বিগ্রহ রহস্য ২

০২.

সরডিহিতে দীনগোপালের এই বাড়িতে এর আগেও তার ভাইপো-ভাইঝিদের দঙ্গল এসে জুটেছে। হইহল্লা করছে। কিন্তু এবারকার আসা অন্যরকম। বিশেষ করে শান্ত এসে একই কথা বলায় প্রকাণ্ড একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রভাতরঞ্জন নীতারই মামা। দীপ্তেন্দু, শান্ত, অরুণেরও অবশ্যই নিজ নিজ মামা আছেন। কিন্তু তাঁরা অন্য ধরনের মানুষ। প্রভাতরঞ্জন অরুণের ভাষায় কমন মামা। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আর বেপরোয়া মানুষ। গল্পের রাজা বলা চলে। অবিশ্যি ‘গল্প’ বললে চটে যান। বলেন, রিয়েল লাইফ স্টোরি। কিন্তু এবার কোনও ‘রিয়েল লাইফ স্টোরি’র আবহাওয়া ছিল না। সরডিহি বাজার এলাকায় যে হোটেলে উঠেছিলেন, সেখান থেকে বোঁচকা গুটিয়ে চলে এসেছিলেন। দীনগোপালকে পাহারার জন্য নিশ্চিদ্র ন্যূহ রচনায় ব্যস্ত হয়েছিলেন। তবে সেটা দীনগোপালের অজ্ঞাতসারে। প্রভাতরঞ্জনের ধারণা, এই রাতেই কিছু ঘটবে। যেহেতু শান্ত আসার পর আর কেউ এখানে আসার মতো নেই।

সুতরাং একটা প্রচণ্ড হিম ও কুয়াশা-ঢাকা রাত শুধু জেগে কাটানো নয়, মাঝে মাঝে বেরিয়ে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা, ভুল কোনও নড়াচড়া দেখেই টর্চের আলো এবং ছুটোছুটি, এসবের মধ্যে কেটে গিয়েছিল। দীনগোপালের প্রতি প্রভাতরঞ্জনের নির্দেশ ছিল, কেউ ডাকলে দরজা যেন না খোলেন। দীনগোপাল একটু হেসে বলেছিলেন–আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুই।

রাত চারটেয় কুয়াশা আরও ঘন হয়েছিল এবং প্রথমে নীতা ওপরে শুতে যায়। পরে অরুণ, তারপর দীপ্তেন্দু, শেষে শান্ত শুতে যায়। নিচের ড্রইংরুমে শুধু প্রভাতরঞ্জন একা জেগে ছিলেন। হাতে টর্চ এবং নবর সেই বল্লম।…

অভ্যাসমতো ভোর ছটায় উঠে দীনগোপাল গলাবন্ধ কোট, মাথায় হনুমান চুপি, পায়ে উলের পুরু মোজা ইত্যাদি পরে এবং হাতে যথারীতি ছড়ি নিয়ে নিচে নামলেন। সিঁড়ি ড্রইংরুমের ভেতর নেমে এসেছে। নেমে দেখলেন, সোফায় কম্বল মুড়ি দিয়ে প্রভাতরঞ্জন ঘুমোচ্ছেন। দীনগোপালের ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি ফুটে উঠল। নবর বল্লমটা সাবধানে তুলে নিলেন এবং নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। তারপর দরজার বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিলেন।

বল্লমটা লনের মাটিতে পুঁতে রেখে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন দীনগোপাল। গেট রাতে তালাবন্ধ থাকে। একটা চাবি তার কাছে, অন্যটা নবর কাছে। নব উঠতে রোজই দেরি করে।

দীনগোপাল রাস্তায় নেমে একটু দাঁড়ালেন। রাস্তাটা পূর্বপশ্চিমে লম্বা। পশ্চিমে এক কিলোমিটার-টাক গেলে টিলা পাহাড়গুলো। পূর্বে আধ কিলোমিটার হাঁটলে ক্যানেলের সুইস গেট। তার দক্ষিণে এই রাস্তার বাঁকে বাজার এলাকা। তারপর রেল স্টেশন।

পশ্চিমে টিলাগুলোর দিকেই হাঁটতে থাকলেন দীনগোপাল। প্রথম টিলাটার মাথায় এখনও চড়তে পারেন। কাল বিকেলে নীতা তাকে কিছুতেই চড়তে দিল না। সেজন্যই যেন জেদ চেপেছিল মাথায়। টিলাটার শীর্ষে একটা খবঁটে পিপুল গাছ আছে। নিচে একটা বেদির মতো কালো পাথর আছে। পাথরটাতে বসে সূর্যোদয় দেখবেন ভাবতে ভাবতে মনে হলো, পাথরটা এখনও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।

 তা হোক। এই ঊনআশি বছরের জীবনে অনেক ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার ঘা। খেয়েছেন দীনগোপাল।…

দোতলার পুবের ঘরে দীনগোপাল, মাঝখানেরটাতে নীতা, পশ্চিমের ঘরে শান্ত। শান্তর ঘরেই প্রভাতরঞ্জনের শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। চারটেয় যখন শান্ত শুতে আসে, নীতা তখনও জেগে ছিল। শান্ত ঘরের দরজা বন্ধ করছে, তাও শুনেছিল। তারপর কখন তার ঘুম এসে যায়।

দীনগোপাল বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে নীতার ঘুম ভেঙে গেল। নিচে প্রভাতরঞ্জনের উত্তেজিত ডাকাডাকি শুনতে পেল। সে উত্তরের জানালা খুলে উঁকি দিল। বাইরে কুয়াশা। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

নীতা দ্রুত ঘুরে এসে দরজা খুলে বেরুল। নিচে নেমে দেখল, পুবের ঘর থেকে চোখ মুছতে মুছতে দীপ্তেন্দু সবে বেরুচ্ছে। তারপর পশ্চিমের ঘর থেকে ঝুমা বেরিয়ে এল, গায়ে আলখাল্লার মতো লালচে গাউন। প্রভাতরঞ্জন ব্যস্তভাবে। বললেন বল্লম! বল্লম অদৃশ্য!

