বিষাণগড়ের সোনা – ১

গেস্ট হাউসের দোতলার বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। নীচে ড্রাইভওয়ে, তার দু’পাশে লন। যে গেট দিয়ে এই বাড়িতে ঢুকতে হয়, সেটা খোলা। গেটের ওদিকে এই ছোট্ট শহরের সবচেয়ে চওড়া রাস্তা, প্যালেস রোড। রাস্তার এদিকে, এই গেস্ট হাউসেরই মতো, পরপর কয়েকটা বাগানওয়ালা বাড়ি। বাঁ দিকে ডক্টর সিদ্দিকির বাড়ির দোতলায় একটা ঘরে এতক্ষণ আলো জ্বলছিল, একটু আগে নিবেছে। ডাইনে যমুনাপ্রসাদ উপাধ্যায়ের বাংলো। বাড়িটা। সেই সন্ধে থেকেই অন্ধকার। 

প্যালেস রোডের ওদিকে একটাও বাড়ি নেই। গোটাকয়েক ঝুপড়ি দোকানঘর ছিল, সেগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাস্তার একটা দিক একদম ফাঁকা। শুধু সারি-সারি কিছু গাছ আর দূরে-দূরে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট প্যালেস রোডের দুই দিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এখন শুক্লপক্ষ, তাই ল্যাম্পপোস্টের মাথায় আলো জ্বলছে না। চাঁদ উঠেছে, কিন্তু আকাশটা মেঘলা, তাই জ্যোৎস্নার তেমন জোর নেই। 

মেঘটা অবশ্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে না, ঝোড়ো হাওয়ায় যেমন মুখের আঁচল সরে যায়, ঠিক তেমনই চাঁদের মুখের উপর থেকে মাঝে মাঝে সরে যাচ্ছে। যখন সরে যায়, ত্রয়োদশীর চাঁদটা তখন হঠাৎ একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জ্যোৎস্নার জোর বেড়ে যায় খানিকটা। তাতে রাস্তার ওদিকটা খানিক স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে। বোঝা যায়, রাস্তার ওদিককার খানিকটা জমি সমতল। তারপরেই জমি হঠাৎ ঢালু হয়ে নীচে নেমেছে। জমির শেষে একটা নদীর চিকচিকে জল আর নদীর পাড়ের ঝুপসি একটা গাছও তখন স্পষ্ট দেখা যায়। একটু নজর করে দেখলে এটাও তখন বোঝা যায় যে, গাছের নীচে, নদীর দিকে মুখ করে একটি মানুষ একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

মানুষটি যে ভাদুড়িমশাই, তা আমি জানি। ঘণ্টাখানেক আগে এই গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে তিনি সর্সোতিয়া নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি তাঁর সঙ্গে যেতে চেয়েছিলুম। তিনি নেননি। এমনকি, বারান্দায় এসে দাঁড়াতেও তিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ঘর থেকে আমার বার না-হওয়াই ভাল। যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসছেন, ততক্ষণ যেন আমি ঘরের মধ্যেই থাকি। তা আধঘণ্টার মতো তা আমি ছিলুমও। কিন্তু তারপরে আর বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারিনি। উদ্বেগ আর কৌতূহল এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, বুঝবার জন্যে বিছানা ছেড়ে পা টিপে-টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। 

তা এখানেও প্রায় আধঘণ্টা আমি দাঁড়িয়ে আছি। হাতঘড়ির রেডিয়াম-ডায়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত এখন একটা বাজতে পাঁচ। চারদিক একেবারে স্তব্ধ। শুধু গাছপালার ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ কোথাও নেই। চাঁদটা আবার মেঘের আঁচলে মুখ ঢেকেছে। তাই ভাল করে এখ.. আর কিছু ঠাহরও করা যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতেই একসময় মনে হল যে, ভাদুড়িমশাই যা-ই ভেবে থাকুন, আজ আর কিছু ঘটবে না। তা হলে আর এইভাবে রাত জেগে লাভ কী? এমনও একবার ভাবলুম যে, ঢের হয়েছে, আর নয়, এবারে নীচে নেমে যাই, রাস্তাটা পার হয়ে ভাদুড়িমশাই ক গিয়ে বলি, চলুন, এবারে গিয়ে শুয়ে পড়া যাক। 

ঠিক সেই মুহূর্তেই মেঘটা আবার সরে গেল। আর চোখ ফিরিয়ে নদীর দিকে তাকানো মাত্ৰ চমকে উঠলুম আমি। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, ঢালু জমি বেয়ে আর-একটা লোক দীর দিকে নেমে যাচ্ছে। ভাদুড়িমশাইকেও চোখে পড়ল। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনও ঠিক সেইভাবেই তিনি—একেবারে নিষ্প্রাণ একটা মূর্তির মতো—নদীর দিকে চোখ রেখে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনের লোকটিকে তিনি দেখতে পাননি। 

কালো আংরাখায় শরীর ঢাকা, লোকটি নিঃশব্দে নামছে। ভাদুড়িমশাই আর তার মধ্যে ব্যবধান যখন বড়জোর হাত দুয়েকের, তখন আর সে এগোল না। দাঁড়িয়ে গিয়ে আংরাখার ভিতর থেকে বার করল তার হাত। জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করে উঠল একটা ছোরার ফলা। 

একবার ভাবলুম, চেঁচিয়ে উঠি, ভাদুড়িমশাইকে সাবধান করে দিই। কিন্তু তার আর সময় পাওয়া গেল না। চেঁচিয়ে উঠবার আগেই বেজে উঠল কলিং বেল। ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা থেকে নেমে পায়ে চটি গলিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতেই বুঝতে পারলুম যে, গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে একেবারে জবজব করছে। 

দরজা খুলতেই হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার আর থার্মোফ্লাস্ক নিয়ে সদানন্দবাবু ভিতরে ঢুকলেন। বসবার ঘরের সেন্টার টেবিলের উপরে সে-দুটোকে নামিয়ে রাখতে-রাখতে বললেন, “ধন্যি মানুষ বটে আপনি, কতক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজাচ্ছি। অথচ আপনার ঘুমই ভাঙতে চায় না!” তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, “ওরেব্বাবা, ঘেমে যে একেবারে নেয়ে উঠেছেন দেখছি।” 

বললুম, “বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখছিলুম। ভাগ্যিস এসে পড়লেন, নইলে ভাদুড়িমশাইকে নির্ঘাত মারা পড়তে হত।” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কী, স্বপ্ন দেখছিলুম যে, পিছন থেকে একটা লোক ভাদুড়িমশাইকে ছোরা মারতে যাচ্ছে।” 

ব্যাপারটা যে বাস্তব নয়, একেবারেই অলীক, এতক্ষণে সেটা সদানন্দবাবু বুঝতে পারলেন। বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “ও, স্বপ্ন? তা-ই বলুন। আমি তো মশাই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলুম। …যান, আর দেরি করবেন না, মুখচোখ ধুয়ে এসে চা-জলখাবার খেয়ে নিন। আমি বরং ততক্ষণ আজকের কাগজটার উপরে চোখ বুলোই।” 

শ্যামনিবাসের সদানন্দবাবুকে আপনাদের না-চিনবার কথা নয়। ভদ্রলোক আমার প্রতিবেশী। বয়সে আমার চেয়ে সাত-আট বছরের বড়। কিন্তু চেহারা দেখে তা কারও বুঝবার জো নেই। সদানন্দবাবুর বয়স এখন তা প্রায় বাহাত্তর-তিয়াত্তর। কিন্তু এই বয়সেও শরীর-স্বাস্থ্য বেশ মজবুত রেখেছেন। থাকেন আমাদের উল্টোদিকের বাড়িতে। নিত্য আমার খোঁজখবর নেন। পরোপকারী, হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল মানুষ। 

সারাক্ষণ যাঁরা পরোপকার করবার জন্য ছটফট করেন, লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তাঁদের অনেকেই একটু গায়ে পড়ে উপদেশ দেন। তা যাঁকে উপদেশ দিচ্ছেন, তিনি সেটা পছন্দ করুন আর না-ই করুন। সদানন্দবাবুও এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তিনিও দেখেছি গায়ে-পড়ে উপদেশ দিতে ভালবাসেন। অনেকে তাতে বিরক্ত হয়। আমি হই না। 

কেন বিরক্ত হব? তাঁর তাবৎ উপদেশ মান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি ঠিকই, কিন্তু অন্তত একটা উপদেশ মান্য করে যে আমার উপকারই হয়েছে, সেটা তো আর অস্বীকার করতে পারি না। একে তো আমি গেঁটে-বাতের রুগি, মাঝে-মাঝেই আমার আঙুলের গাঁট ফুলে গিয়ে ব্যথায় যেন শরীর একেবারে ঝঝন্ করতে থাকে, তার উপরে আবার হাইপার অ্যাসিডিটিও আমাকে দারুণ ভোগাত। সদানন্দবাবু সে-কথা জানবামাত্র নিত্য আমাকে বলতে শুরু করেন, ‘সিগারেটটা ছাড়ুন মশাই; আর হ্যাঁ, ওই দুধ-চিনি দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাসটাও আপনাকে ছাড়তে হবে। নইলে মশাই ভগবানও আপনাকে বাঁচাতে পারবেন না।’ 

সিগারেটটা ছাড়তে পারিনি ঠিকই, তবে কমিয়েছি। দিনে আগে পঞ্চাশ-ষাটটা সিগারেট খেতুম, এখন চার-পাঁচটার বেশি খাই না। দুধ-চিনি মিশিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাসটা অবশ্য পুরোপুরি ছেড়েছি, এখন শুধুই হাল্কা লিকার খাই। তাতে যে উপকার পাচ্ছি, সেটা অস্বীকার করব কেন? বুক জ্বালা করে না, চোঁয়া ঢেকুর ওঠে না, অ্যাসিডিটি একেবারে পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে। 

সদানন্দবাবু বলেন, “গেঁটে-বাতও বিদায় নেবে। অম্বলকে যেমন বিদায় করেছেন, তেমন ওটাকেও এবার তাড়ান। কিন্তু হ্যাঁ, তার জন্যে আপনাকে মর্নিং ওয়াক ধরতে হবে। আমাকে দেখছেন তো, ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে তা ধরুন মাইল তিনেক হেঁটে আসি। তবে হ্যাঁ, রোদ্দুর উঠে গেলেই সর্বনাশ। আপনাকেও ঠিক আমারই মতো ভোর-পাঁচটায় বেরোতে হবে, তারপর অন্তত এক ঘণ্টা হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। দেখবেন, গেঁটে-বাতও তা হলে আর আপনাকে কাবু করতে পারবে না। কী মশাই, রাজি?” 

