তিন
আহারান্তে সুজাতা আর কৌশিক বাসু-সাহেবের গাড়িখানা নিয়ে বেরিয়ে গেল। রানী দুপুরে ঘণ্টাখানেক গা-গড়িয়ে নেন। তাছাড়া সকাল থেকে তাঁর একটু জ্বর-জ্বর মতো হয়েছে। তিনি ঘুমের বড়ি খেয়ে শুতে গেলেন। বাসু ‘দিবা মা শাপ্সি’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। লাইব্রেরী ঘর থেকে ‘ডানসিং উ-লী মাস্টার্স’ নামে একটি সম্প্রতি-প্রকাশিত পপুলার বিজ্ঞানের বই নিয়ে পড়তে থাকেন। কিন্তু তাতেও বাধা। বিশে এসে জানালো, একজন ভদ্রলোক সাক্ষাৎপ্রার্থী। রানী বিশ্রাম নিচ্ছেন। বাসু বলেন, সেদিন কী শেখালাম তোকে? ভিসিটার্স স্লিপে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নিয়ে আয়, আর বাইরের ঘরে তাঁকে বসা।
একটু পরে বিশ্বনাথ ফিরে এল। ভদ্রলোক স্লিপে কিছুই লিখে দেননি। পরিবর্তে নিজের তাঁর নামাঙ্কিত ছাপা কার্ড দিয়েছেন : ডঃ শান্তনু বড়গোঁহাই, এম. বি. বি. এস., ডি. জি. ও. গুয়াহাটির ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বরও লেখা আছে।
একটু পরে বাসু-সাহেবের চেম্বারে এসে উপস্থিত হলেন ডঃ বড়গোঁহাই। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। স্বাস্থ্যবান, দীর্ঘকায়। মাথার চুলগুলি পেছনে ফেরানো। চোখে চশমা নেই। সরু গোঁফ আছে। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলেন বাসু-সাহেবের টেবিলের কাছে। বললেন, নমস্কার স্যার, অসময়ে বিরক্ত করছি। জানি না, দুপুরে আপনি বিশ্রাম নেন কিনা!
বাসু বললেন, বসুন। গুয়াহাটি থেকে কবে এসেছেন? উঠেছেন কোথায়?
—এসেছি দিন-তিনেক হলো। উঠেছি একটা হোটেলে। আপনার কাছে কয়েকটা কথা জানতে এলাম। আপনাকে কি মিস্টার মহাদেব জালান অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেছেন? মাধবীর ব্যাপারে?
বাসু বলেন, কেন জানতে চাইছেন বলুন তো?
—না হলে আমিই আপনাকে ঐ কাজে নিযুক্ত করতে চাইতাম।
–কোন কাজে? মাধবী নামে কোনো মেয়েকে কি পুলিশ খুঁজছে?
—আজ্ঞে না। পুলিশে নয়। খুঁজছে মহাদেব জালান, খুঁজছি আমি। আর মহাদেব যদি আপনাকে এনগেজ করে থাকে, তবে খুঁজছেন আপনি। ভবানীভবনের মিসিং স্কোয়াড অবশ্য খুঁজছে না তাকে।
এই সময় হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। বিশে বাইরের ঘরে ঝাড়পৌঁছ করছিল। সে ছুটে গিয়ে রিসিভারটা তুলল। তুলে শুনল বাসু-সাহেব তাঁর চেম্বারে বসে এক্সটেনশান লাইনের ফোনটা তুলে কথা বলছেন। বাসু বললেন, হ্যালো? বাসু স্পিকিং….
বিশে ধারক-অঙ্গে টেলিফোনের জঙ্গম অংশটা নামিয়ে রাখল।
ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল, আমি মহাদেব বলছি। কোনো সন্ধান পাওয়া গেল?
বাসু বললেন, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? খবর পাওয়া গেলে আমিই জানাব।
—আমি আপনার সামনা-সামনি বসে কিছু কথা বলতে চাই।
—আমি এখন ব্যস্ত আছি। আপনি রাত আটটার সময় আমার চেম্বারে আসতে পারেন। তখন আপনার যা বলার আছে শুনব। আর ভাল কথা, ঐ সময় ফটোগুলো নিয়ে আসবেন। কেমন?
ক্র্যাডলে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই ডক্টর বড়গোঁহাই বলেন, জালান-সাহেব মনে হচ্ছে?
