বিশের কাঁটা – ২

দুই

বাসু ঘড়ি দেখলেন। বেলা দশটার কাছাকাছি। বাসু-সাহেবের জানা ছিল সমরেন্দ্র নন্দী আই. পি. এস. দশটার আগেই অফিসে হাজিরা দেন। ফলে কোনো সময় নষ্ট না করে গাড়িটা বার করেন।

বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসেছিলেন রানী। বলেন, কখন ফিরছ?

–দুপুরে এসে লাঞ্চ খাব। ক্যারামেল পুডিংটা ফ্রিজে আছে তো? না কি কালই খতম হয়ে গেল?

রানী মুখে আঁচল চাপা দেন। বলেন, বয়স যত বাড়ছে তোমার নোলাও তত বাড়ছে। বাসু স্বীকার করেন, উপায় কী? তোমার নজরদারিতে এখন তো একাহারী হয়ে পড়েছি। ওবেলা তো স্রেফ খ‍ই দুধ!

ভবানী-ভবনে দুর্নীতিদমন বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার ডি. সি. ক্রাইম সমরেন্দ্র নন্দীর সঙ্গে বাসু-সাহেবের বিশেষ খাতির। সেটা জানা ছিল তাঁর একান্ত সচিবের। তাই সরাসরি চেম্বারে উপস্থিত হতে কোনো বাধা পেতে হলো না। সুইংডোরে সৌজন্যসূচক নক করে দরজাটা ইঞ্চিখানেক ফাঁক করে বাসু জানতে চান, ভিতরে আসতে পারি? স্যার খুব ব্যস্ত নন তো?

সমরেন্দ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। প্রবীণ ব্যারিস্টারটিকে আরক্ষা বিভাগে সবাই সন্মান করে। নন্দী বলেন, আসুন, আসুন, স্যার। আজ যে এক্কেরে সাত সকালে? খুনটা হলো কোথায়?

বাসু ভিতরে এসে ওঁর দর্শনার্থীর চেয়ার দখল করে বসলেন। বললেন, অনেকদিন এ-পাড়ায় আসিনি। তোমাদের আধুনিক হালচাল তাই ঠিক জানি না। ইদানিং কি কেউ খুন না হওয়া পর্যন্ত তুমি ভিজিটার্সদের কফি-টফি খাওয়াও না?

নন্দী প্রাণখোলা হাসি হাসেন। বলেন, আপনি আধাআধি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। মানে ভিজিটার্সদের শুধু কফি খাওয়াই। প্রাপ্তবয়স্ক হলে ‘টফি’ খাওয়াই না।

ইন্টারকমে একান্ত সচিবকে আদেশ দিলেন ঘরে দু-কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে। তারপর বলেন, খুন নয় তাহলে? কী কেস? এম্বেড্লমেন্ট?

বাসু গুয়াহাটির কেসটা সংক্ষেপে বিবৃত করে বলেন, কেসটা যদিও অঙ্কুরিত হয়েছে আসামে, কিন্তু চুক্তিটা স্বাক্ষরিত হয়েছে ধর্মতলায়। ফলে আইনত, ধৰ্মত, ধর্মতলাত, এটা ক্যালকাটা হাইকোর্টের এক্তিয়ারে।

নন্দী বলেন, জানি। কেসটা নিয়ে আমরা ইতিপূর্বে প্রাথমিক তদন্তও করেছি। একজন ব্যবসাদারের পীড়াপীড়িতে। তিনি ইলেকশনে মোটা চাঁদা দেন, ফলে রাজনৈতিক চাপও ছিল।

—ব্যবসাদারটি কে? মহাদেব জালান?

—হ্যাঁ, তাই। আমরা তদন্ত করে জেনেছি যে, অনীশ আগরওয়াল ঐ ফিল্ম কোম্পানির এজেন্ট হক কথা। স্পেশাল পাওয়ার অব অ্যার্টনি হোল্ডার হিসাবে কোম্পানির তরফে সাই করার অধিকার তার ছিল। আবার চুক্তনামার ধারা মোতাবেক সেটা নাকচ করার একতরফা অধিকারও কোম্পানির ছিল। ইতিমধ্যে আপনার মক্কেল মাধবী বড়ুয়া যদি ঘুষ দিতে গিে ফেঁসে যায় তাহলে পুলিশ কী করতে পারে বলুন?

