বিশুদ্ধ আর্ট
ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে জল ফুটিয়ে খাওয়া হত না। স্বাস্থ্যরক্ষার বই পড়ে বাবাকে যখন বলি যে বিশুদ্ধ জল খেতে হলে ফুটিয়ে খেতে হয় তিনি ওকথা হেসে উড়িয়ে দেন। ফুটিয়ে খেলে কি জলের স্বাদ থাকে? যে জিনিসের যা স্বাদ।
কথাটা সত্যি। আমাদের কুয়োর জলে একটা প্রাণজুড়োনো স্বাদ ছিল। স্বাস্থ্যরক্ষার বই পড়ে ফুটিয়ে দেখি বিশুদ্ধ জল সেই বিশেষ কুয়োটির বিশেষ স্বাদে স্বাদু জল নয়। তা খেয়ে প্রাণ জুড়োয় না। বাড়িতে বিশুদ্ধ জলের প্রবর্তন সেইখানেই শেষ।
বড়ো হয়ে যখন সাহিত্যে আসি তখন বিশুদ্ধ জলের মতো বিশুদ্ধ আর্টের কথা শুনি। কথাটা মনে ধরে। তারপরে কত বার ওকথা শুনেছি ও বলেছি। কিন্তু বার বার লক্ষ করেছি প্রকৃতি যেমন বিশুদ্ধ জল বলে কিছু সৃষ্টি করেনি, করে থাকলে তার বিশুদ্ধি রক্ষা করতে পারেনি, যে জলই মুখে দেবে সেই জলই ধুলো কাদা ঝরা পাতা মেশানো অশুদ্ধ জল, মানুষও তেমনি বিশুদ্ধ আর্ট বলে কিছু সৃষ্টি করেনি, করে থাকলে তার বিশুদ্ধি রক্ষা করতে পারেনি, সেটাও একটা মিশ্র পদার্থ, সুতরাং অশুদ্ধ পদার্থ।
তারপর আরও লক্ষ করেছি যে আস্বাদনের দিক থেকে বিশুদ্ধের চেয়ে অশুদ্ধই শ্রেয়। শ্রেয় আর প্রেয় এ দুটির মধ্যে বেছে নিতে বললে অধিকাংশ সুজন প্রেয়কেই বরণ করবেন। কারণ তার একটা বিশেষ স্বাদ আছে, যা দিয়ে প্রাণ জুড়োয়।
তা ছাড়া শুদ্ধিকরণ ব্যাপারটাই বর্জনশীল। জলকে ফুটিয়ে খাওয়া মানে অনেকগুলি উপাদান বর্জন করে খাওয়া। উপাদানগুলির মধ্যে যেমন ব্যাধিবীজ লুকিয়ে থাকে তেমনি আরও কিছু থাকে যা স্বাস্থ্যপ্রদ ও হিতকর। একটা খারাপকে তাড়াতে গিয়ে তুমি একটা ভালোকেও তাড়ালে। তোমার শ্রেয়বুদ্ধি কি এই যুক্তি শুনে সন্তুষ্ট হয় যে, ভালো না থাকলেও ভালো, কিন্তু মন্দ থাকলেই মন্দ?
বাবা বোধ হয় আমাকে একথাও বুঝিয়েছিলেন যে কুয়োর জল ফুটিয়ে খেলে কতকগুলি উপাদান বাদ পড়ে, সেগুলি হিতকর। অসুখ যদি করে তাহলে কী হবে? এর উত্তরে বোধ হয় বলেছিলেন যে কুয়ো পরিষ্কার রাখতে হবে, ঘটি পরিষ্কার রাখতে হবে, গেলাস পরিষ্কার রাখতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চয়ই দরকারি, কিন্তু বহিষ্কার তেমন অত্যাবশ্যক নয়।
বিশুদ্ধ আর্ট বলে যদি কোনো পদার্থ থাকে তবে বহিষ্কারনীতির আতিশয্য তাকে নীরক্ত ও নির্মাংস করে আস্বাদনের অযোগ্য করতে পারে। তখন সেই বর্জনশীলকে তার উপভোক্তারাই বর্জন করতে পারে। আর্টেও নীতি ‘নেতি নেতি’ নয়। আর্ট বরং বলে ‘ইতি ইতি’।
সবরকম উপাদান নিয়েই আর্টের ঘরকন্না। কিন্তু কোন পদটি রাঁধতে গিয়ে কোন কোন উপাদান ব্যবহার করতে হবে সেটি তারই বিবেচনানির্ভর। কোনটার পরিমাণ কত হবে সেটাও তেমনি তারই বিবেচ্য। সমঝদার যাঁরা তাঁরা আস্বাদন করে তৃপ্ত হলেই সেকৃতার্থ। যদি কেউ মুখে না দেন, যদি পাতে পড়ে থাকে তবে আর রেঁধে কী সুখ! তা হলে অবশ্য সকলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, কারও অসুখবিসুখ করে না। অপঠিত গ্রন্থ বা অশ্রুত সংগীত যে কারও অহিত করতে পারে না এ তো স্বতঃসিদ্ধ।
আসলে বিশুদ্ধ আর্ট বলতে যা বোঝায় তা বর্জনশীল মনোভাবের ফসল নয়। বিশুদ্ধ আর্টের কথা তখনই ওঠে যখন আর্টের কাছে রকমারি প্রত্যাশা করা হয়। সেকালে যেমন ছিল ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়। পুণ্যের পুরস্কার ও পাপের শাস্তি। একালে যেমন সমাজের পরিবর্তন বা বিপ্লব। রাজনৈতিক মতবাদের প্রতিষ্ঠা বা প্রতিবাদ। প্রত্যাশার ফর্দ শুনে যখন উত্যক্ত হই তখন বলে উঠি, আমার হাত দিয়ে ওসব হবে না। আমার আরাধনার বস্তু বিশুদ্ধ আর্ট। আমার লক্ষ্য এস্থেটিক।
সাহিত্যিক বা চিত্রকরের লক্ষ্য যে এস্থেটিক হবে এটাও তো স্বতঃসিদ্ধ। তবু এ নিয়ে তর্কের অন্ত নেই। সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র এটা মানবে না, কারণ সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজে সবাইকে হাত লাগাতে হবে, তুমি শিল্পী বলে তোমাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ইসলামি রাষ্ট্র, ক্যাথলিক রাষ্ট্র, হিন্দু রাষ্ট্র প্রভৃতির দাবিও সেই-জাতীয়। পশ্চিম ইউরোপের রেনেসাঁস এসে আর্টের লক্ষ্য যে এস্থেটিক এরূপ একটি প্রত্যয়ের বীজ বুনেছিল। সেই বীজ থেকে যে চারাগাছ হয় তা নানা দেশে চালান হয়েছিল। কোথাও সেচারা অনুকূল মাটি জল আলো হাওয়া পায়, কোথাও শুকিয়ে যায়। কোনো কোনো দেশে পূর্বতন ঐতিহ্য ছিল এস্থেটিক। যেমন জাপানে। ধর্ম বা সমাজ সেখানে শিল্পীর পিঠে সওয়ার হয়ে বসেনি।
বিশুদ্ধ আর্ট বলতে বুঝি সেই আর্ট যা শিল্পকে মুক্তি দেয়। যার সাধনা ও সিদ্ধি এস্থেটিক। অবশ্য যাঁর ইচ্ছা তিনি তাঁর বিষয়বস্তু বা প্রেরণা বাইবেল থেকে বা পুরাণ থেকে নিতে পারেন বা ডাস কাপিটাল থেকে। বা মাও মহোদয়ের চিন্তা থেকে। কিন্তু শেষফল যেন মুখে রোচে, যেন আস্বাদন সুখ দেয়, যেন এস্থেটিক বিচারে উত্তীর্ণ হয়। উপরন্তু যদি সমাজের বা ধর্মের লক্ষ্যভেদ করে তো বহুত আচ্ছা, কিন্তু আর্টেও লক্ষ্যভেদই প্রথম কাজ, যা না করলেই নয়।
মনে রাখতে হবে যে আর্ট যদিও একদেশে-না-একদেশে সৃষ্টি হয় তবু তা দেশাতীত ও বিশ্বজনীন। যেমন শিশু একজনের গর্ভে জন্মালেও সারা সমাজের। নইলে রাশিয়ান ব্যালে সবাইকে এত আনন্দ দেয় কেন? এমনকী আমেরিকার ক্যাপিটালিস্ট ও ফ্রান্সের বুর্জোয়াদেরও? তেমনি আর্ট যদিও একযুগে-না-একযুগে সৃষ্টি হয় তবু তা যুগাতীত ও সর্বকালীন। তাই যদি না হত তবে মিলো দ্বীপের ভিনাস আমার দেহেমনে এমন পুলক সঞ্চার করত না। যেসব শিল্পকর্ম কালজয়ী বা ক্লাসিক হয়েছে তাদের সকলেরই সেই হ্লাদিনী শক্তি রয়েছে।
যার দেশ আছে অথচ বিদেশ নেই, সব দেশই স্বদেশ। যার যুগ আছে অথচ বিযুগ নেই, সব যুগই স্বযুগ; তাকে যথাসম্ভব বিশুদ্ধ হতে হবে বই কী। যেমন বিশুদ্ধ এসেন্স বা আতর। যেটা তার পক্ষে এসেনশিয়াল সেটাই তার কাছে অগ্রগণ্য। সেটা হয়তো তার হ্লাদিনীশক্তি। অথবা তার অন্তর্নিহিত চিরন্তন সত্য। অথবা তার মধুচক্রের অমৃত যা মানুষকে অমর করে। অথবা তার পাগল করা রূপযৌবন, যা কোনোদিনই ফুরোবে না। অথবা তার ধরাছোঁয়ার অতীত জাদু, যা সব গণনার ঊর্ধ্বে।
আধুনিকরা চাতুর্য দিয়ে জাদুর স্বাদ মেটাতে চান। পারেন না। চাতুর্যেরও হয়তো একটা স্থান আছে, কিন্তু সেটা তেমন অগ্রগণ্য নয়। চাতুর্য যদি আর্টের এসেন্স হত তাহলে সেফলিত বিজ্ঞান হয়ে উঠত। একালের ইমারত দেখে অনেকসময় বোঝা যায় না আর্ট না ফলিত বিজ্ঞান। তাজমহলের জাদু কি আধুনিক চাতুর্যের নাগালের বাইরে নয়? ফলিত বিজ্ঞান আমাদের মহাশূন্যে নিয়ে যেতে পারে, চাঁদের বুড়ি ছুঁইয়ে দিতে পারে, কিন্তু জাদুর রহস্য সেজানে না। জানলে আর্টই জানে। সেইজন্যে আর্টের অভাব ফলিত বিজ্ঞান দিয়ে মেটে না। আধুনিক সভ্যতা যদি আর্টের সাধনা ও সিদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ফলিত বিজ্ঞান নিয়ে মশগুল থাকে ও তারই মতো চতুর এক আর্ট পেলেই চরিতার্থ হয় তবে যাঁরা সমঝদার তাঁরা ক্লাসিকের মধ্যেই আশ্রয় নেবেন। মডার্ন আর্ট যাকে বলা হয় তার সম্বন্ধে আমার নিজেরই মনে দ্বিধা আছে। পরীক্ষানিরীক্ষার দিক থেকে এর মূল্য অশেষ। কিন্তু বিশুদ্ধ আর্টের নামে এও তো সেই ফুটিয়ে খাওয়া জল। আরও শুদ্ধ। ডিস্টিলড ওয়াটার। পরের ধাপটা বোধ হয় অবিমিশ্র হাইড্রোজেন অক্সিজেন।
না, বিশুদ্ধ আর্ট বলতে যদি সেইপ্রকার বিশুদ্ধি যার আছে তেমনি এক আর্ট বোঝায় তবে আর তাকে আর্ট বলে চেনা যাবে না। সেতার বিশুদ্ধি নিয়েই থাকবে। তাতে জলতৃষ্ণা মিটবে না। প্রাণ জুড়োবে না। এমন কয়েকটা উপাদান বাদ পড়বে যাদের বহিষ্কার আর্টের রীতি নয়। আর্টের নীতি নয়।
রাজনীতি সমাজনীতি ইত্যাদি যখন আর্টকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে যায় তখন বিশুদ্ধ আর্টের নাম করে আত্মরক্ষা তথা আর্টরক্ষা করতে চাওয়া এক জিনিস। যেটা সত্যি এসেনশিয়াল তার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বিশুদ্ধির নামে বর্জনশীল ও অবিমিশ্র একটা মৌলিককে লক্ষ করতে যাওয়া আরেক জিনিস। বিশুদ্ধ আর্ট কথাটার দুইরকম অর্থ, মনের প্রবণতা প্রথমটার প্রতি। তা বলে আমি দ্বিতীয়টার বিরোধী নই। পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে চলুক। দেখাই যাক-না নিট ফল কী দাঁড়ায়।
তা ছাড়া আর্টের অগ্রগতির পথটা যে কোন দিকে সে-বিষয়ে আমরা যথার্থই দোটানায় পড়েছি। ‘সব কিছু নিয়েই আর্ট’ যেমন একদিক থেকে টানছে তেমনি আরেক দিক থেকে টানছে ‘কোনো কিছুকে নিয়ে আর্ট নয়, আর্ট তার আপনাকে নিয়ে।’ একদিকে ‘ইতি ইতি’ করে পাওয়া। আরেক দিকে ‘নেতি নেতি’ করে পাওয়া। পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে সবশেষে কী থাকে দেখা যাক। থাকবেই কিছু-না-কিছু।
যাঁরা দোটানায় পড়ে মনঃস্থির করতে পারছেন না তাঁদের সংকট সহজে কাটবে না। সমস্যাটা বহুকাল ধরে ঘনাচ্ছে। কিন্তু আজকের মতো স্পষ্ট হয়নি। সেদিন এক চিত্রশিল্পী বলছিলেন, ‘ছবি আঁকা হচ্ছে বিস্তর। এক একখানা হাজার টাকা দামে বিকোচ্ছে। কিন্তু আর্ট হচ্ছে কি না সন্দেহ।’ কথাটা মোটামুটি সাহিত্য সম্বন্ধেও খাটে। শিল্পী তাহলে করবে কী? কী করলে আর্ট হবে?
যেখানে স্পষ্ট একটা দোটানা সেখানে ঐতিহ্যের অনুসরণ করতে বলা নিষ্ফল। কারণ ঐতিহ্য তো ‘নেতি নেতি’ বলে না। আধুনিকতাই বলে ‘নেতি নেতি’। আবার আধুনিকতার অনুসরণ করতে বলাও নিরর্থক, কারণ আধুনিকতা মাত্র সেদিনকার। যাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে বলব তাঁরা সবে পা ফেলতে শিখেছেন। তবে আমার নিজের মনের প্রবণতা ‘ইতি ইতি’মূলক। সংকটের দিন আমি ক্লাসিক পড়ি ও তারই মধ্যে দিশা পাই।
তারপর যখন পারি জনগণের দিকে তাকাই। লোকসাহিত্যের মধ্যেও নিশানা মেলে। যদিও তার অনুসরণ করা চলে না। করা চলে অনুকরণ। কিন্তু অনুকৃতি তো আর্ট নয়। লোকসাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। জনগণের সঙ্গে পা মেলানো যায়। কিন্তু তারাই প্রত্যাশা করছে পথপ্রদর্শন। আমরা কি তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব? না তারা করবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ? না আমরা তাদের মধ্যে বিলীন হয়ে যাব?