বিশের কাঁটা – ১১

এগারো

বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে উনি রওনা হলেন, গেস্টকিন উইলিয়ামস্ কারখানাকে বাঁয়ে রেখে। আন্দুল রোডে আজ ভিড় আছে। শনিবারের অপরাহু। কলকাতা ছেড়ে অনেকেই সপ্তাহান্তিক অবকাশ কাটাতে চলেছে। কেউ খড়গপুর, কেউ কোলাঘাট, কেউ দীঘা। প্রায় বিশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আলমপুরের মোড়ে এসে পড়লেন বম্বে রোডে। বম্বে রোড ধরে কিছুটা এগিয়েই ধূলাগড়ি গ্রাম। ‘সোনার বাঙলা রিসর্টস্’-এর বিজ্ঞাপন এবং বাহারে গেট নজরে পড়বেই। গেট দিয়ে ঢুকবার মুখে বাসু আঁৎকে উঠলেন। পরক্ষণেই বুঝলেন, না! যে লোকটা ব্যাটনটা বগলে নিয়ে অ্যাটেনশান-ভঙ্গিতে ওঁকে স্যালুট করেছিল তার পোশাক প্রায়-পুলিশের মতো হলেও নেপালী কিশোরটি ঐ প্রতিষ্ঠানের দ্বারপাল মাত্র।

বাসু একটু ভিতরে নিয়ে গিয়ে উল্টোদিকে মুখ করে গাড়িটা পার্ক করলেন, যাতে ঝোপ- ঝাড়ের আড়ালে নম্বরটা সহজে নজরে না পড়ে এবং গাড়ি না ঘুরিয়ে চট করে বেরিয়ে যাওয়া যায়।

কাউন্টারের কাছে এগিয়ে এসে দেখলেন একটি তরুণ পাঞ্জাবি ছেলে বসে আছে। বাসু সরাসরি তার কাছে গিয়ে বললেন, এক্সক্যুজ মি, আপ্‌ প্রীতম সিংজী হাঁয়, ন?

ছেলেটা সোজা হয়ে বসল। রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, আপ্‌কো কৈসে মালুম?

—বহ্ আপকো মনোহরপুকুর রোড প্যে যো ব্রাঞ্চ হয়, উমে মেরি ভাতিজাকা লেড়কি কাম করতি—রলা, রমলা সেনগুপ্তা।

—অব সম্‌ঝা। বৈঠিয়ে। আপকা বেটিকি তালাস মে অ্যায়ে হেঁ?

বাসু বসলেন। লক্ষ্য করে দেখলেন প্রীতম ছাড়া কাউন্টারের কাছাকাছি আর কেউ নেই। হিন্দিতে জানতে চাইলেন, ওঁর মেয়ে-জামাই কি ঘরে আছে?

প্রীতম জানালো মিসেস সেন বেরিয়েছেন; কিন্তু মিস্টার সেন ঘরেই আছেন।

বাসু হিন্দিতে জানতে চান, মিসেস সেন কি চেক-আউট করে বেরিয়ে গেছেন?

প্রীতম জানালো, মিসেস সেনের চেক-আউট করার সওয়াল উঠছে না, কারণ ঘর ‘বুক’ করেছেন মিস্টার সেন। তবে হ্যাঁ, মিসেস সেন তাঁর গ্রে-রঙের স্যুটকেস নিয়ে যাননি। অটো- রিকশায় চেপে বাজারের দিকে গেছেন—লোকাল মার্কেট থেকে কিছু খরিদ করতে। কারণ যাবার আগে প্রীতমকে প্রশ্ন করেছিলেন বাজার কোনদিকে। ডাক্তারখানা আছে কি না সেখানে, ইত্যাদি।

বাসু বললেন, ওর ঘরে ফোন আছে?

—জী হাঁ। উনহোনে ‘ব্রাইডাল স্যুট বুক কিয়া। উমে টেলিফোনভি হ্যায়। এ. সি. ডিলক্স রুম।

—ওকে একবার ফোন করুন তো?

—ক্যা নাম বাঁতাউ?

—বহু রিসিভার উঠানে সে মুঝকো দেনা।

প্রীতম মিস্টার সেনের ঘরে রিং করল। একটু পরেই টেলিফোনটা বাড়িয়ে ধরল বাসু- সাহেবের দিকে। বাসু টেলিফোনে প্রশ্ন করলেন, মিস্টার সেন? সমীর সেন কতে হেঁ ক্যা?

—ইয়েস! আপ কৌন? রিসেপশান?

