বাজনা – শৈলেন ঘোষ
মা আদর করে নাম রেখেছে বাজনা।
বাজনা একটি ছোট্ট ছেলে।
নাক চ্যাপটা ছেলেটার চোখ দুটো কেমন গোল গোল! দুষ্টুমি মাখা!
দাঁত ফোকলা ছেলেটার গাল দুটো কেমন ফুলকো! যেন আসকেপিঠে! উফ! কী দুষ্টু! ছেলে নয়তো দস্যি!
বাজনা। নাম শোন! হাসি পায় না? আহা! বুঝি আর নাম ছিল না ভূভারতে?
বাজনা মায়ের কাছে থাকত। উঃ, বাববা! ছেলের জন্যে মা তো জ্বালাতন-পোড়াতন! মায়ের হাড়-মাস একেবারে কালি! মাকত আদর করত, কত বোঝাত, কত গান শোনাত। বয়ে গেছে গান শুনতে। বাজনা কিছুতেই গান শুনবে না। মা গান গাইলেই বাজনা চেঁচিয়ে মেচিয়ে গল্প বলতে শুরু করে দেবে। শুনতে হবে। নইলে ছাড়ান আছে!
মাকে গল্প বলত বাজনা ল্যাজ-কাটা কুকুরটার। কান-ছেঁড়া ছাগলটার। আর নোলক-পরা হাঁসটার।
আর গল্প বলত,
কার বাড়িতে কুলগাছে কুল ধরেছে।
কাদের ঘরে জামগাছে জাম ফলেছে।
কার বাগানে আমগাছে আম পেকেছে।
গল্প বলতে বলতে রাত আসত। বাজনার চুল আসত। ঘুমিয়ে পড়ত।
মা চেয়ে চেয়ে দেখত বাজনার মুখের দিকে, ঘুমন্ত চোখের দিকে। দেখতে দেখতে চোখের পাতা দুটি ভিজে যায় মা-র। বাজনা সারাদিন দুষ্টুমি করবে। মা কত বকবে। আর এখন? মা সব ভুলে যায়। যতই হোক ছেলে তো! আদর করবে মা ছেলেকে। বলবে ‘সোনা আমার, চাঁদ আমার।’ তারপর মা-ও ঘুমিয়ে পড়বে।
রাত কাটবে।
সকাল। সকাল মানেই তো আলো।
আলোর সকাল প্রথমে আকাশে ছড়িয়ে যায়।
তারপর সকাল নামে আকাশ থেকে গাছের পাতায়।
সবুজ ঘাসে।
রঙিন ফুলে।
নদীর দোলায়।
আর?
বাজনার চোখে।
ঠিক তখুনি মা ডাকল, ‘বাজনা!’
ঘুম থেকে উঠে পড়ল বাজনা। সাড়া দিলে, ‘কেন মা?’
মা বললে, ‘বাজনা, নদীর থেকে এক ঘটি জল এনে দাও তো।’
বাজনা যেন হাতে চাঁদ পেল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলে, ‘যাই মা।’
মা বললে, ‘মাঠে মাঠে ছুটো না যেন!
‘না, না।’
‘গাছে গাছে উঠো না যেন!’
‘না, না।’
‘নদীর জলে নেমো না যেন!’
‘না, না।’
‘যাবে আর আসবে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ বলে বাজনা কোঁচড়ে মুড়ি নিলে। হাতে ঘটি নিলে। মায়ের জন্যে জল আনতে হাঁটা দিলে।
কেমন হাঁটছে দেখো! যেন কত লক্ষ্মী! ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না!
সবুজ ঘাসে রোদ ছড়ানো। মায়ের চোখের আড়াল হতেই ছুট দিলে বাজনা ঘাসের ওপর দিয়ে।
‘বাজনা।’ একটু যেতেই কে যেন হঠাৎ ডাকল!
