বিশের কাঁটা – ১২

বারো

দোতলায় পুলিশের তাণ্ডব চলছে। উনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না। গাড়িটা বার করে রাস্তায় পড়লেন। নেপালী দ্বারপালটি অভ্যাসমতো তার ব্যাটনটা বগলে নিয়ে স্যালুট ঝাড়ল। বাসু-সাহেব ওকে একটা পাঁচ টাকার মুদ্রা ড্রাইভারের সীটে বসেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। লোকটা ক্ষুন্ন হলো, তবু নিল হাত পেতে। বাসু বললেন, আধুলি নেহীরে, পাঁচ রুপেয়া! কুৎকুতে ছোট দুটো চোখ বিস্ময়ে টইটুম্বুর। ও বোধহয় ইতিপূর্বে পাঁচ টাকার মুদ্রা দেখেনি। উল্টে-পাল্টে দেখে একগাল হাসল। আবার স্যালুট বাজাল।

বাসু গাড়িটা নিয়ে অতি ধীর গতিতে রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে আলমপুর মোড়ের দিকে চলেছেন—যাতে ওদিক-থেকে আসা কোনো সাইকেল-রিকশা হুস করে ওঁকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। একটু এগিয়েই ডান হাতি একটা রাস্তা—সাঁকরাইল স্টেশন রোড। ঐ রাস্তায় দশ মিটার ঢুকে গাড়িটা পার্ক করলেন। মুখটা থাকলো বড় রাস্তার দিকে ফেরানো। নেমে এসে বনেটটা খুলে উপরে তুলে নিলেন। তারপর পাইপ ধরিয়ে গিয়ে বসলেন পিছনের সীটে। ভাবখানা—ওঁর গাড়িটা বিগড়েছে; ড্রাইভার গেছে স্পেয়ার পার্টস-এর খোঁজে। এমন জায়গায় গাড়িটা পার্ক করা হলো যেখান থেকে বড় রাস্তা নজরে পড়ে। অর্থাৎ ‘সোনার বাঙলা রিসটস্’ থেকে পুলিশভ্যানটা যখন কলকাতা ফিরে যাবে তখন উনি দেখতে পাবেন। আবার স্টেশন বাজার থেকে মাধবী যখন রিকশা নিয়ে ফিরবে তখন তাকেও ধরতে পারবেন।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট কুড়ি পরেই পুলিশ ভ্যানটা কলকাতা-মুখো চলে গেল। সম্ভবত আন্দুল রোড ধরে বিদ্যাসাগর ব্রিজের দিকে। বাসু গাড়ি থেকে নেমে এসে বনেটটা নামিয়ে দিয়ে চালকের আসনে এসে বসলেন। এখন মাধবীর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা অদ্ভুত পাখির ডাকে উনি এ-পাশ ফিরলেন। পাখিটাকে দেখা যাচ্ছে না—কিন্তু সুরেলা মিষ্টি আওয়াজ। হঠাৎ যেন বাল্যকালে ফিরে গেলেন। পাখিটা ওঁর খুবই পরিচিত— মানে ওর সুরটা; অথচ কী আশ্চর্য! শহুরে জীবনের ঘূর্ণিপাকে সমাজবিরোধীদের পিছনে ছুটতে ছুটতে সেই বাল্যজীবনের সব সৌকুমার্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাসু এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। জনমানবের দেখা পেলেন না। পাখিটাকেও না। অপরাহু ঘনিয়ে আসছে। বাসুর দুরন্ত বাসনা হলো পাখিটাকে দেখবেন, চিনবেন।তিনি রাস্তার ‘বার্ম’ বরাবর প্রায় হামা দিয়ে ঝোপ-জঙ্গলটার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন। অনেক-অনেক অপরাধীকে এভাবে কায়দা করে চমকে দিয়েছেন; এবার পারলেন না। মগডালে-বসা পাখিজোড়া টের পেল। কুরুরুং…করে শব্দ তুলে একের-পিছে-এক উড়ে গেল!

বাসু ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন; ‘অরিয়ল! বেনেবউ!’ বাসন্তী রঙের একটা ঝিলিক তুলে পলাতকা কর্তা-গিন্নি পশ্চিম আকাশের দিকে উড়ে গেল। বহুদূরে একটা তেঁতুল গাছের মগডালে গিয়ে বসল। আবার শুরু হলো তাদের ‘কৃষ্ণ কোথা’? অথবা ‘খোকা হোক’! বহু-বহুদিন পরে দেখলেন : বেনেবউ! শুনলেন তাদের বাল্যস্মৃতি বিজড়িত কণ্ঠস্বর।

এতক্ষণে নজর গেল পশ্চিমকাশের দিকে। সোনা-গলানো রোদে অবগাহন করে অপরাহু যেন সন্ধ্যায় তুলসীমঞ্চে প্রণাম করতে এসেছে। গোটা পশ্চিম আকাশটা লালে-লাল। যেন কারা ওখানে একটু আগে ফাগ-আবীরে রঙদোল খেলেছে মেঘের রাজ্যে।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বাসু-সাহেবের।

প্রকৃতি এই চিরপুরাতন রঙের খেলা খেলে চলেছে নিত্যিদিন। বউ-কথা-কও গাঁয়ে-গঞ্জে আজও ‘কৃষ্ণ কোথায়’ খুঁজে ফেরে, আর ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু তখন বাতানুকূল-করা চেম্বারে বসে শিভাস রিগ্যালের সঙ্গে ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর পাঞ্চ করতে থাকেন!

