বিশের কাঁটা – ১৫

পনের

বাসু-সাহেবের ক্লান্ত ভাবটা এতক্ষণে কেটে গেছে। মাধবীকে লড়াই ময়দানের বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন—পারলেন না। ক্লান্তিটা সেই ব্যর্থতাজনিত— খণ্ডযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি। যুদ্ধটা তা বলে শেষ হয়নি। আগরওয়াল হত্যা মামলার সমাধান উনি করে ফেলেছেন। মনে মনে। কাউকে এখনো কিছু জানাননি। প্রকৃত আসামীকে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু ও-পক্ষ তাঁর কোন্ চালে কী চাল দেবে তা তো বলা যাচ্ছে না—তাই শেষ কিস্তিতে কীভাবে মাৎ করা যাবে তার স্পষ্ট ধারণা হয়নি এখনো।

চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বাসু বললেন, শুনুন ইন্সপেক্টার মজুমদার। আমি লালবাজারে যেতে চাই না, কিন্তু এখানে এই ঘরে বসেই একটা জবানবন্দি দিতে চাই—একটা স্বীকারোক্তি। আপনি কি অনুগ্রহ করে শুনবেন?

—ও তাই নাকি? আপনি একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে এতক্ষণে রাজি হয়েছেন? কী আনন্দের কথা! কিন্তু সেটা আপনাকে হেড কোয়াটার্সে গিয়েই দিতে হবে, ব্যারিস্টার-সাহেব, এখানে বসে নয়।

—না। এখানে বসে। হোমিসাইড নয়, আপনি ভবানীভবনে ক্রাইম সেক্‌শানে মিস্টার সমরেন্দ্র নন্দী আই. পি. এস্.কে টেলিফোনে পান কি না দেখুন। তিনি কেসটা জানেন। তাঁকে এখানে চলে আসতে বলুন। তাঁর সাক্ষাতেই আমি কনফেশটা করব।

মজুমদার ইতিপূর্বেই ক্র্যাডেলে টেলিফোন যন্ত্রটা বসিয়ে রেখেছিলেন। বললেন, দুর্ভাগ্যবশত চাকাটা এখন ঘুরে গেছে বাসু-সাহেব। আপনার আক্রমণাত্বক খেলাটা শেষ হয়ে গেছে যে-মুহূর্তে আপনার প্রাইভেট চেম্বার থেকে ফেরারি আসামীকে আমরা গ্রেফতার করতে পেরেছি। এখন আমাদের অফেন্সসিভ খেলা শুরু হয়েছে! আপনি ডিফেন্সে!

বাসু-সাহেব সমরেন্দ্র নন্দীর নামোচ্চারণমাত্র রানী দেবী তাঁর চাকা দেওয়া চেয়ারে চলে গেছেন পাশের ঘরে—বাসু-সাহেবের একান্তকক্ষে। সুজাতা আর কৌশিক দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মাধবী কিন্তু বসে আছে একটা চেয়ারে। তার মুখে একটা দৃঢ় সঙ্কল্পের ব্যঞ্জনা। তার প্রতিজ্ঞা : সে কিছুতেই কিছু বলবে না! তার একমাত্র প্রত্যুত্তর, অনুগ্রহ করে আমার সলিসিটারকে জিজ্ঞাসা করুন।

বাসু বললেন, লুক হিয়ার, ইন্সপেক্টর মজুমদার! ইতিপূর্বেই বলেছি, আমি একটা জবানবন্দি দিতে ইচ্ছুক। একটা স্বীকারোক্তি। এ ঘরে। এই চেয়ারে বসে। সাত-আট জন সাক্ষীর সামনে আমি সে কথা বলেছি। আপনি সেই কনফেশানটা শুনবেন? না, শুনবেন না? আমার সেই স্বীকারোক্তি?

