বায়ু পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন
প্রথম অধ্যায়
নারায়ণকে নমস্কারের পরে গুণী মানুষকে নমস্কার করা উচিত। এভাবেই বাগদেবী সরস্বতাঁকে নমস্কার করা উচিত। পরাশর পুত্র ব্যাসের জয় হোক। ব্যাসের মুখের বাণী সমস্ত জগত শ্রবণ করে। এখন জগৎপতি মহাদেবকে স্মরণ করছি। আর সেই সঙ্গে আমাদের এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন যিনি, সেই সর্বজ্ঞানী ব্রহ্মাকে স্মরণ করছি। ব্রহ্মাই যোগবলে জগতের সমস্ত প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন।
এবার ব্রহ্মা বায়ু, শিব ও জগতে অন্যান্য মুনিঋষিকে নমস্কার জানিয়ে বায়ু পুরাণের কথা শুরু করছি :
অসীমকৃষ্ণ নামে পৃথিবীতে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি যেমন দেখতে সুন্দর ছিলেন, তেমনই ছিলেন শক্তিশালী। একবার তিনি কুরুক্ষেত্রে দৃষ্যদ্বতী নদীর তীরে যজ্ঞ শুরু করলেন। এই যজ্ঞে পণ্ডিত সব ঋষিরা তপোবনে ভ্রমণ করেছিলেন। সূত নামে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সুন্দর কথা বলে ঋষিদের মন জয় করলেন। মুনিঋষিদের আনন্দ দান করার জন্য তার নাম হল লোমহর্ষণ। লোমহর্ষণ বেদব্যাসের শিষ্য ছিলেন। তিনি পুরাণ, বেদ, মহাভারত ইত্যাদি ছাড়া বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই সূত যখন জ্ঞানী ঋষিদের কাছে এসে হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন তখন ঋষিরা আনন্দিত হয়ে তার প্রশংসা করতে লাগলেন। লোমহর্ষণকে দেখেই তারা বুঝতে পেরেছিলেন ইনি পুরাণ শাস্ত্রে পণ্ডিত। তাই তাদের মনে পুরাণের গল্প শোনার আগ্রহ বেড়ে গেল। একজন বললেন–আপনি তো বেদব্যাসের মতোই পুরাণ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার জন্য অনেক সাধনা করেছেন। আপনি এখন এই মুনিঋষিদের পুরাণের গল্প শোনান। এঁরা প্রত্যেকেই পুরাণের গল্প থেকে নিজেদের বংশের বিবরণ জেনে নিতে পারবেন। মুনিদের পুরাণের কথা শোনাবেন বলেই যজ্ঞের আগেই আপনাকে বরণ করেছিলাম।
সূতের ধর্মই হল বিখ্যাত রাজা দেবতা, মহাত্মা, ঋষিদের বংশ সম্পর্কে যথার্থ বিবরণ জানানো। ইতিহাস ও পুরাণেই সূতের অধিকার।
বেনের পুত্র পৃথুর যজ্ঞ থেকে সূতের উৎপত্তি। এই যজ্ঞে ইন্দ্রের আহুতির দ্রব্যের সঙ্গে বৃহস্পতির আহুতি দেওয়া দ্রব্য মিশে যায়। তাই এর থেকে বর্ণসংকর সূতের উৎপত্তি হয়। ব্রাহ্মণের থেকে নিচু জাতের গর্ভে সূতের জন্ম হয়।
আপনারা জ্ঞানী, আমার স্বধর্ম জিজ্ঞাসা করেছেন তাই আপনাদের পুরাণের কথা নিশ্চয়ই বলব। পিতার বাসবী নামে একটি কন্যা ছিল। সে মৎস্যগর্ভে জন্মায়। সর্ববিদ্যার অধিকারী বেদব্যাস এই মৎস্যকন্যার গর্ভে জন্ম নেন। তিনি সকল প্রকার বেশিক্ষা করেছিলেন। আমি সেই পুরাণপুরুষ বেদব্যাসকে স্মরণ করে পুরাণ কথা শুরু করব।
অনেকদিন আগে তপোবনবাসী মুনিঋষিরা বায়ুর কাছে পুরাণের কথা জানতে চাইলে, বায়ু তাদের এই পুরাণ বলেন। পরমপুরুষ, চতুর্ভুজ ব্রহ্মাই এই জগৎ তৈরী করেছেন। প্রথমে একটি সোনার ডিমের আবির্ভাব হয়। ডিমের ভিতরের আবরণ জল। তারপর বায়ু, আকাশ ইত্যাদি ছিল। এরপর পর্বত নদী ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। এরপর প্রজাসৃষ্টি বর্ণাশ্রম, গাছপালা পশুপাখির উৎপত্তি হয়েছে। আর আছে ব্রহ্মার অবুদ্ধি থেকে নয় রকম সৃষ্টির কথা আর বুদ্ধিজনিত তিন রকম সৃষ্টির কথা। ব্রহ্মার শরীর থেকে ধর্মের উৎপত্তি। প্রিয়ব্রত উত্তানপাদ, প্রসূতি, আকুতি প্রভৃতি নিষ্পাপ ব্যক্তিদের বর্ণনা আছে। আকুতির গর্ভে প্রজাপতি, প্রসূতির গর্ভে দক্ষ কন্যাদের উৎপত্তি হয়। হিংসার গর্ভে যা কিছু অশুভ তার সৃষ্টি। সতীর গর্ভে মহেশ্বরের প্রজাসৃষ্টি। এখানে তিনটি বেদের কথা, ব্রহ্মা ও নারায়ণের মহেশ্বর-এর স্তব; ভৃগু বশিষ্ঠ ইত্যাদির গোত্রগুলির বর্ণনা, স্বাহার গর্ভে অগ্নির প্রজাসৃষ্টি ইত্যাদির বর্ণনা স্থান পেয়েছে। এরপর রয়েছে বিভিন্ন দ্বীপ, সমুদ্র ও পর্বতের বর্ণনা। বৎসর, নদী তাদের ভেদ। হিমবান, হেমকূট, মেরু, নীল ইত্যাদির পর্বতগুলির বিবরণ ও পর্বর্তবাসীদের কথা বলা হয়েছে। এই সমস্ত নানান বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবীর অবস্থানের বর্ণনাও রয়েছে। মানসের উত্তর পাহাড়ের চূড়ায় মহেন্দ্রের পুণ্য সভার কথা বলা হয়েছে। গৃহী সন্ন্যাসীদের পথের কথাও বর্ণনা করা আছে।
স্বয়ং ব্রহ্মার সৃষ্ট এই সৌরমণ্ডলে সূর্য আকাশ পথে ভ্রমণ করছে। এরপর চন্দ্ররথের বিবরণ আছে। এতে দেবতা, আদিত্য, ঋষি, অপ্সরা, সাপ ইত্যাদি আছে। সূর্যের জন্য চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির কথা বলা আছে। ধ্রুব থেকে সূর্য প্রভৃতির বিবরণ শিশুমায়ের কথা বলা হয়েছে। সূর্যের কিরণের জন্য শীত ও গ্রীষ্ম পরপর আসে। সূর্যের কাছাকাছি আসা গ্রহগুলির গতি ও পরিণাম, বিষ খেয়ে শিবের নীলকণ্ঠ হওয়ার বর্ণনাও রয়েছে। শূলপাণির বিষপান, বিষ্ণুর মহেশ্বর বন্দনা, ঐল পুরূরবার মাহাত্ম্যের কথা, পিতৃপুরুষের তর্পণ বর্ণনার কথা ক্রম অনুসারে রয়েছে। ক্রেতা, দ্বাপর, কলিযুগের সংক্ষেপে বর্ণনা। বর্ণ, ধর্ম, আশ্রমগুলির প্রবর্তনের কথা, যুগের প্রভাবে প্রাণীদের বিস্তার উন্নতির কথা, বিভিন্ন নির্দেশ ইত্যাদির কথা বলা আছে।
এরপর বেদ এবং বেদমন্ত্রগুলির কীর্তন, বেদের শাখাগুলির কথা, দেবতা, ঋষি মনু এবং পিতৃগণের বিস্তৃত উদ্ভবের কথা বলা হয়েছে সংক্ষেপে। মনুর থেকে উৎপন্ন মন্বন্তর সংখ্যা নির্ণয়, বর্তমান অতীত ও ভবিষ্যত মন্বন্তরগুলির বর্ণনা, মন্বন্তরের দেবতা ও প্রজাপতির নাম বর্ণনা, প্রজাপতি দক্ষের স্ত্রী, কন্যা এবং নাতি নাতনীদের বিবরণ স্থান পেয়েছে। উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুবের প্রজাসৃষ্টি, বেদের পুত্র পৃথুর পৃথিবী দুয়ে ফেলার বর্ণনা করা হয়েছে। সারিষার গর্ভে দশপ্রচেতা থেকে সোমের অংশে দক্ষ। প্রজাপতির জন্ম বর্ণনা ইত্যাদি রয়েছে।
আগামী মনুদের বহু আখ্যান কথা, বৈবস্বত মনুর সৃষ্টি যজ্ঞে মহাদেবের বারণী ধনু ধারণ বর্ণিত আছে। ব্রহ্মের শুক্র থেকে ভৃগু প্রভৃতির উৎপত্তি। ধ্যান যোগে দক্ষ প্রজাপতির প্রজাসৃষ্টির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। নিজের অভিশাপের জন্য ব্রহ্মার পুত্র বারদের মহাকর্ণ দক্ষপুত্রদের হত্যা, ধরিনার গর্ভে বিখ্যাত দক্ষ কন্যাদের উৎপত্তি বর্ণনা তারপর ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের একত্ব, পৃথকত্ব এবং বিশেষত্ব বর্ণনা, ব্রহ্মার দেবতাদের অভিশাপ দান, দিতির গর্ভে মরুঙ্গনের উদ্ভব, তাদের দেবত্বপ্রাপ্তি প্রভৃতির কথা আছে। এরপর পিতার কথামতো তাদের দেবত্ব ও বায়ুর কাঁধে আশ্রয়লাভ, দৈত্য, দানব গন্ধর্ব, উরগ, রাক্ষস, পিশাচ; পশুপাখি লতা অপ্সরাদের উৎপত্তির কথা, সমুদ্র থেকে ঐরাবতের জন্ম, গরুড়ের উৎপত্তি ও অভিষেক বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর ভৃগু, অঙ্গিরা, কশ্যপ, পুলস্ত্য প্রভৃতি মুনির সৃষ্ট প্রজাদের বর্ণনা। ইলা ও আদিত্যের বিস্তৃত বিবরণ। তারপর ইক্ষবাকু থেকে বৃহদ্বল পর্যন্ত সব রাজার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। রাজা যযাতির কথা। যদুবংশের কথা, হৈহয়ের বিবরণ স্থান পেয়েছে, এরপর জামসের মাহাত্ম্য, অনমিত্র বংশ কথা। বুদ্ধিমান বিবম্বানের মণিরত্ন পাওয়া, যুধাজিতের প্রজাসৃষ্টি, পরে দেবকীর গর্ভে বাসুদেব নামে বিষ্ণুর একান্তে জন্ম বৃত্তান্ত, বিষ্ণুর পরবর্তী প্রজাসৃষ্টি, দেবতা ও অসুরের সংঘর্ষে বিষ্ণুর স্ত্রীবধ এবং ইন্দ্রের জীবনরক্ষা, বিষ্ণুর প্রতি ভৃগুর অভিশাপ বর্ণিত আছে।
এরপর ভৃগুর শুক্রমাতার উত্থাপন, সুর ও অসুরদের সংগ্রাম, নরসিংহ প্রভৃতি অবতারের কথা শুক্রের তপস্যা মহাদেবের স্তুতি, শুক্রের জয়ন্তীর সঙ্গে মিলন, বৃহস্পতিকে অভিশাপ দেওয়া বিষ্ণুর মাহাত্ম্য বর্ণনা ইত্যাদি। যযাতি থেকে শুরু করে যদু, তুর্বসু, অনু পুরু প্রভৃতির কথা। কীর্তিমান রাজাদের বিবরণ। সূর্য থেকে অনাবৃষ্টি, অনলের উৎপত্তির বর্ণনা আছে। ভূ ইত্যাদি সাতটি লোকের বর্ণনা তারপর প্রলয়ের সময় সব জীব যেখানে যায়, ব্রহ্মলোকের ওপর শিবের জায়গা নির্দেশ, সব প্রাণীর পরিণাম, প্রাণীদের সংহার কাহিনী আছে।
