বিশের কাঁটা – ১৬

ষোল

বাসু পুনরায় শুরু করেন তাঁর অসমাপ্ত জবানবন্দি :

অনীশের ঘরে ঢুকে মৃতদেহটা আবিষ্কার করার আগে আমি টেবিলের উপর কাগজ-চাপার তলায় একটা চিরকুট আবিষ্কার করি। মনে হলো, নিচের দরোয়ান সেটা পাঠিয়েছে দুপুরবেলা, জানাতে যে, জনৈকা সুরঙ্গমা দেবী টেলিফোন করে অনীশবাবুর খোঁজ করছিলেন। অনীশ যেন বাড়ি ফিরে তাঁর নম্বরে রিঙব্যাক করে। নম্বরটা ছিল 24-9378; টেলিফোন নম্বর একবার শুনলে আমি সচরাচর ভুলি না। আমি কাগজটা ঐ কাগজ-চাপার নিচে যথাস্থানে রেখে দিয়েই ঘরের বার হয়ে আসি।…আগেই আমার বলা উচিত ছিল যে, আসবার সময় রোহিণী-ভিলার প্রবেশপথে একটি তরুণীকে দেখেছিলাম। সে ঐ অ্যাপার্টমেন্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে আসছিল। আমার মনে হয়েছিল, মেয়েটি রীতিমতো আতঙ্কতাড়িতা। আমাকে দেখে সে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। সার্জেন্ট দত্তরায় যে প্রতিবেশিনীর আহ্বানে খোঁজ নিতে এসেছিল সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলা বলেছিলেন যে, অনীশের বাথরুমে একটি মহিলা ‘সিনেমা কন্ট্রাক্ট’ সংক্রান্ত কী যেন বলছিলেন। তাই নিচে রাস্তায় নেমে এসে আমার স্বতই মনে হলো ঐ আতঙ্কতাড়িতা মেয়েটি হয় সুরঙ্গমা পান্ডে অথবা মাধবী বড়ুয়া। আমি কৌশিককে বললাম, সুরঙ্গমার ফ্লাটে আমাকে নিয়ে যেতে। ঠিকানাটা না জানতাম আমি, না মিস্টার জালান। কিন্তু কৌশিক জানত।

প্রায় দশ-বারো মিনিট পরে আমি সুরঙ্গমার সেই মেজানাইন-ফ্লোর ফ্লাটে পৌঁছাই। তার মিনিটখানেক আগে সুরঙ্গমা স্নান করে বাথরুম থেকে বার হয়েছে; আর শুনলাম তারপর বিশের কাঁটা মাধবী বাথরুমে ঢুকেছে। স্নান করছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ঐ বাথরুমে গীজার বা কোনো ওয়াটার-হীটার নেই। তাহলে এই জানুয়ারীর শীতে ঠাণ্ডা জলে ওরা স্নান করল কেন? দুজনেই—একের পর এক? আমার আশঙ্কা হলো রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলতে কি?

এই সময় মহাদেব জালান নন্দী-সাহেবকে বেমক্কা বলে বসে, আমার একটা কথা শুনবেন, স্যার? এঁরা দুজন তো আমাকে কিছু বলতে দিতেই চাইছেন না!

সমরেন্দ্র এদিকে ফিরে বলেন, ঠিক আছে! কী বলতে চান সংক্ষেপে বলুন। জবানবন্দি দিচ্ছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। আপনার যা বক্তব্য তা আমরা পরে শুনব। তবে একবার যখন বাধা দিয়েই বসেছেন তখন আপনার যা বলার আছে ঝটপট বলে ফেলুন। বারে বারে এভাবে ইন্টারাপ্ট করবেন না।

জালান বললে, বাসু-সাহেব অহেতুক একেবারে সেই ‘আদি কাণ্ডে রামজন্ম, সীতা-পরিণয়’ দিয়ে শুরু করেছেন। ঘটনা পর পর কী ঘটেছে আমরা প্রায় সকলেই তা জানি। আপনি অপরাধ-বিজ্ঞান নিয়ে আছেন, স্যার, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন সমস্যাটা দুটি বিশেষ বিন্দুতে সীমিত। এক নম্বর : দরজার লক-নব; দু নম্বর : অস্ত্রটা। অনীশের আলমারির পিছনে যে রিভলভারটা পাওয়া গেছে—আপনারা প্রকাশ্যে স্বীকার করুন বা না করুন—সেটাই মার্ডার ওয়েপন। ব্যালাসট্রিক এক্সপার্টের মতে, ওতে পাঁচটা তাজা বুলেট ছিল, একটি এক্সপ্লোডেড, যেটা অটোপ্সি-সার্জেন মৃতের দেহের ভিতর থেকে উদ্ধার করছেন?

সমরেন্দ্র বাধা দিয়ে বলেন, আপনি এসব কথা কীভাবে অনুমান করছেন?

মাথা ঝাঁকিয়ে মহাদেব বললে, মেনে নিলাম স্যার, সৌজন্যের খাতিরে, পয়সা খরচ করলে কলকাতার বাজারে বাঘের দুধ পাওয়া যায় না। ছেড়ে দিন সে-কথা। আপনি নিজে তো তা জানেন? তাহলে? বিশ-বাইশ বছরের দুটো লেড়কি শীতের সন্ধ্যায় কেন স্নান করছে এসব কি রেলিভেন্ট টপিক? রিভলভারের লাইসেন্সটা ডক্টর বড়গোঁহাইয়ের নামে। তা দিয়ে সুরঙ্গমা বা মাধবী কি অনীশকে খুন করতে পারে? পারে না। পারে দুজন। এক, ডক্টর শান্তনু বড়গোঁহাই নিজে, অথবা…

—অথবা, থামলেন কেন? বলুন?

—আমার প্রশ্ন করা শোভন হবে না। আপনারা জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন স্যার, যে শনিবার রাত্রে আগরওয়াল খুন হয়, সেদিন বেলা আড়াইটার সময় শান্তনু ডাক্তার ঐ বাসু- সাহেবের চেম্বারে গিয়ে দেখা করেছিল কিনা, এবং সে সময় তার হাতে একটা ছোট্ট অ্যাটাচি ছিল কি না!

সমরেন্দ্রকে প্রশ্নটা পেশ করতে হলো না। বাসু নিজে থেকেই বললেন, হ্যাঁ দুটো অনুমানই সত্য। ঐ দিন দুপুরে ডক্টর বড়গোঁহাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল এবং তার হাতে একটা অ্যাটাচি ছিল। সো হোয়াট?

সমরেন্দ্র জালানের দিকে ফিরে বলেন, তা থেকে কী প্রমাণ হয়?