হঠাৎ নজর হলো স্টেশনের দিকে থেকে একটি রিকশা এগিয়ে আসছে। ত্রিচক্র-যান। এতদূর থেকে মানুষজন ঠাওর হচ্ছে না। তবে একক-সওয়ারির পরনে ঐ ‘বউ-কথা-কও’ রঙের শাড়ি। ওঁর মনে পড়ে গেল—রমলা বলেছিল ‘হলুদরঙের মুর্শিদাবাদী’। তার মানে মাধবী এখানে এসে পোশাক বদলাবার সময় পায়নি।

নির্জনতার সুযোগে বৃদ্ধ বাসু-সাহেব যেমন হামা দেবার ‘বার্ড-ওয়াচিঙে’র চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক তেমনি গুয়াহাটি দূরদর্শনের জনপ্রিয়া গায়িকা এই গ্রাম্য পরিবেশে গলা ছেড়ে গান ধরেছে।

এই রোখকে! রোখকে!

গান ও রিকশা একই সঙ্গে থামল। না হলে রিকশাটা বৃদ্ধ পথচারীকে চাপাই দিয়ে ফেলত হয়তো।

দুরন্ত বিস্ময়ে মাধবী বলল, আপনি! এখানে?

বৃদ্ধ বললেন, উঃ কদ্দিন পরে দেখা! সেই তোর বিয়ের পরে আর দেখিনি। আমি তো এখানেই থাকি রে, নাতনি। হুই যে শিবমন্দিরটা দেখা যাচ্ছে, ওর পিছনবাগে। তুই কোথায় এসেছিলি? ‘সোনার বাঙলায়’? কর্তার সঙ্গে—না, না, সে হবে না। তোর দিদার সঙ্গে দেখা করে যেতেই হবে। আমি তোকে গাড়ি করে হোটেলে পৌঁছে দেব। আয়।

মাধবী কি বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারে না। তার ধারণা শহরের ক্লেদাক্ত কলকোলাহলকে পিছনে ফেলে ওরা দুটিতে এসে আত্মগোপন করেছে এই সুদূর পল্লীপ্রান্তে। একটি ‘মধুচন্দ্রিমা-কক্ষে—ব্রাইডল সুইট এ। ও কোথাও কোনো সূত্র রেখে আসেনি। পুলিশ, গোয়েন্দা, বাসু-সাহেব অথবা সেই হাড়-জ্বালানী জালান ওর খোঁজ পাবে না। অন্তত সাত- সাতটি দিবস রজনী। তা হলো না! প্রথম রাত্রির আগমন মুহূর্তে— সন্ধ্যায়—এসে আর্বিভূত হলেন ওর সলিসিটার। মাঝ সড়কে দাঁড়িয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় প্রলাপোক্তি করে চলেছেন। এক নাগাড়ে। যেন উনি সাঁকরাইলের আদি বাসিন্দা।

বাসু রিকশাওয়ালাকে বলেন, ওহে, কত ভাড়া ঠিক করে সওয়ারি উঠিয়েছিলি রিকশায়?

রিকশাওয়ালা এই উটকো ঝামেলায় বিরক্ত। বলে, স্টেশান বাজার থেকে ‘সোনার বাঙলা’ হোটেল-তক্ পুরো পাঁচ টাকা রফা হয়েছিল। কিন্তু আপনি তো মাঝরাস্তা থেকে মস্তানপার্টির মতো দিদিকে ছিন্তাই করে নিলেন। ভাড়ার কথা কী বলব বলুন?

বাসু বললেন, এ কী একটা কথা হলোরে, দাদুভাই? তুই রিকশা চালাস। আর, আমি হোমিওপ্যাথির ওষুধ বেচি—কিন্তু আমরা দুজন তো একই গাঁয়ের বাসিন্দা? আমার একটা বিবেচনা থাকবে না? নে, ধর—ভাঙানি দিতে হবে না। তবে মালগুলো আমার গাড়িতে তুলে দে, দাদু।

একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরেন রিকশাওয়ালার দিকে।

রিকশাওয়ালা রীতিমতো বিস্মিত। সে বিনা বাক্যব্যয়ে মাধবীর সওদা করা মালপত্র বাসু- সাহেবের গাড়িতে তুলে দিয়ে নোটটা কপালে ঠেকিয়ে বুকপকেটে রাখল। প্রস্থান করল।

মাধবী তার মুলতুবি প্রশ্নটাই পেশ করল আবার। বললে, আপনি এখানে এলেনই বা কী করে আর ঐ শিবমন্দিরের পিছনে…

বাসু বলেন, না না, শিবমন্দিরের পিছনে আমার কোনো বাড়িটাড়ি নেই। ‘দিদা’-র গল্প, হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারির আষাঢ়ে গল্প সে ঐ রিকশাওয়ালাকে বিভ্রান্ত করতে। তুমি জান না, ইতিমধ্যে পুলিশ এসেছে— হোমিসাইড স্কোয়ড— তারা ডক্টর বড়গোঁহাইকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। পুলিশ তোমাকেও অ্যারেস্ট করতে এসেছিল। কিন্তু শান্তনু বলেছে, তুমি রাগারাগি করে কলকাতায় ফিরে গেছ। গোয়েন্দা-পুলিশ সেটা অবিশ্বাসও করতে পারে। তখন লোকাল রিকশাওয়ালাদের মধ্যে খোঁজখবর নেবে। তাই ঐ রিকশাওয়ালাটাকে একটু গুলিয়ে দিলাম আর কি! এসে গাড়িতে উঠে বস।

মাধবী বললে, সোনার বাঙলা রিস্টয়ে-এ পুলিশ রেড করেছে?

