বিষঘ্ন – ২

বাগানে নেমেই সতর্ক হল ভাস্কর। পদম যখন সিটি বাজিয়েছে তখন কেউ না কেউ এ বাড়িতে ঢুকেছে। সে চারপাশে নজর বুলিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে চলে আসতেই খেয়াল হল সেখানেই প্রৌঢ়টির অচেতন শরীর পড়ে আছে। বোধহয় প্রৌঢ়ের শরীরে তখন সাড় ফিরে আসছিল। ওর পেছনে সময় নষ্ট করার মতো সময় আর নেই। কারণ গেট খুলে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে নিরাপদ দূরত্বে। গাড়ির ড্রাইভার একজন টিবেটিয়ান নিচে নেমে চিৎকার করে কাউকে ডাকল। তারপর সাড়া না পেয়ে গাড়ির দিকে মুখ বাড়িয়ে কিছু জানাল। এইবার পেছনের দরজা খুলে গেল। ভাস্কর দেখল জুলি শেরিং মাটিতে নেমে বাড়িটার দিকে এক পলক তাকালেন। তারপর চাপা গলায় ড্রাইভারকে হুকুম করতেই সে একটু পিছু হটে দৌড়ে অনেকখানি লাফ দিয়ে বৈদ্যুতিক তারের সীমানা পেরিয়ে এ পাশে চলে এল। ভাস্কর আবার দেখল জুলি শেরিংকে। শক্ত-সমর্থ মহিলা যে একদা মেয়ের মতই সুন্দরী ছিলেন তার প্রমাণ এখনও তার শরীরে। সে আর অপেক্ষা করল না। যতটা সম্ভব নিচু হয়ে সে তারের সীমানা লাফিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে উঠে এল পাঁচিলের গায়ে। পাঁচিল টপকাবার সময় যদি জুলি শেরিং এদিকে তাকান তাহলে সে হয় ধরা পড়ে যাবে। এখানে কোনও আড়াল নেই। ভেতরে তখন একটি বিশেষ নাম ধরে চিৎকার, চেঁচামেচি চলছে। বোধহয় অচেতন প্রৌঢ়কে খুঁজছে ড্রাইভার। ঠিক তখনই বাইরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল মেয়েটি। আর তাকে দেখতে পেয়েই ক্ষিপ্ত হলেন জুলি শেরিং। চিৎকার করে বললেন, গো ইনসাইড। তারপরেই নিজের ভাষায় অনর্গল কিছু বলতেই মেয়েটি ঈষৎ ক্রুর ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল। এই সুযোগ হারাল না ভাস্কর। জুলি শেরিংয়ের উত্তেজনার সুযোগ নিয়ে সে পাঁচিল টপকে রাস্তায় উঠে এল। এবং সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পদমের মুখোমুখি হল। দাঁত বার করে হাসছে পদম। ইশারায় তাকে সঙ্গে আসতে বলে দ্রুত পা চালাল ভাস্কর। ক্লিন হার্ট রোড ছাড়িয়ে আসার পর ভাস্করের মনে হল এবার একটু খাওয়া যাক। সকাল থেকে অনেক উত্তেজনা হয়েছে।

মোটামুটি একটা ভালো রেস্তোরাঁ দেখে সে পদম বাহাদুরকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে চিকেন রোস্ট আর টোস্টের অর্ডার দিল। পদম এখন তার সামনে বসে পিটপিটিয়ে হাসছে।

সাহেব, একটা কথা বলব?

মাথা নাড়ল ভাস্কর।

পদম বলল, আপনি আমার চেয়ে অনেক বড় ওস্তাদ। একটা চিড়িয়া পর্যন্ত ওই বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না আর আপনি—। কথাটা শেষ করল না পদম কিন্তু ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে ভাস্কর তার চেয়ে অনেক বড়দরের অপরাধী। ভাস্করের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তার ইচ্ছে করছিল এক চড়ে ছেলেটার হাসি ভোঁতা করে দেয়। তার আফসোস হচ্ছিল এই ছিনতাইবাজকে সাক্ষি রাখার জন্যে। কিন্তু সে নিজেকে শান্ত করল। পদম বাহাদুরকে তার এখন প্রতি পদে প্রয়োজন হবে। অনেক চেষ্টায় সে হাসির ভান করল। তারপর পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে পদমের সামনে মেলে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে মুখ চোখ পাল্টে গেল পদমের। মাপ কিজিয়ে সাব। আমি বুঝতে পারিনি। আর কখনও ভুল হবে না। বারংবার কথাগুলো বলে সে নিজের গালে নিজেই চড় মারল, সাহেব যে বড় অফিসার তা বুঝতে পারিসনি শালা, তুই আবার আদমি চিনে ছুরি তুলবি?

ভাস্কর গম্ভীর গলায় গলল, ওটা আর কখনও যেন না হয়। আবার বলছি, এতদিন যা করেছিস সে-সব কথা একদম ভুলে যা।

ঠিক হ্যায় সাহেব। আর বলব না। বিনীত ভঙ্গিতে জানাল পদম।

খাওয়া-দাওয়ার পর পদমের চেহারা পাল্টে গেল। সে বোধহয় জীবনে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে অত দামি খাবার খায়নি। ফুর্তিতে চটপটে গলায় জিজ্ঞাসা করল, এবার কী করতে হবে সাহেব?

নামচে বস্তিতে চল। রোস্টেড মুরগি কিনে একটা প্যাকেটে ভরল ভাস্কর।

হুকুমটা যে মোটেই পছন্দ হল না তা পদমের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। খানিকটা অনিচ্ছায় সে একবার ভাস্করের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যেই ওরা শহরের ব্যস্ততা ছাড়িয়ে এল। রাস্তা বেশ নির্জন। গরিব পাহাড়ি মানুষেরা সাংসারিক কাজ করছে দু-পাশের কাঠের বাড়িতে। ভাস্কর খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল। নীল চোখের মেয়েটি তাকে প্রবল আকর্ষণ করছিল। সেই সঙ্গে জুলি শেরিংয়ের গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানোর ভঙ্গি বুঝিয়ে দিয়েছিল সে ওই মেয়ের মা। জুলি কিছুতেই মেয়েকে বাড়ির বাইরে আসতে দেবে না। আর সেই নিষেধ শোনা মাত্র মেয়ের মুখে-চোখে যে ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছিল তা থেকে অন্তত এটুকু বোঝা যায় যে মা-মেয়ের সম্পর্ক ভালো নয়। মেয়েটি কি মাকে বলবে একটা লোক গোপনে বাড়িতে ঢুকে লুকোনো নব ঘুরিয়েছে? বলে দেওয়া স্বাভাবিক। অবশ্য মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা যদি বেশি হয় তাহলে অন্য কথা। ভাস্কর নিশ্চিত হতে পারছিল না মেয়েটি জুলি শেরিংকে তার কথা জানাবে কি না! জানলাটা সে ভাঙেনি। কায়দা করে ছিটকিনি খুলেছিল মাত্র। খুব সতর্ক চোখে পরীক্ষা না করলে বোঝা যাবে না দাগটা। অবশ্য সেই প্রৌঢ় মানুষটি সাক্ষি দেবে ওই বাড়িতে আগন্তুক ঢুকেছিল। যারা নিজের বাড়ি বৈদ্যুতিক তার ঘিরে রাখে বাইরের মানুষের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্যে তারা অচেতন প্রৌঢ়টিকে আবিষ্কার করার পর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেই। হয়তো মেয়েটি বাধ্য হবে সমস্ত কথা বলতে। আবার সেটা নাও হতে পারে। ভাস্কর অনিশ্চয়তায় দুলছিল। শুধু বারংবার তার মনে পড়ছিল মেয়েটি যখন তার আঙুল স্পর্শ করেছিল তখন অদ্ভুত একটা সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল শরীরে। কিন্তু তাকে দেখে মেয়েটি চিৎকার করেনি কেন? চোর বা ডাকাত বলে ভয় পায়নি কেন? শঙ্কিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু শেষে একটু-একটু করে সহজও তো হয়ে আসছিল। রহস্য উদ্ধার করতে পারছিল না ভাস্কর।

কতটা পথ হেঁটে এসেছে খেয়াল ছিল না, এখন মুখ ফিরিয়ে দেখল শহরটা অনেক ওপরে। পাহাড়ি পথে নামবার সময় দূরত্ব টের পাওয়া যায় না। এই সময় একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে পদম আঙুল তুলে দেখাল, ওইটে হল নামচে বস্তি।

এদিকে জনবসতি বেশি নেই। অনেকটা ফাঁকা পাহাড় আর জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বস্তিটাকে দেখা যাচ্ছে। পঁচিশ-ত্রিশ ঘর বাসিন্দা সেখানে রয়েছে। অবশ্য রাস্তা পিচের এবং পরিষ্কার।

