বিষাণগড়ের সোনা – ১০

১০ 

অরুণ সান্যাল বললেন, “সে কী, তুমি সেখানে একলা গিয়েছিলে?” 

সরস্বতী বলল, “শুধু যে গিয়েছিলুম, তা নয়, পুরো তিন-তিনটে মাস সেখানে ছিলুম। একেবারে একলাই যে গিয়েছিলুম, তা নয়, ভুপিন্দর সিং বলে আমার এক ছাত্র আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু বেশিদিন তার থাকা হয়নি। বালি আর পাথর ঘেঁটে ঘেঁটে সবে তখন লোকেশান খোঁজার কাজ চলছে, সেইসময়ে সে জ্বরে পড়ে। জঙ্গলের কিছু-কিছু লোকের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভাব জমিয়ে নিয়েছিলুম, তাদের দু-একজন সবসময়ে আমার সঙ্গে থাকত। তারা বলল, হাওয়া লেগে জ্বর হয়েছে। কীসের হাওয়া, সেটা অবশ্য বোঝা গেল না, তবে জ্বর দেখলুম ছাড়ছে না। সঙ্গে কিছু ওষুধ-বিষুধ ছিল, তাতে কাজ না-হওয়ায় দিন চার-পাঁচ বাদে ওই লোকগুলোকেই সঙ্গে দিয়ে তাকে শহরে পাঠিয়ে দিই। তারপর থেকেই আমি একা।” 

কৌশিক বলল, “ওরেব্বাবা, এ তো আমি ভাবতেই পারি না।” 

সরস্বতী বলল, “আমিই কি পারতুম? কিন্তু তখন আমাকে কাজের নেশায় পেয়ে বসেছে। ক্রমাগত মনে হচ্ছে এইবারে নিশ্চয়ই ঠিক-জায়গাটার খোঁজ পেয়ে যাব। তো সেই সময়ে এই ট্রাইবালরা যে আমাকে কী সাহায্য করেছিল, সে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। দিনের পর দিন তখন আমি ওদের সঙ্গে একই খাবার খেয়েছি, এমন কী একদিন একটা দাঁতাল শুয়োর আমার তাঁবুর উপরে এসে হামলা করার পর থেকে আমি রাতও কাটিয়েছি ওদের ঘরে। শুধু তা-ই নয়, ওদেরই একটা ছেলে একদিন একেবারে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দেয়। শুকিয়ে যাওয়া একটা নদীর বালির মধ্যে সোনার গুঁড়ো চিকচিক করছে দেখে আমি ছুটে একমুঠো বালি তুলে আনতে গিয়েছিলুম। হঠাৎ দেখি, ছেলেটা আমার হাত টেনে ধরেছে। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই সে তার হাতের লাঠিটা ছুড়ে দিল সেই বালির উপরে, আর দেখতে-দেখতে লাঠিটা সেই বালির মধ্যে তলিয়ে গেল। চোরাবালি! জংলি ওই ছেলেটা যদি না সেদিন টেনে ধরত আমাকে, তা হলে আর দেখতে হত না, চোরাবালির মধ্যেই সেদিন আমি ডুবে মরতুম!” 

আমি বললুম, “ডিপজিটটা কোথায়, তার হদিশ কি শেষ পর্যন্ত পেয়েছ?” 

সরস্বতী বলল, “একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিত হয়ে সে-কথা বলতে পারব না, তবে আমার ধারণা, পেয়েছি। কিন্তু কোথায় পেয়েছি, আমার পেপারে তার উল্লেখ করিনি, সেখানে সাধারণভাবে মধ্যপ্রদেশের নাম করেছি মাত্র। আর সরকারি কর্তাদেরও যে সেই জায়গাটার নাম আমি জানাইনি, তা তো বললুমই। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে জানেন?” 

“কী হয়েছে?” 

“আসলে লোকে ‘নটার কথা চেপে গিয়ে সরকারকে তো আমি যেমন-যেমন মনে এল তেমন-তেমন গোটা দু২ জায়গার নাম জানিয়েছিলুম, কন্ট্রাকটর সেই জায়গাগুলোকে সাফসুতরো করে দেবার পরে সেখানে কাজও শুরু হয়েছিল, কিন্তু মাত্র মাসখানেক কাজ চলবার পরেই ঘটল বিপদ। যাদের ওখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, দল বেঁধে সেই আদিবাসীরা আবার হঠাৎ একদিন ফিরে এল সেখানে। টাঙ্গি, বর্শা, তীরধনুক নিয়ে তারা সার্ভে-ক্যাম্পের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইচ্ছে করলে সেই সার্ভে টিমের প্রত্যেকটি লোকের মাথা তারা সেদিন টাঙ্গির ঘায়ে দু’ফাঁক করে দিতে পারত। অথচ, আশ্চর্য ব্যাপার, একটা লোককেও তারা প্রাণে মারেনি। স্রেফ তাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের জায়গাজমি তারা ফের দখল করে নেয়। এর পরেও যদি শহর থেকে পুলিশ পাঠিয়ে, গুলি চালিয়ে ট্রাইবালদের সেখান থেকে আবার নতুন করে উচ্ছেদ করা হত, তো তাতেও আমি অবাক হতুম না। কিন্তু খবরটা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তো; তা ছাড়া ট্রাইবালদের মধ্যে যারা কাজ করে, এইরকম দু’তিনটে প্রতিষ্ঠানও এই উচ্ছেদের ব্যাপারটা নিয়ে ভোপালে আর ইন্দোরে বার করেছিল প্রতিবাদ-মিছিল। তার উপরে আবার ঝাড়খণ্ড পার্টির ক্ষমতা এ-সব এলাকায় দিনে-দিনে বাড়ছিল, তাই মধ্যপ্রদেশ সরকারও সম্ভবত ভর পেয়ে গিয়েছিল যে, ব্যাপারটা নিয়ে যদি খুব বেশি শোরগোল হয়, তো পরিণামে তাদের ঝঞ্ঝাট আরও বাড়বে বই কমবে না। ফলে তারা আর পুলিশ পাঠাল না, আর সার্ভে-টিমের কাজকর্মও তার ফলে বন্ধ হয়ে গেল।” 

কৌশিককে ডেকে মালতী ইতিমধ্যে তার হাত দিয়ে আর এক রাউন্ড চা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি আমার পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে বললুম, “অর্থাৎ স্বর্ণসন্ধান নিয়ে আমরা খবরের কাগজের লোকেরা যে নাটক জমিয়ে দিয়েছিলুম, সেইখানেই তার উপরে যবনিকা পড়ে গেল, কেমন?” 

বিষণ্ণ হেসে সরস্বতী বলল, “তা আর পড়ল কই। যে-লোকেশানের কথা জানিয়েছিলুম, সারা জীবন খোঁজ চালালেও সেখানে কোনও ডিপজিটের হদিস নিশ্চয় মিলত না। সেক্ষেত্রে কাজ চলেছিল মাত্র মাসখানেক কি বড়জোর মাস দেড়েক। কিন্তু সরকারকে তো বলতে হবে যে, তাদের তরফে চেষ্টার কোনও ত্রুটি হয়নি। ফলে, ট্রাইবালদের যে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, আর তারা খেপে যাওয়ার ফলেই যে অনুসন্ধানের কাজটা ঠিকমতো চালানো হয়নি, এ সব অস্বস্তিকর কথা চেপে গিয়ে একটা রিপোর্ট ঠিকই খাড়া করা হল। তাতে কী বলা হল জানেন?” 

“কী বলা হল?” 

“বলা হল যে, ডঃ সরস্বতী ভট্টাচার্য যে লোকেশানের কথা বলেছিলেন, সেখানে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েও, বৃহৎ ডিপোজিট তো দূরের কথা, কোনও ছোটখাটো ডিপজিটেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি।” 

বললুম, “না-পাওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, আসল-লোকেশানের কথাটা তুমি চেপে গিয়েছিলে।” সরস্বতী বলল, “সেটা ঠিক। কিন্তু অনুসন্ধানটা ব্যাপকই বা হল কোথায়? ওটা একেবারেই মিথ্যে কথা। কাজটা তো করা হয়েছিল নেহাতই দায়সারাভাবে, তা হাঙ্গামা বেধে গিয়েছিল বলে মাঝপথেই সে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, আসলে রিপোর্টের উপসংহারে যা বলা হল, সেটাই হচ্ছে মারাত্মক। সেখানে বলা হল যে, সরস্বতী ভট্টাচার্য তাঁর পেপারে যে অভিমত প্ৰকাশ করেছিলেন, তা ততটা তথ্যনির্ভর নয়, যতটা অনুমানভিত্তিক। বস্তুত এমন সন্দেহ অস্বাভাবিক নয় যে, ভূবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি প্রত্যাশিত দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেননি; যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-প্ৰমাণ না-থাকা সত্ত্বেও, স্রেফ হাততালি পাবার অস্বাস্থ্যকর আগ্রহে তিনি চাঞ্চল্যকর একটা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন।” 

কৌশিক বলল, “মাই গড, ই’ট্স এ টেরিব্‌ল ইনডায়মেন্ট! এই রিপোর্টের কথা জানাজানি হলে তো আপনার ভীষণ দুর্নাম হবে। চাই কী, চাকরি নিয়েও টানাটানি পড়তে পারে।” 

“দুর্নাম তো হয়েছেই।” সরস্বতী বলল, “আর অধ্যাপক মহলে সবাই যে আমার শুভার্থী, তাও তো নয়, সুতরাং চাকরি ধরে টান মারবারও একটা চেষ্টা হয়েছিল বই কী। তবে তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। এই একটা সুবুদ্ধির কাজ করেছিলুম যে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের যিনি কর্তা, সরকারি আমলারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা মাত্র সমস্ত কথা তাঁকে আমি জানিয়ে রেখেছিলুম। এত তাঁকে বলেছিলুম যে, একে তো এঁদের প্রোজেক্টটা একেবারে রদ্দি, তার উপরে আবার ট্রাইবালদের রিহ্যাবিলিটেশানের ব্যবস্থাও এঁরা করছেন না, সুতরাং যা এঁরা করতে চলেছেন আর যেভাবে সেটা করা হবে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সায় নেই, আসল তথ্য এঁদের কাছে আমি চেপে যাব। সুতরাং সেদিক থেকে চিন্তার কিছু নেই।” 

বললুম, “যাক, চাকরিটা তা হলে যাচ্ছে না?”

সরস্বতী হেসে বলল, “চাকরি যাওয়া অত সহজ নাকি? সব শুনে আমাদের ডিপার্টমেন্টাল হেড অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি, বাট আই অ্যাম প্রিটি শিওর, হি ইজ অন মাই সাইড। সো আর মাই স্টুডেন্টস। আমাকে যদি চাকরি ছাড়তে হয় তো তারা লাগাতার ধর্মঘট বাধিয়ে দেবে। না না, ও নিয়ে আপনারা ভাববেন না। তবে হ্যাঁ, একটা দাগ তো পড়েই গেল। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁদের নিয়ে অবশ্য ভাবনা নেই, তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারছেন যে, কিছু-একটা রহস্য এর মধ্যে আছে, তথ্য জোগাড় না-করে কোনও সিদ্ধান্তে আসবার মতো কাঁচা কাজ আমি করি না। কিন্তু সবাই তো আর আমাকে চেনেন না, তাঁরা নিশ্চয় ভাবছেন যে, সরস্বতী ভট্টাচার্য ইজ এ সেনসেশান-মংগার। 

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ সব শুনে যাচ্ছিলেন, একটা কথাও বলেননি। এবারে তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “সরস্বতী মোটামুটি সমস্ত কথাই জানিয়েছে, কিরণবাবু। যদি আরও কিছু আপনার জানবার থাকে তো ওকে জিজ্ঞেস করুন।” 

বললুম, “আপাতত আর কিছু জানবার নেই।” 

“এবারে তা হলে আমার কথা শুনুন। কাজের সূত্রে মাঝে মাঝেই তো আমি দিল্লি যাই, তা বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে যখন ভূতাত্ত্বিকদের ওই সম্মেলন হয়, আমিও তখন দিল্লিতেই ছিলুম। সরস্বতীকে তখনও আমি চিনতুম না। কিন্তু সোনার ডিপজিট নিয়ে সেই সম্মেলনে ও যা বলেছিল, তাই নিয়ে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল তো, তা কাগজে তার বিবরণ পড়ে আমি একটু ঘাবড়ে যাই। ঘাবড়ে যাবার কারণ ছিল। প্রথমেই যা আমার মনে হয়েছিল, তা এই যে, মেয়েটা খুব বুদ্ধির কাজ করেনি। কেননা, ওর পেপারে ও যে-রকম জোরগলায় বলেছে, মধ্যপ্রদেশের মাটির তলায় সোনার একটা বিশাল ডিপজিটের সন্ধান পাওয়া যাবেই, তাতে অনেকেরই এই সন্দেহ হবে যে, ঠিক কোন্ জায়গায় সেই ডিপজিটটা রয়েছে, তাও নিশ্চয় ও জানে। যাদের এই সন্দেহ হবে, তাদের সকলেই যে ভদ্রলোক, এমনটা তো আর আশা করা যায় না, কিছু-না-কিছু গুণ্ডা-বদমাসও তাদের মধ্যে থাকতেই পারে। তা যদি থাকে, সরস্বতী তা হলে নিরাপদ নয়। বাস, এই কথাটা মনে হওয়ামাত্র আমি সরস্বতীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি ওকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলুম।” 

জিজ্ঞেস করলুম, “তা তো হল, কিন্তু যোগাযোগটা করলেন কীভাবে?” 

“ভেবেছিলুম টেলিফোন ডিরেক্টরিতে নামটা পাওয়া যাবে। কিন্তু তা পাওয়া গেল না। তাতে অবশ্য হতাশ হইনি। তার কারণ, কাগজ পড়ে জেনেছিলুম যে, ও দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সেখানে ফোন করে ওর বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করি। ঠিকানাটা নিউ রাজিন্দরনগরের। বিকেল নাগাদ যখন সেখানে যাই, সরস্বতী তখন বাড়িতে ছিল না। যে ভদ্রমহিলা এসে আই-হোলে আমাকে বেশ ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর দরজা খুলে দেন, তিনিই জানান যে, আমি একটুক্ষণ বসলে ভাল হয়, টুকিটাকি দু-একটা জিনিস কিনতে সরস্বতী একটু বেরিয়েছে, কিন্তু দূরে কোথাও যায়নি, মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই ফিরে আসবে। ভদ্রমহিলার বয়স মনে হল বছর পঞ্চাশেক… 

সরস্বতী বাধা দিয়ে বলল, “মায়ের জন্ম ১৯৪১ সালে, তার মানে এখনও… অর্থাৎ ১৯৮৯ সালেও… তাঁর বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হয়নি। আর আজ থেকে দু’বছর আগেই কিনা তাঁকে আপনার পঞ্চাশ বছরের বুড়ি বলে মনে হয়েছিল? দাঁড়ান, ফিরে গিয়ে মা’কে সব বলছি।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওরে বাবা, তোরও তো একদিন পঞ্চাশ বছর বয়েস হবে। তখন বুঝবি যে, পঞ্চাশেই মানুষ বুড়িয়ে যায় না। তা ছাড়া আমি তো পঞ্চাশ বছর বলিওনি, বলেছি বছর-পঞ্চাশেক। তার মানে বাহান্নও হতে পারে, পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। 

অরুণ সান্যাল বললেন, “অবজেক্‌শান ওভাররুলড। বড়দা, ইউ প্লিজ প্রসিড।” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভদ্রমহিলা যে কে, সে তো সরস্বতীর কথা থেকেই আপনি বুঝতে পেরেছেন কিরণবাবু। আমারও কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছিল, কিন্তু ঠিক প্লেস করে উঠতে পারছিলুম না। তো সরস্বতীর জন্যে ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছি, এমন সময় ভদ্রমহিলা ফের ঘরে ঢুকে বললেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি কখনও বিষাণগড়ে ছিলেন?’ বাস্, আর কিছু বলতে হল না, ওই একটা কথাই যেন বছর পঞ্চাশ বছর বয়সের এক মহিলার মুখের উপরে সুপার ইমপোজ করে বসিয়ে দিল একটা পাঁচ-বছরের বাচ্চা-মেয়ের মুখ। আর তক্ষুনি বুঝতে পারলুম যে, কেন এঁকে এত চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল। বললুম, ‘তুমি…তুমি কি লছমি?’ … কিরণবাবু, জীবনে কত বিচিত্র ঘটনাই যে ঘটে। সেই সাতচল্লিশে যাকে শেষ দেখেছি, সাতাশি সালে যে এমনভাবে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে, এ তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না!” 

সরস্বতী বলল, “বড়দা, আপনার চেয়ে আমার মায়ের কৃতিত্ব কিন্তু বেশি। তিনিই প্রথম চিনেছিলেন।” 

আমি বললুম, “ঠিক কথা। নইলে কি লছমি ওইভাবে বিষাণগড়ের উল্লেখ করত?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিলক্ষণ। আমার তো বিশ্বাস আই-হোল দিয়ে আমাকে দেখবামাত্রই লছমি চিনতে পেরেছিল। তা নইলে সে দরজা খুলে দিত কি না, তাতে সন্দেহ আছে। দিল্লিতে আর আজকাল কেউ হুটপাট কাউকে দরজা খুলে দেয় না।” 

মালতী ইতিমধ্যে ঘরে এসে ঢুকেছিল। লছমির সঙ্গে দিল্লিতে দেখা হয়ে যাওয়ার গল্পটা সে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে আগেই শুনেছিল নিশ্চয়, এবারে সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “সে তুমি যা-ই বলো, চেনার ব্যাপারে কিন্তু দাদাকেই আমি বেশি মার্কস দেব।” 

সরস্বতী বলল, “কেন মালতীদি?” 

