বিশের কাঁটা – ১০

দশ

মনোহরপুকুর রোডে বাসু-সাহেব যখন পৌঁছালেন তখন বেলা তিনটে ‘সোনার বাঙলা’ হোটেল খুঁজে বার করতে অসুবিধা হলো না। গাড়িটা পার্ক করে উনি এলেন রিসেপশান কাউন্টারে। একটি বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বাঙালী মহিলা বসেছিলেন কাউন্টারে। উত্তরটা জানাই আছে, তবু বাসু ঐ প্রশ্নটাই করলেন, থ্রি/থ্রি ঘরের মিস্ মঞ্জরী বড়ুয়া কি ঘরেই আছেন?

মহিলাটি নির্নিমেষ নয়নে বাসু-সাহেবকে যাচাই করলেন। খাতাপত্র না দেখেই বললেন, না, মিস্ বড়ুয়া আজ সকালে চেক-আউট করে বেরিয়ে গেছেন। বেলা সওয়া দশটা নাগাদ।

–চেক-আউট করে! কী সর্বনাশ! কোনো ফরোয়ার্ডিং আড্রেস রেখে যায়নি?

—আজ্ঞে না!

বাসু স্বগতোক্তি করলেন, তবে তো ঝামেলা হলো। কী পাগল মেয়ে, আমাকে একটা খবর দিয়ে হোটেল ছাড়বে তো?

মহিলা প্রশ্ন করেন, কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কি ব্যারিস্টার?

—হ্যাঁ, মা। ঐ মঞ্জরী আমার ক্লায়েন্ট। তাকে বলেছিলাম এই হোটেলে আমার জন্য অপেক্ষা করতে!

মহিলাটি বললেন, আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি ‘কাঁটা-সিরিজের’ ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু! তাই নয়? কাগজে আপনার ছবি দেখেছি।

—তা আমি তো সেটা অস্বীকার করছি না…

—একটু কফি খাবেন, স্যার?

—কফি। এইমাত্র তো ঘোল খাওয়ালে, মা। তারপর কফি?

—বাঃ! আমার কী দোষ? আপনার ক্লায়েন্ট যদি আপনার কথা না শোনে!

—তা বটে!

—আপনি যদি আমাদের হোটেলের আপ্যায়নে এক পেয়ালা কফি পান করতে রাজি হন তাহলে আপনাকে দু-একটা ক্লু দিতে পারি!

—‘ক্লু’! কীসের ক্লু?

—মিস্ বড়ুয়া কোথায় যেতে পারেন!

—তুমি তো আচ্ছা মেয়ে! বেশ, কফির অর্ডার দাও। শুনি তোমার ব্লু।

মহিলাটি বেয়ারাকে ডেকে দু পেয়ালা কফি আর বিস্কিটের অর্ডার দিয়ে বললেন, আমার আরও একটা আবদার আপনাকে মানতে হবে কিন্তু…

—অটোগ্রাফ তো? দাও খাতা।

— আজ্ঞে না। অটোগ্রাফ জমানোর বাতিক আমার নেই। কৌশিকবাবু কাঁটা-সিরিজের একটি বইতে একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন—সংস্কৃত শব্দ—আমি তার মানে বুঝিনি। আমি সংস্কৃত আদৌ পড়িনি। বরাবর মিশনারি কনভেন্টে পড়েছি। আপনি যদি কথাটার মানে বলে দেন…

—আমিও ম্যাট্রিক পাশ করার পর—অর্থাৎ 1940 এর পর আর সংস্কৃত পড়িনি। পড়েছি আইন। তবু বল, তোমার কী অনুপপত্তি।

—’অনুপপত্তি’ মানে?

—মানে ‘র‍্যাসকূট। তাও বুঝলে না? আননোন স্যাংস্কৃট ওয়ার্ড!

—ও! শুনুন। ‘অ-আ-ক খুনের কাঁটায়’ একটা শব্দ আছে “বেচারাথেরিয়ামৈঃ নমঃ”। ‘নমঃ’ মানে তো প্রণাম করি। ‘বেচারাথেরিয়ামৈঃ’ মানে কী?

—তুমি সুকুমার রায়ের লেখা ‘হেঁশোরামের ডায়েরি’ পড়েছ?

—না।

—তুমি সুকুমার রায়ের নামটা অন্তত শুনেছ?

—হ্যাঁ। বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বাবা।

—না! বরং বলব, সত্যিজিৎ রায় হচ্ছেন ক্ষণজন্মা সুকুমার রায়ের সুযোগ্য পুত্র। তা সে যাই হোক। ঐ ‘হেঁশোরামের ডায়েরি’তে আছে ‘বেচারাথেরিয়াম্’। ‘হস্’-অন্ত কথা, শব্দটা যে ব্যবহার করেছে সে ভেবেছিল যে, ‘বেচারাথেরিয়াম্’ শব্দটা ‘নরঃ’ শব্দের অনুরূপ। এখন নর শব্দের তৃতীয়ার বহুবচনে হয় ‘নরৈঃ’। সেই হিসাবে ও লিখেছিল, ‘বেচারাথেরিয়ামৈঃ’। তা থেকে বোঝা গিয়েছিল লোকটা সংস্কৃতে আমারই মতো পণ্ডিত। প্রথম কথা, ‘বেচারাথেরিয়াম্’ ‘হস্’-অন্ত যুক্ত শব্দ। তার শব্দরূপ ‘নরঃ’ শব্দের মতো হবে না। দ্বিতীয় কথা, পত্রলেখকের মতে ‘বেচারাথেরিয়াম্’ মাত্র একজন, ফলে বহুবচন হবে না। তৃতীয়ত, ‘নমঃ’ ক্রিয়াপদে যাঁকে প্রণাম করা হচ্ছে তাঁর চতুর্থী বিভক্তির একবচন হবে। যেমন গণেশায় নমঃ, বাস্তুপুরুষায় নমঃ।

কিন্তু ‘সরস্বতৈ নমঃ’ তো বলি আমরা?

—তা বলি। তুমি কি এক কাপ কফি পাইয়ে গোটা সংস্কৃত ব্যাকরণটা আমার কাছ থেকে শিখে নিতে চাও, মা? ‘সরস্বতী’ শব্দটা ‘নদী’ শব্দের মতো হবার কথা। ‘নরঃ শব্দের মতো নয়।

এই সময় কফি এসে পড়ায় প্রসঙ্গটা মুলতুবি থাকল।

বাসু কাপটা টেনে নিয়ে বললেন, তোমার নামটা জানা হয়নি?

—রমলা। রমলা সেনগুপ্তা।

—তা, মা রমলা। এবার বল—কী ‘ক্লু’র কথা বলছিলে?

—আপনি নিশ্চয় জানেন যে, আপনার ক্লায়েন্টের আসল নাম মাধবী বড়ুয়া, মঞ্জরী নয়? বাসু পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করে বললেন, হুঁ! সংস্কৃত না জানলেও তুমি একটি পাক্কা বাস্তুঘুঘু!আমার মক্কেলের নাম আমার জানার কথা, তুমি কী করে জানলে সেটাই প্রশ্ন।

—আমার বাড়ি শিলং। বছরখানেক হলো এই ‘সোনার বাঙলায়’ রিসেপশানিস্টের কাজটা পেয়েছি। শিলঙে টি.ভি.তে. আমরা প্রায়ই গুয়াহাটি স্টেশন ধরতাম। কাল রাত প্রায় সওয়া দশটা নাগাদ ওকে একা আসতে দেখে আমি রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। ও একটা সিঙ্গল- সীটেড রুম বুক করল, ছদ্মনামে। তারপর আমার কাছ থেকে একটা কার্ড চেয়ে নিয়ে বাইরে ট্যাক্সিওয়ালাকে দিতে গেল। দুরন্ত কৌতূহলে আমি উঠে গিয়ে দেখলাম। না ট্যাক্সি নয়। প্রাইভেট কার। চালক রীতিমতো সুদর্শন একজন যুবক। কিন্তু অভদ্র।

—অভদ্র! কেন? তাকে অভদ্র মনে হলো কেন তোমার?

—তার উচিত ছিল স্যুটকেসটা হোটেল রিসেপশান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। মাধবীকে ধকলটা সহ্য করতে না দেওয়া।

—আই সী। তারপর?

—আমি যে ওকে চিনতে পেরেছি তা বলিনি। রুম-বেয়ারার সঙ্গে ঘর দেখে এসে ওর পছন্দ হয়েছিল আগেই। এবার জানতে চাইল, আমাদের টেলিফোনে এস. টি.ডি. আছে কি না। আমি জানালাম, না নেই। তবে কাছেই S.T.D স্টেশন আছে। আমি রুম-বেয়ারাকে সঙ্গে দিতে পারি। মাধবী রুম-বেয়ারাকে নিয়ে ফোন করতে গেল। বোধহয় গুয়াহাটিতে। একটু পরে ফিরেও এল। রাতে আর কিছু হয়নি। আমি এই হোটেলের দোতলায় একাই থাকি। সচরাচর সকাল সাতটায় কাউন্টারে নেমে আসি, বেড-টি দেবার ব্যবস্থাটা হেড-কুক আর বেয়ারার দল নিজেরাই করে। সকালবেলা যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি—অ্যারাউন্ড পৌনে সাতটা, তখন সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলাম মাধবী কাকে যেন ফোন করছে। ওটাতে পে-ফোন-এর ব্যবস্থা। মুদ্রা ফেলে ফোন করা যায়। আপনার কাছে স্বীকার করব—আমার কৌতূহল রুচিবোধকে অতিক্রম করে গেল। মাধবীকে আমি চিনি, বহুবার তার গান শুনেছি—সে কেন শহর কলকাতায় এসে ছদ্মনাম হোটেলে উঠেছে? তারচেয়েও বড় বিস্ময় সে কেন ট্যাক্সি করে এল না, আর সবচেয়ে অবাককরা কাণ্ড সেই সুদর্শন যুবকটি ওর স্বামীর ছদ্মপরিচয়ে কেন আমার হোটেলে রাত কাটালো না।

—অলরাইট! অলরাইট! আড়ি পেতে কথা শোনার যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছ। কী শুনলে তাই বল?

—ন্যাচারলি একদিকের কথাই আমি শুনেছি। ও নিজের হোটেলের নাম আর টেলিফোন নম্বরটা জানাল। তারপর কিছুক্ষণ শুনে বললে…দ্যাটস্ ইম্পসিবল! তুমি ভাল করে খুঁজে দেখ। গাড়িতেই আছে।…কী? ড্যাশবোর্ডটা খোলা ছিল না বন্ধ? …দ্যটস্ অ্যাবসার্ড! যাক, পরে কথা হবে। লোকজনের যাতয়াত শুরু হয়েছে…না, ঘরে নেই, লাউঞ্জে এই একটাই টেলিফোন…

—তারপর?

—তারপর ও নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে বসেই ব্রেকফাস্ট খেল। তারপর অ্যারাউন্ড নয়টা নাগাদ ওর একটা টেলিফোন এল। মহিলা কণ্ঠ। আমি জানতে চাইলাম, “কী নাম বলব?” মেয়েটি বললে, ‘বলুন ওঁর অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান ফোন করছেন।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি ওঁর অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান?’ ও বললে, না, আমি তাঁর নার্স।’ একটা স্লিপে তাই লিখে মাধবীর ঘরে পাঠিয়ে দিলাম বেয়ারার হাতে। ও তৎক্ষণাৎ নেমে এল। আমি খবরের কাগজটা আড়াল করে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। কিন্তু এবার ও কথা বলছিল খুব ফিফিস্ করে, নিচুগলায়। দু-একটা টুকরো কথা কানে এল।…’য়ু প্রমিস্ অন য়োর ওয়ার্ড অব অনার?’…’অ্যাকুইটাল হতে পারে না? কেন?’…ইত্যাদি। বেশ অনেকক্ষণ ডাক্তার-পেশেন্ট কথা হলো—তা প্রায় পাঁচ মিনিট। কিন্তু তার ভিতর অসুখ-বিসুখ, ওষুধপত্র জাতীয় কোনো কথা শুনতে পেলাম না। তারপর একসময় কথোপকথন শেষও হলো। মনে হলো, মেয়েটি যেন আর এ জগতে নেই। এই মনোহরপুকুর রোডের হোটেল, আমার উপস্থিতি কোনো কিছুই যেন ওর খেয়াল নেই। তারপর ও সামনের লেডিজ টয়লেটে ঢুকে গেল। প্রায় দশ মিটি পরে যখন বার হয়ে এল তখন ওর চোখ দুটো ফোলাফোলা, টকটকে লাল। মাথার সামনের চুলগুলো থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরছে। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে সে আমার কাছে এগিয়ে এল। বললে, ‘আমার বিলটা রেডি করুন। আমি এখনি চেক-আউট করব।’ আমি না বলে পারলাম না, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি আপনার মায়ের বয়সী না হলেও দিদির বয়সী। কী হয়েছে আপনার? হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কেন? কোথায় যাবেন আপনি?’ ও মুখটা নিচু করে বললে, ‘একটা নার্সিংহামে। আমি কলকাতায় থাকি না। কলকাতায় এসেছি একটা অপারেশন করাতে। ডাক্তারবাবু বললেন এখনি ভর্তি হতে।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কোন নার্সিংহোমে?” ও বোধহয় আমার প্রশ্নটা খেয়াল করে শুনল না, অথবা জবাবটা এড়িয়ে যেতে চায় বলে ভান করল যেন শুনতে পায়নি। বললে, ‘ঐ ফোল্ডারটা কিসের বিজ্ঞাপন?’ আমি ‘সোনার বাঙলা রিস্ট্’-এর ফোল্ডারটা ওকে ধরিয়ে দিলাম।

বাসু-সাহেবও ফোল্ডার-হোল্ডার থেকে বিজ্ঞপ্তিটা তুলে নিলেন। নীলরঙের একটি সুদৃশ্য ফোল্ডার। মাঝখানে একটা অর্ধচন্দ্রাকার চিত্র—একটা বাঙলা চারচালা খড়ের ঘরের পাশে একজোড়া নারকেল গাছ। নিচে ইংরেজি হরফে লেখা ‘সোনার বাঙলা রিস্টস্।

মহিলাটি বলতে থাকেন, আমি মাধবীকে বললাম, ‘বম্বে রোডে সাঁকরাইল রেল-স্টেশনের কাছে ‘ধূলাগড়ি গ্রামে আমাদের একটা হলিডে রির্স্ট, আছে। এটা তারই বিজ্ঞাপন। মাধবী সেটা নাড়াচাড়া করে বললে, ‘এখন ওখানে ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে?’ আমি বলি, ‘কেন বলুন তো? কার জন্য? আপনি তো নার্সিংহোম যাচ্ছেন অপারেশন করাতে।’ মাধবী চট্‌-জলদি জবাব দিল, ‘আমার এক দিদি-জামাইবাবুর জন্য। ওরা টাটানগর থেকে এসেছে আমার অপারেশনের জন্য। কিন্তু যেখানে আছে…আপনি কাইন্ডলি দেখুন না ফোন করে, ওখানে একটা ড-বেড রুম পাওয়া যায় কি না।’ বুঝলাম, সবটাই ধাপ্পাবাজি। ওর দিদি-জামাইবাবু তো অনায়াসে এই হোটেলেই থাকতে পারে, ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে ধূলাগড়িতে থাকতে যাবে কেন? কিন্তু ও হচ্ছে খদ্দের! ওর মিথ্যে কথা ধরিয়ে দেওয়ার দায় আমার নয়। আমি ধূলাগড়িতে ফোন করলাম।

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, ধূলাগড়ি গাঁয়ে ফোন আছে?

—গাঁয়ে থাক-না-থাক, আমাদের ‘সোনার বাঙলা রিস্টস্’-এ আছে, 669-0837; তারপর যা বলছিলাম শুনুন। ওর কথামতো আমি ‘ধূলিগড়ি-তে ফোন করলাম। ঘর পাওয়া গেল। তারপর মাধবী কাকে যেন ফোন করল—ওর ভগ্নীপতিকেই বোধহয়। এবার ও এত ফিফিস্ করে কথা বলল যে, কিছুই শুনতে পেলাম না। না পেলেও আন্দাজ করলাম’ ও নির্ঘাৎ সেই সুন্দরমতো ছেলেটিকে— যে মাধবীকে কাল রাত্রে পৌঁছে দিয়ে গেছিল তাকেই ফোন করে ধূলাগড়ি যেতে বলল। তাহলে আমার হোটেল কী দোষ করল বুঝলাম না।

বাসু বললেন, তুমি খুবই বুদ্ধিমতী। ধূলাগড়িতে আর একবার ফোন কর তো মা, অ্যাট মাই কস্ট। জেনে নিয়ে আমাকে বল, আজ বেলা এগারোটার পর মাধবীর বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন কোনো মেয়ে একা অথবা যুগলে চেক-ইন করেছে কি না।

রমলা তৎক্ষমাৎ টেলিফোনটা টেনে নিল। ইতিমধ্যে বোর্ডাররা আসছে যাচ্ছে, চাবি দিচ্ছে, চাবি নিচ্ছে। প্রশ্নও করছে, নানান জাতের। রমলা খুবই করিৎকর্মা। যান্ত্রিকভাবে ডিউটি বজায় রেখে বাসু-সাহবের সঙ্গে আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছিল। ফোনে ও-প্রান্তে সাড়া জাগতেই রমলা জানতে চাইল, কৌন? প্রীতম ভেইয়া ক্যা?

ও-প্রান্তে নিশ্চয়ই ইতিবাচক স্বীকৃতি হলো। কারণ এরপর রমলা পাঞ্জাবি-ঘেঁষা চোস্ত হিন্দিতে যা বলে গেল তার মর্মার্থ : শোন প্রীতম, আজ সকাল নটা চল্লিশ মিনিটে এখান থেকে একটি মেয়ে ‘সোনার বাঙলা, ধূলাগড়ি -র ঠিকানা সংগ্রহ করে ট্যাক্সিতে রওনা হয়েছে। বয়স বাইশ-চব্বিশ। মাথায় বকাট চুল, খুব ফর্সা। উচ্চতা পাঁচ চার হবেই। চোখে সানগ্লাস। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। সঙ্গে একটা গ্রে-রঙের মিডিয়াম সাইজ ভি. আই. পি. স্যুটকেস। পরনে হলুদ রঙের মুর্শিদাবাদী, লাল পাড়। ঐ লাল রঙের ম্যাচিং ব্লাউস। মেয়েটি একাও যেতে পারে, তার স্বামীর সঙ্গেও যেতে পারে—তবে ওর সিঁথিতে সিঁন্দুর নেই। সে কি পৌঁছেছে? কী? নাম? কী বাজে কথা বলছ প্রীতম! নাম তো সে যা-ইচ্ছে নিতে পারে।…না, না, পুলিশ কেস নয়। পারিবারিক অশান্তি। শ্বশুরবাড়িতে নববধূর লাঞ্ছনা, এই আর কি।…তাই বল? ওরা ঘরে আছে? দুজনেই? আল রাইট, জাস্ট হোল্ড অন—

টেলিফোনের কথামুখে হাত চাপা দিয়ে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলে, কপোত-কপোতী দুজনেই আছে। মক্কেলের সঙ্গে কথা বলবেন? ওরা নাম লিখিয়েছে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সমীর সেন।

বাসু বললেন, না। তুমি শুধু প্রীতমকে বল যে, ওদের দুজনের যে কেউ চেক-আউট করলে যেন আমার রেসিডেন্সে একটা টেলিফোন করে জানায়। আমার কার্ডখানা রাখ। আমি কে জানতে চাইলে বল, ঐ মেয়েটির বাবা। ‘বধূহত্যা’র রিরুদ্ধে সতর্কতা নিচ্ছি আমি। ও. কে.?

রমলা সেই মতো প্রীতমকে জানিয়ে দিল।

লাইনটা কেটে দেবার পর বাসু ওর দিকে একটি একশ’ টাকার নোট আর একটি নামাঙ্কিত কার্ড বাড়িয়ে ধরলেন।

রমলা বলল, নোটটা কেন?

—টেলিফোন আর তোমার সার্ভিস চার্জ। কফির দাম দিচ্ছি না।

রমলা রাজি হলো না। বলল, আমি আপনার ফ্যান। আজকের ভারতব্যাপী দুর্নীতির বাজারে আপনি যে ‘সত্যমেব জয়তে’ মন্ত্রটা সার্থক করতে চাইছেন তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ। তবে একটা কথা, বর্তমান কেসটা কী, তা আমি জানি না, শুধু জানি মাধবী আপনার মক্কেল। এই ‘ফুলটা যদি কোনো দিন ‘কাঁটা হয়ে ফুটে ওঠে তবে আমাকে একটা অটোগ্রাফড্ কপি পাঠিয়ে দেবেন।

বাসু হাসলেন। বললেন, সুন্দরভাবে কথাটা বলেছ। দেব! এবার আমার বাড়িতে একটা ফোন কর দিকি।

ফোন ধরলেন রানী। বাসু বললেন, জরুরী প্রয়োজনে হঠাৎ একটু কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে। ফিরতে রাত হতে পারে। তবে রাত্রে ফিরব এবং বাড়িতেই ডিনার করব। ইতিমধ্যে কোনো খবর জমেছে?

—তা জমেছে। জমে পাথর হয়ে গেছে। মিস্টার জালান ঘণ্টাখানেক আগে এসেছেন। তুমি বাড়ি নেই শুনে ফিরে যাননি। পাথর হয়ে রিসেপশানে বসে আছেন। তোমার সঙ্গে তাঁর নাকি অত্যন্ত জরুরী কিছু কথা আছে। আমাকে বলে রেখেছেন, তুমি এলেই যেন তাঁকে খবর দিই। এবং টেলিফোন করলেও।

—তা তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?

—তোমার চেম্বার থেকে। সুজাতা-কৌশিকও বেরিয়ে গেছে। একা বসে ঘর পাহারা দিচ্ছি। তুমি মিস্টার জালানের সঙ্গে কথা বলে ওঁকে বিদায় করার ব্যবস্থা কর। তাহলে একটু শুতে যেতে পারি।

—হ্যাং দ্যাট মহাদেব জালান। ও বসে থাকতে চায় থাকুক। বিশেকে বল বাইরের ঘরে…

হঠাৎ বাসু-সাহেবের কানে ভেসে এল ভারী পুরুষালী কণ্ঠ : এক্সকিউজ মি, মিস্টার বাসু। আমি আপনাকে ‘রিটেইন’ করেছি। আমার কথাও কিছু কিছু আপনাকে শুনতে হবে বইকি।

বাসু গম্ভীর হয়ে বলেন, আপনি লাইনে এলেন কেমন করে?

—খুব সহজে। আপনার রিসেপশান-এক্সটেনশানটা ক্র্যাডেলে থেকে উঠিয়ে নিয়ে। —ব্যাট দ্যাট য়ু কান্ট! য়ু শূডন্ট! আপনি ভিজিটার।

—আপনিও তেমনি ব্যারিস্টার! জজ-সাহেব নন। আপনারও কোনো অধিকার নেই ঐ রায় দেবার, ‘হ্যাং দ্যাট মহাদেব জালান!

বাসু টেলিফোনের মাউথ-পীসে বলেন, রানী, তুমি লাইনে আছ!

—আছি।

—নোটবুক পেন্সিল হাতে নাও। মিস্টার জালানের সঙ্গে আমার যে কথোপকথন হচ্ছে তা নোট করে যাও।

—এতক্ষণ তাই করে যাচ্ছি।

—অলরাইট! বলুন মিস্টার জালান, কী বলতে চান?

—আপনি বলছিলেন কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন, তার আগে একবার বাড়ি হয়ে যান। আমার অনেক কথা আছে।

—সরি! তা সম্ভবপর নয়। আপনার যা বক্তব্য টেলিফোনেই সংক্ষেপে বলুন। আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।

—পাঁচ নয়, দশ।

—এটা মাছের বাজার নয়!

—আই নো। আমি বলতে শুরু করলে আপনি কিন্তু বলবেন ‘দশ নয় পনের’। শুনুন স্যার, প্রথম খবর হচ্ছে—অনীশ আগরওয়ালের আলমারির পিছনে একটা যন্তর পাওয়া গেছে নিশ্চয় শুনেছেন। সেটার লাইসেন্স-হোল্ডার কে তা পুলিশে জানতে পেরেছে।

—কে সে?

—এই দেখুন, স্যার! আপনি প্রশ্ন করে আমার বরাদ্দ পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবলা মারছেন। ইয়েস! আপনি যা আশঙ্কা করেছেন তাই, গুয়াহাটির সেই ডাক্তারবাবুই। দু নম্বর খবর, পথিক হোটেলের চিড়িয়া চেক-আউট করে বেরিয়ে গেছে। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তিন নম্বর খবর হচ্ছে পুলিশ পোস্টমটার্ম রিপোর্ট পেয়েছে। অনীশের দেহের ভিতর ফেটাল বুলেটটা পাওয়া গেছে! সিরিয়ালি চার নম্বর খবর যেটা আপনি জানতে চাইবেন, তার জবাব : ‘না’।

বাসু বলেন, কী জানতে চাইব আমি?

আপনার ন্যাচরাল নেক্সট কোশ্চেন হবে : ব্যালাসট্রিক এক্সপার্ট কি টেস্ট-বুলেট ছুঁড়ে কম্পারেটিভ মাইক্রোস্কোপের পরীক্ষায় জেনেছে যে, অনীশের হৃদপিণ্ডে আটকে থাকা ফেটাল বুলেটটা ঐ বড়গোঁহাই-এর রিভলভার থেকে ছোঁড়া কি না। তাই : না?

—তার জবাব, ‘না?

—আজ্ঞে না। তা বলছি না আমি। বলছি কি, পুলিশ এখনো ব্যালাট্রিক্ এক্সপার্ট-এর রিপোর্ট পায়নি।

—আপনি অত কথা জানলেন কি করে?

–পয়সা খরচা করলে বাঘের দুধ ভি পাওয়া যায়। যায় না?

—ঠিক জানি না। বাঘের দুধ কিনতে কখনো বাজারে যাইনি। কিন্তু আপনি কি আর কিছু বলবেন—

—আলবাৎ! এতক্ষণ তো শুধু ইনফরমেশান দিচ্ছিলাম। এবার আমার প্রপোজালটা দাখিল করি? আমার প্রস্তাবটা—

—করুন!

—পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, মাধুর বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ উঠতেই পারে না। তবে কিছু মাইনর অফেন্সের চার্জ উঠবে। মৃতদেহ দেখার পরে পুলিশে খবর না দেওয়া—এমনকি মার্ডারারকে আড়াল করার চেষ্টা করা। সে বাবদে আপনাকে আগেই রিটেইন করেছি। কেস শেষ হলে আপনার নায্য বিল যা হবে তা আমি মিটিয়ে দেব। এখন আপনাকে আর একটা প্রস্তাব দিচ্ছি : আপনি এই কেস-এ ডক্টর শান্তনু বড়গোঁহাই-এর ডিফেন্সও দিন। আমি মিসেস বাসুর কাছে আপাতত পাঁচ হাজার টাকা রিটেইনার দিয়ে যাচ্ছি। ও.কে.?

বাসু বিস্মিত হয়ে বলেন, এ কী বলছেন আপনি! ডক্টর বড়গোঁহাই তো আপনার রাইভাল! আই মীন মাধবীর ব্যাপারে। আপনি তার জন্য…

বাধা দিয়ে মহাদেব বলে ওঠে, প্লীজ মিস্টার, বাসু। দ্যাটস্ নান অব য়োর বিজনেস। আপনাকে আমি ‘রিটেইন’ করেছি, আপনার যাবতীয় ফীজ, এক্সপেন্সেস্ আমি মিটিয়ে দিতে চাইছি—কেন চাইছি তা জানাতে আমি বাধ্য নই।

বাসু বললেন, কিন্তু এইমাত্র আপনি যে ইনফরমেশন দিলেন…

—আই নো, আই নো স্যার! বেকসুর খালাস এক্ষেত্রে হতে পারে না। ব্যালাসট্রিক্ এক্সপার্ট যদি প্রমাণ করেন ডক্টর বড়গোঁহাই-এর রিভলভার থেকেই ফেটাল বুলেটটা ছোঁড়া হয়েছে, তাহলে আপনি তো বটেই আপনার গুরু এ. কে. রে. বার-অ্যাট-ল-ও ওকে বেকসুর খালাস করে আনতে পারবেন না। ওর যদি ফাঁসি না হয়, যাবজ্জীবন না হয়, তাহলেই আমি মেনে নেব আপনি সাকসেসফুল। দীর্ঘ-মেয়াদী সশ্রম কারাদণ্ড ঠেকানো যাবে না!

—আপনি কেন হঠাৎ এভাবে আমাকে এনগেজ করতে চাইছেন, বলুন তো?

–প্লীজ স্যার। ডোন্ট আস্ক দ্য সেম কোশ্চেন ওভার অ্যান্ড ওভার এগেন।

—কিন্তু দুজনকে আমি কীভাবে ডিফেন্ড করতে পারি? আদালতে ওরা হয়তো জবানবন্দিতে পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাবে…

আবার ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় মহাদেব, প্লীজ স্যার। আপনি শুধু বিচক্ষণ ব্যারিস্টারই নন। মনুষ্যচরিত্র আপনি ভালমতো বোঝেন। আদালতে ওরা যদি পরস্পরবিরোধী জবানবন্দি দেয় তবে দেখবেন, তার একটাই উদ্দেশ্য—অপরাধটা নিজের নিজের কাঁধে টেনে নেওয়া। ইন ফ্যাক্ট মাধু যাতে সেই মারাত্মক ভুলটা না করতে পারে এটাই আপনাকে দেখতে হবে। মাধু আপনার কথা শুনবে—বিশেষ যদি বুঝতে পারে আপনি ডক্টর বড়গোঁহাইকে বাঁচাতেই চাইছেন। ফাঁসির দড়ি থেকে নামিয়ে যাবজ্জীবন; যাবজ্জীবন থেকে নামিয়ে দীর্ঘ-মেয়াদী; সশ্রম থেকে বিনাশ্রমে।

বাসু একটু চিন্তা করে বললেন, এটাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য?

মহাদেব বলে, ইয়েস স্যার! না হলে সেই স্কাউন্ডেলটার প্রতি আমার দরদ কেন উথলে উঠবে বলুন? মিসেস বাসুকে তাহলে আপাতত পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ ‘রিটেইনার’ দিয়ে যাই—অন্ বিহাফ অব ডক্টর বড়গোঁহাই?

বাসু টেলিফোনের কথামুখে বলেন, রানু তুমি লাইনে আছ তো?

—আছি!

—মিস্টার জালানকে রসিদটা দিয়ে দাও।

—তুমি দুজনের ডিফেন্সর দায়িত্বই নিচ্ছ?

—তাই নিচ্ছি!