পরিশিষ্ট

বিশুপাল বধ – ১

কালীচরণ দাসকে পাড়ার লোকে আড়ালে শালীচরণ দাস বলে উল্লেখ করত। শুধু হাস্যরস সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য গভীরতর। নামের আদ্যাক্ষর বদল করে কোনো রসিক ব্যক্তি কালীচরণ দাসের প্রকৃতি উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করেছিলেন। আমরা এই কাহিনীতে তাকে শালীচরণ দাস বলেই উল্লেখ করব।

চৌদ্দ বছর আগে শালীচরণ কলকাতার দক্ষিণাংশে বাস করত এবং সামান্য কাজকর্ম করত। বাড়িটি ছোট হলেও দোতলা, শালীচরণ ওপরতলাটা একজনকে ভাড়া দিয়েছিল, নীচের তলায় নিজে সস্ত্রীক থাকত। তার স্ত্রী ছিল বন্ধ্যা। সংসারে আর কেউ ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন বৌ মরে গেল।

কিন্তু সংসার করতে হলে ঘরে একটি স্ত্রীলোক দরকার। শালীচরণের বয়স তখন ত্রিশ বছর, কিন্তু সে আর বিয়ে করল না; ভেবে-চিন্তে একটি বিধবা এবং অনাথা শালীকে এনে ঘরে বসাল। দূর সম্পর্কের শালী, নাম মালতী, বয়স কম, মাঝারি রকমের সুন্দরী, স্বভাব একটু চপল-চটুল; কিন্তু সংসারের কাজকর্মে নিপুণা।

মাসখানেক যেতে না যেতেই পাড়ায় কানাঘুষো আরম্ভ হয়ে গেল। শালীচরণের বৌ যতদিন বেঁচে ছিল নিজে গড়িয়াহাটে গিয়ে বাজার করত, পাড়াপড়শীর বাড়িতে যাতায়াত করত, কিন্তু শালী করে না কেন? শালীচরণ শালীকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না, নিজে বাজার করে কেন? বৌ-এর চেয়ে শালীর আদর কখন বেশি হয়?

তার ওপর শালীচরণের বাড়ির দোতলায় যে ভাড়াটে ছিল তাদের বাড়ির মেয়েরা একটা নতুন খবর বিতরণ করল। নীচের তলায় তাদের যাতায়াত ছিল। তারা বলল, শালী যখন প্রথম আসে তখন দুটো ঘরে দুটো আলাদা খাট বিছানা ছিল, এখন কেবল একটা ঘরে একটা বিছানা। ব্যাস্, আর যায় কোথায়! কালীচরণ দাস শালীচরণ দাসে পরিণত হল।

কিন্তু অপবাদ যে ভিত্তিহীন নয় তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হল মাস ছয়েক পরে। শালীচরণের বাড়ির পাশের বাড়িতে একটা মেস ছিল, সেখানে বিশ্বনাথ পাল নামে এক যুবক থাকত। তার চেহারা যেমন বলবান তেমনি লাবণ্যময়, শালীচরণের মত বৈশিষ্ট্যহীন নয়। বিশ্বনাথ পাল ভাল অভিনয় করত, যাত্রা এবং সখের থিয়েটার দলে যোগ দিয়েছিল। তার সঙ্গে শালীচরণের শালীর নাম সংযুক্ত হয়ে নতুন করে কানাঘুষো আরম্ভ হল। দুপুরবেলা পুরুষেরা যখন কাজে বেরিয়ে যায় এবং মেয়েরা খাওয়া-দাওয়ার পর দিবানিদ্রায় নিমগ্ন হয় তখন নাকি বিশ্বনাথ পাল খিড়কির দোর দিয়ে শালীচরণের বাড়িতে যায়। এইভাবে কিছুদিন দিবাভিসার চলল। শালীচরণের বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল, কিম্বা পাড়ার চ্যাংড়া ছোঁড়ারা হয়তো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপপূর্ণ ইশারা করেছিল। সে একদিন দুপুরবেলা আচমকা খিড়কি দিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

অতঃপর যে দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত হল তা উহ্য রাখাই ভাল। মোট কথা আদিরস ও রুদ্ররস মিলে নাইট্রোগ্লিসারিনের মত বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে পরিণত হল। শালীচরণ মেঘগর্জনের মত শব্দ করে অপরাধীদের আক্রমণ করল। কিন্তু বিশ্বনাথ পালের শরীরে অনেক বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও তার মনে পাপ ছিল, সে পদাহত পথ-কুকুরের মত পালিয়ে গেল। বাকি রইল শুধু মালতী। শালীচরণ তখন বিকট চীৎকার করে মালতীর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার গলা টিপে ধরল।

হুড়োহুড়ি চেঁচামেচিতে দোতলা থেকে লোক ছুটে এল, অল্পবয়স্ক বালক বালিকা ও স্ত্রীলোক। দৃশ্য দেখে তারা চীৎকার করে রাস্তার লোক ডাকল। রাস্তা থেকে দু’চার জন লোক এসে অতি কষ্টে শালীচরণের হাত থেকে মালতীর গলা ছাড়ালো। কিন্তু মালতী তখন দম বন্ধ হয়ে মরে গেছে।…

আদালতে শালীচরণের বিচার হল। সে অপরাধ অস্বীকার করল না। শালীর সঙ্গে অবৈধ সহবাসের অভিযোগও মেনে নিল। হাকিম বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, মানুষের হৃদয়ের খবর রাখতেন। শালীচরণের ফাঁসি হল না, গুরুতর আকস্মিক প্ররোচনা বিধায় চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হল।

শান্তভাবে শালীচরণ জেলে গেল। জেলে যাবার আগে ব্যবস্থা করে গেল: তার বাড়ির দোতলার ভাড়া সলিসিটার আদায় করে ব্যাঙ্কে রাখবেন; একতলা বন্ধ থাকবে। শালীচরণের বিষয়সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর আর কিছু ছিল না।

বিশ্বনাথ পাল সেই যে পালিয়েছিল, কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে রইল। শালীচরণ জেলে চলে যাবার পর সে আবার আত্মপ্রকাশ করল। তার চেহারা ভাল, উপরন্তু যথেষ্ট অভিনয় নৈপুণ্য থাকায় সে অল্পকালের মধ্যেই চলচ্চিত্র ও রঙ্গমঞ্চের নামজাদা অভিনেতা হয়ে দাঁড়াল। চিত্রপটের চেয়ে রঙ্গালয়ের দিকেই তার ঝোঁক বেশি; সে দল গঠন করে একটি রঙ্গমঞ্চের অধিকারী হয়ে বসল।

ওদিকে শালীচরণ জেল খাটছিল, যথাকালে মেয়াদ পূর্ণ হলে মুক্তি পেয়ে বেরুল। জেলখানায় সুবোধ বালক হয়ে থাকলে কিছু রেয়াৎ পাওয়া যায়। শালীচরণ চৌদ্দ বছর পূর্ণ হবার আগেই বেরুল। এই কয় বছরে তার বয়স যেমন বেড়েছে তেমনি চেহারারও পরিবর্তন ঘটেছে; আগে সে ছিল রোগা-পট্‌কা, এখন বেশ চাকন-চিকন হয়েছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে তার মনে। মুক্তি পেয়েই সে সটান নবদ্বীপে চলে গেল, সেখান মাথা মুড়িয়ে কণ্ঠি ধারণা করে মালা জপ করতে করতে বাড়ি এল।

ইতিমধ্যে পাড়ার পুরোনো বাসিন্দারা অনেকে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে, দোতলার ভাড়াটেও বদল হয়েছে, তাই শালীচরণ জেল থেকে ফেরার পর বিশেষ হৈ চৈ হল না। সেও কারুর সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করল না। একলা থাকে, স্বপাক নিরামিষ খায় আর মালা জপ করে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের পর বেড়াতে বেরোয়। তার অর্থ উপার্জনের দরকার নেই। বারো বছর ধরে যে বাড়িভাড়া জমেছে তাই তার পক্ষে যথেষ্ট। উপরন্তু মাসে মাসে দোতলা থেকে ভাড়া আসে।