পরিশিষ্ট

বিশুপাল বধ – ৪

পরদিন সকাল আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় ব্যোমকেশ বসবার ঘরে খবরের কাগজটা মুখের সামনে উঁচু করে ধরে গত রাত্রের থিয়েটারের খুনের বিবরণ পড়ছিল। সত্যবতী সকালে বাড়ি ফিরেছে, ব্যোমকেশকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে গড়িয়াহাটে বাজার করতে গেছে, ফিরে এসে ব্যোমকেশকে আর এক পেয়ালা চা ও প্রাতরাশ দেবে। বাড়িতে কেবল অজিত আছে।

অন্দরের দিকের দরজা থেকে অজিত উঁকি মারল, দেখল ব্যোমকেশ মুখের সামনে কাগজের পর্দা তুলে দিয়ে খবর পড়ছে। অজিত নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে গুটি গুটি সদর দোরের দিকে অগ্রসর হল। সে প্রায় দোর পর্যন্ত পৌঁচেছে পিছন থেকে শব্দ হল, ‘সাত সকালে চলেছ কোথায়?’

ধরা পড়ে গিয়ে অজিত দাঁড়াল, ভারিক্কিভাবে বলল, ‘দরকারী কাজে বেরুচ্ছি, টুকে দিলে তো?’

ব্যোমকেশ কাগজ নামিয়ে বলল, ‘বই-এর দোকানের কাজ?’

গাম্ভীর্য বর্জন করে অজিত মুখ টিপে হাসল।

ব্যোমকেশ বলল, ‘তোমার কার্য-কলাপ গতিবিধি ক্রমেই সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। বিকাশকে ডেকে তোমার পিছনে টিকটিকি লাগাতে হবে দেখছি।’

‘সাত দিন ধৈর্য ধরে থাকো, তারপর আমি নিজেই সব বলব।’ অজিত বেরিয়ে গেল।

ব্যোমকেশ আবার কাগজ তুলে নিল। থিয়েটারে পুলিস প্রায় দেড়টা পর্যন্ত ছিল, থিয়েটারের আগাপাস্তলা তন্ন তন্ন করেছে; থিয়েটার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় স্ত্রী পুরুষের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। কেবল খ্যাতনামা অভিনেত্রী সুলোচনা শোকাভিভূত থাকার জন্য এজাহার দিতে পারেননি। লাশ রাত্রেই ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল, লাশ-পরীক্ষক ডাক্তার বলেন, মৃতের শ্বাসনালী ও ফুস্‌ফুসের মধ্যে সাইনোজেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে, ওই ভয়ঙ্কর বিষই মৃত্যুর কারণ। মামলার পুলিস ইন-চার্জ ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র মনে করেন, বিশু পালের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, কেউ তাকে খুন করেছে। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই, পুলিস তৎপর আছে, শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে। ওকুস্থলে অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহে ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু উপস্থিত ছিলেন কাগজে সে কথারও উল্লেখ আছে।

বাইরে সত্যবতীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সে বাজার করে ফিরেছে। তার পিছনে প্রতুলবাবু দু’হাতে দু’টি পরিপুষ্ট থলে নিয়ে আসছেন, মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি। সত্যবতী ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওগো, দ্যাখো কে এসেছেন। উনিও গড়িয়াহাটে বাজার করতে গিয়েছিলেন—ধরে নিয়ে এলুম।’

ব্যোমকেশ হেসে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘বাঃ, বেশ।—সত্যবতী ঝাঁকামুটের কাজটা আপনাকে দিয়েই করিয়ে নিয়েছে দেখছি।’

‘যাঃ, তা কেন? উনি নিজেই আমার হাত থেকে থলি কেড়ে নিলেন। —আপনারা বসে গল্প করুন, আমি চা তৈরি করে আনছি।’ নিজের থলি প্রতুলবাবুর হাত থেকে নিয়ে সত্যবতী ভেতরে চলে গেল।

প্রতুলবাবু নিজের থলিটি নামিয়ে রেখে ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসলেন, বললেন, ‘কাগজে কালকের কীচক বধের খবর পড়ছেন দেখছি। আমিও পড়েছি। —আচ্ছা, কাল থিয়েটার থেকে ফিরতে ফিরতে আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?’

‘কি কথা, চুড়ির ঝনাৎকার?’

‘হ্যাঁ, কাল থেকে চিন্তাটা মনের পিছনে লেগে আছে, পুলিসকে একথা জানানো উচিত কিনা।’

ব্যোমকেশ একটু নীরব থেকে প্রশ্ন করল, ‘ঝনাৎকার শব্দ স্টেজ থেকে এসেছিল এ বিষয়ে আপনি যোল আনা নিঃসংশয়?’

প্রতুলবাবু বললেন, ‘দেখুন, অন্ধকারে বসে থাকলে কোন্ দিক থেকে আওয়াজ আসছে সব সময় ধরা যায় না। তবু, স্টেজ থেকে যে আওয়াজটা এসেছিল এ বিষয়ে আমি বারো আনা নিঃসংশয়।’

‘তাহলে পুলিসকে বলা উচিত। ওরা যদি তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়—’

এই সময় সদর দোরের কাছ থেকে আওয়াজ এল, ‘আসতে পারি?’

ব্যোমকেশ মুখ তুলে বলল, ‘এস এস, রাখাল। তোমাদের কথাই হচ্ছিল।’

ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার প্রবেশ করলেন, হেসে বললেন, ‘দু’জন আসামীই উপস্থিত আছেন দেখছি।’

ব্যোমকেশ বলল, ‘বসো। তোমার কি কাজকর্ম নেই, সকালবেলাই থানা ছেড়ে বেরিয়েছ যে!’

রাখালবাবু বললেন, ‘কাজকর্ম ঢিমে। কাগজে আপনাদের দু’জনের নাম দেখলাম। আপনারা আমার এলাকার লোক, তাই ভাবলাম তদারক করে আসি।’

সত্যবতী ট্রে’র ওপর দু’ পেয়ালা চা ও রাশীকৃত চিঁড়ে ভাজা নিয়ে এল। রাখালবাবু বললেন, ‘বৌদি, আমিও আছি। আর এক পেয়ালা চাই।’

আর এক পেয়ালা চা এল। তিনজনে চায়ের অনুপান সহযোগে চিঁড়ে ভাজা খেতে খেতে গত রাত্রির থিয়েটারী হত্যাকাণ্ডের আলোচনা করতে লাগলেন।

চিঁড়ে ভাজা নিঃশেষ হলে রাখালবাবু চায়ের পেয়ালায় অন্তিম চুমুক দিয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, এ পাড়ায় শালীচরণ দাস নামে কাউকে চেনেন?’

ব্যোমকেশ বলল, ‘শালীচরণ দাস! নামের একটা মহিমা আছে বটে কিন্তু আমি চিনি না। কে তিনি?’