রাজি তো অবশ্যই। কিন্তু বহুকাল যে-লোকটা সূর্যোদয় দেখেনি, ভোর পাঁচটায় সে ঘুম থেকে উঠবে কীভাবে? খবরের কাগজে কাজ করি, সেখান থেকে বাড়ি ফিরতে-ফিরতেই তো রাত ন’টা-দশটা। তারপরে থাকে নিজের লেখাপড়ার কাজ, যে-বইটা প্রেসে রয়েছে তার প্রুফ দেখার কাজ, শুতে-শুতে তাই রাত তা প্রায় একটা বেজে যায়। তা হলে আর ভোর পাঁচটায় কী করে বিছানা ছাড়ি? পরপর ক’দিন চেষ্টা করেও যখন পারা গেল না, তখন একদিন সদানন্দবাবুকে বলেও ফেললুম যে, জীবনে তো অনেক ভাল কাজই করা হয়নি, তা এটাও আমার দ্বারা হবার নয়। 

সদানন্দবাবু তবু হাল ছাড়েননি। ভদ্রলোকের এক কথা, গেঁটেবাতের যন্ত্রণা থেকে তিনি আমাকে রক্ষা করবেনই। তা এই যে আমার উপকার করবার আগ্রহ, শ্যাম-নিবাসের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর থেকেই এটা আরও বেড়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের মনে নেই, তাই সংক্ষেপে বলি। সেলামি নয়, আগাম তিনমাসের ভাড়া পর্যন্ত নয়, স্রেফ মুখের কথায় বিশ্বাস করে সদানন্দবাবু তাঁর বাড়ির একতলাটা সেবার একজন উটকো লোককে ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যস্, তার কিছুদিন বাদেই সেই ভাড়াটে খুন হল, আর ভদ্রলোক জড়িয়ে গেলেন একটা বিচ্ছিরি মামলায়। তবে তাঁর ভাগ্য ভাল, ভাদুড়িমশাই সেইসময় কলকাতায় ছিলেন। কেটা যদি তিনি না নিতেন, সদানন্দবাবুকে তা হলে সম্ভবত সেই মামলা থেকে ছাড়িয়ে আনা যেত না। ফাঁসি না হোক, যাবজ্জীবন হতই। তা ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগটা যেহেতু আমিই করিয়ে দিয়েছিলুম, সদানন্দবাবু তাই আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় একেবারে আপ্লুত হয়ে আছেন। মুখে যদিও সেই ঘটনার কোনও উল্লেখ তিনি করেন না, তবু বুঝতে পারি, আমার জন্যে কিছু-একটা করবার সুযোগ পেলে তিনি বর্তে যান। 

সুযোগ এ-যাত্রায় বাসন্তীই করে দিয়েছে। বড়-মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে থাকে এলাহাবাদে, কলকাতায় থাকি আমি, বাসন্তী আর আমাদের ছোট-মেয়ে পারুল। তা দিন দশেক আগে খাওয়ার টেবিলে বাসন্তী হঠাৎ বলে বসল, “জগন্নাথ এক্সপ্রেসে তিনটে বার্থ চাই। দুটো লোয়ার, একটা আপার। তরশু পুরী রওনা হবার কথা।” 

ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললুম, “কারা রওনা হচ্ছে?” 

“পরে বলছি। আগে বলো, রিজার্ভেশানটা করিয়ে দিতে পারবে?” 

ভাতের গ্রাসটা মুখের কাছে এসে গিয়েছিল। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললুম, “তা হয়তো পারা যাবে। আজকাল অবশ্য সবই কম্পিউটারাইজড়, তবে কিনা আমাদের ট্রাভল এজেন্ট মলয় অতি তুখোড় ছেলে, কিছু-না-কিছু বার্থ তো ওর ঝুলির মধ্যে থাকেই, জগন্নাথ এক্সপ্রেসের তিনটে বার্থ কি আর দিতে পারবে না? কিন্তু তা না হয় হল, যাচ্ছে কারা?”

“আমি যাচ্ছি, পারুল যাচ্ছে, তুমিও যাচ্ছ।” 

ভাতের গ্রাসটা আবার নামিয়ে রাখতে হল। বললুম, “তার মানে? আমি এখন কী করে যাব? না না, হাতে এখন বিস্তর কাজ, আমার এখন যাওয়া হবে না। যেতে হয় তো তোমরা যাও, দিন কয়েক একটু ঘুরে এসো।” তারপর একটু থেমে বললুম, “কিন্তু আমি না-গেলে তোমরাই বা যাবে কী করে? থাকবে কোথায়?” 

বাসন্তী গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলল, “তা নিযে তোম।কে ভাবতে হবে না। মেজদিরা পুরী যাচ্ছে। চক্রতীর্থে একটা মস্ত বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। ঘর কি পাঁচ-ছ’খানা। তাই বলছিল যে, আমরাও যদি যাই তো বেশ হয়।” 

বললুম, “তা হলে আর ভাবনা কী? ‘ 

বাসন্তী বলল, “ভাবনা তোমাকে নিয়ে। নিজে তো কুটোটি পর্যন্ত নাড়তে শেখোনি, সকালবেলার চা থেকে রাত্তিরের খাওয়ার পরের মশলাটা পর্যন্ত তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হয়। সে-সব কে এগিয়ে দেবে? কে কেচে দেবে তোমার গেঞ্জি আর রুমাল? নিজে তো দেখি ফাউন্টেন পেনের কালিটা পর্যন্ত ভরতে পারো না। তা হলে?” 

ভাবলুম বলি যে, এইজন্যেই আমাদের পূর্বপুরুষরা একাধিক বিয়ে করতেন। কিন্তু বাসন্তীর মুখচোখ দেখে আর হাল্কা গলাতেও কথাটা বলবার সাহস হল না। তার বদলে কালুম, “আরে দূর, ও-সব কি একটা সমস্যা নাকি? আসল সমস্যা তো পাওয়ার। তা আমাদের অফিসে চমৎকার ক্যান্টিন রয়েছে। তোমরা তো আর সাতদিনের বেশি বাইরে থাকছ না, ও আমি ঠিক চালিয়ে নিতে পারব।” 

“সকালবেলার জলখাবারটা কে করে দেবে?” 

“সেটাও কোনও সমস্যা নয়। ফ্রিজের মধ্যে এক প্যাকেট মাখন আর কিছু ডিম রেখে যেয়ো। রোজকার রুটিটা আমি কিনে নেব। বাস্।” 

“কিছু বিস্কুটও থাকবে। কিন্তু চা? ওটা তুমি করে নিতে পারবে তো?” 

হেসে বললুম, “আমার চা মানে তো ফোটানো-জলের মধ্যে এক-চিমটি চায়ের পাতা। উনুন তো আর ধরাতে হচ্ছে না, স্রেফ গ্যাসটা জ্বেলে জলটা ফুটিয়ে নেব। তার আগে একটা ডিমও সেদ্ধ করে নেওয়া যাবে।” 

পারুল এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিল। এতক্ষণে মুখ খুলল সে। বলল, “দেখো বাবা, যে-জলে ডিম সেদ্ধ করবে, তাতেই যেন আবার চা করতে যেয়ো না। তা হলে কিন্তু ভীষণ আঁশটে গন্ধ হবে।” 

বললুম, “তুই আর তোর মা আমাকে কী ভাবিস বল্ তো? যা যা, তোরা ঘুরে আয়, আমাকে নিয়ে অত ভাবতে হবে না।” 

রিজার্ভেশানের ব্যাপারে কোনও ঝঞ্ঝাট হয়নি। মলয় ঠিকই দুটো লোয়ার বার্থ জোগাড় করে দিয়েছিল। ট্রেন ছাড়বার মিনিট পাঁচেক আগে হঠাৎ বাসন্তী একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবে পুরীতে আমাদের কাগজের এজেন্টকে তো ওদের যাবার কথা জানিয়ে রেখেছিলুম, পরশুদিন তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলে বুঝতে পারি যে, মা আর মেয়ে বাইরে গিয়ে বেশ ফূর্তিতেই আছে। পুরী এক্সপ্রেসে কাল সকালে তাদের ফিরবার কথা। 

কিন্তু যে-কথা বলছিলুম। বাসন্তী আর পারুলকে যে-দিন হাওড়া ইস্টিশনে গিয়ে জগন্নাথ এক্সপ্রেসে তুলে দিই, তার পরদিন সকালে একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় আটটার সময় সদানন্দবাবু আমার বাসায় এসে হাজির। কথায়-কথায় বাসন্তী হয়তো কখনও ওঁর স্ত্রী কুসুমবালাকে বলে থাকবে যে, সকাল ঠিক আটটায় আমাকে ব্রেকফাস্ট দিতে হয়, ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর কাছে সেটা শুনেছেন নিশ্চয়ই, ফলে একেবারে ঘড়ি দেখে তিনি আমার জলখাবার এনে হাজির করেছেন। শুধু তা-ই নয়, টিফিন ক্যারিয়ার খুলে টেবিলের উপরে জলখাবার সাজিয়ে দিয়ে, ফ্লাস্ক থেকে পেয়ালায় চা ঢেলে, ভদ্রলোক বলেছিলেন, “আপনার মিসেস তো এখন কয়েকটা দিন বাইরে তাকবেন। তা এই ক’টা দিন যদি দুপুর আর রাত্তিরের খাওয়াটা আমাদের বাড়িতে সেরে নেন তো হোটেলে খেয়ে আপনাকে আর শরীর নষ্ট করতে হয় না। …না না, আপনার সংকোচের কিছু নেই, বলেন তো দু’বেলার খাবার আমি পৌঁছেও দিয়ে যেতে পারি। 

রাজি হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সদানন্দবাবুর স্ত্রীকে জানি তো, বাতের ব্যথায় ভদ্রমহিলা প্রায় পঙ্গু বললেই হয়, হঠাৎ একজন অতিথির বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপলে তিনি ঘোর অসুবিধেয় পড়বেন, তাই প্রস্তাবটা একেবারে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বললুম, “পাগলামি করবেন না তো, আপিসে একটা ক্যান্টিন রয়েছে, তারা খাওয়ায়ও চমৎকার, দু’বেলা সেখানেই খেয়ে নেব।” 

ব্রেকফাস্টের ব্যাপারটা অবশ্য অত সহজে নাকচ করা গেল না। ওটাতে যদি আপত্তি করি, সদানন্দবাবুর ‘বেটার হাফ’ তা হলে নাকি দারুণ দুঃখ পাবেন। ব্যাস্, ভদ্রলাক একেবারে সেই থেকেই রোজ টিফিন ক্যারিয়ার আর ফ্লাস্ক-ভর্তি চা নিয়ে আমাদের ‘ফ্ল্যাটে এসে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। আসেন একেবারে কাঁটায-কাঁটার সকাল আটটায়। একদিনও তার ব্যতিক্রম হতে দেখলুম না। 

আজও এসেছেন। চোখমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বসবার ঘরে ঢুকে দেখলুম, সেন্টার-টেবিলে দুটো প্লেটের উপরে টোস্ট আর অমলেট সাজিয়ে রেখে ভদ্রলোক কাগজ পড়ছেন। ঝাঁটপাট দেওয়া আর থালাবাসন মাজবার জন্যে যে কাজের মেয়েটি এইসময়ে আসে, তাকে দিয়ে আমাদের ভাঁড়ার ঘর থেকে একজোড়া পেয়ালা-পিরিচও আনিয়ে নিয়েছেন ইতিমধ্যে। 

ফ্লাস্ক থেকে পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে রোজই সদানন্দাবাবুকে যে প্রশ্ন করি, আজও সেটা করলুম। “আপনি এক কাপ খাবেন না?” 