“এ তো খুবই সহজ কথা, তাও বুঝতে পারছ না?” মালতী বলল, “লছমি যখন বিষাণগড়ে আমার দাদাকে প্রথম দেখেছিল, দাদার বয়েস তখন অলরেডি চব্বিশ-পঁচিশ, যে-বয়েসের পরে মানুষের মুখের আদল খুব-একটা পালটায় না। কিন্তু দাদা যখন লছমিকে প্রথম দেখেছিল, সে তখন নেহাত পাঁচ-বছরের একটা পুঁচকে মেয়ে। তার মুখের আদল তারপরে বিস্তর পালটেছে, আর সেটাই স্বাভাবিক। তবু যে দিল্লিতে তাকে দেখে দাদার চেনা-চেনা মনে হয়েছিল, এ কি কম কথা?” 

অরুণ সান্যাল বললেন, “সত্যিই তো, চল্লিশ বছর বাদে দেখা, পাঁচ বছরের সেই মেয়েটার মুখ ইতিমধ্যে কত পালটে গেছে, তবু কেন অমন কথা মনে হচ্ছিল আপনার?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর কিছু নয়, ওর চোখ দেখে। কী জানো, যাদের চোখের তারা খুব নীল হয়, তাদের চুল সাধারণত ঘন কালো হয় না। লছমিকে সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে। ওর চোখের তারা অতি আশ্চর্য রকমের নীল, অথচ মাথার চুল মিশমিশে কালো। তা ছাড়া ওর থুতনির নীচে একটা কাটা-দাগ ছিল। সেটাও দেখলুম মিলিয়ে যায়নি। লছমির বয়স যখন তিন বছর, তখন নাকি মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। বিষাণগড়ে থাকতে ওর বাবার কাছে তা-ই শুনেছিলুম।” 

সরস্বতী বলল, “তার মানে তো আমার দাদামশাইয়ের কাছে। তাঁকে আপনি চিনতেন?”

“চিনতুম বই কী। কিরণবাবু অবশ্য তাঁকে দেখেননি, উনি গিয়ে বিষাণগড়ের চাকরিতে জয়েন করার মাসখানেক আগেই পুরন্দর মিশ্র মারা যান। তবে আমি তো আরও কিছুদিন আগে থেকেই সেখানে ছিলুম, তাই যেমন আরও অনেকের সঙ্গে, তেমনি তোর দাদামশাইয়ের সঙ্গেও আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। বিকেলের দিকে মাঝে-মাঝে উনি সর্সোতিয়ার ধারে বেড়াতে আসতেন, সেইখানেই ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়। …ও হ্যাঁ, ওই নদীর নামেই যে তোর নাম, সেটা জানিস তো?” 

প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি, এইভাবে অন্য কথায় চলে গেল সরস্বতী। জিজ্ঞেস করল, “বড়দা, আপনি তো তাঁকে দেখেছেন, কেমন মানুষ ছিলেন আমার দাদামশাই?” 

গাড়িতে করে এখানে আসবার সময় আমাকেও এই প্রশ্নটা সরস্বতী করেছিল। কিন্তু আমি তো তাঁকে তুমি না। তাই স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারিনি। বিষাণগড়ে থাকতে পুরন্দর মিশ্র সম্পর্কে অন্যের কাছে যা শুনেছি, শুধু সেইটুকু ওকে বলেছিলুম। 

কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাঁকে চিনতেন। তাঁর মতামতের মূল্যও তাই অনেক বেশি। 

সরস্বতীর প্রশ্নের জবাব কিন্তু তক্ষুনি তিনি দিলেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পাল্‌টা তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, “কথাটা তুই জানতে চাইছিস কেন?” 

“তাঁর সম্পর্কে নানাজনের কাছে নানা কথা শুনেছি। কেউ বলে তিনি পায়জামা-পাঞ্জাবি-পরা সন্ন্যাসী ছিলেন, কেউ বলে তিনি বাউন্ডুলে-গোছের মানুষ ছিলেন, কেউ বলে সাংসারিক দায়-দায়িত্বের কোনও ধারই তিনি ধারতেন না!” 

“এ-সব কথা কোথায় শুনলি?” 

“বিষাণগড়ে। আপনি হয়তো জানেন না, বিষাণগড়ে আমাদের একটা বাড়ি আছে। মারা যাবার বছর দুয়েক আগে গঙ্গাধর মিশ্র অর্থাৎ আমার দাদামশাইয়ের বাবাই সেটা তৈরি করান। বাড়িটা তিনি তাঁর পুত্রবধূ অর্থাৎ আমার দিদিমার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। তো আমার দিদিমাও যে এখন আমারই কাছে আছেন, তা আপনি জানেন। বাড়িটা তিনি ভাড়া দেননি, এখনও মাঝে-মাঝে বিষাণগড়ে গিয়ে দু’চার সপ্তাহ সেখানে কাটিয়ে আসেন। আমরাও যাই। তা সেই বিষাণগড়েই দাদুর সম্পর্কে এ-সব কথা শুনেছি।” 

“এত সব শুনেছিস আর বিষাণগড়ের মাইল পনরো দক্ষিণের এক জঙ্গলে তোর দাদুর যে একটি রক্ষিতা ছিল, এই রসালো গল্পটাই কেউ তোকে শোনায়নি?” 

শুনে হোহো করে হেসে উঠল সরস্বতী। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “ওহ বড়দা, ইউ আর দ্য লিমিট! প্লিজ মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ! … রক্ষিতা নয়, প্রেমিকা। তো সেই প্রেমিকার কথা দিদিমার কাছেও শুনেছি। দাদুই তাঁকে খেপাবার জন্যে বলতেন।” 

রান্নাঘর থেকে মালতী মাঝে-মাঝে ড্রইংরুমে এসে আমাদের কথা শুনছিল। এবারে সে ঘরে ঢুকে বলল, “কিরণদা, আপনি আর সরস্বতী এখানে খেয়ে যেতে পারেন। রান্না হয়ে গেছে।” 

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললুম, “ওরেব্বাবা, ন’টা বাজে। না না, বাড়িতে বলে আসিনি, আর যদি দেরি করি তো বাসন্তী হাঙ্গামা করবে। …সরস্বতী, তুমি খেয়ে নিতে পারো, তবে আমি খাচ্ছি না।

সরস্বতী বলল, “আমার পক্ষেও খাওয়া সম্ভব নয়। কাল সকালে চলে যাচ্ছি, আজ যদি বাইরে খেয়ে ফিরি তো আমার বড়-জা ভীষণ চটে যাবে। দাঁড়ান ভাইয়া, আমিও আপনার সঙ্গে উঠব। কিন্তু তার আগে বড়দা’র কথাটা শুনে যাই। …কই বড়দা, আপনি তো কিছু বলছেন না?” 

ভাদুড়িমশাইও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, “আমি আর কী বলব। আপাতত শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, তোর দাদামশাইকে সবাই খুব খেয়ালি মানুষ মনে করত। কিন্তু সেটা যে ঠিক কথা, অর্থাৎ পুরন্দর মিশ্র যে খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, আমার তা মনে হয় না।” 

অরুণ সান্যাল নীচে নামতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ মানুষ, আপাতত তাঁর চেম্বারে বসাও বন্ধ, তাই তাঁকে নামতে দেওয়া হল না। অন্যেরা সবাই আমাদের বিদায় জানতে নীচে নেমে এলেন। যাবার পথে সরস্বতীকে পার্ক সার্কাসে নামিয়ে দিয়ে যাব। চাবি ঘুরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাচ্ছি, এমন সময় জানলার কাছে মুখ এনে ভাদুড়িমশাই সরস্বতীকে বললেন, “রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নাম শুনেছিস?” 

“না তো।” 

“তা যদি শুনতি, তা হলে হয়তো খানিকটা অন্তত বুঝতে পারতি যে, তোর দাদু কেমন মানুষ ছিলেন। কিন্তু আজ আর এ নিয়ে কিছু বলছি না। সামনের মাসের গোড়ার দিকে একবার দিল্লি যাবার কথা আছে। তখন বলব।” 

গাড়ি ছেড়ে দিলুম। বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে দশটা। 

স্টোনম্যানের কথাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম। কাল রাতে তবু আবার সেই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। রাত তখন তিনটে। তারপর যে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙতে দেখি, সাড়ে সাতটা। 

বাসন্তী বলল, “আজ আর বাজারে যাবার দরকার নেই। মাছ আর আনাজ যা আছে, কাল পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু একবার বাইরে যাও তো, সকাল থেকেই একটা গোলমাল শুনতে পাচ্ছি, কী হয়েছে দেখে এসো।” 

গোলমালটা আমিও শুনতে পাচ্ছিলুম। কিন্তু সেটার কারণ বুঝবার জন্যে আর বাইরে যেতে হল না। সদানন্দবাবু এসে বললেন, “ভীষণ ব্যাপার মশাই!” 

“কী হয়েছে?” 

“আবার খুন! আবার সেই ফুটপাথের উপরে!” 

“কিন্তু কোথায়? মানে কোন্ এলাকায়?” 

সদানন্দবাবুর মুখে যেন কথাই সরছিল না। ধপ করে তিনি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর কপালের ঘাম মুছে অস্ফুট গলায় বললেন, “একেবারে আমাদের বাড়ির পাশে। শেয়ালদা ফ্লাইওভারের তলায়। উঃ, মাথাটা একেবারে থেতলে দিয়েছে!” 

“সেই জুন মাসে শুরু হয়েছে, তার পরে একটা মাস বাদ গেল না। এক জুলাই মাসে তিন-তিনটে লোক মরেছে, আর সেপ্টেম্বরে দু’জন। তার মানে গত জুন থেকে এই নভেম্বরের মধ্যে মোট ন’জন লোক এই একই ভাবে মারা পড়ল। তার মধ্যে আবার পাঁচটা খুনই হল আমাদের শেয়ালদা-পাড়ায়। ভাবা যায়?” 

সদানন্দবাবু যাও-বা বসে ছিলেন এতক্ষণ, আমার শেষ কথাটা শুনে চেয়ারের মধ্যেই এলিয়ে পড়লেন। 

১১ 

“আমি তো এখান থেকে চলে যাচ্ছি। বয়েস অনেক হয়েছে, আর বেশিদিন আমি বাঁচবও না। কিন্তু চ্যাটার্জিবাবু, দয়া করে আমার এই একটা অনুরোধ আপনি রাখবেন। বড়কুমারের উপরে আপনাকে একটু নজর রাখতে হবে। অনেক বছর ধরে আমি এই রাজবংশের নিমক খেয়েছি, আমি চাই এরে ভাল হোক্, তো সেইজন্যেই এখন যাবার সময়ে এই কথাটা আপনাকে বলে গেলাম। … না না, শঙ্করনারায়ণের কথাবার্তা আর চালচলন দেখে আপনি ওকে পাগ্‌লা আদমি ভাববেন না। আপনি বুঝদার লোক, একদিন আপনি সব বুঝবেন, সব জানবেন। সির্ফ থোড়া হুঁশিয়ার থাকুন, আঁখ ঔর কান খুলা রাখুন, বাস্।” 

কথাগুলি শিউশরণ ত্রিপাঠীর। আমার আগে এই বিষাণগড় প্যালেসের তিনিই ছিলেন কেয়ারটেকার। চাকরি থেকে তাঁর ছুটি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ তিনি বিষাণগড় থেকে বিদায় নেননি, কেয়ারটেকারের কাজটা আমাকে বুঝিয়ে দেবার দরকার ছিল, তাই আমি এখানে না-আসা পর্যন্ত তিনি থেকে যান। যেদিন আমি বিষাণগড়ে পৌঁছই, তার পরদিন সকাল দশটা নাগাদ তিনি এসে চার্জ হ্যান্ডওভার করলেন। যাবতীয় খাতাপত্তর বুঝিয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে বিশদভাবে জানালেন যে, আমার কাজটা ঠিক কীরকম হবে। ত্রিপাঠীজির কাছে এটাও জানা গেল যে, আমি একজন সহকারী পাব। 

“তবে কিনা তার উপর খুব ডিপেন্ড না-করাই ভাল।” 

“কেন?” 

ত্রিপাঠীজি হাসলেন। বললেন, “আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট মুরারিপ্রসাদেরই উচিত ছিল সব্‌সে আগে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু সে কি এসেছে?” 

“কই, না তো।” 

“কেন আসবে? রাজবাড়ির মুনিমজি নারায়ণ ভার্মার সে ছেলে, তাই জানে যে, আপনাকে পরোয়া না-করলেও তার চাকরি যাবার ভয় নেই। এমনিতেও সে বারোটা-একটার আগে কাজে আসে না, তাও বোধহয় দয়া করে আসে। তো ওই ছেলে আপনার কাজে হেল্প করবে, এমন আশা করবেন না চ্যাটার্জিবাবু। নিজে যেটুকু পারবেন, করবেন, বাস্।” 

শিউশরণ ত্রিপাঠীর কাছে সেদিন এমন আরও কিছু-কিছু খবর শুনি, যা আমার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। সম্পত্তি থাকলে অশান্তিও থাকবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তার উপরে এ তো রাজবাড়ি, যেমন সম্পত্তি তেমন ক্ষমতা নিয়েও এখানে অল্পবিস্তর অশান্তি যে থাকবে, তা আমি ধরেই রেখেছিলুম। কিন্তু ত্রিপাঠীজি সেদিন বিদায় নেবার আগে যে-সব খবর আমাকে শুনিয়ে গেলেন, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। 

বললুম, “এ-সব কথা আমাকে বলছেন কেন?” 

“দুটো কারণে বলছি। এক, মহারাজ ধূর্জটিনারায়ণ যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর এই দ্বিতীয় পক্ষের বউয়ের বাপের বাড়ির লোকরা ততদিন এই বিষাণগড়ে কোনও পাত্তাই পেত না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এরাই জাঁকিয়ে বসেছে। এরাই এখানে কলকাঠি নাড়ে, এরাই কাউকে ওঠায় কাউকে নামায়, কোন্ ব্যাপারে কী হবে না-হবে তা এরাই ঠিক করে। কিন্তু তাতে যে এ-রাজ্যের মঙ্গল হচ্ছে, তা নয়। …মুশকিল কী হয়েছে জানেন? যেমন অন্য সব নেটিভ স্টেটে, তেমনি এখানেও ইংরেজরা একজন পোলিটিক্যাল অফিসার বসিয়ে রেখেছে তো, সেই রিচার্ড উইলসন লোকটাও হচ্ছে পাজির পা-ঝাড়া, তাকে এরা হাত করেছে, তা নইলে নিশ্চয় পঞ্জাব থেকে এসে এরা এখানকার হর্তা-কর্ম:-বিধাতা হয়ে এইভাবে ছড়ি ঘোরাতে পারত না।” 

“মহারাজের শ্বশুরবাড়ি কি পঞ্জাবে?” 

“দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুরবাড়ি। ছোটরানি-মা তো এখন সেইখানেই আছেন। …ও হ্যাঁ, একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনি যেন ভুল করে কক্ষনো ওঁকে ছোটরানি-মা বলবেন না। ওটা ওঁর পসন্দ নয়।” 

“কেন?” 

ত্রিপাঠীজি হেসে বললেন, “তাও বুঝলেন না? উনি রাজার মেয়ে ঠিকই, কিন্তু বংশমর্যাদায় অনেক ছোট, ও-সব ছোটঘরের মেয়েরা কি আর এ-সব রাজবাড়িতে পাটরানি হয়ে ঢুকতে পারে? উনিও এখানে পাটরানি হয়ে আসেননি। তো ছোটরানি-মা বললে সেই কথাটা মনে পড়িয়ে দেওয়া হয় তো, সেটা পসন্দ করেন না। আপনি ওকে রানি-মা’ই বলবেন, নইলে ঝামেলা হবে।” 

বললুম, “ঠিক আছে, ঝামেলায় যাব না। কিন্তু ছোটরানি-মা’র ব্যাপারটা না হয় বুঝলুম, বড়রানি-মা কোথায়?” 

ঘরের সিলিংয়ের দিকে আঙুল তুলে ত্রিপাঠীজি বললেন, “স্বর্গে। বড়কুমার শঙ্করনারায়ণের বয়েস যখন মাত্র এক বছর, রানি জয়েশ্বরী দেবী তখন মারা যান। ছোটরানি যশোমতীর তখনও ছেলেপুলে হয়নি, কী করেই বা হবে, তার মাত্র দু’মাস আগে তিনি বউ হয়ে এই রাজবাড়িতে এসেছেন, বড়রানির বাচ্চা-ছেলেটাকে তিনি কোলে তুলে নিলেন, আর আমরাও ভাবলুম যে, এক রানি থাকতে যে মহারাজ ধূর্জটিনারায়ণ আবার বিয়ে করেছিলেন, সেটা ভালই করেছিলেন, নইলে এই বাচ্চা তো সির্ফ, ঝি-চাকরের কাছে মানুষ হত, মায়ের আদর তার জুটত না।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ত্রিপাঠীজি। তারপর স্নান হেসে বললেন, “কিন্তু চ্যাটার্জিবাবু, আমরা যা ভাবি, সবসময়েই কি তা হয়? বিয়ের আট মাস বাদে ছোটরানির ভি একঠো লেড়কা হল, আর…. 

ত্রিপাঠীজির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললুম, “বড়কুমারের তিনি সৎমা হয়ে গেলেন, এই তো?” 