দূরত্বটা অতিক্রম করতে বেশি সময় লাগল না। পদম এখন বেশ স্মার্ট হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলছে কম। কিন্তু সমানে শিস দিয়ে চলেছে আগে-আগে। বস্তিতে পৌঁছে ভাস্কর বুঝল এদের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। কর্মঠ মানুষজন তেমন চোখে পড়ল না। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং শিশুরা ওদের অবাক চোখে দেখছিল। পদম মানুষগুলোকে একদম পাত্তা না দিয়ে শেষপ্রান্তে চলে এল। সেখানে বস্তি থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা কাঠের দোতলা জীর্ণ বাড়ি দাঁড়িয়ে। সেটার দিকে আঙুল তুলে পদম নিচু গলায় বলল, ওই বাড়িটায় বুড়ো থাকে। যাওয়ার আগে আর-একবার ভাববেন সাহেব। তিব্বতি বুড়োটাকে মাঝে-মাঝে শয়তান ভর করে। তখন ওর চোখের সামনে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নীরবে মাথা নাড়ল ভাস্কর। তারপর প্যাকেটটা হাতে ঝুলিয়ে সে এগিয়ে গেল কাঠের বাড়িটার দিকে। সে লক্ষ করল বস্তির বাচ্চা এবং বৃদ্ধারা বেশ দূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে।

কাঠের দোতলাটায় ঘর, নিচে শুধু গোটা-আটেক বিম যার ওপর বাড়িটা দাঁড়িয়ে। জরাজীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরের বারান্দায় উঠে ভাস্কর ডাকল, কোই হ্যায়?

হুম। একটা চাপা হুঙ্কারের মতো আওয়াজ ভেসে এল দুটো ঘরের কোনো একটা থেকে। তারপর অদ্ভুত একটা বাজনা বেজে উঠল। ডুম ডুম ডুমাং, ডুম ডুম ডুমাং। এবং সেইসঙ্গে অদ্ভুত গলায় অবোধ্য ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণের মতো কিছু শব্দ। ভাস্কর মুখ ঘুরিয়ে দেখল পদম তো বটেই বস্তির উৎসুক দর্শকরা আওয়াজ হওয়া মাত্র ত্রস্তে অনেক দূরে সরে গেল। সামান্য ইতস্তত করে সে কয়েক পা এগিয়ে প্রথম ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়াতেই একটা গর্জন ছিটকে এল। ব্যাপারটা এমন আচমকা যে ভাস্করের নিশ্বাস এক পলকের জন্যে থমকে গিয়েছিল। ঘরের ভেতরটায় প্রায় অন্ধকার। খোলা দরজা দিয়ে যেটুকু আলো যাচ্ছে তাতেই মানুষটিকে দেখতে পেল। ওরকম তীব্র জ্বলন্ত চোখ এর আগে কখনও দেখেনি ভাস্কর। তিব্বতি পোশাক পরা এক বৃদ্ধ বাবু হয়ে বসে দু-তিন ফুট লম্বা তেল চুকচুকে একটা কিছু নাচিয়ে যাচ্ছে সামনে। লোকটির মাথায় বিশ্রী ধরনের জটা। ভাস্কর একটু সামলে নিয়ে হাসবার চেষ্টা করল। তারপর হিন্দিতে বলল, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সঙ্গে-সঙ্গে হাতের সঞ্চালন থেমে গেল। লোকটি বলল, কী চাও?

কথা না বললে কী করে বোঝাব? ভাস্কর আর-একটু এগিয়ে আসতেই লোকটি চিৎকার করে উঠল, তফাত যাও। নইলে তোমার মাথায় গোখরো ছোবল মারবে।

হকচকিয়ে এক পা পিছিয়ে গেল ভাস্কর। সঙ্গে-সঙ্গে হেসে উঠল লোকটা সশব্দে, সবাই ভয় পায়। হুঁ-হুঁ বাবা, নাগকে ভয় পায় না এমন কোনও জীব পয়দা হয়নি। ওই যে দেখো অতবড় চেহারার জীব হাতি, সে পর্যন্ত নাগকে চটায় না। তুমি তো কোন ছার?

ততক্ষণে ভাস্কর বুঝেছে গোখরোর ব্যাপারটা অভিনয় মাত্র। সে এবার খাবারের প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল, আপনার জন্যে এনেছিলাম।

কী আছে ওতে?

দামি দোকানের খাবার।

দেখি। ছুড়ে দাও ওখান থেকে।

একটু বিরক্ত হয়ে প্যাকেট ছুড়তেই লুফে নিল লোকটা। তারপর তড়িঘড়ি বাঁধন খুলে মুরগির ঠ্যাং বের করে শিশুর মতো হাসল। ভাস্কর দেখল লোকটি ডানহাতে ঠ্যাংটা ধরে হাঘরের মতো চিবিয়ে যাচ্ছে। যেন কোনওকালে সে এইসব খাবার খায়নি বা অনেকদিন হয়তো একেবারেই অভুক্ত আছে।

খাওয়া শেষ হলে লোকটা তৃপ্ত মুখে জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

ভেতরে আসব?

আসতে পারো। তবে হ্যাঁ, আমাকে ঘুষ দিয়ে যে কাজ হাসিল করবে সেটি হচ্ছে না। আমি সহজে ভুলি না। লোকটি মাথা নাড়ল।

সতর্ক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল ভাস্কর। আশেপাশে সাপের কোনও চিহ্ন নেই। মাথার ওপর একটা ঝুলজমা সিলিং। একটা ভাঙা টুল দেখতে পেয়ে সেটাকে টেনে নিয়ে বসল ভাস্কর।

মতলব কী?

আমার যে মতলব আছে তা জানলেন কী করে?

এখানে তো মতলব ছাড়া কেউ আসে না। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে সাপের বিষ চাই, মানুষ মারার জন্যে বিষ চাই, নেশা করার জন্যে সাপের কৌটো দরকার—হাজির হও এখানে। সব শালা ধান্দাবাজ। তোমার ধান্দাটা কী বলে ফেল! লোকটা তার আলখাল্লার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তেল চুকচুকে সত্যিকারের সাপ বের করে এনে আদর করতে লাগল।

আপনি সাপের বিষ চেনেন?

অ্যাঁ? তুমি কোনও মাকে জিগ্যেস করছ বুকের দুধ দেখেছে কি না! কী আজব বাত। আমি বিষ চিনব না কি তুমি চিনবে? তোমার কী চাই?

ভাস্কর হাসল, আপনিই বলুন তো কী চাই?

হঠাৎ প্রচণ্ড খেপে গেল লোকটা, আমাকে মুরগি খাইয়ে কিনে নিয়েছ? খেলা হচ্ছে আমার সঙ্গে। কথা শেষ করে শিস দিল লোকটা। সঙ্গে তার হাতের সাপটা তড়াক করে খাড়া হয়ে ফনা তুলল। যদিও ভাস্কর বেশ দূরত্বে বসেছিল তবু তার শরীরে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা জিগ্যেস করল, ধান্দাটা কী সত্যি করে বলো। নইলে ও তোমায় ছাড়বে না।

ওটাকে শান্ত হতে বলুন আগে নইলে কথা বলা যাবে না।

মানে?

আমাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারবেন না।

লোকটা এবার অদ্ভুত চোখে ভাস্করকে দেখল। তারপর ঠোঁটে একটা শব্দ করতেই সাপটা গুটিয়ে এল। সেটাকে আবার তুলে নিয়ে লোকটা বলল, শাবাশ। হিম্মতবাজ মানুষের সঙ্গে কথা বলার আরাম আছে। এখানে যারা আসে তাদের মধ্যে জুলি ছাড়া আর কারও এমন হিম্মত নেই।

নাড়া খেল ভাস্কর। বাঃ, চমৎকার।

সে নিচু গলায় বলল, ছোট সাপ রাখেন?

ছোট সাপ?

ছোবল খাওয়ার সাপ?

তুমি তো নেশা করো না।

কী করে বুঝলেন?

তোমাকে দেখে।

অন্যের জন্যে দরকার।

যার দরকার কাকেই আসতে বলো।

আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই। মিস্টার শেরিংকে চিনতেন? যার মদের দোকান ছিল।

বুড়ো শেরিং? হ্যাঁ, লোকটা নেশা করতো বটে। তারপর হঠাৎ সুর পাল্টে জিগ্যেস করল, তার কথা তুমি জানলে কী করে? তোমার সঙ্গে আলাপ ছিল?

হ্যাঁ। বুড়ো শেরিং আপনার কথা বলেছিল আমাকে। মদ খেলে আমার নেশা হয় না, বমি হয়ে যায়। বুড়ো বলেছিল তাই আপনার কাছে আসতে। মিথ্যে কথা বলতে গলা কাঁপল না ভাস্করের।

লোকটা মাথা নাড়ল। তারপর উঠে দাঁড়াতে আরও দুটো সাপ ওর শরীর থেকে নেমে আসনের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে রইল। লোকটা এতক্ষণ সাপের সঙ্গে বাস করছিল? পাশের দরজা খুলে লোকটা ভাস্করকে ডাকল। ভাস্কর কাছে যেতেই বলল, ওই ঘরে তিরিশটা কালনাগিনী ছিল এক সময়। এখন মাত্র পাঁচটা আছে। আর কৌটোয় ধরা সাপ আছে পনেরোটা। ওগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। লোকেরা নিজেদের ধান্দায় আমার কাছে এসে কিনে নিয়ে যায়। তুমি যখন বুড়ো শেরিংয়ের বন্ধু তখন তোমায় বলি, বুড়ো লোকটা ভালো ছিল। অন্তত আমার কাছে। অনেক টাকা খেয়েছি ওর কাছে সাপ বিক্রি করে।

ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে ভাস্কর বলল, জুলি শেরিং কি রোজ আপনার কাছে আসে?

রোজ? রোজ কেউ আমার কাছে আসে না। জুলিকে পাঠিয়েছিল বুড়ো শেরিং। দুবার এসেছিল সে।

বুড়ো বলত ছোবলে তার কাজ হয় না। তাই ইঞ্জেকশন দিয়ে বিষ ঢোকানোর কথা বলত হাতের শিরায়। আমি রাজি হতাম না। এসব কথা তোমাকে আমি বলছি কেন? হঠাৎ সচেতন হল বৃদ্ধ। তারপর সন্দেহের চোখে তাকাল।

ততক্ষণে পকেট থেকে কাঠের বাক্স বের করে শিশিটা সামনে ধরেছে ভাস্কর, এটা কোন সাপের বিষ?

দেখি? চকচক করে উঠল লোকটার চোখ।

ভাস্কর একটু দোনামনা করল। তারপর শিশিটা বৃদ্ধ লোকটার হাতে তুলে দিল। লোকটা চোখের সামনে শিশিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। তারপর বলল, এটা কোনও সাপের বিষ নয়।

চমকে উঠল ভাস্কর, কী বলছেন? ঠিক করে বলুন?

লোকটা মাথা নাড়ল, আমাকে বিষ চিনিও না। আমি এই শিশিটাকে চিনি। এতে করেই কেউটের বিষ নিয়ে গিয়েছিল জুলি শেরিং। কিন্তু এখন এতে যা আছে তা সাপের বিষ নয়। বলতে-বলতে ছিপি খুলে সাবধানে ঘ্রাণ নিল লোকটা। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, না কক্ষনও না। এ সাপের বিষ নয়, ওষুধ। শিশিটা বন্ধ করে ছুড়ে দিল লোকটা ভাস্করের হাতে। লুফে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। যে রোজ সাপের ছোবল খায় তাকে কেউটে কামড়ালে মরবে?

মাথা নাড়ল বুড়ো, একদিন অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারে। হয়তো দুদিন। কিন্তু রোজ যার শরীরে বিষ ঢুকছে তার কলজে শক্ত হয়ে যায়।

পার্স খুলে দশটা টাকা বের করল ভাস্কর। তারপর বলল, অনেক ধন্যবাদ। যদি কখনও দরকার হয় আবার দেখা হবে।

টাকাটা ছুড়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এল বাইরে।

ভাস্করকে স্বচ্ছন্দে হেঁটে আসতে দেখে পদম বাহাদুর এগিয়ে এল, তিনশো টাকা দাম নিল সাহেব?

তিনশো?

ওই যে কৌটোর সাপ কিনতে গেলেন তার দাম।

আমি সাপ কিনিনি পদম। কারণ আমার ওই নেশা নেই।

কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেল ছেলেটা। সাহেব এসেছিল সাপ কিনতে ছোবল খেয়ে নেশা করবে বলে। যাওয়ার সময় বলছে সেই নেশা নেই। সে ভাস্করের পাশে হাঁটতে-হাঁটতে উশখুশ করছিল। সাহেবকে এখন তার আরও রহস্যময় লাগছে। তবে সে এটুকু বুঝতে পেরেছে এই মানুষটি বেশ ক্ষমতাবান। এর সঙ্গে লেগে থাকলে আখেরে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লোকটার গায়ে যে শক্তি আছে এতে তার নিজের কোনও সন্দেহ নেই। সঙ্গে আবার ছবিওয়ালা কার্ড আছে যা একমাত্র পুলিশদের থাকে। বড়-বড় পুলিশদের। পদম সেটা শুনেছে।

দুপুরে স্নান করে মিনিট তিরিশ শুয়েছিল ভাস্কর। বুড়ো শেরিং সাপের ছোবলের নেশা করত। তাতে তার তৃপ্তি হতো না। সে ইঞ্জেকশনে সাপের বিষ ভরে নেশা শুরু করেছিল। এই উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল বউ জুলিকে সেটা বুড়ো তিব্বতির কাছে থেকে সংগ্রহ করে আনতে। জুলি দুবার গিয়েছে, বুড়োর কথায় জানা গেল। ধরা যাক, প্রথমবার সে ঠিক বিষ এনেছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিষ এনে তার জায়গায় যে জিনিসটা শিশিতে ঢেলেছিল সেটা জানতে আর কয়েক ঘণ্টা লাগবে। শহরে ফিরে ভাস্কর একটা ল্যাবরেটরিতে জমা দিয়ে এসেছে সেটাকে পরীক্ষার জন্যে নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে। যদি ওই জিনিসের কোনও পরিমাণ বুড়ো শেরিংয়ের শরীরে কোনও ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তাহলে ব্যাপারটায় কোনো অন্ধকার থাকে না।

সকালের ব্রেকফাস্ট বেশ ভারী হয়ে যাওয়ায় মনে হয়েছিল দুপুরের খাওয়ার তেমন দরকার হবে না। কিন্তু এতটা পথ ওঠানামা করার পর এখন বেশ খিদে পাচ্ছে। কাল এখানে আসার পর থেকে সে লোকাল অফিসের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। ওদের না জানিয়ে যতটা এগিয়ে যাওয়া যায় ততটাই ভালো। কারণ জুলি শেরিংকে সাহায্য করতে ওখানে কেউ নিবেদিত প্রাণ হয়ে আছে কি না কে জানে। কিন্তু আজ না হোক, আগামী কালই একবার যাওয়া উচিত। হেড-অফিসকে সে বলেনি এতটা গোপনে কাজ করবে। কে জানত, জুলি শেরিং বাড়িার চারপাশে ইলেকট্রিক তার ছড়িয়ে রাখে। ব্যাপারটা কী করে পুলিশের অনুমতি পেল তাই বিস্ময়ের।

ব্যাপারটা জিগ্যেস করবে সে অনিল মিত্রকে। অনিল এই শহরের পুলিশের বড়কর্তা। একসময়ে ওরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। ভাস্কর ভেবেছিল তার উপস্থিতির কথা অনিলকেও জানাবে না। কিন্তু ল্যাবরেটরি যদি রিপোর্ট দেয় ওই শিশির ওষুধ গোলমেলে তাহলে হয়তো প্রয়োজন হবে।

এছাড়া আর-একটি ব্যাপার ঘটেছে। তার অনুপস্থিতিতে কেউ এই ঘরে ঢুকেছিল। তার সুটকেস হাতড়েছে কেউ। ইচ্ছে করেই সে ওটায় চাবি দিয়ে যায়নি। টাকা-পয়সা বা অন্য দরকারি জিনিস সে চিরকাল সঙ্গেই রাখে। অতএব অনুসন্ধানকারী কোনও কিছুর তল্লাশ পায়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, কে এসেছিল? জুলি শেরিংয়ের পক্ষে কিছুতেই জানা সম্ভব নয় তার অস্তিত্বের কথা। তাহলে?

এই সময় দরজায় শব্দ হল। ভাস্কর সতর্ক হয়ে উঠে দরজা খুলে দিতেই শাজাহানবাবুকে দেখতে পেল। নেশায় চুর হয়ে আছে ভদ্রলোক। দুটো পা স্থির থাকছে না। তাকে দেখে বলল, সরি। আবার নম্বর ভুল করে ফেলেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না ভাই।

আপনি খুব বেশি নেশা করেছেন।

করতাম না। আপনি বললেন থেকে যেতে। আমি দেখলাম যখন চান্স পাওয়া গেল তখন মনের সুখে খেয়ে নিই। কলকাতায় গেলে তো আর মদ খেতে পাব না স্ত্রীর জ্বালায়। হাসতে চেষ্টা করল ভদ্রলোক। ভাস্কর ওর হাত ধরল, চলুন আপনার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি। বাধ্য ছেলের মতো শাজাহান ওর সঙ্গে হেঁটে এল। দরজা বন্ধ ছিল। ভাস্কর কয়েকবার আওয়াজ করার পর প্রৌঢ় এবং স্থূলকায় এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। তার চুলগুলো ঘাড় অবধি নেমেছে। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। বেশ দুধে ঘিয়ে মানুষ তা এক নজরেই বোঝা যায়। কপালে সিঁদুরের টিপ কিন্তু শরীরে ফিনফিনে পাঞ্জাবির ওপর শাল আর লুঙ্গি করে পরা সিল্কের একটা কাপড়।

