বাহির ও ভিতর
সদরমহলে সারাদিন কাটানোর পরে স্বভাবতই মন চায় অন্দরমহলে যেতে। বাইরের সঙ্গে তো পরিচয় ঘটল, এবার দেখতে হবে ভিতরে কী আছে।
রূপ রস গন্ধের জগৎ, ঘটনার পর ঘটনার জগৎ, তথ্যের ও যুক্তির জগৎ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ—এর কি কোথাও শেষ আছে না সীমা আছে? হয়তো আছে, কিন্তু সেই সব নয়। জানতে ইচ্ছা করে এর আড়ালে কী আছে, ভিতরে কী আছে? হয়তো কিছুই নেই, কিন্তু কোন অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে বলব যে নেই! সদরমহল থেকে অন্দরমহলের আন্দাজ করা যায় না। ভিতরে না ঢুকে ভিতরের সত্য উপলব্ধি করা যায় না।
বিজ্ঞান যেখানে গিয়ে আর এগোতে পারে না, ইন্টেলেকট যেখানে গিয়ে আর কুল পায় না, শিল্পীর ইনটুইশন সেখানকার রহস্য ভেদ করতে পারে। শিল্পীর দৃষ্টি কেবল বহির্দৃষ্টি নয়, বহির্দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তার পরিপূরক অন্তর্দৃষ্টি।
শুধু অন্তর্দৃষ্টিও নয়। সেটা হয়তো যোগী ঋষির। তাঁদের চোখ মেলে তাকাতে হয় না। তাঁরা ধ্যানেই বহির্বিশ্ব দেখতে পান। কিন্তু শিল্পী সেকথা বলতে পারে না। তার চোখ-কান সবসময় খোলা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে তার চোখ-কান সৃষ্টি করা হয়েছে। তার বহির্দৃষ্টিতে সব কিছুই পড়ে। অধিকন্তু তার অন্তর্দৃষ্টিও আছে। তা দিয়ে সেবহির্জগতের সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
সে-জগৎ থেকে ফিরে এসে যে ভাষায় সেকথা বলে সে-ভাষা রূপকথার ভাষা, রূপকের ভাষা, সাংকেতিক কাব্যের ভাষা, অ্যাবসার্ড নাটকের ভাষা। এমনও হতে পারে যে তার মুখে কথাটি নেই, সেশুধু আভাসে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করে সেকী দেখেছে, কী জেনেছে। কোনো মানবিক শব্দই তার বাহন হবার যোগ্য নয়।
যুগপৎ সদরে ও অন্দরে যার চলাফেরা সেমানবিক শব্দ পরিহার করতে পারে না। তাকে দুই ভাষায় কথা বলতে হয়। সেইজন্যে তার সৃষ্টি অমন দুর্বোধ্য মনে হয়। কতক বুঝি, কতক বুঝিনে। ভাবি অভিধানের সাহায্যে বুঝতে পারব। কিন্তু অভিধানের সহজতম শব্দও দুর্বোধ্য হতে পারে। অনুভূতিটাই দুরূহ।
ভাষা আসলে তৈরি হয়েছে বহির্জগতের প্রয়োজনে, তার ঘটনা ও তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে। একই ভাষায় অন্তর্জগতের প্রয়োজন মেটানো যায় না, অথচ সেই চেষ্টাই করতে হয়। আরেক সেট শব্দ খুশিমতো বানানো যদি-বা সম্ভব হয় তবে সাধারণ সেটা নেয় না, তার পরমায়ু বেশিদিন নয়। শব্দের জন্যে যেতে হয় সাধারণের ভান্ডারে। নতুন অর্থ দিয়ে তাকে ভান্ডারে ফেরত পাঠাতে হয়।