“না না, তা যদি বলি তো ঝুট্ হবে, বাবুজি।” ত্রিপাঠীজি বললেন, “সাথ-সাথ্ তিনি শঙ্করনারায়ণের সৌতেলা-মা হননি। মহারাজ তো তার পরেও কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন, অন্তত তার মধ্যে যে হননি, সেটা ঠিক। তো মহারাজ আজ থেকে ছে’ বরস আগে, চল্লিশ সালে মারা গেলেন। শঙ্করনারায়ণের উমর তখন আর কত হবে, করিব দশ কি এগারো। আর ছোটকুমারের উমর তাঁর চেয়ে দেড় কি দো সাল কম। তো তখুন হল মুশকিল। পঞ্জাব থেকে লোক এল। ছোটরানি-মা’র পিতাজি এলেন, দো ভাই এলেন, সেখানকার রাজ-এস্টেটের ম্যানেজার কপুর-সাব এলেন, আর এল কুলদীপ সিং।” 

“কপুর-সাব মানে ত্রিবিক্রম কপুর? বিষাণগড়ের দিওয়ান?” 

“হ্যাঁ, বাবুজি। খুব ঘটা করে ধূর্জটিনারায়ণের শ্রাশান্তি হল। অনেক দানধ্যান হল, সাতদিন ধরে দরিদ্রনারায়ণের সেবা হল। তারপর সব কাজকাম মিটবার পরে ছোটরানি-মা’র পিতাজি আর ভাইরা একদিন পঞ্জাবে চলেও গেলেন। কিন্তু কপুর-সাব আর ইখান থেকে নড়লেন না, কুলদীপ সিংও না। …বাবুজি, মহারাজের বাবার আমল থেকে বিষাণগড়ের দেওয়ান ছিলেন কৃষ্ণস্বামী আচারিয়া। তিনি ছিলেন সাউথ ইন্ডিয়ার লোক। কাজকর্মে যেমন ওস্তাদ, তেমনি বিবেচক আর বুদ্ধিমান। তা ছাড়া খুব জবরদস্ত মানুষ ছিলেন, কোনও পোলিটিক্যাল অফিসারকেই কখনও পাত্তা দেননি, এমনকি এই রিচার্ড উইলসনকেও না; রাজ্যের তরফে যা কিছু জানাবার, তা একেবারে সরাসরি বড়লাটকে জানাতেন। জানি না, উইলসন-সাহেব সেইজন্যেই তাঁর উপরে খাপ্পা হয়ে ছিলেন কি না। আমরা শুধু দেখলুম যে, মহারাজ মারা যাবার দেড় মাসের মাথায় আচারিয়া-সাহেবের নোকরি গেল, আর সেখানে গ্যাঁট হয়ে বসলেন এই ত্রিবিক্রম কপুর। আর ওই যে কুলদীপ সিংয়ের নাম করলুম, কপুরের সে মস্ত শাকরেদ। অতি নচ্ছার লোক। দু’দিন থাকুন, সবই টের পেয়ে যাবেন।” 

আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই আবার সেই একই কথা জিজ্ঞেস করলুম, “আপনি আমাকে এ-সব কথা বলছেন কেন?” 

ত্রিপাঠীজি বললেন, “সে তো আপনাকে জানিয়েছি। দুটো কারণে আমার পক্ষে আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। প্রথম কারণ, আপনাকে সব জানানো আমার কর্তব্য, যাতে আপনি হুঁশিয়ার থাকতে পারেন। দ্বিতীয় কারণ, আপনাকে এটাও আমার জানিয়ে রাখা দরকার যে, এখানে আপনি যা দেখবেন আর যা শুনবেন, তার সবই যে সত্যি, ভুল করেও যেন কক্ষনো তা ভাববেন না। বাবুজি, এই রাজবাড়ির মধ্যে পাপ ঘুষেছে, সেই পাপের চক্করে আপনি ফেঁসে যাবেন না। আপনি দূরে থাকবেন বাবুজি, একবার যদি ফেঁসে যান তো আপনি মারা পড়বেন।”

বললুম, “এ-সব কথা বলতে আপনার ভয় হচ্ছে না?” 

শুনে এমনভাবে হেসে উঠলেন ত্রিপাঠীজি যেন আমার কথাটায় তিনি খুব মজা পেয়েছেন। হাসিটা থামবার পরেও তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর, আমার মুখের উপর থেকে তাঁর চোখ না-সরিয়ে বললেন, “কামাল্ হ্যায়! চাটার্জিবাবু, অনেকদিন তো ভয়ে-ভয়ে কাটালুম, আর কত ভয় করব? নোকরি থেকে ছুট্টি মিলে গেছ, চক্ষু মুদে চার-বেহারার কান্ধে উঠে গঙ্গাতীরে যাবার ভি সময় এসে গেল। না চাটার্জিবাবু, এক ভগবান ছাড়া দুăা কিসিকো আর আমি এখন ভয় করছি না।” 

“মুনিমজির কাছে কাল শুনেছি যে, আপনি ইউ.পি.র লোক, আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েই সেখানে চলে যাবেন। সত্যি?”

“হ্যাঁ, বাবুজি, কালই আমি ইলাহাবাদে রওনা হচ্ছি। ইখান থেকে ভোর পাঁচটায় ট্রেন ছাড়ে, সেই ট্রেন ধরে ভিরিন্ডি চলে যাব।” 

“যাবার আগে অন্তত এই কথাটা আমাকে বলে যান যে, এখানে কাকে-কাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি।” 

“কাউকে না বাবুজি, কাউকে না।” ত্রিপাঠীজি আবার হেসে উঠলেন। তারপর হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “এক ওই গঙ্গাধর মিশির বাদ। মিশিরজি খুব ধার্মিক মানুষ বাবুজি, অওর বহোত বহোত ইমানদার। লেকিন দুঃখী মানুষ। একটাই লেড়কা, সেটা মারা পড়ল। যেভাবে মরল, সেটা নিয়েও ভাববার অ ছে। আমার বিশোয়াস…” 

বিশ্বাসটা যে কী, তা আর জানা হল না। সিঁড়িতে যদিও জুতোর শব্দ পাইনি, ঠিক এই সময়েই দরজার পর্দা সরিয়ে বছর কুড়ি-বাইশের একটি লোক আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, “রাম রাম চাটার্জি-সাব। পিতাজির কাছে শুনলুম যে, আপনি এসে গেছেন। 

ত্রিপাঠিজি বললেন, “আরে এসো এসো, মুরারি। …চাটার্জি বাবু, এই হচ্ছে মুরারিপ্রসাদ, আমাদের মুনিমজি নারায়ণ ভার্মার ছেলে। তো মুরারিই আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এখন থেকে আপনারা দুজনে মিলে সব কাজকাম চালিয়ে নেবেন।” 

কথাটা শেষ করেই ত্রিপাঠীজি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়েছিলেনও, কিন্তু বারান্দায় পা বাড়াবার আগে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার সঙ্গে আরও কিছু কথা ছিল বাবুজি, অনেক কিছু বলবার ছিল, লেকিন আমার তো এখন আর সময় নেই বাবুজি, কাল ভোরেই চলে যাব, অথচ সব এখনও গোছগাছ করে উঠতে পারিনি। তো ভাবছি একটা কাজ করব। আপনার সুবিধার জন্যে দরকারি কিছু-কিছু কথা একটা কাগজে আমি নোট করে রাখব। আমি নিজে হয়তো আর আসতে পারব না, কিন্তু তাতে কিছু মুশকিল হবে না বাবুজি, আজ রাতেই হোক আর কাল সকালেই হোক, আমার নোকর হরদেও সেই চিরকুটখানা আপনার কাছে ঠিকই পৌঁছে দিয়ে যাবে।” ত্রিপাঠীজি চলে গেলেন। বুঝতে পারলুম, যে-প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল, তৃতীয় ব্যক্তির সামনে তিনি আর তা নিয়ে কিছু বলতে চান না। 

তো এ-সবই হল দিন-পনেরো আগের কথা। এর মধ্যে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে।

প্রথম ঘটনা, শিউশরণ ত্রিপাঠী তাঁর নোকরের হাত দিয়ে আমার জন্যে কোনও চিরকুট পাঠিয়েছিলেন কি না, তা আমার জানা নেই। যদি পাঠিয়েও থাকেন, সেই চিরকুট আমার কাছে পৌঁছয়নি। যেদিন আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়, তার পরদিন ভোরের ট্রেনেই তিনি ভিরিন্ডি রওনা হয়ে যান, কিন্তু সেই ভোরবেলাতেই সর্সোতিয়ার ধারে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ডঃ সিদ্দিকি হঠাৎ দেখতে পান যে, প্যালেস রোডের যে-দিকটায় কোনও বাড়িঘর নেই, সেই দিকে, রাস্তা থেকে দশ-বারো গজ দূরে, ঢালু ঘাসজমির উপরে একটি মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, মানুষটি জীবন্ত নয়, তার মাথাটা একেবারে থ্যাতলানো। সে যে শিউশরণ ত্রিপাঠীর নোকর হরদেও, খানিক বাদেই তা জানতে পারা যায়। ডঃ সিদ্দিকির চিৎকারে যারা ছুটে এসেছিল, তাদেরই একজন হরদেওকে শনাক্ত করে। পুলিশের ধারণা এটা বদলা নেওয়ার ঘটনা। হরদেও জুয়া খেলত, বছর খানেক আগে জুয়ার আড্ডায় সে একজনের মাথা ফাটিয়েছিল, ফলে সে গ্রেফতার হয়, কিন্তু ত্রিপাঠীজি তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। গোটা পঞ্চাশেক টাকা জরিমানা দিয়েই হরদেও যে সে-যাত্রায় রেহাই পেয়ে যায়, সেও নাকি ত্রিপাঠীজির জন্যেই। তবে যার মাথা ফাটিয়েছিল, তার তো একটা আক্রোশ ছিলই। এবারে হরদেওয়ের মাথা ফাটিয়ে সে কিংবা তারই কোনও শাকরেদ সেই পুরনো ঘটনার বদলা নিয়েছে। 

দ্বিতীয় ঘটনা, দিন দশ-বারো আগে বড় বিচিত্রভাবে কুমার রূপেন্দ্রনারায়ণ সিংয়ের সঙ্গে পরিচয় হল। বিকেল পাঁচটায় আমার কাজকর্ম সেরে মহেশ্বরের মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসেছি, হঠাৎ দেখি, একটা বাচ্চা-কুকুর প্যালেসের দিক থেকে তীরবেগে ছুটে আসছে। কাছে আসতে বুঝলুম, বাচ্চা নয়, কুকুরটা আসলে ড্যাশুন্ড। বয়েস বাড়লেও আকারে এরা বিশেষ বড় হয় না, তাই দূর থেকে দেখলে বাচ্চা বলে ভ্রম হয়। কুকুরের পিছন পিছন হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে যে ছুটে এল, পনেরো-ষোলো বছর বয়সের সেই ছেলেটিকে অবশ্য চিনতে পারলুম না। বাদামি রঙের কুকুরটা ইতিমধ্যে মন্দিরের বারান্দায় উঠে পড়েছিল। ছেলেটিও বারান্দায় উঠতে যাচ্ছে দেখে তাকে বাধা দিয়ে বললুম, “কী ব্যাপার? কী চাও তুমি?” 

ছেলেটি তাতে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “বাট হু আর ইউ?” 

বললুম, “আমি এই প্যালেসের কেয়ারটেকার। এখন বলো তুমি কী চাও।”

“হোয়াই, আই ওয়ান্ট টু কিল্। আই হ্যাভ অলরেডি কিলড থ্রি অভ দেম, অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু ফিনিশ অফ্ দ্য হোল ট্রাইব!” 

শুনে ইচ্ছে করছি। যে, ওর হাতের লাঠিটা কেড়ে নিয়ে ওকেই আগাপাশতলা পেটাই, কিন্তু সেই মুহূর্তেই মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন গঙ্গাধর মিশ্র। কী ঘটতে চলেছে, সেটা তিনি আঁচ করেছিলেন নিশ্চয়, তবু গম্ভীর গলায় বললেন, “কী ব্যাপার?” 

ছেলেটি বলল, “ড্যাশগুগুলোকে আদর করতে গিয়েছিলুম, কিন্তু ওরা এত পাজি যে, আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে। আমি ওদের মেরে ফেলতে চাই। তিনটেকে পিটিয়ে মেরেছি, এখন এটাকেও মারব!” 

মিশ্রজি বললেন, “আর এক পা’ও এগিয়ো না! যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, ওখান থেকেই ফিরে যাও!” 

“যদি না যাই?” 

মিশ্রজির চোখ দুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল। কঠিন গলায় তিনি বললেন, “না গেলে কী হবে, সে তুমি ভালই জানো। আগের বারে তুমি এই মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে গুতি দিয়ে একটা পায়রা মেরেছিলে। সেবার তোমার কী হয়েছিল, ভুলে গেছ?” 

ছেলেটি চোখ নামিয়ে নিল। তারপর অস্ফুট গলায় বলল, “ভুলিনি। সেবারে আমার টাইফয়েড হয়েছিল।” 

“আর এবারে যদি এই কুকুরটাকে মারো, তা হলে কী হবে সেটাও বলে দিই।” সেই একই রকমের কঠিন গলায় মিশ্রজি বললেন, “মহেশ্বরের অভিশাপে এবারে তা হলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।” 

শুনে কী যে হল, জানি না, যেমন এসেছিল ঠিক তেমনিভাবেই ছুটতে ছুটতে ছেলেটি আবার প্যালেসের দিয়ে চলে গেল। 

মিশ্রজি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্যালেসের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পেলে বললেন, “চাটার্জিবাবু, এঁকে বোধহয় আপনি চিনলেন না। ইনি আমাদের ছোটকুমার, রূপেন্দ্রনারায়ণ সিং।” 

তৃতীয় ঘটনা, মুরারিপ্রসাদ কখন কাজে আসে আর কখন চলে যায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দিন সাতেক সেদিকে নজর রেখেছিলুম। তাতে দেখা গেল, রোজই সে বারোটা-একটায় এসে হাজিরা দেয়, আর কোনওদিনই সে বিকেল চারটের পরে দফতরে থাকে না। অথচ হাজিরা খাতায় আসা-যাওয়ার সময় লেখে দশটা-পাঁচটা। এই ব্যাপারটা নিয়ে তাকে খুব কড়কে দিয়েছি। বলে দিয়েছি, এখন থেকে সে যদি দশটার সময় দফতরে আসতে না পারে, আর আমার অনুমতি না-নিয়ে পাঁচটার এক মিনিট আগেও দফতর থেকে বেরিয়ে যায়, তা হলে তাকে অ্যাটেনড্যান্স-রেজিস্টারে সই করতে দেব না। এ হল ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সেইদিনই রাত্তিরে প্যালেসে আমার ডাক পড়ে। ছোটরানি-মা ইতিমধ্যেই পঞ্জাব থেকে ফিরে এসেছিলেন, শুনলুম তিনিই ডেকে পাঠিয়েছেন। বিষাণগড়ে আসার পর যশোমতী দেবীর সঙ্গে সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎকার। 

প্যালেসের একতলায় কেউ থাকে না। তার একদিকে সুইমিং পুল। সেদিকটায় কারও যাবার হুকুম নেই। অন্যদিকে পরপর ছোটবড় কয়েকটা দফতর। কোনওটা দেওয়ানজির, কোনওটা তাঁর সেক্রেটারির, কোনওটা এস্টেট-ম্যানেজারের। একতলার দুদিক দিয়ে দুটো সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। আমাকে দফতরের দিককার সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে যাওয়া হল। যশোমতী দেবী তাঁর ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। আমি সেখানে যেতে হেসে বললেন, “সো ইউ আর হিয়ার। তা বিষাণগড় তোমার কেমন লাগছে?” 

বললুম, “খুব ভাল লাগছে। তবে কিনা মাত্রই কয়েকদিন হল এসেছি তো, তাই শহরটা এখনও ঘুরে দেখা হয়নি। 

যশোমতী দেবীর দ্বিতীয় প্রশ্ন, “কাজকর্ম সব বুঝে নিয়েছ?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ, ত্রিপাঠীজি আমার আসার অপেক্ষায় ছিলেন, তিনি আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।” 

তৃতীয় প্রশ্নটা একেবারে গুলির মতো ছুটে এল। “মুরারিপ্রসাদের সঙ্গে তোমার কী হয়েছিল?” মুরারিপ্রসাদ যে লোক মোটেই সুবিধের নয়, ত্রিপাঠীজির কথা থেকেই সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। তাকে কড়কানোর ব্যাপারটা যে সে সহজভাবে নেবে না, উপরতলায় আমার নামে নালিশ করবে, তাও জানতুম। তবে সেটা যে এত তাড়াতাড়ি রানি-মা’র কানে পৌঁছবে, এতটা আমি কল্পনা করিনি। 

প্রশ্ন শুনে আমার বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল। কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। তবু যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললুম, “লোকটি ফাঁকিবাজ। দফতরে তার সাতঘণ্টা কাজ করবার কথা, কিন্তু গত এক হপ্তায় তাকে একটা দিনও তিন-চার ঘণ্টার বেশি কাজ করতে দেখিনি। তাই তাকে একটু কড়কে দিতে হল। এটাও জানিয়ে দিতে হল যে, দশটায় দফতরে না এলে তাকে আমি হাজিরা খাতায় সই করতে দেব না।” 

“কাজ করতে ওর কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে?” 