মহাদেব সবিনয়ে বললে, না স্যার, প্রমাণ করার দায় আমার নয়, আমি শুধু সমস্যার অনুদ্‌ঘাটিত একটা দিক দেখাতে চাইছিলাম, এই আর কি!

সমরেন্দ্র বললেন, দ্যাটস অল! আর মাঝখানে বাধা দেবেন না। নিন মিস্টার বাসু, আপনি শুরু করুন।

বাসু বললেন, যে-কথা বলছিলাম। আমার আশঙ্কা হলো অনীশ আগরওয়ালের মৃত্যুর পর ওদের দুজনের অন্তত একজন সে ঘরে ঢুকেছে। মাধবী অথবা সুরঙ্গমা! একজনের জামাকাপড়ের রক্ত অপরজনের পোশাকে লেগেছে। অথবা ওরা দুজনেই হয়তো ঐ ঘরে ঢুকেছে অনীশ খুন হওয়ার পর। মিস্টার জালান যে প্রশ্নটা তুলেছেন—মার্ডার ওয়েপন—সেটা তখন ছিল অজানা তথ্য। ফলে আমার মনে হয়েছিল, এদের দুজনের যে কেউ খুনটা করে থাকতে পারে। একটু তৎপর হতেই সেসময় জানতে পারি, ঘটনার সময় সুরঙ্গমার পাক্কা অ্যালেবাঈ আছে। সে তার কাজিন ব্রাদারের সঙ্গে তখন থিয়েটার দেখছিল। আমার আশঙ্কা হলো, মাধবীকে পুলিশ অচিরে অ্যারেস্ট করতে পারে। তাই কৌশিকের গাড়িতে আমার মক্কেলকে অন্য একটা হোটেলে পাঠিয়ে দিলাম। স্বনামে একটা সিঙ্গল-সিটেড ঘর নিতে বললাম!

তারপরইে ঐ ইন্টালী মার্কেটের একটা দোকান থেকে আমার বাড়িতে ফোন করি। সুজাতা ধরে। বলে, মিস্টার জালান ইতিমধ্যে হোটেল থেকে তাঁর কাগজপত্র আর ফটো নিয়ে আমার বাড়ি ফিরে এসেছেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। যেমন কথা হয়েছিল….

—জাস্ট এ মিনিট!― হঠাৎ আবার বাধা দেয় মহাদেব। বলে, আপনি একটা কথা মিস্‌ করছেন। সুজাতা দেবী আপনাকে জানিয়েছিলেন যে, ডিউক হোটেল থেকে আধঘন্টা আগে আপনার বাড়িতে আমি ফোন করেছিলাম। জানতে, যে আপনি ফিরে এসেছেন কি না।

বাসু বিরক্ত হয়ে বললেন, হঠাৎ সে-কথা কেন? আপনি কী বলতে চাইছেন?

মহাদেব কায়দা করে বলে, ফ্যাক্ট! তথ্য! সত্যঘটনা! আপনি কি প্রতিবাদ করছেন? হোটেল থেকে আপনাকে আমি ফোন করিনি? ঠিক নটা বেজে বারো মিনিটে?

বাসু বললেন, জানি না। তবে সে-কথা আপনি বলেছিলেন। তা সে যাই হোক যে-কথা বলছিলাম, আমি মিস্টার জালানকে আমার অফিসে অপেক্ষা করতে বলি। উনি রাজি হন না। কারণ রাত দশটায় ওঁর নাকি একটা জরুরী বিজনেস অ্যাপায়েন্টমেন্ট ছিল ডিউক হোটেলে। তাই উনি আমাকে ডিউক হোটেলে রাত সওয়া দশটায় দেখা করতে বললেন। তার আগে অবশ্য আমি ওঁকে টেলিফোনে জানিয়েছিলাম যে, অনীশ আগরওয়াল খুন হয়ে গেছে!

—সরি টু ইন্টারাপ্ট এগেন। আপনি সেই সময় টেলিফোনে—তখন আই. এস টি. —নটা চল্লিশ আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আপনি অনীশ আগরওয়ালের ঘরে গিয়ে পৌঁছান রাত আটটা পঞ্চাশে। দেখেন যে, অনীশ স্টোন ডেড। বুলেট উন্ড। গুলিটা বুকের বাঁ-দিকে লেগেছে। অনীশের গায়ে কোনো জামা বা গেঞ্জি নেই। পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার! এসব কথা আপনি আমাকে বলেছিলেন না বলেননি?

বাসু মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, কারেক্ট। ঐসব কথা আমি ঐ সময়েই বলেছিলাম।

মজুমদার বলে ওঠেন, মিসেস বাসু, আপনি টাইমিংগুলো সব নোট করেছেন তো?

রানী সংক্ষেপে বলেন, করেছি! বারে বারে একই প্রশ্ন করার দরকার নেই। আমার অসুবিধা হলে বক্তাকে থামিয়ে দেব, ‘বেগ য়োর পার্ডেন’ বলে।

সমরেন্দ্র বলেন, নিন, বাসু সাহেব, শুরু করুন।

—আমি ডিউক হোটেলে মিস্টার জালানের ঘরে যখন ঢুকি তখন আই. এস. টি. দশটা তের। তার মানে, আমার টেলিফোন পাবার পর মিস্টার জালান তেত্রিশ মিনিট সময় পেয়েছিলেন। অর্থাৎ ট্যাক্সিতে আসতে ওঁর যদি কুড়ি মিনিট সময় লেগে থাকে— নিউ আলিপুর টু লিন্ডসে স্ট্রিট যা মিনিমাম টাইম-সে-ক্ষেত্রে উনি তের মিনিট সময় পেয়েছিলেন। তার ভিতর উনি ওঁর বিজনেস অ্যাপয়েন্টমেন্টটা সারেন, লোকটিকে বিদায় করেন, স্নান করেন, এবং গ্রে রঙের সফরি স্যুটটা ছেড়ে সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিধান করে আমার জন্যে প্রতীক্ষা করছিলেন। ইন জাস্ট থার্টিন মিনিট্স। অ্যাম আই কারেক্ট, মিস্টার জালান।

জালান কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। সমরেন্দ্র প্রশ্ন করেন—ঐ তের মিনিটের কি কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে, মিস্টার বাসু?

—আমি তাই মনে করি। আমার জবানবন্দিটা শেষ হলে বোঝা যাবে।

—অলরাইট। প্লীজ প্রসীড়!

