বিষঘ্ন – ৩

অনিলের জিপটা চলে যাওয়া মাত্র ভাস্করের মনে হল এবার একটু ভারী বয়সের পোশাক পরা দরকার। সে হোটেলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসতেই সামনে দাঁড়াল পদম বাহাদুর, সেলাম সাহেব।

ভাস্কর হাসল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

আরে বাপ! আপনাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তামাম শহরে। এখন দেখছি খোদ এস-পি সাহেবের জিপ থেকে নামছেন। ওই জিপ দেখতে পেলে আমরা ত্রিসীমানায় আসি না। এস-পি সাহেব আপনাকে যখন নামাতে এসেছিল তখন আপনি আরও ভারী অফিসার। হুকুম করুন সাব এখন আমাকে কী করতে হবে? পদম সোজা হয়ে দাঁড়াল।

তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর। আমি হোটেল থেকে ঘুরে আসি।

নিজের ঘরের দরজা খুলতে গিয়ে ভাস্কর শুনল পাশের ঘরের দরজাটা খুলে গেল। তারপর টলায়মান পায়ে শাজাহান যেন এগিয়ে এল, কী ব্যাপার স্যার?

গুরুদেব হাওয়া হয়ে গেলেন?

হ্যাঁ বিকেলে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে মালপত্র নিয়ে উধাও।

হোটেল চেঞ্জ করেননি তো?

না-না। আমি নিজে ওঁকে লাস্ট বাসে তুলে দিয়েছি। আর হ্যাঁ, এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলে গিয়েছিলেন। শাজাহানের কাঁপা হাত থেকে খামটা নিয়ে ছিঁড়ল ভাস্কর। সাদা কাগজে গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে, মহিলা মারাত্মক। চোখের সামনে যা দেখলাম তারপর আর এই শহরে থাকা আমার পক্ষে সেফ নয়। উদোর পিন্ডি চিরকালই বুধোর ঘাড়ে পড়ে। মুচকি হেসে চিঠিটা পকেটে রেখে দরজা খুলল সে। শাজাহানকে কোনও কথা বলার সুযোগ দিল না ভাস্কর। অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন গুরুদেব। স্থান ত্যাগ করেও তিনি হোটেলে ফিরে আসেননি। কোনও আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, নাটকটা দেখার পর মনে হয়েছে ছেলেটির পড়ে যাওয়ার পেছনে সম্মোহন কাজ করেছে। আর ঝুঁকি নিতে চাননি ভদ্রলোক। ভালোই হল। লোকটা যা করত সেটার দ্বিতীয় অংশে অপরাধ ছিল। চাপ দিয়ে টাকা আদায় করা আইনের চোখে অন্যায়। কিন্তু সম্মোহনের প্রভাবে যদি কেউ ভেতরের কথা বলে দেয় তাহলে আইনের কিছু করার আছে কি না বলা শক্ত। তবে লোকটা ঠিক সময়ে বিদায় নিয়েছে।

জামাকাপড় পাল্টে বাইরে এল। তার আগ্নেয় অস্ত্রটিতে ছটি গুলি আছে। ঈশ্বর করুন, এগুলোর একটাও যেন তাদের স্থান ত্যাগ না করে। এখন ভাস্করের পরনে র্যাংলারের জিনিস, স্কিন টাইট চামড়ার জ্যাকেট, মাথায় ঠান্ডা থেকে বাঁচবার জন্যে বারান্দা দেওয়া টুপি। শাজাহান সেনের সঙ্গে সে ইচ্ছে করেই দেখা করল না। ফালতু কিছু সময় নষ্ট হবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে লোকটা এখানে আসে শুধু মদ্যপান করতে। মানবচরিত্র বুঝতে চাওয়া ঈশ্বরেরও অসাধ্য!

পদম বাহাদুর চটপট চলে এল, সেলাম সাহাব। ভাস্কর বুঝতে পারছিল ওর চোখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যেন হিন্দি ছবির কোনও নায়ককে সে চোখের সামনে দেখছে। ভাস্কর বলল, সেই মদের দোকানে যাব। তোর সঙ্গে ছুরিটা আছে তো?

জি সাব! যেন একটা কাজের ইঙ্গিত পেল পদম।

পদমকে পায়ের গোড়ালিতে নিয়ে ভাস্কর ম্যাল রোডে যখন উঠে এল তখন বড় দোকানগুলোয় ঝকঝকে আলো জ্বলছে। উল্টো রাস্তা দিয়ে নামতে-নামতে পদম বলল, সাহেব আমাকে কি ভেতরে ঢুকতে হবে? ভাস্কর মাথা নাড়ল।

কিন্তু সাহেব, আমি তিব্বতিদের মদ সহ্য করতে পারি না।

করতে হবে না।

অর্থ ধরতে পারল পদম। ভাস্করের সঙ্গে হাঁটার তাল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল সে। এই পথে আলো আছে। কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই চারধার কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। পাশের বাড়িগুলোয় কোনও শব্দ নেই। এই শহরে রাত আসে সন্ধের ঘাড়ে চেপে। এবং এলেই মানুষজন ঝিমিয়ে পড়ে।

খুশ মেজাজী পানশালার সামনে এসে পদমের পা থেমে গেল। ভাস্কর বলল, কী হল?

আমাকে ভেতরে যেতেই হবে সাব?

ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে মায়া হল ভাস্করের। সে জিগ্যেস করল, তোর মতন মস্তান ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে কেন?

একটা গোলমাল হয়েছিল তিন মাস আগে ওখানে। তারপর ওদের বারম্যান জোহাং বলে দিয়েছিল আমি যেন ভেতরে আর না ঢুকি। ও শালা ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে।

ঠিক আছে। আমার বন্দুকের আওয়াজ শুনলেই তুই চলে আসবি। আমি খুব বিপদে না পড়লে আওয়াজ করব না।

ভাস্কর আর দাঁড়াল না। মিসেস শেরিংয়ের গাড়িটাকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার একটা ধারে পার্ক করা আছে। ভেতরে আলো জ্বলছে। ফাঁকা বারান্দায় পা দিয়ে দরজাটা ঠেলতেই তীব্র মদের গন্ধ নাকে এল। সোজা ভেতরে ঢুকতেই স্প্রিং-এর চাপে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এখন প্রায় প্রতিটি টেবিল ভর্তি। প্রত্যেক টেবিলে একজন করে বসে পান করছে। একটা বাজনা বাজছে রেকর্ডে। যারা খাচ্ছে তারা কোনও কথা বলছে না। কাউন্টারের দিকে তাকাল সে। সকালের সেই স্বাস্থ্যবান লোকটি নেই। তার বদলে যে খদ্দেরদের দেখছে তাকে চিনতে পারল ভাস্কর। আজ সকালেই সে অজ্ঞান করে রেখেছিল। তার মানে শেরিংদের বাড়ির প্রহরী বদল হয়েছে। আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বাসী লোক ওখানে গিয়েছে পানশালা ছেড়ে।

বসার জায়গা না পেয়ে সে সামনে পা বাড়াতে বারম্যান মুখ তুলে তাকাল। লোকটার পক্ষে তাকে চেনা মোটেই সম্ভব হবে না। কারণ সে ওকে পেছন থেকে আঘাত করেছিল। কাউন্টারে পৌঁছে সে মেজাজে বলল, এ কেমন বার যেখানে বসার জায়গা পাওয়া যায় না! আমি কি দাঁড়িয়ে খাব? লোকটা তার চেরা চোখে দেখল, এরা সব রেগুলার কাস্টমার। দাঁড়িয়ে খেতে না ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারেন।

আমি তো চলে যেতে আসিনি।

লোকটা একটু অবাক হয়ে ভাস্করকে দেখল। ভাস্কর বলল, ভেতরে তো অনেক ঘর দেখছি। তার একটায় চেয়ার নিয়ে বসতে পারি।

ওখানে বসার জায়গা নেই। খেতে হলে এখানেই, নইলে কেটে পড়ো। ঝামেলাবাজ লোকদের জন্যে আমার অন্য ব্যবস্থা আছে।

তাই নাকি? আমি ওই ঘরটায় বসব। ইঙ্গিতে কাউন্টারের পেছনের একটা ঘর দেখাল ভাস্কর।

কী? মেমসাহেবের ঘরে? চটপটে হাতে লোকটা কাউন্টারের নিচ থেকে একটা রবার জড়ানো রড বের করতেই ভেতর থেকে জুলি শেরিং বেরিয়ে এলেন, হোয়াটস দ্য প্রব্লেম?

