বিশের কাঁটা – ৬

ছয়

সুরঙ্গমার বাড়ি থেকে বড় রাস্তায় নেমে বাসু-সাহেব এগিয়ে এলেন তাঁর পার্ক করা গাড়িটার কাছে। ড্রাইভারের সীটে অন্ধকারে বসে ছিল কৌশিক। লক্ষ্য হলো, ড্রাইভারের সীটের পাশের কাচটা একটু নেমে গেল, আর একটি জ্বলন্ত সিগ্রেটের স্টাম্প উড়ে গিয়ে পড়ল কার্বের কাছে। পরমুহূর্তেই পিছনদিকের ফুটপাতের দিকে দরজাটা খুলে গেল। জ্বলে উঠল পিছনের আলো। বাসু-সাহেবের পিছন-পিছন স্যুটকেস-হাতে এগিয়ে আসছিল মাধবী। বাসু খোলা দরজার হাতলটা ধরে তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার ভাল নাম তো মাধবী, আর কোনো নামটাম আছে? ডাকনাম জাতীয়?

মাঝরাস্তায় হঠাৎ এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটা বোধকরি মেয়েটি আশঙ্কা করেনি। বলে, ডাকনাম ‘মাধু’, পুরো নাম মাধবীমঞ্জরি বড়ুয়া।

—দ্যাটস্ ফাইন। শোন মাধু। আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি না। কৌশিক তোমাকে একটা হোটেলে পৌঁছে দেবে…

মাধবী বাধা দিয়ে বলে, কৌশিক কে?

ড্রাইভারের সীটে বসা লোকটা মুখ না ঘুরিয়ে উইন্ডস্ক্রীনকে সম্বোধন করে এই সময় বলে ওঠে, পি. কে. রাসু, বার-অ্যাট-ল’র ড্রাইভার।

বাসু শ্রাগ করে বলেন, সরি! তোমাদের ইন্ট্রোডিউস্ করে দেওয়া হয়নি। শোন মাধবী, ঐ যে আমার গাড়ির ড্রাইভারের সীটে বসে আছেন, উনি হচ্ছেন শ্রীমান কৌশিক মিত্ৰ বি. ই.— ‘সুকৌশলী গোয়েন্দা সংস্থা’র সিনিয়ার পার্টনার। এঁর স্ত্রীর নামই সুজাতা—যে সুরঙ্গমার কাছ থেকে অনীশ আগরওয়ালের পাত্তা জেনে নেয়। আর এ হচ্ছে মাধবী বড়ুয়া অব গুয়াহাটি, হু হ্যাজ…

দৃষ্টি না ঘুরিয়েই কৌশিক বলে ওঠে, আই নো! উঠে আসুন।

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, না। আমার বাকি বক্তব্যটা আগে শেষ করি, যেহেতু আমি গাড়িতে উঠছি না।

এতক্ষণে কৌশিক এদিকে ফেরে। বলে, অ্যাত রাত্রে ইন্টালি বাজারে আপনি কী করবেন? ফিরবেন কী করে?

–সে আপনাকে ভাবতে হবে না, মিস্টার মিত্র। আমি কাজ সেরে ট্যাক্সি করে ফিরে যাব। আপনি কাইন্ডলি আমার এই ক্লায়েন্টটিকে কোনো হোটেলে পৌঁছে দিন। হোটেলের ভিতরে গিয়ে আপনার খানদানী বদনখানি রিসেপশানিস্টকে দেখাবেন না। চেক-ইন হয়ে গেলে মাধুই বেরিয়ে এসে আপনাকে জানিয়ে যাবে যে, সে একটা পছন্দমতো সিঙ্গলসীটেড রুম পেয়েছে। রুম নম্বরটা আপনাকে বলে যাবে। আর হোটেলের টেলিফোন নম্বরটা!