নীতার চোখ গেল বাইরের দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দম আটকানো গলায় বলল-দরজা খোলা!

প্রভাতরঞ্জন সশব্দে ভেজানো দরজা খুলে বারান্দায় গেলেন। তারপর তাকে ঝাঁপ দেবার ভঙ্গিতে নিচের লনে নামতে দেখা গেল এবং ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠলেন–সর্বনাশ! সর্বনাশ!

দীপ্তেন্দু দৌড়ে গেল। নীতা ও ঝুমা বারান্দায় গিয়ে দেখল, নিচে শিশির ভেজা ঘাসে বল্লমটা বেঁধা এবং প্রভাতরঞ্জন সেটার এদিক থেকে ওদিক মাকুর মতো আনাগোনা করছেন। দীপ্তেন্দু বল্লমটা উপড়ে তুলল। তখন প্রভাতরঞ্জন হাঁসফাঁস করে বললেন–রক্তক্ত লেগে নেই তো?

দীপ্তেন্দু ভাল করে দেখে বললনাঃ! কিন্তু ব্যাপারটা কী? প্রভাতরঞ্জন সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন নীতু! শীগগির ওপরে গিয়ে দ্যাখ তো দীনুদা ঘুমুচ্ছেন নাকি! তার গলার স্বর ছ্যাৎত্রানো–কিছুটা হিমও এর কারণ। দেখে মনে হচ্ছিল, কাঁপছেন। সেটা অবশ্যি হিমের চেয়ে উত্তেজনার দরুনই। এই সময় নব বারান্দার লাগোয়া কিচেন-কাম ভঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নীতার উদ্দেশে বললবাবুমশাই বেড়াতে বেরুলেন দিদি! আজ আমি ওঁর আগেই উঠেছি। সে খি-খি করে হাসল।–দেখি কী, বাবুমশাই বল্লমখানা পুঁতে দিয়ে চলে গেলেন। আমার বল্লমখানা বরাবর ওঁর অপছন্দ।

নীতা কোনও কথা না বলে ওপরে চলে গেল। তারপর দীনগোপালের ঘরের দরজায় তালা দেখে আশ্বস্ত হলো। সে শান্তর ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকতে লাগল–শান্তদা! উঠে পড়ো–দারুণ মজার ঘটনা ঘটেছে। নীতার হাসি পেয়েছিল জ্যাঠামশাইয়ের কৌতুকবোধ দেখে। গম্ভীর ধাতের মানুষ। এমন রসিকতা কল্পনা করা যায় না…

নিচে দীপ্তেন্দু ও প্রভাতরঞ্জন তখন নবকে ধমক দিচ্ছেন পালাক্রমে। কেন সে সঙ্গে সঙ্গে জানায়নি? ঝুমা ঘরে ঢুকে অরুণকে ওঠানোর চেষ্টা করছিল। খিমচি এবং শেষে গালে বাসি দাঁতের একটা প্রেম কামড় খেয়েই অরুণ চোখ মেলল। ঝুমা মুখে মিথ্যা আতঙ্কের ভাব ফুটিয়ে বলল বাইরে কী হচ্ছে দ্যাখো গিয়ে! বল্লমটা কে বিঁধিয়ে দিয়ে গেছে–

সর্বনাশ! বলে সে স্ত্রীর কথা শেষ হবার আগেই কম্বল থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারপর একলাফে ড্রইংরুম পেরিয়ে বাইরের বারান্দায় গেল। চিড় খাওয়া গলায় চেঁচাল-হোটাট হ্যাঁপনড়? মার্ডার? ও মাই গড! সে জ্যাঠামশাইয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখতে যাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে লনে ঝাঁপ দিল।…

এতক্ষণে দীনগোপাল প্রায় সিকি কিলোমিটার দূরে। সরডিহি এলাকায় প্রকৃত শীত আসতে এখনও কয়েকটা দিন দেরি। শেষ হেমন্তের ভোরবেলায় এই শীতটা বাইরের লোককে পেলে হয়তো মেরেই ফেলবে। কিন্তু দীনগোপালের এ মাটিতে প্রায় অর্ধশতক কেটে গেল।

ইচ্ছে করেই একটু জোরে হাঁটছিলেন তিনি। বুঝতে পারছিলেন, তার ঘর তালাবন্ধ দেখে ওরা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। ব্যাপারটা প্রচণ্ড বিরক্তিকর ঠেকছে দীনগোপালের। তাঁর কোনও শত্রু নেই বলেই জানেন–অন্তত তাকে প্রাণে মেরে ফেলবে, এমন কেউ নেই। কারণ জীবনে কারুর সঙ্গে এতটুকু ঝগড়া-বিবাদ করেননি। বরাবর সমস্ত কিছুতে নির্লিপ্ত এবং একানড়ে স্বভাবের মানুষ তিনি। স্থানীয় কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনার সঙ্গে কোনোদিন জড়িয়ে পড়েননি। সরডিহির সবাই তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে। তার মতো মানুষের কী বিপদ ঘটতে পারে, কিছুতেই মাথায় আসছে না।