বারম্যান কিছু বলার আগেই ভাস্কর বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

হু দ্য হেল য়ু আর?

ভাস্কর আশ্বস্ত হল। যাক ভদ্রমহিলা হয়তো টুপি এবং স্থানের জন্যেই তাকে এখনও চিনে উঠতে পারেননি।

আপনার স্বামীর ইনসুরেন্স-এর ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন ছিল।

ইনসুরেন্স?

ভাস্কর পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে খুলে মহিলাকে দেখাল। এক মুহূর্ত দ্বিধা। তারপর জুলি শেরিং মাথা নেড়ে বললেন, ভেতরে আসুন। তারপরেই তিব্বতি ভাষায় কিছু নির্দেশ বারম্যানকে দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। বারম্যান তখনও তীব্র চোখে ভাস্করকে দেখছে। ভাস্কর আর ইতস্তত না করে কাউন্টারের সুইংডোর খুলে ভেতরে পা দিল।

দরজায় এসে দাঁড়াতেই সে দেখল একটা বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসে আছেন জুলি। তাকে দেখামাত্র উলটোদিকের একটা বেয়ারা ইশারা করে বলল, বসুন।

ভাস্কর দেখল ঘরে আর-একটা দরজা আছে। আসবাব বলতে ওই টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। দেওয়ালে এক টিবেটিয়ান বৃদ্ধের ছবি। সম্ভবত উনিই মিস্টার শেরিং। পাকানো জীর্ণ শরীর।

আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো!

এই টুপি এবং চামড়ার জ্যাকেট বিভ্রান্তি এনেছে। সে ধীরে টুপিটা খুলে টেবিলে রাখতেই জুলি চমকে উঠলেন, আরে আপনিই আজ বিকেলে একজন গুরুদেবকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিলেন না?

ঠিকই।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন পরিচয়টা সত্যি?

ওটা প্রমাণ করা মুশকিল হবে। আর এই আইডেন্টিটি কার্ড সম্পর্কে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয় নিশ্চয়ই?

তখন প্রশ্ন করলেন না কেন?

তখন শুধু আপনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। শুনুন, হেড-অফিস আমাকে পাঠিয়েছে। মিস্টার শেরিংয়ের নর্মাল মৃত্যুর খবর থাকা সত্বেও হেড-অফিস নিজের লোক দিয়ে যাচাই করে নিতে চায়। কারণ টাকার অঙ্কটা মোটেই কম নয়। ভাস্কর অত্যন্ত তৎপর গলায় কথাগুলো বলে চোখের দিকে তাকাল।

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন জুলি, বুঝলাম। আমার স্বামীর অত্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এখানে এক হলঘর মানুষ দেখেছে তিনি বুকের যন্ত্রণায় ঢলে পড়েছেন। কেউ তাঁকে আঘাত করেনি। ডাক্তার পরীক্ষা করে সেইরকম সার্টিফিকেট দিয়েছে। এখন আপনার কোম্পানি আমাকে টাকাটা দিতে বাধ্য। যদি তা না দেয় তা হলে আমি কেস করব।

কেসে আপনি জিতবেন কী হারবেন সেটা আমার ওপর নির্ভর করছে। কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল ভাস্কর। তারপর দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, প্রধান আমাকে একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন সে এখন কোথায়?

মুহূর্তেই জুলির মুখ মোমের মতো সাদা হয়ে গেল, কোথায়?

হাসপাতালে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছে।

প্রধান কী বলেছে আপনাকে? নির্লিপ্ত গলায় কথা বলতে পারছিলেন না জুলি।

আজ সকালে সে আপনার বাড়িতে গিয়েছিল।

ইয়েস। হি ইজ এ চিট। থিফ। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন জুলি।

হতে পারে। কিন্তু আপনার বাড়িতে আর-একজনের অস্তিত্ব সে জানিয়েছে।

দাঁড়ান। ভাস্করের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে কাঁধ নাচালেন জুলি। তারপর বললেন, আমাকে ভয় দেখিয়ে কেউ পার পায়নি কিন্তু।

ভয় দেখাতে যাব কেন?

বেশ, কাল সকাল ন’টায় আমার ওখানে আসুন। ব্রেকফাস্ট করবেন। হঠাৎ জুলি প্রসন্ন মুখে নিমন্ত্রণ করলেন।

ঠিক আছে। তবে দয়া করে ইলেকট্রিক অফ করতে ভুলবেন না। প্রধান এই তথ্যটাও জানিয়েছে। নমস্কার।

লম্বা পা ফেলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে কাউন্টারে দাঁড়াল। তারপর মদ্যপানরত মানুষগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে সে হলঘর পেরিয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে পদম বাহাদুরকে খুঁজল। কাঠের সাঁকোটা পার হয়ে আসামাত্র পদম শিস বাজিয়ে অস্তিত্ব জানাল।

পদমকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছিল ভাস্কর। এখন অবধি যা অঙ্ক পাওয়া গিয়েছে তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না মিস্টার শেরিংকে কেউ খুন করেছে। এবং এই কেউটির মুখোশ খুলে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্বেও ভাস্করের মনে একটা খুঁতখুঁত ভাব থেকেই যাচ্ছিল। জুলি শেরিং জানেন এটা হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে সন্দেহটা তাঁর ওপরেই প্রথম পড়বে। এবং সেটা জেনেও কেন তিনি বিষের শিশি এবং সিরিঞ্জ রেখে দিলেন বাড়িতে? হোক না লুকোনো জায়গায়, কিন্তু নষ্ট করলেন না কেন? দ্বিতীয়ত, বাড়িতে নিজের মেয়েকে অত্যন্ত গোপনে রেখে দিয়েছেন যা তাঁর আপাত-বন্ধু প্রধানও জানত না। যদি সত্যি তিনি প্রধানের সঙ্গে জড়িত থাকতেন তা হলে এই সত্য একদিন না একদিন ফাঁস করতেই হতো।

ঠিক এই সময় একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। গাড়িটা তীব্র গতিতে ওপরে উঠে আসছে। পদম বলল, সরে আসুন সাহেব। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে ড্রাইভারের মাথার ঠিক নেই। এই বলে সে রাস্তা থেকে এক পা উঁচুতে উঠে দাঁড়াল। ভাস্কর এবার আলোটা দেখতে পেল। এখানে পথ বেশি চওড়া নয়। দুপাশের পাড়াড় নেমে এসে পথটাকে যেতে দিয়েছে। আলোটা এ পাহাড় সে পাহাড় ঝেঁটিয়ে ওপরে উঠে সোজা হল। যেন বিশাল চোখে দুটো হায়না তেড়ে আসছে। ড্রাইভারের হাত কাঁপছে। পদম আবার চেঁচাল, হঠ যাইয়ে সাব।

এবং শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে ওপরে উঠতেই গাড়িটা তীব্র গতিতে পাহাড়ের যে ধারে ওরা হাঁটছিল সেদিকটা ঘেঁষে তেড়ে এসে না পেরে ছিটকে এগিয়ে গেল সামনে। তখনই দড়াম করে একটা আওয়াজ এবং কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল রাত্রে নিস্তব্ধতায়। পদমের চাপা গলা শোনা গেল, শালে শুয়ার কি বাচ্চা।

পাথরটা ছুড়েছে পদমই। সেটা গিয়ে সোজা আঘাত হয়েছে গাড়ির পেছনের কাচে। ড্রাইভার বোধহয় এইটে আশা করেনি, থতমত হয়ে ব্রেক কষতেই বোধহয় চেতনায় ফিরে এল। ভাস্কররা দৌড়ে যাওয়ার আগেই সে গাড়ি সমেত উধাও। পদম বলল, পাহাড়ে এইরকম খুবই হয়। মাল খেয়ে সব শালা আমজাদ হয়ে যায়। কিন্তু ইচ্ছে করলে কাল-পরশু এই গাড়িটাকে ধরা যাবে। কাচ পাল্টাতে ওকে গ্যারেজে যেতেই হবে। সাহেব যদি চান তাহলে এই কাজটুকু করতে পারি।

ভাস্কর মাথা নাড়ল, তোর দরকার হবে না। আমি পুলিশকেই বলব। তুই বরং একটা কাজ কর। সামনের বাঁকটা থেকে আড়ালে চলে যাবি। দেখবি কেউ আমার পিছু নিয়েছে কি না! যদি নেয় তাহলে দুপুরে যে হোটেলে খেয়েছিলাম সেখানে এসে আমাকে জানাবি। ঠিক আছে?

