বিশের কাঁটা – ৫

পাঁচ

সুরঙ্গমা তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিল। বলল, না, আপনি অবশ্য তা বলেননি। কিন্তু আপনার ভাবখানা ঐরকম। যেন পুলিশের হোমিসাইড স্কোয়াড সারা শহর দাবড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের দুজনের সন্ধানে।

বাসু বললেন, তাই বেড়াচ্ছে, সুরঙ্গমা। কেন তারা তোমাদের দুজনকে খুঁজছে তা তোমরা জান, কিন্তু আমার কাছে স্বীকার করছ না। আমার কথাটা শোন। একটুও সময় নষ্ট কর না। তোমাদের দুজনের কাছ থেকেই আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করে নিতে চাই, এখানে পুলিশ এসে পৌঁছানোর আগে। না হলে পুলিশের সামনে আমি কী স্ট্রাটেজি নেব বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমে বল, তোমরা পরস্পরকে চিনলে কী করে?

সুরঙ্গমা বলে, আমিই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। গুয়াহাটিতে টেলিফোন করেছিলাম।

—আর একটু আগে থেকে শুরু কর। মাধবী বড়ুয়ার গুয়াহাটির টেলিফোন নম্বর তুমি পেলে কেমন করে? ওকে চিনলে কীভাবে?

—আপনি নিশ্চয় জানেন, মাধবীর মতো আমিও জামশেদপুরে বোকা বনেছি। ঠিক একইভাবে। সেটা নভেম্বরের ফার্স্ট উইক। অনীশের সঙ্গে আমি বোম্বাই যাই ‘তারকা’ হবার বাসনা নিয়ে। সেখানে গিয়ে টের পাই অনীশ কীভাবে আমাদের লেঙ্গি মেরেছে। মাধবী নিজে হাতে নিজের টাকা দিয়েছিল; আমার ক্ষেত্রে ‘চীটেড’ হয়েছেন আমার বাবা। তাই বোম্বাই থেকে ট্রাঙ্ককলে বাবাকে সব কথা জানাই। ফিরে আসি জামশেদপুরে। বাবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আমি একটা ফয়শালা করব বলে গোপনে অগ্রসর হলাম। প্রথমে ঐ জামশেদপুরের একটি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সিকে নিয়োগ করি। তারা দু-তিন দিনের মধ্যেই আমাকে জানিয়ে দিল যে, অনীশ এভাবে একের পর এক নানা শহরে গিয়ে লোককে বোকা বানিয়ে টাকা কামাচ্ছে। মাধবী বড়ুয়ার নাম-ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর তারাই আমাকে সরবরাহ করে। আমি তখন মাধবীকে গুয়াহাটিতে একটা এস. টি. ডি. টেলিফোন করি। তাকে সব কথা খুলে বলি। আর চলে আসতে বলি কলকাতায়। কারণ ইতিমধ্যে ঐ গোয়েন্দা সংস্থা অনীশের কলকাতার ঠিকানাটাও আমাকে সরবরাহ করেছিল। মাধবীকে এই মেজানাইন-ফ্লোরের ঘরে উঠতে বলি। আমার মনে হয়েছিল যে, আমরা দুজনে যদি অনীশকে একসঙ্গে আক্রমণ করি তখন ও বলবার অবকাশ পাবে না যে, এটা ওর অজ্ঞাতসারে অ্যাকসিডেন্টালি হয়েছে। তাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এটা ‘ডেলিবারেট র‍্যাকেটীয়ারিং’! সুপরিকল্পিত জুয়াচুরি।

বাসু বললেন, বুঝলাম। সেজন্যই কি মাধবী আজ রাত পৌনে নয়টা নাগাদ রোহিণী- ভিলায় গিয়েছিলে?

মাধবী স্বীকার করল।

বাসু বললেন, কিন্তু তোমাদের তো একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ করার কথা ছিল, তুমি একলা গেলে কেন?