“যদি হয়, তো স্পষ্ট করে সেটা বলুক। যদি আমার সাধ্যে থাকে, তো অসুবিধেটা আমি মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করব। কিন্তু তার জন্যে কাজে ফাঁকি দেবে কেন? রানি-মা, আমি অসুবিধের কথাটা বুঝি, দাবিদাওয়ার কথাটাও বুঝি, সে-সব যে মেটানো দরকার, তাও বুঝি, কিন্তু এই ফাঁকিবাজির ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করি না।” 

রানি-মা হাসলেন। বললেন, “কামাল হ্যায়! তো ঠিক আছে। আর-এক হপ্তা দ্যাখো। আমি ওর বাবাকে সব বলছি। তাতেও যদি না বিধা হয়, তো আমাকে জানিয়ো, ওর বদলে আমি তোমাকে অন্য লোক দেব।…আর হ্যাঁ, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। তোমার যা কোয়ালিফিকেশন, তাতে ‘কেয়ারটেকার’ উইল নট বি দ্য রাইট কাইন্ড অভ্ ডেজিগনেশন ফর ইউ। তাই দেওয়ানজির সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলুম যে, সামনের মাস থেকে পোস্টার নাম আমরা পালটে দেব, অ্যান্ড ইউ উইল বি নোন্ অ্যাজ দ্য প্যালেস সুপারিনটেন্ডেন্ট। সেইসঙ্গে তখাও কিছু বাড়বে। গে এখন তুমি কত পাও?” 

“সাড়ে তিনশো।” 

“ওটা পাঁচশো হয়ে যাবে। …ওয়েল, ইউ মে গো নাউ।” 

কোনওক্রমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে প্রায় বিমূঢ় অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ পিছন থেকে রানি-মা আবার ডাকলেন। বললেন, “ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। … না না, তেমন কিছু নয়, এ ভেরি মাইনর ম্যাটার। রূপকে তুমি দেখেছ তো?” 

“ছোট রাজকুমারের কথা বলছেন তো? মাত্র একদিনই তাঁকে দেখেছি, তাও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে।” 

রানি মা আবার খুব সুন্দর হাসলেন। বললেন, “সিলি বয়, হঠাৎ রেগে গিয়ে তিনটে ড্যাশুন্ডকে মেরে ফেলেছে। অবিশ্যি ওরা এমনিতেই মরত। অনেক বয়েস হয়েছিল তো, আর ভুগছিলও খুব। এদিকে রূপও এমনিতে বড় দয়ালু ছেলে, তাই এখন খুব আক্ষেপ করছে।” 

ঠিক কী যে যশোমতী দেবী বলতে চান, তা আমি বুঝে উঠতে পারছিলুম না। তাই কুণ্ঠিতভাবে বললুম, “আমায় কিছু করতে হবে?” 

“ও নো, ইউ ডোট হ্যাভ টু ডু এনিথিং।” রানি-মা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “শুধু একটা কথা। তুমি তো মাঝে-মাঝে বাইরে যাও, তা এই রেগে গিয়ে কুকুর মারার ব্যাপার নিয়ে প্যালেসের বাইরে কাউকে কিছু বোলো না। …বাস্, এবারে তুমি যেতে পারো।” 

চতুর্থ ঘটনা, কাল ২৭ ফেব্রুয়ারির বিকেলে ডঃ সিদ্দিকির কাছে গিয়েছিলুম। কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলেই রানি-মা আমাকে বলেছিলেন যে, প্যালেস আর্কিটেকচার সম্পর্কে ডঃ সিদ্দিকি একজন অথরিটি, সুতরাং এ-ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবার থাকলে তাঁকেই জিজ্ঞেস করা ভাল। তো বিষাণগড় প্যালেসের কয়েকটা খুঁটিনাটি বিষয়ে আমার জানবার ছিল। সেইজন্যেই তাঁর কাছে যাওয়া। অমায়িক পণ্ডিত মানুষ, আলাপ করে খুশি হওয়া গেল। তাঁরই ওখানে পরিচয় হল এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম শুনলুম চারু ভাদুড়ি। বিলিতি বিমা কোম্পানি কাম্বারল্যান্ড ইনসিওরেন্সের জাল তো ভারতবর্ষেও মস্ত করে ছড়ানো, ইনি তাদের একজন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। বছরখানেক হল বিষাণগড় অফিসের চার্জে আছেন। কথায় কথায় বললেন, বিষাণগড় শহরটা তো ভালই, তবে কিনা পরপর দু’মাসে দুটো লোক খুন হয়ে গেল, আগে এখানে এই ধরনের ঘটনার কথা ভাবাও যেত না। 

ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন, মানে ওই সেকেন্ড মার্ডারটার কথা বলছি, এত লোক থাকতে শেষ পর্যন্ত লাশটা কিনা আমারই চোখে পড়ল!” 

চারু ভাদুড়ি বললেন, “তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার, পুলিশ যাকে খুনি বলে এক্ষেত্রে সন্দেহ করছে, অন্তত সন্দেহ করছে বলে চতুর্দিকে বলে বেড়াচ্ছে, বরাবর সেই লোকটা কিন্তু এখানেই ছিল, অথচ পুলিশ তাকে তখন অ্যারেস্ট করেনি, আর এখন নাকি তাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।” 

বললুম, “কী ব্যাপার বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কী করে বলব। তবে কিনা আপনি এখানে নতুন এসেছেন তো, তাই গায়ে পড়ে একটা পরামর্শ দিচ্ছি। একটু সাবধানে থাকুন। আর যা-ই করুন, বেশি রাত করে … মানে পথে যখন লোকজন খুব কম, তখন … রাস্তাঘাটে পারতপক্ষে বেরুবেন না।”

১২ 

গ্র্যাড হোটেলে ইন্টারভিউয়ের ডাক পাবার পর মধ্যপ্রদেশ সম্পর্কে যা-কিছু জানা দরকার, মোটামুটি তা জেনে নিয়েছিলুম। কিন্তু যে-সব বই তখন পড়ি, তাতে ব্রিটিশ-শাসিত এলাকা সম্পর্কে যত তথ্য ছিল, মধ্য-ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে তার অর্ধেক কেন সিকিভাগ তথ্যও ছিল না। তো-এসব হল ভারত স্বাধীন হওয়ার আগের কথা, সেই ছেচল্লিশ সালের ব্যাপার। তারপরে তো ওলট-পালট কম হল না, দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখনই বা আজকের ভারতে যা কিনা আয়তনে সবচেয়ে বৃহৎ রাজ্য, সেই মধ্যপ্রদেশ ছিল কোথায়। স্বাধীনতার ন’মাস বাদে, ১৯৪৮ সালের ২৮ মে তারিখে, এই এলাকার তাবৎ দেশীয় রাজ্যকে একই শাসনব্যবস্থার সুতোয় গেঁথে যখন মধ্যভারত ইউনিয়ন গড়া হল, আর গোয়ালিয়রের মহারাজা জিয়াজি রাও সিন্ধিয়াকে করা হল তার রাজপ্রমুখ, আজকের এই মধ্যপ্রদেশ তখনও জন্ম নেয়নি। এর জন্ম তো আরও আট বছর বাদে, ১৯৫৬ সালে। মধ্যভারত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটিয়ে আর সেইসঙ্গে আগেকার সেই ব্রিটিশ শাসিত সেন্ট্রাল প্রভিন্সের চোদ্দোটি জেলাকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করা হল ভারতের এই বৃহত্তম রাজ্যটিকে, যার আয়তন এখন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। ইউরোপের মানচিত্রের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিন, তা হলেই বুঝতে পারবেন যে, ওখানকার বহু ছোটখাটো দেশকে আমাদের এই মধ্যপ্রদেশ এখন অক্লেশে গিলে খেতে পারে, আর তা খাবার পরেও তার পেটের ভিতরকার সবখানি জায়গা ভরাট হবে না। 

তো সে-কথা থাক। আমি তো আর এই আমলের কাহিনি শোনাচ্ছি না, বলছি সেই আমলের কথা, দেশের এই বিরাট এলাকার অনেক খবরই যখন আমাদের কানে এসে পৌঁছত না। বিশেষ করে এখানকার দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল নেহাতই অস্পষ্ট। আমরা মোটামুটি এইটুকু জানতুম যে, এ-সব রাজ্যের কোনওটা খুবই বড়, আবার কোনওটা খুবই ছোট মাপের, কারও বার্ষিক আয় বিরাট অঙ্কের, আবার কারও আয় এতই কম যে, ছোটখাটো অনেক জমিদারির আয়ও তার চাইতে অনেক বেশি। ভাসাভাসাভাবে এটাও আমাদের জানা ছিল যে, এই রাজ্যগুলির কোনও-কোনওটার শাসনব্যবস্থা খুবই আধুনিক, সেখানে সবই চলে আইনমাফিক, প্রজারা তাই মোটামুটি সুবিচারও পায়, তবে কিনা বেশির ভাগ রাজ্যেই জমে আছে মধ্যযুগের অন্ধকার, সেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই, রাজারাই সেখানে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁরা তাঁদের খেয়ালখুশিমতো রাজ্য চালান, আর তাঁদের বিলাসব্যসনের কড়ি জোগাতেই প্রজাদের প্রাণ বেরিয়ে যায়। 

তা এই অত্যাচারের কথা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা শুনেই জানা যেত, বইপত্তরে এ-সবের উল্লেখ থাকত না। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, বইগুলো তো ইংরেজদের লেখা, দেশীয় রাজারা তাদের বন্ধু, তাঁদের অত্যাচারের কাহিনী কেন সাহেব-লেখকরা ফাঁস করতে যাবে। তার উপরে যাবার আমি যে-সব বই তখন জোগাড় করতে পেরেছিলুম, তাতে এই এলাকার দেশীয় রাজ্যগুলির শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ভাল-মন্দ কোনও কথাই ছিল না। তবে এই গোটা ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের আলোচনা ছিল বিস্তারিত। তাতে এই একটা সুবিধে আমার হয়েছিল যে, এখানকার ভূপ্রকৃতি, অরণ্য আর খনিজ সম্পদ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা আমি করে নিতে পেরেছিলুম। এখানে জানিয়ে রাখি, বিষাণগড়ে থাকতে এই ধারণাটা আমার খুব কাজে লেগেছিল। 

বিষাণগড় রাজ্যটা যে বড়, তা নয়। তবে এই এলাকায় অতিশয় ক্ষুদ্র রাজ্যও তো বিস্তর আছে, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে কিন্তু বিষাণগড়কেও নেহাত ছোটখাটো রাজ্য বলা যাবে না। এর আয়তন বিশ হাজার বর্গ-কিলোমিটারের চেয়েও কিছু বেশি, অর্থাৎ আমাদের হুগলি জেলার যে আরামবাগ মহকুমা, তার আয়তনের মোটামুটি বিশগুণ; এদিকে আবার এখনকার আরামবাগের লোকসংখ্যা তো প্রায় দশ লক্ষ, সেক্ষেত্রে বিষাণগড় রাজ্যের লোকসংখ্যা পাঁচ-ছ লাখের বেশি তো নয়ই, কিছু কমও হতে পারে। তারও মোটামুটি বারো আনাই যে ট্রাইবাল পপুােশন, এই তথ্যটা ডঃ সিদ্দিকির কাছে জেনেছিলুম। 

বিষাণগড়ের রাজধানীর নামও বিষাণগড়। এটাই এ-রাজ্যের একমাত্র শহর। লোকসংখ্যা হাজার পনরো। গোটা কয়েক স-মিল অর্থাৎ করাত-কল আছে, দুটো রাইস মিল আছে, দুটো ইটখোলা আছে, আর আছে ছোটবড় কিছু দোকান। এ-সব ব্যাবসার সবই চালায় মারোয়াড়ি আর গুজরাটিরা। কিছু লোক সেখানে কাজ করে আর কিছু লোক রাজ-এস্টেটের নানান দফতরে। শহরে জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। যাঁরা মোটামুটি সচ্ছল লোক, নিজেদের জলের ব্যবস্থা তাঁরা নিজেরাই করে নিয়েছেন। তা ছাড়া, সব রাস্তায় না হোক, বড়-বড় তিনটি রাস্তার প্রত্যেকটিতেই আছে চার-পাঁচটি করে সরকারি টিউবওয়েল। গরিব মানুষদের সবাই যে যেখান থেকে খাবার জল নিয়ে যায়, তা অবশ্য নয়, তাদের ভরসা সর্সোতিয়া নদী আর গুটিকয় দিঘি। কিছু বাড়িতে ইঁদারা আছে, তার জল শুনেছি খুবই স্বাস্থ্যকর। 

বিষাণগড়ে একটা আদালত আছে। কলেজ নেই। একটি উচ্চ-ইংরেজি বিদ্যালয় আছে, আর আছে দুটি মাইনর ইস্কুল। সেখানে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ানো হয়। 

রাজ্যের মোট জনসংখ্যার শতকরা যারা পঁচাত্তর ভাগ, সেই ট্রাইবালরা শহরে থাকে না। এ-বাজ্যে জঙ্গল আছে প্রচুর, পাহাড়িয়া এলাকাও কম নয়। সমতল ভূমি বলতে গেলে চোখেই পড়ে না। পাহাড়ে আর জঙ্গলেও অবশ্য কিছু-কিছু ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে চাষও অল্পবিস্তর হয়। ট্রাইবালদের মধ্যে সবাই যে একই গোষ্ঠীর লোক, তা নয়, তাদেরও অনেক গোষ্ঠী। কিছু-কিছু গোষ্ঠীর লোক চাষবাস করে, তাঁত বোনে, এখানে একরকমের শণ জন্মায়, তা দিয়ে মাদুর বানায়। কিছু-কিছু লোক সে-সবের ধার ধারে না। 

বিষাণগড়ের খনিজ সম্পদ নিতান্ত কম নয়। লোহা আছে, ম্যাঙ্গানিজ আছে, আর আছে কয়লা। তবে রাজ্যের যা আয়, তার বেশির ভাগই আসে জঙ্গল থেকে। জঙ্গলে যেমন শাল, তেমন সেগুনও প্রচুর। রাজ-এস্টেট থেকে জঙ্গল ইজারা দেওয়া হয়। মূল্য বাবদে যা মেলে, তার সবটাই রাজ-এস্টেটের। জঙ্গলের যারা বাসিন্দা, তারা একপয়সাও পায় না। গাছপালা কাটবার অধিকার তাদের নেই; তবে হ্যাঁ, শুকনো মরা ডালপালা তারা কুড়িয়ে নিতে পারে। 

এ রাজ্যের সব নদীই পাহাড়িয়া নদী। শীতকালে তিরতির করে বয়, গ্রীষ্মে প্রায় শুকিয়ে যায়, আবার বর্ষাকালে মাঝেমধ্যে এমন ঢল নামে যে, সেইসময়ে স্রোতের মধ্যে পড়লে বোধহয় হাতিও ভেসে যাবে। নদীগুলির মধ্যে সর্সোতিয়াই বড়। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়ায় এই বিষাণগড় শহরের বাহারও খুলেছে খুব। বিশেষ করে তার পুব দিকে এই প্যালেস রোডের তো তুলনাই নেই’ বেড়াবার পক্ষে যাকে বলে একেবারে আদর্শ জায়গা। বিষাণগড়ে ইতিমধ্যে আমার পুরো একমাস কেটে গেছে। এখন মার্চ মাসের মাঝামাঝি। কলকাতায় এইসময়ে রীতিমত গরম পড়ে যায়, দুপুরের দিকে রাস্তাঘাট বেশ তেতে ওঠে। এখানে কিন্তু এখনও তত গরম পড়তে দেখছি না। ভোরে আর সন্ধের পর থেকে তো এখনও একটু শীত-শীত করে। হাল্কা একটা চাদর গায়ে থাকলে তখন আরাম বোধ করি। 

সাধারণত আমি আজকাল ভোরেই ঘুম থেকে উঠি, তবে সকালের দিকে আর বেড়াতে যাওয়া হয় না। দফতরের কাজ চুকে যাবার পরে লছমি আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। তখন সে আর আমাকে ছাড়তে চায় না। তার তাগাদায় বিকেলের দিকে প্রায় রোজই এখন সর্সোতিয়ার ধারে বেড়াতে যাই। তখন ডঃ সিদ্দিকি আর ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। নদীর ধারে মাঝে-মাঝেই লোহার বেঞ্চি পাতা। খানিক হাঁটবার পরে তারই কোনও একটায় বসে পড়ি আমরা। নানান ব্যাপারে গল্প হয়। লছমি আমার গা ঘেঁষে তখন চুপটি করে বসে থাকে। 

সেদিনও গল্প হচ্ছিল। কথায়-কথায় সসোতিয়ার প্রসঙ্গ উঠল। বললুম, “নামটার মানে কী? এটা কি কোনও ট্রাইবাল শব্দ?” 

শুনে ডঃ সিদ্দিকি হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “আরে না মশাই। আসলে নামটা হচ্ছে সরস্বতী, লোকের মুখে-মুখে সেটাই সর্সোতিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।” 

“কিন্তু সরস্বতী নদী এখানে কী করে এল?” 