— বটেই তো! পুলিশ কিছু করতে পারে না। কিন্তু আমরা কিছু করলে পুলিশের আপত্তি নেই তো?

—আপনি কী করবেন?

—আমি একবচনে বলিনি নন্দী, বলেছি গৌরবে বহুবচনে, ‘আমরা’। আমি বুড়ো মানুষ, কী আবার করব? তবে আমার নন্দীভৃঙ্গিরা যদি উত্তম-মধ্যমের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়-

বাধা দিয়ে সমরেন্দ্র বলেন, ‘উত্তম-মধ্যমে’ আপত্তি নেই—সে তো লক্-আপের ভিতরে আমরাও দিয়ে থাকি। দেখবেন ‘অধম’ না হয়ে যায়। অর্থাৎ ভায়া-হাসপাতাল শ্মশানে না নিয়ে যেতে হয়। ঐ ডাক্তারবাবুকেও আমি সে-কথাই বলেছি।

—’ডাক্তারবাবু’ মানে?

—ঐ যে কী যেন নাম—হ্যাঁ, মনে পড়েছে শান্তনু বড়গোঁহাই। কাল বিকালে সে ঐ একই কেসে খোঁজখবর নিতে এসেছিল।

—তুমি তাকে কী বললে?

—বললাম ঐ একই কথা। আমাদের হাতে কোনো প্রাইমাফেসি কেসই নেই। কেউ কোনো এফ. আই. আর. করেনি। আর করবেই বা কী করে? অনীশ তো রসিদ দিয়ে টাকাটা নেয়নি। মাধবী কাজ হাঁসিল করতে ঘুষ দিয়েছে, যার কোনো প্রমাণ নেই। এর আবার পুলিশ-কেস হয় নাকি?

ইতিমধ্যে দু-কাপ কফি এসে গেল। কফি পানান্তে বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আমি যে ঐ কেস সম্বন্ধে খবর নিতে এসেছিলাম এটা ঐ ডাক্তার বা মহাদেবকে জানাবার দরকার নেই।

সমরেন্দ্র উঠে দাঁড়ান। বলেন, দিন স্যার, অধম-ঘেঁষা উত্তম-মধ্যম দিন। এই অনীশ আগরওয়াল জাতীয় জুয়াচোরেরা হচ্ছে ‘লেজিটিমেট র‍্যাকেটীয়ার’। এরা আইন বাঁচিয়ে মানুষজনকে ঠকায়। এদের আইন-মোতাবেক শাস্তি হয় না।

.

বাসু বাড়ি ফিরে এলেন। গাড়িটা গ্যারেজ করতে গিয়ে খেয়াল হলো তামাক ফুরিয়েছে। ওঁর বাড়ির উল্টো দিকে সম্প্রতি একটা বহুতলবিশিষ্ট বাড়ি উঠেছে। তার একতলায় একটা ছোট্ট মনিহারি দোকান খুলে বসেছে অল্পবয়সী একটি মেয়ে। বাসু-সাহেব বিশুকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন ঐ দোকান থেকেই যাবতীয় মনিহারি জিনিস খরিদ করতে। উনি নিজেও তাই করেন। কী ব্রান্ডের টোব্যাকো ওঁর মনপসন্দ তা জানিয়ে রেখেছেন মেয়েটিকে, যাতে সে আনিয়ে রাখতে পারে। মেয়েটির প্রতি ওঁর কিছু দুর্বলতা আছে। পাড়ারই মেয়ে। ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে পার্কে খেলতে অথবা বাসে চেপে স্কুলে যেতেও দেখেছেন। বাসু-সাহেবের একমাত্র সন্তানটি— যে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে—তার সহপাঠিনী ছিল এই মেয়েটি : অর্পণা। পাড়ারই একটি ছেলের সঙ্গে ভালবেসে বিয়ে হলো। কিন্তু বিধি বাম। বছর তিনেকের মধ্যেই অর্পণা বিধবা হলো। বৃদ্ধা শাশুড়ি আর শিশুকন্যাটিকে নিয়ে এই বয়সেই জীবনসংগ্রামে নেমেছে। স্বামীর একটা ইন্সিওরেন্স পলিসি ছিল। সেটুকুই ওর দোকানের মূলধন।

বাসু এগিয়ে এসে বললেন, অপুদিদি, মুন্না-মা কেমন আছে?

