারে ঠিকই তবে কিনা সর্বক্ষেত্রে তারাও কিছু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নয়। তা ছাড়া, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির নিজস্ব লোকজনেরাও কি আর সক্কলেই খুব অনেস্ট? ক্লায়েন্টের সঙ্গে ষড় থাকা সম্ভব তাদেরও। তারাও হয়তো ক্লায়েন্টের টাকা খেয়েছে।” 

“অর্থাৎ সর্ষের মধ্যেই ভূত?” 

“তা থাকে বই কী। অন্তত আছে বলেই আমাদের কর্তাদের হয়তো সন্দেহ হয়েছিল।” 

“আর সেইজন্যেই এখানকার ব্রাঞ্চ-ম্যানেজারকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গায় আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “তা কী করে বলব? আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি। সেটা এই যে, এখানে আসবার আগে যে আমি মাধোপুরে আর ধুলসরে ছিলম, প্যালেসের লোকেরা তা খুব ভালই জানে। আপনি ওই যে বলছিলেন না, প্যালেসের লোকেরা আমাকে খাতির করে, একটু নাকি ভয়ও পায়, তো সেটা হয়তো এইজন্যেই। তবে হ্যাঁ, আর-একজন লোককেও ওরা নিশ্চয় ভয় পেত, যদি জানত যে, সে আসলে আমারই লোক। সে কিন্তু প্যালেসের মধ্যে আছে।” 

“বলেন কী?” 

“ঠিকই বলছি। দয়া করে এ নিয়ে আর টু-শব্দটি করবেন না, করলে শুধু যে আমাদেরই প্ল্যানটা বানচাল হবে, তা নয়, আপনারও বিপদ ঘটবে। কিন্তু আর নয়, এ-সব কথা এখন থাক, পামেলার কথা বলুন। সে কবে আমার সঙ্গে দেখা করবে?” 

“শিগগির নয়। মে মাসে কুলদীপ সিংয়ের দিল্লি যাবার কথা আছে, তার আগে দেখা করতে চাইছে না।” 

“অর্থাৎ কুলদীপকে সে ভয় পাচ্ছে কেমন?” 

“তা-ই তো মনে হল।” 

“আশ্চর্য!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কুলদীপকে দেখছি অনেকেই ভয় পায়। আমাদের এই অফিসেও দু’চারজন দেখেছি ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে থাকে। সে যাক্ গে, সুযোগ-সুবিধে মতো পামেলাকে বলে দেবেন, মে মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, আমার ইনফরমেশন যদি ঠিক হয় তো এপ্রিলেই কুলদীপ একবার আপনাদের রানি-মা’কে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি যাবে। সম্ভব হলে তখনই আসুক।…কিন্তু আপনার হাতে ওটা কী? কাগজপত্রের প্যাকেট বলে মনে হচ্ছে? পোস্ট করতে হবে?”

বললুম, “ওই যা, আসল কথাটাই ভুলে মেরে দিয়েছি। আপনার কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে পামেলা আমাকে প্যাকেটটা দিয়েছে। বলল, এটা হয়তো আপনার কাজে লাগতে পারে।” 

প্যাকেটটা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলুম। তিনি সেটা হাতে নিয়ে বললেন, “ওরেব্বাবা, এ তো সিলমোহর করা দেখছি!” 

সিলমোহন ভেঙে প্যাকেট খুলে তিনি তার ভিতর থেকে যা বার করে আনলেন, তা আর কিছুই নয়, এক তাড়া ফোটোগ্রাফ। কার ফোটোগ্রাফ, ভাদুড়িমশাইকে সেগুলি পাঠানো হয়েছে কেন, কিছুই বুঝতে পারলুম না। ভাদুড়িমশাই প্রতিটি ফোটোগ্রাফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, তারপর আবার সেগুলিকে প্যাকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী মশাই, দেখবার জন্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে নাকি?”

বললুম, “একেবারেই না। কাল রাতে এই প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে পামেলা যা বলেছিল, তার তো একটাই মাত্র অর্থ হয়, দে আর মেন্ট ফর ইয়োর আইজ ওলি।” 

“থাক, তা হলে আর আপনার দেখে কাজ নেই। কিন্তু কী আছে এর মধ্যে, সেটা অন্তত জেনে রাখুন।” 

“কী আছে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডাইনামাইট। অর্থাৎ সেই বস্তু, যা দিনে পাহাড় পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু না, আর গল্প নয়, ন’টা বাজে, এবারে আমি একতলায় নামব। আপনারও তো দফতরে বাবার সময় হল।” 

বললুম, “আজ মহারাজা ধূর্জটিনারায়ণের জন্মদিন না? আজ আমাদের ছুটি।” 

.

এপ্রিল আর মে মোটামুটি শান্তিতেই কেটে গেল। ভাদুড়িমশাই ঠিকই বলেছিলেন। এপ্রিল মাসেই রানি-মা’কে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি গেলেন কুলদীপ সিং, আবার ফিরেও এলেন দিন পনেরো বাদে। পামেলা তারই মধ্যে একদিন গিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, তবে দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা আমি জানি না। পামেলাকে সাহায্য করতে ভাদুড়িমশাই রাজি হয়েছেন কি না, তা না। 

বেশ গরম পড়ে গেছে। দুপুরটা তো তেতে একেবারে আগুন হয়ে যায়। বিকেলেও তার জের চলতে থাকে। ভোরবেলাটা অবশ্য এখনও মোটামুটি ঠাণ্ডা। তারপর একটু বেলা হতেই সূর্যদেব সেই যে ডাণ্ডা ঘোরাতে শুরু করেন, পৃথিবীর চাঁদি একেবারে ফেটে চৌচির হবার উপক্রম হয়। তবে সন্ধেটা বড় মনোরম। ভোরবেলাতেও অবশ্য হাঁটতে বার হই। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। সন্ধেবেলায় লছমি সঙ্গে থাকে। তাকে নিয়ে সর্সোতিয়ার ধারে গিয়ে বসি। ভাদুড়িমশাই আর ডঃ সিদ্দিকির সঙ্গে তখন দেখা হয়। 

ইদানীং আবার যমুনাপ্রসাদ উপাধ্যায়ও মাঝে-মাঝে আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় এসে যোগ দিচ্ছেন। ভদ্রলোক এককালে বিষাণগড়ের রাজবৈদ্য ছিলেন। ধূর্জটিনারায়ণের মৃত্যুর পর থেকে যেহেতু প্যালেসে তাঁর খাতিরও অনেক কমে গেছে, তাই বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখন পুনায় তাঁর ছেলের কাছে থাকেন। বিষাণগড়ে আসেন মাঝেমধ্যে। বাড়িঘর সবই তো এখানে, তাই জায়গাটাকে একেবারে ছেড়ে থাকতেও পারেন না। 

ভদ্রলোকের গল্পের স্টক অফুরন্ত। শুনতে-শুনতে অনেক সময় বেশ রাত হয়ে যায়। লছমি ঘুমিয়ে পড়ে। তাঁকে কাঁধে তুলে বাড়ি ফিরি। ভাদুড়িমশাই আমাকে প্যালেসের দেউড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। মাঝে-মাঝেই ভাদু।ড়মশাই বলেন, “বেড়াতে বেরিয়ে এত রাত করবেন না, কিরণবাবু। একটু তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার চেষ্টা করবেন।” 

সেদিনও তিনি এই কথাটা আবার বললেন। তাতে আমি বললুম, “কেন, ভয় কীসের? সেই যে হরদেও মারা গিয়েছিল, তার পরে তো আর কিছু ঘটেনি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঘটতে কতক্ষণ। একটু সাবধানে থাকুন মশাই।”

বললুম, “কী গরম পড়েছে দেখছেন তো। সন্ধের পর ওই যে একটু নদীর ধারে গিয়ে বসি, শরীর যেন জুড়িয়ে যায়। চট করে আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না।” 

ভাদুড়িমশাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজবাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে পড়লুম। মিশ্রজি বারান্দায় বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “আজও দেরি করলি বেটা?” 