বাসু এবার শাদা বাঙলায় বললেন, আজ্ঞে না। আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার দরকারটা ছিল মিসেস সেনের সঙ্গে। উনি কি আছেন?

—না। কিন্তু আপনি কে? চিনি-না-চিনি আপনার একটা পিতৃদত্ত নাম তো আছে।

—তা আছে। আপনার পিতৃদত্ত নামটা যেমন সমীর সেন, আমার পিতৃদত্ত নামটা তেমনি শান্তনু বড়গোঁহাই। তা মিসেস সেন কখন ফিরবেন?

এবার ও-প্রান্তে নীরবতা।

—কী হলো সমীরবাবু? শুনতে পেলেন না?

ও-প্রান্ত এবার বললেন, সে…ইয়ে…কলকাতায় ফিরে গেছে!

—খুব ভাল কথা। তাহলে এই মওকায় আপনার সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা সেরে নেওয়া যাক। আমি আসছি আপনার ঘরে। ব্রাইডাল স্যুটটা তো?

—বাট্…বাট্…হু আর য়ু? কে আপনি?

—এখনি বললাম না—আমার নাম ডক্টর শান্তনু বড়গোঁহাই? গুয়াহাটির!

একটু পরে হোটেলের ও-প্রান্তে নির্জন ‘ব্রাইডল স্যুইট -এর দ্বিতলে উঠে এলেন বাসু। দরজায় নক করামাত্র সেটা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনে ডঃ বড়গোঁহাই যেন ভূত দেখল।

—আপনি! এখানে!

বাসু বললেন, ‘ম্যাকবেথে’-এর উক্তিটা এখানে সুপ্রযুক্ত হতো, ডক্টর! —দাউ কাল্ট সে দ্যাট আই ডিড্ ইট!’

বড়গোঁহাই-এর মুখে জবাব ফোটে না। বাসুই ধমকে ওঠেন, দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ান। বসুন ঐ খাটে। না, আমি ব্যাঙ্কোর প্রেতাত্মা নই। তবু একই প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা করব—কেন আপনি এ কাজ করলেন? কেন? কেন? কেন?

বড়গোঁহাই দু পা পিছিয়ে গেল। বোধকরি ওর চরণযুগল আর দেহভার বইতে পারছিল না। ধপ্ করে বসে পড়ল খাটে। বললে, বিশ্বাস করুন, বাসু-সাহেব, আমি অনীশ আগরওয়ালকে হত্যা করিনি।

বাসু একটা চেয়ার দখল করে বসলেন। অনেকক্ষণ একটানা ড্রাইভ করে এসেছেন। ধূমপান করা হয়নি। পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করে বললেন, মার্ডার-কেসটার কথা পরে হবে। আপাতত জবাব দিহি করুন—বিবাহ না করে একটি কুমারী মেয়েকে ‘সিডিউস্’ করে কেন এনে তুলেছেন এই ‘মধুচন্দ্রিমা-কক্ষে? নাম ভাঁড়িয়ে। স্বামী-স্ত্রীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে?

শান্তনু বললে, এটাও বিশ্বাস করুন, স্যার। পরিকল্পনাটা আমার নয়। ওর।

—ন্যাকা! আপনি কচি খোকা! জানেন না যে, আপনাদের দুজনকেই পুলিশে হন্যে হয়ে খুঁজছে? এই অবস্থায় কেন আপনি আমার মক্কেলকে এখানে ফুলে এনেছেন?

—প্লীজ, মিস্টার বাসু! এভাবে বলবেন না। একবার বলেছি, আবারও বলছি, এই ‘ধূলাগড়ি গ্রামের ‘সোনার বাঙলা রিসটস্’-এর নামই আমি জানতাম না। মাধুই আমাকে টেলিফোন করে সাঁকরাইল স্টেশনে চলে আসতে বলে। আমরা দুজনে দুটি পৃথক লোকাল ট্রেনে চলে আসি। সেখান থেকে একটা অটো-রিকশায়—

—কিন্তু ‘পথিক হোটেল’ থেকে চেক-আউট করে চলে এলেন কেন?

—বাঃ! সেটা তো আপনারই ইন্সট্রাকশানে!

—আমার ইন্সট্রাকশানে? মানে?

—না! আপনার নিজের নয়। কিন্তু আজ সকাল সাতটার সময় আপনার সেক্রেটারি, মানে মিসেস বাসু তো আমাকে টেলিফোন করে বলেছিলেন, ইম্মিডিয়েটলি ‘পথিক হোটেল’ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে!