রাখালবাবু বললেন, ‘বছর বারো আগে আমি এই থানাতেই সাব-ইন্সপেক্টর ছিলাম। তখন শালীচরণকে নিয়ে বেশ কিছুদিন হৈ চৈ চলেছিল।’

‘হৈ চৈ কিসের? কী করেছিলেন তিনি?’

‘শালীকে খুন করেছিল।’

‘শালীচরণ শালীকে খুন করেছিল!’

‘এবং বিশু পালের সঙ্গে এই ঘটনার কিছু যোগাযোগ আছে।’

‘তাই নাকি! বল বল, শুনি। —প্রতুলবাবু, আপনার গল্প শুনতে আপত্তি নেই তো?’

প্রতুলবাবু বললেন, ‘গল্প শুনতে কার আপত্তি হতে পারে? আমি এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দা, শালীচরণ নামটা যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। আজ রবিবার, ভেবেছিলাম সকালবেলা একটু লেখাপড়া করব। তা গল্পই শোনা যাক।’

অতঃপর রাখালবাবু শালীচরণের অতীত কাহিনী বললেন। গল্প শুনে ব্যোমকেশ বলল, ‘শালীচরণ এখন কোথায়? জেল থেকে বেরিয়েছে?’

রাখালবাবু বললেন, ‘মাসখানেক হল। জেলখাটা কয়েদীদের খবরাখবর আমাদের রাখতে হয়—’

‘কোথায় আছে?’

‘নিজের বাড়ির একতলায় উঠেছিল। আজ কোথায় আছে জানি না। খোঁজ নিতে পারি।’

ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করে বলল, ‘আজ ছুটির দিন, একটু সত্যান্বেষণে বেরুলে কেমন হয়? শালীচরণ আমার মনোহরণ করেছে। যাবেন তার বাড়িতে তত্ত্ব-তল্লাশ নিতে?’

প্রতুলবাবু বললেন, ‘বেশ তো, চলুন না। আমি কখনো খুনী আসামী দেখিনি, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। উঠুন তাহলে। আমার গাড়ি রয়েছে, তাতেই যাওয়া যাক।’

তিনজনে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। রাখালবাবু ড্রাইভারকে পথ নির্দেশ করার জন্যে সামনের সিটে বসলেন।

যেতে যেতে ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, রাখাল, মাধব মিত্তিরকে তুমি চেন?’

রাখালবাবু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, ‘চিনি। ওঁর সঙ্গে কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করেছি।’

‘লোকটি কেমন বল তো?’

রাখালবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘খুব হুঁশিয়ার কাজের লোক, আর ভারি মুখমিষ্টি। কিন্তু নিজের এলাকায় কাউকে নাক গলাতে দেন না।’

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর পানে চেয়ে একটু হাসল।

পাঁচ মিনিট পরে রাখালবাবুর নির্দেশ অনুসরণ করে মোটর একটি বাড়ির সামনে থামল। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তার ওপর ছোট দোতলা বাড়ি; বাড়ির গায়ে জীর্ণতার ছাপ পড়েছে। তিনজনে মোটর থেকে অবতীর্ণ হয়ে বাড়ির সদরে এসে দেখলেন দরজায় তালা ঝুলছে।

তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। বাড়িতে তালা লাগিয়ে শালীচরণ কোথায় গেল? বাজারে?

সদর দোরের মাথায় দোতলায় একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ব্যালকনি ছিল, এক ভদ্রলোক সেখান থেকে নীচে উঁকি মারলেন, ‘কাকে চান?’

নীচে তিনজন ঊর্ধ্বমুখ হলেন। রাখালবাবু বললেন, ‘শালী—মানে কালীচরণ দাস আছেন?’

ত্রিশঙ্কুর মত ভদ্রলোক বললেন, ‘না, তিনি বাইরে গেছেন।’

‘কোথায় গেছেন?’

‘দাঁড়ান, আমি আসছি।’ ত্রিশঙ্কু ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হলেন।

অল্পক্ষণ পরে বাড়ির পাশের দিক থেকে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। মধ্যবয়স্ক লোক, কিন্তু ভাবভঙ্গীতে চটুলতার আভাস বয়সের অনুকূল নয়। বললেন, ‘আমি কালীচরণবাবুর ভাড়াটে। ওপরতলায় থাকি। আপনারা কি তাঁর বন্ধু?’

ব্যোমকেশ হেসে বলল, ‘অন্তত শত্রু নয়; দর্শনার্থী বলতে পারেন। তিনি কোথায়?’

ভদ্রলোক হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘তিনি বোষ্টুমীকে নিয়ে বৃন্দাবন গেছেন।’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে বলল, ‘বৃন্দাবন! বোষ্টমী!’

ভদ্রলোকের মুখের হাসি আর একটু প্রকট হল, ‘আজ্ঞে। আমার বাসায় একটি কমবয়সী ঝি কাজ করত, দেখতে শুনতে ভাল, বোধহয় বিধবা। কাজকর্ম ভালই করছিল, তারপর কালীচরণবাবু জেল থেকে ফিরে এলেন। একলা মানুষ হলেও তাঁর একজন ঝি দরকার, চপলা—মানে আমার ঝি তাঁর কাজও করতে লাগল। কিছুদিন যেতে না যেতেই চপলা আমার কাজ ছেড়ে দিল, কেবল কালীচরণবাবুর কাজ করে। তারপর দেখলাম চপলা গলায় কণ্ঠি পরে বৈষ্ণবী হয়েছে। ক্রমে সন্ধ্যার পর নীচের তলা থেকে খঞ্জনির আওয়াজ আসে; যুগল-কণ্ঠে গান শোনা যায়—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে—

‘দিন দশেক আগে একদিন সন্ধ্যেবেলা কালীচরণবাবু এক থালা মালপো আর পরমান্ন নিয়ে দোতলায় এলেন, সলজ্জভাবে জানালেন চপলা বোষ্টুমীকে তিনি কণ্ঠি-বদল করে বিয়ে করেছেন।’

নিঃশব্দ হাসিতে ভদ্রলোকের মুখ ভরে গেল।

ব্যোমকেশ চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে বলল, ‘তাই তো। কবে বাইরে গেলেন?’

‘কাল সকালে।’

‘সকালে?’

‘আজ্ঞে। ভোরবেলা ওপরতলায় এসে আমাকে নীচের তলার চাবি দিয়ে বললেন, আমরা বৃন্দাবন যাচ্ছি বেলা দশটার ট্রেনে, হপ্তা দুই পরে ফিরব। এই বলে বোষ্টুমীকে ট্যাক্সিতে তুলে চলে গেলেন। বৃন্দাবনে নাকি কোন্ আখড়ায় মোচ্ছব আছে।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল, প্রতুলবাবু বললেন, ‘এটা বোধহয় বৈষ্ণবীয় হনিমুন।’

তারপর রসিক ভদ্রলোকটিকে ধন্যবাদ ও নমস্কার জানিয়ে তিনজনে গাড়িতে এসে উঠলেন। প্রতুলবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘খুনী আসামী দেখা আমার ভাগ্যে নেই।’

পাঁচ-ছয় দিন বিশুপাল বধ সম্বন্ধে আর কোনো নতুন খবর পাওয়া গেল না; সংবাদপত্রে খবরটি প্রথম পৃষ্ঠা ছেড়ে অন্দরমহলে গা-ঢাকা দিয়েছে। মাধব মিত্রের সাড়াশব্দ নেই। ভাবগতিক দেখে মনে হয় তিনি মামলার কোনো কিনারা করতে পারেননি, আসামী এখনো অজ্ঞাত।

ব্যোমকেশের হাতে অন্য কোনো কাজ ছিল না, তাই তার মনটা থিয়েটারী হত্যার দিকে পড়ে থাকত। শনিবার বিকেলবেলা সে প্রতুলবাবুকে ফোন করবে মনস্থ করেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। স্বয়ং প্রতুলবাবু ফোন করছেন। তিনি বললেন, ‘এইমাত্র ইন্সপেক্টর মাধব মিত্রের পরোয়ানা এসেছে। তিনি আমার বাসায় আসছেন। আপনাকেও হাজির থাকতে হবে। বোধহয় হালে পানি পাচ্ছেন না।’

ব্যোমকেশ বলল, ‘হুঁ। আপনি তাকে কঙ্কণ ঝনাৎকারের কথা বলেছেন নাকি?’

‘না। তিনি এলে বলব।’

‘আর শালীচরণ দাসের রোমান্স?’

‘না, দরকার বোধ করেন আপনি বলবেন।’

‘আচ্ছা, আমি এখনি বেরুচ্ছি।’

‘গাড়ি পাঠাব?’

‘না না, দরকার নেই। দশ মিনিটের তো রাস্তা।’

‘গাড়ি থাকলে দু’ মিনিটে আসা যেত।’

ব্যোমকেশ হেসে বলল, ‘হুঁ। বুঝেছি আপনার ইঙ্গিত।’

পনেরো মিনিট পরে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর বাড়িতে দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসতে না বসতেই মাধব মিত্র উপস্থিত হলেন। তাঁর হাতে চামড়ার মোটা ফাইল। টেবিলের ওপর ফাইল রেখে তিনি বিনীত হাস্য করলেন, ‘বিরক্ত করতে এলাম। ভেবেছিলাম আপনাদের কষ্ট দেব না, কিন্তু গরজ বড় বালাই। আপনারা সে রাত্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; যদিও চোখে কিছু দেখেননি, তবু আপনাদের উপস্থিতিই আমার কাছে মূল্যবান। আপনারা জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি, পরম পণ্ডিত। আপনাদের মানসিক সহযোগিতা পেলেই আমরা কৃতার্থ হয়ে যাব।’

লোকটির মিষ্টি কথা বলবার ক্ষমতা আছে বটে। কিন্তু ব্যোমকেশও হার মানবার পাত্র নয়। সে বলল, ‘সে কি কথা! পুলিসকে সাহায্য করা তো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। তাছাড়া আপনি যে রকম মিষ্টভাষী সজ্জন ব্যক্তি আপনাকে সাহায্য করা তো গৌরবের কথা। আমরা কি করতে পারি বলুন। সে-রাত্রে থিয়েটার থেকে চলে আসার পর কী ঘটেছিল আমরা কিছুই জানি না; খবরের কাগজে যা পড়েছি তা ধর্তব্য নয়। এইটুকু শুধু জানি যে অজ্ঞাত আসামী এখনো সনাক্ত হয়নি।’

প্রতুলবাবু ইতিমধ্যে চা ফরমাস করেছিলেন, সঙ্গে এক প্লেট প্যাস্ট্রি। মাধববাবু এক চুমুক চা খেয়ে প্যাস্ট্রিতে কামড় দিলেন, চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘না, সনাক্ত হয়নি। তবে জাল খানিকটা গুটিয়ে এনেছি। ঘটনাকালে যে দশজন মঞ্চে উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে ছাঁটাই করে গুটি তিনেক লোককে দাঁড় করানো গেছে। মুশকিল কি হয়েছে জানেন, ওদের সকলেরই একটা একটা মোটিভ আছে। তাহলে গোড়া থেকে বলি শুনুন—

‘আপনারা চলে আসবার পর থিয়েটারের মঞ্চ গ্রীনরুম অডিটোরিয়াম, তারপর হাতার মধ্যে প্রভুনারায়ণের কোয়ার্টার—সব খানাতল্লাশ করলাম; স্টেজের দোরের কাছে দুটো মোটর ছিল—একটা বিশু পালের, দ্বিতীয়টা মণীশ ভদ্র’র—সে দুটোও খুঁজে দেখলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। আর্টিস্টরা সবাই ব্যাগ হাতে করে অভিনয় করতে আসে, তাদের ব্যাগের মধ্যেও সাধারণ কাপড়-চোপড় পাউডার লিপস্টিক ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। কেবল মালবিকার ব্যাগে একটা নরুনের মত ধারালো ছুরি আর ব্রজদুলালের ব্যাগে এক বোতল হুইস্কি পাওয়া গেল। তারপর নিষ্ফল বডি সার্চ।’

মাধব মিত্র চায়ের পেয়ালা শেষ করে রুমালে মুখ মুছলেন, বললেন, ‘অতঃপর সাক্ষীদের জবানবন্দী নিতে শুরু করলাম। প্রথমে বিশু পালের ভাই অমল পাল—’

ব্যোমকেশ হাত তুলে বলল, ‘জবানবন্দী মুখে বলতে গেলে অনেক কথা বাদ পড়ে যাবে। তার চেয়ে যদি জবানবন্দীর নথি আপনার কাছে থাকে—’

মাধববাবু ফাইলের ওপর হাত রেখে একটু দ্বিধাভরে বললেন, ‘আছে। একটা কপি সর্বদাই সঙ্গে থাকে। কিন্তু—মুশকিল কি জানেন, ফাইল হাতছাড়া করার নিয়ম নেই। যাহোক, এক কাজ করা যেতে পারে, আমি বসছি, আপনি ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিন। আপনার পড়াও হবে, নিয়ম রক্ষেও হবে। কি বলেন?’

ব্যোমকেশ নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘দেখুন, আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনার যদি আগ্রহ থাকে তবেই জবানবন্দী পড়ব।’

মাধববাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না, সে কি কথা! আমার আগ্রহ আছে বলেই না আপনার কাছে এসেছি।’ তিনি ফাইল থেকে টাইপ করা ফুলস্ক্যাপ কাগজের একটা নথি বার করে ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘এই নিন। আপনি পড়ুন, আমি না হয় ততক্ষণ প্রতুলবাবুর সঙ্গে পাশের ঘরে বসে গল্প করি।’

ব্যোমকেশ নথি টেনে নিয়ে বলল, ‘মন্দ কথা নয়। প্রতুলবাবু আপনাকে কিছু নতুন খবর দিতে পারবেন। আমিও একটা খবর দেব। আগে জবানবন্দী পড়ি। ডাক্তারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট নথিতে আছে নাকি?’

