একচল্লিশতম অধ্যায়
সূত বললেন–সাদা রঙের দেবকূট একটি মর্যাদা সম্পন্ন পর্বত। এই পাহাড়ের বিরাট চুড়াতে বিনতার ছেলে ধীমান সুপর্ণের জন্মস্থান, এই জায়গাটি চারিদিকে একশো যোজন বিস্তৃত ও এক মহাভবনে মণ্ডিত। শাল্মলী দ্বীপে বায়ুবেগী পক্ষিরাজের আদি ভবন। এটিকে তার স্বগোত্রী দ্রুতগামী পাখিরা ঘিরে রাখে। এই পাখিরা সকলেই সাপের শত্রু। চার চূড়াযুক্ত পাহাড়গুলোর দক্ষিণে সাতটি সুসমৃদ্ধ শৃঙ্গ দেখা যায়। তাতে সাতটি গান্ধর্ব নগর। এর প্রাচীর ও তোরণগুলি সোনার। দেবতাদের তৈরি নগরগুলোতে নানা নরনারীর বাস।
হে দ্বিজগণ শুনুন–এই মহাগিরি দেবকূটের উত্তরদিকের শৃঙ্গগুলোতে দেবদেবীদের বাস আছে। প্রাচীরগুলি রম্য ও হর্ম প্রসাদগুলো নানা প্রকারে সাজানো। প্রাচীর ও তোরণগুলি খুব উঁচু। জায়গাটিতে আছে অনেক সাপ। শত শত বাদ্যের আওয়াজ ঐ নগরের বনের ভেতর সব সময় মুখর। ঐ নগরটিকে শত্রুরা আক্রমণ করতে পারে না।
দ্বিতীয় মর্যাদা পর্বতে কালকেয় অসুরদের এক দুধর্ষ নগর আছে। ঐ নগরে নানা রঙে রঙিন, মণিখচিত অসংখ্য ভবন আছে। নগরটি নিত্যই আনন্দিত, সুরক্ষিত, এতে অনেক স্ত্রী-পুরুষ থাকে। এই অসুরনগর সুনীল নামে খ্যাত। এর দক্ষিণ তটে রাক্ষসদের মহাপুরী রয়েছে। ত্রিশ যোজন বিস্তৃত বাষট্টি যোজন আয়ত, এর প্রাচীর ও তোরণগুলি সোনার তৈরি। এগুলি হৃষ্টপুষ্ট গর্বিত রাক্ষসদের বাসস্থান। দেবকূট পর্বতের মাঝে মহাকূটে ভূতবট নামে একটি বিশাল গাছ আছে। এর অনেক শাখা-প্রশাখা স্কন্দ ও কাণ্ড রয়েছে। ঐ গাছটি দশ যোজন ধরে বিস্তারিত। গাছটি দেখতে রমণীয়। এর তলদেশ ছায়াতে ঢাকা, নানা ভূতজাতির আশ্রয়স্থল ও মহাত্মা মহাদেব ত্র্যম্বকের সর্বলোক খ্যাত উজ্জ্বল আয়তন। মহাদেবের পারিষদরা সব সময়ই সেখানে থাকে। এরা হল বরাহ, হাতি, সিংহ, ঋক্ষ, বাঘ ইত্যাদি মুখ বিশিষ্ট, কেউ কেউ শকুন উট-এর মত বিশাল মুখ যুক্ত। কেউ বিকটাকার, কেউ স্থূল, কারো লম্বা চুল ও লোম বিশিষ্ট। উগ্ৰাপরাক্রমশালী ঐসব ভূতেরা রোজ সেখানে ভূতনাথ-এর পুজো করে থাকে। পুজো শুরু হলে নানারকম বাদ্যযন্ত্রে, যেমন শাখ, ঘণ্টা, ঝাঁঝর, ভেরী ইত্যাদির শব্দে ও গর্জনে চারিদিক ভরে ওঠে। প্রমথরা আনন্দিত মনে সেখানে থাকে। সাক্ষাৎ মঙ্গলদায়ক মহাদেব, ঋষি, দেব, গন্ধর্ব, যক্ষের পূজা পেয়ে থাকেন।
.
বিয়াল্লিশতম অধ্যায়
সূত বললেন–কৈলাস নামে একটি পবিত্র পর্বত আছে। গিরিশিখরটি শঙ্খের মতো সাদা। অনেক পুণ্যাত্মা দেব ভক্তেরা ঐ কৈলাস পর্বতে বাস করেন। এর মাঝে কুন্দফুলের মতো সাদা শৃঙ্গতট আছে। এতে মহাত্মা কুবেরের একটি নগর আছে। ঐ নগর প্রচুর মণিমুক্তো ও ছবিতে সাজানো। অনেক বড় বড় প্রাসাদ এই নগরের অনেক দূর ছড়িয়ে আছে। অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ঐ নগরে কেউ ঢুকতে পারে না। এর মাঝে সোনার তৈরি একটি সভাগৃহ আছে, নাম বিরুলা। বিরাট স্তম্ভ তোরণ দিয়ে ঘেরা, সেখানে পুষ্পক নামে মহবিমান আছে। এটি নানা রত্নে সাজানো, খুব সুন্দর বিমানটি কুবেরের বাহন। ভগবান মহাদেবের সখা। তিনি প্রধান প্রধান যক্ষদের সাথে সর্বভূতের পুজো পেয়ে ঐ নগরে বাস করেন। মহাত্মা কুবের অপ্সরা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণদের নিয়ে ঐ জায়গাতে সবসময় বাস করেন। কুবেরের সভায় পদ্ম, মহাপদ্ম, মকর, কচ্ছপ, কুমুদ, শঙ্খ, নীল ও নিধিশ্রেষ্ঠ নন্দন আটটি আর দিব্য মহনিধি আছে, কৈলাস পাহাড়ে যক্ষের আবাসস্থলের কাছেই, ইন্দর, অগ্নি, যম প্রভৃতির বাসস্থান। পূর্বে যারা মহাত্মা যক্ষেশ্বর-এর উপাসনা করেছেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে তার পরিচারকের পদ পেয়ে থাকেন। এর পাশ দিয়ে মন্দাকিনী বয়ে চলেছে। ঘাটের সিঁড়িগুলো সোনা, মণি মুক্তার গড়া, নানা রঙে নানা জাতের অতি সুন্দর সব মহাপদ্ম দিয়ে ঐ নদী সাজানো। যক্ষ গন্ধর্ব রমণী ও অপ্সরাদের স্থান যেটি এছাড়া অলকনন্দা ও নন্দী নামে আরও দুটো নদী বয়ে চলেছে। এই সব পুণ্য সলিলা নদীদের দেব ও ঋষিরা সেবা করে থাকেন।
কৈলাস পর্বতের পূর্বদিকের চূড়োতে পরম সমৃদ্ধিশালী দশটি গন্ধর্ব নগর রয়েছে। এই নগরগুলি দশ যোজন বিস্তৃত আর হাজার যোজন আয়ত। নগরটি নানা ভবনে শোভিত, সুবাহ, হরিকেশ, চিত্রসেন, জর প্রভৃতি দশজন পরাক্রান্ত গন্ধর্বরাজ ঐ নগর গুলোর রাজা, এই পাহাড়ের সুর সেবিত পশ্চিম চূড়োতে চাঁদের মত শুভ্রকান্তি এক একটি যক্ষভবন। মহাযক্ষদের ত্রিশটি বাসস্থল আছে। সমুদ্র, মণিবর প্রভৃতি ত্রিশজন যক্ষ রাজা এইসব ভবনে থাকেন। বায়ু ও অগ্নির মতোই এরা তেজস্বী। ঐ কৈলাশ পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে পর্বত শ্রেষ্ঠ হিমবান, হিমালয় পর্বত ও অসংখ্য নদী, ঝর্ণা, গুহা, বাড়ি ও তটভূমিতে পূর্ণ। এখানে কিন্নরদের প্রচুর ভবন রয়েছে। এগুলোতে সুখী, আনন্দিত স্ত্রী, পুরুষেরা বাস করেন। এখানে প্রতাপশালী কিন্নরদের রাজা হলেন, দ্রুম সুগ্রীব, সৈন্য ও ভগদও প্রভৃতি একশো রাজা। এই শৈল শিখরেই মহাদেবী উমার সাথে রুদ্রদেবের বিয়ে হয়েছিল। উমাদেবী এখানেই তপস্যা করেছিলেন। হর-পার্বতী এই পাহাড় থেকেই সমস্ত জম্বুদ্বীপ দেখতে পেতেন। শিবের ক্রীড়াভূমি হিমালয়, এ সুন্দর জায়গাটি ভূতগণে পরিবৃত আর ফলে শোভিত। অনেক প্রকারের ফুল, এখানে সুন্দরী সুনয়না, কৃশাঙ্গী কিন্নরীরা আনন্দিত মনে ঘুরে বেড়ায়। অপ্সরা গন্ধর্ব ঘুরে বেড়ায়। এখানেই সর্বলোক প্রসিদ্ধ উমাবন আছে। শঙ্কর এখানেই অর্ধনর অর্ধনারী রূপ ধরেছিলেন।
শরবন নামে এখানে একটি বনে ষড়ানন জন্মেছিলেন। কার্তিকেয়-এর এখানে এক সিংহ রথ আছে। ঐ রথের ধ্বজা পতাকা ও কিঙ্কিনী জালে শোভিত। দৈত্য বৈদ্বেষী গুহ যিনি বারোটি সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তাকে দেবতারা সেনাপতি করেছিলেন। পাহাড়ের নানা জায়গায় কার্তিকেয়ের আবাস আছে। পাণ্ডুলিশা হল কার্তিকের ক্রীড়াভূমি। পাহাড়ের পূর্ব তটে বিখ্যাত সিদ্ধাবাস আছে। এর নাম কলাপ গ্রাম। বশিষ্ঠ, ভরত, নল, বিশ্বামিত্র ইত্যাদি ঋষিদের অনেক আশ্ৰম আছে।
হিমালয় বহু আশ্রম ও সিদ্ধবাসে পরিপূর্ণ। এটি যক্ষ ও গন্ধবদের বিচরণ স্থান। এটি নানা রত্নের, আবার বহু প্রাণীর আশ্রয় ও বহু নদীর উৎপত্তি স্থান। বিপ্রগণ এবার পশ্চিম পাহাড়ের বর্ণনা করছি শুনুন। এই পাহাড়ের মাঝের চুড়ো খুব চওড়া ও সোনা দিয়ে মোড়া। সেখানে বিষ্ণুর এক উজ্জল আয়তন আছে। সেখানে গন্ধর্ব, যক্ষ, অপ্সরা, সিদ্ধজনেরা বাস করেন। সিদ্ধজনেরা সাক্ষাৎ মহাদেব ও পীতাম্বরধারী হরিকে পুজো করে থাকেন। এই পর্বতের ভেতর উজ্জ্বল ধাতুতে মোড়া কোমল শিলাময় তটে রাক্ষসদের আনন্দপুরী আছে। এর তোরণগুলো তপ্ত কাঞ্চনময় রূপা ও সোনার তৈরি। এখানে অনেক বাগান রয়েছে। শত্রুরা সেখানে ঢুকতে পারে না। এর দক্ষিণদিকে অনেক দৈত্য বাস করে। এর মধ্যে অনেক নগর আছে যেখানে সহজে প্রবেশ করা যায় না। গুহার মধ্যে দিয়ে নগরে ঢুকতে হয়। পশ্চিম চুড়ো পরিজাত ফুলে শোভিত। সেখানে দেব, দানব ও নাগের সমৃদ্ধ পুরী আছে।
উত্তর পাহাড়ে ব্রহ্ম পার্শ্বনামে এক স্থান আছে। এটি স্বর্গে ব্রহ্মার জায়গা বলে প্রসিদ্ধ। মহাত্মা স্বয়ম্ভকে সেখানে পুজো উপাসনা করেন সিদ্ধ, যক্ষ, গন্ধর্বগণেরা। এখানে অগ্নিরও একটি আয়তন আছে। সেখানে মূর্তিমান অগ্নিদেবকে সিদ্ধ ও চারণরা পুজো করে থাকেন। এভাবে উত্তর দিকে শ্রেষ্ঠ পর্বত ত্রিশৃঙ্গ, এটি ভূতেদের আশ্রয়স্থল। হেমচিত্র নামে ত্রিলোক বিখ্যাত পুরী আছে এখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর-এর, আবাসস্থল।
দৈত্য, দানব, যক্ষ ও মহেশ্বর-এর আবাসস্থল পুজো করে থাকেন। ত্রিশৃঙ্গ নামের পর্বতের জায়গায় জায়গায় যক্ষ, গন্ধর্ব ও নাগদের সুন্দর অট্টালিকা আছে। গিরির অষ্টম শৃঙ্গে ঋষি পরিবৃত রমণীয় স্থান আছে। সেখানে আনন্দজল নামে মহাপুণ্য জল সরোবর আছে। এখানে চণ্ড নামে এক নাগপতি তার একশোটি মাথা এবং বিষ্ণুর চক্র চিত্র আঁকা।
বহু প্রাসাদ, অট্টালিকা, অপূর্ব সরোবর, গুহা, নানা রকম বৃক্ষ, মণিময় শিলা, নদী আর বহু বিস্তৃত পাহাড় দিয়ে সমস্ত বসুমতী পরিব্যপ্ত। এছাড়া এই মহাপৃথিবীতে প্রচুর পাহাড় রয়েছে। পাহাড়গুলি পুণ্যবাণে ভরা। মেরু পর্বতের গিরিমালই সিদ্ধলোক বলে খ্যাত, এটি পুণ্যাত্মা মানুষের আবাসস্থল। ঐ সুমেরু গিরিকেই স্বর্গ বলে। চারটি মহাদ্বীপ পৃথিবীতে খ্যাত। ভদ্র, ভরত, কেতুমাল ও উত্তরকুরু, দ্বিজগণ! আমি সেই চারটে প্রধান দ্বীপ ও অনেক দ্বীপ সমন্বিত এই পৃথিবীর বর্ণনা করলাম। বিখ্যাত ব্রহ্মলোক, দেব অসুর ও মানুষলোক পর্যন্ত সমস্ত জায়গা প্রাণীদের কাছে ত্রিলোক আখ্যা পেয়ে থাকে। গন্ধর্ব, বর্ণ, রস, শব্দ ও স্পর্শ গুণ সমন্বিত এই জগৎলোক পদ্ম নামে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
.