বায়ু পুরাণে প্রাণের আট রকম ত্যাগ ধর্ম ও অধর্মের আশ্রয়ে ঊর্ধ্ব ও অধোগতির বর্ণনা আছে। ব্রহ্মার অনিত্যত্ব, ভোগের দৌরাত্ম্য, দুঃখ, বৈরাগ্যের বশে সংসারের দোষ দেখা ব্রহ্মাকেই আশ্রয়রূপে দেখা ইত্যাদি আছে। জগতের সব রকম প্রলয়-এর কথা, বশিষ্ঠের প্রাদুর্ভাব, সৌদাসের নিগ্রহ, পরাশর এর উৎপত্তি, পরাশরের প্রতি বিশ্বামিত্রের দ্বেষ, বিশ্বামিত্রকে হত্যা করার জন্য বশিষ্ঠের আগুন সংরক্ষণ, ভগবান ব্যাসের বেদ বিভাগ স্থান পেয়েছে এই বায়ু পুরাণে।
ব্যাসের শিষ্যদের প্রশ্ন অনুসারে বেদের বিভিন্ন শাখার বর্ণনা আছে। বর্ণনায় আছে পবিত্র দেশ পাওয়ার ইচ্ছায় ধার্মিক মুনিঋষিরা ব্রহ্মার কাছে প্রশ্ন করেন, ব্রহ্মা তখন বলেন একটি অনুপম দিব্যরূপ চক্র আছে। এই ধর্মচক্রের পেছনে চলতে চলতে আপনারা যখন দেখবেন চাকার পরিধি অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে সেখানেই পাবেন পুণ্যদেশ। একথা বলে তিনি মিলিয়ে গেলেন।
এরপর এই পুরাণে রয়েছে গঙ্গার গর্ভধারণ। তপোবনে মুনিদের যজ্ঞারম্ভ, শরদ্বানের মৃত্যু, ঐড় রাজাকে সমগ্র পৃথিবীর রাজা হিসাবে মুনিঋষিদের বরণ। পরে যজ্ঞক্ষেত্রে মুনিদের সঙ্গে রাজার বিবাদ বাধে। পরে ঐড়ের পুত্র আয়ু যজ্ঞ সমাপন করে। এইসব বিবরণ এই পুরাণে যথাযথ রয়েছে। এই পুরাণ-এর কথা শ্রবণ ও কীর্তন করে পুণ্য লাভ করা যায়।
এ পুরাণ সংক্ষিপ্ত শুনলেও মহান অর্থ লাভ হয়ে থাকে। যিনি উপনিষৎ ও চারিটি বেদ পড়েছেন কিন্তু পুরাণ সম্পর্কে কিছু জানেন না সেইরকম লোক বিচক্ষণ হতে পারেন না। ইতিহাস ও পুরাণের সাহায্যে বেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হয়। সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু এই অধ্যায়ের বক্তা। এই অধ্যায় পাঠ করলে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পুরাকালের কথা বলেই এর নাম হয়েছে পুরাণ। ভগবান নারায়ণ এই বিশ্বে বিরাজ করছেন। মহেশ্বর হলেন স্রষ্টার স্রষ্টা। তাই বলা যায় পুরাণের মূল বিষয় হল স্বয়ং মহেশ্বর। তিনি সৃষ্টির সময় সব সৃষ্টি করেন আবার ধ্বংসের সময় সব ধ্বংস করেন।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
শুক বললেন–তপোবনের ঋষিরা সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন–হে সূত, কোথায় সেই যজ্ঞ হয়েছিল। প্রভঞ্জন কিভাবে পুরাণ ব্যাখ্যা করেছিলেন? এইসব বিষয়ে তুমি আমাদের জানাও। সূত উত্তর দিলেন বিশ্ব সৃষ্টি করার জন্য হাজার বছর ধরে বিশ্বের স্রষ্টাগণ পবিত্র যজ্ঞ করে আসছিলেন। সেখানে যেভাবে যত যজ্ঞ হয়েছে তার কথা বলছি। যেমন যেখানে স্বয়ং ব্রহ্মা ব্ৰহ্মকাজে ব্রতী হয়েছিলেন, যেখানে ইলার পত্নীত্ব হয়। যেখানে বিবুধরা হাজার হাজার বছর ধরে যজ্ঞ করেছিলেন। যেখানে রোহিণী প্রসব করেন। বুধের জন্ম হয়। যেখানে অরুন্ধতীর গর্ভে একশ জন পুত্রের জন্ম হয়। যেখানে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের পরস্পর বিদ্বেষ দেখা দেয়, যেখানে পরাশয় মুনির জন্ম হল বশিষ্ঠের পরাজয় হল, সেখানে ব্রহ্মবাদী ঋষিরা যজ্ঞ করেছিলেন। নৈমিষারণ্য যজ্ঞ হয়েছিল বলে মুনিরা নৈমিষের নামে বিখ্যাত রাজা পুরুররা যখন পৃথিবী শাসন করেছিলেন, তখন মুনিদের বারো বছর ধরে যজ্ঞ চলে। স্বর্গের ঊর্বশী এই পুরুরবাকে কামনা করেছিল। রাজা পুরুরবা উর্বশীকে নিয়েই যজ্ঞ করেন। নৈমেষিয় মুনিরা পুরুরবার শাসনকালে যজ্ঞ শুরু করেছিলেন তা সোনার আকার নিয়েছিল। দেব বিশ্বকর্মা সেই সোনা দিয়েই যজ্ঞের বাট তৈরী করেছিলেন। সেই ঋষিদের যজ্ঞে দেবগুরু বৃহস্পতি এসেছিলেন।
রাজা পুরুরবা একদিন শিকারে এসে ঋষিদের সেই হিরন্ময় যজ্ঞভূমি দেখে লোভের বশে তা গ্রহণ করতে চাইলেন। তখন সেই নৈমিষারণ্যবাসী মহাত্মা মুনিরা রেগে গিয়ে তাকে কুশব্রজ দিয়ে আঘাত করলে পুরুরবা দেহত্যাগ করেন। তখন উর্বশীর গর্ভজাত পুত্রকে মুনিরা রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। নদুষপিতা নামে এই বিখ্যাত রাজা ধার্মিক ও মহাত্মা ছিলেন। তিনি মুনিদের যথাযযাগ্য সম্মান দিলেন। ব্রহ্মজ্ঞ মহর্ষিরা তার ধর্মবৃদ্ধির যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। প্রাচীনকালের বিশ্বসৃষ্টির যজ্ঞের মতোই এই যজ্ঞ আশ্চর্যজনক। এই যজ্ঞে বৈশ্বানসেরা প্রিয় সখা বালখিল্যরা, মূর্খ, বৈশ্বানরপ্রভ অন্যান্য মুনিরা দেব, অপ্সরা, গন্ধর্ব, চারণেরা এসেছিলেন। ইন্দ্রের সভার মতোই এই যজ্ঞস্থল সম্পদে ভরে গিয়েছিল। সেখানে দেবগণের স্তুতি করে সম্মান জানানো হল, পিতৃপুরুষেদের অর্চনা করা হল। সমস্ত অতিথিরা সম্মান অনুসারে অর্চিত হলেন। তারপর সবশেষে যজ্ঞে উপস্থিত গন্ধর্বরা নামগান করলেন, অপ্সরারা নৃত্য করলেন। যুক্তিবাদী তার্কিকরা তর্কে অপরপক্ষকে পরাজিত করলেন। অনেক ন্যায়কোবিদ মুনিরা পরস্পর শাস্ত্রের অর্থ বিচার শুরু করলেন। সেখানে কোন ঘাতক রাক্ষস, দৈত্য বা যজ্ঞচোর অসুরেরা কোন বাধা দিতে পারে নি। যজ্ঞের কোন দোষই ঘটেনি। ঋষিরা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিষ্ঠা, জ্ঞান দিয়ে সুন্দরভাবে বারো বছর ধরে যজ্ঞ সমাপন করলেন।
ভৃগু প্রভৃতি ঋষিরা সেখানে আলাদা যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। যজ্ঞ শেষ হলে সমস্ত ঋষিরা অমিতাত্মা বায়ুর কাছে পুরাণ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। হে দ্বিজগণ, আপনারা আমাকে যে প্রশ্ন করেছেন, সেই ঋষিরাও বায়ুর কাছে একই প্রশ্ন করেন। ঋষিদের উত্তরে বায়ু তাদের পুরাণ কথা বলতে শুরু করেন। এই বায়ু ভগবান স্বয়ম্ভর শিষ্য। ইনি সর্বদর্শী, জিতেন্দ্রিয় ও আটটি ঐশ্বর্যে মণ্ডিত। ইনি তির্যক যোনি প্রভৃতির ধর্মানুযায়ী সমস্ত লোক ধরে রয়েছেন। এক এক যোজনের পর সাত সাতটি গণে ভাগ হয়ে সবসময় বয়ে চলেন। এই বলশালী তিনটি ভূতের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করেন। ইনি তেজ থেকে উত্তাপ নিয়ে শরীরিদের পালন করেন। প্রাণ প্রভৃতি পাঁচটি বৃত্তির স্বরূপ এই বায়ু ইন্দ্রিয়বৃত্তি দিয়ে শরীরিদের ধারণ করেন। বায়ুই আকাশযোনি, এঁর গুণ শব্দ ও স্পর্শস্থিত। মনীষীরা এই বায়ুকে তিজস প্রকৃতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন। বায়ু শব্দশাস্ত্র বিশারদ ও পুরাণজ্ঞ তাই ভগবান বায়ু সুমধুর পুরাণ কথায় মুনিদের আনন্দ দান করেছিলেন।
.
তৃতীয় অধ্যায়
সূত বললেন–সহস্র সূর্য ও আগুনের মতো তেজস্বী, মহাধীর, ত্রিলোকের সংহর্তা, সুরশ্রেষ্ঠ মহেশ্বরকে প্রণাম। প্রজাপতিগণ, রুদ্র স্বয়ম্ভু প্রভৃতি ঈশ্বরগণ, ভৃগু, মনু, মরীচি প্রভৃতি প্রাচীন ঋষিরা যারা প্রজা সৃষ্টি করেছেন তাদের এবং বৃহস্পতি শুক্র প্রভৃতি দয়ালু ঋষিদের প্রণাম জানিয়ে বায়ু কথিত পুরাণের কথা বলছি। এতে দেবর্ষিদের বিবরণ আছে। প্রজাপতিদের তপস্যা ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ। শ্রুতিমধুর শব্দে পূর্ণ। এতে প্রকৃতিও পুরুষের প্রথম সৃষ্টির বিবরণ আছে। প্রকৃতি দেবীর আটটি মূর্তি থেকেই সৃষ্টি ও কর্ম। সাগর, পাহাড়, দেব, অসুর, রাক্ষস, প্রজাপতি ঋষি, মনু, পিতা, সূর্য, নক্ষত্র, মাস, ঋতু, বৎসর, রাত্রি, দিন, কাল, যুগ, পশু, অপ্সরা, লতা, ওষধি, মেঘ, বিহঙ্গ ইত্যাদি স্থূল, সূক্ষ্ম যেখানে যা কিছু পদার্থ আছে সেগুলি প্রকৃতি দেবীর পরিণতির আওতায়। ঋক, সাম, যজু, সাম যোগাদির নানারকম জীবিকা বর্ণনার সঙ্গে জগতের পূর্ণ বিবরণ পুরাণে রয়েছে। পুণ্যাত্মা দেব ঋষি ও মনু প্রভৃতির বিবরণ আছে। এছাড়া রুদ্রের অভিশাপে দক্ষের পৃথিবীতে আগমন, ভবদেবের ক্ষিতিতলে বাস, দ্বাপরযুগে ব্যাস হয়ে যারা বেদের বিস্তার করেছেন তাদের বর্ণনাও আছে এই পুরাণে। কশসংখ্যা, ব্রাহ্মদিগের সংখ্যা, উদ্ভিজ্জ স্বেদজ ও জরায়ুদের বর্ণনা ও স্বর্গবাসী, ধর্মাত্মা, নরকগত জীব তাদের প্রমাণ বর্ণনা রয়েছে বায়ুপুরাণে। ধৃতিমান ঋষিরা যেমন যেমন বলেছেন, আমি সযত্নে শাস্ত্রের যুক্তি দিয়ে সেই সমস্ত বর্ণনা করছি, হে ব্রাহ্মণরা শুনুন।
.