মাধবী কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুরঙ্গমা বললে, সেরকমই কথা ছিল বটে, কিন্তু আজ আমার একটা থিয়েটারের টিকিট কাটা ছিল বলে ও একাই গিয়েছিল।

বাসু সুরঙ্গমার দিকে ফিরে বললেন, ওর হয়ে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে না, মিস্ পাণ্ডে। ওকে যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব মাধবীকেই দিতে দাও। তারপর তোমার সঙ্গে কথাবার্তা হবে। কেমন? তা মাধবী, তোমার সঙ্গে অনীশের আজ কী কথা হলো?

—আমি ঢুকতেই পারলাম না ওর অ্যাপার্টমেন্টে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। অনেকবার কলবেল বাজালাম। কেউ সাড়া দিল না। অথচ ভিতরে ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছিল। -ভিতরে কোনো শব্দ শোননি? কোনো ঝগড়া বা তর্কাতর্কি? দ্রাম করে দরজা বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ? অথবা ফায়ারিঙের?

সুরঙ্গমা একটু চমকে উঠে বলল, কী বললেন, ফায়ারিঙ?

বাসু ধমকে ওঠেন, প্লিজ কীপ কোয়ায়েট! এটা স্টেজ নয়!

মাধবী নিঃশব্দে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল। নেতিবাচক ভঙ্গিতে।

—তুমি বলতে চাইছ যে, তুমি ঘরের ভিতর আদৌ ঢোকনি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই তো ক্রমাগত বলে চলেছি। ঘরে ঢুকতে না পেরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি। আর তখনি আপনার মুখোমুখি পড়ে যাই।

—তাহলে আমাকে দেখে তুমি অত ঘাবড়ে গেলে কেন?

—ঘাবড়াইনি তো!

—ও! ঘাবড়াওনি! তবে বোধহয় আমারই দৃষ্টিভ্রম। সেক্ষেত্রে তোমার জামাকাপড় জুতোয় রক্ত লাগল কী করে?

—রক্ত? আমার জামাকাপড়ে? কী বলছেন! কই না তো!

বাসু সুরঙ্গমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার বাথরুমে গীজার আছে? অথবা ইমার্শান-হীটার?

—না, একথা কেন?

—তাহলে কী কারণে এই জানুয়ারীর সন্ধ্যায় তোমাদের দুজনকেই ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হলো সেটাই আমাকে বুঝিয়ে বল!

দুজনের মুখে কথা ফোটে না। পরস্পরের দিকে তাকায়।

বাসু এদিকে ফিরে বলেন, অল রাইট। রাত আট থেকে নটা তুমি কোথায় ছিলে সুরঙ্গমা?

—রবীন্দ্রসদনের পাশে অ্যাকাডেমি হলে। আমার এক কাজিনের সঙ্গে থিয়েটার দেখছিলাম। শো ভাঙলো রাত আটটা চল্লিশে। তারপর আমার সেই কাজিন তার নিজের গাড়িতে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল।

—কী থিয়েটার দেখলে তোমরা?

—মনোজ মিত্রের ‘অলকনন্দার পুত্রকন্যা’।

—আই সী। তোমার দাদার গাড়ি আছে শুনলাম। যেহেতু নিজের গাড়িতে পৌঁছে দিল। কী করে সে?

—আর্কিটেক্ট। নিজেরই ব্যবসা আছে। দোতলায় থাকে। একতলায় অফিস।

— বিবাহিত?

—হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

—বউ বুঝি থিয়েটার দেখতে ভালবাসে না?

—না, তা কেন? বউ আছে নার্সিংহোমে। তার বাচ্চা হয়েছে।

—বাঃ। তোমার দাদা তো বেশ কাজের ছেলে। বউ নাসিংহোমে আর সে কাজিন-

সিস্টারকে নিয়ে থিয়েটার দেখে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যায় ভিজিটিং আওয়ার্সে বউ-এর কাছে যায় না!

—যাবে না কেন? আজ যায়নি।

—ওকে কি এখন টেলিফোনে পাওয়া যাবে? কী নাম?

—যাবে, যদি এখান থেকে সোজা বাড়িতেই গিয়ে থাকে। ওর নাম রামলগন ভার্গব।

বাসু টেলিফোনটা তুলে সুরঙ্গমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার দাদাকে একটা ফোন কর তো? লাইনে রিঙিং-টোন হলেই আমাকে দেবে। দাদার সঙ্গে কথা বলবে না। বুঝলে?