—মিস্টার জালান আমাকে রাতের ডিনার খেয়ে যেতে বলেন। আমি রাজি হয়ে যাই। ডিনার খেতে খেতে উনি আমাকে বুঝিয়ে দেন যে, ঘটনাচক্রে রঙের টেক্কাখানা ওঁর হাতে। অর্থাৎ আমি যে পুলিশ আসার আগে ও-ঘরে ঢুকেছিলাম এবং হত্যার কথাটা পুলিশকে বলিনি—মক্কেল হিসাবে বিশ্বাস করে এই যে কথাটা বলি—এটাই ওঁর রঙের টেক্কা। এটা যতক্ষণ ওঁর কব্জায় তখন ওঁর ইচ্ছামতো আমাকে চলতে হবে। সর্ট অব ব্ল্যাকমেইলিং আর কি!

সে যাই হোক, পরদিন সকালেই খবর পেলাম, মাধবী এবং শান্তনু তাদের হোটেল ছেড়ে পালিয়েছে। পুলিশ দুজনকেই খুঁজছে। এই নিরুদ্দেশ হওয়াটা খুবই অনভিপ্রেত পুলিশের দৃষ্টিতে। পরে দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওরা নাকি মিসেস রানী বোসের নির্দেশ মতো আত্মগোপন করেছিল। মিসেস বোস, মানে আমার স্ত্রী, আমার সেক্রেটারি এমন নির্দেশ ওদের দুজনের কাউকেই দেয়নি। ফলে ঘটনার আবর্তে এসে উপস্থিত হলো একজন অজ্ঞাত মহিলা। যে রানী বাসু সেজে রবিবার বেলা নটা নাগাদ শান্তনুকে পথিক হোটেলে, আর মাধবীকে সোনার বাঙলা হোটেলে পৃথক পৃথকভাবে টেলিফোন করে নির্দেশ দিয়েছে ফেরার হতে।

মজার কথা এই যে, মাধবী বড়ুয়া কোন হোটেলে রাত দশটার পর উঠেছে তা জানে সে নিজে, আমি আর কৌশিক। চতুর্থ কেউ নয়। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ অজ্ঞাত মহিলা কেমন করে সেই হোটেলের টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করল?

হঠাৎ মহাদেবের দিকে ফিরে বাসু প্রশ্ন করেন, বাই দ্য ওয়ে, মিস্টার জালান, আপনি কি মমতা বা মমতাজ নামে কোনো কলকাতার কলগার্লকে চেনেন?

মহাদেব নিপাট বিস্ময়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। বলল, থ্যাংক গড! কোনো কলগাৰ্লকেই চিনি না আমি। মমতা বা মমতাজকেও নয়। হঠাৎ এ-কথা কেন?

—অথবা জুলি মেহ্তা নামে কোনো ফ্রি-লান্সারকে?

ভ্রূকুঞ্চন হলো জালান-সাহেবের। বললেন, জুলি মেতা? জাস্ট আ মিনিট! হ্যাঁ, ও নামটা শোনা-শোনা। দিন কয়েক আগে এখানকার একটা ‘ক্লারিক্যাল সার্ভিসিং এজেন্সিকে’ ফোন করে একটা স্টেনো-টাইপিস্ট চেয়েছিলাম। আমার একটা লীগ্যাল ডকুমেন্টের ডিকটেশান নিতে। ওরা যে মেয়েটিকে পাঠিয়েছিল তার নাম জুলি। জুলি সাক্‌সেনা অথবা জুলি মেহ্তা ঠিক মনে নেই। সে আমাকে একটা বিরাট রিপোর্ট টাইপ করতে সাহায্য করে। কেন বলুন তো?

সে-কথায় কান না দিয়ে বাসু বলেন, দুর্ঘটনার পরদিন সকালে আরও একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটে। একজন বিবাহিতা মহিলা সুকৌশলী ডিটেকটিভ এজেন্সিতে এসে সাহায্য প্রার্থনা করে। নিজের পরিচয় সে দিয়েছিল মিসেস শান্তনু বড়গোঁহাই বলে। গুয়াহাটির একজন ম্যারেজ- রেজিস্ট্রারের সার্টিফিকেটের জেরক্স কপিও দেখায়। সে সুকৌশলীকে বলে যে, মিস্টার জালান আমাকে মাধবীর তরফে এনগেজ করছেন অনীশ আগরওয়ালের হত্যা মামলায়। সেই খুনের অপরাধে যাতে মাধবী জড়িয়ে না পড়ে তাই আমি আর মিস্টার জালান নাকি যৌথভাবে ডক্টর শান্তনু বড়গোঁইকে ফাঁসাতে চাইছি। মেয়েটি বলে, সে শান্তনুর সঙ্গে একই প্লেনে গুয়াহাটি থেকে কলকাতা এসেছে; কিন্তু রবিবার সকালে স্ত্রীকে হোটেলে ফেলে ডক্টর বড়গোঁহাই ফেরার হয়েছে। যথেষ্ট টাকাকড়ি অবশ্য রেখে গেছে, যাতে শান্তনুর স্ত্রী গুয়াহাটিতে ফিরে যেতে পারে। সুকৌশলী কেসটা নিতে ইতস্তত করে। আমার পরামর্শ চায়। আমি ওদের বলি যে, ওদের প্রতিষ্ঠান আমার সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত। ওরা যা ভাল বুঝবে তাই করবে।…ওরা কেসটা নিয়েছিল কি না জানি না। তবে আমি সেই মেয়েটির দুটো ফটো তুলে নেবার ব্যবস্থা করি—টেলিফটো-লেন্সে। মেয়েটি জানতেও পারেনি। একটা সামনে থেকে, একটা পাশ থেকে।

এইখানে জবানবন্দি থামিয়ে বাসু তাঁর পকেট থেকে খান-কতক ফটো বার করলেন। একজোড়া ফটো কৌশিক ও সুজাতার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এই মেয়েটিই কি মিসেস বড়গোঁহাই পরিচয়ে তোমাদের কাছে এসেছিল?

ওরা দুজনে দৃকপাতমাত্র স্বীকার করল।

বাসু বলেন, কৌশিক তুমি কি সেই রবিবার সাত-সকালে, সরি, সাত নয়, ছয়-সকালে, এই মেয়েটিকে মাধবীর টেলিফোন নম্বরটা জানিয়েছিলে? ভবানীপুর সোনার বাঙলা হোটেলের?