চতুর্থ অধ্যায়
নৈমিষ্যারণ্যবাসী মহর্ষিরা বর্ণনা শুনে আশ্চর্য হয়ে অবাক চোখে সূতকে বললেন, আপনি ব্যাসের কাছে যেসব জাগতিক তত্ত্ব জেনেছেন, সে সকল বিবরণ বলুন। প্রজাপতি প্রথমে যে আর্য সৃষ্টি করেন তা বিচিত্র, আমাদের সেসব কথা জানতে ইচ্ছে, এই বলে মুনিরা লোমহর্ষণকে বারবার জিজ্ঞেস করলে সূত বলতে শুরু করলেন। হে মুনিগণ, আপনাদের অনুরোধ দিব্যসুন্দর, পাপনাশক, অনেকাৰ্থযুক্ত সৃষ্টি বৃত্তান্ত বলছি। যে শুদ্ধ সংহত হয়ে তীর্থে বা মন্দিরে পুরাণাখ্যান শোনে বা আলোচনা করে সে দীর্ঘায়ু হয় ও স্বর্গলাভ করে। সেইসব কীর্তিমান পুণ্যাত্মাদের কথা যা শুনেছি তা বলছি। এটি যযাস্য, আয়ুস্য শত্রুনাশক, কীর্তিবর্ধক, স্বর্গপ্রাপক। আপনারা এবার মন দিয়ে শুনুন। পুরাণের পাঁচটি লক্ষ্য হল–স্বর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ মন্বন্তর ও বংশজাত জনগণের বিবরণ। প্রবোধ, প্রলয়, স্থিতি, উৎপত্তি এই চারটি বিবরণযুক্ত প্রক্রিয়া অনুষঙ্গ, উপপাদঘাত ও উপসংহার এই চারটি ভাগে এই মহাপুরাণ ভাগ করা হয়েছে। যিনি প্রথমে বিশিষ্ট পুরুষ, যিনি লোকতন্ত্রের প্রবর্তক, সেই প্রজাপতি ব্রহ্মাকে প্রমাণ করে তত্ত্বান্ত, অধিকার, পুরুষাবিষ্টিত, পাঁচটি প্রমাণ, দুটি শ্বেত বিবরণ ও লক্ষণ নিয়ে প্রশংসনীয় আমি নিঃসংশয় হয়ে বলছি। সদসদাত্মক, নিত্য প্রধান প্রকৃতি ব্রহ্মই ছিলেন একমাত্র আর কিছুই ছিল না। এই ব্ৰহ্ম গন্ধবর্ণহীন, শব্দস্পর্শহীন, অক্ষয়, নিত্য, আত্মস্থ, সর্বভূতের মূল স্বরূপ অনাদি, অনন্ত, ত্রিগুণ, অসীম ও সকলের পরবর্তী। তার দ্বারাই সমস্তই ব্যাপ্ত তমোময় ছিল।
সৃষ্টিপূর্বে প্রকৃতির গুণগুলি সমভাবে ছিল। পরে তিনি গুণবৈষম্যের জন্যে আবির্ভূত হন। তিনি সূক্ষ্ম অব্যক্ত দিয়ে সম্যকরূপে আবৃত। সত্ত্বগুণযুক্ত সেই মহানই লিঙ্গমাত্র ইনি ধর্মাদিলোক তত্ত্বগুলির কারণ। এই মহানের নাম হয়েছে মন, মতি, ব্রহ্মা, খ্যাতি, ঈশ্বর, প্রজ্ঞা, চিতি ইত্যাদি। সেই বিভু পরিবর্তনশীল সমস্ত ভূতের চেষ্টাকালগুলি সূক্ষ্ম ভাবে সাধন করেন বলে তাকে মন বলা হয়। তিনি সমস্ত তত্ত্বগুলির অগ্রজ পরিমাণে অন্যান্য গুণের থেকে মহান। সবচেয়ে বড় এবং জলের মধ্যে থেকে ভাবগুলির পুষ্টিবিধান করেন এজন্য এঁকে ব্রহ্মা বলে। এঁনার করুণাতেই জীবেরা সর্বক্ষণ পরিপূরক হয় বলে ইনি পূর নামে খ্যাত। পুরুষেরা এঁকেই অবলম্বন করে সমস্ত হিতাহিত বুঝে নেন, আর ইনি সকলকে বুঝিয়ে দেন, এজন্য এনাকে বুদ্ধি বলা যায়। খ্যাতি ও ভোগগুলি ইনি প্রবর্তন করেছেন বলে ইনি খ্যাতিপদ বাচ্য। ইনি গুণগুলির জন্য নানান নাম রূপ যোগে খ্যাতি সম্পন্ন হয়েছেন বলে এনাকে খ্যাতি বলে। ঈশ্বর সাক্ষাত রূপে সবকিছু জেনে থাকেন, তা থেকে গ্রহগুলি জন্মেছে। এজন্য তাকে প্রজ্ঞা বলা যায়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কাজে মন করেন বলে তাঁকে স্মৃতি বলা হয়। সমস্ত ভোগের আধার বলে তিনি সর্ববিদ। তিনি সর্বত্র রয়েছেন, সমস্ত প্রজ্ঞ তাতেই রয়েছে। তিনি জ্ঞান নিধি, জ্ঞান পদবাচ্য। তিনি সকলের নিয়ন্তা বলে ঈশ্বর। অব্যক্ত পুরে তিনি সর্বক্ষণ শুয়ে রয়েছেন তাই তিনি পুরুষ। কেউ তাকে সৃষ্টি করেন নি। তিনি স্বয়ম্ভু।
এই মহানই প্রকৃতি সৃষ্টির ইচ্ছাতে বিকারত্মক সৃষ্টির প্রবর্তন করেছেন। সঙ্কল্প ও অধ্যবসায় তার বৃত্তি। সত্ত্ব, রজ ও তমঃ এই তিনটি গুণের মধ্যে রজোগুণ বৃদ্ধি পেলে অহঙ্কার জন্মে। তমঃপ্রধান অহঙ্কার বিকৃত হয়ে ভূত তন্মত্রের সৃষ্টি করে এজন্য তিনি ভূতাদি বলে খ্যাত। এই ভূতাদি থেকে শব্দ তন্মত্রের সৃষ্টি। এর থেকে শব্দ গুণযুক্ত আকাশের উৎপত্তি। এই আকাশকে ভূতাদি-আবৃত করে থাকে। পরে শব্দ তন্মাত্ৰত্মক-আকাশ থেকে স্পর্শ তন্মাত্ৰত্মক বায়ুর সৃষ্টি হয়। বায়ু বলবান স্পর্শগুণাত্মক। . বায়ুকে আবৃত করে আছে শব্দ তন্মাত্ৰত্মক আকাশ। বায়ু বিকারপ্রাপ্ত হয়ে রূপ তন্মাত্র জ্যোতিঃ সৃষ্টি করে। ঐ জ্যোতি পদার্থকে স্পর্শ তন্মাত্ৰত্মক বায়ু আবরণ করে। জ্যোতি বিকৃত হয়ে রস তন্মাত্রত্মক জল সৃষ্টি করে। সেই জল রূপ তন্মাত্রত্মক জ্যোতিঃ দিয়ে আবৃত।
সূত বললেন, ভূত তন্মাত্ৰত্মক সৃষ্টির বর্ণনা করছে। বিকারিত, সাত্বিক অহঙ্কার থেকে একসাথে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়ের সৃষ্টি। ইন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাতা দেবতা দশটি। এঁরা বৈকারিত। মন একাদশ ঐন্দ্রিয়। কর্ণ, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও নাসিকা বুদ্ধিযুক্ত পাঁচটি ইন্দ্রিয় শব্দাদির বিষয় বোধক। পাদ, পায়ু, উপস্থ, হস্ত, বাক্য এই পাঁচটি দিয়ে যথাক্রমে গতি, মনত্যাগ, আনন্দ, শিল্প, বাক্য ও কর্ম সাধন হয়। আকাশ স্পর্শ তন্মাত্ৰাত্মক বায়ুতে প্রবেশ করে বলে বায়ু শব্দ ও স্পর্শ এই দুটি গুণযুক্ত। শব্দ, স্পর্শ ও রূপ তিনটি গুণ রয়েছে তেজে। জলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস চারটি গুণ আছে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস, গন্ধ তন্মত্রে অনুপ্রবেশ করে গন্ধ তন্মাত্ৰত্মক সংঘাত শব্দ, স্পর্শ, রস ও গন্ধ এই পাঁচটি গুণযুক্ত। এই সংঘাতেই পৃথিবীরূপে পরিবর্তন। পৃথিবী পাঁচটি গুণযুক্ত। এরা শান্ত, ঘোর, মূঢ় বলে এদের বিশেষ বলা হয়। এরা পরস্পর পরস্পরকে ধারণ করে আছে। এরা মাটিতে লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এরপর ভূতেরা আগের ভূতের গুণ পায় বলে গুণের তারতম্য হয়। বায়ুর যে গন্ধ উপলব্ধি হয় তা পৃথিবীর গুণ, বায়ুর নয়। মহান থেকে বিশেষ পর্যন্ত সাতটি মহাবীর্য ভূত প্রজা সৃষ্টি করতে পারে না। পরে সকলের অব্যক্ত এর কৃপায় একটি অণ্ড সৃষ্টি করে। জল বুদ্বুদের মতো বিশাল অণ্ডটি ব্রহ্মার কার্যকারণ রূপ জলমধ্যে রয়েছে। ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ এই অণ্ডের মধ্যে ব্রহ্মা হয়ে রইলেন। ইনিই শরীরধারী পুরুষ। আদিকর্তা চতুর্মুখ ব্রহ্মা। ইনি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সবকিছু সৃষ্টি করেন আবার সংহার কালে সংহার করেন। হিরন্ময় মেরু তার জরায়ু, সমুদ্র তার গভেদিক, আর পাহাড় অস্থি স্থানীয়। সেই অণ্ডের মধ্যে সাতটি লোক, সাতটি দ্বীপ, সাতটি সমুদ্র, বিশাল পাহাড় নিয়ে পৃথিবী এর মাঝে রয়েছে। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, গ্রহ, বাতাস সব অণ্ডের মধ্যে দশগুণ জল দিয়ে বাইরে থেকে অণ্ডটি আবৃত। সেই জল দশগুণ তেজ দিয়ে আবৃত। সেই তেজ দশগুণ বায়ু দ্বারা বাইরে থেকে আবৃত। সেই বায়ু আবার দশগুণ আকাশ দিয়ে ঘেরা। সেই আকাশ ভূতাদি দ্বারা, ভূতাদি মহানের দ্বারা, আর মহান অব্যক্ত দ্বারা সমাবৃত হয়ে রয়েছে। সাতটি প্রাকৃত আবরণ দিয়ে অণ্ডটি ঘেরা। পরস্পর ঘিরে রয়েছে আটটি প্রকৃতি। লয়কালে এরা পরস্পরকে গ্রাস করে। এই বিকারগুলি অব্যক্তের ক্ষেত্র। ব্রহ্মাই হলেন ক্ষেত্রজ্ঞ। হিরণ্য গর্ভের এই জন্ম বিবরণ যিনি জেনেছেন তিনি দীর্ঘায়ু, কীর্তিবান, প্রজাবান শুদ্ধচিত্ত, নিষ্কাম পুরুষ পুরাণগুণে অন্ত সুখ ও মোক্ষ প্রাপ্ত হন ও শেষে সঙ্গতি লাভ করেন।
.
পঞ্চম অধ্যায়
লোমহর্ষণ বললেন–হে ব্রাহ্মণরা! সৃষ্টির আগে আমি যে কালান্তরের কথা বলেছি, সেটা পরমেশ্বরের একটিদিন মাত্র। রাত্রির পরিমাণও এর মতো। সৃষ্টিকাল তার দিন প্রলয়কাল তাঁর রাত্রি। প্রজাপতি, প্রজা, ঋষি, মুনি, ব্রহ্ম সাযুজ্য পেয়েছেন এমন ব্যক্তিরা, ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয় বিষয় পঞ্চ মহাভূত তন্মাত্রা, বুদ্ধিমন–এ সমস্ত সেই পরমেশ্বর দিনের বেলাতেই থাকে। দিনের শেষে সমস্তই লয় পেয়ে যায়। আবার রাত্রি শেষে বিশ্বের উৎপত্তি। প্রকৃতি ও পুরুষ একই ধর্মযুক্ত হয়ে অবস্থান করে থাকেন। তখন তম ও সত্ত্বগুণ পরস্পর সমভাবে থাকে। গুণের সমতা হলে লয় হয়, বৈষম্য হলে সৃষ্টি হয়। তিলের মধ্যে যেমন তেল থাকে বা দুধে ঘি থাকে, তেমন অব্যক্তর আশ্রিত যে তমোগুণ তা সত্ত্ব ও তমোগুণের মধ্যে থাকে। সেই মাহেশ্বরী পরা রাত্রি অতিবাহিত করে প্রকৃতিস্থ পুরুষ রূপী পরমেশ্বর দিবাভাগে যোগ দ্বারা প্রকৃতি দেবীর ক্ষোভ জন্মান। প্রকৃতির রাগ থেকে রজঃ প্রবর্তিত হয়। তারপর রজোগুণ সমস্ত কাজের জন্ম দেয়। গুণক্ষোভ থেকেই তিন দেবতার উৎপত্তি। এরা সর্বজীবকে আশ্রয় করে রয়েছেন। রজঃ, ব্রহ্মা, তমঃ অগ্নি, সত্ত্ব বিষ্ণু। ব্রহ্মা স্রষ্টা রূপে, অগ্নি কালরূপে আর বিষ্ণু উদাসীনরূপে থাকেন। এঁরা পরস্পর পরস্পরকে আশ্রয় করে থাকেন। এঁরা একে অপরের উপজীব্য হয়ে থাকেন। রজোগুণ যুক্ত ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেছেন। মহেশ্বরের অধিষ্ঠিত প্রকৃতি মহেশ্বরের প্রেরণাতেই সৃষ্টিরূপে প্রবৃত্ত হন। সৃষ্টির প্রথমে ঈশ্বরের অধিষ্ঠিত সদ সদাত্মক প্রকৃতির গুণবৈষম্য ছিল। তখন ব্রহ্মা ও বুদ্ধি এই মিথুন একসাথে সৃষ্টি হয়েছিলেন। এই তমোময় বিশ্বে অব্যক্ত রূপ ক্ষেত্রজ্ঞ হলেন ব্রহ্মা। কার্যকারণের সমষ্টি, ধীমান ব্রহ্মাই তেজ দ্বারা প্রকাশিত হন। ইনি অনন্ত জ্ঞানের বিপুল ঐশ্বর্যের অশেষ ধর্মের ও বৈরাগ্যের সৃষ্টি করেন। সেই ঈশ্বরের জ্ঞান ও বৈরাগ্যের শেষ নেই। ব্রহ্মার ধর্ম ও ঐশ্বর্য থেকে ব্রাহ্মী বুদ্ধি জন্মে। ইনি গুণ পরিণাম সাধক ও সুরদের ঈশ্বর। এজন্যে ইনি যা যা চেয়ে থাকেন, সেই সবই অব্যক্ত থেকে সৃষ্টি। ইনি স্রষ্টা রূপে চতুর্মুখ। কালরূপে অণ্ডক, বিষ্ণুরূপে সহস্ৰশীর্ষা পুরুষ। এই তিনটি স্বয়ম্ভর অবস্থা তিনি ব্রহ্মারূপে সত্ত্ব ও রজঃগুণকে আশ্রয় করে থাকেন। কালরূপে রজঃ ও তম এবং পুরুষরূপে সত্ত্বগুণকে আশ্রয় করেন। ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, কালরূপে সবকিছু ধ্বংস করেন। আর পুরুষরূপে উদাসীন থাকেন। এই হল প্রজাপতির তিন অবস্থা। ব্রহ্মা পদ্মগর্ভ, কাল নীলাঞ্জনের মতো আর পুরুষ শ্বেত কমলপ্রভা। নিজের লীলান্তে নানারূপ আকৃতি বৃত্তি নিয়ে দেহ ধারণ করেন আবার ধ্বংস করে থাকেন। লোকেদের মাঝে তিনভাবে থাকেন বলে তাকে ত্রিগুণ আর চারভাগে বিভক্ত বলে চতুর্বহ বলা যায়। ইনি যা গ্রহণ করেন, পেয়ে থাকেন এবং যা খেয়ে থাকেন সবই তার নিত্যভাব, এজন্য এঁকে আত্মা বলে। সর্বভূতে রয়েছেন, তাই তিনি ঋষি। সর্বশরীর থেকে লয়কালে প্রয়াণ করেন, সর্বভূতে তার প্রভুত্ব রয়েছে আর সমস্ত ভূতের মধ্যে আছেন এজন্য তাঁকে বিষ্ণু বলা হয়।