একটা কাজের মতো কাজ পেল যেন পদম। বাঁকটা আসামাত্র সে নিমেষের মধ্যেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভাস্কর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একা বড়-বড় পা ফেলে হেঁটে আসছিল। এখন এই শহরটা আপাত চোখে ঘুমন্ত। শীত আরও বাড়ছে। কিন্তু ভাস্কর ভাবছিল, জুলি শেরিং এই ভুলটা করতে গেলেন কেন? নির্জন পথে গাড়ি চাপা দিয়ে কাউকে মারতে যাওয়া সব সময় সফল হবে এই রকম ভাবনা এল কেন মাথায়? এতক্ষণ জুলি সম্পর্কে তার যে দ্বিধাটা জন্মাচ্ছিল সেটা আবার ম্লান হয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে দ্বিতীয় একটা চিন্তা কাজ করল, হয়তো গাড়িটা জুলি পাঠাননি। যে পাঠিয়েছে সে এখনও পর্দার আড়ালে রয়েছে। এমনও তো হতে পারে।

একসঙ্গে খাওয়া শেষ করে হোটেলে ফিরে এল ভাস্কর। পদমকে সে সকাল আটটায় হোটেলে দেখা করতে বলল। না, পদমের রিপোর্ট অনুযায়ী তাকে কেউ অনুসরণ করেনি। পদম এ ব্যাপারে খুব নিঃসন্দেহ। তাছাড়া যেসব চোর-বাটপাড়-গুণ্ডা এসব কাজ করে তাদের নাড়িনক্ষত্র পদম জানে। তাদের কাউকেই পদম দ্যাখেনি শুধু সাহেব চলে আসার পর একজন মহিলা গাড়ি নিয়ে উঠে এসেছিল। সেটা সাহেব চলে আসার পনেরো মিনিট পরে। ভাস্কর তাকে দ্যাখেনি। হয়তো সে ততক্ষণে শহরের তেমাথা পেরিয়ে চলে এসেছে।

অতএব এইটুকু ধরে নেওয়া যায় কেউ তার পেছনে আসেনি যখন-তখন আজকের রাত্রের মতো সে নিরাপদ। হোটেলে ঢুকতেই রিসেপশনের সামনের চেয়ারে শাজাহানকে বসে থাকতে দেখল ভাস্কর। ওকে দেখা মাত্র শাজাহানের যেন প্রাণ ফিরে পেল, ওরা আপনার পথ চেয়ে বসে আছে।

ভাস্কর হেসে ফেলল, কোনও মেয়ে যা করে না আপনি তাই করলেন?

ইয়ার্কি না। আমাকে তো আজ থেকে যেতে বললেন। বিকেলে একটু মদের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম এসে দেখি গুরুদেব হাওয়া আর তার জায়গায় একটা বিশাল তিব্বতি শুয়ে জপ করছে। উঃ, কী মারাত্মক চাহনি। আর আমার ব্যাগ থেকে মাত্র দশটা টাকা রেখে তিনি সব নিয়ে গিয়েছেন। প্রায় কেঁদে ফেলল শাজাহান।

পুলিশে জানিয়েছেন?

দূর! পুলিশ গুরুদেবের কী করবে?

করবে। কারণ আপনার গুরুদেব যখন হোটেলে ফিরেছেন তখন কোনও বাস নিচে নামে না। আমার মনে হয় না তিনি নিজে একটা গাড়ি ভাড়া করে রাত্রের পাহাড়ি পথে নামবেন। অর্থাৎ এই শহরে খুঁজলেই তাকে পাওয়া যাবে। আচ্ছা, চলুন আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।

শাজাহানকে নিয়ে বেরিয়ে এল ভাস্কর। বেচারার অবস্থা খুব কাহিল। কাল সকালে হোটেল থেকে বেরুবারও উপায় নেই। বিল মেটানোর পয়সা নেই। এরপর গাড়ি ভাড়া আছে। লোকটার ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল ভাস্করের। সম্মোহন করে টাকা আদায় করে খুশি হয়নি, এই ছ্যাঁচড়ামো পর্যন্ত করলে।

অনিল মিত্র সব ব্যাপারটা শুনে জিগ্যেস করলে, এই রকম একটা লোক তোমার হোটেলে ছিল বিকেলে বললে না কেন?

তখন তুমি একটা প্রব্লেম নিয়ে ছিলে আর আমারও মাথায় আসেনি। বাট আই অ্যাম সিওর ও এই শহরে এখনও পর্যন্ত আছে।

তুমি লোকটার যে বিবরণ দিলে তাকে আমি কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে দেখেছি। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে—। অনিল মিত্রকে চিন্তিত দেখাল।

হাসপাতালে? ভাস্কর অবাক হল।

হ্যাঁ। আজ একটা কেস পেয়েছি। পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে—ওহো, তুমি তো জানো, সেই স্পটেই দেখা হল। তোমাদের বিবরণমাফিক লোকটি হাসপাতালে গিয়ে অনুরোধ করেছিল সে পেশেন্টকে একবার দেখতে চায়। ওর জ্ঞান তখনও ফেরেনি বলে দেখতে দেওয়া হয়নি। ও যখন গিয়েছিল তখন আমি হাসপাতালে ছিলাম। বাই দ্য বাই, ছেলেটির পরিচয় তুমি জানো? অনিল মিত্র সরাসরি প্রশ্ন করল।

ভাস্কর এত তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রকাশ করতে চায়নি। অথচ সোজাসুজি মিথ্যে কথা বলতেও খারাপ লাগছিল, তুমি তো বলেছিলে চেনা মানুষ।

হ্যাঁ। এই শহরের একজন নামকরা রোমিও। কাজ করে ভালো। ইনফ্যাক্ট তোমাদের কলিগ বলতে পারো।

কলিগ? যতটা সম্ভব বিস্ময় দেখাল ভাস্কর।

হ্যাঁ। তোমাদের ইন্সুরেন্স ডিপার্টমেন্টের স্থানীয় এক কর্তা ওই ছোকরা। সম্প্রতি এক বিধবা টিবেটিয়ান মহিলার সঙ্গে মাখামাখি হচ্ছিল। মহিলা একটু রহস্যময়ী।

রহস্যময়ী এই কারণে যে তিনি বাইরের কারও সঙ্গে মেশেন না। স্বামী বেঁচে থাকলেও ওঁদের মদের দোকান আর বাড়ি ছাড়া মাঝে-মাঝে গাড়ি নিয়ে নির্জন পাহাড়ে একা বসে থাকেন। দো শি ইজ টিবেটিয়ান কিন্তু তাঁকে দেখলে মনে হবে শি ইজ ফ্রম হলিউড।

হাসল অনিল।

ফেরার পথে হাসপাতালে এল ওরা। না এখনও প্রধানের জ্ঞান ফেরেনি। হেড-ইনজুরি। ডাক্তার বলছেন বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কোনও ভবিষ্যৎবাণী করা সম্ভব নয়। ভাস্কর দেখল যে ব্লকে প্রধান রয়েছে তার বারান্দায় দুটো সেপাই পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে। যারা বুদ্ধিমান তাদের পক্ষে ওদের কাঠের পুতুল বানিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়। প্রধানের প্রাণনাশের চেষ্টা হলে আটকাবে কে? তবে ও বেঁচে থাকলেও বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে কোনও সাহায্যে আসবে না। বাহাত্তর ঘণ্টা অনেক দীর্ঘ সময়। যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।

থানা-পুলিশ করে শাজাহান সেন একটু ভরসা পেয়েছিল। ভাস্কর অনিল মিত্রকে দিইয়ে বলিয়েছে লোকটাকে আগামীকালই খুঁজে বের করা হবে। তাছাড়া ওর কাছে যদি টাকা নাও পাওয়া যায় তাহলে পুলিশের অয়্যারলেসের মাধ্যমে শাজাহানের বাড়িতে খবর দেওয়া যাবে টাকা পাঠিয়ে দিতে। দু-তিনদিন আরও থেকে যেতে হবে সেক্ষেত্রে। ভালোই হবে এতে। কারণ শাজাহান স্বীকার করল এতবার সে এসেছে কখনই দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখা হয়নি। মদ খেতে-খেতেই তার সময় গিয়েছে। এখন যে দুদিন অপেক্ষা করতে হবে তাতে তো মদ খাবার পয়সা থাকবে না, সুযোগটা কাজে লাগানো যাবে। তবে ওই টিবেটিয়ান রুমমেটকে নিয়ে থাকা—এটাই প্রধান সমস্যা।