কৌশিক নতনেত্রে বলে, ইয়েস। তখন আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, ঐ মেয়েটি ডাক্তার শান্তনু বড়গোঁহাই-এর বৈধ স্ত্রী। আমাদের মনে হয়েছিল মাধবী জানে না যে, ডাক্তার বড়গোঁহাই বিবাহিত। তাই মাধবীকে সে তথ্যটা জানাবার অধিকার ও দায়িত্ব আমরা মিসেস বড়গোঁহাইকে দিয়েছিলাম।

—ওয়ান উইকেট ডাউন! একটা সমস্যা মিটল। হত্যাকারী—তা সে যেই হোক— এই মেয়েটিকে অর্থমূল্যে নিয়োগ করেছিল। মেয়েটি প্রফেশনাল কলগার্ল। সচরাচর বিবাহ- বিচ্ছেদের মামলায় অভিনয় করে লোককে ফাঁসায়।

মমতা বা মমতাজ ওর নাম। তবে উপাধিটা সাক্সেনা না মেহ্তা তা ঠিক জানি না। আপনি জানেন মিস্টার জালান।

বাসু-সাহেব একজোড়া ফটো—একটা সামনে থেকে, একটা পাশ থেকে তোলা—বাড়িয়ে ধরেন জালানের দিকে।

নিরুপায়ভাবে ফটো দুটি নিয়ে নির্বাক বসে থাকে জালান।

সমরেন্দ্র নন্দী প্রশ্ন করেন, কী হলো? মিস্টার জালান? এই মেয়েটিই কি আপনার টেম্পরারি স্টেনো-টাইপিস্ট জুলি কি-যেন?

জালান এতক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলে, হ্যাঁ, অনেকটা সেই রকমই দেখতে মনে হচ্ছে বটে।

সমরেন্দ্র ঝুঁকে পড়ে বলেন, আপনি কোন্ ‘ক্লারিক্যাল সার্ভিস এজেন্সির’ মাধ্যমে এই মেয়েটিকে রিক্রুট করেছিলেন বলুন তো?

জালান ইতস্তত করতে থাকে। বাসু বলেন, তার প্রয়োজন হবে না সমরেন্দ্র। তুমি এই ফটো জোড়া নাও। ওর পিছনে একটা হোটেলের নাম, অ্যাড্রেস আর রুম নম্বর লেখা আছে। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি। মেয়েটি এখন ওখানেই আছে। আমার গোয়েন্দার নজরবন্দি হয়ে। আধঘন্টার মধ্যেই ওকে অ্যারেস্ট করা যাবে।

সমরেন্দ্র ফটোটা নিয়ে তার পিছন দিকটা দেখে সেটা মজুমদারের হাতে দিলেন। মজুমদার দিলেন ভৌমিককে। বললেন, গাড়িটা নিয়ে হোটেলে যাও। মেয়েটিকে অ্যারেস্ট করেই এখানে একটা ফোন কর। তারপর এখানে নিয়ে এস। মিস্টার কৌশিক মিত্রকে দিয়ে আইডেন্টিফেকেশানটা সেরে ফেলা যাবে।

সমরেন্দ্র বলেন, শুধু কৌশিকবাবু কেন? মিস্টার জালানও বলতে পারবেন মেয়েটি জুলি সাক্সেনা অথবা জুলি মেহ্তা কি না।

মহাদেব কোনো কথা বলল না।

বাসু এবার জালানের দিকে ফিরে বললেন, মিস্টার জালান, একটা কথা। আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো—সেই ঘটনার রাত্রে, শনিবার, আমি যখন রওনা হয়ে পড়লাম বেগবাগানের দিকে আর তার ঠিক আগে আপনি চলে গেলেন ডিউক হোটেলে, সেইদিন হোটেলে পৌঁছে অহেতুক আমাকে একটা ফোন করেছিলেন কেন? রাত ন’টা বারোয়?

—অহেতুক কেন হবে? আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনি ফিরে এসেছেন কি না।

—হোটেলে নিজের ঘর থেকেই ফোনটা করেছিলেন তো?

—অফকোর্স।

—আর রাত নটা সতেরয় সুরঙ্গমার ফ্ল্যাটে ফোন করেছিলেন কোথা থেকে?

—কে? আমি? কী বকছেন মশাই পাগলের মতো? সুরঙ্গমার ফোন নম্বর কি আমি জানতাম যে, ফোন করব?

—জানতেন নিশ্চয়ই। কারণ সেই রাত্রে আপনি তো সুরঙ্গমার ফ্ল্যাটে দু-দুবার ফোন করেছিলেন। প্রথমবার মাধবী যখন স্নান করছে—রাত নটা সতেরয়। দ্বিতীয়বার হোটেল থেকে রাত এগারোটা দশে, তাই নয়?

জালান বলে, কীসব যা-তা বকছেন মশাই! আপনি নিজেই তো বললেন, মাধবী কোথায় উঠেছে তা আমি জানতাম না। তাহলে আমি সুরঙ্গমা পাণ্ডের টেলিফোন নম্বর জানব কী করে?

—ঠিক যেভাবে আমি জেনেছিলাম, ঠিক যেভাবে পুলিশ জেনেছিল!

সমরেন্দ্র সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, তার মানে?

—তার মানে পুলিশ মৃতদেহ আবিষ্কারের আগে আমি ঐ ঘরে ঢুকে মৃতদেহটা প্রত্যক্ষ করেছিলাম—ফ্যাক্ট! কিন্তু আমি ও-ঘরে ঢোকার আগে মিস্টার জালান ঐ অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিলেন—সেটাও ফ্যাক্ট! বাইরের ঘরে কাগজ-চাপা দেওয়া দরোয়ানের স্লিপটা উনিও দেখেছিলেন। তারপর অনীশের বেডরুমে ঢুকে তার দেখা পান—উর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, নিম্নাঙ্গে আন্ডারওয়্যার। অনীশ কোনো কথা বলার আগেই জালান ফায়ার করে। অনীশ লুটিয়ে পড়ে। মার্ডার-ওয়েপনটা আলমারির পিছনে ছুঁড়ে ফেলার আগে আঙুলের ছাপ মুছে নিতে ভোলেনি। তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়।

ঘরে আলপিনপতন নিস্তব্ধতা।

হঠাৎ জোরে জোরে হাততালি দিয়ে ওঠে মহাদেব জালান! তারপর অবাক হবার ভান করে বলে, এ কী! আপনারা এই আপ্তবাক্যের ‘মনোলগে’ হাততালি দিচ্ছেন না যে?

সমরেন্দ্র সে-কথায় কর্ণপাত না করে বাসুকে বলেন, মাথার বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো এভিডেন্স আছে?

—ভৌমিক জুলি মেহ্ত্তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলেই তা পাবেন? এই মমতাজই, সেই মিসেস বড়গোঁহাই।

জালান রুখে ওঠে, অ্যাশুমিং তাই দেখা গেল। তাতে কী প্রমাণ হবে, মিস্টার বাসু?

