বিশের কাঁটা – ৭

সাত

বাসু-সাহেব ডিউক হোটেলের রিসেপশানে যখন এসে পৌঁছালেন রাত তখন দশটা দশ। কাউন্টারে প্রশ্ন করে জানলেন 207 ঘরের বোর্ডার উপস্থিত আছেন। এবার কাউন্টারে ছিলেন একটি বাঙালী মহিলা, বললেন, কী নাম বলব, স্যার?

–পি. কে. বাসু।

নামটা অ্যানাউন্স করতে গিয়ে উনি মাঝপথে থেমে গেলেন। টেলিফোনের কথামুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন, এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি কি ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু?

—হ্যাঁ, মা। মনে হচ্ছে ইতিপূর্বে তোমার কন্টকিত হবার দুর্ভাগ্য হয়েছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ তা হয়েছে। আমি এবং আমার মেয়ে। সে তো আপনার দারুণ ফ্যান। আপনি আসবেন জানলে তার অটোগ্রাফ খাতাখানা আজ সকালে অফিসে আসার সময় ব্যাগে ভরে নিয়ে আসতাম।

বাসু হাসতে হাসতে বললেন, সে জন্য দুঃখ করার কিছু নেই, মহাদেব জালান আমার মক্কেল। আমাকে হয়তো আরও দু-একবার এ হোটেলে আসতে হবে—যদ্দিন না ওর কেসটা মেটে। তুমি একবার ফোন করে দেখ দেখি, ও একা আছে কি না। বলেছিল, দশটা নাগাদ ওর এক পার্টি আসবে। সে আছে, না গেছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, না, দশটা নাগাদ ওঁর কোনো গেস্ট তো আসেনি। যাহোক দেখছি। এরপর তিনি ফোন করে জানালেন, আজ্ঞে না, মিস্টার জালান আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। আপনি উপরে যান 207।

বাসু স্বয়ংক্রিয় লিফটের মাধ্যমে তিনতলায় উঠে এলেন। 207 নম্বর ঘরে কল-বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লাটা খুলে গেল। মহাদেব স্নানান্তে ধবধবে শাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘরোয়া হয়েছেন। ‘সীতশ্চ হসিতম্’। অর্থাৎ ভালুকে শাঁকালু খাচ্ছে! বললেন, আইয়ে সাব, তসলিম রাখিয়ে।

বাসু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সেই বিজনেস অ্যাপয়েন্টমেন্টটা…

মহাদেব বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, লোকটাকে বিদায় করেছি।

বাসু এগিয়ে এসে একটি চেয়ারে বসলেন। বেশ বড় সিঙ্গলবেড-ঘর। এয়ারকন্ডিশান করা জালানের হাতে সিগারেট। সেও সামনের একটা চেয়ার দখল করে বসল। বলল, একটা কথা বলি, স্যার? আমার বেশ খিদে পেয়ে গেছে। আপনি যদি বাড়িতে একটা ফোন করে জানিয়ে দেন, তাহলে আমরা দুজনে এখানে ডিনারটা সারতে সারতে কথা বলতে পারি। আপনার পক্ষেও আরও রাত করে ডিনার খাওয়া উচিত হবে না। কী বলেন?

বাসু বললেন, আপত্তি নেই। তবে রাতে আমি অল্পই খাই।

—বেশ তো। অল্প-বেশি যা মন চায় খাবেন। সে তো আপনার অর্ডার-মাফিক। কিন্তু ড্রিঙ্কস কী নেবেন? দাঁড়ান, রুম-বেয়ারাকে ডাকি।

বোতাম টিপে রুম-সার্ভিসকে ডাকলেন। বাসু-সাহেবের দিকে টেলিফোন রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরেন। বাসু ফোন করতে ধরল সুজাতা। বাসু জানতে চান, কৌশিক কি ফিরেছে?

—হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরেছে। আপনার মক্কেলকে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে দিয়ে। বিস্তারিত বলব?

—না। বাড়ি গিয়েই শুনব বরং। আর তোমার মামিমা?

—আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন।

—তাহলে শোন। তোমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও। আমি অ্যারাউন্ড এগারোটা নাগাদ ফিরব; কিন্তু খেয়ে নিয়ে। বিশেও যেন আহারাদি মিটিয়ে নেয়।

—বুঝলাম। তা আপনি নৈশাহার করছেন কোথায়?