অপর্ণা হাসিমুখে বললে, ভাল আছে, মেসোমশাই।

—আমাকে একটা প্যাকেট টোব্যাকো দাও, আর একটা ক্যাডবেরি চকলেটের স্ল্যাব। ম্যাগনাম সাইজ।

অপর্ণা সওদা দিয়ে দাম নিল। তারপর বাসু-সাহেব ওর কাউন্টারে ক্যাডবেরি চকলেটটা নামিয়ে রেখে বললেন, এটা মুন্না-মাকে দেবে।

হঠাৎ কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল অপর্ণা। বললে, কিছু মনে করবেন না, মেসোমশাই, একটা কথা বলব?

—বল? একটা ছেড়ে দশটা কথাও বলতে পার।

—এ কথা ঠিক যে, মুন্নার মায়ের আর্থিক সঙ্গতি নেই মেয়েকে ক্যাডবেরি চকলেট কিনে দেবার। আপনি প্রায়ই…

হঠাৎ বাসু-সাহেব হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলেন অপর্ণার শাখাহীন মণিবন্ধ। ও হতচকিত হয়ে যায়। বাসু চাপা গলায় বললেন, স্টপ ইট, অপর্ণা! ঐদিকে তাকিয়ে দেখ একবার। রাস্তার ওদিকের বাড়ির বারান্দায়। তারপর তোমার বক্তব্যটা শেষ কর বরং। দেখতে পাচ্ছ? হুইল- চেয়ারে-বসা ঐ বৃদ্ধাকে? উনি কেন ঐ চেয়ারটা ব্যবহার করেন তা জান?

অর্পণার সাদা-সিঁথি মাথাটা নিচু হয়ে যায়। পাড়ার মেয়ে। সে জানে, বিশ বছর আগেকার সেই দুর্ঘটার কথাটা। ওর বাল্যবান্ধবীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ইতিবৃত্ত। বাসু ধরা গলায় বললেন, বেঁচে থাকলে সে হতভাগী আজ তোমার বয়সীই হতো। হ্যাঁ, এবার বল, কী বলছিলে?

অপর্ণা বললে, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলছিলাম। একটা প্রণাম করবার কথা বলতে যাচ্ছিলাম।

কাউন্টারের এপারে এসে মেয়েটি বাসু-সাহেবকে প্রণাম করল।

বাসু বললেন, তোমার দোকান তো বিষ্যুদ্বারে বন্ধ থাকে। বিষ্যুদ্বারে বিকালে এস না আমাদের বাড়িতে। মা-মেয়েকে নিয়ে।

অর্পণা বলল, আসব।

বাসু সওদা নিয়ে বাড়ি-পানে রওনা হচ্ছিলেন। হঠাৎ নজর হলো ওঁদের বাড়ি থেকেই বার হয়ে আসছে কৌশিক আর মহাদেব। কাছাকাছি আসতে বাসু বললেন, এতক্ষণ ধরে তোমরা কী এত আলোচনা করলে?

মহাদেব বললেন, এন্টায়ার কেস হিস্ট্রিটা ডিটেলে শোনাতে হলো কিনা।

মিস্টার মিত্র কিছু ফটো চেয়েছেন। ওবেলা দিয়ে যাব। গুয়াহাটির লোকাল কাগজে অনেক ছবি ছাপা হয়েছিল। তাছাড়া ঐ এম. পি.-র পার্টিতে একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে এনগেজ করা হয়েছিল। ওদের সকলের ফটোই আছে আমাদের কাছে—মধু, আই মীন মাধবী, অনীশ এবং শান্তনু ডাক্তারের! ওবেলা সব নিয়ে আসব। আমি উঠেছি হোটেল ডিউকে। রুম নম্বর ২০৭, দরকার হলে ফোন করবেন। হোটেলের ঘরে ঘরে ফোন আছে।

বাসু কিছু বলার আগেই মহাদেব চোখ তুলে দেখতে পেল অপর্ণাকে। একটু যেন চমকে উঠল। তারপর রাস্তা ছেড়ে এগিয়ে গেল অপর্ণার স্টলে। ক্লাসিক সিগারেটের কার্টন দেখিয়ে বললে, পাঁচ প্যাকেট দিবেন তো, দিদি।

অপর্ণার কাছে পাঁচ প্যাকেটই ছিল। নামিয়ে দিল। মহাদেব উঠে এল দোকানে। ম্যাগাজিনগুলো ঘাঁটতে থাকে—স্টার ডাস্ট, ডেবনেয়ার, আলোকপাত, মনোহর কহানিয়া সবকিছুই।

কৌশিক বললে, ঠিক আছে, আমরা চলি তাহলে?

