০৬.
প্রভাতরঞ্জনের পরনে এখন পাঞ্জাবি, পাজামা, জহর কোট এবং আলতোভাবে একটা পুরু আলোয়ান জড়ানো গায়ে। দু’হাতে পশমি দস্তানা, পায়ে পশমি মোজা ও পামসু। মুখে বিষণ্ণ গাম্ভীর্য। নমস্কার করে বসলেন। নব ইতিমধ্যে আর একটা চেয়ার এনে দিয়েছিল পুলিশের হুকুমে। একটু তফাতে দাঁড়িয়েও ছিল সে। ত্রিবেদীর ধমকে কেটে পড়ল। প্রভাতরঞ্জন হাসবার চেষ্টা করে বললেন–দীনুদার এই লোকটা একটু নাক-গলানে স্বভাবের। দেখলে বোঝা যায় না কিছু, কিন্তু বেজায় চালাক। এতক্ষণ তো জেরা করলেন ওকে। কিছু বের করতে পারলেন পেট থেকে? পারবেন না। আমি ওকে হাড়েহাড়ে চিনি।
ত্রিবেদী একটু হেসে বললেন–আপনার নামের সঙ্গে আমি পরিচিত। চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হলো এতদিনে। আপনার নামে ফিরোজাবাদ এলাকায় বিস্তর গল্প চালু আছে।
–থাকা উচিত। প্রভাতরঞ্জন ঈষৎ গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন। আমি জেলের পাঁচিল টপকে পালিয়েছিলাম। আপনারা ধরতে পারেননি। শেষে নিজেই ধরা দিয়েছিলাম। আমার পার্টি ক্ষমতায় এলে ছাড়াও পেয়েছিলাম। তবে মশাই, সত্যি বলছি–আর রাজনীতি ব্যাপারটা শিক্ষিত এবং আদর্শবাদীর জন্য নয়। এখন রাজনীতি হলো মতলববাজ আর রাজ্যের মস্তানদের আখড়া। কাজেই ইস্তফা দিয়ে দূরে সরে এসেছি। এ বয়সে নোংরা ঘাঁটতে পারব না।
প্রভাতরঞ্জনের মুখভাব বদলে বিকৃত হয়ে গেল। ত্রিবেদী বললেন–আপনি তো নীতাদেবীর মামা?
–হ্যাঁ। নীতার বাবা জয়গোপাল আমার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী ছিল। আমার বোনও রাজনীতি করত। আমিই ওদের পার্টি ম্যারেজের ব্যবস্থা করেছিলাম। ঘটকালিই বলতে পারেন।
–আপনার ঠিকানাটা, প্লিজ?
–লিখে নিন : ভিলেজ অ্যান্ড পোস্ট অফিস ইন্ডিয়া! ইন্ডিয়া কেন, পৃথিবীই লিখুন!
প্রভাতরঞ্জনের মুখে কৌতুকের ছাপ। ত্রিবেদী ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন। বললেন–তামাশা করার জন্য আমি আসিনি প্রভাতবাবু! অফিসিয়্যালি এসেছি। তাছাড়া এটা পোলিশ ইনভেস্টিগেশন।
প্রভাতরঞ্জন একটুও না দমে গিয়ে বললেন–যা সত্যি তাই বলছি। আমার কোনও বিশেষ ঠিকানা নেই। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে। সেই যে পদ্যে আছে : সব ঠায়ে মোর ঘর আছে…
–আপনি নিজেকে ভবঘুরে বলছেন?
–ঠিক টার্মটি হলো যাযাবর।
ত্রিবেদী বিরক্ত হয়ে ঝললেন–আপনার জানা উচিত, ভবঘুরে বিষয়ে একটা আইন আছে।
–অবশ্যই জানি। গ্রেফতার করুন সেই আইনে। তারপর আপনাদের স্টেটের হোম দফতর, মানে পুলিশ যার অধীনে তার মিনিস্টার খবর পাবেন। তিনি আমার সঙ্গে একসময় ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। তারপর….
ত্রিবেদী সঙ্গে সঙ্গে নেতিয়ে গিয়েছিলেন। কর্নেল দ্রুত বললেন–প্রভাতবাবু, আপাতত সরডিহি এসেছেন তো কলকাতা থেকেই?
–পথে আসুন। প্রভাতরঞ্জন অমায়িক হাসলেন। হ্যাঁ, কলকাতা থেকেই। সে-ঠিকানা অবশ্য দিতে পারি। লিখুন : কেয়ার অফ অনন্তকুমার হাটি, অ্যাডভোকেট এবং প্রাক্তন এম এল এ। ১২২/২ সি হরিনাথ আঢ্যি লেন, কলকাতা-৭৯। এখানে তেরাত্তির ছিলাম। তার আগেরটা বলি, লিখে নিন।
–থাক। আচ্ছা প্রভাতবাবু, আপনার বয়স কত হলো?
বাষট্টি বছর তিন মাস বারো দিন।
–আপনি সমস্ত ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার!