—কৈলাসে।

টেলিফোনটা নামিয়ে রাখেন। দেখেন ইতিমধ্যে রুম-সার্ভিস বেয়ারা এসেছে। মহাদেব তাকে ঘরে খাবার নিয়ে আসার অর্ডার দিচ্ছে। নিজে কী পানীয় নেবে এবং খাদ্য, তা বলা হয়েছে। এবার বাসু সাহেবের দিকে ফিরে বলে, অব্ আপ্ ফরমাইয়ে

বাসু রুম-সার্ভিস বেয়ারাকে বললেন, হুইস্কি, সোডা, ফিশ ফিঙ্গার, এক ‘পীস নান আর চিকেন উইথ ক্যাপসিকাম।

—ডেসার্ট স্যার?

—না, আমার চাই না।

—কী হুইস্কি আনব স্যার? ব্ল্যাক-লেবেল?

—কী দরকার? ইন্ডিয়া নাম্বার ওয়ানই নিয়ে এস না।

ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিল মহাদেব। বিলাইতি না পাইয়ে সে ছাড়বেই না। নিজের জন্য সে ইতিপূর্বে ‘রম’ অর্ডার দিয়েছিল। সেটা বাতিল করে একটা পুরো বোতলই আনতে বলল।

ব্লাক-লেবেল।

বাসু বললেন, আমি কিন্তু দু-পেগের বেশি খাব না।

—খাবেন না। বাকি প্রসাদটুকু না হয় আমিই শেষ করব। আজ না হলে কাল।

খাবারের অর্ডার নিয়ে রুম-বেয়ারা চলে যাবার পর মহাদেব দরজায় ছিটকানি দিয়ে ওঁর

মুখোমুখি বসল। বলল, এবার বলুন?

—মাধবীকে আমি খুঁজে বার করেছি। তার সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। ও যে ঘটনার কাছাকাছি সময় ঐ রোহিণী-ভিলায় ছিল এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ব্যাপারটায় সে যে কতটা জড়িয়ে পড়েছে তা এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কলকাতায় এসে মাধবী এক বান্ধবীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সে একাই থাকে। তার বাড়িতে গিয়ে তার সামনেই আমি মাধবীর দেখা পাই। মেয়েটির নাম সুরঙ্গমা পান্ডে। কলকাতার মেয়ে নয়। সেও মাধবীর মতো লোভে পড়ে ফেঁসেছে। একইভাবে সে কলকাতায় এসেছিল টাকাটা উদ্ধার করতে।

—ও কোথাকার মেয়ে?

—টাটানগর।

—তাহলে হয়তো ঐ মেয়েটিই অনীশের বাড়ির বাথরুমে আত্মরক্ষা করছিল। সেও ফিল্ম কন্ট্রাক্টের’ কথা বলে থাকতে পারে—আই মীন প্রতিবেশিনী যা শুনেছেন।

—না। সে সম্ভাবনা নেই। অনীশ খুন হয়েছে অ্যারাউন্ড রাত পৌনে নয়টায়। সুরঙ্গমা সে-সময় আকাদেমি অব ফাইন আর্টস্-এ ওর কাজিনের সঙ্গে থিয়েটার দেখছে। থিয়েটার ভেঙেছে পৌনে নয়টায়। তারপর ওর কাজিন ওকে নিজের গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছে। এটা ওর বজ্রবাঁধুনি অ্যালেবাঈ। আমি ভেরিফাই করে দেখেছি। তবে সুরঙ্গমা মেয়েটি ভাল। সে মাধবীকে সবরকম সাহায্য করতে প্রতিশ্রুত।

—মধুর, আই মীন মাধবীর কোনো বিপদ নেই তো?

—সপ্তকাণ্ড রামায়ণ পাঠ শ্রবণান্তে আপনি যদি প্রশ্ন করেন জানকী কার পূজ্যপাদ পিতৃদেব, তাহলে কী জবাব দেব?

মহাদেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বললে, সরি, স্যার! আপনার প্রশ্নটা আমার মাথার এক বিঘৎ উপর দিয়ে চলে গেল।

বাসুকে ব্যাখ্যা দিতে হলো না। তার আগেই কেউ নক্ করল দরজায়। মহাদেব গিয়ে দরজা খুলে দিল। রুম-অ্যাটেডেন্ট তার সহকারীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। পানীয় আর খাদ্য সাজিয়ে দিল টেবিলে। তাকে বিদায় করে ফিরে এসে মহাদেব অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করল, অনীশের ব্যাপারটা বলুন। কী করে কী হলো। আপনি গিয়ে কী দেখলেন?

—কী করে কী হলো তা আমি জানি না। আমার জানার কথাও নয়। কারণ, আমি ওর ঘরে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই কেউ ওকে খুন করে গেছে। আমি যখন পৌঁছাই ওর সদর দরজা তখন ভিতর থেকে বন্ধ। রাত নটা বাজতে দশ-বারো হবে। আমি তিন-চার বার কল- বেল বাজাই—কোনো সাড়া জাগে না। দরজায় দুম্ দুম্ করে কিল মারি, তাতেও কেউ সাড়া দেয় না। ভিতরটা একেবারে নিস্তব্ধ। অথচ ঘরে আলো জ্বলছে।

মহাদেব ইতিমধ্যে দুটি গ্লাসে পানীয় ঢেলেছে। নিজেরটা তুলে নিয়ে বললে, চিয়ার্স। ভিতরে আলো জ্বলছে কী করে বুঝলেন? সদর দরজায় কি ফ্রস্টেড-গ্লাসের প্যানেল?

বাসুও তাঁর পানীয়টা তুলে নিয়ে বললেন, চিয়ার্স! না, দরজা মজবুত সেগুন কাঠের। কিন্তু উপরে গ্রিল্ড ট্রান্‌সম্ ছিল। তা দিয়েই বোঝা যাচ্ছিল ঘরে আলো জ্বলছে। তাছাড়া আমি ‘কী-হোল’ দিয়ে দেখে নিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পেয়ে আমি যখন ফিরে আসছি তখন নজর হলো ঐ প্রতিবেশিনী মহিলা এক পুলিশ-সার্জেন্টকে নিয়ে আসছেন। আমি তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে আবার কল-বেল বাজাতে শুরু করলাম।

–কেন?

—আমার আশঙ্কা হয়েছিল, রুদ্ধদ্বার কক্ষের ভিতর কিছু একটা রহস্য আছে। কে জানে―হয়তো অনীশ খুন হয়ে পড়ে আছে—তাই আমি চাইনি যে, সার্জেন্টটা আমাকে চিনে রাখুক—ঐ মৃত্যুশীতল কক্ষ থেকে নির্গত শেষ ব্যক্তি হিসাবে।

—আই সী! তারপর?

—সার্জেন্ট আমাকে জিজ্ঞেস করল, ঐ অ্যাপার্টমেন্টে কে থাকে? আমি বললাম, আমি যদ্দূর জানি, অনীশ আগরওয়াল নামের একজন বোম্বাইয়ের ফিল্মওয়ালা। বললাম, তাকে আমি চিনি না, নাম-ঠিকানা জেনে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু যে কারণেই হোক ও দরজা খুলছে না। তাই ফিরে যাচ্ছি। সার্জেন্ট আমাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে—অনীশকে আমি কতদিন ধরে চিনি, কী কারণে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম ইত্যাদি। আমি মূল কথাটা এড়িয়ে সত্য জবাব দিই। নিজের কার্ডটা সার্জেন্টকে দিয়ে বলি প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করতে।…তা কার্ড দেখে সার্জেন্ট আমাকে চিনতে পারল। ও তখন দারোয়ানকে ডেকে কেয়ারটেকারকে খবর দিতে হুকুম করল। বলল, ঐ অ্যাপার্টমেন্টের ডুপ্লিকেটচাবি নিয়ে কেয়ার-টেকার যেন ইমিডিয়েটলি চলে আসে।

একটা ফিস ফিঙ্গার চিবাতে চিবাতে মহাদেব বলে, আর আপনি?

—আমি তৎক্ষণাৎ সুযোগ বুঝে কেটে পড়লাম। নিচে কৌশিক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার গাড়িতেই।

—আই সী। তাহলে মাধুকে কোথায় দেখলেন?