তার ভগ অর্থাৎ ঐশ্বর্য বীর্য ইত্যাদি রয়েছে বলে তিনি ভগবান, আর রাগগুলি সামনে রেখেছেন বলে রাগ বলা হয়। ইনি ওঁ শব্দবাচ্য, সর্বজ্ঞ, সমস্ত পদার্থে রয়েছেন বলে সর্ব। মানুষের অয়ন বা গম্যস্থান বলে তিনি নারায়ণ। তিনি ত্রিলোকে তার তিনটি রূপ দিয়ে সৃজন, সংহরণ ও উসানী ভাব দেখিয়ে থাকেন। ইনি সকলের প্রথম বা আদি বলে তিনি আদিদেব। প্রজাপালন করেন বলে প্রজাপতি, সমস্ত দেবতার মধ্যে মহান বলে মহাদেব। ইনি সর্বভূতের রূপে রয়েছেন এজন্য ইনি ভূত, বিভু। সকলের যজনীয় তাই ইনি যজ্ঞ। ইনি সব বর্ণকে পালন করেন বলে তিনি আদি, অগ্নিরূপ আছে তাই কপিল, ইনি হিরণ্যগর্ভ স্বরূপ। সৃষ্টিকর্তা পরমব্রহ্ম যতক্ষণ সৃষ্টি করে চলেন সেই সময়কে কল্প বলে।
সৃষ্টি থেকে নিরত হলেও তাঁর তত সময়ই পেরিয়ে যায়। তারপরে আবার সৃষ্টি শুরু হয়ে থাকে। হাজার কোটি কল্প অতীতে হয়ে তাতে লয় পেয়েছে। এই যে কল্প বর্তমানে রয়েছে একে বরাহকল্প বলা হয়। এই কল্পের প্রথম ভাগ চলছে।
এই কল্পে স্বয়ম্ভ প্রভৃতি চোদ্দজন মনু জন্মান। এঁদের কেউ অতীত, কেউ বর্তমান, কেউ ভবিষ্যতে জন্মাবেন। এইসব মহাত্মারা পৃথিবীতে প্রজা উৎপাদন ও তপস্যা দিয়ে সম্পূর্ণ হাজার যুগ ধরে পালন করেন। এক মন্বন্তর দিয়ে অন্য মন্বন্তর, এক কল্প থেকে অন্য কল্প, অতীত দিয়ে বর্তমান, ভবিষ্যত এভাবে আগের কারণ দিয়ে পরের ফলধীমান লোকেরা জেনে থাকেন।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়
সূত বললেন–অগ্নি থেকে জলের সৃষ্টি। উঁচু, নিচু পৃথিবী জলে পরিণত হলে অগ্নি নষ্ট হয়। তখন কিছুরই উপলব্ধি থাকে না। তখন ব্রহ্মা সহস্র মাথা, চোখ, পা, সোনার বর্ণ, অতীন্দ্রিয় নারায়ণ পুরুষমূর্তি নিয়ে জলরাশির মাঝে শুয়ে থাকেন। নারায়ণ শ্লোকে আছে জলীয় পরিমাণগুলির নাম নারা’। তিন হাজার যুগ শেষ হলে রাত্রির শেষে সৃষ্টি করার জন্য ব্রহ্মামূর্তি ধরেন। ক্রমে সত্ত্বগুণের উদ্রেক হলে ব্রহ্মা প্রবুব্ধ হয়ে সব জায়গা লোকশূন্য আর জলে পূর্ণ দেখে বাতাস হয়ে বর্ষার রাত্রিতে পাখির মতো উড়লেন। এরপর বুদ্ধিমান ব্রহ্মা জলের মধ্যে থেকে পৃথিবী উদ্ধারের জন্য ভাবতে শুরু করলেন। কি করে কোন মহরূপ ধারণ করে পৃথিবী উদ্ধার করতে পারবে? এভাবে চারিদিকের জল দেখে জলক্রীড়ায় অভিজ্ঞ বরাহরূপ স্মরণ করলেন। ঐ রূপ বাঙ্য়, এর নাম ধর্ম। এই মূর্তি চওড়া, উঁচু নীল মেঘের মতো। এঁর দেহ পর্বতের মতো, রং সাদা, মেঘ গর্জনের মতো স্বর, চোখ আগুনের মতো উজ্জ্বল, দেহের দ্যুতি আদিত্যের মতো। পতি সিংহের মতো। তারপর সেই হরি বিশাল বরাহ রূপ নিয়ে পৃথিবীর উদ্ধারের জন্য রসাতলে প্রবেশ করলেন। তার চার পাচারবেদ, বুক–ক্রতু, মুখ-চিতি, জিব–অস্থি, রোম–কুশ, ব্রহ্মা-মস্তক, চোখ–দিনরাত, দেহকান্তি–সত্য ও ধর্ম, বিক্রমধর্ম, স্পৃহা-ঘি, গন্ধহবি, লিঙ্গ–হোম, আসন-গুহ্য উপনিষদগুলি, তার পত্নী ছায়া। সেই মহাসত্ত্বময় যোগী মণিশিখরের মতো উঁচু। সেই বিভু প্রজাপতি বরাহরূপ ধারণ করে জলের মধ্যে প্রবেশ করে পৃথিবীকে উদ্ধার করলেন। সেই জলরাশিকে ভাগ করে সমুদ্রের জল সমুদ্রে আর নদীর জল নদীতে গিয়ে জলমগ্না পৃথিবীকে মঙ্গল কামনায় দাঁত দিয়ে তুলে ধরলেন। জলের ওপর নৌকার মতো পৃথিবী ভেসে রইল। মন দ্বারা পৃথিবীকে ধারণ করেছিলেন, এবার জলের ওপর রাখলেন, কিন্তু পৃথিবী ভাগে মন দিলেন। পৃথিবীর সমভূমির মধ্যে পর্বতগুলো সৃষ্টি করলেন। আগের সৃষ্ট পর্বতগুলি আগুনে পুড়ে শীর্ণ হয়ে গেছিল। পরে বাতাসের দ্বারা জলরাশি জায়গায় জায়গায় দৃঢ় হয়ে পর্বত তৈরী হয়। এদের চলার ক্ষমতা নেই বলে অচল। আগের কল্পের সমুদ্র পাহাড় সব নষ্ট হয়। পরকল্পের শুরুতে বিশ্বকর্মা। সাতটি দ্বীপ, সমুদ্র ও পর্বত দিয়ে পৃথিবীকে ভাগ করেন। ভগবান স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা আগের কল্পের মতোই সৃষ্টি কাজে প্রবৃত্ত হলেন। তিনি বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা শুরু করলে প্রথমে তমোময় সৃষ্টি হল। সবার প্রথম সৃষ্টি হল তমঃ, মোহ, মহামোহ, তমিস্র ও অন্বতা মিশ্র–এই পঞ্চপর্ব সবার প্রথমে সৃষ্টি হল। এরা ব্রহ্মকে পাঁচটি আবরণে ঢেকে রাখল।
এর ফলে তিনি বাইরে থেকে ঢাকা, অন্তরে শুদ্ধ, প্রকাশমান অথচ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন। মোহ ইত্যাদি দিয়ে বুদ্ধি আর প্রধান ইন্দ্রিয়গুলি সমাবৃত হওয়াতে এদের সংবৃতাত্মা বলে এরাই পর্বতের রূপ ধারণ করে। প্রথম সৃষ্টি ব্রহ্মার মনের মতো না হওয়াতে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে আবার ভাবতে শুরু করলেন। তখন স্রোতগুলি কুটিলভাবে বয়ে চলার ফলে তা থেকে তির্যক জাতির সৃষ্টি হল। এদের তির্যক জাতি বলে। তমোগুণ আছে বলে এরা অজ্ঞানে আচ্ছন্ন ধ্যান থেকে উৎপন্ন ধ্যানাভিমানী। এরা অহংকারী, অভিমানী, আঠারো প্রকার আত্মযুক্ত, এগারোটি ইন্দ্রিয় যুক্ত, নয় রকম উদয়বিশিষ্ট, আট প্রকার তারকা শক্তি সম্পন্ন। এদের অন্তরে এগুলি প্রকাশিত বাইরে নয়। তির্যক স্রোতের সৃষ্টি দেখে ঈশ্বর আনন্দিত হলেন। তখন তার মন সাত্ত্বিকভাবে পূর্ণ হওয়াতে ঊর্ধ্বস্রোতের সৃষ্টি হল। এটি হল প্রজাপতির তৃতীয় সৃষ্টি। এটি সবচেয়ে উপরে রইল। ঊর্ধ্বস্রোত সৃষ্টিজাত জীবেরা সবাই অন্তরে ও বাইরে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত দেবতারাও প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত দেবতারাও ঊর্ধ্বস্রোতে সৃষ্টি হলে ব্রহ্মা কিছুটা খুশি হলেন। তখন আবার তিনি অন্য সৃষ্টির কথা চিন্তা শুরু করলেন। এরপর অবাক স্রোত সৃষ্টি হল। নীচের দিকে এদের প্রবৃত্তি বলে অবাকস্রোতঃ নম। এরা প্রকাশবহুল ও রজোগুণযুক্ত। এজন্য এরা প্রায়ই দুঃখে আক্রন্ত। অন্তর বাইরে প্রকাশিত এই মানুষ সৃষ্টি সাধক সৃষ্টি। এরা আট প্রকার লক্ষণযুক্ত। সিন্ধ ও গন্ধর্বরা এই মনুষ্য-সৃষ্টির প্রকার ভেদমাত্র।
বিপর্যয়, শক্তি, তুষ্টি, ঋদ্ধি–এই চারটে গুণ অনুগ্রহ সর্গ পঞ্চম সৃষ্টি। ভবিষ্যত ও বর্তমানের সমস্ত তত্ত্ব তাদের জানা। তামসজীব জাতি হল ষষ্ঠ সৃষ্টি। এরা ভোগাসক্ত, দুঃশীল। বিপর্যয়ের জন্য জড়ভাবাপন্ন। মহানের সৃষ্টি প্রথম, তন্মাত্র সৃষ্টি দ্বিতীয়, একে ভূত সৃষ্টি বলে। বৈকারিক সৃষ্টি হল তৃতীয় সৃষ্টি একে ইন্দ্রিয় সৃষ্টি বলে। এই কটি সৃষ্টি ব্রহ্মার অবুদ্ধিতেই হয়েছিল। স্থাবরদের মুখ্য বলে। মুখ্য সৃষ্টি হল চতুর্থ। তির্যক জাতির সৃষ্টি হল পঞ্চম। ঊর্ধ্বস্রোতে দেবসৃষ্টি হল ষষ্ঠ। অবাক বা মানুষ সৃষ্টি হল সপ্তম। তমঃ সত্ত্বযুক্ত অনুগ্রহ সৃষ্টি হল অষ্টম। প্রথম তিনটি হল প্রাকৃত সৃষ্টি ও শেষ পাঁচটি হল বৈকৃত সৃষ্টি। কোমার সৃষ্টি হল নবম, প্রাকৃত, বৈকৃত ও ভৌমার–এই তিনটি সৃষ্টির মাধে প্রাকৃত তিনটি সৃষ্টি ব্রহ্মার অবুদ্ধির ফল। আর বাকি ছয়টি বুদ্ধি পূর্বক হয়েছিল।
এবার অনুগ্রহ সর্গ বিস্তারিত বলছি। প্রাকৃত ও বৈকৃত ইত্যাদি সব মিলিয়ে নয়টি সৃষ্টি আবার নানাপ্রকার। প্রথমে ব্রহ্মা সনন্দন, সনক ও সনাতন–তিনটি মানস সন্তান সৃষ্টি করেন। এঁরা ব্রহ্ম জ্ঞানবান, তেজস্বী। এরা কোন প্রজাসৃষ্টি না করে নিবৃত্তির পথ ধরে মহাপ্রস্থান করেন। এনারা চলে গেলে ব্রহ্মা তখন অন্যান্য পুত্রদের সৃষ্টি করলেন। এঁরা হলেন জল, আগুন, পৃথিবী, বাতাস, আকাশ, দিক, স্বর্গ, দ্বীপ, সমুদ্র; মদ, শৈল, বনস্পতি–এ সকলের আত্মা, লব, কাষ্টা, কলা, মুহূর্ত, সন্ধি, রাত্রি, দিবা, অর্ধমাস, মাস, অয়ন, যুগ এরা সকলেই স্থানাভিমানী। সুতরাং স্থানপদবাচ্য। পরমপুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বুক থেকে ক্ষত্রিয়, দুই উরু থেকে বৈশ্য আর দুই পা থেকে শূদ্র–এভাবে বর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। অণ্ড থেকে ব্রহ্মার সৃষ্টি। এই ব্রহ্মা নিজেই সব লোক সৃষ্টি করেছেন। আমি সংক্ষেপে বায়ু পুরাণের সৃষ্টির কথা বললাম।
.
সপ্তম অধ্যায়
সূতের মুখে বায়ুপুরাণে প্রথমপাদে সৃষ্টির কথা শুনে খুশি হয়ে তাঁকে সম্বোধন করে বললেন–আপনি প্রাচীন কথা বলতে পারদর্শী, তাই আমাদের কাছে বর্ণনা করুন। সূত বললেন–অতীত ও বর্তমান কল্পের প্রতিসন্ধ আমি আপনাদের বলছি। যে কল্পে যত মন্বন্তর বর্তমান বরাহ-র কল্পের পূর্ববর্তী কল্প এবং এদের অবস্থার বর্ণনা শুনুন। আগের কল্প চলে গেলে অন্য কল্প শুরু হয়। এই দুয়ের সন্ধিতে জনলোক থেকে অন্য সৃষ্টি শুরু হয়ে থাকে। সৃষ্টির ধারা সম্পূর্ণ নষ্ট হলে কল্পগুলোও বিচ্ছিন্ন হয়। সেগুলি পরের কল্পের অনুগামী হতে পারে না। বরং বিলুপ্ত হয়ে যায়। এজন্য এক কল্প থেকে অন্য কল্পের প্রতিসন্ধি কল্প বিবরণ বলছি। ছোট করে কল্পের বিবরণগুলো বলছি। আগে যে কল্প অতীত হয়ে গিয়েছে তা আগের পরাধের অন্তর্গত। আর পরপাঠের কালের কল্পগুলির মধ্যে বরাহকল্প প্রথম।
.