উত্তরে রোজই তিনি যা বলেন, আজও ঠিক তা-ই বললেন। “না মশাই, দিনে আমার বরাদ্দ হচ্ছে তিন কাপ। এক কাপ খাই মর্নিং ওয়াকে বেরোবার আগে, এক কাপ খাই মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে, আর এক কাপ খাই বিকেলবেলায়। বাস্, ওর আর নড়চড় হবার উপায় নেই। তা সকালবেলার দু’কাপ আমার হয়ে গেছে তো, এখন তাই আর খাব না।” বলে আবার খবরের কাগজে চোখ বুলোতে লাগলেন। 

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। চায়ে চুমুক দিয়ে সবে এক টুকরো অমলেট কেটে নিয়ে সেই টুকরোটাকে টোস্টের উপরে রেখে সেটা মুখে তুলেছি, কাগজখানা সরিয়ে রেখে সদানন্দবাবু বললেন, “আর তো এখানে থাকা যাবে না মশাই।”

বললুম, “কেন? শ্যামনিবাসে আবার কী গণ্ডগোল হল?” 

“আরে ধুর মশাই, বাড়ির কথা হচ্ছে না, বাড়ি ইজ পার্ফেক্টলি অলরাইট। মাঝখানে অবশ্য কলির একটু সর্দি-জ্বর হয়েছিল, তা সেও এখন ভালই আছে। … না না, বাড়ির কথা আমি ভাবছি না।’ 

“তা হলে কীসের কথা ভাবছেন?” 

“ভাবছি এই শহরটার কথা, এই কলকাতার কথা। উঃ, কী শহর কী হয়ে গেল! আগে এখানে রাস্তার উপরে একটা জিলিপি পড়ে থাকলেও সেটা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলা যেত। আর সেই শহরেই এখন কিনা নাকে রুমাল না-চেপে সাহেবপাড়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। এখন আবার তার উগরে এই কাণ্ড!” 

“কী কাণ্ড?” 

“আবার একজন খুন হয়েছে! সেই একইভাবে!” বলে হাত-থেকে-নামিয়ে-রাখা কাগজখানাকে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে সদানন্দবাবু বললন, “এই নিন, দেখুন।” 

পেশায় আমি সাংবাদিক, তাই মাত্র একটা কাগজ রাখলে আমার চলে না, এই সেদিনও পাঁচখানা কাগজ রাখতুম, কিন্তু খবরের কাগজের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর পেরে ওঠা গেল না, এখন তিনখানাতেই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সদানন্দবাবু ‘দৈনিক সমাচার’-এর ভক্ত, সেইখানাই তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। তার লিড-স্টোরির হেডলাইনের উপরে চোখ বুলিয়েই আমাকে চমকে উঠতে হল। ‘আবার খুন, আবার স্টোনম্যান’। 

হেডলাইন যদিও পিলে চমকানো, আর ঘটনা যদিও পাথর দিয়ে থেঁতলে মারার, তরু রিপোর্টার দেখলুম এমন ভয়ংকর ব্যাপারের প্রতিবেদন লিখতে বসেও কবিত্ব করার লোভ সামলাতে পারেননি। কে মরল, কোথায় মরল, কখন মরল, কীভাবে মরল, সে-সব প্রাথমিক খবর দেবার আগেই তিনি ভাষার তুবড়ি ছুটিয়ে দিয়েছেন। “নাগরিকদের তৃষ্ণার জল সরবরাহে যেখানকার পুরসভা একান্ত অপারগ, সেই কলকাতা শহরেই ফুটপাথের রক্ততৃষ্ণা নিবারণে কিন্তু বিকৃতমস্তিষ্ক ঘাতকের উদ্যোগ এখনও অব্যাহত। সূচনা গত জুন মাসে। তখন থেকে নিয়মিতভাবে সে এই তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে। ঘাতক এবারেও সেই স্টোনম্যান, তার শিকার এবারেও এক অসহায় নিদ্রিত মানুষ, আর তার বধ্যভূমি এবারেও এই শহরের এক ফুটপাথ। সমগ্র নগর যখন নিদ্রমগ্ন, সেই নিশাকালে এ্যারেও সে একটি প্রস্তরখণ্ডের নির্দয় আঘাতে এক ঘুমন্ত ব্যক্তির মস্তক চূর্ণ করেছে। শমন যে কখন তার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, হতভাগ্য তা জানতেও পারেনি।…’ 

আমরা যখন কাগজের চাকরিতে ঢুকি, রিপোর্টারদের নাম ছাপবার রেওয়াজ তখন ছিল না। বছর কয়েক হল এটা চালু হয়েছে। স্টোনম্যানের এই খবরটাতেও রিপোর্টারের নাম ছাপা হয়েছে দেখলুম। ভদ্রলোককে চিনি। এককালে সাহিত্য করতেন, তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি বলেই হয়তো খবরের কাগজের রিপোর্টের মধ্যেই আজকাল তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভাকে তিনি একেবারে যৎপরোনাস্তি উজাড় করে দেন। 

খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলুম, সদানন্দবাবু আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। বললেন, “পড়লেন?’ 

“পড়লুম বই কী।”

“বুঝলেন কিচ্ছু?”

“কী বুঝব?” 

সদানন্দবাবু একেবারে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। যেন এমন অদ্ভুত কথা তিনি কস্মিনকালেও শোনেননি। তারপর বললেন, “এ তো বড় তাজ্জব কথা! কিচ্ছু বোঝবার নেই?” 

আবার বললুম, “কী বুঝব?” 

“বা রে, এই যে একটা লোক গত জুন মাস থেকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, ফুটপাথের উপরে একটার-পর একটা খুন করে যাচ্ছে, এর মধ্যে কিচ্ছু বোঝবার নেই? মানে এইভাবে সে খুন করছে কেন, তার মতলব কী, সেটা বুঝতে হবে না?”

ব্যাপারট, যে বিচিত্র, তাতে আর সন্দেহ কী। নিষ্ঠুরতার দিক থেকেও এই হত্যাকাণ্ডের তুলনা খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে। ভাদুড়িমশাই এখন কলকাতায় নেই, কবে আসবেন তাও জানি না, তবে তাঁকে দেব বলেই এই হত্যাকাণ্ডগুলোর একটা খতিয়ান আমি রেখে যাচ্ছি। প্রথম খুনটা হয় জুন মাসে। যে-লোকটি খুন হয়, সে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট আর হেয়ার স্ট্রিটের মোড়ের কাছে ফুটপাথের উপরে ঘুমিয়ে ছিল। 

জুলাই মাসে একটা নয়, তিন তিনটে লোক খুন হয়ে যায়। প্রথমজন শেয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, দ্বিতীয়জন শেয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে, আর তৃতীয়জন জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সামনে। 

অগস্টে আবার শেয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে একজন মারা পড়ে। সেপ্টেম্বরে মরে দু’জন। একজন হাওড়া ব্রিজ অ্যাপ্রোচের কাছে আর একজন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে, অর্থাৎ একেবারে হাইকোর্ট পাড়ায়। 

তারপরে এই আট-নম্বর হত্যাকাণ্ড। সন ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের লক্ষ্মীপুজোর ভাসান সবে শেষ হয়েছে, দিন কয়েক বাদে কালীপুজো, পাড়ায়-পাড়ায় তার জন্যে আবার নতুন করে এখন সর্বজনীনের প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। তারই মধ্যে কলকাতার ফুটপাথে ফের স্টোনম্যানের এই হামলা। লোকটা তত্ত্বে-তক্কে ছিল নিশ্চয়ই, সুযো। মিলবামাত্র আর-একটি মানুষের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। 

সদানন্দবাবু বললেন, “মিলগুলো দেখেছেন?” 

‘দৈনিক সমাচার’-এর হেডলাইনগুলোর উপরে চোখ বুলোনো শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেখানা ফের সদানন্দবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে সেদিনকার ‘দি ইস্টার্ন কুরিয়ার’খানা টেনে নিয়ে বললুম, “সে তো যে-কোনও বাচ্চা ছেলেও দেখতে পাবে। এক নম্বর মিল, আজ পর্যন্ত যে-ক’জনকে খুন করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই ফুটপাতের বাসিন্দা। দু’নম্বর মিল, তারা প্রত্যেকেই ছিল ঘুমন্ত। কেউ যে চিৎকার করে ওঠেনি কিংবা চেষ্টা করেনি হত্যাকারীকে বাধা দিতে, তাতে অন্তত সেই কথাই মনে হয়।” 

“চিৎকার করেনি, সেটা কী করে বুঝলেন?”

“আরে মশাই, থাকেন নাহয় বাড়ির মধ্যে, কিন্তু নাকে রুমাল না চেপে যে আজকাল রাস্তাঘাটে হাঁটাই যায় না, সেটা নাহয় মেনে নিলুম, কিন্তু চোখ দুটো তো খোলা না রেখে উপায় নেই। নাকি আপনার চোখ দুটোও তখন বন্ধ থাকে?” 

হতভম্ব হয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “কই, না তো। চোখ বন্ধ করে কি কলকাতার রাস্তায় হাঁটা যায় নাকি? তা হলে তো লরি কিংবা মিনিবাসের তলায় চাপা পড়তে হবে। না না, চোখ আমার খোলাই থাকে তখন।” 

“তবু দেখতে পান না যে, পেভমেন্ট-ডোয়েলারদের সংখ্যা এই শহরে কীরকম বেড়ে গেছে? আশ্চর্য! আরে মশাই, হাজার-হাজার লোক এখানে ফুটপাথের বাসিন্দা। হয় ঝুপড়ি বানিয়ে, নয় পলিথিনের পাতলা চাঁদোয়া টাঙিয়ে, আর নয়তো গাড়ি-বারান্দার নীচে তারা জীবন কাটায়। সেইখানেই তাদের সংসার। ফুটপাথেই তারা উনুন ধরায়, ভাত রাঁধে, হাইড্রান্টের জলে চান করে, কাপড় কাচে, কলাই-করা বাসনকোসন ধোয়, তারপর ঘুমিয়েও পড়ে সেই ফুটপাথের উপরে। এক-আধজন নয়, নাইট-ডিউটি দিয়ে রাত আড়াইটে-তিনটের সময় যখন বাসায় ফিরতুম, নিত্য তখন দেখতে পেতুম যে, এক-একটা ফুটপাথে কাতারে কাতারে লোক পাশাপাশি শুয়ে ঘুমুচ্ছে।” 

“তাতে কী হল?” 

“এই হল যে, খুনিকে দেখে কেউ যদি চিৎকার করে উঠত, তা হলে আরও অনেকে সেটা শুনতে পেত। অথচ, কেউই নাকি কিছু শুনতে পায় না। এই যে পরপর এতগুলো ঘটনা ঘটল, একটা ক্ষেত্রেও কেউই কিচ্ছু শোনেনি। কেন শোনেনি? না, খুনির সঙ্গে ধস্তাধস্তি তো দূরের কথা, চিৎকার করে উঠবারও সুযোগ পায়নি কেউ। স্রেফ ঘুমের মধ্যেই মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত লেগে তারা মারা পড়েছে।” 

চুপচাপ ব্যাপারটা একটু বুঝবার চেষ্টা করলেন সদানন্দবাবু। তারপর বললেন, “আর কোনও মিল চোখে পড়ল?” 