—আলবাৎ শুনব। তবে এখানে নয়। হেড কোয়টার্সে! আপনাকে আমি গ্রেফতার করেই নিয়ে যাচ্ছি। একটা কগ্‌নিজিবল অফেন্স করায়। মাধবী বড়ুয়াকে পুলিশ খুঁজছে এ-কথা খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে—সবাই জানে! আপনি তার সলিসিটার; ফলে আপনিও তা জানতেন। সেই ফেরারি আসামীকে আমরা খুঁজে পেয়েছি আপনার প্রাইভেট চেম্বারে। সুতরাং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিষ্প্রয়োজন। আমি শুধু হেডকোয়ার্টাসের কাছে জানতে চাই—এ-ক্ষেত্রে আপনাকে হাতকড়া পরানো হবে, না, হবে না।

নাটকীয়ভাবে পিছন ফিরে তিনি আবার তুলে নিলেন টেলিফোন যন্ত্রটা। কানে লাগালেন বার-কতক খট্‌খট্ করলেন। তারপর বললেন, এ কি! এটা ডেড্ হয়ে গেল কি করে?

বাসু বললেন, সম্ভবত আমার সেক্রেটারি পাশের ঘরে গিয়ে প্লাগ কানেকশানটা খুলে দিয়েছেন। উনি যে প্রতিবন্ধী নন—পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও রুখে দাঁড়াতে পারেন, তারই সামান্য একটা প্রমাণ দিলেন, এই আর কি!

মজুদার বুনো-মোষের মতো গিয়ে ধাক্কা দিলেন বাসু-সাহেবের প্রাইভেট রুমের দরজায়। দেখা গেল সেটা ভিতর থেকে বন্ধ।

বাসু বললেন, এবার কী করবেন পুলিশ-সাহেব? দরজা ভেঙে আমার আপত্তি সত্ত্বেও ট্রেসপাস—নাকি বাইরের কোনো টেলিফোন বুথ থেকে হেড কোয়ার্টাসকে ফোন করা?

মজুমদার এতক্ষণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বেশ জোরের সঙ্গে বলেন, দ্বিতীয়টা। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক, ভৌমিক। এঁদের দুজনের কেউ যেন না পালায়।

নির্গমনদ্বারের দিকে এক-পা আগাতেই বাসু বলেন, যাবার আগে একটা কথা শুনে যান, মিস্টার মজুমদার। আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে লালবাজারে নিয়ে গেলে আমি ওঁদের বলব যে, নিজের বাড়িতে বসে আমি একটা সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি করতে স্বীকার করেছিলাম—পাঁচ জন সাক্ষীর সামনে। কিন্তু দুজন দাম্ভিক নির্বোধ পুলিশ অফিসার আমাকে সেই কনফপেশন করতে দেয়নি। আমি আরও বলব, লালবাজারে আমি কোনো কথার জবাব দেব না। প্রসিকিউশানের হিম্মৎ থাকে তো আমাকে দোষী প্রমাণ করুক!

মজুমদার থমকে গেলেন। তার সহকর্মী বললে, স্যার…

বাসু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, একজ্যাক্টলি! য়ু আর রাইট, ইয়াংম্যান! আমার সলিসিটার যদি’ প্রমাণ করতে পারেন যে, আমি কলকাতার বাইরে থাকার সময় আমার অজ্ঞাতসারে মাধবী বড়ুয়া আমার প্রাইভেট অফিসে ঢুকেছিল, তাহলে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে অহেতুক অপমান করার জন্য তোমার সহকর্মীর চাকরি নিয়েও টানাটানি হতে পারে। সেটা অবশ্য নির্ভর করবে হাইকোর্ট-বার-অ্যাসোসিয়েশান কীভাবে রিয়্যাক্ট….

মাধবী হঠাৎ বলে ওঠে, সেটাই তো ঠিক। আমি যে ওখানে লুকিয়ে ছিলাম তা তো আপনি জানতেনই না—

বাসু ধমকে ওঠেন, তুমি কোনো কথা বল না, মাধবী।

মাধবী মাঝপথেই থেমে যায়।

বারান্দার দিক থেকে এই সময় হুইল-চেয়ারে পাক মেরে ঘরে ফিরে এলেন রানী দেবী। স্বামীকে সম্বোধন করে বললেন, ও-ঘর থেকে আমি ভবানীভবনে ফোন করেছিলাম। মিস্টার নন্দী তোমাকে চেম্বারে অপেক্ষা করতে বললেন। উনি নিজেই আসছেন। তোমার জবানবন্দিটা শুনতে।

মজুমদার গুটি গুটি নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসলেন। বললেন, আপনি কি নিজে থেকে একটা কনফেশান, মানে জবানবন্দি দিতে চান?

বাসু বললেন, ফর দ্য এন-এথ্ টাইম আই রিপীট, ইয়েস স্যার!

—কীসের জবানবন্দি?

—সেটা ক্রমশ বুঝতে পারবেন, বলতে শুরু করি তো আগে।

মজুমদার সকলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর বাসুকেই বললেন, এঁরা সবাই এঘরে থাকবেন?

বাসু বলেন, সেটাই আমার ইচ্ছা। তোমরা দুজন বস, কৌশিক আর সুজাতা। আর রানী তুমি তোমার নোটবইটা তুলে নাও। আমি জবানবন্দি শুরু করার পর ওঘরে যে-কেউ যে- কেন কথা বলবেন, তা নোট করে নিও। পরে এটা আদালতে প্রয়োজন হতে পারে এভিডেন্স হিসাবে।

তারপর সকলের উপর চোখ বুলিয়ে বলেন, যদিও আপনাদের কারও কোনো হলফ নেওয়া নেই তবু কেউ জ্ঞাতসারে কোনো মিছে কথা বলবেন না। আমরা যা লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছি তা ভবিষ্যতে অনীশ আগরওয়াল মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি হতে চলেছে।

মজুমদার বললেন, ভূমিকা থাক, এবার শুরু করুন।

রানী তাঁর নোটবই ও ডট পেনটা তুলে নিলেন।

বাসু শুরু করলেন তাঁর স্বীকারোক্তি।

অনীশ আগরওয়ালের নামটা আমি প্রথম শুনি মিস্টার মহাদেব জালানের কাছে শনিবার সকালে, যে শনিবার রাত্রে অনীশ খুন হয়। মিস্টার জালান হাজার টাকা রিটেইনার দিয়ে মাধবী বড়ুয়ার তরফে আমাকে এনগেজ করেন। লক্ষণীয়, তখনো কিন্তু কোনো আইনত অপরাধ সংঘটিত হয়নি। সম্ভবত আসামী বাদে—যদি এটা ডেলিবারেট মার্ডার হয় শুধু সে- ক্ষেত্রেই—আর কেউ জানত না যে, অনীশ আগরওয়াল অচিরেই খুন হতে চলেছে।

মহাদেব রুখে ওঠে, আপনি কী বলতে চাইছেন?

—ফ্যাক্ট! তথ্য! সত্যঘটনা! এ পর্যন্ত যা বলেছি তাতে আপনি কি প্রতিবাদ করছেন? করলে কোন বিষয়ে? এক : আপনি কি রিটেনশান মানি দেননি, মাধবীর তরফে? দুই : তখনো কোনো আইনত অপরাধ কি সংঘটিত হয়েছিল? তিন : কেউ কি তখন জানত যে অনীশ অচিরেই…

মজুমদার বলেন, আপনি ওঁর সঙ্গে আর্গু করবেন না, প্লীজ! আপনি নিজের স্বীকারোক্তিটা দিতে থাকুন!

—অলরাইট! মিস্টার জালান যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন তিনি জানতেন না, অনীশ আগরওয়াল কোথায় আছে। এমনকি তিনি এ-কথাও জানতেন না, মাধবী বড়ুয়া কোথায় আছে। তাই মিস্টার জালানের অনুরোধে আমি ওঁকে সুকৌশলী প্রাইভেট এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই—ঐ শনিবারের সকালেই—যাতে সুকৌশলী অনীশ আগরওয়াল এবং মাধবী বড়ুয়ার সন্ধান যোগাড় করতে পারে।

মজুমদার বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, এ জবানবন্দি তো আদৌ স্বীকারোক্তির মতো শোনাচ্ছে না?

বাসু জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি আমার কথা শুনতে চান, না, না? আপনি চাইলে আমি চুপ করেই থাকব।

ভৌমিক বলে ওঠে, স্যার, ওঁকে বাধা দেবেন না। উনি কী বলতে চান চুপচাপ শুনেই যান না।

মহাদেব এই সময় বলে ওঠে, একটা কথা! উনি কী বলছেন না বলছেন, তাতে আমাকে কিন্তু কোনোভাবেই জড়াতে পারবেন না। মানে, পরে যেন বলবেন না—আপনি তখন কেন প্রতিবাদ করেননি?

মজুমদার বলেন, আপনি চুপ করুন।

জালান রুখে ওঠে, না, চুপ করব না। আমার কোনো লীগ্যাল অ্যাডভাইসার এখানে নেই তাই আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি—

মজুমদার তাঁর সহকর্মীর দিকে ফিরে বলেন, ওকে চুপ করিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার।

ভৌমিক নিঃশব্দে এগিয়ে জালানের টাইটা চেপে ধরে বললে, স্যারের কথাটা কানে গেছে? আপনি যদি আর একটা কথা উচ্চারণ করেন তাহলে ট্যাক্সি চেপে হোটেলে নয়, অ্যাম্বুলেন্সে চেপে হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে। বুঝেছেন?

মজুমদার বলেন, আপনি শুরু করুন, মিস্টার বাসু।

—হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। মিস্টার জালান তাঁর হোটেলে ফিরে যাবার পর সুকৌশলী ডিটেকটিভ এজেন্সি ঐ দুজনের—মানে অনীশ আর মাধুরীর তল্লাশ করতে থাকে। ইতিমধ্যে লিন্ডসে স্ট্রিট-এর ‘হোটেল ডিউক থেকে মিস্টার জালান আমাকে টেলিফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান। অ’মি ওঁকে রাত আটটার সময় আসতে বলি। উনি সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমার বাড়িতে এসে হাজির হন। আমি বিরক্ত হই। বলি, ‘আমি তো আপনাকে আটটার সময় আসতে বলেছিলাম।’ উনি অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, ‘অলরাইট। আমি আটটার সময়েই ঘুরে আসব। আমি না হয়, ঐ পার্কে গিয়ে আধঘন্টা বসে থাকি।’ তাতে আমি আপত্তি করে বললাম, ‘পার্কে ঐভাবে বসে থাকলে আপনার ঠাণ্ডা লাগতে পারে, আপনি বরং আমার বাইরের রিসেপশান ঘরেই বসে থাকুন।…মিনিট দশ-পনের পরে কৌশিকের টেলিফোন এল। আমি চেম্বারে বসে কলটা অ্যাটেন্ড করলাম। এই টেলিফোনের একটা এক্সটেনশান আছে আমার রিসেপশানে, যেখানে আমার সেক্রেটারি সচরাচর বসেন, আর একটি আমার বেডরুমে যেহেতু ঘটনার রাত্রে আমার সেক্রেটারি অসুস্থা ছিলেন, আমার বেডরুমে শুয়ে ছিলেন, তাই বেডরুমের প্লাগটা আমি খুলে রেখেছিলাম। সে যাই হোক, আমি চেম্বারে বসে কৌশিকের টেলিফোন অ্যাটেন্ড করলাম। ও জানালো, মাধবীকে সে ট্রেস করতে পেরেছে। মাধবী আছে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ইন্টালি মার্কেটে। সেই বান্ধবীর মাধ্যমে আগরওয়ালকেও ট্রেস করা গেছে। এখানে বলে রাখা যেতে পারে, টেলিফোনে কৌশিক কিন্তু মাধবীর অ্যাড্রেসটা জানায়নি, কিন্তু তার বান্ধবীর নাম যে সুরঙ্গমা তার উল্লেখ করেছিল। আর বলেছিল যে, আগরওয়াল আছে বেগবাগানের কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে। তার নাম ‘রোহিণী- ভিলা’। অনীশের রুম নম্বর 2/3; অর্থাৎ দোতলায় তিন নম্বর ঘর। কৌশিক আরও বলেছিল, রোহিণী-ভিলায় ঘরে ঘরে ফোন নেই। তবে দরোয়ানের টুলের পাশে একটা ফোন আছে। বাইরে থেকে কেউ কোনো বোর্ডারকে কিছু মেসেজ পাঠালে তা দারোয়ান ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় ..

মজুমদার হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, এত বিস্তারিত বিবরণের কি কোনো প্রয়োজন আছে, মিস্টার বাসু? ‘কনফেকশান’ মানে স্বীকারোক্তি—গোটা মহাভারত রচনা নয়।

ভৌমিক তৎক্ষণাৎ বাধা দেয়, প্লীজ স্যার! আপনি কথা দিয়েছিলেন, কোনো রকম বাধা দেবেন না।

মজুমদার গা এলিয়ে বসলেন। বললেন, অলরাইট, অলরাইট! বলে যাচ্ছেন বেদব্যাস, লিখে যাচ্ছেন গণেশজী, অফিস স্টেশনারি ওঁদের, আমি কেন বাধা দিই? হোক, পুরো অষ্টাদশপর্বই হোক

মহাদেব জালান তার সিগ্রেটের কার্টুনটা বাড়িয়ে ধরল। মজুমদার তা থেকে একটা স্টিক তুলে নিয়ে ধরালেন। মৌজ করে শুনতে থাকেন।

বাসু কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, ঠিক ঠিক বলছি তো? কিছু মিস্ করছি না?

কৌশিক এ কামরায় প্রবেশের পর একটি কথাও বলেনি। একটা প্রচণ্ড মানসিক অপরাধবোধে সে ভুগছিল। সে আর সুজাতা। সেই অজানা মেয়েটা ওদের বিপথে পরিচালিত করেছে। দারুণ অভিনয়ক্ষমতা মেয়েটার! কেঁদে কেটে ওদের হৃদয় জয় করে ফেলেছিল। ওরা ধরে নিয়েছিল, সে সত্যি মিসেস শান্তনু বড়গোঁহাই। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন আজ ক্যালকাটা-বারের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার। একটা নগন্য ইন্সপেক্টার তাঁর হাতে হাতকড়া পরিয়ে লালবাজারে নিয়ে যেতে চাইছে। কৌশিক এবার সোজা হয়ে বসে বললে, আমার মনে হচ্ছে, সামান্য একটু ‘ডিটেইলস’ বাদ দিয়ে গেলেন স্যার। আমি বলেছিলাম, ‘বাইরে থেকে মেসেজ এলে দারোয়ান সেটা বিশেষ-বিশেষ ক্ষেত্রে লিফটম্যানের হাতে বোর্ডারকে পাঠায়।’ তখন আপনি জানতে চেয়েছিলেন “বিশেষ বোর্ডার অর্থে?’ আর আমি এক্সপ্লেন করেছিলাম, “যারা দরাজ হাতে দরোয়ানকে সেজন্য বকশিস্ দেয়।’

বাসু সোৎসাহে বলে ওঠেন, কারেক্ট। ‘বিশেষ-বিশেষ’ বোর্ডার! গট দ্যাট করটেড, রানু?

রানী তাঁর খাতায় নিবদ্ধদৃষ্টি অবস্থাতেই নির্বিকারভাবে বললেন, ‘কারেকশানের’ দায় আমার নয়। যে-যা বলছেন এখানে লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মহাভারত রচনা করার অপরাধে ঋষি বেদব্যাস এবং তাঁর স্টেনোগ্রাফার হিসাবে কাজ করায় গণেশজী ইতিমধ্যেই অ্যাকিউজড্ হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছেন। আই রিপীট— সংশোধন করার দায় আমার নয়।

বাসু আবার শুরু করেন, ইয়েস! যে কথা বলছিলাম—

আমি কৌশিককে টেলিফোনে বললাম, ‘এখন রাত সাতটা পঞ্চাশ। আমি রাত পৌনে নটা নাগাদ বেগবাগানে ঐ বাঙলাদেশ মিশনের কাছে পৌঁছাব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর’।…তারপর আমি বাইরের ঘরে এসে দেখলাম, মিস্টার জালান একমনে একটা বই পড়ছেন। ওঁকে বললাম, একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে এক্ষুণি বের হতে হবে। ফিরতে আমার ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমি ঐ সময় মিস্টার জালানের কাছে কিছু কাগজপত্র আর ফটো চাই—এগুলো তাঁর আগেই নিয়ে আসার কথা ছিল। উনি বললেন, সেগুলো উনি ভুল করে নিয়ে আসেননি। নিজেই বললেন, ট্যাক্সি নিয়ে উনি লিন্ডসে স্ট্রিটে চলে যাবেন এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঐসব কাগজপত্র হোটেল থেকে নিয়ে আসবেন। হিসাবমতো, আমার বাড়ি থেকে ‘ডিউক হোটেল’ যাওয়া-আসায় ঐ রকমই সময় লাগার কথা।

মহাদেব জালান হঠাৎ বলে ওঠে, মিস্টার বাসু, আপনি কি আপনার স্বীকারোক্তিতে ঐ কথাটা জানাবেন যে, পুলিশ মৃতদেহ আবিষ্কার করার আগেই আপনি অনীশ আগরওয়ালের মৃতদেহটা প্রত্যক্ষ করেছিলেন? আপনি কি আরও বলবেন যে, পাশের ঘরের সেই অ্যাংলো- ইন্ডিয়ান মহিলা একজন পুলিশ সার্জেন্টকে নিয়ে উপস্থিত হবার পূর্বমুহূর্তে আপনি মৃতের ঘর থেকে বার হয়ে এসেছিলেন? দরজার লক্-নবটা অ্যাডজাস্ট করে? অর্থাৎ আপনি ডাউন- রাইট মিথ্যে কথা বলেছিলেন পুলিশ সার্জেন্টকে?

মজুমদার সোজা হয়ে বসলেন এতক্ষণে। বললেন—আপনি এসব কথা জানলেন কেমন করে?

জালান যেন খুশিতে ফেটে পড়ছে—রঙের টেক্কাখানা টেবিলে নামিয়ে দিয়ে। এ পিঠটা সে নির্ঘাৎ কোলপাঁজরে টেনে নেবে। বলতে থাকে, তার কারণ রাত পৌনে দশটা নাগাদ – ঐ ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর বাড়িতে ফোন করেন। তার আগেই আমি হোটেলে থেকে কাগজপত্রগুলো নিয়ে ফিরে এসেছি। সেই পুলিশ সার্জেন্টকে জিজ্ঞেস করে আপনারা দেখবেন—ডুপ্লিকেট চাবি এনে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ওদের পৌনে দশটাই হয়ে গেছিল। তার প্রায় আধঘন্টা আগে বাসু-সাহেব রোহিণী-ভিলা ছেড়ে চলে যান। উনি বাড়িতে টেলিফোন করায় সেটা ধরেছিলেন মিসেস মিত্র—ঐ সুজাতা দেবী। পরে তিনি আমাকে টেলিফোনটা দেন। মিস্টার বাসু তখন—সেই পৌনে দশটায় আমাকে হত্যাকাণ্ডের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন। লোকটা উবুড় হয়ে পড়ে আছে, বুলেট উন্ড। তার পরনে শুধু আন্ডারওয়ার! কী করে? পুলিশও হয়তো তখন সেসব তথ্য জানতে পারেনি!

মজুমদারের সঙ্গে ভৌমিকের দৃষ্টি বিনিময় হলো।

মজুমদার রানী দেবীকে প্রশ্ন করেন, ওঁর কথা সব আপনি লিখে নিয়েছেন? রানী সংক্ষেপে বললেন, প্রতিটি শব্দ।

মজুমদার সোৎসাহে বলেন, বলুন মিস্টার জালান। আর কি বলবেন?

জালান বলল, আমি কেন বলব? জবানবন্দি তো দিচ্ছেন বাসু-সাহেব। তিনি স্বীকারোক্তি করতে চেয়েছিলেন বলে, জাস্ট ওঁকে মনে করিয়ে দিলাম একটা ছোট্ট ‘ডিটেস্‌’!

মজুমদার বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলেন, ইয়েস?

বাসু নির্বিকারভাবে বলে চলেন, যে-কথা বলছিলাম; ঠিক পৌনে নটার সময় আমি রোহিণী-ভিলায় পৌঁছাই। দরোয়ান তার টুলে বসে ছিল না। আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যাই। অনীশ আগরওয়ালের দরজায় বার তিন-চার কলবেল বাজাই। কেউ সাড়া দেয় না। অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম—ট্রান্সসমের ফোকর দিয়ে—ভিতরে আলো জ্বলছে। আমি দরজার হ্যান্ডেলটা ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। সেটা লক করা ছিল না। আমি ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম, অনীশ আগরওয়াল মরে পড়ে আছে। খালি গা, পরনে আন্ডারওয়্যার। নাড়ি দেখলাম। লোকটা নিঃসন্দেহে মারা গেছে। আমি নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বার হয়ে এলাম—ইয়েস, ডোর-নবে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে দিয়ে। ঠিক সেই সময় লিফটের খাঁচায় একজন পুলিশ অফিসারের হেলমেট দেখতে পেয়েই আমি দরজার লক-নবটা খাড়া করে দিয়ে দরজাটা টেনে দিই। ভিতর থেকে দরজাটা লক্ড হয়ে যায়। পুলিশ অফিসারটি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কতক্ষণ এসেছি। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘এইমাত্র। দরজার বেল বাজাচ্ছি, কেউ খুলছে না!”

বাসু-সাহেব থামলেন। কক্ষে আলপিনপতন নিস্তব্ধতা। শুধু রানু দেবীর কলমের খস্ খস্ শব্দটা শোনা যায়। আর এয়ার কুলারের আওয়াজটা।

মজুমদার ইতস্তত করলেন না। তিনি এতই উত্তেজিত যে, অনুমতিও নিলেন না। জালানের হস্তধৃত সিগ্রেটের কার্টনটা টেনে নিয়ে একটা সিগ্রেট ধরালেন। জালান তাতে অগ্নিসংযোগ করে দিল। মজুমদার একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এক্সকিউজ মি, মিস্টার বাসু। আমি ঢের ঢের ব্যারিস্টার দেখেছি। তবে আপনার মতো একটিও দেখিনি। আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, আপনার এই জবানবন্দি মিস্টার জালানের কোলাবোরেশনের ভিত্তিতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। আপনাকে বাকি জীবন জেলখানার গরাদের ওপারে কাটাতে হবে। এ একেবারে নির্ঘাৎ?

বাসু বললেন, আপনি যদি দয়া করে ঐ-সব জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য বিতরণ বন্ধ করেন তাহলে আমি আমার জবানবন্দিটা শেষ করতে পারি।

মজুমদার বলেন, পান্ডিত্যপ্রকাশ বন্ধ করে আপনি আপনার জবানবন্দিটা তাড়াতাড়ি শেষ করুন, মশাই। এ পর্যন্ত যা বলেছেন বাকি জীবন জেলখাটার পক্ষে তাই যথেষ্ট!

জালান আগবাড়িয়ে বলে, অফিসার্স! আপনারা যদি একটু বুঝবার চেষ্টা করেন তাহলে ‘রিয়ালাইজ’ করবেন ঐ দরজাটার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। ব্যারিস্টার-সাহেব যদি ঐ ঘরে ঢুকতে না পেরে থাকেন, দরজাটা বন্ধ থাকায়—তাহলে ধরে নেওয়া যায় অপকীর্তিটি শান্তনু বড়গোঁহাইয়ের। খুনটা করে পালাবার সময় বাসু-সাহেবকে এগিয়ে আসতে দেখে, তাই তাড়াতাড়ি হাতের যন্ত্রটা আলমারির ফাঁকে ফেলে খালি হাতে লিফ্‌ট দিয়ে নেমে যায়। আর যদি বাসু-সাহেব ও-ঘরে ঢুকে থাকেন—দরজাটা খোলা পেয়ে, তাহলে অবশ্য…

ভৌমিক গর্জে ওঠে, আপনার মতামত আপনার নিজের মনেই রাখুন। কোনো কথা বলবেন না।

মজুমদার বলেন, নিন, শুরু করুন ব্যারিস্টার-সাহেব, আপনার ‘অমৃতসমান’ জবানবন্দি আমরা কজন পুণ্যবান শ্রোতা শুনে ধন্য হই।

বাসু-সাহেব শুরু করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বেজে উঠল ডোরবেলটা। কৌশিক একলাফে এগিয়ে গেল। সদর দরজাটা খুলে দিল।

ঘরে প্রবেশ করলেন ভবানীভবনের অপরাধ-বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়ার অফিসার সমরেন্দ্র নন্দী আই. পি. এস.। চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সবাইকে দেখে নিলেন। পুলিশবিভাগের শিষ্টাচার মোতাবেক মজুমদার ও ভৌমিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

বাসু বললেন, হ্যালো নন্দী। এস, বস।

নন্দী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলেন, এখানে কী হচ্ছে? কোনো নাটকের রিহার্সাল? আমাকে মিসেস বাসু টেলিফোনে …

মজুমদার এতক্ষণে আবার জমিয়ে বসেছেন তাঁর চেয়ারে। নন্দীর কথার মাঝখানেই বলে ওঠেন, স্যার, এই মেয়েটিই হচ্ছে গুয়াহাটির মাধবী বড়ুয়া, যাকে আজ দু-তিনদিন ধরে আমরা গরু-খোঁজা খুঁজছি। প্রায় আধঘন্টা আগে ঐ ফেরারি আসামীটিকে ব্যারিস্টার পি. কে. বসুর চেম্বার থেকে গ্রেপ্তার করা গেছে।

সমরেন্দ্র মাধবীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর মজুমদারের দিকে ফিরে বললেন, কেসটা আমার জানা। ঐ মেয়েটি কি ভায়োলেন্ট? হ্যান্ড-কাফ্ পড়ানোর কী প্রয়োজন হয়েছিল?

–এটা একটা মার্ডার কেস, স্যার! আর সে বিষয়ে মিস্টার পি. কে. বাসু একটা কনফেশান করছিলেন এতক্ষণ!

—কী করছিলেন?

—একটা স্বীকারোক্তি দিচ্ছিলেন, মানে অপরাধের কনফেশান

—কোন অপরাধের স্বীকারোক্তি?

—এই মার্ডার কেস সংক্রান্ত স্বীকারোক্তিই, এ পর্যন্ত উনি স্বীকার করেছেন যে, অনীশ আগরওয়ালের প্রতিবেশিনী সেই সার্জেন্ট দত্তরায়কে নিয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হবার আগেই উনি অনীশের ঘরে ঢুকেছিলেন। মৃতদেহটি দেখেছিলেন। নিজেই তারপর দরজাটা লক্ করে দিয়ে বেরিয়ে আসেন। আর তারপর সার্জেন্ট দত্তরায়কে ডাহা মিছে কথা বলেন। বলেন, যে উনি প্রথম এসে দরজাটা বন্ধই দেখেছিলেন। ঘরে যে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে একথাটা পুলিশকে রিপোর্ট পর্যন্ত না করে উনি কেটে পড়েন!

সমরেন্দ্র নন্দীর ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। তিনি বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন। বাসু নির্বিকার! তারপর রানীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, আপনি এসব কথা ডিটেশানে লিখে যাচ্ছেন? কেন?

—উনি তাই চাইছেন বলে!

সমরেন্দ্র এবার বাসুকে প্রশ্ন করেন, ব্যাপারটা কী হচ্ছে?

বাসু বললেন, আমি একটা স্বীকারোক্তি করতে চাইছিলাম। ইন ফ্যাক্ট করছি—কিন্তু এই পুলিশ অফিসার দুজন আমাকে ক্রমাগত বাধা দিচ্ছেন।

সমরেন্দ্র সবিস্ময়ে বলেন, কনফেশানে আপনি কী বলবেন?

—আমাকে জবানবন্দিটা শেষ করতে দিলে তা পরিষ্কার বোঝা যাবে।

সমরেন্দ্র বললেন, অলরাইট! চলুক যা চলছিল!