শাজাহানকে হোটেলে পাঠিয়ে ভাস্কর রাস্তা পালটাল। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল গুরুদেব জুলি শেরিংয়ের বাড়িতে যাবেন। ব্ল্যাকমেল করা যার নেশা সে এই সুযোগ ছাড়বে না। আরও কিছু খবরের জন্যে প্রধানকে কথা বলাতে চেয়েছিল নিশ্চয়ই। লোকটা জেনেছে ইন্সুরেন্সটা যদি হেড অফিস অনুমোদন না করে তাহলে জুলি প্রধানকে বিয়ে করবে না। এর মানে ব্যাপারটায় কিছু ভাঁওতা আছে। আর জুলি যে ফেলে দিয়েছে ছেলেটিকে সেটাও লোকটা কোনও আড়ালে থেকে চাক্ষুষ করতে পারে। অতএব নিশ্চয়ই এতক্ষণে লোভের সাপ ফণা তুলেছে। পৃথিবীর যে কোনও নেশার চেয়ে যা মারাত্মক।

পথ নির্জন। ঠান্ডাটা বাড়ছে হুহু করে। রাস্তার আলোগুলোকে কুয়াশায় ডাইনির চোখের মতো দেখাচ্ছে। দু-পকেটে ভাস্করের হাত, এক হাতে রিভলভারের স্পর্শ। পদমটাকে ছেড়ে না দিয়ে সঙ্গে আনলে ভালো হতো।

প্রধানের কাণ্ডটা যেখানে ঘটেছিল সেখানে এখন কোনও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এই শহরে বোধহয় রাত ঘনালে গাড়ি করেও মানুষ বের হতে চায় না। বাঁক ঘুরতেই জুলির বাড়িটা চোখে পড়ল। ছবির মতো চুপচাপ। কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না। গুরুদেব যদি এসে থাকেন তাহলে তো এতক্ষণে আলো জ্বলা উচিত ছিল। কারণ জুলির গাড়িটা বাড়ির সামনে দেখা যাচ্ছে। নিজেকে আড়ালে রেখে প্রায় আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকল ভাস্কর। না, বাড়িটায় কোনও মানুষ জেগে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আর থাকলেও গুরুদেব নেই। জুলি শেরিং আলো নিভিয়ে গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলার পাত্রী নয়।

ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে এবং দরজায় শব্দ হওয়ায়। ভাস্কর খানিকটা সময় নিয়ে দরজা খুলতে দেখল একজন সেপাই দাঁড়িয়ে আছে খাম হাতে। ওর নাম জিগ্যেস করে খামটা দিয়ে চলে গেল সে। খানিকটা অবাক হয়ে সে চিঠিটা বের করল। অনিল মিত্র জানিয়েছে লোকটির হদিশ পাওয়া গিয়েছে। সে উঠেছে একটা প্রাইভেট গেস্ট হাউসে। তবে জিনিসপত্র রেখে সন্ধে নাগাদ সেই-যে বেরিয়েছে এখনও ফেরেনি। ফিরলেই ওকে ধরে ফেলা যাবে। আর হ্যাঁ, প্রধানকে বাঁচানো যায়নি। কাল রাত তিনটে নাগাদ অজ্ঞান অবস্থায় সে মারা গিয়েছে। পোস্ট-মর্টেমের জন্যে বডি রেখে দেওয়া হয়েছে।

ঠোঁট কামড়াল ভাস্কর। একজন সাক্ষি চলে গেল। মৃত্যুটা কি আঘাত-জনিত না নতুন কোনও প্রচেষ্টায় সেটা চিঠিতে বোঝা যাচ্ছে না। আর এই গুরুদেবটি কোথায় গেলেন জিনিসপত্র ফেলে। ওর এক সিড়িঙ্গে শিষ্য ছিল, সে-ই বা কোথায়? ঘড়ি দেখল ভাস্কর। সর্বনাশ। ন-টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। এই পাহাড়ি শহরগুলোর আবহাওয়া বড্ড সময় আড়াল করে রাখে। আর রোদ নেই। সকালটা শুরু হয়েই যেন সন্ধে হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই মাথার ওপর বড্ড বেশি মেঘের চলাফেরা চলছে এখন।

ঠিক পাঁচ মিনিট আগে জুলি শেরিংয়ের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেল ভাস্কর। পদম বাহাদুর তার পেছনে। ও ঠিক সময়ে সঙ্গ নিয়েছে। শাজাহানবাবু বেরিয়েছে পর্যটনে। পদমকে যা বোঝাবার এতটা পথ চলার সময় বুঝিয়ে দিয়েছে ভাস্কর। জুলি শেরিংয়ের বাড়িটা চোখে পড়া মাত্র সে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল এমন একটা জায়গা খুঁজে নিতে যেখান থেকে দেখা এবং শোনার দুটো কাজই চমৎকার চলে।

সাদা পুলওভার এবং স্টোন-ওয়াল প্যান্টে নিজের চেহারাটা যে আরও খুলেছে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল ভাস্কর। হোটেলের বুড়িটা তো বটেই এই পদমটা পর্যন্ত তার দিকে ঘুরে-ঘুরে তাকিয়েছে। কী দেখছে জিগ্যেস করায় বলেছিল, সাহেব, অনেক নাম-করা ফিল্মস্টার এখানে আসে শুটিং-এর জন্যে, তারাও তোমার কাছে এখন হার মেনে যাবে।

ভাস্কর সুপুরুষ। তবে কিছু-কিছু পোশাক তাকে আরও আকর্ষণীয় করে এ তথ্য তার জানা। একজন সুন্দরী মহিলার কাছে আসতে হলে নিজের চেহারা খোলতাই করাই উচিত। এবং তখনই ওর সেই মেয়েটিকে মনে পড়ল। কাল থেকে প্রায়ই ওকে মনে পড়ছে। এভাকে কোনও মেয়ে তাকে কখনও টানেনি। কিন্তু জুলি যদি হত্যাকারী হয় বা মেয়েটির যদি এদেশে আসার ভিসা না থাকে তাহলে সে কী করতে পারে? ভাস্কর প্রার্থনা করছিল ওই দুটোই যেন বেঠিক হয়।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকল সে। বেশ ঘন ছায়া বাগানে। সকাল ন’টায় মেঘ নেমে এসেছে মাথার ওপরে। বৈদ্যুতিক তারের জায়গাটায় এসে সে সতর্ক হল। সেই সময় দরজা খুলে গেল। এবং ভাস্করের সমস্ত শরীরে আর এক রকমের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। জুলি শেরিং দরজা খুলে আশ্চর্য রকমের মিষ্টি হাসি হাসলেন তার দিকে চেয়ে। মহিলার বয়স বোঝাই যাচ্ছে না। অতিরিক্ত রকমের ছোট একটা লাল শর্টস আর দুধেল গেঞ্জি ওঁর পরনে। পায়ে ঘাসের চটি। চোখে নীল হরিণচোখো চশমা। মাথার চুল ফুলে-ফেঁপে মেঘ হয়ে দুলছে। যদিও মেঘের জন্যে ঠান্ডা আজ কম কিন্তু এত ছোট প্যান্ট পরার মতো আবহাওয়া নয়। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুলি হাসলেন আবার, হা-ই!

ভাস্কর পা ফেলল। লুকনো তারে যদি বিদ্যুৎ থাকত তাহলে জুলি নিশ্চয়ই ওকে ডাকতেন না। এগিয়ে যেতে সে বলল, হ্যালো!

ঘরের ভেতরে ঢুকে জুলি বললেন, আপনার দেখছি চমৎকার সময়জ্ঞান। এখন ঠিক নটা।

ভাস্কর জুলির দিকে না তাকিয়ে সোফায় বসতে যাচ্ছিল। এই মহিলার বয়স সে জানে, কিন্তু দেখছে তার সঙ্গে কিছুতেই মেলে না। সব মেয়ের শরীরে চুম্বক থাকে না। ঈশ্বর কাউকে-কাউকে সেটা দীর্ঘকালের জন্যে লিজ দিয়ে দেন। জুলি সেইরকম। আজকের এই পোশাক, উন্মুক্ত দীর্ঘ উরু এবং পায়ের গোছ যা কিনা শঙ্খের চেয়ে সুন্দর, না দেখলে সে এর হদিশ পেত না। এই মহিলার কী করে অত বড় মেয়ে থাকতে পারে?