“পড়ল বই কী। তিন-নম্বর মিল, খুনির হাত কিংবা পায়ের ছাপ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা যেন হাওয়ায় ভেসে আসে, তারপরে কাউকে খুন করে ফের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।” 

“কিন্তু যে পাথর দিয়ে খুন করে, সেটা তো আর হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না। তার উপরেই বা তার হাতের ছাপ পাওয়া যায় না কেন?”

বললুম, “সেটাই তো সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার। পরপর এতগুলো ঘটনা ঘটল, অথচ একটা ক্ষেত্রেও সে কোনও ব্লু রেখে যায়নি। অন্তত পুলিশ তো তেমন কিছু বলছে না। অন্য সময়ে কত লম্বাচওড়া কথা বলে তারা, কিন্তু এ-ব্যাপারে একেবারে স্পিকটি নট।” 

“পুলিশ খুব ধাঁধায় পড়ে গেছে, কী বলেন?” 

“পড়াই তো স্বাভাবিক। একটা কোনও সূত্র পেলে তবে তা সেইটে ধরে তারা এগোবে। তা কোনও সূত্রই যদি না মেলে, তো তারা এগোয় কী করে?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “তা তো বটেই।” তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আচ্ছা মশাই, লোকে যে খুন করে, তার একটা মতলব থাকবে তো? হতে পারে যে, এ-লোকটারও কিছু একটা মতলব আছে, আর সেই মতলব হাসিল করবার জন্যেই সে একটার-পর-একটা লোককে এইভাবে খুন করে যাচ্ছে। …কী, চুপ করে রইলেন কেন? কিছু-একটা মতলব কি এর থাকতে পারে না?” 

কাজের মেয়েটি চা আর জলখাবারের বাসনপত্র আগেই নিয়ে গিয়েছিল। চায়ের ফ্লাস্ক, টিফিন-ক্যারিয়ার আর জলখাবারের প্লেট ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে নিয়ে এসে বলল, “এগুলো আমি ও-বাড়ির মাসিমাকে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছি। আপনার জন্যে সিগারেট আনতে হবে?” 

হবে না শুনে বলল, ‘তা হলে আমি যাই। মা আর দিদিমণি তো কাল সকালে আসছেন?” বললুম, “হ্যাঁ।” 

“তা হলে আমি কাল খুব ভোরেই চলে আসব।” 

দরজা টেনে দিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে গেল।

সদানন্দবাবু বললেন, “কই, কিছু বলছেন না যে?”

“কী বলব?” 

“লোকটার কি কোনও মতলব থাকতে পারে না?” 

“কোন্ লোকটা?” 

অবাক হয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “যাচ্চলে! সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে এখন সীতা কার বাবা! নিশ্চয়ই অন্য-কিছু ভাবছিলে।?” 

সত্যিই তা-ই। ভাবছিলুম স্বপ্নটার কথা। এই স্বপ্ন যে কালই প্রথম দেখলুম, তাও নয়। 

প্রথম দেখি ছেচল্লিশ সালের জুলাইয়ে। আমি তখন বিষাণগড়ে থাকতুম। সাতচল্লিশে সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে আসি। তারপরেও মাসকয়েক এই স্বপ্ন আমার ঘুমের মধ্যে হানা দিত। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগের কথা, প্রায় গত জন্মের ব্যাপার। গত চল্লিশ বছর ধরে স্বপ্নটা আমি দেখিনি, একদিনও না। 

কিন্তু ইদানীং আবার দেখতে শুরু করেছি। স্টোনম্যান তার পাঁচ-নম্বর খুন সমাধা করে অগস্ট মাসের শেষ হপ্তায়। খুনটা হয়েছিল শেয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে। কাগজে তার খবর যেদিন বেরোয়, সেদিন রাত্তিরেই বিষাণগড়ের সেই পুরনো স্বপ্নটা আবার আমার ঘুমের মধ্যে এসে হানা দেয়। তারপর থেকে দু-একদিন অন্তর-অন্তর সেই একই স্বপ্ন আমি দেখে যাচ্ছি। 

“কী হল, চুপ করে রইলেন যে?” 

লজ্জিত হয়ে বললুম, “ঠিকই ধরেছেন, অন্য-একটা কথাই ভাবছিলুম বটে। তা আপনি কী যেন বলছিলেন?” 

সদানন্দবাবু বললেন, “এই যে একটা লোক খুন করছে তো করেই যাচ্ছে, এর একটা মতলব থাকতে পারে না?” 

“কী আর মতলব থাকবে,” বিষণ্ণ গলায় বললুম, “যাদের খুন করছে, তারা ফুটপাথের বাসিন্দা। কেউই কোটিপতি নয়। সুতরাং টাকাটা একটা মোটিভ হতে পারে না।” 

“কে বলল পারে না?” সদানন্দবাবু চওড়া হেসে বললেন, “ফুটপাথে শুলেই যে সে ভিখিরি হবে, তার কোনও মানে নেই। আবার ভিখিরি হলেই যে সে কপর্দকশূন্য হবে, তারও কোনও মানে নেই।” 

অবাক হয়ে বললুম, “অর্থাৎ?” 

“অর্থাৎ আর কী, গিন্নির কথায় সেদিন একটা ভিসিপি ভাড়া করে এনেছিলুম। মানে আমার মোটেই ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আমার মিসেসকে তো আপনি ভালই চেনেন, তাঁর কথার উপরে কে কথা বলবে? অগত্যা কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা খসিয়ে একদিনের জন্যে ওই যম্ভরটা আমাকে আনতেই হল, আর তার সঙ্গে আনতে হল বারো টাকা খসিয়ে দু’খানা ক্যাসেট। একটা বাংলা, আর একটা হিন্দি। তা সত্যি বলব মশাই, বাংলার চেয়ে হিন্দি বইটা অনেক ভাল। অবশ্যি বইটা ঠিক হিন্দিও নয়, মানে কারুর মুখে কোনও কথাই নেই, একেবারে সাইলেন্ট পিকচার। ওই মানে চার্লি চ্যাপলিনের বইয়ের মতো। অঙ্গভঙ্গি করে সব বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তো, তাই কে কী বলছে আর কোথায় কী ঘটছে, সে-সব ধরতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।” 

“তা তার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক কী?”

“আছে মশাই,” সদানন্দবাবু আবার আকর্ণবিশ্রান্ত হাস্য করে বললেন, “সম্পর্ক একটা আছে। বইটা কমল হাসনের। ওই যে মশাই, সাউথ ইন্ডিয়ার সেই বিখ্যাত অ্যাক্টর, হিন্দি বইয়েও আজকাল যে খুব নাম করেছে। তো যা বলছিলুম। বইয়ের মধ্যে একটা ভিখিরির ক্যারেক্টার আছে। একেবারে ফুটপাথের ভিখিরি। তা সে মরতে কী দেখা গেল জানেন?” 

“কী দেখা গেল?” 

চোখ বড়-বড় করে সদানন্দবাবু বললেন, “দেখা গেল যে, তার বালিশের মধ্যে লুকোনো ছিল কাড়ি-কাঁড়ি টাকা।” 

“তাতে হল কী?” 

এবারে সদানন্দবাবুর অবাক হবার পালা। অবাক হয়ে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আপনি একটা শিক্ষিত লোক মশাই। বাড়িতে আপনার আলমারি-ভর্তি মস্ত-মস্ত বই। তার উপরে আবার কাগজে কাজ করেন। নিজেও বই লেখেন শুনেছি। অথচ এই সহজ ব্যাপারটাই আপনি বুঝতে পারলেন না? আরে মশাই, এই লোকটাও হয়তো টাকার ধান্ধায় ঘুরছে। বড়লোকদের তো ছোঁবার উপায় নেই, তাই ফুটপাথের ভিখিরিদের খুন করছে। কেন খুন করছে? যদি তাদের বালিশের খোলে কিছু পাওয়া যায়।”

“কই, পুলিশ তো তেমন কিছু বলছে না।” 

“পুলিশের কথা বাদ দিন, আপনি কী ভাবছেন বলুন। মানে, লোকটার মতলব কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?” 

“মতলব যে আছেই, তা-ই বা কী করে বলব?” 

“তার মানে?” 

বললুম, “মানে তো নরেশ দস্তিদারই বলে দিয়েছেন।” 

“সে আবার কে?”

“দৈনিক সমাচারের রিপোর্টার। তিনি তো স্পষ্টই লিখেছেন যে, এখানকার ‘ফুটপাথের রক্ততৃষ্ণা নিবারণে বিকৃতমস্তিষ্ক ঘাতকের উদ্যোগ এখনও অব্যাহত।” 

“ওরেব্বাবা! তো ওই ‘বিকৃতমস্তিষ্ক ঘাতকের’ না কী যেন বললেন, কথাটার অর্থ কী?”

“মানে পাগল। এখন ভেবে দেখুন, পাগলদের কোনও কাজের পিছনে কি মতলব থাকে? থাকা সম্ভব? কিন্তু না, আর না মশাই, এবারে আমি স্নান করতে যাব।” 

সদানন্দবাবু উঠে পড়লেন। তারপর দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা এত খটোমটো বাংলা লেখেন কেন মশাই? পাগল লিখলেই তো হত। …আর হ্যাঁ, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। ভাদুড়িমশাই বড় ভালমানুষ, তাঁর বেঁচে থাকা দরকার। দয়া করে আর তাঁকে নিয়ে ও-সব অলুক্ষুনে স্বপ্ন দেখবেন না।” 

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলুম। সদানন্দবাবু আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, “আপনি কী বলবেন, আমি জানি। বলবেন, স্বপ্ন ইজ স্বপ্ন, অর্থাৎ নেহাতই অলীক ব্যাপার। কিন্তু না, হতে পারে অলীক, কিন্তু অমন মানুষকে নিয়ে তাও আপনার দেখবার দরকার নেই। তাঁর সম্পর্কে ভাল-ভাল কথা ভাবুন, তা হলেই আর যত রাজ্যের বিচ্ছিরি সব স্বপ্ন আপনাকে দেখতে হবে না।” 

সদানন্দবাবু চলে গেলেন। সদরদরজা বন্ধ করে আমি কলঘরে গিয়ে ঢুকলুম। 

স্বপ্নটা কিন্তু অলীক নয়। 

কিন্তু কথাটা বলবার আগেই বোধহয় বলা দরকার যে, কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ কেন আমি বিষাণগড়ে গিয়েছিলুম। তা হলে কিন্তু সেই সময় আর সেই পরিবেশের কথাটাও বলতে হয়। 

১৯৪২ সনে আই. এ. পাশ করে আমি খবরের কাগজে ঢুকি। বিনা মাইনের চাকরি; তার উপরে আবার বিকেলের শিফটের চার্জে যিনি থাকতেন, রোজ তাঁকে একটা করে ভেজিটেবল চপ আর এক কাপ চা না-খাওয়ালে তিনি অনুবাদ করবার মতো কপিই আমাকে দিতে চাইতেন না। চা আর চপ খাওয়ালে কিন্তু অ্যাসোশিয়েটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়া আর রয়টারের কপি তো দিতেনই, সেইসঙ্গে এই আশ্বাসটাও দিতেন যে, মালিককে বলে খুব শিগগিরই তিনি আমাকে মাসিক অন্তত তিরিশটা টাকা দেওয়াবার ব্যবস্থা করে দেবেন। 