“এখানে বলে কথা নেই, আরও নানা জায়গায় আছে। আপনাদের বেঙগলেও একটা সরস্বতী ছিল, কিন্তু সেই নদী এখন হেজেমজে গেছে। আসলে ব্যাপার কী জানেন, একই নামের নদী রয়েছে ইন্ডিয়ার হরেক এলাকায়। এই যেমন যমুনা। তো দিল্লিতে যেমন যমুনা রয়েছে, তেমনি ইস্টবেঙ্গলেও ওই নামের একটা নদী আপনি দেখবেন। এ-সব আলাদা-আলাদা নদী, কিন্তু একই নাম।” 

প্যালেসের কথাটাও সেদিন তুলেছিলাম। তাতে নাক কুঁচকে ডঃ সিদ্দিকি < বলেন, “আরে দূর দূর, এখানকার এই রাজবাড়িটা তো একটা হচপচ ব্যাপার। গথিক, রেনেসাঁস, বারোক, ভিকটোরিয়ান, সব মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি। অথচ, মজা কী জানেন, প্যালেস কমপ্লেক্সের যেটা মূল বাড়ি, সেটা ছিল রাজস্থানি-ধঁচের। আমার ঠাকুর্দার কাছে অন্তত সেইরকমই শুনেছি। তাঁর ছেলেবেলায় সেই বাড়ি তিনি দেখেওছেন। চমৎকার বাড়ি। তো এইট্রিন থার্টিতে সেই বাড়িটাকে ঘিরে নতুন-নতুন উইং গড়বার কাজ শুরু হয়ে যায়। বিলেত থেকে আর্কিটেক্‌ট নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে ছিল হরেক স্টাইলের নকশা। তা তো থাকতেই পারে। সম্ভবত তিনি আশা করেছিলেন যে, তার থেকে একটা কোনও স্টাইল বেছে নেওয়া হবে। কিন্তু তা তো আর হল না, মহারাজা হলেই যে শিল্প সম্পর্কেও তাঁর কিছু জ্ঞানগম্যি থাকবে, এমন তো কোনও কথা নেই। তা তখন যিনি মহারাজা, তাঁর রুচির বালাইও বিশেষ ছিল না। ফলে তিনি ঢালাও হুকুম দিয়ে বসলেন, সব রকমের স্টাইল মিলিয়ে-মিশিয়ে প্যালেস তৈরি হোক। তো তা-ই হল। তার ফল যে কী হয়েছে, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। অথচ এই পাঁচমিশেলি ব্যাপারটার মধ্যে যেটা ঢাকা পড়ে গেছে, তার কাজ দেখবেন। চোখের পলক পড়বে না।”

“রানি-মা কিন্তু এই নতুন আর্কিটেকচারাল প্যাটার্নেরই মস্ত ভক্ত। দেশীয় রাজাদের প্রাসাদ নিয়ে বিলেত থেকে একখানা বই বেরিয়েছে, তাঁকে সেই বইখানার কথা বলেছিলুম। তা সেখানা তিনিও দেখেছেন। তাতে বিষাণগড়ের রাজবাড়ির বিশেষ প্রশংসা নেই বলে দেখলুম রানি-মা’র খুব অভিমান।” 

ডঃ সিদ্দিকি হেসে বললেন, “অভিমান তো হতেই পারে। রুচির বালাই তো তাঁরও বিশেষ নেই।”

“তিনি কিন্তু প্যালেস-আর্কিটেকচারের ব্যাপারে আপনাকে একজন অথরিটি বলে গণ্য করেন।”

“বটে?” ডঃ সিদ্দিকি বললেন, “থাক্ থাক্, তা হলে আর আমার ওপিনিয়নটা তাঁকে জানাবেন না।” 

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা তো হল, এবারে আপনার নিজের কথা বলুন। খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?”- 

বললুম, “না না, খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও খুঁতখুঁতি নেই, যা পাই তা-ই চেটেপুটে খাই। তার উপরে আবার এখানে যা খাচ্ছি, তা রাজবাড়ির কিচেন থেকে আসছে তো, সবই অতি উচ্চাঙ্গের খাদ্য।” 

“ভাল, ভাল। তা কেয়ারটেকারের কাজটাও আশা করি খারাপ লাগছে না?”

“ওঃ হো, আপনাকে তো বলা-ই হয়নি। আমি আর এখন কেয়ারটেকার নই।”

“তা হলে কী?” 

“প্যালেস-সুপারিন্টেন্ডেন্ট। কাজ অবশ্য পালটায়নি। তবে মাইনে বেড়েছে দেড়শো টাকা।”

ভাদুড়িমশাই চোখ গোল করে বললেন, “বটে? কবে থেকে?” 

“এই মাসের গোড়া থেকে।” 

“তাজ্জব ব্যাপার। মাত্র পনেরো দিনের মাথায় প্রোমোশান? আপনি মশাই ভাগ্যবান মানুষ! “

“তা-ই তো দেখছি। নইলে আর অমার নামে রানি-মা’র কাছে নালিশ করা সত্ত্বেও তিনি পানিশমেন্টের বদলে প্রোমোশানের ব্যবস্থা করবেন দেন? শুধু কি তা-ই, যে-লোকটি নালিশ ঠুকেছিল, তাকে একেবারে ঢিট্ করে দিয়েছেন, বলেছেন যে, ফের যদি সে আমার কথার অবাধ্য হয় তো প্যালেসের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে জঙ্গলের কাজ দেখতে পাঠিয়ে দেবেন।” 

“বাস্ রে!” ভাদুড়িমশাই একটা চোখ একটু ছোট করে বললেন, “আপনি দেখছি ছোটরানির নেকনজরে পড়ে গিয়েছেন। তো মশাই, এর মধ্যে কোনও কিন্তু-টিন্তু নেই তো?” 

ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলুম। তাই লজ্জিত গলায় বললুম, “দূর দূর, কী যে বলেন!” 

ডঃ সিদ্দিকি উঠে পড়েছিলেন। বললেন, “আমার একটু হাঁপানির টান আছে, তাই রাত্তিরের খাওয়া সাড়ে সাতটার মধ্যেই চুকিয়ে দিতে হয়। আজ তা হলে চলি।” 

লছমি কিছুক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল। তাই আমাকেও উঠতে হল। বললুম, “আমিও চলি। এখন বাড়িতে ফিরে এই ভদ্রমহিলাটিকে খাইয়ে দিতে হবে, গল্প শোনাতে হবে, তাইলে ইনি ছাড়বেন না।” 

ফেরার পথে লছমি বলল, “চাচাজি, মানুষ মরে গিয়ে কী হয়?” 

এই প্রশ্নটা লছমি রোজই করে। বললুম, “সে তো তোকে কতবার বলেছি। মনে নেই?”

“আছে। তবু বলো।” 

“মানুষ তো মরে না, সে আকাশে উঠে আকাশের তারা হয়ে যায়।”

“আমার বাবুজিও আকাশের তারা হয়ে গেছে?” 

“হ্যাঁ, লছমি। আমিও তারা হয়ে গিয়েছিলুম। তোর বাবুজি তো আমার বড়-ভাইয়া, আকাশে উঠে সে আমাকে বলল, আমরা দুজনেই যদি আকাশের তারা হয়ে থাকি তো লছমিকে খাইয়ে দেবে কে, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে কে, তাকে কহানিয়াঁই বা কে শোনাবে? না না, তুই ফিরে যা, নইলে লছমির খুব কষ্ট হবে। বাস্, আমিও তাই শুনে আকাশ থেকে নেমে পড়লুম। তো তুই তো বড় হবি। তখন আমি বরং আকাশে উঠে গিয়ে বড়-ভাইয়াকে এখানে পাঠিয়ে দেব।” 

এই কথাগুলি যে আজই প্রথম বললুম, তা নয়। সেই প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি। কিন্তু এ-সব “কথায় লছমি রোজ যা করে না, আজ তা-ই করল। রাস্তার মধ্যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে সে বলল, “চাচাজি, তুম্ জেরা মুঝে গোদ পর্ উঠা লো।” 

কোলে তুলে নিতেই সে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল আমার গলা। তারপর আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে অস্ফুট গলায় বলল, “নেহি চাচাজি, উ নেহি হো সকতা, পিতাজিকো যো-কুছ বোল্‌না হ্যায়, য়হাঁসেই বোলো, ম্যয় তুমকো জানে নেহি দুঙ্গি।” 

বাড়ি না পৌঁছনো পর্যন্ত লছমি আর আমার কোল থেকে নামল না। মিশ্রজির কোয়ার্টার্সে ঢুকবার পরে নামল বটে, কিন্তু তার মা যখন বললেন যে, মুখহাত ধুয়ে, জামা পালটে এবারে তাকে খেতে বসতে হবে, তখন সে এক নতুন বায়না তুলে বসল। বলল, “চাচাজি আমার মুখহাত ধুইয়ে দেবে।” 

লছমির মা যমুনা দেবীকে প্রথম প্রথম আমি ‘ভাবি’ বলতুম। পরে তাঁরই ইচ্ছেমতো ‘দিদি” বলতে শুরু করি। মেয়েকে শাসন করবার জন্যে তিনি হাত তুলেছিলেন, আমি তাঁকে বাধা দিয়ে বললুম, “ঠিক আছে দিদি, ওর যখন ইচ্ছে হয়েছে, তখন আজ নাহয় আমিই ওর মুখহাত ধুইয়ে জামা পালটে দিচ্ছি।” 

গঙ্গাধর মিশ্রের স্ত্রী ইতিমধ্যে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ব্যাপার দেখে তিনি বললেন, “মেয়েটা তোমাকে পরেসান্ করে ছাড়ল বেটা।” 

হেসে বললুম, “কিছু না, তাইজি, কিছু না। পরেসান কেন হব, আমার তো ভালই লাগছে।” যমুনা দেবী বললেন, “তো ঠিক আছে, ভাইয়া তোর মুখহাত ধুইয়ে দিক, জামা পালটে দিক, কিন্তু তারপর ওকে তুই ছেড়ে দিবি, কেমন?” 

মাথা ঝাঁকিয়ে লছমি বলল, “নেহি নেহি। ছোডুঙ্গি নেহি। তারপর আমাকে খাইয়ে দেবে, তারপর আমাকে একটা গল্প ওনাবে…” 

“তারপর?” 

“তারপর আমি আজ উপরে গিয়ে চাচাজির কাছে ঘুমাব।” 

লছমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর উপরে আসেনি। ‘স্নো হোয়াইট’-এর গল্প শুনতে শুনতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমারও যে একটু ক্লান্ত লাগছিল না, তা নয়। ভাবছিলুম, উপরে উঠে ভাল করে স্নান করে নেব। 

উপরে উঠতে-উঠত দশটা। কিচেন থেকে রাত ন’টা নাগাদ আমার রাত্তিরের খাবারটা দিয়ে যায়। বুধন বলে একটি অল্পবয়সী ছেলে আমার ঘরদোর পরিষ্কার করে, গেঞ্জি-রুমাল কেচে দেয়, দরকারি টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে আনে। রাত আটটা নাগাদ আমি যখন বাইরে থেকে বেড়িয়ে ফিরি, তখন তার ছুটি। আজ আমি একতলায় আটকে গিয়েছিলম, তাই ফিরতে দেরি হয়েছে। বুধনকে অবশ্য বলাই ছিল এক-আধদিন হয়তো ফিরতে দেরি হয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে সে যেন বাড়ি চলে যায়। কিন্তু উপরে উঠে দেখলুম, বুধন তখনও বাড়ি যায়নি। 

বললুম, “কী ব্যাপার? তুই এখনও বাড়ি যাসনি কেন?” 

বুধন বলল, “আপনাকে একটা খবর দেবার আছে বাবুজি।”

“কী খবর?” 

“কুলদীপ সিংজি বলে পাঠিয়েছেন যে, ফিরে এসে আপনি যেন একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। খুব জরুরি।’ 

বিষাণগড়ে যাঁরা খুব ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, কুলদীপ সিং যে তাঁদেরই একজন, সেটা জানতুম, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়া তো দূরের কথা, মানুষটিকে আমি চোখে পর্যন্ত দেখিনি। শুনেছিলুম যে, রানি-মা’র সঙ্গে তিনিও পঞ্জাবে গিয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লিতে কিছু কাজ ছিল বলে একসঙ্গে ফেরেননি। কাজ সেরে মাত্র গতকালই তিনি বিষাণগড়ে ফিরে এসেছেন। কী এমন জরুরি কাজে আমাকে তাঁর দরকার হল, বুঝতে পারলুম না। রাতের খাবারটা ঢাকা ছিল, ঢাকা-ই পড়ে রইল, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে, পোশাক পালটে রওনা হলুম প্যালেসের দিকে। 

প্যালেসের পশ্চিম দিককার কোন্ ঘরে তিনি বসেন, সেটা জানা ছিল। সেখানে যেতেই একজন বেয়ারা বলল, “সাব্ এখন দেওয়ানজির ঘরে আছেন, সেইখানেই যেতে বলেছেন আপনাকে।” 

দেওয়ান সার্ ত্রিবিক্রম কপুরের ঘরে ঢুকে দেখলুম, একজন সাহেবের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। ঘরে যে তৃতীয় ব্যক্তিটি বসে আছেন, তাঁকে আগেও দেখেছি। চোখে মনোক্‌ল, নাকের নীচে মোমে-মাজা ছুঁচলো-ডগার গোঁফ, এই মানুষটিকে আমি গ্র্যান্ড হোটেলে দেখেছিলুম। রানি-মা যে এঁকে ‘দীপ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তাও মনে পড়ল। ও হরি, ইনিই তা হলে কুলদীপ সিং। 

দেওয়ানজি বললেন, “প্লিজ টেক ইয়োর সিট। …নাউ দীপ, তুমি ওঁকে কী বলবে বলো।”

কুলদীপ বললেন, “লুক হিয়ার মিঃ চ্যাটার্জি, ইট্‌স নো ইউজ বিটিং অ্যাবাউট দ্য বুশ… রূপ যখন একটা কুকুরকে তাড়া করে মন্দিরের দিকে ছুটে গিয়েছিল, তখন আপনি তাকে বাধা দিয়েছিলেন?”

প্রায় এক মাস আগের সেই ঘটনার প্রসঙ্গ যে আজ আবার কেন উঠল, কিচ্ছু বুঝতে পারলুম না। বললুম, “হ্যাঁ, বাধা দিয়েছিলুম। কিন্তু তিনি যে আমাদের ছোটকুমার, তা আমি জানতুম না।”

কুলদীপ কিছু বলবার আগেই সাহেবটি বললেন, “অ্যান্ড হোয়াট উড ইউ হ্যাভ ডান্, হ্যাড ইউ নোন্ দ্যাট হি ওয়াজ ইনডিড্ দ্য ছোটা কুমার অভ্ বিষাণগড়?”

আমি ত্রিবিক্রম কপুরের দিকে তাকালুম। তিনি বললেন, “উনি মিঃ রিচার্ড উইলসন, এখানকার পোলিটিক্যাল অফিসার। ওঁর প্রশ্নটার আপনি জবাব দিন।” 

বললুম, “জানলেও হয়তো বাধা দিতুম। তার কারণ, কুকুরটাকে তিনি মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।” 

“কী করে বুঝলেন?” 

“ছোটকুমার নিজেই বলেছিলেন যে, তিনটে ড্যাশুকে তিনি পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন, এখন এটাকেও পিটিয়ে মারতে চান।” 

“ওহ্ নো,” কুলদীপ সিং দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “ইট’স এ লাই, এ ডেপিকেব্ল লাই!”

তাকিয়ে দেখলুম, রাগে তাঁর মুখ টকটক করছে। শান্ত গলায় বললুম, “আমি যদি আপনার রাগ করবার মতো কোনও কথা বলে থাকি, তো তার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু কথাটা মিথ্যে নয়, রানি-মা নিজেও তা আমাকে বলেছেন।”

সার ত্রিবিক্রম বললেন, “উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই দীপ, এখন ওঁকে যা বলবার সেটা বলে দাও।” কুলদীপ ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছিলেন। বললেন, “এই কুকুর মারবার কথাটা কি আপনি প্যালেসের বাইরে কাউকে বলেছেন?” 

“না, কাউকেই বলিনি। যাতে না বলি, তার জন্যে রানি-মা নিজেই আমাকে অনুরোধ করেছেন।” কুলদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, উইলসন তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, “রানিসাহেবা অনুরোধ করেছেন, এখন আমি আপনাকে আদেশ দিচ্ছি যে, এ-ব্যাপারে বাইরের কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু না জানতে পারে। কিপ মাম্ অ্যাবাউট অল দ্যাট ইউ মে হ্যাভ সিন অর হার্ড। এ নিয়ে যদি বাইরে আপনি মুখ খোলেন, তো তার পরিণাম আপনার পক্ষে খারাপ হবে। কিপ্ ইয়োর মাউথ অ্যাবসলি শার্ট। ওয়েল, দ্যাটস হোয়াই ইউ হ্যাভ বিন গিড়ন এ বিগ (প্রামোশান। 

প্যালেস থেকে ফিরতে-ফিরতে পৌনে এগারোটা। নীচের তলার বারান্দায় দেখলুম গঙ্গাধর মিশ্র একটা মোড়ার উপরে বসে আছেন। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “কী ব্যাপার বেটা? এত রাতে প্যালেসে গিয়েছিলে কেন?” 

সব কথা তাঁকে জানালুম। তারপর হেসে বললুম, “ছোট কুমার যে কুকুর মারতে গিয়েছিল, তা তো আমি একা দেখিনি, আপনিও দেখেছিলেন। বোধহয় আমরা দুজনেই খুব অন্যায় করে ফেলেছি। না-দেখলেই ভাল ছিল।” 

শুনে মিশ্রজিও হাসলেন। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললেন, “আমাকে নিয়ে কোনও ভয় নেই বেটা, আমাকে ঘাঁটাবার মতো সাহস এদের হবে না। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার ভয় এবারে বেড়ে গেল।” 

রাজবাড়ি থেকে ঘোর অস্বস্তি নিয়ে ফিরেছিলুম। কিছুতেই সেটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলুম না। মনের মধ্যে একটা কাঁটা সারাক্ষণ খচখচ করছিল। তার উপরে মুখটাও কেমন যেন তেতো হয়ে আছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে-উঠতে ভাবলুম, আজ আর কিছু খাব না, স্রেফ জামাকাপড় পালটে এবারে শুয়ে পড়ব। কিন্তু আরও একটা চমক তখনও অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। বারান্দা থেকে বসবার ঘরে ঢুকে লাইট জ্বাললুম। তারপর ঘুরে দাঁড়াতেই যা আমার চোখে পড়ল, তার জন্যে আমি একেবারেই তৈরি ছিলুম না। 

দেখলুম একটা সোফার উপরে পামেলা উইলসন বসে আছেন। 

১২

টেলিফোন বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল। বেড সুইচ টিপে আলো জ্বেলে ঘড়ির দিকে তাকালুম। সাড়ে ছ’টা। কিন্তু এখন ডিসেম্বর মাস। দিল্লিতে এখন এত তাড়াতাড়ি সকাল হয় না। শীতও পড়েছে কড়া রকমের। এদিকে টেলিফোনটা তো বিছানার পাশেই থাকবে, তাও নেই। সেটা রয়েছে দূরে, রাইটিং টেবিলের উপরে। কিন্তু কী আর করা, কম্বলটাকেই গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে টেলিফোন ধরলুম। 

“চ্যাটার্জি স্পিকিং” বলতেই ওদিক থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর। “কী মশাই, ঘুমুচ্ছিলেন নাকি?” 