সোফায় বসার আগেই জুলি বাধা দিলেন, ওঃ নো! আজকের এমন আবহাওয়ায় এই বদ্ধ ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমার সঙ্গে অন্য একটা ঘরে আসা হোক। সেখানে অন্তত অবাঞ্ছিত অতিথিরা আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না। প্লিজ। বলার ভঙ্গিতে এমন একটা আদুরে ভঙ্গি আনলেন জুলি যে ভাস্কর নিজের হৃদস্পন্দন অনুভব করল। কিন্তু অন্য ঘর কেন? সেই গুন্ডা টাইপের বারম্যানটা কি কাছে-পিঠে ওৎ পেতে আছে। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। রিভলভারের স্পর্শ তাকে অনেকটা নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে দিল। জুলি শেরিং তখন চলতে শুরু করেছেন। টাইট খাটো লাল শর্টস তাঁর ভারী নিতম্বকে শাসন করার নিষ্ফল চেষ্টা চালাচ্ছিল। এই দৃশ্যের সামনে পৃথিবীর সেরা সন্ন্যাসীকেও সমস্যায় পড়তে হবে। কেন যে সেকালে মুনিঋষিদের মতিভ্রম হতো আজ বোঝা গেল।

জুলি তাকে যে ঘরটায় নিয়ে এলেন তার তিনদিকে কাচের দেওয়াল, ছাদেও স্বচ্ছ কাচের টালি। দেওয়ালের কাছে এমন একটা ঘষা ভাব আছে যা দেখলেই ভাস্কর বুঝল বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যাবে না, সে স্পষ্ট বাগান এবং আকাশের মেঘ দেখতে পেল। এখানে বেতের হেলানো রঙিন চেয়ার যাতে নরম কুশন দেওয়া। তার একটায় জুলি বসলে মুখোমুখি বসল ভাস্কর। আশ্চর্য, চারদিক বন্ধ মনে হচ্ছে তা সত্বেও একটা হিমেল বাতাস পাক খাচ্ছে এই ঘরে। সত্যি, জুলি এই পোশাকে সামনে না বসলে দম বন্ধ হওয়ার কোনও কারণ নেই।

দুটো পা আড়াআড়ি ভাঁজ করে জুলি বললেন, দুঃখের খবরটা নিশ্চয়ই শুনেছেন? প্রধান মারা গেছে।

চমকে তাকাল ভাস্কর। এই সংবাদ জুলি পেয়ে গেছেন?

জুলি হাসলেন, আজ সকালে আমি ফুল দিতে গিয়েছিলাম। বেচারা! যাক ব্রেকফাস্ট আনতে বলি?

একটু পরে। ভাস্কর কোনও রকমে উচ্চারণ করল।

আপনাকে আজ খুব হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। রিয়েলি, অনেককাল পরে আমি একজন সুপুরুষ দেখলাম। আশঙ্কা করছি আপনার বান্ধবীর সংখ্যা আপনি নিজেও জানেন না! ঠোঁটে আলতো হাসি জুলি।

ভাস্কর বুঝতে পারছিল ক্রমশ তার ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে যাচ্ছে জুলি। এ আর-এক সম্মোহন। এখনই কাজের কথায় আসা উচিত। সে বলল, মিসেস শেরিং—!

বলো জুলি। নামটা মিষ্টি নয়?

ওয়েল, জুলি। আমার কোম্পানি মনে করে মিস্টার শেরিংয়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। প্রধান আমাকে সে তথ্য দিয়েছে—।

সে তথ্য আর কাজে লাগবে না। হি ইজ ডেড। আচমকা উত্তেজিত হয়ে উঠে বসলেন জুলি, আপনার কী জিজ্ঞাস্য আছে তাই বলুন।

হাসল ভাস্কর। জুলি যত উত্তেজিত হবেন তত ভালো। সে প্রশ্ন করল, কোনও সাধারণ মানুষ তার বাড়ির চারপাশে ইলেকট্রিক অয়ার লুকিয়ে রাখে না। আপনি কেন রেখেছেন?

তার সঙ্গে মিস্টার শেরিংয়ের মৃত্যুর কী সম্পর্ক?

আমি আসছি সে প্রসঙ্গে। জবাব দিন।

এইটে আপনার এক্তিয়ারের বাইরে। কিন্তু আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। সুতরাং আমি কথা বলছি। যেভাবে উত্তেজিত হয়েছিলেন প্রায় সেই ভাবেই শান্ত হয়ে গেলেন জুলি, আমার বাড়িতে একজোড়া বুদ্ধ মূর্তি আছে। যেটাকে আপনি বাইরের ঘরে দেখেছেন সেটা নকল। আসলটি ভিতরে। ওই মূর্তিটির ওপর অনেক টিবেটিয়ান এবং আমেরিকানদের লোভ আছে। এর আগে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছিল মূর্তিটি চুরি করার। স্রেফ সিকিউরিটির জন্যে ওই অয়ার লাগিয়েছি। এবং এটা পুলিশের অনুমতি নিয়ে।

পুলিশ আপনাকে অনুমতি দিয়েছে!

হ্যাঁ, রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত।

কিন্তু প্রধান বলেছে সকালেও, আপনি বাড়ি না থাকলে ওটা চালু থাকে।

হয়তো ভুলে অফ করা হয়নি।

আপনার মেয়ের লিগ্যাল পেপারস আছে এদেশে থাকার?

আমার মেয়ে? এখানে আমার মেয়েকে আপনি কোথায় পেলেন?

এই বাড়িতে একটি তরুণী নেই? চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করল ভাস্কর কিন্তু চশমার দেওয়াল কী করে ডিঙোবে সে?

আমি ছাড়া এখানে কোনও মহিলা থাকে না। অবশ্য আমি জানি না আপনি আমাকে তরুণী বলতে চাইবেন কি না? মদির হাসি হঠাৎ ঝরনার মতো ছিটকে উঠল।

মিথ্যে কথা বলছে। ভাস্কর নিজের মনে বলল। সে যে চাক্ষুষ করে গেছে সেটা তো ইনি জানেন না। সে হাসল, কথাটা কি সত্যি?

প্রধান আপনাকে ভুল তথ্য দিয়েছে।

আমি যদি বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাই?

স্বচ্ছন্দে। ঠোঁট কামড়ালেন জুলি।

একটু অবাক হল ভাস্কর। এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কী করে কথাটা বললেন জুলি? মেয়েটি যদি এই বাড়িতে থাকে? হঠাৎ তার মনে হল, ওকে এখানে থেকে গত রাত্রে সরিয়ে দেওয়া হয়নি তো? না, খুঁজতে চাওয়া বোকামি হবে। সে হেসে বলল, বিশ্বাস করলাম।

খুশি হলেন জুলি, বিশ্বাসই দুটো মানুষকে কাছে আনে। আপনার নামটা পড়েছি। কিন্তু কোথায় থাকেন তা জানি না।

কলকাতায়।

ওহ! কী করে থাকেন? চিৎকার গোলমাল! বিবাহিত? প্রসঙ্গান্তরে দ্রুত চলে যাওয়ার দক্ষতা দেখে ভালো লাগল ভাস্করের, নাঃ। এখনও সময় করে উঠতে পারিনি। মিস্টার শেরিং কোন সাপের বিষ পছন্দ করতেন?

মুহূর্তেই আবার রক্ত জমল মুখে, সেটা মিস্টার শেরিং জবাব দিতে পারতেন। আমি ওঁর স্ত্রী, তার মানে এই নয় আমাকে সব খবর জানতে হবে।

ঠিকই। মাথা নাড়ল ভাস্কর, যদি আপনি নামচে বস্তিতে সেই বুড়ো সাপুড়ের কাছে বিষ আনতে না যেতেন তাহলে আপনার কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ থাকত। তাই না?