ঘুমন্ত লছমিকে তাঁর কোলে তুলে দিয়ে লজ্জিত গলায় বললুম, “একটু দেরি হয়ে গেল। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, এখন ঘুম থেকে তুলে ওকে খাওয়াতে নিশ্চয় দিদির খুব কষ্ট হবে।” 

যমুনা দেবী আমাদের কথাবার্তা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বললেন, “আমার কষ্ট নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ভাইয়া, দয়া করে একটু নিজের কথা ভাবো। এই যে এত রাত অব্দি বাইরে থাকো, এটা ভাল নয়।” 

হেসে বললুম, “ভাদুড়িমশাইও তা-ই বলছিলেন বটে।” 

“ভাদুড়িদাদা ঠিকই বলছেন।” মিশ্রজির কাছ থেকে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে যমুনা দেবী ভিতরে চলে গেলেন। 

ভাদুড়িমশাই যে ঠিকই বলেছেন, কিছুদিন বাদেই সেটা বোন গেল। 

এপ্রিল আর মে মাসে ঝড়বৃষ্টি হবার কথা, কিন্তু তাও বিশেষ হয়নি, ফলে গরম একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। মিশ্রজি বললেন, “আর ক’টা দিন একটু সহ্য কর বেটা, জুনের প্রথম হপ্তায় তো বর্ষা আসে, তখন দেখবি সব একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে।” 

তা বর্ষা নামল পনরোই জুন। অমন বর্ষা কলকাতায় কখনও দেখিনি। দু-তিন দিন ধরে নাগাড়ে বৃষ্টি। তাও মুষলধারে। ঘাস মরে হলদে হয়ে গিয়েছিল, তাদের পাতা ঢাকা পড়েছিল ধুলোর পুরু সরে। কিন্তু দেখতে-দেখতে যেন পালটে গেল সবকিছু। যেদিকে তাকাই, সবই একেবারে ঝকঝকে সবুজ, সর্সোতিয়াতেও ঢল নেমেছে। বর্ষার তোড়ে কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের রক্তিম বাহার হঠাৎ মুছে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্যালেস রোড ধরে ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় যে, ভারী মিষ্টি একটা গন্ধের দেওয়াল ঠেলে আমাকে হাঁটতে হচ্ছে। তাতে বুঝতে পারি যে, সড়কের পুব দিককার বাংলো বাড়িগুলির প্রত্যেকটার বাগানেই বেল আর জুঁই ফুটেছে অজস্র। 

তারিখটা ভুলে যাইনি। আঠাশে জুন। সেদিনও ঘুম থেকে উঠে, চোখেমুখে জল দিয়েই হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছিলুম। তখনও আলো ফোটেনি, শুধু রাতের অন্ধকার ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, পুবের আকাশে কালোর বদলে পড়তে আরম্ভ করেছে নীলচে ইস্পাত-রঙের পোচড়া। 

রাত্তিরে জোর বৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু জায়গাটা তো পাহাড়িয়া, তাই কোথাও জল জমেনি। শুধু মনে হচ্ছিল যে, হোস পাইপে তোড়ে জল ঢেলে প্যালেস রোডকে আরও ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে। 

পথ একেবারে নির্জন। এটা শৌখিন পাড়া। বুঝতে পারছিলুম যে, এখনও এখানে কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। শেষ-রাত্তিরে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় একটু ঠান্ডাও পড়েছে তো, হয়তো সেইজন্যেই সবাই একেবারে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। 

হাঁটতে-হাঁটতে স্টেট গেস্ট-হাউস পর্যন্ত পৌঁছেই চমকে উঠতে হল। নদীর ধার, ঢালু ঘাস- জমির উপরে, উবু হয়ে কেউ বসে আছে। দু-এক মুহূর্ত পরেই লোকটি উঠে দাঁড়াল, আর তখনই বুঝতে পারলুম যে, তিনি ভাদুড়িমশাই। 

বললুম, “কী ব্যাপার মশাই, ওখানে কী দেখছেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিরণবাবু? ভালই হল। এদিকে একবার আসুন তো।” 

আমি হাঁটছিলুম প্যালেন রোডের পুবদিককার পেভমেন্ট ধরে। রাস্তা পেরিয়ে নদীর দিকের পেভমেন্টে চলে এলুম। আর পরক্ষণেই যা চোখে পড়ল, তাতে একেবারে হিম হয়ে গেল আমার রক্ত। 

দেখলুম, ঢালু ঘাসজমির উপরে ছড়িয়ে পড়ে আছে তিনটি মানুষ। যেভাবে পড়ে আছে, তাতেই বুঝলুম যে, তারা ঘুমোচ্ছে না, তাদের একজনের শরীরেও প্রাণ নেই। পাশেই এলোমেলোভাবে পড়ে আছে তিনটে লাঠি। লাঠির ডগায় একটা করে পুঁটলি বাঁধা। 

বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবার শব্দ হচ্ছে, জিভ শুকিয়ে গিয়েছে, খানিকক্ষণ সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম, তারপর কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করলুম, “এরা কারা?” 

আমার কথার কোনও উত্তর দিলেন না ভাদুড়িমশাই। ডান পাটা কালি চপ্পলের ভিতর থেকে বার করে নিলেন তিনি, তারপব সেই পায়ের সাদা মোজাটাকে খুলে নিয়ে মোজাটা ডান হাতে পরে নিলেন। পরক্ষণে পুঁটলি তিনটির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তার ভিতরকার জিনিসগুলোকে বার করে আনলেন। সেগুলি পরীক্ষা করতে করতেই আমার দিকে তাকালেন একবার। বললেন, “ও-সব কথা পরে হবে। গেস্ট হাউসে ঢুকে থানায় এক্ষুনি ফোন করুন। বলুন, সর্সোতিয়ার ধারে তিনটে ডেডবি পড়ে আছে। দেরি না-করে ওরা কাউকে পাঠিয়ে দিক। …যান্, যান, আর দেরি করবেন না।”

১৭ 

ভেবেছিলুম, ঘুম থেকে একটু তাড়াতাড়ি উঠে সরস্বতীদের বাড়ি থেকে হোটেলে ফিরে আসব। দিল্লিতে কয়েকটা জরুরি কাজ এখনও বাকি, এ-যাত্রায় সেগুলি না সারলেই নয়। কিন্তু একে তো ঘুমিয়েছি দেরিতে, তার উপরে শীতকাল, লেপের মায়া কাটাতে কাটাতে তাই সাড়ে আটটা বেজে গেল। তার উপরে যেমন লছমি, তেমনি সরস্বতীও বেঁকে বসল যে, ব্রেকফাস্টটা না-খেয়ে বেরোনো চলবে না। দিদি অবশ্য কিছু বলছিলেন না, কিন্তু তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলুম যে, কিছু যদি না-খাই, তো তিনি কষ্ট পাবেন। 

দাড়ি কামিয়ে, স্নান করে, ব্রেকফাস্ট সেবে রওনা হতে হতেই তাই সাড়ে দশটা বাজল। হোটেলে পৌঁছলুম সওয়া এগারোটায়। ভাদুড়িমশাই-২ নামিয়ে দিলেন। বলে গেলেন, এয়ারপোর্টে ইন্ডিয়ান এারলাইনসের কাউন্টারের কাছেই তিনি অপেক্ষা করবেন। আমি তাঁর টিকিটখানা চেয়ে রাখলুম, ভবনের বোর্ডিং কার্ডে যাতে পাশাপাশি সিট-নম্বর লিখিয়ে নিতে পারি। মালপত্র বলতে নেহাতই দুজনের দুটো হ্যান্ডব্যাগ, কেবিনে ও দুটো আমাদের সঙ্গেই থাকবে, সুতরাং তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। 

হোটেলে আমার ঘরে ঢুকে হ্যান্ডব্যাগটা চটপট গুছিয়ে নিলুম। তারপর সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে ফের নেমে এলুম একতলার রিসেপশান কাউন্টারে। চাবি জমা দিয়ে, হোটেলের পাওনা মিটিয়ে চেক-আউট করতে করতে আরও মিনিট পনেরো। হোটেলে যে আর ফিরব না, সেটা আগেই ঠিক করে রেখেছিলুম। দুপুরের খাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। কনট সার্কাসে তো দু-তিনটে অফিসে যেতেই হচ্ছে, সেখানে কাজ সেরে পালিকা বাজারে ঢুকে যে-কোনও ফাস্ট-ফুডের দোকান থেকে হালকা কিছু খেয়ে নেব। 

দুপুরে কাজকর্ম যত তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দিতে পারব ভেবেছিলুম, তত তাড়াতাড়ি “অবশ্য হল না। কাজ ছিল বাবা খড়গ সিং মার্গেও। কনট সার্কাসের ঝামেলা মিটিয়ে তাই সেখানেও একবার ঢুঁ মারতে হল। তারপরে আবার আটকে গেলুম একটা মিছিলে। প্রায় ঘণ্টাখানেক একেবারে নট-নড়ন-চড়ন-নট-কিচ্ছু অবস্থা। ফলে, যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলুম, টেক-অফ টাইমের তখন আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি। সিকিউরিটি-চেকের ডাক তার অনেক আগেই পড়ে গিয়েছে। 

দূর থেকেই ভাদুড়িমশাই!ক দেখতে পেয়েছিলুম। কাউন্টারের কাছাকাছি যে চেয়ারের সারি, তারই একটায় বসে তিনি পাশের এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর পরে দেখা। তবু যে দেখবামাত্র মানুষটিকে আমি চিনতে পারলুম, তার কারণ আর কিছুই নয়, মনোক্‌ল আর গোঁফ। বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। কুলদীপ সিংয়ের বয়েস তো এখন বিরাশি-তিরাশির কম হবে না। এখানে তিনি কী করছেন? 

আমাকে দেখেই ভাদুড়িমশাই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “কী ব্যাপার, এত দেরি?”

বললুম, “একটা মিছিলে আটকে গিয়েছিলুম, তাই দেরি হয়ে গেল।” 

কুলদীপ সিং বললেন, “গুড ইভ্‌নিং মিঃ চ্যাটার্জি, অনেক দিন বাদে আবার দেখা হল।”

বললুম, “গুড ইভ্‌নিং। আপনারা একটু বসুন, আমি ততক্ষণে বোর্ডিং কার্ডের ব্যবস্থা করি।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে কুলদীপ বললেন, “ঠিক আছে, আপনারা আসুন, আমি ততক্ষণে সিকিউরিটির দিকে এগোই। বুড়ো হয়েছি, আমি তো তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারব না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কলকাতায় কোথায় উঠছেন?” 