কৌশিকের বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাসু-সাহেব মর্মান্তিক চটেছেন। তিনি যে ওদের দুজনের ‘ফর্মাল-ইন্ট্রোডাকশান’ না করিয়েই ফর্মান জারি করেছেন এবং সেটা যে এটিকেট- বিরুদ্ধ কাজ—এটা কৌশিক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়াতেই এই অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। এবার মাধবীর দিকে ফিরে বললেন, যে-কথা বলছিলাম মাধু। তুমি এই কার্ডখানা রাখ। এতে আমার টেলিফোন নম্বর আছে। তোমাকে কৌশিক একটা মডারেট হোটেলে পৌঁছে দেবে—ফর এক্জাম্পল্ হাজরা-ল্যান্সডাউনের মোড়ে ‘ত্রিস্তার’ হোটেল। ওখানে যদি সিঙ্গেল-সীটেড রুম পেয়ে যাও নিয়ে নেবে। না পেলে অন্য কোনো হোটেলে। তোমার নাম লেখাবে ‘মঞ্জরী এম. বড়ুয়া’—অর্থাৎ মিড্‌ল-নেমটা এগিয়ে দিয়ে….

মাধবী মাঝপথেই বাধা দিয়ে বলে, কেন স্যার?

–কেন? ‘য়ু আর নট টু রিজন হোয়াই।’ কিন্তু মুখ-ফসকে যখন জানতে চেয়েছ, তখন বলি—পুলিশে হয়তো তোমাকে খুঁজবে। হয়তো সুরঙ্গমার মাধ্যমে নামটাও জানবে—’মাধবী বড়ুয়া’। ফলে হয়তো ‘মঞ্জরী বড়ুয়া’ নামটা ওদের নজরে পড়বে না—যদি বিভিন্ন হোটেলে আজকের রাত্রের ‘এন্ট্রি’ চেক্ করতে বসে। আবার নামটা একেবারে অন্য জাতির হলে—’বেলা দত্তগুপ্তা’ বা ‘নির্মলা গুহঠাকুরতা’ হলে, যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে, তুমি পলাতকা—’ফিউজিটিভ্। যেটা আইনের চোখে স্বতই সন্দেহভাজক। এক্ষেত্রে এক ঢিলে দুটো পাখি মরল—তোমাকে নাম-ভাঁড়ানোর চার্জেও ফেলা যাবে না। আবার আত্মগোপনও করা গেল। সেকেন্ডলি, সাকিন, মানে ঠিকানা হিসাবে ‘গুয়াহাটি’ লিখ না। তোমার কলকাতাবাসী কোনো মামা-কাকা-মেশো-বন্ধুর ঠিকানা লিখে দেবে, বুঝলে?

মাধবী ঘাড় নেড়ে জানাল যে, সে বুঝেছে

—আর একটা নির্দেশ, কোনো প্রয়োজনেই হোটেল ছেড়ে রাস্তায় নামবে না, আমাকে ছাড়া আর কোথাও কোনো ফোন করবে না। একটা পুরো দিন হোটেলে বসে গল্পের বই পড়বে অথবা টি. ভি. দেখবে। টি. ভি. -ওয়ালা ঘর বুক কর। আমি কাল বিকালে তোমার হোটেলে আসব। অ্যান্ড দিস্ ইজ মাই লাস্ট ইন্সট্রাকসন্স : কোনোক্রমে যদি পুলিশ তোমার সন্ধান পায়, তাহলে তাদের প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না। তোমার কী নাম, কোথা থেকে এসেছ, মায় তোমার ঘড়িতে কটা বাজে—নাথিং। সব প্রশ্নের একটাই জবাব, আমার সলিসিটারের নাম মিস্টার পি. কে. বাসু—এই তাঁর কার্ড। তাঁকে ফোন করুন। তাঁর অসাক্ষাতে আমি আপনাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না। আন্ডারস্ট্যান্ড?

ঘাড় নেড়ে মাধবী জানায় সে বুঝেছে।

—এবার তাহলে গাড়িতে ওঠ।

মাধবী বুঝতে পারে না এক্ষেত্রে তার পিছনের সীটে উঠে বসা অভদ্রতা হবে কি না। কিংবা অপরিচিত পুরুষের পাশে এত রাত্রে সামনের সীটে উঠে বসা দুঃসাহসিকতা হবে কি না। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল কৌশিকের কণ্ঠস্বরে। সে উইন্ডস্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই স্বগতোক্তি করে : হে মাধবীদেবী! দ্বিধা কেন?

‘মিস্-কোট টা শ্রবণমাত্র মনস্থির করে মিস্ বড়ুয়া। উঠে বসে পিছনের সীটে।

কৌশিক হাত বাড়িয়ে বলে, গুড-নাইট, মামু!