এবার স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে বেশ জোরে হেসে উঠলেন মহিলা। তারপর একেবারে ভাস্করের সামনে দাঁড়িয়ে ঈষৎ ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আমার চিরকাল ভালো লাগে। যত দেখছি, যত শুনছি তত আমার ভালো লাগাটা বাড়ছে। হাত মেলান, সব কথা বলছি।

ভাস্কর চোখ তুলতেই ঝুঁকে পড়া জুলির গেঞ্জিকে হাঁসফাস করতে দেখল। সম্মোহিতের মতো সে হাতে হাত মেলাতেই জুলি সোজা হয়ে বললেন, গুড। শুনুন, আমার স্বামী নেশা করতেন। প্রথমে মদ। তারপর গাঁজা। তারপর পাউডার। আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল বটে কিন্তু এই নেশার জন্যে আমাদের দাম্পত্য জীবন বলতে কিছু ছিল না। শেষপর্যন্ত ছোট সাপের ছোবল নিতেন। তাতেও নেশা ফিকে হয়ে গেলে শঙ্খচূড় সাপের বিষ ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে নিতেন। কিন্তু উনি মারা গেছেন স্রেফ হার্ট-অ্যাটাকে। দু-বার উনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন সেই সাপুড়ের কাছে যেতে। কিন্তু এসব আপনি ওঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আদালতে প্রমাণ করতে পারবেন না। ডাক্তার যে ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়েছেন তাতে এসবের উল্লেখ নেই।

ভাস্কর মাথা নাড়ল। সব ঠিক। শুধু শেষ সত্যটি বললেন না মহিলা। জুলি এগিয়ে এলেন এবার। একটা হাত আলতো করে তুলে দিলেন ভাস্করের কাঁধে, বিশ্বাস করুন আমাকে। এই দেশে এসে এখন আমি একা। ওই টাকাটা আমাকে নিরাপত্তা দেবে। আপনি আমার কথাও ভাবুন।

কী ভাবতে হবে বলুন?

আপনি আমার পাশে দাঁড়ান।

তারপর?

আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।

আমারও। বলে উঠে দাঁড়াল ভাস্কর। সঙ্গে-সঙ্গে অত্যন্ত খুশিতে তার একটা হাত তুলে নিয়ে তাতে নিজের গালে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই ভাস্কর বলে উঠল, কেউ আসছে।

আসুক।

আমরা বোধ হয় বড্ড তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছি। ঝড়ে কিছুই নড়ে না।

উঁহু, আমি ওসব থিওরিতে বিশ্বাস করি না। যখন হওয়ার হয় তখন যে-কোনও ভাবেই তা হতে পারে। জুলির চোখ বন্ধ তখনও।

সেই সময় পেছনের দরজার দিকে চোখ যেতেই মনে হল কিছু একটা সরে গেল সেখান থেকে। তাদের কেউ লক্ষ করছে? একটা শব্দ হচ্ছিল যেন তখন থেকে এক নাগাড়ে। সে তাকাতেই শব্দটা থেমে গেল। এবার যেন শরীরে সাড় ফিরে পেল ভাস্কর। বেচারা প্রধান বোধহয় এই ভাবেই ভুল করেছিল।

সে ধীরে-ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিল, আমি এবার বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাই। আপত্তি নেই তো এখন?

নিশ্চয়ই না। কিন্তু এখনও কি অবিশ্বাসের কারণ আছে?

আমার চোখ এবং কানের মধ্যে কোনও ফারাক রাখতে চাই না। আসুন। খানিকটা অনিচ্ছায় জুলি তাকে পেছনের দরজায় নিয়ে এল। তারপর একটার পর একটা ঘর। কোথাও মানুষের চিহ্ন নেই। জুলির শোয়ার ঘরে এসে ভাস্কর বলল, মিস্টার শেরিংয়ের জিনিসপত্র এখানে দেখছি না কেন? মনে হয় ভদ্রলোক এই বাড়িতেই থাকতেন না।

বাজুতে চিমটি কাটলেন আলতো করে জুলি, আমার শোয়ার ঘরে ও কেন থাকবে? বলেছি না আমাদের দাম্পত্য জীবন ছিল না।

বাড়িতে কেউ নেই?

এ প্রশ্ন কেন?

কাউকে দেখছি না। অথচ তখন বললেন ব্রেকফাস্ট আনতে বলব? কাকে আনতে বলতেন?

ও। আমাদের ওপাশে একটা আউটহাউস আছে। এখন এই বাংলোয় আমি—আমরা একা। একটা চোখ ঈষৎ কাঁপল জুলির।

আমি একবার মিস্টার শেরিংয়ের ঘরে যাব।

ওঃ ভাস্কর! বিলিভ মি প্লিজ। এসো।

প্রায় টানতে-টানতে চতুর্থ ঘরে নিয়ে গেল জুলি তাকে। এই সেই ঘর। দেওয়াল ভর্তি বই। তলায় কার্পেট। সে জিগ্যেস করল, এইসব বই কে পড়তেন? মিস্টার শেরিং?

না। বাড়িটা ছিল হ্যারল্ড টমসন নামে একজনের। সে আমাদের এটা বিক্রি করে চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। বইগুলো নিয়ে যায়নি। মিস্টার শেরিং এখানেই শুতেন যখন বাড়িতে থাকতেন।

ওই বইগুলো তিনি পড়তেন না?

যে লোকটা চব্বিশ ঘণ্টা নেশায় ডুবে থাকত তার বই পড়ার সময় কোথায়? আর আমি অত পুরোনো মোটা বইতে ইন্টারেস্টেড নই।

আপনাদের সেই দ্বিতীয় বুদ্ধমূর্তি কোথায়? দেখলাম না তো!

আমার ঘরে একটা সুটকেসে রাখা হয়েছে। আমি বাইরে রাখতে সাহস পাই না। মিস্টার শেরিং ওইটে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল এই মূর্তির ইজ্জত রেখো আর এই বাড়ি বিক্রি করো না।

নিয়ে আসুন মূর্তিটা। হুকুমের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল ভাস্কর। এই বাড়ি বিক্রি করো না। কথাটার মধ্যে কোনও তাৎপর্য ছিল, না জুলি বানিয়ে বললেন। জুলি দুটো মিথ্যে বলছেন। এক, কাল অন্য মেয়ে এখানে ছিল, দুই আজ এই বাড়িতে আর কেউ আছে যার অস্তিত্ব তার অনুভূতিতে সে টের পাচ্ছে। জুলি খানিকটা বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরে চলে গেছেন মূর্তিটা আনতে। হঠাৎ ভাস্করের মনে এল, জুলি কি এই ঘরে যে লুকনো গর্ত আছে তার হদিশ জানে না? সে একটা বাক্স ওখান থেকে নিয়েছে কিন্তু আর একটা কাঠের বাক্স গর্তে ছিল। তাতে কী আছে? ঠিক তখনই জুলি সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক দরজার ফ্রেমে। ওঁর হাতে চমৎকার এক বুদ্ধমূর্তি। কালো পাথরের খোদাই করা, নিখুঁত। জুলি বললেন, এইটে আমাদের পারিবারিক সম্পদ। এর ওপর লোভ অনেকের। বিশ্বাস হল? ভাস্কর এগিয়ে গিয়ে মূর্তিটি স্পর্শ করতে যেতেই জুলি এক পা পিছিয়ে গেলেন, নাঃ। এই পরিবারের বাইরের কারও একে স্পর্শ করার অধিকার নেই। ওঁর গলার স্বরে প্রতিরোধ।

ঝুঁকে দেখতে লাগল ভাস্কর। স্পর্শ না করে যতটা দেখা যায়। এবং ঠিক তখনই জুলির শরীরের পাশ দিয়ে ওপাশের ঘরের দেওয়ালটা চোখে পড়ল। দেওয়ালের গা জুড়ে বিশাল পর্দা। পর্দার তলায় দুটো চামড়ার জুতো। একটা জুতো সামান্য নড়ল। ভাস্কর অনেক চেষ্টায় নিজের ভাবান্তর প্রকাশ করল না। ছায়াটার হদিশ পাওয়া গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এই মূর্তির দাম কত?

অন্তত তিন লক্ষ ডলার। কিংবা তারও বেশি হতে পারে।

তিন লক্ষ ডলার? আমি এইরকম একটা মূর্তির খবর জানি যা দশ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছিল লস-এঞ্জেলসের এক নিলামে। এটা বিক্রি করলেই তো আপনি বড়লোক। ইনসুরেন্সের ওই টাকা তো এর কাছে সামান্য। তাই না?