“বরাবর তো গ্র্যান্ডে উঠি, এবারেও তা-ই উঠব। কেন, আপনি আসবেন? কোনও কথা ছিল?”

“না, না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-যাত্রায় আর দেখা হবে বলে মনে হয় না। কালই আমি ব্যাঙ্গালোরে ফিরছি। তবে সামনের মাসে তো দেখা হচ্ছেই। যদি অবশ্য আপনি বিষাণগড়ে আসেন।” 

কাউন্টারের ভিড় ইতিমধ্যে একেবারে হালকা হয়ে গিয়েছিল। চটপট বোডিং কার্ড করিয়ে নিয়ে আমরাও সিকিউরিটির দিকে রওনা হলুম। যেতে-যেতেই পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ঘোষণা শোনা গেল : প্যাসেঞ্জারস ফর ক্যালকাটা, দিস ইজ আওয়ার লাস্ট কল্ ফর ইয়োর সিকিউরিটি চেক। 

এয়ারবাস ফ্লাইট। প্লেনে উঠে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়েই বোঝা গেল যে, প্যাসেঞ্জার আজ কম। বিস্তর আসন ফাঁকা পড়ে আছে। যে সারিতে আমাদের সিট, সেটা খুঁজে নিয়ে পাশাপাশি দুজনে বসে পড়লুম। তারপর সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে মৃদু গলায় বললুম, “আমাদের বিষাণগড়ের বন্ধুটিকে দেখছি না যে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “উনি কি আর আপনার-আমার মতো ফেলু পার্টি? নিশ্চয় ‘জে’ ক্লাসের টিকিট, সামনের দিকে বসেছেন।” 

“আপনার কথা শুনে মনে হল, সামনের মাসে উনিও বিষাণগড়ে যাবেন। সত্যি?” 

“মিথ্যে বলব কেন?”

“উপলক্ষটা কী?” 

“তাও বলতে হবে? বিষাণগড়ের গঙ্গাধর মিশ্র মশাই যে বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন, জানুয়ারি মাসে সেখানে শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা হবে না? তো সেই সময় আমরা যেমন বিষাণগড়ে যাব, তেমনি কুলদীপও যাবেন।” 

“কুলদীপ সে-কথা জানলেন কী করে? আপনি ওঁকে বলেছেন বুঝি?” 

“তা বলেছি বই কী।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “এত ধুমধাম করে একটা কাজ হতে যাচ্ছে, আর ওঁকে সেখানে গিয়ে দুদিন থাকতে বলব না?… কেন, কুলদীপ যাচ্ছেন শুনে আপনি ঘাবড়ে গেলেন নাকি?” 

তক্ষুনি-তক্ষুনি ভাদুড়িমশাইয়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেওয়া গেল না। তার কারণ, প্লেন ইতিমধ্যে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে চলতে-চলতে রানওয়ের একটা প্রান্তে এসে এক মুহূর্ত থেমে থেকেই ভীষণভাবে গর্জে উঠেছে, আর পরক্ষণেই শুরু করে দিয়েছে তার প্রচণ্ড দৌড়। কানে প্রায় তালা লেগে যাবার জোগাড়। 

সেকেন্ড কয়েক বাদেই আমরা আকাশে উঠে পড়লুম। গর্জন ক্রমে শান্ত হয়ে এল। ঘোষণা শোনা গেল : আপনারা এবারে ধুমপান করতে পারেন, সিট-বেল্টও খুলে ফেলতে পারেন, তবে কিনা ওটা বেঁধে রাখাই উচিত হ্যায়। 

বললুম, “ঘাবড়ে যাবার কথা কী বলছিলেন?” 

“বলছিলুম যে, কুলদীপ সম্পর্কে আপনার ভয় কি আজও কাটেনি?” 

“ভয় নয়, একটা অস্বস্তি ছিল। সেটা এখনও কাটেনি। লোকটাকে যখন প্রথম দেখি, তখনই মনে হয়েছিল, ওর মাথায় হরেক মতলব খেলছে। পরে দেখলুম, সেটা মিথ্যে নয়। আজও ওকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলুম।” 

“আরে দূর,” ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “সে-সব তো প্রায় গতজন্মের ব্যাপার। নাইনটিন ফর্টিসিক্সের পরে যে তেতাল্লিশ বছর কেটে গেছে, সেটা ভুলে যাবেন না। তখন ওর অর্থলোভ ছিল, ক্ষমতার লোভ ছিল, কিন্তু বয়েসও ছিল চল্লিশ বছরের মতো। আর আজ ও বিরাশি তিরাশি বছরের বুড়ো। এই বয়েসে ও টাকা দিয়েই বা কী করবে, ক্ষমতাই বা ওর কোন্ কাজে লাগবে?” 

“বাট ইউ শুড হ্যাভ থট্ অভ পামেলা। তার জীবনটা তো ও নষ্ট করে ছেড়েছে।”

“পামেলার কথা যে আমি ভাবিনি, তা আপনাকে কে বলল? ভেবেছি মশাই, ভেবেছি। যেমন পামেলার কথা ভেবেছি, তেমনি ভেবেছি যশোমতী দেবীর কথা। …ও হ্যাঁ, একটা খবর তো আপনাকে বলাই হয়নি, কিরণবাবু। আপনাদের ছোটরানি-মাও জানুয়ারি মাসে বিষাণগড়ে আসছেন। 

“এই একই উপলক্ষে?” 

“হ্যাঁ। বিষাণগড়ের রাজবংশ হচ্ছে মহেশ্বরের উপাসক, আর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার মতো একটা পবিত্র অনুষ্ঠানে তিনি আসবেন না? তাই কখনও হয়? নাকি হওয়া উচিত?” 

আমার বিস্ময় ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। বললুম, “তিনিও যে আসবেন, তা আপনি জানলেন কী করে?” 

“কুলদীপকে আসতে বললুম তো, তা তিনি বললেন যে, যশোমতী দেবীকেও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।” 

“শিবলিঙ্গটি যে পুরন্দর মিশ্র জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তাও বলেছেন নিশ্চয়?” 

“বা রে, তা কেন বলব না?” ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “অর্ডারি শিবলিঙ্গ হলে কি আর তার প্রতিষ্ঠায় ওঁদের এত উৎসাহ হত? ও-সব তো রোজই কোথাও-না-কোথাও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আর এ হচ্ছে প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি করা ব্যাপার। তাও কোথায় সেটা পাওয়া গেছে? না, জঙ্গলে। দেখুন না, খবরটা একবার রটে যাক, তখন নাগপুর থেকেও রিপোর্টার আর ফোটোগ্রাফাররা দল বেঁধে ছুটে আসবে।” 

“ওরেব্বাস! এটা তো ভেবে দেখিনি! আপনি তো দেখছি এই উপলক্ষে একটা মেলা বসিয়ে দেবার তালে আছেন। যা বললেন, তাতে তো মনে হচ্ছে বিস্তর লোক আসবে।” 

ভাদুড়িমশাই রহস্যময় হাসলেন। তারপর তাঁর আধ-খাওয়া সিগারেটটাকে সিটের হাতলে লাগানো অ্যাসট্রের মধ্যে পিষে দিয়ে বললেন, “আসুক, আসুক। যত লোক আসে, ততই ভাল। দ্য মোর দ্য মেরিয়ার।” 

খাবারের ট্রলি এসে গিয়েছিল। তাই আর তখন কোনও কথা হল না। বাকি পথটাও বলতে গেলে চুপচাপই কাটল। 

দমদমে নেমে ভাদুড়িমশাই একটা ট্যাক্সি নিলেন। তারপর আমাকে শেয়ালদায় আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন বালিগঞ্জের দিকে। যাবার আগে বললেন, কলকাতার কাজ সেরে পরদিনই তিনি বাঙ্গালোরের ফ্লাইট ধরবেন। সুতরাং ইতিমধ্যে আর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। 

একটা কথা এখানে বোধহয় বলে রাখা ভাল। যদিও একই প্লেনে আমরা কলকাতায় এলুম, দমদমে নেমে কুলদীপকে আর দেখতি পাইনি। 

.

জন্মেছিলুম বোধহয় পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে, যত্রতত্র ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়িয়েছি, দু’দণ্ড কোথাও থিতু হয়ে বসা হত না, একটানা কোনও জায়গায় কয়েকদিন কাটাবার পরেই মনে হত, ঢের হয়েছে, এবারে দুগ্‌গা বলে বেরিয়ে পড়া যাক। খবরের কাগজে রিপোর্টারের চাকরি নিয়েছিলুম, সেও বসে-বসে কাজ করবার চাকরি নয়, চর্কির মতো ঘুরে বেড়াতে হত। সেই তুলনায় এখন একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছি। বাইরে যে যাই না, তা নয়, তবে কিনা খুবই কম যাই। ঘুরে বেড়াতে আগের মতো আর ভালও লাগে না। বুঝতে পারি যে, বুড়ো হচ্ছি, শরীর এখন বিশ্রাম চায়। 

বাসন্তীও সেটা বুঝতে পারে। তাই দিল্লি থেকে ফিরে তাকে যখন জানালুম যে, জানুয়ারিতে আবার আমাকে বিষাণগড়ে যেতে হবে, বাসন্তী তখন অবাক হয়ে বলল, “সে কী, আবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হল?” 

