০৭.
দীনগোপাল খাটে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। চমকে উঠে বললেন– কে ওখানে? তারপর কর্নেলকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক সেকেন্ড পরে নঃশ্বাসের সঙ্গে বললেন–আসুন।
কর্নেল বলেন–একটু বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম দীনগোপালবাবু!
ঘরে কে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দীনগোপাল একটু কেশে বললেন– কাল সন্ধ্যায় আপনি আমাকে বললেন শান্তকে ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। কথাটা পরে আমার মাথায় এসেছে। আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। ফাঁদ– হ্যাঁ, ফাঁদ ছাড়া আর কী বলব? আর ওই যে সোনার ঠাকুরের কথাটা বলছিলেন, সেটা…দীনগোপাল ঢোক গিলে আত্মসংরণ করে বললেন সেটা ঠিক। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।
-দীনগোপালবাবু, শান্তর ঘরের বালিশের তলায় কাগজে মোড়া সোনার ঠাকুরের কথা আপনাকে নব বলেছিল। তাই না?
দীনগোপাল সোজা হয়ে বসলেন। নব পুলিশকে বলে দিয়েছে? হারামজাদা নেমকহারাম!
না। কর্নেল একটু হাসলেন। আমার ধারণা। কারণ বিছানাপত্র গোছানোর কাজ নব ছাড়া আপনার বাড়িতে আর কেউ করার নেই। সে শান্তবাবুর বিছানা গোছাতে গিয়েই দেখতে পায়…
বাধা দিয়ে দীনগোপাল বললেন–হ্যাঁ। নব আমাকে বলেছিল। সেদিনই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে রাজবাড়ির ঠাকুর চুরির কথা শুনেছিলাম। খুব হইচই পড়েছিল চারদিকে। বাড়ি ফেরার পর নব আমাকে শান্তর বালিশের তলায় কী আছে বলল। গিয়ে দেখি, সর্বনাশ! আমার বাড়িতেই সেই ঠাকুর।
–তখন শান্ত ছিল না বাড়িতে?
না। আমি হতভাগাকে বাঁচানোর জন্য শুধু নয়, নিজেকে বাঁচানোর জন্যও ওটা সরিয়ে ফেলি। আমার বাড়ি পুলিশ সার্চ করতে পারে বলে মাশঙ্কা করেছিলাম। কারণ শান্ত পুলিশের খাতায় দাগী-উগ্রপন্থী! সে তখন আমার বাড়িতে এসেছে। অবস্থাটা চিন্তা করুন!
নব ছাড়া আর কাউকে কথাটা বলেছিলেন?
–প্রভাতকে বলেছিলাম। দীনগোপাল চাপাস্বরে বললেন।–ওকে ডেকে ঠিয়ে এ নিয়ে গোপনে আলোচনা করেছিলাম।
–শান্ত চলে যাওয়ার পরে?
হা। তখন প্রভাত থাকত ফিরোজাবাদে ওর এক বন্ধুর বাড়িতে। ভদ্রলোক উকিল। আমার বিষয়-সম্পত্তির মামলা-মোকর্দমার কান করেন।
কী নাম?
–অভয় মিশ্র। নামকরা উকিল।
–প্রভাতবাবু কী পরামর্শ দিয়েছিলেন?
দীনগোপাল বিরক্ত মুখে বললেন–প্রভাত একটা বদ্ধ পাগল। বলল, আমাকে দাও। রাজমন্দিরে চুপিচুপি রেখে আসি। কিন্তু আমি দিইনি ওকে।
-কেন?
দীনগোপাল অবাক হয়ে বললেন–আপনিও তাই! প্রভাত শুধু পাগল নয়, নির্বোধ! রাজমন্দিরে রাখতে গিয়ে ঠিক ধরা পড়ত। পুলিশের ধাতানিতে আমাকেও জড়াত। মুখে খালি বড় বড় বুলি! ওকে আমি চিনি না? গবেট– বুদ্ধ–হাঁদারাম! ওর জেল-পালানোর গল্প মিথ্যে। আমি বিশ্বাস করি না।
–আপনি প্রভাতবাবুকে কী বলেছিলেন?
ওর ওই কথা শুনে রাগ হয়েছিল। বলেছিলাম, থাক। যা করার আমি করব, তুমি যাও।
আপনি কী করলেন?
-বলব না। সব বলব, এই কথাটা বলব না। সে আপনি যত বড় গোয়েন্দা হোন, ও কথা আমার কাছে আদায় করতে পারবেন না।
–আমি জানি দীনগোপালবাবু, কোথায় সোনার ঠাকুর লুকিয়ে রেখেছেন।
দীনগোপাল তাকালেন। নিষ্পলক দৃষ্টি। একটু পরে বললেনবলুন।
–আমিও বলব না। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন।
–গোয়েন্দাদের চালাকি! দীনগোপাল রুষ্টভাবে বললেন।–যদি জানেন, পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন না কেন জিনিসটা?
–শান্তর খুনীকে না ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি।
দীনগোপাল রুষ্ট ভঙ্গিতে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন– বেশ দেখা যাবে।
নব আপনাকে একটা কালো কুকুরের কথা বলেছিল?