—তাই নাকি? কেন?

—কেন মানে? আপনি জানেন না কেন?

—লুক হিয়ার ডক্টর, সময় কম। পুলিশে আপনাকে সত্যিই খুঁজছে। আমি যেভাবে আপনাকে ‘ট্রেস’ করেছি একক প্রচেষ্টায়, পুলিশ বাহিনী তা যে-কোনো মুহূর্তে সম্পন্ন করতে পারে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে বলে যান মিসেস বাসু আপনাকে কী বলেছিলেন এবং আপনি তাঁর ইন্সট্রাকশান মোতাবেক কী কী করেছিলেন?

—উনি আমাকে বললেন যে, পুলিশে আমার হারানো রিভলভারটা ট্রেস করেছে। তাতে নাকি একটা ডিচার্জড বুলেট। অথচ আমার কাছে থেকে যখন ওটা খোয়া যায় তখন ছয়টাই তাজা বুলেট ছিল। উনি আমাকে বললেন, অবিলম্বে আত্মগোপন করতে। কারণ পথিক হোটেলের অ্যাড্রেসটা অনেকেই জানে। বললেন, শহর বা শহরতলী অঞ্চলে ছদ্মনামে উঠতে। আরও বললেন, মাধুকেও পুলিশে খুঁজছে। সে আছে মনোহরপুকুরের সোনার বাঙলা হোটেলে। টেলিফোন নাম্বারটাও বললেন। এবং বললেন, আপনি বলেছেন সেও যেন ঐ হোটেল ত্যাগ করে অন্য কোনো হোটেলে চলে যায়। মিসেস বাসু এ-কথাও বলেছিলেন যে, আপনার বাড়ির টেলিফোনটা হয়তো পুলিশে ট্যাপ করেছে। তাই আপনাকে যেন কোনো কারণেই আমরা ফোন না করি।

—ওয়ান্ডারফুল অ্যারেঞ্জমেন্ট! তা আপনি কী করলেন?

—আমি তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে নিতেই রুম-বেয়ারা এসে বলল, ফোনে আবার কেউ আমাকে ডাকছে। এবার ফোন করেছিল মাধবী, সে জানালো সে কোন্ হোটেলে কী নামে উঠেছে। আমি বললাম, তা আমি ইতিমধ্যে জেনে গেছি। ওকে জানালাম আপনার ইন্সট্রাকশান—শহরতলীর কোনো হোটেলে পালিয়ে যেতে। আমার রিভলভারটা খোয়া যাওয়ার কথাও বললাম। তবে পুলিশে যে সেটা পেয়েছে তা আর জানাইনি। ও নার্ভাস হয়ে যাবে আশঙ্কায়।

—বুঝলাম। তারপর?

—তারপর বেলা সাড়ে নটা নাগাদ ও আবার ফোন করল। এই ‘ধূলাগড়ি হলিডে রিসটস্’-এর খবরটা দিল। বলল, যে-কোনো লোকাল ট্রেনে এসে আমি যেন সাঁকরাইল স্টেশনের আপ প্লাটফর্মে অপেক্ষা করি। ও একই সময়ে রওনা দিচ্ছে। আমরা যেই আগে পৌঁছাই সে অপেক্ষা করবে স্টেশনে!

—বাট হোয়াই দিস্ ‘ব্রাইডাল সুইট?

—বিশ্বাস করুন। সেটাও আমার ইচ্ছায় নয়। মাধুর ইচ্ছাতেই।

—আপনি কি ওকে বিয়ে করবেন?

—যদি আমার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না হয় এবং আমি জেল থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত মাধবী যদি অপেক্ষা করে।

—আপনি কি অনীশ আগরওয়ালকে খুন করেছেন?

—সে তো এইমাত্র বললাম, করিনি, করিনি, করিনি। —আপনি কি বিবাহিত?

–বেগ য়োর পার্ডেন?

—আপনি বছর দুই আগে রেজিস্ট্রি মতে একটি মেয়েকে বিবাহ করেননি?

—এসব কী বলছেন আপনি! সার্টেনলি নট!

—রিভলভারটা গুয়াহাটি থেকে কেন এনেছিলেন? কী করে খোয়া গেল?

—এনেছিলাম আত্মরক্ষার্থে। অনীশ আগরওয়াল লোকটা মারাত্মক হবে আশঙ্কা করে। আর ওটা খোয়া গেছে— যদ্দূর সম্ভব—আমার ঐ ‘রেন্ট-আ-কার’ গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে।

—ড্যাশবোর্ডের ড্রয়ারটা তালাবন্ধ ছিল না?

—না…মানে…

—কোথায়? কখন নজরে পড়ল আপনার?

ডক্টর বড়গোঁহাই জবাব দেবার আগেই লাফ দিয়ে উঠে পড়েন বাসু। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন। বলেন, আয়াম অ্যাফ্রেড ওরা এসে গেছে।

—ওরা?

—পুলিশ! শোন শান্তনু! তুমি আমার মক্কেল! কিন্তু মাধুকে বাঁচাতে আমি বাধ্য হয়ে ঐ নেকড়েগুলোর মুখে তোমাকে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হচ্ছি। ওরা মিনিট তিন-চারের মধ্যেই এসে যাবে। তোমাকে অ্যারেস্ট করবে। তুমি বলবে, মাধবী তোমার সঙ্গে এসেছিল কিন্তু রাগারাগি করে কলকাতায় ফিরে গেছে। অনীশ আগরওয়ালের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কোন প্রশ্নের জবাব দেবে না। বলবে, আমি তোমার অ্যাটর্নি। আমার অনুপস্থিতিতে তুমি ও বিষয়ে কোনো কথা বলতে পার না।

—বাট্ স্যার, আপনি তো আমার অ্যাটর্নি নন। আপনি তো মাধুর অ্যার্টনি।

–নো। তোমরা দুজনেই আমার মক্কেল! সেটা প্রমাণ করার দায় আমার। এখন মাধুর স্যুটকেসটা আমাকে দাও।

ভাগ্যক্রমে সেটা খোলা ছিল। বাসু ড্রেসিং টেবিল থেকে টপাটপ কিছু মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী তুলে নিয়ে তাতে ভরে দিলেন। ওয়াড্রবটা খুলে মেয়েদের পোশাক-আশাক অতি ক্ষিপ্রগতিতে তুলে স্যুটকেসটা বন্ধ করলেন। তালাবন্ধ করা গেল না। সেটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন করিডোরে। পর পর তিনটে ডোর-নব ঘোরাবার চেষ্টা করলেন। কোনোটাই খুলল না। চতুর্থটার ক্ষেত্রে ডোর-নব ঘুরল। ডবলবেড রুম। বেশ বোঝা যায়, প্রাগর্তী বোর্ডার বিদায় হওয়ার পর ঘরটা এখনো ঝাড়-পৌঁছ করা হয়নি। বিছানাটা অপরিষ্কার। সয়েলড তোয়ালেটা টেবিলের উপর। বাসু চট্-জলদি ঢুকে গেলেন সেই ঘরে। বৃদ্ধ মানুষ, স্যুটকেসটা বইতে পরিশ্রম হয়েছে। বসে পড়লেন খাটের উপর। ওয়ালেট বার করে তার গর্ভ থেকে একটা ‘সরব্রিট্রেট টাবলেট বার করে জিবের তলায় রাখলেন।

বিশ সেকেন্ডও হয়নি। করিডোরে ভারী কিছু বুটের শব্দ। সিঁড়ির দিক থেকে ‘ব্রাইডাল সুইটের’ দিকে এগিয়ে গেল। বাসু মাধবীর স্যুটকেসটা ওয়াড্রবে ঢুকিয়ে দিলেন। হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা টান-টান করে দিলেন। দরজার ভিতর দিকে তালায় গা-চাবিটা ঝুলছিল। সেটা পকেটস্থ করে দরজা তিন সেন্টিমিটার ফাঁক করে দেখলেন। ত্রিসীমানায় কাউকে দেখা গেল না। টুপ্ করে বাইরে এসে দরজাটা টেনে দিলেন। তারপর নিঃশব্দে নেমে এলেন নিচে। কাউন্টারের কাছে একজন কন্সটেব্‌ল্‌ খৈনি ডছিল। বাসু তাকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না। এগিয়ে গেলেন কাউন্টারে। চাবিটা হস্তান্তরিত করে বললেন, পুলিশনে উ শালা দামাদকো পাকড় লিয়া। ইয়ে কুঞ্চি রাখিয়ে। ম্যয় বাহারকা তরফ যা-রহা হুঁ। মেরি লেড়কি কী তালাস মে। কিসিকো কুছ না বাতানা

প্রীতম সিং তার বাম চক্ষুটা নিমীলিত করল।

বাসু-সাহেব দেখাদেখি তাঁর দক্ষিণ চক্ষুটা নিমীলিত করে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেলেন।