এক
বেশ কিছুদিন হাতে কোনো কাজ আসেনি। তার মানে এ নয় যে, এই কল্লোলিনী কলকাতায় খুন-জখম-রাহাজানি জাতীয় অপরাধ কমে গেছে। মোট কথা বাসু-সাহেবের দ্বারস্থ হয়নি নিরপরাধীরা। বাসু-সাহেব প্রাতভ্রমণ অন্তে ফিরে এসে সকলের সঙ্গে প্রাতরাশ সেরেছেন। বাগানে নয়; কাল রাত্রে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই প্রাতরাশ সারা হয়েছে ‘ডাইনিং হল’-এ। তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে এসে বসেছেন তাঁর চেম্বারে। শীতের সকাল—জানুয়ারির মাঝামাঝি। বস্তুত 15.1.93 তারিখ শুক্রবারের কথা। কলকাতার শীত অবশ্য—তবে বাসু-সাহেবের ঠাণ্ডার ধাত। তাই তাঁর গায়ে গরম কোট, তদুপরি গলায় গলবন্ধ। খবরের কাগজে প্রথম পাতার হেড-লাইগুলো পড়া শেষ হবার আগেই ইন্টারকমে ‘নজরকাড়ি শব্দ হলো। কাগজটা নামিয়ে বাঁ-হাতে রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললেন, বলো? কোনো মক্কেল-টক্কেল পথ ভুলে এ পাড়ায় এসে পড়েছে নাকি?
ভিজিটার্স রুম, বা গৌরবে যাকে ‘রিসেপশান’ বলা হয় সেই ঘর থেকে রানী বলেন, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছেন। গুয়াহাটি থেকে আসছেন। নাম বললেন, মিস্টার মহাদেব জালান।
বাসু জানতে চাইলেন, ব-ফলা আছে?
একটু হকচকিয়ে যান রানী। আগন্তুকের সামনে অপ্রস্তুত হতে চান না বলে যন্ত্রটার ‘কথামুখে’ বলেন, আসছি ও-ঘরে।
মিস্টার জালানকে রিসেপশান রুমের ডানলোপিলো-সোফায় বসিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে, রানী দেবী তাঁর চাকা-গাড়িতে পাক মেরে এ-ঘরের দিকে এগিয়ে আসেন।
যেসব পাঠক-পাঠিকা ইতিপূর্বে কোনো কন্টকাকীর্ণ কাহিনীর ঘুলঘুলিয়ায় বিড়ম্বিত হবার দুর্ভাগ্য থেকে বঞ্চিত তাঁদের এইখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখা দরকার : বৃদ্ধ-তরুণ পি. কে. বাসু কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামকরা ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার। থাকেন তাঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে। চেম্বারটা ঐ বাড়ির বৈঠকখানায়। একই বাড়ির অপরাংশে থাকে ওঁদের স্নেহধন্য দম্পতি কৌশিক আর সুজাতা। ভাড়াটে নয়, নিঃসন্তান বৃদ্ধ দম্পত্তির পরিবারভুক্ত হিসাবে। তারা দুজনে একটি প্রাইফেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছে। নাম ‘সুকৌশলী’। বাসু- সাহেবের ধর্মপত্নী তথা একান্তসচিব রানী দেবী প্রৌঢ়া। ইনভ্যালিড চেয়ারে চেপে এঘর-ওঘর করেন। একটিমাত্র সন্তান ছিল তাঁর। মোটর-অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
চেয়ারের চাকায় পাক মেরে রিসেপশান থেকে বাসু-সাহেবের চেম্বারে এসে রানী জানতে চান, ওটা কী বললে তখন? ‘ব-ফলা আছে’ মানে?
—’ব-ফলা’ চেন না? বিদ্যাসাগরমশায়ের বর্ণ-পরিচয়টা আর একবার ঝালিয়ে নিও। জানতে চাইছি, মহাদেব কি তৃতীয় নেত্রের আগুনে মানুষজনকে ক্রমাগত জ্বালান? দেখে তাই মনে হলো?