ভাদুড়িমশাই। বললুম, “বাঃ, ঘুমুব না? কালকের ইভনিং ফ্লাইট কখন পালামে এসে পৌঁছেছিল জানেন? রাত সাড়ে ারোটায়। কিনা ফগের জন্যে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। তো এয়ারপোট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে দেড়টা বাজল। শুয়েছি দুটোয়। …কিন্তু সে কথা থাক, আমি যে এই হোটেলেই উঠেছি, তা জানলেন কী করে?” 

“বার-বার তো ওইখানেই ওঠেন। তাই ভাবলুম টেলিফোনে একবার চেষ্টা করে দেখি। তো রিসেপশানে আপনার নাম বলতেই আপনার ঘরে লাইন দিয়ে দিল।” 

“আপনি কোথায় উঠেছেন? এবারেও ইম্পিরিয়াল?” 

“না, আমার এক ক্লায়েন্ট এখানে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের ব্যবসা করে। লোকটা বিয়ে-থাওয়া করেনি, অথচ গ্রেটার কৈলাসে বাড়ি হাঁকিয়েছে বিশাল। অনেকদিন ধরে বলছিল যে, দিল্লিতে তো আমি প্রায়ই আসি, অন্তত একবার তার বাড়িতে উঠতেই হবে। তো এবারে তা-ই উঠেছি। চান তো আপনিও এখানে এসে উঠতে পারেন।।” 

বললুম, “না মশাই, এই শস্তার হোটেলে দিব্যি আছি। সবকিছুই এখান থেকে কাছে তো, তাই আমার কাজকর্মের খুব সুবিধে হয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, আপনি তা হলে আরও খানিকক্ষণ, ঘুমিয়ে নিন। তারপর আপনার কাজকর্ম সারুন। কিন্তু যেখানেই যান, বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে হোটেলে ফিরে তৈরি হয়ে থাকবেন। সাড়ে চারটে থেকে পৌনে পাঁচটার মধ্যে ওখান থেকে আমি আপনাকে তুলে নিয়ে নিউ রাজিন্দরনগরে সরস্বতীদের বাড়িতে যাব। রাতের খাওয়াটা আজ ওখানেই সারব আমরা, সরস্বতী অন্তত সেইরকমই বলে রেখেছে।” 

“ফিরতে রাত হবে?” 

“তা একটু হতে পারে, তাই রাত্তিরের দিকে অন্য কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখবেন না। আর হ্যাঁ, হোটেলে ফেরার ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন না। আমার ক্লায়েন্ট তার একটা গাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, আপনাকে আপনার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে তবে আমি গ্রেটার কৈলাসে ফিরব।” 

ভাদুড়িমশাই ফোন নামিয়ে রাখলেন। আমি আবার বিছানায় ফিরে কম্বল মুড়ি দিলুম। 

দ্বিতীয় দফার ঘুম ভাঙল ন’টা নাগাদ। ফলে আর ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় হল না। লোদি গার্ডেনসের ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে দশটায় যে সেমিনার বসবে, তাতে সকালের অধিবেশনেই আমার একটা পেপার পড়বার কথা। লাঞ্চ সেখানেই। সঙ্গে কিছু বিস্কুট ছিল। বেড-টি’র সঙ্গে তারই খান-দুই খেয়ে, দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে, তৈরি হয়ে সাড়ে ন’টা নাগাদ একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সেমিনার। আমার পেপারটা পড়বার পরে জনা তিন-চার শ্রোতা যথারীতি কিছু প্রশ্ন করলেন। যথারীতি তার উত্তরও দিতে হল। তারপর আরও দুজনের আরও দুটি পেপার। আরও দু’কিস্তি প্রশ্নোত্তর। তারপর লাঞ্চ। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হল আড়াইটেয়। সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলবার কথা। কিন্তু আমি আর শেষ পর্যন্ত থাকিনি। সাড়ে তিনটে নাগাদ একটা ট্যাক্সি ডাকিয়ে হোটেলে ফিরে এলুম। 

আসলে এই সেমিনার একটা উপলক্ষ মাত্র। গত মাসে সরস্বতীকে নিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে গিয়েছিলুম। তখনই ভাদুড়িমশাইকে বলতে শুনি যে, ডিসেম্বরে তিনি দিল্লি যাবেন। পরে আমাকে ফোণ করে বলেন, সম্ভব হলে আমিও যেন সেই সময়ে দিল্লি যাই। তো এমন যোগাযোগ যে, তার হপ্তাখানেক আগেই এই সেমিনারে এসে একটা পেপার পড়বার আমন্ত্রণ পেয়েছিলুম। এমনিতে আমি এ-সব সেমিনারে বিশেষ যাই না। কিন্তু ভেবে দেখলুম, এবারে যদি আসি তো সকলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, তেমনি যাতায়াত আর থাকা-খাওয়ার খরচটাও আমাকে মেটাতে হবে না, সেমিনারের ব্যবস্থা যাঁরা করেছেন, তাঁরাই সেটা দিয়ে দেবেন। কবে সেমিনার, ভাদুড়িমশাইকে সেটা জানাতে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আমিও তা হলে ওই সময়েই যাচ্ছি।” 

ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থেকে সওয়া চারটের মধ্যেই হোটেলে ফিরে এসেছিলুম। ভাদুড়িমশাই এলেন চারটে চল্লিশে। আমি যে হোটেলের লাউঞ্জেই বসে আছি, এইটে দেখে বললেন, “বাঃ, তা হলে আর উপরে উঠছি না, চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।” 

কনট সার্কাসের আউটার সার্কলে একটা পাক মেরে আমাদের বেরুতে হবে। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করি বলুন তো?” 

“কেন, কী হল?” 

“যখনই কলকাতা থেকে দিল্লি আসি, ওদের জন্যে কিছু মিষ্টি নিয়ে আসি। কিন্তু এবারে তো আসছি ব্যাঙ্গালোর থেকে। সেখানেও অবশ্য স্পঞ্জ রসগোল্লা পাওয়া যায়, কলকাতার কে সি দাশ ব্যাঙ্গালোরেও চমৎকার একটা দোকান চালাচ্ছে, কিন্তু আমার তো মশাই সবই একেবারে শেষ মুহূর্তে, তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হল, তাই মিষ্টিটা আর মনে করে নিয়ে আসা হয়নি। এদিকে মিষ্টি আনিনি শুনলেই তো সরস্বতীর মুখ ভার হবে। লছমিও কথা শোনাতে ছাড়বে না।” 

বললুম, “ভয় নেই, কলকাতা থেকে দু’টিন রসগোল্লা নিয়ে এসে ই, আমার ব্যাগেই রয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শাব্বাশ, এই না হলে চাচাজি! লছমি যে রল্লার খুব ভক্ত ছিল, সেটা আপনি মনে রেখেছেন তাহলে!” 

“না রাখলেও ক্ষতি ছিল না, গোল মার্কেটেও আজকাল রসগোল্লা পওয়া যায়, স্বাদ নেহাত খারাপও নয়।” 

“আরে মশাই, আমি তো গোল মার্কেটে যাবার কথাই ভাবছিলুম। যাক্, তার আর দরকার নেই।” 

গাড়ি অন্য পথ ধরল। শঙ্কর রোডের উঁচু রাস্তা থেকে নীচে নামলুম আমরা। বাঁদিকে একটা মন্দির। সেটা ছাড়িয়ে বাঁয়ে টার্ন নেবার পর খানিক বাদে ডাইনে একটা পার্ক পড়ল। পার্ক ছাড়াতে একটা মোড়। মোড়ের কাছে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নেমে পড়ুন কিরণবাবু, আমরা এসে গেছি।” 

সরস্বতীরা যে আমাদের জন্যেই উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল, তাতে সন্দেহ নেই। রাস্তায় গাড়ি থামবার আওয়াজ আর সিঁড়িতে জুতোর শব্দও তারা শুনতে পেয়েছিল নিশ্চয়। তাই আর আমাদের কলিং বেল বাজাবারও দরকার হল না। সিঁড়ির বাঁক ঘুরে উপরে তাকাতেই দেখলুম, দোতলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী মশাই, কাউকে চিনিয়ে দেবার দরকার হবে?” 

চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল। প্রাণপণ চেষ্টায় সেটা সামলে নিয়ে অস্ফুট গলায় বললুম, “না। …তুমি তো সরস্বতী, তোমাকে গত মাসেই দেখেছি। …তুমি লছমি। …আর আপনি…” লছমির পাশে যিনি শ্বেতপাথরের একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে বললুম, “আর আপনি তো আমার সেই দিদি, ‘ভাবি’ ডাকটা যিনি একটুও পছন্দ করতেন না।” 

বছর-দুয়েকের একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা যে যুবকটি চুপচাপ সরস্বতীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, “এ পর্যন্ত ফুল মার্কস। কিন্তু আমি কে?” 

“তুমি নিশ্চয় সুমঙ্গল।” 

সরস্বতী বলল, “চমৎকার। আর সুমঙ্গলের কোলে ওই যে বিচ্ছুটি দেখছেন, ওটিকে চিনতে পারলেন?” 

হাত বাড়াতেই বিচ্ছুটি একেবারে ঝাঁপিয়ে আমার কাছে চলে এল। বললুম, “এর মুখে তো দেখছি ায়ের মুখখানা একেবারে রসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা হলে আর চিনব না কেন? এ হচ্ছে সরস্বতীর পুত্র। চোখ দুটি যে-রকম ভাসা-ভাসা, তাতে মনে হচ্ছে, কবি হবে। তখন সবাই সরস্বতীর পুত্র না বলে একে সরস্বতীর বরপুত্র বলবে। কিন্তু আমি তো তখন বেঁচে থাকব না।” 

যমুনা দেবী বললেন, “ও কী কথা ভাইয়া! তুমি আরও অনেকদিন বাঁচবে। …কিন্তু তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ভিতরে এসো। ভাদুড়িদাদা, আপনিও আসুন।” 

সবাই মিলে ভিতরে গিয়ে বসা গেল। লছমি যে সরাসরি আমার দিকে তাকাচ্ছে না, সেটা আমার নজর এড়ায়নি। সম্ভবত তারও চোখে জল এসে গিয়েছিল। আসাই স্বাভাবিক। এই যে এতদিন বাদে আমি ওদের সামনে এসে হাজির হয়েছি, এ তো হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষেরই আবার ফিরে আসার ব্যাপার। এমন মানুষ, তেতাল্লিশ বছর আগে যে কিনা ওদের ঘরের মানুষ ছিল। সত্যিই তা-ই। আমি যে বাইরের লোক, বিষাণগড়ে তা তো ওরা আমাকে কখনও বুঝতেও দেয়নি। গঙ্গাধর মিশ্রকে প্রথম-প্রথম আমি ‘মিশ্রজি’ বলতুম। বয়সে তিনি আমার বাবার চেয়ে কিছু বড়। ভারী স্নেহ করতেন আমাকে। মাত্রই কিছুদিন আগে তাঁর ছেলেকে তিনি হারিয়েছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে সেই হারনো-ছেলেকেই যে তিনি দেখতে পেতেন, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর স্নেহের সেটাই মস্ত কারণ। আমি যে সেটা জানতুম না, তাও তো নয়। তাই ‘মিশ্রজি’ বলে সম্বোধন করতে একটু সংকোচই হত আমার। ফলে, দিন কয়েক বাদেই তাঁকে আমি ‘তাউজি’ বলতে শুরু করি। প্রথম যেদিন তাঁকে ‘তাউজি’ বলি, প্রসন্ন হাসিতে বৃদ্ধের মুখখানা যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, আজ এতদিন বাদেও তা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। 

লছমি যে মুখ নিচু করে বসে আছে, কিছু বলছে না, তার একটা কারণ হয়তো সংকোচ। সেটা কাটিয়ে দেবার জন্যে বললুম, “কী লছমি, বিষাণগড়ের সেই দিনগুলির কথা কি ভুলে গেছ? আমি যে তোমাকে নিয়ে রোজ বিকেলে সসোতিয়ার ধারে বেড়াতে যেতুম, রোজ তোমাকে গল্প শোনাতুম, খাইয়ে দিতুম, এমনকি মাঝে-মাঝে ঘুম পাড়িয়েও দিতে হত, সে-সব কিছু তোমার মনে নেই?” 

শুনে সবাই হেসে উঠল। এক যমুনা দেবী ছাড়া। সরস্বতী বলল, “সত্যি নাকি মা?”

মেয়ের কথার কোনও উত্তর দিল না লছমি। যেন কথাটা ও শুনতেই পায়নি। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটা নালিশ আছে, চাচাজি।” 

“তোমার কথা না শুনে চলে এসেছিলুম, তাই নিয়ে নালিশ তো?”

“তা নিয়ে নয়।” এতক্ষণে হাসি ফুটল লছমির মুখে। বলল, “আগে তো আপনি আমাকে ‘তুই’ বলতেন, এখন তা হলে ‘তুমি’ বলছেন কেন?”

“এই ব্যাপার।” এবারে আমিও হোহো করে হেসে উঠলুম। তারপর বললুম, “কিন্তু লছমি, তুই-ই বা তা হলে তোর চাচাজিকে কেন ‘আপনি’ বলছিস? আগে তো দিব্যি ‘তুমি’ বলতি।” 

কাজের মেয়েটি চা দিয়ে গেল। সেইসঙ্গে মস্ত একটা রেকাবিতে স্লাইস-করা প্রচুর কেক আর মিষ্টি। মিষ্টির দিকে এক পলক তাকিয়েই বললুম, “দিদির দেখছি সবই মনে আছে। কিছুই ভুলে যাননি।” 

যমুনা দেবী বললেন, “আর বোলো না ভাইয়া। এদের ধারণা, আমি বুড়ো হয়ে গেছি, তাই কটোটি পর্যন্ত নাড়তে দেয় না। তো কাল ভাদুড়ি-দাদা ফোন করে বললেন, সম্ভবত তুমিও দিল্লিতে আসছ, যদি আসো তো আজ তোমাকে নিয়ে এখানে আসবেন। তার পরে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকি কী করে? মনে পড়ল যে, তুমি ঠেকুয়া খেতে ভালবাসো, তাই তক্ষুনি তোমার জন্যে ঠেকুয়া বানাতে বসে গেলাম। ওগুলো সবই তোমার জন্যে। এরা সব একালের ছেলেমেয়েরা এ-সব মিষ্টি পছন্দ করে না।” 

লছমি বলল, “আমি তো আর একেলে নই, মাথার চুলে পাক ধরতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু মা, ঠেকুয়া আমিও পছন্দ করি না। আমি রসগুল্লা ভালবাসি, চাচাজি তাই দু-টিন রল্লা নিয়ে এসেছে।” 

“বেশ, তা হলে তোরা তা-ই খা, এ-মিষ্টি পাবি না। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমিও না?” 

যমুনা দেবী হেসে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি হয়তো এক-আধটা পাবেন, তাও ভাইয়া যদি দেয়।” 

সুমঙ্গল বলল, “কী পার্শিয়ালিটি রে বাবা, আমি নাতজামাই, আর আমিই বাদ?” 

“ঠিক আছে, তোমাকেও এক-আধটা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লছমিও পাবে না, সরস্বতীও পাবে না। ওরা তো আমার রান্নাঘরে ঢোকা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।” 

লছমি বলল, “সাধে কি আর বন্ধ করেছি মা। সারাটা জীবনই তো সকলের জন্যে খেটে মরলে, এখন একটু বিশ্রাম নাও।”

কী যে ভাল লাগছিল, সে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। এ যেন এক পারিবারিক পুনর্মিলনের ব্যাপার। যেন বিষাণগড়ের সেই দিনগুলিতেই আবার আমরা ফিরে গিয়েছি। তফাত শুধু এই যে, আমাদের প্রত্যেকেরই বয়স তখন তেতাল্লিশ বছর কম। আর হ্যাঁ, সরস্বতী সুমঙ্গলের তখনও জন্মই হয়নি। মিশ্রজি, তাঁর স্ত্রী, আমি, দিদি আর ল্ঽমি যে তখন পরস্পরের জীবনের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলুম, আর মাঝে-মাঝে যখন ভাদুড়িমশাইকে নিয়ে ওদের কোয়ার্টার্সে গিয়ে হানা দিতুম, তখন তিনিও যে কীভাবে বাঁধা পড়ে যেতেন সেই একই ভালবাসার জালে, তা বোধহয় ওরা কল্পনাও করতে পারবে না। 

আমরা গল্প করছিলুম, ওরা শুনছিল। সবই বিষাণগড়ের গল্প। রাজবাড়ির গল্প, রানি আর রাজকুমারদের গল্প, শহরে যাঁরা আমাদের পরিচিত ছিলেন তাঁদের গল্প, নদীতে ঢল নামবার গল্প, পাহাড় থেকে একটা হাতি একবার শহরে এসে ঢুকে পড়েছিল, সেই গল্প, জঙ্গলে পিকনিক করতে গিয়ে কীভাবে আমরা একবার পথ হারিয়ে ফেলেছিলুম তার গল্প। ভুলভাল হিন্দি বলতুম আর তার ফলে যে মাঝে-মাঝে কীরকম বিপদে পড়তে হত আমাকে, দিদির মুখে সেই গল্প শুনে তো সবাই হেসেই কুটিপাটি। মনে হচ্ছিল, টানা তিনদিন ধরে যদি এখন বিষাণগড়ের গল্প চলে, তাও বোধহয় আমাদের গল্পের স্টক ফুরিয়ে যাবে না। 

গল্প যে আরও কতক্ষণ চলত কে জানে, কিন্তু সরস্বতী ইতিমধ্যে তার জায়গা থেকে উঠে গিয়েছিল, রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে সে বলল, “ডিনার রেডি। সুমঙ্গল, তুমি বড়দা আর ভাইয়াকে সাবান আর তোয়ালে এগিয়ে দাও, ওঁরা হাতমুখ ধুয়ে নিন, তারপর ওঁদের নিয়ে খেতে বসে যাওঁ।”

আজকাল যা হয় আর কি, মস্ত বড় লাউঞ্জটাকেই মাঝখানে একটা কাজ করা কাঠের পার্টিশান বসিয়ে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একদিকে বসবার জায়গা, অন্যদিকে ডাইনিং স্পেস। গল্প করতে-করতেই বাসনকোশনের আওয়াজ পাচ্ছিলুম, এবারে পার্টিশানের ওদিককার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলুম যে, এর পরে আর বসে থাকা চলবে না, ডাইনিং টেবিলে খাবার-দাবার এসে গেছে। সুমঙ্গলের কোলে তার বাচ্চা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে শুইয়ে রেখে এসে সুমঙ্গল বলল, “চলুন, হাতমুখ ধুয়ে বসে পড়া যাক।”

টেবিলে মাত্র চারটে প্লেট দেখে বললুম, “কী ব্যাপার, দুজন কী পরে খাবে নাকি? সবাই একসঙ্গে বসে পড়লেই তো হত।” 

যমুনা দেবী বললেন, “তোমার মনে নেই, ভাইয়া, রাত্তিরে আমি খাই না। লছমি অবশ্য দুধ-খই খায়, তাও ও আজ খাবে না, আজ একাদশী। তোমরা খেতে বসে যাও।” 

খাওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে গল্প চলতে লাগল। শুনলুম, আমরা চলে আসবার পরে গঙ্গাধর মিশ্র আর মাত্র বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। শরীর ক্রমেই ভেঙে পড়ছিল। শেষের দিকে খুব জ্বর হত, আর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন নাকি কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারতেন না। শুধু অস্ফুট গলায় দু’জনের নাম করতেন। 

বললুম, “কার?” 

লছমির চোখে আবার জল এসে গিয়েছিল। মুখ নিচু করে আঁচলের খুঁটে জল মুছে নিয়ে বলল, “বাবুজির আর তোমার। শুধু বিড়বিড় করে বলতেন, একটা ছেলেকে কেড়ে নিয়ে ভগবান যদি আর-একটাকে পাঠিয়ে দিলেন, তো সেটাও কেন চলে গেল? চাচাজি, অমন হঠাৎ তুমি বিষাণগড় থেকে চলে গেলে কেন?” 

“তাও জানিস না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, তোর মা তোকে পরে কিছু বলেননি?”

“কই না তো?” 

যমুনা দেবী বললেন, “প্রায়ই ভাবতুম, বলে দিই; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হত, থাক, কাজ নেই, এখন ওর বয়েস কম, ভুল বুঝবে, তাই বলি-বলি করেও বলা হত না। তারপরে তো শ্বশুরমশাই মারা গেলেন। মারা যাবার কিছুদিন আগে এই বিষাণগড়েই একটা ছোটমতন বাড়ি তৈরি করিয়ে রেখে যান, আমরা সেখানে উঠে আসি। তো লছমির ঠাকুমাও তার পরে আর খুব বেশিদিন বাঁচেননি। লছমির বয়েস তখন আর কত হবে, এই ধরুন এগারো-বারো। তো শাশুড়ি-ঠাকরুন বেঁচে থাকতে তাও যা হোক একটা ভরসা ছিল, তিনি মারা যাবার পরে আর মেয়েকে নিয়ে ওখানে থাকবার সাহস হল না, বাড়িতে তালা লাগিয়ে মেয়েকে নিয়ে দিল্লিতে আমার বাপের বাড়িতে চলে এলুম। তারপরে তো ব্যাপারটা আমি ভুলেই যাই, ভাইয়াকে যে কেন বিষাণগড় ছাড়তে হয়েছিল, তা আর ওকে আজ পর্যন্ত বলাই হয়নি।” 

ভাদুড়িমশাই লছমির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কারণটা তা হলে আমার কাছেই শোন্। তোর চাচাজিকে একটা খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।” 

আঁতকে উঠে লছমি বলল, “সে কী! … যাঃ যত্ত সব বাজে কথা! বিলকুল ঝুট!” 

“না রে, বাবা, বাজে কথা নয়। শিউশরণ ত্রিপাঠীর নোকর হরদেওয়ের খুনের তো কোনও কিনারা হল না। তারপর মার্চ, এপ্রিল, আর মে মাসটা মোটামুটি ভালয় ভালয় কাটল। কিন্তু জুনের শেষ হপ্তায়… তারিখটা এখনও আমার মনে আছে, আঠাশে জুন …. যা ঘটল, সে এক বীভৎস ঘটনা! সেও ভোরবেলাকার ব্যাপার। তা সর্সোতিয়ার ধারে যাঁরা মর্নিং ওয়াক করে, আমি তো তাদেরই একজন, আমারই চোখে পড়ল যে, ঠিক ওই নদীর ধারের ঢালু ঘাসজমির উপরে তিন-তিনটে লাশ পড়ে আছে। তিনজনেই ট্রাইবাল। তবে হ্যাঁ, এটা মাথা ফাটিয়ে মারবার ব্যাপার নয়, তিনজনকেই গুলি করে মারা হয়েছে।” 

সুমঙ্গল বলল, “বলেন কী?” 

যমুনা দেবী বললেন, “ভাদুড়িদাদা যা বলছেন, ঠিক বলছেন। বাধা দিও না, শুনে যাও।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিষাণগড় তো বড় শহর নয়, ছোট জায়গা। একটা খুন হলেই সেখানে শহরশুদ্ধ লেকের পিলে চমকে যায়, আর এ তো ট্রিপ্ল মার্ডারের ঘটনা, বিষাণগড়ে একেবারে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। সন্ধে নাগাদই বাড়িতে-বাড়িতে খিল পড়ে যেতে লাগল, দোকানপাট তো বিকেলের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়, পথঘাট একেবারে খাঁখাঁ।” 

সরস্বতী বলল, “পুলিশ কী করছিল?” 

“কী আর করবে, এ-সব ব্যাপারে যা তারা করে থাকে, তা-ই করছিল। অর্থাৎ চোর পালাবার পরে আস্তাবলে তালা লাগাচ্ছিল।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “তারা এল, লাশ পরীক্ষা করল, তারপর খুব বিজ্ঞের মতন বলল যে, তিন-তিনবার গুলি চালানো সত্ত্বেও কেউ যখন কোনও শব্দ শুনতে পায়নি, তখন রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো ছিল নিশ্চয়। আর হ্যাঁ, এই আশ্বাসটাও তাদের কাছে পাওয়া গেল যে, এর পরে পাহারা আরও জোরদার হবে, সুতরাং কারও ভয় পাবার কিছু নেই।”

“আর তারপরেই গোটা ব্যাপারটার উপরে ধামা চাপা পড়ল!” আমি বললুম, “সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো, পাহাড় থেকে পারতপক্ষে যারা শহরে আসে না, হঠাৎ তাদের তিনজন যে কেন রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বিষাণগড় শহরে এসে ঢুকেছিল, এই প্রশ্নটা কেউই তুলল না।” 

“আপনিই বা আগ বাড়িয়ে অমন প্রশ্ন তুলতে গেলেন কেন?” ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছিল বুঝি?” 

লজ্জিত গলায় বললুম, “কৌতূহল, স্রেফ কৌতূহল।” 

“অ্যান্ড দিস্ কিউরিয়সিটি কিল্ড দ্য ক্যাট। ওয়েল, অলমোস্ট।” ভাদুড়িমশাই হাসতে-হাসতে বললেন, “প্রায় মারাই তো পড়তে বসেছিলেন। তাই না?” 

বললুম, “তা বটে।” 

“পুলিশ দেখল, এ বড় গোলমেলে লোক। এ-লোককে যদি এক্ষুনি না সমঝে দেওয়া হয় তো পরে হয়তো আরও গোলমেলে সব প্রশ্ন তুলবে। তারা সুযোগের অপেক্ষায় রইল, আর সেটা এসেও গেল খুব তাড়াতাড়ি। …কী কিরণবাবু, সুরজপ্রসাদ আগরওয়াল কবে মারা গিয়েছিল?’ 

ম্লান হেসে বললুম, “ওই ট্রিপ্ল-মার্ডারের এক হপ্তার মধ্যে। দোসরা জুলাই।” 

“কারেক্ট। তো শুধু ওইটুকু বললেই তো হবে না। ট্র্যাপটা কীভাবে পাতা হয়েছিল, সেটাও ওদের জানিয়ে দিন।” 

“আর বলবেন না। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট মুরারিকে একটা কাজে মার্কেট রোডে পাঠিয়েছিলুম। বিকেল চারটে নাগাদ দফতরে ফিরে এসে সে জানাল যে, মার্কেট রোডে সুরজপ্রসাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল তো আমার সঙ্গে তাঁর কী একটা জরুরি কথা আছে, আমি যদি আজ একবার মার্কেট রোডে তাঁর গয়নার দোকানে যাই তো বড় ভাল হয়। তা বিষাণগড়ের দোকানপাট তখন তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি দেখলুম, গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভাল। এক কন্ট্রাক্টর তার ক’দিন আগে কিছু বিল্ডিং মেটেরিয়ালের দামের একটা কোটেশন দিয়েছিল, বাজারে গিয়ে সেটাও যাচাই করে দেখা যাবে। চটপট বেরিয়ে তাই পাঁচটার মধ্যেই সুরজপ্রসাদের দোকানে পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি, দোকান বন্ধ করে ভদ্রলোক তখন কোলসিবল গেটে তালা লাগাচ্ছেন।” 

সরস্বতী বলল, “লোকটিকে আপনি আগে থেকেই চিনতেন?” 

“চিনি বই কী। বিষাণগড়ে যেদিন প্রথম আসি, সেদিনই ট্রেনে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়। ভদ্রলোকের যেমন মার্কেট রোডে ওই গয়নার দোকান ছিল, তেমনি ছিল কাঠের কারবার। গয়নার দোকানের দায়িত্ব ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে ইদানীং কাঠের কারবারটাই দেখছিল। সেই সূত্রে প্রায়ই জঙ্গলে-জঙ্গলে যেতে হত। তবে ইদানীং কিছুদিন ধরে যাচ্ছিলেন না। বিষাণগড়ে ওঁর একটা করাত-কলও আছে, ছেলেকে সেখানে বসিয়ে উনি তাই আবার গয়নার দোকানে বসতে শুরু করেছিলেন। মাঝে-মাঝে বিকেলের দিকে সেখানে যেতুম। আমাকে চা না-খাইয়ে ছাড়তেন না, লছমির জন্যেও পাশের দোকান থেকে লাড্ডু আনিয়ে দিতেন। কী রে লছমি তোর মনে নেই?” 

মৃদু গলায় লছমি বলল, “আছে চাচাজি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তো আপনাকে দেখে কী বললেন সেদিন সুরজপ্রসাদ আগরওয়াল?”

“আমাকে দেখে ফের দোকান খুললেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজবও হল। তার আগেই অবশ্য তিনি জানিয়েছিলেন যে, বাজারে একবার মুরারির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল ঠিকই, তবে তার সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি।” 

“কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবার পরে সুরজপ্রসাদও কি আপনার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন?” 

“না। বললেন যে, আবার যখন দোকান খুলেছেন, তখন আরও দু-একটা কাজ সেরে তারপর বাড়ি ফিরবেন।” 

ভাদুড়িমশাই লছমির দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনলে তো? এখন আমার কাছে শোনো, তারপরে কী হল। কিরণবাবু তো দোকান থেকে সওয়া পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে এলেন, আর পৌনে ছ’টা নাগাদ একটা লোক ছুটতে ছুটতে গিয়ে কাছেই পুলিশ-চৌকিতে এই খবর পৌঁছে দিল যে, আগরওয়ালজি তাঁর দোকানের মধ্যেই খুন হয়েছেন, কেউ কিছু দিয়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।…তো সুমঙ্গল, তুমি বলো তো, খুনের ব্যাপারে পুলিশের সন্দেহ সাধারণত কার-কার উপরে পড়ে?” 

সুমঙ্গল হেসে বলল, “এ তো অতি সহজ প্রশ্ন। পুলিশ প্রথমেই খোঁজ নেবে যে, খুনটা হয়ে যাওয়ায় কার লাভ হল, আর খুন করবার সবচেয়ে সহজ সুযোগটাই বা ছিল কার।” 

“আর?” 

“আমাকে ঠকাতে পারবেন না বড়দা।” সুমঙ্গল বলল, “আমি গোয়েন্দা গল্পের পোকা। পুলি। আরও খোঁজ নেবে যে, লোকটাকে মৃত অবস্থায় প্রথম দেখেছিল কে, আর জীবন্ত অবস্থাতেই বা কে তাকে শেষ দেখেছিল।” 

“শাবাশ।” ভাদুড়িমশাই এবারে লছমির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তো তোর চাচাজিই তো স্বজপ্রসাদকে জীবন্ত অবস্থায় শেষ দেখেছিলেন। সন্দেহের কাঁটাটাকে ওঁর দিকে ঘুরিয়ে দিতে তাই নেটিভ স্টেটের পুলিশের কিছুমাত্র অসুবিধে হল না। আসলে তারা এই রকমের একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই বসে ছিল তো। সুরজপ্রসাদকে যাদের দিয়ে খুন করানো হয়েছিল, দোকান থেকে বেশ কিছু গয়নাও সরিয়ে ফেলেছিল তারা। ফলে একটা মোটিভও দাঁড় করানো গেল। তার উপরে আবার মুরারিও অম্লানবদনে বলে বসল যে, সুরজপ্রসাদ যে কিরণবাবুকে তাঁর দোকানে গিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন, সে নাকি তোর চাচাজিকে এমন কোনও কথাই কখনও বলেনি। অর্থাৎ একেবারে চমৎকার ফ্রেম-আপ।” 

লছমি বলল, “তারপর?” 

“তারপর আর কী,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দু’চারদিন জেরার পরেই তোর চাচাজির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। তবে কিনা তা যে হবে, তাঁর এই বন্ধুটির কাছ থেকে তোর চাচাজি সে-কথা আগেই জেনে গিয়েচিলেন। যেদিন জেনেছিলেন, সেইদিনই তিনি আমার কাছে ছুটে আসেন, আর আমিও আমার জিপে করে সেই রাত্তিরেই তোর চাচাজিকে বিষাণগড় থেকে রায়পুরে পৌঁছে দিই। নইলে আর ওঁকে বাঁচতে হত না। তা এখন বুঝলি তো, হঠাৎ একদিন কিরণবাবু কেন বিষাণগড় থেকে চলে গিয়েছিলেন। … কিন্তু না, আর নয়, দশটা প্রায় বাজে। এবারে উঠব।” 

১৪ 

সরস্বতী বলল, “উঠতে দিলে তো উঠবেন। না বড়দা, আজ আর আপনাদের ছাড়ছি না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বলিস কী, যাঁর বাড়িতে উঠেছি, তিনি তো ভীষণ চিন্তা করবেন।”

“একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি এসে পৌঁছবার খানিক বাদেই তাঁকে ফোন করে আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, রাত্তিরটা আপনি এখানেই থাকছেন।” 

বললুম, “কিন্তু আমার কী হবে?” 

“আপনি তো হোটেলে উঠেছেন। ঘরের চাবিও রিসেপশানে জমা দিয়ে এসেছেন নিশ্চয়। তা হলে ফোন না-করলেও ক্ষতি নেই। ওরা ঠিকই বুঝবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তোদের অসুবিধে হবে না তো?” 

“কিচ্ছু না।” সরস্বতী হেসে বলল, “আপনাদের নাতজামাইয়ের এই ফ্ল্যাটটা কি খুব ছোট নাকি? তিন-তিনটে বেডরুম। তার একটা তো খালিই পড়ে থাকে।” 

খাওয়ার পাট চুকে গিয়েছিল। আমরা আবার ড্রয়িংরুমে এসে যে-যার জায়গায় বসে পড়েছি। সুমঙ্গল বলল, “আমার কাছে ভাল জেসমিন-টি আছে, কেউ খাবেন তো বলুন।” 

দিদি বললেন, “আমি খাব না।” 

লছমি বলল, “আমিও না। তবে তোমরা খাও। আমি আর মা অবশ্য এখুনি উঠব না, বসে-বসে তোমাদের গল্প শুনব। চাচাজি, তুমি আরও ক’টা দিন এখন দিল্লিতে আছ তো?” 

বললুম, “না রে, লছমি, কালই ইভনিং ফ্লাইটে আমাকে ফিরতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমিও কালই ফিরছি। তবে সরাসরি ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছি না। কলকাতায় আবার একটা কাজ পড়ে গেছে।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “কিরণবাবু, আমারও কাল ইনিং ফ্লাইট।” 

বললুম, “বাঃ, তা হলে তো এক সঙ্গেই ফিরছি।” 

“মাঝে-মাঝে তো দিল্লি আসতে হয়। তা তোদের বাড়িটা তো দেখেই গেলুম। যখনই আসি, দেখা হবে।” 

চা এসে গিয়েছিল। হাল্কা চা, তাতে জুঁইয়ের গন্ধ ভুরভুর করছে। ভাদুড়িমশাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “তারপর সরস্বতী, তোর চাকরির খবর কী?” 

সরস্বতী বলল, “চাকরির আবার নতুন খবর কী হবে? যেমন পড়াচ্ছিলুম, তেমন পড়িয়ে যাচ্ছি। আপনি সেই রিপোর্টের কথা ভাবছেন তো? মানে ওই যে রিপোর্টে আমার সম্পর্কে কয়েকটা খারাপ কথা বলা হয়েছিল, তাতেই বোধহয় আপনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভয় তো পাবারই কথা। তা ওতে তোর কোনও ক্ষতি হয়নি তো?” 

সুমঙ্গল বলল, “কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। আসলে গোটা ব্যাপারটাই এখন ধামাচাপা পড়ে গেছে। দেশে একটা মস্ত পালাবদল হয়ে গেল তো, দিল্লিতে এখন কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট, ও-সব ব্যাপার নিয়ে কেউ আর এখন মাথা ঘামাচ্ছে না।” 

সরস্বতী বলল, “কিন্তু অন্য দিকে ছোট্ট একটা ঝামেলা বেধেছে বড়দা। সেই যে ভুপিন্দর সিং বলে একটা ছেলের কথা বলেছিলুম না, মনে আছে আপনাদের?” 

নামটা চেনা-চেনা লাগছিল, কিন্তু কোন্ প্রসঙ্গে কার কাছে এই নামটা শুনেছিলুম মনে করতে পারলুম না। 

ভাদুড়িমশাই দেখলুম ঠিকই মনে রেখেছেন। বললেন, “মানে সেই ছেলেটার কথা বলছিস, যাকে নিয়ে তুই বিষাণগড়ের জঙ্গলে সোনার খোঁজে গিয়েছিলি?” 

সরস্বতী বলল, “হ্যাঁ, বড়দা। পাহাড়ে গিয়ে মাত্র দিনকয়েক ঘোরাঘুরি করার পরেই তার খুব জ্বর হয়। তখন জনাকয় ট্রাইবালকে সঙ্গে দিয়ে তাকে শহরে পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল। তা ভুপিন্দার এই দিল্লি ইউনিভার্সিটিতেই পড়ত। আমার ছাত্র।” 

“তাকে নিয়ে আবার কী ঝামেলা হল?” 

“আর বলবেন না বড়দা। শত হলেও ছাত্র তো, তাই কিছু বলতে বড় সংকোচ হয়। কিন্তু না-বলেও পারছি না। ছেলেটা বড্ড গণ্ডগোল করছে।” 

“কী রকম গণ্ডগোল?”

“তা হলে শুনুন। জ্বর সেরে যাবার পরে ছেলেটা আর জঙ্গলে যায়নি, সরাসরি দিল্লিতে ফিরে আসে। তারপর এম. এসসি. পাশ করে এখানে একটা আন্ডারগ্রাজুয়েট কলেজে লেকচারারের চাকরিও পেয়ে গেছে। তো দিল্লিতে সেই যে জিওলজিস্টদের কনফারেন্স হয়, তাতে সে একদিনও যায়নি বটে, তবে সেখানে আমি যা বলেছিলুম, কাগজগুলোর কল্যাণে তার তা জানতে কিছু বাকি নেই।” 

ভাদুড়িমশাই সরস্বতীকে বাধা দিয়ে বললেন, “তা তো এখন দেশসুদ্ধু সবাই জানে, তা হলে তোর এই ছাত্রটিই বা তা জানবে না কেন? কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।” 

সুমঙ্গল বলল, “কী ভাবছেন আপনি?” 

“সরস্বতী যে-কটা লোকেশানের কথা সরাসরি কর্তাদের বলেছিল, সেখানে খোঁজ চালিয়ে যে সোনার হদিশ মেলেনি, সেটাও সে জানে তো?” 

সরস্বতী বল, “তাও জানে, বড়দা। এমনকি, রিপোর্টে যে আমাকে নিন্দেমন্দ করা হয়েছে, তাও জানে।” 

“তবে তো মিটেই গেল। তা হলে আর গণ্ডগোল কীসের?” 

“কীসের গণ্ডগোল, সবটা না শুনলে তা আপনি বুঝতে পারবেন না।” এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সরস্বতী, পট থেকে নিজের পেয়ালায় ফের চা ঢেলে নিল, তারপর একটা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বলল, “দিন পনেরো আগে ভুপিন্দার আমার কাছে এসেছিল। এসে কী বলল জানেন? বলল যে, সরকারকে আমি যদি ভুলভাল লোকেশানের কথা না বলতুম, তা হলে নিশ্চয় সোনার হদিশ মিলত, আর রিপোর্টেও তা হলে আমার সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা থাকত না।” 

“তাতে তুই কী বললি?” 

“আমি তে। হতভম্ব। প্রথমে তো বুঝতেই পারলুম না যে, এমন কথা বলবার মতো সাহস এর হয় কী করে! অনেক কষ্টে রাগ সামলে নিয়ে বললুম, তুমি তো বলতে গেলে আমার সঙ্গে ছিলেই না, জ্বরে পড়েছিলে বলে প্রথম দু’চারদিনের পরেই তোমাকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, তারপরে আমি কোথায়-কোথায় কাজ করেছি, তা তো তোমার জানবার কথা নয়, তা হলে তোমার এমন সন্দেহ হল কেন যে, আমি ভুলভাল কয়েকটা লোকেশানের কথা ওদের বলেছি? না ভুপিন্দার, যেখানে সোনা পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয়েছিল, সেই জায়গার কথাই আমি বলেছিলম। সোনা যে পাওয়া যায়নি, তাতে বুঝতে হবে যে, যা আমার মনে হয়েছিল, তা নির্ভুল নয়। সেটা নিশ্চয় জিওলজিস্ট হিসেবে আমার পক্ষে খুবই লজ্জার কথা। কিন্তু তাই বলে তুমি এমন ভাবছ কেন যে, সরকারি টিমটাকে আমি ইচ্ছে করে ভুল জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলুম?” 

ভাদুড়িমশাইও পট থেকে আবার নতুন করে তাঁর পেয়ালায় চা ঢাললেন। তারপর মুখ না তুলেই বললেন, “কথাটা তোর ছাত্র বিশ্বাস করল?” 

“মোটেই না। বিশ্বাস তো করলই না, বরং একটা মারাত্মক কথা বলে বসল। বলল যে, ম্যাডাম, আপনি তো আমাকে নিয়ে বিষাণগড় শহর থেকে মাইল কুড়ি দক্ষিণের এক জঙ্গলে এলাকায় গিয়ে ঢুকেছিলেন, কিন্তু সরকারি কর্তাদের যে লোকেশানের কথা বলেছেন, তার একটাও বিষাণগড়ের দক্ষিণে নয়, আর সেইজন্যেই আমার মনে হচ্ছে যে, ওদের আপনি সত্যি কথা বলেননি।” 

“ভুপিন্দার আর-কিছু বলল?” 

“বলল বই কী। জনাকয় ট্রাইবালকে সঙ্গে দিয়ে তো আমি ওকে শহরে ফেরত পাঠিয়েছিলুম, তা তাদেরই একজন নাকি ওর হাতের সোনার আংটিটা দেখিয়ে বলেছিল যে, জঙ্গলে এইরকম রঙের পাথর পাওয়া যায়। তো ভূপিন্দার বলল, আমিও নাকি প্রথম দু-একদিন ওখানে কাজ করেই ওকে বলেছিলাম যে, সম্ভবত আমরা জায়গা বাছতে ভুল করিনি।” 

“তা সে এখন কী চায়?” 

“ওখানে যেতে চায়। কিন্তু একা যাবে না। ধরে পড়েছে যে, আমাকে ওর সঙ্গে যেতে হবে।”

“তোর কী ইচ্ছে? যাবি?” 

সরস্বতী হাসল। “যেতুম বড়দা, কিন্তু কার কী মতলব, কথাবার্তার ধরন দেখে সেটা অন্তত খানিক পরিমাণে আঁচ করা যায় তো, তা তুপিন্দারের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হচ্ছে যে, ছেলেটার মতলব বিশেষ ভাল নয়। ও আমাকে লোভ দেখাচ্ছে।” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কী, বলছে যে, ওকে সঙ্গে নিয়ে সামনের মাসে আমি যদি সেই লোকেশানটায় যাই, আর লোক্যালি দশ-বারোজন মজুর জোগাড় করে ফের কাজ শুরু করি তো তার তাবৎ খরচা ও দিয়ে দেবে।” 

“সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।” 

“তা নিয়ে ওর ভাবনা নেই।” সরস্বতী বলল, “ভুপিন্দারের বাপ বড়লোক, তাই টাকাটা ও দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আমার মন এতে সায় দিচ্ছে না। কী জানি কেন মনে হচ্ছে যে, কোনও আবিষ্কারের নেশায় নয়, ও যেতে চাইছে সোনার লোভে। অথচ এই সহজ কথাটাই ওর জানা নেই যে, মাটির নীচে যা-কিছুই থাকে, তা সে এক-ঘড়া মোহরই হোক কি সোনার একটা আস্ত খনিই হোক, তার মালিকানা হচ্ছে রাষ্ট্রের। এই নিয়ে যে একটা আইন রয়েছে, আর সেই আইন ভাঙার শাস্তি যে মোটেই লঘু নয়, তা পর্যন্ত জানে না।” 

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ গম্ভীর মুখে সব শুনছিলেন, এবারে হেসে উঠলেন। বললেন, “জানবে না কেন, সবই হয়তো জানে। কিন্তু সোনার লোভ যাদের পেয়ে বসে, আইনের কথাটা জানলেই বা তারা মানবে কেন?” 

টেলিফোন বেজে উঠল। ফানটা শোবার ঘরে। সরস্বতী উঠে গিয়ে ফোন ধরল। ফিরে এল মিনিট তিন-চার বাদে। দেখলুম তার মুখচোখ থমথম করছে। লছমি বলল, “এত রাতে কে ফোন করেছিল রে?” 

সরস্বতী বলল, “ভুপিন্দার।” 

বললুম, “কী বলল?” 

সরস্বতী তখন-তখনই আমার কথার কোনও জবাব দিল না। একেবারে শূন্য চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। যেন আমার কথাটা সে শুনতেই পায়নি। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বড়দা, ছেলেটা শুধু লোভী নয়, পাজি। আমাকে … আমাকে ও এখন ভয় দেখাচ্ছে। কী বলছে জানেন? বলছে যে, ওর কথায় রাজি হয়ে আমি যদি সামনের মাসেই ওকে নিয়ে বিষাণগড়ে না যাই, তো সহজে ও আমাকে ছাড়বে না। বলছে, আমার যে একটা বাচ্চা-ছেলে রয়েছে, অন্তত তার কথাটা যেন আমি ভেবে দেখি। কায়দা করে বলল, থিংক অভ্ ইয়োর বেবি, ম্যাডাম, থিংক অভ হিজ হেল্থ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইঙ্গিতটা তো খুবই স্পষ্ট। তা তুই কী করবি? যাবি?” 

“যদি-বা যেতুম, এর পরে আর যাওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠছে না।”

লছমি যাও বা একটা-দুটো কথা বলছিল, দিদি এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি। এবারে তিনি বললেন, “কিন্তু ভাদুড়িদাদা, জানুয়ারি মাসের শেষদিকে তো আমাদের সবাইকে একবার বিষাণগড়ে যেতেই হচ্ছে। তখন আপনাদেরও আসতে হবে। না-এলে ছাড়ছি না।” 

বললুম, “কী ব্যাপার?” 

দিদি বললেন, “চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর ধরে একটা কাজ ফেলে রেখেছি, কিন্তু এবারে সেটা না করলেই নয়। কবে মরে যাব, তার ঠিক কী! কাজটা না-করেই যদি মরি, তো পরলোকে গিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।” 

লছমি বলল, “কী হয়েছে বলি। বাবুজি তো মাঝে-মাঝেই জঙ্গলে চলে যেতেন। শেষবার যখন জঙ্গল’ থেকে ফিরে আসেন, তখন কষ্টিপাথরের একটা শিবলিঙ্গ সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তার দিন দুই-তিন পরেই তিনি মারা যান। দাদু ঠিক করেছিলেন, বিষাণগড়ে যখন আমাদের নিজেদের বাড়ি হবে, তখন সেই বাড়ির চত্বরে ছোটমতন একটা মন্দির বানিয়ে তাতে ওই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করবেন। তো তার সময় তিনি আর পেলেন কোথায়? বাড়ির কাজ শেষ হতে-না-হতেই তিনিও মারা গেলেন। তার কিছুদিন বাদে মারা গেলেন আমার দাদিও। আমরাও তারপর দিল্লিতে চলে এলুম। ফলে শিবলিঙ্গ আর প্রতিষ্ঠা করাই হল না, দাদুর ইচ্ছেটা অপূর্ণ থেকে গেল। তো মা এখন তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে চাইছেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেই শিবলিঙ্গ এখন কোথায়?” 

সরস্বতী বলল, “এখানে আমাদের কাছেই রয়েছে, শোবার ঘরের একটা কুলুঙ্গিতে রেখে দিয়েছি, তবে প্রতিষ্ঠা না-করে নাকি পুজো করতে নেই, তাই পুজো করা হয় না।” 

“এখানে প্রতিষ্ঠা করিসনি কেন?” 

“এটা তো ভাড়া-করা ফ্ল্যাট। কবে এখান থেকে উঠে যাব, তার ঠিক কী। নিজেদের বাড়ি হলে প্রতিষ্ঠা করা যেত, কিন্তু দিল্লিতে এখন জমির যা দাম, নিজেরা কখনও বাড়ি করতে পারব এমন ভরসা আর করি না।” 

“চল্ শিবলিঙ্গটা একবার দেখে আসি।” 

সরস্বতীর সঙ্গে তাদের শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলুম আমরা। কুচকুচে কালো পাথরের ছোট্ট একটি শিবালঙ্গ। হাইট সম্ভবত ইঞ্চি সাত-আটের বেশি হবে না। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একবার হাতে তুলে দেখতে পারি?” 

দিদি বললেন, “দেখুন না। এখনও তো প্রতিষ্ঠা করা হয়নি, যত খুশি ছুঁয়ে দেখুন।” 

ভাদুড়িমশাই কুলুঙ্গি থেকে শিবলিঙ্গটিকে তুলে নিয়ে ভাল করে সেটিকে দেখলেন। তারপরে যথাস্থানে আবার সেটিকে বসিয়ে রেখে বললেন, “একটুও খুঁত নেই। এমন নিখুঁত শিবলিঙ্গ বড় একটা দেখাই যায় না।…কিন্তু আর না সরস্বতী, অনেক রাত হল, এবারে আমরা শুয়ে পড়ব।” 

গেস্টরুমে পাশাপাশি দুটো সিঙ্গল খাট। শুনে পড়তেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল, হঠাৎ ভাদুড়িমশাইয়ের কথায় আমার চট্‌কা ভেঙে গেল ‘ও কিরণবাবু, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?” 

এই অবস্থায় সবাই যা বলে আমিও তা-ই বললুম। “না না, ঘুমিয়ে পড়ব কেন, এই একটু চিন্তা করছিলুম আর কি।” 

“দেখুন মশাই, আপনার নামে যে ওয়ারেন্ট অভ অ্যারেস্ট বেরিয়েছিল সেটা মিথ্যে কথা নয়। কিন্তু সেইজন্যেই যে ছেচল্লিশের জুলাই মাসে আপনি বিষাণগড় থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেটা মিথ্যে।” 

“ও হ্যাঁ, গ্রেফতারি পরোয়ানা তো প্রত্যাহার করা হরেছিল, ফলে মাঝখানে কলকাতায় এসেছিলুম বটে, কিন্তু পরে আবার ফিরেও যাই। বিষাণগড় থেকে পাকাপাকিভাবে আমি চলে আসি তার পরের বছর, সাতচল্লিশ সালে। তাই আপনার কথা শুনে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। তা আপনি তো সবই জানেন, তা হলে আপনি জেনেশুনে ও-কথা বলতে গেলেন কেন?” 

“অর্থাৎ, গ্রেফতারি পরোয়ানাটাকে আপনার চলে আসার কারণ হিসেবে দেখালুম কেন, এই তো?” 

“সত্যিই তো, কেন দেখালেন?” 

“এইজন্যে দেখালুম যে, আপনার বিষাণগড় ছাড়বার আসল কারণটা যে কী, তা আমি এখনও ওদের জানাতে চাইছি না। দেখছেন তো, সেখানে যেমন আপনাকে বাগে আনবার জন্যে একটা বাচ্চা-মেয়েকে খুন করা হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল, এখানেও তেমনি সরস্বতীকে বাগে আনবার জন্যে ওদের বাচ্চা-ছেলেকে ভুপিন্দার তার টার্গেট করে নিয়েছে। না কিরণবাবু, আপনারও এখন কিছু বলবার দরকার নেই, এমনকি বিষাণগড়ে যে তিন ট্রাইবাল খুন হয়েছিল, তাদের একজনের ঝুলির মধ্যে আমি কার ফোটোগ্রাফ পেয়েছিলুম, তাও এখন এদের বলবেন না। নাহক উত্তেজনা সৃষ্টি করে লাভ কী। বরং ভাবুন, একটা কথা একটু গভীরভাবে ভাবুন।” 

“কী ভাবব?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “বিষাণগড় আর দিল্লির মধ্যে কোথাও কোনও লিংক আছে কি না, সেইটে ভাবুন। যদি কোনও লিংক আছে বলে মনে হয় তো আমাকে জানাবেন।”