অষ্টম অধ্যায়
সেই পুরুষ সহস্ৰযুগ রাত্রি অতিবাহিত করে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মমূর্তি ধরেন–একথা বলে সূত শুরু করলেন। সেই অন্ধকার জলে ভরা বিভাগহীন পৃথিবীতে ব্রহ্মা বাতাস হয়ে পাখির মতো আকাশে ঘুরতে ঘুরতে পথ সন্ধান করতে লাগলেন। ভূমি উদ্ধারের জন্য চিন্তা করে আগের কল্পের মতো অন্য শরীর ধরলেন। বরাহ বেশে জলে প্রবেশ করে পৃথিবী উদ্ধার করলেন।
আগের সৃষ্টিতে সংবর্তক আগুনে সমস্ত পৃথিবী পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবার শীতের প্রকোপে বায়ু দ্বারা কিছু জায়গায় কঠিন আকার হয়ে পর্বতে পরিণত হয়েছে। প্রভু প্রজাপতি জল থেকে পৃথিবী উদ্ধার করে সাত বর্ষ যুক্ত সাতটি দ্বীপে ভাগ করেন। সব দ্বীপের পর্বত সংখ্যা উনপঞ্চাশ।
সাতটি দ্বীপ ও সাতটি সমুদ্র পরস্পরকে, গোল করে ঘিরে রয়েছে সবার আগে সৃষ্ট হয় চাঁদ, সূর্য, গ্রহ তারা সহ ভূ ইত্যাদি চারটি লোক নির্মাণ করেন। কল্পের প্রথমে ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন জল, আগুন, পৃথিবী, বাতাস, অন্তরীক্ষ, স্বর্গ, দিক, সমুদ্র, নদী, পর্বত, ঔষধি, গাছ, লতা, কলা, মুহূর্ত, সন্ধি, রাত্রি, দিন, পক্ষ, মাস, অয়ন, বৎসর ইত্যাদি সৃষ্টি করে পরে যুগবস্থা নির্মাণ করেছিলেন।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই হল চার যুগের নাম। কল্পের প্রথম ভাগে সত্যযুগে ব্রহ্মা প্রজাদের সৃষ্টি করেন। আগের কল্পে প্রজারা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। যারা তাপলোকে না পৌঁছে জনলোকেই রয়ে গেছিলেন, তাঁরাই হলেন পরবর্তী সৃষ্টির বীজ। এঁরাই প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে প্রজা থেকে প্রজা বৃদ্ধি হতে থাকে। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের সাধক এরাই। দেব, পিতৃ, ঋষি ও মনুরা তপস্যার দ্বারা স্থানগুলি পূর্ণ করার জন্য ব্রহ্মার মানসপুত্র রূপে জন্ম নেন আর যারা হিংসামূলক কাজ করেও স্বর্গে গেছিলেন সঙ্গগুণে, তারা যুগে যুগে এই সংসারে ফিরে আসেন। জনলোক থেকে শুভাশুভ ফলভোগের জন্য জন্মগ্রহণ করেন। মাটিতে জন্ম নিয়ে কর্ম অনুযায়ী খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করে থাকে। আগের আগের কল্পে যিনি যেমন কাজ করেছেন, পরের জন্মেও সেই লোক সেরকম কর্মাচরণ করবেন। সেই বিষয়ে ভাবনাবশতঃ হিংস্র, অহিংস, মৃদু, কুর, সত্য, মিথ্যা, ধর্ম, অধর্ম সবকিছুই পূর্ব কল্পের জন্মের মতো হয়ে থাকে। আগের কল্পে যার যেমন রূপ ছিল, ভাবিকল্পেও জীবেরা প্রায়ই তা পেয়ে থাকে। তাই একই নামরূপ নিয়ে কল্প কল্পে জন্ম নিয়ে থাকেন। স্বয়ং ব্রহ্মা ধ্যান এর দ্বারা মুখ থেকে সহস্র মিথুন সৃষ্টি করেন। এই সমস্ত প্রজা সত্ত্বগুণসুক্ত আর প্রশস্তচিত্ত। তার বুক থেকে হাজার প্রজা সৃষ্টি করেন এরা রজগুণযুক্ত গর্ব আর উৎসাহ সম্পন্ন তিনি তার উরু থেকে রজঃ ও তমোযুক্ত আর এক হাজার প্রজার জন্ম দেন। এরা খুব বেশি স্পৃহাসম্পন্ন। তিনি তার দুই পা থেকে যে হাজার শূদ্র সৃষ্টি করেন তাদের তমোগুণ রয়েছে। এরা শ্রীহীন, বুদ্ধিহীন এইসব প্রজারা আনন্দে মিথুনে ব্রতী হলে, সেই থেকে পৃথিবীতে মিথুনোৎপত্তি প্রবৃত্তি ঘটে। মিথুনের ফলে মেয়েদের সন্তান হতো না। আয়ুর একদম শেষে একবার একসঙ্গে পুত্রকন্যার জন্ম দিতেন। এদের বৃদ্ধকালে যে কুবিবেচকরা জন্মেছে, তারাই মিথুন দ্বারা সন্তান জন্ম দিয়েছে। প্রজাপতি ব্রহ্মার মানস প্রজাদের বংশের প্রজা দিয়েই জগত পরিপূর্ণ হচ্ছে।
আদিম যুগে শীত, বৃষ্টি, গরম অল্পই ছিল। প্রজারা তখন সরোবরে, পাহাড়ে, সমুদ্রে থাকতো। পৃথিবীর সজাত খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতো। এদের ধর্ম অধর্ম ছিল না। আয়ু, রূপ, সুখ–সব বিষয়েই তারা এক ছিল। নিজ নিজ অধিকারে জীবনযাপন করত। সত্যযুগের পরিমাণ চার হাজার বছর। সেই সময়কার প্রজাদের শীত, গ্রীষ্মের কষ্ট ও অসুবিধে ছিল না। পর্বত সাগরের সেবা করে একান্ত সুখী ছিল। তাদের নির্দিষ্ট কোন থাকার জায়গা ছিল না। তখন পশু, পাখি, সরীসৃপ ও উদ্ভিদ বা দুঃখী মানুষ ছিল না। সকলেই শোকহীন, সত্ত্বযুক্ত কামাচারী হয়ে আনন্দে ছিল। আকাশে সব সময় সূর্য ছিল। প্রজাদের স্থির যৌবন ছিল। তাদের বিশুদ্ধ সংকল্পে সন্তান জন্ম নিত। রূপ, আয়ু সকলেরই এক ছিল তাই ভালোমন্দের ভাব ছিল না। সত্যযুগে-দুঃখহীন প্ৰজাই জন্মাতো। তখন লাভ-অলাভ, বন্ধু-শত্রু। এসব ছিল না। তাদের ভালোবাসা বা অনুগ্রহ ছিল না। সত্য যুগে ধ্যান, ত্রেতার জ্ঞান, দ্বাপরে যজ্ঞ আর কলিযুগে দাসই প্রশংসনীয় ছিল। সত্যযুগে সত্ত্ব, ত্রেতায় রজঃ, দ্বাপরে রজস্তমঃ আর কলিতে তমোগুণই প্রবল। যুগের ক্রিয়াগুলোয় তারতম্য বলেই গুণের তারতম্য হয়।
চার হাজার বছর হল সত্যযুগের পরিমাণ। তখনকার প্রজারা দুঃখকষ্ট হীন হয়ে এই আয়ুকাল পেরিয়ে যেত। সত্যযুগের সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ শেষ হলে যুগ ধর্মের একপাদ শেষ হয়। যুগান্তকালে প্রজাদের মানসী সিদ্ধিগুলিও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। সত্যযুগের সন্ধ্যাকালে যুগ ধর্মের এক পাদ এবং ত্রেতা আরম্ভে সেই সন্ধ্যাংশ কালীন ধর্মের একপাদ, এইভাবে আস্তে আস্তে তপস্যা, শাস্ত্রজ্ঞান বল ও আয়ুক্ষয় পেয়ে থাকে।
হে মুনিরা! সত্যযুগ সন্ধ্যাংশ শেষ হলে ত্রেতাযুগ শুরু হয়। তখন প্রজাদের আদিমযুগের মতো সিদ্ধি থাকে না। তখন আবার অন্য সিদ্ধি শুরু হয়। জলের সূক্ষ্মতা নষ্ট হওয়ায় গর্জনকারী মেঘরূপ পায়। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টি থেকেই গাছ জন্মায় আর প্রজারা প্রয়োজনের জিনিস পেতে থাকে। ত্রেতাযুগের প্রথমে এভাবেই প্রজারা জীবিকা নির্বাহ করত। এরপর পরিবর্তন আসে, আসক্তি থেকে লোভ তাদের আক্রান্ত করে। সত্যযুগের শোষণকারীরা গর্ভধারণে সক্ষম হয়। ত্রেতাযুগে সেভাব লুপ্ত হয়ে নারীরা মাসে মাসে ঋতুমতী হত। প্রতিমাসে সঙ্গমবশে অকালে গর্ভোৎপাদনের ফলে অসংখ্য সন্তানের জন্ম হত।
কালের পরিবর্তনে প্রজাদের বাসস্থলের আগে যে গাছগুলি জন্মেছিল সেগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রজারা ব্যাকুল, বিভ্রান্ত হয়ে ধ্যানে বসে। তখন আবার গাছ জন্মায়। সেই সব গাছ থেকে বস্ত্র, আভরণ, ফল, মধু ইত্যাদি পাওয়া যেত। ত্রেতাযুগের প্রজারা তাই দিয়ে আনন্দে দিন কাটাত। এরপর এরা লোভের বশবর্তী হয়ে এইসব গাছ মধু ইত্যাদি জোর করে কেড়ে নিতে শুরু করে। তাদের এই অনাচারের জন্য সব গাছ নষ্ট হয়। তখনই প্রজাদের শীত গ্রীষ্মে কষ্ট শুরু হয়। তখন শীত গ্রীষ্ম থেকে রক্ষা পেতে বস্ত্র ব্যবহার করতে থাকে। আর যেখানে সেখানে ভ্রমণ না করে বাসগৃহে আশ্রয় নেয়।
এভাবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করে। নদী, পাহাড়, উঁচু নিচু জায়গায় কষ্ট নিবারণের জন্য দুর্গ বাড়ি বানাতে শুরু করে এইভাবে গ্রাম, পুর, অন্তঃপুর ইত্যাদি স্থাপিত হয়। সেই সবের হিসাব অর্থাৎ দৈর্ঘ্য প্রস্থ প্রভৃতির পরিমাণ করার জন্য আঙ্গুল দিয়ে নানারকম পরিমাণ সংজ্ঞা স্থির হয়। প্রদেশ, হস্ত, কিন্তু, ধন ইত্যাদি সংজ্ঞা তখন থেকেই প্রচলিত। দশ আঙ্গুলে এক প্রদেশ, অঙ্গুষ্ঠাবিধি তর্জনী পর্যন্তের ব্যাস পরিমাণ প্রাদেশ, মধ্যমা পর্যন্ত তাল, অনামিকায় গোকর্ণ, আর কনিষ্ঠায় এক বিতস্তি হয়। বিতস্তির পরিমাণ বারো আঙ্গুল। কুড়ি আঙ্গুলে এর রত্ন, চব্বিশ আঙ্গুলে এক হস্ত, চল্লিশ আঙ্গুলে এক কিন্ধু হয়। চার হাতে এক ধনু, দণ্ড নালিকা আর যুগ হয়। দুই হাজার ধনুতে এক গরূ্যতি। আট হাজার ধনুতে এক যোজন। এই যোজন পরিমাণ দিয়েই নিজ নিজ বাস সন্নিবেশ করে।
তারা চার রকম দুর্গ আশ্রয় করত। তার মধ্যে তিনটে দুর্গ স্বভাবজাত। চতুর্থ দুর্গটি কৃত্রিম। এটির বর্ণনা দিচ্ছি–সৌধগুলো উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, পরিখা–অনেক জলে ভরা। দ্বারদেশে–সেতু সংযুক্ত দরজা-স্বস্তি-কাম্য। ঐ দুর্গ কুমারীপুর বিশিষ্ট করা উচিত। পরিখা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে আট হাত ও দশ হাত হলেই ভাল হয়। ছোট গ্রাম, নগর, গ্রাম ও তিন রকমের দুর্গের পর্বত আর জল দিয়ে সীমারেখা থাকবে। তিনরকম দুর্গের মধ্যে যা বিষম্ভে পরিমাণ তাদের আয়তন পরিমাণ, তার অর্ধেকের বেশি আট অংশ। পুর নির্মাণ কাজে দৈর্ঘ্য থেকে বিস্তারের পরিমাণ অর্ধেক হলেই ভালো হয়। ছিদ্রকর্ণ, বিকর্ণ, বৃত্তাকার, খুব বড় খুব ছোট সাবকাশ পুর নিন্দনীয়।
