বিষঘ্ন – ১

মিনিবাস থেকে নেমে জায়গাটা মোটেই পছন্দ হল না ভাস্করের। বাঁ-দিকটা মিনি বড়বাজার, সামনে গাড়ির জট-পাকানো আবহাওয়া। ডানদিকে তাকালে একটা খেলার মাঠ দেখা যায় বটে তবে সেটা অযত্নে রাখা। খানিকটা নিচে পাহাড় কেটে বড় মাঠ তৈরি যিনি করেছিলেন তাঁর চেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর বাসনা এখনকার কারও নেই। চারপাশের বাড়িঘর দোকানপাটও খুব পুরোনো চেহারার।

অথচ সেবক ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে কালিঝোরা বাংলোকে রেখে উঠে আসবার সময় থেকেই মন প্রফুল্ল হচ্ছিল। এদিকে কখনওই আসা হয়নি ভাস্করের। ডানদিকে খরস্রোতা তিস্তা আর চমৎকার ঝিমধরা পাহাড় দেখতে-দেখতে বারংবার মনে হচ্ছিল দার্জিলিংয়ের পথের চেয়ে এর চেহারা-চরিত্র আলাদা। অথচ বাস-টার্মিনাসে নামার পর তার মন খারাপ হয়ে গেল। একটা ঘিঞ্জি এলাকা ছাড়া কিছু ভাবা যাচ্ছে না।

কিন্তু শীত পড়েছে জব্বর। এখন কলকাতায় ঘাম ঝরছে আর এখানে মনে হচ্ছে হাফ স্লিভের বদলে পুরো হাতা কিছু থাকলে ভালো হতো। আর বিকেল তিনটেয় যদি এই অবস্থা হয় তা হলে সন্ধের পর ঘরের বাইরে পা দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

মিনিবাসের ছাদ থেকে মালপত্র নামানো হলে ভাস্কর তার সুটকেস তুলে নিল। তিনটে লোক ছুটে এসেছিল মাল বইবার জন্যে, কিন্তু ভাস্কর তাদের হঠিয়ে দিল। ভাস্কর জানে সে বিরক্তিভরে কিছু বললে যারা জ্বালাতন করতে আসে তারা সব সরে যায়। হয়তো তার চেহারা এবং কণ্ঠস্বরে এমন একটা ব্যাপার আছে কোনও দালাল বা পাণ্ডা তাকে ঘাঁটাতে চায় না।

ভাস্কর লম্বায় ঠিক ছয় ফুট। শরীরে সামান্য মেদের প্রলেপ থাকায় লাবণ্য আছে, ব্যায়ামবীরদের মতো কাঠ-কাঠ ভাবটা নেই। কিন্তু তার চওড়া বুক, সরু কোমর এবং সুগঠিত হাত দেখলে বোঝা যায় শুধু ঈশ্বরের দান নয়, ওই শরীর-নির্মাণের পেছনে অধ্যবসায় আছে। মজার ব্যাপার, ঝামেলাবাজ মানুষেরা তাকে দেখেই বুঝতে পারে, সুবিধে হবে না।

সুটকেসটা ভারী কিন্তু অসুবিধে হচ্ছিল না ভাস্করের। তিনটে জায়গায় সে উঠতে পারে। সার্কিট হাউস, ট্যুরিস্ট লজ অথবা—। না। অন্য কোথাও তাকে উঠতে হবে আজ। সে যে এসেছে এখানে তা যত কম লোক জানতে পারে তত ভালো। শহরটাকে ভালো করে দেখে-শুনে তারপর আত্মপ্রকাশ করা যাবে।

বাজারের গায়েই সাইনবোর্ডটা নজরে এল, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা লজ।

এখানেই ওঠা যাক। ভাস্কর স্থির করল একটা অ্যাটাচড বাথ আর পরিষ্কার বিছানা যদি থাকে তা হলে এই হোটেলেই আজকের রাতটা কাটানো যাক। সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকতে সে কাউন্টারের গায়ে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখতে পেল। বৃদ্ধার শরীরে টিবেটিয়ান পোশাক। ওকে দেখে যে হাসি ওর ঠোঁটে ফুটল তা শুধু মায়েদের মুখেই দেখা যায়।

ভাস্কর জিগ্যেস করল, সিঙ্গল রুম, অ্যাটাচড বাথ, খালি আছে?

বৃদ্ধা ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল। তারপর হিন্দিতে বলল পঞ্চাশ টাকা করে লাগবে। একদিনের ভাড়া অ্যাডভান্স। খারাপ মেয়েছেলে ভাড়া করে এনে রাত্রে শোওয়া চলবে না। ব্যস।

ভাস্করের চোখে কৌতুক চলকে উঠল, ব্যাপারটা নতুন শুনছি। আমি যাকে আনছি সে খারাপ না ভালো তা তুমি বুঝবে কী করে?

আমি ঠিক বুঝতে পারি।

এই নিয়ম এখানকার অন্য হোটেলে চালু আছে?

মাথা খারাপ। তা হলে ওরা ব্যবসা করে খাবে কী করে?

তুমি ব্যবসা করতে চাও না?

আমার পেট ভরে গেলে হল। আমি আর আমার নাতনি, দুটো মাত্র পেট, তার জন্যে নোংরা ঘাঁটব কেন?

খাতায় নিজের নাম সই করার আগে যে দ্বিধা ছিল তা কাটিয়ে উঠল সে এক পলকেই। মিথ্যে কথা লেখার কী দরকার। এই মুহূর্তে এই শহরে কেউ তাকে চিনবে না। চাবি নিয়ে সে দোতলার যে ঘরটায় উঠে এল সেটা মোটেই বড় নয়। এই হোটেলকে শ্যাবি বলার যথেষ্ট কারণ আছে। এবং সম্ভবত সে ছাড়া অধিকাংশ বোর্ডারই হয় টিবেটিয়ান, নয় সিকিমিজ। একটা অপরিচ্ছন্ন গন্ধ করিডোরে পাক দিলেও ঘরের বিছানাপত্র মোটামুটি ছিমছাম। বাথরুমের দরজাটা খুলে ভাস্করের মনে হয় এইটেয় বোধহয় হোটেলের শ্রেষ্ঠ ঘর। নইলে এই চেহারার হোটেলের বাথরুমের অবস্থা এতটা ভদ্র হতো না। শুধু ওপরের জানলাটা বেশ নড়বড়ে। জোরে হাওয়া দিলেই বোধহয় খুলে পড়বে। ভাস্কর আবার ঘরে ফিরে এল। তারপর জুতোসুদ্ধু বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। এই শহরের অনেক প্রশংসা শুনেছে সে এতকাল। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পর্যন্ত নানা প্রশংসাবাক্য লেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই এই বাজার এলাকাই সমস্ত শহর নয়।

ঠিক এই সময় বন্ধ দরজায় জোর আঘাত শুরু হল। কেউ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে দমাদম কয়েকটা লাথিও কষিয়ে দিল ওপাশের কাঠে। ভাস্কর উঠল। তারপর আচমকা দরজার পাল্লা হাট করে খুলে দিতেই একটা লোক হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে টেবিলে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলার জন্যে। লোকটার হাতে কয়েকটা প্যাকেট ছিল, সেগুলো ছিটকে গেল এদিক-ওদিক।

ততক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে লোকটা, ঘরটা দেখতে দেখতে বলল, সরি। আমি ভেবেছিলাম আমার রুম। রুমমেট মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করছে বলে দরজা খুলছে না। শালা মালের ঘোরে ঘর বদলে ফেলেছি। মার্জনা করবেন দাদা। দুটো হাত জোড় করল লোকটা।

প্রচণ্ড ক্রোধ শরীরে জন্ম নিয়েছিল, অনেক কষ্ট সংবরণ করল ভাস্কর। লোকটা রোগা, শরীর ভর্তি গরম জামা সত্বেও সেটা বোঝা যায়, এই বিকেলেই মাঙ্কি ক্যাপ সেঁটেছে মাথায় এবং ভালো রকম মদ পেটে পড়েছে ওর। এই অবস্থায় ঘর পালটে ফেলা অসম্ভব নয়। সে চাপা গলায় বলল, বসুন।

বসব? রং নাম্বার হয়ে যাওয়ার পরও বসব?

রং নাম্বার?

ঘরের নম্বর। পাশাপাশি, অন্য ঘর হলে ছাতু হয়ে যেতাম এতক্ষণে, আপনি তবু বসতে বলছেন। সব মাইরি হেভি চেহারার টিবেটিয়ান বোর্ডার। শুধু আমার রুমমেট বাঙালি, অত্যন্ত নোংরা লোক।

পড়ে যাওয়া প্যাকেটগুলো তুলে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভাস্কর জিজ্ঞাসা করল, আপনার বন্ধু?

না-না। এখানে এসে আলাপ। আমি আজ রুম চেঞ্জ করব বলে ঠিক করেছিলাম। আর পারা যাচ্ছে না।

কেন? ভাস্করের মজা লাগছিল ওর কথা বলার ধরন দেখে। একটু খেঁকুরে, কিন্তু মনে হচ্ছে সরল।

আরে মশাই রোজ ঘরে ঢুকে দেখি আমার বিছানায় মাথার ক্লিপ, চুলের ফিতে পড়ে আছে। কাকে কী বলব? চেপে যেতাম। কাল রাত্রে শুতে গিয়ে নাকে সুড়সুড়ি লাগল। হাত দিয়ে দেখলাম ইয়া লম্বা একটা চুল তাতে আবার সুবাসিত তেলের গন্ধ। আর পারলাম না। বলে ফেললাম। তিনি বললেন তাঁর শিষ্য-শিষ্যারা আসেন, বসার জায়গা কম বলে আমার খাটটাকে ব্যবহার করেন। আমি যেন কিছু মনে না করি। বুঝুন। কথাগুলো একটানা বলে সোজা হয়ে বসতেই একটা হেঁচকি উঠল।

ভাস্কর হাসল, হোটেলের মালকিনকে জানান। তিনি বলছেন বাজে মেয়েদের এখানে ঢোকা নিষেধ। তাহলে এরা আসছে কী করে?