—সে তো যখন আমি রোহিণী-ভিলার দিকে যাচ্ছি, তখন। মাধবী তখন রোহিণী-ভিলা থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছিল।

আর এক সিপ্ কণ্ঠনালীতে ঢেলে দিয়ে মহাদেব বলল, আই সী। তার মানে, আপনি যখন চলে আসেন তখনো সার্জেন্ট ডুপ্লিকেট ‘কী’ দিয়ে দরজাটা খোলেনি?

বাসু-সাহেব তাঁর গ্লাসটা তুলছিলেন ঠোটে। মাঝপথে থেমে গিয়ে বলেন, হোয়াই ডু য়্যু আস্ক দ্য কোশ্চেন?

মহাদেব বললে, আগে ভোজনপর্বটা সমাধা করা যাক, স্যার। আপনি কি কিছু ডেসার্ট ডিশ নেবেন?

—নো থ্যাঙ্কস। কিন্তু হঠাৎ ও-প্রশ্নটা কেন জানতে চাইলেন, বলুন তো?

মহাদেব নিঃশব্দে আহার-কার্য সমাধা করতে থাকে। বাসু তাগাদা দেন; কী হলো? কিছু বলছেন না যে?

—বলছি। ভোজনটা শেষ হোক।

বাসু তাঁর গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন। নান-রুটি দিয়ে আর একটু মাংস মুখে তুললেন। তারপর ন্যাপকিনে হাত মুছে নিয়ে গ্লাসের তলানিটুকু কণ্ঠনালীতে ঢেলে দিলেন।

মহাদেব বললেন, প্লীজ হ্যাভ অ্যনাাদার পেগ ফর দ্য রোড, স্যার।

—নো, থ্যাঙ্কস! আমার পরিমিত ডোজ পান করেছি। এবার আমার প্রশ্নটার জবাব দিন।

মহাদেবও ন্যাপকিনে মুখটা মুছে নিয়ে বললে, মিস্টার বাসু। এ বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। প্লীজ লি কেয়ারফুলি। ইটস্ ইম্পর্ট্যান্ট, ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট! জীবন-মরণের প্রশ্ন!

বাসু ওর বক্তব্যটা আন্দাজ করেছেন। সে কী বলতে চায়, কেন বলতে চায়, আর কোথায় সে বাসু-সাহেবের স্টেটমেন্টে একটা বিরাট অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছে। ভুলটা ওঁরই। এ বিষয়ে ওঁর সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। অভিজ্ঞ ব্যারিস্টারের এতবড় ভ্রান্তি নিতান্ত ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু ভুলটা হবার একটা বিশেষ হেতুও আছে। এই মুহূর্তটার আগে মহাদেবকে উনি প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখেননি। সে তো ক্লায়েন্টের তরফের লোক। সেই তো মাধবীর তরফে রিটেইনার দিয়ে গিয়েছিল।

বাসু গম্ভীর হয়ে বললেন, বলুন, মিস্টার জালান। আপনার যদি কোনো বক্তব্য থাকে তা বলুন। আমি শুনে রাখি।

—ইয়েস, শুনে রাখুন। তিন পেগ হুইস্কিতে আপনিও মাতাল হননি, আম্মো হইনি। প্রথম কথা, আপনি পরিষ্কারভাবে এটা বুঝে নিন যে, এ কেস-এর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মাধবী মঞ্জরী বড়ুয়া, অ্যান্ড নান্ এস্‌। তাকে আমি ভালোবাসি, নিজের জানের চেয়েও বেশি। সুতরাং তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হোক এটা আমি কোনোমতেই—আই রীপিট – ‘কোনক্রমেই’ বরদাস্ত করব না।

বাসু এখনো গম্ভীর। বলেন, একথা আপনি প্রথম দিনেই বলেছেন। এই শর্তেই আমি আপনার রিটেইনার গ্রহণ করেছি।

—অল রাইট। দ্বিতীয় কথা, আয়াম এ ফাইটার। আমি জানকবুল লড়ে যাব। মাধবীকে রক্ষা করার প্রয়োজনে আমি সবকিছু স্যাক্রিফাইস করতে প্রস্তুত। সে জন্য যদি অন্য কেউ এ ‘কেস’-এ বেকাদয়াদ পড়ে যায়, তাতে আমি ভ্রূক্ষেপ করব না।