পুর মধ্যবর্তী মূল বাসস্থানের বিষ্কম্ভ পরিমাণ আটশ কিস্কু ছোট গ্রামের পরিমাণ নগর পরিমাণের অর্ধেক। রাজপথ দশধনু বিস্তার, মানুষ, রথ, হাতি, ঘোড়া অনায়াসে চলাচল করতে পারে। সেই সময় শাখাপথগুলি চার ধনু প্রমাণ করতেন। গৃহপথ দুই ধনু, উপরথ এক ধনু, ঘণ্টা পথ চারপদে, আর গৃহ থেকে গৃহান্তর ত্রিপদ প্রমাণযুক্ত। জলপূর্ণ হওয়ায় পাথর পরিমাণ একপদ। আগে যেমন গাছের ছায়ায় কুটির বানিয়ে থাকত, এখন বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করল। গাছের শাখার মতো চারিদিকে বিস্তার লাভ করল এদের তৈরী বাড়িগুলি। শাখার আকারে তৈরী বলে বাড়িগুলি থালা’ নামে প্রসিদ্ধ। প্রজারা তখন শীতগ্রীষ্মের কবল থেকে বাঁচবার উপায় বের করার পর জীবিকার সন্ধান করতে লাগল।
কল্পবৃক্ষগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ও মধু বিলুপ্ত হওয়ায় প্রজারা খিদে-তেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে পড়ল। এরপর ত্রেতাযুগে সত্যযুগের মতো বৃষ্টিরূপে সিদ্ধির প্রাদুর্ভাব হয়। সে দ্বিতীয় বৃষ্টি জনহীন শুকনো জায়গাগুলো ভরে যায়। সেই জল থেকে পৃথিবী শস্যশ্যামলা হয়। তখন চোদ্দপ্রকার ওষধির সৃষ্টি হয়। নানারকম ঋতুর বৈচিত্র্যময় ফল, ফুল, ত্রেতা যুগেরই সৃষ্টি। তারপর আবার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে প্রজাদের মনে লোভ, রাগ, হিংসা তৈরী হয়। তখন জোর করে তারা নদী, ক্ষেত, পাহাড়, গাছ, লতা, ঔষধিগুলো কেড়ে নিতে থাকে।
সত্যযুগের প্রথমে যে সিদ্ধাত্মাদের কথা বলেছি তারা ব্রহ্মার মানসসৃষ্টি তারাই আবার ত্রেতাযুগে জন্ম নেন। শুভাশুভ কাজের গুরুত্ব অনুসারে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও তিন বর্ণের সেবাকারী শূদ্র-এ চার প্রকার প্রজার সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে যারা বলবান, সত্যবাদী, অহিংসক, নির্লোভ, জিতেন্দ্রিয় তারা সেই সমস্ত পুরগুলিকে বাস করত। যারা এদের থেকে দুর্বল তারা এদের কাছে বাসস্থান নির্মাণ করত। তার থেকেও দুর্বল যারা তারা এদের কাছে কাজ করে জীবন চালাত। আরও হীনবল মানুষরা এদের সেবা করে জীবনযাপন করত।
এইভাবে পরস্পর একসঙ্গে বাস করতে করতে তাদের লোভ দ্বারা সমস্ত ঔষধি হ্রাস পেয়ে বলির মতো নষ্ট হয়ে গেল। প্রজারা সব কিছু নষ্ট করার পর খিদে তেষ্টায় কাতর হয়ে স্বয়ম্ভু ব্রহ্মার কাছে এল। ত্রেতাযুগে ভগবান স্বয়ম্ভু অবস্থা দেখে আবার শস্য ইত্যাদি আবিষ্কার করলেন। সুমেরুকে বৎস্যরূপে কল্পনা করে পৃথিবী দোহন করলেন। তখন আবার ওষধি বীজগুলি জন্মায়। তখন সতেরো প্রকার ওষধি জন্মায়। যথা–ব্রীহি, যব, অনু, তিল, প্রিয়ঙ্গু, উদারকরুষ, কলায়, মাষ, মুগ, মসুর, নিষ্পব, কুলথ এসব গ্রাম্য ঔষধি। ওষধি নয় এমন অনেক কিছু নিজে থেকেই ত্রেতা যুগে উৎপন্ন হয়েছিল।
এছাড়া নানারকম ফলে ফুলে প্রজাদের সুখ বৃদ্ধি হত। পৃথিবী দোহন করার পর বীজ থেকে বিভিন্ন ঋতুর ফল ফুল যুক্ত ওষধি জন্মায়, কিন্তু ওষধি পরে ঠিকমতো রোপণ করা হল না, তখন ব্রহ্মা প্রজাদের জীবিকাবৃত্তির কথা চিন্তা করলেন। প্রজাদের কাজের জন্য জমি কর্তন করে শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করলেন। তখন থেকেই শস্য উৎপাদন হতে লাগলো। প্রজাদের মধ্যে বিবাদ মেটানোর জন্য তিনি কতগুলি বিধি ব্যবস্থা নিলেন। যারা বলবান তারা জমির মালিক, ক্ষত্রিয়দের ইতর জনের রক্ষার কাজে নিযুক্ত করলেন। সেসব ক্ষত্রিয়ের কাছে যারা যেত তারা ভয়হীন, সত্যবাদী আর সর্বভূতে ব্রহ্মা জ্ঞানবান ছিলেন তাদের ব্রাহ্মণ বলা হতো। যারা এদের থেকে দুর্বল অথচ কুটিল হিংসুক সেই প্রজাদের বৈশ্য নাম দিয়ে সকলের বৃত্তি সাধন কাজে নিযুক্ত করলেন। অল্প বলশালী শূদ্ৰজাতিকে অন্য তিনবর্ণের সেবায় নিযুক্ত করলেন। যাতে তারা নিজ নিজ কর্তব্য করতে পারে। পরে আবার আস্তে আস্তে তারা এইসব নিয়মের অনাদর করে একে অপরের বিরুদ্ধে বিবাদে লিপ্ত হয়। ব্রহ্মা একথা জানতে পেরে ক্ষত্রিয়দের জন্য বল, যুদ্ধ ও শাসন–এই তিন জীবিকা নির্দিষ্ট করলেন। ব্রাহ্মণরা করবে যাজন, অধ্যাপন, আর প্রতিগ্রহ। পশুপালন, ব্যবসা ও কৃষি দিলেন বৈশ্যের হাতে। আর শূদ্রদের জন্য শিল্প ও দাসত্ব–এ দুটি বৃত্তি নির্দিষ্ট হল। এসব কাজ ও জীবিকা বিধান করে প্রভু ব্রহ্মা সিদ্ধির ফলস্বরূপ কর্মান্তর-এর স্থান ঠিক করে দিলেন। যে ব্রাহ্মণরা কাজ করেন, তারা যাবেন প্রজাপত্য স্থানে, যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুকহীন ক্ষত্রিয় যাবে ঐন্দ্রস্থানে। স্বধর্মনিষ্ঠ বৈশ্যদের জন্য মারুত স্থান আর নিজেদের আচার যারা করেনি এমন শূদ্রেরা যাবে গন্ধব্য স্থানে। বর্ণের প্রতিষ্ঠার পর আশ্রমগুলির প্রতিষ্ঠা হল। গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বাণপ্রস্থ ও ভিক্ষুক–এই চার আশ্রমে তখন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজাদের মধ্যে যখন অনেকে বর্ণধর্ম পালন করতে অবহেলা শুরু করল তখন ব্রহ্মা তাদের উৎসাহী করার জন্য চারটি আশ্রমের বিধান দিলেন। তাদের শিক্ষার জন্য নানারকম ধর্ম, আচার উপদেশ দিতে থাকেন।
গৃহস্থ আশ্রমই তিনটি আশ্রমের উৎপত্তির কারণ। এবার চারটি আশ্রমের কথা বলছি। গৃহস্থের প্রতিপাল্য ধর্ম হল বিবাহ, অগ্নি হোমের অনুষ্ঠান, অতিথি সেবা, যজ্ঞ-শ্রাদ্ধ করা ও সন্তানের জন্ম দেওয়া। দণ্ড, মেঘলা আর জটা রামা, মাটিতে শোয়া, গুরুসেবা, ভিক্ষা-বিদ্যালাভের জন্য ব্রহ্মচারীর এইসব বিধান পালন করা উচিত। গাছের ছাল, হরিণের চামড়া পরিধান, ফলমূল আর ধান খাওয়া, দুই সন্ধাতে স্নান করা ও হোম করা হল বাণপ্রস্থদের কাজ। সেই সময় ভিক্ষা, অস্তেয়, শৌচ, সাবধানতা, প্রাণীদের ওপর দয়া, ক্ষমা, অক্রোধে গুরুসেবা ও সত্য এই দশটি বিশেষ ধর্মের মধ্যে প্রথম পাঁচটি সন্ন্যাসীদের প্রধান ব্রত, আর পাঁচটি গৌণ ব্রত। এছাড়া সদাচার, বিনয়, শৌচ, বিলাসিতা ত্যাগ আর যথাযথ বিচার এই পাঁচটি হল উপব্রত। ব্ৰহ্ম বলেছেন, সমস্ত আশ্রমই জনগণের মঙ্গলদায়ক সত্য সরলতা, দয়া, ক্ষমা, যোগ, যাগ, দম, বেদ, বেদাঙ্গ, যজন, ব্রত, নিয়ম প্রভৃতি শ্রদ্ধাহীন লোকেদের কাজ দেয় না। হৃদয়ে যার শ্রদ্ধা নেই, বাইরে আড়ম্বর করলেও সিদ্ধিলাভ হয় না। কলুষিত মন নিয়ে সর্বস্ব দান করলেও ধার্মিক হয় না। ধর্ম লাভ বিষয়ে মানসিক লাভ কারণ। দেব, পিতা, ঋষি, মনু প্রভৃতি যেমন পরলোকে বাস করেন, সন্ন্যাসীরাও মরণের পরে পরলোকবাসী হন।
ঊর্ধরেত ঋষিরা যেখানে থাকেন, গুরুকুলবাসী ব্রহ্মচারীরাও সেখানে বাস করতে পারেন। সপ্তর্ষিরা যেখানে থাকেন সেটাই দেবতাদের থাকার জায়গা। গৃহস্থেরা প্রজাপতি লোকে থাকতে পারেন। সন্ন্যাসীরা ব্ৰহ্মলোক পেয়ে থাকেন। যোগিদের অধ্যাত্মপদে স্থান হয়। কিন্তু নানা বুদ্ধি লোকেদের কোথাও স্থান নেই। আশ্রমবাসকারী ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য যেসব স্থান নির্দিষ্ট। দেবযান মহাপথের এই চারটি সাধারণ পথ। প্রজা সৃষ্টিতে ইচ্ছুক প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথম মন্বন্তরে দেবলোকের জন্য ভূমণ্ডলে এসব সৃষ্টি করেন। রবি হল এই সব পথের দরজা। আর চন্দ্র হল পিতৃযান পথের দ্বার। বর্ণাশ্রম বিভাগ প্রচলিত হলেও প্রজারা সেই ধর্ম পালনে অবহেলা করছে দেখে তিনি আবার কতগুলি মানসী প্রজা সৃষ্টি করলেন। এরা হলেন দেব, ঋষি, পিতৃ ও মনু। এরা ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ও জীবনযাত্রা এ সমস্তের সাধক। এই পুত্ররাই ধর্মানুসারে যুগে যুগে সন্তান উৎপাদন করে সৃষ্টি বিস্তার করেছেন। আগেই বলা হয়েছে অতীতকালে যারা জনলোকে ছিলেন তারাই এই কল্পে দেবাদিরূপে জন্ম নিয়েছেন। ব্রহ্মার ধ্যান থেকে এমন প্রজা সৃষ্টি হয়, এইসব সৃষ্ট প্রজা প্রতি মন্বন্তরে সুকর্ম, কুকর্ম, সুখ, দুঃখ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, রূপ, গুণ ইত্যাদি সব বিষয়ে একপ্রকার হয়ে থাকে। প্রাণীদের কর্মফল অবশিষ্ট থাকলেই জন্মগ্রহণ করতে হয়। তারা তখন দেব অসুর পিতৃ, পশু, পাখি, সরীসৃপ, গাছ, কীট, পতঙ্গ নানাভাবে জন্মায়। ভগবান ব্রহ্মা আত্মসৃষ্ট প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্যেই এই সমস্ত ব্যবস্থা করলেন।
.