—হ্যাঁ। শান্তনুকে ঐ নেকড়েগুলোর মুখে ফেলে দিয়ে আমি এখানে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, মাধবী। বিশ্বাস কর, আমার কোনো দ্বিতীয় পথ খোলা ছিল না। শান্তনু যদি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে, কোনো প্রশ্নের জবাব না দেয়, তবে ওরা তোমাকে ধরতে পারবে না।

মাধবী বললে, আমাকে ধরতে না পারাই কি আপনি নিজের চরম সাফল্য মনে করেন?

—না, তা করি না। কিন্তু এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে হবে, মাধবী। আর সেটা এই মাঝসড়কে সম্ভবপর নয়। তুমি গাড়িতে উঠে এস। এ জায়গাটা নিরাপদ নয়।

—তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?

—চুপচাপ বসে থাক। একটু পরেই দেখতে পাবে।

মাধবীকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে উনি স্টেশন বাজারের দিকে ফিরে গেলেন। গাড়িটা পার্ক করলেন একটি বড় স্টেশনারি দোকানের পাশে, যার কাউন্টারে একটা টেলিফোন নজরে পড়ল। মাধবীকে নির্দেশ দিলেন গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে। একটা খবরের কাগজ বাড়িয়ে ধরে বললেন, মুখটা যতদূর সম্ভব কাগজের আড়ালে রাখতে পারলেই ভাল হয়।

মাধবী জবাব দিল না। উনি গেলেন দোকানে। দোকানদারকে খুশি করতে কিছু হাবিজাবি জিনিস কিনলেন, যা নিত্যপ্রয়োজনীয়—টুথপেস্ট, মাথার তেল, শেভিং ক্রীম। মাধবীর জন্য একটা আঙ্কল চীস্‌। তারপর প্রশ্ন করলেন, একটা লোকাল ফোন করতে পারি?

—করুন। দু টাকা লাগবে।

বাসু রিসিভারটা তুলে নিয়ে সোনার বাঙলা রিস্টস্-এ ফোন করলেন। যথারীতি প্রীতম সিংজী ধরল ও-প্রান্তে। বাসু জানালেন যে, কন্যার সাক্ষাৎ তিনি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। উনি হোটেলে ফিরতে চান। আরও জানতে চাইলেন, কলকাতা থেকে যে উটকো ঝামেলা এসেছিল তারা বিদায় হয়েছে কি না। প্রীতম নিজে থেকেই জানালো তারা চলে গেছে; আর কোনো সেপাই-টেপাই বসিয়ে রেখে যায়নি। উনি বললেন, তাহলে এখনি ওঁরা দুজন ফিরে আসছেন। একটা ঘর ওঁর জন্য রিজার্ভ রাখতে।

দোকানিকে সওদা আর দূরভাষণের দাম মিটিয়ে অচিরেই ফিরে এলেন। নেপালী ছেলেটি বাগিয়ে স্যালুট করল আবার। যে-ঘরের ওয়াড্রবে উনি মাধবীর স্যুটকেসটা রেখে গিয়েছিলেন সেই দ্বিতলের ঘরটিই ভাড়া নিলেন। নিজের নামে। জানতে চাইলেন, ব্রাইডল-সুইট ছাড়া অন্য কোনো ঘরে টেলিফোন আছে কি?

প্রীতম বলল, জী নেহি। লেকিন এন্তাজাম হো জায়েগা।

প্রতি ঘরেই প্লাগ পয়েন্ট আছে। টেলিফোনের লাইনও টানা আছে। প্রীতমের ব্যবস্থাপনায় একটি টেলিফোন রিসিভার ঐ ঘরে এনে বসিয়ে দিল।

বাসু মাধবীর কাছে জানতে চাইলেন, তোমাকে পই পই করে বারণ করেছিলাম মনোহরপুকুর রোডের সোনার বাঙলা হোটেল থেকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাস্তায় নামবে না। কেন তুমি অবাধ্য হলে, মাধবী?

মাধবী অবাক হলো। বলল বাঃ! সে তো আপনারই ইন্সট্রাকশানে! আপনি বললেন না যে, এ হোটেল ছেড়ে শহরতলীর কোনো আস্তানায় গিয়ে গা-ঢাকা দিতে? শুধু আমাকে কেন, শান্তনুকেও তো আপনি তাই বলেছিলেন!

—আমি! কখন? কীভাবে?

—না, আপনি নিজে বলেননি। টেলিফোন করেছিলেন মাসিমা, আই মীন মিসেস বাসু। আজই সকালে। উনি আরও বললেন গোয়েন্দা-পুলিশ হয়তো আপনার লাইনটা ট্যাপ করেছে। কোনো কারণেই যেন আমি আপনাকে রিং ব্যাক না করি।

—বাঃ! তা তুমি আমার স্ত্রীর কণ্ঠস্বর চিনতে পারলে?