সুরঙ্গমা আদেশ পালন করল। ম্যানিকিওর করা আঙুলে ছয়-সাতটা নম্বর ডায়াল করল। রিঙিং-টোন হতেই যন্ত্রটা বাড়িয়ে ধরল বাসু-সাহেবের দিকে। একটু পরে ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ভার্গব স্পিকিং

—মিস্টার রামলগন ভার্গব?

—ইয়েস। স্পিকিং। বলুন।

—লুক হিয়ার, মিস্টার ভার্গব। আমি পি. জি. হসপিটালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে বলছি। একটা দুঃসংবাদ আছে। মনটাকে শক্ত করুন।

—ইয়েস। ফায়ার?

—মিস সুরঙ্গমা পাণ্ডে কি আপনার পরিচিত?

—ইয়েস। আমার কাজিন-সিস্টার। কেন?

—একটা মোটর অ্যাকসিডেন্টে মিস্ পাণ্ডে আহত হয়েছেন। অ্যারাউন্ড রাত সাড়ে আটটায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস হলের সামনে। জ্ঞান নেই। ওঁর ব্যাগের নোটবইতে আপনার টেলিফোন নাম্বার …

বাসু-সাহেবের কথাটা শেষ হলো না। তার আগেই ভার্গব ধমকে ওঠে, হোয়াটস্ অল দিস রাবিশ! আপনি কে মশাই? অ্যাবাউট সাড়ে আটটায় সুরো আর আমি অ্যাকাডেমিতে বসে থিয়েটার দেখছিলাম। তারপর শো ভাঙার পর ওকে ওর ইন্টালির বাসায় যখন নামিয়ে দিই তখন নটা পাঁচ-সাত হবে। অথচ আপনি….

বাসু নিঃশব্দে ধারক-অঙ্গে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। মাধবীর দিকে ফিরে বললেন, অঙ্কটা যে মিলছে না মাধবী! তুমি বলছ, তুমি ঘরের ভিতরে ঢোকনি। সুরঙ্গমার পাক্কা অ্যালেবাঈ আছে। রাত সাড়ে আটটায় সে দাদার সঙ্গে থিয়েটার দেখছে। অথচ আমি যে নিশ্চিতভাবে জানি, রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে তোমাদের দুজনের মধ্যে অন্তত একজন ওঘরে ছিলে?

সুরঙ্গমা বললে, আমাদের দুজনের মধ্যে একজন? তা তো নাও হতে পারে। কোনো থার্ড মহিলা…

—না! সে মেয়েটির সঙ্গে অনীশের ঝগড়া হচ্ছিল। ঝগড়ার সময় সেই মেয়েটি ‘ফিল্ম কন্ট্রক্ট’ কথাটা বলেছিল। সুতরাং তৃতীয় কোনো মহিলার প্রশ্ন উঠছে না!

সুরঙ্গমা বলে, উঠছে স্যার। আমরা দুজন ছাড়া আরও একটি মহিলাকে অনীশ একইভাবে ফাঁসিয়েছে। ভুবনেশ্বরে। ওড়িয়া নয়, মেয়েটি বাঙালী। তার নাম সুজাতা মিত্র। আমি তাকে রোহিণী-ভিলার ঠিকানা দিয়েছিলাম। কিন্তু বারণ করেছিলাম যেন আজ রাতে সে রোহিণী- ভিলায় না যায়। কারণ আজ সন্ধ্যায় মাধবী ওর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। ইন ফ্যাক্ট, রামদা থিয়েটারের টিকিটটা না কেটে ফেললে হয়তো আমরা দুজন একসঙ্গেই যেতাম।