–হয়তো দেখা যাবে সে ডিকটেশান নিতে জানে না, টাইপিং করতেও জানে না।

—তাতেই বা কী প্রমাণ হবে? বড়গোঁহাইয়ের রিভলভারটা আমার হাতে কীভাবে এল এ প্রশ্নের জবাব তাতে মিলবে? তাছাড়া অনীশের মৃত্যুসময় — সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টা—আপনার নিজের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী তখন আমি হয় ট্যাক্সি চেপে নিউ আলিপুর থেকে লিন্ডসে স্ট্রিটে যাচ্ছি, অথবা হোটেল থেকে আপনাকে ফোন করছি, কিংবা হোটেল থেকে নিউ আলিপুরে ফিরে আসছি! সবচেয়ে বড় কথা, অনীশ আগরওয়াল যে রোহিণী-ভিলায় থাকে এটা আমি প্রথম জানতে পারি রাত নটা চল্লিশে। যখন আপনি আমাকে টেলিফোন করে খবরটা দিলেন। তার পূর্বে আপনি নিজেই মৃতদেহটা দেখেছেন।

বাসু-সাহেব মিস্টার নন্দীর দিকে ফিরে বললেন, মিস্টার জালান তিন-তিনটি বিরুদ্ধ যুক্তি দেখিয়েছেন। প্রথম প্রশ্ন : বড়গোঁহাইয়ের রিভলভারটা উনি কী করে পেলেন। সেই ব্যাখ্যাটা প্রথমে দিই, মাধবী আমাকে বলেছিল, শান্তনু একটা রেন্ট-আ-কার নিয়ে তাকে বেগবাগানে পৌঁছে দেয়। তার ড্যাশবোর্ডে শান্তনুর নিজস্ব রিভলভারটা রাখা ছিল। মাধবী সেটা দেখে ভয় পায়। বিশেষত, শান্তনুর রাগের মাথায় বলেছিল—অনীশকে গুলি করে মারা উচিত। তাই অনীশের ঠিকানাটা সে শান্তনুকে জানায়নি। রোহিণী-ভিলার কাছাকাছি মাধবী নেমে যায়। বলে সে টয়লেটে যাচ্ছে। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পিছনের দ্বার দিয়ে পালিয়ে যায়। এ পর্যন্ত যা বলছি তা ফ্যাক্ট, প্রমাণ করা যাবে। বাকিটা আমার অনুমান। জালান সে সময় রোহিণী-ভিলার কাছাকাছি। সে গাড়ি থেকে মাধবীকে নেমে যেতে দেখে। একটু পরে শান্তনুও যায় তার খোঁজে। জালান ফাঁকা গাড়িটার কাছাকাছি এসে দেখতে যায়—কী-বোর্ডে চাবিটা লাগানো আছে কি না। থাকলে, গাড়িটা চালিয়ে সে কিছু দূরে গাড়িটাকে রেখে আসত। যাতে শান্তনু আর মাধবী এসে গাড়িটা না পেয়ে কিছু খোঁজাখুজি করে। তাতে জালান মিনিট দশেক সময় পেয়ে যেত। ঐটুকু সময়ই তার পক্ষে যথেষ্ট। কারণ তার অ্যাটাচিতে তখন ছিল তার নিজস্ব লোডেড রিভলভার। আমার বিশ্বাস, সেটা এখনো ওর অ্যাটাচিতে আছে।

মহাদেব প্রতিবর্তী প্রেরণায় তার অ্যাটাচির দিকে হাত বাড়ানো মাত্র নন্দী-সাহেব ঝুঁকে পড়ে বাধা দেন। অ্যাটাচিটা নিজের দিকে সরিয়ে রাখেন। বাসুকে বলেন, প্লীজ প্রসীড়!

—শান্তনু যখন মাধবীর সন্ধানে রেস্তোরাঁয় যায়—আমার অনুমান—তখন সে গাড়িটা লক করে যায়নি। কিন্তু চাবিটা নিয়ে গিয়েছিল। জালান ড্রাইভারের দিকের দরজাটা খুলে দেখে কী-বোর্ডে চাবি নেই। ড্যাশবোর্ডে আছে কিনা দেখতে সে ঐ ড্যাশবোর্ডের নব ধরে টানে। সেটা খোলা ছিল। শান্তনু এটা অত্যন্ত অন্যায় করেছিল। উত্তেজনায় সে খোলা ড্যাশবোর্ডে রিভলভারটা রেখে মাধবীর খোঁজ নিতে যায়। জালান ‘ছপ্পড়-ফোঁড় জ্যাকপট’ পেয়ে গেল। সে আর ডানে-বাঁয়ে তাকায়নি। আমার বিশ্বাস জালান যখন অনীশকে হত্যা করে তখন সুরঙ্গমা ছিল ওর বাথরুমে। মাধবী আসে তার পরে। আসলে মাধবী একটা প্রচণ্ড ভুল করেছিল। তার ধারণা, খুনটা শান্তনুই করেছে। তাই তার ডিফেন্সের ব্যবস্থা করতে সে জালানকে বিবাহ করতে পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। আমি জানি না—জালানের মূল উদ্দেশ্যটা কী। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, অথবা শান্তনুকে নিজের সাফল্যের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এটুকু জানি, মাধবী একটা প্রকাণ্ড ভুল করেছে। সে ভেবেছিল, শান্তনু তাকে কোনোভাবে অনুসরণ করে অনীশের ঠিকানাটা জানতে পারে। বোকা মেয়েটা ভেবে দেখেনি যে, তাকে অনুসরণ করে শান্তনু কিছুতেই অনীশের মৃত্যুর পূর্বে তার ঠিকানায় পৌঁছাতে পারত না!

বাসু থামলেন। আবার ঘনিয়ে এল নৈঃশব্দ্য। শুধু কাগজের উপর ডট পেনের খস্থস্ শব্দ। রানী মহাভারত লিখে চলেছেন!

মাধবী বলে ওঠে, আমি একটা কথা বলতে পারি?

সমরেন্দ্র বলেন, বল?

—বাসুদাদু যা বললেন, তা সত্যিই ঘটেছিল কি না আমি জানি না, তবে এটুকু জানি যে, গাড়ির ড্যাশবোর্ডে শান্তনুর রিভলভারটা ছিল। আর ও-কথাটাও সত্যি…মানে আমি ভেবেছিলাম শান্তনুই খুনটা করেছে। আমাকে অনুসরণ করে!