নবম অধ্যায়
সূত বললেন–ভগবান ব্রহ্মা ধ্যান করতে থাকলে তার মানসী প্রজারা উৎপন্ন হয়। তিনি দেব, পিতা, মানুষ ইত্যাদি প্রজা সৃষ্টির জন্য জলরাশির মধ্যে যোগে মগ্ন হন। তখন তার জঘন থেকে অসুরেরা জন্মে। বিপ্রেরা প্রাণকেই অসু বলেন। তার থেকে জন্ম নিয়েছে যারা তারা অসুর। অসুরদের জন্ম দেখে ব্রহ্মা শরীর ত্যাগ করলেন। তার সেই পরিত্যাগ করা শরীর রাত্রিরূপ পায়। তমোপূর্ণ বলে রাত্রিও ত্রিমাত্মিকা। সেজন্য প্রজারা রাত্রিতে তমোগুণ আবৃত হয়ে পড়ে। দেবতা ব্রহ্মা-অসুরদের দেখে অন্যমূর্তি ধারণ করেন। তিনি সেই মূর্তি গ্রহণ করে আনন্দিত হয়ে যোগ থেকে নিরস্ত হলেন। সেই আনন্দিত ব্রহ্মার মুখ থেকে দেবতারা উৎপন্ন হলেন।
দিব্ ধাতুর অর্থ ক্রীড়া বা খেলা। দেবনযুক্ত শরীরে জন্মের জন্য তারা দেবতা বলে বিখ্যাত। দেবতাদের সৃষ্টি করে ব্রহ্মা যখন অন্য দেহ ধারণ করলেন তখনই তা দিনে পরিণত হল। সেজন্য দেবগণ কাজের জন্য দিবের উপাসনা করেন। তারপর ব্রহ্মা অন্য শরীর নিয়ে পিতার মতো সস্নেহে পুত্রদের কথা চিন্তা করতে থাকেন। পরে দুটি পক্ষে সাথে দিনরাত্রির মাঝে পিতৃগণকে সৃষ্টি করলেন। সেজন্য সেই দেবদের পিতৃ এই নাম হল।
তারপর ব্রহ্ম যে শরীরে পিতৃগণকে সৃষ্টি করেছেন সেই শরীর পরিহার করলে তা সদ্যই সন্ধ্যারূপে প্রাপ্ত হল। তখন দিবা দেবদের, রাত্রি অসুরদের আর দুই-এর মাঝে সন্ধ্যা পিতৃদের আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তখন থেকে দেব, অসুর, ঋষি, মনু সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে ব্রহ্মার সেই তৃতীয় শরীরের উপাসনা করতে থাকেন। এরপর ব্রহ্মা রজোগুণ সম্পন্ন অন্য শরীর গ্রহণ করলেন। সেই রজোপূর্ণ দেহে অন্য কতগুলি মানস-সন্তান সৃষ্টি করলেন। মন থেকে জন্ম বলে সেই সব সন্তানরা মানস নামে পরিচিত। ব্রহ্মা এই সন্তানদের দেখে শরীর ত্যাগ করলেন তা তখনি জ্যোৎস্না রূপ পেল। সেজন্য প্রজারা জ্যোৎস্না দেখে আনন্দ পায়। জ্যোৎস্না সন্ধ্যা ও দিন–এই তিন সত্ত্বগুণসম্পন্ন। রাত্রি তমোগুণ সম্পন্ন ও ত্রিযামযুক্ত।
ব্রহ্মার দিব্য শরীরের মুখ থেকে উদ্ভব হওয়াতে দেবেরা সবসময় আনন্দ মনে থাকেন। দিনে তাদের জন্ম বলে দিনেই তারা বেশি শক্তিশালী আর রাত্রিকালে ব্রহ্মার জঘন হতে অসুরদের সৃষ্টি অসুররা রাত্রে বেশি শক্তিশালী ও অসহ্যবিক্রম। দেব, অসুর, পিতা, মনু প্রভৃতির ভূত ভবিষ্যত সব মন্বন্তরে এভাবে উৎপত্তি হয়। রাত্রি, দিন, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না এভাবেই এসে থাকে। ভা’ ধাতু দীপ্তি বাচক। প্রজারা তা. যুক্ত হয়েছিল বলে এর নাম অম্ভঃ। মনীষীরা বলেন প্রজাপতি এমন নাম দিয়েছেন। এই অম্ভঃ দেখেই তিনি অন্যান্য নানারকম দেব, মানব, দানব, পিতাদের সৃষ্টি করেছেন। ব্রহ্মা সেই শরীরও ত্যাগ করলেন এবং খিদে নিয়ে রজস্তমোযুক্ত মূর্তি নিয়ে আবার যাদের সৃষ্টি করলেন তারাও খিদে নিয়ে জন্মে ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে চাইল। তার মধ্যে যারা বলল, এই জলরাশিকে রক্ষা করব সেই নিশাচর ক্রোধাত্মাকে রাক্ষস বলে।
আর যারা বলল জলকে খেয়ে ফেলব, তাদের বলে যজ্ঞ। বক্ষ ধাতু থেকে এসেছে রাক্ষস শব্দ আর ক্ষি ধাতু ক্ষয়াৰ্থক-এর থেকে যক্ষ শব্দ এসেছে। এই অপ্রিয় সৃষ্টি দর্শন করে ভগবান ব্রহ্মার চুল খসে পড়ে সাপের আকার নিয়ে তার গায়ে উঠতে থাকে। ব্রহ্মার মাথা থেকে এরা খসে গিয়েছিল বা অপসর্পতা হয়েছিল আর এরা খারাপ স্বভাব হেতৃহীন। তাই এরা অহি, সর্প পৃথিবীর যেখানে চাঁদ বা সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না, সেখানে এদের থাকার জায়গা স্থির হল। ব্রহ্মার ভীষণ আগুনের মতো রাগ সাপেদের মধ্যে চলে যাওয়াতে এরা বিষযুক্ত হল। সাপেদের দেখে রেগে গিয়ে রাগী কপিলবর্ণ ভূত ও পিশাচ সৃষ্টি করলেন। এরা ভূমণ্ডল ঘিরে রয়েছে। এরা মাংস খায় বলে পিশাচ নামে অভিহিত। এরপর জন্মায় গন্ধর্বরা। এরা জন্মেই গো বা তেজ পান করতে থাকে বলে পানাৰ্থক ধৈ ধাতু থেকে গন্ধর্ব শব্দটি এসেছে।
এই আট রকম দেবযানি সৃষ্টি হলে প্রভু ব্রহ্মা স্বচ্ছন্দ মনে বয়স থেকে বয়ঃসমূহ সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মাশূন্য দেখে পাখিদের সূজন করে। ব্রহ্মা পেটের দুপাশ থেকে গোরুদের সৃষ্টি করেন। তার দুপা থেকে ঘোড়া, হাতি, শরভ, হরিণ, উট, অশ্বতর প্রভৃতি পশুরা জন্মে। তার গায়ের রোম থেকে ওষধি ফল-মূলাদি জন্মায়। এভাবে ত্রেতাযুগে শুরুতে পশু ও ওষধি সৃষ্টি করে যজ্ঞের কাজে নিয়োগ করলেন। গোরু, অজ, পুরুষ, মোষ, ঘোড়া ইত্যাদি গ্রাম্য পশু। এবার অরণ্য পশুরা হল স্বাপদ দ্বিখুর, হাতি, বানর, পাখি, উল্ক সরীসৃপ। পার এ বরুণ, ত্রিবৃত, সৌম্য, রথন্তর, অগ্নিষ্টোম এইসব শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ তার পূর্বমুখ থেকে সৃষ্টি হয়। ছন্দগুলো যেমন–ত্ৰৈষ্ঠুভ, কর্ম, স্তোম, পঞ্চদশ, বৃহৎসাম, উকম–এরা দক্ষিণ মুখ থেকে। সাম জগতী ছন্দে সতেরোটি প্রকারভেদ। বৈরূপ্য, অতিরাত্র–এরা পশ্চিম মুখ থেকে, আর একুশ প্রকার অথর্ব, অপ্তোষমি, অনুষ্ঠু ও বৈরাজ–এরা সব উওর মুখ থেকে সৃষ্টি।
প্রভু ব্রহ্মা কল্পের আদিতে বিদ্যুৎ অশনি, মেঘ নভোবৈচিত্র্য ইন্দ্রধনু–এইসব সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রহ্মার গা থেকে ছোট বড় প্রাণীরা জন্মায়। তিনি প্রথম দেব, অসুর, পিতা প্রভৃতি চার প্রকার প্রজা সৃষ্টি করে স্থাবর চর প্রভৃতি অন্যান্য সমস্ত উৎপাদন করেন। যজ্ঞ, পিশাচ, অপ্সরা, গন্ধর্ব, নর, কিন্নর, রক্ষঃ, পশু-পাখি, হরিণ, উবর্গ, অব্যয়, ব্যয়, স্থাবর, জঙ্গম সমস্ত পদার্থই প্রথম সৃষ্টিতে যে যেমন কাজে নিযুক্ত ছিল, সে অন্যান্য জন্মে তেমন কাজে যুক্ত হয়। কাজ অনুযায়ী তাদের আলাদা আলাদা প্রবৃত্তি জন্মায়।
এজন্য তারা হিংস্র, অহিংস্র, ক্রুর, ধর্ম, অধর্ম, সত্য, মিথ্যা ইত্যাদি নানা কাজে ব্রতী। হে বিপ্রেরা কোনো মানুষ কাজে, কেউ পুরুষকার, কেউবা দেব, অন্যরা স্বভাবকেই কাজের ফলদায়ক বলে নির্ণয় করেন। কিন্তু পুরুষকার, কর্ম, দেব-এরা প্রত্যেকেই স্বভাবশে ফলসাধক। এদের মধ্যে অল্প বা বেশি ভাব নেই। প্রত্যেকেই তুল্য প্রাধান্য সম্পন্ন। কোন কাজই এদের একের দ্বারা হচ্ছে এ কথা বলা যায় না। এজন্য সত্ত্বস্থ ব্রহ্মনিষ্ঠ লোকেরা বিষয়গুলি কর্মস্থ বলে নির্দেশ করেন। রাত্রির শেষে দিনের শুরুতে ভগবান ব্রহ্মা আগের দিনের বেদ বচনগুলি প্রকাশ করেন।
বিভিন্ন ঋতুর বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন নানাভাবে ব্যক্ত হয় সেরকম বিভিন্ন যুগে ভাবগুলো বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হয়। রাত্রির শেষে ব্রহ্মা মানসী সিদ্ধিকে আশ্রয় করে প্রতিদিন সৃষ্টির কাজে ব্রতী হন। প্রতিদিনই তিনি স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করেন। পরে সেই সমস্ত প্রজা বৃদ্ধি পাচ্ছে না দেখে, তিনি ভৃগু, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, অঙ্গিরা, মরীচি, দক্ষ, অত্রি ও বশিষ্ঠ এই ক’জন মানস পুত্র সৃষ্টি করেন। এঁরা ‘নবব্রাহ্মণ’ নামে পুরাণে বিখ্যাত। এরা সকলেই ব্রহ্মবাদী ও ব্রহ্মচর্য নিষ্ঠ হলেন। তখন রেগে গিয়ে ব্রহ্মা রুদ্রকে সৃষ্টি করলেন। এর সৃষ্টি হল ধর্ম ও সংকল্পের। ব্রহ্মা এর আগে সনন্দন, সনক, সনাতক, সনৎ কুমার নামে পুত্রদের উৎপাদন করেন। কিন্তু এঁরা সংসারে আসক্ত হলেন না।
তারা নিরপেক্ষ জিতেন্দ্রিয়, রাগহীন, বিমৎসর ও ভবিষ্যতজ্ঞান সম্পন্ন। হিরণ্যগর্ভ সেই পুত্রেরা নিরপেক্ষ ব্রহ্মবাদী হল। তাই দেখে ব্রহ্ম আবার রেগে গেলেন। তার রাগ থেকে তখন সূর্যের মতো তেজদীপ্ত দেহ, অর্থ, স্ত্রী, অর্ধপুরুষ মূর্তি আবির্ভূত হয়ে ব্রহ্মাকে বলল–সবকিছুই তেজময় হয়েছে। আদিত্যের মতো তেজস্বী আত্মাকে এবার ভাগ করো। এই বলে সেই মূর্তি মিলিয়ে গেল।
এই শুনে ভগবান ব্রহ্মা নিজেকে দুভাগে ভাগ করে একস্ত্রী ও একপুরুষ রূপ নিলেন। অর্ধেক পুরুষ মূর্তিটির আবার সতেরো ভাগ করলেন। তাদের বললেন–তোমরা জগতের কল্যাণের জন্য সৃষ্টির বিস্তারের জন্য যত্নশীল হও। একথা শুনে তারা রোদন করতে করতে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। এজন্য এরা রুদ্র নামে পরিচিত। এই রুদ্রেরা সমস্ত চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছেন। গণেশ্বর রুদ্রেরা সকলেই অন্যান্য সৃষ্টদের চেয়ে বেশি বলবান। আগে বলা হয়েছে যে–ব্রহ্মার মুখ থেকে দক্ষিণার্ধে শুক্লবর্ণা ও বামাঙ্গে শঙ্করার্ধ শরীনিনী এক মহাভাগ দেবী আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সেই দেবী নিজদেহ দুভাগে বিভক্ত করলেন।
তার একমূর্তি শুক্ল আর একমূর্তি কালো। তাদের নাম হল–স্বাহা, স্বধা, মহাবিদ্যা, মেধা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অপর্ণা, একপর্ণা, পাটলী, উমা, হেমবতী, ষষ্ঠী, কল্যাণী, খ্যাতি, প্রজ্ঞা, মহাভাগা ও গৌরী। এই আর্যদেবীই ভিন্ন ভিন্ন দেহ ধারণ করে সৃষ্টি ব্যপ্ত করে আছেন। তার অন্য নামগুলি হল–প্রকৃতি, নিয়তি, রৌদ্রী, দুর্গা, ভদ্রা, প্ৰমথিনী, মহামায়া, রেবতী ইত্যাদি দ্বাপরযুগে দেবীদের কয়েকটি নাম হল–গৌতমী, কৌশিকী, আর্যা, চণ্ডী, কাত্যায়নী, সতী, কুমারী, যাদবী, বরদা, অপরাজিতা, সিংহবাহিনী, মহিষমর্দিনী প্রভৃতি। মানুষ ভদ্রকালীর এইসব নাম পাঠ করলে তার কখনো পরাজয় হয় না। অরণ্যে, প্রান্তরে, গৃহ, জলে, স্থলে, বাঘ, কুমীর ভূতাদির দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ যদি দেবী নাম পাঠ করে তবে সবকিছু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। প্রজ্ঞা ও শ্ৰী এই দুটি দেবীর মূল মূর্তি, এই মূর্তি দুটি থেকেই সহস্র সহস্র মূর্তির আবির্ভাব হয়ে জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রহ্মার মন থেকে রুচি নামে এক পুত্র জন্মে ও প্রাণ থেকে দক্ষ, দুচোখ থেকে মরীচি, হৃদয় থেকে ভৃগু, মাথা থেকে অঙ্গিরা, কাল থেকে অত্রি, উদান থেকে পুলস্ত্য, ধ্যান থেকে পুলহ, সমান থেকে বশিষ্ঠ, অপান থেকে ক্রতু ও অভিমান থেকে নীললোহিত রুদ্রকে উৎপাদন করে। এদের ভৃগু প্রভৃতি নয়জন পুরাতন গৃহস্থ। এরাই প্রথম ধর্মকে প্রবর্তন করেন। রুদ্রের সাথে এই বারোজন মানুষের কল্যাণের জন্য সবসময় ব্যস্ত। ঋভু ও সনৎ কুমার এই দুই মহাত্মা ও আত্মতেজ ও সংযমের দ্বারা বৈরাজ লোকে গিয়েছিলেন। তারা যেমন জন্মেছেন, তেমনই আছেন বলে তাদেরকে কুমার ও সনকুমার বলা যায়। এই বারোজন ব্রহ্মতনয়ের বংশবৃদ্ধি পেয়ে দেব গুণান্বিত প্রজা বৃদ্ধি পেল। ব্রহ্মার সৃষ্টিকার্য থেকে প্রাকৃত বিকারগুলো চাঁদ, সূর্য, আলো, অন্ধকার, গ্রহ, নক্ষত্র, নদী, সমুদ্র, পাহাড় নানা আকারের পুর ওজন পদাদির সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মা সেই ব্রহ্মবর্ণের মধ্যে রাত্রি যাপন করে থাকেন। সেই ব্রহ্মবৃক্ষ অব্যক্ত বীজের থেকে উৎপন্ন। বুদ্ধি এর কাঁধ, ইন্দ্রিয়েরা এর কোটর, মহাভূত এর শাখাপ্রশাখা, বিশেষ তত্ত্বগুলো এর পাতা, ধর্ম ও অধর্ম এর ফুল আর সুখ-দুঃখ এর ফল। এই সনাতন ব্রহ্মই সর্বভূতের উপজীব্য। ব্রহ্মবৃক্ষ পূর্ণ ব্রহ্ম বনের কারণ অব্যক্ত। সেই ব্রহ্মবক্ষে একই রকম দেখতে, একই স্বভাবের দুটি পাখি থাকে। তাদের একজন বৃক্ষতত্ত্ব জানে, অন্যজন কোন তত্ত্ব জানে না। ব্রাহ্মণের ঊর্ধ্বলোককে যার মাথা, নভোমণ্ডলকে নাভি, চাঁদ সূর্যকে চোখ ও দিক সকলকে দু-কান, ভূমিকে দু-পা বলে বর্ণনা করেন, সেই অচিন্তাত্মা ভগবানের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বক্ষঃস্থল থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য ও দু-পা থেকে শূদ্রের জন্ম। তাঁর পাত্র থেকে সমস্ত রঙের সৃষ্টি। অব্যক্ত থেকে অণ্ডের উৎপত্তি। অণ্ড থেকে ব্রহ্মার জন্ম। ব্রহ্মাই এই চরাচর ত্রিলোকের স্রষ্টা।
.