পি.টি. আই. আর ইউ. এন. আই. তখনও জন্ম নেয়নি। ও-সব অনেক পরের কথা। রয়টার অবশ্য এখনও আছে, তখনও ছিল। এখনকার মতো তখনও তারা শুধুই বিদেশি খবর সরবরাহ করত। দিশি খবরের জন্যে ছিল অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অভ ইন্ডিয়া আর ইউনাইটেড প্রেস অভ ইন্ডিয়া। সংক্ষেপে এ. পি. আই. আর ইউ. পি. আই.। বলা বাহুল্য, তারা বিনা পয়সায় খবর দিত না। কিন্তু ছোট্ট কাগজ, নিয়মিত পয়সা দেবার ক্ষমতা নেই, নিউজ এজেন্সির বিল মাসের পর মাস বাকি পড়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত তারা খবর পাঠানো বন্ধ করে দিল। ঝাঁপ বন্ধ করা ছাড়া মালিকেরও তখন আর গত্যন্তর রইল না। 

তারই মধ্যে বি. এ. পাশ করে গিয়েছিলুম আমি। সেই ছোট্ট কাগজ ছেড়ে ঢুকেও পড়েছিলুম আর একটু সচ্ছল একটা কাগজে কিন্তু যুদ্ধও শেষ হল, আর বিজ্ঞাপনেও ধরল টান। দেশে তখন এত-এত শিল্প তো গড়ে ওঠেনি, কে বিজ্ঞাপন দেবে। যুদ্ধের বাজারে ব্যাঙের ছাতার মতো গুচ্ছের কাগজ গজিয়ে উঠেছিল, সেগুলোর তখন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। এ. আর. পি. আর সিভিক গার্ডের দফতরগুলিকে গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে; বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন আরও অসংখ্য আপিস, শুধুই যুদ্ধকালীন দরকার মেটাবার জন্যে যা খোলা হয়েছিল। ফলে চাকরির বাজারেও আবার দেখা দিয়েছে সেই আগের মতোই দুঃসময়। আমি ইতিমধ্যে আরও দু-তিনটে কাগজ পালটে সদ্য যে নতুন কাগজে যোগ দিয়েছি, তারও মধু ক্রমেই শুকিয়ে আসছিল। মাইনে পাই একশো পঁচিশ। তাও এক কিস্তিতে পাওয়া যায় না। মাইনে চাইতে গেলে ক্যাশিয়ারবাবু দশ কি পনেরো টাকা দিয়ে বলেন, “আপাতত এই দিয়েই চালিয়ে নিন, মনে হচ্ছে সামনের হপ্তায় আরও কিছু দিতে পারব।” 

এ হল ১৯৪৬ সালের কথা। বিয়াল্লিশের আন্দোলনের আগুন তার অনেক আগেই নিবেছে। তেতাল্লিশের মন্বন্তরে মানুষ মরেছে পোকামাকড়ের মতো। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নেতারা জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। ছেচল্লিশের দাঙ্গা তখনও বাধেনি। মনে হচ্ছে, স্বাধীনতা হয়তো আর খুব দূরে নয়। পাকিস্তানের জিগির তখন অহোরাত্র উঠছিল ঠিকই, কিন্তু দেশ যে সত্যি দু’ভাগ হবে, তখনও তা আমি ভাবতে পারছিলুম না। 

সেই সময়ে হঠাৎ একদিন স্টেট্সম্যানে একটা বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়ে। বিষাণগড় প্যালেসের জন্যে একজন কেয়ারটেকার চাই। রাজবাড়ির আউটহাউসে থাকতে হবে। থাকা-খাওয়া ফ্রি। মাইনে তিনশো টাকা। প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, গ্র্যাজুয়েট হলে ভাল হয়, স্পোকেন ইংলিশে তুখোড় হওয়া আবশ্যক, আর যেটা চাই-ই চাই, সেটা হল ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার বা ভারতীয় স্থাপত্যশিল্প সংক্রান্ত কিছু জ্ঞানগম্যি। 

কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখলেই তখন আমি দরখাস্ত ছাড়ি। তবে কোনও দরখাস্তেরই কোনও উত্তর আসে না। জানতুম, এটারও কোনও উত্তর আসবে না। তবু মনে হল, দেখাই যাক না, দরখাস্ত যখন সব চাকরির জন্যেই করছি, তখন এটার জন্যে করতেই বা ক্ষতি কী। বি. এ. পড়তেই পড়তেই স্পোকেন ইংলিশের একটা কোর্স শেষ করি, তার জন্যে একটা সার্টিফিকেট পাওয়া গিয়েছিল। সেইসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনসেন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি বিভাগের এক নামজাদা অধ্যাপকের কাছ থেকে এই মর্মে একটা প্রশংসাপত্র জোগাড় করাও খুব কঠিন হল না যে, বয়স কম হলেও স্থাপত্যশিল্পে আমার পড়াশুনো নেহাত কম নয়, বস্তুত এ-ব্যাপারে আমাকে একজন ‘নলেজেল ইয়াং ম্যান’ হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে। 

আমিও ইতিহাসেরই ছাত্র, তবে কিনা মডার্ন হিস্ট্রির, ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের ‘হ ক্ষ’ তো দূরের কথা, ‘অ আ ক খ’ও আমার জানা নেই। অধ্যাপক সেটা বিলক্ষণ জানতেন, তাই প্রশংসাপত্রর সঙ্গে খানকয়েক বইয়ের একটা লিস্টি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখো হে, আমাকে ডুবিয়ো না, এই বইগুলো একটু নাড়াচাড়া করে নিয়ো।”

বাস্, দরখাস্তের সঙ্গে সার্টিফিকেট, টেস্টিমোনিয়াল ইত্যাদি গেঁথে সেইদিনই ‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা’ বলে পোস্ট করে দিই, তবে কিনা ফলের প্রত্যাশা কিছুমাত্র করিনি। ধরেই নিয়েছিলুম যে, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। 

কিন্তু ছিঁড়ল। সাতদিনের মাথায় আমার দরখাস্তখানার প্রাপ্তিস্বীকার করে একখানা চিঠি এল, আর পনেরো দিনের মাথায় এল সাক্ষাৎকারের নির্দেশ। 

না, ইন্টারভিউয়ের জন্যে আমার বিষাণগড় যাবার দরকার নেই, ওটা কলকাতাতেই হবে। অমুক দিন অমুক সময়ে আমি যেন গ্র্যান্ড হোটেলের অত নম্বর কামরায় গিয়ে দেখা করি। 

সাংবাদিকদের গতি নাকি সর্বত্র। কিন্তু আমি নেহাতই একজন জুনিয়ার রিপোর্টার। বড় মাপের দু-চারজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছি বটে, কিন্তু সেজো-মাপেরও কোনও হোটেলে তার আগে ঢোকা হয়নি। আমার দৌড় তখনও ময়দানের মিটিং পর্যন্ত; সেক্ষেত্রে ময়দানের উল্টোদিকের ওই পেল্লায় হোটেলে ঢুকবার সময়ে আমার হাঁটু যদি কিঞ্চিৎ কেঁপে থাকে, তো তার জন্যে নিশ্চয় আমাকে খুব দোষ দেওয়া যাবে না। 

কথাটা শুনে যাঁরা হাসছেন, তাঁদের মনে রাখতে বলি যে, দেশ তখনও পরাধীন। ইংরেজ তখনও ভারত ছাড়েনি। যেমন গ্রেট ইস্টার্ন, তেমন গ্র্যান্ডও তখন পরিচিত ছিল ষোলো-আনা সাহেবি হোটেল’ হিসেবে। তার উপরে আবার আমি তো সেখানে ‘গেস্ট’ হিসেবে যাইনি, স্রেফ ‘চাকরিপ্রার্থী’ হিসেবে গিয়েছিলুম। ভিতরে ঢুকে এটাও লক্ষ করেছিলুম যে, চতুর্দিকে শুধুই স্যুটেড-বুটেড লালমুখো আর দিশি সাহেবের ছড়াছড়ি। শাড়ি-পরা দু’চারজন মহিলাকেও দেখলুম বটে, কিন্তু আমার মতো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কোনও ভারতীয় ভদ্রলোক আমার চোখে পড়ল না। 

যে কামরায় গিয়ে আমাকে দেখা করতে বলা হয়েছিল, রিসেপশন কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে, সেটা দোতলায়। যথাস্থানে গিয়ে দরজায় টোকা দিতে এক মেমসাহেব এসে দরজা খুলে দিলেন। তারপর আমার আসবার উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে বললেন, “আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি রানি-মা’কে খবর দিচ্ছি।” 

মেমসাহেব বেরিয়ে গেলেন। আমি একটা সোফায় বসে কামরাটার উপরে চোখ বুলোতে লাগলুম। কামরাটা ছোট, দেখলেই বোঝা যায় যে, আপাতত এটা একটা অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘরের একদিকে একটা সেন্টার-টেবিলের চারপাশে খানকয় সোফা, অন্যদিকে একটা ছোট টেবিলের উপরে একটা টাইপরাইটার। তার বাঁ দিকে একটা টেলিফোন। টেবিলের সামনে একটা খাড়া-পিঠ চেয়ার। টাইপরাইটারে কাগজ পরানো রয়েছে। মেমসাহেবটি যে ওই চেয়ারে বসে কিছু টাইপ করছিলেন, সেটা বোঝা গেল। টেবিলের পাশে একটা র‍্যাক। তাতে এক কপি কনসাইজ অক্সফোর্ড ডিকশনারি ও অন্য কিছু বইপত্তর রয়েছে। তা ছাড়া আর কিছু এ-ঘরে নেই। এমনকি, দেওয়ালে একটা ছবি পর্যন্ত না। 

খানিক বাদেই ফিরে এলেন মেমসাহেব। মৃদু হেসে, সামান্য শ্রাগ করে বললেন, “ওয়েল … শি ইজ্ন্ট রেডি ইয়েট টু রিসিভ হার ভিজিটরস। নাউ উড য়ু মাইন্ড ওয়েটিং ফর সাম টাইম… সে অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার?” 

বসলুম, “ডু আই হ্যাভ এ চয়েস? চাকরিটা আমার দরকার। তাই আধ ঘণ্টা কেন, দরকার হলে সারাদিনই আমি অপেক্ষা করব।” 

“ডু য়ু কেয়ার ফর আ কাপ অভ টি? চান তো রুম সার্ভিসকে বলে আনিয়ে দিতে পারি।”

“ধন্যবাদ। কিন্তু দরকার হবে না, একটু আগেই খেয়েছি।” 

মেমসাহেব তাঁর কাজে বসে গেলেন। 

আধ ঘণ্টাও অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট কুড়ি বাদেই ফোন বেজে উঠল। মেমসাহেব ফোন ধরলেন। কেউ কিছু বলছিল। সেটা শুনলেন। তারপর ফোন নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শি ইজ রেডি নাউ, অ্যান্ড শি ওয়ান্টস্ মি টু সেন্ড য়ু আপ।” 

“কোথায় যেতে হবে?” 