ছুটতে ছুটতে শুনতে পেয়েছে বাজনা। থমকে দাঁড়াল। এদিক ওদিক চোখ ফেরাল। কাউকে তো দেখতে পেলে না। কী জানি, হয়তো ভুল শুনেছে। আবার ছুটল।
‘বাজনা।’ আবার ডেকেছে। এবার একটু জোরে। না, এবার ঠিক শুনতে পেয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়ল বাজনা। ‘কে রে?’ চেঁচিয়ে সাড়া দিলে।
চুপচাপ! এদিক ওদিক, কোনোদিকেই তো কেউ নেই। যাঃ বাবা! ভেলকি নাকি! একটু দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে যাবে বাজনা, আবার ডেকেছে, ‘বাজনা।’
‘হি-হি-হি!’ হেসে ফেলেছে বাজনা। এবার বুঝতে পেরেছে। ঠিক বুঝতে পেরেছে। ছোটটুন! বাজনার বন্ধু। লুকোচুরি খেলা করছে! কিন্তু লুকাল কোথায়?
‘ছোটটুন।’ বাজনাও হাঁক দিলে।
অমনি খিলখিল করে হেসে উঠেছে ছোটটুন। সামনের বটগাছটার একটা ডাল বেয়ে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। একেবারে বাজনার সামনে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘কেমন ঠকালুম!’
‘ওরে! তুমি গাছের ওপর!”
‘কোথা যাচ্ছ সাতসকালে?’ হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলে ছোটটুন।
বাজনা বলল, ‘নদীর ঘাটে, জল আনতে।’
‘জল আনতে যাবেন, এখন আমার সঙ্গে চল।’
‘কোথা?
‘এস না।’
‘না ভাই, দেরি হয়ে যাবে।’
‘দেরি হলে কী হয়েছে। নদীর জল তো আর ফুরুচ্ছে না।’ বলেই ছোটটুন আচমকা বাজনার হাত থেকে ঘটিটা ছিনিয়ে নিয়ে দে ছুট। ছুটতে ছুটতে হি-হি করে কী হাসি!
বাজনা থতমত খেয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছোটটুন, ঘটি দাও।’ বলে নিজেও ওর পিছু ছোটা দিলে।
বেশ কিছুটা ছুটে এসেই একটা পেয়ারা গাছ। গাছ ভরতি পেয়ারা। ডাঁসা-ডাঁসা, পাকা পাকা।
ছোটটুন বললে, ‘বাজনা, আমি গাছে উঠছি। তোমার ঘটি নীচে রাখছি।’ বলে তরতর করে গাছ উঠে গেল।
আর ঘটি! অত পেয়ারা দেখে কি আর লোভ সামলাতে পারে বাজনা? চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছোটটুন, আমিও উঠছি।’ উঠে পড়ল গাছে।
সবচেয়ে বড়ড়া পেয়ারাটা একেবারে আগডালে। ছিঁড়ে নিল বাজনা। কামড় দিল।
ছোটটুন বললে, ‘কী বাজনা, কেমন লাগছে?
‘খুব মিষ্টি।
‘তবে যে আসছিলে না!’
‘আমি কি আর পেয়ারার কথা জানতুম!
‘মায়ের জন্যে নেবে না বাজনা?’
‘নেবো।’
বাজনা আর দুটো বড়ো বড়ো পেয়ারা মায়ের জন্যে কোঁচড়ে নিল। আর দুটো নিজে খেলে।
ছোটটুন বললে, ‘বাজনা, বাজনা, সাধ মিটেছে?’
বাজনা বলল, ‘সাধ মিটেছে। এবার ঘাটে যাই।’
ছোটটুন বলল, ‘আমিও ঘর যাই।’ বলে ছোটটুন এডাল-ওডাল লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়ল। ঘর চলল।
বাজনা আগডাল, মাঝডাল ডিঙিয়ে মাড়িয়ে টপকিয়ে নামল। ঘটি নিয়ে ঘাটে ছুটল।
নদীর ঘাট।
এপার নদী। ওপার নদী। জল চিকচিক। ঢেউ ঝিকমিক। কত নৌকো। চলেছে দুলতে দুলতে। মাঝিরা দাঁড় টানছে। হাওয়াতে পাল তুলেছে। কোথা চলেছে কে জানে!
বাজনা হাঁকল, ‘ও মাঝি, মাঝিভাই, কোথা যাচ্ছ?
মাঝি হাঁকলে, ‘হাটে যাচ্ছি।’
‘আমায় নিয়ে যাবে?”