দশম অধ্যায়
সূত বললেন–লোককর্তা ব্রহ্মা এই প্রকার সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করলেও সেই প্রজারা বিধি নির্দিষ্ট পথে থাকলেন না। ব্রহ্মা তাই তমোগুণে আচ্ছন্ন হয়ে দুঃখিত মনে চিন্তা করতে করতে নিজের মধ্যে তামসী শক্তি সৃষ্টি করলেন। পরে সেই তমোভাব পরিহার করে রজোগুণ অবলম্বন করে তমোগুণকে ঢেকে দিলেন। এই তমোগুণ থেকেই একটি মিথুন জন্মায়। ব্রহ্মার পা থেকে অধর্ম ও শোক থেকে হিংসা উৎপন্ন হল। ব্রহ্মা তখন খুশী হলেন। এরপর ব্রহ্মা সেই মলিন দেহ ত্যাগ করে, দেহের অর্ধেক অংশ দিয়ে পুরুষ ও অপর অর্ধাংশ দিয়ে নারীমূর্তি তৈরী করলেন। ইনি প্রকৃত ভূতধাত্রী শতরূপা। নিজের মহিমায় আকাশ বাতাস ব্যপ্ত করে আছেন।
সেই শতরূপা নিযুত বৎসর ধরে কঠিন তপস্যা করে মনুকে পতিরূপে বরণ করেন। মনু সেই অযোনিজা শতরূপাকে পত্নীরূপে পেয়ে তাতে রত হলেন। এজন্য শতরূপা হলেন রতি। এই প্রথম স্ত্রী-পুরুষ সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হল। মনু ও শতরূপার প্রিয়ব্রত, জ্ঞানপাদ নামে দুই পুত্র, ‘আকুতি’ প্রসূতি দুই কন্যা হয়। মনু প্রসূতিকে দক্ষের হাতে সম্প্রদান করলেন আর রুচিকে আকূতি নামের কন্যা দান করলেন। ব্রহ্মার মানসসন্তান রুচির গর্ভে যজ্ঞ দক্ষিণা একটি মিথুন উৎপন্ন হয়। দক্ষিণার গর্ভে যজ্ঞের থাম নামে বিখ্যাত বারোজন পুত্র হয়। যজ্ঞের আরেক নাম যম। যমের ছেলে যাম। এরা অজিত ও শূক এই দুই নামে বিভক্ত। এদিকে দক্ষ, প্রসূতির গর্ভে লোকমাতা চোদ্দটি কন্যার জন্ম দেন। এই মেয়েরা সবাই মহা ভাগ্যবতী, মনলোচনা, যোগমাতা। এঁরা হলেন-শ্রদ্ধা, লক্ষ্মী, ধৃতি, তুষ্টি, পুষ্টি, মেধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, বপু, শান্তি, সিদ্ধি ও কীর্তি। প্রভু ধর্ম এদের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। সতী, সস্তৃতি, স্মৃতি, প্রীতি, ক্ষমা, সন্নতি, অনসূয়া, ঊর্জা, স্বাহা ও স্বধা–এই দশজন কন্যাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন যথাক্রমে-রুদ্র, ভৃগু, মরীচি, অঙ্গিরা, পুলহ, ক্রতু, পুলস্ত্য, অত্রি, বশিষ্ঠ, পিতৃগণ ও অগ্নি। এই দক্ষ কন্যারা সবাই প্রলয়কাল পর্যন্ত সব মন্বন্তরে সদাচারগুলো পালন করে থাকেন। এঁদের সন্তানরা হলেন–শ্রদ্ধার পুত্র কাম, লক্ষ্মীর ছেলে দর্প, ধৃতির ছেলে নিয়ম, তুষ্টির পুত্র সন্তোষ, পুষ্টির ছেলে লাভ, মেধার পুত্র শ্রুত, ক্রিয়ার ছেলে জয়, দণ্ড ও সময়। বুদ্ধির পুত্র বোধ অপ্রসাদ, লজ্জার ছেলে বিনয়, বপুর পুত্র ব্যবসায়, শান্তির পুত্র ক্ষম, সিদ্ধির পুত্র সুখ ও কীর্তির ছেলে যশ–এরা ধর্মের সন্তান। রতির গর্ভে কামের হর্ষ নামে পুত্র জন্মায়। এখানে ধর্মের বংশ বিবরণ দেওয়া হল। হিংসার গর্ভে অধর্মের নিকৃতি নামে মেয়ে ও অনৃত নামে ছেলে হয়। এদের ভয় ও নরক নামে দুজন ছেলে আর মায়া ও বেদনা নামে দুই কন্যা হয়। ভয় ও মায়ার মিথুনে মৃত্যুর উৎপত্তি আর নরক ও বেদনার দুঃখ নামে পুত্র জন্মে। মৃত্যু থেকে ব্যাধির জরা, শোক, ক্রোধ, অসুয়া নামে সন্তান হয়।
এরা সবাই দুঃখময় ও অধর্ম লক্ষণযুক্ত। এদের স্ত্রীপুত্র কেউ নেই। এরা বিনাশহীন। ব্রহ্মা নীললোহিতকে প্রজা সৃষ্টি নির্দেশ দিলে, তিনি আত্মসম হাজার হাজার মানস সন্তানের জন্ম দিলেন। তারা সবাই রূপে, তেজে, জ্ঞান, বলে পিতৃতুল্য। সকলেই চামড়ার বসনধারী, পিঙ্গলবর্ণ, জটাবান, হরিত, কেশ, ক্রুরদৃষ্টি, ত্রিলোচন। তারা কেউ কেউ বহুরূপ, বিরূপ সুরূপ ও বিশ্বরূপ। কেউ কেউ শত বাহু, সহপ্রবাহ, স্কুলশীর্ষ ও আটটি দাঁতযুক্ত। কারওবা জিব নেই। কেউ অন্নভোজী, মাংসভোজী, ঘৃতপ্ৰায়ী, ভীষণ রাগী এবং নানান অস্ত্রধারী। কেউ কাজ করছে, কেউ বা বসে রয়েছে কেউ জপ, ধ্যান যোগ করছে। কেউ কেউ রাতে বিচরণ করেন, মহাযোগযুক্ত, স্থির যৌবন, মহাতেজস্বী।
এরা সবসময় শত সহস্র দলে কাঁদতে থাকেন বা ছোটাছুটি করতে থাকেন। ভগবান ব্রহ্মা এইরকম সমস্ত প্রজা দেখে নীললোহিতকে বললেন–তোমার মঙ্গল হোক, তুমি নিজের মতো এরকম প্রজা আর বেশি সৃষ্টি করো না। একথা শুনে নীললেহিত বললেন–আমি বিরত হলাম। এবার আপনি প্রজা সৃষ্টি করুন। আমি মরণশীল প্রজা সৃষ্টি করব না। আমি যে বিরূপ, আত্মতুল্য হাজার হাজার প্রজাসৃষ্টি করেছি। এরা পৃথিবীতে ও অন্তরীক্ষে রুদ্র নামে প্রসিদ্ধ হবেন এবং দেবতাদের মধ্যে গণ্য হয়ে সমস্ত দেবযুগে দেবতাদের সঙ্গে যজ্ঞভোজী হবেন। প্রতি মন্বন্তরে ছন্দ থেকে যেসব যজ্ঞীয় দেবতা জন্মাবেন তাদের সাথে এরা পূজিত হবেন এবং মহাপ্রলয় অবধি থাকবেন, মহাদেবের কথা শুনে ভীষণ হেসে ব্রহ্মা ভীমমূর্তি নীললোহিতকে বললেন–প্রভু আপনার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
হে মুনিগণ–সব কালে সব কাজেই বিধাতার ইঙ্গিতে থাকে। সেই থেকে তিনি প্রজা সৃজনে বিরত। ‘স্থিতোহস্মি’ অর্থাৎ আমি বিরত হলাম এই বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন এইজন্য তিনি স্থানু’ নামে প্রসিদ্ধ। জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য, তপস্যা, সত্য, ক্ষমা, ধৃতি, সুষ্ঠুত্ব ও অধিষ্ঠাতৃত্ব এই দশটি গুণ সেই শঙ্করদেবে সব সময় রয়েছে। তিনি ঋষি, দেব অমর-মহা তেজস্বী মহাদেব নামে খ্যাত। তার ঐশ্বর্য দিয়ে দেবতারা, বল দিয়ে মহাসুরেরা, জ্ঞান দিয়ে মুনিরা, যোগ দিয়ে সমস্ত ভূত পরাজিত হয়েছে। ঋষিরা বললেন–হে মহামুনি সূত! আমাদের কাছে মহেশ্বর যোগ, তপস্যা ধর্ম ও জ্ঞানসাধন বিষয়ে বলুন।
যার অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণেরা গতি লাভ করেন, সেই সব মহেশ্বর যোগধর্ম শুনতে ইচ্ছা করি। বায়ু তখন বললেন–রুদ্রদেব পাঁচ রকম ধর্ম প্রচার করেছেন। পুরাণ এদের মাহেশ্বর ধর্ম বলে। অক্লিষ্ট কর্মা রুদ্রেরা সেইসব ধর্ম প্রতিপালন করে। আদিত্য, বসু, সাধ্য অশ্বিনীকুমার দুজন, মরুত, ভৃগুবংশীয়রা আর সুরপুরবাসী ইন্দ্র, যম, পিতৃ, কাল প্রভৃতি অনেকে এই ধর্ম পালন করেন। এই ধর্মের উপাসকরা বাসনাহীন নির্মল হন।
এই ধার্মিকরা গুরুর প্রিয় সাধনের জন্য মঙ্গল অনুষ্ঠানে রত হয়ে মানুষের জন্ম ত্যাগ করে দেবতাদের মতো বিহার করেন। মহেশ্বরের পাঁচরকম ধর্মের বিধানগুলি হল–প্রাণায়ম, ধ্যান, প্রত্যাহার, ধারণা ও স্মরণ। শিবের দ্বারা এসবের লক্ষণ ও কারণ যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাহল–প্রাণের বিস্তার গতিকে প্রাণায়াম বলে। এটি মন্দ, মধ্যম, উত্তম এই তিন প্রকার আর প্রাণের নিরোধকেও প্রাণায়ম বলে। প্রাণায়মের প্রণাম দ্বাদশ মাত্রা, মন্দ প্রাণায়ম বারোমাত্রার। এতে বারোটি আঘাত, মধ্যম প্রাণায়ামে চোদ্দটি মাত্রা আছে, এতে দুটো আঘাত। উত্তম প্রাণায়াম ছত্রিশ মাত্রা। এর প্রমাণ ও লক্ষণ সংক্ষেপে বলছি–অরণ্যের কোনো দুরন্ত পশুকে ধরে বশে আনতে থাকলে সে যেমন ধীরে ধীরে মৃদুভাব অবলম্বন করে, প্রাণও তেমনি অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির পক্ষে দমন করা যায় না। কিন্তু যোগ প্রভাবে বশীভূত হয়। সেই হিংস্র পশু যেমন আস্তে আস্তে দুর্বল ও বশীভূত হয়ে অহিংস হয়ে যায়, প্রাণও তেমনি আয়ত্তে আসে ধীরে ধীরে। যোগানুষ্ঠানের সময় প্রাণবায়ু যখন বশে থাকে তখন স্বচ্ছন্দে তাকে যেখানে সেখানে আনা নেওয়া যায়। সিংহ ও হাতি বশে এলে তাদের দিয়ে মানুষ যেমন সাধারণ পশুর ভয় দূর করে। শরীরগত বায়ু তেমনি অবরুদ্ধ বা অনবরুদ্ধ এই দুই অবস্থায় সমস্ত পাপনাশ করে। যে বিপ্র প্রাণায়াম করে তার সব দোষ দূর হয়। যত তপস্যা, যজ্ঞ, নিয়ম, ব্রত আছে। সবার তুল্য প্রাণায়ম। একশ বছর ধরে, মাসে মাসে কুশাগ্র দিয়ে জলপান করলে যে ফল হয়, সেই ফলের সমান প্রাণায়াম। প্রাণায়াম দিয়ে দোষ, পাপ দূর করা যায়। তাই সকলকে যোগনিষ্ঠ প্রাণায়ম করতে হবে। প্রাণায়াম দিয়েই যোগীরা সমস্ত পাপমুক্ত হয়ে পরমব্রহ্ম লাভ করেন।