বাসুর ভ্রূকুঞ্চন হয়। কিন্তু কণ্ঠস্বরে কোনো পরিবর্তন হয় না। বলেন, আপনি এখনো কোনো নতুন কথা বলেননি, মিস্টার জালান।

মাথা ঝাঁকিয়ে মহাদেব বলেন, নো স্যার! বলেছি! য়ু আর ইন্টেলিজেন্ট এনাফ্ টু আন্ডারস্ট্যান্ড আমি কী নতুন কথা বলেছি। বেশ, না হয় আরও স্পষ্ট ভাষায় বলি! মাধবীকে বাঁচাতে গিয়ে আমি যদি দেখি অন্য কেউ মার্ডার-চার্জে ফেঁসে যাচ্ছে তাহলে আমি বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ ক্রূরব না। আই কেয়ার টু ফিস্‌ হু দ্য ডেভিল গেটস্ দ্য পাঞ্চ!

বাসু আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাভ য়ু ফিনিশড, মিস্টার হোস্ট? আপনার আর কিছু বলার আছে?

—আছে! বসুন। আমার বক্তব্যটা শেষ হয়নি। আপনি অকুস্থলে পৌঁছানোর কতক্ষণ আগে খুনটা হয়েছে আন্দাজ করতে পারেন?

—তা আমি কেমন করে জানব? দু-মিনিট হতে পারে, দশ মিনিট হতে পারে। —রীগর মর্টিস তখনো শুরু হয়নি?

—আপনি ‘রীগর মর্টিস্’ বোঝেন? না শুরু হয়নি।

মহাদেব ইতিমধ্যে সিগ্রেট ধরিয়েছে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, কিছু মনে করবেন না ব্যারিস্টার সাহেব, গাঁ থেকে এসেছি বলে আমি আইনের বিষয়ে একেবারে গেঁয়ো নই।

বাসু বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মিস্টার জালান। আমরা পরস্পরকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। এরপর থেকে কেউ আর কাউকে আন্ডারএস্টিমেট করব না।

—তাহলে আমায় যুক্তি-নির্ভর ঘটনা-পরম্পরার একটা ব্যাখ্যা দিন। অ্যাজুমিং মাধু খুনটা করেছে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, সে একটা রিভলভার হাতে নিয়ে দেখা করতে যায়। দ্যাটস অ্যাবসার্ড। তাকে আমি ফ্রক-পরা অবস্থা থেকে চিনি। সে কোনোদিন কোনো রিভলভার হাতে করেনি। ওদের বাড়িতে রিভলভার নেই। ওর বাবার একটা দোনলা বন্দুক অবশ্য আছে। ফলে সে কোথায় পাবে অমন একটা রিভলভার?…অল রাইট, যুক্তির খাতিরে ধরে নেওয়া গেল যে, কোনো-না-কোনো সূত্র থেকে সে একটা রিভলভার যোগাড় করে ছিল….

ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বাসু বলেন, একটা কথা। আপনি গুয়াহাটির লোক। অনেক খবর রাখেন। আপনি জানেন, মাধবীদের বাড়িতে কোনো রিভলভার নেই। আপনার নিজের কি আছে?

জালান বিচিত্র হাসল। উঠে গিয়ে অ্যাটাচিটা তুলে নিয়ে সামনে রাখল। স্প্রিং-লক খুলে দেখালো—উপরেই তোয়ালের উপর রাখা একটি পয়েন্ট টু টু মার্কিন রিভলভার। বলল, এক নম্বর কথা, মাধু কলকাতা আসার পর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। সে কোথায় উঠেছে আমি এখনো জানি না। দু-নম্বর কথা, পোস্ট-মর্টামে অনীশের দেহে বুলেটটা খুব সম্ভরত পাওয়া যাবে, আপনার কোনোরকম সন্দেহ থাকলে একটা কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপ স্টাডি করারেন।

বাসু বললেন, অল রাইট। এবার বলুন, ডক্টর বড়গোঁহাই-এর কি কোনো রিভলভার লাইসেন্স আছে?