যতক্ষণ বহির্জগতের কথা হচ্ছে ততক্ষণ শব্দের একপ্রকার অর্থ, চেনা অর্থ। বহুজনের ব্যবহৃত অর্থ। কিন্তু অন্দরমহলের কথা বলতে গেলে অর্থান্তর ঘটে, অচেনা অর্থ উড়ে আসে, বহুজনের ব্যবহারে দোলা লাগে। ক্রমে সেটাও গা-সওয়া হয়ে যায়।
বাইরের জগতে জরা আছে, ব্যাধি আছে, মরণ আছে। আছে অন্যায় ও অপরাধ ও পাপ। অসত্য ও হিংসা। কতরকম দুঃখ আর দুর্দৈব। প্রকৃতির কত-না উৎপাত, মানুষের কত-না স্খলন পতন। তেমনি এর প্রত্যেকটির বিপরীত বা সংশোধন বা ক্ষতিপূরণও আছে। যৌবন আর স্বাস্থ্য আর পরমায়ু। ন্যায় আর পুণ্য, সত্য আর প্রেম। প্রকৃতির রাজ্যে কীসের অভাব? মৃত্যুও প্রাণের অভাব নয়। প্রকৃতির রাজ্যে যদি কোনো কিছুর অভাব থাকেও বিধাতার রাজ্যে নেই। সেখানে চির পরিপূর্ণতা। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
শিল্পীরা সুন্দরের ঘরানা, তাদের কারবার সৌন্দর্য নিয়ে। কিন্তু অন্দরমহলের বাইরে বিশুদ্ধ সৌন্দর্য কোথায়? বহি:সৌন্দর্যের উপর দৃষ্টিপাত করলেই সেইসঙ্গে অসুন্দরের উপরেও দৃষ্টি পড়ে। সেই ভয়ে যদি দৃষ্টি রুদ্ধ করি তবে সুন্দরকেও দেখা হয় না। অসুন্দরকে এড়াতে গেলে সুন্দরকেও এড়াতে হয়। এমন কোনো কৌশল কি কেউ জানে যা দিয়ে পানি না ছুঁয়েও মাছ ধরা যায়, পাঁক না ছুঁয়েও পদ্ম তুলে আনতে পারা যায়?
অন্দরমহলে সুন্দর ছাড়া আর কেউ নেই। মাঝে মাঝে সেখানে যাওয়া যায়, কিন্তু দিনরাত সেখানে থাকতে পারা যায় না। বিশুদ্ধ সৌন্দর্য যেন বিশুদ্ধ আত্মা। আমরা দেহও চাই, দেহসুখও চাই। সুখের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ আসে। জন্মালেই মরতে হয়। যৌবনের সূর্যাস্ত জরা। একটাকে চাইলে আরেকটাকেও চাওয়া হয়ে যায়। দেহ যার আছে তাকে দেহের সুন্দর-অসুন্দর মেনে নিতে হয়। তেমনি বহির্জগতের সুন্দর-অসুন্দর। সুন্দরের কারবারিকে অসুন্দরের ব্যাপার করতে হয়, করতে না হোক বুঝতে হয়। শিল্পীর মার্গ ছুঁতমার্গ নয়। যেটা তোমার ভালো লাগে না সেটার অস্তিত্ব তা বলে নাস্তিত্ব হয়ে যায় না। সাদা আছে, কালো আছে, তাতে আরও কতরকম রং। তোমার যেটা ভালো লাগে না অপরের হয়তো সেটা ভালো লাগে, অন্তত সত্যের খাতিরে ভালো লাগে। সমগ্রকে নিয়েই সত্য। সমগ্র নিশ্চয়ই বিশুদ্ধ প্রীতিকর নয়। তা বলে নিছক প্রীতিকরকে নিয়ে সৃষ্টি চলে না। না বিধাতার সৃষ্টি, না প্রকৃতির সৃষ্টি, না মানুষের সৃষ্টি। তেমনি নিছক অপ্রীতিকরকে নিয়েও সৃষ্টি নয়। যদিও সেটাই হালফ্যাশন।