বাসু সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, লুক হিয়ার, ডক্টর! আপনার কোনো অ্যাসাইনমেন্ট আমি নিতে পারছি না। কেন, তা আপনি নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছেন। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি আপনার স্বার্থের পরিপন্থী কিছু করছি না। ভাল হয়, যদি আপনার হোটেলের ঠিকানা আমাকে জানিয়ে যান। তাহলে প্রয়োজনবোধে আমি আপনাকে কোনো তথ্য জানাতে পারি, যা আমার মক্কেলের স্বার্থবিরোধী নয়।
—অন্তত একটা কথা বলুন, স্যার। আপনার মক্কেল কি মহাদেব জালান?
—সার্টেনলি নট! আমার মক্কেল শ্রীমতী মাধবী বড়ুয়া।
—থ্যাঙ্কস্। সেক্ষেত্রে জানিয়ে যাই আমি উঠেছি রাজাবাজারের কাছে ‘পথিক হোটেলে’। ঘরের নম্বর ৩৭—ওদের প্রতি বোর্ডারের ঘরে-ঘরে টেলিফোন নেই। তবে রিসেপশানে ফোন করে কোনো বোর্ডারকে ডাকলে ডেকে দেয়। কোনো মেসেজ থাকলে লিখে রাখে, নম্বরটা রাখুন কাইন্ডলি।
বাসু হাত বাড়িয়ে স্লিপ কাগজটা নিলেন। বললেন, থ্যাঙ্কস্ ফর য়োর কাইন্ড ভিজিট।
ডক্টর বড়গোঁহাই বুদ্ধিমান। বুঝে নিলেন, এটা সাক্ষাৎকারের সমাপ্তিসূচক সৌজন্য- ধন্যবাদ। উনি উঠে দাঁড়ালেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। এদিক ফিরে বললেন, এক্সকিউজ মি, স্যার। যদি আপনার মক্কেলের সন্ধান পান, আর মনে করেন সে- খবরটা আমি জানলে আপনার মক্কেলের কোনো ক্ষতি হবে না…
বাসু ওঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, সে ক্ষেত্রে আমি নিজেই আপনাকে টেলিফোনে জানাব। উইশ য়ু বেস্ট অব লাক!
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। শীতের সন্ধ্যা হুড়মুড়িয়ে আসে। বিশেষ ধুলো আর ধোঁয়ায় যে কল্লোলিনী শহর, যেখানে পাশাপাশি শুধু ইটের উপরে ইট, মাঝেতে মানুষ কীট। বাসু- সাহেব আর রানী দেবী সচরাচর শীতের অপরাহ্ণে পশ্চিমের বারান্দায় বসে চা-পান করতেন—গত বছরও করেছেন—কারণ সূর্যের দক্ষিণায়ন হলে ঐ এক চিলতে বারান্দায় বসে সূর্যাস্তের স্বর্ণাভা উপভোগ করা যায়। যায় নয়, যেত। সম্প্রতি সেখানে একটি মালটি– স্টোরিড মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সূর্যাস্তের সোনা ছিনতাই হয়ে গেছে। তাই ইদানীং বিশে ওঁদের আপরাহ্লিক-চা ঘরেই পরিবেশন করে যায়।
রানীর জ্বরটা বেড়েছে। কাল একজন ডাক্তার ডাকতে হবে। সুজাতা আর কৌশিক ফিরে আসেনি। রানী আবার গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। বাসু একা-একা ঘর-বার করছেন। সময় আর কাটে না। শেষে টিভির চ্যানেল পালটাতে পালটাতে হঠাৎ ওয়াল্ট ডিজনের একটা পুরনো ছবি পেয়ে গেলেন। তাতেই বুঁদ হয়ে গেলেন।
একটু পরে বিশে এসে খবর দিল, একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চাইছেন। এবার আর ভুল করেনি। ভিজিটার্স স্লিপে সাক্ষাৎপ্রার্থীর নাম-ঠিকানা লিখিয়ে এনেছে : মহাদেব জালান।
বাসু বললেন, রিসেপশানে বসতে বল। আমি যাচ্ছি—
ভিতর দিক থেকেও ওঁর চেম্বারে যাবার একটা সরাসরি পথ আছে। বাসু গায়ে একটা পশমের গাউন জড়িয়ে ঐ পথে চেম্বারে এলেন। বিশে গিয়ে বাইরের ঘরে খবর দিল। একটু পরে বাইরের দরজায় সৌজন্যসূচক করধ্বনি করে মহাদেব চেম্বারে ঢুকলেন। নমস্কার করে বসলেন দর্শনার্থীর আসনে। তাঁর পরিধানে ও-বেলার সেই ব্রাউন রঙের স্যুটটাই। হাতে একটা অ্যাটাচি। সেটা চেয়ারের পাশে নামিয়ে রাখলেন।