—ও! ‘জ্বালান’! না বাপু, আমার তা মনে হয়নি। পরনে দামী সাফারি স্যুট, ব্রাউন রঙের। বছর চল্লিশ বয়স। খর্বকায়, কিন্তু স্বাস্থ্যবান। শরদিন্দু হলে হয়তো বলতেন, ‘মস্তকে দর্পণসদৃশ ইন্দুলুপ’। শৌখিন মানুষ। বলেছেন, গতকাল বিকালে গুয়াহাটি থেকে আই. সি-230 ফ্লাইট ধরে কলকাতায় এসেছেন। উঠেছেন লিন্ডসে স্ট্রিটের ডিউক হোটেলে। প্রয়োজনটা কী, তা শুধু তোমাকে জানাতে চাইছেন।
—বুঝলাম। আ-নে বোলো! দেখি, জালান কী পরিমাণ জ্বালান।
একটু পরেই এ-ঘরে এলেন মিস্টার জালান। রানী দেবীর বর্ণনায় আব কিছু সংযোজন করা চলে : গায়ের রঙ বায়সকৃষ্ণ। মুখে বসন্তের দাগ। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিনের কাছাকাছি। চোখে দামী ফ্রেমের চশমা। দেখলেই বোঝা যায়, লোকটি ধূর্ত এবং অর্থকরী-বিচারে জীবনে সাফল্যমণ্ডিত। হাতে ক্লাসিক সিগারেটের কার্টন।
বাসুকে নমস্কার করে বললেন, কাল সন্ধ্যায় গুয়াহাটি থেকে এসেছি। জানি, একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসা উচিত ছিল। চেষ্টার ত্রুটি করিনি স্যার; কিন্তু কিছুতেই লাইন পেলাম না।
বাসু বলেন, আপনি বোধহয় টেলিফোন ডাইরেক্টারি দেখে ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করেছেন। আপনার জানা নেই, জোব চার্নকের প্রয়াণের পরবর্তী কালে এ শহরে টেলিফোন গাইডের আর কোনো সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। এই নিন আমার কার্ড। নাম্বারটা ওতেই লেখা আছে। কী ব্যাপার বলুন?
—কোথা থেকে শুরু করব তাই ভাবছি।
–একেবারে ‘বিগ্ ব্যাঙ’ থেকে শুরু নাই বা করলেন।
—’বিগ্ ব্যাঙ’? বিগ্ ব্যাঙ কী?
—আমাদের পুরাণে বলা হয়েছে, সৃষ্টির আদিমতম অবতার হচ্ছেন ‘মৎস্য’। আধুনিক বিজ্ঞানীরা তা মানেন না। তাঁরা বলেন, মৎস্য নয় : ব্যাঙ! Big Bang! গড দ্য ফাদার বললেন, ‘লেট দেয়ার বি লাইট!’ অমনি লাফ মারল বিরাটাকার একটা ‘ব্যাঙ’। বিগ্ ব্যাঙের উল্লম্ফনে সব আলোয় আলো হয়ে গেল…
মহাদেব বললেন, আমি ব্যবসায়ী মানুষ, আধুনিক বিজ্ঞান….
—তাই তো বলছি! ওসব প্রসঙ্গ থাক। নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়ে এসেছেন। সেই বিপদের সূত্রপাত থেকেই না হয় শুরু করুন। আপনার নাম তো মহাদেব জালান। কী করেন আপনি?
—অনেক রকম বিজনেস্ আছে আমার। নানারকম এজেন্সি। পেট্রল পাম্প, ইন্ডেন গ্যাস…
—তাই বলুন। ঠিকই ধরেছি! ‘ব-ফলা’ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বর্তমান!
—আজ্ঞে?
—কিছু না। বলে যান?