ঠিক তখনি ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। সুরঙ্গমা সেটা তুলে নিয়ে আত্মঘোষণা করতেই ও-প্রান্ত থেকে যেনস্টাইফুন ধেয়ে এল। সুরঙ্গমা বলে, তা আমার উপর তড়পাচ্ছ কেন? ও নিশ্চয় তোমার কোনো বন্ধু-টন্ধু—প্র্যাকটিক্যাল জোক করছে।… নিশ্চয়! খুব অন্যায় কথা! বন্ধুকে লোকেট করতে পারলে ধমকে দিও…না, না, আমি আর বাড়ি ছেড়ে বার হইনি। তুমি নামিয়ে গিয়ে গিছ—তা মিনিট কুড়ি হবে, তাই নয়? মোটর অ্যাকসিডেন্ট হবে কী করে! হয়তো তুমি ‘কান’ শুনতে ‘ধান’ শুনেছ!…কী? অলরাইট! অলরাইট! বেশ তো, মেনে নিচ্ছি, ঠিকই শুনেছ! এ তোমার কোনো থার্ড ক্লাস ইয়ার দোস্ত! গুড নাইট!

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলে, রামদা!

বাসু তা আগেই বুঝেছেন। তিনি মাধবীর দিকে ফিরে বলেন, ডক্টর বড়গোঁহাই কলকাতা এসেছেন তা জান?

মাধবী চমকে ওঠে। বলে, আপনি তাকে কী করে চিনলেন?

বাসু ধমকে ওঠেন, প্লীজ ডোন্ট কাউন্টার-কোশ্চেন। যা জানতে চাইছি চটপট করে জবাব দাও। সময় খুব কম। এখনি হোমিসাইড-স্কোয়াড থেকে টেলিফোনটা এসে যেতে পারে। বল, বড়গোঁহাই যে কলকাতা এসেছে তা তুমি জান?

মাধবী সম্মতিসূচক গ্রীবাভঙ্গি করে।

—ও কোথায় উঠেছে তা জান?

—জানি! ‘পথিক হোটেল’-এ। গুয়াহাটি থেকে রওনা হবার আগে আমি ডক্টর বড়গোঁহাইকে এই ইন্টালি অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলাম। প্রযোজনে ফোন করতে বা চিঠি লিখতে—

—অর্থাৎ তুমি তাকে কলকাতায় আসতে বলনি?

—নিশ্চয় নয়। সে নিজের কাজে কলকাতায় এসেছে।

—ও! নিজের কাজে! কী কাজ তা জান না বোধকরি? —আমি কেমন করে জানব?

—বটেই তো! সে কলকাতায় আসার পর তোমাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে?

এবার একটু দেরি হলো জবাবটা দিতে। শেষে মাধবী বলল, না। দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। শুধু টেলিফোনে কথা হয়েছে।

বাসু বলেন, আই সী, ডক্টর বড়গোঁহাই আমার সঙ্গে আজ দেখা করতে এসেছিলেন। বললেন, তিনি তোমার ঠিকানা খুঁজছেন। এবার বল, কে মিথ্যা কথা বলছে? তুমি না বড়গোঁহাই? তোমার ঠিকানা যদি জানাই থাকবে তাহলে তিনি কেন আমাকে ওকথা বললেন?

—আমি জানি না।

সুরঙ্গমা হঠাৎ বলে ওঠে, আমি আন্দাজ করতে পারি। ডক্টর বড়গোঁহাই হয়তো জানতে গিয়েছিলেন, আপনি মাধবীর পাত্তা পেয়েছেন কিনা।

বাসু আবার ওকে থামিয়ে দেন, প্লীজ ডোন্ট ইন্টারাপ্ট মী, মিস্ পান্ডে। যার কাছে যা জানতে চাইছি একমাত্র সে-ই তার জবাব দেবে। ওয়েল মাধবী! ডক্টর বড়গোঁহাই যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তখন তিনি একটা প্রাইভেট গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছিলেন। গুয়াহাটি থেকে বাই রোড কেউ একা কলকাতা আসে না। গাড়িটা কার?

—না, ও প্লেনেই এসেছে। গাড়িটা কলকাতায় এসে ভাড়া নিয়েছে। ‘রেন্ট-আ-কার’মানে একটা এজেন্সি থেকে।

—ভাড়া নেওয়া গাড়ি? আমার তো তা মনে হলো না। কী রঙের গাড়ি বল তো?