এটা বিক্রি করা অসম্ভব। কিন্তু ওই টাকাটা আমার চাই। আর সেই ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। যাই, এটাকে রেখে আসি। জুলি পেছন ফিরে এগিয়ে যেতেই ভাস্কর আবার জোড়া জুতোর দিকে তাকাল। পর্দার আড়ালে জুতোজোড়া সরে-সরে যাচ্ছে। ভাস্কর যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল দরজার পাশে। আর সেই সময় টিবেটিয়ানটির মুখ বেরিয়ে এল পর্দার ফাঁক দিয়ে। উঁকি মেরে সে এই দরজার দিকে একবার দেখে চোখের পলকে ঢুকে গেল জুলির ঘরে। লোকটা যে গেল কিন্তু এতটুকু শব্দ হল না। এই লোকটিকেই সে দেখেছিল প্রথমদিন পানশালার কাউন্টারে। সেই সময় জুলি ফিরে এলেন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে।

ভাস্কর প্রশ্ন করল, আচ্ছা, ওই মূর্তিটার কথা আপনার পরিচারকরা জানে? ওর দামের কথা?

না। দামের কথাও জানে না। তবে জানে ড্রইংরুমের মূর্তিটাই মূল্যবান।

ওরাও তো এটা চুরি করতে পারে!

না। ওরা বিশ্বস্ত। তা ছাড়া, ওরা জানে না আমি কোথায় রেখেছি মূর্তিটাকে। হাসলেন জুলি।

ঠিক নয়। এই মুহূর্তে আপনার ঘরে একজন ঢুকেছে। যাকে আপনি পাহারা দেওয়ার কাজে আপনার পানশালা থেকে আনিয়েছেন। জুলি আপনি আমার কাছে মিথ্যে কথা বলছেন।

ঠোঁট কামড়ালেন জুলি। তারপর বলল, এ থেকে প্রমাণ হয় না আমার স্বামীর মৃত্যু অস্বাভাবিক।

কিন্তু ওই মূর্তি এই মুহূর্তে চুরি হয়ে যেতে পারে জুলি!

নাঃ। বলেই জুলি দৌড়ালেন। কিন্তু দু-পা যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়ালেন। বুটজোড়া এবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে কালো পিস্তল। অন্য হাতে কাগজে মোড়া প্যাকেট।

জুলি চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে বিদ্যুৎগতিতে সরে দাঁড়াল। তারপর পিস্তলটা ভাস্করের দিকে উঁচিয়ে ধীরে-ধীরে দ্বিতীয় দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জুলি মরিয়া হয়ে তেড়ে আসছিলেন কিন্তু তার আগেই লোকটা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

জুলি এবার চিৎকার করে উঠলেন, বিশ্বাসঘাতক! ওকে আমার আনাই ভুল হয়েছিল। হাউ-হাউ করে কেঁদে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। খুব অসহায় দেখাচ্ছিল এই মুহূর্তে। কয়েক পলক ওর দিকে তাকিয়ে ভাস্কর চটপট মিস্টার শেরিংয়ের ঘরে চলে এল। তারপর শেলফ থেকে সেই বইটা সরিয়ে বোতাম টিপতেই পায়ের তলার কার্পেট ঝুলে পড়ল। দ্রুত হাতে কার্পেট সরাতেই সে দ্বিতীয় বাক্সটাকে দেখতে পেল গর্তের মধ্যে। সন্তর্পণে গর্তটা থেকে বাক্স তুলতেই মনে হল ওটা খুব হালকা। ঢাকনা খুলে মাথা নাড়ল সে। বাক্সটা খালি।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় অস্ফুট শব্দ হল। ভাস্কর ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল জুলি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। ওঁর চোখে এখনও জল।

ওটা কী? ওখানে গর্ত কীভাবে এল? ছুটে এলেন জুলি। ওঁর চোখে বিস্ময়? ভাস্করের হাত থেকে বাক্সটা টেনে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, এই বাক্স কোত্থেকে এল?

তুমি জানতে না এই গর্তের কথা?

না। জানতাম না। এই ঘরে আমি আসতাম না।

মিথ্যে কথা।

বিশ্বাস করো। আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না। জুলি চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু এই বাক্সটাকে আমি চিনি। এতেই ওই বুদ্ধমূর্তিটা ছিল। ও জানত। নিশ্চয়ই জানত। কিন্তু আমাকে মূর্তিটা দিয়ে ও এখানে বাক্সটা রাখতে গেল কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন জুলি।

এই প্রথম বিশ্বাস করলেন তিনি।

ভাস্কর জুলির কাঁধে হাত রাখল, তোমার মেয়ে এখন কোথায়? মিথ্যে কথা বললে নিজেরই ক্ষতি হবে।

দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন জুলি। অনেক কষ্টে নিজেকে ফিরে পেলেন, ঘুমে।

কাল রাত্রে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ।

গুরুদেব কোথায়?

আবার তাকালেন জুলি। ইতস্তত করলেন। ভাস্কর বলল, সত্যি কথা বললে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

অজ্ঞান হয়ে আছে। লোকটা আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল।

কী বলেছিল?

বলেছিল, ও দেখেছে আমি প্রধানকে খুন করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তা করতে চাইনি! আমি সামান্য ঠেলেছিলাম কিন্তু ও পুতুলের মতো খাদে চলে গেল।

আমি দেখেছি।

তুমি দেখেছ? এই প্রথম স্বস্তি পেলেন জুলি, তাহলে বলো আমি খুন করতে চেয়েছিলাম কি না?

না। কিন্তু আর-একটা কথা বলো। মিস্টার শেরিং ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন কোথায়? পানশালায় না এখানে?

ওর দুটো সিরিঞ্জ ছিল। একটাতে সব সময় বিষ ভরা থাকত। প্রয়োজন হলেই নিত। ওই বিষের ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। শেষ দিকে বলত সাপের বিষ ইঞ্জেকশন করেও নাকি বেশিক্ষণ আরাম হচ্ছে না। ও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই গর্ত কোত্থেকে এল? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি ওই বিশ্বাসঘাতকটাকে ছাড়ব না। ওকে আমি খুন করবই। আমাদের পারিবারিক বুদ্ধমূর্তি ওটা। হিংস্র ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল জুলি, তুমি ওকে যেতে দিলে কেন?

ও কোথাও যায়নি। সাধারণ গলায় জানাল ভাস্কর।

মানে?

তার আগে বলো গুরুদেবের অজ্ঞান শরীরটা কোথায় আছে?

ঘুমে। যে বাড়িতে আমার মেয়ে আছে। ও ওকে পাহারা দিচ্ছে।

জ্ঞান ফিরে এলে তোমার মেয়ে পারবে সামলাতে?

ওর শরীর বাঁধা আছে শক্ত করে। উঠতে পারবে না।

কিন্তু—।

এসো। জুলির হাত ধরে বেরিয়ে এল ভাস্কর। সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠলেন জুলি। লনে পুলিশ গিজগিজ করছে। অনিল মিত্র ওদের দেখে এগিয়ে এল, লোকটাকে ধরেছি। বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পালাচ্ছিল।

থ্যাঙ্ক ইউ। হাত বাড়িয়ে বুদ্ধমূর্তিটা গ্রহণ করল ভাস্কর।

কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না—অনিল মিত্র বলল।

ঘুম কি তোমার জুরিসডিকশনে?

হ্যাঁ। কেন?

তাহলে আমাদের পেছনে-পেছনে চলে এসো। ওখানে গিয়ে কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য দেব। এসো জুলি, তোমার গাড়িটা নাও। পুলিশের গাড়ি নিয়ে প্রথমে যাওয়া ঠিক হবে না। তাড়া দিল ভাস্কর।

না! জুলি শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন।

ভাস্কর চট করে অনিল মিত্রকে দেখে নিল। অনিল যেন এখনই কোনও গন্ধ না পায়। তারপর চাপা গলায় বলল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমার সঙ্গে চলো।

নিতান্ত অনিচ্ছায় জুলি তাঁর গাড়িতে উঠলেন, পাশে ভাস্কর। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভাস্কর বলল, অনিল তোমরা এমনভাবে ফলো করো যাতে কেউ বুঝতে না পারে। যে বাড়িতে আমরা ঢুকব সেটা কভার করে অপেক্ষা করবে আধঘণ্টা। আমি না বের হলে চার্জ করবে।

বাট হোয়াই? অনিল মিত্র চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল আবার।

এসো বলছি। গাড়িটা যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে তখন পদম বাহাদুরকে নজরে এল। খুব উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশ দেখে এগোচ্ছে না। হাত নাড়ল ভাস্কর, হোটেলে থাকিস। এখনই ফিরছি।

কথাটা পছন্দ হল না পদমের। সে বোধহয় আরও উত্তেজনা চাইছিল। কিন্তু ছেলেটাকে যা-যা বলেছিল তা মান্য করেছে। অনিল মিত্রকে খবর দিয়ে না আনলে লোকটি গ্রেপ্তার হতো না।

বুদ্ধমূর্তিটা মাঝখানে সিটের ওপর, জুলির হাতে স্টিয়ারিঙ। বললেন, আমি জানি তুমি আমাকে ধরিয়ে দেবে প্রধানের খুনের কেসে। কিন্তু তা যদি আমি হতে না দিই?