—না, তা পারিনি। অনেক সময় টেলিফোনে তা বোঝাও যায় না। তাছাড়া আপনি ছাড়া, মানে আপনি আর কৌশিকদা ছাড়া আমার টেলিফোন নাম্বার তো আর কেউ জানেন না। আমার তাই আদৌ কোনো সন্দেহ হয়নি। কেন? ফোনটা মাসিমা করেননি?

—ফর য়োর ইনফরমেশন, না!

—সেকি! তাহলে কে করতে পারে?

—দ্যাটস্ অ্যা মিলিয়ান-ডলার কোশ্চেন! তুমি কাল রাত্রি দশটায় ঐ হোটেলে চেক-ইন করেছিলে। কৌশিক আর আমি শুধু তোমার হোটেলের নাম বা নম্বর জানি। এক্ষেত্রে কীভাবে তুমি এমন ভুতুড়ে ‘কল’ পেতে পার?

—আপনি কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না?

—তা পারছি। আন্দাজ! সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু তার আগে আমার কতকগুলো প্রশ্নের জবাব দাও, মাধবী। তুমি একটি টেলিফোনে নির্দেশ পেলে চুপিচুপি সেই হোটেল ছেড়ে শহরতলীর কোনো হোটেলে আত্মগোপন করলে। তোমার স্টেটমেন্ট অনুযায়ী তুমি ধরে নিয়েছিলে যে, সে নির্দেশ আমারই, আমার প্রাইভেট-সেক্রেটারির মাধ্যমে দেওয়া। কেমন তো? সে-ক্ষেত্রে তুমি একা-একাই পালিয়ে গেলে না কেন?

—তাই যেতাম। জিনিসপত্র প্যাক আপ্ করে একটা টেলিফোন করলাম শান্তনুকে। সে বললে, সেও মাসিমার কাছ থেকে ঐরকম একটা নির্দেশ পেয়েছে। তার কিছুক্ষণ আগে এই ধূলাগড়ির বিজ্ঞাপনটা দেখেছি। আমিই ওকে সাজেস্ট করলাম সেখানে যেতে। দুজনেই পৃথক পৃথক রওনা হব। অবিলম্বে। সাঁকরাইল স্টেশনে নেমে যে আগে পৌঁছাবে সে অপেক্ষা করবে দ্বিতীয়জনের জন্য।

—ঠিক আছে। এবার তাহলে একটা ব্যক্তিগত ডেলিকেট প্রশ্ন করি, সচরাচর ক্রিমিনাল কেস-এ এজাতীয় রোমান্টিক প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু এক্ষেত্রে উঠছে। হোটেলে উঠে ‘ব্রাইডাল সুইট টা বুক করার প্রস্তাবটা কে প্রথমে দিয়েছিল? তুমি না ডক্টর বড়গোঁহাই?

মাধবী নতমস্তকে নীরবে রইল।

ঠিক তখনি দরজায় কে যেন নক করল। বাসু মাধবীকে বললেন, কুইক! বাথরুমে ঢুকে যাও।

মাধবী এক লাফে স্নানাঘরে ঢুকে দরজা টেনে দেবার পর বাসু সদর দরজা খুললেন। এসেছে রুম-বেয়ারা। তোয়ালে-সাবান, দুটো বেডশীট ইত্যাদি নিয়ে। রুম-বেয়ারা জানতে চাইল, ডিনারের অর্ডার দেবেন কিনা। বাসু বললেন, পরে। লোকটা চলে গেল। বাসু বাথরুম- দরজায় টোকা দিতে বার হয়ে এল মাধবী। বললে, বাপরে! এত ঘাবড়ে গেছিলাম!

বাসু সে কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, আমার প্রশ্নটার জবাব মুলতুবি আছে, মাধু। ‘ব্রাইডাল সুইটটা’ বুক করার প্রস্তাবটা কার? শান্তনুর না তোমার?

এবার ও মুখ তুলে বলল, আপনার এ-প্রশ্নটা ইলিভেন্ট হয়ে যাচ্ছে না কি? এটা আমাদের দুজনের প্রাইভেট ব্যাপার—

—নো, মিলেডি! প্রশ্নটা অত্যন্ত রেলিভেন্ট! শান্তনু না তুমি? কে ঐ ফুলশয্যা-কক্ষের জন্য এক্সট্রা চার্জ দিতে রাজি হয়ে প্রথম প্রস্তাবটা তুলেছিল?

হঠাৎ কী যেন একটা পরিবর্তন হলো মাধবীর। কোথা থেকে সাহস সঞ্চয় করে বৃদ্ধের চোখে চোখে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ, আমি স্বীকার করব। প্রস্তাবটা আমিই দিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, আরও বলব—তাতে ঘোরতর আপত্তি ছিল শান্তনুর। আমি কর্ণপাত করিনি।

বাসু বললেন, সিটি বাজানোটা আমার আসে না। হাততালিই দিই—কী বল? এই সিকোয়েন্সে তুমি একটা গানও ধরে দিতে পার, মাধবী, ‘প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা’?