—শাদা অ্যাম্বাসাডার। কেন? আপনার কেন মনে হলো ওটা ‘রেন্ট-আ-কার’ এজেন্সির নয়?

বাসু এতক্ষণে পাইপ পাউচ বার করলেন। বললেন, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাওয়ার তোমাকে বুদ্ধিমতী মনে হয়েছিল, আসলে তুমি ততটা নও।

মাধবী জবাব দেয় না। জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকে।

পাইপটা ধরিয়ে বাসু বললেন, এবার আমাকে বুঝিয়ে বল তো মাধবী, কলকাতায় আসার পর তোমার সঙ্গে যদি বড়গোঁহাইয়ের দেখাসাক্ষাৎ না হয়ে থাকে তাহলে তুমি কেমন করে জানলে ওর ভাড়া-করা গাড়িটার রঙ স্কাই-ব্লু বা কালো রঙের নয়? শাদা অ্যাম্বাসাডার? তথ্যটা কি বড়গোঁহাই তোমাকে টেলিফোনে জানিয়েছিল?

মাধবী লজ্জা পায়। জবাব দেয় না। সুরঙ্গমা আবার ফোড়ন কাটে, আপনি আমাদের দুজনকে এভাবে জেরা করছেন কেন বলুন তো?

—অঙ্কটা যে মিলছে না। রাত সাড়ে আটটায় অনীশের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে কে ছিল? সিনেমা কন্ট্রাক্টের প্রসঙ্গ কেন উঠল? না সুরঙ্গমা, মেয়েটির নাম সুজাতা মিত্র নয়। কারণ সুজাতা মিত্রের অ্যালেবাঈ আমি নিজে। ও আমারই এজেন্ট। তোমার কাছে এসেছিল অনীশের ঠিকানা সংগ্রহ করতে। ও আমার বাড়িতেই থাকে। ভুবনেশ্বরে নয়।

সুরঙ্গমা বলে, বুঝলাম। এখন আপনি আমাদের কী করতে বলেন?

—শোন! তোমরা দুজন যা আন্দাজ করেছ, বরং বলা উচিত দুজনের মধ্যে একজন যা প্রত্যক্ষ করেছ, বাস্তবে সেটাই ঘটেছে. অনীশ আগরওয়াল খুন হয়েছে আজ রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নটার মধ্যে। সেসময় অথবা খুনের ঠিক আগে ওর বাথরুমে একজন বঙ্গভাষী মহিলা ছিল। যার সঙ্গে অনীশের উচ্চকণ্ঠে ব্যক্যবিনিময় হচ্ছিল। কী নিয়ে ঝগড়া তা বুঝতে পারেননি প্রতিবেশিনী। কারণ তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, বাংলা জানেন না। কিন্তু মেয়েটি— আগেই বলেছি—’ফিল্ম কন্ট্রাক্ট’ বিষয়ে কী যেন বলছিল। অনীশ খুন হয়েছে সম্ভবত রিভলভারের গুলিতে। সারা মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত। আমাদের সময় কম। শোন! তোমাদের দুজনের মধ্যে কেউ আত্মরক্ষার্থে অথবা আত্মসম্মানরক্ষার্থে অনীশকে খুন করেছ কিনা তা আমি জানি না;কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, তোমাদের দুজনের মধ্যে কোনো একজন আজ রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নটার মধ্যে ঐ ঘরের ভিতর গিয়েছিলে। মৃতদেহটা সে দেখেছে। তার জামাকাপড়ে রক্তের দাগ লেগেছে। হয়তো তোমরা দুজনেই ঐ ঘরে ঢুকেছিলে, অথবা একজনের জামাকাপড়ের কাঁচা রক্তের দাগ আর একজনের পোশাকে লেগেছে। না হলে এই শীতের সন্ধ্যায় তোমাদের দুজনকেই ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হতো না। খুন কে করেছে…না, না, তোমরা আমাকে বাধা দিও না। সময় খুব কম। আমার যা বলার আছে তা আমাকে বলতে দাও। প্রথম কথা, সুরঙ্গমা, আমি জানি না, জামশেদপুর থেকে তুমি কোনো রিভলভার সঙ্গে করে এনেছিলে কিনা। তোমার বাবা শুনেছি স্টীল অথরিটির একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। তাঁর নিজস্ব রিভলভার থাকা সম্ভব। আছে, তাই নয়?

—আছে। কিন্তু আমি…তা…

—নো, নো, নো, সুরঙ্গমা! যেটুকু জানতে চাইছি তার বেশি আমাকে কিচ্ছু বলবে না। বেণী চাইলে স্রেফ বেণী, নট্ উইথ মাথা! বুঝলে না? তুমি আমার মক্কেল নও। তবে এটুকু আমি বলতে পারি : লি কোয়ারফুলি—যদি তোমার ধারণায় বা জ্ঞানমতে তোমার বাবার সেই রিভলভারটা বর্তমানে জামশেদপুরে না থাকার কোনো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে রাত পোহালেই তুমি কোনো ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে! ফলো? আমার কার্ডটা রাখ। প্রয়োজনে আমাকে ফোন কর। আমি ভাল ডিফেন্সের ব্যবস্থা করে দেব।

সুরঙ্গমা বলে, কেন স্যার? আপনি নিজেই তো–

—না, তা আমি পারি না। এ কেসে মাধবী আমার ক্লায়েন্ট। মাধবীর তরফে আমি রিটেইনার গ্রহণ করেছি। হয়তো মামলা চলাকালে দেখা যাবে তোমাদের দুজনে স্বার্থে সংঘাত বাধছে-

—কিন্তু আমার দাদার অ্যালেবাঈ—

—আই নো, আই নো। সেটা আমি যাচাই করে নিয়েছি। তা হোক। তবু যদি তোমার বাবার রিভলভারটা…এক কথা বারবার বলার দরকার নেই। তুমি বুদ্ধিমতী। নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি। অ্যন্ড য়ু মিস্ মাধবী বড়ুয়া! তোমার কোনো অ্যালেবাঈ নেই। বরং উল্টোটা আছে। হত্যামুহূর্তের কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমাকে ঘটনাস্থলে দেখতে পাওয়া গেছে। তখন তুমি অত্যন্ত অস্বাভাবিক অবস্থায় ছিলে। বস্তুত ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলে ঘটনাস্থল থেকে!

সুরঙ্গমা বলে, কিন্তু দেখেছেন তো আপনি। ওর পক্ষের উকিল।

বাসু মাথা নেড়ে বলেন, তোমার ভুল হচ্ছে, সুরঙ্গমা। মক্কেল তার আইনজীবীকে বিশ্বাস করে যেটুকু বলে সেটুকুই ‘প্রিভিলেজড়’! তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে আসামীর আইনজীবী আইনত বাধ্য। কিন্তু তাই বলে কোনো কোর্ট অফিসার—তিনি যে পক্ষেই থাকুন—তাঁর জ্ঞানমতে প্রত্যক্ষ করা কোনো ঘটনার কথা গোপন করতে পারেন না! নো, নেভার! সেটা এভিডেন্স! মক্কেলের বলা গোপন কথা নয়। তাছাড়া আরও একজন মাধবীকে ঐ বাড়ি ছেড়ে যেতে দেখেছে। সে ঐ সুজাতা মিত্রের স্বামী। মুশকিল হচ্ছে এই যে, এই টেলিফোনের একটা এক্সটেনশান আছে। না হলে তোমাকে পরামর্শ দিতাম ক্র্যাডল থেকে টেলিফোনের মাউথপীসটা নামিয়ে রাখতে।

সুরঙ্গমা জানতে চায়, কেন স্যার?

—অনীশের ঘরে দারোয়ানের পাঠানো ঐ স্লিপটা পুলিশের হস্তগত হলেই ওরা এখানে ফোন করবে। তুমি এটা ডেড করে রাখলেও গৃহস্বামীর ঘরে টেলিফোন বাজবে। তিনি লোক পাঠিয়ে তোমাকে বলবেন টেলিফোনে কথা বলতে। বিশেষ যদি থানা থেকে টেলিফোনটা আসে।

—তাহলে আমি কি কোনো হোটেলে পালিয়ে যাব?

—আয়াম সরি। এক্সটীমলি সরি, মিস্ পান্ডে। আমি তোমাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারি না। তবে একটা কথা বলি, হঠাৎ এভাবে আত্মগোপন করাটা পুলিশ ভাল চোখে দেখবে না। সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে। তোমার অ্যালেবাঈ আছে। তোমার বাবার রিভলভারটা যদি জামশেদপুরে থাকে তাহলে তোমার ঘাবড়াবার কী আছে? বাট য়ু মাধবী! তোমার কোনো অ্যালেবাঈ নেই। তুমি পাঁচ মিনিটের ভিতর তোমার স্যুটকেসে সবকিছু গুছিয়ে নাও। নিচে আমার গাড়ি আছে। তোমাকে কোনো হোটেলে চেক ইন করিয়ে আমি বাড়ি যাব। তুমি সেই হোটেল ছেড়ে একদম বার হবে না—যতক্ষণ না আমি পারমিশান দিচ্ছি। নিজে থেকে বড়গোঁহাই বা সুরঙ্গমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করবে না। দিন দুই শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবে বা বই পড়বে। বুঝলে? পুলিশে তোমাকে খুঁজবে। কারণ সুরঙ্গমার বজ্রবাঁধুনি অ্যালেবাঈ আছে। তোমার তা নেই। নাউ লুক হিয়ার মাধবী–আমি তোমাকে সুরঙ্গমার সামনে জিজ্ঞেস করছি না যে, তুমি গুয়াহাটি থেকে কোনো রিভলভার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ কিনা, অথবা সেল্ফ-ডিফেন্স—আত্মরক্ষার্থে বা আত্মসম্মানরক্ষার্থে তুমি অনীশকে গুলি করেছ কিনা-

মাধবী দৃঢ়স্বরে বলল, দুটো প্রশ্নের একই জবাব : না!

—আমি শুনিনি। কোনো তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে আমি ও-জাতীয় প্রশ্ন মক্কেলকে জিগ্যেস করতেই পারি না। যা বলছি কর। তুমি পাঁচ মিনিটের ভিতর তৈরি হয়ে নাও

ঠিক তখনই ঝন্‌ঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোনটা।

সুরঙ্গমা তুলে নিয়ে ‘কথামুখে’ বলল, হ্যালো?… কে? লালবাজার? হোমিসাইড সেকশান? ইয়েস? বলুন। আমার নাম সুরঙ্গমা পান্ডে। হ্যাঁ, এই ঘরেই থাকি…হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটা আমারই টেলিফোন আপাতত!

বাসু বললেন, কুইক! স্যুটকেসটা সাজিয়ে ফেল, মাধবী। ওরা আসছে। এ-ঘরে তোমার কোনো ট্রেস্ রেখে যেও না। বাথরুমে তোমার কোনো ভিজে জামাকাপড় থাকলে তা প্লাস্টিকে জড়িয়ে তুলে নাও। এই চটি পরেই চল। সেই সোয়েডের শাদা জুতোজোড়া কাগজে জড়িয়ে…

—কোন শাদা জুতো?

—আঃ! কেন তর্ক করছ যেটা পরে রোহিণী-ভিলায় গেছিলে।

—আমার কোন শাদা জুতো নেই।

—অলরাইট। আমারই দৃষ্টিবিভ্রম। মোট কথা তোমার যা যা আছে সবই তুলে নাও! মাধবী স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে গুছোতে বসল। ইতিমধ্যে সুরঙ্গমা টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রেখেছে। বললে, ডিসিশানটা আমাকে আর নিতে হলো না। আমাকে এখানেই থাকতে হবে আপাতত। ওরা আসছে।

বাসু একটু ইতস্তত করে বললেন, একটা জরুরী কথা বলি। মন দিয়ে শোন। বুঝে, জবাব দাও! তুমি কি একটা ছোট হাতব্যাগে তোমার কোনো দামী জিনিস—জিনিসটার নাম উচ্চারণ না করে—আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে চাও?

সুরঙ্গমা পূর্ণদৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার রিভলভারটা আমি জামশেদপুর থেকে আনিনি, মিস্টার বাসু।