“করিডরে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরুন, তারপর দুটো দরজা ছেড়ে দিয়ে তৃতীয়টায় নক করুন। ওটাই রানি-মা’র স্যুইট।” 

নক করতে যিনি দরজা খুলে দিলেন, তাঁকে দেখবামাত্র যা আমার মনে হল, তা এই যে, ঠিক-দরজায় নক করিনি। মহিলা নন, ইনি একজন দশাসই পুরুষ। দৈর্ঘ্যে অন্তত ছ’ফুট, প্রস্থেও নেহাত কম হবেন না। ওই যাকে শালপ্রাংশু মহাভুজ বলে, ঠিক তা-ই। বয়স সম্ভবত বছর চল্লিশ। পরনে থ্রি-পিস স্যুট। গায়ের রং লালচে-সাদা। চোখে মনোল। তার থেকে একটা কালো কার ঝুলছে। চুল ব্যাকব্রাশ করা। নাকের নীচে চমৎকার এক জোড়া গোঁফ। বস্তুত মোমে-মাজা সেই গোঁফজোড়াটি এতই সুদৃশ্য যে, হঠাৎ দেখলে কৃত্রিম বলে মনে হয়। সত্যিই যে কৃত্রিম, সেটা অনেক বছর বাদে জেনেছিলুম। 

যা-ই হোক, ভদ্রলোককে দেখে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলুম আমি। ইন্টারভিউয়ের চিঠিখানা তাঁর দিকে এগিয়ে ধরে বললুম, “আমি কি ভুল-দরজায় নক করেছি?” 

চিঠির উপরে চোখ বুলিয়ে দশাসই পুরুষটি হাসলেন। তারপর দরজার পাল্লা পুরোপুরি খুলে দিয়ে বললেন, “ভুল কেন হবে, ভিতরে আসুন।” 

ভিতরে ঢুকলুম। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট ছিল অগের ঘরটাতেও, তবে এখানে সেটা অনেক বেশি পুরু। গালচে তো নয়, যেন পালকের গদি, পা একেবারে ডুবে যাচ্ছিল। ঘরটাও মস্ত বড়। 

ঢুকেই বুঝেছিলুম, এটা ড্রইং রুম। সোফা, সেটি, সেন্টার টেবিল দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। একদিকে, দেওয়ালের ধারে একটা ডিভান। দু’দিকের দেওয়াল ফাঁকা। অন্য দুই দেওয়ালের একটিতে ঝুলছে কাঞ্চনজঙ্ঘার মস্ত একটা ফোটোগ্রাফ। ফোটো সেকালে শুধু সাদা-কালোই হত, রঙিন হত না। তবে রং-তুলির ব্যাপারটা যাঁরা বোঝেন, তাঁদের দিয়ে সাদা-কালো ফোটোগ্রাফকেই অনেকে রঙিন করিয়ে নিতেন। এটাকেও সেইভাবে রঙিন করা হয়েছে। সূর্যোদয়ের মুহূর্ত। আকাশে একটু লালচে আভা। তার ছোঁয়া লাগায় পাহাড়চূড়ায় বরফের বাহার খুব খুলেছে। অন্য দেওয়ালে গিল্টি-করা ফ্রেমের মধ্যে ইংরেজ রাজা-রানির ছবি। 

ড্রইং-রুমের লাগোয়া শোবার ঘর। দুই কামরার মধ্যবর্তী দরজায় জামদানি-কাজ করা পুরু পর্দা। আমাকে বসতে বলে ভদ্রলোক সেই পর্দার কাছে গিয়ে অনুচ্চ গলায় বললেন, “যশ, আওয়ার ইয়াং ম্যান ইজ্ হিয়ার।” 

ভিতরের ঘর থেকে পরক্ষণেই যিনি বেরিয়ে এলেন, তাঁর মতো রূপবতী রমণী হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন, কিন্তু আমি অন্তত তার আগে আর দেখিনি। বয়স, মনে হল, পঁয়তিরিশের বেশি হবে না। বেশভূষায় আতিশয্য নেই। পরনে হাল্কা পেঁয়াজ-রঙের পাড়-ছাড়া শিল্কের শাড়ি, গলায় খুবই সরু একটা সোনার চেন, দু’হাতে দু’গাছি সোনার চুড়ি, পায়ে মখমলের স্লিপার। চুলে পাক ধরেনি, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। 

ভদ্রলোক বললেন, “শি ইজ দ্য কুইন মাদার অভ্ বিষাণগড়, রানি যশোমতী দেবী। … অ্যান্ড যশ, হিয়ার ইজ মিঃ কিরণ চ্যাটার্জি, দ্য ইয়াং ম্যান হু অ্যাপ্লায়েড ফর দ্যাট পোস্ট আন্ড হুম য়ু হ্যাভ কল্ড।” 

রানি-মা এ-ঘরে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। তিনি আমাকে বসতে বললেন, নিজেও বসলেন, তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দীপ, তুমি একবার পামেলার ঘরে যাও। গিয়ে দ্যাখো, ওকে যে চিঠিগুলো টাইপ করতে বলেছিলুম, সেগুলো রেডি হল কি না। ওগুলো আজই ছাড়তে হবে।” 

ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। 

রূপ নানা রকমের হয়। কিছু রূপ আমাদের প্রীতি উৎপাদন করে, কিছু দেখে আমরা মুগ্ধ হই, আবার কিছুর উপরে চোখ পড়তেই আমাদের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবার শব্দ শোনা যায়। 

বাসন্তী আমার কোনই কথাই বিশ্বাস করে না। এটাও সম্ভবত করবে না। তবে সেটাই এক্ষেত্রে আমার পক্ষে নিরাপদ। তাই নিঃসংকোচে বলি, রানি যশোমতী এসে ঘরে ঢুকবার মুহূর্ত থেকেই আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলুম, নিশ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। 

রানি-মা কয়েক মুহূর্ত দেখলেন আমাকে। তারপর বললেন, “যার জন্যে আপনি দরখাস্ত করেছেন, সেটা খুব উঁচু দরের চাকরি নয়, কেয়ারটেকারের কাজ, মাস-মাইনে মাত্র তিনশো টাকা। নর্মালি এ-সব চাকরির ইন্টারভিউ আমার নেবার কথা নয়। তা হলে নিচ্ছি কেন? কী মনে হয় আপনার?” 

বললুম, “আন্দাজ একটা করতে পারি। তবে সেটা ভুলও হতে পারে।” 

“বলুন।” 

“চাকরির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, কেয়ারটেকারকে রাজবাড়ির আউটহাউসে। থাকতে হবে। কিন্তু আউটহাউস হলেও সেটা তো রাজবাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যেই। তাই না?” 

“হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কী হল?” 

“আমার ধারণা, নিজে কথা বলে যতক্ষণ না কারও সততা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন, ততক্ষণ আপনি বাইরের কাউকে প্যালেস-কম্পাউন্ডের ভিতরকার কোনও চাকরিতে ঢোকাতে চান না।” 

“এ ভেরি ইনটেলিজেন্ট গেস্।” রানি-মা মৃদু হাসলেন। “এবারে দু-একটা কাজের কথা বলি। দরখাস্তের সঙ্গে যে-সব টেস্টিমোনিয়াল পাঠিয়েছেন, তার একটা পড়ে মনে হল, আর্কিটেকচার সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু পড়াশুনো করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনার জ্ঞান মোটামুটি নির্ভরযোগ্য। কিন্তু আপনার কাজ তো রাজবাড়িতে। তার জন্য স্পেশ্যালাইজড নলেজ চাই। প্যালেস-আর্কিটেকচার সম্পর্কে কিছু পড়েছেন?” 

বললুম, “ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব প্রাসাদ নিয়ে বছর দশেক আগে লন্ডন থেকে একটা বই বেরিয়েছিল। তাতে প্রাসাদগুলির ছবি তো ছিলই, সেইসঙ্গে ছিল তাদের স্থাপত্যশৈলীর আলোচনা। বইখানা পড়েছি।” 

“বইখানার নাম যদ্দুর মনে করতে পারছি ‘দ্য আর্কিটেকচারাল ইউনিকনেস অভ দ্য প্যালেসেস অভ ইন্ডিয়া।’ তাই না?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” 

“ওতে কাজ হবে না।” রানি-মা’র ঠোঁট বিদ্রুপে বেঁকে গেল। “এ-সব বিলিতি পাবলিশারদের আমি চিনি তো, অল দে ওয়ন্ট টু ডু ইজ টু কিপ বিকানির মাইসোর বরোদা ভোপাল অ্যান্ড জয়পুর ইন গুড হিউমার। আপনি যদি বিকানির মাইসোর বরোদা ভোপাল কি জয়পুরের চাকরি নিতেন তো ও-বই আপনার কাজে লাগত। কিন্তু আপনি তো বিষাণগড়ে কাজ করতে চাইছেন। 

বললুম, “বিষাণগড়ের প্যালেস নিয়েও ও-বইয়ে বেশ ক’পাতার একটা রাইট-আপ আছে কিন্তু।”

“তা আছে ঠিকই, কিন্তু যে ওটা লিখেছে, হি নোজ নেক্সট টু নাথিং অ্যাবাউট আওয়ার প্যালেস। বিষাণগড় রাজবাড়ি নিয়ে সত্যি যদি আপনি কিছু জানতে চান, তো আপনাকে ডঃ সিদ্দিকির বই পড়তে হবে।” 

অকপটে স্বীকার করলুম যে, ডঃ সিদ্দিকির নাম পর্যন্ত আমি শুনিনি। 

রানি-মা তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না। বললেন, “সেট অস্বাভাবিক নয়। ভদ্রলোক তো আর চতুর্দিকে নিজের ঢাক পিটিয়ে ঘুরে বেড়ান না, তাই শোনেননি। বাট হি ইজ আ প্রোফাউন্ড স্কলার। ইতিহাসের অধ্যাপক, বম্বে ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন, রিটায়ার করে এখন বিষাণগড়েই আছেন। আমাদের ওখানে ওঁরা সাতপুরুষের বাসিন্দা। ওঁর বাপ-ঠাকুর্দা, এমনকি ঠাকুর্দার বাবাও আমাদের রাজ-এস্টেটে কাজ করতেন।” 

ভদ্রমহিলার আরও কিছু প্রশ্ন ছিল। অধিকাংশই মধ্যপ্রদেশ সম্পর্কে। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, বিষাণগড় তো সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার একটা দেশীয় রাজ্য। প্রশ্নগুলির বেশির ভাগেরই যে নির্ভুল উত্তর দেওয়া গেল, তার কারণ ইন্টারভিউয়ের চিঠিখানা হাতে আসবার পর থেকে মধ্যপ্রদেশের ভূগোল আর ইতিহাসই ছিল আমার প্রধান পাঠ্য বিষয়। 

রানি-মা’র শেষ প্রশ্নটার সঙ্গে অবশ্য মধ্যপ্রদেশ কেন, ভারতবর্ষেরই কোনও যোগ-সম্পর্ক ছিল না।

“ধরুন আমাদের প্যালেসের একটা উইং নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি আলোচনা করছি। ধরুন, প্যালেসের সেই অংশটা কীভাবে সাজানো হবে, তাই নিয়ে কথা হচ্ছে। তা সেই সময়ে যদি আমি ‘কুইন অ্যান্’ কি ‘লুই দ্য ফোরটিনথ্’-এর উল্লেখ করি, তো আপনি কী বুঝবেন?”

