বিশের কাঁটা – ৪

চার

বেগবাগান পার হয়ে বাংলাদেশ মিশনের কাছাকাছি পৌঁছে বাসু- সাহেবের নজর হলো তাঁর গাড়িটা রাস্তার কার্ব ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। উনি ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলেন। গাড়ির ড্রাইভারের দরজা খুলে এগিয়ে এল কৌশিক। বলল, এবার বলুন, আমাদের অপারেশনটা কী জাতের হবে?

—তুমি এখানেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা কর। ‘রোহিণী-ভিলা’ বোধহয় ঐ ছয়তলা বাড়িটা, না? আমি একাই প্রথমে যাব। আমাকে মিনিট দশেকের হ্যান্ডিকাপ দাও। আমি গিয়ে কথাবার্তা শুরু করি। ঘরে ঢুকে আমি দেখব সদর দরজাটা যেন খোলা থাকে। আমার সঙ্গে যেন তোমার পরিচয় নেই। আমি ওর কাছে গেছি মাধবীর তরফে। তুমি এসেছ সুরঙ্গমার তরফে। দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে ও ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। মোট কথা, নাউ অর নেভার। আজ রাতেই একটা শো-ডাউন করতে হবে।

কৌশিক বলে, আপনার নিজের যন্ত্রটা সঙ্গে আছে তো?

—আছে। তবে তার প্রয়োজন হবে না। তুমি এসে পৌঁছোনোর আগে বিতণ্ডাটা অত বাড়াবাড়ি হতে দেব না।

বাসু দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যাবার পর কৌশিক একটা সিগ্রেট ধরালো। বাসু পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন রোহিণী-ভিলার দিকে। প্রবেশপথে একটা জোরালো বাল্ব জ্বলছে, কিন্তু জনমানবের দেখা পেলেন না। বাড়ির প্রবেশপথ থেকে যখন দশ মিটার দূরে তখন দেখলেন ঐ বাড়িটা থেকে একটি মেয়ে দ্রুতপায়ে বার হয়ে আসছে। বয়স—বিশ-বাইশ। পরনে মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ, একই রঙের উড়নি। তার হাতে একটা টর্চ, পায়ে শাদা রঙের মিডিয়াম-হিল সোয়েডের জুতো। বাসু-সাহেবকে দেখেই সে যেন কেমন সিঁটিয়ে গেল। রাস্তাটা যদিও সেখানে তিন মিটার চওড়া তবু সে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

বাসুর মনে হলো, মেয়েটা ভয় পেয়েছে। কেন? তাঁকে? নির্জনতাজনিত আতঙ্ক? এতটা ঘাবড়ে যাবার তো কোনো কারণ নেই। জবাবটা জানা ছিল তবু বাসু ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, এটাই রোহিণী-ভিলা?

অভিনয়-অভিধানে যাকে ‘স্টিল হয়ে-যাওয়া’ বলে সেই কায়দায় এতক্ষণ মেয়েটি দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে নিস্পন্দে দাঁড়িয়ে ছিল। বাসু-সাহেবের প্রশ্নটা শুনেই সে যেন সংবিদ্ ফিরে পেল। নতনেত্রে ‘ইয়েস’ বলেই চলতে শুরু করে। বাসুও এগিয়ে গেলেন বিপরীতমুখো। রোহিণী-ভিলার প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে দেখলেন। আশ্চর্য! মেয়েটি দৌড়াচ্ছে না বটে, কিন্তু যেন ‘ওয়াকিং রেস’-এর প্রতিযোগী।

বাসু এদিকে ফিরলেন। দারোয়ানের টুলটা খালি। টেলিফোনটা দেওয়ালে একটা কাঠের ব্রাকেটে সাঁটা। তালাবন্ধ। লিম্যান নেই। অটোমেটিকের ব্যবস্থা আছে। বাসু লিফটের খাঁচায় ঢুকে দুটি দরজাই বন্ধ করলেন। স্বয়ংক্রিয় লিফটে উঠে এলেন দ্বিতলে। সামনেই তিন নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট।