মাধবী জ্বলন্ত একজোড়া চোখে তাকিয়ে থাকল নির্বাক।

বাসু বললেন, যা হোক। বোঝা গেল ব্যাপারটা। শান্তনু তোমাকে ফুসলে আনেনি, তুমিই তাকে সিডিউস করেছ! এবার তোমার অ্যাটর্নিকে কি জানাবে—কী কারণে ঐ নির্বাচন? আই মীন ‘ফুলশয্যা-কক্ষ’? অবিবাহিত পুরুষ-রমণীর?

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। তিন-পা পিছিয়ে গিয়ে ধপ্ করে বসে পড়ে খাটে। অস্ফুটে বলে, উঃ! কী নিষ্ঠুর আপনি! হিউম্যান সেন্টিমেন্ট বলে আপনার অন্তরে কোনো কিছু কি নেই? এভাবে ব্লান্ট প্রশ্ন করতে আপনার সঙ্কোচ হচ্ছে না!

—না, হচ্ছে না। কারণ আমার উদ্দেশ্যর সূচীমুখে একটি মাত্র লক্ষ্য : প্রবলেমটা সলভ্ করা।

—প্রবলেম! কী প্রবলেম?

—সমস্যা তো একটাই মাধবী, সে-রাত্রে অনীশকে কে খুন করেছিল।

—তার সঙ্গে এই ধূলাগড়ি রিস্টস্-এর ‘ব্রাইডাল সুইট -এর কী সম্পর্ক?

—অতি নিবিড় সম্পর্ক! যাক্ ও-কথা। তুমি যখন প্রশ্নটার জবাব দিতে সঙ্কোচবোধ করছ, তখন ও প্রশ্ন থাক। তুমি বরং একটা মামুলি প্রশ্নের জবাব দাও : তুমি নিশ্চয় ডক্টর বড়গোঁহাইকে বিবাহ করার মনস্থির করেছ?

এবার দেরি হলো জবাবটা দিতে। তারপর ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নেড়ে নিঃশব্দে জানালো : না।

—না? তুমি ওকে বিয়ে করতে রাজি নও? কেন? যেহেতু সে বিবাহিত?

চমকে উঠে মাধবী এবার বলে, কে?

—শান্তনু বড়গোঁহাই?

মাধবী ধমকে ওঠে, কী বকছেন স্যার, পাগলের মতো? শান্তনু বিবাহিত! তাকে আমি হাফপ্যান্ট পরে ড্যাং-গুলি খেলতে দেখেছি। গুয়াহাটিতে পাশাপাশি পাড়ায় থাকি— সে বিয়ে করলে আমি জানতে পারব না? ও বিবাহিত এমন উদ্ভুটে কথাটা কে বলেছে আপনাকে?

—তাহলে কিন্তু আমাকে সেই অশালীন প্রশ্নটায় আবার ফিরে আসতে হচ্ছে, মাধবী। অর্থাৎ—সেই ‘ব্রাইডাল সুইট -এর প্রসঙ্গে। তুমি যদি ওকে বিয়ে করতে রাজি না থাক তাহলে কেন গিয়ে তুলেছিলে ঐ ‘মধুচন্দ্রিমা কক্ষে? তুমি নিজেই বলেছ, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে?

আবার নতনয়না হলো মেয়েটি। আঙুলে আঁচলের খুঁটটা জড়াতে থাকে। বাসু-সাহেবের মনে হলো সাক্ষীর একটা জোরালে কৈফিয়ৎ আছে; কিন্তু কিছুতেই সেটা প্রকাশ করে বলতে পারছে না। এমন কাণ্ড মাঝে মাঝে আদালতে হতে দেখেছেন। তখন ঘুরপথে সত্যে উপনীত হতে হয়। আবার তাগাদা দেন, কী হলো? বল?

—আমি আপনাকে বলব না। বলতে পারি না। আমি…আমি যে ‘ওয়ার্ড অব অনার’ দিয়ে বসে আছি। এ জীবনে কখনো কাউকে সে-কথা বলব না। এখন যদি আত্মরক্ষা করতে আপনার কাছে স্বীকার করি, তাহলে আমি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাব।

বাসু বললেন, আই অ্যাপ্রিশিয়েট। এটা উইমেন্‌স্‌-লি-এর যুগ! পুরুষ একাই কেন ‘নাইটহুড-শিভালরি’ দেখাবে? অর্থাৎ ঐ প্রফেশনাল সমাজবিরোধীর দল, যারা গায়ের জোরে অথবা টাকার জোরে আমাদের সর্বস্ব বেআইনীভাবে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে–আমাদের টাকা- পয়সা মা-বোনদের—ক্রমাগত বিলো-দ্যবেল্ট আঘাত করে যাচ্ছে—আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেভাবে প্রত্যাঘাত করতে পারব না। কেন? কারণ ওরা যে অ্যান্টিসোশ্যাল; আর আমরা সত্যশিবসুন্দরপন্থী! অলরাইট, মাধু! তোমাকে স্বমুখে কিছুই স্বীকার করতে হবে না। কী ঘটেছে তা আমিই বলব! যে-কথাটা স্বমুখে স্বীকার করতে তোমার বাধছে, তা আমিই বলে যাচ্ছি। তুমি শুধু শুনে যাও। যদি ঠিক ঠিক আন্দাজ করতে পারি তাহলে তুমি ‘হাঁ-না’ কিছুই বলবে না। উঠে গিয়ে এক গ্লাস জল গড়িয়ে আমাকে এনে দেবে। ও. কে.?