বিপদ ঘটার অন্য একটা সম্ভাবনার দিক অবশ্যি ছিল। তা হলো, ধনসম্পত্তি। কিন্তু সেও যতটুকু আছে, সবটাই ব্যাঙ্ক আর সরকারি-বেসরকারি কিছু কাগজে, অর্থাৎ ঋণপত্রে। সুদের টাকার সামান্য কিছু অংশ জীবনযাত্রার জন্য নেন। বাকিটা জমার ঘরে ঢুকে যায়। বছর বিশেক আগে দশ কিলোমিটার দূরে খনি অঞ্চলে গোটা তিনেক খনির মালিক ছিলেন। সেগুলো সরকার নিয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন, সেই টাকা। একসময় ক্যানেল এলাকায় কিছু জমি কিনেছিলেন। কিন্তু চাষবাসের ঝুটঝামেলা বড্ড বেশি। জমিগুলো বেচে দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে মাত্র লাখ দেড়েক টাকা লগ্নি করা আছে। তার মৃত্যুর পর ভাইপো ভাইঝিরা তা পাবে। মাঝে মাঝে অবশ্যি এ নিয়েও চিন্তাভাবনা করেছেন। অরুণ, দীপ্তেন্দু–ওদের পয়সাকড়ির অভাব নেই। অরুণ তার পরের ভাই সত্যগোপালের ছেলে। সত্যগোপাল কলকাতায় বিশাল কারবার কেঁদেছিলেন। মৃত্যুর পর সে-সবের মালিক হয়েছে অরুণ। একটু খ্যাপাটে স্বভাবের হলেও টাকাকড়ির ব্যাপারে হুঁশিয়ার। পরে ভাই নিত্যগোপালের নাম ছিল ডাক্তার হিসেবে সুখ্যাত। নিত্যগোপালের মৃত্যুর পর দীপ্তেন্দু যদিও মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নিয়েছে, সেটা ওর নেহাত খেয়াল। ডাক্তারি পড়ানো যায়নি ওকে, পালিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। বছরখানেক প্রায় নিরুদ্দেশ। বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফেরে। তাহলেও ওর বাবা যা রেখে গেছেন, তা ওর পক্ষে যথেষ্ট। শুধু শান্তর বাবা প্রিয়গোপাল কিছু রেখে যাননি। মাথায় সন্ন্যাসের ঝোঁক চেপেছিল। এখন নাকি হরিদ্বারের কোন আশ্রমে আছেন–একেবারে সাধুবাবা! শান্তর মা সুইসাইড করেছিলেন, সেটাই প্রিয়গোপালের সংসারত্যাগের কারণ কি না কে জানে! শান্ত ভাগ্যিস ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছিল। মফস্বলের স্কুলে মাস্টারি পেয়ে যায়। তারপর উগ্রপন্থী রাজনীতির আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। এখন সে কলকাতায় কী করে-টরে, দীনগোপাল জানেন না।

আর নীতা ছোটভাই জয়গোপালের মেয়ে। জয়গোপাল এবং তাঁর স্ত্রী নন্দিনী বছর দুই আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। তার আগে অবশ্যি নীতার বিয়ে হয়েছিল। গতবছর স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে নীতার। লোকটা নাকি লম্পট আর মাতাল। তবে বিয়ের পর নীতা তার স্বামী প্রসূনকে সঙ্গে নিয়ে দীনগোপালের কাছে এসেছিল, হনিমুনে আসার মতোই, তখন দীনগোপালের মনে সন্দেহ জেগেছিল ওদের দাম্পত্য-সম্পর্কে কোথায় যেন কিসের একটা অভাব আছে। তার চেয়ে বড় কথা, প্রসূনকে পছন্দ হয়নি দীনগোপালের। আর নবও চুপিচুপি বলেছিল, জামাইবাবু লোকটা সুবিধের নয়, বাবুমশাই! মহুয়ার মদ কোথায় পাওয়া যায় জিগ্যেস করছিলেন।

নীতা একটা আফিসে স্টেনো-টাইপিস্টের চাকরি করে। তাকেও বারবার ডেকেছেন দীনগোপাল, আমার কাছে এসে থাক্। কী দরকার চাকরি করার? নীতার এক কথা, কলকাতা ছেড়ে থাকতে পারবে না। তবে মাঝে মাঝে। বেড়াতে যেতে তার আপত্তি নেই।

দীনগোপালের গোপন পক্ষপাতিত্ব নীতার প্রতিই। তার জন্য তার বেশি মমতা। তাই ভাবেন, বরং উইল করে নিজের যা কিছু আছে, নীতার নামেই দেবেন। কিছুদিন আগে ফিরোজাবাদে তার অ্যাটর্নির সঙ্গে এ নিয়ে শলাপরামর্শ করেও এসেছেন। তারপর হঠাৎ নীতা চলে এল। গতকালও ভাবছিলেন, ফিরোজাবাদে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলবেন। নীতাকে দেখে তার কষ্ট হচ্ছিল। কী উজ্জ্বল দীপ্তি ছিল চেহারায়, ক্ষয়ে গেছে একেবারে। দীনগোপাল ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলেন। একটু পরে তার ভাবনা মোড় নিল। অবাক হয়ে গেলেন। গতকাল সন্ধ্যায় একের পর এক করে দীপ্তেন্দু, অরুণ, প্রভাতরঞ্জন এবং শেষে শান্ত এসে হাজির। কৈফিয়তটা বড্ড হাস্যকর আর রহস্যময়। এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছেন। না। বাসস্টপেবাসস্টপে ঘুরে একটা দাড়িওয়ালা কালো চশমাপরা লোক কেনই বা ওদের অমন একটা উদ্ভট কথা বলে সরডিহি পাঠিয়ে দেবে, বিপদটাই বা কী, নাকি সবাই মিলে ওঁর সঙ্গে তামাশা করতে এসেছে, কিছু বোঝা যায় না।

তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন দীনগোপাল। ভুরু কুঁচকে গেল। ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সমস্ত ব্যাপারের পেছনে একটা ক্রুর অভিসন্ধি ওঁত পেতে আছে যেন। বাসস্টপের লোকটা..

অথবা সবটাই ওই প্রভাতরঞ্জনের কারসাজি। ওঁকে বোঝা কঠিন। রাজনীতিওয়ালারা দীনগোপালের চক্ষুশূল। তবে এমনিতে প্রভাতরঞ্জন বেশ মনখোলা মানুষ। তাছাড়া নীতার বাবার সঙ্গে নিজের বোনের বিয়ের ঘটকালি তিনিই করেছিলেন–এর সঙ্গে দীনগোপালের সঙ্গে তার পূর্ব পরিচয় এবং বন্ধুতার সূত্র ছিল। রাজনীতি করার সময় ফেরারি আসামী প্রভাতরঞ্জন কতবার দীনোপালের বাড়িতে এসে লুকিয়ে থেকেছেন। খনি এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ছিলেন তখন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ চালাতেন। কিন্তু যখনই দীনগোপাল বুঝতে পারতেন, তার বাড়িটি রাজনীতির ঘাঁটি হয়ে উঠেছে, তখনই সোজা প্রভাতরঞ্জনকে বলতেন–আর নয় হে! এবার তল্পি গোটাও। প্রভাতরঞ্জনের এই একটা গুণ, তার ওপরে রাগ করতেন না। একটু বেহায়া ধাতের মানুষ বটে। ফের কোনও এক রাতে এসে হাসিমুখে হাজির হতেন।

কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দীনগোপাল উদ্বিগ্ন হয়ে হাঁটছিলেন। টিলাগুলোর কাছাকাছি রাস্তার চড়াই শুরু। এবার একটু ক্লান্তি এল। বাঁদিকে ঝোঁপজঙ্গল আর ন্যাড়া পাথুরে মাটি ঘিরে টিলার দিক থেকে একটা ঝিরঝিরে জলের ধারা এসে ছোট্ট সাঁকোর তলা দিয়ে চলে গেছে। সাঁকোর ধারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন।

ততক্ষণে কুয়াশা কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। পেছনে পুবের আকাশে লালচে ছটা। সূর্য উঠেছে, তবে সরডিহির আড়ালে রয়েছে এখনও। বাঁদিকে ঝরনাধারার গা ঘেঁষে সামান্য দূরে সেই টিলাটা আবছা দেখা যাচ্ছে। মাথার পিপুল গাছটায় লাল রঙের ছোপ পড়েছে। কাছিমের খোলার গড়ন টিলাটার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখের কোনা দিয়ে আবার লক্ষ্য করলেন, কিছুদিন ধরে যা ঘটছে, একটা আবছা মানুষমূর্তি!

কেউ ঝোঁপগুলোর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে নিশ্চল দাঁড়িয়ে দেখছে যেন।

ঘুরে সোজাসুজি তাকাতেই আর তাকে দেখতে পেলেন না দীনগোপাল। অভ্যাসমতো কে ওখানে’ বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, কিন্তু কথাটি উচ্চারণ করলেন না। সোজাসুজি তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই টিলাটাও নজরে পড়েছিল। একটা লোক পিপুল গাছের নিচে এইমাত্র উঠে দাঁড়াল।

মুহূর্তে ক্ষিপ্ত দীনগোপাল ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। খোলা পাথুরে জমিটার ওপর দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ মনে হলো, চোখের কোনা দিয়ে অন্যদিনের মতো যে-ছায়ামূর্তি দেখেন, সে কোন মন্ত্রবলে একেবারে টিলার মাথায় চলে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে?

টিলার শীর্ষে কুয়াশা হাল্কা হয়ে গেছে এবং ঈষৎ রোদ্দুরও পড়েছে। লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ চোখে ছানি, কিন্তু ডান চোখটা অক্ষত। দীনগোপালের দৃষ্টিশক্তি বরাবর প্রখর। একটা চোখে পরিষ্কার দূরের জিনিস দেখতে পান। চশমার দরকার হয়নি এখনও। পিপুল গাছের তলায় দাঁড়ানো লোকটির পরনে ওভারকোট, মাথায় টুপি, একটা হাতে ছড়ি বলেই মনে হচ্ছে। মুখে একরাশ সাদা দাড়ি। অন্য হাতে কী একটা যন্ত্র ধরে চোখে রেখেছে এবং দূরে পুবদিকে কিছু দেখছে। দূরবীন বা বাইনোকুলার মনে হলো।

দীনগোপাল টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। এই সময় চোখ থেকে যন্ত্রটি নামিয়ে লোকটি দীনগোপালের দিকে ঘুরে তাকাল। দীনগোপাল নিচে থেকে রুষ্টভাবে চেঁচিয়ে বললেন–ও মশাই! শুনছেন? কে আপনি? ওখানে কী করছেন?

জবাব না পেয়ে আরও রুষ্ট দীনগোপাল ঢালু টিলা বেয়ে উঠে গেলেন। তারপর থমকে দাঁড়ালেন। সাদা দাড়িওয়ালা লোকটির চেহারায় মার্জিত এবং অমায়িকভাব। রীতিমতো সাহেবসুবো মনে হলো। উজ্জ্বল ফর্সা রঙ। সরডিহি গির্জার পাদ্রি সলোমন সায়েবের প্রতিমূর্তি!

নমস্কার! আশা করি, আপনিই দীনগোপালবাবু?

বিস্মিত দীনগোপাল কপালে হাত ঠেকালেন, নিছক ভদ্রতাবশে তার মনে পড়েছিল একটা দাড়িওয়ালা লোক দীপ্তেন্দুদের সরডিহি আসতে প্ররোচিত করেছে এবং তার মতলব বোঝা যাচ্ছে না। এই লোকটিই সেই লোক কি? অবশ্য তার দাড়ির রঙ সাদা না কালো ওরা বলেনি। কিন্তু কথাটা হলো, এঁকে দেখে তো অত্যন্ত সজ্জন ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। কণ্ঠস্বরও অমায়িক। শুধু হাতের ওই দুটো জিনিস সন্দেহনক। বাইনোকুলারটা, এবং একটা ছড়িনয়, ডগার দিকে জালের গোছা জড়ানো! জিনিসটা কী?

দীনগোপাল একটু দ্বিধায় পড়ে বললেন–মশাইকে তো আগে কখনও দেখিনি! আপনি কে?

আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

–আপনি কর্নেল? দীনগোপাল একটু অবাক হয়ে বলেনে। মানে মিলিটারির লোক?

ছিলাম। বহু বছর আগে রিটায়ার করেছি।

–অ। তা আপনি এখানে..

–আপনার মতোই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছি।

–আপনি আমার নাম বললেন! অথচ আপনার সঙ্গে আমার কস্মিনকালে চেনাজানা নেই!

–আপনার কথা আমি শুনেছি। কাল বিকেলে আপনাকে দূর থেকে বাইনোকুলারে দেখেছিও।

দীনগোপাল সন্দিগ্ধভাবে বললেন–আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আপনি থাকেন কোথায়?