বলেছিল। ও একটা রামছাগল। সব কিছুতেই ওর সন্দেহ। দীনগোপাল পুবের জানালার দিকে ঘুরে অন্যমনস্কভাবে বললেন। আপনি আবার এর সঙ্গে একটা ‘আড়ালের লোক’ যুক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, আমি নাকি না জেনে এমন কিছু করতে তৈরি হয়েছি, যাতে তার বিপদ হবে। এই তো আপনার থিওরি?
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছি, ‘আড়ালের লোকটা নেহাত পুতুল। পুতুলনাচ দেখেছেন তো? পুতুলের আড়ালে একটা মানুষ থাকে। সেই মানুষটা বেশি সাংঘাতিক।
–হেঁয়ালি! চালিয়ে যান।
–দীনগোপালবাবু, আপনি জানেন কি যে দীপ্তেন্দুর ব্যাগ থেকে একটা বিষাক্ত ওষুধের অ্যাম্পুল আর ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ হারিয়ে গেছে? শান্তর বডিতে সেটাই ইঞ্জেক্ট করা হয়েছিল।
দীনগোপাল চমকে উঠলেন। আমাকে কেউ বলেনি! আশ্চর্য! আর দীপুটাও আহাম্মক, হাঁদারাম! বিষাক্ত ওষুধ-টুযুধ সঙ্গে নিয়ে ঘোরে! এরা–এরা সব্বাই গবেট। গাধার গাধা।
–মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে নানারকম ওষুধের স্যাম্পল থাকা স্বাভাবিক।
-কোথায় রেখেছিল দীপু?
–খোলা কিটব্যাগে।
দীনগোপাল চঞ্চল হয়ে বললেন–আমি এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। সত্যিই শান্তকে ফাঁদে ফেলে মারা হয়েছে। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমিই এজন্য দায়ী। শান্তকে সোনার ঠাকুর চুরির দায় থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত ওর মৃত্যুর উপলক্ষ হলাম। আমিও গবেট। আমারও বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল।
বলে দীনগোপাল বিছানা থেকে নামলেন। ছড়িটি হাতে নিয়ে পা বাড়ালেন।– কই? দীপু হতচ্ছাড়াকে একবার দেখি। ওভাবে বিষাক্ত ওষুধ সঙ্গে নিয়ে ঘোরে–বাউণ্ডুলে! এক বচ্ছর নিপাত্তা হয়েছিল পড়াশুনা ছেড়ে। স্রেফ একজামিনেশনের ভয়েজানেন? আমার ভাইপোদের কেউই ভাল নয়। সবগুলো বদমাশ! ছিটগ্রস্ত! অভিশপ্ত বংশ মশাই! এমন কী, নীতাও কি কম? জেনেশুনে এক বাঁদরের গলায় মালা দিয়ে এখন ভুগছে। কাল রাত্তিরে বাঁদর ওকেই খুন করতে এসেছিল আসলে।
কর্নেল আগেই বেরিয়েছিলেন বারান্দায়। শান্তর সেই ঘরের সামনে দুজন সেপাই পাহারা দিচ্ছে। কর্নেল ঝটপট একবার বাইনোকুলারে যতটা দূর দেখা যায়, দেখে নিলেন। দীনগোপাল বললেন–আপনার মশাই এই এক বাতিক! কালো কুকুর, আর…।
কথা শেষ না করে করিডরে ঢুকে চেষ্ঠালেন কই? দীপু কোথায়? কোথায় সে বুদ্বু?
কর্নেল তাঁর পিছু পিছু নেমে নিচে বসার ঘরে গেলেন। দীনগোপালের হাঁকডাক শুনে বাইরের বারান্দা থেকে প্রভাতরঞ্জন, ঝুমা ও নীতা ঘরে এল। ঘিরে ধরল তাঁকে। কর্নেল দেখলেন, কালো রঙের একটা কিটব্যাগ টেবিলে রেখে লনে গণেশ ত্রিবেদী বসে আছেন এবং তাঁর সামনে কাচুমাচু মুখে অরুণ খালি দুহাত নাড়ছে। সায়েবি ভঙ্গিতে কাঁধে ঝাঁকুনিও দিচ্ছে। দীপ্তেন্দু বারান্দার নিচেই একা দাঁড়িয়েছিল। কর্নেল নেমে গেলেন। সে দীনগোপালের ডাক শুনেছিল। পাশ কাটিয়ে বারান্দায় উঠল এবং ঘরে ঢুকল।
কর্নেল ত্রিবেদীর কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে বললেননবকে অ্যারেস্ট করবেন বলছিলেন। আর দেরি করবেন না। হ্যাঁ–এখনই সোজা লক-আপে পাঠিয়ে দিন। শুধু একটা কথা, যেন ওকে মারধর না করা হয়।
ত্রিবেদী ভুরু কুঁচকে তাকালেন এবং ফিক করে হাসলেন।–আই অ্যাম রাইট। ওকে! লালজি! ইধার আইয়ে।
এ এস আই মানিকলাল ছুটে এলেন। বলিয়ে স্যার!
–অ্যারেস্ট দ্যাট ম্যান, নব। বুঢ়াবাবুকা নোকর!
মানিকলাল দুজন কনস্টেবলসহ বাড়ির দিকে মার্চ করে গেলেন। অরুণ অবাক চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিল। বলল–তাহলে নব ব্যাটাছেলেই…মাই গড। কী সাংঘাতিক কথা!
কর্নেল বসলেন না। বললেন–অরুণ কি সোনার ঠাকুর দেখেছে মিঃ ত্রিবেদী?