‘আছে। তিনি ডাক্তারি পরিভাষার কচ্‌কচি রিপোর্টে যথাসম্ভব সরল করে দিয়েছেন।’

ব্যোমকেশ সিগারেট ধরিয়ে জবানবন্দীর নথির পাতা খুলে পড়তে আরম্ভ করল।

থিয়েটারের অফিস ঘরে বসে মাধব মিত্র একের পর এক সাক্ষী ডেকে তাদের এজাহার নিয়েছিলেন। একজনের এজাহার নেবার সময় অন্য কোনো সাক্ষী উপস্থিত ছিল না।

অমল পাল। বয়স—৩৯। জীবিকা—ডাক্তারি। ঠিকানা—* * গোলাম মহম্মদ রোড, দক্ষিণ কলিকাতা।

মৃত বিশ্বনাথ পাল আমার দাদা ছিলেন। আমরা দুই ভাই; আমি কনিষ্ঠ। দাদা আমার পড়ার খরচ দিয়ে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন। আমি দক্ষিণ কলকাতায় প্র্যাক্‌টিস করি, দাদা থিয়েটারের কাছে থাকার জন্যে শ্যামবাজারে থাকতেন। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। শ্যামবাজারের বাসায় অভিনেত্রী সুলোচনা তাঁর সঙ্গে থাকত। আমার সুযোগ হলে আমি থিয়েটারে এসে কিম্বা শ্যামবাজারের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিপূর্ণ সদ্ভাব ছিল, তিলমাত্র মনোমালিন্য কোনো দিন হয়নি।

দাদা উদার চরিত্রের মানুষ ছিলেন, পরোপকারী ছিলেন। তিনি পনেরো হাজার টাকার লাইফ ইন্‌সিওর করে আমাকে তার ওয়ারিশ করেছিলেন। শুনেছি থিয়েটারের আরো অনেক লোককে লাইফ ইন্‌সিওরের ওয়ারিশ করেছিলেন। কাউকে দশ হাজার, কাউকে পাঁচ হাজার। তিনি অজস্র টাকা রোজগার করতেন, কোনো বদ্‌খেয়াল ছিল না; যাদের ভালবাসতেন তাদের দু’হাত ভরে দিতেন।

নৈতিক চরিত্র? তিনি আমার গুরুজন ছিলেন, তাঁর নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। সুলোচনার সঙ্গে ওঁর বিবাহিত সম্বন্ধ না থাকলেও ওঁরা স্বামী-স্ত্রীর মতই থাকতেন।

দাদার শত্ৰু? শত্ৰু কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। সকলেই তাঁর অনুগৃহীত, শত্রুতা কে করবে?

আমি আজ এ পাড়ায় একটা ‘কল’এ এসেছিলাম, ভাবলাম দাদার সঙ্গে দুটো কথা বলে যাই; তাই থিয়েটারে এসেছিলাম। আমার ডাক্তারি প্র্যাক্‌টিস মোটের ওপর মন্দ নয়। আমি বিবাহিত; তিনটি মেয়ে দু’টি ছেলে।

আজ নাটক শেষ হবার ঠিক আগে যখন এক মিনিটের জন্যে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল তখন আমি স্টেজের পিছন দিকে একটা টুলের ওপর বসে সিগারেট টানছিলাম। তখন কে কোথায় ছিল, নিজের জায়গা থেকে নড়েছিল কিনা আমি লক্ষ্য করিনি। আলো জ্বলার পরে আবার অভিনয় আরম্ভ হল, কিছুক্ষণ পরে চীৎকার কান্না হৈ হৈ, ড্রপসিন পড়ে গেল। তখন আমি স্টেজে এসে দেখলাম—

আমি ডাক্তার, কিন্তু দাদার মৃত্যুর কারণ আমি বুঝতে পারিনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু—হার্ট ফেলিওর হতে পারে। কিন্তু দাদার হার্ট দুর্বল ছিল না, কয়েক দিন আগে আমি পরীক্ষা করেছি। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পোস্ট-মর্টেমে জানা যাবে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত, এখনো ঠিক ধারণা করতে পারছি না।

দাদা যদি উইল করে গিয়ে থাকেন তাহলে কে তাঁর উত্তরাধিকারী আমি জানি না, সলিসিটার সিংহ-রায়ের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যাবে। যদি উইল না থাকে তাহলে সম্ভবত আমিই তাঁর উত্তরাধিকারী। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কী আছে আমি জানি না।

ব্রজদুলাল ঘোষ। বয়স—৪২। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—* * শ্যামপুকুর লেন।

ইন্সপেক্টরবাবু, আপনি সুলোচনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে এখনো সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হয়নি। আপনি আগে আমাকে প্রশ্ন করুন। আমার এজাহার শেষ হলে সুলোচনা আসবে।

প্রশ্ন: আপনি এই নাটকে ভীমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন?

উত্তর: হ্যাঁ। বিশু যতগুলি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সব নাটকেই আমি অভিনয় করেছি।

প্রশ্ন: কতদিন তাঁর সঙ্গে আছেন?

উত্তর: তা প্রায় দশ বছর। বিশু যখন নিজের দল তৈরি করে আসরে নামল তখন থেকে আমি ওর সঙ্গে আছি।

প্রশ্ন: আপনার মত আর কেউ গোড়া থেকে আছে?

উত্তর: গোড়া থেকে—। আছে। কমিক অভিনেতা দাশরথি চক্কোত্তি আর তার বৌ নন্দিতা। অন্য যারা ছিল তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন: আপনাদের কারুর সঙ্গে বিশু পালের অসদ্ভাব ছিল?

উত্তর: দেখুন, কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যায় না। কার মনে কি আছে জানি না, কিন্তু বাইরে কোনো অসদ্ভাব ছিল না। বিশু ছিল দিলদরিয়া মেজাজের লোক, দলের লোককে সে ঘরের লোক বলে মনে করত। এমন অমায়িক চরিত্র দেখা যায় না।

প্রশ্ন: বিশু পালের চরিত্রে কোনো দোষ ছিল না?

উত্তর: একটু আধটু দোষ কার না থাকে? ঠক্ বাছতে গাঁ উজোড়। বিশু মরে গেছে, কিন্তু আমি গলা ছেড়ে বলতে পারি সে উঁচু মেজাজের সজ্জন ব্যক্তি ছিল। যারা তার দলে কাজ করেছে তারা সপরিবারে কাজ করেছে। সমস্ত থিয়েটারটাই একটা পারিবারিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন আমাদের সকলের এজমালি থিয়েটার। এখন সে মরে গেছে, এরপর কী হবে জানি না।

প্রশ্ন: আচ্ছা, এবার আপনার ঘরের কথা কিছু জিজ্ঞেস করি। আপনার পরিবারে কে কে আছে?

উত্তর: বুড়ি পিসি আছেন। আমার স্ত্রী শান্তি আছে আর একটি মেয়ে আছে। মেয়ে স্কুলে পড়ে। শান্তি আমাদের থিয়েটারে গান-বাজনা শেখায়।

প্রশ্ন: তিনি আজ আসেননি?

উত্তর: না। নতুন নাটকের যখন মহড়া আরম্ভ হয় তখন সে আসে, নাচ-গান শেখায়; নাটক একবার চালু হলে তার কাজ থাকে না, তখন আর বড় একটা আসে না। বাড়িতে একটা নাচ-গানের কোচিং ক্লাস খুলেছে, তাইতে শেখায়।

প্রশ্ন: আপনি থিয়েটারে যোগ দেবার আগে কোনো কাজ করতেন কি?

উত্তর: হ্যাঁ, আমি মুষ্টিযোদ্ধা ছিলাম। একবার ভারতের মিড্ল-ওয়েট চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম। একটি জিম্‌নেসিয়ামে বক্সিং শেখাতাম। কিন্তু থিয়েটারের শখ বরাবরই ছিল, একটা সুযোগ পেয়ে চলে এলাম।

প্রশ্ন: আজ স্টেজের ওপর বিশু পালের সঙ্গে আপনার মল্লযুদ্ধ হয়েছিল; তখন আপনি বিশু পালের শরীরে কোনো দুর্বলতা লক্ষ্য করেছিলেন?

উত্তর: না। ঠিক অন্য দিনের মত।

প্রশ্ন: কখন জানতে পারলেন বিশু পালের মৃত্যু হয়েছে?

উত্তর: আমি জানতে পারিনি। লাইট অফ্ হয়ে যাবার পর আমি আর সুলোচনা পিছন দিকের দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আলো জ্বললে স্টেজে এসে অ্যাক্‌টিং আরম্ভ করলাম। এই সময় বিশুর মাটি থেকে উঠে আমার পিঠে ছুরি মারবার কথা; কিন্তু বিশু উঠল না। তারপরই সুলোচনা চীৎকার করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন আমি বুঝতে পারলাম।

প্রশ্ন: এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? আচ্ছা, আজ আপনি বাড়ি যান। যদি নতুন কিছু মনে পড়ে জানাবেন।

সুলোচনা। বয়স—৩৫। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—* * শ্যামবাজার, উত্তর কলিকাতা।

সুলোচনা মুখের রঙ অনেকটা পরিষ্কার করেছে, তবু কানে ও গলায় কিছু পেন্ট লেগে আছে। তার গায়ের রঙ ফরসা, শরীরের গড়ন ভাল; কিন্তু আকস্মিক বিপর্যয়ে একেবারে যেন ভেঙে পড়েছে। অফিস ঘরে এসে মাধব মিত্রের সামনের চেয়ারে সে বসে পড়ল, আর্তস্বরে নিজেই প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘কে একাজ করল, দারোগাবাবু?’

উত্তরে দারোগা প্রশ্ন করলেন, ‘কোন্ কাজ?’

সুলোচনার চোখ দারোগার মুখের ওপর স্থির হল, গলার স্বরে তীক্ষ্ণতা এল। সে বলল, ‘আপনি জানেন না কোন্ কাজ? ওঁর শরীরে কোনো রোগ ছিল না, ওঁর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কেউ ওঁকে খুন করেছে।’

প্রশ্ন: এ বিষয়ে এখনো ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তবে আপনার অনুমান সত্যিও হতে পারে। যদি সত্যি হয়, কে খুন করেছে আপনি বলতে পারেন?

উত্তর: তা কি করে বলব। কিন্তু ওঁর কোনো শত্রু ছিল না।

প্রশ্ন: শত্রু না থাকলেও বিশু পালের মৃত্যুতে অনেকের লাভ ছিল। যাদের উদ্দেশ্যে উনি লাইফ ইন্‌সিওর করেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে তাদের সকলেরই লাভ। নয় কি?

উত্তর: তা সত্যি কিন্তু এমন কে আছে কয়েকটা টাকার জন্যে চিরজীবনের উপকারী বন্ধুকে খুন করবে!

প্রশ্ন: আপনি কাউকে সন্দেহ করেন না?

উত্তর: না।

প্রশ্ন: বাইরের কেউ হতে পারে না?

উত্তর: বাইরের লোক! তা জানি না। তিনি থিয়েটারের বাইরের অনেক লোককে চিনতেন, কার মনে কী আছে কেমন করে জানব?

প্রশ্ন: আচ্ছা যাক। আপনার সঙ্গে বিশুবাবুর কতদিনের পরিচয়?

উত্তর: প্রায় পাঁচ বছর।

প্রশ্ন: কোথায় পরিচয় হয়েছিল? কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল?

উত্তর: এই থিয়েটারে পরিচয় হয়েছিল। ব্রজদুলালবাবু আগে থাকতে আমাকে চিনতেন, তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: আগেও থিয়েটার করতেন নাকি?

উত্তর: নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে করতাম।

প্রশ্ন: আপনার পারিবারিক পরিস্থিতি কিছু জানতে চাই।

উত্তর: মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছিলুম। থিয়েটারের দিকে ঝোঁক ছিল। সুযোগ পেয়ে চলে এলুম।

প্রশ্ন: এ থিয়েটারে আসার পর থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে আছেন?

উত্তর: হ্যাঁ। বিয়ে হয়নি, কিন্তু উনিই আমার স্বামী।

প্রশ্ন: বাপের বাড়ির সঙ্গে আর আপনার কোনো সম্বন্ধ নেই?

উত্তর: না। আমার মা বাবা নেই, দাদা খবর রাখেন না।

প্রশ্ন: ডাক্তার অমল পালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

উত্তর: ভাল। সে তার দাদাকে শ্রদ্ধা করত। বাড়িতে বড় একটা আসত না, দরকার হলে এখানে এসে দাদার সঙ্গে দেখা করত।

প্রশ্ন: কিসের দরকার—টাকার?

উত্তর: হ্যাঁ। বেশির ভাগই টাকা। ওর ডাক্তারি ভাল চলে না। অনেকগুলি ছেলেমেয়ে—

প্রশ্ন: বিশু পালের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন কে পাবে আপনি জানেন?

উত্তর: যতদূর জানি উনি উইল করে যাননি। স্থাবর সম্পত্তির কথাও কখনো শুনিনি। ব্যাঙ্কে কিছু টাকা আছে, আর মোটর গাড়িটা আছে। ব্যাঙ্কের টাকা কে পাবে তা জানি না, তবে গাড়িটা আমার নামে আছে, সম্ভবত আমার নামেই থাকবে।

প্রশ্ন: এবার শেষ প্রশ্ন। আজ অভিনয়ের সময় কিছু দেখেছেন কিম্বা শুনেছেন কি যা আমাদের কাজে লাগতে পারে?

সুলোচনা একটু চিন্তা করে বলল, ‘সন্দেহজনক কিছু নয়, তবে সোমরিয়াকে উইংসের বাইরে এক কোণে লুকিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। সে মাঝে মাঝে ভিতরে এসে থিয়েটার দেখে।’

প্রশ্ন: সোমরিয়া কে?

উত্তর: দারোয়ান প্রভু সিং-এর বোন।

ইন্সপেক্টর: আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত।

মণীশ ভদ্র। বয়স—২৯। জীবিকা—থিয়েটারের আলোকযন্ত্র পরিচালনা। ঠিকানা * * আমহার্স্ট স্ট্রীট।

মণীশ ঘরে ঢুকে একবার কজির ঘড়ির দিকে তাকালো। রেডিয়াম লাগানো ঘড়ি, অন্ধকারেও সময় দেখা যায়। সে চেয়ারে বসে বলল, ‘পৌনে এগারটা। দারোগাবাবু, বড্ড রাত হয়ে গেছে, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন? হোটেল সব বন্ধ হয়ে গেছে, আজ আর বোধহয় কিছু জুটবে না—’

মাধববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার এজাহার পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।’

মণীশ বলল, ‘আমি একলা নয়, বৌও আছে। —দু’জনের এজাহার একসঙ্গে নিলে হয় না?’

মাধববাবু বললেন, ‘না, তা হয় না। আপনারা দু’জন দু’ জায়াগায় ছিলেন। —আচ্ছা, বলুন দেখি, আলো নেভাবার পর আপনি কী করলেন?’

উত্তর: সুইচের ওপর হাত রেখে ঘড়ির পানে তাকিয়ে রইলাম, পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পরে সুইচ টিপে আলো জ্বাললাম।

প্রশ্ন: আপনার বোর্ডে অনেকগুলি সুইচ, কোনটা কোথাকার সুইচ সব আপনার নখদর্পণে?

উত্তর: হ্যাঁ, তবু সাবধান থাকা ভাল, তাই এই দৃশ্যে সুইচে হাত রাখি।

প্রশ্ন: ঠিক পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড কেন?

উত্তর: বিশুবাবু সময় ধার্য করে দিয়েছিলেন, পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হাউস অন্ধকার থাকবে।

প্রশ্ন: আপনার একজন সহকারী আছে না?

উত্তর: আছে। কাঞ্চন সিংহ। সে আমার সঙ্গে সুইচ বোর্ডে ছিল না। তার মাথা ধরেছিল—

প্রশ্ন: তার প্রায়ই মাথা ধরে?

মণীশ চুপ করে রইল।

প্রশ্ন: সে কোথায় ছিল আপনি জানেন?

উত্তর: পরে শুনেছি সে অফিস ঘরে ঘুমোচ্ছিল।

প্রশ্ন: কার মুখে শুনলেন?

উত্তর: তার নিজের মুখে।

প্রশ্ন: ও। বিশুবাবুর সঙ্গে আপনি কতদিন কাজ করছেন?

উত্তর: প্রায় চার বছর।

প্রশ্ন: আপনার স্ত্রীও?

উত্তর: না, তখন আমার বিয়ে হয়নি। মালবিকা থিয়েটারে যোগ দিয়েছে বছরখানেক, এই নাটক ধরবার পর থেকে। বিশুবাবু উত্তরার পার্ট করার জন্যে কমবয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন: শেষ পর্যন্ত মালবিকাকে রাখেন।

প্রশ্ন: আপনার নামে বিশুবাবু জীবনবীমা করেননি?

উত্তর: না। আমি বলেছিলাম জীবনবীমা চাই না, মাইনে বাড়িয়ে দিন। তা তিনি জীবনবীমাও করলেন না, মাইনেও বাড়ালেন না। সাতশো টাকা ছিল, সাতশো টাকাই রইল।

প্রশ্ন: তার বদলে বিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি কিনে দিলেন?

উত্তর: গাড়ির একটা ইতিহাস আছে। বিশুবাবু যখন মাইনে বাড়িয়ে দিলেন না তখন আমি বাইরে কাজ খুঁজতে লাগলাম। এই নাটক আরম্ভ হবার কয়েকদিন আগে আমি মাদ্রাজ থেকে একটা ভাল অফার পেলাম। একটা বিখ্যাত সিনেমা কোম্পানি আলোকশিল্পী চায়; মাইনে দেড় হাজার, তাছাড়া বাড়িভাড়া ইত্যাদি। বিশুবাবুকে গিয়ে চিঠি দেখালাম। তিনি বে-কায়দায় পড়ে গেলেন, কিন্তু তবু নিজের জিদ ছাড়লেন না। আমাকে গাড়ি কিনে দিলেন। আর মালবিকাকে যে একশো টাকা হাতখরচ হিসেবে দিতেন তা বাড়িয়ে দু’শো টাকা করে দিলেন। তখন আমি মাদ্রাজের অফারটা ছেড়ে দিলাম। দেশ ছেড়ে কে বিদেশে যেতে চায়?

দারোগাবাবু বললেন, ‘তা বটে। তাহলে আপনি বিশু পালের মৃত্য সম্বন্ধে কোনো হদিস দিতে পারেন না? আচ্ছা, এবার তাহলে আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।’

মালবিকা ভদ্র। বয়স—২০। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা * * আমহার্স্ট স্ট্রীট।

নোট: বিশু পালের আকস্মিক মৃত্যুতে সাক্ষী প্রথমটা খুব শক্ খেয়েছিল, এখন সুস্থ হয়েছে। বয়স কম, দেখতেও সুন্দরী; কিন্তু চোখের ঋজু দৃষ্টি ও চিবুকের মজবুত গড়ন থেকে চরিত্রের দৃঢ়তা অনুমান করা যায়।

প্রশ্ন: নাটকে আপনি উত্তরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আপনার অভিনয় আছে?

উত্তরা: না। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে আমার অভিনয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার স্বামীকে থাকতে হয়, তাই আমিও থাকি।

প্রশ্ন: আজ যখন শেষ অঙ্কে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

উত্তর: সাধারণ অভিনেত্রী মেয়েদের জন্যে একটা আলাদা সাজঘর আছে। আমি সেই সাজঘরে গায়ের মুখের রঙ সবেমাত্র তুলতে আরম্ভ করেছিলুম।

প্রশ্ন: সেখানে আর কেউ ছিল?

উত্তর: লক্ষ্য করিনি। একবার বোধহয় নন্দিতাদিদি ঘরে এসেছিল।

প্রশ্ন: আপনি কবে থেকে অভিনয় করছেন?

উত্তর: এই নাটকের আরম্ভ থেকে। প্রায় বছর ঘুরতে চলল।

প্রশ্ন: অভিনয়ের দিকে আপনার ঝোঁক আছে।

উত্তর: খুব বেশি নয়। আমার স্বামী চেয়েছিলেন, কিছু টাকাও আসছিল, তাই থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলুম।

প্রশ্ন: আপনি বোম্বাই কিম্বা মাদ্রাজে গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করলে অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতেন। করেননি কেন?

উত্তর: বাংলা দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আমি গেরস্থ ঘরের মেয়ে, ঘরকন্না করতেই ভালবাসি। আমার মা সহমৃতা হয়েছিলেন।

প্রশ্ন: সহমৃতা! আজকালকার দিনে—!

উত্তর: বাবা মারা যাবার এক ঘন্টা পরে মা হার্টফেল করে মারা যান।

প্রশ্ন: ও—বুঝেছি। আচ্ছা, বিশু পাল কেমন লোক ছিলেন?

উত্তর: খুব মিশুকে লোক ছিলেন। দরাজ হাত ছিল। সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন।

প্রশ্ন: মেয়েদের সঙ্গেও?

উত্তর: হ্যাঁ। কিন্তু কখনো কোনো রকম বেচাল দেখিনি।

ইন্সপেক্টর: আচ্ছা, এবার আপনি বাড়ি যান।

কাঞ্চন সিংহ। বয়স—২৬। জীবিকা—থিয়েটারের আলোকশিল্পীর সহকারী। ঠিকানা—মানিকতলা স্ট্রীটের একটি মেস।

নোট: লোকটির ভাবভঙ্গী একটু খ্যাপাটে গোছের; মাঝে মাঝে আবোল তাবোল এলোমেলো কথা বলে। কতখানি খাঁটি কতখানি অভিনয় বলা যায় না।

প্রশ্ন: আপনি হিপি, না বিট্‌লে, না অবধূত?

উত্তর: আজ্ঞে, আমি বাঙালী।

প্রশ্ন: আপনার সাজপোশাক বাঙালীর মত নয়। দাড়ি গোঁফও প্রচুর। কোনো কারণ আছে কি?

উত্তর: আমার ভাল লাগে। তাছাড়া থিয়েটার করার সময় পরচুলো পরতে হয় না।

প্রশ্ন: আপনি এখানে আসার আগে কী কাজ করতেন?

উত্তর: বাউণ্ডুলে ছিলাম। বাপ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিল, মেসে থাকতাম আর শখের থিয়েটার করতাম।

প্রশ্ন: তাহলে চাকরিতে ঢুকলেন কেন?

উত্তর: বাপের পয়সায় শাক-চচ্চড়ি খাওয়া চলে, রসগোল্লা খাওয়া চলে না।

প্রশ্ন: তাহলে রসগোল্লা খাওয়ার জন্যেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন?

উত্তর:. শুধু রসগোল্লা নয়, অন্য মতলবও ছিল। জানেন, আমি খুব ভাল অ্যাক্‌ট করতে পারি। শিবাজির পার্ট, ঔরঙ্গজেবের পার্ট প্লে করেছি। বিশুবাবু আমার চেহারা দেখে চাকরিতে নিলেন, কিন্তু কাজ দিলেন আলো জ্বালা আর আলো নেভানোর। যদি অভিনয় করতে দিতেন, আগুন ছুটিয়ে দিতাম।

প্রশ্ন: তা বটে। এখন বলুন দেখি, আলো নেভানোর সময় আপনি সুইচের কাছে ছিলেন না কেন?

উত্তর: আলো নেভানোর সময় সুইচবোর্ডে একজন লোকেরই দরকার হয়। মণীশদা ছিলেন, তাই আমি—

প্রশ্ন: কোথায় ছিলেন?

উত্তর: মাথা ধরেছিল, তাই আমি অফিস ঘরে গিয়ে টেবিলে মাথা রেখে একটু বসে ছিলাম।

প্রশ্ন: স্টেজের ওপর খুন হল। অসময়ে প্লে বন্ধ হয়ে গেল, এসব কিছুই জানতে পারেননি?

উত্তর: এঁ—একটু ঝিমকিনি এসে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: আপনি নেশাভাঙ করেন?

উত্তর: নেশাভাঙ! নাঃ, পয়সা কোথায় পাব!

প্রশ্ন: কোন্ নেশা করেন?

উত্তর: এঁ—নেশা করি না—মাঝে মাঝে ভাঙ খাই। মানে—

প্রশ্ন: মানে মারিওয়ানা সিগারেট খান। কে যোগান দেয়? পান কোথায়?

উত্তর: যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। ঠেলাগাড়িতে পানের দোকানে। আপনার চাই?

ইন্সপেক্টর: আপনি এখন যেতে পারেন। মেস ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কলকাতাতেই থাকবেন।

দাশরথি চক্রবর্তী। বয়স—৪৫। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—বেহালা।

ভাল মানুষের মত ভাবভঙ্গী, কিন্তু কথা বলার ধরন সোজা নয়। সরলভাবে চোখ মিট্‌মিট্ করে তাকায়, কিন্তু চোখের গভীরে প্রচ্ছন্ন দুষ্টতার ইঙ্গিত। লোকটি কমিক অ্যাক্‌টর, খোঁচা দিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু খোঁচা বুঝতে একটু সময় লাগে।

প্রশ্ন: আপনি গোড়া থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে ছিলেন?

উত্তর: ছিলাম। বিশুর সঙ্গে যথেষ্ট সম্ভাবও ছিল। তাই বুঝতে পারছি না যাবার সময় সে আমাকে এমনভাবে দয়ে মজিয়ে গেল কেন?

প্রশ্ন: সেটা কি রকম?

উত্তর: ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এত রাত্রে যদি ট্যাক্সি না পাই, পেটে কিল মেরে এখানেই শুয়ে থাকতে হবে।

ইন্সপেক্টর: আপনি বেহালায় থাকেন তো? কিছু ভাববেন না, আমি পুলিস ভ্যানে আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

দাশরথি: ধন্যবাদ। এবার যত ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করুন।

প্রশ্ন: বিশু পালের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?

উত্তর: কারুর সঙ্গে আমার অসদ্ভাব নেই। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না।

প্রশ্ন: বিশু পালের কোনো শত্রু ছিল?

উত্তর: শত্রুর কথা শুনিনি। তবে কি জানেন, যেখানে মেয়েমানুষ সেখানেই গণ্ডগোল।

প্রশ্ন: তার মানে? সুলোচনার কথা বলছেন?

উত্তর: (ক্ষণেক নীরব থাকার পর) সুলোচনা খুব ভাল অভিনয় করে, কিন্তু সে খানদানি অ্যাক্‌ট্রেস নয়, গেরস্তঘরের মেয়ে। ব্রজদুলাল প্রথম ওকে—মানে—থিয়েটারে নিয়ে আসে। তারপর বিশুর সঙ্গে সুলোচনার জোটপাট হয়ে গেল—

প্রশ্ন: ও—বুঝেছি। তা নিয়ে বিশুবাবুর সঙ্গে ব্রজদুলালবাবুর কোনো মনোমালিন্য হয়নি?

উত্তর: অমন হেরফের হামেশাই হয়ে থাকে, কেউ গায়ে মাখে না। কে যাবে কেউটে সাপের লেজ মাড়াতে।

প্রশ্ন: হুঁ। অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিশু পালের ঘনিষ্ঠতা ছিল?