মহাদেব অন্যমনস্কের মতো বললে, ও. কে.!

বাসু ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলতে থাকেন। কৌশিক তাঁকে অনুসরণ করে। একবার পিছন ফিরে দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখে। মহাদেব ইতিমধ্যে অনেকগুলি পত্রিকা খরিদ করেছে। ভারী ওয়ালেট বার করে দাম মেটাচ্ছে।

কৌশিক বলে, মামু, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? অপর্ণাকে দেখে মহাদেব জালান যেন একটু চমকে উঠেছিল।

অপর্ণা পাড়ার মেয়ে। কৌশিক তাকে ভালমতোই চেনে।

বাসু বললেন, হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার নজর এড়ায়নি।

—কী মনে হলো বলুন তো আপনার? মহাদেব কি অপর্ণাকে চিনত?

—না। তা মনে হয়নি আমার।

—তাহলে? তবে অপর্ণার মধ্যে অমন করে ও কী দেখছিল?

—হতভাগীটার যৌবন! মেয়েটি যে অল্পবয়সী, বিধবা, এটুকু বুঝে নিয়েছে। আন্দাজ করেছে, অর্থকৃচ্ছ্রতাও আছে। আরও কিছু সমঝে নিতে চায় বোধহয়। হোটেলে একা একা থাকে তো। তাই!

.

সেদিনই দুপুরবেলা। ঘড়িতে তখন দেড়টা। বাসু-সাহেব আর রানী বসেছিলেন বাইরের বারান্দায়। সচরাচর এই সময়ে ওঁরা মধ্যাহ্ন আহার সারেন। বিশে ভিতর থেকে এসে জানতে চাইল, দাদাবাবুরা তো এলেননি, আপনাদের দু’জনার ভাত বেড়ে দেব টেবিলে?

রানী বললেন, আর একটু দেখি বরং…

বলতে বলতে বাসু-সাহেবের গাড়িটা এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। নেমে এল কৌশিক আর সুজাতা। গাড়ি লক করে কৌশিক লাফাতে লাফাতে উঠে এল বারান্দায়। বললে, মামু! আপনার হারানো মানিকের সন্ধান পাওয়া গেছে! শ্রীমান অনীশ আগরওয়াল বর্তমানে এই কল্লোলিনী কলকাতাতেই সশরীরে বিরাজমান!

—তাই নাকি! কোথায়? তার ঠিকানা?

—বাড়ির অ্যাড্রেসটা এখনো পাইনি….

–রাস্তার নাম? পাড়া?

—এক্‌জ্যাক্ট লোকেশানটা,…মানে….

বাসু ওর কথার মাঝখানেই বলে বসেন, বাঃ বাঃ বাঃ। তবে তো সারা সকাল ধরে মস্ত কাজ করে ফেলেছ! সুতানুটির মতো ছোট্ট একটা গ্রামে অনীশকে কোণঠাসা করে ফেলেছ! আর পালাবে কোথায়? বাই দ্য ওয়ে–সুতানুটিই তো? নাকি গোবিন্দপুর?

কৌশিক একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে ধপাস্ করে বসে পড়ে। বাসু-সাহেবকে কিছু বলে না, সালিশ মানে রানী দেবীকে। বলে, দেখেছেন মামি! মামুর ঐ এক চারিত্রিক দোষ। কারও সাফল্যটা অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারেন না। লোকটা বোম্বাই নয়, চন্ডীগড় নয়, মাদ্রাজ নয়, বাঙ্গালোর নয়, খাশ কলকাতায়! অথচ উনি…

রানী বলেন, বটেই তো! তুমি দুঃখ কর না, কৌশিক। আমি বুঝতে পেরেছি। শুধু বোম্বাই মাদ্রাজ কেন, লোকটা তো আবুধাবিতেও পালিয়ে যেতে পারত, কিংবা হনলুলু। কিন্তু কীভাবে হদিস পেলে?