মহাদেব জালান একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ইদানীং ধনী ব্যবসায়ীরা যে ব্যবসা কব্জা করে কোটিপতি থেকে অর্বুদপতি হওয়া যায় সেটিও করায়ত্ত করেছেন অর্থাৎ ‘রাজনীতি ব্যবসায়’। কখনো ডান, কখনো বাম! ‘আসামভ্যালী মাল্টিপার্পাস এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির এই বড় তরফ কখন কোন পার্টির সমর্থক বোঝা কঠিন। স্থানীয় একজন ধনী ব্যক্তিকে পার্টনার করে ব্যবসায় নেমেছিলেন বছর-দশেক আগে। এক দশকেই জালান গুয়াহাটির অন্যতম ধনিকশ্রেষ্ঠ। দুর্ভাগ্যবশত ওঁর বিজনেস-পার্টনার ইতিমধ্যে স্বর্গারোহণ করেছেন : সন্তোযমোহন বড়ুয়া। মহাদেব কাজের ঘূর্ণাবর্তে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, বিবাহ করে ওঠার সময় পাননি। অপরপক্ষে সন্তোযমোহনের একটিমাত্র কন্যাসন্তান : মাধবী। গত বছর বি. এ. পাশ করে পড়াশুনায় পূর্ণচ্ছেদ টেনেছে। বয়স : বাইশ। অত্যন্ত সুন্দরী, সুতনুকা। খুব ভাল গানের গলা। গুয়াহাটির দূরদর্শন ও আকাশবাণীতে তার নিয়মিত প্রোগ্রাম থাকে। শহরের সবাই তাকে চেনে।
বাসু আগ বাড়িয়ে বলেন, বিপদটা মনে হচ্ছে ঐ মাধবী বড়ুয়ারই?
—আজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন আপনি।
—তাহলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না কেন? তাছাড়া বিপদটা কি গুয়াহাটি হাইকোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত নয়?
মহাদেব তাঁর ক্লাসিক-কার্টন থেকে একটি সিগারেট বার করে ধরালেন। বাসু-সাহেবের দিকে কার্টুনটা বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে লক্ষ্য করেন তিনি পাইপ সেবন করছেন। দেশলাই-কাঠিটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে মহাদেব বলেন, আপনি দু-দুটো প্রশ্ন করেছেন। প্রথম প্রশ্নের জবাব : মাধু—আই মীন মাধবী, এখন কোথায় আছে তা আমি জানি না। এটুকু শুধু জানি যে, গত সোমবার ইন্ডিয়ান এয়ার-লাইন্সের ফ্লাইট আই-সি 708 এর প্যাসেঞ্জার লিস্টে তার নাম ছিল। সে ঐ প্লেনে উঠেছিলও। কলকাতা এসেছে এটা অবধারিত; কিন্তু এখানে আছে, না বোম্বাই চলে গেছে তা জানি না। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব এই যে, অপরাধটার সূচনা গুয়াহাটিতে হয়েছিল বটে, তবে সেটা দুঃসম্পন্ন হয়েছে এই কলকাতাতেই।
—’দুঃসম্পন্ন’ মানে?
—আয়াম সরি। আমি ভাল বাঙলা জানি না। ‘সুসম্পন্ন’ শব্দটার অ্যান্টোনিম কি ‘দুঃসম্পন্ন’ নয়?
বাসু বললেন, আয়াম ইকোয়লি সরি। বাঙলাভাষাটা আমিও ভাল জানি না। তা সে যা-হোক, এবার ঐ মাধু—ইউ মীন মাধবীর, বিপদটা কীভাবে পাকালো সেটা জানান বরং?