বৈজ্ঞানিক তাঁর ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। কবির তেমন কোনো গবেষণাগার নেই। কিন্তু কবির আছে অন্দরমহল। সেখানে গিয়ে তিনি চিরসুন্দরের সঙ্গে মিলিত হন, অন্তঃসৌন্দর্যর সঙ্গে বহি:সৌন্দর্যকে মিলিয়ে নেন, যাচাই করেন। এই যে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর অন্তঃপুরে যাওয়া ও প্রবেশ পাওয়া এ এক দুর্লভ সৌভাগ্য। কারো কারো জীবনে এ সৌভাগ্য আপনি আসে। অন্যদের এর জন্যে সাধনা করতে হয়। ইন্টেলেকটের বিকাশ না হলে যেমন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক হওয়া যায় না তেমনি কবি বা চিত্রকর হওয়া যায় না ইনটুইশনের বিকাশ না হলে।
সূর্যের আলোর মতো আরও একরকম আলও আছে যার উদয় পুব আকাশে নয়, চিদগগনে। কবিদের সেআলোর জন্যে প্রতীক্ষা করতে হয়, তার জন্যে প্রস্তুত হতে হয়। সূর্যের আলো যেমন পৃথিবীর বাইরে থেকে আসে তেমনি যে আলোর কথা বলছি সে-আলো আসে সদরমহলের বাইরে থেকে। আমাদের সাধারণ জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার উপর সে-আলো যখন পড়ে তখন সব পরিষ্কার হয়ে যায়। যা দেখেছি অথচ দেখিনি তা যেন নতুন চোখে দেখি, নতুন আলোয় দেখি। আর এই যে নতুন আলোয় দেখা একে দেখানোও হয় আমাদের কাজ, আমাদের সৃষ্টিকর্ম। একের সৃষ্টি অপরকে দৃষ্টিদান করে।
কবিদের যে দ্রষ্টা বলা হয় সেটা এই কারণেই। দ্রষ্টা, অপিচ দৃষ্টিদাতা। বলা বাহুল্য নিছক বহুদর্শিতার জন্যে কেউ দ্রষ্টা বা দৃষ্টিদাতা বলে অভিহিত হন না। নিছক বহুদর্শিতারও মূল্য আছে নিশ্চয়। কবিরাও কবিরাজের মতো বহুদর্শী হলে অভিজ্ঞতাসম্পদে সমৃদ্ধ হন। কিন্তু কোন আলোয় দেখেছেন তারই উপর নির্ভর করে অন্তিম মূল্য। দেওয়ালি রাতে হাজার হাজার পিদিমের আলোয় আমরা বহুদর্শী হতে পারি, কিন্তু তার পরের দিন সূর্যের আলোয় যা হই তার নাম দ্রষ্টা। একই দৃশ্য দিনের আলোয় দেখতে আরেকরকম।
জীবনটা এত ছোটো যে সদরমহলের সব ক-টা ঘর এক জীবনে দেখা হয়ে ওঠে না। শতবর্ষ পরমায়ুও তার জন্যে যথেষ্ট নয়। আমাদের সকলেরই দৌড় পরিমিত। কিন্তু অন্দরমহলে যাবার দুয়ার সব বয়সেই খোলা থাকে। কিশোরবয়সিও হয়তো বর্ষীয়ানের আগে সেখানে প্রবেশ পায়। পঁচিশ বছরের কিটস যা দেখেছেন তার তুলনা তাঁর দ্বিগুণবয়সিদের অনেকের জীবনে নেই। কিটসের গৌরব শুধু তাঁর অনবদ্য কাব্যদেহের জন্যে নয়। তাঁর কবিচিত্ত কোন সুদূরের সৌরালোকে উদ্ভাসিত! সুদূরের হয়েও তা ভিতরের।