অরুণ তখনই দুহাত নেড়ে বলল–নাঃ। অলরেডি আই হ্যাভ টোল্ড হিম দ্যাট! বাট হোয়াই সোনার ঠাকুর? ঠিক এটাই বুঝতে পারছি না। কর্নেল প্রত্যেককে এ কথা জিজ্ঞেস করেছেন শুনলাম। আমরা মামাবাবুর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
ত্রিবেদী কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে বললেন-আমার কাজ শেষ। আপনি ইচ্ছা করলে প্রশ্ন করতে পারেন অরুণবাবুকে।
কর্নেল বললেন–না। আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
–দেন ইউ গো! ত্রিবেদী অরুণকে ইশারা করলেন। অরুণ চলে যেতে পারলে বাঁচে, এমন ভঙ্গিতে তড়াক করে উঠে চলে গেল। তারপর ত্রিবেদী বললেন–এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কর্নেল, আমি দুঃখিত। সোনার ঠাকুরের কথা আপনি প্রথমে যাকে জিজ্ঞেস করবেন, তাকে চলে যেতে দিলে তো সে অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেই এবং তৈরি হয়েই আসবে। তখনই আমি ভেবেছিলাম আপনাকে বলব, এ পদ্ধতিটা ঠিক নয়। যাকে জেরা করা হবে, জেরা শেষ হলে তাকে তফাতে রাখতে হবে। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে বলেই কথাটা তুলিনি। ভাবছিলাম, সম্ভবত আপনার কোনও কৌশল এটা।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। কৌশল। ঠিক, ঠিক। আপনি বুদ্ধিমান।
ত্রিবেদী দেখলেন, কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে নিয়েছেন এবং পশ্চিমের অসমতল মাঠের দিকে ঘুরে রয়েছেন। ত্রিবেদী বিরক্ত হয়ে বললেন–কৌশলটা বুঝিয়ে দিলে আমার সুবিধে হতো।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–হঠাৎ সোনার ঠাকুরের কথা তুলে আমি কার কী প্রতিক্রিয়া, সেটা যাচাই করতে চাইনি মিঃ ত্রিবেদী। আসলে আমি ওদের জানাতে চেয়েছিলাম, সোনার ঠাকুরের ব্যাপারটা আমি বা আপনি, মানে পুলিশ জানে। অর্থাৎ শান্তর খুনের সঙ্গে একটা সোনার ঠাকুর জড়িত, সেটা আমরা জানি।
–কিন্তু তা ওদের জানিয়ে দেওয়া মানে তো সতর্ক করে দেওয়া!
–হ্যাঁ, সতর্ক করে দেওয়া। ঠিক বলেছেন।
ত্রিবেদী হতাশ ভঙ্গিতে বললেন–মাথায় ঢুকছে না। আপনি বড্ড হেঁয়ালি করেন, কর্নেল!
কর্নেল হাসলেন।–হেঁয়ালি কিসের? ওদের পরোক্ষে সতর্ক করে দিয়েছি, সোনার ঠাকুরের দিকে আর এক পা বাড়ালে বিপদ ঘটবে এবং পুলিশ সব জেনে গেছে।
বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। পৌনে দুটো! মাই গুডনেস! আজ আমার স্নান করার দিন! চলি মিঃ ত্রিবেদী!
ত্রিবেদী অবাক এবং গুম হয়ে বসে রইলেন। মানিকলাল নবকে পাকড়াও করে নিয়ে আসছিলেন! পেছনে ক্রুদ্ধ দীনগোপাল তাড়া করে আসছেন। কড়া ধমকের জন্য তৈরি হলেন ত্রিবেদী।…
.
স্নানাহারের পর রোদে বসে কিছুক্ষণ চুরুট টেনে কর্নেল জলাধারে পাখি দেখায় মন দিয়েছিলেন। এ বেলা আর বেরুনোর ইচ্ছে ছিল না। সেই কেরানি পাখি বা সেক্রেটারি বার্ডটি জলটুঙ্গি থেকে উধাও হয়ে গেছে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হলেন।
সবে ঘরে ঢুকেছেন, আলোও জ্বেলে দিয়েছে রামলাল, এমন সময় জিপ এল। পুলিশের। পাণ্ডের সাড়া পাওয়া গেল। কর্নেল বললেন–আসুন মিঃ পাণ্ডে!
পাণ্ডের জিপে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবলও এসেছে। রামলালের চেনা লোক। রামলাল তাদের সঙ্গে গল্প করতে গেল।
পাণ্ডে ঘরে ঢুকে বললেন–প্রসূন মজুমদার গভীর জলের মাছ। স্যুটকেসের ভেতর জাকাকাপড় ছাড়া নাকি আর কিছুই ছিল না। কালো কুকুর ওর স্যুটকেস নিয়ে পালিয়েছে শুনে খুব হাসতে লাগল। কিন্তু কী অদ্ভুত কথাবার্তা শুনুন! বলে কী, ডাকু মঙ্গল সিংয়ের প্রেতাত্মা ওর স্যুটকেসটা হাতিয়েছে।
কুকুরটা সম্পর্কে কী বলেছে প্রসূন?