শাজাহান সেই অবস্থায় বলল, গুরুদেব। খুব বড় তান্ত্রিক।

আইচ্ছা! আয়েন, ঘরে আয়েন। আপনার কথা এঁর লগে অনেক শুনছি। উদার গলায় আহ্বান জানালেন ভদ্রলোক।

ঘরে ঢুকে শাজাহান নিজের বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। এবং তখনই ভাস্করের চোখে পড়ল একজন মধ্যবয়সি সুদর্শনা মহিলা সামান্য আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। গুরুদেব ডাকলেন, ঘরে আয়েন, একটু আলাপ করি।

ভাস্কর এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসল। ভদ্রলোকের পাশ ঘেঁষে হাঁটার সময় সে বিলিতি সুবাস পেয়েছে। মানুষটি শৌখিন সেটা বোঝা যাচ্ছে বিছানায় পড়া মাত্র কোনও মানুষের নাক ডাকে শাজাহানকে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। সেদিকে তাকিয়ে গুরুদেব বললেন, নন-ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট। আপনার নিশ্চয়ই মনে হয় কেন আমি সিঙ্গল রুম না নিয়ে এর সঙ্গে শেয়ার করে আছি! তার কারণ আমার অনেকটা স্পেস চাই। সিঙ্গল রুম বড্ড ছোট। আর অন্য হোটেলে গেলে বাঙালিদের উপদ্রব বেশি। আমি একটু সাধনা করি, শিষ্য-শিষ্যারা আসে। ওরা অবশ্য আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমি মশাই কোনও গৃহীর কাছে থাকতে চাই না।

আচমকা ছিমছাম বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন গুরুদেব। প্রাথমিক পূর্ববঙ্গীয় টান উধাও হয়ে গেল।

আমার ঘরে কী খুঁজতে গিয়েছিলেন? আচমকা প্রশ্ন করল ভাস্কর।

আপনার আইডেন্টিটি। নির্বিকার মুখে জানালেন গুরুদেব।

এতটা আশা করেনি ভাস্কর। লোকটি অত্যন্ত ঘোড়েল কিংবা শয়তান।

আপনি নিশ্চয়ই বলবেন আপনার অনুপস্থিতিতে কাজটা করা অন্যায়। একশোবার অন্যায়। কিন্তু পাশের ঘরে একজন বাঙালি টিকটিকি বাস করলে সেটা কার ভালো লাগে মশাই।

আপনার ব্যবসা কী?

সেটা নাই জানলেন। কারণ আপনি তো আমার উদ্দেশ্যে আসেননি।

আমি কী উদ্দেশ্যে এসেছি সেটা আপনি জানেন?

ঠিকঠাক জানি না। তবে আপনি যখন একটা মদের দোকানে ঢুকে মদ না খেয়ে বেরিয়ে আসেন এবং সেই দোকানের মালিকের বাড়িতে চোরের মতো ঢোকেন তখন এটা পরিষ্কার যে আমার সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই। বিগলিত হাসলেন গুরুদেব।

তীব্র চোখে তাকাল ভাস্কর, আপনি কে?

আমি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তবে হ্যাঁ, আপনার ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা অন্যায় হয়ে গেল এজন্যে আবার দুঃখ প্রকাশ করছি। এখন বলুন তো, আমি আপনার কী সেবা করতে পারি? গুরুদেব ফিরে গেলেন নিজের আসনে। তারপর গ্যাঁট হয়ে বসলেন।

সেবা?

অতিথি নারায়ণ, তার সেবা করব না?

ভাস্কর লোকটির চোখের দিকে তাকাচ্ছিল। একটা লোক তার ঘরে ঢুকেছিল চোরের মতো জানতে পেরেও সে উত্তেজিত হচ্ছে না। লোকটার নিশ্চয়ই কিছু ক্ষমতা আছে। এবং ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললে সেই ক্ষমতায় আক্রান্ত হতে হয়। সে মহিলার দিকে তাকাল। সেই থেকে ভদ্রমহিলা একই ভঙ্গিতে বসে আছেন। এবং তখনই মনে হয় উনি ঠিক চেতনায় নেই। সে বলল, আপনাকে আমি বুঝেছি। আপনার ব্যবসাটাও।

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না কেন?

আমি নির্বোধ নই বলে।

হুম।

যদিও আপনি জানেন আমি আপনার উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি কিন্তু মানুষকে সম্মোহিত করে আপনার কী লাভ সেটা জানতে পারি?

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর গুরুদেব বললেন, নাঃ, আপনি বুদ্ধিমান। আর বুদ্ধিমানের সঙ্গে মিত্রতা করতে আমি ভালোবাসি। তবে শুনুন। আমি আজ পর্যন্ত কোনও মানুষের ক্ষতি করিনি। তবে অত্যন্ত প্রয়োজনে চাপ দিয়ে টাকা নিই যাতে একটু ভালোভাবে থাকতে পারি। টাকা নিই তারই কাছে যার সেটা দেবার ক্ষমতা থাকে। আচ্ছা, আপনাকে একটা উদাহরণ দেখাই—। বলতে-বলতে গুরুদেব উঠে মহিলার সামনে বসলেন, কমলাদেবী, আপনি খুব ভদ্রমহিলা, আপনার স্বামী কি আপনাতে আসক্ত?

মহিলা খুব ধীরে-ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, আগে ছিল, এখন না।

ওঁর ব্ল্যাক মানি আছে?

অনেক। মহিলা জবাব দিলে যেন বহুদূর থেকে স্বর ভেসে এল।

এবার গুরুদেব ভাস্করের দিকে তাকিয়ে হেসে নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বললেন, এখন ইচ্ছে করলে আমি ওঁর কাছ থেকে অনেক গোপন তথ্য জেনে নিতে পারি যা পরে আমার টাকা উপায়ে সাহায্য করবে। কোনও পুলিশের বাপের সাধ্য নেই আমাকে ধরে। আসলে আমি প্রকাশ্যে কোনও ক্রাইম করছি না। তাই না? গুরুদেব মধুর হাসলেন, আমার এখানে শিষ্যরা আসে বলে হোটেলের মালকিনের কোনও আপত্তি নেই কেন তা বুঝলেন? এখন এই অবস্থায় যদি শুনি পাশের ঘরে এমন কেউ এসেছে যার গতিবিধি সন্দেহজনক তা হলে অস্বস্তি হয় কি না বলুন? তাই মন স্থির করতে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখলাম আপনার জিনিসপত্র। আগেই ক্ষমা চেয়েছি, আবার চাইছি। এবার আপনি আসুন কারণ ভদ্রমহিলার চেতনা ফিরে আসার সময় হয়েছে। আমি দশ-বারো মিনিটের বেশি আচ্ছন্ন রাখতে পারি না কাউকে।

ভাস্কর উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনি চালিয়ে যান। আপনার কোনও অপরাধ যদি আমার চোখে প্রমাণ সমেত ধরা না পড়ে তা হলে তাতে আমার আপাতত কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে প্রয়োজনে হয়তো আপনাকে আমার দরকার হতে পারে। সেই সময় কি সাহায্য পেতে পারি?

আবার বিগলিত হলেন গুরুদেব, অবশ্যই। আমি আর আটচল্লিশ ঘণ্টা এখানে আছি। তার মধ্যে প্রয়োজন হলে জানাবেন।

তৃপ্তি করে দুপুরের খাওয়া যখন শেষ করল ভাস্কর, তখন এই পাহাড়ি শহরে রোদ নেই, আকাশে হালকা মেঘ উড়ছে এবং ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘরে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সে সোজা ল্যাবরেটরিতে চলে এল।

রিপোর্ট দেখে চমকে উঠল সে। বৃদ্ধ সাপুড়ের কথাই ঠিক। ওটা কোনও সাপের বিষ নয়। তীব্র দুটো অ্যাসিড মিশিয়ে রাখা হয়েছে শিশিতে। সেটা ধমনীতে প্রবেশ করার কয়েক মিনিটের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যাবে। এই মিশ্রণের সঙ্গে শঙ্খচূড়ের বিষের খুব সূক্ষ্ম সাদৃশ্য আছে। শরীরে বেশিক্ষণ থাকলে পোস্টমর্টেমে দুটোকে গুলিয়ে ফেলার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে অ্যাসিড এবং সাপের বিষের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান তা বিশেষজ্ঞ মাত্রেই চোখে পড়বে। কিন্তু এখানে যে একটা কৌশল ছিল তা পরিষ্কার।

রাস্তায় নেমে মন স্থির করতে দুদণ্ড সময় নিল ভাস্কর। মিস্টার শেরিংয়ের শরীরে যদি এই বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে ওই সিরিঞ্জ এবং শিশিটি কেন নষ্ট করে ফেলা হল না? কেন সেটা সঞ্চয় করে রাখলেন বাড়ির মালকিন? কেউ কি নিজের অপরাধ প্রমাণ করার ব্যবস্থা জিইয়ে রাখে? হঠাৎ ভাস্করের মাথায় আর একটা প্রশ্ন ঢুকল। ওই সিরিঞ্জেই কি এই শিশির মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছিল? এটা জানতে পারা অবশ্য এমন কিছু অসুবিধের নয় যদি না খুব সুপটু হাতে ওটাকে বিশুদ্ধ করা হয়।