কপালগুণে উত্তরটা আমার জানা ছিল। বললুম, “ফার্নিচারের কথা বুঝব। সেই আমলের ফার্নিচারের কথা।” 

রানি-মা হাসলেন। বললেন, “ভেরি গুড। তবে কিনা চাকরিটা যে আপনার হবেই, তা কিন্তু এখুনি আমি বলছি না। চারজনকে আমরা ডেকেছি। আপনাকে নিয়ে তিনজনের সঙ্গে কথা হল। আর-একজন বাকি। তিনি বিকেলের দিকে আসবেন।” 

ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সেই গুল্ফবান ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। দরজার বাইরে করিডরেই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বেরিয়ে আসতেই তিনি ভিতরে ঢুকে গেলেন। 

রানি-মাকে ইনি ‘যশ’ বলেন, আর রানি-মা এঁকে ‘দীপ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ভদ্রলোকের পুরো নামটা জানা হল না। বিষাণগড়ের রাজবাড়ির সঙ্গে এঁর সম্পর্ক কী, তাও না। 

গ্র্যান্ড হোটেল থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এসে চৌরঙ্গি রোডের জনস্রোতের মধ্যে আমি মিশে গেলুম। 

ইন্টারভিউ হয়েছিল ছেচল্লিশের জানুয়ারির মাঝামাঝি। তারপর এক সপ্তাহ কাটল, দু’সপ্তাহ কাটল, ওঁদের দিক থেকে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। তাতে যে খুব অবাক হয়েছিলুম, তা নয়, কেননা, ওই যে আগেই বলেছি, গোড়ার থেকেই ধরে রেখেছিলুম যে, এ-চাকরি আমার হবার নয়, হবেও না 

বরং ফেব্রুয়ারির গোড়ায় একদিন বাড়িতে পিওন এসে, আমাকে দিয়ে সই করিয়ে, যে রেজিস্টার্ড চিঠিখানা দিয়ে গেল, খাম খুলে সেই চিঠি পড়েই আমি তাজ্জব বনে গিয়েছিলুম। মোটা ব্রোমাইড পেপারে টাইপ করা চিঠি। “ডিয়ার স্যার, উই আর গ্ল্যাড টু ইনফর্ম ইউ….” 

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আরও একটা খুশির খবর ছিল। বিজ্ঞাপনে যদিও বলা হয়েছিল যে, মাস-মাইনে তিনশো টাকা, এঁরা আমাকে সাড়ে তিনশো দেবেন। প্রথম তিন বছর সেটা পঞ্চাশ টাকা করে বাড়বে, তারপর থেকে বাড়বে বছরে পঁচাত্তর টাকা করে। বিজ্ঞাপনে যা বলে দেওয়া হয়েছিল, নিয়োগপত্রেও তার উল্লেখ দেখলুম। ফুড আর লজ-এর ব্যবস্থা করা হবে প্যালেস থেকেই, তার জন্য আমার মাইনে থেকে কিছু ‘ডিডাক্ট’ করা হবে না। 

কিন্তু আমাকে কাজে যোগ দিতে হবে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই। যদি রাজি থাকি, তা হলে যেন কবে আমি বিষাণগড়ে পৌঁছচ্ছি, পত্রপাঠ তা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিই; সেই অনুযায়ী স্টেশনে আমার জন্য লোক রাখা হবে। 

একে অজানা জায়গা, তায় একা যাচ্ছি, তায় আবার সেখানে না আছে আত্মীয়স্বজন, না বন্ধুবান্ধব কী খেতে দেবে, তা আমার সহ্য হবে কি না, কে জানে। তার উপরে আবার মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বললেন, “কেন, এত-এত লোক এই কলকাতায় চাকরি-বাকরি করছে, আর তোর একটা চাকরি হবে না?” 

বললুম, “চাকরি তো করছিই, বেকার। তা আর নই, কিন্তু মাইনেটাই যে পাচ্ছি না।” 

“তাই বলে কলকাতা ছেড়ে এই বয়সে একা-একা বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে থাকবি?” 

বাবা হেসে বললেন, “ওই তো তোমার মুশকিল, হাওড়া ইস্টিশন থেকে গাড়ি ছাড়লেই চতুর্দিকে তোমার বিদেশ-বিভুঁই শুরু হয়ে যায়। না না, ওকে বাধা দিও না। চাকরি বলে কথা কী, দেশটাকে চেনাও তো চাই। সব দেখুক, সব চিনুক, তাতে ওর ভালই হবে।”

দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। আমার নীচে এক ভাই আর এক বোন। তারা এখনও ইস্কুলের গণ্ডি ছাড়ায়নি। রাজবাড়িতে চাকরি করতে যাচ্ছি শুনে তারা বলল, “ভালই তো, রাজবাড়ির কাজ যখন, তখন দু’বেলা নিশ্চয় রাজভোগ খাওয়াবে। তবে ও-সব খেয়ে আবার আমাদের কথা ভুলে যেয়ো না কিন্তু।” 

মা প্রথমটায় কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বাবার কথায় রাজি হলেন। 

কিন্তু বিষাণগড়ে যাব কী করে? জায়গাটা যে মধ্যপ্রদেশে, শুধু এইটুকুই তো জানি। কোন্ ট্রেন ধরে কীভাবে সেখানে পৌঁছতে হয়, মাঝপথে কোথাও ট্রেন পালটাতে হয় কি না, কিছুই তো জানা নেই। 

মা বললেন, “তুই বরং সুরেশের সঙ্গে দেখা কর। সে রেলের চাকরি ক…। আমার ধারণা, সে-ই তোকে সব বলে দিতে পারবে।” 

সুরেশ মুখুজ্যে আমার মেসোমশাই। হাওড়া ইস্টিশানের দোতলায় বসেন। সেখান গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলুম। সব শুনে তিনি বললেন, “বেশ, বেশ, বাইরে যাচ্ছ, এর চেয়ে ভাল কথা আর কী হতে পারে! বাঙালির ‘ঘরকুনো’ বদনামটা যদি তোমরা ইয়াং ম্যানরা না ঘোচাও, তা হলে তো এ-জাতটার ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার।” 

বদনামটা ঘোচাবার জন্য বিষাণগড়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু যাব কী করে? 

মেসোমশাই বললেন, “তা তো জানি না বাবাজীবন। আমি তো ই. আই. আর.-এ চাকরি করি, আর তোমাকে যেতে হবে বি. এন. আর. লাইনে। ও-লাইনের খবর তো আমার জানা নেই।” 

“তা হলে?” 

মেসোমশাই একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “দাঁড়াও, একটা উপায় কি আর হবে না? হবে। তবে কিনা এক্ষুনি হবে না। তুমি বরং বাড়ি চলে যাও। উপেনকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিয়ে আমি নাহয় রাত্তিরে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে সব জানিয়ে আসব।” 

কে উপেন, কিছু বুঝতে পারলুম না। বেজার হয়ে বাড়ি ফিরলুম। মাকে সব বলতে তিনি বললেন, “উপেনকে চিনিস না? সুরেশের পিসতুতো ভাই। বি. এন. আর.-এ চাকরি করে। অনেকদিন রায়পুরে ছিল, বছর দেড়েক হল কলকাতার আপিসে বদলি হয়েছে। বয়েসে সুরেশের চেয়ে ছোট হলে কী হয়, অনেক বেশি তুখোড়।” 

মেসোমশাই এলেন রাত ন’টায়। এসে বললেন, “উপেনের কাছে শুনে যা বুঝলুম, তোমার পথটা তো মোটেই সুবিধের নয় হে।” 

বললুম, “ট্রেনে যাব, এতে আবার অসুবিধের কী আছে?” 

“নেই?” মেসোমশাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে শোনো। রেলগাড়িতে উঠলুম আর ঘুমিয়ে রাত কাবার করে বিষাণগড়ে গিয়ে নামলুম, এ অত সহজ ব্যাপার নয়। সবচেয়ে মুশকিল কী জানো, বিষাণগড় আসলে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের আওতার মধ্যেই পড়ছে না।” 

“তা হলে?” মা জিজ্ঞেস করলেন, “ও সেখানে যাবে কী করে?” 

মেসোমশাই বললেন, “যাওয়া কি আর যাবে না, যাবে। তবে কিনা একটু কষ্ট করে যেতে হবে। খানিকটা পথ অবশ্য যেতে হবে ওই বিন. এন. আর. লাইনের বোম্বে মেলেই।” 

“কোন্ পর্যন্ত?” 

“রায়পুর পর্যন্ত। বোম্বে মেল সেখানে রাত্তিরে পৌঁছবে। সেখানে …”

“গাড়ি পালটে বিষাণগড়-লাইনের ট্রেন ধরতে হবে, এই তো?” মেসোমশাইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসতে-হাসতে বললুম, “এ আর এমন শক্ত কী। আমার সঙ্গে তো আর রাজ্যের লটবহরও থাকছে না। একটা সুটকেশ, একটা শুজনি আর একটা বালিশ, বাস্। যত রাত্তিরই হোক, লাইন পালটে করেসপন্ডিং ট্রেনে ঠিকই উঠে পড়তে পারব।” 

হাঁ করে আমার কথাগুলি শুনে গেলেন মেসোমশাই। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুঝলেন সেজদি, আজকালকার ছেলেছোকরাদের নিয়ে এই হয়েছে ফ্যাসাদ, এরা ভাল করে অন্যের কথাটা পর্যন্ত শুনতে চায় না।” তারপর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে ঝাঁঝালো গলায়, “আরে, করেসপন্ডিং ট্রেনে যে উঠবে, বিষাণগড়ের সেই ট্রেনটা তুমি ওখানে পাচ্ছ কোথায়?” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কী, রাতটা তোমাকে রায়পুর ইস্টিশানের ওয়েটিং রুমেই কাটাতে হবে। তা কোন্ ক্লাসে যাচ্ছ? থার্ড ক্লাসেই তো?” 

“অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে বলেছে যে, ইন্টার ক্লাসের ভাড়া দেবে। তা হলে আর থার্ড ক্লাসে যাব কেন?” 

“ঠিক আছে, টাকা যখন বাঁচাতে চাও না, তখন ইন্টারেই যাও। সেটাই অনেস্ট কাজ। কিন্তু ইন্টারের ওয়েটিং রুমও তো বিশেষ সুবিধের হবে না, বাবাজীবন। তাই একটা মতলব ঠাউরেছি। উপেন একটা চিঠি লিখে দেবে অখন, সেটা সঙ্গে নিয়ে যেয়ো। সে তো ওই রায়পুর ইস্টিশানেই পুরো পাঁচটা বছর কাটিয়ে এসেছে, সেখানকার রেলের লোকেরা সবাই তাকে চেনে। রায়পুরের মাস্টারমশাইকে যদি চিঠিখানা দেখাও, তা হলে তিনি ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে দেবেন। সাহেব-সুবো প্যাসেঞ্জার থাকলে অবিশ্যি ঝঞ্ঝাট বাধে, তবে থাকবে বলে মনে হয় না। নিশ্চিন্তে ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারবে।” 

“তারপর?” 