উত্তর: তা কি করে জানব। কেউ তো ঢাক পিটিয়ে এসব কাজ করে না। অবশ্য থিয়েটারে নানা রকম মেয়ের যাতায়াত আছে, কোন্ অ্যাক্‌টরের কখন কোন্ মেয়ের ওপর নজর পড়বে কে বলতে পারে। এই যে দারোয়ান প্রভুনারায়ণের একটা বোন আছে—সোমরিয়া, উচক্কা বয়স, রূপও আছে। সে থিয়েটারে চাকরানীর কাজ করে; কারুর নজর এড়িয়ে চলা তার স্বভাব নয়। বিশুও সকাল বিকেল নিয়ম করে থিয়েটার তদারক করতে আসত—

প্রশ্ন: অর্থাৎ, সোমরিয়ার সঙ্গে বিশু পালের—?

উত্তর: ভগবান জানেন। তবে সুযোগ সুবিধে সবই ছিল।

প্রশ্ন: আচ্ছা, ওকথা যাক। —বিশু পালের সঙ্গে বাইরের কোনো লোকের শত্রুতা ছিল?

উত্তর: এক থিয়েটারের অধিকারীর সঙ্গে অন্য থিয়েটারের অধিকারীর রেষারেষি থাকে। বিশুর থিয়েটার খুব ভাল চলছিল, অনেকের চোখ টাটিয়েছিল। একে যদি শত্রুতা বলেন, বলতে পারেন।

প্রশ্ন: এবার নিজের কথা বলুন।

উত্তর: নিজের কথা আর কি বলব? ছেলেবেলা থেকে থিয়েটারে ঢুকেছি, অনেক ঘাটের জল খেয়েছি। স্ত্রীকে নিয়ে বেহালায় থাকি, ছেলেপুলে নেই। বেশি উচ্চাশাও নেই। যেমনভাবে দিন কাটছিল তেমনিভাবে কেটে গেলেই খুশি থাকতাম। কিন্তু বিশু মরে গেল, ওর দল টিকবে কিনা কে জানে। হয়তো ভেঙে যাবে, তখন আবার অন্য দলে গিয়ে ভিড়তে হবে।

প্রশ্ন: আজ দ্বিতীয় অঙ্কে আপনার আর আপনার স্ত্রীর অভিনয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাড়ি যাননি কেন?

উত্তর: দ্বিতীয় অঙ্কের পর বাড়ি যাব বলে বেরুচ্ছি, বিশু বলল, ‘একটু থেকে যাও, তোমার সঙ্গে কথা আছে। নাটক শেষ হলে বলব।’

প্রশ্ন: কি কথা?

উত্তর: তা জানি না, বিশু বলেনি।

প্রশ্ন: সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত ছিল?

উত্তর: না, আমরা একলা ছিলাম। বিশুর ড্রেসিংরুমে কথা হয়েছিল।

ইন্সপেক্টর: হুঁ। আজ এই পর্যন্ত। আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।

নন্দিতা চক্রবর্তী। বয়স—৪৪। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—বেহালা।

নোট: মহিষমর্দিনী চেহারা, দাশরথির চেয়ে মুঠিখানেক মাথায় উঁচু। লালচে চোখ, বড় বড় দাঁত, কিন্তু গলার স্বর মিষ্টি। আচরণ শিষ্ট ও শালীন।

প্রশ্ন: আপনার স্বামী নামকরা কমিক অ্যাক্‌টর, আপনিও কি কমিক অ্যাক্‌টিং করেন?

উত্তর: ও মা, অ্যাক্‌টিং-এর আমি কি জানি। আগে আমি থিয়েটারের পোশাক আশাকের ইন-চার্জ ছিলুম। একদিন বিশুবাবু আমাকে একটা ছোট পার্টে নামিয়ে দিলেন। সেই থেকে (হেসে) আমার চেহারার মানানসই পার্ট থাকলে আমি করি।

প্রশ্ন: বিশুবাবু কেমন লোক ছিলেন?

উত্তর: দিল্‌দরিয়া লোক ছিলেন। টাকা তাঁর হাতের ময়লা ছিল, যেমন রোজগার করতেন তেমনি খরচ করতেন। কিন্তু মদ খেতেন না, বদ্‌খেয়ালি ছিল না।

প্রশ্ন: প্রভুনারায়ণের বোনের সঙ্গে কিছু ছিল?

উত্তর: ওসব বাজে গুজব, আমি বিশ্বাস করি না।

প্রশ্ন: সুলোচনা কেমন মানুষ?

উত্তর: (একটু থেমে) সুলোচনা ভাল অভিনয় করে, মেয়েও ভাল, কিন্তু মনের কথা কাউকে বলে না। ভারি চাপা প্রকৃতির মেয়ে।

প্রশ্ন: আর মালবিকা?

উত্তর: মালবিকা ছেলেমানুষ, কিন্তু মনে ছুঁই-ছুঁৎ আছে। ভালভাবে কারুর সঙ্গে মেশে না, একটু দূরত্ব রেখে চলে। তবে মেয়ে ভাল।

প্রশ্ন: আর ওর স্বামী?

উত্তর: মণীশ? একটু গম্ভীর প্রকৃতি, কিন্তু ভাল ছেলে। আর ওর কাজের তুলনা নেই, আলো ফেলে নাটকের চেহারা বদলে দিতে পারে। আগে সাঁতারু ছিল, কিন্তু সাঁতারে তো পয়সা নেই, তাই থিয়েটারে ঢুকেছে।

প্রশ্ন: আর ব্রজদুলালবাবু?

উত্তর: মদ-টদ খান বটে কিন্তু ভারি বিজ্ঞ লোক। এক সময় মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, এখনো গায়ে অসুরের শক্তি। ওঁর স্ত্রী শান্তিও ভারি গুণের মেয়ে; নাচতে জানে, গাইতে জানে, গানে সুর দিতে জানে। এখানকার মিউজিক্‌ মাস্টার।

প্রশ্ন: স্বামী-স্ত্রীতে সদ্ভাব আছে?

উত্তর: তা আছে বই কি। তবে যে-যার নিজের কাজে থাকে, কেউ কারুর বড় একটা খবর রাখে না।

প্রশ্ন: আজ যখন আলো নেভানো হয় আপনি কোথায় ছিলেন?

উত্তর: আমার স্বামী আর আমি স্টেজের পিছন দিকে একটা বেঞ্চিতে বসেছিলুম।

ইন্সপেক্টর একজন জমাদারকে ডেকে বললেন, ‘ইনি বেহালায় থাকেন। এঁকে আর এঁর স্বামীকে পুলিসের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দাও।’

কালীকিঙ্কর দাস। বয়স—৪০। জীবিকা—থিয়েটারের প্রমপ্‌টার। ঠিকানা * * কৈলাস বোস লেন।

অসমাপ্ত