বাসু প্রতিবাদ করেন, নাইট ইজ ইয়েট ইয়াং, ইয়াং ম্যান! গুড নাইট সম্বোধনটা ডাইনিং- টেবিলের জন্য মুলতুবি থাক!

গাড়িটা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করামাত্র বাসু ঘড়ি দেখলেন। রাত নটা চৌত্রিশ। এগিয়ে গেলেন একটি পাবলিক টেলিফোন বুথ-এর দিকে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। সাতটা নম্বর ডায়াল করা মাত্র ও-প্রান্তে সাড়া জাগল : গুড ঈভনিং, দিস্ ইজ ডিউক হোটেল—রিসেপশান। হোয়াট ক্যানাই…

বাসু ইংরেজিতে বললেন, অনুগ্রহ করে আমাকে 207 নম্বর ঘরে কানেকশানটা দেবেন?

ও-প্রান্তের মহিলা বললেন, সরি, স্যার! 207 নম্বরের চাবি কী-বোর্ডে ঝুলছে। ঘরে কেউ নেই।

—ঘরটা কি মিস্টার মহাদেব জালানের নামে বুক করা?

—জাস্ট এ মোমেন্ট। লাইনটা ধরুন। রেজিস্টার দেখে বলছি।

রেজিস্টার দেখে মহিলা জানালেন যে, ঐ ঘর মিস্টার জালানের নামেই বুক করা। এবং তিনি এ মুহূর্তে ঘরে নেই।

ধন্যবাদ জানিয়ে লাইনটা কেটে দিয়ে এবার ফোন করলেন বাড়িতে। একবার রিঙিং টোন হতেই ধরল সুজাতা। বাসু বললেন, তুমি কতক্ষণ এসেছ?

—অনেকক্ষণ। আপনি বেরিয়ে যাবার ঠিক পরেই। বিশে বলল, সাহেব এক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন।

এর মধ্যে আমার কোনো ফোন এসেছিল?

—হ্যাঁ, ডিউক হোটেল থেকে মিস্টার মহাদেব জালান ফোন করে জানতে চান আপনি ফিরেছেন কি না। আমি বললাম, না ফেরেননি।

—আর কোন ফোন?

—না।

—তোমার মামিমা কেমন আছেন?

—ভাল। জ্বর নেই। ঘুমটা হওয়ায় শরীর অনেক ঝরঝরে। রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছেন।

—তুমি কোথা থেকে কথা বলছ? আমার চেম্বার, না রিসেপশান?

—না, চেম্বার। রিসেপশানে বসে আছেন সেই মহাদেব ‘জ্বালান’।

—ও কতক্ষণ জ্বালাচ্ছে?

—মিনিট পাঁচেক হলো।

—লাইনটা ওকে দাও তো?

একটু পরেই মহাদেবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বলুন স্যার? কোথা থেকে বলছেন?

বাসু ভৌগোলিক অবস্থানের প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললেন, একটা টেলিফোন বুথ থেকে আপনি কতক্ষণ এসেছেন?

—ঘড়ি দেখিনি। মিনিট দশ-পনের হবে। আমি সেই কাগজপত্রগুলো, ফটো, পেপার- কার্টিং সব হোটেল থেকে নিয়ে এসেছি। আপনি বাড়ি ফিরে না এসে বাইরে থেকে ফোন করছেন কেন স্যার?

বাসু গম্ভীরভাবে বললেন, যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। সুজাতা কি ঐ ঘরে আছে, না চলে গেছে?

মহাদেব একটু ইতস্তত করে বললে, না, এখানেই।

—তাহলে মনটাকে শক্ত করুন। আমি চাই না আমার কথা শুনে আপনি চমকে উঠুন বা এমন কোনো আচরণ করুন, যাতে ঐ মেয়েটি কিছু বুঝতে পারে। বুঝলেন?

—না বোঝার কী আছে? বলুন? কী এমন কথা?

—বলছি। কিন্তু বেশি কথা বলবেন না। যা বলছি শুধু শুনে যান। উত্তেজিত না হয়ে। আমি চাই না সুজাতা যেন কিছু আন্দাজ করতে পারে।

—সে তো আগেই বলেছেন। কথাটা কী?

—আমার বাড়ি থেকে আপনি ডিউক হোটেলে গেছিলেন?

—হ্যাঁ। এতে উত্তেজিত হব কেন?