বাজে মেয়ে নয়তো। শিষ্যা। পঞ্চাশ বছরের গুরুদেব হোটেলে বসে আছেন আর শিষ্যারা আসছে একের পর এক। না, চলি দেখি ঘর খালি হল কি না। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে ভাস্কর তাকে বাধা দিল, আর-একটু বসুন। কী করেন আপনি? মানে আপনার পরিচয় এখনও জানা হয়নি।

শাজাহান সেন। স্রেফ বেড়াতে এসেছি এখানে। চাকরি করি একটা মার্চেন্ট ফার্মে। একান্নবর্তী পরিবার। সেখানে বাস করে মাল খাবার সুযোগ পাই না। মা জীবিতা আছেন, খুব কনজারভেটিভ পরিবার। বছরে দশ দিনের জন্যে ছিটকে বেরিয়ে এই জায়গায় এসে চুটিয়ে মাল খেয়ে যাই। এখানে মাল খাওয়ার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। মশাই-এর নাম? দুনম্বর হেঁচকিটা এবার উঠল।

ভাস্কর চ্যাটার্জি। সেলস-এ কাজ করি। কিন্তু শাজাহানবাবু আপনার নামের সঙ্গে সেন উপাধি একটু গোলমেলে লাগছে না?

মোটেই না। আমার মায়ের প্রিয় কবিতা ছিল রবীন্দ্রনাথের শাজাহান। আমি হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারের ঊর্ধ্বে। মায়ের প্রিয় কবিতার নামে আমার নামকরণ।

শাজাহান সামান্য টলছিল। সে যে মদ্যপান পরেছে একটা কিছুতেই বোঝাতে চাইছিল না। যদিও ওর কথা জড়ানো নয়, তবু বুঝতে অসুবিধে হয় না।

ভাস্করের ভালো লাগছিল লোকটাকে। বলল, চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি। নইলে আবার কার ঘরে ধাক্কা দিয়ে বিপদে পড়বেন। শাজাহান ঘাড় ঘুরিয়ে ভাস্করকে দেখল, আপনি মানুষটা তো দেখছি বেশ ভালো। বেশ, চলুন।

শাজাহানকে ধরতে হল না। ওর পায়ে এখনও বেশ শক্তি আছে। আসলে ভাস্করের খুব ইচ্ছে করছিল গুরুদেবটিকে দেখতে। সুযোগটাকে কাজে লাগাল সে।

শাজাহানবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ। ভাস্কর বাইরে থেকে খুব ভদ্রভাবে আওয়াজ করল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া এল না।

শাজাহান চাপা গলায় বলল, কেসটা বুঝতে পারছেন. আমার ঘর অথচ আমাকে তীর্থের কাকের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

তৃতীয়বার আঘাতের পর দরজা খুলল। অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে একটা শুঁটকো চেহারার লোক ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ইয়ার্কি হচ্ছে? যে-ই যায় সেই একবার দরজায় শব্দ করে। গুরুদেব একটু শান্তিতে সাধনা করবেন তার উপায় নেই। ও আপনি? তা আপনার এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কী প্রয়োজন পড়ল? বললাম না, দূরবিন দাঁড়া পর্যন্ত বেড়িয়ে আসুন।

সন্ধে হয়ে এসেছে যে। তারপর মাইরি ঠান্ডাটাও। বাইরে ঘুরতে পারলাম না। শাজাহানের কণ্ঠস্বর হঠাৎ একদম পালটে গেল যেন। মিনমিন করছে।

আসুন।

শাজাহান ভেতরে পা বাড়ানো মাত্র দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভাস্কর বুঝতে পারছিল না কী করবে। সে শাজাহানের সঙ্গে এসেছে এখানে। ঘরটার অর্ধেক অধিকার শাজাহানের। অতএব সে ওর অতিথি হিসেবে ঢুকতেই পারে ঘরে। কিন্তু লোকটা এখানে আসা মাত্র অমন পালটে গেল কেন? যেন খুব ভয় পাচ্ছিল সামান্য প্রতিবাদ করতে। তা ছাড়া, লোকটা তাকে দেখা সত্বেও মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। ব্যাপারটা অত্যন্ত অপমানজনক হলেও ভাস্কর মত পালটাল। ঠিক এখনই ঘরে ঢোকা উচিত হবে না। শাজাহানবাবুর সঙ্গে যখন আলাপ হয়েছে তখন যে-কোনও সময় ওর খোঁজে হাজির হওয়া যাবে।

নিজের ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে এল ভাস্কর। কাউণ্টারে সেই বৃদ্ধার হাতে এখন জপের মালা। মালা ঘোরাতে-ঘোরাতেও ভদ্রমহিলা যে আড়চোখে তাকে দেখে নিলেন তা টের পেল সে।

পাহাড়ি শহরগুলোর একটা চরিত্রগত মিল আছে। বিকেলের ছায়া ঘন হলেই চারপাশ কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হয়। একটা অদ্ভুত মায়াবী কিন্তু গা-ছমছমে ভাব প্রতিটি পথের বাঁকে ওত পেতে থাকে। বাজার এলাকা এবং বাসস্ট্যান্ড গায়ে-গায়ে। সেটা পেরিয়ে ওপরের রাস্তায় উঠে আসতেই মন ভালো হয়ে গেল ভাস্করের। চমৎকার সুন্দর সাজানো রাস্তার দুপাশে দোকান। এই দোকানগুলো নিশ্চয়ই ট্যুরিস্টদের জন্যে। রাস্তাটায় একটা কুটো পড়ে নেই। সামান্য এগোতেই একটা তেমাথা পেল সে। তেমাথার পাহাড়ের গায়ে সুন্দর একটা ম্যাপ এঁকে শহরের কোথায় কী আছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভাস্কর ম্যাপটার সামনে দাঁড়াল। দূরবিন দাঁড়া নামের জায়গাটা এখান থেকে অনেক দূরে। অথচ সেখানেই শাজাহানকে পাঠাচ্ছিল লোকটা। নির্ঘাৎ ওদের সময় প্রয়োজন ছিল। শাজাহানকে ওরা এখনই ঘরে রাখতে চাইছিল না। তারপরই ভাস্করের খেয়াল হল, শাজাহান বলেছিল সে ছাড়া আর একজন ওই ঘরে থাকে, যে নাকি গুরুদেব। তাহলে ওই সিড়িঙ্গি-মার্কা লোকটা কে? ওটাকে তো কখনওই গুরুদেব বলে মনে হল না। ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হেসে ফেলল ভাস্কর। খামোকা সে শাজাহানকে নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছে। এই জন্যে তো সে এখানে আসেনি। শাজাহানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সামান্য আগে। ওকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাচ্ছে।

ম্যাপের ওপর কয়েকবার চোখ বোলাবার পর শহরটা মাথায় বসে গেল।

কয়েক পা হাঁটাহাঁটি করা মাত্র সন্ধে নামল অসাড়ে। বোঝা গেল আশেপাশের দোকানে আলো জ্বলে ওঠায়। এই রাস্তার প্রতিটি দোকান চমৎকার সাজানো এবং টিবেটিয়ান বা সিকিমিজ সেলসম্যান কাউন্টারে। দোকানপাটের এলাকাটা পার হতেই চোখ জুড়িয়ে গেল ভাস্করের। এই শহরটাকে কেন এত সুন্দর বলা হয় তা মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে গেল। এ-পাহাড় থেকে সে-পাহাড় যেখানেই শহরটা গড়িয়েছে সেখানেই টুকরো-টুকরো আলোর হীরে জ্বলছে। আর কী নয়ন ভোলানো ভ্যালি। এই আবছা আলোয় আরও মায়াবী মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটা মাথায় রেখে হাঁটতে লাগল ভাস্কর। দুপাশে লম্বা-লম্বা দেওদার গাছ। অন্য পাহাড়ি শহরের সঙ্গে এর পার্থক্য এটাও। প্রচুর গাছ দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড অফ অনার দেওয়ার ভঙ্গিতে।

ক্রমশ পথ আরও নির্জন হয়ে গেল। এবং নিচের জঙ্গলের মাথায় একটা প্রায় গোল চাঁদ আবদারের ভঙ্গিতে উঠে বসল। পায়ের তলায় চাঁদ, কবি হলে বোধহয় এমনটা বলা যেতে পারত।

রাস্তার নাম ক্লিন হার্ট রোড। নির্মল হৃদয় সরণি। চমৎকার রাস্তাই। এদিকের বাড়িগুলোও লাগোয়া নয়, একটার সঙ্গে আর-একটার ফারাক বেশ। এর গেট থেকে মূল বাড়ির প্রভেদ অনেকটা। প্রত্যেকটা বাড়ির গেটে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে কুকুর থেকে সাবধান। এই রাস্তায় সেই বাড়ির মালকিন থাকেন কিন্তু কোন বাড়ি তা ঠাওর করা যাচ্ছে না। রাস্তায় লোক নেই যে প্রশ্ন করে জেনে নেওয়া যাবে তার কাম্য বাড়ি কোনটি। গেটে কোনও নম্বর নেই। ঠিক এই সময় পেছনে মোটরবাইকের আওয়াজ উঠল। ভাস্কর স্বস্তি পেল। যদি এই শহরের বাসিন্দা হন, নিশ্চয়ই হবেন নইলে সন্ধের পর এমন অঞ্চলে বাইক চালাতেন না। ভাস্কর দেখল নিচের রাস্তা বেয়ে এঁকে-বেঁকে মোটরবাইকটা ওপরে উঠে আসতে আসতে থেমে গেল। চালক একটা গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে যেন আচমকাই মিলিয়ে গেল।

ভাস্কর ধীরে-ধীরে ফিরে এল মোটরবাইকটার কাছে। খুব দামি এবং শক্তিশালী বাইক। না হলে এই পাহাড়ে এত স্বচ্ছন্দে ছুটতে পারত না। ঠিক তখনই গেট পেরিয়ে বাগান আর বাগান পেরিয়ে সুন্দর বাড়িটার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ভাস্করের কেমন যেন অনুভূতিতে এল, এইটেই সেই বাড়ি। কিংবা বাড়িটি যদি অন্য কারও হয় তাহলে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে হদিশ নিয়ে আশা যায় মহিলার বাড়ি কোনটি!

গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ভাস্কর। চমৎকার গন্ধ ছড়াচ্ছে বাগানের ফুলগুলো। কিন্তু ভেতরে পা দেওয়া মাত্র একটা অদ্ভুত শিরশিরে নির্জনতা চেপে ধরল। ঝিঁ-ঝিঁ ডাকছে বিশাল গাছগুলো থেকে। পাহাড়ি এই গাছগুলোর একটা চরিত্র আছে। ঝিঁ-ঝিঁগুলো তাদের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে নেয়। ভাস্কর খালি বারান্দায় পা রাখতে যাচ্ছে তখনই গলাটা ভেসে এল। হিসহিসে তীক্ষ্ণ গলা, যাতে ঘেন্না এবং জ্বালা স্পষ্ট, আবার কী দরকার? তোমাকে আমি বলে দিয়েছিলাম এখানে না আসতে।

মহিলার বয়স অনুমান করা মুশকিল কণ্ঠস্বর থেকে। কিন্তু বেশ কর্তৃত্ব আছে স্বরে। ভাস্কর বারান্দা থেকে পা নামিয়ে নিল। একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে ধীরে-ধীরে ঘুরে জানলার পাশে এসে দাঁড়াল। জানলাটা বন্ধ। কাচের ভেতরে পর্দা আছে। এখান থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল সে। ছেলেটি, সম্ভবত যে প্রবেশ করেছে বাইক থেকে নেমে, বলল, কিন্তু আমার যে না এসে উপায় নেই।

উপায় নেই মানে? কী বলতে চাও? মহিলাকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল। শীতল গলায় ছেলেটি বলল, গলা নামিয়ে কথা বলো। চিৎকার করে কেউ কথা বললে আমার সহ্য হয় না। তারপর হঠাৎ একটু হাসি জড়ানো সেই গলায়, তোমায় না দেখে থাকতে পারি না।

মিথ্যে কথা! একশো ভাগ মিথ্যে। তুমি টাকার ধান্দায় এসেছ।

টাকা। ছেলেটি আবার হাসল, হ্যাঁ, সেটাকেও ভালোবাসি। তোমাকে তো নিয়ে যেতে পারব না বাইকে চাপিয়ে, ওটাকে পারব, দাও।

আমি আর টাকা দিতে পারব না।

দিতে হবে।

সেরকম কোনও কথা ছিল না।

ছেলেটি হাসল, রাগ করলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। বিশেষ করে তোমার গজ দাঁতটা। বিউটিফুল।

মেয়েটি বলল, আমি রাগ করতে যাব কোন দুঃখে?

ছেলেটি বলল, সত্যি রাগ করোনি। তাহলে দুটো হুইস্কি খাওয়াও।

মেয়েটি বলল, আগে বলো তুমি ব্ল্যাকমেইল করতে আসোনি?

ছেলেটি জানাল, সে-সব কথা পরে হবে। আগে হুইস্কি!

মেয়েটি বলল, ঠিক আছে।

ভাস্কর আর অপেক্ষা করল না। খুব সতর্ক পায়ে সে বাগান ছেড়ে রাস্তায় উঠে এল। কয়েক পা হাঁটতেই এক বৃদ্ধ দম্পতিকে সে এগিয়ে আসতে দেখল বাজারের দিক থেকে। বৃদ্ধের হাতে ছড়ি, বৃদ্ধা তাঁর কনুই আঁকড়ে ধরে ধীরে-ধীরে উঠে আসছেন। কাছাকাছি হতে ভাস্কর দেখল এঁরা বাঙালি নন। চেহারায় বিদেশি কিংবা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মনে হয়। তবে এই এলাকার বাসিন্দা তা বৃদ্ধের হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে। ভাস্কর ওঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বিনীত গলায় জিজ্ঞাসা করল, এটাই ক্লিন হার্ট রোড, তাই না?

ইয়েস। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তেই বৃদ্ধা হাত ছেড়ে রুমালে মুখ মুছলেন। এই ঠান্ডায় যেন ওঁর মুখে ঘাম জমছিল।

মিসেস জুলি শেরিংয়ের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন? বৃদ্ধ একটু বিব্রত চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকাতে বৃদ্ধা জানালেন, দ্যাট টিবেটিয়ান লেডি।

আই সি। বৃদ্ধর এবার মনে পড়ল, তুমি অনেকটা এগিয়ে এসেছ মাই বয়। ওই যে রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে তার গায়েই দেখবে শেরিংদের গেট। বাঁ-দিকের নিচের কটেজ। ওটা আগে ছিল মিস্টার হ্যারল্ড টমসনের। মাই ওল্ড ফ্রেন্ড। টমসন অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার সময় শেরিংদের বিক্রি করে গেল। টমসন ছিল বিরাট পুলিশ অফিসার আর শেরিংরা নাকি মদের দোকান চালায়। তাও কান্ট্রি-লিকার।

ও জন, তুমি বড্ড বেশি কথা বলছ। বৃদ্ধা চাপা গলায় শাসন করতে বৃদ্ধ যেন সতর্ক হলেন, নাইস টু মিট য়ু জেন্টলম্যান, গুড নাইট। ভাস্করকে ছাড়িয়ে টুকটুক করে ওঁরা উঠে গেলেন ওপরে।

না। আর কোনও সন্দেহ নেই। সে জুলি শেরিংয়ের বাড়িতেই ঢুকে পড়েছিল। চটপটে পায়ে সে পা চালাল শহরের দিকে। এর মধ্যে জম্পেশ অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। আজ আর কোনও কাজ নয়। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে টেনে ঘুম। প্রথম দিনেই একটা নাটক শুনতে পাবে এমনটা কে আশা করেছিল!

সেই সুন্দর রাস্তায় এখনও দোকানপাট খোলা। তবে পথে তেমন মানুষজন নেই। আলো জ্বলছে তবে দার্জিলিংয়ের মতো এখানে ট্যুরিস্টদের ভিড় নেই। ভাস্করের মনে পড়ল তার হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাইরে যদি খেতে হয় তাহলে এখানকার কোনও রেস্তোরাঁতে খেতে যাওয়াই ভালো। ঘড়িতে এখন আটটাও বাজেনি। হঠাৎ তার সেই কান্ট্রি-লিকার শপের কথা মনে পড়ল। আজ একবার সেখানে গেলে কেমন হয়? যদিও একটু আগে ঠিক করেছিল আজ আর কোনও কাজ নয়, তবু তাকে এখন দোকানটা টানছে, ওই নাটকটা শোনার জন্যেই হয়তো। সে একটা পানের দোকানদারকে সিগারেট কেনার অছিলায় জিগ্যেস করে জানতে পারল, আজ এই শহরে ড্রাই-ডে। সমস্ত মদের দোকান বন্ধ।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হোটেলের দিকে ফিরছিল ভাস্কর। রাস্তাটা অন্ধকার। সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে নামতে হয়। খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল সে। তিন লক্ষ টাকার ইনসুরেন্স ক্লেইম করেছেন জুলি শেরিং। লোকাল অফিস সেটাকে ফরোয়ার্ড করেছে কলকাতার অফিসে। মিস্টার শেরিং ভারতবর্ষে এসেছিলেন বাষট্টি সালে। চীন যখন তিব্বত দখল করল তখন যেসব টিবেটিয়ান এদেশে পালিয়ে আসেন নানারকম সঞ্চয় নিয়ে, মিস্টার শেরিং তাদের মধ্যে একজন। প্রথমে আশ্রিত, তারপর ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব পেয়ে যান ভদ্রলোক। এই শহরে এসে টিবেটিয়ান দেশি মদের একটা ভালো দোকান খুলে বসেন। আর খোলামাত্র ব্যবসাটা জমে উঠল তাঁর। এ সবই সম্ভব, ঠিক। কিন্তু সেই মানুষটা মরে গেলেই তিন লক্ষ টাকা ইনসুরেন্স কোম্পানির কাছে ক্লেইম পাঠানো হবে এবং কোম্পানি তা মেনে নেবে, এটা যেন একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি। ব্যাপারটা তিরিশ হাজার হলে কোম্পানি গায়ে মাখত না। কিন্তু তিন লাখ বলেই কর্তাদের টনক নড়েছে। আর প্রিমিয়াম দেওয়া হয়েছে বড়জোর চারটে।

ফলে কোম্পানি একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে যে সমস্ত ইনসুরেন্স ক্লেইমে রহস্যের গন্ধ থাকবে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করা দরকার। এবং এই উদ্দেশেই ভাস্করকে এখানে পাঠানো। ভাস্কর কোম্পানির গোয়েন্দা বিভাগের খুব নামকরা অফিসার। সন্দেহজনক দাবির কেস এই অঞ্চল থেকে গেছে পাঁচটি। প্রত্যেকটির সুরাহা করে ফিরতে কত সময় লাগবে কেউ জানে না। হয়তো ছয় মাস, কিংবা এক বছর। তবে ভাস্কর যে এখানে আসছে তা কোম্পানির লোকাল অফিস জানে না। সে নিজেই চায়নি ওরা আগে থেকে জেনে যাক। বলা যায় না, হয়তো সর্ষের মধ্যেই ভূত বিচরণ করছেন।

দিনেরবেলায় বাস-স্ট্যান্ডে যেরকম অভদ্র-ব্যস্ততা থাকে, এখন এ সন্ধে পেরোনো সময়টায় তা নেই। কিছু মিনিবাস দাঁড়িয়ে আছে বটে, সেগুলোর আলো নেভানো এবং লোকজন নেই। এখনও শহরটাকে ভালো করে দেখা হয়নি কিন্তু অনুমানেই বলা যায় এই জায়গাটা চোর বদমাশ গুন্ডাদের আরামের। কারণ এখানেই পাঁচ মিশালি নিম্নবিত্ত মানুষেরা হল্লা করে কথা বলতে পারে। এখানে কোনও রুচি বা শোভনতা ভ্রূ কুঁচকে থাকে না। একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই ভাস্কর দেখতে পেল একটি অল্পবয়সি নেপালি ছেলে তাকে লক্ষ করছে। এই কি পেছন-পেছন আসছিল? অন্ধকারে পায়ের আওয়াজটাকে ঠিক পাত্তা দেয়নি সে।

চট করে পানের দোকান ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর রাস্তার ধারের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে নিচের খেলার মাঠটাকে নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে। এবং তখনই ভাস্কর টের পেল ছেলেটি তার দিকে এগিয়ে আসছে শব্দহীন পায়ে। আসুক। আসতে দাও। ভাস্কর তার শরীরের মাসল একটুও শক্ত করল না। যেন অত্যন্ত তন্ময় হয়ে সে আর্ট দেখছে। ঠিক তখনই কোমরে একটা ধারালো এবং তীক্ষ্ণ কিছু স্পর্শ করল এবং সেইসঙ্গে চাপা গলায় একটা হুমকি, জেবমে যো হ্যায় নিকালো, নেহি তো খতম হো যায়েগা।

ভাস্কর হাসল। শব্দহীন। ছেলেটি নেহাতই নভিস। না হলে ওর আক্রমণটা একটু অন্য ধরনের হতো। সে ঠিক করল জবাব দেবে না। শুধু ওই তীক্ষ্ণ কিছুর উপস্থিতিটাই তার অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল। ছেলেটি এবার চাপা হুঙ্কার দিল, নিকালো!