কাঁধ ঝাঁকালো ভাস্কর। অনেক হয়েছে। এর মধ্যে সে এই সত্যে পৌঁছেছে যে মিস্টার শেরিং প্রচণ্ড নেশা করতেন। মদ-গাঁজায় তার শানাত না বলে ছোট সাপের ছোবল নিতেন। শেষ দিকে তাতেও আরাম না হওয়ায় সাপের বিষ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে নেওয়া শুরু করেন। এই সুযোগটিকে কাজে লাগাল কেউ। সাপের বিষের বদলে অ্যাসিডের মিশ্রণ দেওয়া হয়েছিল মিস্টার শেরিংকে। কী স্বার্থ ছিল তার? বুড়ো সাপুড়ের কথা অনুযায়ী জুলি শেরিং দুবার সাপের বিষ আনতে গিয়েছিল। সহজ ধারণায় জুলিকেই এর জন্যে দায়ী করা উচিত। এবং সেটার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। দুজনের বয়সের পার্থক্য তো ছিলই। হয়তো অবৈধ প্রেমও এটা করতে সাহায্য করেছে। তা ছাড়া, বৈদ্যুতিক তারের বেড়া, স্বাস্থ্যবান প্রহারী, মেয়েকে লুকিয়ে রাখার ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে ভদ্রমহিলা সোজা চরিত্রের মানুষ নন।

কিন্তু তাহলে জুলি শেরিং এই বস্তুগুলো কেন রেখে দেবেন বাড়িতে? আর ওই মোটরবাইক চালিয়ে ছোকরাটাই বা কে? সে-ই কি জুলির প্রেমিক? এত সহজে সব কিছুর সমাধান হয়ে যাচ্ছে, মন মানতে চাইছিল না। সে হাতঘড়ি দেখল। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গুরুদেবটির সেই মানচিত্র আঁকা দেওয়ালের সামনে আসার কথা। লোকটা অপরাধ করছে ঠিকই কিন্তু এমন অপরাধ তার আওতার মধ্যে পড়ে না। সম্মোহন করে শেষের কথা জেনে নিয়ে পরে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করা অবশ্যই আদালত ক্ষমা করবে না কিন্তু আপাতত তার এ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। সে পুলিশে চাকরি করে না। তাকে যা করতে বলা হয়েছে সেটা করতে এসেই একেবারে সমুদ্রের মাঝখানে ডুব দিয়ে ফেলেছে। আগে এটা সমাধান হোক।

যদিও গুরুদেব কথা দিয়েছিলেন কিন্তু ভাস্করের সন্দেহ ছিল পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর ভদ্রলোক হাওয়া হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ঠিক সময়ে ওঁকে হাজির হতে দেখে ভালো লাগল তার। পাঁচ ফুটের মধ্যে থাকলে সে কখনওই লোকটার চোখের দিকে তাকাবে না বলে ঠিক করেছে। মুখোমুখি হতেই গুরুদেব বললেন, বলুন, আপনার কোনও সেবায় আমি লাগতে পারি?

ভাস্কর উদাস চোখে হাসল। তারপর বলল, আপনি তো একটার পর একটা অপরাধ করে যাচ্ছেন। আজ একটা ভালো কাজ করুন।

কী কাজ? গুরুদেবের গলার স্বর বেশ চিন্তিত।

এই শহরের সমস্ত মহিলাকে আপনি চেনেন?

ওই যাঃ। এমন কথা বললেন যেন আমি—! না মশাই, তা চিনি না।

জুলি শেরিং বলে কাউকে চেনেন?

এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন গুরুদেব। তারপর বললেন উঁহু। আমি আছি টিবেটিয়ান হোটেলে। শেরিং যখন তখন মনে হচ্ছে টিবেটিয়ান। ওই লাইনে নেই। আমার সব শিষ্যা বাঙালি, মাড়োয়ারি।

ভালোই হল। আপনি আমার সঙ্গে এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে যাবেন। ধরে নিন আপনি শুনেছেন যে স্বামীর মৃত্যুর পর জুলি ওই বাড়ি বিক্রি করবে। আপনি ওখানে একটা আশ্রম খুলতে চান। তাই দরাদরি করতে এসেছেন। আর আমি আপনার শিষ্য, সঙ্গে এসেছি।

যাচ্চলে! খামোকা মিথ্যে বলতে যাব কেন?

একটা ভালো কাজ করতে। আমি দেখতে চাই আপনার সম্মোহনের ক্ষমতা কতটুকু! এই একটি কাজ করলে আপনার সঙ্গে সন্ধি হতে পারে। বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু আমার প্রশংসা করে যাবেন।

সম্মোহন করার পর কী করতে হবে?

আপনি চলে আসবেন। আর দ্বিতীয়বার যাবেন না। মেয়েটি খুব মারাত্মক। সমস্ত বাড়ি ইলেকট্রিক তারে ঘিরে রাখে। এবং আটচল্লিশ ঘণ্টা নয়, আগামীকালই এই শহর থেকে চলে যাবেন কারণ জুলির কর্মচারীরা মারাত্মক।

কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর প্রায় নিমরাজি হয়ে গুরুদেব সঙ্গী হলেন। ভাস্করকে আর-একবার তার পরিচয়পত্র দেখাতে হয়েছিল। ভদ্রলোক যতই তড়পান না কেন ভাস্কর বুঝতে পারছিল তাকে দেখার পর ওর মনে একটা ভয় কাজ করছে।

ক্লিন হার্ট রোডে এখন বেশ লোক চলাচল করছে। দিনটা এখনও মরে যায়নি বটে তবে পৃথিবীতে আর রোদ নেই। গুরুদেব কয়েকবার ওর চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ভাস্কর সেই সুযোগ দেয়নি। নির্দিষ্ট বাড়িটির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না জুলি শেরিং আছেন কি না। আজকের ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাও তো জানা নেই। হুট করে ঢুকে গেলে বৈদ্যুতিক তারটা খুঁজতে হবে। কাল রাত্রে সে যখন ঢুকেছিল তখন যদি তারে বিদ্যুৎ থাকত তাহলেই হয়ে গিয়েছিল। এটা থেকে বোঝা গেছে জুলি বাড়িতে থাকলে তারটা নিষ্ক্রিয় থাকে।

গুরুদেবকে সাবধানে পা ফেলতে বলে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ভাস্কর। সেই চটপটে লোকটাকে এখন বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। ঠিক যেখানটায় জুলির গাড়ি থেমেছিল সেখানে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, কেউ আছেন? বাড়িতে কেউ আছেন?

নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। ভাস্কর সবিস্ময়ে দেখল জুলি দাঁড়িয়ে আছেন দরজার মাঝখানে, ছবির মতো। অভিব্যক্তিতে কিছুটা বিস্ময়, অনেকটাই বিরক্তি। স্পষ্ট ইংরেজিতে উচ্চারণ করলেন, কী চাই?

ভাস্কর বলল, নমস্কার, আমার গুরুদেব আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

গুরুদেব? এবার জুলির বিস্ময় যেন বেড়ে গেল।

উনি পৃথিবীবিখ্যাত যোগী আনন্দস্বামী। এই শহরে একটা যোগাশ্রম খুলতে চান। সেই ব্যাপারেই—আপনি ওঁর নাম শোনেননি? যতটা সম্ভব অভিনয় করার চেষ্টা করল ভাস্কর। যদিও কপালের টিপ ছাড়া গুরুদেবকে মোটেই যোগী বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য যোগীরা টিপ পরে কি না সেটাও তার জানা নেই।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন জুলি শেরিং। তারপর খানিকটা নিরাসক্ত গলায় বললেন, যদিও যোগীদের সম্পর্কে আমার কোনও আগ্রহ নেই তবু আপনারা খানিকক্ষণ বসতে পারেন।

সতর্ক পায়ে প্রথমে হেঁটে গেল ভাস্কর। না, পায়ে কোনও বিদ্যুতের স্পর্শ নেই। ওকে দরজার কাছে পৌঁছতে দেখে হাঁটা শুরু করলেন গুরুদেব।

জুলি শেরিং ততক্ষণ ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলেছেন। এখন বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে। তা সত্বেও জুলির শরীরে এখন লাল রঙের ম্যাক্সি যার কোমর চাপা। মহিলার বয়স আন্দাজ করা মুশকিল কিন্তু যৌবন যে অচঞ্চল তা বুঝিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছে। ধবধবে সাদা সোফায় এমন ভঙ্গিতে বসল ভাস্কর যাতে গুরুদেব এবং জুলি মুখোমুখি বসতে পারে। জুলি শেরিং যে তাকে দেখছে সেটা বুঝতে পেরে ভাস্কর সরল ভাবভঙ্গি করার চেষ্টা করল। গুরুদেব বসলেন। জুলি ঘরের কোণে একটা বুদ্ধমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, কী চাই বলুন।

ভাস্কর দেখল গুরুদেব নিচের কার্পেট দেখছেন। যদিও জুলি যে দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেটা সম্মোহনের সীমায় নয় কিন্তু ওঁকে এত লাজুক দেখাচ্ছে কেন? সে বলল, আমরা খবর পেয়েছি আপনি আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর এই বাড়ি বিক্রি করে দিতে চান। গুরুদেবের ইচ্ছে এইটে কিনে নিয়ে যোগ-সেন্টার খোলেন।

কে খবর দিল? খুব শীতল গলা জুলি শেরিংয়ের।

একজন দালাল।

আমি কোনও দালালকে চিনি না। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার নেই। আপনাদের আর কিছু জানার বা বলার আছে?