কৌশিক তার স্ত্রীর দিকে ফিরে বললে, তুমি বুঝিয়ে বল, সুজাতা। আমি আর কোন উৎসাহ পাচ্ছি না।

অগত্যা সুজাতাই বুঝিয়ে বলল, কীভাবে যুক্তির পারম্পর্যে ধাপে ধাপে সমস্যাটা সমাধান করে ওরা অনীশের সন্ধান পেয়েছে। প্রথম কথা : অনীশ আগরওয়ালের পরিকল্পনাটা ছিল নিশ্ছিদ্র। ডি. সি. ক্রাইমের ভাষায় একে নাকি বলে, ‘লেজিটিমেট র‍্যাকেটীয়ারিং’— আইনসঙ্গত ভাবে অপরের মস্তক বিদীর্ণান্তে পনসভক্ষণ! সেক্ষেত্রে আমরা কেন ধরে নিচ্ছি যে, অনীশ এই খেল্টা গুয়াহাটিতেই প্রথম খেলেছে? তা তো নাও হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, মাধবী অথবা মহাদেব ঐ সিনেমা-কোম্পানির কাছে অনীশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। করার উপায়ও নেই। চিত্র-প্রযোজক প্রতিষ্ঠান তো অনীশ আগরওয়ালকে নায়িকা নির্বাচনের ক্ষমতা নিবঢ় শর্তে দিয়ে রেখেছে। প্রার্থিনীকে উৎকোচ দেবার কোনো পরামর্শ তো তারা দেয়নি!

সুতরাং? যদি ধরে নেওয়া যায় যে, গুয়াহাটিতেই অনীশ তার জীবনের প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেনি, তাহলে এটাও যুক্তি-নির্ভরভাবে আশা করা যায় যে, আগের-আগের আছাড়- খাওয়া নির্বাচিতার দল একইভাবে কিল খেয়ে কিল চুরি করেছে। সেসব খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। ভূপতিতার দল আপ্রাণ চেষ্টা করেছে জানাজানিটা যত কম হয়। তা যদি ঘটে থাকে তবে সেই ঘটনাস্থল কোথায়? কলকাতায় সম্ভবত নয়। কলকাতার ব্যাপার হলে ‘সুকৌশলী’ কোনো-না কোনো সূত্র থেকে ঐ মুখরোচক কিস্সাটা শুনতে পেত। তা কলকাতায় যদি না হয় তবে ইম্ফল, ত্রিপুরা, শিলং ইত্যাদিও হবে না। সেসব শহরের লোকসংখ্যা কম, গুয়াহাটির কাছাকাছি জনপদ। সুকৌশলীর আন্দাজ হলো, অনীশ যদি একই কায়দায় আর কোনো ধনীর দুলালীকে লেঙ্গি মেরে ভূতলশায়ী করে থাকে, আর ঘটনাস্থল যদি পূর্বভারত হয় তাহলে এই কয়টি শহরের মধ্যে সম্ভবত কোনো একটিতে— ভুবনেশ্বর, কটক, পাটনা, জামশেদপুর, ধানবাদ বা রাঁচি। এই কয়টি শহরে ‘নেতি-নেতি’ পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে হবে। পূর্বভারতে একটি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কমফেডারেশনের সভ্য হয়েছে ‘সুকৌশলী’। ক্রাইম যে-হারে ক্রমবর্ধমান, আর বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ যে-ভাবে স্থানীয় শাসকদলের অঙ্গুলি হেলনে চলতে ক্রমশ অভ্যস্ত হচ্ছে, তাতে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এভাবে সঙ্গবদ্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। ওরা পরস্পরকে সাহায্য করে কমিশন বেসিস্-এ। কৌশিক একের পর একটি এস. টি.ডি. টেলিফোন করে শেষ পর্যন্ত হদিস পেল। যা আন্দাজ করেছিল ঠিক তাই। ঘটনাস্থল ইস্পাতনগরী জামশেদপুর। গত নভেম্বর মাসে সেখানে একজন উচ্চপদস্থ পারচেজ অফিসারের একমাত্র মেয়েটিকে একই পদ্ধতিতে বোকা বানানো হয়েছে। বোম্বাইয়ের ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট সম্পাদনের পরে সুরঙ্গমার বাবা পান্ডে-সাহেব একটা বিরাট পার্টি থ্রো করেছিলেন। ইস্পাতনগরীর অফিসার্স ক্লাব থেকেও সুরঙ্গমাকে একটি পৃথক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। তারপর স্ক্রীন-টেস্টের জন্য সুরঙ্গমা পান্ডে আর অনীশ আগরওয়াল বোম্বাই চলে যায়। হ্যাঁ, অনীশ বেনামে কোনো কারবার করেনি—করতে পারেও না—কারণ ফিল্ম কোম্পানি অনীশকেই নির্বাচন-দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। যাহোক, সুরঙ্গমা সেই যে বোম্বাই গেল আর জামশেদপুর ফিরে এল না! বাপিকে সে টেলিফোনে জানিয়েছিল কী- ভাবে সে বোকা বনেছে। এ-ক্ষেত্রে অবশ্য বাস্তবে বোকা বনেছেন পাণ্ডে-সাহেব স্বয়ং। কন্ট্রাক্ট সই হয়ে যাবার পর অনীশকে কালো-টাকার বান্ডিলটা তিনিই তুলে দিয়েছিলেন। সুরঙ্গমা তার বাবাকে জানিয়েছে যে, অনীশ কলকাতায় আত্মগোপন করে আছে। ফলে, সুরঙ্গমাও কলকাতা যাচ্ছে। একটা মুখোমুখি ফয়শালা করতে।