বাইরের রিয়্যালিটির মতো ভিতরের রিয়্যালিটিও আছে। চোখ খুলে গেলে ইনার রিয়্যালিটির দর্শন মেলে। তখন সৃষ্টিলীলা প্রত্যক্ষ হয়। কবি তখন তাঁর নিজের সৃষ্টিলীলাকেও বিধাতার সৃষ্টিলীলার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারলে বঁাচেন।
বাইরের রিয়্যালিটিকে আমি মায়া বলিনে। তা যদি বলতুম তবে সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি সবই মায়া। কিন্তু ইনার রিয়্যালিটির আলোয় না দেখলে, না দেখতে জানলে, দেখার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তার ফলে সৃষ্টিকর্মেও অসম্পূর্ণতা আসে। একরাশ লিখলে কী হবে, দৃষ্টি যে অসম্পূর্ণ। পক্ষান্তরে একটি কবিতাই যথেষ্ট হতে পারে। সে-কবিতা এতটুকুও হতে পারে। কী দেখলুম তা দেখানোর জন্যে মহাকাব্য লিখতে হয় না প্রত্যেক কবিকে। মহাকাল তেমন কোনো দাবিও করেন না কালজয়ীর কাছে। দু-চার পঙক্তিও কালজয়ী হয়েছে।
সদরমহলে যেমন সুন্দরের সঙ্গে অসুন্দরও আছে অন্দর মহলে তেমন নয়। সদরমহলে যেমন শিবের সঙ্গে অশিবও আছে অন্দরমহলে তেমন নয়। সদরমহলে যেমন আনন্দের সঙ্গে নিরানন্দও আছে অন্দর মহলে তেমন নয়। সদর মহলে যেমন প্রেমের সঙ্গে অপ্রেমও আছে, সত্যের সঙ্গে অসত্যও আছে, অন্দরমহলে তেমন নয়। সদরমহলে যেমন জীবনের সঙ্গে মৃত্যুও আছে, যৌবনের সঙ্গে জরাও আছে, অন্দরমহলে তেমন নয়। একদিক থেকে অন্দরমহল বৈচিত্র্যহীন। মানুষ বৈচিত্র্য চায়। তাই অন্দরমহলে চিরবসন্ত উপভোগ করতে রাজি নয়। সেমুখে যা-ই বলুক-না কেন, সদরমহলের বৈচিত্র্য ছেড়ে অন্দরমহলে বৈকুন্ঠসুখ চায় না।
হাসি আর কান্না, জন্ম আর মরণ, পাপ আর পুণ্য, মিলন আর বিরোধ, সুন্দর আর অসুন্দর, ভালো আর মন্দ এই নিয়ে বাইরের রিয়্যালিটি। এর বৈচিত্র্যের শেষ নেই। সেইজন্যে সাহিত্যেরও শেষ নেই, সংগীতেরও শেষ নেই, ললিতকলারও শেষ নেই। একদল বিদায় হবার আগে আরেক দল এসে হাজির হয়। সৃষ্টির কাজ চালিয়ে নিয়ে যায়। সৃষ্টিপ্রবাহ বহতা থাকে। সদরমহলে লোকারণ্য। তারই মাঝখানে দু-চার জনকে দেখি যাঁরা ভিতরের রিয়্যালিটির সন্ধান রাখেন। তারই আলোয় পথ চলেন। তাঁদের সৃষ্টি আভ্যন্তরিক আলোকে উদভাসিত।
না, দু-চার জন নয়। অনেকেই মাঝে মাঝে ভিতরের বার্তা পান, মুহূর্তের জন্যে অন্দরে উঁকি মেরে আসেন, ইনার রিয়্যালিটির আভাস বয়ে আনেন। কিন্তু বাইরের রিয়্যালিটি তাঁদের অভিভূত করে রাখে। যেমন অভিভূত করে অফিস বা দোকান। দোকানদারের কাছে দোকানই পরম সত্য আর অফিসওয়ালার কাছে অফিস। যদি নিজের দোকান বা নিজের অফিস হয়ে থাকে।
অন্দরমহলের তাতে কিছুই আসে-যায় না। সেতার চিরবসন্ত নিয়ে অপেক্ষা করে। যে চায় সেপায়। আর যে পায় সেতার প্রাপ্তিসৌরভ বিতরণ করে।