কীরকম? কৌতুক করে বলল ভাস্কর।

যদি এই গাড়িটা নিয়ে খাদে ঝাঁপ দিই?

চমকে উঠল ভাস্কর। এখন তাদের ডান দিকে বিশাল খাদ, বাঁ-দিকে পাহাড়। সে আড়চোখে জুলির দিকে তাকাল। জুলির নগ্ন পা, সতেজ বুক আর আকর্ষণ করছে না। তরল একটা হিমস্রোত নেমে এল। তার মনে হল ও যা বলছে তা অবহেলায় করতে পারে। তা হলে কিছু করার উপায় থাকবে না। সে নির্লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করল। এখন প্রার্থনার সুরে কথা বললে জুলির জেদ চেপে যাবে। একটা কাণ্ড ঘটাতে দ্বিধা করবে না কারণ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ওর হাতে। ভাস্কর বলল, তোমাদের পারিবারিক বুদ্ধমূর্তিটা বেহাত হয়ে যাবে তাহলে।

মানে? চমকে উঠে পাশের মূর্তিটার দিকে তাকাল।

আমার যতদূর বিশ্বাস এই মূর্তি জাল।

জাল?

হ্যাঁ। আসল মূর্তি ছিল ওই গর্তের দ্বিতীয় বাক্সে। এটা আমার অনুমান। তুমি বললে বাক্সটায় মূর্তি ছিল। অথচ মিস্টার শেরিং তোমাকে বাক্সটা না দিয়ে লুকিয়ে রাখলেন গোপন জায়গায়। এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

তুমি কি বলতে চাও এটা—। মূর্তিটায় হাত দিলেন জুলি।

প্লিজ অপেক্ষা করো জুলি।

বাড়িটা ছবির মতো একটা পাহাড়ের মাথায়। পথে আসার সময় ওরা লক্ষ করেছিল পুলিশের গাড়ি বেশ দূরত্ব রেখে আসছে। বাড়িটার সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতেই ভাস্কর লাফিয়ে নামল। জুলি নামতেই সে বলল, পিছনদিকে কোনও দরজা আছে?

হ্যাঁ।

বাড়িতে আর কে-কে আছে?

ওরা দুজন ছাড়া কেউ নেই।

তুমি সামনের দরজায় নক করো। কথাটা বলে দ্রুত পায়ে ভাস্কর পেছনের দরজায় হানা দিল। সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিন্তু এপাশে একটা জানলার পাল্লা খোলা। কিন্তু তার গায়ে মোটা গ্রিল। অতএব ভাস্করকে আবার সামনে চলে আসতে হল।

জুলি নেই। দরজাটা খোলা।

খুব সন্তর্পণে ঘরে ঢুকল ভাস্কর। আর তখনই ভেতরের ঘরে আওয়াজ হল। কাল রাত্রে আমাকে খুব মারা হয়েছিল না? মেয়েকে পাহারায় রাখা হয়েছিল। সঙ্গে-সঙ্গে একটা থাপ্পড়ের শব্দ এবং জুলির আর্তনাদ। লোকটি চাপা গলায় বলল, গাড়িতে আর কেউ ছিল? আমার দিকে তাকাও।

হ্যাঁ।

কে?

ভাস্কর।

ঠিক তখনই পা চালাল ভাস্কর। সতর্ক ভঙ্গিতে অথচ অত্যন্ত দ্রুত পায়ে সে দূরত্বটা অতিক্রম করল, মাথায় ওপরে হাত তুলুন। নইলে খুলি উড়ে যাবে।

চট করে ফিরে দাঁড়াবার চেষ্টা করল গুরুদেব কিন্তু ধমকে উঠল ভাস্কর। একদম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। গুরুদেব যেন কী করা যায় ঠাওর করতে পারছে না। আর সময় নষ্ট করল না ভাস্কর। রিভলবারের বাঁট দিয়ে আধা জোরে আঘাত করল সে গুরুদেবের মাথায়। সঙ্গে-সঙ্গে কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল গুরুদেব। ততক্ষণে জুলি ছুটে গিয়েছে পাশের ঘরে। গিয়ে চিৎকার করে উঠল।

ভাস্কর বুঝল গুরুদেবের সম্বিত ফিরতে অন্তত মিনিট দশেক সময় লাগবে। সে একটা কাপড়ে টুকরোয় ওর চোখ দুটো বাঁধল। তারপর ধীরে-ধীরে পাশের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। পাথরের মতো বসে আছে একটি সতেরো বছরের মেয়ে। চোখ নড়ছে না। শরীর শক্ত। আর তাকে দুহাতে ধরে ঝাঁকিয়ে জুলি বললেন, কথা বল, তুই এমন করছিস কেন? কী হয়েছে তোর? কথা বল?

তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ। যা ইচ্ছে করো তুমি, ও আমার মেয়ে।

আমি কিছুই করতে চাই না। তবে কিছুক্ষণ ওকে ডেকে কোনও লাভ হবে না। ও এখন সম্মোহিত। তারপর ওর চোখের সামনে চোখ রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, বুদ্ধমূর্তিটা কোথায়?

পাশের ঘরে। খাটের তলায়। বিড়-বিড় করে বলল মেয়েটি। তার ঠোঁট যেন কাঁপল না।

দৌড়ে পাশের ঘরে ঢুকল ভাস্কর। তারপর বুদ্ধমূর্তিটা সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল জুলির কাছে। মেয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে সে। এই কয়েক মিনিটেই তাকে খুব বয়স্কা দেখাচ্ছে। বুদ্ধমূর্তির দিকে অবাক চোখে তাকাল সে।

ভাস্কর বলল, এই মূর্তি মিস্টার শেরিং ওই গর্তের বাক্সে রেখেছিলেন লুকিয়ে। এক বাড়িতে থেকে তুমি যে তা জানতে না এটা আমি বিশ্বাস করি। তোমার মেয়ে দেখেছিল এটাকে। তাই এখানে চলে আসার সময় ও লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। কারণ বৌদ্ধ এবং এই পরিবারের মানুষ হিসেবে ওর নিশ্চয়ই লোভ হয়েছিল মূর্তিটার ওপর। ওর কোনও দোষ নেই। বাইরে যেটা ছিল তোমার কাছে, সেটা জাল। ওই গর্তে আর-একটা বাক্স ছিল। তাতে ছিল দুটো অ্যাসিডের মিশ্রণ আর একটা একদম অব্যবহৃত সিরিঞ্জ। তোমার কথাই সত্যি। মিস্টার শেরিং গোপনে অ্যাসিড নেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছিলেন শরীরে। ইঞ্জেকশনে অ্যাসিড পুরে বাকিটা গর্তে রেখে উনি পানশালায় গিয়েছিলেন। বাকিটা তোমরা জানো। না জুলি, তুমি মিস্টার শেরিংকে খুন করোনি। তুমি চাওনি প্রধান নিহত হোক। আইন দিয়ে জোর করে তোমাকে বাঁধা যায় হয়তো, কিন্তু আমি সেটা চাই না। কিন্তু তুমি স্বামীর ইন্সুরেন্সের টাকা চেয়ো না। ওটা তো জেনে-শুনেই আত্মহত্যা। ঝুঁকি নেওয়া, যদি না মরি তা হলে ভালো লাগবে—এইরকম। তোমার দোকান আছে, আর এই বুদ্ধমূর্তিটা রইল। মেয়ের জন্যে কাগজপত্র ঠিক করে নিও। আমি চলি। ওই লোকটার ব্যবস্থা পুলিশ করবে।

দুটো পাথরের মূর্তিকে ঘরে রেখে বাইরের ঘরে এল ভাস্কর। গুরুদেব তখনও বেহুঁশ। ভারী পায়ে সে আকাশের নিচে আসতেই দেখল অনিল মিত্র এগিয়ে আসছে বাহিনী নিয়ে। ক্লান্ত গলায় ভাস্কর বলল, ভেতরে যাও। ওখানে তোমার আসামী আছে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করল।

***