বাসু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি একটু তাড়াতাড়ি এসেছেন।
মহাদেব বলেন, সে কি কথা? আপনি তো বলেছিলেন আজ সন্ধ্যেবেলা আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।
—না, ‘সন্ধ্যেবেলা’ বলিনি। বলেছিলাম, রাত আটটায় আসতে। এখন সাতটা বত্রিশ। মহাদেব নতুন ক্লাসিক কার্টনের সেলফোন-মোড়ক ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, কী জানেন, বাসু-সাহেব, আমার আর ধৈর্য মানছে না। ঠিক আছে, আমি না হয় আধঘণ্টা-খানেক ঐ পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসি। আটটার সময়েই আসব।
বাসু বললেন, না। তার দরকার হবে না। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আপনি বরং সামনের ঘরে ঐ ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বসুন। আই মীন, রিসেপশানে। ওখানে দেখবেন, টেবিলে অনেক ম্যাগাজিন আছে। আধঘন্টা কেটে যাবে। আমারও হাতের কাজটা সারা যাবে।
—থ্যাঙ্কু, স্যার। শুধু একটা কথা বলুন। সুকৌশলী কি এখনো কোনো সন্ধান পায়নি? মাধবী কিংবা আগরওয়ালের?
বাসু বললেন, এত উতলা হচ্ছেন কেন? ওরা দু’জন সেই খোঁজেই গেছে। এখনো কোনো খবর দেয়নি। যে-কোনো সময়ে আমি জানতে পারব। কিন্তু আমার কিছু জরুরী কাজ আছে…
—আয়াম সরি, স্যার, এক্সট্রীমলি সরি! আমি বাইরের ঘরে গিয়েই অপেক্ষা করি বরং মহাদেব উঠে চলে গেল বাইরের ঘরে। বাসু-সাহেবের সত্যিই কোনো কাজ ছিল না। ওয়াল্ট ডিজনেতে আর নতুন করে মন বসবে না। নির্জন ঘরে উনি ভাবতে বসলেন। তখন কৌশিক যে প্রশ্নটা করেছিল তার জবাবটা ওঁর জানা নেই। কৌশিক যদি কর্নার কিক্টা ঠিক মতো করতে পারে তাহলে কোন কায়দায় বলটাকে গোলে ঢোকাবেন। অনীশ আইনত কোনো অপরাধ করেনি—মানে তা প্রমাণ করা যাবে না। জামশেদপুরের সেই ডাকাবুকো মেয়েটাই বা কী করতে পারে? দু-দশ ঘা বসিয়ে দিতে পারে হয়তো—তাতে তো টাকাটা উশুল হবে না। তবে সে নাকি বলে এসেছে দ্বৈরথ সংগ্রামে তার মৃত্যু হলে যেন তার শব-ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ সেই দুঃসাহসিনী শেষ পর্যন্ত লড়বার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে। সে কি শুধু তার ক্যারাটে বিদ্যার উপরেই নির্ভর করতে চায়, অথবা তার সঙ্গে কোনো মরণাস্ত্র আছে?
হঠাৎ কী মনে হলো, উঠে দাঁড়ালেন। সন্তর্পণ পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন সামনের দরজাটার দিকে, যে দরজা খুলে মিনিট দশেক আগে মহাদেব বেরিয়ে গিয়ে রিসেপশানে বসেছে। নিঃশব্দে হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে আধ ইঞ্চি মতো ফাঁক করে চোখ লাগালেন দরজার ফাঁকে। দেখলেন, মহাদেব জালান রানী দেবীর টেবিলে টেব্ল-ল্যাম্পটা জ্বেলেছেন। একমনে রীডার্স ডাইজেস্টের একটা সংখ্যা পড়ছেন। তাঁর বাঁ-হাতে ধূমায়িত সিগ্রেট। উনি তন্ময়। বাসু নিঃশব্দেই দরজাটা বন্ধ করে নিজের আসনে ফিরে এলেন, ঠিক তখনি বেজে উঠল টেলিফোনটা। তুলে নিয়ে উনি বললেন, বাসু স্পিকিং…
—মামু! এইমাত্র হদিস পেয়েছি। সুজাতা কিছু নতুন তথ্যও সংগ্রহ করেছে। জামশেদপুর কেসটায়। সুরঙ্গমা সুজাতাকে সাহায্য করতে স্বীকৃত। তবে সে বারে বারে সুজাতাকে বলেছে আজ রাত্রে আগরওয়ালের ডেরায় না যেতে।
—ঠিকানাটা জানা গেছে?