তেতাল্লিশতম অধ্যায়
সূত বললেন– পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত যেসব সরোবর থেকে পূণ্য সলিলা নদী বয়ে এসেছে, তা আকাশগামী হয়ে সপ্তম বায়ুপথে বয়ে চলেছে। ঐ নদী জ্যোতিষ্ক মণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছে কোটি কোটি তারার মাঝে বিস্তৃত হয়েছে। ইন্দ্রের ঐরাবত হাতি আকাশপথ ভ্রমণ করে এর জলের ভেতর খেলা করে। সিদ্ধজনেরা বিমানে উঠে নভোস্থলে এর পুণ্যজল স্পর্শ করে আসেন।
সূর্য যেমন প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়ে থাকেন, বায়ু প্রেরিত ঐ নদীও তেমনি নানা জায়গায় গিয়ে বার বার পরিবর্তনশীল হয়। ঐ নদী সুমেরু গিরিকেও প্রদক্ষিণ করেছে। ঐ নদী মেরুগিরির উত্তরদিকে। চারটি চূড়াতে পড়েছে। মেরুর শিখর থেকে এর জলরাশি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে ঐ নদী চার ভাগে ভাগ হয়ে বয়ে চলেছে। ঐ পুণ্য মহানদী এক ভাগে মন্দর পর্বতের পূর্বদিক থেকে পড়ে সুমেরুর সাথে সুর সিদ্ধদের আবাস মন্দার গিরির পাশ দিয়ে অরুণোদ সরোবরে সাথে মিলেছে। এরপর সরোবর থেকে ঝর্ণায় পরিণত হয়ে সিদ্ধনিবাস শৈলে পড়ছে। সীতা নামে এক মহাপুণ্যা নদী আছে। ঐ নদী সব নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পাহাড় জঙ্গলে বাধা পেয়ে বহুদিকে বয়ে চলেছে। প্রথমত ঐ নদী শীতান্ত শৈলের শিখর থেকে মুকুঞ্জ গিরিতে এসে পড়ে। তারপর সেখান থেকে মাল্যবান পর্বতে মাল্যবান থেকে বৈকন্ধে, বৈকন্ধ থেকে মণিশৈলে, সেখানে থেকে বহু কন্দরময় মহলে বৃষভাচলে এসে পড়ে।
এভাবে ঐ নদী হাজার হাজার পর্বত পেরিয়ে জঠর নামে মহাশৈলে পড়েছে। আবার সেই নদী জঠর থেকে বেরিয়ে মহাগিরি দেবকূটে গিয়ে সেখানকার ভেতর দিক প্লাবিত করে ক্রমশঃ পৃথিবীতে পড়েছে। এভাবে ঐ নদী হাজার হাজার ভূমি, শত শত পর্বত, বহু বিচিত্র বন, সরোবরকে ভাসিয়ে প্রচুর নির্মল জল বয়ে অন্যান্য সহস্র সহস্র নদীর সাথে মিলে বয়ে চলেছে। ঐ নদী প্রধান প্রধান দ্বীপের সাথে ভদ্ৰাস্ববর্ষকে প্লাবিত করে পূর্বসাগরে মিলেছে। পূর্বদ্বীপে একে মহানদী বলে। দক্ষিণদিকের পাহাড়শ্রেষ্ঠ গন্ধমাদনে যে নদী এসেছে সেটি বিচিত্র প্রপাত দিয়ে বিমল জল বিকীর্ণ করে গন্ধমাদন পর্বতের দেবনন্দন, নন্দনবন প্রদক্ষিণ করে প্লাবিত হয়েছে।
এই নদীর নাম অলকানন্দা, এটি সর্বলোকেই প্রসিদ্ধ। ঐ অলকানন্দা প্রথমে দেবতাদের মানস সরোবরে প্রবেশ করে সেখান থেকে রমণীয় ত্রিকূটে, ত্রিকূট থেকে কলিঙ্গ শিখরে, সেখান থেকে রুচকাঁচলে, সেখান থেকে নিষধে, নিষধ থেকে তাম্রশিখরে, সেখান থেকে শ্বেতোদর পর্বতে, সেখান থেকে শৈলেন্দ্র সুমুখ ও রসুধার পর্বতে, সেখান থেকে হেমকূটে, হেমকূট থেকে দেবশৃঙ্গ, দেবশৃঙ্গ থেকে পিপাঁচকে। এখান থেকে পঞ্চকূটে, সেখান থেকে দেব নিবাস কৈলাস শৈলে পৌঁছে সকল দিক প্লাবিত করে গুহাপূর্ণ হিমালয় পর্বতে এসে পড়েছে। এভাবে এই নদী হাজার হাজার পাহাড়, শতশত ভূমি সহস্র সহস্র কানন, গুহা প্লাবিত করে দক্ষিণ সাগরে এসে মিশেছে। এই মহানদী গঙ্গা, ভীষণ পাপাচারীদেরও পার দূর করে। মহাদেব বা পুষ্করের অঙ্গ সংস্পর্শে দ্বিগুণ পবিত্র জলশালিনী হয়ে সর্বলোকে প্রসিদ্ধ। ঐ নদী হিমালয় পাহাড় থেকে চারিদিকে অনেক শাখায় বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে সহস্র সহস্র নদী রূপে বিখ্যাত। ঐ মহানদী নন্দা নামে প্রসিদ্ধ। একে সিদ্ধজনেরা সেবা করে থাকেন। যেসব দেশের ভেতর দিয়ে রুদ্র, সাধ্য, বায়ু ও আদিত্য প্রভৃতি দেবপুজ্য যশস্বিনী গঙ্গা বয়ে চলেছে, সেই দেশই ধন্য ও শ্রেয়।
এবারে মেরুর পশ্চিমদিকের সুবিস্তৃত প্রত্যন্ত পর্বতের কথা বলছি। পর্বতটিতে প্রচুর রত্ন আছে। এটি পুণ্যময়, পুণ্যকারীদের সেবিত, নানা গুহায় সাজানো। এর অভ্যন্তর দেশ পাহাড়ের গায়ে নানা ফুল দিয়ে মোড়া। বহুদেশে বহমান লতার মত ঘুরে মেরুগিরি শৃঙ্গতট থেকে পড়েছে। বহু প্রাণীর তৃষ্ণা মিটিয়ে, নানা অঞ্চল ঘুরে দেবভ্রার্জ বনে পড়েছে। এরপরে মহাভ্রাজ, বেভ্রাজ প্রভৃতি মহাবনগুলো প্রদক্ষিণ করে, ভাসিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকের বিমল জলপূর্ণ শীতোদ সরোবরে মিলেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে সুপক্ক পর্বতে, সেখান থেকে পুণ্যোদ সরোবর আবার সেই সরোবর থেকে কয়েকটি শৃঙ্গে ঘুরে শিখী পর্বতে এসে মিশেছে। শিখী পর্বত থেকে কক্ষ, কক্ষ থেকে বৈদূর্যে সেখান থেকে কপিলে, কপিল থেকে গন্ধমাদনে, সেখান থেকে পিঞ্জরাচলে। এইভাবে কুমুদাচল থেকে মুধুটাটলে। মুকুটাম্য পর্বতচূড়ো থেকে কৃষ্ণম্য মহাপর্বতে। কৃষ্ণ থেকে মহানাগ শ্বেত মহাশৈলে, শ্বেতশৈল থেকে শৈলেন্দ্র সহস্রশিখরে পড়েছে। এভাবে ঐ মহানদী হাজার পর্বতকে বিদীর্ণ করে পারিজাত নামে মহাপর্বতে পড়েছে।
এই পারিজাত পর্বতের গুহার ভিতর দিয়ে পর্বতগাত্রের অনেক ঝর্ণা রূপে বহু সংখ্যক পাথর খণ্ড ভাসিয়ে, অথবা বাধা পেয়ে পৃথিবীতে এসেছে। এবং ম্লেচ্ছপূর্ণ কেতুমাল বর্ষ প্লাবিত করে পশ্চিম সাগরে এসে মিশেছে। এই নদী যখন আকাশতলে পড়ে বিরাট আকারে বেড়ে বয়ে চলেছিল তখন ষাট হাজার যোজন প্রদেশ ধরে মালার মত বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়েছিল। এইভাবে এই দেবঋষি সেবিত নদী পর্বত শিখর থেকে পড়াতে এর জলরাশি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়। নানা ফুলের ভেলা বহন করে নানা রত্নময় দেশ, অরণ্য মহাবন প্রদক্ষিণ করে ভাসিয়ে দিয়ে মহাভদ্র নামে এক মহাসরোবরে মিলিত হয়েছে। মহাপুণ্য সলিলা এই সরোবর তটে অনেক সাধুরা থাকেন। সরোবর থেকে বেরিয়ে এই নদী ভদ্রসোমা নামে বিখ্যাত হয়েছে। এই ভদ্রসোমা প্রচণ্ড বেগবতী। এই নদী বহু ঝর্ণা, জলাশয় সৃষ্টি করে । শঙ্কুট নামে পাহাড়ে এসে পড়েছে। সেখান থেকে বৃষ পর্বতে, তারপর বৎস, নাগশৈল, পর্বত নীলাচল, নীলাচল থেকে কপিজ্ঞল, সেখান থেকে ইন্দ্রনীলে, ইন্দ্রনীল থেকে নীচের মহানীল হেমশৃঙ্গে এসে পড়েছে। এরপর শ্বেতাচলে, আবার সেখান থেকে শতশৃঙ্গে।
শতশৃঙ্গ থেকে পুষ্পমণ্ডিত পুষ্করে, সেখান থেকে বরাহ পাহাড়ে, ময়ুরাচলে, গুহাযুক্ত জারুধি নামের পাহাড় চুড়োতে দ্রুতগতিতে পড়েছে। এভাবে এই মহানদী হাজার হাজার ভূমি প্রবাহিত করে ত্রিশৃঙ্গ নামে শৃঙ্গময় মর্যাদা পর্বতে এসে পড়েছে। তারপর ঐ মহাভাগা নদী ওখান থেকে হেমকূট হয়ে বীরুধ পর্বতে এসে পড়েছে। মেরুর উভয় দিকে সুপার্শ্ব নামে সুবর্ণময় প্রাণী সঙ্কুল বিশাল বিচিত্র পাদদেশে বিস্তৃত ভাবে পড়েছে। তারপর উত্তরকুরু দেশ প্লাবিত করে মহাদ্বীপের মধ্য দিয়ে উত্তর সাগরে মিলেছে। এভাবে বিমল জলে ভরা চারটে মহানদী মহাগিরি তট থেকে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। এভাবে বহু বিস্তৃত পৃথিবীর বর্ণনা করা হল।
.
চুয়াল্লিশতম অধ্যায়
সূত বললেন–গন্ধমাদন পর্বতের পাশে একটি বিশাল আকার গণ্ডশিলা আছে। দৈর্ঘ্য বত্রিশ যোজন। এটি পূর্ব-পশ্চিমে আয়ত, ওখানে কেতুমাল বর্ষের লোকেরা শুভ কাজ করে থাকেন। ওখানকার অধিবাসী লোকেদের গায়ের রঙ কালো, মহাবীর্য মহাবল সেখানকার স্ত্রী জাতির গায়ের রঙ। পদ্মপাতার মত দেখতে সুন্দরী ওখানে পনস নামে (কাঁঠাল) একটি মহাবৃক্ষ আছে। এই বৃক্ষ ব্রহ্মার পুত্রস্থানীয়। সেই গণ্ডশিলাবাসী নর-নারীরা এই গাছের ফলের রস পান করে দীর্ঘজীবি হয়। মাল্যবান পর্বতের পূর্বদিকে এক গণ্ডশিলা আছে, এটি পূর্ব গণ্ডিকা নামে বিখ্যাত। ভদ্ৰাস্ববাসী জনগণ সেখানে সবসময় আনন্দ সহকারে বাস করেন। এখানে ভদ্র নামে একটি শালবন আছে। এখানে যে সব পুরুষ আছে, তাদের রঙ সাদা, স্ত্রীলোকেরা দেখতে সুন্দরী, কুমুদের মতো গায়ের বর্ণ। এখানকার স্ত্রী-পুরুষরা কালা ফলের রস পান করে, স্থির যৌবন সম্পন্ন এবং আয়ু দশ হাজার বছর।
ঋষিরা বললেন–হে সুত, তুমি এই চারটি দ্বীপের অধিবাসীদের সম্বন্ধে আরো বিস্তৃত ভাবে বল। সূত বললেন–হে কীর্তিশালীগণ শুনুন, আমি বর্ণনা করছি। শৈবাল, বর্ণমালগ্র, কোরঞ্চ, শ্বেত ও নীলাচল এই পাঁচটি কুলপর্বত। এই পর্বতের জননী সদৃশ আরো হাজার হাজার, শত শত পর্বত আছে। এই সব পর্বতে কত জনপদ যে সৃষ্টি হয়েছে, সেই সব জনপদ নানা প্রাণীর আশ্রয়স্থল, নানা প্রকারে ভাগ করা। সেখানে নানা রাজবংশের বাস। এইসব জনপদ ও পাহাড়ের মাঝে উঁচুনিচু স্থানগুলো হল–সুমঙ্গল, শুদ্ধ, চন্দ্র, অনন্ত, সুনন্দ, বিজয়স্থল, মহাস্থাল, মহানেত্র, শৈবাল, কুমুদ। উত্তম হেমভৌম ইত্যাদি। ঐসব জনপদবাসীরা মহানদী মহাগঙ্গার জল পান করে, আরো অনেক নদী ঐসব জনপদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।
সেই নদীগুলি হল–হংসবসতি, মহাচক্রা, কাঞ্চী, সুরেসা, শাখাবতী, ইন্দ্ৰনদী, মেঘা, কাবেরী, পম্পা, পম্পাবতী, সুবর্ণা, মণিব, কৃষ্ণতায়া অরুণাবতী, ক্ষীরোদা মণিতটা, হিরণ্য বাহিনী প্রভৃতি। এরা সকলেই গঙ্গার মতো মহানদী। এছাড়া আরও অনেক নদী পূর্বদ্বীপের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে গেছে। এরা সকলেই পুণ্যতোয়া মনে করা হয়। ঐ সব নদীর নাম স্মরণ করলেও মানুষেরও পুণ্য হয়। ভদ্ৰাস্ব বর্ষের রাষ্ট্রগুলো সুসমৃদ্ধ, স্ফীত ও নানা জনপদে পরিব্যপ্ত, নানা জন পরিবেষ্টিত। নরনারীরা এখানে আনন্দিত মনে বাস করে। এই সব দেশের পুরুষদের আকৃতি খুব সুন্দর ও তারা বলশালী। তাদের আয়ুষ্কাল দশ হাজার বছর। অহিংসা ও সত্য কথা তাদের স্বভাবজাত গুণ। রোজ তারা ভক্তি সহকারে দেবদেব শঙ্কর ও পরম বৈষ্ণবী গৌরী দেবীকে পূজা ও প্রণাম করে।
.
পয়তাল্লিশতম অধ্যায়
সূত বললেন–ভদ্রাস্ববাসীদের সাধারণ বিবরণ আমি দিলাম। এবার কেতুমাল বর্ষের বিস্তৃত বিবরণ শুনুন। পশ্চিম দিকের শ্রেষ্ঠ পাহাড় নিষেধের পশ্চিম দিকগুলোতে যে সাতটি কুলাচল, সেসব নদী ও বিশেষত জনপদের কথা বলছি তাদের নাম। বিশাল, কম্বল, কুঞ্চ, জয়ন্ত, হরি পর্বত, অশোক ও বর্তমান। এই সব কুলাচলের প্রসূতি স্থানীয় অন্য আরও কোটি কোটি, হাজার হাজার, শত শত বিস্তৃত পর্বত আছে। সেইসব পর্বতের সাথে কত যে জনপদ মিশে আছে তার ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন রাজাদের দ্বারা পরিচালিত ঐসব জনপদ ও বিভিন্ন রাজ্যের নাম হল–সুখ ভ্রমর, অচল, কূটক, স্তবক, ত্রৈঞ্চ, কৃষ্ণঙ্গ, মণিপুঞ্চক, কুমুদাভ, মহানাশ, গজভূমিক, বঙ্গ রাজীব, কোকিল, বচাঙ্গ, মহাঙ্গ, পিত্তল, ইত্যাদি অসংখ্য জনপদে, বহু ধরনের প্রাণী ও মানুষ পরিপূর্ণ এগুলি।
এসব জনপদের বসবাসকারী নরনারীরা যে সমস্ত নদীর জল পান করে থাকে তারা হল– মহানদী, সুব, তামসী, শ্যামা, শিখিমালা, ভদ্রানদী, শাকবতী, চন্দ্রাবতী, সমুদ্রমালা, চঞ্চাবতী, নন্দিনী, কালিন্দী, ভারতী, শীতোদা, পতিকা, বিশালা, পীবরী ইত্যাদি অসংখ্য নদ নদী। এই নদীগুলি এবং অনেক সরোবরের জল জনপদবাসীরা পান করে। সমস্ত নদনদীগুলোই পুণ্য জলে পূর্ণ, ঋষি ও সিদ্ধজন সেবিত। কেতুমাল এরূপ জনপদে সমৃদ্ধ, রত্নে পরিপূর্ণ, সবসময় আনন্দিত ও মঙ্গলময়। ধনীরা সেখানে থাকে বলে ঐ মহাদ্বীপ বিশেষ সমৃদ্ধ। হে দ্বিজগণ আমি কেতুমাল বাসীদের সমস্ত বিবরণ জানালাম।
.
ছেচল্লিশতম অধ্যায়।
শাংপায়ন বললেন–হে প্রভু! আপনি পূর্ব ও পশ্চিমদিকের দুটি মহাদেশের বিবরণ বললেন। এবার উত্তর ও দক্ষিণ দিকের বর্ষগুলোর ও পর্বতবাসীদের বৃত্তান্ত বলুন। সূত বললেন–শ্বেত পর্বতের দক্ষিণে ও নীলাচলের উত্তরে রমণক নামে একটি বর্ষ আছে। সেখানে যেসব মানুষ জন্ম নেয়, তারা সব ঋতুতে সমান কামফল উপভোগ করে। তারা প্রিয়দর্শন, বিশুদ্ধ। তাদের জরা রোগ ইত্যাদি নেই। সেখানে একটি মহাবৃক্ষ আছে, নাম রোহিন। সেখানকার লোকেরা সেই গাছের ফলের রস পান করে বেঁচে থাকে ও দশহাজার দশ শত বছর বেঁচে থাকে। সেই সব মহাভাগ্যশালী লোকেরা সব সময়ই সন্তুষ্টচিত্ত। শ্বেতজলের উত্তরে ও শৃঙ্গাচলের দক্ষিণে হিরন্বত নামে এক বর্ষ আছে। ঐ দেশের মধ্যে দিয়ে হিরন্বতী নদী বয়ে চলে। এই দেশের সব মানুষ মহাবল, সুতেজী, ধনী ও প্রিয়দর্শন। এই সব মানুষের আয়ু এগারো হাজার একশো পঞ্চাশ।
ঐ দেশে লুকুচ নামে এক মহাবৃক্ষ আছে, এটি ছটি রসের আশ্রয়। তার ফলের রস পান করে ঐ বর্ষবাসী মানুষেরা জীবনধারণ করে থাকেন। এখানকার পর্বতের তিনটি মহান চুড়া রয়েছে। একটি চুড়া মণিময়। আরেকটি চুড়া হিরন্ময় ও অন্যটি রত্নময়। নানা ভবন ও পুরীতে শেষ শৃঙ্গটি পূর্ণ।
উত্তর সমুদ্রের দক্ষিণ দিকে সমুদ্রের কাছে পুণ্য কুরুবর্ষ আছে। এখানকার গাছগুলি সকল সময় ফুলে ফলে পরিপূর্ণ। ফলগুলি মধুময়। এই সব গাছগুলি থেকে নিত্য বস্ত্র ও অলংকার পাওয়া যায়। এই গাছগুলি উত্তম গন্ধ, বর্ণ ও রসে পূর্ণ। মধু এই গাছে জন্মায়। কতগুলো ক্ষীরিবৃক্ষ আছে, তারা দেখতে মনোহর সব সময় ক্ষীর ক্ষরণ করে থাকে। এখানকার ভূমি সমস্তই মণিময় বালুকার মতো। সোনার গুঁড়ো দিয়ে ঢাকা। এসব জায়গা নিষ্কলঙ্ক, ধুলি ময়লাহীন। দেবলোক থেকে এসে মানুষেরা এখানে জন্মগ্রহণ করে। মানুষেরা সবাই অভিজাত, ধনী ও স্থির যৌবনা। এখানকার রমণী মনোহারিণী। স্ত্রী পুরুষ সবাই ক্ষীরিগাছের অমৃত পান করে। নরনারী একসাথে জন্ম নেয়। এক সাথে বেড়ে ওঠে। তাদের রোগ নেই। শোক নেই। সেখানকার অধিবাসী পুরুষরা তেরো হাজার একশো পঞ্চাশ দিন জীবনধারণ করে। এরা কখনো পরস্ত্রী সম্ভোগ করে না।
এরপর উত্তর কুরুবর্ষের বিবরণ বলছি। এই দেশে দুটি খুব উঁচু পাহাড় আছে। এগুলোতে ছোট-বড় অনেক গুহা ও ঝর্ণা আছে। এখানে বহু কুঞ্জ, বন, চিত্র বিচিত্র ধাতুরাগে রঞ্জিত। বহু ধাতু অনেক ফল ফুল দিয়ে সাজানো। ঐ কুলাচল দুটোর নাম চন্দ্রকান্ত ও সূর্যকান্ত। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ভদ্রসীমা নামে মহানদী বয়ে চলেছে।
এছাড়া অনেক নদী আছে। এসব নদীগুলো কুরুবর্ষবাসীদের স্নান, পান ও অবগাহনের জন্য, তারা পর্যাপ্ত জল বয়ে নিয়ে চলেছে। এদের মধ্যে কতগুলো নদী ক্ষীরবাহিনী, কতগুলি মধু ও মদ্যবাহিনী আর কতগুলি ঘৃতবাহিনী। এছাড়া ওখানে শত শত দধিদ, বহুসংখ্যাক সুস্বাদু অন্ন পর্বত ও অমৃতের মতো সুস্বাদু নানা রকম ফল রয়েছে। সেখানে হাজার হাজার ফুল। তমাল, অগুরু ও চন্দনের হাজার হাজার বনভূমি। ভ্রমর গুঞ্জনে মুখরিত গাছ, লতাপাতা যুক্ত সুন্দর বন পাখিদের কূজন মুখরিত পদ্ম সরোবর। সোনামণিরত্নযুক্ত দিয়ে সাজানো সুন্দর উদ্যান ও বহু শিলাগৃহ, লতাগৃহ ইত্যাদি আছে। সুন্দর মণিময় অট্টালিকা আছে, সেখানকার শত সহস্র কল্পবৃক্ষ ঐসব ফল প্রসব করে থাকে। ঐ বর্ষের সব জায়গাতে উদ্যান ও নগর রয়েছে। সমস্ত দ্বীপ নরনারী সমাকুল। স্বর্গচ্যুত মানুষেরাই এখানে জন্ম নেয়। সেই মনোহর জায়গাটিকে ভৌম স্বর্গ বলা হয়। পূর্বদেশ থেকে যে নরশ্রেষ্ঠরা এসেছেন, তাঁরা চাঁদের মতো কান্তিযুক্ত এবং অধিবাসী প্রজারা সূর্যের মতো কান্তিশালী। এরা যথাক্রমে শ্যামা ও শ্যাখাবদাত ও সবাই সুখভোগে নিমগ্ন। ঐসব দেশের নরগণ দেবতাদের মত পরাক্রান্ত, সুপ্রভ। বালা, হার, কানের দুল এদের গয়না, মালা, মুকুটে সজ্জিত। এরা স্থির যৌবন, প্রিয়দর্শন। ঐ প্রজারা বহু হাজার হাজার বছর জীবনধারণ করে। এরা প্রসবধর্মী নয়, এদের বংশক্ষয় নেই। সেখানকার গাছগুলি থেকে যমজ নরনারী জন্মায়। এখানে ধর্ম বা অধর্ম কিছুই নেই। ব্যাধি, জরা ক্লান্তি সেখানে নেই। সময় শেষ হলে এখানে সকল জন বুদবুদের মতোই নষ্ট হয়ে যায়। সর্ব দুঃখ মুক্ত ও সুখভোগী উত্তর কুরুর দক্ষিণপাশে চন্দ্রদ্বীপ নামে এক বিখ্যাত সুরনিবাস আছে। সাগরের ঢেউ-এ ঘেরা, জল শব্দ মুখরিত। ঐ দ্বীপ নানা ফুলে ফলে ভরা, পরম সমৃদ্ধি সম্পন্ন।
এর বিস্তার হাজার যোজন আয়তন। এর মাঝে কুমুদ্রপ্রভ নামে এক সিদ্ধ চারণসেবিত পর্বত আছে। এটি চন্দ্রাভ, চন্দ্রাকার, সুলক্ষণযুক্ত, শ্বেতবর্ণ, কুমুদ দিয়ে চিত্রিত। এর ভেতরে নানা উদ্যান, ঝর্না, গুহা রয়েছে। ঐ পাহাড় থেকে চন্দ্রাবতী নামে একটি তরঙ্গময় উত্তম নদী বয়ে চলেছে। ঐ নদীর জল চাঁদের কিরণের মতো বিমল, এই নদী চন্দ্রমার প্রধান স্থান। গ্রহনেতা চন্দ্রমা ঐ নদীতে সবসময়ই নেমে থাকেন। ওখানে চন্দ্রমা নামে একটি মহাপর্বত এবং স্বর্গ-মর্ত্য দু জায়গাতেই মহাদ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপ প্রকাশ পাচ্ছে। চাঁদের কান্তি সম্পন্ন, পূর্ণ চন্দ্রের মতা মুখমণ্ডলধারী ধার্মিক, প্রিয়দর্শন তারা সবাই সদাচারী এক হাজার বছর বেঁচে থাকে।
পশ্চিমদিকে নানা ফুলে ভরা একটি দ্বীপ আছে। এটি পশ্চিম দ্বীপ নামে খ্যাত, নাম ভদ্রাকর। ধনধান্যে ভরা এই দ্বীপের পালন ভার রাজাদের ওপর। এই দ্বীপে ভগবান বায়ুর একটি নানা রত্নময় ভদ্রাসন আছে। সেখানে পর্বে পর্বে মূর্তিমান বায়ু পূজিত হয়ে থাকেন। সেখানে যেসব রাজা বাস করেন, তাদের গাত্র বর্ণ সোনার মতো। সোনার অলংকারে সজ্জিত, দেবসদৃশ রাজাদের আয়ুর পরিমাণ পাঁচশো বছর। তারা ভাগ্যবান, সত্য প্রতিজ্ঞ।
ঋষিরা সূতকে বললেন–এই যে ভারতবর্ষ, যেখানে স্বয়ম্ভুবাদি, চোদ্দজন মনু প্রজাসৃষ্টির ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়ে থাকেন, সেই ভারত বিষয়ে আমরা জানতে চাই। সূত বললেন–হিমালয়ের দক্ষিণ দিকের উঁচু দেশ পূর্ব ও পশ্চিম আয়ত। এর দক্ষিণ দিকে পুণ্যতীর্থ ভারতবর্ষ। এটি বিচিত্র, শুভাশুভ ফলের উৎপাদন। সেখানকার প্রজারা ভারতী প্রজা নামে বিখ্যাত। মনু এখানকার প্রজাদের ভরণ ভারণের ফলে ভরত নামে অভিহিত হন। এই ভারতবর্ষেরই স্বর্গ, মোক্ষ বা মধ্য ও অন্তগতি লাভ করে থাকে। এই জায়গা ছাড়া অন্য কোন ভূমিতেই মর্ত্য বাসীদের কাজের ব্যবস্থা নেই। এই ভারতবর্ষের নটি বিভাগ আছে। ঐসব বিভাগ বা দ্বীপের মাঝে সমুদ্র আছে। সুতরাং সমুদ্র পার হয়ে অন্য দ্বীপে যাওয়া যায় না। ইন্দ্রদ্বীপে, কুমেরু, তাম্রপানী, পতস্তিমান, নাগদ্বীপ, মোখ্য, গন্ধর্ব ও বারুন, এবং নবম। এটি কুমরিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত আয়ত ও নয় হাজার যোজন পর্যন্ত উত্তরদিকে তির্যক ভাবে বিস্তীর্ণ।
এর শেষ সীমাতে ম্লেচ্ছ জাতির বাস। পূর্ব দিকে কিরাতদের ও পশ্চিম দিকে যবনদের বাস। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-এর মাঝে বিভাগ রয়েছে। এইসব বর্ণের পারস্পরিক ব্যবহার, ধর্ম, অর্থ ও কামযুক্ত। এই ভারতবর্ষেই পাঁচ আশ্রম যথাবিধি প্রতিপালিত হয়। এই ভারতবর্ষে সাতটি সুপর্ব বিশিষ্ট পর্বত বিখ্যাত। এদের নাম, মহেন্দ্ৰ মলয় সহ্য সুক্তিমাম, ঋক্ষ, বিন্ধ্য, পরিযাত্র, এদের সঙ্গে আরও হাজার হাজার পর্বত আছে। এরা সমস্ত গুণের আকর, বিচিত্র সানুযুক্ত। এদের মধ্যে মন্দর, বৈহার, কোলাহল, সুরস, মৈনাক, বৈদ্যুত, পুষ্পগিরি, কৃষ্ণগিরি, রৈবতক, শ্ৰী পর্বত, করু ও কূট শৈল প্রভৃতি। এই পর্বতগুলো থেকে আরও ছোট ছোট পর্বত এসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনপদে এসে মিশেছে। আর্য ও ম্লেচ্ছ জাতিরা এই জনপদে বাস করে। তারা যেসব নদীর জল পান করে তাদের–নাম হল গঙ্গা, সিন্ধু, সরস্বতী, শতদ্রু, চন্দ্রভাগা, যমুনা, ইরাবতী, সরযু, বিতস্তা, বৃহু, গোমতী, গণ্ডকী, কৌশিকী, ইক্ষু, লোহিত প্রভৃতি। এইসব নদী ও নদগুলো হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। বেদশ্রুতি, বেদবতী, বিদিশা, বন্দনা, সিন্ধু, শিপ্রা, অবন্তী–এই সব নদী পর্বত্র থেকে বেরিয়েছে। মহানদ শোল, নর্মদা, মন্দাকিনী, করতোয়া, তমসব–এসব নদী মণিনিভ এবং ঋক্ষপাদ হতে বয়ে চলেছে। তাপী, ভদ্রা, বৈতরণী, শিতিবাহু, মহাগৌরী, দুর্গা, অন্তরশীলা এইসব নদী বিন্ধ্যপর্বত থেকে বয়ে এসেছে।
গোদাবরী, ভীমরথা, কৃষ্ণা, বগুলা, তুঙ্গভদ্রা, কাবেরী এই দক্ষিণা পথ প্ৰবাহিণী নদী সহ্যপাদ থেকে এসেছে। কৃতমালা তাম্রবণী, পুষ্পজাতী ও উৎপলাবতী এই নদীগুলো মলয় পর্বতের পাদদেশ থেকে এসেছে। ত্রিযামা, ইক্ষলা, ত্রিদিবা, লাঙ্গুলিনী ও বরবাধরা এই নদীগুলো মহেন্দ্র পর্বত থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ঋচীকা, সুকুমারী, মন্দগা, মন্দবাহিনী, কৃপা ও পশিলী এই নদীগুলো শুক্তিমৎ প্ৰভবা এই গঙ্গা প্রভৃতি নদীগুলোকে পুণ্য জলশালিনী, সমুদ্রগামী বিশ্ব মাতৃকল্পা ও জগৎ পাপহরা বলে।
এদের শাখা-প্রশাখা থেকে শত সহস্র নদী উপনদী সৃষ্টি হয়েছে। ঐ নদী উপনদীর কতগুলো কুরুজঙ্গলে বয়ে চলেছে। এভাবে কতগুলি সম্বদেশে, কতগুলো জঙ্গলে, কতকগুলো শূরসেনে, কিছু ভদ্রাকারে, কিছু বোধ দেশে, কিছু বংশদেশে, কিছু নদী কুন্তরে, কিছু নদী মগধে আর কতগুলো মধ্যদেশে বয়ে চলেছে। সহ্যাদ্রির উত্তরদিক যেখানে গোদাবরী নদী বয়ে চলেছে, সেই জায়গাটি সমস্ত পৃথিবীর প্রদেশগুলোর মধ্যে মনোরম। এখানেই সুররাজ গোবর্ধন নামে এক পুরী নির্মাণ করেন। ভগবান ভরদ্বাজ মুনি রামচন্দ্রের প্রিয় পর্বত, বৃক্ষ, ওষধি প্রভৃতি অবতারিত করেন। রামচন্দ্র অন্তঃপুরচারিণীরদের জন্য তৈরী করেন বাহ্লীক, আভীর, শুদ্র, চর্মণ্ডিক, গাধার, যবন, শক, হ্রদ, রুদ্ধ কটক, আত্রেয় ইত্যাদি দেশগুলো উদীজ।
প্রাচ্যদেশীয় জনপদ হল অন্ধ্র, অন্তর্গিরি প্রবঙ্গ, বঙ্গেয়, ভার্গব, বিদেহ, তাম্রলিপ্তক, মাল, মগধ, ইত্যাদি। দক্ষিণা পথের জনপদগুলো পাণ্ডু, কেরল, চৌল্য, কুল্য, সেতুক, মূষিক কুমন, বন বাসিক, মহারাষ্ট্র, বর, পুলিন্দ, বৈদর্ভ, দণ্ডক, পৌণিক, কুণ্ডল ইত্যাদি অন্য দক্ষিণাত্য দেশগুলি হল ভোলবর্ণ, দুর্গ, কালিতক, মুরাল, রূপস, তাপস, পরক্ষর, নাসক্য ইত্যাদি। নর্মদা নদীতীরে দেশগুলো হল ভানুকচ্ছ, শাৰ্দ্ধত, কচ্ছীয়, নর্তন।
অবুদ ও সস্পরীত, এবার বিন্ধ্যাচলের দেশগুলোর নাম শুনুন–মানব, করুষ, রোকল, উত্তাল, উত্তমান, রসাণ, ভোজ, কিষ্কিন্ধ্যা, তোষণ, কোশল, ত্রৈপুর, বৈদিক, তুমুর, তুম্বুর, অষ্টসুর, নৈষধ, অনুপ, তুন্তিকের, বীতিহোত্র ও অবন্তী এই সব জনপদ বিন্ধ্যের ওপর রয়েছে। এবার পর্বতাশ্রয়ী দেশ গুলো হল নিগহর, হাংসমাগি, ক্ষুপন যশ, হূণ, কিরাত, মালব ইত্যাদি।
.
সাতচল্লিশতম অধ্যায়
ঋষিরা অন্যান্য বিষয়ে আরো শুনতে ইচ্ছা করলেন ও আনন্দের সাথে লোমহর্ষণকে জিজ্ঞাসা করলেন–হে সূত! যেমন ভারতবর্ষের কথা বললেন–সেই ভাবেই কিশুরুষ ও হরিবর্ষের কথা বলুন। সূত বললেন–হে বিপ্রগণ, আপনাদের যা শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে আমি তার বিস্তৃত বিবরণ বলছি, আপনারা আনন্দের সাথে তা শুনুন। কিম্পুরুষবর্ষে নন্দনের মতো সুমহান প্লক্ষখণ্ড রয়েছে। সেখানকার লোকেদের আয়ু দশহাজার বছর। লোকেদের গায়ের রং সোনার মত। স্ত্রীলোকেরা সুন্দরী, সকলেই সেখানে শোকহীন, শুদ্ধচিত্ত ও তপ্ত কাঞ্চনের মত উজ্জ্বল তাদের শরীর। পবিত্র এই দেশে মধুস্রাবী সাদা ফুলের গাছ আছে। সবাই তার রস পান করে।
এবার হরিবর্ষের বিবরণ বলছি–এরা সবাই দেবাকৃতি সম্পন্ন। এরা মধুর ইক্ষুরস পান করে। মানুষের আয়ুর পরিমাণ এগারো হাজার বছর। এখানে কেউ জরা বা জীর্ণদশা ভোগ করে না। আমি যে মধ্যম বর্ষ ইলাবৃতের কথা বলেছি, সেখানে সূর্য তাপ দেয় না বা মানুষ কখনো জীর্ণ হয় না। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র সমস্তই ইলাবৃতে অপ্রকাশিত মানবেরা, সেখানে পদ্মপ্রভ, পদ্মবর্ণ, পদ্মপত্রের মতো চোখ, তারা জমুফলরস পান করে থাকে। তাদের জরামৃত্যু নেই। তারা মনস্বী, ভোগ নিরত ও তারা দেবলোক থেকে এসেছে। সেখানে নরোত্তমেরা তেরো হাজার বছর জীবনধারণ করে। মেরুগিরির পূর্বদিকে নয় হাজার যোজন বিস্তৃত ভূভাগে ইলাবৃতবর্ষের লোকেরা বাস করে।
এই বর্ষটি ছাব্বিশ হাজার যোজন বিস্তৃত। মেরুর পশ্চিমভাগ নয় হাজার যোজন পরিমাণ, সেখানে চৌত্রিশ হাজার যোজন ধরে গন্ধমাদন পর্বত আছে। এটি উত্তর ও দক্ষিণ দিকে নীল ও নিষধাচল পর্যন্ত আয়ত। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতার পরিমাণ চল্লিশ হাজার যোজন, এটি ভূগর্ভে এক হাজার যোজন ঢুকে পড়েছে। এর পূর্ব দিকে মাল্যবান পর্বত। ঐ পাহাড়ের পরিমাণ গন্ধমাদনের মতোই বিশাল, দক্ষিণে নীলাচল, উত্তরে নিষ্ঠাচল আর ঐ গন্ধমাদন ও মাল্যবান এদের মধ্যে মহামেরু আছে।
নিষধাচলের উত্তরদিকে সুমেরুর দক্ষিণ পাশে এক জম্বুরসবতী নদী বয়ে গেছে। সেখানে সুদর্শন। নামে এক মহাজম্বুগাছ আছে। এটি ফুল ফলে সাজানো, সিদ্ধ ও চারণদের দ্বারা সেবিত। ঐ দ্বীপে অন্য এক মহান বনস্পতি আছে। ঐ বনস্পতি সাত হাজার যোজন বিস্তৃত, তত্ত্বদর্শী ঋষিরা বলেন, ঐ গাছের একটি ফলের পরিমাণ আটশো ষাট আরতি। ঐসব ফল মাটিতে পড়লে মহাশব্দ হয়। এদের রস প্রবাহ নদীর আকারে বয়ে চলেছে। আর মেরু গিরিকে প্রদক্ষিণ করে জম্বু গাছের নীচে প্রবেশ করেছে। সেখানে অধিবাসীরা আনন্দের সঙ্গে ঐ গাছের রস পান করে। কারণ এই গাছের রস পান করলে জরা, ব্যাধি, ক্রোধ বা মৃত্যুকে জয় করা যায়। সেখানে জন্ধুনদ নামে বিশুদ্ধ সোনা জন্মায়। সমস্ত বর্ষবৃক্ষের মধ্যে এই ফুলের রসই সুমধুর, রুক্ষ, পিশাচ, যক্ষ, হিমালয়বাসী গন্ধর্ব, অপ্সরা, শেষ বাসুকি, তক্ষক প্রভৃতি সমস্ত নাগ নিষধাচলে থাকে। তেত্রিশ সংখ্যক যাজ্ঞিক সুর মহামেরুর ওপরে ঘুরে বেড়ায়, বৈদূৰ্য্যময় নীলাচলে অনল, সিদ্ধ ও ব্রহ্মর্ষিরা রয়েছেন। শ্বেতগিরি দৈত্য ও দানবের বাসভূমি। শৃঙ্গবান পর্বত পিতাদের আবাসস্থান, বিভাগ ক্রমে যে ন-টি বর্ষ, সেখানে পতিশীল ভূতগণ সব সময় থাকে। চেষ্টা করেও তার সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না।
.
আটচল্লিশতম অধ্যায়।
সূত বললেন–হিমালয়ের মাঝে কৈলাস নামক এক পর্বত আছে। সেখানে শ্রীমান কুবের রাক্ষসদের সাথে থাকেন, লঙ্কাপতি কৈলাসে অপ্সরাদের সাথে সব সময়ই আমোদ আহ্লাদ করে থাকেন। কৈলাস পর্বতের পাদদেশ থেকে শরতের জলের মত পবিত্র, শীতল জল উৎপন্ন হয়। এখান থেকেই শুভ মন্দাকিনী নামের দিব্য নদী উৎপন্ন হয়েছে। নদীর তীরে একটি বিরাট নন্দন বন আছে। কৈলাস পর্বতের পূর্ব-উত্তর দিকে চন্দ্ৰপ্ৰভ নামে এক রত্ন সন্নিভ পর্বত আছে, ঐ পর্বতে দিব্য সত্ত্ব ও ঔষাধাদি যুক্ত নানা ঋতু রয়েছে। এর নীচের দিকে আচ্ছাদন নামে একটি পবিত্র নদী বয়ে গেছে। সেই নদীর তীরে চৈর রথ নামে প্রসিদ্ধ বন আছে। পূর্বে বলা হয়েছে যে চন্দ্ৰপ্ৰভ পর্বতের কথা সেখানে যক্ষসেনাপতি মণিভদ্র অনুচর সহচর নিয়ে বাস করেন।
কৈলাস পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বে সূর্যপ্রভ নামে এক বিশাল পর্বত আছে। এটি দেখতে লোহিতাকার আর শৃঙ্গগুলো সোনা দিয়ে নির্ণীত। এই সূর্য প্রভ পর্বতের নীচের দিকে লোহিত নামে একটি মহৎ দিব্য সরোবর আছে। ঐ সরোবর থেকে লোহিত্য নামে এক পুণ্য মহানদী বয়ে চলেছে। তার তীরে বিশোক নামে এক মহাবন রয়েছে এই বন দেবতাদের লীলাস্থান। ঐ পর্বতের ওপরে মণিবর নামে এক যক্ষরাজ বাস করেন, সৌম্য, সুমিক গুহ্যকেরা তাকে ঘিরে থাকে। কৈলাস পর্বতের দক্ষিণ পাশে বৃত্রকায়ত থেকে জাত ক্রুর জন্তা ও ওষধিযুক্ত অজ্ঞানাচলের বিশাল বৈদ্যুৎপতি রয়েছে। তার পাশে পবিত্র মানস সরোবর। মানস থেকে সরয়ু নদী উদ্ভূত, এর তীরে বন আছে। ঐ বনে কুবেরের তীরে ব্রহ্মপাত নামে এক বিপুল বিক্রম রাক্ষস বাস করে। কৈলাসের পশ্চিমে, বিভিন্ন জন্তু ও ওষধি পরিপূর্ণ মেগাকার পাহাড় আছে।
এক নাম শ্ৰীবান পর্বত। স্বর্ণচূড়া নিয়ে পাহাড়টি যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ঐ দুর্গম পর্বত সুবৃহৎ দেবভোগ্য ও হিমচিত, ঐ গিরির উপরিভাগে বাস করেন গিরিশ, এর পাদদেশ থেকে শৈলোদ নামে এর সরোবর উৎপন্ন হয়েছে। সেই সরোবর থেকে শৈলেদা নামে এক দিব্য নদী প্রবাহিত হয়েছে। ঐ নদী চক্ষু ও সীতা নদীর মধ্যে দিয়ে লবণ সাগরে প্রবেশ করেছে। এর তীরে রয়েছে সুরভি নামে বন। কৈলাস শৈলের উত্তরদিকে মঙ্গলময় প্রাণী ও ওষধিময় গৌর নামে পর্বত আছে। এটি হরিতালময়। এর নীচের দিকে সুন্দর স্বর্ণ বালুময় সরোবর আছে। এটি হরিতালময়। এর নীচের দিকে সুন্দর স্বর্ণ বালুকাময় সরোবর আছে। নাম বিন্দুসরা। রাজা ভাগীরথ সেখানে গিয়েছিলেন, এই রাজা গঙ্গার জন্য আরাধনা করেন। আমাদের পূর্বপুরুষরা গঙ্গাজলে প্লাবিত হয়ে স্বর্গ লাভ করবেন, এই ছিল তার সংকল্প।
দেবী ত্রিজথগা প্রথমে সেখানেই ছিলেন। এরপর তিনি সোমপাদ থেকে এসে সাতটি ভাগে ভাগ হয়ে সাতদিকে চলেন। ইন্দ্র সমস্ত দেবতাদের সাথে যজ্ঞ করে স্বর্গপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আকাশে নক্ষত্র মণ্ডলের কাছে যে ছায়াপথ, তিনিই দেব ত্রিপথ গামিনী। স্বর্ণ অন্তরীক্ষ প্লাবিত করে ভূতলে এসেছেন। তিনি মহাদেবের মাথায় পতিত হয়ে বাঁধা পড়েন। মহাদেব রুষ্ট হলে মাটিতে যে কয়েক বিন্দু জল পড়েছিল, তাতেই সৃষ্ট বিন্দুমর।
দেবী গঙ্গা মহাদেবের কাছে বাঁধা পড়ে ভাবতে লাগলেন আমি কিভাবে মুক্তি পাব, তাহলে শঙ্করকে নিয়েই স্রোতের বেগে পাতাল প্রবেশ করি। মহাদেব এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে সতর্ক হলেন, নিজের মাথাতেই আটকে রাখলেন। তিনি দেখলেন রোগ জীর্ণ চেহারায় রাজা ভগীরথকে সামনে দাঁড়িয়ে দেখে বুঝলেন ভগীরথ গঙ্গার জন্য আমায় তুষ্ট করেছিলেন। তাই এঁকে বরদান করা উচিত। তখন গঙ্গাকে তিনি সতেজ ত্যাগ করলেন পরে সেই গঙ্গার ধারা সাতটি ভাগে ভাগ হয়। নলিনী, ব্রাদিনী ও পাবনী এই তিনধারা পূর্বদিকে, সীতা, চক্ষু সিন্ধু এই তিনটে ধারা পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে।
এজন্যই গঙ্গা ভাগিরথী নামে পরিচিত হয়ে লবণ সাগরে প্রবেশ করেন। গঙ্গার এই সাতটি ধারাই বিস্তীর্ণ প্লাবিত করছে। বিন্দু সরোবর থেকে সাতটি নদী বেরিয়েছে। এরা নানা দেশ প্লাবিত করে বয়ে চলেছে। এই সাত নদী সিরীন্ধ্র কুন্তল, চীন, বর্বর, যবন দ্রুহ ও রুথান, কলিন্দ ও অঙ্গ লোকে উপস্থিত হয়েছে। গঙ্গার শীতল ধারা সিন্ধু ও অরুদেশকে দুভাগে ভাগ করে পশ্চিম সাগরে প্রবেশ করেছে। চম্বুনাথের ধারাটি চীন, অরু, তঙ্গন, অন্দ্র, তুষার প্রভৃতি অসংখ্য জনপদকে প্লাবিত করেছে। দরদ, কাশ্মীর, গান্ধার, বরক, হ্রদ, শিবগৌরী প্রভৃতি সিদ্ধচারণ সেবিত দেশগুলো ও কুরু, ভরত, পাঞ্চাল, কোশল, কাশী, মৎস্য, মগধ, উরগ, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত এই সবলোক ও জনপদগুলোকে গঙ্গানদী পবিত্র করেছে এবং বিন্ধ্যাচলে বাধা পেয়ে দক্ষিণ সাগরে প্রবেশ করেছে।
নলিনী ধারা সবেগে পূর্বদিকে বয়ে চলেছে। এই নদী তোমর, হংসমার্গ, হুহুক ও অন্যান্য পূর্বদেশগুলো প্লাবিত করেছে। এই ধারাই বহু পর্বতভেদ করেছে। গঙ্গার সাতধারা থেকে শত শত সহস্র নদী উপনদী বেরিয়ে তাদের সাথে মেঘেরা এসে মিলেছে। জম্বাক সাগর তীরে সুরভিত বন প্রদেশে হরিশৃঙ্গে বিদ্বান, কৌবেরক, জিতেন্দ্রিয় চারজন কুবেরের অনুচর বাস করেন। তারা হলেন যজ্ঞোপেত অমিতেজা সুমহান ও সুবিক্রম, এঁরা অগস্ত্য বংশীয় বিদ্বান, সকলেই কুবেরের সমকক্ষ, পর্বত বাসীদের সমৃদ্ধি ভাবে প্রসিদ্ধ। হেমকূটের আগে সায়ন নামে এক সরোবর আছে। ঐ সরোবর থেকে মনস্বিনী জ্যোতিষ্মতী নদী উৎপন্ন হয়েছে। নিষাধচলে বিষ্ণুপাদ নামে সরোবর আছে। মেরুর পেছনে চন্দ্রপ্রভ নামে একটি বিশাল হ্রদ আছে। তা থেকে পবিত্র জন্ধুনদী প্রবাহিত। নীলাচলে পায়াদ নামে এক পদ্মফুল ভরা শুভ্র সরোবর আছে, তা থেকে পুণ্ডরীকা ও পয়োদা নামে দুটি নদী নির্গত হয়েছে। শ্বেত পর্বত থেকে উত্তর মানস নামে পুণ্য সরোবর উৎপন্ন হয়েছে। জ্যোৎস্না ও মৃগকান্তা নামে এর দুটি শাখা। সেখানে পদ্ম, মাছ ও পাখিতে পূর্ণ আরো একটি সরোবর আছে। এটি মধু রসে ভরা, কল্পবৃক্ষ নিয়ে সব দিক থেকে সুখী। এর নাম রুদ্রকান্ত, স্বয়ং ভবদের সৃষ্টি করেছেন, এছাড়া পদ্ম, মাছ নানা পাখিতে পরিপূর্ণ আরো বিখ্যাত হ্রদ এখানে আছে। ঐসব হ্রদ জয় নামে অভিহিত। ঐসব হ্রদ থেকে শান্তি ও বাকী নামে দুটি নদী উৎপন্ন হয়েছে। কিশুরুষ ইত্যাদি বর্ষগুলোতে দেবতা বৃষ্টি বর্ষণ করেন না। সেখানে প্রধান প্রধান নদীগুলো সব উদ্বৃত্ত জলরাশি বয়ে নিয়ে চলে।
ঋষ্য, মহাগিরি, ধুম্র, চন্দ্ৰকল্ক প্রভৃতি পাহাড় দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরদিকের শেষ সীমা পর্যন্ত। প্রসারিত হয়ে ক্ষীরসাগরে মিশেছে। চক্র, মৈনাক প্রভৃতি দক্ষিণ সমুদ্রে মিশেছে। চন্দ্র ও মৈনাক পাহাড়ের মধ্যভাগে সম্বর্তক নামে এক অগ্নি আছে এই অগ্নিরই নামান্তর সদ্রপ, বড়বামুখ ও শ্রীমান ঔর্য। বারোটি পর্বত মহেন্দ্রের পাখা ছেদনের ভয়ে ভীত হয়ে তখন লবণ সাগরে প্রবেশ করেছিল। শুভ্রবর্ণ চাঁদের মধ্যে যে কালো রঙের শশকাকৃতি দেখা যায়, তাকে ভারতবর্ষেরই প্রতিবিম্ব বলে। অন্য জায়গায় উদিত হলে চাঁদের মধ্যে অন্যান্য দেশের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, নানা জাতীয় দেশগুলোতে বাস করছে।
.
ঊনপঞ্চাশতম অধ্যায়
সূত বললেন–ভারতবর্ষের দক্ষিণে অযুত যোজন দূরে একটি মহাসাগর রয়েছে। ঐ মহাসাগর তিন হাজার যোজন আয়ত, এর তিনভাগ বিস্তীর্ণ স্থানে নানা ফুল, ফল নিয়ে বিদ্যুত্বান্ নামে এক বিরাট পর্বতকুল পর্বত রূপে বিরাজ করছে। পর্বতের চূড়াগুলো দিয়ে দ্বীপটি সাজানো। ঐ দ্বীপে স্বচ্ছ ও স্বাদুজল নিয়ে হাজার হাজার নদী বয়ে চলেছে। বিদ্যুত্বা নামে কুল পর্বতের চারিদিকে বিস্তীর্ণ ও আয়ত গুহাগুলোতে নানা আকারযুক্ত সমৃদ্ধ ও আনন্দিত স্ত্রী পুরুষরা রয়েছে। ঐ পর্বতের নীচের দিকে ও মধ্যভাগে শত, সহস্র পুরী রয়েছে। এরা পরস্পর দ্বার বিশিষ্ট। সেখানে প্রজারা জন্মের সময় থেকে গোঁফ দাড়ি সম্পন্ন, তারা নীল মেঘের মত ও আশী বছর আয়ু সম্পন্ন। ঐ প্রজাদের কেউ কেউ ফল মূল, লতাপাতা খেয়ে থাকে। এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুকে দ্বীপটি পরিপূর্ণ। এখন অন্তরদ্বীপের বিবরণ বলা হচ্ছে। অন্তরদ্বীপগুলো বিশাল আয়তন ও বহু প্রাণীপূর্ণ।
বর্হিনদ্বী বর্ষ হাজার হাজার ছোটো দ্বীপ ও নানা বস্তুর আকরা এমন আরও দুটি দ্বীপ আছে। তারা জম্বুদ্বীপ থেকে উন্নত। এখন যে দ্বীপের কথা বলা হচ্ছে সেই দ্বীপগুলো নানা রত্নের আকর, এই দ্বীপ বহু নদী ও শৈল বনে সাজানো এবং এটি লবণ জলধির মত। এখানে অনেক ঝর্না ও গুহা নিয়ে চক্রগিরিনামে এক পর্বত আছে। পর্বতের গুহায় অনেক জন্তুর বাস। দ্বীপগুলি হল অঙ্গদ্বীপ, যমদ্বীপ, মলয়দ্বীপ, এর মধ্যে অঙ্গদ্বীপ বিরাট বড় ও সোনা প্রভৃতির আকর।
তাছাড়া যমদ্বীপেও নানা ধনরত্ন আছে। এখানে ধাতুমণ্ডিত দ্যুতিমান নামে পর্বত আছে। মলয় দ্বীপটিও খুব উঁচু, এটি সোনা, মণি, রত্ন ও চন্দনের আকর। দ্বীপটি নদী পাহাড় ভূষিত। এটি রজত সকলের আকর। এখানে মহামলয় নামেও আর একটি বিখ্যাত পর্বত আছে। দেবাসুর পুজ্য অগস্ত্য ঋষি এই পর্বতে বাস করেন। মলয়ের মতো আরও একটি পর্বত আছে তার নাম কাঞ্চন পাদ। ঐ পাহাড় ঘাসপাতা ও সোমলতা নিকুঞ্জ দিয়ে আশ্রম তৈরী হয়েছে। এটি নানা ফুল, ফলে স্বর্গ থেকে ও সুন্দর শ্রী ধারণ করেছে। এখানেই পতি পর্বে স্বর্গভূমি অবতরণ করে থাকে।
নানা ধাতুতে পূর্ণ ত্রিকূট পাহাড়। এই পাহাড় বহু যোজন বিস্তৃত। গুহাগুলি বিচিত্র। এই পাহাড়ে সোনার প্রাচীর ও তোরণ দিয়ে রমণীয় মনোহর সৌধ রয়েছে। এই সব প্রাসাদ একশো যোজন বিস্তৃত ত্রিশ যোজন আয়ত। এখানেই লঙ্কা নামে মহাপুরী আছে। এই পুরী কামরুপী বলদৃপ্ত মহাত্মা দেবদেবী রাক্ষসদের আবাসস্থল। মানুষের প্রবেশযোগ্য নয়। কেউ ওখানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। ঐ লঙ্কা দ্বীপের পূর্বে সাগরতীরে গোকর্ণ শিবের প্রধান আবাসস্থল আছে।
শঙ্খদ্বীপে একটি রাজ্য আছে। এটি একশো যোজন বিস্তীর্ণ ও সেখানে প্রচুর ম্লেচ্ছ জাতির বাস। সেখানে শঙ্খের মতো শুভ্র নানা রত্নময় পর্বত আছে। এই শঙ্খগিরি থেকে শঙ্খনাগ নামে একটি পুণ্য নদী বয়ে চলেছে। শঙ্খ মুখ নামে নাগরাজ সেখানে বাসস্থান তৈরী করে রয়েছেন। এরপর কুমুদ নামে দ্বীপ রয়েছে। এখানে পুণ্যজনের বাস। সেখানে মহাভাগা কুমুদ নামে মহাদেবের বোন নিজের প্রভা নিয়ে সবার পূজ্য হয়েছেন।
এভাবে নানা অধিষ্ঠান নিয়ে সজ্জিত বহারদ্বীপেও নানান ম্লেচ্ছ ও অন্যান্য বহু জাতির বাসস্থান রয়েছে। এই দ্বীপটি উঁচু ও ধনধান্যে ভরা। সেখানে ধার্মিক লোকেরা বাস করে থাকেন। এখানে বরাহ নামে পর্বত রয়েছে। বিচিত্র নদী, দ্বীপ, পাহাড়, বন, অনেক ফুল ফল ও শিলাতে রমণীয় অনেক গুহা, নদী দিয়ে এটি সবসময় শোভিত, সরস জলে ভরা পবিত্র তীর্থ, তরঙ্গিনী বরদা বারাহী নামে মহানদী এই বরাহ পর্বত থেকে উৎপত্তি হয়েছে। বরাহ-ই সর্বদেবময়। তাই বিপ্রেরা বরাহরূপী বিষ্ণুকে প্রণাম করে থাকেন। চারটি দ্বীপের কথা বললাম, ভারত দ্বীপ দক্ষিণে বহু বিস্তৃত। এই ভারতবর্ষেই অনেক দ্বীপ আছে। সমুদ্রজলে অনেক ভাগ হয়ে গেছে। চারটি দ্বীপ জম্বুদ্বীপের বিস্তার ও তার অনুদ্বীপের বর্ণনা, আমি আগেই ভালভাবে করেছি।
.
পঞ্চদশ অধ্যায়
সূত বললেন–হে দ্বিজোত্তম, এবার আমার যেমন জানা আছে সেভাবে প্লদ্বীপের বর্ণনা করছি। প্লক্ষদ্বীপের বিস্তার জম্বুদ্বীপের দ্বিগুণ। এবার এর চারদিকের বিশালতা তার থেকে দ্বিগুণ। এই দ্বীপই লবণ সাগরকে ঘিরে রেখেছে। জনপদগুলি খুব পবিত্র প্রজারা দীর্ঘায়ুযুক্ত। এখানে দুর্ভিক্ষ, জরা কিংবা ব্যাধি ভয় নেই। মণিময় সাতটি পর্বত ও নানা রত্নময় নদীগুলো রয়েছে। সাতটি দ্বীপের প্রত্যেক দিকেই সাতটি করে পর্বত রয়েছে। প্রথমটির নাম গোমেদক পর্বত। এটি মেঘের মত। দ্বিতীয়টির নাম চন্দ্রপর্বত। এই পর্বতে নাম ওষধি সবসময় রয়েছে। অমৃতের জন্য অশ্বিনীকুমারদ্বয় এই পর্বতে ওষধি স্থাপন করেছেন। তৃতীয় নারদ পর্বত। এই পর্বতটি দুর্গশেল রূপে বিরাজ করছে। এটি খুব উঁচু নয়। এখানেই নারদ ও পর্বত ঋষি উদ্ভূত হয়েছিলেন। চতুর্থ দুন্দুভি প্রাচীন ছিলেন। এটি বহু অসুরদের বধ্যভূমি।
এবার বর্ষগুলোর কথা বলছি। গোমেদ পর্বতের বর্ষনাম পাণ্ডভয়, চন্দ্রের শিশির, নারদের সুখোদয়, দুন্দুভির আনন্দ, সোমকের শিব, ঋষভের সোমক এবং বেভ্রজে এর বর্চ ধ্রুব। এ সব জায়গাতে চারণদের সাথে দেব, গন্ধর্ব ও দ্বিজদের সব সময় বিহার করতে দেখা যায়। এদের প্রত্যেকের সাগরগামী একটি নদী আছে। সাত গঙ্গা হল–অনুতপ্তা, সুতপ্তা, বিপাশা, মুদিতা, ক্রতু, অমৃতা ও সুকৃতা। এরা আবার হাজার নদীর জননী। দেবরাজ এই সব বর্ষে সব সময় বর্ষণ করে থাকেন। প্রজারা এই সব নদীর জল পান করে থাকে। তারা সবল, নীরোগ, মানুষেরা আকাঙ্ক্ষা উঁচু বা নিচু নয়। প্লক্ষ প্রভৃতি দ্বীপে সবসময় যেন ত্রেতা যুগ, কাল মাহাত্মে এরা পাঁচ হাজার বছর বেঁচে থাকে। প্লক্ষ দ্বীপে ওষধিযুক্ত বনস্পতি রয়েছে। হাজার হাজার গ্রাম্য ও অরণ্য পশু আছে। এই দ্বীপে প্লক্ষ নামে এক মহাবৃক্ষ আছে। আমের রসের সাগর দিয়ে ঘেরা জনপদ বাসীর পূজ্য দেবতা স্থানু।
এবার সংক্ষেপে শাল্মলীদ্বীপের বর্ণনা শুনুন–শাল্মলদ্বীপ শ্রেষ্ঠতায় অন্যান্য দ্বীপগুলোর তৃতীয় ও আমের রসের সাগর দিয়ে বেষ্টিত। এর পরিধি প্লক্ষদ্বীপের বিস্তারের দ্বিগুণ। এখানে সাতটি বর্ষ পর্বত আছে। এরা সব রত্নের আকর। ঐসব বর্ষ পর্বতের প্রথমটির নাম কুমুদ। এটি সূর্যের মতো প্রভাসম্পন্ন। এর শৃঙ্গমালা নানা ধাতুময় এবং তা থেকে আবার বহু শিলা বার হয়েছে।
দ্বিতীয় উন্নত পর্বত বিখ্যাত পর্বত। বরিতালময় শৃঙ্গগুলো স্বর্গ আবৃত করে রেখেছে।
তৃতীয় বিশ্রুত বলাহক, এই বলাহক ও অজ্ঞানময় শৃঙ্গ দিয়ে স্বর্গ আবৃত করে রেখেছে।
চতুর্থত দ্রোণ এখানে মৃত্যজ্ঞবণী ও বিশল্যকরণী আছে।
পঞ্চমত বাদ খুব উঁচু পর্বত, ফল ফুলে ভরা গাছ ও লতা রয়েছে।
ষষ্ঠত মহিষ পর্বত, মেঘের মতো আভাযুক্ত এখানে জল থেকে উৎপন্ন মহিষ নামে অগ্নি বিরাজ করে।
সপ্তমত কুকমাল, এখানে নানারকম রত্ন আছে। বিধাতা যখন প্রথম প্রজা সৃষ্টি করতে শুরু করেন, স্বয়ং বাসব তখন এখানে বৃষ্টিবর্ষণ করেছিলেন। এবার সাতটি পর্বতের সাতটি বর্ষের নাম বলছি কুমুদ পর্বতের বর্ষশ্বেত, উন্নতের লোহিত, বলাহকের জীমূত, দ্রোণের হরিত, কচ্ছের বৈদ্যুত, মহিষের মানস, ককুদের সুপ্রভ–এই সাতটি বর্ষ সাত ভাগে বিভক্ত। এবার নদীর নাম শুনুন। পানিতোয়া, বিতৃষ্ণা, চন্দ্রা, শুক্রা, বিমোচনী, নিবৃত্তি প্রভৃতি। এসব নদীর কাছাকাছি অনেক নদী রয়েছে। তাদের সংখ্যা বলা অসাধ্য। পাল্মলের সন্নিবেশের কথা বলা হয়েছে। এটি প্লক্ষ বৃক্ষের জন্য বিখ্যাত। এর মধ্য দেশে শাল্মল দ্বীপ অবস্থিত। এর চারিদিকেই সাগর।
এবার চতুর্থ কুশদ্বীপের কথা বলছি। সুরোদ সাগর কুশ দ্বীপ দিয়ে ঘেরা। এখানেও সাতটি পর্বত রয়েছে। বিস্তার শাল্মল দ্বীপের দ্বিগুণ। এটাই এই দ্বীপের প্রথম পর্বত। এভাবে এই দ্বীপে দ্বিতীয় হেম পর্বত, তৃতীয় জীমূতের মত দুতিমান, চতুর্থ পুষ্পৰা, পঞ্চম কুশেবায়, ষষ্ঠ হরিগিরি ও সপ্তম বন্দর। মন্দ নামে জলের ভেদ করে এই পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। তাই পাহাড়ের নাম হয়েছে মন্দার। এবার এদের বর্ষ পর্যন্ত গুলো হল। প্রথম উদ্ভিদ, দ্বিতীয় রেণুমণ্ডল, তৃতীয় স্বৈরথাকার, চতুর্থ লবণ, পঞ্চম ধৃতিম, ষষ্ঠ প্রভাকর ও সপ্তম কপিল। এই সব পর্বতে ঐ শ্ৰীশক্তি সম্পন্ন দেব গন্ধবদের বিচরণ করতে দেখা যায়। ম্লেচ্ছ জাতি বা দস্যুভীতি নেই। এদের গায়ের রঙ ফর্সা। এদের পর্যায় ক্রমে মৃত্যু হয়। এসব জায়গার মাটি পবিত্র, বিস্তৃত, তেজোগৰ্ভ। এই কুশদ্বীপের বাইরের দিকটা সমুদ্র দিয়ে ঘেরা রয়েছে।
ক্রৌঞ্চ দ্বীপের বিস্তার কুশ দ্বীপের দ্বিগুণ। এটি ঘৃতোদ সাগরকে ঘিরে রয়েছে। এই দ্বীপে ক্রৌঞ্চ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ও প্রথম, এর পর বা মনক, অন্ধকারক, দিবাকৃত, দিবিন্দ, পুণ্ডরীক ও দুন্দুভি নামক পর্বত প্রসিদ্ধ। ক্রৌঞ্চদ্বীপ-এর সাতটি পর্বর্তই রত্নময়, ফলবান গাছ ও নানা জাতীয় ফুল ও লতা দিয়ে সাজানো। এদের বর্ষ পর্বতগুলো পরস্পর নিজ নিজ বিষ্কম্ভ থেকে দ্বিগুণ। এবার এদের নাম ক্রৌঞ্চের বনাম, কুশলী, বামনের মনোনুগ, এর পর তৃতীয় বর্ষ। উষ্ণ, উষ্টেত্ত পর প্রবরকে এর পর অন্ধকারক, এরপর মুনিদের মুনিদেশের পরে দুন্দুভিস্বন, এখানে সিদ্ধ চারণেরা থাকেন, মানুষেরা সব গৌরবর্ণ। বর্ষগুলোতে একটি করে সাতটি নদী আছে। এরা সকলেই শুভ দায়িনী, গৌরি কুমুতী, সন্ধ্যা, রাত্রি মনোজবা খ্যাতি পুণ্ডরীকা ও গঙ্গা এই সাতটি হল বর্ষনদী, এই সব বর্ষনদীতে বিপুল ইন্দ্র সাগর গামিনী নদীগুলোর সাথে আবার ঐ সাতটি বর্ষনদী মিলেছে। দ্বীপের চারধারেই দধি সাগর দিয়ে ঘেরা। প্লক্ষ দ্বীপগুলোও ক্রৌঞ্চদ্বীপের তুল্য।
এর পর শাক দ্বীপের বিষয় বলছি শুনুন। এই শাক দ্বীপের বিস্তার ক্রৌঞ্চদ্বীপের দ্বিগুণ। দধিমণ্ডোদক সমুদ্রকে ঘিরে এই দ্বীপ রয়েছে। এখানকার জনপদগুলো পবিত্র, এখানকার প্রজারা দীর্ঘজীবি। এখানে দুর্ভিক্ষ, জরা ব্যাধি ভয় নেই। এই দ্বীপে মণিভূষিত সাতটি সাদা পর্বত ও নানারকম রত্নে ভরা সাতটি নদী আছে। আমার কাছে এদের নাম শুনুন। প্রথমে সাতটি পাহাড়ের নাম বলছি। প্রথমটির নাম মেরু, এই মেরুতে দেবর্ষি ও গন্ধর্বরা থাকেন। দ্বিতীয় উদয় পর্বত। এই পর্বত পূর্বদিকে চওড়া ও সোনার তৈরী। বৃষ্টির জন্য মেঘেরা এখানে জড়ো হয় এবং অন্য জায়গায় চলে যায়। এরপর বৃহৎ জলাধার মহাগিরি। এখানে অনেক প্রজা বাস করেন। এরপর রৈবতক–এখানে বেরতী নক্ষত্র সব সময় প্রতিষ্ঠিত এবং একেই স্বর্গ বলা হয়। পর্বতটি ব্রহ্মা নির্মাণ করেছেন। তারপর শ্যাম নামক মহাগিরি। এরপর আছে অস্তগিরি এই গিরি রজতময় তারপর অন্থিকেয় নামে পর্বত আছে, নাম কেশরী। এখান থেকে বাতাস বয়ে আসে।
এবার এদের বর্ষ পর্বতের নাম বলছি। উদয়ের বর্ষ পর্বত জলদ, এভাবে জলধারে রসুকুমার, রৈবতের কৌমার। শ্যামের মণিচক, অন্তের কুমুমোত্তর ও অম্বিকেয়ের মোদক। এই দেশে মোচকের কেশরযুক্ত বড় বড় গাছ রয়েছে। এই দ্বীপের পরিমাণ শাক দ্বীপের সমান। এদের মধ্যে এক বিখ্যাত বনস্পতি আছে, তার নাম শাক। সবাই এই মহাবৃক্ষের পূজা করে থাকে। এই দ্বীপে চারণ, দেব, গন্ধর্বরা বিচরণ করেন। এখানকার জনপদগুলি পবিত্র। এই দ্বীপের প্রতি বর্ষে এক একটি নদী আছে। তারা সকলেই সাগরে মিলেছে। এই সাত নদীকে সাত গঙ্গা বলে। এদের নাম হল–প্রথম সুকুমারী গঙ্গা, অনুতপ্তা, কুমারী বাসবী, নন্দা ও পার্বতী, চুতর্থ শিবেতিকা বা ত্রিদিবা, তারপর ইক্ষু বা ক্রতু, ষষ্ঠ ধেনাকা বা মৃতা এভাবে সপ্তগঙ্গা প্রতি বর্ষেই বয়ে চলেছে। নদীগুলোর জল খুব মঙ্গলদায়ক। এরা শাকদ্বীপবাসী জনগণের সুখের বস্তু। এখান পর্বতগুলো নানা ধাতু দিয়ে চিত্রিত, মণিমুক্তা দিয়ে সাজানো, ফুল ফলে পূর্ণ, গাছ সেখানে রয়েছে। এগুলো উঁচু জনপদ, ক্ষীরোদ সাগর এর চারিদিকেই গোল করে ঘিরে থাকে। শাকদ্বীপের সমানই বড়। এখানকার বিভিন্ন জনপদগুলো পাহাড় দিয়ে বিভক্ত। এখানেও বর্ণাশ্রম ধর্ম আছে। ধর্মের ব্যাভিচার নেই। তাই প্রজারা সুখী। এখানে লোভ, মায়া, হিংসা, বিপর্যয় নেই। প্রজারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করেন। আমি এইটুকু শাকদ্বীপবাসীদের বিবরণ বলতে পারছি।
এরপর সপ্তম দ্বীপ পুষ্করের কথা বলছি। এটিও ক্ষিরোদ সাগর দিয়ে বেষ্টিত। এখানে একটি সমৃদ্ধি সম্পন্ন পর্বত আছে। এর নাম হমশিল, ঐ মণিময় পর্বতে অন্যান্য বিচিত্র মণিময় শৈলশিখর আছে। এই দ্বীপের অর্ধেক পরিমাণ আয়তন নিয়ে উত্তম মানস পর্বত সাগর সৈকতের কাছে যেন চাঁদের মতো শোভা পাচ্ছে। এই দ্বীপের পেছনের দিকে পৃথ্বীধর মানস পর্বত আছে। এর একটি অংশ দুভাগে ভাগ হয়েছে। এই দ্বীপের মানস পর্বতের নীচে গোলাকার ভাবে ঘিরে রয়েছে দুটো জনপদ। মানসপর্বতের বাইরের দিকে মহাবীত নামে যে বর্ষ আছে তার মাঝে যাকে ধাতকীখণ্ড বলা হয়, সেখানকার মানুষেরা দশহাজার বছর বেঁচে থাকে। এখানকার জনপদবাসীরা নীরোগ ও সুখী হয়। তারা রূপে গুণে সমান। এখানে ঈর্ষা, লোভ, ভয়, চুরি, নিগ্রহ, দণ্ড, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্ম, বর্ণাশ্রম ব্যর্থতা, বাণিজ্য, পশুপালন কিছুই নেই।
স্বাদু জলের সাগর দিয়ে পুষ্কর দ্বীপ বেষ্টিত। সাত সাগর পরিবেষ্টিত এই সাত দ্বীপের পর এক একটি সমুদ্র আছে। অর্থাৎ সমুদ্রের পর বর্ষ, বর্ষের পর সমুদ্র, সমুদ্রগুলোর বিস্তার বর্ষগুলোর সমান।
ঋষিরা এই সকল বর্ষে থাকেন। ব্রাহ্মণ ইত্যাদি চার বর্ণের প্রজা থাকেন বলেই বর্ষগুলি সব সময় সুখপ্রদ। যেমন ঋষ ধাতু থেকে ঋষিপদ সাধিত হয় তেমনি শক্তি প্রবন্ধন অর্থে বৃষধাতু থেকে বর্ষপদ সাধিত হয়ে থাকে। শুক্লপক্ষে পূর্ণচন্দ্র থাকলে, সমুদ্র জলে পূর্ণ থাকে। অমাবস্যার আগে চাঁদ ক্ষয় হতে থাকলে সমুদ্রের জলে ভাটা আসে। চাঁদ উদয় বা অস্তে গেলে সেই অনুসারে জল বেড়ে যায় ও কমে যায়। শুক্লপক্ষে বা কৃষ্ণপক্ষেই চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। হ্রাস-বৃদ্ধি পর্বে পনেরোশো আঙ্গুল পরিমাণ ক্ষয়বৃদ্ধি হতে দেখা যায়। জলপ্রবাহের মধ্যে বলে দ্বীপ নাম হয়েছে। উদয়ের আধার বলেই উদধি নাম হয়েছে, পর্বহীন বলে গিরি, পর্বযুক্ত বলে পর্বত।
প্লক্ষদ্বীপে গোমেদ মণি আছে বলে ঐ দ্বীপের পর্বতের নাম গোমদ। এভাবে শাল্মল বৃক্ষের জন্য শাল্মলদ্বীপ, কুশস্তন্ত দিয়ে কুশদ্বীপ শ্রেষ্ঠ, ক্রৌঞ্চ পর্বতের জন্য ক্রৌঞ্চ দ্বীপ এবং শাকনামক গাছের জন্য শাকদ্বীপ প্রসিদ্ধ। পুষ্কর দ্বীপে একটি বটগাছে আছে। সেখানকার লোকেরা ঐ বৃক্ষটিকে পূজা করেন। এখানে মহাদেব এবং ব্রহ্মার পূজা হয়।
যে পুষ্কর দ্বীপের কথা বলা হয়েছে, সেখানে তেত্রিশজন মহর্ষিদের সাথে দেবতা, সাধ্যদের সাথে প্রজাপতি ব্রহ্মা তপস্যা করেন। জম্বুদ্বীপে রত্ন জন্মায়, ওই দ্বীপগুলোতে সর্বজ্ঞ প্রজারা ব্রহ্মচর্যে থাকেন বলে নীরোগ এবং দীর্ঘায়ু হয়। পুষ্কর দ্বীপের প্রজারাও সাধু চরিত্রের এবং বিদ্বান। বিষ্ণু, শিব, সূর্য এবং এর সাথে স্বয়ং ব্রহ্মা এদের শাসন এবং পালন করেন। এই দ্বীপের চারিদিকে স্বাদু জলে বেষ্টিত সমুদ্র। এরপরে একটি কাঞ্চন পুরী আছে। এখানকার ভূমি যেন একটি মাত্র শিলা দ্বারা গঠিত। তারপর সীমান্তে একটি পর্বত আছে। পর্বতের একদিক প্রকাশ আবার অন্যদিকে অপ্রকাশ। এর একদিক আলোময় আর একদিক অন্ধকার। এটি দশ হাজার যোজন উঁচু, বিস্তারও সেই রকম।
এর চারিদিকের শীলারূপ জল দিয়ে ঘেরা। পর্বতের একদিকে আলোক অপর দিকে নিরালোক। নিরালোকের পর অপরাংশ ব্রহ্মাকে আবৃত করে রেখেছে। এই অন্ত মধ্যেই সপ্তদ্বীপা মেদিনী। এরপর ভূঃ, ভূব, স্বর্গ, মর্ত, জল, অপ, এবং সত্য– এই সাতটি লোক রয়েছে। এরপরই তার শেষ সীমা অর্থাৎ এরপর কিছুই নেই। শুক্লপক্ষের প্রথম প্রতিপদ তিথিতে পশ্চিমদিকে চাঁদ যেমন কুম্ভে থাকেন, অন্তের গঠনও তেমন। অব্যয় আত্মার কারণ স্বরূপ, তির্যক, উৰ্দ্ধ ও মধ্যদিক থেকে অন্তরগুলোর সংখ্যা এক হাজার কোটি। ঐ সপ্ত লোকের প্রতি লোকেরই এক একটি আকাশ আছে, এরা সাতটি প্রকৃত কারণ দিয়ে আবৃত। পরস্পর পরস্পরকে ধারণ করে আছে। অণ্ডের ভিতরে গভীর জল। বাইরের দিকেও ঐ ঘন জলের তির্যক উঁচু মণ্ডল এভাবে রয়েছে, যেন তা তেজোদ্বার ধার্যমান হয়েই রয়েছে। বায়ু আকাশকে ধরে রয়েছে।
আকাশ ভূতাদি মহানকে, মহান আবার আকাশকে ধরে রয়েছে। সব মহান অব্যক্ত অনন্ত দিয়ে ঘেরা। এই অনন্ত দশ রকম সূক্ষ্ম, অনালম্ব, অকৃতাত্মা তমোভূত, দেবতাদেরও এবং শেষ সীমায় শিবের বিরাট আয়তন। এর সীমান্তে উঁদ সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত যেসব লোক বিখ্যাত, তাদের জাগতিক লোক বলে। রসাতলের ওপরে ও নীচে সাত সাতটি তল বা স্তর আছে। ব্রহ্মনিবাস পর্যন্ত কর্তাদের সাতটি স্তর আছে। এর মধ্যে পাতাল থেকে স্বর্গ বাতাসের পাঁচটি গতি, এটাই জগতের প্রমাণ। এর নাম সংসার সাগর। বহুজাতির উদ্ভবভূমি এই অনাদি অনন্ত জগতে এমনই বলছে। এ জগতের অগ্নি, বায়ু, মহান, তম, দেব, ঈশ্বর ও অনন্ত। এদের ক্ষয় নেই এদের অস্ত হয় না। এটি অনন্ত নামেই পরিচিত। স্বয়ং শিব ভূমি, আকাশ, পবন, অনল, সমুদ্র এবং স্বর্গ সব জায়গাতেই পূজিত হয়ে থাকেন। তিনি তপস্যা রত, মহাদ্যুতি সম্পন্ন, প্রভু মহেশ্বর নিখিলে লোকেশ নামে পূজিত।
আধার ও আধেয় এইভাবে পরস্পর থেকে উৎপন্ন লোক সকল পরস্পরকে ধারণ করে আছে। এরা আগে অবিশেষ ভাবে ছিল। পরে পরস্পর সন্নিবেশের জন্য, এরাই বিশেষ ভাবে রয়েছে। পৃথিবীর আদি তেজ পর্যন্ত এদের তিনটে পরিচ্ছেদ রয়েছে। কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম কল্পনা করা যায় না। নিখিল ভূতেয় পরবর্তী একটি নিরবচ্ছিন্ন আলোক রয়েছে। হে দ্বিজোত্তমেরা! যে পর্যন্ত প্রাণী আছে সে পর্যন্ত সৃষ্টি জানাবেন। স্থল ভূতদের সংস্কার প্রাণীদেরই আছে। পঞ্চভূত ছাড়া কার্য হয় না। যে সাতটি দ্বীপ ও সাত সমুদ্র যুক্ত মেদিনীর বিস্তার এর আগে বলা হয়েছে তা বিশ্বরূপের একাংশ মাত্র। এই সমস্ত জগৎ, জগৎ নির্মাণকারী ভগবানের অধিষ্ঠান। এবার তির্যক, উৰ্দ্ধ, মধ্যম প্রভৃতি বহু প্রকৃতি, তারার সমাবেশ, দিব্য মণ্ডল ইত্যাদির কথা বলছি।