মহাদেবের দীর্ঘ জবানবন্দি সংক্ষেপিত করলে মোদ্দা তথ্যটা এইরকম দাঁড়ায় আসামভ্যালী মাল্টিপার্পাস এন্টারপ্রাইজ-এর তিনজন ডাইরেক্টার। পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ারের মালিক মহাদেব, পঁয়তাল্লিশ শতাংশের বর্তমান মালিক সন্তোষমোহন বড়ুয়ার বিধবা শান্তি দেবী। বাকি পাঁচ শতাংশ শেয়ার বিক্রয় করা হয়েছিল সন্তোষমোহনের বাল্যবন্ধু ডাক্তার হৃদয়নাথ বড়গোঁহাইকে। কোম্পানি-ল অনুসারে অন্তত তিন জন অংশীদার না থাকলে নানান অসুবিধা দেখা দেয়। সে যাহোক, সন্তোষবাবুর মতো তাঁর বাল্যবন্ধুও স্বর্গারোহণ করেছেন। ঐ পাঁচ শতাংশ শেয়ার বর্তেছে হৃদয়নাথের একমাত্র পুত্র, মাতৃহীন শান্তনুর অ্যাকাউন্টে। শান্তনু পড়ত গুয়াহাটির মেডিকেল কলেজে। মাধবীর চেয়ে কিছু সিনিয়ার। বছর দুয়েক আগে ডাক্তারী পাশ করে বেরিয়েছে। সম্প্রতি হাসপাতালের হাউস-ফিজিশিয়ানশিপ ছেড়ে নিজের বাড়িতে প্র্যাকটিসে বসেছিল। বাবার প্র্যাকটিস ভালই ছিল। ফলে শান্তনু ধীরে ধীরে পশার জমিয়ে তুলছিল।
যে তথ্যটা মহাদেব স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করেননি, কিন্তু তীক্ষ্ণধী বাসু-সাহেব আন্দাজ করে নিলেন তা এই : সন্তোষমোহনের মৃত্যুর আগে থেকে না হলেও, তাঁর প্রয়াণের পরবর্তীকালে মহাদেব অর্ধেক রাজত্বসহ একটি রাজকন্যার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। শান্তি দেবী নানা বিষয়ে মহাদেবের উপর নির্ভরশীলা। ফলে যাতায়াতটা ছিলই। বাধা একটাই : বয়সের। মাধবী বাইশ, মহাদেব বিয়াল্লিশ! কিন্তু তাতে কী হলো? এটাই তো ভারতীয় প্রথা! বিবাহবাসরে হবুজামাইকে দেখে মেনকার কি মূর্ছা যাবার উপক্রম হয়নি? আর শুধু ভারতীয়ই বা কেন? সারা বিশ্বে কীর্তিমান মানুষেরা কী ঐতিহ্য রেখে গেছেন? অনাসিম, পাবলো পিকাসো, মার্লিন ব্র্যান্ডো? তাছাড়া মহাদেব জালান কিছু দোজবরে নন!
বয়সের বাধাটা মহাদেবের মতে অনতিক্রমণীয় ছিল না। বয়সের খামতিটার জন্য যথাযোগ্য ‘মূল্য ধরে দিতে সে তো গররাজি নয়। রূপের খামতি রূপায় না কুলালে, সোনায়। বাধ সাধলো পাঁচ শতাংশের ছপ্পড়-ফোঁড়-মালিক ঐ কালকের ছোঁড়াটা। সে কিছুতেই ঐ পাঁচ শতাংশ শেয়ার বেচতে রাজি হলো না। ক্রমে সে মহাদেবের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে চাইল। বোঝ দুঃসাহসের দৌড়টা! ঐ ছোঁড়া সারা মাসে যা উপার্জন করে তার দ্বিগুণ অর্থ দৈনিক জমা পড়ে মহাদেবের মাসিক ফিক্সড-ডিপোসিট অ্যাকাউন্টের সুদ হিসাবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, মল্লযুদ্ধটা তো কুবেরমঞ্চে নয় মদনের বাসরে! তবু লড়ছিল মহাদেব। মদনভস্মের আয়োজন করছিল নেপথ্যে।
