এক
আঁধার চিরে বেরিয়ে এল হাঙরটা, পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে চলেছে টিনা টার্নারকে লক্ষ্য করে।
ওটার মারাত্মক, ধারাল দাঁতগুলোর দিকে চেয়ে ছিল টিনা, শিউরে উঠে পিছিয়ে গেল দু’পা। হাঙরটা ট্যাঙ্কের কাঁচের দেয়ালে মুখ ছুঁইয়ে ছিটকে সরে যেতেই চারপাশে চোখ বোলাল টিনা, ওর ভীতিটুকু কেউ টের পায়নি তো?
ওরা সবাই এমুহূর্তে এক পাতালগুহায়। কাঁচের একমাত্র দেয়ালটির ওপাশে, প্রকাণ্ড জলাধারটির ভেতরে স্বচ্ছন্দে চক্রাকারে ঘুরছে খুনে হাঙরগুলো; গুহার অপরপাশে পেঙ্গুইনরা ব্যস্ত রূপচর্চায়, ওদিকে কুমিরের পাল জ্বলজ্বলে হলদেটে চোখ মেলে মাপছে দর্শকদের।
গুহা ছেড়ে, টিনা শশব্যস্তে কটা ধাপ ভেঙে উঠে এল ওয়েস্ট এডমনটন মল-এর মর্মর পাথরের করিডরে। অনেক উঁচুতে বসানো গম্বুজাকৃতির জানালাগুলো দিয়ে চুইয়ে পড়ছে সূর্যের আলো, দোকানপাটের পাশ দিয়ে অলসভঙ্গিতে হেঁটে চলা ক্রেতাদের শরীর গরম করছে। এই মল-এ মোট ৮২৮টি দোকান।
রোদ পড়ে চিকমিক করছে এক ইনডোর সাগরের সুনীল পানি, এক স্প্যানিশ জলযানের পাশ দিয়ে ধীর গতিতে বয়ে চলেছে কয়েকটা সাব। সাগরের পাশে, পুলে নজরকাড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছে বেশ কিছু ডলফিন। ওগুলোকে আলোকিত করছে সাবগুলো।
উঁচু এক কাঁচের দেয়ালের পেছনে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটারপার্ক’, যেখানে পাম গাছে ছাওয়া এক সৈকতে উদ্দেশ্যবিহীন হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে ছেলে-মেয়েরা, বড়-বড় ঢেউয়ের ওপর চড়ে সার্ফ করছে বাচ্চারা এবং অন্যরা লাফিয়ে পড়ছে ওয়াটারস্লাইডগুলো থেকে। এখানে সবুজ আর নীল সাপের মতন পরস্পর এঁকেবেঁকে পেঁচিয়ে রয়েছে নানা ধরনের বেশ কটি ওয়াটারস্লাইড।
কাছেই, এক দোকান দেখল টিনা। ওটার নাম লস্ অভ ফান স্টাফ। ওখানে ডিসপ্লে দেয়া হয়েছে স্টিক-অন ট্যাটুর, মালিকের ভাষায় যেগুলো ঠিক আসলের মতই।
‘এগুলো উঠে আসবে ঠিকই, কিন্তু আমার স্পেশাল, প্রিন্টেড ইন্সট্রাকশনগুলো তোমাকে মেনে চলতে হবে।’
‘বাদুড়গুলো দারুণ তো, বলল টিনা। ওদের চোখগুলো কী ভয়ঙ্কর!’
মল-এর ম্যাপ দেখে নিয়ে, টিনা সিদ্ধান্ত নিল বুরবোঁ স্ট্রিটে যাবে, অবিকল নিউ অর্লিন্সের বিখ্যাত এক পর্যটন এলাকার মত করে সাজানো ওটা। ওখানে খোয়া বাঁধানো রাস্তা আর বেঞ্চি নিয়ে ক্যাফে অর্লিন্সের মত রেস্তোরাঁ রয়েছে। মাথার ওপর মিটমিট করে আলো জ্বলে, মনে হয় যেন রাতের তারা জ্বলা আকাশ, রেস্তোরাঁর বাইরে দীপ্তি ছড়ায় নিয়ন লাইট, তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানিকিনদের দেখে নিচ দিয়ে চলাচলরত মানুষজনের মনে হয় ওগুলো জ্যান্ত বুঝি।
সুসান নামের এক মেয়ে খদ্দেরদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেকেলে জুতো পালিশের চেয়ারের এক সারিতে। টিনার মত ওর বয়সও ১৬।
‘আয়-রোজগার ভাল আর সামারে একটা কাজও করা হলো,’ হেসে উঠে বলল সুসান। ‘তবে মাঝেমধ্যে অবশ্য নোভা স্কশিয়ার জন্যে মন কেমন করে।’
‘যা-ই বল, জায়গাটা কিন্তু চমৎকার! যদিও আমারও বাসার জন্যে মন খারাপ লাগে।’
‘কতদিন থাকছ এখানে?’
‘এই তো, এই উইকএণ্ড পর্যন্তই। আমার বাবা মল-এর সিকিউরিটি গার্ডদের এক কোর্সে ট্রেনিং দিতে এসেছে। তারপরই,’ ঠোঁট ওল্টাল টিনা, ‘বাসায় ফ্লাই করব।’
‘উনি উইনিপেগ পুলিসের ইন্সপেক্টর বলেছিলে না?’
‘হ্যাঁ, বাবা…’
‘টিনা, কী যেন হয়েছে!’
‘মানে?’
‘ওই যে, শোনো!’
ছাদে লুকানো স্পিকারগুলো থেকে জরুরী কণ্ঠে কেউ ঘোষণা করছে: ‘কোড রেড, বুরবো স্ট্রিট। কোড রেড, বুরবোঁ স্ট্রিট। সুসান ঝটপট ওর ব্রাশ আর পালিশগুলো সরিয়ে ফেলল।
‘কোড রেড হচ্ছে সিকিউরিটি গার্ডদের জন্যে সর্বোচ্চ সতর্ক সঙ্কেত। বুরবো স্ট্রিটে নিশ্চয়ই কোন ধরনের সমস্যা হয়েছে।’
গদাইলশকরি চালে চলাফেরা করছে লোকজন, তাদের দিকে চাইল টিনা।
‘ওদেরকে জানাবে কে?’
‘গার্ডরা এখুনি এসে পড়বে। সবাইকে সরিয়ে দেবে এখান থেকে।’
‘কিন্তু কোড রেডের ব্যাপারটা কী? আমরা তো কিছুই জানি না! সুসানের দিকে কাছিয়ে এল টিনা। ‘আমার জানতে হবে ঘটনাটা কী। আশপাশে লুকানোর কোন জায়গা আছে?’
মুহূর্তের দ্বিধার পর, কাছের এক বুথের দিকে চাইল সুসান। রাশিচক্রের চিহ্ন আঁকা ওটায়, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তোমার অতীত- বর্তমান-ভবিষ্যৎ নির্ভুল বলে দেবে।
‘ফরচুন-টেলার আমাকে চাবি দিয়ে গেছে। তুমি ওখানে লুকোতে পার।’
‘গ্রেট!’ টিনা দেখল বুরবোঁ স্ট্রিটের প্রবেশপথ থেকে নিরাপত্তাকর্মীরা মানুষজনকে সরে যেতে বলছে। ‘জলদি, সুসান, জলদি।’ এবার নিরাপদে বুথের ভেতর থেকে আঁধার ভেদ করে বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ! কাল দেখা হবে।’
‘আশা করি।’
কাঠের দেয়াল ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে রয়েছে, এলাকা থেকে গার্ডরা জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছে শুনল টিনা। কোড রেড বেজে চলেছে তখনও, অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নামল বুরবোঁ স্ট্রিটে। ক’মিনিট পরে টিনার হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠল, যখন ওর বাবা পুলিস অফিসার জোসেফ টার্নারের আগুয়ান কণ্ঠস্বর কানে এল।
‘একটা প্যাকেজ বললেন?’
‘জি, ইন্সপেক্টর টার্নার,’ কেউ জবাব দিল। ‘স্থানীয় পুলিসকে আমরা জানিয়েছি, তবে তার আগে আপনি যদি একবার দেখতেন।’
‘রোবট ওখানে উঠতে পারে না?’
‘জি না, স্যর। প্যাকেজটা যে রেখে গেছে সে জানে ওটা রোবটের নাগালের বাইরে।’
কণ্ঠস্বরগুলো মিলিয়ে যেতেই, দেয়ালের এক ফাটলে চোখ রাখল টিনা। দেখল সড়ক বরাবর নিয়ন বাতি জ্বলছে, অল্প ক’জন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া একদম ফাঁকা এখন রাস্তাটা। বুকে দু’বাহু ভাঁজ করে, ভ্রূ কুঁচকে দূরে দাঁড়িয়ে, ওরা টিনার বাবাকে ক্যাফে অর্লিন্সের ওপরের ব্যালকনিতে পা রাখতে দেখছে।
গুড়ি মেরে, বাদামি কাগজে মোড়ানো এক প্যাকেজের দিকে সাবধানে এগোচ্ছেন জোসেফ টার্নার। টিনা নিশ্চিত ওটা বোমা।