কলকাতায়। গতকাল আমি সরডিহিতে বেড়াতে এসেছি। উঠেছি ইরিগেশান বাংলোয়।

দীনগোপাল ফের ওঁর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, বুঝলাম। কিন্তু আমার কথা কে আপনাকে বলল? বলার কোনও স্পেসিফিক কারণই বা কী?

–সরডিহিতে বাঙালিদের মধ্যে আপনার যথেষ্ট সুনাম আছে। আর আমার স্বভাব, যেখানে যাই, সেখানকার মানুষজন সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিই।

দীনগোপাল এবার হাল্কা মনে একটু হাসলেন–ভাল। খুব ভাল। তা ওই যন্তরটা দিয়ে কী দেখছিলেন?

–পাখি। বার্ড-ওয়াচিং আমার হবি।

–হুঁ। আর ওটা কি যন্তর?

–এটা প্ৰজাপিত ধরা জাল। বিশেষ কোনও স্পেসির প্রজাপিত দেখলে ধরার চেষ্টা করি!

দীনগোপাল হাসতে লাগলেন। কলকাতার লোকেদের মাথায় সব অদ্ভুত বাতিক থাকে দেখছি। তবে আপনার বাতিক বড্ড বেশি উদ্ভুটে, কর্নেলসায়েব!

–আচ্ছা দীনগোপালবাবু, আপনি সরডিহিতে এ বয়সে একা পড়ে আছেন কেন?

দীনগোপালের হাসি মুছে গেল। আস্তে বললেন–হঠাৎ এ প্রশ্নের অর্থ?

–নিছক কৌতূহল, দীনগোপালবাবু!

দীনগোপাল চটে গেলেন আরও।অদ্ভুত কৌতূহল! চেনা নেই, জানা নেই, হঠাৎ কোত্থেকে এসে এই উটকো প্রশ্ন। আপনার কি অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর স্বভাব, নাকি আপনি–

বলুন, দীনগোপালবাবু।

দীনগোপাল ক্রুদ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন-কে আপনি? কেন এমন আজগুবি প্রশ্ন করছেন?

প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেন না! আমি আপনার হিতৈষী।

–কোনও উটকো লোকের এই উদ্ভট প্রশ্নের জবাব দিতে আমি রাজি নই–তা আপনি মিলিটারির কোনও কর্নেল হোন, আর যেই হোন। বলে দীনগোপাল সটান ঘুরে টিলা বেয়ে নামতে থাকলেন। আপন মনে গজগজ করছিলেন–কেন এখানে একা পড়ে আছি! যাবটা কোথায়? সরডিহি আমার ভাল লাগে। একলা থাকতে ভাল লাগে। অদ্ভুত কথা তো! তারপর হঠাৎ থেমে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বিকৃত কণ্ঠস্বরে বললেন–জালনোটের কারখানা খুলেছি, বুঝলেন, চোরাচালানের কারবার করছি। আরও শুনবেন? মেয়ে পাচারের ঘাঁটি গড়েছি। নার্কোটিক্স চালানও দিই। ডাকাতের দল পুষি।…

একটু পরে রাস্তায় পৌঁছে আবার ঘুরে টিলার মাথায় কর্নেলকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টে দেখে নিলেন। কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার। তারপর দ্রুত টিলার অন্যদিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দীনগোপালের শরীর অবশ। মনে হলো, আর এক পাও হাঁটতে পারবেন না।

কিছুক্ষণ পরে উত্তেজনা কেটে গেল। ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। বহু বছর আগে এক সন্ন্যাসী তাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে এমন আকস্মিকতা ছিল না। ছিল না এমন একটা রহস্যময় পরিপ্রেক্ষিতও। সন্ন্যাসী বলেছিলেন, একলা পড়ে আছ বেটা! এই একলা থাকাটাকে কাজে লাগাও। জেনো একলা থাকা মানুষই যোগী হতে পারে। আর যোগী কেনা, যে যোগ করে। যোগ কিসের সঙ্গে? মনের সঙ্গে আত্মার যোগ। এই যোগ সময়কে থামিয়ে দেয়। সময় বলে কোনও জিনিস তখন থাকে না। অথচ আত্মা থাকে। আনন্দের মধ্যে লীন হয়ে থাকে।

সাধুসন্ন্যাসীদের সবই হেঁয়ালি। সেটা একটা দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাপার। কিন্তু ওই ভদ্রলোককর্নেল! তার হঠাৎ এই হেঁয়ালির মানেটা কী? কেন এ প্রশ্ন–অতর্কিতে?…

শান্তকে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে এবং বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়েও জাগাতে পারেনি নীতা। কোনও সাড়াও পায়নি। বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে এসেছিল। শান্ত এমন মড়ার মতো ঘুমোয়, সে জানত না।

লনে অরুণকে নিয়ে তখন খুব হাসাহাসি হচ্ছে অরুণ ‘মার্ডার’ বলে ঝাঁপ দিতে গিয়ে সিঁড়িতে আছাড়া খাওয়ার উপক্রম, সেটাই সবচেয়ে হাসির ব্যাপার। নীতাকে দেখে প্রভাতরঞ্জন হাঁকলেন–দীনুদা? অর্থাৎ নবর কথা সত্যি কি না। নীতার মুখে দীনগোপালের ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা আটকানো শুনে তিনি গুম হয়ে বললেন-দীনুদাটা চিরকাল এরকম একগুঁয়ে মানুষ। কোনও মানে হয়? ওর সেফটির জন্য আমরা সারারাত জেগে পাহারা দিলাম, আর দিব্যি একা বেড়াতে বেরুল? এভাবে রিস্ক নেবার কোনও মানে হয়?

–অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল–মামাবাবু, চলুন, আমরা জ্যাঠামশাইকে গিয়ে দেখি–কোনও বিপদ ঘটল নাকি! দীপু তুইও আয়।

দীপ্তেন্দু বলল, হ্যাঁ। আমাদের যাওয়া উচিত। এতক্ষণ নিশ্চয় বেশি দূরে যেতে পারেননি।

ওরা তিনজনে শশব্যস্তে পা বাড়ালে পেছন থেকে ঝুমা বলল–আহা, সশস্ত্র হয়ে যাও। বল্লমটা অন্তত হাতে নাও!