মাধবী প্রশ্নটা বুঝল কী বুঝল না বোঝা গেল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। বাসু বললেন, তুমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছ, শান্তনুই এই হত্যাটা করেছে, কারণ, মার্ডার ওয়েপনটা পাওয়া গেছে মৃতব্যক্তির আলমারির পিছনে। সেটার লাইসেন্স ডক্টর বড়গোঁহাই- এর নামে। হত্যা উদ্দেশ্য যদি না থাকবে তাহলে সেটা গুয়াহাটি থেকে বেগবাগানে এসে পৌঁছাবে কী করে? এবং ঐ ঘরে? শতকরা নাইন্টি পার্সেন্ট চান্স ‘ফেটাল’ বুলেটটা ঐ রিভলভার থেকে নিক্ষিপ্ত। মোটিভও স্পষ্ট! ডাক্তার তোমাকে ভালবাসে—অনেকেই তা জানে। অনীশ তোমার সর্বনাশ করেছে। ফলে শান্তনু প্রতিশোধ নিতে এই কাজ করেছে। প্রশ্ন হতে পারে রিভলভারটা সে ওখানে ফেলে আসবে কেন? প্রসিকিউশান বলবে, দরজা খুলতে গিয়েই ও সার্জেন্টকে দেখতে পায়। তাই হাতে-নাতে ধরা-পড়ার চেয়ে ও সেটা আলমারির পিছনের ফাঁকে ফেলে পালায়…

মাধবী বাধা দিয়ে বলে, আপনি তাই বিশ্বাস করেন?

—না না, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা এখানে উঠছে না। আমি বলতে চাইছি, তুমি এই ঘটনাপরম্পরা, এই যুক্তির বিন্যাস করে সিদ্ধান্তে এসেছিলে খুনটা করেছে শান্তনু। তুমি অনীশের ঠিকানা না জানালেও শান্তনু তোমাকে অনুসরণ করে এসে ওর আস্তানাটা জেনেছে। তুমি আরও জানতে সুরঙ্গমার পাক্কা অ্যালেবাঈ আছে—

—আছে?

—আছে কি নেই, তুমি সঠিক জান না। হয়তো জান, নেই। কিন্তু সুরঙ্গমার সঙ্গে যেহেতু শান্তনুর আলাপ-পরিচয় নেই, তাই ওর অ্যালেবাঈ না টিকলেও প্রমাণ করা যাবে না যে, সুরঙ্গমা ঐ বিশেষ রিভলভারে অনীশকে খুন করেছে!… তুমি নিজে করনি, তা তুমি জান আমি করিনি, যেহেতু শান্তনুর রিভলভার আমার হস্তগত হতে পারে না। মহাদেব জালান করতে পারে না—একই কারণে, তাছাড়া ঘটনামুহূর্তে সে ট্যাক্সি নিয়ে নিউ আলিপুর থেকে হোটেল ডিউকে যাচ্ছে অথবা হোটেল থেকে আমার বাড়ি আসছে। উপরন্তু অনীশের বাড়ির অবস্থান জানার কোনো সুযোগ সে পায়নি। ফলে ‘নেতি নেতি করতে করতে—তোমার মতে অবশিষ্ট থাকল সেই দুর্ভাগা, যাকে তোমার ভাষায়, যার সঙ্গে তোমার বেণী দুলিয়ে স্কিপিং- করা যুগ থেকে একটা ‘কাফ-ল্যভ’ গড়ে উঠেছিল।

পাইপটা ধরিয়ে নিতে উনি থামলেন। মাধবী প্রস্তরমূর্তির মতো চুপ করে বসে রইল খাটে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বাসু শুরু করেন, লেডি-ইন-ডিস্ট্রেস্ যখন মুক্তির কোনো পথই দেখতে পাচ্ছেন না, তখন ম্যান্ডেলিন বাজাতে বাজাতে এসে হাজির হলেন কাহিনীর খলনায়ক! তোমাকে বললেন, শান্তনুর ফাঁসি হবেই! তবে তিনি তাঁর আকাশচুম্বী প্রভাব খাটিয়ে—রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক—ফাঁসির দড়ির বদলে যাবজ্জীবনের ব্যবস্থাপনা করে দিতে পারেন, যদি

—যদি? জানতে চায় মাধবী।

—তুমি তো সেটা জানই, মাধবী। উনি তোমাকে শর্তসাপেক্ষে শহরের সেরা লিগ্যাল অ্যাডভাইসের এন্তাজাম করে দিতে রাজি হলেন, যদি তুমি ঐ ভল্লুকাকৃতি প্রৌঢ়টিকে বরমাল্য দিতে স্বীকৃত থাক। তুমি শান্তনুকে ভালবাস। তীব্রভাবে ভালবাস। তুমি শ্যামার উত্তীয়কে চেন; তুমি টেইল অব টু সিটিজ-এর সিডনি কার্টনকে চেন! প্রেমের জন্য প্রাণ দেওয়া তোমার কাছে নতুন কথা কিছু নয়। তুমি রাজি হয়ে গেলে। মেনে নিলে ঐ চক্রান্তকারী ভালুকটার দাবী! বন্যার ভাষায় “সেথা মোর তিলে তিলে দান, করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করি পান।