সব কথা তাকে খুলে বললুম। এটাও বললুম যে, সে তো কখনও বিষাণগড়ে যায়নি, এবারে যদি আমার সঙ্গে যায় তো নতুন একটা জায়গা তার দেখা হয়ে যাবে। 

বাসন্তী বলল, “যেতে তো ইচ্ছে করে। এত যে লছমি আর যমুনাদির গল্প শুনেছি, তোমার কাছে, গেলে ওদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যেত। কিন্তু যাই কী করে? ছেলে একমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসছে, কালই চিঠি পেয়েছি, তো সে এল আর আমি বেরিয়ে পড়লুম, তা তো হয় না। তোমাকে তাই একাই যেতে হবে। ভাদুড়িদা যাচ্ছেন তো?” 

“তিনি তো যাচ্ছেনই। সম্ভবত কৌশিকও যাবে।” 

“তা হলে আর তাবনা কী, ভাদুড়িদা যখন সঙ্গে আছেন, তখন আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। আর তা ছাড়া, আমি আর পারুল তো এই সেদিনই পুরী থেকে ঘুরে এলুম। তোমারই বরং কোথাও যাওয়া হয় না। না না, তুমি যাও, এখন যখন যেতে চাইছে, তখন দিন কয়েকের জন্যে ঘুরেই এসো।” 

যেমন লছমি আর যমুনাদির কথা, তেমনি কুলদীপের কথাও বাসন্তীকে অনেক বলেছি। কুলদীপ সিংও যে বিষাণগড়ে যাচ্ছে, সেটা আবশ্য বাসন্তীকে আজ জানালুম না। জানালে আমার বিষাণগড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাসন্তী এত সহজে সম্মতি দিত কি না, সেটা সন্দেহের ব্যাপার। 

.

সকালের জলখাবার খেয়ে সদ্য চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি, সদানন্দবাবু এসে হাজিরা দিলেন। একগাল হেসে বললেন, “কী মশাই, দিল্লি কেমন হল?” 

“ছিলুম তো মাত্র একটা দিন আর দুটো রাত। তার মধ্য আর কী হবে?” 

“না মানে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে বলেছিলেন না? দেখা হল?”

“তা হয়েছে।” 

“আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করলেন তিনি?” 

করেননি। কিন্তু সেটা বললে পাছে সদানন্দবাবু দুঃখ পান, তাই মিথ্যে করে বলতে হল, তা করেছেন বই কী। বিশেষ করে জিজ্ঞেস করলেন আপনার স্বাস্থ্যের কথা।” 

“তা আপনি তাঁকে কী বললেন?” 

“বললুম যে, মর্নিং ওয়াক করে আপনি চমৎকার আছেন। অ্যাজ ফিট অ্যাজ এ ফিল।” সদানন্দবাবুর মুখে হঠাৎ ছায়া পড়ল। বললেন, “কিন্তু মশাই, আমি একা ভাল থাকলেই তো হবে না, কলকাতারও তো ভাল থাকা চাই।” 

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “কেন, কলকাতার আবার কী হল?” 

“না মানে নতুন করে কিছু হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে, তার তো একটা কিনারা হওয়া দরকার।”

“কীসের কিনারা।” 

“তাও বুঝলেন না? স্টোনম্যানের মশাই, স্টোনম্যানের।” 

“তা-ই বলুন। তা পরশুর আগের দিন কলকাতা ছেড়ে কাল রাত্তিরে তো ফিরে এসেছি, এর মধ্যে আবার কী ঘটল?” 

“না না, নতুন কিছু ঘটেনি। গত মাসে সেই যে আমাদের ফ্লাই-ওভারের তলায় একজনের মাথা ফাটিয়েছিল, তারপরে তো দিন-পঁচিশেক কাটল, ইতিমধ্যে আর ফুটপাথে কেউ ওভাবে মারা পড়েনি।” 

“তা হলে?” 

শুনে সদানন্দবাবু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “ইতিমধ্যে আর-কেউ মরেনি ঠিকই, কিন্তু মরতে কতক্ষণ! জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে এমন একটা মাসও কি গেছে, যে মাসে কেউ মরেনি? এক জুলাই মাসেই তিনটে লোক মরেছে, আর সেপ্টেম্বরে দুটো। এখন এই ডিসেম্বর মাসটা ভালয় ভালয় কাটলে হয়। কাটবে কি না কে জানে, আজ তো একুশে ডিসেম্বর, মাস কাবার হতে এখনও দশ দিন বাকি, দেখুন এখন এর মধ্যে আবার কেউ কাবার হয়ে যায় কি না!” 

“হলেই বা আমরা কী করতে পারছি?” 

“আমরা আর কী করব, আমাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু, চুপচাপ সব দেখে যাওয়া আর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা ছাড়া তো কিছু করবারও নেই আমাদের। তবে কিনা ভাদুড়িমশাই হয়তো কিছু করতে পারেন। তা দিল্লিতে তো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার, এটার একটা ফয়সলা করার জন্যে তাঁকে একবার রিকোয়েস্ট করলেও তো পারতেন।” 

“তিনিই বা কী করবেন? ভাদুড়িমশাই বাঙ্গালোরে থাকেন, আর ৬ হল কলকাতার ব্যাপার। অতদূর থেকে এ-সব ব্যাপারের ফয়সলা করা যায়?” 

“তা কেন যাবে না? আমার কথাটাই ভেবে দেখুন না। আমি থাকি শেয়ালদায়, আর তিনি থাকেন বালিগঞ্জে। তাও যে থাকেন, তা নয়, দিন কয়েকের জন্যে সেখানে তাঁর বোনের বাড়িতে এসে উঠেছিলেন মাত্র। তা সেখান থেকে তাঁর একবার এ পাড়ায় আসার দরকার? ল না, বালিগঞ্জে বসেই তিনি আমার কেসটার কেমন ফয়সলা করে দিলেন। তা হলে বা লোর বসেই ব। তিনি এই ব্যাপারটার ফয়সলা করে দিতে পারবেন না কেন?”

আমাদের পীতাম্বর চৌধুরি লেনের মার্ডার কেসটার ফয়সলা ভাদুড়িমশাই যেভাবে করেছিলেন, সত্যি সেটা চমকপ্রদ। কিন্তু তাই বলে কি আর এ-দুটো ব্যাপারের মধ্যে কোনও তুলনা চলে? তা ছাড়া, শেয়ালদা থেকে বালি।ঞ্জ যত দূর, কলকাতা থেকে বাঙ্গালোর যে তার চেয়ে কিছু বেশি দূর, সদানন্দবাবু তা জানেন না, তাও নয়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে, সদানন্দবাবুকে ফাঁসির দড়ির থেকে ছাড়িয়ে আনার পর থেকেই তিনি ভা’ডিমশাইকে সাক্ষাৎ ভগবান বলে ভাবতে শুরু করেছেন। তাঁর ধারণা, ভাদুড়ি শাইয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। 

ধারণাটাকে ভেঙে দেবার কোনও অর্থ হয় না। তাই বললুম, “হয়তো পারেন। তবে কিনা এখন তিনি অন্য একটা কেস নিয়ে বড় ব্যস্ত হয়েছেন। বড্ড জটিল কেস, তাই দৌড়ঝাঁপও করতে হচ্ছে খুব। তো সেটা না-মেটা পর্যন্ত তো এই স্টোনম্যনের ব্যাপারটায় তিনি হ’তই দিতে পারবে না।” 

সদানন্দবাবু বেজার গলায় বললেন, “তবে তো মুশকিল হল। শেয়ালদা পাড়ায় থাকি, চতুর্দিক জমজমাট, রাস্তায় পা ফেলবার জায়গা মেলে না, সারাক্ষণ ভিড়ভাট্টা লেগে আছে, অথচ এই তল্লাটেই কিনা এমন ব্যাপার। নাঃ, বাড়িঘর বিক্রি করে এখান থেকে সরেই যাব ভাবছি।” 

হেসে বললুম, “কোথায় যাবেন? রাজভবনের কাছাকাছি কোথাও? সেখানেও কিন্তু সেপ্টেম্বরেই একজন খুন হয়েছে!” 

“ওরে বাবা!” সদানন্দবাবু বললেন, “ঠিকই তো, আমার তো মনেই ছিল না। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটেও যে স্টোনম্যান একজনের মাথা ফাটিয়েছে, তা তো ভুলেই গিয়েছিলুম। তা হলে আর কোথায় যাব।” 

বাড়ি ফেরার জন্যে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ধপ্ করে আবার বসে পড়লেন। 

বললুম, “কোথাও যাবার দরকার নেই। এইখানেই থাকুন। আমরাও তো রয়েছি, এত ভয় পাচ্ছেন কেন? তা ছাড়া আপনি তো আর ফুটপাথের বাসিন্দা নন। তবে?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “আরে মশাই, ফুটপাথের বাসিন্দা না-হলেই যে রেহাই মিলবে, তা-ই বা ভাবতে পারছি কই। ওই যে সেদিন কার নাম করছিলেন … ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, নরেশ দস্তিদার তা সেই ভদ্রলোক আজ তাঁর কাগজে কী লিখেছেন জানেন?”

“কী লিখেছেন?” 