—হ্যাঁ। বেগবাগানের কাছে। বাংলাদেশ মিশনের খানকতক বাড়ি পরে। ঐ একই রাস্তায় ‘রোহিণী-ভিলা’।
— হোটেল?
—না, অ্যাপর্টমেন্ট হাউস। বহু পুরনো বাড়ি। সাত-আট তলা উঁচু। কারনানি ম্যানসন্স- এর মতো। বোম্বাই-এর সেই ফিল্ম কোম্পানি ঐ বাড়ির একটি দু-কামরা ফ্লাটের ভাড়া গুনে যায়। অনীশ আগরওয়াল কলকাতায় এলে ঐ ফ্লাটে ওঠে। দোতলায় পুবদিকের অ্যাপার্টমেন্ট। নম্বর ২৩
—অনীশের ঘরে টেলিফোন আছে?
—না, নেই। তবে একতলায় দারোয়ানের টুলের পাশে একটা টেবিল আছে। তাতে আছে এক সার্বজনীন টেলিফোন। বোর্ডাররা পয়সা দিয়ে সেখানে ফোন করতে পারে। আবার ফোনে কেউ কোনো খবর দিলে দারোয়ান সেটা লিটম্যানের হাতে বিশেষ-বিশেষ বোর্ডারকে পৌঁছে দেয়।
—বিশেষ-বিশেষ বোর্ডার মানে?
—যারা দরাজ হাতে বকশিস্ দিতে প্রস্তুত।
—এত খবর তুমি জানলে কি করে?
—সুজাতাই জেনেছে সুরঙ্গমার কাছ থেকে।
—তা সুজাতাকে ও আজ রাত্রে অনীশের ডেরায় যেতে বারণ করল কেন?
—সুরঙ্গমা যুক্তি দেখিয়েছে—সন্ধ্যার পর পাড়াটা বড় নির্জন হয়ে যায়। সুজাতার পক্ষে তখন একা একা ওখানে যাওয়াটা বিপজ্জনক। তার মতে কাল সকালে দিনের আলোয় সুজাতার পক্ষে ও-পাড়ায় অনীশের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াই ভাল।
—অল রাইট। এবার শোন। তুমি সুজাতাকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে বল। তোমার মামিমার জ্বর হয়েছে। ঘুমোচ্ছে। সুজাতা তার দেখভাল করুক। আমি এখনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হচ্ছি। এখন সাতটা পঞ্চাশ। আমার এখানে মহাদেব জালান বসে আছে। তাকে বিদায় করে, ধর পৌনে নটা নাগাদ আমি বাংলাদেশ মিশনের গেটের কাছে পৌঁছাব। . একটু বেশি সময় নিচ্ছি, কারণ তোমার মামিমাকে রাতের খাবারটা খাইয়ে রওনা হব। তুমি আমার গাড়িটা নিয়ে ঐ মিশনের বিপরীত ফুটপাতে রাত ঠিক পৌনে ন’টায় অপেক্ষা কর। যন্ত্রটা সঙ্গে আছে তো?
—আছে। আমি ঠিক পৌনে নটায় ঐখানে থাকব।
বাসু টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। মিনিটখানেক কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর এগিয়ে এসে রিসেপশানের দরজাটা খুলে সে-ঘরে ঢুকলেন। মহাদেব একমনে পত্রিকাটা পড়ছিলেন। বাসুর পদশব্দে বইয়ের পাতায় আঙুল গুঁজে চোখ তুলে চাইলেন। বললেন, আটটা বাজল? আপনার কি এখন…
বাসু বললেন, আয়াম সরি, মিস্টার জালান। একটা জরুরী টেলিফোন এসেছিল। আমাকে এখনি বের হতে হবে। আপনি বরং একটু ঘুরে আসুন।
মহাদেব বললেন, কী দরকার? আমি বরং এখানেই অপেক্ষা করি। আপনি কখন ফিরবেন?