বাসু থামলেন। মাধবী দু হাতে মুখ ঢাকল। শব্দ হচ্ছে না কিছু, কিন্তু ওর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। নিষ্ঠুরকণ্ঠে বাসু বললেন, তুমি কি জান, মাধু? ফাঁসির আসামীকে ফাঁসিমঞ্চে নিয়ে যাবার আগে তার ইচ্ছামতো লোভনীয় কিছু খাবার খাওয়ানো হয়? আহা! লোকটা তো মরেই যাচ্ছে—একমুঠো ভালোমন্দ কিছু খেয়ে যাক! সেই কারণেই কি তুমি এখানে এসে ‘ব্রাইডল সুইট টা বুক করেছিলে, মাধবী? নবমীর বলির পাঁঠাকে একমুঠো দূর্বাঘাস খাইয়ে তৃপ্ত করতে…

—শাট আপ!—মাধবী সোজা হয়ে বসেছে। তার টিপটা ধেবড়ে গেছে। চোখ দুটো ফুলো ফুলো। মাথার চুল অবিন্যস্ত।

রাসু থমকে থেমে গেলেন। মাধবী বললে, আপনার একটুও দয়া-মায়া নেই? আমার বিড়ম্বিত দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের আগে, মাত্র একটা সপ্তাহ আমি ওর জন্যে চুরি করে নিয়ে অঞ্জলি ভরে ওকে দিতে এসেছিলাম, আর আপনি সেটাকে এভাবে দুপায়ে মাড়াচ্ছেন!

—আয়াম সরি মাধবী! এভাবে দুপায়ে না মাড়ালে সত্য কথাটা স্বীকার করতে না! যাক, আমার যেটুকু জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। আন্দাজ ঠিকই করেছিলাম—হঠাৎ কেন মহাদেব জালান আমাকে এনগেজ করল ডক্টর বড়গোঁহাইয়ের তরফে। কিন্তু সেটা কনফার্ম করে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ঠিক আছে মাধবী, তুমি মুখ-চোখে জল দিয়ে তৈরি হয়ে নাও আমরা এবার ডিনারে যাব। ঐ ওয়াড্রবের ভিতর স্যুটকেসটা আছে। ইচ্ছা করলে পোশাকটা বদলেও নিতে পার।

মাধবী বাথরুমে চলে গেল মুখে-চোখে জল দিতে।

বাসু এবার টেলিফোন করলেন নিজের বাড়িতে। একবার বাজতেই ও-প্রান্তে থেকে ভেসে এল, ব্যারিস্টার বাসু’জ চেম্বার।

কণ্ঠস্বর শুনেই চিনেছেন। বললেন, শোন রানু। আমি অনেক দূর থেকে কথা বলছি। হয়তো রাতে ফিরতে পারব না। কোনো খবর আছে?

হেড-পিসে ভেসে এল রানীর কণ্ঠস্বর, আয়াম সরি, স্যার। মিস্টার পি. কে. বাসু এখন কলাকাতায় নেই। কাল-পরশুর মধ্যে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে পারছি না…

বাসু বললেন, বুঝেছি! তোমার নাকের ডগায় বসে আছেন বোধকরি তেনারা, যাঁদের স্পর্শ করলে অষ্টাদশ বিস্ফোটক হয়? তাই কি?

—একজ্যাক্টলি!

—অলরাইট! মনে হচ্ছে তুমি আউটার রিসেপশানে বসে ফোনটা অ্যাটেন্ড করছ…তাই নয়?

—ইয়েস।

–সে-ক্ষেত্রে তুমি কি আমার প্রাইভেট চেম্বারে চলে আসতে পার? এক্সটেনশান টেলিফোনের প্লাগটা খুলে দিয়ে?

রানী বললেন, হ্যাঁ, নেক্সট উইক হলে হতে পারে। আপনি লাইনটা ধরে থাকুন। মিস্টার বাসুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্যাডটা ওঁর চেম্বারে আছে। আমি সেখানে গিয়ে, সেটা দেখে, আপনাকে পরের সপ্তাহে একটা সুবিধামতো তারিখ দিতে পারি। প্লিজ হোল্ড অন।

রিসেপশান কাউন্টারে বসে থাকা দুই পুলিশ অফিসার আর মহাদেব জালানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। বললেন, প্লীজ এক্সকিউজ মি!

তারপর হুইল চেয়ারে পাক মেরে উনি চলে গেলেন চেম্বারে। ঠিক তখনই বিশু একটা বড় ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকল। আগন্তুকদের চা-বিস্কিটে আপ্যায়ন করতে।

মিসেস বাসু এঘরে এসে এক্সটেনশান লাইনের প্লাগ-পয়েন্টটা খুলে দিলেন। বললেন, এবার বল? এখন আমি তোমার প্রাইভেট চেম্বার থেকে বলছি।

—রিসেপশানে কেউ রিসিভার তুললে আমাদের কথাশুনতে পাবে না তো, সেবারের মতো?

—না!তুমি কোথা থেকে বলছ?

–কলকাতার বাইরে, সাঁকরাইলের কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে। এখানকার টেলিফোন নম্বরটা লিখে নাও। ফর এমারজেন্সি ফোন : শোন, আজ রাতে আর ফিরতে পারছি না। কাল সকালে ফিরব। ওঘরে কে কে আছে?