চকিতে ভাস্করের ডান গোড়ালি পেছনে উঠে গেল ততটাই, যতটা ছেলেটির তলপেটে আঘাত করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে কঁক করে একটা শব্দ হল। এবং চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাস্কর বাঁ-হাতের পাশ দিয়ে দ্বিতীয় আঘাত করল ছেলেটির ধারাল ছুরি-ধরা হাতে। সঙ্গে-সঙ্গে ছুরিটা উড়ে গিয়ে পড়ল খানিকটা দূরের চাতালে। ছেলেটি তখন দাঁড়িয়ে টলছে। ওর দুটো পা এক জায়গায় নেই। ভাস্করের আফসোস হল এই দ্বিতীয় আঘাতটা করার কোনও দরকার ছিল না। ছুরিটা হাতের মুঠো থেকে এমনিই খসে পড়ত।

ভাস্কর বাঁ-হাত বাড়িয়ে ছেলেটির জামার কলার ধরল, তোর নাম কী?

ছেলেটি তখনও কথা বলার অবস্থায় ফিরে আসেনি। ভাস্কর ওকে এমন একটা ঝাঁকুনি দিল যে কিছু শব্দ ছিটকে এল মুখ থেকে। তা থেকে অন্তত এটুকু বোঝা গেল সে ক্ষমা চাইছে।

ভাস্কর ওকে ধরে নিয়ে গেল পানের দোকানের সামনে। দোকানদার এতক্ষণ বোবা চোখে দেখছিল। এখন মাথা নামিয়ে কাজের ভান করতে লাগল। ভাস্কর লোকটাকে জিগ্যস করে, একে তুমি চেনো?

ওদের দিকে না তাকিয়ে পানওয়ালা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা গেল আর বেশি কিছু বলতে সে নারাজ। ভাস্কর এবার ছেলেটিকে বলল, তুই কি এইসব করে বেড়াস?

ছেলেটি ততক্ষণে বোধহয় খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিল। খানিকটা জেদের ভঙ্গিতে সে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

চাকরি-বাকরি করিস না?

কোই মুঝে নোকরি নেহি দেতা।

জেলে গেছিস?

হ্যাঁ, তিনবার।

ভাস্কর এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিল। তারপর ওর জামাটা ছেড়ে দিল, যা ছুরিটা কুড়িয়ে নে। আমি ওই কাঞ্চনজঙ্ঘা লজে আছি। কাল খুব ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করিস। তোর উপকার হবে।

ভাস্কর আর দাঁড়াল না। তবে সে অনুভব করছিল ছেলেটি তখনও সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো হতভম্ব হয়ে গেছে। এরকম শিক্ষাপ্রাপ্তি ওর বোধহয় এই প্রথম।

কাঞ্চনজঙ্ঘা লজের রিসেপশনিস্টের ডেস্কটা এখন খালি। একজন বৃদ্ধ টিবেটিয়ান উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিলেন। তাঁর হাতের মালা ঘুরছে। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে সেই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একটা প্লেটে অদ্ভুত ধরনের খাবার নিয়ে তিনি বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ভাস্কর তাঁকে দেখে মাথাটা সামান্য দোলাল। বৃদ্ধা আড়চোখে তাকে দেখে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন, মুখে কিছু বললেন না। ভাস্কর সিদ্ধান্ত নিল এই টিবেটিয়ানরা নিশ্চয়ই কম কথা বলে আর যা বিদঘুটে গন্ধ এখানে, কাল সকাল হলেই হোটেল পালটাতে হবে।

শাজাহান সেনের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সে। লোকটার খবর নেওয়া দরকার। তখন যেভাবে ঘরে ঢুকেছিল সেটা সুবিধের নয়। সে দরজায় নক করল। ভেতর থেকে কোনও উত্তর এল না। আরও দুবার নক করার পর সে জোরে দরজাটাকে ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না ভাস্কর। বাঁ-দিক, ডানদিকে চোখ বুলিয়ে সে দেখে নিল করিডোরে কেউ আছে কি না, তারপর সামান্য নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের ভেতর পা বাড়াল। সুন্দর ধূপের গন্ধ পাক খাচ্ছে ঘরে। এবং শাজাহান সেন উপুড় হয়ে পড়ে আছে তার খাটে। এছাড়া ঘরে আর কেউ নেই। ভাস্কর এগিয়ে গিয়েই বুঝতে পারল শাজাহান বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এবং এই ঘুম স্বাভাবিক নয়। সে মৃদু গলায় ডেকেও সাড়া পায়নি। অথচ শাজাহানের পিঠ নিঃশ্বাসের তালে দুলছে। দুবার আলতো করে চড় মারল সে শাজাহানের গালে। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। ভাস্কর আর অপেক্ষা না করে দ্রুত বেরিয়ে এল। তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের তালা খুলল। আজ সন্ধে থেকে একটার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। ঠান্ডা মাথায় সবকিছু তলিয়ে দেখতে হবে। পাশের ঘরে যে নাটক চলছে তা জুলি শেরিং-এর ঘটনাটার চেয়ে কম চমকপ্রদ নয়।

সকালটা এল টাটকা রোদ নিয়ে। কাচের জানলার বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশ পাহাড়ের ওপর উপুড় হয়ে রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ভাস্কর বেল টিপল। এরা খাবার না দিক, চা অন্তত দিতে পারে।

মিনিটখানেক বাদে একটি টিবেটিয়ান বালক দরজায় এসে দাঁড়াতে ভাস্কর হুকুমটা জানাল। ছেলেটা একটুও না হেসে চলে গেল। এবং তখনই দরজায় এল শাজাহান সেন, গুড মর্নিং। কেমন আছেন?

গুড মর্নিং। আসুন। কেমন আছেন? ভাস্কর স্বাভাবিক গলায় বলল।

আছি। ভাবছি আজই ফিরে যাব।

সেকি? কেন?

ওই ঘরে যা চলছে তারপর আর এখানে থাকা যায় না।

কী চলছে?

বলা নিষেধ।

অন্য হোটেলে যান।

অন্য হোটেলে গেলে আমায় শেষ করে ফেলে দেবে বলে শাসিয়েছে।

ভাস্কর এবার লোকটিকে ভালো করে দেখল। আপাত চোখে সরল বলেই মনে হয়। সে নিচু গলায় প্রশ্ন করল, ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলবেন? হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

কোনও লাভ হবে না।

এই সময় চা নিয়ে ঢুকল ছেলেটি। শাজাহানকে এই ঘরে দেখে যেন একটু অবাক হল সে। তবে মুখে কিছু না বলে সে বেরিয়ে গেল। শাজাহান বলল, এইটে আর এক চিজ। চায়ে মুখ দেবেন না। শরীর গুলিয়ে উঠবে।

কেন?

টিবেটিয়ান চা। হতকুচ্ছিত খেতে। বিশ্বাস না হয় চুমুক দিয়ে দেখুন। চায়ের দিকে তাকিয়ে ভাস্করের মনে হয় কথাটা সত্যি। সে উঠে দাঁড়াল, আপনার হাতে কোনও কাজ আছে?

না। এখানে তো কাজ করার জন্যে আসিনি। দুপুরের বাস ধরব। ততক্ষণ আমি ফ্রি। কেন, কিছু করতে হবে?

চলুন একটু বেড়িয়ে আসি। জায়গাটা আপনার চেনা। ভালো খাবারের দোকান কোথায় আছে দেখিয়ে দিন। শাজাহানের আপত্তি ছিল না। দরজায় তালা দিয়ে ভাস্কর বলল, আপনার ঘরে তালা দেবেন না?

শাজাহান মাথা নাড়ল, আমার রুমমেট ঘুমুচ্ছেন। দশটাকা বেশি দিলে তখন আপনার সিঙ্গল রুমটা পেয়ে যেতাম। কিপ্লেটমি করে যে কী ভুল করেছি! বাইরে বেরিয়ে এসে ভাস্কর জিগ্যেস করল, কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করেছিলেন?

খাওয়া-দাওয়া? কাল রাত্রে? আচমকা প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল শাজাহান, হঠাৎ এইরকম প্রশ্ন করছেন কেন? আমি কি খুব বেশি মাল খেয়েছিলাম কাল রাত্রে? আমার না বেশি মাল খেলে খাবার খেতে ইচ্ছে করে না।

আপনি কাল রাত্রে বেশি মদ খাননি। আর যখন ঘরে ঢুকেছিলেন তখন তো সন্ধে। নিশ্চয়ই গুরুদেবের সামনে মদ খাননি।

না। না। এইবার মনে পড়ছে। তাই বলি, এখন এত খিদে পাচ্ছে কেন? না, কাল রাত্রে কিছু খেয়েছি বলে মনে হচ্ছে না। চলুন, ওই দোকানটায় চমৎকার চা করে। দেখছেন কেমন গরম-গরম জিলিপি ভাজছে। আহা, চোখ জুড়িয়ে যায়।

সকালবেলায় মিষ্টি খাওয়া ধাতে নেই ভাস্করের। সে চা এবং একটা বিস্কুট খেল। শাজাহান গোটা ছয়েক জিলিপি শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল, স্টমাকটা একদম খালি হয়েছিল, প্রাণ জুড়োল।

ভাস্কর ঠাট্টা করে বলল, আপনি দেখছি অদ্ভুত মানুষ। রাত্রে মদ খান, ভোরে জিলিপি।

সিওর। আমার ডায়াবেটিস নেই, ব্লাডসুগার নেই, আমি খাব না কেন?

পাহাড় ভাঙতে-ভাঙতে ভাস্কর জিগ্যেস করল, কাল রাত্রে ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো শাজাহানবাবু। আপনার হঠাৎ নেশা হয়ে গেল কী করে? যখন ঢুকলেন তখন তো সামান্যই ড্রিঙ্ক করেছিলেন। তাতে বেঘোর হবার কথা নয়! ভাস্কর একটু উস্কে দিতে চাইল।

কী হয়েছিল সত্যি আমার মনে নেই। ঘরে ঢুকে দেখলাম গুরুদেব শব-সাধনা করছেন। আমি ঢুকে পড়েছি বলে শিষ্যমহারাজ খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, এভাবে হুটপাট ঢুকে পড়বেন না। গুরুদেবের অর্চনার বিঘ্ন হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। গুরুদেব সেই অবস্থায় বললেন, বাক সংযম কর বৎস। বরং ওকে প্রসাদ পাইয়ে দাও।

শিষ্যমহারাজ আমাকে মন্ত্রঃপুত কারণবারি পান করতে দিলেন। আমি দেখলাম নেশাটা জলো হয়ে এসেছিল তাই সেটাকে জমাট করতে মেরে দিলাম পুরোটা। ব্যস, আর কিছু খেয়াল নেই। শাজাহান বিবৃতি শেষ করল।

ভাস্কর খানিকটা অবাক গলায় জিগ্যেস করল, শব-সাধনা করছিলেন বললেন না? শব, মানে ডেডবডি এল কী করে ওই ঘরে? আর এইসব তো শুনেছি তান্ত্রিকরা করে থাকেন।

শাজাহান ঠোঁটে একটা আওয়াজ করল, ডেডবডি হতে যাবে কেন, একটি মেয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে আর গুরুদেব তার পিঠে পদ্মাসনে বসে ধ্যান করেন। মাইরি সব বলব আপনাকে, দেখলে সহ্য করা যায় না।

একটি মেয়ে মানে, রোজ কি একই মেয়ে আসে?

নো, নেভার। প্রত্যেক দিন তো নতুন মুখ দেখি।

ভাস্কর মাথা নাড়ল। লোকটা যে দুনম্বরি তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই পাহাড়ে ও রোজ একটা করে মেয়ে পাচ্ছে কোত্থেকে? নাঃ আজ যেমন করেই হোক লোকটার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তবে লোকটা যদি এমন ধান্দাবাজ হয় তাহলে ডাবল সিটেড রুম নিতে যাবে কেন? কেন আর-একজন অচেনা মানুষকে রুমমেট হিসেবে সঙ্গে রাখবে? ও তো স্বচ্ছন্দে সিঙ্গল সিটেড রুম নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারত। এইখানেই খটকা লাগছিল ভাস্করের। শাজাহান লোকটা দু-নম্বরি নয়তো? এইসব কথা বলে তার সঙ্গে অন্য মতলবে ভিড়ছে না তো!

মুখে কিছু প্রকাশ করল না সে। বলল, শাজাহানবাবু, আজকের দিনটা থেকে যান। এতদিন কষ্ট করলেন আর-একটা দিন করলে কোনও অসুবিধে হবে না। বুঝলেন?

শাজাহান মাথা নাড়ল, আমি যে অ্যানাউন্স করে ফেলেছি।

সেটা শুনে গুরুদেব কী বলছেন?

উনি খুব চটে গেলেন। বললেন আমার নাকি ধৈর্য নেই, সংযমশক্তি নেই। আমার দ্বারা সাধনা হবে না। আমি একটু তন্ত্রসাধনা শিখতে চেয়েছিলাম তাই উনি খেপে গেলেন আমি চলে যাব শুনে।

আপনার হঠাৎ ওসব শেখার ইচ্ছে হল কেন?

মানে, এই আর কী? রোজ মশাই ভৈরবী দেখতে-দেখতে—।

হো-হো করে হেসে উঠল ভাস্কর। যাক এতক্ষণে শাজাহানের মতলবটা বোঝা গেল। শাজাহান বেশ সংকুচিত হচ্ছিল, বলল, না-না, এটা ঠাট্টার বিষয় নয়। আমি একটা বইতে পড়েছিলাম টিবেটে তন্ত্রের প্রচার ছিল।

হাসি থেমে গেল ভাস্করের। টিবেটে? হ্যাঁ, তিব্বতে তো শাক্ততন্ত্র প্রবেশ করেছিল। বুদ্ধের মন্দিরে শাক্তদের অনেক প্রতীক আছে। কিন্তু তার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক মশাই?

বাঃ, এই গুরুদেব তো অরিজিন্যাল টিবেটিয়ান।

টিবেটিয়ান? হতভম্ব হয়ে গেল এবার ভাস্কর।

ইয়েস অরিজিন্যাল। যেহেতু উনি বুদ্ধের মতাবলম্বী নন তাই ওঁর জাতভাইরা তাঁকে এড়িয়ে চলে। তবে চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। শিষ্যমহারাজ বলেন, গুরুদেব নাকি পৃথিবীর যে কোনও ভাষায় কথা বলতে পারেন। যোগীরা একটা স্টেজে চলে গেলে বোধহয় ওইসব ক্ষমতা অর্জন করেন। তবে শিষ্যমহারাজ বাঙালি, একটু খেঁকুরে টাইপের। লোকাল লোক।

কোথায় থাকেন?

জিগ্যেস করিনি।

সমস্ত ব্যাপারটাই দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল ভাস্করের কাছে। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছিল। এবার শাজাহান জিগ্যেস করল, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

এমনি, উদ্দেশ্যবিহীন বেড়ানো আর কী!

শাজাহান নিজের ঘড়ি দেখল, নটা বেজেছে। এখন একটু খাওয়া যায়।

কী খাবেন?

সলজ্জ মুখ করল শাজাহান। তারপর শরীরটা বেঁকিয়ে বলল, যে জন্যে এই পাহাড়ে একা-একা ছুটে আসি। এখানে একটা শস্তার বার আছে।

এই সাতসকালেই মদ খাবেন?

সাতসকাল কোথায়? নটা বেজে গেছে।

টিবেটিয়ান মদ? ভাস্করের চোখ ছোট হল।

না, না। এই বাঙালির লিভার ওসব সহ্য করতে পারে না। আমি পুরো ইংলিশ।

তাহলে আজ থেকে যাচ্ছেন?

বলছেন যখন, আর-একদিন মাল খাওয়া যাক।

শাজাহানকে ছেড়ে উলটো পথ ধরল ভাস্কর। ম্যাল রোডে আসামাত্র সে মোটরবাইকটাকে দেখতে পেল। তার আরোহী চোখে সানগ্লাস সেঁটে সিটের ওপর স্টাইলে বসে একটি লোকের সঙ্গে কথা বলছে। লোকটি বৃদ্ধ নেপালি। ছেলেটির কথায় বারংবার মাথা নাড়ল লোকটি। তারপর আচমকা স্টার্ট দিয়ে মোটরবাইকটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটি ডানদিকের রাস্তায়। সেই সময় ভাস্কর ছেলেটিকে দেখতে পেল। দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকে দেখছে। ভাস্কর চিনতে পারল। এই ছোকরাই গতরাত্রে ছিনতাই করতে এসেছিল। সে ইশারায় ওকে কাছে ডাকতে ছেলেটি এপাশ ওপাশ দেখে এগিয়ে এল, আপকো হোটেলমে গিয়া থা।

ভাস্করের মনে পড়ল ওকে সে দেখা করতে বলেছিল।

সে মাথা নেড়ে জিগ্যেস করল, তোর নাম কী?

পদম বাহাদুর।

তুই ছুরি দেখিয়ে রোজ কত টাকা কামাস?

দশ-বিশ-পঞ্চাশ, কভি-কভি একদম নিল।

এখন কী করছিস?

কুছ নেহি।

তুই এই শহরের সবকিছু জানিস?

হলুদ দাঁত বের করে হাসল পদম। তারপর ডানহাত সামান্য বাড়িয়ে বলল, এই হাতটাকে যেমন চিনি তার চেয়ে কম নয়।

তুই চাকরি চাস?

ফুঃ, কেউ আমাকে চাকরি দেবে না। সবাই জানে আমি কী করি। নিরাসক্ত মুখে কথাগুলো শোনাল পদম।

ভাস্কর হাসল, তুই যদি কথা দিস আর কখনও ছিনতাই করবি না তাহলে আমি তোর জন্যে চেষ্টা করতে পারি। তার আগে বলতো এখানে দিশি মদ কোথায় পাওয়া যায়?

এবার যেন ছেলেটি স্বাভাবিক হল, অনেক রকমের দিশি মদ এখানে পাওয়া যায়। আপনি কোনটা চাইছেন বললে আমি এনে দিতে পারি। হাঁড়িয়া, চোলাই, পচাই আউর তিব্বতিরা যে মাল খায় তারও একটা বড় দোকান হয়েছে এখানে। তবে সেটাকে সাহেব দিশি মদ বলবেন কি না জানি না। বহুৎ খারাপ গন্ধ আর তেমনি কড়া, কলজে জ্বালিয়ে দেয়।

ভাস্কর হাসল, এইরকম মদই আমার পছন্দ। দোকানটা কোথায়, তুই আমাকে সেখানে নিয়ে চল।

পদম বাহাদুর ইতস্তত করছিল, আপনি ওখানে যাবেন না সাহেব। আমরাই যেতে চাই না। আসলে ওই দোকানের খদ্দের সব তিব্বতি। মাল খেলে ওদের মেজাজ খুব চড়া থাকে।

তোর চেয়েও?

মানে?

তোকে যদি আমি কব্জা করতে পারি তো ওদের পারব না? তাহলে বল তোর চেয়ে বড় শের এই শহরে আছে! ভাস্কর ইচ্ছে করে গলার স্বরে ব্যঙ্গ মিশিয়ে দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটি মুখ ভ্যাটকাল। তারপর দুই কাঁধ নাচিয়ে চলল, চলুন। তবে গোলমাল হলে আমাকে দোষ দেবেন না। আমি যে কোনও নেপালির সঙ্গে টক্কর দিতে পারি কিন্তু তিব্বতিদের হালচাল বুঝতে পারি না। ঠিক হ্যায়—।

পদম আগে-আগে হাঁটছিল। রাস্তাটা ঢালু, বাঁদিকে নামছে। পদমের হাঁটা-চলার মধ্যে এক ধরনের বিদেশি ভাব আছে। অথবা বিলিতি ছবির প্রভাবও হতে পারে। অবশ্য এই শহরে বিদেশি ছবির চেয়ে হিন্দির পোস্টারই বেশি চোখে পড়ছে। তা ওদের নায়ক-নায়িকারাও তো আন্তর্জাতিক।

এখন সঁবে সকাল শেষ হয়েছে। নিচের রাস্তাটায় বেশ ভিড়। দোকানপাট আছে তবে ওপরের ম্যাল রোডের মতো অত সাজানো নয়। কিন্তু ব্যবসাপত্র বেশ জমজমাট তা তাকালেই ধরা যায়। গলির মধ্যে ঢুকতে হল না। বড় রাস্তা থেকে একটা কাঠের সাঁকো সোজা থেমেছে একটা কাঠের বারান্দায়। বাড়িটার ওপর ইংরেজি এবং সম্ভবত টিবেটিয়ানে লেখা রয়েছে। দ্বিতীয়টি বোঝার সামর্থ্য ভাস্করের নেই। প্রথমটির সরল অর্থ খুশমেজাজি পানশালা।

পদম বলল, আমি ভেতরে যাব না।

কেন? ভাস্কর অবাক হল।

পদম উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল যার অর্থ সে আর এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। ভাস্কর আর জোর করল না। সে সাঁকোর ওপর পা রাখল। বেশ মজবুত সাঁকোর দুপাশে কাঠের রেলিং। বারান্দাটা ফাঁকা। কিন্তু সেখানেও কয়েকটা খালি বেঞ্চি বোঝাচ্ছে ভেতরের ভিড় বেশি হলে ওগুলোর প্রয়োজন হয়। সে দরজায় দাঁড়ানো মাত্র একটা বিদঘুটে গন্ধ নাকে এল। তীব্র এবং শরীরগোলানো গন্ধটায় অ্যালকোহল মিশে রয়েছে। ঘর না বলে হলঘর বলাই ঠিক। এই সময় তেমন ভিড় নেই। ভাস্কর গুনে দেখল মাত্র পাঁচজন পান করছে। এরা প্রত্যেকেই তিব্বতের মানুষ। কাউন্টারে যে লোকটি পরিবেশন করছে তার চেহারা বিশাল। অনুমানে বোঝা যায় তিন-চারজন সাধারণ মানুষকে সে অবহেলায় ছুড়ে ফেলতে পারে। ভাস্করকে দরজায় দাঁড়াতে দেখে লোকটা তার চেরা এবং প্রায় বোজা চোখ সমেত মাথাটা নাড়াল।

ভাস্কর ভাব-জমানোর হাসি হাসল কিন্তু লোকটির কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ততক্ষণে ভেতরে পা দিয়েছে ভাস্কর। হলঘরটির একটা বিশেষত্ব আছে। প্রতিটি টেবিলের সঙ্গে মাত্র একটি চেয়ার সাঁটা। অর্থাৎ তোমাকে পান করতে হবে একা-একা। আড্ডা মেরে পাঁচজন মিলে খাওয়া এখানে চলবে না। যে পাঁচজন খাচ্ছে তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এবং নির্বাক।

ভাস্কর অনেক খালি টেবিলের একটায় বসল। চেয়ার মোটেই আরামদায়ক নয়। এই ব্যবস্থা নিশ্চয়ই একজন মানুষ যেন অযথা সময় এখানে না কাটায় সেই কারণে। সে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখল স্বাস্থ্যবান লোকটি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই সে ইঙ্গিত করল কাউন্টারের কাছে এগিয়ে যেতে। ভাস্কর একটু সময় নিল। লোকটার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুব বিরক্ত হচ্ছে। ভাস্কর এবার ইঙ্গিত করল লোকটাকে কাছে আসতে। দশ সেকেন্ড তাকে দেখল লোকটা। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। ভাবখানা এমন, চুলোয় যাও।

সাতসকালে মদ্যপান করার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না। জায়গাটা তার দেখতে আসাই উদ্দেশ্য। এই পানশালার মালিক ছিলেন মিস্টার শেরিং। তিনি মারা গিয়েছেন। সকালবেলার খদ্দের দেখে অবশ্য ঠাওর করা যায় না এই পানশালায় বিক্রি কত! তবে তিন লক্ষ টাকার জীবন-বীমা সাধারণ আয়ের মানুষ করে না। কাউন্টারের পেছনে কয়েকটা ঘর আছে। সেগুলোয় কারা থাকে? একটি মানুষ তার জীবনের নিরাপত্তা বা তার পরিবারকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে বীমা করতেই পারে। কিন্তু ভাস্কর শুধু দেখবে মিস্টার শেরিঙের মৃত্যুতে কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই।

শেষপর্যন্ত সোজা পায়ে ভাস্কর হেঁটে গেল কাউন্টারে। তারপর সামান্য হেসে বলল, গিভ মি সাম টিবেটিয়ান ব্রেকফাস্ট।

নো ব্রেকফাস্ট! অনলি ড্রিংকস। লোকটা চেরা চোখে তাকাল।

ইজ ইট টিবেটিয়ান?

ইয়েস। ভেরি গুড। অনলি ইন দিস শপ।

আই সি। ঠিক হ্যায়। আই লাইক টিবেটিয়ান ড্রিংক। তবে এখন নয়। আজ বিকেলে আসব। গুডবাই। কথাটা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই ভাস্কর দেখল একটা গাড়ি এসে কাঠের সাঁকোর সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার দ্রুত নেমে দরজা খুলে দিতেই জুলি শেরিং গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে-সঙ্গে কাউন্টারের লোকটা চঞ্চল হয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজায় ছুটে গেল। ভাস্কর চট করে বাঁদিকে সরে গেল যাতে ভদ্রমহিলার সামনা-সামনি না পড়তে হয়। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট লম্বা, ছিপছিপে শরীর দুম্বায় ঢাকা সত্বেও বোঝা যায় ওঁর যৌবনে বেশি রকমের বাড়াবাড়ি। কিন্তু মাথা সোজা করে যখন চোখ নীল চশমায় ঢেকে হেঁটে এল তখন ভাস্কর ব্যক্তিত্ব শব্দটা মনে করতে পারল। লম্বাটে কিন্তু সুশ্রী মুখ। টিবেটিয়ানরা যেরকম ফর্সা হয় মহিলা তার চাইতে একটু বেশি। বয়স অনুমান করা মুশকিল। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হলে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু ভাস্কর জানে মিস্টার শেরিংয়ের একটি কুড়ি বছরের মেয়ে রয়েছে যে তিব্বতেই থেকে গিয়েছিল বাষট্টি সালে ভারতে পালিয়ে আসবার সময়। সেই মেয়ের মা যে এত অল্পবয়সি তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। কোনও-কোনও চিত্রাভিনেত্রী নাকি বাহান্নতে বত্রিশে থেমে থাকেন। এই মহিলা সেই কৌশলটি আয়ত্ত করেছেন।

জুলি শেরিং মদ্যপায়ীদের দিকে তাকালেন না। গর্বিত পদক্ষেপে হলঘরটা পেরিয়ে ঢুকে গেলেন কাউন্টারের পাশ দিয়ে ভেতরের ঘরে। আর স্বাস্থ্যবান লোকটি বশংবদের মতো ওর পেছন-পেছন দরজা পর্যন্ত পৌঁছে বিনীত ভঙ্গিতে আবার কাউন্টারে ফিরে এল। ভাস্কর আর দাঁড়াল না।

জুলি শেরিং নিয়মিত এই পানশালায় তদারকিতে আসেন। অর্থাৎ কর্মচারীদের ওপর দায়িত্ব চাপানোর মহিলা নয়। ওর হাঁটার ধরন, মুখের গড়ন এবং গাম্ভীর্য বলে দেয় এই মহিলা মোটেই সাধারণ রমণী নয়। বাইরে বেরিয়ে এসে ঠান্ডা বাতাস নিল সে বুক ভরে। ঘরের মধ্যে এই সময়টুকু থেকেই যেন নেশা হয়ে যাচ্ছিল। এই মদ সত্যিই তীব্র।

জুলি শেরিংয়ের সঙ্গে আজ কথা বলা যেতে পারত। সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে তাতে কথা বলার সম্পূর্ণ অধিকার তার আছে। কিন্তু না, আর একটু অপেক্ষা করা যাক। নদীর জল, মাটি, শ্যাওলা ইত্যাদি দেখার পর স্নানে নামাই ভালো।

রাস্তায় নামতেই পদম এগিয়ে এল, পিয়া সাব?

ভাস্কর সত্যি কথা বলতে গিয়েও মত পালটালো। সে নীরবে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল যার অর্থ দুটোই হতে পারে। পদমের চোখ বিস্ফারিত হল, আপনার খাওয়া অভ্যেস ছিল নিশ্চয়ই। ওই যে লোকটা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকে ও বহুৎ বদমাশ। একা তিনটে লোককে শুইয়ে দিতে পারে। আর ওই যে মেমসাহেব এই মাত্র ঢুকলেন তিনি হলেন এখন দোকানের মালকিন। খুব ঘাঘু চিজ।

খবর পাওয়া যাচ্ছে। খুশি হচ্ছিল ভাস্কর। কিন্তু সেটাকে প্রকাশ না করে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করল, একজন ভদ্রমহিলা সম্পর্কে অভদ্র-ভাষায় কথা বলছ কেন?

ভদ্রমহিলা? ও যদি তুড়ি মারে তাহলে যে কোনও লোকের লাশ পড়ে যাবে। তিব্বতিরা পর্যন্ত ওকে এড়িয়ে চলে। ওর ডান হাত হল ওই কাউন্টারের লোকটা। ওই বারে মাতালরা ঝামেলা করতে সাহস করে না। ওর স্বামী যখন মারা গেল তখন অনেকেই সন্দেহ করেছিল মৃত্যুটা সাদা কি না!

সাদা কি না মানে? ভাস্কর সতর্ক হল কিন্তু ভঙ্গিতে প্রকাশ করল না।

মানে মানুষরা বলে বুড়ো স্বামীকে হয়তো ওর পছন্দ হয়নি।

কীভাবে মারা গেল লোকটা? উল্টোপথে হাঁটতে-হাঁটতে প্রশ্ন করল ভাস্কর। মিস্টার শেরিংয়ের মৃত্যুর বিশদ বিবরণ যে ফাইলে আছে সেটি সে পড়েছে। পুলিশ মৃত্যুর পেছনে কোনও অস্বাভাবিকত্ব লক্ষ করেনি। যে ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তিনিও বলেছেন মৃত্যুটা স্বাভাবিক। মিস্টার শেরিং কিছুদিন থেকেই বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। অনেক মানুষের সামনে ওই কাউন্টারের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি বুকের যন্ত্রণায়। এই অবধি কোনও গোলমাল নেই। গোলমাল ছিল কি না সেটা জানতেই তার এই শহরে আসা। অতএব এই ছেলেটি যদি কিছু তথ্য দিয়ে দেয়, গুজব যত বানানোই হয় একটা সত্যের বীজ থাকে সুদূর নেপথ্যে।

মদ খেয়ে। পদম হাসল, এ শালা তিব্বতি মদ কলিজা পুড়িয়ে দেয়। খুব মদ খেত লোকটা। কেউ-কেউ বলে ওই মদে কিছু মিশিয়ে দিত মেয়েটা। আবার কেউ বলে মদ খেত বটে কিন্তু তার চেয়ে আর-একটা নেশা ছিল বুড়োর।

কী নেশা? ভাস্কর হতাশ হচ্ছিল। ছেলেটার কথাগুলো সাধারণ গপ্পোবাজ অলস মানুষের বানানো। তার মধ্যে সত্যতা হয়তো আদৌ নেই এবং এ থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না।

ছোবল খেত লোকটা। সাপের ছোবল।

দূর। ছোবল খেলে তো মরে যাবে। এই নেশা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সত্বেও অজ্ঞ সাজল ভাস্কর।

হ্যাঁ যাবে, আপনি-আমি মারা যাব। কিন্তু যাদের অভ্যেস আছে তারা ঠিক থাকে। তবে সে-সব সাপ খুব ছোট-ছোট। বিষ সবে জমছে। একটা কৌটোতে আটকে রাখা হয়। কৌটোর ওপরে ছোট্ট ফুটো থাকে। ছোবল খাওয়ার আগে খুব জোর কৌটোকে নাড়ালে সাপটা রেগে যায়। তখন সেই ফুটোতে জিভ রাখলে সাপ ছোবল মারবেই। অত ছোট ফুটো, ছোট সাপ, বিষে তাই মানুষ মরে না কিন্তু জব্বর নেশা হয়ে যায়। সারাদিন পড়ে থাকে নেতিয়ে। আমেরিকাতে শুনেছি সাহেবরা ইঞ্জেকশনে ওই বিষ ঢুকিয়ে শরীরে নেয়। মানুষ বড় আজব জিনিস সাহেব। খুব বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল পদম।

মনে-মনে তারিফ করল ভাস্কর। সাপের বিষ নেবার পদ্ধতিটা ও সঠিক না জানলেও কায়দাটার আন্দাজ আছে। মিস্টার শেরিং যে ওই নেশা করতেন তার প্রমাণ চাই। সে জিগ্যেস করল, তুই সাপের বিষ কাউকে নিতে দেখেছিস? চোখের সামনে?

মাথা নাড়ল পদম, নাঃ। সাপকে আমার খুব ভয় করে। তবে নামচে বস্তিতে একজন তিব্বতি থাকে যে নাকি ওই ছোট-ছোট সাপ ধরে বিষের কারবার করে। হয়তো ওই মাল দিত বুড়োটাকে।

নামচে বস্তি এখানে আছে?

হ্যাঁ। এখান থেকে মাইল দেড়েক হেঁটে গেলেই নামচে বস্তি।

তুই আমাকে সেই লোকটার কাছে নিয়ে যেতে পারবি?

কেন? এই প্রথম যেন সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল পদম বাহাদুর।

আমি সাপ কিনব। মদ খেয়ে কোনও কাজ দিচ্ছে না।

সাহেব, এটা ঠিক নয়। আপনি তিব্বতি মাল খেলেন তবু মনে হচ্ছে যেন চা খেয়ে এলেন। তার মানে মদ হেরে গেছে। কিন্তু সাপের বিষ যেসব মানুষ নেয় তারা শুনেছি মানুষ থাকে না।

ভাস্কর হাসল। ছেলেটা সত্যিকারের ছিনতাইবাজ নয়। জেল খাটলেও নয়। কিংবা ওসব হলেও মনের আনাচে-কানাচে কিছু নরম ব্যাপার আছে। মানুষের ভেতর আর-একটা নরম মানুষ না থাকলে অন্যের সত্য উপলব্ধি করা যায় না। সে নিচু গলায় বলল, তোর সঙ্গে আমার একটা বন্দোবস্ত দরকার।

পদম বেশ ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল।

ভাস্কর বলল, তুই তোর অভ্যেস ছাড়লে চাকরির ব্যবস্থা করব বলেছি। এছাড়া আমার সঙ্গে যে ক’দিন ঘুরবি তার জন্যে আলাদা টাকা পাবি। রাজি?

পদম হাসল, হেসে মাথা নাড়ল।

ম্যাল রোড ধরে ওরা হাঁটছিল। এই সময় সেই মোটরবাইকওয়ালাকে নিচে নেমে যেতে দেখল ভাস্কর। সে জিগ্যেস করল, লোকটাকে চিনিস?

ঘাড় নাড়ল পদম, খুব ভালো ব্যাডমিন্টন খেলে। সরকারি চাকরি করে। এখানকার মেয়েরা ওর জন্যে পাগল।

ক্রমশ ওরা এগিয়ে এল ক্লিন হার্ট রোডে। এখন এই রাস্তায় মোটামুটি লোক চলাচল করছে। তবে জায়গাটা যেহেতু বড়লোকদের তাই আজেবাজে মানুষজন নেই। ভাস্কর চটপট চারপাশে তাকিয়ে নিল। তারপর পদমকে বলল, তুই এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবি। আমি ওই বাংলোর ভেতর যাব। কেউ গেট খুলে ঢুকতে দেখলেই সিটি বাজাবি। সিটি বাজাতে পারিস?

পদমের মুখ উজ্জ্বল হল, সে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভাস্কর বুঝল অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত কোনও মানুষ একজন সঙ্গী পেলে সুখী হয়। পদম এতক্ষণে তাকে ওইরকম কিছু ভাবছে।

জায়গাটা সামান্য নির্জন হওয়া মাত্র ছোট পাঁচিল ডিঙিয়ে ভাস্কর ভেতরে ঢুকে পড়ল। দুপাশে ফুলের বাগান এবং লম্বা গাছের সারি। এই মুহূর্তে জুলি শেরিং বাড়িতে নেই। তার সাকরেদ স্বাস্থ্যবান মানুষটিও কাউন্টার সামলাচ্ছে। রাত্রে যে মোটরবাইকওয়ালা জুলিকে দেখছিল সেও নিচে নেমে গেছে। এখন এই মুহূর্তে বাড়িতে আর কে-কে থাকতে পারে? এই বাড়ির ভেতরটা জুলির অজান্তে একবার ভালো করে দেখতে চায়। খুব বুদ্ধিমান মানুষও কখনও-কখনও বোকার চেয়ে সাধারণ ভুল করে বসে। এক্ষেত্রে সেরকম কিছুর সন্ধান পাওয়া গেলেও যেতে পারে। মাথা নিচু করে ঢালু বাগান দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ভাস্কর যতটা সম্ভব ওই অবস্থায় যাওয়া যায়। হঠাৎ মাটির দিকে চোখ পড়তে ও কোনওক্রমে গতি সামলাতে গিয়ে বসে পড়ল। তার চোখের সামনে তিনটে নগ্ন তার ছয় ইঞ্চির ফারাকে লাইন করে চলে গেছে বাড়িটাকে পাক খেয়ে। একটু অন্যমনস্ক, একটু বেশি গতি থাকলে ওই তারের সঙ্গে পায়ের সম্পর্ক হতোই। এই তার কীসের? সামান্য ঝুঁকে ভাস্করের সন্দেহ হল খুব, ওই তারের ভেতর দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলছে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট স্ক্রু-ড্রাইভার জাতীয় জিনিস বের করল সে। যার হাতলটা কাঠের কিন্তু ডগাটা লোহার। সাবধানে সেই ডগাটা একটা তারে ছোঁয়ানো মাত্র ভাস্করের ঠোঁটে হাসি ফুটল। বাঃ, চমৎকার। ওই তিনটে তারে পা পড়লে সে হয়তো মারা যেত না কিন্তু অজ্ঞান হয়ে আটতে থাকতে হতো যতক্ষণ না কেউ এসে তাকে উদ্ধার করে। নিজের অনুপস্থিতিতে বাড়িটাকে সুরক্ষিত করার চমৎকার ব্যবস্থা করে গেছেন জুলি শেরিং।

পেছনে সরে এসে ভাস্কর লাফ দিল যতটা উঁচু দিয়ে সম্ভব, যাতে সে তিনটে তারের পরিধি ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে আসতে পারে। এবং তখনই সে একটা চাপা শিস শুনতে পেল। শিস দিতে-দিতে কেউ বাড়িটার ডানদিক দিয়ে উঠে আসছে। চকিতে সে বাড়িটার বাঁ-দিকের একটা আড়ালে চলে এল। তার মনে পড়ল গতকাল যখন সে গেট খুলে এই বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত উঠে এসেছিল আজ কেউ তাকে বাধা দেয়নি এবং কোনও বৈদ্যুতিক তার পায়ের তলায় পড়েনি। সে ব্যাপারটা তো ওই মোটরবাইকওয়ালার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। অর্থাৎ এই সাবধানতা অবলম্বন করা হয় জুলি শেরিং যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তখনই। এবং তখনই ভাস্কর শিস দিতে-দিতে আসা লোকটিকে দেখতে পেল। ছুম্বা জাতীয় পোশাকে দুটো হাত ঢুকিয়ে এক স্বাস্থ্যবান প্রৌঢ় বাড়ির চারপাশে চোখ বোলাল। এবং তারপর বেশ উদাস ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে লাগল এপাশে। ভাস্কর নিশ্চিন্ত হল। লোকটা মোটেই সতর্ক নয়।

মিনিটখানেক বাদে অজ্ঞান মানুষটিকে টেনে নিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে শুইয়ে দিল ভাস্কর। এই বাড়ি খালি ভেবেছিল সে। অথচ একটি লোককে দেখা গেল। একাধিক আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। ভাস্কর সতর্ক পায়ে এগিয়ে এল। এদিকটা বেশ ঢালু। লোকটাকে অজ্ঞান করতে একটু বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়েছে। আচমকা আঘাত করার সময় লোকটার ঘাড়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করা ঠিক হয়নি। অন্তত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চেতনা ফিরবে না এটা সে নিশ্চিত।

বাড়ির পেছনে চলে এল সে। বাংলোটা খুব বড় নয়। বড়জোর গোটাচারেক ঘর এবং একটা হল থাকতে পরে। বাড়ির পেছনে একটুকরো লন পেরিয়ে আউট হাউস গোছের রয়েছে। তার একটা দরজা খোলা। বোঝা যাচ্ছে প্রৌঢ় লোকটি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছিল।

অভ্যস্ত হাতে জানলাটা খুলে ফেলল। এতদিন হয়ে গেল তবু এইরকম সময়ে মনে একটা গ্লানি জন্মায়। সন্তর্পণে সে ভেতরের কার্পেটে পা দিতেই মনে হয় কোথাও মৃদুস্বরে একটা বাজনা বাজছে। তার মানে এই বাংলোয় মানুষ আছে। ভাস্কর সতর্ক চোখে তাকাল। এইটি বোধহয় স্টোর রুম। প্রচুর জিনিসপত্র স্তূপ করা রয়েছে। সে ধীরে-ধীরে দ্বিতীয় ঘরটিতে ঢুকল। এটা শোওয়ার ঘর বোঝা যাচ্ছে। পরিপাটি বিছানা। এটা মেয়েলি গন্ধ ঘর জুড়ে। সে ওয়ার্ড্রোবের দিকে এগিয়ে গেল অগুণতি মেয়েলি পোশাক। এটা নিশ্চয়ই জুলি শেরিংয়ের ঘর। এই টিবেটিয়ান মহিলার যা পোশাক আছে তা কোনও আধুনিক আমেরিকানদের লজ্জিত করবে। ওয়ার্ড্রোবের নিচে দুটো ভারী সুটকেস। ওদুটো খোলার সময় এখন নেই। তিন নম্বর ঘরটাতে ঢুকল সে। এটি কি স্টাডি রুম? প্রচুর বইপত্র সাজানো দেওয়ালে। ভাস্কর একটু অন্যমনস্ক হয়ে বইগুলো দেখছিল। এনসাইক্লোপিডিয়ার সারি। হঠাৎ মাঝখান থেকে একটা বই তুলে নিতেই ওর শরীর শক্ত হল। একটা ছোট্ট নব রয়েছে দেওয়ালে। গোপন কিছু লুকোবার জন্যেই এত বই-এর প্রদর্শনী। নবটা ধীরে-ধীরে ঘোরাতেই পায়ের তলার কাঠের মেঝে নড়তে লাগল। ভাস্কর দেখল কার্পেটের একটা জায়গা যেন সামান্য নিচু হয়ে ঝুলছে। দ্রুত সেখানকার কার্পেট সরিয়ে নিতে সে সুন্দর একটা গর্ত দেখতে পেল। তিন ফুট বাই চার ফুট গর্তের মধ্যে দুটো কাঠের বাক্স। সে ছোট বাক্সটা তুলে চাপ দিতেই ডালাটা খুলে গেল। একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ এবং তার পাশে ছোট শিশিতে সামান্য তরল পদার্থ। ভাস্কর চোখের সামনে বস্তুটাকে ধরল। কাচের আড়ালে সাদা তরল পদার্থটি কী হতে পারে তা সে ঠাওর করতে পারছিল না। এইভাবে গোপনে কেন সিরিঞ্জে এই বস্তুটি লুকিয়ে রাখা হবে? শিশির জিনিসটি যে ওষুধ নয় তা টের পাওয়া যাচ্ছে কারণ শিশির গায়ে কোনও লেবেল নেই। বাক্স সমেত ওদুটোকে সে পকেটে চালান করে দ্বিতীয় বাক্সে হাত দিতে গিয়েই চমকে উঠল। তার শরীর শক্ত হয়ে উঠল। তার অনুভূতির প্রতিটি পর্দায় প্রতিফলিত হচ্ছিল পেছনে কারওর উপস্থিতি। সে ধরা পড়ে গিয়েছে। যে এসেছে যে কোনও কথা বলছে না। ভাস্কর ধীরে-ধীরে হাত সরিয়ে নিল। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে যখন মুখোমুখি হল তখন তার হাতে ০.৩৮ রিভলভার। সে দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে একটি ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির চোখে এতক্ষণ বিস্ময় ছিল, অস্ত্র তাকে ভীত করল। মুখে হাত চাপা দিয়ে সে একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল। ভাস্কর ততক্ষণে ওটা পকেটে চালান করে দিয়েছে। তারপর দ্রুত নব ঘুরিয়ে কার্পেটটাকে সমান করে দিয়ে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল, সরি। আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না।

মেয়েটি তখনও ভীত এবং সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাস্কর কথাগুলো বলেছিল ইংরেজিতে। কিন্তু তার একটি শব্দ মেয়েটি বুঝেছে কি না তাতে তার সন্দেহ হল। সে এবার হিন্দিতে কথাগুলো বলল। মেয়েটির মুখে সামান্য স্বাভাবিকতা ফিরে এল। ভাস্কর দুটো হাত যুক্ত করে হিন্দিতেই বলল, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে চাই না। অবশ্যই এটা চীনা কিংবা তিব্বতের ভাষা। অর্থাৎ মেয়েটি ইংরেজি জানে না এবং হিন্দি সামান্য বুঝলেও বলতে পারে না।

অতএব ভাস্কর পৃথিবীর আদিম ভাষার সাহায্য নিল। দুটো হাতের এবং ঠোঁটের সাহায্যে নির্বাক কথা বলার চেষ্টা করল সে। বোঝাতে চাইল, আর মেয়েটির কোনও ভয় নেই। সে কোনও ক্ষতি করবে না। বিশেষ প্রয়েজেনে তাকে এখানে আসতে হয়েছিল। মেয়েটি ইংরেজি বুঝবে না ভেবে সে পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে মেয়েটির সামনে ধরল। মেয়েটি এতক্ষণ একাগ্র হয়ে ভাস্করের অঙ্গভঙ্গি বুঝবার চেষ্টা করছিল। এবার কার্ডটাকে দেখে হাত বাড়িয়ে সেটাকে নিল। কার্ড খুলতেই ভাস্করের উজ্জ্বল ছবি। ছবির নিচের দিকে অফিসের স্ট্যাম্প রয়েছে। মেয়েটি ছবি এবং মানুষের মধ্যে দু-তিনবার দৃষ্টি বদল করল। তারপর তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটল। তাই দেখে ভাস্কর খুব সরল হাসির চেষ্টা করল। মেয়েরা বলে থাকে যে ভাস্করের হাসিতে একটা মুখোশ আছে। তিনটে খুন করে এসেও ওই হাসি হাসলে মনে হয় সারল্য একেই বলে।

মেয়েটি এবার পেছন ফিরল। তার ঘর থেকে ভেসে আসা বাজনা থেমে গেছে সেটা এতক্ষণে খেয়ালে এল। সে দ্রুত নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল।

ভাস্কর বুঝতে পারছিল না সে কী করবে? এই মুহূর্তে তার এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। মেয়েটি তার ভাষা ইচ্ছে করে না বোঝার ভান করছে কি না তা সে জানে না। তাছাড়া সে যে এসেছে তার একটা সাক্ষি রয়ে গেল। যদি মেয়েটি ইংরেজি পড়তে পারে তাহলে কার্ডে তার নাম জেনে নিয়েছে। সেটা বিরাট ভুল হয়ে গেল। আসলে মেয়েটির চোখ-মুখ এমন নিষ্পাপ সুন্দর যে ওর বিশ্বাস পাওয়ার জন্যেই কার্ডটি বের করে দেখিয়েছিল যে সে সাধারণ চোর-বদমাশ নয়। ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, ভাস্কর যেন নিজের কাছেই স্বীকার করল, এমন সুন্দরী যুবতী মেয়ে সে আর কখনও দ্যাখেনি। কী অদ্ভুত জাদু আছে মেয়েটির নীল চোখ। আপেলের মতো লাল গাল, ঈষৎ চাপা নাক অথচ সেটাই গোলাপি ঠোঁটের ওপর অদ্ভুত মায়াবী হয়ে আকর্ষণ বাড়িয়েছে। নিশ্চয়ই এই মেয়ে এদেশে বেশি দিন আসেনি। জুলি শেরিংয়ের মেয়ের তো তিব্বতে থাকার কথা। আর ক্লেইমে বলা নেই মেয়েটি এই দেশে চলে এসেছে কি না। কিন্তু আসতে ভিসা-পাশপোর্টের প্রয়োজন। এদেশে চিরকাল থেকে যেতে চাইলে নাগরিকত্ব দরকার। ভাস্করের সন্দেহ হল মেয়েটি কোনও বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই এই দেশে এসেছে। এবং সেই কারণেই জুলি শেরিং ওকে প্রকাশ্যে বের করেননি। এই জন্যেই মেয়েটি তার নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে কিংবা বুঝতে পারে না! কিন্তু জুলি শেরিংয়ের মেয়ের বয়স তো কুড়ি, অথচ একে দেখে ষোলো-সতেরোর বেশি কিছুতেই মনে হয় না। ভাস্কর মাথা নাড়ল, মেয়েদের বয়স বুঝতে চাওয়া তাদের মনের চেয়েও কষ্টকর।

চলে যাওয়া উচিত অথচ মেয়েটি তাকে টানছে। এবং সেই মুহূর্তে পাশের ঘরে বাজনা বেজে উঠল। ভাস্কর কয়েক পা এগিয়ে মেয়েটির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। রেকর্ড-প্লেয়ারে একটা রেকর্ড চাপিয়ে মেয়েটি ওর দিকে অপাঙ্গে তাকাতেই ভাস্করের বুকের ভেতর পাক দিয়ে উঠল। সে হাসল, মেয়েটিও হাসল। এবার পরিষ্কার ঝকঝকে পাহাড়ি হাসি। সে হাত বাড়াল, অনেকটা করমর্দন করার ভঙ্গিতে। মেয়েটি একটু দ্বিধা করে তার আঙুল স্পর্শ করা মাত্র বাইরে তীব্র সিটি বেজে উঠল। চকিতে চেতনা ফিরে পেল ভাস্কর। সে ইশারায় মেয়েটিকে বোঝাল পরে দেখা হবে, তারপর দ্রুত ঘরগুলো পেরিয়ে জানলাটার কাছে চলে এল। এক লাফে সেটা ডিঙিয়ে বাইরে নামবার আগে সে দেখতে পেল মেয়েটি পেছন-পেছন এসে তাকে পরম বিস্ময়ে চলে যেতে দেখছে।