সে মুখ টিপে হাসছিল। নীতাও হেসে ফেলল। কারণ বউয়ের কথায় সত্যিই অরুণ বল্লমটা দীপ্তেন্দুর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল। গেট খুলে দিল নব। দীনগোপাল বেরুনোর সময় বাইরে থেকে গরাদ দেওয়া গেটে তালা আটকে দিয়েছিলেন।

নব ফিরে এসে বলল–আপনাদের জন্য চা করে দিই ততক্ষণ। ওঁরা ফিরে এলে তখন ফের করে দেব।

ঝুমা বলল–আমার কিন্তু র। দুধ দেবে না।

 নব কিচেনে গিয়ে ঢুকলে নীতা লনে নামল। ডাকল–এসো বউদি, মর্নিং ওয়াক করি ততক্ষণ।

ঝুমা বলল-বড্ড কুয়াশা। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। রোদ্দুর উঠতে দাও না।

নীতা বলল–আমার ঠাণ্ডা লাগবে না। গত দুদিনই জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছি। কতদূরে জানো? সেই টিলাগুলো অব্দি। এসো না বউদি, গেটে গিয়ে দেখি মামাবাবুরা কোনদিকে গেলেন!

ঝুমা অনিচ্ছা অনিচ্ছা করে লনে নামল। তারপর নীতার পাশে গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল-জ্যাঠামশাই যেদিকে গেছেন, দেখবে ওরা ঠিক তার উল্টোদিকে গেছে।

নীতা হাসল।–শান্তদাকে ডেকে ওঠাতে পারলাম না। ও দলে থাকলে সুবিধে হতো। দুজন করে দুদিকে খুঁজতে যেত। জ্যাঠামশাই কোনও কোনও দিন উল্টোদিকে ক্যানেলের সুইসগেটের কাছেও যান।

–শান্ত উঠল না?

 –নাঃ। একেবারে কুম্ভকর্ণ।

 গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে নীতা নিচের রাস্তায় দুদিকে দলটাকে খুঁজছিল। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে চাদরটা এতক্ষণে মাথায় ঘোমটার মতো টেনে দিলে ঝুমা আস্তে বলল–শান্তর বিয়ের কথা বিশ্বাস হয় তোমার?

নীতা বলল–ও জ্যাঠামশাইয়ের মতো আনপ্রেডিক্টবল। শুনলে তো, রাত্তিরে জ্যাঠামশাইয়ের সামনেই জোর দিয়ে বলল, বিয়ে করেছে।

–কিন্তু বউকে সঙ্গে আনল না কেন?

হয়তো এমন একটা সিচুয়েশানে সঙ্গে আনা ঠিক মনে করেনি। ঝুমা একটু পরে বলল–আমার বিশ্বাস হয় না।

কেন?

ঝুমা একটু গম্ভীর মুখে বলল–বিবাহিত পুরুষ চেনা যায়। অন্তত আমি চিনতে পারি।

নীতা হাসতে হাসতে বলল–কোনও বিশেষ লক্ষণ দেখে বুঝি? কী লক্ষণ? শারীরিক না মানসিক!

–দুই-ই।

 নীতা দুই কাঁধে এবং হাতে আঁকুনি দিয়ে একটা ভঙ্গি করে বলল–কে জানে বাবা! আমি ওসব বুঝিটুঝি না।

নব ডাকছিল।..দিদি বউদিদি! চা রেডি।

ঝুমা বলল–এখানে দিয়ে যাও!

নীতা বলল–ঠাণ্ডার ভয়ে বেরুচ্ছিলে না বউদি। এখন কেমন এনজয় করছ দেখ।

নব চা নিয়ে এল। নীতা বললনবদা! তুমি গিয়ে দেখো তো, শান্তদাকে ওঠাতে পারো নাকি।

ঝুমা আস্তে বলল–ওকে বলবে একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। ব্যস্। দেখবে হইহই করে বেরিয়ে পড়বে।

নব গম্ভীর মুখে চলে গেল। নীতা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল–এবার এসে এবং জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আমার মধ্যে একটা দারুণ চেঞ্জ ঘটেছে, জানো বউদি?

কী চেঞ্জ?

সরডিহিতে থেকে যেতে উচ্ছে করছে। বেশ নিরিবিলি সুন্দর ন্যাচারাল স্পট। কলকাতায় থাকলে রাজ্যের উটকো প্রব্লেম এসে ব্রেনকে ঘুলিয়ে তোলে। নীতা শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে বলতে লাগল। এখানে এসে সেগুলো একেবারে অর্থহীন লাগছে। আসলে আর্বান লাইফে সবসময় কতকগুলো কৃত্রিম সমস্যা। মানুষকে ব্যস্ত করে রাখে। এখানে কিন্তু কোনো সমসাই নেই।

–আছে। হঠাৎ করে দুদিন এসে থেকে-টেকে সেটা বোঝা যায় না।

–উঁহু। তুমি জ্যাঠামশাইয়ের কথা ভাবো বউদি! দিব্যি আছেন।

–কোথায় আছেন? ঝুমা অন্যমনস্কভাবে বলল।কী জন্য তাহলে তোমরা ছুটে এসেছ, ভেবে দেখো। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। সরডিহি, আফটার অল অন্য প্ল্যানেট তো নয়।

নীতা একটু চুপ করে থাকার পর বলল–এটা একটা আনইউজুয়্যাল ব্যাপার। হয়তো সত্যি কেউ জোক করেছে কোনও উদ্দেশ্যে। তবে যাই বলো, আমি সরডিহির প্রেমে পড়ে গেছি।

ঝুমা বাঁকা হেসে বলল তুমি তো চিরপ্রেমিকা। হুট করতেই প্রেমে পড়ো এবং সাফার করো।

নীতা একটু চটে গেল খোঁচা খেয়ে। কিন্তু কিছু বলল না। গম্ভীর হয়ে দূরে তাকিয়ে রইল।

–এই তো! রাগ করলে! এজন্যই নাকি মুনি-ঋষিরা বলেছেন অপ্রিয় সত্য কক্ষনো বলো না। ঝুমা তার কাছে গেল।-সরি, নীতা। অ্যাপলজি চাইছি।

নীতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও হেসে ফেলল ওর ভঙ্গি দেখে। তারপর বলল–কিন্তু নব যে শান্তদাকে ওঠাতে গেল! পাত্তা নেই কেন?…

.

দীনগোপাল থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বল্লমধারী অরুণ এবং প্রভাতরঞ্জনকে দেখে। প্রভাতরঞ্জন ওঁর মুখের রাগী ভাব দেখে আমতা-আমতা করে বললেন– মানে, আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম দীনুদা!

দীনগোপাল রূঢ় স্বরে বললেন–তোমাদের এ পাগলামি সত্যি বরদাস্ত হচ্ছে .. না।

অরুণ বলল–কিন্তু জ্যাঠামশাই, যাই বলুন, এভাবে আর আপনার একা বেরুনো উচিত হয়নি।

উচিত অনুচিতের ব্যাপারটা আমি বুঝব। দীনগোপাল পা বাড়িয়ে বললেন– তোমাদের মতলব আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।

মাই গড! অরুণ হতভম্ব হয়ে বলল।–এ আপনি কী বলছেন জ্যাঠামশাই?– আমরা এতগুলো লোক সব্বাই আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছি? কী আশ্চর্য! বাসস্টপে সত্যি একটা লোক–সে অভিমানে চুপ করল।

দীনগোপাল জবাব দিলেন না। প্রভাতরঞ্জন বললেন দীনুদা, তুমি কিন্তু আমাকেই আসলে অপমান করছ। আমাকেও তুমি মিথ্যাবাদী বলছ, মাইন্ড দ্যাট।

দীনগোপাল তবু চুপচাপ হাঁটতে থাকলেন।

প্রভাতরঞ্জন ক্ষুব্ধভাবে বললেন–তোমার সেফটির জন্য আমরা এত কাণ্ড করছি কাল থেকে। আর তুমি এর মধ্যে মতলব দেখছ। কী মতলব? তোমার ভাইপো-ভাইঝিদের মতলব থাকার কথা–অবশ্যি, আছে তা বলছি না–জাস্ট একটা সম্ভাবনা। কারণ তোমার কিছু প্রপার্টি হয়তো আছে কী বা কতটা আছে, তাও আমি জানি না। কিন্তু আমি? আমার কী মতলব থাকতে পারে! তুমি একসময়ে আমাকে দুর্দিনে আশ্রয় দিয়েছ। সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েছ। আমি তোমার কাছে ঋণী। তাছাড়া বরাবর আমি তোমার হিতৈষী।

–হঠাৎ ভূঁইফোড় হিতৈষীদের জ্বালায় আমি অস্তির। দীনগোপাল বাঁকা হাসলেন।–একটা আগে একটা অদ্ভুত লোকের সঙ্গে দেখা হলো। সেও হঠাৎ বলে কিনা–আমি আপনার হিতৈষী।

প্রভাতরঞ্জন ও অরুণ দুজনেই চমকে উঠেছিল। একগলায় বলল, লোক!

-হ্যাঁ। তারও মুখে দাড়ি আছে।

ফের দুজনে একগলায় বলে উঠল-দাড়ি!

-হ্যাঁ দাড়ি, সাদা দাড়ি। দীনগোপাল আগের সুরে বললেন। পাদ্রি সলোমন সায়েবের মতো পেল্লায় চেহারা। হাতে বাইনোকুলার আর প্রজাপতি-ধরা নেট। সরডিহিতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত সব লোক আসে। তবে কেউ এ পর্যন্ত আমাকে বলেনি, আমি আপনার হিতৈষী।

প্রভাতরঞ্জন খুব ব্যস্তভাবে বললেন–তাহলে তো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে পড়ল। লোকটার পরিচয় নিলে না কেন?

দীনগোপাল এবার একটু হাল্কা মেজাজে বললেন বলল, মিলিটারির লোক ছিল। কর্নেল!..হুঁ, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইরিগেশান বাংলোয় উঠেছে বলল।, অরুণ বলল–খোঁজ নেওয়া দরকার। কিন্তু আগাগোড়া একটু ডিটলেস বলুন তো জ্যাঠামশাই!

দীনোপাল বললেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

অরুণ প্রভাতরঞ্জনকে বলল–মনে হচ্ছে এ লোক বাসস্টপের লোকটা নয়, মামাবাৰু! তাই না?

প্রভাতরঞ্জন বললেন–হ্যাঁ। আমাদের প্রত্যেকের বর্ণনা মিলে গেছে। দাড়ির কথা ধরছি না। নকল দাড়ি সাদা বা কালো দুই-ই হয়। কিন্তু গড়ন? দীনুদা বলল, পেল্লায় চেহারা–পাদ্রি সলোমনের মতো। এই পাদ্রি ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে।

অরুণ বলল–আমিও তাকে দেখছি।

–হু, অরুণ! চিন্তিত মুখে প্রভাতরঞ্জন বললেন। তুমি এখনই ইরিগেশান বাংলোয় গিয়ে খোঁজ নাও, সেখানে সত্যি কোনও কর্নেল-টর্নেল এসেছেন কি না। তারপর যা করার করব’খন। দীপুকে ওদিকে পাঠিয়েছি। দেখা হলে ওকে সঙ্গে নিও।

অরুণ তার হাতে বল্লমটা গছিয়ে দিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল। দীনগোপাল বললেন–সঙ! জোকার একটা! সার্কাসের ক্লাউন!

প্রভাতরঞ্জন ব্যথিতস্বরে বললেন–আমাকে বলছ!

না ওই অরুণটাকে। বলে দীনগোপাল ভুরু কুঁচকে একবার প্রভাতরঞ্জনকে দেখে নিলেন। একটু পরে গলা ঝেড়ে ফের বললেন–এভাবে বল্লম হাতে আমার সিকিউরিটি গার্ড সেজে পাশে পাশে হেঁটো না। আমার খারাপ লাগছে। তুমি এগিয়ে যাও। আমি একটু পরে যাব।

দীনগোপাল রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একটা প্রকাণ্ড, পাথরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রভাতরঞ্জন বললেন–ওকে দীনুদা! সিকিউরিটি গার্ড তো সিকিউরিটি গার্ড। আমি তোমাকে একলা ফেলে রেখে যাচ্ছি না।

–খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, প্রভাত!