—সরি। আমি জানি না। ধরা যাক, আছে। মাধু সেটা হাত করেছে। ধরা যাক, সেটা সে গুয়াহাটি থেকে দমদমে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ধরা যাক, সেটা হাতব্যাগে নিয়েই সে অনীশের ঘরে ঢোকে। ও. কে.? এবার আপনি প্রশ্নটা অন্য দিক থেকে দেখুন। অনীশের .ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু ছিল না। জানুয়ারি মাসের সন্ধ্যারাত্রের শীতে নিম্নাঙ্গে ছিল শুধুমাত্র ড্রয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, লোকটা ‘রেপ’ করতে যাচ্ছিল ঐ মেয়েটিকে—যে ওর বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষা করেছে। কেমন তো? সেক্ষেত্রে কি মেয়েটি মাধবী বড়ুয়া হতে পারে? যে মাধবীর হাতে ডক্টর বড়গোঁহাইয়ের লোডেড রিভলভার? ওর হাতে উদ্যত রিভলভার দেখলে অনীশ কি জামাকাপড় আদৌ খুলত? কুকুরের মতো কেঁউ কেঁউ করত না? দেয়ারফোর : অনীশের বাথরুমে যদি কোনো মেয়ে ব্যারিকেড রচনা করে থাকে তবে সে রিভলবারধারিণী মাধবী বড়ুয়া নয়।

বাসু বললেন, অনীশের গায়ে যে কোনো জামা ছিল না, অথবা নিম্নাঙ্গে শুধু আন্ডারওয়ার – ছিল, এটা কেমন করে জানলেন?

জালান তার নিঃশোষিত সিগ্রেটের স্টাম্প থেকে একটি নতুন সিগ্রেট ধরাতে ব্যস্ত ছিল। বিচিত্র হেসে বললে, ও-প্রসঙ্গ থাক।

—থাকবে কেন?

—ওটা আমার রঙের টেক্কা, বাসু-সাহেব! আপাতত সেটা মুলতুবি থাক। কোনো একটি বিশেষ সূত্র থেকে ঐ অভ্রান্ত তথ্যটা জেনেছি। যে কথা বলছিলাম, আমি প্রমাণ করেছি যে, বাথরুমে আটক-পড়া মেয়েটি মাধবী বড়ুয়া হলে তার এক্তিয়ারে কোনো রিভলভার ছিল না। মেয়েটি যেই হোক— প্রথম কথা, তার এক্তিয়ারে কোনো রিভলভার থাকতে পারে না, কারণ তা থাকলে সে অফেন্স নিত, অনীশ খেলত ডিফেন্সে! এবার ধরা যাক, মেয়েটি যখন বাথরুমে তখন খোলা দরজা দিয়ে একজন কেউ ঢুকে অনীশকে গুলি করে। সে-ক্ষেত্রে কী হবে? মেয়েটি বাথরুম থেকে ফায়ারিঙের একটা শব্দ শুনবে, একটা দেহপতনের শব্দ। আততায়ীর পলায়নের শব্দ। তারপর সব শুনশান। স্বতই মেয়েটি দরজা একটু ফাঁক করে দেখবে। মৃতদেহটা দেখতে পাবে নিশ্চিত। আততায়ীকে দেখতেও পারে, নাও পারে। সে-ক্ষেত্রে সেই মেয়েটি নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাবে, জমাট রক্তের এলাকাটা এড়িয়ে। সে যদি ‘রোহিণী- ভিলা’ থেকে বেরিয়েই কারও মুখোমুখি পড়ে যায়, তবে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ে সিঁটিয়ে যাবে।

বাসু বলেন, তার মানে আপনি বলতে চান যে, মাধবীই আটক ছিল বাথরুমে। সে মৃতদেহটা দেখেছে বলেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্নটা এই : দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ হলো কী করে? মাধবী বা অন্য মেয়েটি যখন ছুটে বেরিয়ে যায়, তখন তো মৃত অনীশ আগরওয়াল ছাড়া ঘরে কেউ ছিল না?