ভাস্কর বিপাকে পড়ল। সে গুরুদেবকে বলল, গুরুদেব, আপনি কিছু বলুন। উনি বলছেন দালাল আমাদের ভুল সংবাদ দিয়েছে।

গুরুদেব মুখ তুললেন। তারপর উল্টোদিকের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, ওই বুদ্ধমূর্তি কোত্থেকে এনেছেন?

আমি জানি না। কারণ এটা শেরিং পরিবারে কয়েক বছর ধরে আছে।

খুব জীবন্ত। খু-উব। গুরুদেব অন্যদিকে দৃষ্টি রাখছিলেন।

এটা বিক্রির জন্য নয়। এনি থিং মোর?

নাঃ। গুরুদেব উঠে দাঁড়ালেন।

ভাস্কর বিপাকে পড়ল। যে জন্যে লোকটাকে সঙ্গে আনা তা কাজেই লাগল না। ওরকম চটপটে লোকটার পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারছে না সে। তবু কথা বানানোর জন্যে বলল, আমাদের গুরুদেব অতীত এবং ভবিষ্যত বলতে পারেন। আপনার যদি তেমন কিছু জানার আগ্রহ থাকে—।

তাই নাকি! অদ্ভুত হাসি খেলে গেল জুলির মুখে, আমার ওসবে মোটেই বিশ্বাস নেই, আমি বর্তমান নিয়েই ভাবি।

ভাস্কর ইতস্তত করল। তারপর বলল, এখানে, মানে আপনার বাড়ির গেট পেরিয়েই গুরুদেব বলছিলেন এই মহিলা খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তাই আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।

মহিলা একটুও না নড়ে কাঁধ ঝাঁকালেন। ভাস্কর দেখল গুরুদেব একবারও মহিলার দিকে তাকাচ্ছেন না। তার খুব রাগ হচ্ছিল। লোকটা নির্ঘাৎ তাকেও ভাঁওতা দিয়েছে। ওসব সম্মোহন-টম্মোহন বাজে কথা। স্রেফ ফোর টুয়েন্টি। এই বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে গেলে আবার ঢোকা মুশকিল হবে। কিন্তু এ ছাড়া আর কী উপায়!

পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বড় রাস্তায় উঠেই গুরুদেব হাত জোড় করলেন, মাপ করুন ভাই। আমি হেরে গেলাম।

হেরে গেলেন মানে?

মানে, যেই ওই মেয়েছেলেটার দিকে তাকাতে গিয়েছি অমনি চোখ পড়ে গেছে বুদ্ধদেবের চোখে। মাইরি কী বলব, বুদ্ধদেবের চোখে অমন জ্যোতি যে আমার সব শক্তি ভোঁতা হয়ে গেল। মেয়েছেলেটা নড়ছিল না ওখান থেকে যে বুদ্ধদেবকে এড়িয়ে সম্মোহিত করব। আপনাকেও বলতে পারছি না ব্যাপারটা। তবে হ্যাঁ, খানদানী চিজ। একে ক্লায়েন্ট করতে পারলে মোটা কামানো যাবে। তবে হ্যাঁ, ওই বুদ্ধমূর্তি—। খুব আফসোসের গলায় গললেন গুরুদেব। ব্যাপারটাকে একদম উড়িয়ে দিতে পারল না ভাস্কর। এ গল্প তো জানা, ক্রশ সামনে থাকলে ড্রাকুলারা পালিয়ে যায়। এটাও সেরকম হতে পারত।

ঠিক সেই সময় মোটরবাইকটাকে উঠে আসতে দেখল সে। ছেলেটা একটা চামড়ার জ্যাকেট গায়ে চাপিয়েছে। ভাস্কর গুরুদেবকে বলল, এটাকে বধ করুন তো। বলেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল। বাঁক ঘুরে এসে ছেলেটি এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল, কী চাই? সে তখন স্পিড কমিয়েছে মাত্র, চলা থামায়নি।

আপনার জন্যে জরুরি খবর আছে।

এবার অনেকটা হতভম্ব হয়ে ছেলেটি ইঞ্জিন বন্ধ করল, কে আপনারা? কী খবর? কে দিয়েছে?

গুরুদেব বললেন, একসঙ্গে তিনটে প্রশ্ন। উত্তর দিচ্ছি। আমার দিকে তাকাও। হ্যাঁ, চমৎকার। এই রকম চোখাচোখি। বাঃ উত্তর পাচ্ছ? তিন-তিনটে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছ?

ভাস্কর অবাক হয়ে দেখল ছেলেটি সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

বাঃ। কী নাম তোমার?

এ. কে. প্রধান।

কী কাজ করো?

এখানকার ইন্সুরেন্স অফিসের ইনচার্জ।

বাঃ। কোনও দুশ্চিন্তা আছে?

হ্যাঁ। হেড অফিস যদি জুলিদের কেসটা অ্যাপ্রুভ না করে তাহলে ও আমাকে বিয়ে করবে না। আমি বিপদে পড়ে যাব। ছেলেটা মমির মতো দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ভাস্কর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ম্যাজিক অনেক দেখেছে সে, কিন্তু এমন দেখেনি। সে অন্যদিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, ওর এই অবস্থা কতক্ষণ থাকবে? আপনার কোনও ডোজ আছে?

তা আছে। এর ক্ষেত্রে অন্তত একঘণ্টা।

তাহলে আপনি কেটে পড়ুন।

অ্যাঁ!

যা বলছি শুনুন।

না, মানে এর কাছে থেকে অনেক মশলা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।

সেটা আপনার দরকারে লাগবে না। আমি প্রশ্ন করলে উত্তর দেবে? জিগ্যেস করেই সে ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল, কত বছর চাকরি হয়েছে তোমার?

বারো বছর। তেমনি পুতুলের মতো উত্তর দিল ছেলেটি।

ভাস্কর এবার ইশারা করল গুরুদেবকে চলে যেতে। ভদ্রলোকের মোটেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি স্থান ত্যাগ করলেন।

ছেলেটিকে প্রশ্ন করল ভাস্কর, জুলি কত টাকা ক্লেইম করেছে?

তিন লাখ।

ওর মেয়েকে দেখেছ?

না। মেয়ে নেই।

মিস্টার শেরিং কি জুলিকে ভালোবাসত?

হ্যাঁ। জুলি ভালোবাসত না। জুলি ভালোবাসে আমাকে।

ও। কিন্তু জুলির একটা মেয়ে আছে সতেরো-আঠারো বয়স তার। ওই বাড়িতেই আছে। তুমি জানো না?

জানি না।

মিস্টার শেরিংকে কে হত্যা করেছে?

হত্যা করেনি কেউ! সাপের বিষ ইনজেক্ট করেছিল নিজেই। তাতেই মারা গেছে। এটা অবশ্য আত্মহত্যা হতে পারে। জুলি ধরেছিল বলে ডাক্তার এটাকে হার্টফেল বলে চালিয়েছে। আমিও তাই চেয়েছিলাম।

কোন ডাক্তার? কোথায় থাকে?

পাশেই। হিল কটেজে। ডক্টর এস. কে. রায়!

ঠিক তখনই একটা গাড়ির শব্দ পেল ভাস্কর। সে তাড়াতাড়ি বলল, আজ সকালে তুমি জুলির বাড়িতে গিয়েছিলে। বুঝেছ? বলে দ্রুত রাস্তার পাশে একটা বিশাল পাথরের আড়ালে চলে এল। আর তখনি জুলি শেরিংয়ের গাড়িটা বাঁক ঘুরে হর্ন বাজাল। ভাস্কর সন্তর্পণে দেখল ব্রেক চেপে গাড়ি থামিয়ে জুলি মাটিতে নেমে অবাক হয়ে প্রধানকে দেখছেন। এই যে একটা গাড়ি এল তাতেও কোনও সম্বিত আসেনি প্রধানের। তেমনি শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুহূর্তেই ছুটে গেলেন জুলি তার কাছে, প্রধান, ডার্লিং, কী হয়েছে?

কে?

ও গড! আমাকে চিনতে পারছ না? আমি জুলি। তোমাকে খুব অ্যাবনর্মাল দেখাচ্ছে। কী হল তোমার? উদ্বিগ্ন হলেন জুলি।

ও জুলি। আমি তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম আজ সকালে। তোমার একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার বয়স সতেরো-আঠারো। নামতা পড়ার মতো কথাগুলো বলে যেতেই ঠাস করে চড় মারলেন জুলি প্রধানের গালে। তারপর উন্মাদিনীর মতো ধাক্কা দিয়ে বললেন, ইউ, ইউ। তুমি আজ আমার বাড়িতে চোরের মতো ঢুকেছিলে? আমার গার্ডকে অজ্ঞান করে আমার মেয়েকে ভুলিয়েছ তুমি?

সত্যিকারের একটা পুতুল হয়ে গেছে প্রধান। জুলির ধাক্কা তাকে ছিটকে নিয়ে গেল রাস্তার ওপাশে একটা পাথরের ওপর। পাথরটা হয়তো নড়বড়ে ছিল। প্রধানের আঘাত সেটা সহ্য করতে না পেরে কাত হয়ে পড়ল একপাশে। আর প্রধানের শরীরটা বেটাল হয়ে গড়িয়ে গেল নিচে। চিৎকার করে ছুটে গেলেন জুলি পাথরটার কাছে। তারপর অনেকটা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকালেন এবং তৎক্ষণাৎ ফিরে দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা ভাস্করের কাছে এমন আকস্মিক যে সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে যেদিকে রয়েছে ঠিক তার উল্টোদিকে ঘটেছে ওটা। জুলি শেরিংয়ের মুখ সাদা, ভূত দেখার আতঙ্ক তার চোখে। পরমুহূর্তে তিনি ছুটে গেলেন গাড়িতে। তারপর মোটরবাইকটাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ঝড়ের গতিতে নিচের দিকে। যেন জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারলে বেঁচে যান।

এইবার দৌড়ে এল ভাস্কর। পাথরটা যেখানে বেটাল হয়েছিল সেখানে এসে দেখল নিচে, বেশ নিচে ঢালু উপত্যকায় জঙ্গল ছড়িয়ে। প্রধানের শরীরটা সেই জঙ্গলে ঢুকে গেছে। শুধু তার দুটো পা দৃশ্যমান। কোনওরকমে নিচে নামল ভাস্কর। প্রধানের শরীরটা স্পর্শ না করে বুঝল এখনও প্রাণ আছে। মাথার কাছাকাছি কোথাও আঘাত জব্বর হওয়ায় রক্তপাত হচ্ছে। ছেলেটা এখনও অচেতন।

এই মুহূর্তে প্রধানকে তুলে নিয়ে ওপরে ওঠা তার একার পক্ষে অসম্ভব। সে আর দাঁড়াল না। ওপরে উঠে আসতেই দেখতে পেল কালকের সেই বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা ফিরছেন। বৃদ্ধা বৃদ্ধকে কিছু বলতেই তিনি গলা তুললেন, হেই জেন্টলম্যান, গুড ইভনিং। তুমি কি এখনও বাড়িটা খুঁজে পাওনি?

ভাস্করের মনে পড়ল। বুড়ো কালকের কথা মনে রেখেছেন। সে বলল, হ্যাঁ পেয়েছি। সেখান থেকেই আসছি।

এই সময় পরিত্যক্ত মোটরবাইকটা ওঁদের চোখে পড়ল। বৃদ্ধ বললেন, এটা কার বাইক? কাউকে তো দেখছি না।

বৃদ্ধা বললেন, মনে হচ্ছে সেই ছোকরাটার, যে জুলির বাড়িতে প্রায়ই আসে! দ্যাট নটোরিয়াস চ্যাপ। লেটস গো।

ওরা হাঁটা শুরু করতেই ভাস্কর জিজ্ঞাসা করল, মাপ করবেন, এখানে কারও বাড়িতে টেলিফোন আছে?

আছে, ডাক্তার রায়ের বাড়িতে আছে। হিল কটেজ।

খুব দূরে?

না। ওইতো, জুলি শেরিংয়ের নেক্সট ডোর নেবার।

ভাস্কর দেখল এখান থেকে হেঁটে শহরে পৌঁছে পুলিশ কিংবা হাসপাতালে খবর দিতে যে সময় লাগবে তাতে রাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। অতক্ষণ প্রধানের শরীর ওইভাবে পড়ে থাকলে বাঁচার সুযোগ থাকবে কি না সন্দেহ। বরং একজন ডাক্তারের বাড়ি থেকে টেলিফোন করতে পারলে হাসপাতাল খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ডাক্তার রায়ের বাড়িটা তাকে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। গেট খুলে কম্পাউন্ডে ঢুকতে-ঢুকতে ভাস্করের খেয়াল হল প্রধানের কথা। এই ডাক্তারই মিস্টার শেরিংয়ের ডেথ-সার্টিফিকেট লিখেছেন জুলির চাপে। যদিও প্রতিবেশী তবু গাছপালার জন্যে জুলির বাড়ি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। এই মানুষটির কথার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে।

ডাক্তার সাহেব যে বাড়িতেই থাকবেন এতটা আশা করেনি ভাস্কর। সে সোজা নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বলল, একটা টেলিফোন করতে চাই, খুব জরুরি। অনুমতি দেবেন?

ডাক্তার পরিচয়পত্রটি দেখার পর সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিলেন, অনুরোধ শুনে সহজ হলেন, অবশ্যই। ওই কোণে রয়েছে।

পরপর দুটো টেলিফোন করল ভাস্কর। প্রথমটা হাসপাতালে। দ্বিতীয়টা লোকাল থানায়। দু’জায়গায় জানাল ক্লিন হার্ট রোডের বাঁকে একটা মোটরবাইক পড়ে আছে। তার পাশে খাদের দিকে উঁকি মারলে নিচে একটি মানুষের শরীর দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনও জীবিত। যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে বেঁচে যেতে পারে। দু’জায়গা থেকেই প্রশ্ন করা হল তার পরিচয় কী? জবাব না দিয়ে টেলিফোনের লাইন কেটে দিল সে।

ডাক্তার রায় ইনফরমেশনগুলো শুনছিলেন। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমাদের রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? কোথায়?

ভাস্কর তাঁকে থামাল, আপনি বসুন। পুলিশ আর হাসপাতাল তাদের দায়িত্ব বুঝবে। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

আমার সঙ্গে? আমি কী করেছি?

যদি বলি এই অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে আপনিও জড়িত!

কী আজেবাজে কথা বলছেন? আমি আজ সারাদিন বাড়ি থেকে বের হইনি। তাছাড়া কার অ্যাক্সিডেন্ট হল তাও জানি না। কে আপনি?

আমার পরিচয় তো একটু আগেই দেখতে পেয়েছেন। আমরা অনেক কিছু করি না জেনে যা অন্য ঘটনাকে ডেকে আনে। মিস্টার শেরিংয়ের মৃত্যুটাকে কি আপনার নর্মাল ডেথ মনে হয়েছিল? ঈষৎ ঝুঁকে একটা সোফায় বসল ভাস্কর। ইঙ্গিতে ডাক্তারকেও বসতে বলল।

হতবাক হয়ে গেলেন কয়েক মুহূর্ত। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাকে এই প্রশ্ন কেন?

কারণ আপনি সার্টিফিকেট লিখেছিলেন। ডাক্তার রায়, আপনার সম্পর্কে আমার কোনও অসদ্ভাব নেই। আমি শুধু আলোচনা করতে চাই এই পরিচয়পত্রের জোরে। বসুন। ভাস্কর আবার কার্ডটা বের করল।

কার্ডটার দিকে আর-একবার তাকিয়ে ডাক্তার রায় বিপরীত সোফায় বসলেন। ভাস্কর জিগ্যেস করল, এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হল কেন?

কারণ ওটা মিস্টার শেরিংয়ের কাছে অস্বাভাবিক নয়। ওঁর হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার রায় চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক হতে।

কিন্তু কেন হার্ট অ্যাটাক হল? সাপের বিষে?

আই সি! আপনি দেখছি সবই জানেন। তাহলে আপনাকে আমি খুলেই বলি। মিস্টার শেরিং আমার পেশেন্ট ছিলেন না। পেশেন্ট ছিলেন মিসেস শেরিং। ওঁর প্রায়ই মাথার যন্ত্রণা হয়। মিস্টার শেরিং নেশা করতেন। ওঁদের কোনও দাম্পত্য জীবন ছিল না। মদ-গাঁজা ছাড়িয়ে ভদ্রলোক শুনতাম সাপের ছোবল নিতেন। শেষ পর্যন্ত সেটাও খুব কাজে আসত না। তখন মিসেস শেরিং ওঁকে নিয়ে এলেন আমার কাছে। এসব শুনে আমি পরামর্শ দিলাম নেশা ছাড়ার জন্যে। কিন্তু তখন উনি এমন স্টেজে চলে গেছেন যে নেশা না করলে বাঁচবেন না। আমার কাছে শেরিং এলেন কী করে ইঞ্জেকশন নিতে হয় জানতে। আমি ওঁর পরীক্ষা করিয়েছিলাম। কোনও বিষাক্ত সাপের বিষ ওঁকে কাহিল করতে পারবে কি না সন্দেহ ছিল। তবে আমি নিষেধ করেছিলাম। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষ শরীরে নেওয়াতে আমার আপত্তি ছিল, অত্যন্ত অন্যায় ব্যাপার—

ডাক্তারকে থামিয়ে ভাস্কর প্রশ্ন করল, জুলি আপত্তি করেনি?

আমার আড়ালে করেছে কি না জানি না, তবে বলেছিল কোনও মানুষ যদি ওই নেশা করে আরাম পায় তো সে কী করতে পারে। আমি ওর কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলাম। যাক, মিস্টার শেরিং নিয়মিত বিষ শরীরে নিতে লাগলেন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রায় মাসখানেক বাদে একদিন ওঁর দোকানের ভেতরের ঘরে ইঞ্জেকশন নিয়ে কাউন্টারে বেরিয়ে আসতেই হার্ট অ্যাটাক হল। বিষ তিনি স্ব-ইচ্ছায় নিতেন। তাই কেউ তাঁকে হত্যা করেনি। তিনি বিষ নিয়মিত না নিলেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এবং আত্মহত্যা করার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না। ওই পদ্ধতিতে বিষ নিয়ে মাসখানেক বহাল তবিয়তে ছিলেন। তাই এটাকে আমি আত্মহত্যাও বলতে পারি না।

কেন? এই বিষ তো শেষ পর্যন্ত মরণ ডাকতে পারে জেনেও তিনি নিতেন।

সিগারেট খেলে ক্যান্সার হতে পারে জেনেও মানুষ সিগারেট খায়। তার জন্যে কি আপনি বলবেন সে আত্মহত্যা করছে? দার্শনিকভাবে হয়তো বলা যায়, কিন্তু আইনত? হত্যা কিংবা আত্মহত্যা যখন নয় তখন আমার পক্ষে নর্মাল ডেথ সার্টিফিকেট দিতে বাধা ছিল না।

কিন্তু আপনি ইতস্তত করেছিলেন। জুলি শেরিং আপনাকে চাপ দিয়েছিল সেটা লিখতে, তাই না?

অবাক হলেন ডাক্তার রায়, কে বলেছে আপনাকে?

ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারেন?

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন ডাক্তার রায়, এটা খেলে আমার ক্ষতি হলেও হতে পারে, আর এটা খেলে আমার ক্ষতি আজ নয় কাল হবেই—এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই আমি সামান্য দ্বিধায় ছিলাম, আত্মহত্যা লিখব কি না। কিন্তু জুলি আমাকে বোঝাল যে মিস্টার শেরিং মরতে চাননি। তিনি ইঞ্জেকশন নিয়ে কাস্টমারদের দেখাশোনা করার জন্যে বাইরে এসেছিলেন। এই সময় হয়তো বিষ ওঁর হৃদযন্ত্র স্তব্ধ করে বা—

কোনও বিষের প্রতিক্রিয়া নয়। মিস্টার শেরিংয়ের বয়স হয়েছিল। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার যে-কোনও কারণ থাকতে পারে। ডাক্তার রায় জানালেন।

কিন্তু ধরুন, সেইদিন মিস্টার শেরিংয়ের সাপের বিষের শিশিতে যদি কেউ অন্য কিছু তীব্রতম বিষ ঢেলে রাখে এবং শেরিং সেটাকেই সাপের বিষ ভেবে শরীরে ইনজেক্ট করেছিলেন, এরকম সম্ভাবনার কথা আপনার মাথায় এল না কেন? ওঁর বডি পোস্টমর্টেম না করে দাহ করতে দিলেন? কেটে-কেটে প্রশ্নগুলো করার সময় ভাস্কর বুঝতে পারছিল ভদ্রলোক সত্যি নির্দোষ। কোনও মানুষের মাথায় দ্বিতীয় চিন্তা প্রবেশ করলে যে প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই দেখছে সে।

মিস্টার রায় হতভম্ব হয়ে জিগ্যেস করলেন, এ আপনি কী বলছেন? কে খুন করবে ওই বৃদ্ধকে! তিনি তো কারও কাজে, বিশেষ করে মিসেস শেরিংয়ের কোনও ব্যাপারে বাধা দিতেন না। না-না, এ হতে পারে না।

কিন্তু আপনার মনে দ্বিধা এসেছিল ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময়।

স্বাভাবিক। আসতই না, যদি লোকটার নেশার অভ্যেস না থাকত। কিন্তু জুলি বলল, পোস্টমর্টেম মানেই ওর নেশার কথা জানাজানি হয়ে যাওয়া। তাছাড়া এটা হত্যা বা আত্মহত্যা না হলেও ওই কারণেই নাকি সে কিছু টাকা পাবে না ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে। ব্যাপারটা সমর্থন করেছিল প্রধান। আমি ভাবলাম বিধবা মেয়েটা কেন বিনা দোষে বঞ্চিত হবে।

ডাক্তার রায়ের কথা শেষ হওয়া মাত্র ভাস্কর উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনি মনে হয় নির্দোষ। তবে সেটা প্রমাণিত হবে যদি আমি আপনার কাছে এসেছিলাম এই সংবাদ তৃতীয় ব্যক্তি না জানে।

বিস্মিত মানুষটিকে পেছনে রেখে ভাস্কর বাইরে এসে দেখল মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। সন্ধে হয়ে এল বলে। আর দু-পা হাঁটতে না হাঁটতেই পথের আলোগুলো জ্বলে উঠল। দুর্ঘটনার জায়গায় এসে দেখল মোটর বাইকটা রয়েছে। পুলিশের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন পুলিশ কিছু খোঁজাখুঁজি করছে টর্চ জ্বেলে। ওরা নিশ্চয়ই প্রধানের শরীরটাকে এতক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। এবং তখনই ওর খেয়াল হল প্রধানকে বাঁচাতে হবে। যে করেই হোক। দুর্ঘটনার জন্যে যদি ও না মারা যায় তাহলে ওকে আজ-কালের মধ্যে মেরে ফেলার চেষ্টা হবেই। জুলি শেরিং কোনও প্রমাণ রাখতে চাইবে না। এবং তখনই সে অনিল মিত্রকে দেখতে পেল। দুজন পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে নিচে থেকে উঠে আসছে।

ভাস্করকে দেখে চমকে উঠল অনিল মিত্র। তারপর চিৎকার করে বলল, হোয়াট এ সারপ্রাইজ। তুমি এখানে?

এই তো। কেমন আছ? ভাস্কর হাসল।

ছিলাম ভালোই। এইমাত্র একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আবার ঠিক এটাকে অ্যাক্সিডেন্ট বলতেও মন চাইছে না। লোকটা আমাদের পরিচিত। মোটর বাইকটাকে মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে নিচের ওই ঝোপে পড়েছিল। ভঙ্গি দেখে বোঝাই যায় আত্মহত্যা করতে চায়নি। কোনও গাড়ির সঙ্গে ক্ল্যাশ হলে মোটরবাইকটা নিটোল থাকত না। নিজের মোটরবাইকটাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে ছেলেটা কী করে ওই খাদে গিয়ে পড়ল সেটাই বুঝতে পারছি না।

রহস্যজনক ব্যাপার। ও বেঁচে আছে?

হ্যাঁ। মাথায় চোট লাগায় বেহুঁশ হয়ে আছে। হসপিটালাইজড করা হয়েছে।

ওখানে গার্ড রাখো যদি ছেলেটিকে বাঁচাতে চাও।

মানে?

যদি এটা হত্যাকাণ্ড হয় তাহলে হত্যাকারী চাইবে না ও বেঁচে থাকুক। কে ধরা পড়তে চায় বলো?

অনিল মিত্র চিন্তা করল একটু, তুমি ভালোই বলেছ! ছেলেটার স্টেটমেন্ট নেওয়া যায়নি এখনও। এখানে তো কোনও ক্লুও পেলাম না। কাল সকালে আর একবার আসব। বাই দ্য বাই, উঠেছ কোথায়?

কাঞ্চনজঙ্ঘা লজ।

যাচ্চলে। ওটা তো টিবেটিয়ানদের। খাওয়াদাওয়ার অসুবিধে। কী ব্যাপার?

কোনও ব্যাপারই নয়।

অনিল মিত্র ওকে হোটেল পর্যন্ত লিফট দিল। বাজায়ের গায়ে ওর গাড়ি থেকে নামিয়ে বারংবার বলল সোজা ওর কোয়ার্টার্সে চলে আসতে। ভাস্কর কোনও কথা জানায়নি। দেখা যাক, আর-একটু দেখা যাক। এমনকী একজন বাঙালি যে টেলিফোন খবরটা দিয়েছিল কিন্তু পরিচয় জানায়নি—তাকে নিয়েও দুশ্চিন্তা অনিল মিত্রের।