মহাদেব মাধবীর দিকে একটা আগুনঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললে, মিস্টার বাসু। আপনি একজন আইনজ্ঞ লোক। আপনি নিশ্চয় জানেন, এজাতীয় অনুমান-নির্ভর আষাঢ়ে গল্প আদালত শুনতে চান না।

বাসু বললেন, হ্যাঁ শুনেছি বটে। জজ সাহেবরা গল্প-টল্প শুনতে ভালবাসেন না। ওঁরা চান শুধু কংক্রিট এভিডেন্স। কিন্তু এটা তো আদালত নয়। আমার আষাঢ়ে গল্পটা এঁরা যখন উপভোগ করছেন তখন শেষ করেই ফেলি। আপনি তিনটি বিরুদ্ধ যুক্তি পেশ করেছিলেন। এক নম্বর : শান্তনুর রিভলভার প্রাপ্তি, দু নম্বর সুরঙ্গমার টেলিফোন নম্বর প্রাপ্তি। অনুমান- নির্ভর দুটি প্রাপ্তিযোগেরই আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েছি। সম্ভাব্য, যুক্তিগ্রাহ্য, অনুমান-নির্ভর ঘটনাপরম্পরা। অবশ্য স্বীকার্য : এভিডেন্স কিছু দাখিল করিনি আমি। আপনার তৃতীয় যুক্তিটা ছিল, অ্যালেবাঈ। তার জবাবটা দিই, আপনি আমার মিনিট পাঁচেক আগে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দেন। আমি কিছুটা দেরি করি বেডরুমে গিয়ে আমার অসুস্থা স্ত্রীর তত্ত্ব-তালাশ নিতে, পোশাক বদলাতে। আপনার অ্যাটাচিতে শুধু লোডেড রিভলভার নয় ঐ ফটোগুলোও ছিল। আপনি আদৌ ডিউক হোটেলে যাননি। সোজা বেগবাগান চলে যান। রোহিনী-ভিলায়…

সমরেন্দ্র বাধা দিয়ে বলেন, জাস্ট আ মিনিট! কিন্তু উনি অনীশ আগরওয়ালের ঠিকানাটা জানলেন কী করে?

বাসু বললেন, খুব সহজে। কৌশিক যখন শনিবার সন্ধ্যাবেলায় আমাকে ফোন করেছিল তখন আমি সেটা ধরেছিলাম খাশ কামরায়। কৌশিক রোহিণী-ভিলার অবস্থান আর অনীশের রুম নম্বরটা টেলিফোনে বলেছিল। ঐ সময় মিস্টার জালান একা বসেছিলেন আমার রিসেপশানে। কৌশিকের রিঙিং টোন একসঙ্গে দু-ঘরেই বেজেছে। আমি যেমন চেম্বারে বসে রিসিভারটা ক্র্যাডল থেকে তুলছি, মিস্টার জালানও তেমনি বাইরের ঘরে বসে তাই করছেন। কৌশিকের এবং আমার সব কথাই উনি চুপচাপ শুনে যান। এ জাতীয় অসভ্যতায় তিনি অভ্যস্ত। গত তিন দিনে আমি বার দুই-তিন ওঁকে আড়ি পাততে দেখেছি। ফলে, অনীশের ঠিকানা ও রুম নম্বর উনি জানতেন।

জালান কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাসু-সাহেবের চেম্বারে টেলিফোনটা বেজে উঠল। কৌশিক একলাফে সে-ঘরে চলে যায়। গিয়ে দেখে বিশে তার আগে আগেই টেলিফোনটা তুলে বলছে, রঙ নাম্বার। এ বাড়িতে মজুমদার বলে কেউ থাকে না। কৌশিক ওর হাত থেকে যন্ত্রটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ধরুন। ডেকে দিচ্ছি।

বালিগঞ্জ-ফাঁড়ির কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে ভৌমিক ফোন করছিল। সে জানালো হোটেলের ঘরে ফটোর মেয়েটিকে পাওয়া গেছে। সে কোনো কথা বলছে না। বলছে, তার নিজের তরফের উকিলের সঙ্গে কথা না-বলে সে কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না।

মজুমদার তাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসতে বললেন।

এ-ঘরে এসে সংবাদটা জানালেন নন্দী-সাহেবকে।

সমরেন্দ্র বললেন, মিস্টার বাসুর জবানবন্দি থামিয়ে আমাদের কয়েকটি কাজ এখনি করতে হবে। প্রথম কাজ, মাধবী বড়ুয়ার হাতকাড়াটা খুলে দেওয়া। শী ইজ স্টিল আন্ডার অ্যারেস্ট— কিন্তু ঐ হ্যান্ড-কাটা নিষ্প্রয়োজন। ওটা আমার ঠিক বরদাস্ত হচ্ছে না।

মজুমদার এসে নিজেই হ্যান্ড-কাটা খুলে দিলেন।

সমরেন্দ্র বললেন, নেক্সট স্টেপ ডক্টর বড়গোঁহাই। কিন্তু সে বিষয়ে হোমিসাইড হেড কোয়াটার্সে ফোন করার আগে আমি মিস্টার বাসুর কাছে জানতে চাই—উনি যে অনুমান-নির্ভর ঘচনাপরম্পরার বর্ণনা দিলেন মিস্টার জালানকে ‘অ্যাকিউজ’ করে, তার স্বপক্ষে কি ওঁর কোনো কংক্রিট প্রমাণ আছে?

বাসু বললেন, আছে। পর্বতপ্রমাণ প্রমাণ। শুধু কংক্রিট নয় রি-ইনফোর্সড কংক্রিট!

এক দুই করে বলে যাই :

এক নম্বর, আপনার সেই মুলতুবি প্রশ্নটা—’তের মিনিট’ সময়টার কোনো সিগ্‌নিফিকেন্স আছে কিনা। সেটা এই : মিস্টার জালান সন্ধ্যাবেলা সাড়ে সাতটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন একটা ব্রাউন রঙের সাফারি স্যুট পরে। আমার অনুমান দ্বিতীয়বার আমার অনুপস্থিতিতে যখন আসেন তখন ওঁর প্যান্টের পায়ায় রক্তের দাগ লেগেছিল। সুজাতার তা নজরে পড়েনি—একে রাত্রিকাল, তায় ব্রাউনে লালরঙ সহজে নজরে পড়ে না। কিন্তু উনি আমার অভিজ্ঞ চোখকে ভয় পেয়েছিলেন। তাই টেলিফোনে আমাকে রাত সওয়া দশটায় ওঁর হোটেলে যেতে বলেন। ওর সঙ্গে নাকি নিজের হোটেলের ঘরে একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কোনো এক বিজনেসম্যানের। তা ছিল না। উনি তের মিনিটের ভিতর রক্তমাখা প্যান্টটা ছেড়ে স্নানান্তে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

মহাদেব বাধা দিয়ে বলে, এটাকে কি আপনার অভিধানে এভিডেন্স বলে? আমার সামান্য আইনজ্ঞানে এটা তো স্রেফ আপনার একটা অনুমান।

বাসু বললেন, ক্যারেক্ট। মামলা যখন আদালতে উঠবে, তখন দুটি এভিডেন্স আমি দাখিল করব। প্রথমটা, আপনার সেই রক্তমাখা প্যান্টটা। যেটা হোমিসাইড নিশ্চয় ইতিমধ্যে খুঁজে পাবে হোটেলে, আপনার ওয়াড্রোবে। দু নম্বর, যে অলীক সাক্ষীটিকে আপনি হাজির করবেন বিজনেস-টকের ব্যাপারে, তাঁকে আমি আদালতে বুঝিয়ে দেব ‘পার্জারি কেস’-এ ক-বছরের সাজা হয়।