মহাদেব নিঃশব্দে বার-কতক সিগ্রেটে টান দিয়ে বললে, সমস্যাটা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবেছি মিস্টার বাসু। এটার পাঁচরকম বিকল্প সমাধান হতে পারে :

এক : অনীশ যখন প্রথম ঘরে ঢোকে তখন দরজাটা খোলা রাখে। কারণ তার সঙ্গে সুরঙ্গমা অথবা মাধবী কিংবা অন্য কোনো মেয়ের হয়তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। যাতে সে পাড়া না জাগিয়ে আসতে পারে তাই। কিন্তু সে ইয়েল-লকের ডোর-নবটা মেঝের সঙ্গে আলম্ব করে রেখেছিল। যাতে দরজাটা টেনে দিয়ে কেউ বেরিয়ে গেলেই তা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে।

দুই : অনীশ দরজাটা খোলাই রেখেছিল; কিন্তু লক-নবটা জমির সমান্তরালে ছিল। মেয়েটি, যদি মাধবীই হয়, লক-নবটা ভার্টিকাল করে দিয়ে দরজাটা টেনে দেয়। এ সম্ভাবনা খুবই কম—কারণ পলাতকার এসব দিকে খেয়াল না থাকারই কথা। সে তখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে।

তিন : মেয়েটি আততায়ীর নিষ্ক্রমণের পরে অ্যাপার্টমেন্ট ত্যাগ করে। সে আততায়ীকে লক- নবটা ভার্টিকাল করতে দেখেছিল বাথরুম থেকে। তাই কায়দাটা জানে। সে নবটা প্রথমে হরিজন্টাল করে দোর খোলে, তারপর ভার্টিকাল করে দরজাটা টেনে বেরিয়ে যায়।

চার : আততায়ী মেয়েটির পরিচিত। মেয়েটি তাকে বাঁচাতে চাইছে। দুজনে যুক্তি করে দরজাটা ভিতর থেকে লক করার ব্যবস্থা করে পালায়। যাতে মৃতদেহ আবিষ্কারে দেরি হয়।

পাঁচ : আপনি যখন ওখানে পৌঁছান তখন দরজাটা আদৌ বন্ধ ছিল না। আপনি ঘরের ভিতর গিয়েছিলেন। মৃতদেহকে দেখেছেন। লক্ষ্য করেছেন, বুলেটটা বুকের বাঁ-দিকে লেগেছে। লক্ষ্য করেছেন, অনীশের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ এবং নিম্নাঙ্গে আন্ডারওয়্যার। আপনি নিজেই দরজাটা টেনে বন্ধ করে দেন। লক করেন।

মহাদেব থামল। সিগ্রেটের ছাইটা ঝেড়ে হাসিহাসি মুখে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে, দ্যাটস্ অল্, মি লর্ড!

বাসু বললেন, এই পাঁচটি বিকল্প সম্ভাবনার মধ্যে আপনার কোনটিকে সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে হয়?

—চতুর্থটি এবং পার্টলি পঞ্চমটি!

—অর্থাৎ?

—বাথরুমে মাধবীই ছিল। নিরস্ত্র। আত্মসম্মান রক্ষা করতে ছিটকিনি বন্ধ করে দুর্গ রচনা করেছিল। সে-সময় সদর দরজাটা খোলাই ছিল। আততায়ী ঘরে ঢোকে। অর্ধ-উলঙ্গ অনীশকে গুলি করে। মাধবী তা দরজা ফাঁক করে দেখে। আততায়ীকে চিনতে পারে। নাম ধরে ডাকে। আততায়ী থমকে দাঁড়ায়! তারপর দুজনে দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। লক-নব তখন জমির সমান্তরাল। অর্থাৎ দরজাটা তালাবন্ধ হয় না। ওরা একসঙ্গে যায় না। মাধবী লিফটে করে নামে। আগে পোর্টিকোতে পৌঁছায়। আপনাকে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। আপনি যখন লিফটে করে উঠছেন তখন আততায়ী দেওয়াল সেঁটে লুকিয়ে পড়ে। লিফ্‌ট ওকে ক্রশ করে উপরে উঠতেই সে বাকি সিঁড়ির ধাপকটা পার হয়ে নেমে যায়। আপনি এসে দরজাটা বন্ধ দেখেন, কিন্তু লক্-করা নয়। হয়তো বার-কতক বেল বাজান। সাড়া না পেয়ে দরজাটার ডোর-নব ঘুরিয়ে দেখেন। দরজা খুলে যায়। আপনি ভিতরে যান। তাই আমাকে তখন টেলিফোনে বলতে পেরেছিলেন, গুলিটা বুকের বাঁ-দিকে বিদ্ধ হয়েছে। বলতে পেরেছিলেন, অনীশের ঊর্ধ্বাঙ্গ ছিল নিরাবরণ, নিম্নাঙ্গে আন্ডারওয়ার। আপনিই লক্-নবটা ভার্টিকাল করে টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। সার্জেন্টের মুখোমুখি হন।…মিস্টার বাসু, ধীরস্থিরভাবে ভেবে দেখুন—এছাড়া বিকল্প কোনো সমাধান হতে পারে না, পারে না!