কুকুরটাও প্রেতাত্মা! পাণ্ডে হাসবার চেষ্টা করলেন। আসল কথা বের করা যেত। সমস্যা হলো, ওর জামাইবাবু সত্যিই সি আই ডি ইন্সপেক্টর অমর চৌধুরী তিনটের ট্রেনে পৌঁছেছেন।
–অর্থাৎ এ প্রসূন সত্যিই তার শ্যালক?
–সেটাই সমস্যা। শ্যালককে খুব বকাবকি করলেন অবশ্য। নেহাত একটা ট্রেসপাসের পেটি কেস। কী আর করা যাবে? পাণ্ডে গম্ভীর হয়ে গেলেন হঠাৎ। শ্যালককে নিয়ে মিঃ চৌধুরী আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। আপনার সঙ্গে নাকি ওঁর খুব চেনাজানা আছে।
–আছে। বলে কর্নেল ডাকলেন, রামলাল!
বাইরে থেকে সাড়া এল–আভি আতা হ্যায় স্যার!
–দো পেয়ালা কফি, রামলাল!
বলে কর্নেল পাণ্ডের দিকে ঘুরলেন। পাণ্ডে বললেন–এদিকে কেসের অ্যাঙ্গল ঘুরে গেছে। দীনগোপালবাবুর চাকর নবকে ও সি সায়েব অ্যারেস্ট করে লক-আপে ঢুকিয়েছেন।
জানি।
পাণ্ডে একটু হাসলেন। কিন্তু এটা কি জানেন, সে নিজেই আগেভাগে কবুল করেছে একটা ডোরাকাটা মাফলার গতকাল জৈন ব্রাদার্সের দোকান থেকে কিনে বসার ঘরের সোফার তলায় লুকিয়ে রেখেছিল?
কর্নেল নড়ে বসলেন।–হুঁ! তাই বলেছে নব? কিন্তু কেন এমন করল বলেনি?
বলেছে, মামাবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিল।
–প্রভাতবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিল? কর্নেল কথাটার পুনরাবৃত্তি করে চোখ বুজলেন। একটু পরেই চোখ খুলে ফের বললেন বাঁচাতে যদি চাইবে, তাহলে কেন নিজে আগেভাবে কথাটা কবুল করল নব? হুঁ বুঝেছি!
পাণ্ডে তীক্ষ্মদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন কী?
–তার মনিব দীনগোপালবাবুর হুকুমেই কাজটা সে করেছিল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তিনিই প্রভাতবাবুকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন পুলিশের সন্দেহ থেকে। কারণ শান্তর গলায় লটকানো মাফলারটা প্রভাতবাবুরই। আর, এটা উনি আগাগোড়া জানতেন বলেও মনে হচ্ছে। তবে প্রথম প্রভাতবাবুর মাফলারের ব্যাপারটা নীতারই নাকি চোখে পড়ে। যাই হোক, নব নিজেই কথাটা জানিয়ে দিয়েছে। কখন? না তাকে প্রেফতারের পর। এই পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ মিঃ পাণ্ডে।
পাণ্ডে পুলিশ-টুপি খুলে টেবিলে রেখে সহাস্যে বললেন–মগজ ঘেমে যাচ্ছে ক্রমশ। একটু হিম খাইয়ে নিই। …হা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ও সি সায়েবকে বলব’খন।
দীনগোপালবাবুর বাড়িতে পাহারা কি তুলে নিয়েছে আপনারা?
না। আপনাদের মিঃ চৌধুরী এবার তদন্তে নামবেন। ওঁর অনুরোধ নাকচ করেননি ও সি সায়েব। পাণ্ডে হাসলেন।–ওসব যা হবার হোক। আমার শুধু একটা চিন্তা–দ্যাট ব্লাডি ব্ল্যাক ডগ। কালা কুত্তা! আমার কাজ আমি চালিয়ে যাব। কুকুরটা প্রেতাত্মা তোক, আর যাই হোক, আমি তাকে খতম করবই।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–সব কি কিছু আশঙ্কা করেছে? পাণ্ডে দ্রুত বললেন–কিসের?
–ওর মনিবের কোনও ক্ষতির!
–কে ক্ষতি করবে?
প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে কর্নেল ফের অন্যমনস্কভাবে বললেন–ক্ষতি হওয়ার চান্স ছিল নবর। তাই নবকে নিরাপদে রাখার জন্যই থানার লক-আপে ঢোকাতে পরামর্শ দিয়েছি আমি। নব কিছু জানে, যা বলেনি আমাদের। নিশ্চয় জানে নব। সে রাতে সে ভোর অব্দি জেগে ছিল। কিছু দেখে থাকবে। কিন্তু বলতে চায়নি।
রামলাল কফি নিয়ে ঢুকলে কর্নেল চুপ করলেন। কপির পেয়ালা রেখে সে চলে গেলে কর্নেল আগের মতো আপন মনে বললেন–মঙ্গল সিং ডাকুর ছবি থানায় আছে। কাল গিয়ে দেখব’খন। আমার মনে হচ্ছে, প্রসূন কিছু হিন্ট দিয়েছে।
পাণ্ডে কফিতে চুমুক দিয়ে সকৌতুকে বললেন–মংলা ডাকু ওই ড্যামের জলে ভেসে গেছে। তার প্রেতাত্মা দর্শন করেননি তো? ড্যামের ধারেই এই বাংলো! রামলাল কী বলে?
কর্নেল চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন। কফি শেষ হলে চুরুট ধরালেন। পাণ্ডে উঠে বললেন–চলি কর্নেল! আসা করি, সকালেই খবর পাবেন কালো কুকুর খতম এবং তার মনিব প্রেফতার হয়েছে।
–আপনি কি কুকুর খতম অভিযানে বেরিয়েছেন?
–দ্যাটস রাইট। বলে পাণ্ডে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন।
জিপের শব্দ মিলিয়ে গেলে কর্নেল বারান্দায় বেরুলেন। পাণ্ডের গাড়ি পশ্চিমে চলেছে। ওই তল্লাটে নৈশ অভিযানে যাচ্ছেন ভগবানদাস পাণ্ডে। জেদী অফিসার বটে!…
.
অমর চৌধুরী এবং প্রসূনকে থানার গাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল, তখন রাত প্রায় ন’টা। অমরবাবু বললেন–যেমন আমার গিন্নি, তেমনি তার এই সহোদরটি! সবচেয়ে আশ্চর্য, আমার গিন্নির পেটে পেটে এত দুষ্টুমি ছিল! নীতাকে সোজা আপনার কাছে পাঠিয়ে দিল? এখানে না আসা অব্দি জানতামই না সে-কথা।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–কেয়াদেবীর স্বামী সত্যিকার গোয়েন্দা। আর আমি নেহাতই নকল! আপনাদের মহলে বলে বটে আমাকে বুড়ো ঘুঘু–কিন্তু আমি নিজেই ঘুঘুর সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। সরডিহির লাল ঘুঘুর কথা সারা পৃথিবীর ওরনিথোলজিস্ট্রা জানেন। আমিই জানতাম না। কাজেই কেয়াদেবী আমার উপকার করেছেন। ঘুঘু দেখেছি!
–ফাঁদও দেখলেন। অমরবাবু জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে সিগারেট পেপার আর তামাকের প্যাকেট বের করলেন। হাতের চেটোয় সিগারেট তৈরি করতে করতে ফের বললেন–অ্যাই পুঁটে! তোর ঘরের অবস্থা দ্যাখ গিয়ে আগে। আর চৌকিদারকে বল্, একটা এক্সট্রা বেড ম্যানেজ করতে পারে নাকি।
প্রসূন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। আস্তে বলল–ওটা ডাবল-বেড রুম।
অমরবাবু জোরাল হেসে বললেন–তুইও ফাঁদ পেতে রেখেছিলি? পাখি পড়েনি! পড়বে রে পড়বে! কী বুঝলেন কর্নেল?
কর্নেলও হাসলেন।–পড়ার চান্স ছিল।
–অফ কোর্স! উড়ো পাখি তো নয়, খাঁচা থেকে পালানো পাখি!
প্রসূন রামলালের সঙ্গে কথা বলতে গেল। রামলাল অবাক হয়ে তাকে দেখছিল। একটু পরে প্রসূনের ঘরের তালা খোলার শব্দ শোনা গেল। অমরবাবু বললেন–আমি কাল বিকেলের ট্রেনে কেটে পড়ব। আশা করি, তার আগেই আপনি শান্তর খুনীকে খুঁজে বের করতে পারবেন। সত্যি বলতে কি, সেটা স্বচক্ষে দেখার জন্যই ছুতোনাতা করে থেকে গেলাম। কী? পারবেন না?
কর্নেল একটু পরে আস্তে বললেন–পেরেছি।
অমরবাবু চমকে উঠে তাকালেন।–খুঁজে বের করতে পেরেছেন? কিন্তু তাহলে দেরি করছেন কেন? আরও কোনো বিপদ ঘটতেও তো পারে।
–সোনার ঠাকুরের এপিসোডটি আশা করি শুনেছেন।
অমরবাবু বললেন–শুনেছি। তাহলে আপনি এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন মনে হচ্ছে!
কর্নেল হাসলেন।–সেটাই ইচ্ছা। কারণ শান্তর হত্যাকাণ্ড আর সোনার ঠাকুর একসূত্রে বাঁধা।
প্রসূন এল। মুখটা গম্ভীর। একটু তফাতে বসে হাই তুলে বলল–আমি ড্যাম টায়ার্ড। ঘুমও পাচ্ছে। কিন্তু একা ঘরে বড্ড গা ছমছম করছে।
কর্নেল বললেন–মঙ্গল সিংয়ের প্রেতাত্মার ভয়ে?
প্রসূন হাসবার চেষ্টা করল।-মংলা ডাকু অপঘাতে মরেছিল শুনেছি।
–প্রসূন। তুমি ভালই জানো যে মঙ্গল সিং মরেনি।
প্রসূন তার দিকে তাকাল। অমরবাবু চমকে উঠেছিলেন! রুষ্টভাবে বললেন– ওর পেট থেকে কথা বের করা কঠিন। আপনিই হয়তো পারবেন।
–পারব। কারণ অন্যের হাতের তাস দেখার কৌশল আমি জানি।
প্রসূন একটু হাসল। ক্লান্তির ছাপ হাসিতে। বলল, বলুন আমার হাতে আর কী তাস আছে?
অমরবাবু বাঁকা মুখে বললেন–একটা আমিও বলতে পারি। ডায়ামন্ড কুইন। রুইতনের বিবি। ইডিয়ট কোথাকার!
কর্নেল বললেন–প্রসূন! মঙ্গল সিং ধোলাইয়ের চোটে লক-আপে আধমরা হয়ে যায়। ওর শক্ত প্রাণ। ড্যামে পুলিশ তাকে ফেলে দিয়েছিল মড়া ভেবে। কিন্তু যেভাবেই হোক, বেঁচে ওঠে। তোমার এবং শান্তর সঙ্গে পরে যোগাযোগ করে। ঠিক বলছি?
প্রসূন গম্ভীর মুখে বলল–আপনি কী করে জানলেন?
কয়েকটি তথ্য জোড়া দিয়ে এ সিদ্ধান্তে এসেছি। শান্তর খুন হওয়ার খবর আমার মুখে শুনেই তুমি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেলে। এতে বোঝা যায়, শান্তর সঙ্গে তোমার কোনও গোপন প্ল্যান ছিল। এমন সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাবে, তুমি ভাবতেই পারোনি। শান্ত তোমার বন্ধু ছিল। কিন্তু তার খুন হওয়া শুনে চুপিচুপি দীনগোপালবাবুর বাড়ি ঢুকতে গেলে! এবং ওইভাবে তোমার হঠাৎ এ-বাংলো থেকে ছুটে যাওয়া…প্রসূন! এটা কিছুতেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
অমরবাবুও জোর দিয়ে বললেন–কখনই নয়। বিশেষ করে নীতার সঙ্গে যখন ডিভোর্সের মামলা ঝুলে আছে, তখন রাত্রে ওদের বাড়ি যাওয়া এবং চুপিচুপি! মাথার ঠিক ছিল না বলেছিস। ওটা বাজে কথা। শান্ত তোর বন্ধু ছিল। সে খুন হয়েছে। বেশ তো! দিনে যেতে পারতিস, যদিও সে-যাওয়াতে রিস্ক ছিল।
কর্নেল বললেন–তোমার উদ্দেশ্য যাই থাক, শান্তর সঙ্গে তোমার গোপন প্ল্যান ছিল। সেই প্ল্যানের সঙ্গে মঙ্গল সিংও জড়িত ছিল। মঙ্গল সিং তার কালো অ্যালসেশিয়ানের সাহায্যে তোমার স্যুটকেসটি হাতিয়েছে। এতে বোঝা যায়, তোমার আগের নির্দেশ ছিল, যদি তোমারও কোনও বিপদ ঘটে, তোমার স্যুটকেসটা সে যেভাবে পারে, সরিয়ে ফেলে।
প্রসূন বলল-রাতেই সরাতে পারত।
–দুটি কারণে সেটা হয়নি। প্রথমত, সে তোমার ধরা পড়ার খবর রাতে পায়নি। কারণ আমার ভয়ে সে রাতে এ-তল্লাটে পা বাড়াতে সাহস পায়নি। দ্বিতীয়ত, তোমার ধরা পড়ার খবর সকালের দিকে সে পেয়ে থাকবে। তারপর সে গোপনে এসে এ বাংলোর নিচের দিকে ঝোঁপঝাড়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু রামলালের চোখ এড়িয়ে বাংলোয় ঢোকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। হ্যাঁ– মঙ্গল সিংয়ের সঙ্গে আমার একটা ছোটখাটো এনকাউন্টার ঘটেছিল। সেটা বলা দরকার। কেন সে আমাকে ভয় পেয়েছে, বলি।
কর্নেল সেদিন বিকেলের ঘটনাটি সংক্ষেপে বলে তার বিছানার তলা থেকে ভারী ছোরাটি বের করে আনলেন। অমরবাবু সেটি পরীক্ষা করে দেখে বললেন–সর্বনাশ! তাহলে খুব জোর বেঁচে গেছেন আপনি। পুটু, তুই গোখরো সাপের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিলি, বুঝতে পারছিস! তোকে…তোকে জেলে আটকে রাখাই দরকার।
প্রসূন গুম হয়ে রইল। কর্নেল বললেন–তোমার স্যুটকেসে এমন একটা চিঠির জবাব সেটা।
অমরবাবু ধমক দিলেন।–খুলে না বললে থাপ্পড় খাবি বলে দিচ্ছি।
শান্ত নীতার সঙ্গে আমার মিটমাট করিয়ে দিতে চেয়েছিল–একটা শর্তে।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন–তুমি তাকে সোনার ঠাকুরের খোঁজ দেবে লিখেছিলে।
প্রসূন অবাক চোখে তাকাল। অমরবাবু প্রসূনকে দেখে নিয়ে বললেন–মাই গুডনেস!
কর্নেল বললেন–দুবছর আগে এখানে হনিমুনে এসেছিলে তোমরা। এক বিকেলে বাইরে থেকে ফিরে দোতলায় দীনগোপালের ঘরের দরজায় নীতার চোখে পড়ে, তার জ্যাঠামশাইয়ের হাতে একটা সোনার ঠাকুর। উনি তখনই লুকিয়ে ফেলেন। নীতার ধারণা, তুমি পেছনে থাকায় ওটা দেখতে পাওনি। কিন্তু তুমিও দেখতে পেয়েছিলে!
প্রসূন মুখ নামিয়ে বলল—হু!
-তুমি তারপর নজর রেখেছিলেন, দীনগোপাল ওটা কী করেন। এমন কী, ওঁর ঘর থেকে ওটা হাতানোর চেষ্টা করাও সম্ভব তোমার পক্ষে। কারণ তুমি জানতে, ওটা কোন সোনার ঠাকুর এবং শান্তকে ওটার জন্যই লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে!