সুরঙ্গমার বয়স চব্বিশ। স্থানীয় গার্লস স্কুলের গেম্স টীচার। মেয়েদের বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় মহিলা হিসাবে বিহারের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ভাল রকম ক্যারাটে জানে। প্রচণ্ড দুঃসাহসী। তবু সে ঐ প্রাইভেট-ডিটেকটিভ এজেন্সিকে সবকিছু জানিয়ে রেখেছে। নির্ভয়ে বলেছে, যদি খবর পান যে, আমার দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়েছে, তাহলে দেখবেন দেহটা যেন পোস্টমটার্ম হয়। বলেন তো, এজন্য কিছু রিটেইনার দিয়ে যাই!

বাসু জানতে চান, তা ঐ দুঃসাহসিকা সুরঙ্গমা পাণ্ডের ঠিকানাটা কি জানা গেছে? সুজাতা বলে, তা গেছে। ইন্টালি-বাজারের কাছাকাছি একটা বাড়ির এক-কামরার মেজানাইন ফ্লোরের ফ্লাটে।

—বটে! তা মিস্ পাণ্ডে কলকাতা শহরে রাতারাতি অমন একটা এক-কামরার ফ্লাট যোগাড় করল কেমন করে? তুমি-আমি তো পাই না?

—সেসব আপনার শুনে কাজ নেই। ওর বাবা জামশেদপুরের একজন পার্চেজ অফিসার। ইন্টালি-মার্কেটের ঐ বাড়িটা একজন সাপ্লায়ারের। ঐ মেজানাইন ঘরখানা গেস্ট-রুম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ফার্নিশ্ড্। সংলগ্ন স্নানাগার ও ছোট্ট কিচেনেট। সাপ্লায়ার ভদ্রলোকের পরিচিত বিশিষ্ট মেহমানরা দু-এক দিনের জন্য কলকাতায় এলে হোটেলে না উঠে ঐ ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করেন। সুরঙ্গমা সেই সুযোগটাই নিয়েছে। ওর ঘরে একটি টেলিফোন কানেকশানও আছে।

—নম্বরটা জানা গেছে?

—নিশ্চয়। ঘণ্টাখানেক আগে কৌশিক টেলিফোন করেছিল। সুরঙ্গমা তখন ঘরে ছিল না। ঘর তালাবন্ধ করে কোথাও গেছিল। যিনি টেলিফোন ধরলেন তিনি জানালেন, সুরঙ্গমা বিকেল চারটে নাগাদ ফিরে আসবে।

রানী জানতে চান, ঘর যদি তালাবন্ধ, তাহলে টেলিফোন ধরল কে?