দীনগোপাল খাপ্পা মেজাজে কথাটা বললেন। কিন্তু গ্রাহ্য করলেন না প্রভাতরঞ্জন। বল্লমটা সঙ্গিনের মতো কাঁধে রেখে সকৌতুকে সান্ত্রীর স্যালুট ঠুকলেন। দীনগোপাল অমনি রাস্তা থেকে ঢালুতে নেমে হনহন করে উত্তরে ব্লাড় জমিটার দিকে হেঁটে চললেন। জমিটার নিচের দিকে কিছু গাছপালা তারপর ক্যানেল। প্রভাতরঞ্জন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর তাকে অনুসরণ করলেন। কিন্তু ক্যানেলের পাড়ে গিয়ে আর দীনগোপালকে দেখতে পেলেন না। পাড় বরাবর ঘন ঝোঁপঝাড়। প্রভাতরঞ্জন বারকতক ‘দীনুদা’ বলে ডাকাডাকি করার পর তেতো মুখে আপন মনে, বললেন বদ্ধ পাগল! জানে না কী বিপদ ঘটতে চলেছে।

তারপর তাকে খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। ততক্ষণে রোদ্দুর ফুটেছে এবং কুয়াশা হাল্কা হয়ে গেছে। কিন্তু ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দীনগোপাল গুঁড়ি মেরে কোনদিকে নিপাত্তা হলেন, প্রভাতরঞ্জন বুঝতে পারছিলেন না। ক্যানেলটা পুব-পশ্চিমে লম্বা। প্রথমে পশ্চিমেই পা বাড়ালেন প্রভাতরঞ্জন।

নীতা বলল–ধুস! নব শান্তদাকে ডাকতে গিয়ে নিপাত্তা হয়ে গেল যেন।

আমি ভাবছি মামাবাবু আর তোমার শ্রীমান দাদাটির কথা। ঝুমা হাসতে হাসতে বলল। জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে গেল, হাতে বল্লম! জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে এতক্ষণ যুদ্ধ বেধে গেছে!

নীতা আনমনে বলল–কেন?

ঝুমা প্রশ্নে কান না দিয়ে বলল–লাঠি ভার্সেস বল্লম। বল্লমটা অবশ্য লাঠির ঘায়ে ধরাশায়ীনীতা! দেখো, দেখো! যা বলছিলাম। তোমার শ্রীমান দাদা জগিং করছে। অথবা তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসছে। আরে! ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

নীতা গেট থেকে দেখল অরুণ জগিংয়ের ভঙ্গিতে নিচের রাস্তা দিয়ে উধাও হয়ে গেল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ডাকবে বলে ঠোঁট ফাঁক করেছিল, কিন্তু সুযোগ পেল না। অরুণ দ্রুত নাগালের বাইরে চলে গেল।

ঝুমা বলল কিছু মনে কোর না নীতা! তোমাদের বংশে পাগলদের সংখ্যা বড্ড বেশি।

–ঠিকই বলেছ বউদি! নীতা হাসল। আই এগ্রি। ওই দেখো, উল্টোদিক থেকে দীপুদা এসে গেছে।

অরুণ এবং দীপ্তেন্দুকে মুখোমুখি দুটি ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়ানো দেখা যাচ্ছিল। তারপর দুজনে কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ঝুমা ব্যাপারটা দেখার পর মন্তব্য করল–একটা ব্যাপার বোঝা গেল। জ্যাঠামশাইকে এখনও ওরা খুঁজে পায়নি।

তাকে এবার একটু গম্ভীর দেখাচ্ছিল। নীতা বলল–আমার ধারণা, জ্যাঠামশাই খুব বিরক্ত হয়েছেন।

–হবারই কথা! ঝুমা ওর হাত ধরে টানল। বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে এখানে। চলো, ঘরে গিয়ে বসি।

লন পেরিয়ে দুজনে বাইরের বারান্দায় পৌঁছে ওপরতলায় নবর হাঁকাহাঁকি এবং দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনতে পেল। ঝুমা বলল–কী আশ্চর্য! সেই তখন থেকে নব ওকে ওঠাতে পারছে না? কী কুম্ভকর্ণ রে বাবা!

সে দ্রুত ঘরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকল। পেছনে নীতা। ওপরে গিয়ে ওরা দেখল, নব এবার দরজায় উদ্ভান্তের মতো লাথি মারতে শুরু করেছে। ঝুমা দম আটকানো গলায় বলল, সাড়া পাচ্ছ না?

সেই মুহূর্তে পুরনো দরজার একটা কপাট মড়াৎ করে ভেঙে গেল এবং নব আবার লাথি মারলে সেটা প্রচণ্ড শব্দে জং ধরা কজা থেকে উপড়ে ভেতরে পড়ল। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল নব। তারপরই সে চেঁচিয়ে উঠল–দাদাবাবু! সর্বনাশ!

দরজা থেকে নীতা ও ঝুমা উঁকি মেরে দেখেই আঁতকে পিছিয়ে এলো। ঝুমা দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। নীতা দেয়াল আঁকড়ে ধরেছিল। ঠোঁট কামড়ে আত্মসংরণের চেষ্টা করছিল সে। ঘরের মাঝামাঝি কড়িকাঠ থেকে শান্ত ঝুলছে। গলায় একটা মাফলারের ফাঁস আটকানো। ঝুলন্ত পায়ের একটু তফাতে একটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে।

নীতা ভাঙা গলায় অতিকষ্টে ডাকল–নব!

নব বেরিয়ে এল। কিন্তু কোনও কথা বলল না। পাথরের মূর্তির মতো মাঝখানের অপ্রশস্ত করিডর থেকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির মাথায় একটু দাঁড়াল। কিছু বলবে মনে হলো এবার। কিন্তু বলল না। সশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। ঝুমা তখনও দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীতা দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল।