বিকল্প
দরজা খুলে নাসরীন দেখল জাহিদের পিছনে আরেকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এবং মানুষটির চেহারা অস্বাভাবিক সুন্দর, শুধুমাত্র সিনেমার পত্রিকাতেই এ রকম সুন্দর চেহারার মানুষ দেখা যায়। জাহিদের সাথে একটু আগেই ভিডিফোনে কথা হয়েছে, সে সাথে আরো কাউকে নিয়ে আসবে বলে নি। বললে ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখা যেত, সে নিজেও চট করে শাড়িটা পাল্টে নিতে পারত। নাসরীন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জাহিদ ইচ্ছে করে তার সাথে এ রকম ব্যবহার করে। এ রকম সুপুরুষ একজন মানুষের সামনে সে এভাবে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেবে তার নিজের উপরেই কেমন জানি রাগ উঠে যায়।
জাহিদ নাসরীনকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল, সে যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্যাপারটিও যেন তার চোখে পড়ে নি। সুপুরুষ মানুষটা কী করবে বুঝতে না পেরে জাহিদের পিছনে পিছনে ঘরে এসে ঢুকল, তার চোখেমুখে হতচকিত একটা ভাব।
জাহিদ টেবিলে ব্রিফকেসটা রেখে টাইয়ের গিটটা একটু ঢিলে করতে করতে বলল, আমার একটা জরুরি ভিডিফ্যাক্স আসার কথা ছিল।
নাসরীন মুখ শক্ত করে বলল, এসেছে।
ভিডিফ্যাক্সের কথা শুনে জাহিদের মুখের চেহারা একটু নরম হয়ে আসে। সে মাথা নেড়ে বলল, গুড। আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো
নাসরীন নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে, ইচ্ছে হল বলে তুমি নিজে ঢেলে নাও। কিন্তু ঘরে একজন বাইরের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, সে কিছু বলল না। ফ্রিজের কাছে গিয়ে বোতাম টিপে এক গ্লাস পানি বের করে এনে দেয়। জাহিদ পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে গলা দিয়ে এক ধরনের বিশ্রী শব্দ করল। নাসরীন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন বাইরের মানুষের সামনে জাহিদ এ রকম একটা আচরণ করতে পারে। সে নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত করে বলল, ইনি কে?
জাহিদ মাথা ঘুরে তাকাল, যেন সে বুঝতে পারছে না নাসরীন কার কথা বলছে। সুপুরুষ মানুষটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, এই?
হযা। নাসরীন শান্ত গলায় বলল, তুমি এখনো আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও নি
জাহিদ উত্তর না দিয়ে হা হা করে হাসতে থাকে এবং এক সময় হাসি থামিয়ে বলল, এটাকে তুমি মানুষ ভেবেছ?
নাসরীন হকচকিয়ে গেল, বলল, তাহলে
এটা রবোট।
নাসরীন অবাক হয়ে সুপুরুষ মানুষটার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার কেন জানি এক ধরনের আশাভঙ্গের অনুভূতি হয়। সে আবার তার বুকের ভিতরে একটি নিশ্বাস ফেলল, তার আগেই বোঝা উচিত ছিল, এ রকম নিখুঁত সুপুরুষ একজন মানুষ সত্যি সত্যি পাওয়া যায় না, তাকে তৈরি করতে হয়।
মনে নেই আমি বলেছিলাম আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব বলেছিলেন আমাকে। একটা রবোট দেবেন, ট্রায়াল হিসেবে।
নাসরীন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বল নি।
বলি নি? জাহিদ অবাক হবার এক ধরনের দুর্বল অভিনয় করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ভেবেছিলাম বলব। ভুলে গেছি।
কী বলতে ভুলে গিয়েছিলে? এখন বলবে?
আমাদের লোকাল ফ্যাক্টরিতে রবোট এসেম্বলি করছে, ট্রায়াল হিসেবে প্রথমে আমাদের নিজেদের মাঝে রবোটগুলো দিচ্ছে।
কেন?
জাহিদ অকারণে একটা হাই তুলল, বোঝা যাচ্ছে তার কথা বলার বিশেষ ইচ্ছে নেই। এটি নতুন নয়, দীর্ঘদিন থেকে সে নাসরীনের সাথে এ রকম ব্যবহার করে আসছে। নাসরীন কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার জিজ্ঞেস করল, কেন?
জাহিদ নেহাত অনিচ্ছার সাথে বলল এতদিন ফ্যাক্টরিতে এসেম্বলি লাইনে টেকনিক্যাল কাজে ব্যবহার করেছে। এখন দেখতে চায় গৃহস্থালি পরিবেশে ব্যবহার করা যায় কি না। আমাকে একটা দিয়েছে কয়দিন বাসায় রাখার জন্যে।
তোমাকে কেন?
কারণ আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব আমাকে পছন্দ করেন। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
আমি সিকিউরিটি ডিভিশনের মানুষ। কোনো ইমার্জেন্সিতে রবোটটাকে কিছু করতে হলে আমি করতে পারব। আমার কাছে ইমার্জেন্সি কোড রয়েছে।
জাহিদ নিচু হয়ে জুতোর ফিতা খুলতে গিয়ে হঠাৎ কী মনে করে থেমে যায়। সে তার পা উপরে তুলে সুপুরুষ মানুষটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, খোল দেখি জুতোটা।
নাসরীন কেমন জানি শিউরে ওঠে, কিন্তু রবোট মানুষটার কোনো ভাবান্তর হল না। সে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে জাহিদের জুতোর ফিতে খুলতে শুরু করে। একজন অত্যন্ত সুদর্শন মানুষ–হোক–না সে রবোট, নিচু হয়ে আরেকজনের পায়ের জুতো খুলে দিচ্ছে ব্যাপারটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। জাহিদ হাসি হাসিমুখে নাসরীনের দিকে তাকিয়ে বলল, এর নাম হচ্ছে আবদুল্লাহ।
আবদুল্লাহ?
সাথে সাথে রবোটটি নাসরীনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, জি। এখন আমার নাম আবদুল্লাহ।
রবোটটির গলার স্বর অপূর্ব, মনে হয় দীর্ঘদিন রেওয়াজ করে ভোকাল কর্ডে সুর বাধা হয়েছে। নাসরীন জিজ্ঞেস করল, এখন আপনার নাম আবদুল্লাহ? আগে অন্য নাম ছিল?
যখন যে প্রজেক্টে যাই তখন সেই প্রজেক্টের উপযোগী একটা নাম দেয়া হয়।
আপনার–
জাহিদ আবার হা হা করে খারাপভাবে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে বলল, এটা একটা রবোট, এর সাথে আপনি জি–হুজুর করার কোনো দরকার নেই।
নাসরীন রবোটটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আপনার মানে তোমার কি অনুভূতি আছে?
রবোটটি ঠিক তখন জাহিদের জুতোর ফিতা খুলে এনেছে, সে জাহিদের পা নিচে নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার মুখে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা হাসি কিংবা হাসির মতো একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। বলল, অনুভূতি একটা অত্যন্ত মানবিক ব্যাপার। রবোটের অনুভূতি আছে বলে দাবি করা হবে অত্যন্ত বড় ধরনের ধৃষ্টতা। তবে
তবে কী?
মানুষ যে পরিবেশে আনন্দ দুঃখ কষ্ট বা অপমান বোধ করে সপ্তদশ প্রজাতির রবোটের কপোট্রনেও ঠিক সেই পরিবেশে আনন্দ দুঃখ কষ্ট বা অপমান নামের মডিউলে এক ধরনের অসম পটেন্সিয়ালের জন্ম হয়। মানুষের অনুভূতির সাথে তার কোনো তুলনাই হয় না কিন্তু তবু আমাকে স্বীকার করতে হবে আমাদের কপোট্রনে এ ধরনের কিছু একটা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
জাহিদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, সেটা একটা মহা মূর্খামি হয়েছে।
আবদুল্লাহ নামের রবোটটি চুপ করে রইল। নাসরীন বলল, কেন, এটাকে মূর্খামি কেন বলছ?
কারণ মানুষের এই অনুভূতি দরকার। রবোটের কোনো দরকার নেই। রবোটকে যত খুশি অপমান করা যায়, রবোট অপমানিত হয় কিন্তু সে রাগ করতে পারে না। এই অনুভূতির মূল্য কী?
নাসরীন ভুরু কুঁচকে বলল, রবোটের ভিতরে যদি অনুভূতি থাকে তাহলে রাগ নেই কেন? রাগও তো একটা অনুভূতি!
জাহিদ আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, নিরাপত্তা। নিরাপত্তার জন্যে রবোটের মাঝে কোনো রাগ দেয়া হয় নি। সব রবোট হচ্ছে মাটির মানুষ।
কথা শেষ করে জাহিদ হা হা করে হাসতে থাকে। নাসরীনের ভুলও হতে পারে কিন্তু তার স্পষ্ট মনে হল আবদুল্লাহর চোখে এক ধরনের বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে।
রাতে খাবার টেবিলে আবদুল্লাহ নাসরীন এবং জাহিদকে খাবার পরিবেশন করল। জাহিদ চেয়ারে পা তুলে অত্যন্ত আয়েশ করে খেলেও নাসরীন কেন জানি ভালো করে খেতে। পারল না। একজন অত্যন্ত সুদর্শন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় তাদের খাওয়াচ্ছে ব্যাপারটা সে ঠিক গ্রহণ করতে পারল না, যদিও সে খুব ভালো করে জানে সুদর্শন মানুষটি একটি বোট ছাড়া আর কিছু নয়। খাবার টেবিলে বা অন্য কোথাও জাহিদ আজকাল নাসরীনের সাথে বেশি কথা বলে না, আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে মিনি ভিডি রিডার নিয়ে দূরপ্রাচ্যের একটি আইস হকি খেলাতে মগ্ন রইল। নাসরীন খানিকক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে আবদুল্লাহকে বলল, তোমার খিদে পায় না?
না। আবদুল্লাহ মাথা নাড়ল এবং মানুষের মতো হাসল। বলল, খিদে একটা অত্যন্ত মানবিক অনুভূতি। পৃথিবীর সভ্যতার একটা বড় অংশের জন্ম হয়েছে সুসংবদ্ধভাবে ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রচেষ্টার কারণে। সে কারণে মানুষেরা সভ্যতার জন্ম দিতে পারে, রবোটেরা কখনো সভ্যতার জন্ম দেবে না।
তোমরা যেভাবে অনুভূতির জন্ম দিয়েছ সেভাবে তো খিদের অনুভূতিটাও তৈরি করে নিতে পার।
আবদুল্লাহ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, আপনি অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটা কথা বলেছেন। সত্যি সত্যি সেটা করা হলে কী হবে সেটা জানার জন্যে আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে।
কী আর হবে। তোমরাও আমার সাথে বসে খাবে।
ক্ষুধা তৃষ্ণা থেকে মুক্ত কিন্তু প্রায় মানুষের কাছাকাছি বুদ্ধিমান কিছু একটা তৈরি করার সময় এক সময় রবোটকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু যদি তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলে কি মানুষ রবোট সম্পর্কে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে না?
আবদুল্লাহ কথা থামিয়ে হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি বেশ অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি আপনি কিন্তু কিছুই খাচ্ছেন না।
নাসরীন উত্তরে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই জাহিদ মুখভরা খাবার নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, এই শালা তো দেখি খালি নামেই রবোট। কথাবার্তায় তো দেখি ক্যাসানোভা!
জাহিদের কথা বলার ভঙ্গিটি ছিল কদর্য, নাসরীন আহত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ স্থির চোখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবদুল্লাহকে বলল, তুমি কিছু মনে কোরো না আবদুল্লাহ। আমার স্বামীর মানসিক পরিপক্কতা খুব বেশিদূর যেতে পারে নি। এগার–বার বছরের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেছে।
জাহিদ নাসরীনের কথা শুনে হঠাৎ ভিডি রিডার থেকে চোখ তুলে একবার আবদুল্লাহর দিকে তাকাল এবং একবার নাসরীসের দিকে তাকাল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বলল, তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এটা মানুষ না, এটা যন্ত্র। এর সাথে ভদ্রতা করার কোনো দরকার নেই, এর ভিতরে আছে লোহালক্কড় টিউব ব্যাটারি যন্ত্রপাতি
নাসরীন নিচু গলায় বলল, তার সাথে অভদ্রতা করারও কোনো দরকার নেই। তুমি শুনেছ সে নিজেই বলেছে তার ভিতরে এক ধরনের অনুভূতি রয়েছে।
বিছানায় শুয়েই জাহিদ ঘুমিয়ে পড়ে, আজকেও তাই হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। নাসরীন দীর্ঘ সময় অন্ধকারে একা একা শুয়ে থাকে। পাশের ঘরে একজন একা একা বসে আছে চিন্তা করে তার কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকে, মানুষটা একা একা কী করছে কে জানে। বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে শেষ পর্যন্ত সে বিছানা থেকে নেমে এল। নাসরীন হালকা পায়ে হেঁটে পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল। ঘরে আবছা অন্ধকার, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে ঘরে, সেই আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে আবদুল্লাহ পাথরের মূর্তির মতো বইয়ের শেলফের কাছে বসে আছে। নাসরীন মৃদু গলায় বলল, অন্ধকারে তুমি কী করছ?
বইগুলো দেখছি।
অন্ধকারে?
আমার কাছে আলো আর অন্ধকার নেই। আমার অবলাল সংবেদী চোখ দিয়ে আমি দৃশ্যমান আলো না থাকলেও দেখতে পারি। আমি অবলাল বা অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করতে পারি।
আবদুল্লাহ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আপনি এত রাতে কী করছেন?
ঘুম আসছিল না তাই উঠে এসেছি।
ঘুম?
হ্যাঁ।
ঘুম একটি জিনিস যার সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আপনার কেন ঘুম আসছে না? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খুব ঘুম পেয়েছে।
তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, আপনাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আপনি চমৎকার হালকা গোলাপি রঙের একটি নাইটি পরে আছেন।
নাসরীন নিজের অজান্তে নাইটিটা শরীরে ভালো করে টেনে নিতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, আমি আলো জ্বালাই?
জ্বালান।
অন্ধকারে আমি তোমার মতো দেখতে পাই না, আর কাউকে না দেখলে আমি তার সাথে কথা বলতে পারি না।
নাসরীন এগিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল। দেখা গেল শেলফের সামনে আবদুল্লাহ কয়েকটা বই হাতে নিয়ে উদাসীন মুখে বসে আছে। নাসরীন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বই দেখছ?
কবিতার বইগুলো। অত্যন্ত চমৎকার সংগ্রহ, আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
নাসরীন আরো একটু এগিয়ে এসে আগ্রহ নিয়ে বলল, তুমি কবিতা পড়?
আপনি যদি ধৃষ্টতা হিসেবে না নেন তাহলে বলব হ্যাঁ পড়ি
কার কবিতা তোমার ভালো লাগে
কবিতার প্রকৃত রস আস্বাদন করার ক্ষমতা আমার নেই। মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় আমার কপোট্রন খুব নিম্নস্তরের। আমার কাছে যে কবিতা ভালো লাগে আপনার কাছে তা হয়তো অত্যন্ত ছেলেমানুষি বলে মনে হবে।
তবু শুনি।
এই যে বইটি। অত্যন্ত সহজ স্পষ্ট ছন্দবদ্ধ কবিতা—
নাসরীন তরল গলায় বলল, কী আশ্চর্য, এটা আমারও সবচেয়ে প্রিয় বই।
বইটি হাতে নিয়ে সে আবদুল্লাহর পাশে বসে পড়ে। চকচকে মলাটে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, আমি যখন কলেজে পড়ি তখন একজন আমাকে এই বইটি উপহার দিয়েছিল।
আবদুল্লাহ মৃদু স্বরে বলল, কথাটি বলতে গিয়ে আপনার গলার স্বরে একটা ছোট পরিবর্তন হয়েছে। মনে হয় এই বইটির সাথে আপনার কোনো সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে।
নাসরীন কিছু বলার আগেই হঠাৎ জাহিদের তীব্র চিৎকার শোনা গেল। সে কখন নিঃশব্দে উঠে এসেছে তারা লক্ষ করে নি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, কী হচ্ছে এখানে? প্রেম? রবোটের সাথে প্রেম? বাহ! বাহ!
নাসরীন কী একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জাহিদ আরেকটু এগিয়ে এসে ঘরের সোফায় একটা লাথি মেরে বলল, রবোটের সাথে প্রেম? তারপর কার সাথে হবে? জন্তু জানোয়ারের সাথে?
নাসরীনের মুখে রক্ত উঠে এল। সে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জাহিদ হঠাৎ প্রায় ছুটে এসে নাসরীনের একটা হাত ধরে তাকে ঝটকা মেরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, বেশ্যা মাগী তুই ঘরে বসে আছিস কেন? রাস্তায় যা।
নাসরীনের চোখ জ্বলে ওঠে, সে চাপা গলায় বলল, মুখ সামলে কথা বল।
জাহিদের মুখ প্রচণ্ড আক্রোশে কুৎসিত হয়ে আসে, সে চিৎকার করে বলল, তোর সাথে আমার মুখ সামলে কথা বলতে হবে? বেশ্যা মাগী।
জাহিদ ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হঠাৎ হাত তুলে প্রচণ্ড জোরে নাসরীনকে আঘাত করল–অন্তত সে তাই ভাবল। কিন্তু তার হাত নেমে আসার আগেই এক অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়েছে, নাসরীনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে নিয়েছে এবং অন্য হাতে জাহিদের হাতকে ধরে ফেলেছে।
কী হয়েছে ব্যাপারটা বুঝতেই জাহিদের কয়েক মুহূর্ত লেগে যায়। যখন বুঝতে পারল তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং এক ধরনের অন্ধ আক্রোশে আবদুল্লাহকে আঘাত করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেটি পুরোপুরি অসম্ভব অর্থহীন একটি প্রক্রিয়া।
আবদুল্লাহ অত্যন্ত শক্ত হাতে জাহিদকে ধরে রেখে নরম গলায় বলল, আপনি অর্থহীন শক্তি ব্যয় করছেন।
জাহিদ উন্মত্তের মতো বলল, চুপ কর শালা। দাঁত ভেঙে ফেলব রবোটের বাচ্চা
আমাদের ভিতরে কোনো রাগ নেই। আবদুল্লাহ জাহিদকে এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ না–থাকা ব্যাপারটি একটি আশীর্বাদ। মানুষ রেগে গেলে তাকে খুব কুশ্রী দেখায়।
খামোশ! চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা। ছেড়ে দে আমাকে
আপনি একটু শান্তি হলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেব। এখন আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে খারাপভাবে আঘাত পেতে পারেন।
আবদুল্লাহ জাহিদকে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল, জাহিদ সেই অবস্থায় তার হাতপা ছুঁড়তে থাকে এবং তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখায়। নাসরীন আবদুল্লাহর প্রশস্ত বুকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল এবার সাবধানে মুখ তুলে তাকাল। আবদুল্লাহ নরম গলায় বলল, আপনি নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যান। তাহলে আমি একে ছেড়ে দিতে পারি।
নাসরীন তার মুখে অত্যন্ত বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে আবদুল্লাহর বুকে মাথা রেখে বলল, আমি এর থেকে নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাব না।
আবদুল্লাহ একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি অন্তত একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। আমি তাহলে একে ছেড়ে দেবার কথা চিন্তা করব।
নাসরীন বলল, আমি কোথাও যাব না, তুমি বরং ওকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
আবদুল্লাহ হেসে বলল, কোনো মানুষকে এ ধরনের কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি একটু সাবধানে থাকুন, আমি একে ছেড়ে দিচ্ছি।
জাহিদকে ছেড়ে দেয়া মাত্র সে চিৎকার করে বলল, দাঁড়া ব্যাটা বদমাইশ ধড়িবাজ। আমি তোর বারটা বাজাচ্ছি। মাঝরাতে আমার বউয়ের সাথে প্রেম করা ছুটিয়ে দিচ্ছি।
জাহিদ তার ভিডিফোনটা নিয়ে এসে কাঁপা হাতে ডায়াল করল, প্রায় সাথে সাথেই সেখানে ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ডিভিশনের একজন লোকের চেহারা ভেসে ওঠে। মানুষটি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, এত রাতে কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
তুমি এই মুহূর্তে আবদুল্লাহর সার্কিট কেটে দাও।
কেন কী হয়েছে?
ব্যাটা বদমাইশ আমার সাথে আমার সাথে
আপনার সাথে কী করেছে?
না, মানে রাত্রিবেলা আমার স্ত্রীকে
ভিডিফোনে অন্য পাশের মানুষটিকে খুব কৌতূহলী দেখা গেল। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী করেছে আপনার স্ত্রীকে?
জাহিদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সেটা তোমার শোনার দরকার নেই। আমার অথরিটি আছে, আমি বলছি। এই মুহূর্তে কানেকশান কেটে দাও—
এক মিনিট অপেক্ষা করুন। মানুষটি স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং মিনিট দুয়েক পরে আবার তাকে দেখা গেল, তার সাথে আরো একজন উচ্চপদস্থ মানুষ। মানুষটি গম্ভীর গলায় বলল, কে.এল. ৪২–এর কানেকশান কাটতে বলেছেন, কিন্তু সত্যিকার বিপদের ঝুঁকি না থাকলে আমরা সেটা কাটতে পারি না। নিয়ম নেই।
জাহিদ ভিডি টেলিফোনটা ঝাঁকিয়ে বলল, বিপদের নিকুচি করছি। এই মুহূর্তে কানেকশান কেটে রবোটটাকে অচল কর। এই মুহূর্তে। আমার অর্ডার
ভিডি স্ক্রিনের মানুষটা একটু বাঁকা করে হেসে বলল, আপনার ব্যাপারটাতে আমাদের জিএম ইমতিয়াজ সাহেব খুব কৌতূহল দেখিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি নিজেই আপনার বাসায় আসছেন।
জাহিদ হতচকিতভাবে বলল, জিএম? ইমতিয়াজ সাহেব? এখন আসছেন? এত রাতে?
হ্যাঁ, এখনই আসছেন। আপনি সোজাসুজি তার সাথে কথা বলতে পারবেন।
ভিডি স্ক্রিনের মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে কল, গুড নাইট।
জাহিদ কোনো উত্তর না দিয়ে ভিডিফোনটাকে আছাড় দিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল।
.
রবোট ফ্যাক্টরির জিএম ইমতিয়াজ আহমেদ একজন আইনজ্ঞ এবং একজন ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে গভীর রাতে জাহিদ এবং নাসরীনের বাসায় উপস্থিত হলেন। ততক্ষণে জাহিদের অন্ধ আক্রোশ কমে সেখানে তার স্ত্রী এবং আবদুল্লাহর প্রতি এক ধরনের বিজাতীয় বিদ্বেষ আর ঘৃণা স্থান করে নিয়েছে। ইমতিয়াজ আহমেদ কিন্তু জাহিদের সাথে কথা বলায় বেশি আগ্রহ দেখালেন না, দীর্ঘ সময় নাসরীনের সাথে কথা বললেন। তার মুখে তিনি যেটা শুনলেন সেটা তার পক্ষে বিশ্বাস করা খুব শক্ত, কয়েকবার শুনেও তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না, মাথা নেড়ে বললেন, তুমি বলছ যে তোমার বার বছরের বিবাহিত স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে এই রবোটের সাথে ঘর–সংসার করবে?
হ্যাঁ।
তুমি ঠাণ্ডা মাথায় বলছ?
হ্যাঁ, আমি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি। আবদুল্লাহ রবোট হতে পারে কিন্তু তার ভিতরে রয়েছে একটা অনুভূতিশীল মন। তার তুলনায় আমার স্বামী একটি নিচু শ্রেণীর পশু।
জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, এটা পাগলামি, বদ্ধ পাগলামি
ইমতিয়াজ আহমেদ হাত তুলে জাহিদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এটা পাগলামি না কী সেটা নিয়ে আলোচনা করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। তার জন্যে আমাদের দুটি বড়। বিভাগই আছে। কিন্তু তোমার স্ত্রী আমাদের সামনে সম্ভাবনার বিশাল একটা জগৎ খুলে দিয়েছে।
জাহিদ অবাক হয়ে ইমতিয়াজ আহমেদের দিকে তাকাল। ইমতিয়াজ আহমেদ উত্তেজিত গলায় বললেন, পৃথিবীতে বিবাহিত স্বামী–স্ত্রীদের একটা বিশাল অংশ অসুখী। তাদের আবার বিশাল একটা অংশ তাদের স্বামীদের আচার–আচরণে এত বিরক্ত হয়েছে, তাদের এত ঘেন্না করে যে মানুষ জাতিটার প্রতিই তাদের ভক্তি উঠে গেছে। তারা এখন মানুষের বদলে রবোটকে নিয়ে ঘর–সংসার করার জন্য প্রস্তুত। এই রবোটেরা আবেগবান, সংস্কৃতিবান। তাদের মাঝে কোনো রাগ নেই, শুধু তাই না তারা অসম্ভব সুদর্শন! আমরা যদি এ রকম আরো রবোট তৈরি করে ঠিকভাবে মার্কেটিং করি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে।
পাশে বসে থাকা আইনজ্ঞ মানুষটি পকেট থেকে একটা ছোট কম্পিউটার বের করে। তার মাঝে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে ইমতিয়াজ আহমেদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, প্রায় তের ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কেট!
তের ট্রিলিয়ন ডলার! ইমতিয়াজ আহমেদ জিভ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বললেন, তার যদি দশ পার্সেন্টও আমরা ধরে রাখতে পারি—
জাহিদ হতচকিতের মতো সবার দিকে তাকিয়েছিল, এবারে চিৎকার করে বলল, কখনোই না! কখনোই এটা হতে পারে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ ভুরু কুঁচকে জাহিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, পারে না?
না। আমি এই কোম্পানির একজন কর্মচারী। আমার একটা অধিকার রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ জাহিদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, তোমার কোনো অধিকার নেই জাহিদ।
কেন নেই!
কারণ তোমাকে আমি বরখাস্ত করলাম। তোমার মতো পাষণ্ডকে কোম্পানিতে রাখা ঠিক না। কী বল তোমরা?
আবদুল্লাহ ছাড়া আর সবাই ঋঞ্জ নেড়ে সম্মতি জানাল।