—কাগজপত্র, ফটো, পেপার কাটিং নিয়ে এসেছেন?

— হ্যাঁ।

—ডিউক হোটেল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন ইতিমধ্যে?

—হ্যাঁ।

—কেন?

—জানতে যে, আপনি বাড়ি ফিরে এসেছেন কি না।

—ঠিক আছে। শুনুন, আমরা অনীশ আগরওয়ালের পাত্তা পেয়েছি। আমি তার বাড়িতে গিয়েছিলাম।

— দ্যাটস গ্রেট! দেখা হলো? কী বললে বদমায়েশটা?

—কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না তার। আমি পৌঁছানোর আগেই লোকটা ফৌত হয়েছে।

—কী! …কী বললেন? ফৌত হয়েছে! কে? মানে, আপনি ওর বাড়িতে গিয়ে….

—শাট আপ! আপনাকে বললাম না, ‘চুপচাপ শুনে যাবেন।’ এমন চেঁচাচ্ছেন কেন?

—আয়াম সরি, স্যার! বলুন?

—আমি আগেই বলেছি মনটাকে শক্ত করুন। যা বলছি মন দিয়ে শুনে যান। চুপচাপ। আমরা অনীশ আগরওয়ালের ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। বেগবাগানে। বাংলাদেশ মিশনের কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস ‘রোহিণী-ভিলা’য় সে থাকত। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেখানেই যাই। আপনি লিন্ডসে স্ট্রিটের ডিউক হোটেলের দিকে রওনা হবার কিছুক্ষণ পরে। আমি কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, দুজনে মিলে চেপে ধরলে সে স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আপনাকে ইচ্ছে করেই সঙ্গে নিতে চাইনি। কারণ আমার আশঙ্কা ছিল, ওকে দেখলেই আপনি উত্তেজিত হয়ে উঠবেন, আর অনীশ সতর্ক হয়ে যাবে। সে যাই হোক, কৌশিককে গাড়িতে রেখে আমি একাই ওর ঘরে যাই। আমি ওর 2/3 নম্বর ঘরে গিয়ে যখন পৌঁছাই তখন রাত আটটা পঞ্চাশ। মনে হয়, তার মিনিট পাঁচ-দশ আগে কেউ ওকে খুন করে ফেলে রেখে গেছে। বুলেটের গুলি। বুকের বাঁ-দিকে। রক্তের মধ্যে মেঝেতে ওর মৃতদেহটা পড়েছিল। খালি গা, পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার। স্টোন ডেড!

নিজের অজান্তেই মহাদেব স্বগতোক্তি করে বসে, গুড গড!

তারপর সামলে নিয়ে বলে, আয়াম সরি, স্যার! তারপর?

—আমি যখন রোহিণী-ভিলার পোর্টিকোর কাছাকাছি পৌঁছেছি তখন ঐ অ্যাপার্টমেন্ট- হাউস থেকে একটি সুন্দরী তরুণীকে বার হয়ে আসতে দেখেছিলাম। বয়স বিশ-বাইশ, খুব ফর্সা রঙ। চুল বব্ করে কাটা। চোখে চশমা নেই। তার পরনে ছিল মেরুন রঙের সালোয়ার- কামিজ, একই রঙের উর্নি, পায়ে শাদা রঙের সোয়েডের জুতো। হাইট পাঁচ চার-সাড়ে চার। এবার বলুন, এ বর্ণনার সঙ্গে মাধবী বড়ুয়ার চেহারাটা মেলে?

— ইয়েস স্যার। শাদা সোয়েড়ের জুতোটা ও আমাকে সঙ্গে নিয়েই কিনেছিল। গুয়াহাটির বাজারে।

—তাহলে অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? মাধবী একটা গভীর গাড্ডায় পড়ে গেছে।

—তা কেন, স্যার? শাদা সোয়েডের জুতো তো যে কেউ পরতে পারে! তাছাড়া কেউ তো ওকে দেখেনি….

—লুক হিয়ার, জালান। মেয়েটিকে আমি ছাড়া আরও কেউ কেউ দেখেছে। তাকে শনাক্ত করার লোকের অভাব হবে না। তার মানে প্রসিকিউশান অনায়াসে প্রমাণ করবে যে, হত্যামুহূর্তের তিন-চার মিনিট পরে মাধবী বড়ুয়া ‘রোহিণী-ভিলা’ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। এটুকু প্রমাণ হলেই সর্বনাশ! কারণ ‘রোহিণী-ভিলা’ কেন, গোটা ‘বেগবাগান’ এলাকায় মাধবী কোনও পরিচিত ব্যক্তির নামধাম বলতে পারবে না। যার সঙ্গে দেখা করতে যাবার একটা যৌক্তিকতা খাড়া করা যায়। কলকাতাতেই সে কাউকে চেনে না, বেগবাগান ‘দূর অস্ত্’। তাছাড়া আগরওয়ালের এক প্রতিবেশিনী ঐ দিন সন্ধ্যায় ঐ ঘর থেকে কিছু তর্কাতর্কি শুনেছেন।একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার কণ্ঠ! মেয়েটি নাকি ‘ফিল্ম কন্ট্রাক্ট’-এর প্রসঙ্গে কী সব কথা বলছিল। সমস্ত কথাই সেই মহিলা পুলিশের কাছে জানিয়েছেন। আমি যখন অনীশের ঘর ছেড়ে বার হয়ে আসি তখন সেই মহিলা একজন সার্জেন্টকে ডেকে নিয়ে আসেন। অনীশের প্রতিবেশিনী অথবা হয়তো সেই সার্জেন্টও মাধবীকে রোহিণী-ভিলা ছেড়ে চলে যেতে দেখেছে। সুন্দরী মেয়ের দিকে অজান্তেই নজর চলে যায়। এখন বলুন, এ বিষয়ে কী করা যেতে পারে?

টেলিফোনে মহাদেবের কণ্ঠস্বর একটু উত্তেজিত শোনালো, কী বলছেন স্যার! এ-কথা কী প্রশ্ন করে জানবার? মাধবীর যদি গভীর গাড্ডায় পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে তবে আপনি তাকে রক্ষা করবেন। কী করে করবেন তা আপনিই জানেন। অনীশ আগরওয়াল ফৌত হয়েছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যেই খুনটা করে থাক সে ধরণীর ভার লাঘব করেছে। কিন্তু সেজন্য মাধবীর কেশাগ্র কেউ যেন স্পর্শ না করে….

—কিন্তু কাজটা যদি সে-ই করে থাকে?

—ইম্পসিবল! অ্যাবসার্ড! মাধু সেরকম মেয়েই নয়। তাছাড়া ও রিভলভার পাবে কোথায়? শুনুন মশাই! ও-সব ফালতু কথার মধ্যে আমি নেই। খুনটা যে করেছে সে হয়তো দোষটা মাধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইবে—নিজেকে বাঁচাতে। বিশেষ যদি প্রমাণিত হয় মাধু ঐ সময় অনীশের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। এই জাতের আশঙ্কা করেই আমি আপনাকে আগাম রিটেইনার দিয়ে রেখেছি। বলেন তো, আরও কিছু দিয়ে যাই। মানি ইজ নট এনি ফ্যাক্টর…

বাসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে বলেন, অল রাইট! তাহলে আপনি ওখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আধ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি। জরুরী কথা আছে আপনার সঙ্গে। আমাদের স্ট্রাটেজিটা খাড়া করতে হবে।

—না, স্যার! এখানে নয়। এখন রাত পৌনে দশটা। হোটেলে একজনের সঙ্গে আমার রাত দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। বিজনেস-ব্যাপার। আপনি যেখান থেকে কথা বলছেন সেখান থেকে স্ট্রেট ডিউক হোটেলে চলে আসতে পারবেন কি?

—তা পারব। অ্যারাউন্ড দশটায়।

—না, স্যার। ঐ লোকটাকে বিদায় করতে আমার মিনিট পনের লাগবে। আপনি সওয়া দশটা নাগাদ আসুন।

—ঠিক আছে, তাই হবে। আপনি যেন সুজাতা বা আর কাউকে কিছু বলবেন না অনীশের ব্যাপারে।

—ঠিক আছে। ফটো, পেপার-কাটিং এগুলো কি হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাব? আপনার হাতে-হাতে দেব?

—না। ওগুলো আপনার কাছে আমি চাইনি। বরং ‘সুকৌশলী’ চেয়েছিল। ওগুলো সুজাতার কাছে দিয়ে আপনি হোটেলে ফিরে যান।