“সেই কথা বলব বলেই তো এসেছিলুম।” হাতের কাগজখানা তুলে ধরে সদানন্দবাবু বললেন, “শুনুন তবে। ভদ্রলোক লিখেছেন, ‘আপাতত সেই অদৃশ্য শিকারি ফুটপাথকেই তার মুণ্ডশিকারের মঞ্চ হিসেবে নির্বাচন করে নিয়েছে বটে, কিন্তু শুধু ফুটপাথেই যে তার এই ঘৃণ্য জিঘাংসাবৃত্তি সীমাবদ্ধ থাকবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বস্তুত সেই নরঘাতী উন্মাদের হস্ত ক্রমে যদি নাগরিকদের গৃহাভ্যন্তরেও প্রবিষ্টু হয়, তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।’ তা হলেই বুঝুন। আমার তো মশাই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।” 

হেসে বললুম, “তা তো দিতেই পারে। যা ভাষা, আপনি যে ভির্মি খাননি, এই যথেষ্ট।”

“ঠাট্টা করছেন তো? তা করুন।” 

সদানন্দবাবু আর একটিও কথা বললেন না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

একটু বাদেই ফোন বেজে উঠল। যিনি ফোন করছিলেন, আমি যে কিরণ চ্যাটার্জি, এইটে জেনে নিয়ে তিনি বললেন, “প্লিজ হোল্ড দ্য লাইন।” 

পরক্ষণেই ভেসে এল গম্ভীর কণ্ঠস্বর। “মিঃ চ্যাটার্জি?” 

“স্পিকিং।” 

“আমি কুলদীপ সিং কথা বলছি। অনেকদিন বাদে কাল আপনার সঙ্গে দিল্লি এয়ারপোর্টে দেখা হল, লেকিন বাতচিত হল না। তা আপনি আছেন কেমন?” 

“এই আছি একরকম। আপনি?” 

“আমি আর কী ভাল থাকব? বুডটা হয়ে গেছি না? তা জানুয়ারি মাসে আপনিও বিষাণগড়ে যাচ্ছেন তো?” 

“ভাবছি তো যাব। এখন দেখি কী হয়।” 

“আরে চলুন চলুন। পুরানো ঝগড়া ভুলে যান মশাই। উই আর অল ওল্ড পিল নাউ, ছেলেছোকরাদের মতন ঝগড়া করা আমাদের সাজে না। কী, আমি ভুল বলছি?” 

“না, না, ভুল কেন, ঠিকই তো বলছেন।” 

“তা হলে আপনি যাচ্ছেন তো?” 

ঢোক গিলে বললুম, “ঠিক আছে, আপনি যখন এত করে বলছেন, তখন নিশ্চয়ই যাব।”

“বাঃ, তা হলে ওই কথাই রইল। আই লুক ফরোয়ার্ড টু মিটিং ইউ দেয়ার।” 

কুলদীপ ফোন ছেড়ে দিলেন। 

পালামে যখন কুলদীপকে দেখি, একটা অস্বস্তির কাঁটা তখন থেকেই আমার মনের মধ্যে খচখচ করছিল। ফোনে অবশ্য খুবই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলল। হাসলও খুব। কিন্তু কী জানি কেন, আমার অস্বস্তি তাতে বাড়ল বই কমল না। 

১৮ 

গেস্ট হাউসে ঢুকে ফোন করবার পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি এসে গেল। জিপ থেকে প্রথমেই লাফিয়ে নামলেন বিষাণগড় স্টেট পুলিশের বড়কর্তা অর্জুন প্রসাদ। বাজখাঁই গলার জন্য আড়ালে অনেকেই তাঁকে গর্জন প্রসাদ বলে। তবে সব সময়েই যে তিনি হাঁকার পেড়ে কথা বলেন, তা নয়। এমনিতে যাঁর গলা শুনলে মনে হয় যেন আকাশে মেঘ ডাকছে, সেই মানুষটিকেই রাজবাড়িতে অনেক সময় হাত জোড় করে খুবই মোলায়েম গলায় কথা বলতে শুনেছি। 

ভাদুড়িমশাইকে যে রাজবাড়িতে সবাই খাতির করে চলে, অর্জুন প্রসাদও সেটা জানতেন নিশ্চয়। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি খুব-একটা গলা চড়ালেন না। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন অফিসার এসেছিলেন। লাশ তিনটির দিকে ছড়ি উঁচিয়ে অর্জুন প্রসাদ তাঁর সহকারীদের বললেন, “আপনারা ওদিকটা দেখুন, আমি ততক্ষণ মিঃ ভাদুড়ির সঙ্গে কথা বলি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার যা বলবার, তা আমি নিজের থেকেই বলব, নাকি আপনি যা জানতে চান, তা আমাকে প্রশ্ন করে জেনে নেবেন?” 

অর্জুন প্রসাদ বললেন, “মুখে না বলে আপনি যদি একটা রিটন স্টেটমেন্ট আমার অফিসে পাঠিয়ে দেন, তো খুব ভাল হয়। দুপুরের মধ্যে সেটা পাঠাতে পারবেন না?”

“না-পারবার তো কিছু নেই। বারোটার মধ্যেই সেটা পেয়ে যাবেন।” 

“থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ ভাদুড়ি। আপাতত কয়েকটা প্রশ্ন করছি। বাট অফ কোর্স আই ডোন্ট হ্যাভ টু টেল ইউ দ্যাট ইউ মে ভেরি ওয়েল ডিসাইড নট টু আসার এনি অভ্ দেম।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওহ্ ফর্গেট দ্য ফর্মালিটিজ! কী জানতে চান বলুন। জানলে উত্তর দেব, না জানলে বলব জানি না।” 

“আপনি এই মানুষগুলিকে প্রথম কখন দেখেন?”

“পৌনে পাঁচটায়।” 

“তখন তো বলতে গেলে ভোরই হয়নি, ওই সময়ে আজ আপনি এখানে এসেছিলেন কেন?”

“আজই যে প্রথম এলুম, তা নয়, রোজই আসি।” 

“কিন্তু আপনি থাকেন তো হিলক রোডে, এখান থেকে তার দূরত্ব নেহাত কম হবে না।”

“তা তো হবেই না,” ভাদুড়ি হেসে বললেন, “হাঁটাপথে তা অন্তত কুড়ি মিনিট।”

“এতটা পথ হেঁটে এখানে আপনি আসেন কেন? তাও ওই শেষ-রাতে?” 

“আমি তো হেঁটে আসি না, হাঁটতে আসি।” 

“তার মানে?” 

“মানে তো খুবই সহজ।” ভাদুড়ি বললেন, “রাত চারটেয় আমি ঘুম থেকে উঠে পড়ি। মুখহাত ধুয়ে বেরোতে বেরোতে চারটে কুড়ি-পঁচিশ। এখন জুন মাস তো, সাড়ে চারটের মধ্যে অন্ধকার মোটামুটি কেটে যায়। তবে পথ তখনও ফাঁকা। হিলক রোড তো ফ্ল্যাট নয়, উঁচুনিচু, ও-রাস্তায় হেঁটে সুবিধে হয় না, তাই বাইসাইকেল চালিয়ে প্যালেস রোডে চলে আসি। আজও এসেছিলুম। এসে দেখি, এই ব্যাপার। তার একটু বাদেই মিঃ চ্যাটার্জিও এসে পড়লেন। গেস্ট হাউস থেকে উনিই আপনাদের ফোন করেছিলেন।” 

একটু-একটু করে ভিড় জমতে শুরু করেছে। থানা থেকে একটা লরি এসে পৌঁছেছে ইতিমধ্যে। অর্জুন প্রসাদ তাঁর সহকারীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কাজ এখনকার মতো হয়ে গিয়ে থাকলে লাশ তিনটে মেডিক্যাল এগজামিনেশনের জন্যে পাঠিয়ে দিন। …ও হ্যাঁ, সব দিক থেকে- ফোটো তুলে রেখেছেন তো? …রেখেছেন। ভাল। তা হলে আপনারাও আর দেরি করবেন না, থানায় ফিরে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে চলে আসতে বলুন। আমিও একটু বাদেই ফিরছি।” 

থানা থেকে পরে যারা এসেছিল, ধরাধরি করে লাশ তিনটিকে তারা লরিতে তুলে নিল। অর্জুন প্রসাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজনও লরির ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। লরি চলে গেল। 

অর্জুন প্রসাদ বললেন, “একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, মিঃ ভাদুড়ি। আপনি তো বললেন হিলক্‌ রোড থেকে সাইকেলে করে রোজ এখানে হাঁটতে আসেন। তো সেই সাইকেলটা কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই তো একটা বেঞ্চির গায়ে হেলান দিয়ে রেখেছি। বাঁ দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন।”

বাঁ দিকে তাকিয়ে সাইকেলটা দেখে নিলেন মিঃ প্রসাদ। তারপর বললেন, “মানুষগুলিকে আপনি ঠিক কী অবস্থায় দেখেছিলেন?” 

“মানে কেউ তখনও বেঁচে ছিল কি না, এটাই জানতে চাইছেন তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“তা হলে শুনুন, দুজনকে আমি মৃত অবস্থায় দেখেছিলুম, কিন্তু একজন তখনও বেঁচে ছিল। দু-একটা কথাও সে আমাকে বলেছে। কিন্তু সে তো ডিলিরিয়ামের মতো। জ্বরের ঘোরে কি স্বপ্নের মধ্যে মানুষ যে-রকম কথা বলে, অনেকটা সেইরকম। এত ইনকোহেরেন্ট যে, তার কোনও অর্থ আমি ধরতে পারিনি।” 

“কী বলেছিল লোকটা?” 

“বলেছিল, “হলদে পাথর… দশদিন বাদে আবার আসবে… এইখানে… মাঝরাত্তিরে… মরবে বারণ করো…’। বাস্ আর কিছু সে বলতে পারেনি।” 

“তারপরেই সে মারা যায়?” 

“তারপরেই মারা যায়।” 

“কিন্তু মরবার আগে ওই কথাগুলো সে নিশ্চয় হিন্দিতে বলেনি, ট্রাইবাল ভাষায় বলেছিল। আপনি সে-ভাষা বুঝলেন কী করে?” 

“ভাষাটা মোটামুটি জানি বলেই বুঝলুম। আমাদের অফিসে এখানকার একটি ট্রাইবাল ছেলে বেয়ারার কাজ করে, তার কাছেই শিখেছি। কিন্তু ছাড়া ছাড়া কয়েকটা শব্দ বুঝে আর লাভ কী হল, তার দ্বারা যে লোকটা কী বোঝাতে চাইছে, সেটাই তো ধরতে পারা গেল না।” 

অর্জুন প্রসাদ চুপচাপ কী যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, তা হলে ওই কথাই রইল, বারোটার মধ্যে একটা রি স্টেটমেন্ট আপনি পাঠিয়ে দিন। …আর হ্যাঁ, তিনটে লোকের সঙ্গে একটা করে পুঁটলি রয়েছে দেখলুম। ওর মধ্যে কী আছে আপনি জানেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা কী করে জানব? জানতে হলে তো পুঁটলি খুলে দেখতে হয়, বাট টু ডু দ্যাট উড হ্যাভ বিন হাইলি ইমপ্রপার। না মশাই, খোলা তো দূরের কথা, কোনও কিছু আমি ছুঁয়েও দেখিনি। ও-সব আপনাদের কাজ, আপনারা করুন।” 

“তা হলে আর আপনাকে আটকে রাখব না।” অর্জুন প্রসাদ বললেন, “আপনি এখন যেতে পারেন। দরকার বুঝলে পরে আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।” 

অর্জুন প্রসাদ তাঁর জিপে গিয়ে উঠলেন। ভিড় ইতিমধ্যে পাতলা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাইকেলটিকে নিয়ে এলেন ভাদুড়িমশাই, তারপর বললেন, “চলুন, আপনাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।” 

হাঁটতে-হাঁটতে মৃদু গলায় বললুম, “পুলিশকে কিন্তু আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো বলেইছি। তিনটে পুঁটলিই আমি খুলেছিলুম। একটার মধ্যে এই মূল্যবান জিনিসটি পাওয়া গেল।” 

পকেট থেকে আলগোছে বার করে যা তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, সেটি একটি জীর্ণ, ময়লা ফোটোগ্রাফ। যাঁর ফোটোগ্রাফ, তাঁর মাথার পাগড়িতে পাখির পালক গোঁজা, হাতে তীরধনুক। কিন্তু আদিবাসী সেজে ফোটো তোলালেও মানুষটি যে কে, তা বুঝতে আমার কিছুমাত্র অসুবিধে হবার কোনও কারণ ছিল না। গঙ্গাধর মিশ্রের বাড়িতে এঁরই আর-একটি ফোটোগ্রাফ দেখে আমি চমকে গিয়েছিলুম। 

অস্ফুট গলায় বললুম, “পুরন্দর মিশ্র?” 

ফোটোগ্রাফখানা আমার হাত থেকে ফিরিয়ে নিতে-নিতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক, তা হলে চিনতে পেরেছেন।” 

“এ-ফোটো ওদের থলিতে কী করে এল?” 

“আমার ধারণা, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “কিন্তু আপাতত সে-কথা থাক। তার বদলে আর-একটা কথা শুনুন। পুলিশকে আমি আরও একটা মিথ্যে কথা বলেছি।” 

“আবার কী মিথ্যে বললেন?” 

“পুলিশকে ওই যে আমি বললুম, একটা লোক বেঁচে ছিল, আর মরবার আগে ডিলিরিয়াম বকার মতো আমাকে খাপছাড়া কয়েকটা কথা বলে গেছে, ওটা একেবারে ডাহা মিথ্যে।”

হতভম্ব হয়ে বললুম, “সে কী, লোকটা আপনাকে কিছু বলেনি?” 

“কী করে বলবে। কেউই তো বেঁচে ছিল না। অল অভ্ দেম ওয়্যার স্টোন ডেড।” 

“তা হলে পুলিশকে আপনি ও-কথা বলতে গেলেন কেন?” 

“কারণ আছে নিশ্চয়। .. শুধু একটা অনুরোধ, আমি যে দু’দুটো মিথ্যে বলেছি, তা যেন কেউ জানতে না পারে। আর হ্যাঁ, এই ফোটোর কথাও এখন কাউকে বলবেন না।”

কথা বলতে বলতে আমরা রাজবাড়ির দেউড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিলুম। বললুম, “ভিতরে গিয়ে একটু বসবেন না?” 

“না দশাই, এখন বাড়ি ফিরে স্টেটমেন্ট লিখে থানায় পাঠাতে হবে। তা ছাড়া, বেলাও তো কম হয়নি। অফিস রয়েছে না?” 

ভাদুড়িমশাই সাইকেলে উঠে পড়লেন! আমিও রাজবাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে আমার কোয়ার্টার্সের দিকে পা বাড়া। 

.

দুপুরে আজ আর দফতরে যাবার ইচ্ছে ছিল না। একে তো আজকের দিনটা শুরুই হয়েছে খুব খারাপভাবে, তার উপর আবার নদীর ধারে দেখা দৃশ্যটার কথা ভাবতে গেলেই গা’টা কেমন যেন গুলিয়ে উঠছিল। কিচেন থেকে সকালবেলার যে জলখাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঘরে ঢুকে দেখলুম সেটা ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছু আর মুখে তুলতে ইচ্ছে করল না। দফতরে অবশ্য না গেলেই নয়। প্যালেসের পিছন দিককার একটা পুরনো বাড়ি কিছুদিন আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে, সেখানে নতুন বাড়ি উঠবে, তার প্ল্যান নিয়ে আজ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বৈঠক হবার কথা, আমাদের এস্টেট-ম্যানেজার গোপীচাঁদ শেঠিও তাতে উপস্থিত থাকবেন, ফলে না গিয়ে উপায় নেই। কিন্তু গিয়ে শুনলুম, ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক রায়পুর থেকে ফোন করে জানিয়েছেন যে, হঠাৎ একটা কাজে আটকে যাওয়ায় আজ তিনি আসতে পারছেন না, কাল আসবেন। 

মুরারি আজকাল সময়মতো আসছে, তাকে নিয়ে আর নতুন কোনও সমস্যা দেখা দেয়নি। যে-লোকটা আগে প্রায় প্রতিটি কাজ নিয়েই কিছু-না-কিছু ওজর-আপত্তি তুলত, ইদানীং যে সমস্ত কাজই সে হাসিমুখে করে দেয়, তাতে বুঝতে পারি, রানি-মা তাকে ধমকে দিয়েছেন নিশ্চয়, নইলে তার এই রূপান্তর ঘটত না। ভেবেছিলুম, পাওনাদারদের যে-সব বিল কিছুদিন ধরে জমে আছে, ‘পাস্ড ফর পেমেন্ট’ ছাপ মারবার আগে আজ তাকে সেগুলি একবার ভাল করে চেক করবার কাজে লাগিয়ে দেব, কিন্তু দশটার সময়ে দফতরে পৌঁছে শুনলুম, মুরারি আসেনি। 

এল সাড়ে দশটায়। বললুম, “কী ব্যাপার, আজ হঠাৎ দেরি যে? শরীর ঠিক আছে তো?” মুরারি সে-কথার জবাব না দিয়ে বলল, “শুনেছেন?” 

“কী শুনব? সর্সোতিয়ার ধারে আজ আবার তিনটে মানুষ মরে পড়েছিল, এই খবর?” 

“ও তো পুরনো খবর!” মুরারি বলল, “আপনিই যে ইনফর্মেশানটা পুলিশকে দিয়েছিলেন, তাও জানি। তো পুলিশ শুনলুম পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পাবার পরেই জোর তদন্ত শুরু করবে। শহরে কার-কার কাছে রিভলভার আছে, তার একটা লিস্টি নাকি তৈরি করে ফেলেছে।” 

“তা তো করেছে, কিন্তু শহরে যারা পারতপক্ষে আসে না, ট্রাইবাল এরিয়া থেকে এমন তিনজন মানুষ কাল রাত্তিরে হঠাৎ শহরে এসে ঢুকেছিল কেন, সেটা তো আগে বোঝা চাই। আমার তো মনে হয়, সেটাই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। তা এখানকার পুলিশের বড়কর্তাটি যে আদৌ এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন, আজ সকালে তাঁর কথাবার্তা শুনে তা কিন্তু মনে হল না। মিঃ ভাদুড়িকে আগড়ম-বাগড়ম গোটাকয় প্রশ্ন করলেন, বাস্।” 

মুরারি বলল, “যাচ্চলে, লেংটি পরা তিনটে জংলি মানুষ মরেছে তো কী হয়েছে, আপনি তা নিয়ে অত ভাবছেন কেন, ভাবতে হয় তো এদিককার কথা ভাবুন।” 

“কেন, এদিকে আবার কী হল?” 

“যা হয়েছে, তা তো ভয়ংকর ব্যাপার!” মুরারি হঠাৎ একেবারে সবচেয়ে নিচু পর্দায় নামিয়ে ফেলল তার গলা, তারপর তার মুখখানাকে আমার কানের কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “বড়কুমার তো নিরুদ্দেশ!” 

বরটা শুনবামাত্র পামেলার কথা মনে পড়ে গেল আমার। মার্চ মাসে যেদিন সে রাত্তিরবেলায় আমার কোয়ার্টার্সে এসে দেখা করেছিল, সে-দিন সে কি এইরকম একটা সম্ভাবনার কথাই আমাকে বলেনি? যদ্দুর মনে পড়ে, সে বলেছিল যে, এই প্যালেস আর এখন বড়কুমারের পক্ষে বিশেষ নিরাপদ জায়গা নয়, তাই হয়তো সে এখান থেকে পালিয়ে রাজস্থানের মাধোপুর স্টেটে চলে যেতে পারে। 

আমি যে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি, মুরারি সেটা লক্ষ করেছিল। বলল, “কী ভাবছেন বলুন তো?” 

বললুম, “কিছু না। কিন্তু এ তো বড় অদ্ভুত কথা! হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হতে যাবেন কেন? ঠিক জানো তো?” 

“বেঠিক জানলে কি আর আপনাকে বলতুম? খবরটা শুনেছি একেবারে স্ট্রেট ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ।” 

“কখন থেকে নিরুদ্দেশ?” 

“কাল রাত্তির থেকেই তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। … দিন, কী করতে হবে বলে দিন, কাজে বসে যাই।” 

বিলগুলি আগের দিনই গুছিয়ে রেখেছিলুম, ড্রয়ার থেকে বার করে মুরারির হাতে তুলে দিয়ে বললুম, “বেশ ভাল করে চেক করে দাও তো, অনেকদিন হল পড়ে আছে, আজই এগুলি পেমেন্টের জন্যে পাঠিয়ে দেব।” 

মুরারি তার টেবিলে গিয়ে বসল। তারপর বিল চেক করতে-করতে হঠাৎ একসময় মুখ তুলে বলল, “আপনি অবশ্য স্বীকার করলেন না, কিন্তু বড়কুমারের খবর শুনে সত্যি আপনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হল যেন আপনি আর-কিছু ভাবছেন।” 

বললুম, “আরে না, কিছুই ভাবছিলুম না।”

বললুম বটে, কিন্তু একইসঙ্গে লক্ষ করলুম, একটা অদ্ভুত হাসি তার মুখের উপরে খেলা করে বেড়াচ্ছে। মনে হল আমার কথাটা সে বিশ্বাস করেনি। 

.

একটা থেকে দুটো। দুপুরে এই এক ঘণ্টা আমরা ছুটি পাই। খাওয়ার ছুটি। মুরারি আগে এই সময়ে বাড়ি চলে যেত, তারপরে আর বড়-একটা ফিরত না। আজকাল সে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে আসে, অফিসে বসেই দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে নেয়। আমি আমার কোয়ার্টার্সে চলে যাই। যাবার সময় কিচেনে বলে যাই খাবার পাঠিয়ে দিতে। আজ সকালে সেই যে গা কেমন গুলিয়ে উঠেছিল, তার জোর এখনও মেটেনি, মুখটা একেবারে বিস্বাদ হয়ে আছে। কিচেনের দিকে পা বাড়াতেও অস্বস্তি হচ্ছিল। 

প্যালেসের উত্তরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তারপর কিচেন। সেও এক যজ্ঞিবাড়ির মতো এলাহি ব্যাপার। কিচেন এখানে একটা নয়, পাশাপাশি দুটো। একটায় দিশি-মতে ডাল-ভাত-রুটি-তরকারি লুচি-পরোটা মাছ-মাংস হয়, অন্যটায় সাহেবি খানা। এদিকের দায়িত্বে আছে জনার্দন ঠাকুর, আর ও-দিকটা সামলায় গোয়ানিজ কুক ড্যানিয়েল। এরা নিজেরা রান্না করে না, রান্না ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তার তদারক করে। আার জন্যে সাহেবি কিচেন থেকে ব্রেকফাস্ট যায়, আর যেমন দুপুর তেমনি রাত্তিরের খাবার যায় দিশি কিচেন থেকে। সেই দিকে যেতে-যেতে দেখলুম, সামনের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জনার্দন আর ড্যানিয়েল কথা বলছে। কী কথা বলছে, বোঝা গেল না, তবে এইটে লক্ষ করলুম যে, দুজনের মুখই গম্ভীর। 

জনার্দনকে বললুম, শরীরটা ভাল নেই, তাই দুপুরে আর আমার জন্যে খাবার পাঠাতে হবে না। বলে আমার কোয়ার্টার্সের দিকে পা বাড়ালুম। ঠিক করেছিলুম যে, খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে তারপর দুটো নাগাদ আবার দফতরে ফিরে যাব। 

বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে শোবার ঘরের এককোণে রাখা ইজিচেয়ারে এসে গা এলিয়ে দিয়েছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। এই দুপুরে আবার কার কী দরকার পড়ল, বুঝতে পারলুম না। চটিতে পা গলিয়ে বাইরের ঘরে এসে দরজা খুলে দেখি, ড্যানিয়েল দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেন করলুম, “কী খবর ড্যানিয়েল?” 

“আপনার জ্বর হয়েছে চাটার্জিসাব?” 

বললুম, “জ্বর নয়, ওই একটু অরুচির মতো হয়েছে, তাই আর এ-বেলা কিছু খাব না ভাবছি।” ড্যানিয়েল বলল, “একেবারে কিছু না-খেয়ে থাকাটা ঠিক হবে না, সাব্। আমি বরং একটা স্যুপ করে আপনার জন্যে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে দেখুন, ভাল লাগবে। …না না, থিক স্যুপ নয়, ক্লিয়ার স্যুপ। খুব হাল্কা।” 

হেসে বললুম, “ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।” 

“আভি ভেজ দুঙ্গা সাব্।” সেলাম ঠুকে ড্যানিয়েল চলে গেল। 

তার দু-তিন মিনিট বাদেই বেজে উঠল আমার শোবার ঘরের ফোন। 

“হ্যালো।” 

ইংরেজিতে প্রশ্ন ভেসে এল, “মিঃ চ্যাটার্জি দেয়ার?” 

“স্পিকিং।” 

“প্লিজ ডোন্ট আস্ক এনি কোয়েশ্চনস্‌, জাস্ট লিস্‌ন টু হোয়াট আই সে। ডোন্ট টেক এনি ফুড অফার্ড বাই এনিওয়ান। নট ইন এ গ্ল্যাস অভ ওয়াটার।” 

যিনি ফোন করছিলেন, কথা শেষ করেই তিনি ফোন নামিয়ে রাখলেন। গলাটা চিনতে পারলুম না। 

১৯ 

স্যুপটা খানিক বাদেই এসে গিয়েছিল, সঙ্গে বেশ কড়া করে সেঁকা দুখানা টোস্ট। কিন্তু খাইনি। টোস্ট দুখানা স্যুপের বাটির মধ্যে ফেলে দিয়ে একটা চামচে দিয়ে নাড়তে নাড়তে যখন কাদামতো হয়ে গেল, গোটা জিনিসটা তখন নর্দমায় ঢেলে দিলুম। খাবার পাঠানো সত্ত্বেও যে তা আমি মুখে তুলিনি, এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে। 

দফতরে যাবার পথে কিচেনে গিয়ে জনার্দন ঠাকুরকে বললুম যে, আমার শরীর সত্যি ভাল নেই, একটু জ্বর মতো হয়েছে, আপাতত দিন-তিনেক স্রেফ বার্লি খেয়ে থাকব ভাবছি, তাই কিচেন থেকে এই ক’টা দিন কোনও খাবার পাঠাবার দরকার হবে না। 

জনার্দন ঠাকুরের মুখ দেখে মনে হল না যে, সে খুব বিস্মিত হয়েছে। বলল, “হঠাৎ বারিষ নামল তো, তাই এখুন একটু জ্বরজারি হোবে। তো ঠিক আছে, বার্লি পাঠিয়ে দিব।” 

বললুম, “তোমাকে আর ও নিয়ে ভাবতে হবে না। মার্কেট রোড থেকে কালই এক কৌটো বার্লি কিনে এনেছি। স্টোভও আছে। ও আমি নিজেই করে নিতে পারব।” 

জনার্দনকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না-দিয়ে দফতরে চলে এলুম। 

বিকেলে চলে গেলুম হিলক্ রোডে। ফোনের কথাটা ভাদুড়িমশাইকে জানাতে তিনি বললেন, “গলাটা চিনতে পারলেন না?” 

“না।” 

“পুরুষের গলা, না মহিলার?” 

“পুরুষের।” 

“তাই তো, বড় চিন্তায় ফেলে দিলেন দেখছি।” ভুরু কুঁচকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইচ্ছে করলে অবিশ্যি বিকৃত গলায় কথা বলা যায়, চেনা লোককে তখন গলা শুনে আইডেন্টিফাই করা যায় না। যা-ই হোক, হুঁশিয়ারিটা সত্যি না মিথ্যে, তাও তো বুঝতে পারছি না।” 

“মিথ্যেও হতে পারে?” 

“হতেই পারে। কেউ হয়তো আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছে। বাট লেট আস্ টেক ইট অ্যাজ জেনুইন। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার এই হিতার্থী বন্ধুটি কে?…প্যালেসে আমার নিজের একজন লোক আছে ঠিকই, সে-কথা আপনাকে আমি বলেওছি, কিন্তু সে-ই যে আপনাকে সতর্ক করে দিয়েছে, তা আমার মনে হয় না।” 

“কেন?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সে যদি সতর্ক করে দিত, তো এতক্ষণে তা আমি জেনে যেতু! সে-ই জানাত। কিন্তু না, সে কিছু জানায়নি। তাই ধরে নেওয়া যায় যে, এ-কাজ তার নয়, অন্য ারও। এমন কারও, যে কিনা চায় না যে, আপনি বেঘোরে মারা পড়ুন।” 

“তা হলে এটা কার কাজ? কে ফোন করল?” 

“তা-ই তো ভাবছি। আচ্ছা, আপনিও একটু ভেবে দেখুন তো, রাজবাড়িতে কি এমন কেউ আছে, যাকে আপনি যোলো-আনা বিশ্বাস করতে পারেন?” 

শিউশরণ ত্রিপাঠীর কথা মনে পড়ল। এ-প্রশ্ন তাঁকে আমি করেছিলুম। তাতে তিনি বলেছিলেন যে, কাউকেই ওখানে বিশ্বাস করা চলে না। 

বললুম, “না মশাই, কাউকেই ওখানে আমি বিশ্বাস করি না। এক ওই গঙ্গাধর মিশ্র বাদে। তবে কিনা তিনি তো আর প্যালেসের লোক নন।” 

“তা না-ই বা হলেন, কিন্তু প্যালেস কম্পাউন্ডের মধ্যেই তো আছেন, তাও আপনি যে-বাড়িতে আছেন, তিনিও আছেন সেই বাড়িরই একতলায়। ভদ্রলোক আপনাকে স্নেহও করেন।” 

“কিন্তু তাঁর তো ফোন নেই। মন্দির আর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যান না তিনি। তা ছাড়া, ফোনটা যিনি করেছিলেন, তিনি ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। কিন্তু তাউজি ইংরিজি জানেন না। না না, তাউজি নন, আর-কেউ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই হবে। কিন্তু আমি ভাবছি, কিচেন থেকে খাওয়া তো বন্ধ করলেন, এখন আপনি খাবেন কোথায়। এক কাজ করুন, খাওয়ার ব্যাপারে অন্তত কয়েকটা দিনের জন্যে এখন মিশিরজির সঙ্গে একটা ব্যবস্থা করে নিন। সব কথা তাঁকে খুলে বলবার দরকার নেই। জাস্ট বলবেন যে, কিচেনের খাবারে বড্ড ঝালমশলা দেয়, তাতে আপনার একটু স্টম্যাক-আপসেটের মতো হয়েছে, তাই কয়েকটা দিন এখন ওঁদের সঙ্গে খাবেন।” 

বললুম, “সে তো স্বচ্ছন্দেই করা যায়। ঠিক আছে, তা হলে ওই কথাই রইল।” 

বলে উঠে পড়তে যাচ্ছিলুম। ভাদুড়িমশাই আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, “উঠবেন না, আর-একটা কথা আছে। আটুই জুলাই আপনাদের গেস্ট-হাউসটা খালি পাওয়া যাবে?” 

“তা তো এখুনি বলতে পারছি না। বুকিংয়ের খাতাটা দেখে বলতে হবে।” 

“আজেবাজে বুকিং থাকলে ক্যানসেল করিয়ে দিতে পারবেন না? যদি পারেন তো খুব ভাল হয়। ওই একটা দিনের জন্যে গেস্ট হাউসটা আমার চাই।” 

“ঠিক আছে, লছমিকে নিয়ে একটু বাদেই তো সসোতিয়ার ধারে বেড়াতে যাচ্ছি, আপনিও চলে আসুন, পাকা খবর তখনই পেয়ে যাবেন।” 

হিলক্ রোড থেকে রাজবাড়িতে ফিরে এসেই মিশ্রজিকে বললুম যে, আমার শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না, কয়েকটা দিন আমি এখন ওঁদের বাড়িতেই খাব। শুনে মিশ্রজি তো দারুণ খুশি। পরক্ষণেই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। একটু সংকুচিতভাবে বললেন, “কিন্তু বেটা, আমরা তো নিরামিষ খাই, মছলি না থাকলে তোর অসুবিধে হবে না তো?” 

বললুম, “নিরামিষই তো খেতে চাইছি। এরা যা ঝাল-মশলা দেয় না, মাছ-মাংসে অরুচি ধরে গেছে। তা ছাড়া ঠিক সহ্যও হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, আপনাদের বাড়িতে শুধু দুপুর আর রাতের খাবারটা খাব। সকালের চা-জলখাবার নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আপনাদের তো চায়ের পাট নেইও।” 

“আমরা না-ই বা খেলাম, তোর জন্যে বানিয়ে দেব।” 

“দরকার হবে না। আমার স্টোভ আছে, এক. কৌটো চা আর কয়েক প্যাকেট বিস্কুটও আছে। দু’বেলার চা আমি নিজেই করে নিতে পারব।” 

মিশ্রজি বললেন, “সে তুই যা ভাল বুঝিস। যাই, তোর তাইজিকে বলে আসি যে, আজ রাত্তিরে তুই আমাদের সঙ্গে খাচ্ছিস। দারুণ খুশি হবেন।” 

বাড়ির ভিতর থেকে লছমি বেরিয়ে এল। সেজেগুজে একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে। বললুম, “একটু দাঁড়া লছমি। একবার দফতরে যাওয়া দরকার। একটু কাজ আছে।…না না, যাব আর আসব। পাঁচ মিনিটও লাগবে না।” 

দফতরে গিয়ে স্টিলের আলমারি খুলে গেস্ট-হাউসের বুকিং রেজিস্টারটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলুম। তারপর আবার সেটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে, আলমারিতে চাবি দিয়ে কোয়ার্টার্সে ফিরে এলুম আমি। লছমি চুপচাপ বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বললম, “চল, এবারে বেরিয়ে পড়া যাক।” 

আকাশে আজ মেঘ নেই বটে, কিন্তু বর্ষা এসে গেছে। ক’দিন ধরেই রাত্তিরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ধুলো যেমন মরেছে, তেমনি গরমও কমেছে অনেকটা। গাছপালা এখন ঝকঝকে সবুজ। এদিকে নদীতেও ঢল নেমেছে, সর্সোতিয়া একেবারে কানায় কানায় ভর্তি। আধডোবা পাথরে ধাক্কা খেতে-খেতে, চতুর্দিকে ফেনা ছড়িয়ে খলখল করে জল ছুটছে। 

খানিক বাদেই ভাদুড়িমশাই এসে গেলেন। সকালে অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল, অথচ তা নিয়ে তাঁর মুখে দেখলুম উদ্বেগের কোনও চিহ্ন নেই। বললেন, “কী হল?”

বললুম যে, কারও রিজার্ভেশন ক্যানসেল করার কোনও দরকারই হচ্ছে না। “আটুই জুলাই আমাদের গেস্ট হাউস একেবারে ফাঁকাই থাকবে। অন্তত আমার খাতায় কোনও বুকিং নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে। তা হলে ওই একটা দিনের জন্যে ওটা বুক করে রাখুন।”

“কার নামে বুক করব?” 

“কাম্বারল্যান্ড ইনসিওরেন্সের নামে। টাকাকড়ি কী দিতে হবে?”

“কিচ্ছু না। থাকা বলুন, খাওয়া বলুন, গেস্ট-হাউসে সবই ফ্রি। খাবার যাবে প্যালেসের কিচেন থেকে। ওখানে যে-সব বয়-বেয়ারা আছে, স্রেফ গরম করে তারা সার্ভ করে দেয়। ও নিয়ে ভাববেন না। শুধু একটা কথা; কী খাবেন, সেটা কিন্তু আগে থাকতে জানিয়ে রাখা দরকার।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিচ্ছু খাব না। শুধু একটা রাত ওখানে থাকতে চাইছি। রাত্তিরবেলায় দোতলার বারান্দায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সসোতিয়ার বাহার দেখব, বাস্।” 

তো এ-সবই হল আঠাশে জুনের কথা। তারপর তিনটে দিন মোটামুটি শান্তিতেই কাটল। মিশ্রজির ওখানে খাচ্ছি, সুতরাং সেদিক দিয়েও নিশ্চিত্ত। ইতিমধ্যে আর-কোনও রহস্যজনক ফোনও আসেনি। ববির কী হয়েছে, তা অবশ্য জানি না। সেই যে সে নিরুদ্দেশ হয়েছে, তা নিয়ে আর কিছু বলতেও শুনছি না কাউকে। পামেলা বলেছিল, ববি এখান থেকে মাধোপুর স্টেটে চলে যাবে। গেছে কি না, কে জানে। ভাদুড়িমশাইকে তার নিখোঁজ হবার খবরটা যথাসময়ে দিয়েছিলুম। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।