ইতিমধ্যে ঘটে গেল একটা অবিশ্বাস্য আজব ঘটনা। কোথাও কিছু নেই, বোম্বাই থেকে উড়ে এল এক ভুঁইফোড় আলাদীনের দৈত্য : অনীশ আগরওয়াল। বোম্বাইয়ের একটি প্রখ্যাত ফিল্ম প্রোডাকশানের তরফে সে নাকি ভূ-ভারত ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে একজন বেহেস্তী হুরীর তল্লাশে। মেদবর্জিত, সুতনুকা, সুন্দরী, বয়স পঁচিশের কম, কনভেন্ট ললিতা, হিন্দি কথোপকথনে পারদর্শিনী, মাইক-ফিটিং গলা। উচ্চতা পাঁচ-তিনের কম নয়। খুঁজতে খুঁজতে অনীশ গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকা পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায়— গুয়াহাটিতে। সে সন্ধ্যায় ঘটনাচক্রে টি. ভি. তে মাধবীর একটা গানের অনুষ্ঠান ছিল। পছন্দ হয়ে গেল অনীশের। দূরদর্শন অফিস থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে এসে দেখা করল শান্তি দেবীর সঙ্গে, মাধবীর সঙ্গে।
অনীশ তার অ্যাটাচি খুলে দেখালো—বোম্বাই-এর ফিল্ম কোম্পানি তাকে নায়িকা নির্বাচনের নিবঢ় অধিকার দিয়েছে। অবশ্য নির্বাচিতা প্রার্থিনীকে মাইক-টেস্ট, স্ক্রীন-টেস্ট ইত্যাদি পাশ করতে হবে। তবে মাধবীর ক্ষেত্রে সেসব প্রশ্ন ওঠে না। কারণ মাধবী দুরদর্শন ও আকাশবাণীর বাঁধা আর্টিস্ট। মাধবীকে নির্বাচন করে চুক্তিনামা স্বাক্ষর করলে কোম্পানি তাকে নায়িকা হিসাবে অন্তত তিনটি ছবিতে কাজ করাবে, অথবা তিন বছর ধরে—যেটা কম হয়। মাস-মাহিনা পঁচিশ হাজার টাকা। এছাড়া বোম্বাইয়ে একটি তিন-কামরার ফার্নিশ্ড্ ফ্লাট, ড্রাইভারসহ গাড়ি, টেলিফোন, টি.ভি, ভি সি. আর, ফ্রিজ, আরও নানা জাতের পার্কস্!
শহরে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেল। শান্তি দেবীর আপত্তি ছিল। একমাত্র মেয়ে, অতদূরে চলে যাবে, দীর্ঘ তিন বছরের জন্য। কিন্তু মেয়ের জেদাজেদিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হলো।
অনীশ জানালো, ঐ ফিল্ম কোম্পানির কোনো অফিস আসাম রাজ্যে নেই। মাধবীকে তাই কলকাতায় এসে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর দিতে হবে। কলকাতায় ঐ ফিল্ম কোম্পনির একটি শাখা- অফিস আছে ধর্মতলায়। তার আগে অবশ্য মাধবীর টি. ভি. ক্যাসেটের ভি. ডি. ও. টেপ বানিয়ে তা ক্যুরিয়ার সার্ভিসে বোম্বাইয়ে পাঠানো হলো। অবিলম্বে তাদের সম্মতিও এসে গেল।
মহাদেব জালানের ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু সে আপত্তি ধোপে টিকল না। মাধবীর স্বার্থে মহাদেব বোম্বাইতে এস. টি. ডি. টেলিফোন করেছিল। কোম্পানির লীগ্যাল অ্যাডভাইসার সেকশান জানালো যে, অনীশ আগরওয়াল কোম্পানির বৈধ এজেন্ট। তাকে নায়িকা নির্বাচনের জন্য কোম্পানি স্পেশ্যাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে রেখেছে।
ডিসেম্বরের একুশে মাধবী আর অনীশ এসেছিল কলকাতায় চুক্তিনামায় সই করতে। শান্তি দেবীর অনুরোধে মহাদেবও এসেছিল ওদের সঙ্গে। ওরা উঠেছিলেন লাউডন স্ট্রিটের ‘হোটেল রাতদিন’-এ। তিন জনে তিনটি পৃথক কক্ষে। পরদিন একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা তিন জনে চলে আসে ধর্মতলার ব্রাঞ্চ-অফিসে। খুব সাজানো-গোছানো অফিস। বাতানুকূল করা। রিসেপশানিস্টের কাউন্টারে তিন রঙের তিনটে টেলিফোন। তদপুরি একটি ইন্টারকম। সেদিন ছিল ছুটির দিন। তবু পুরো দমে অফিসে কাজ হচ্ছে। বোধকরি সবাই ওভারটাইমে।
অনীশ ওঁদের দুজনের সঙ্গে কলকাতা ব্রাঞ্চ-অফিসের ম্যানেজারের আলাপ করিয়ে দিল। তিনি মাধবীকে অভিনন্দন জানালেন। বীয়ার এল সকলের জন্য। শুধু মাধবী পান করল কফি একটু পরে এলেন কলকাতাস্থিত কোম্পানির আইন পরামর্শদাতা। তিনিও আনুষ্ঠানিকভাবে মাধবীকে কনগ্র্যাচুলেট করলেন। মাধবী এবং মহাদেব চুক্তিখানি পাঠ করলেন। মাধবী স্বাক্ষর দিল। মহাদেব সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর দিলেন। কোম্পানির তরফে অনীশ সই দিল—সে ছিল স্পেশাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোল্ডার।
সে রাত্রে মোকাম্বোতে দারুণ খানাপিনার আয়োজন হলো। মাধবীই একমাত্র মহিলা। পরদিন চুক্তিনামা নিয়ে অনীশ ফিরে গেল বোম্বাই, এঁরা দু’জন ফিরে এলেন গুয়াহাটিতে!
আসামের নানান পত্র-পত্রিকায়, বিশেষ করে গুয়াহাটিতে একাধিক দৈনিকে মাধবীর ছবি ছাপা হলো। তার ইন্টারভিয়ু প্রকাশিত হলো। শহরের কিছু উৎসাহী সিনেমাপাগল স্থানীয় সাংসদকে চেপে ধরল। বাধ্য হয়ে তিনি একটি নাগরিক সম্বর্ধনার আয়োজন করলেন। একটি অসমীয়া মেয়ে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় সবাইকে পিছনে ফেলে বোম্বাইয়ের তারকাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে যাচ্ছে এটা কি কম কথা?
বলা বাহুল্য, সাংসদ শুধু ব্যবস্থাই করেছিলেন। তিনি শুধু আমন্ত্রণ কর্তা। বাস্তবে ব্যয়ভার বহন করেছিলেন মহাদেব জালান। তারপরেই একেবারে বিনামেঘে বজ্রপাত। এগারোই। জানুয়ারির ডাকে এসে পৌঁছালো বোম্বাই থেকে একটি মর্মান্তিক পত্র। প্রযোজক চুক্তিনামার সাঁইত্রিশ-সি ধারা মোতাবেক জানাচ্ছেন যে, বিশেষ কারণে ওঁরা মাধবী বড়ুয়ার চুক্তিপত্র গ্রহণ করতে অসমর্থ।
বাসু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, কী ছিল সেই সাঁইত্রিশ-সি ক্লজ-এ?
—প্রয়োজনবোধে কোনো কারণ না দেখিয়ে কোম্পানি একতরফাভাবে ঐ চুক্তিপত্রটা বাতিল করতে পারবে। এ জন্য কোনো খেসারত দাবি করা চলবে না।
—তা এ ক্লজটা আপনারা পড়ে দেখেননি?
—দেখেছিলাম। কিন্তু গুরুত্বটা বুঝতে পারিনি।
—আই সী। তা আপনাদের প্লেন ভাড়া, হোটেল ভাড়া, মোকাম্বোর খাওয়ার খরচ কে মেটালো? অনীশ না আপনি?
—অধিকাংশই অনীশ। কিছুটা আমি।
বাসু বলেন, বুঝলাম। এ ক্ষেত্রে না অনীশ আগরওয়াল, না ওদের কোম্পানি কেউই তো বে-আইনি কাজ কিছু করেনি। তাহলে আপনি কেন এসেছেন?
—আপনাকে স্যার, আসল কথাটাই এখনো বলা হয়নি।
—কী সেই আসল কথাটা? এবার সেটাই বলুন?
—চাকরিটা পাইয়ে দেবে বলে অনীশ মাধুর কাছে থেকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে।
—প-ঞ্চা-শ হাজার! অত টাকা মাধবীর কাছে ছিল?
—মানে, ইয়ে, মা-মেয়ের তো জয়েন্ট-অ্যাকাউন্ট। ইউনিট-ট্রাস্ট, এন. এস. সি., শেয়ার, সবই দুজনের নামে। এগ্রিমেন্টে সই করার পর মাকে না-জানিয়ে, মায় আমাকেও না-জানিয়ে মৌখিক চুক্তিমতো মাধু অনীশকে টাকাটা দিয়েছে। সরল বিশ্বাসে, যাতে অনীশ কন্ট্রাক্টটা বোম্বাইয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি পাকা করে ফেলতে পারে। তারপর থেকেই অনীশ হাওয়ায় মিশে গেছে। মাধু কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছে না। গুয়াহাটি শহরে সে কোনমুখে ফিরে যাবে? চিঠিখানা পেয়েই সে কাউকে কিছু না বলে কলকাতায় চলে এসেছে। আমি দু-চারজন উকিল- ব্যারিস্টারের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, সহজ সরল আইনের পথে কিচ্ছু হবে না। অনীশ বে- আইনি কাজ কিছুই করেনি। তার এই শয়তানীর জন্য কেউ যদি তাকে শায়েস্তা করতে পারে–তাহলে সেটা আপনিই। পঞ্চাশ হাজার টাকাটা কিছু নয়, কিন্তু আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না যে, মাধু আসাকে এগ্রিমেন্টটা দেখিয়ে তারপর স্বাক্ষর করেছে। আমি যে মরমে মরে আছি। টাকাটা আপনি উদ্ধার করুন তা বলছি না, কিন্তু শয়তানটাকে আপনি যথোপযুক্ত শাস্তি দিন—এটাই আমার প্রার্থনা। বলুন স্যার, আপনাকে কী রিটেইনার দেব?
বাসু বললেন, ‘রিটেইনারের প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপনি এ পর্যন্ত যা বলেছেন তা আইনের পর্যায়ে আসে না। না অনীশ, না তার ফিল্ম কোম্পানি, কেউই বে-আইনি কোনো কাজ করেনি। আপনারা কন্ট্রাক্টের অর্থ না বুঝে, আইনজ্ঞের পরামর্শ না নিয়ে যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন তার জন্য যা ভোগান্তি তা আপনাদেরই পোহাতে হবে। তাছাড়া ফিল্ম কোম্পানি আপনাদের গুয়াহাটি-কলকাতার বিমান ভাড়া দিয়েছে, হোটেল খরচ দিয়েছে। ফলে কোনোভাবেই আপনাদের কোনো কেস আইনত দাঁড়ায় না। কিন্তু নেপথ্যে যে কাণ্ডটা ঘটেছে তা নিশ্চয় অন্যায়। একটি কুমারী মেয়েকে গ্ল্যামারের লোভ দেখিয়ে আগরওয়াল যে অর্থটা আত্মসাৎ করেছে, ন্যায়ত ধর্মত সেজন্য তার শাস্তি হবার কথা। যেহেতু সে রসিদ দিয়ে ঘুষের টাকাটা নেয়নি তাই আইন এখানে ক্ষমতাহীন। আইনের চোখে যে ঘুষ দেয় এবং যে ঘুষ নেয়—দুজনেই দায়ী। কিন্তু আইনই তো ন্যায়ধর্মের শেষ কথা নয়। আমার মনে হয় আপনি যা চাইছেন তা একটি প্রাইভেট গোয়েন্দা এজেন্সির এক্তিয়ারে। তারাই অনীশ আগরওয়ালের হদিস আপনাকে জানাবে। তারপর সে যদি ঘুষের টাকাটা প্রত্যর্পণে স্বীকৃত না হয়….
মহাদেব,বাধা দিয়ে বলে, তেমন বিশ্বস্ত গোয়েন্দা এজেন্সি আছে এই কলকাতা শহরে?
—আছে। এই বাড়িতেই আছে। আমি ইন্টারকমে বলে দিচ্ছি, ওরা স্বামী-স্ত্রী একটি গোয়েন্দা সংস্থার মালিক। নাম : সুকৌশলী। আপনি ওদের কাছে গিয়ে আপনাদের সমস্যার কথা বলুন। ওরা হয়তো অনীশ আগরওয়াল আর মাধবী বড়ুয়ার সন্ধান খুঁজে বার করতে পারবে। বাকি কাজ আপনাদের দুজনের এবং সুকৌশলীর। আমার কোন ভূমিকা নেই।
—থ্যাঙ্কু, স্যার। কিন্তু আমার একটা আশঙ্কা হচ্ছে যে, মাধু—আই মীন মাধবী, যদি অনীশের সন্ধান আদৌ পায় তাহলে রাগের মাথায় কিছু একটা ভালমন্দ করে ফেলতে পারে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। তাকে নিয়ে গুয়াহাটিতে অনেক হৈচৈ হয়েছে। অনীশ তাকে রাতারাতি খ্যাতির সপ্তম স্বর্গে তুলে দিয়েছিল। তাই মাকে না জানিয়ে মাধবী লুকিয়ে অনীশকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছে। আর পরিবর্তে অনীশ ওকে চরম অবমাননার মধ্যে এনে ফেলেছে। বেচারি নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে পারছে না। আমি জানি, মাধু একেবারে মরিয়া হয়ে আছে। আপনি স্যার, অনুমতি দিন, আমি আপনাকে কিছু অগ্রিম রিটেইনার দিয়ে যাই—মানে মাধু যদি কোনো ভালমন্দে জড়িয়ে পড়ে তবে আপনি তার কেসটা দেখবেন। ধরুন, আপাতত হাজার টাকা? ঠিক আছে?
বাসু বললেন, ঠিক আছে। আপনি ওঘর থেকে রসিদটা নিয়ে যাবেন। আমি ইন্টারকমে আমার সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি। তবে একটা কথা পরিষ্কার সমঝে নিন, মিস্টার জালান। টাকাটা কে দিচ্ছেন সেটা কোনো ফ্যাকটার নয়, যদি এই ব্যাপারে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হয় তবে আমি মাধবী বড়ুয়ার স্বার্থ দেখব শুধু।
—সার্টেনলি, স্যার। আপনি একমাত্র মাধবী বড়ুয়ার স্বার্থটাই দেখবেন। সে যদি বে- আইনি, আই মীন উত্তেজনাবশে বিসদৃশ কিছু করে বসে তবে আপনি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেন।
—অলরাইট। আপনি এবার এই ইউ-শেপ’ বাড়ির অপর উইং-এ চলে যান। সুকৌশলী গোয়েন্দা এজেন্সির সাইন বোর্ডটা নিশ্চয় দেখতে পাবেন। আমি ইতিমধ্যে ইন্টারকমে ব্যাপারটা ওদের জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি নিঃসঙ্কোচে ওদের সব কথা খুলে বলবেন।
—থ্যাঙ্কু, স্যার।