–ধরুন সাড়ে নয়টা।
—ঠিক আছে। আমি বরং এখানে বসে বসে এই বইটাই পড়ি। একটা দারুণ গল্প পড়ছিলাম রীডার্স ডাইজেস্টে। বড় গল্প—ঘণ্টাখানেক লাগবে শেষ হতে।
বাসু বললেন, ঠিক আছে। তবে অপেক্ষাই করুন। শুধু ফটো আর কাগজপত্র যা এনেছেন তা আমাকে দিন।
মহাদেব উঠে দাঁড়ান। রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে যান ভদ্রলোক। বলেন, আয়াম সো সরি, স্যার। ওগুলো আনতে ভুলে গেছি।…ঠিক আছে, আমি বরং সেগুলো হোটেল থেকে নিয়ে আসছি। ট্যাক্সি নিয়ে যাব আর আসব। যাতায়াতে দেড় ঘণ্টাই লাগুক। আমি সাড়ে নয়টার মধ্যেই ফিরে আসব। আমারই ভুল। মিস্টার মিত্রও আমাকে বলেছিলেন। আমি সবকিছু গুছিয়েও রেখেছি। আসার সময় সেটা অ্যাটাচিতে ভরে নিতে ভুলে গেছি।
বাসু বললেন, ঠিক আছে। আপনি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান। হোটেল থেকে ছবি আর পত্রিকার কপি নিয়ে আসুন।
মহাদেব জিজ্ঞেস করেন, ম্যাডামকে আজ দেখছি না যে? আই মীন মিসেস্ বাসু?
—ওঁর শরীরটা ভাল নেই। আপনি হোটেল থেকে কাগজপত্র নিয়ে এসে ডোরবেল বাজাবেন। আমি আমার কমবাইন্ড-হ্যান্ডকে বলে যাচ্ছি। ও দরজা খুলে আপনাকে বসাবে।
মহাদেব সম্মতি জানিয়ে বিদায় হলেন। দরজা বন্ধ করে বাসু ফিরে এলেন শয়নকক্ষে। রানী অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। না, জ্বরটা কমেছে–হয়তো ছেড়েই গেছে। বাসু নিঃশব্দে উলেন গাউনটা ছেড়ে গরম-স্যুট পরে নিলেন। ভেবেছিলেন রানী দেবীকে নৈশ আহার খাইয়ে রওনা হবেন, কিন্তু তিনি অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। ঘুম ভাঙানোটা ঠিক হবে না। সুজাতা এসে না হয় খাওয়াবে। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ড্রয়ারটা খুলে রিভলভারটা হিপ্পকেটে ভরে নিলেন। খুনোখুনি হবার কথা নয়। তবে আত্মরক্ষার অস্ত্রটা সঙ্গে থাকা ভাল। বিশেকে বললেন, শোন, আমি একটু বেরুচ্ছি। সাড়ে নটা নাগাদ ফিরে আসব। ঐ যে বাবুটি এতক্ষণ বাইরের ঘরে বসেছিলেন, উনি হয়তো তার আগেই ফিরে আসবেন। ম্যাজিক-আই দিয়ে দেখে নিয়ে তারপর দোর খুলে ওঁকে বাইরের ঘরে বসাবি
—কোন বাবু? ঐ যিনি এতক্ষণ টেলিফোন করছিলেন?
বাসু ধমকে ওঠেন, তোর মাথায় কি নিরেট গোবর পোরা? কটা বাবু বাইরের ঘরে বসেছিল এতক্ষণ? একটাই তো? তার কথা বলছি। উনি নটা সাড়ে নটা নাগাদ আবার ফিরে আসবেন। ম্যাজিক-আইয়ের ভিতর দিয়ে ভাল করে দেখে নিয়ে ওঁকে বসতে দিবি। সুজাতাদিদিও এখুনি হয়তো এসে পড়বে। অজানা লোক এসে কলবেল বাজালে দোর খুলবি না। জানালা দিয়ে কথা বলবি। বুঝলি?
বিশে বললে, না বোঝার কী আছে? এসব কথা তো জানিই।
—আবার না হয় নতুন করে জানলি। বাড়িতে তো আর কেউ নেই এখন। তাই বলছি। বিশে অবাক হয়ে বললে, মানে? বাড়িতে কেউ থাকবে না কেন? মা আছেন, আমি আছি—
বাসু চলতে শুরু করেছিলেন, থমকে থেমে পড়ে বলেন, সরি য়োর অনার! আই বেগ টু উইথড্র।
বিশে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।