—দুজন পুলিশ অফিসার। মনে হচ্ছে লালবাজার হোমিসাইড স্কোয়াডের ইন্সপেক্টার ওরা সারাদিনে বার-তিনেক এসেছিল তোমার খোঁজে। আমাকে জানিয়ে রেখেছে, লালবাজার হোমিসাইডের বড়কর্তা তোমাকে খুঁজছেন। অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন। এ খবরটা তুমি সশরীরে আসামাত্র অথবা টেলিফোনে যোগাযোগ করামাত্র যেন তোমাকে জানিয়ে দিই।

—তা দিও। আমি শরীরে ফিরেও আসিনি, টেলিফোনও করিনি। এ টেলিফোনটা তো একজন নেক্সট-উইক-ক্লায়েন্টের।

—হ্যাঁ, পুলিশ ইন্সপেক্টর দুজন মনে হলো তা বিশ্বাস করেছে; কিন্তু জালান করেনি।

—জালান? সেই জ্বালান! এখনো জ্বালাচ্ছে?

—প্রায় সরাদিনই বসে আছে। মাঝে মাঝে অর্পণার স্টেশনারি দোকানে উঠে যায় ফস্টি-নস্টি করতে, মাঝে মাঝে মোড়ের মাথার রেস্তোরাঁয় যায় ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে; কিন্তু বাড়ির উপর সারাদিনই নজর রাখেছে।

—আই সী? কৌশিক আর সুজাতা কোথায়?

—ওরা বেরিয়েছে। রাতে ফিরবে বলে গেছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি।

—অলরাইট। একটা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছি। ভাল হয়, তুমি যদি শর্টহ্যান্ডে নোট নিয়ে নাও কাগজ পেন্সিল নিয়েছ?…অলরাইট। নম্বর ওয়ান : রামলগন ভার্গব, আর্কিটেক্টকে ফোনে ধর। ওর নম্বরটা মনে নেই, কোথাও লেখাও নেই। কিন্তু টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে পাবে। ঠিকানা : ‘সল্টলেক সেক্টার টু। তাকে ধরতে পারলে তোমার পরিচয় দিয়ে আমার নাম করে জানতে চেয়ো ওর মাসতুতো বোন সুরঙ্গমার পাণ্ডের টেলিফোন নম্বরটা কত। সে এখন সম্ভবত জামশেদপুরে আছে। ভার্গব যদি তোমার আইডেন্টিটিতে সন্দেহ প্রকাশ করে তাহলে বল, “আপনার যে বোনের সঙ্গে ‘অলোকাছন্দার পুত্রকন্যা’ থিয়েটার দেখেছিলেন—অলোকানন্দার’নয়। মনে পড়েছে?” এ-কথাতেই সে মেনে নেবে যে, তুমি মিসেস বাসু।

মিসেস বাসু বলেন, অলরাইট। ধর, আমি ভার্গবের কাছ থেকে সুরঙ্গমার টেলিফোন নম্বরটা পেলাম। তারপর?

—নম্বর টু : তুমি সুরঙ্গমাকে আজ রাত্রে জামশেদপুরে এস.টি.ডি. ফোন করবে। জানতে চাইবে—দিস্‌ ইজ্ মোস্ট ইম্পর্টেন্ট : ‘ঘটনার রাত্রে অর্থাৎ শুক্রবার রাত নটা নাগাদ মাধবী বড়ুয়া সুরঙ্গমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসার পর এবং রাত সাড়ে নটা নাগাদ আমার সঙ্গে মেজানাইন ঘর ছেড়ে চলে আসার মধ্যে মাধবীকে কি কেউ টেলিফোন করেছিল? যদি করে থাকে তাহলে সে কি তার আইডেন্টিটি জানিয়েছিল?’ প্রশ্নটা বুঝেছ?…অলরাইট প্রশ্নটা পড়ে শোনাও তো?

মিসেস বাসু প্রশ্নটা পড়ে শোনালেন। বাসু বললেন, কারেক্ট! এবার শোন : জবাবে ও যা বলবে তা শর্টহ্যান্ডে নোট করে ট্র্যান্সক্রাইব করে আমার জন্য রেখে দিও। আরও একটা কথা, সুরঙ্গমা তোমাকে চেনে না। সে জবাব দিতে অস্বীকারও করতে পারে। তখন তার বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য বল, আমার স্বামীর সঙ্গে আপনার শেষ কথোপকথন হয়েছিল এই রকম উনি বলেছিলেন—তুমি কি একটা ছোট হাতব্যাগে তোমার কোনো দামী জিনিস—জিনিসটাব নাম উচ্চারণ না করে—আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে চাও?” আর আপনি জবাবে বলেছিলেন, “বাবার সেই জিনিসটা আমি জামশেদপুর থেকে আনিনি, মিস্টার বাসু।”—এই কথায় সে মেনে নেবে যে তুমি মিসেস পি. কে. বাসু। এনি কোশ্চেন?

—হাঁ। ডিনারের আগে মনে করে আধখানা সরবিট্রেট খেও। তোমার ওয়ালেটের বাঁ- দিকের খোপে আছে!

বাসু বললেন, যা বাব্বা! কী কথার কী জবাব! এনিথিং এস্‌?

—হ্যাঁ! দু পেগের বেশি মদ খেও না, রাতে! ওখানে ভাল হুইস্কি পাবে না। দেশী মদ! লাইনটা কেটে দিলেন রানু।