জালান জবাব দেয় না।

বাসু নন্দী সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, দু নম্বর, ঐ মেয়েটি। যাকে আর আধঘন্টার মধ্যে ভৌমিক এখানে নিয়ে আসছে। তাকে একজন ভাল সলিসিটার পাইয়ে দেবেন। মেয়েটি আই মীন জুলি মেহতা সম্ভবত জানে না—অর্থমূল্যে সে যাকে এ-ক’ দিন সাহায্য করে আসছিল, সে একজন খুনী আসামী। ঐ সামান্য টাকার জন্য সে মার্ডার কেস-এ পার্টনার -ইন-ক্রাইম হবে না। আপনার অবগতির জন্য জানাই—ঐ জুলি মেহতা নামের মেয়েটি ডিউক হোটেলে 205 নম্বর ঘরে ক’ দিন রাত্রিবাস করেছে। ঠিক পাশের ঘরটাই মিস্টার জালানের, দুশো সাত। ফর য়োর ফার্দার ইনফরমেশান—দুটি ঘরই বুক করেছেন মিস্টার জালান।

জালান গর্জে ওঠে, বাজে কথা! আপনি প্রমাণ দিতে পারেন?

বাসু বললেন, এবারকাল ডীলে রঙের টেক্কাখানা কিন্তু আমার হাতে এসেছে, মিস্টার জালান। আপনি তা এখনো টের পাননি। এবার সেটা টেবিলে নামিয়ে দিই :

কোটের ইনসাইড পকেট থেকে উনি বার করে আনলেন ডিউক হোটেলের সেই পেমেন্ট ভাউচারখানা।

নন্দী-সাহেবের দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, মিস্টার জালানের অ্যাটর্নি হিসাবে আজ পর্যন্ত ওঁর সমস্ত ডিউ মিটিয়ে দিয়ে ঐ ভাউচারখানা সংগ্রহ করে এনেছি। ওতে দেখুন, মিস্টার জালান দুটি ঘরই নিজের নামে বুক করেছিলেন। আর ঐ ভাউচারের পিছনে দেখুন কতকগুলি লোকাল টেলিফোনের নম্বর। বোর্ডার 205 এবং 207 ঘর থেকে লোকাল ফোন করেছেন তার তালিকা। তার সঙ্গে লেখা আছে তারিখ, সময় এবং ডিউরেশন। নন্দী কাগজটার পিছন দিক দেখে বললেন, এই সইটা কার?

—হোটেল ডিউক-এর একজন রিসেপশানিস্ট-এর, যে মেয়েটি টেলিফোন রেজিস্টার দেখে দেখে স্বহস্তে নম্বরগুলি লিখে দিয়েছিল, তার। একে একে লক্ষ্য করুন। নাম্বার ওয়ান : শনিবার রাত নটা বেজে বারো মিনিটে কোনো এন্ট্রি নেই। অর্থাৎ মিস্টার জালান হোটেলে যাননি। হোটেল থেকে আমাকে ফোন করেননি। তাঁর স্যুটকেসে ফটোগুলি প্রথম থেকেই ছিল। রাত নটা বারোতে তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন রোহিণী-ভিলার কাছাকাছি কোনো পাবলিক ফোন-বুথ থেকে। এটা এভিডেন্স—ওঁর অ্যালেবাঈটা নাকচ করতে। নাম্বার টু : শনিবার রাত এগারোটা দশে ওঁর ঘর থেকে একটা ফোন করা হয়েছে 24-9378-এ। ওটা সুরঙ্গমার টেলিফোন নম্বর। এতে প্রমাণ হয় জালান ও-ঘরে ঢুকেছিল, টেবিলের উপর পড়ে থাকা স্লিপটা দেখেছিল। সুরঙ্গমা নামটা ও শুনেছে কৌশিকের টেলিফোনে। এটা আমার অনুমান নয়, এভিডেন্স। এটাকে নাকচ করতে হলে জালানকে জানাতে হবে সে কোন সূত্রে রাত এগারোটায় সুরঙ্গমার টেলিফোন নম্বরটা জানতো? নাম্বার থ্রি : আদালতে মামলা উঠলে সুরঙ্গমা তার সাক্ষ্যে বলবে একই পুরুষকণ্ঠ শনিবার রাতে দুবার ফোন করে মাধবীর সন্ধানে। প্রথমবার রাত সওয়া নটা নাগাদ, দ্বিতীয়বার রাত এগারোটায়। ঐ ভাউচারে লক্ষণীয় রাত সওয়া নটা নাগাদ কোনো এন্ট্রি নেই। তার অর্থ : সেবার জালান অন্য কোনো জায়গা থেকে ফোন করে। সেখান থেকেই দু মিনিট পরে আমাকে। নাম্বার ফোর : রবিবার সকালে নটা নাগাদ দুটি এন্ট্রি আছে। ঐ নম্বর দুটিতে ফোন করলে জানা যাবে ওর একটা পথিক হোটেলের; দ্বিতীয়টা ভবানীপুরের সোনার বাঙলা হোটেলের। এ দুটি জালানের নির্দেশে মমতা বা মমতাজ বা জুলি করেছিল বড়গোঁহাই আর মাধবীকে ফেরার হবার নির্দেশ দিতে। যদি তা না হয়, তবে জালান বলুক— সে কেন ঐ দুটি হোটেলে ফোন করেছিল? কার সঙ্গে কী কথা বলেছিল। মাধবীর নম্বরটাই বা সে পেল কেমন করে? নাম্বার ফাইভ : রবিবার বেলা দশটা পঞ্চাশে দেখছি লালবাজার হোমিসাইড সেক্‌শানের ডাইরেক্ট লাইনে একটা ফোন করা হয়েছে। আমার অনুমান…

বাধা দিয়ে মজুমদার বলে ওঠেন, না, স্যার, ওটা আপনার অনুমান নয়। ওটা ঘটনা। কারণ লালবাজারে ফোনটা আমিই অ্যাটেন্ড করি। একজন অজ্ঞাত-পরিচয় মহিলা একটা টিপস্ দেন, অনীশ আগরওয়াল হত্যা মামলার আসামী সাঁকরাইল-এর কাছাকাছি ধূলাগড়ি গাঁয়ের ‘সোনার বাঙলা’ হোটেলে লুকিয়ে আছে। আমি আর ভৌমিকই গিয়েছিলাম ওদের অ্যারস্ট করতে; কিন্তু তার আগেই আপনি মাধবীকে সরিয়ে ফেলেন।

তখনই বাইরে থেকে কে যেন কলবেল বাজালো। কৌশিক এগিয়ে গেল দরজাটা খুলে দিতে। মজুমদার বললেন, জাস্ট এ মিনিট। একটু অপেক্ষা করুন। মনে হচ্ছে ভৌমিকই এসেছে—ঐ জুলি মেহ্ত্তাকে নিয়ে। মেয়েটি এ-ঘরে আসার আগেই আসামীকে হ্যান্ড-কাটা পরিয়ে রাখি। না হলে ঐ মেয়েটিকে কব্জা করা মুশকিল হবে। জুলি এসেই দেখুক, তার সম্ভাব্য রক্ষাকর্তা স্টেনলেস্-স্টিলের বালা পরে বসে আছেন। আমারও ধারণা মেয়েটি ‘মার্ডার-কেস’ জেনে-বুঝে জালানকে সাহায্য করেনি। করবে না!

হ্যান্ড-কাটা নিয়ে মজুমদার এগিয়ে গেলেন জালানের দিকে।

.

পরদিন সকালে।

সবাই ঘিরে বসেছে বাসু-সাহেবকে। বাড়ির সবাই তো আছেই, তার উপর জুটেছে মাধবী এবং সদ্যমুক্ত ডাক্তার শান্তনু বড়গোঁহাই। সমবেত প্রশ্ন : বলুন স্যার? কী করে বুঝলেন? কখন ঠিক বুঝতে পারলেন?

বাসু বললেন, কৌশিক, তুমি যদি এই জালানের কেসটা নিয়ে ‘কাঁটা সিরিজে’র কোনো গোয়েন্দা গল্প লেখ, আই মীন, ‘শান্তনু-মাধৰী’র প্রেমের ফুলটা যদি কোনোদিন কাঁটা হয়ে ফুটে ওঠে তাহলে বইটার নামকরণের অধিকারটা আমাকে দিও।

সুজাতা জানতে চায়, কী নাম?

—বিশের কাঁটা’।

কৌশিক বলে, কিন্তু ‘পয়েজনিঙের’ কেস তো এটা নয়?

— না, না, মূর্ধণ্য ‘ষ’ নয়, বানানটা তালব্য ‘শ’ দিয়ে!

—’বিষ’ নয়? বিশ!—কিন্তু বিশ সংখ্যাটাই বা এল কোথেকে?

—-না-রে বাপু। তা নয়। ‘বিশ’ মানে এখানে ‘দুই-য়ের পিঠে শূন্য’ নয়। বিশ্বের মানে ‘বিশ্বনাথের’—ঐ যে হতভাগা কপাটের ফাঁকে দাঁড়িয়ে বোকার মতো হাসছে! ঐ বিশে হতভাগাই তো প্রথম ক্লু-টা আমাকে সাপ্লাই করল। তাই এক্ষেত্রে ‘কাটা’ মানেও ‘কন্টক নয়,—নির্দেশক, পয়েন্টার, ইন্ডিকেটার। যেমন ঘড়ির, ওজনদাঁড়ির বা কম্পাসের।

রানী দেবী হাসতে হাসতে বলেন, হায় রে হায়! শেষ পর্যন্ত তোমার রহস্য কাহিনীর হিরো হলো, বিশে?

বাসু বললেন, তাই হলো! বিশে ‘হিরো’ আর তুমি ‘হিরোইন’!

খিলখিল করে হেসে ওঠেন রানী দেবী। অনেকদিন এমন করে হাসেননি তিনি। বলেন, ওমা আমি কোথায় যাব? আমি বিশের বিপরীতে হিরোইন?

—আলবাৎ! রানী যদি তাঁর ঐ চাকা-দেওয়া সিংহাসনে পাক মেরে ও-ঘরে গিয়ে প্লাগটা সময় মতো খুলে না দিতেন, তাহলে রাজার হাতে হাতকড়া পরাতো ঐ মজুমদার। যে গাধাটা শেষ দিকে আমাকে ‘স্যার-স্যার’ করছিল!

রানী বলেন, আচ্ছা তা না হয় হলো। কিন্তু বিশেটা হিরো হলো কোন সুবাদে?

—শোন বলি। সেই শনিবার রাত তখন আটটা বা সওয়া আটটা। তুমি জ্বরের তাড়সে ঘুমাচ্ছ। জালান তার অ্যাটচিটা তুলে নিয়ে রওনা দেবার পর আমি বিশেটাকে ডেকে বললাম, শোন, আমি একটু বেরুচ্ছি। সাড়ে নটা নাগাদ ফিরে আসব। ঐ যে বাবুটি এতক্ষণ বাইরের ঘরে বসেছিলেন উনি হয়তো তার আগেই ফিরে আসবেন। ম্যাজিক-আই দিয়ে দেখে নিয়ে দরজা খুলে দিবি। ওঁকে বাইরের ঘরে বসাবি। ও তার জবাবে কী বলেছিল, জান? বললে, ‘কোন বাবু? ঐ যিনি এতক্ষণ ধরে বাইরের ঘরে বসে টেলিফোন করছিলেন?” তার জবাবে আমি ওকে ধমক দিয়ে বলেছিলাম, ‘তোর মাথায় কি নিরেট গোবর? কটা বাবু এতক্ষণ বসেছিল বাইরের ঘরে? একটাই তো? তার কথাই বলছি।…..বিশের উচ্চারিত ঐ একটি মাত্র পংক্তি এই গোটা রহস্যকাহিনীর পিভটাল পয়েন্ট! সেন্ট্রাল ব্লু! কী দুঃখের কথা, আমি তার তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। বোকামি তুমি একাই করনি ভাগ্নে, ভুলি মেহতাকে বিশ্বাস করে, বোকামি তোমার মামাও করেছিল বিশেকে অবিশ্বাস করে। আমি তখনি বুঝতে পারিনি যে, বিশ্বে বারান্দা থেকে স্বচক্ষে দেখেছিল ঐ বাবুটিকে ‘টেলিফোন কানে’ অবস্থায়। বিশের কথাটার তাৎপর্য যদি তখনই বুঝতে পারতাম তাহলে সমস্যার সমাধান অনেক-অনেক আগেই হয়ে যেত। সেটা বুঝতে পেরেছিলাম অনেক পরে। জালানকে বারে বারে বাইরের ঘরের এক্সটেনশানে আড়ি পাততে দেখে। তাই আমার প্রস্তাব : এই রহস্যকাহিনীটার নামকরণ কর ‘বিশের কাঁটা’। পাঠক-পাঠিকাকে একটা বাড়তি ক্লু প্রথম থেকেই বরং দিয়ে রাখ। তারা ভাবতে থাকুক— একেবারে শুরু থেকেই—গল্পটার নাম কেন হলো : বিশের কাঁটা?