“তারপর সকালবেলায় মুখহাত ধুয়ে চা-জলখাবার খেয়ে বাসে উঠতে হবে। বাস ছাড়বে ইস্টিশনের বাইরে থেকেই। যাবে ভিরিন্ডি পর্যন্ত। মাইল পঞ্চাশেক পথ। পৌঁছতে পৌঁছতে বারোটা। দুপুরের খাওয়াটা চটপট সেখানেই খেয়ে নিয়ো। 

“তা না হয় নিলুম, কিন্তু ভিরিন্ডি পর্যন্ত যাব কেন?” 

মেসোমশাই বললেন, “না গিয়ে উপায় কী, বিষাণগড় লাইট রেলওয়ের ট্রেন তো ওই ভিরিন্ডি থেকেই ছাড়ে। ওখান থেকে বিষাণগড় যে খুব দূরপাল্লার পথ, তা নয়। তবে লাইট রেলওয়ের ব্যাপার তো, আমাদের এই হাওড়া-আমতা লাইনের গাড়ির মতোই নাকি ঢিকুস-টিকুস করে চলে। উপেন অন্তত সেই কথাই বলল। বিষাণগড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে তোমার তা প্রায় পাঁচ-ছ ঘণ্টা লেগে যাবে। পথে কোনও খাবার তো দূরের কথা এক কাপ চা পর্যন্ত পাবে না।” 

অবাক হয়ে মা বললেন, “সে কী, চা পর্যন্ত পাওয়া যাবে না, সে আবার কেমন কথা?” 

“কী করে পাওয়া যাবে,” মেসোমশাই বললেন, “ভিরিন্ডি থেকে বিষাণগড়, গোটা পথটাই শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। উপেনের কাছে শুনলুম, এটা একেবারে ষোলো-আনা ট্রাইবালদের এলাকা। আদিবাসীরা থাকে, আর থাকে বাঘ-ভাল্লুক।” 

“ওরে বাবা, সেখানে গিয়ে চাকরি করতে হবে?” 

বললুম, “উপায় কী, চাকরির বাজার যেভাবে গুটিয়ে আসছে, তাতে না-যাওয়াটা খুব বোকামির ব্যাপার হবে।” 

“তাই বলে ওই জঙ্গুলে জায়গায় যাবি? বলি চাকরি বড়, না মানুষের প্রাণটা বড়?” 

মেসোমশাই বললেন, “যেতে দেবেন না সেজদি, যেতে দেবেন না। আরে, গত বছর আমাকে মোগলসরাইয়ে বদলি বরেছিল, তাও পর্যন্ত গেলুম না, পাড়ার এর ছোকরা ডাক্তারকে দিয়ে একটা ফল্স সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিয়ে তারপর বড়সাহেবকে সেইটে দেখিয়ে বদলিটা রদ করিয়ে ছাড়লুম, আর এ কিনা সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ায় যাবার জন্যে নাচছে!” 

আমি তো হতভম্ব। এই মানুষটিই আজ দুপুরবেলায় কিনা বাঙালির ঘরকুনো বদনামটা ঘোচাতে বলছিলেন! 

বাবা অসুস্থ মানুষ। এতক্ষণ তিনি একটা কথাও বলেননি। চুপচাপ মা আর মেসোমশাইয়ের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এবারে বললেন, “তোমরা এত বাধা দিচ্ছ কেন? যেতে যখন চাইছে, যাক না। যদি ভাল না লাগে, ফিরে আসবে।” 

এর পরে আর কথা বিশেষ এগোল না। চা-জলখাবার খেয়ে মেসোমশাই উঠে পড়লেন। যাবার আগে বললেন, “দাদা এক হিসেবে ঠিক কথাই বলেছেন। জায়গাটা যদি পছন্দ না হয় তো ফিরে এলেই হল। কেউ তো আর ওকে শেকল দিয়ে সেখানে বেঁধে রাখছে না।” 

তাও যে রাখতে পারে, অন্তত তার চেষ্টা যে একটা হতে পারে, তখন কি আর তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিলুম? পারলে আমি বিষাণগড়ের পথে পা বাড়াতুম না। 

বাবার অনুমতি মিলেছে, এই আনন্দেই তখন আমি মশগুল। নিয়োগপত্রে বলা হয়েছে, আমাকে বিষাণগড়ে গিয়ে কাজে যোগ দিতে হবে ‘বাই দ্য ফিফ্‌টিথ অভ ফেব্রুয়ারি’। যেখানে কাজ করছি, সেখানে এক-মাসের নোটিস দিলে ভাল হত। কিন্তু যারা মাইনেই দিতে পারছে না, তারা কি আর নোটিসের জন্যে ঝুলোঝুলি করবে। কে জানে, এই যে আমি সেখানকার কাজ ছেড়ে দিচ্ছি, তাতেই হয়তো তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাববে যে, যাক, ঘাড় থেকে অন্তত একটা বোঝা নামল। কিছু কেনাকাটা অবশ্য করা দরকার। কিন্তু তার জন্যে একটা দিনই যথেষ্ট। জামাকাপড় কাচিয়ে নিতে বড়জোর আর তিনটে দিন। ভেবে দেখলুম, ইচ্ছে করলে দশ তারিখেই আমি নতুন কাজে জয়েন করতে পারি। কিন্তু তাতে আবার না আমার তরফে বড্ড-বেশি গরজ প্রকাশ পায়। ঠিক আছে, যে ডেডলাইন দেওয়া হয়েছে, তার একদিন আগে, চোদ্দ তারিখে, আমি বিষাণগড়ে পৌঁছব। 

জি.পি.ও. থেকে পরদিনই সেই মর্মে একটা টেলিগ্রাম ছেড়ে দিলুম। 

.

রায়পুরে গাড়ি থামল রাত আটটায়। গাড়ি এখানে অনেকক্ষণ থেমে থাকে। কেননা, এই স্টেশন থেকেই কামরায়-কামরায় রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। ইন্টার ক্লাস কামরা থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখলুম, উর্দি-পরা তকমা-আঁটা খানসামারা বম্বে মেলের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। 

মেসোমশাইয়ের সেই ভাই ঠিকই চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। চিঠিখানা যে সঙ্গে করে আনিনি, তাও নয়। কিন্তু আমি ইন্টার ক্লাসের প্যাসেঞ্জার, ফার্স্ট ক্লাসের সুবিধে নিতে সংকোচ হচ্ছিল। তা ছাড়া ইন্টার ক্লাসের ওয়েটিং রুমে উঁকি মেরে দেখলুম যে, সেখানেও বিশেষ ভিড়ভাট্টা নেই, অন্তত এক কোণে একটা বেতের আর্মচেয়ার খালি পড়ে রয়েছে। তার উপরে শুজনি বিছিয়ে শুয়ে পড়া গেল। চামড়ার সুটকেসটা রেখেছিলুম পায়ের কাছে। যাতে তার উপরে পা রেখে শোয়া যায়। তাতে একদিকে যেমন আরাম করে শোয়া গেল, অন্যদিকে তেমন নিশ্চিন্ত রইলুম যে, সুটকেসটা চুরি যাবে না। 

সারাটা দিন টুকটাক খাবার নেহাত কম খাইনি। স্টেশনে-স্টেশনে চাও সম্ভবত একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সেই কারণেই খিদে বিশেষ ছিল না। সঙ্গে একটা ম্যাগাজিন ছিল, সেটার উপর চোখ বুলোতে বুলোতেই এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। 

ঘুম ভাঙল ভোর ছ’টায়। আগের রাত্তিরেই খবর নিয়ে জেনেছিলুম যে, আটটা নাগাদ স্টেশন চত্বরের বাইরে থেকে ভিরিন্ডির বাস ছাড়বে। ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা-শহরে শীত বিশেষ থাকে না, সকালে সন্ধ্যায় আর রাত্তিরে তেমন গরম বোধ না হলেও দুপুরের দিকে বাতাস মোটামুটি তেতে উঠতে আরম্ভ করে। এখানে কিন্তু ফেব্রুয়ারিতেও দেখলুম বেজায় শীত। তারই মধ্যে জমাদার ডেকে, তাকে আস্ত একটা সিকি বখশিস করে ওয়েটিং রুমের বাথরুমটা পরিষ্কার করিয়ে নিয়ে, শুধু মুখেচোখে জল দেওয়া আর দাড়ি কামানো নয়, স্নানটাও চুকিয়ে ফেলা গেল। 

স্টেশন-চত্বরের বাইরেই চায়ের দোকান। পরপর কয়েকটা চালাঘর। তারই একটার সামনের বেঞ্চিতে বসে এক প্লেট পুরি-তরকারি আর দু’ খুরি চা খেয়ে যখন ভিরিন্ডির বাসে উঠলুম, ঘড়িতে তখন পৌনে আটটা। 

বাস ঠিক আটটাতেই ছাড়ল। রায়পুর খুব বড় শহর নয়, শহরের চৌহদ্দি ছাড়াতেও তাই খুব সময় লাগল না। তারপরেই রাস্তা একেবারে ফাঁকা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু মিলিটারি ট্রাকের আনাগোনা তখনও খুব কমেনি। দু’চারটে তাঁবু আর কাঁটাতারের বেড়াও মাঝে-মাঝে চোখে পড়ছিল। সৈন্যদের একটা মস্ত ছাউনি যে এখানে ছিল, সেটা জানতুম। মনে হল, ধীরে-ধীরে সেটা গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিস্তর শালগাছও যে পথের দু’দিকে দেখতে পাচ্ছিলুম না, তা নয়, তবে যাকে জঙ্গল বলে, ভিরিন্ডি পৌঁছবার আগে পর্যন্ত সেটা বিশেষ দেখিনি। 

বারোটায় পৌঁছবার কথা ছিল, কিন্তু বাসও চলছিল ঢিকুস-টিকুস করে। তাই ভিরিন্ডিতে পৌঁছতে-পৌঁছতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এখান থেকে লাইট রেলওয়ের ট্রেন ছাড়বে দেড়টায়। হাতে পুরো এক ঘণ্টা সময়। টিকিট কেটে স্টেশনের বাইরের একটা খাপড়ার চালের ঘরের সামনে তাই বসে পড়া গেল। সেটাই এখানকার একমাত্র হোটেল। দুপুরের খাওয়া সেখানেই সেরে নিলুম। খাওয়া মানে মোটা চালের ভাত, সেইসঙ্গে দুখানা বাজরার রুটি, দু’হাতা ডাল আর কুঁদরির একটা ছেঁচকি-জাতীয় জিনিস। পাশের চায়ের দোকান থেকে চা’ও নিয়ে নিলুম ফ্লাস্ক ভর্তি করে। শুনেছিলুম, এখান থেকে বিষাণগড় পর্যন্ত পথে আর কিছু পাওয়া পাবে না। তা ফ্লাস্ক-ভর্তি চা যখন রইল, তখন আর অন্য-কিছুর দরকারই বা কী। মোটামুটি ফাঁকা একটা কামরায় উঠে জানলার ধারে বসে পড়লুম।

ঘণ্টা পড়ল। গার্ডসাহেব সবুজ পতাকা দেখাতে লাগলেন। হুইসল দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে, খেলনা-রেলগাড়ি তার যাত্রা শুরু করল। আর তার খানিক বাদেই শুরু হয়ে গেল জঙ্গলের রাজত্ব।