সুজাতা বলে, এক্সটেনশান-লাইনে দোতলায় বা তিনতলায় সম্ভবত গৃহস্বামী। মামুর যেমন আছে চেম্বারে আর রিসেপশানে।

বাসু বলেন, জামশেদপুরের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার কি জানিয়েছে যে, সুরঙ্গমা অনীশ আগরওয়ালের ঠিকানা জানে?

কৌশিক এতক্ষণে কথোপকথনে যোগ দেয়। বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। সুরঙ্গমা যে অনীশের ঠিকানা জানে একথা জানিয়েছে তার জামশেদপুরের ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি। সুরঙ্গমা তাদের বলেছে, দু-চার দিনের মধ্যেই সে যাবে ফয়শালা করতে। যদি তিন দিনের মধ্যে আবার ফোন না করে তাহলে ওরা যেন কলকাতায় এসে খোঁজ করে। যাবতীয় ব্যবস্থা করে।

রানী বলেন, যাবতীয় ব্যবস্থা মানে?

—মানে, সুরঙ্গমার ডেড বডিটা যাতে পোস্টমর্টাম হয়!

বাসু বলেন, এ তো আচ্ছা পাগল মেয়ে দেখছি!

কৌশিক আরও বলে, তাই আমাদের স্ট্যাটেজি হচ্ছে সুজাতা বিকাল চারটে নাগাদ ঐ মেজানাইন ঘরে গিয়ে সুরঙ্গমার সঙ্গে আলাপ করবে। বলবে, ওকেও অনীশ একই ভাবে লেঙ্গি মেরেছে—ভুবনেশ্বরে। তাই অনীশের খোঁজে ও কলকাতায় এসেছে টাকা আদায় করতে!

রানী এবার বলেন, শোন বাপু। তোমাদের বাকি স্ট্র্যাটেজির কথা না হয় খেতে খেতে আলোচনা কর। বেলা দুটো বেজে গেছে। বিশেও না খেয়ে বসে আছে। বার-দুই উঁকি মেরে দেখে গেছে। তাছাড়া সুজাতা তো তিনটে নাগাদ আবার বেরুবে ঐ ডাকাবুকোর সঙ্গে দেখা করতে। ও একাই যাবে তো?

বাসু বলেন, না। আমার গাড়িটা নিয়ে কৌশিক আর সুজাতা দু’জনেই যাবে। অনীশের ঠিকানা জানামাত্র আমাকে টেলিফোন করে জানাবে। আমি এখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাব। সুজাতা বাড়ি ফিরে আসবে। বাসে বা ট্যাক্সিতে। আর কৌশিক একা গাড়ি নিয়ে ঐ ঠিকানায় আমাকে ‘মীট করবে।

কৌশিক বলে, ধরুন আমরা দু’জন ওর ঘরে হানা দিলাম। দেখাও পেলাম। তারপর? অনীশ তো বে-আইনি কোনো কাজ করেনি! মানে কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। সে যে সুরঙ্গমা পাণ্ডের বাবার কাছ থেকে অথবা মাধবী বড়ুয়ার কাছ থেকে কোনো টাকা নিয়েছে এটা তো আমরা প্রমাণ করতে পারব না। ও তো স্রেফ অস্বীকার করবে। তাই না?

বাসু বললেন, তুমি শুধু বাগিয়ে কর্নার-কিটা কর তো কৌশিক। শুধু দেখ, বলটা যেন গোল-লাইনের বাইরে চলে না যায়। অনীশ-গোলকীপারকে কাটিয়ে আমি কিভাবে হেড করব সে চিন্তা আমাকেই করতে দাও। আর হ্যাঁ, তোমার যন্ত্রটা যেন সঙ্গে থাকে। বেগতিক বুঝলে অনীশ আগরওয়াল ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে পারে।

রানী বলেন, কী দরকার বাপু এসব উটকো ঝামেলায়? আর পাঁচটা ব্যারিস্টার যেভাবে প্র্যাকটিস্ করে….

কথাটা শেষ হয় না। বাসু তড়াৎ করে লাফিয়ে ওঠেন। চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেন; বিশেটা আবার কোথায় গেল? ওদিকে বেলা দুটো বেজে গেছে সে খেয়াল আছে?

সুজাতা বলে, আমি বলছিলাম কি…

—ওর নাম কি, খাবার টেবিলে বাকি কথা হবে। শুনলে না, তোমার মামিমা কী বললেন। বিশে, এই বিশে…