বাসু বললেন, আপনার ডিটেকটিভ হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু এত কথাই যখন বললেন তখন আততায়ীর নামটা ঊহ্য রাখলেন কেন?

—বাঃ! আমি কেমন করে জানব, খুনটা কে করেছে?

—জানবার কথা হচ্ছে না। সবটাই তো অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান। প্রব্যাবিলিটি। যুক্তি- নির্ভর বিশ্লেষণ। সে-ক্ষেত্রে আততায়ীর নামটাও কি অনুমান করতে পারেন না?

সোজা হয়ে উঠে বসল মহাদেব। হঠাৎ বোতলের ছিপিটা খুলে আবার কিছুটা হুইস্কি ঢালল পাত্রে। সোডা নিল না। কয়েক টুকরো বরফ ফেলে দিল শুধু। একচুমুক ব্ল্যাক-লেবেল-অন্- র পান করে বলল—বুল্স্ আই হিট করেছেন আপনি! আততায়ী আর কেউ হলে মাধবী তার নামটা বলে দিত। জ্ঞাতসারে আততায়ীকে রক্ষা করত না। ‘নাউ শী ইজ অ্যান অ্যাসেসারি আফটার দ্য ফ্যাক্ট’! তাকে বাঁচাতেই হবে। একটিমাত্র পথ। আততায়ীকে পুলিশ ধরতে না পারলেও আপনি তাকে চিহ্নিত করুন! ধরিয়ে দিন!

বাসু বললেন, লোকটা প্রেমের বাজারে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কোনো পক্ষপাতিত্ব করছেন না তো?

মহাদেব শ্রাগ করল। আর এক সিপ্ পান করল। তারপর বলল, য়ু মে সার্চ মি! আপনি একটিমাত্র যুক্তি দেখানঃ কেন মাধু লোকটাকে আড়াল করতে চাইছে, যদি না সেই স্কাউড্রেলটা হয়? আপনি একটিমাত্র যুক্তি দেখান—আমার থিয়োরিকে অপ্রমাণ করে—যাতে জ্ঞাত তথ্যগুলো জিগ্‌স্‌-ধাঁধার মতো খাঁজে খাঁজে মিলে যাবে।

বাসু ঘড়ি দেখে বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে। এরপর ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল হবে। মহাদেব বললে, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না, স্যার। হোটেলের গাড়ি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে। আমি বলে দিচ্ছি।

টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সেই মতো নির্দেশ দিল। তারপর রিসিভারটা স্বস্থানে নামিয়ে রেখে বললে, হোটেলের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। W.B.F 9678। আপনি নিজের নামটা বললেই আপনাকে নিউ আলিপুরে পৌঁছে দেবে। গুড-নাইট, স্যার।

বাসু উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, গুড-নাইট!

মহাদেব বললে, আপনাকে নিচে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলাম না বলে মার্জনা চাইছি। আয়াম সরি…রিয়ালি সরি! একটু বেশি পান করা হয়ে গেছে।

বাসু বললেন, দ্যাটস্ অলরাইট। হ্যাভ সুইট ড্রীমস্!

দরজা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ কী ভেবে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, বাই দ্য ওয়ে মিস্টার জালান, মাধবীর ঠিকানাটা কি আপনি এখনো জানেন না?

—না। আপনি তো জানালেন না!

—বললাম না এজন্য যে, সে এখন ওখানে নেই। কোন হোটেলে কী নামে উঠেছে তা আমিও জানি না।

মহাদেব জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, হাউ স্যাড! দ্য লেডি ইন ডিস্ট্রেস্-এর পাত্তা না জানে তার প্রিন্স চার্মিং, না তার লীগ্যাল অ্যাডভাইসার!