বাসু কলবেল বাজালেন। ভিতরে কর্কশ একটা ‘বাজার’-এর শব্দ হলো। কেউ সাড়া দিল না। চরাচর শুনশান। কলবেলটা একবার, দুবার, তিনবার বাজালেন। ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ শোনা গেল না। অথচ ঘরে আলো জ্বলছে—সদর দরজার উপর গ্রিলবদ্ধ ‘ট্রানসম্’-এর ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরে বাতি জ্বালা আছে।

দ্বারে করাঘাত করতে গিয়ে নজর হলো দরজায় গোদরেজের ইয়েল-লক। কী মনে হলো, নবটা ধরে ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। নিঃশব্দে উনি প্রবেশ করলেন ঘরে। দরজাটা ঠেলে দিলেন আবার।

এটি নিঃসন্দেহে বৈঠকখানা। ছোট ঘর। কিছু চেয়ার টেবিল। টেবিলের ওপরে একটা স্লিপ কাগজ—কাচের কাগজ-চাপা দেওয়া। তুলে দেখলেন, দেবনাগরী হরফে লেখা আছে “শ্রীআগরওয়াল-2/3-আপনি কামরায় ওয়াপস্ এলে মেহেরবানি করে 24-9378-এ একটা ফোন করবেন—দুপুর দুটো দশ।” কাগজটা যথাস্থানে নামিয়ে কাচের কাগজ-চাপায় ঢাকা দিলেন। বৈঠকখানার অপরপ্রান্তে আর একটি দরজা। এতে ইয়েল-লক ছিল না। বাসু দরজায় ‘নক’ করলেন। কেউ সাড়া দিল না। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঠেলতেই এ-দরজাটাও ভিতর দিকে খুলে গেল। এ-ঘরেও আলো জ্বলছে। ঘরের ও-প্রান্তে একটি ডবল-বেড় বড় খাট। তার উপর খুব তাড়াহুড়োয় ছুঁড়ে ফেলা কিছু পুরুষের পোশাক— কোট-প্যান্ট-শার্ট-টাই। খাটের নিচে জুতো- মোজা। আর রক্তের ধারার মধ্যে চিৎ হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। কাঁচা-পাকা চুল। চশমাটা ছিটকে দূরে পড়ে আছে। লোকটার ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই, নিম্নাঙ্গে শুধু আন্ডার-ওয়্যার। বুকের বাঁদিকে একটা বুলেটের গর্ত।

বাসু সাবধানে রক্তের ধারা টপকে লোকটার কাছে এগিয়ে গেলেন। সাবধানেই হাত রাখলেন মণিবন্ধে। নিঃসন্দেহে মারা গেছে। নাড়ির স্পন্দন নেই। তবে মৃত্যু বোধহয় পাঁচ- সাত মিনিট আগে হয়েছে। দেহ শীতল হবার সময়ই হয়নি। উপরন্তু লক্ষ্য করে দেখলেন, বুক থেকে রক্ত এখনো ক্ষীণ ধারায় নির্গত হচ্ছে। অর্থাৎ হৃদপিণ্ড তার কার্যকারিতা থামিয়েছে কিন্তু যেটুকু রক্ত নির্গত হয়েছিল, মাধ্যাকর্ষণের টানে তা বুক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। জনমানবের চিহ্ন নেই। সাবধানে পা ফেলে শয়নকক্ষের ও-প্রান্তের ছোট্ট পাল্লাটা খুলে দেখলেন। সেটা স্নানাগার। সে ঘরেও বাতি জ্বলছে। মেঝে ভিজে নয়। পকেট থেকে রুমাল বার করে প্রতিটি মসৃণ বস্তু—যাতে ওঁর আঙুলের ছাপ পড়ে থাকতে পারে, তা মুছে দিয়ে ফিরে এলেন সদর দরজার কাছে। ইয়েল-লকের কলকব্জা খুঁটিয়ে দেখলেন—’লকিং অ্যারেঞ্জমেন্টটা’। লকের নবটা জমির সমান্তরাল রয়েছে। অর্থাৎ শেষবার যে পাল্লাটা বন্ধ করেছিল সে ‘লক-নবটা’ জমি থেকে খাড়া করে রাখেনি। তার ফলে দরজাটা লক হয়নি। তালাবন্ধ হয়নি। সেজন্যই বাসু-সাহেব হাতল ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকতে পেরেছিলেন। উনি রুমাল দিয়ে ভিতর থেকে হ্যান্ডেলের মসৃণ অংশটা মুছে দিলেন। একবার উঁকি মেরে দেখলেন বাইরের দিকে। করিডোর এবং সিঁড়ি জনমানবশূন্য। নিঃশব্দে দরজার বাইরে বার হয়ে এলেন। ঠিক তখনই লিটা চালু হলো। কেউ ওপরে উঠছে। কৌশিক নিশ্চয় নয়। কারণ তার দশ মিনিট পরে আসার কথা। এ অন্য লোক!

মুহূর্তমধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন। পাল্লাটা আবার খুলে ‘লকনব’টা জমির আলম্ব অবস্থায় রেখে আস্তে পাল্লাটা টেনে দিলেন! ক্লিক্ করে শব্দ হলো। অর্থাৎ দরজার ভিতর থেকে তালা পড়ে গেল। ঠিক তখনই লিটা এসে থামল ঐ ফ্লোরে। লিফটের দরজা খুলে বার হয়ে এল একজন পুলিশ সার্জেন্ট। তার সঙ্গে একজন মাঝবয়সী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা।

পুলিশ সার্জেন্ট-এর হেলমেটটা মেঝে ফুঁড়ে লিফটে উঠতে শুরু করা মাত্র বাসু পিছন ফিরে ছিলেন। অনীশের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতে থাকেন। চোখে দেখছেন না, কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করছেন ওঁর ঠিক পিছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে আছে সার্জেন্টটা। বাসু দু-তিনবার বেল বাজালেন। তারপর হতাশার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এপাশে ফিরলেন। পিছন ফিরতেই সার্জেন্টের মুখোমুখি হলেন। সার্জেন্ট ওঁকে প্রশ্ন করে, কী হলো? ফিরে যাচ্ছেন?

বাসু যেন এই প্রথম ওকে দেখলেন। ওকে, আর পিছনে যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকে। বললেন, তাছাড়া কী করব? দরজাও খুলছে না, সাড়াও দিচ্ছে না। অথচ ওদিকে ভিতরে আলো জ্বলছে।

সার্জেন্ট প্রশ্ন করে, কে থাকে এই অ্যাপার্টমেন্টে?

—অনীশ আগরওয়াল। অন্তত আমি সেই রকমই শুনেছি।

—আপনার পরিচিত? কেন এসেছিলেন ওর কাছে?

—না, আমার পরিচিত নয়। একটা প্রয়োজনে ঠিকানা সংগ্রহ করে দেখা করতে এসেছিলাম, এত কথা কেন জানতে চাইছেন বলুন তো?

সার্জেন্ট মহিলাকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করে, এঁকে চেনেন? আগে কখনো রোহিণী-ভিলায় বা অন্যত্র কোথাও দেখেছেন?

প্রৌঢ়া নীরবে দুদিকে মাথা নাড়লেন। বাসু নিঃশব্দে হিপ পকেট থেকে তাঁর ওয়ালেট বার করে একটি নামাঙ্কিত কার্ড পুলিশ অফিসারটিকে দিলেন।

—ও, আপনিই ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু? তাই বলুন! সেজন্যই এত চেনা-চেনা লাগছিল। আদালতে আপনাকে দেখেছি, তা আপনি কতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছেন, স্যার?

—তা মিনিট-খানেক, অথবা দু-মিনিট হবে। কেন?

—’কেন’ তা বলছি। তার আগে অনুগ্রহ করে বলুন, ঐ দেড়-দু মিনিটের ভিতর আপনি কি ভিতর থেকে কোনো শব্দ শুনেছেন? অথবা সন্দেহজনক কোনো কিছু কি নজরে পড়েছে আপনার?

—না। ‘সন্দেহজনক’ কিসের কথা বলছেন? কিসের সন্দেহ?

সার্জেন্ট বলল, এই ভদ্রমহিলার অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক পাশেই। উনি বলছেন, মিনিট দশেক আগে এই ফ্লাট থেকে একটা ঝগড়া বা কথা-কাটাকাটির আওয়াজ শুনেছেন। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। তারপর হঠাৎ দ্রাম করে একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ। ওঁর মনে হয়েছে শব্দটা এ-ফ্লাটের বাথরুম থেকে সেটা ওঁর বাথরুমের লাগাও—একটি মহিলা ‘ফিল্ম কন্ট্রাক্টের’ কথা কিছু বলছিল। বাংলা কথা—উনি অর্থ বোঝেননি, কিন্তু ‘ফিল্ম কন্ট্রাক্টের’ কথা সে বলছিল—

—বেশ তো। তাতে কী হলো। ‘ফিল্ম কন্ট্রাক্ট’ কথাটা তো অশ্লীল নয়। যে কেউ তা বলতে পারে–

সার্জেন্ট সে কথায় কর্ণপাত না করে এক নিশ্বাসে বলে গেল—আর তারপরেই উনি একটা ফায়ারিঙের শব্দ শুনেছেন।

বাসু সবিস্ময়ে ইংরেজিতে বলনে, কী শুনেছেন? ফায়ারিঙের শব্দ? এই ফ্লাট থেকে? প্রৌঢ়া কথোপকথনে যোগ দেন, আমার প্রথমে মনে হয়েছিল রাস্তায় কোনো গাড়ি ব্যাক- ফায়ার করেছে। তাই রাস্তার দিকে জানলার কাছে সরে গিয়ে নিচে ঝুঁকে দেখলাম। তখন ত্রিসীমানায় কোনো গাড়ি ছিল না। এবার আমার আশঙ্কা হলো ওটা তাহলে ফায়ারিঙের শব্দ। আশ্চর্যের কথা, ঐ শব্দটা হবার সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি আচমকা থেমে গেল। এ-ফ্ল্যাটে সব শুনশান! আমার মনে হলো…

সার্জেন্ট মাঝপথেই প্রশ্ন করে বসে, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তা আপনি জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

ভদ্রমহিলা রুখে ওঠেন, লুক হিয়ার, সার্জেন্ট! একজন আইন-সচেতন নাগরিক হিসাবে আমার মনে হয়েছিল আপনাকে ডেকে আনা আমার কর্তব্য। তাই জানলা দিয়ে রাস্তায় আপনাকে দেখতে পেয়ে ডেকে এনেছি। সেটা যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে….

আবারও বাধা দিয়ে সার্জেন্ট বললে, আমাকে ভুল বুঝবেন না ম্যাডাম। আপনি আপনার কর্তব্যই করেছেন। সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমি শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম, এই পাশের ফ্লাটে

—কেন জানব না? এই অ্যাপার্টমেন্টটা বোম্বাইয়ের একটা ফিল্ম কোম্পানি ভাড়া নিয়েছে। তারা যাকে চাবি দেয় সেই’ থাকে এই ফ্লাটে। আজ টম তো কাল হ্যারি। আমি কাউকেই চিনি না।

সার্জেন্ট নিজে কয়েকবার কলবেল বাজালো। দরজায় দমাদ্দম কিলও মারল। কোনো সাড়াশব্দ জাগল না। এমন সময় লিটা এসে ঐ ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ালো। পুলিশ দেখে লিম্যান এগিয়ে এল। বলল, ক্যা হুয়া সাব?

সার্জেন্ট জানতে চাইল, কেয়ারটেকার কোথায় থাকে? তাকে খবর পাঠাও—এই ফ্লাটের ডুপলিকেট চাবি আমার চাই।

লিম্যান লিফ্ট-কূপের কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচের দিকে মুখ করে হাঁকাড় পাড়ে, দোবেজি! তুর উপর চলা আইয়ে!

নিচে থেকে প্রতিপশ্ন হলো, কেও? ম্যয় কেঁউ উপর যাউ? তু নিচে আ যা।

বাসু সার্জেন্টকে বললেন, আমি তাহলে চলি। কোনো প্রয়োজন হলে আমার চেম্বারে ফোন করবেন।

সার্জেন্ট রাজি হলো। লিম্যানকে আদেশ দিল বাসু-সাহেবকে নামিয়ে দিতে এবং ঐ ফ্লাটের ডুপলিকেট চাবি যোগাড় করে আনতে।

নিচে এসে বাসু লক্ষ্য করলেন যে, রোহিণী-ভিলার প্রবেশপথ থেকে বাংলাদেশ মিশনের সামনে রাখা ওঁর গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, রোহিণী-ভিলা থেকে দুটি গলিপথ দুদিকে গেছে। একটি পার্কসার্কাসের দিকে, একটি বেগবাগানের মোড়ের দিকে। দ্রুত পদচারণে বাসু এসে পৌঁছালেন নিজের গাড়ির কাছে। কাচ নামিয়ে কৌশিক বলল, কী হলো? অনীশ বাড়ি নেই?

সে-কথার জবাব না দিয়ে বাসু বলেন, আমি চলে যাবার পর ওদিক থেকে একটি মেয়েকে আসতে দেখেছ? খুব জোরে হেঁটে? বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, সালোয়ার-পাঞ্জাবি পরা, পায়ে শাদা জুতো, হাতে টৰ্চ?

কৌশিক বললে, দেখেছি। একটা ফ্লাইং-ট্যাক্সি ধরে বেগবাগানের দিকে চলে গেল। ট্যাক্সিটা ডাইনে মোড় নিয়েছিল। সার্কুলার রোড ধরে, শেয়ালদার দিকে।

বাসু বলেন, ঠিকই আন্দাজ করেছি। ফলো হার—

—কী বলছেন মামু? ওকে ফলো করব কী করে? সে তো সাত-আট মিনিটের লীড নিয়েছে। এতক্ষণে পার্ক স্ট্রীটের মোড় পার হয়েছে।

—আহ্। কেন তর্ক করছ? চিনতে পারনি? ও হচ্ছে সুরঙ্গমা পান্ডে। ও বাড়ি গেছে নিশ্চয়। সোজা ওর ফ্লাটের দিকে চল। ইন্টালি বাজারে ওর ফ্লাটের কাছাকাছি গাড়িটা রাখবে। বাড়িটা আমাকে চিনিয়ে দিয়ে তুমি অপেক্ষা কর। আমি একাই যাব সুরঙ্গমার মেজানাইন ফ্লাটে।

নটা কুড়িতে ইন্টালি বাজারের কাছাকাছি কৌশিক গাড়িটা পার্ক করল। বাসুকে চিনিয়ে দিল বাড়িটা। বাসু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন মেজানাইন ফ্লোরে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে ঐ ফ্লাটের কলবেল বাজালেন। ভিতরে একটা মিঠে বাজনার সুর শোনা গেল। তারপর দোরগোড়ায় নারীকণ্ঠের প্রশ্ন হলো : কে?

বাসু অম্লানবদনে বললেন, টেলিগ্রাম!

একটু বিস্ময়মিশ্রিত প্রতিপশ্ন হলো, কার নামে?

বাসু তোলামি শুরু করলেন, মিস্ সুর…সুরা….সুরাং সিঁড়িতে আলো কম, ঠিক পড়া যাচ্ছে না। সাম মিস্ এস. পান্ডে। এই দরজা না উপরতলায় যাব?

ক্লিক্ করে অর্গলমোচনের শব্দ হলো। দরজার পাল্লাটা দশ-পনের সেন্টিমিটার ফাঁক হলো। একটি সুডৌল ফর্সা হাত বার হয়ে এল। পিছন থেকে কথার জবাবও, এই ফ্লোরেই। দাও টেলিগ্রামটা, সই করে দিচ্ছি…

বাসু হঠাৎ চাপ দিয়ে দরজাটা ঠেলে খুলে দিলেন। ভিতরে প্রবেশ করেই ঠেলে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। দুরন্ত বিস্ময়ে দু-পা পিছিয়ে গেল মেয়েটি। তার পরনে শুধু একটা হাউসকোট। মনে হলো ভিতরে কিছু নেই—শাড়ি-শায়া-সেমিজ-ব্রা। ওর চুলগুলো ভিজা। তোয়ালে দিয়ে বোধকরি এতক্ষণ মাথা মুছছিল। এখন প্রতিবর্তী-প্রেরণায় সেই তোয়ালেটাই বুকে জড়িয়ে বললে, কে আপনি? হাউ ডেয়ার য়ু…

বাসু বললেন, কাম অন, সুরঙ্গমা। ঠাণ্ডা লাগিও না। ঐ লেডিজ শালটা প্রথমে গায়ে জড়িয়ে নাও।

কথাটা ও শুনল। বোধকরি স্নানের পর শীত করছিল বলে। অথবা অপরিচিত পুরুষের সামনে অপ্রতুল গাত্রাবরণের অস্বোয়াস্তিতে। শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ও ঘুরে দাঁড়ালো মহড়া নিতে। বাসু-সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, এভাবে অনধিকার প্রবেশ করলেন কেন? কে আপনি?

জবাব না দিয়ে বাসু বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলেন টেবিলটার দিকে। তার উপর একটা টেলিফোন। ঝুঁকে পড়ে জোরে জোরে তার নম্বরটা পড়ে শোনালেন : 24-9378

মেয়েটি ওঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ছিনিয়ে নিল টেলিফোনের ‘কথামুখ’ অংশটা। সেটা বাগিয়ে ধরে বললে, এই মুহূর্তে আপনি এ-ঘর ছেড়ে চলে না গেলে আমি ইন্টালি থানায় ফোন করব কিন্তু! আপনাকে ট্রেসপসিং চার্জে…

বাসু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে জুৎ করে বসলেন। বললেন, কর। থানাও তোমাকে খুঁজছে। থানার সঙ্গে যোগাযোগ হলে ওরাই উল্টে জানতে চাইবে, অনীশ আগরওয়াল তোমার অনুরোধমতো রিঙ-ব্যাক করেছিল কিনা।

মেয়েটির সুর নামে। হাতটাও। বলে, কে অতীশ আগরওয়াল?

—অতীশ নয়, সুরঙ্গমা। অনীশ। রোহিণী-ভিলার। চিনতে পারছ না? যাকে ফোন করেছিলে দুপুরবেলা—দুটো দশ মিনিটে। তার সাড়া না পেয়ে দারোয়ানের কাছে মেসেজ রেখেছিলে…কী আশ্চর্য! এখনো মনে পড়ছে না?

টেলিফোনটা এবার ধারক-অঙ্গে নামিয়ে রাখল মেয়েটি। বললে, আপনি কিন্তু এখনো নিজের পরিচয়টা দেননি। আপনি কি থানা থেকে আসছেন?

‘থানা থেকে!” কেন? থানা থেকে তোমার খোঁজে কারও আসার কিছু কারণ ঘটেছে নাকি?

মেয়েটি জবাব দেয় না। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। বাসুই আবার জানতে চান, তোমার বাথরুমে কে আছে? এই শীতের সন্ধ্যায় ওখানে স্নান করছে কে?

মেয়েটি যেন প্রতিবর্তী-প্রেরণায় জবাবে বলে, বাথরুমে কেউ নেই।

বাসু হেসে ওঠেন। কারণ ঠিক তখনই বাথরুমে জলের কলটা বন্ধ হলো! জল্পপড়ার শব্দটাও। বাসু বললেন, ওকে বল গায়ে কিছু একটা জড়িয়ে বাইরে আসতে। তুমি জামশেদপুরে থাক, তাই হয়তো আমার নাম শোননি। ও বোধহয় আমাকে নাম শুনে চিনবে। দরজা খোলার আগে ওকে জানিয়ে দাও পি. কে. বসু, ব্যারিস্টার এসেছেন। ওর সঙ্গে দেখা করতে।

সুরঙ্গমা রুদ্ধদ্বারের কাছে গিয়ে ওঁর অনুরোধটা জানালো। গায়ে শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে বার হয়ে এল সদ্যস্নাতা একটি তরুণী। জানতে চাইল, কে তিনি? ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু? আমাকে কেন খুঁজছেন?

বাসু ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে একবার দেখতে। মাধবী। চিনতে পারছ? আধঘন্টা আগে রোহিণী-ভিলার ‘এন্ট্রেন্সে’ যাঁকে দেখে দেওয়ালে সিঁটিয়ে গেছিলে! তাই নয়?

মেয়েটি জবাব দিল না। বাণবিদ্ধ হরিণীর মতো বিস্ফারিত লোচনে শুধু তাকিয়ে থাকে। বাসু তাঁর মণিবন্ধে ঘড়ির দিকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন, সময় অত্যন্ত কম। দশ থেকে পনের মিনিট…

সুরঙ্গমা জানতে চায়, তারপর কী হবে?

—পুলিশের ভ্যানটা ইন্টালিতে পৌঁছে যাবে। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই, এবং শুনেও নিতে চাই। আমি ধরে নিচ্ছি তোমার নাম মাধবী বড়ুয়া, সাকিন গুয়াহাটি; আর তুমি সুরঙ্গমা পান্ডে, জামশেদপুরের একটি স্কুলের গেম্স টীচার। আমার আন্দাজে ভুল হলে প্রতিবাদ করো, ঠিক হলে চুপচাপ শুনে যাও। কী করে আন্দাজ করেছি জানতে চেও না। অ্যান আই কারেক্ট?

কেউ কোনো কথা বলে না। বাসু বলেন, তোমাদের মৌনতাই প্রমাণ দিচ্ছে আমার আন্দাজ ঠিক।

সুবঙ্গমা বললে, কিন্তু পুলিশে আমাদের পাত্তা পাবে কি করে?

—সহজেই। ঠিক যে পদ্ধতিতে আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। তোমার টেলিফোন কলটা একটা সহজ সূত্র। শোন মাধবী, তোমার স্বার্থ দেখবার জন্য মহাদেব জালান আমাকে ‘রিটেইন’ করেছে। আমি তোমাকে জানাচ্ছি যে, তোমার একটা প্রচণ্ড বিপদ ঘনিয়ে আসছে। আমাকে কয়েকটা কথা এক্ষুণি জানতে হবে। জনান্তিকে —

মাধবী বললে, না! সুরঙ্গমার কাছ থেকে লুকাবার মতো কোনো গোপন কথা আমার নেই! আপনি যা জানতে চান তা ওর সামনেই জানতে চাইতে পারেন। আপনার নাম আমি শুনেছি। কিন্তু আপনিই যে সেই ব্যারিস্টার বাসু তা আমি….

বাসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ইন্টেলিজেন্ট কোশ্চেন! এই দেখে নাও মাধবী। হিপ্‌-পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বার করে ওর চোখের সামনে মেলে ধরেন। বলেন, আমি তোমার সঙ্গে একমত নই, মাধবী। সুরঙ্গমার কাছ থেকে লুকাবার মতো কথা তোমার অনেক কিছু আছে। আমাকে তুমি যা বলবে তা ‘প্রিভিলেজড্ কভার্সেশান’; কোনো আদালত আমাকে বাধ্য করতে পারে না সে কথা স্বীকার করতে। কিন্তু সুরঙ্গমাকে যদি পুলিশ ডকে তোলে…

সুরঙ্গমা বাধা দিয়ে বললে, কেন ওকে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন? আমরা কিছুই জানি না। মাধবী কিছু জানে না, কিছুই দেখেনি। এ মার্ডার কেস সম্বন্ধে আমরা…

মাঝপথেই ও থেমে যায়। বাসু বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, কী বললে? ‘মার্ডার কেস’? কেন? আমি তো এখনো পর্যন্ত বলিনি কেউ খুন হয়েছে? বলেছি? কী সুরঙ্গমা?