–অন্তত চেষ্টা করি পার্টিকুলার থাকতে।
–আপনার সবদিকে দৃষ্টি প্রখর। কারণ গতরাতে আপনিই প্রসূনকে বেড়া গলিয়ে ঢুকতে দেখেছিলেন।
–হুউ। প্রভাতরঞ্জন সগর্বে বললেন। আমি কড়া নজর রেখেছিলাম। অন্ধকারেও আমি দেখতে পাই।
–কিন্তু কাল দিনের বেলাতেই কালো কুকুরটা আপনি দেখতে পাননি।
প্রভাতরঞ্জন তাচ্ছিল্য করে বললেন–আপনি ডিটেকটিভ। আপনার প্রশ্নের লক্ষ্য কী জানি না। তবে কুকুর ইজ কুকুর–স্বাভাবিক প্রাণী। সবখানেই ঘোরে। সন্দেহজনক কিছু গণ্য হলে তবে তো সেদিকে মানুষের চোখ পড়ে।
কর্নেল একটু হাসলেন।–বাসস্টপের লোকটাকেও চিনতে পারেননি!
প্রভাতরঞ্জন নড়ে বসলেন!–তখন পারিনি। এখন পারছি। শয়তান প্রসূনই ছদ্মবেশে…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–তার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে? এভাবে আপনাদের সরডিহিতে জড়ো করবে কেন?
–দীনুদা আমাদের সকলেরই প্রিয়জন। কাজেই ও জানে, দীনুদার বিপদের কথা বললে আমরা সবাই এখানে এসে জড়ো হবো। প্রভাতরঞ্জন জোর গলায় বললেন।–শান্তর সঙ্গে ওর শত্রুতা ছিল। ও শান্তকে খতম করতে চেয়েছিল আসলে। এখানে খতম করলে আমাদেরই কারও না কারও ঘাড়ে দায়টা পড়বে। দীপ্তেন্দুর মাথায় এটা এসেছে। একটু আগে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ও ঠিক ধরেছে। দীনুদার ভাইপোদের ঘাড়ে দায় পড়তই।
-কেন?
–দীনুদার সম্পত্তি।
–সোনার ঠাকুর?
মুহূর্তে প্রভাতরঞ্জনের উত্তেজনা নিভে গেল।–সোনার ঠাকুর! কথাটা ঠাণ্ডা হিম হয়ে বেরিয়ে এল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ফের বললেন সোনার ঠাকুরটা কী?
–আপনি কখনও সোনার ঠাকুর দেখেননি প্রভাতবাবু?
দীনুদা নাস্তিক। এ বাড়িতে ঠাকুরই নেই তো সোনার ঠাকুর! কর্নেল প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করলেন–আপনি কখনও সোনার ঠাকুর দেখেননি?
এবার প্রভাতরঞ্জন একটু হাসলেন।–কোনও ক্লু পেয়েছেন বুঝি? ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো? আপনি ডিটেকটিভ। জীবনে এই প্রথম ডিটেকটিভ দেখলাম। তবে পলিটিক্যাল লাইফে পুলিশের আই বি বিস্তর দেখেছি। যাই হোক, কালো কুকুর এবং আড়ালের লোকটা ছিল। এবার এল সোনার ঠাকুর। বলে ত্রিবেদীর দিকে ঘুরলেন।মিঃ ত্রিবেদী, এই ডিটেকটিভদ্রলোকের যা বয়স, তাতে সরি! অভদ্রতা করতে চাইনে। আমার ভাগনীই এই গণ্ডগোলটি বাধিয়েছে। কিছু প্রশ্ন করার থাকলে আপনি করুন। ডিটেকটিভদ্রলোকের প্রশ্নগুলো শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাচ্ছে।
ত্রিবেদী নোট করছিলেন। মুখটা নিচু। মুখ তুললেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন–আপনি কোন হোটেলে উঠেছিলেন প্রভাতবাবু?
আপনার প্রশ্নের জবাব দেব না।
ত্রিবেদী বললেন–ঠিক আছে। প্রশ্নটা আমিই করছি।
–তাহলে জবাব দিচ্ছি। হোটেল পারিজাতে। রুম নম্বর ২২। দোতলায়।
ত্রিবেদী বললেন–আপমি মঙ্গল সিং নামে কাউকে চিনতেন? এই এরিয়া তো আপনার পরিচিত।
–হুউ। নাম শুনেছিলুম। কেন বলুন তো? প্রভাতরঞ্জন কর্নেলের দিকে কটাক্ষ করে ফের বললেন-ট্রেড ইউনিয়ন করতাম বটে, ডাকাতি করার দরকার হয়নি। জানেন তো? ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অনেক টাকা রোজগারের স্কোপ থাকে। তাছাড়া এখন আমি আর ওসবে নেই। আর ডাকু মঙ্গল সিংও শুনেছি বেঁচে নেই। আপনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছে কাগজে পড়েছিলাম।
পরশু রাত্তিরে কটা অব্দি শান্তবাবুকে দেখেছিলেন?
–সঠিক লাইনের প্রশ্ন। প্রভাতরঞ্জন মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে বললেন।রাত্তির। চারটে অব্দি আমরা বাড়ি পাহারা দিয়েছি। চারটে বাজলে সবাইকে শুতে যেতে বলি। শান্তও দোতলায় চলে যায়। আমি নিচে বসার ঘরে সোফায় শুয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে গিয়েই বিপদটা হলো।
শান্তবাবু গুপ্ত বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা জানি আপনার দলের সঙ্গে ওদের প্রচণ্ড শত্রুতা ছিল। আমাদের রেকর্ড তাই বলে।
প্রভাতরঞ্জন নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন–আমি এতকাল বাদে শান্তকে সেজন্য খুন করেছি? বিষাক্ত ইঞ্জেকশান করে তারপর লটকে দিয়েছি? ইজ ইট? সেজন্য তার ঘরে ঢুকে খাটের তলায় বলে জোরে হাসলেন। কিন্তু খাটের তলায় ঢুকলাম কখন? শান্তর পিছুপিছু গিয়ে?
–সরি প্রভাতবাবু! তা বলছি না। ত্রিবেদী দ্রুত বললেন।জাস্ট জানতে চাইছি, শান্তবাবুর বিরুদ্ধে কোনও পুরনো রাজনৈতিক আক্রোশ কারও ছিল কি না? তার মানে, তেমন কাউকে আপনার মনে পড়ছে কি না?
–ওসব কোনও পয়েন্টই নয়। প্রভাতরঞ্জন শক্ত মুখে বললেন কথাটা। প্রসূনই খুনী। প্রসূনের সঙ্গে শান্তর গণ্ডগোল হয়েছিল শুনেছি। পলিটিক্যাল রাইভ্যালরি। নীতু বলতে পারে। তাকে জিজ্ঞেস করবেন। একই দলের দুটো ফ্যাকশনের মধ্যে বিবাদ। আজকাল তো এরকমই ঘটছে। ঘটছে না?
–ত্রিবেদী কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল বললেন–এই যথেষ্ট। এবার বরং নীতাকে ডাকুন।
প্রভাতরঞ্জন উঠে পা বাড়িয়েছেন, কর্নেল হঠাৎ ডাকলেন–প্রভাতবাবু, এক মিনিট।
প্রভাতরঞ্জন ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনার এলেবেলে প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।
–আপনি কি মাফলার ব্যবহার করেন না?
প্রভাতরঞ্জন প্রচণ্ড চমকে উঠেছিলেন। সামলে নিয়ে বললেন–মাথার ঠিক নেই। বলব বলে এসে আপনারই উদ্ভট সব প্রশ্নে কথাটা ভুলে গেছি। এতক্ষণ সেই নিয়ে…মানে, নীতাই কথাটা তুলেছিল।
–ডোরাকাটা মাফলারটা আপনারই?
প্রভাতরঞ্জন গুম হয়ে বললেন–হ্যাঁ। গলায় জড়িয়ে সোফায় শুয়ে পড়েছিলুম। পরে শান্তর লাশের গলায় দেখে চমকে উঠি। পাছে আমার ওপর সন্দেহ জাগে, চেপে রেখেছিলাম। তবে আমি সময়মতো বলতামই। আসলে আমিও গোয়েন্দার মতো তদন্ত করছি–তাই…
হাত তুলে কর্নেল বললেন।–ঠিক আছে। ও নিয়ে ভাববেন না। নীতাকে পাঠিয়ে দিন।
প্রভাতরঞ্জন খুব আস্তে হেঁটে গেলেন। ত্রিবেদী অবাক হয়ে বললেন আপনি দেখছি সত্যিই অন্তর্যামী, কর্নেল! ব্যাপারটা কী?
কর্নেল একটু হাসলেন। আমি নিজেই নিজের প্রশ্নে অবাক হয়েছি, মিঃ ত্রিবেদী।
তার মানে?
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা। কেন বেরুল, সঠিক বলা কঠিন। তবে এটুকু ব্যাখ্যা করা যায়, প্রভাতবাবু যে-পোশাক পরে আছেন, তার সঙ্গে একটা মাফলার মানানসই হতো। বিশেষ করে বিহার মুল্লুকে মাফলারের রেওয়াজ এ মরসুমে অহরহ চোখে পড়ে। তবে এও ঠিক ওঁর মাথায় শীতের পশমি টুপি থাকলে প্রশ্নটা আমার মাথায় আসত না। আজ ঠাণ্ডাটা বেশ বেড়েছে। তাই না?
ত্রিবেদী ভাবতে ভাবতে বললেন–যাই হোক, একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বেরিয়ে এল। ওদিকে আপনার কথামতো সরডিহি বাজারে ডোরাকাটা মাফলার কে সম্প্রতি কিনেছে, সেই খোঁজে লোক লাগিয়েছি।
সূত্রটা গুরুত্বপূর্ণই বটে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, প্রভাতবাবু নিচের বসার ঘরের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ার পর খুনী ওঁর গলা থেকে সাবধানে মাফলার খুলে নিয়ে গেছে।
–চারটে থেকে ভোর ছ’টার মধ্যে।
–ঠিক। কিন্তু কেন?
–শান্তবাবুর বডি কড়িকাঠে লটকানোর জন্য, যাতে আত্মহত্যা সাব্যস্ত করা যায়!
কর্নেল বেতের টেবিলে একটা চুরুট খেলাচ্ছলে ঠুকতে ঠুকতে বলেলেন– সেজন্য শান্তর মাফলার ছিল। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, খুনী নীচে থেকে ওপরে উঠেছিল না ওপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল? এটা একটা বড় প্রশ্ন।
ত্রিবেদী নড়ে বসলেন।–অবশ্যই বড় প্রশ্ন। তবে তার উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে। পোস্টমর্টেমের একটা রিস্ক থেকে যায়। তাই খুন প্রমাণিত হলে যাতে প্রভাতবাবুর ঘাড়েই দায়টা চাপে, তার ব্যবস্থা করেছিল। তার মানে সে প্রভাতবাবুরও শত্রু। অথবা প্রভাতবাবুকে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্য ছি কোন কারণে।
বলে পয়েন্টগুলো ঝটপট নোট করে ফেললেন ত্রিবেদী। সেই সময় নীতা এল। তাকে ইশারায় বসতে বললেন ত্রিবেদী। কর্নেল তার দিকে তাকালে সে আস্তে বলল–একটা অদ্ভুত ব্যাপার কর্নেল! শান্তদার গলায় যে মাফলারটা আটকানো ছিল, সেটা মামাবাবুর। কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ আমারই খেয়াল হলো…
জানি। কর্নেল তাকে থামিয়ে দিলেন।–কেয়া চৌধুরী নামে কোনও মহিলাকে তুমি চেনো?
হা। কেয়াদিই আপনার কাছে যেতে বলেছিলেন আমাকে। আমি আপনাকে অত খুলে বলিনি।
–কেয়া চৌধুরী প্রসূনের দিদি?
নীতা মুখ নামিয়ে গলার ভেতর বলল–হ্যা! এখন বুঝতে পারছি সব কথা আপনাকে খুলে বলা উচিত ছিল।
-কী কথা?
–কেয়াদি তার ভাইয়ের সঙ্গে আমার মিটমাটের চেষ্টা করছিলেন। একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাসস্টপে একটা লোক সন্ধ্যাবেলা..
কর্নেল ফের তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–প্রসূনের সঙ্গে শান্তর শত্রুতা ছিল?
না তো! শান্তদাও আমাকে বকাবকি করত। বলত, মিটমাট করে নে। নীতু মুখ নামিয়ে ফের বলল–আসলে আমার বাবা-মায়ের প্রভাবে ছোটবেলা থেকে ড্রিঙ্কের বিরুদ্ধে আমার তীব্র অ্যালার্জি ছিল। বাবা-মা গান্ধীজির আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আমিও সেই পরিবেশে বড় হয়েছি। মাতাল দেখলে আমার প্রচণ্ড ঘৃণা হতো। আমি জানতম না প্রসুন ড্রিঙ্ক করে। বিয়ের পর জেনেছিলাম। সেই থেকে আমাদের রিলেশান নষ্ট হতে শুরু করে। বিশেষ করে জ্যাঠামশাইয়ের এখানে হনিমুনে এসে ওকে বস্তির লোকদের সঙ্গে কুচ্ছিৎ ওইসব জিনিস খেতে : দেখলাম। তখন আর সহ্ন করতে পারিনি।
-কীভাবে দেখলে?
–এ বাড়ির দোতলা থেকে ওপাশের বস্তিটা দেখা যায়। এক বিকেলে ওকে খাঁটিয়ায় বসে একটা লোকের সঙ্গে ওই রাবিশ খেতে দেখেছিলাম। নবকে ডেকে দেখালাম। নব বলেছিল, লোকটা নাকি সাংঘাতিক ডাকাত। তাই আরও ঘৃণা–আর একটু সন্দেহও হয়েছিল প্রসূনের ওপর। শুনেছিলাম, শান্তদার দলের লোকেরা নাকি ডাকাতি করত এবং প্রসূন শান্তদার বন্ধু।
পরশু রাতে সবাই যখন নিচে পাহারা দিচ্ছিল, তুমি কোথায় ছিলে?
-নিচে ঝুমা বউদির কাছে। আমরাও জেগে ছিলাম চারটে অব্দি। তারপর ওপরে গিয়ে আমি শুয়ে পড়ি। ছ’টায় জ্যাঠামশাই কখন বেরোন, জানতে পারিনি। একটু পরে নিচে চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙে। নিচে গিয়ে শুনি মামাবাবুর বল্লমটা…।
কর্নেল হাত তুলে বললেন-তোমার ঘর আর শান্তর ঘরের মধ্যে করিডর। তোমার ঘর থেকে কোনও অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পেয়েছিলে কি?
নীতা একটু ভেবে বলল–ভীষণ ঘুম পেয়েছিল। শুধু শান্তদার ঘরের দরজা। বন্ধ হওয়ার শব্দ…বলে নীতা একটু চঞ্চল হয়ে উঠল।-হ্যাঁ, হা! কী সব শব্দ…অস্বাভাবিক শব্দ। কিন্তু ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছিল।…আপনি বলায় মনে পড়ছে। দরজা আবার খোলা বা বন্ধ হওয়ার শব্দ, কেউ কিছু বলল, কিংবা ওইরকম কী সব।
–হুঁ। তুমি কি মনে করো প্রসুন শান্তকে খুন করেছে?
নীতা জোরে মাথা নেড়ে বলল–নাঃ। কেন করবে? ওরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।
–সোনার ঠাকুর নিয়ে কোনও বিবাদ হতে পারে দুজনের মধ্যে?
-কী করে হবে? আমি ছাড়া কেউই জানে না, বা দেখেওনি জ্যাঠামশাইয়ের কাছে একটা সোনার ঠাকুর আছে। আমি কাউকে বলিনি এ পর্যন্ত আপনাকে ছাড়া।
ত্রিবেদী প্রশ্ন করলেন–আর য়ু সিওর?
নিশ্চয়। নীতা শক্ত মুখে বলল।তাছাড়া জ্যাঠামশাইয়ের পেট থেকে কোনও কথা বেরোয় না, আমি জানি।
কর্নেল বললেন–কিন্তু তুমি আমাকে বলেছ, সোনার ঠাকুর নিয়েই জ্যাঠামশায়ের বিপদের আশঙ্কা করছ!
হা। জাস্ট একটা সন্দেহ। কারণ জ্যাঠামশায়ের কোনও শত্রু নেই। তাই ভেবেছিলাম, সোনার ঠাকুরটার কথা কেউ যেভাবে তোক জানতে পেরেছে। তার কোনও ওয়েল-উইশার সেজন্য আমাকে… নীতা বিব্রত মুখে চুপ করল। শ্বাস ফেলে ফের বললব্যাপারটা রহস্যময় বলেই প্রথমে কেয়াদির কাছে। গিয়েছিলাম। কারণ ওঁর স্বামী সি আই ডি পুলিশ।
-কেয়াদেবীকে তুমি সোনার ঠাকুরের ব্যাপারটা বলেছিলে?
হ্যাঁ। না বললে তো… ।
–তুমি কেয়াদেবীকে সোনার ঠাকুরের কথা বলেছিলে? কর্নেল ফের প্রশ্ন করলেন। অথচ তুমি একটু আগে বললে, আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলোনি!
নীতাকে আরও বিব্রত দেখাল। বলল বলা দরকার মনে করেছিলাম। শুনে কেয়াদি বললেন, আমার কর্তার মাথা মোটা। বিহারে গিয়ে পুলিশ জড়ো করে হইচই বাধাবে।, বরং তুমি কর্নেলসায়েবের কাছে যাও। আমি আপনার সম্পর্কে কেয়াদির কাছে সাংঘাতিক সব কীর্তির কথা শুনলাম। তাই আপনার কাছে গেলাম। জানি, কেয়াদি কাউকে ঠাকুরের কথা বলবে না।
এই সময় প্রভাতরঞ্জনকে হন্তদন্ত আসতে দেখা গেল। চিৎকার করতে করতে আসছেন রহস্য! রহস্য! বদমাইশি অ্যান্ড রহস্য!
তাঁর হাতে একটা ডোরাকাটা মাফলার। জোরে নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–দেখছেন কাণ্ডটা? এই হচ্ছে আমার মাফলার। এইমাত্র নব বসার ঘর সাফ করতে গিয়ে উদ্ধার করেছে। সোফার তলায় পড়ে ছিল। খামোকা আমাকে ফাঁসানোর তালে ছিলেন এই ডিটেকটিভদ্রলোক!
ত্রিবেদী মাফলারটা নিয়ে পরীক্ষা করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল তখনই প্রভাতরঞ্জনকে ফেরত দিয়ে বললেন–কিছু মনে করবেন না প্রভাতবাবু! বুড়ো হয়ে গেছি। বুদ্ধিভ্রংশ হওয়া স্বাভাবিক। নীতা, তুমি এসো। প্রভাতবাবু, দয়া করে ঝুমাদেবীকে পাঠিয়ে দিন।
প্রভাতরঞ্জন বীরদর্পে ভাগনীসহ সোজা বাড়ির বারান্দায় গিয়ে উঠলেন। দীপ্তেন্দু, অরুণ, ঝুমা বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। নব বারান্দায় ঝাড়, হাতে বেরুল। প্রভাতরঞ্জন মাফলারটা নেড়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।
একটু পরে ঝুমা এল। কর্নেল বললেনবসো। তখন ঝুমা কুণ্ঠিত মুখে বসল। তাকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন–তুমি সকালে ওই ব্রিজের ওখানে বলছিলে, নীতার কাছে– শুনেছ যে প্রসূন আর শান্তর মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া ছিল!
ঝুমা বলল-হা, নীতা বলেছিল। কিন্তু এখন অন্য কিছু বলেছে বুঝি?
–হ্যাঁ। বলল, দুজনের খুব বন্ধুত্ব ছিল। শত্রুতা ছিল না।
ঝুমার চোখ জ্বলে উঠল।তাই বলল নীতা? আশ্চর্য মেয়ে তো! আমাকে মিথ্যাবাদী সাজালো!’
–আচ্ছা ঝুমা, নীতার সঙ্গে প্রসূনের বিয়ের আগে তুমি কি প্রসূনকে চিনতে?
ঝুমা বাঁকা মুখে বলল–নাঃ। অমন আজেবাজে লোকের সঙ্গে পরিচয়ের প্রশ্নই ওঠে না।
শান্তকে তুমি তোমার বিয়ের আগে থেকে চিনতে?
ঝুমা তাকাল। একটু পরে বলল–নীতা বলল বুঝি?
আমিই জানতে চাইছি।
ঝুমা চুপ করে রইল। মুখটা নিচু। ঠোঁট কামড়ে ধরল।
–শান্তর সঙ্গে তোমার পরিচয় ছিল?
ঝুমার চোখে জল এসে গেল। আস্তে বলল ছিল। কেন?
কর্নেল চুরুট জ্বেলে তারপর বললেন–শান্তর মৃত্যুতে তুমি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছ। আমার চোখ, ঝুমা! এ চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। কাজেই আমিই তোমাকে প্রশ্ন করছি, কেন তুমি সবার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলে?
ঝুমা এবার দুহাতে মুখ ঢাকল। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল।
ত্রিবেদী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বললেন–কান্নাটান্না পরে। কর্নেলের প্রশ্নের জবাব দিন।
ঝুমা মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভেজা চোখে তীব্র দৃষ্টি রেখে বলল–দ্যাটস্ মাই পার্সোনাল অ্যাফেয়ার। আমি জবাব দেব না।
ত্রিবেদী আরও খাপ্পা হয়ে কি বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে নিবৃত্ত করে শান্তস্বরে বললেনঝুমা! আমি শান্তর হত্যাকারীকে খুঁজছি। তোমার সহযোগিতা চাই। ভুল বুঝো না।
ঝুমা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–আমার সঙ্গে শান্তর একটা ইমোশনাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ও বিয়েতে রাজি হয়নি। পরে অরুণের সঙ্গে আম বিয়ে হয়। বাট আই লাভ মাই হাজব্যান্ড কাজেই পাস্ট ইজ পাস্ট।
ঝুমা! পরশু রাত্তিরে শান্তর সঙ্গে তোমার কোনও কথা হয়েছে?
পরশু রাত্তিরে এক ফাঁকে শান্ত আমাকে চুপিচুপি বলেছিল, হয়তো এভাবে তাকেই একটা ফাঁদে ফেলা হয়েছে। জ্যাঠামশাইয়ের নয়, হয়তো তারই। কোনও বিপদ ঘটতে পারে। ব্যাপারটা খুলে বলার সুযোগ ও আর পায়নি। মামাবাবু একটুতেই ডাকাডাকি হইচই বাধিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।
ত্রিবেদী তাকালেন কর্নেলের দিকে। বললেন–নবও ঠিক একই……ওকে!
কর্নেল তাকে থামিয়ে ঝুমাকে বললেন–তুমি কখনও শান্তর কাছে সোনার ঠাকুরের কথা শুনেছ?
ঝুমা চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল–শান্ত বেঁচে নেই। কাজেই এখন বলা যায়বলা উচিত।
বলো, ঝুমা!
শান্তর পলিটিক্যাল গ্রুপ সরডিহি রাজবাড়ির মন্দির থেকে সোনার ঠাকুর ডাকাতি করেছিল। আমাকে শান্ত বলেছিল।
তারপর, তারপর? ত্রিবেদী উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
ঝুমা বলল–শান্ত সোনার ঠাকুরটা এনে লুকিয়ে রাখে। যে-ঘরে ও খুন হয়েছে, ওই ঘরে। তারপর নাকি ওটা চুরি যায় ও-ঘর থেকে।
কর্নেল বললেন কীভাবে চুরি যায়, বলেনি?
বলেছিল। কাগজে মুড়ে বালিশের তলায় রেখেছিল। তারপর বাইরে থেকে এসে আর ওটা খুঁজে পায়নি। দলের লোকের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে যায় সরডিহি ছেড়ে।
ত্রিবেদী বললেন–সঠিক দিকেই আমরা এগিয়েছিলাম তাহলে। হা’গো-অন প্লিজ।
কর্নেল বললেন–আর কিছু জানো এ সম্পর্কে?
না। ঝুমা মাথা নাড়ল। আমি ওকে বরাবর নিষেধ করতাম, যেন সরডিহি না যায়। তবু কেন ও বোকামি করল বুঝতে পারছি না। পরশু রাত্তিরে ও যখন কথাটা বলল, ওকে সাবধান করে দিয়েছিলাম।
–ঠিক আছে। তুমি আসতে পারো, ঝুমা! তোমার স্বামীকে না, দীপ্তেন্দুকে পাঠিয়ে দাও।
ঝুমা চলে গেলে ত্রিবেদী হাসলেন।–এ পর্যন্ত শুধু এটুকু জানা গেল, এই খুনের সঙ্গে সেই সোনার ঠাকুর চুরির কেস জড়িত। প্রসূন, কর্নেল! প্রসূনই বারবার ফ্রন্টে এসে যাচ্ছে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট চানছিলেন। কোনও মন্তব্য করলেন না। দীপ্তেন্দু এসে নমস্কার করে বসল। ত্রিবেদী প্রথমে তার নাম-ঠিকানা-পেশা লিখে নিলেন। তারপর কর্নেলকে বললেন–আপনিই শুরু করুন। আমি নোট করি।
কর্নেল মিষ্টি হেসে বললেন–তুমি বললে, আশা করি কিছু মনে করবে না।
দীপ্তেন্দু গম্ভীর মুখে বললনা। বলুন না!
তুমি তো মেডিকেল কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ?
-হ্যাঁ। বাবা ডাক্তার ছিলেন। আমি ডাক্তার হতে পারিনি। তবে বাবার চেনাজানার সুযোগে অগত্যা এই পেশাটা জোটাতে পেরেছি। এই নিন- আমার কার্ড। এই পেশা না জোটাতে পারলে শান্তর মতো সাংঘাতিক একটা কিছু করে বেড়াতাম। বাঁচাটাই পাপ এ যুগে।
-তুমি কি কোনও কারণে উত্তেজিত? কার্ডটা দেখতে দেখতে কর্নেল বললেন।
–হ্যাঁ। এবং উদ্বিগ্নও। আমার সঙ্গে সবসময় কিছু ওষুধপত্র থাকে। তো একটা ওষুধ…
কোনও ওষুধ হারিয়েছে?
দীপ্তেন্দু নড়ে উঠল।–হ্যারিয়েছে। সাংঘাতিক ওষুধ।
ইঞ্জেকশানের ওষুধ কি?
–হুঁ। দীপ্তেন্দু মুখ নামিয়ে বলল।–মর্ফিয়ার বিকল্প নতুন একটা ওষুধ আমার কোম্পানি বের করেছে। তার দুটো স্যাম্পল ছিল–দুটো অ্যাল। একটা নেই। নিকোটিন থেকে তৈরি ওষুধ। নির্দিষ্ট ডোজের বেশি ইঞ্জেক্ট করলেই মানুষ মারা পড়বে।
ত্রিবেদী প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রশ্ন করলেন–কখন দেখলেন একটা অ্যাল নেই?
কাল রাত ন’টায়।
কাউকে বলেছেন সে-কথা? ত্রিবেদী কর্নেলকে আর মুখ খুলতেই দিলেন না।
না। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তারপর যখন শুনলাম আজ পুলিশ তদন্ত করতে আসবে, তখন ঠিক করেছিলাম ওই সময় বলব, যা ঘটে ঘটুক।
আপনার স্যুটকেসে ছিল অ্যাম্পুল দুটো?
–না। কিটব্যাগেই রাখি। কারণ সবসময় কেউ-না-কেউ এটা-ওটা ওষুধ চায়। কার অ্যাসিডিটি, কার মাথাধরা! সব মেডিকেল রিপ্রেজন্টেটিভই এভাবে ওষুধপত্র সঙ্গে রাখে। খোঁজ নিলে জানবেন।
ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ ছিল কি আপনার ব্যাগে?
দীপ্তেন্দু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল–বলতে সময় দেবেন তো? সিরিঞ্জ ছিল। সেও বেপাত্তা হয়ে গেছে।
–শান্তর পোস্টমর্টেম রিপোর্টের খবর শুনেছেন আপনি?
–শুনেছি। কেন শুনব না?
কবে, কখন?
কাল বিকেলে হসপিটালের মর্গে গিয়েই শুনেছি। দীপ্তেন্দু উত্তেজিতভাবে বলল।–তো তখনও মাথায় এটা আসেনি। শ্মশান থেকে ফেরার পর রাত্রে হঠাৎ খেয়াল হলো। তখন কিটব্যাগ খুলে দেখি এই অদ্ভুত ব্যাপার। ভেবে দেখলাম, এ কথা পুলিশ ছাড়া কাউকে বলা উচিত হবে না। পরস্পর সন্দেহ জাগবে। তিক্ততার সৃষ্টি হবে।
ফের ত্রিবেদী কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বললেন–তুমি কখনও সোনার ঠাকুর দেখেছ?
দীপ্তেন্দু তাকাল। তারপর খুব আস্তে বলল সোনার ঠাকুর?
–হ্যাঁ, সোনার ঠাকুর।
–হঠাৎ সোনার ঠাকুর আসছে কেন? দীপ্তেন্দু বিরক্তভাবে পুলিশ অফিসারের দিকে ঘুরল।–এই মার্ডার কেসের ব্যাপারে এমন সাংঘাতিক একটা তথ্য দিলাম। তার সঙ্গে এই উদ্ভট প্রশ্নের সম্পর্ক কী?
ত্রিবেদী একটু হেসে কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল বললেন, প্রশ্নের জবাব কিন্তু পাইনি!
দীপ্তেন্দু চটে গেল।না, সোনার ঠাকুর দেখার সৌভাগ্য এ জীবনে হয়নি।
-ঠিক আছে। আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই।
–তাহলে স্যার, দীপ্তেন্দু পুলিশ অফিসার ত্রিবেদীর দিকে ফের ঘুরে বলল–আমি কিটব্যাগটা এনে দেখাচ্ছি আপনাকে।
ত্রিবেদী খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একদল পুলিশের দিকে হাতের ইশারা করলেন। এ এস আই মানিকলাল এগিয়ে এলে বললেন–এঁর সঙ্গে যান। উনি একটা কিটব্যাগ দেবেন। নিয়ে আসুন।
দীপ্তেন্দু উঠল। সে কয়েক পা এগিয়ে গেলে কর্নেল ডাকলেন–আর একটা কথা দীপ্তেন্দু!
–ওষুধটা, মানে যে অ্যাম্পলটা হারিয়েছে, সেটা তোমার কোম্পানি নতুন বের করেছে?
বললাম তো নতুন। এমাসেই বাজারে ছাড়া হয়েছে। ফ্রেশ নতুন ওষুধ।
–ঠিক আছে। তুমি অরুণকে পাঠিয়ে দাও।
দীপ্তেন্দু এবং মানিকলাল চলে গেলে ত্রিবেদী গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন– একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। অপারেশন সাকসেসফুল।
কর্নেল হেসে উঠলেন। প্রায় অট্টহাসি।
ত্রিবেদী বললেন–হোয়াটস রং কর্নেল?
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এটা হয়। কর্নেল টুপি খুলে প্রশস্ত টাকে অভ্যাসবশে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সবাই সত্য-মিথ্যাকে জড়িয়ে ফেলে। অর্থাৎ পুরো সত্য মুখ থেকে বেরিয়ে আসে না। স্টেটমেন্টগুলোর একেকটা কাঠামো থাকে। কাঠামো বিশ্লেষণ করে সত্য আর মিথ্যা আলাদা করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে–এই কেসটার কথাই বলছি, এরা কেউ কেউ নিশ্চয় মিথ্যা বলছে আবার সত্যও বলছে। না–আমি এখনও জানি না, কোনটা ওরা সত্য বলছে বা কোনটা মিথ্যা বলছে। শুধু এটুকু জানি, প্রত্যেকের স্টেটমেন্টের কাঠামোতে সত্য-মিথ্যা মেশানো আছে।
ত্রিবেদী সিরিয়াস হয়ে বললেন–স্টেটমেন্ট বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা যা প্রশ্ন করছি, ওরা তার জবাব দিচ্ছে মাত্র। আমাদের প্রশ্নগুলোও ভুল প্রশ্ন হতে পারে। তার মানে, ঠিক প্রশ্ন করলে ঠিক জবাব পেতাম হয়তো। শুধু ব্যতিক্রম দীপ্তেন্দুবাবু। উনি নিজে থেকেই একটা সাংঘাতিক তথ্য দিয়েছেন।
কর্নেল চোখ বুজে একটু হেলান দিয়ে বললেন–আপনি বলছেন অপারেশন সাকসেসফুল?
–অবশ্যই। ঘুরে-ফিরে প্রসূনের কাছেই আমরা পৌঁছুচ্ছি।
–কীভাবে?
–প্রসূনের জানা সম্ভব দীপ্তেন্দুবাবুর কাছে বিষাক্ত ওষুধপত্র থাকে। সে এবাড়ির নাড়ী-নক্ষত্র চেনে। আগে থেকে এসে লুকিয়ে ছিল সে। বলে ত্রিবেদী চোখে হাসলেন।নব তাকে হেল্প করেছে। নবকে আমি অ্যারেস্ট করছি। দীপ্তেন্দুবাবুর স্টেটমেন্ট থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার ঘর থেকে বিষাক্ত ওষুধ আর ইঞ্জেকশান সিরিঞ্জ চুরি করতে হলে বাড়িরই একজন লোকের সাহায্য জরুরি। নব ছাড়া আর কে হতে পারে সে?
অরুণ আসছিল। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।–আপনি ওকে জেরা করুন। আমি আসছি।
বলে ত্রিবেদীকে অবাক করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন কর্নেল।