প্রসূন চুপ করে রইল। অমরবাবু আবার একটা সিগারেট তৈরিতে মন দিলেন।
কর্নেল বললেন–আমি দৈবজ্ঞ নই। কিছু তথ্য জোড়াতালি দিয়েছি। উপমা দিয়ে বলতে হলে বলব, জোড়াতালি দিয়েছি যে আঠার সাহায্যে, তাকে বলে ‘অনুমান’। ন্যায়শাস্ত্রে অনুমান একটা গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। যাই হোক, তুমি ওঁত পেতে থেকে আবিষ্কার করেছিলেন সোনার ঠাকুর কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন দীনগোপাল। কিন্তু একজ্যাক্ট স্পটটি তুমি জানতে পারোনি। শুধু এরিয়াটা জানতে পেরেছিলে! এখনও জানো। নীতার সঙ্গে মিটমাট করাতে পারলে শান্তকে তার হদিস দেবে, এমন আভাস ছিল তোমার চিঠিতে।
প্রসূন মাথা দোলাল। বলল–তারপর সম্প্রতি শান্ত আমার সঙ্গে দেখা করেছিল।
–হ্যাঁ, রীতিমতো একটা আবিষ্কার-অভিযানের প্রয়োজন ছিল। ওটা প্রথমত, কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত্ব, এমন আর একজনের সাহায্যের দরকার ছিল, যে সেই এলাকার নাড়ী নক্ষত্র চেনে। কিন্তু এক্ষত্রে অন্য কাউকে দলে টানার প্রচণ্ড ঝুঁকি ছিল। অতএব মঙ্গল সিং এই ছকে চমৎকার ফিট করে যাচ্ছে। সে বিশেষ করে সোনার ঠাকুর চুরি বা ডাকাতির সঙ্গে পরোক্ষ জড়িত ছিল। কারণ সে পুলিশকে বলেছিল, ঠাকুর চুরি হবে সে জানত। পরিকল্পিত অভিযানে তার উৎসাহ বেশি হওয়ারই কথা।
প্রসূন একটা কেশে নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল–আপনি ঠিক বলছেন। কিন্তু শান্ত…
কথা কেড়ে কর্নেল বললেন-তার আগের প্রশ্ন, তুমি শান্তর হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েই ওবাড়ি দৌড়ে গেলে কেন? কেন চুপিচুপি হানা দিতে চেষ্টা করলে?
শান্তর কাছে…
–আমি বলছি। শান্তর কাছে তোমার সেই চিঠিটা ছিল। তাই কি?
–হ্যাঁ।
–শান্তর খুন হওয়ার খবর শুনেই তুমি চিঠিটা উদ্ধার করতে গেলে এবং বোকার মতো ধরা পড়লে।
-মাথার ঠিক ছিল না।
অমরবাবু ভেংচি কেটে বললেন–মাথার ঠিক ছিল না! পুলিশকে এ কথাটাই বলেছে, জানেন তো কর্নেল? একের নম্বর বোকা!
কর্নেল বললেন–প্ল্যানিং মতো ডাকু মঙ্গল সিং দীনগোপালকে আনাচে কানাচে থেকে ভয় দেখাতে শুরু করে। কী প্রসূন?
প্রসূন বলল–ওটা একটা নেহাত চেষ্টা যদি একজ্যাক্ট স্পট লোকেট করা সম্ভব হয়। মানে জ্যাঠামশাই ভয় পেয়ে মূর্তিটা অন্য কোথাও লুকিয়ে ফেলতে পারেন ভেবেছিলাম। মঙ্গল সিং ওঁকে ফলো করে বেড়াচ্ছিল সেজন্য। কিন্তু ভদ্রলোক শক্ত মানুষ। তাছাড়া তিনি জানেন, তাকে মেরে ফেললে আর জিনিসটা উদ্ধার করাই যাবে না।
–ঠিক। আমিও দীনগোপালবাবুকে সামনাসামনি এ কথা বলেছি। অমরবাবু বললেন-কিন্তু বাসস্টপের লোকটা কে? পুটু বলছে, সে নয় এবং এটা তার কাছে রহস্যময় মনে হয়েছে। কীরে? বল্ কথাটা!
প্রসূন আস্তে বলল–সত্যিই জানি না কে সে। শুধু একটা খটকা লাগছে, সে যেই হোক, আমাদের তিনজনের প্ল্যানিংয়ের কথা জানতে পেরেই কি এভাবে ফাঁদ পেতেছিল?
কর্নেল বললেন কারেক্ট। তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছ। ফাঁদ।
অমরবাবু বললেন–ফঁদ মানেটা কী?
শান্তকে খুনের মোটিভ এবার খুব স্পষ্ট ধরা পড়ছে বলেই ফাঁদটাও সাব্যস্ত হচ্ছে।
–কী মোটিভ?
–আপনি পুলিশ ডিটেকটিভ। আপনি ভাল জানেন, সব ডেলিবারেট মার্ডারে দুটো মোটিভ থাকে। পার্সোনাল গেইন আর প্রতিহিংসা। এখানে পার্সোনাল গেইন একটা ফ্যাক্টর। খুনী যেভাবে হোক জানতে পেরেছিল–প্রসূন ঠিকই বলেছে। সে জেনেছিল সোনার ঠাকুর সংক্রান্ত কিছু গোপন তথ্য শান্তর কাছে আছে। সেটা প্রসূনের চিঠিটাই বটে। ওটা হাতাতে সে শান্তকে খুন করেছে। ভেবেছে, ওতে নিশ্চয় একজ্যাক্ট স্পট মানে ঠাকুর কোথায় লুকানো আছে, সেটা জানা যাবে।
প্রসূন বলল–তাহলে সে ঠকেছে।
হ্যাঁ, ঠকেছে তো বটেই। কর্নেল বললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শান্ত বেঁচে নেই। তাই জানা যাচ্ছে না, কীভাবে চিঠিটা বা প্ল্যানিংয়ের কথা সে জানতে পারল। শান্ত কি তারও সাহায্য চেয়েছিল?
প্রসূন বলল–কথাটা আমিও ভেবেছি। শান্ত আরও কাউকে দলে নিতে গিয়েই বিপদ বাধিয়েছে।
–শান্ত বিয়ে করেছিল সম্প্রতি?
–বিয়ে? প্রসূন একটু হাসল। নাঃ, ওটা ওর জোক। মাঝে মাঝে বিয়ে করেছে বলে জোক করত।
-তোমার সঙ্গে কি শান্তর কখনও বিবাদ হয়েছিল?
–কে বলল?
হয়েছিল কি না?
–হ্যাঁ। সেজন্যই চিঠি লিখেছিলাম। নইলে ত মুখোমুখি..বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন কী নিয়ে বিবাদ?
রাজনৈতিক বিবাদ। নেহাত মতাদর্শগত ব্যাপার। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
ঝুমা বলেছে।
ঝুমার সঙ্গে শান্তর একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শান্ত বিয়েতে রাজি হয়নি। পরে ঝুমা অরুণকে বিয়ে করে। শান্তর ওপর ঝাল ঝাড়তেই শান্তর এক জ্যাঠতুতো ভাইকে ধরে ঝুলে পড়েছিল। আমি ওকে পছন্দ করি না।
–কিন্তু নীতা বলেছে শান্তর সঙ্গে তোমার কোনও বিবাদ ছিল না।
প্রসূন হাই তুলে বললনীতার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে তার অনেক পরে। কাজে সে জানে না।
কর্নেল চুরুট বের করে বললেন–বাসস্টপের লোকটা…
–আমি নই। প্রসূন ঝটপট বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল।–ক্ষমা করবেন কর্নেল! ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরায় জেরবার হয়ে এসে আবার আপনার জেরা। আমার ঘুম পাচ্ছে।
বলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমরবাবু আস্তে বললেন–গোঁয়ার! ওকে বাগ মানানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর পেটে-পেটে বুদ্ধি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুটু জানে শান্তকে কে খুন করেছে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন–আপনারা আশা করি ডিনার খেয়ে এসেছেন?
-হ্যাঁ। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। প্রায় দশটা! আপনি খাওয়া সেরে নিন। রামলাল অপেক্ষা করছিল। কর্নেলের কথায় টেবিলে রাতের খাদ্য এনে রাখল। কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানছিলেন। চোখ বন্ধ। অমরবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন–তাহলে আমি উঠি কর্নেল!
কর্নেল চোখ খুলে একটু হেসে বললেন–অন্যের সামনে অনেকে আহার করা পছন্দ করেন না। আমি সে-দলে নই। যাই হোক, আপনি আপনার শ্যালকের কান বাঁচিয়ে কিছু বলতে চান, সেটা বুঝতে পেরেছি। এবার স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।
আমরবাবু চাপাস্বরে বললেন–আমার মনে হচ্ছে, আজ রাত্রে আবার একটা বিভ্রাট বাধাবে পুটু। আমি একটু ঘুমকাতুরে মানুষ। আমার ভয় হচ্ছে, কখন চুপিচুপি বেরিয়ে গিয়ে ফের ওবাড়ি ঢোকার চেষ্টা না করে। কর্নেল, আমার শ্যালকটিকে মোটেও নিরীহ ভাববেন না। ওর অসাধ্য কিছু নেই। আপনি প্লিজ একটা কাজ করবেন। আপনার দরজার তালাটা আমাদের ঘরের দরজায় চুপি চুপি আটকে দেবেন।
কর্নেল চুরুট ঘষটে নিভিয়ে বললেন–আপনি না বললেও তাই করতাম।
আমরবাবু কী বলতে যাচ্ছেন, হঠাৎ বারান্দায় প্রসূনের গলা শোনা গেল। বাঃ! জিও মঙ্গল সিং! বহুত আচ্ছা কাম কিয়া তুমনে!
আমরবাবু দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। তারপর গেলেন কর্নেল। বারান্দায় একটা স্যুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রসূন। উজ্জ্বল মুখে বলল-দরজার কাছে রেখে গেছে কাল্লু। কাল্লুকে এক কেজি মাংস খাওয়াব। আর তার মনিব-মাই গুড ফ্রেন্ড মঙ্গল সিংকে বখশিস দেব এক বোতল রঙ্গিয়া। রঙ্গিয়া কী জানেন কর্নেল? সরডিহি এরিয়ার দ্যা বেস্ট মহুয়া। দ্যা কুইন অফ দ্যা মহুয়াজ!.