‘বড়ো হও, তারপর।‘
‘মা বলেছে আমি তো বড়ো হয়ে গেছি।’
মাঝি শুনতেই পেলে না। পালতোলা নৌকো হাওয়ার টানে সোঁ সোঁ করে চলে গেল।
‘প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক’, নদীর জলে হাঁস দুলছে। রাজহাঁস। ডাক দিচ্ছে। একটা, দুটো, তিনটে, চারটে, সাঁতার কাটছে।
‘রাজহাঁস, রাজহাঁস, কোথা চলেছ?’ জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
সবচেয়ে বড়ো রাজহাঁসটা উত্তর দিল, ‘যাচ্ছি না কোথাও, দোল খাচ্ছি। প্যাঁক-প্যাঁক!’
বাজনা বললে, ‘আমারও দোল খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘নেমে পড় না জলে। প্যাঁক-প্যাঁক।’
‘মা যে বারণ করেছে জলে নামতে।’
‘তবে পাড়ে বসে বসে ঘাস কাটো।’
‘কেন, তোমার পিঠে যদি বসি!’
ওমা! কথা শুনে কী জোর হেসে উঠল হাঁসগুলো! ‘প্যাঁক-প্যাঁক, ফ্যাঁক-ফ্যাঁক।’ আরে বাবা! হেসে হেসে জলের ভেতর ডিগবাজি খেতে লেগেছে!
বাজনা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘হাসছ কেন?’
‘তোমার কথা শুনে। আমার পিঠে চাপলে তোমার ভার সামলাবে কে? আমিও মরব, তুমিও ডুববে।’
‘আমি তো সাঁতার জানি। ডুবব কেন?’
‘বেশ তো। তা হলে আমার ঘাড়ে না চেপে নিজে নামলেই পার।’
‘না, এখন না। মা রাগ করবে।’
‘তবে ঘরে যাওগে। মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে দুধ খাওগে।’ বলে হাঁসগুলো প্যাঁক-প্যাঁক করে আবার হেসে উঠল। হাসতে হাসতে পেছন ফিরে চলে গেল।
বাজনা চেয়ে চেয়ে দেখলে সেদিকে একদৃষ্টে। তারপর ঘটিটা বাগিয়ে ধরে, ঘাটে পা বাড়ালে। জলে হাত নামালে। হেঁট হয়ে মুখে জল দিলে। হঠাৎ জলের ছায়ায় নিজের মুখটা ভেসে উঠেছে। ভয় পেয়ে গেল বাজনা। মা বলেছিল, যাবে আর আসবে। ইস! কত দেরি হয়ে গেল!
বাজনা তাড়াতাড়ি ঘটিটা জলে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলে। ঘটি ভরতি জল নিলে। ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরে যেই ছুটতে যাবে, হঠাৎ কে যেন ডাকলে তাকে মিহি সুরে, ‘বাজনা।’
বাজনা চমকে মুখ তুললে, চোখ ফেরালে। কাউকে দেখতে পেলে না।
আবার ডাকল, ‘বাজনা।’
বাজনার একবার ডানদিকে চোখ। একবার বাঁদিকে কান।
‘বাজনা।’ ফের ডাকল।
বাজনা পেছনে চাইল।
‘ওদিকে নয়, জলের ভেতর।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে বাজনা জলের দিকে চেয়েছে। চেয়েই দেখে একটা এত্তো বড়ো মাছ। পাখনা দোলাচ্ছে জলের তলায়।
বাজনার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। লোভে। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল। যাঃ! টাল সামলাতে পারলে না! হাত বাড়াতে পা ফসকাল! পা ফসকে জলের ভেতর চিৎপটাং! ঝপাং!
বাজনা পড়ল জলের ভেতর। ঘটিও পড়ল। কাপড় ভিজল। মাথাও ডুবল।
কোথা ছিল রাজহাঁসগুলো? বাজনাকে চিৎপটাং দেখে প্যাঁক-প্যাঁক, ফ্যাঁক-ফাঁক করে হেসে গড়িয়ে গেল। মাছটা নেচেকুঁদে আহ্লাদে আটখানা। লজ্জায় মরে যায় বাজনা!
হঠাৎ বাজনার খেয়াল হল, ঘটি গেল কোথায়! ভয়ে চমকে ওঠে! যাঃ! হাত থেকে ফসকে গেছে!
খিলখিল করে হেসে উঠল মাছটা বাজনার ভয়-মাখানো মুখটা দেখে!
‘হাসছ কেন?’ একটু রেগেই জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
মাছ হাসতে হাসতেই বললে, ‘আহা! রাগ করলে কী হবে! ঘটি জলের তলায় তলিয়ে গেছে। আর পেতে হচ্ছে না।’ বলে মাছটাও সাঁতার দিয়ে জলের নীচে হারিয়ে গেল।
এখন কী হবে! বাজনার ভয়ে মুখ এইটুকু।
‘যেমনকে তেমন। লোভ করলেই দুর্ভোগ।’ বলে মাছটা জলের নীচ থেকে উঁকি মেরে বাজনাকে মুখ ভেঙালে!
হাঁসগুলো হাসতে হাসতে মাঝদরিয়ায় ছুট দিল।
বাজনা জলে জলে খুঁজল। এদিক ওদিক ডুবল। নদী তোলপাড়! ছাই, পেলে তবে তো! ঘটি কি আর আছে! নদীর জলে ভেসে গেছে। হারিয়ে গেছে। তাই তো! কী হবে তা হলে?
খুঁজতে খুঁজতে বেলা বাড়ল। মা ভাবল। বাজনা ঘরে ছুটল।
বাজনাকে দেখে মা বললে, ‘বাজনা, দেরি কেন?
‘মাগো, মা, ছোটটুনটা ডাকল তাই।’
‘ছোটটুন ডাকল, তাই বুঝি মাঠে মাঠে ছুটলে? গাছে গাছে উঠলে? কতদিন না বারণ করেছি!’ মায়ের চোখে রাগ! ‘বাজনা, আমার ঘটি কই?’।
‘মাগো, মা, তোমার জন্যে পেয়ারা এনেছি।’
‘পেয়ারা আমার কী হবে? আমার ঘটি কই?জল কই?’
কোঁচড় থেকে একটা পেয়ারা বার করে বাজনা বলল, ‘দেখো মা, এটা কেমন পাকা!’
মা বলল, ‘থাক পেয়ারা, তুমি জলে ভিজলে কেন?’
‘মাগো, মা, হাঁসটা জলে নাচল কেন?”
‘হাঁস নাচলে তোমার কী?
‘মাগো, মা, মাছটা জলে হাসল কেন?”
‘মাছ হেসেছে তো কী হয়েছে?’
‘আমি যেই ধরতে গেছি, মাছ পালাল। হাত ফসকে ঘটি হারাল।’
মা বকলে, ‘বাজনা তুমি দুষ্টু! ছিঃ ছিঃ, কথা শোন না।’ বলে মা রাগ করে ঘরে ঢুকে গেল।
বাজনা ছুট্টে মায়ের কাছে গেল। বলল, ‘মাগো, রাগ করো না। কাল থেকে ঠিক আমি লক্ষ্মী হব। তুমি যা বলবে, তাই শুনব। ছোটটুন যদি বলে মাঠে মাঠে ছুটতে ছুটব না। হাঁস যদি বলে জলে জলে খেলতে, খেলব না। মাছ যদি ডাকে জলে জলে ডুবতে, ডুবব না। আমি কারো কথা শুনব না। শুধু তোমার কথা শুনব।’ বলে বাজনা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। আদর করে নরম সুরে ডাকলে, ‘মাগো!’
মা মুচকি মুচকি হাসল।
আজ হাটবার।
মা বললে, ‘বাজনা, আমি হাটে যাচ্ছি।’
‘কখন আসবে?’
‘সন্ধেবেলা। তুমি লক্ষ্মী হয়ে ঘরে থাকবে।’
‘মাগো, একটু একটু মেঘ করেছে। বিষ্টি নামবে। তুমি টোকাটা সঙ্গে নাও।’ বলে বাজনা মায়ের হাতে টোকাটা তুলে দিল।
মা হাটে গেল।
একটু পরে মেঘে-মেঘে ছেয়ে গেল।
একটু পরে কড়-কড়-কড় বাজ পড়ল।
গুড়-গুড়-গুড় মেঘ ডাকল।
বাজনা ‘দুগগা-দুগগা’ ডাকতে ডাকতে মায়ের কথা ভাবতে লাগল।
তারপর টুপ-টুপ-টুপ বিষ্টি নেমেছে।
বাজনা ভাবলে, ‘আহারে! মা এখন মাঠে, না হাটে!
এতক্ষণ ঘরের জানলা বন্ধ ছিল। বাজনা জানলাটা খুলে দিলে।
টুপ-টুপ-টুপ বিষ্টি তখন ঝমঝমঝম নাচছে।
সবুজ ঘাসে নাচছে।
শিউলি ফুলে নাচছে।
পদ্মপাতায় নাচছে।
আর নাচছে বাজনার মনে।
বাজনা জানলা দিয়ে হাত বাড়াল। হাতের ওপর বৃষ্টি পড়ে টুপটাপ!
বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘ও বিষ্টি, বিষ্টি-ফোঁটা, তোমরা কোত্থেকে আসছ?’
একটা বড়ো ফোঁটা একেবারে বাজনার হাতের ওপর টুপ করে নেমে এল। হাতের ওপর। দুলতে লাগল। দুলতে দুলতে বললে, ‘আমাদের বাড়ি মেঘের দেশে। আমরা আসছি সে দেশ থাকে।’
‘সে তো জানি। না, জিজ্ঞেস করছি আমার মাকে দেখেছ?’
‘কেমন দেখতে?’
‘বারে! আমার মা আমার মায়ের মতন। কালো চুল মেঘলা। গায়ে শাড়ি কমলা। পান সুপারি ঠোঁট রাঙানো। মায়ের হাসি মনজুড়ানো।’
বিষ্টি-ফোঁটা বললে, ‘দেখেছি।’
‘দেখেছ! দেখেছ!’ খুশিতে উপচে গেল বাজনার মুখখানা। ‘কোথা দেখেছ?মাঠে? না, হাটে?’
‘তোমার মা মাঠেও না, হাটেও না।’
‘তবে?’
‘শিব মন্দিরে।’
‘কেন?’
শিবঠাকুরকে তোমার মা পুজো দিয়ে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘শিবঠাকুর, শিবঠাকুর, আমার ছেলে ভারি দুষ্টু। তাকে লক্ষ্মী করে দাও।’
বিষ্টি-ফোঁটার কথা শুনে মায়ের মুখখানি বাজনার চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠল। ছলছল করে উঠল দুটি চোখ বাজনার। কাঁদো-কাঁদো সুরে বললে, ‘সত্যি বলছি বিষ্টি-ফোঁটা, আজ থেকে আমি একদম দুষ্টুমি করিনি।’
বিষ্টি-ফোঁটা জিজ্ঞেস করলে, ‘তোমার নাম কী?
‘আমার নাম বাজনা।’
‘বাজনা!’ লক্ষ ফোঁটা একসঙ্গে হেসে উঠল, ‘হা-হা-হা, হো-হো-হো, হি-হি-হি।
বাজনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘হাসছ কেন?’
বিষ্টি-ফোঁটারা ঝমঝমিয়ে নাচতে নাচতে ছড়িয়ে গেল। হাসতে হাসতে গড়িয়ে গেল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ছি-ছি-ছি, বিচ্ছিরি-ই-ই, বিচ্ছিরি-ই-ই।’
বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘কী বিচ্ছিরি?’
“বিচ্ছিরি নামটা।’
‘কেন?’
‘বাজনা আবার কেমন নাম? বাজনা আবার নাম হয়!’
‘কেন?’
অমনি বিষ্টি-ফোঁটারা চেঁচালে, ‘বাজনা তো বাজে।
‘কেমন?
‘যেমন পায়ে নূপুর বাজে,
ঘন্টা বাজে,
সানাই বাজে,
বাঁশি বাজে,
বীণা বাজে,
ভেঁপু বাজে,
ঢোলক বাজে।
নামটা তোমার বাজে।’ বলতে বলতে, হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে লাগল বিষ্টি ফোঁটারা।
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল বাজনার। কাঁপতে লাগল রাগে। রেগেমেগে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল বিষ্টি-ফোঁটাদের। ফসকে গেল। ফোঁটারা আরও জোরে চেঁচাতে লাগল, ‘বাজে, বাজে, বাজে।’
বাজনার মনে হল, যেন বিষ্টি-ফোঁটাগুলো হাততালি দিয়ে তাকে ভেংচি কাটছে। শুনতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল বাজনা চিৎকার করে, ‘না, না।’ নিজের কান দুটো দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল। না, কিছুতেই শুনবে না সে।
না শুনলে কী! বিষ্টি-ফোঁটারা চেঁচাবেই, রাগাবেই।
দুম করে জানালাটা বন্ধ করে দিল বাজনা।
তাতে কী! তাতে কি আর ওরা থামে! যতক্ষণ কালো মেঘ থাকবে আকাশে, ততক্ষণ বিষ্টি ফোঁটারাও নাচবে মাটিতে!
দু-কানে আঙুল দিয়ে চুপটি করে বসে রইল বাজনা ঘরের কোণে।
অনেকক্ষণ পর বিষ্টি থামল। কালো মেঘ সাদা হল। সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যিঠাকুর উঁকি মারল।
না, আর বিষ্টি নেই, চেঁচামেচি নেই। নাচানাচিও নেই। মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। বিষ্টি ফোঁটারা কেন এমন কথা বললে! সত্যিই কি তার নামটা বিচ্ছিরি! বসে বসে ভাবল বাজনা। একটুখানি। না, বসতে তার ভালো লাগছে না। দাঁড়াল বাজনা। দাঁড়াতেও ভালো লাগছে না। দোর ঠেলে ছুটল বাইরে।
বাইরে আকাশ। রামধনু উঠেছে। চোখ জুড়িয়ে গেল। থমকে দাঁড়াল বাজনা। একদৃষ্টে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। ভাবল, বিষ্টি-ফোঁটারা দুষ্টু ভারি! রামধনু কত মিষ্টি! আহা রে! আমার নাম বাজনা না হয়ে যদি রামধনু হত!
বাজনা আকাশের দিকে ছোট্ট দুটি হাত বাড়াল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘রামধনু, রামধনু, বল না আমার নামটা বিচ্ছিরি?’
‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’ বলে এমন একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল গাছের ফাঁক দিয়ে!
বাজনা শিউরে উঠল। ছুটল সামনে। পুকুর পাড়ে। ডাক দিল, ‘সোনা-ব্যাং, সোনা-ব্যোং আচ্ছা, আমার নামটা বিচ্ছিরি?’
সোনা ছানাপোনা নিয়ে বিষ্টির জলে রা কাড়ছিল। গাবদা-গাবুস গলা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’
বাজনা আবার ছুটল। ছুটল নদীর ধারে। হাঁকল, ‘রাজহাঁস, রাজহাঁস, আমার নামটা বিচ্ছিরি?’
রাজহাঁস সাঁতার কাটছিল নদীর জলে, ‘প্যাঁক-প্যাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’
অমনি মাছগুলোও হেসে উঠল খিলখিল করে। ডেকে উঠল, ‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’
বাজনা ছুট দিলে। না, আর কাউকে সে জিজ্ঞেস করবে না। জিজ্ঞেস করতে হলও না। মনে হল সবাই যেন তার পিছু পিছু ছুটছে। সবাই যেন একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে, ‘বিচ্ছিরি, বিচ্ছিরি!’
কান ঝালাপালা হয়ে গেল বাজনার। থাকতে পারল না। চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘থামো, থামো তোমরা।’
থামল না কেউ।
ছুটতে ছুটতে ঘরে পৌঁছে গেল বাজনা। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে। ঘুমিয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ পর মায়ের মিষ্টি মিষ্টি হাত দুটি যখন বাজনার কপাল ছুঁয়ে গেল, তখন ঘুম ভাঙল। চোখ চাইল বাজনা।
মা হাসছে।
বাজনা হাসল না। উঠে বসল।
মা জিজ্ঞেস করলে, ‘কী হয়েছে, বাজনা?’ চিবুকে হাত দিলে।
বাজনা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
মা আদর করলে। বলল, ‘এই দেখো, তোমার জন্যে হাটের থেকে কী এনেছি!’
মা এনেছে কাঠের ঘোড়া।
বাজনা দেখল না। বললে, ‘চাই না। আমি তো দুষ্টু!’
‘কে বললে তুমি দুষ্টু? তুমি আমার লক্ষ্মী সোনা।‘
‘লক্ষ্মী না আর কিছু! দুষ্টু বলেই তো আমার নামটা অমন বিচ্ছিরি রেখেছ! বাজনা! নাম না ছাই। আমার ও নাম চাই না, চাই না।’ বলে বাজনা মুখ ফিরিয়ে বসে রইল।
‘বাজনা!’ মা আবার ডাকল। ছেলেকে আদর করে জড়িয়ে ধরলে। বাজনা মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপেয়ে কেঁদে ফেলল।
পরের দিন মা বললে, ‘বাজনা, আমি কাঠ কুড়ুতে মাঠে যাচ্ছি। তুমি লক্ষ্মী হয়ে ঘরে থেকো।’
মা চলে গেল।
বাজনার মুখে হাসি নেই কাল থেকে। মন ভার-ভার। জানলার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল চুপটি করে। দেখছিল আকাশের দিকে। মেঘ আছে নাকি! যদি বিষ্টি নামে! বিষ্টি
ফোঁটারা আবার যদি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বিচ্ছিরি, বিচ্ছিরি’ বলে!
না, মেঘ নেই। খুশিতে, আলোতে আকাশ আজ উপচে গেছে।
তবু ভালো লাগছে না বাজনার। বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অন্যদিন ও কি এতক্ষণ ঘরে থাকত? মা বারণ করলে কী হয়েছে! কে শুনছে মায়ের কথা? বাজনা? তবেই হয়েছে! কখন ও ঘর থেকে পালিয়ে মাঠে মাঠে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিত!
‘বাজনা!’ কে যেন ডাকল তাকে হঠাৎ। একেবারে অচেনা গলা।
চমকে উঠল বাজনা। ফিরে তাকাল। ঘরের মধ্যে কাউকে দেখতে পেলে না তো!
‘বাজনা!’ আবার ডেকেছে।
কে ডাকছে? কার গলা? এমন অচেনা?
‘এই তো, আমি।’
বাজনা অবাক চোখে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কেউ তো নেই!
‘আমার দিকে চাও, আমি টাট্টু ডাকছি।’
দৌড়ে গেল বাজনা খেলনা ঘোড়াটার কাছে। কাঠের ঘোড়া। কাল মা কিনে এনেছে।
‘মন খারাপ তোমার?’ টাট্টু জিজ্ঞেস করলে।
বাজনা বেবাক হয়ে চেয়ে রইল টাট্টুর চোখের দিকে। মুখের দিকে।
টাট্টু এবার ঘাড় নাড়ল। ‘আমি জানি, কেন তোমার মন ভার।’
‘কেন?’ ধরা-ধরা গলায় খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
‘বিষ্টি-ফোঁটারা বলে গেছে তোমার নামটা বিচ্ছিরি, তাই।‘
চোখের পাতা দুটি কেঁপে উঠল বাজনার।
‘আবাক লাগছে?’
তবু অবাক হয়েই চেয়ে রইল বাজনা।
‘মা তোমাকে দুষ্টু বলেন, না?’
সঙ্গে সঙ্গে অভিমানে ভার হয়ে গেল বাজনার মুখখানি। উত্তর দিলে, ‘বলেই তো। আমি তো দুষ্টু।’
‘আসলে কিন্তু তুমি একটুও দুষ্টু নও।’ বলে হাসল ঘোড়াটা।
‘তবে?’
‘যত নষ্টের গোড়া তোমার নামটা।’
থমকে চায় বাজনা। জিজ্ঞেস করে, ‘মানে?’
‘মানে তোমার নামটা বিচ্ছিরি।’
চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল বাজনা, ‘না-আ-আ।’ রাগে চেপে ধরল ঘোড়াটাকে দু-হাত দিয়ে। ঘোড়াও তার নাম নিয়ে ঠাট্টা করছে! ছুঁড়ে ফেলে দিতে গেল।
ঘোড়াও চেঁচাল, ‘না, না, ফেল না। শোন, শোন, আমার কথা শোন।’
‘কী কথা?’ রাগে কাঁপতে কাঁপতেই জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
‘বলছি। তুমি এত রাগ করলে বলব কেমন করে?’
‘না, আমার নাম নিয়ে সবাই ঠাট্টা করবে, আমি কিছুতেই শুনব না।’
‘ঠাট্টা আমি করিনি সত্যি বলছি।’ উত্তর দিলে ঘোড়া।
‘বেশ, তবে কী বলতে চাও, বল তাড়াতাড়ি।’
‘আমি বলছি কী জান, বলছি তোমার দরকার একটা সুন্দর নামের। সুন্দর নাম। লক্ষ্মী নাম।’
‘তার মানে?’
‘মানে একটা সুন্দর নামে সবাই ডাকছে তোমায়, সবাই আদর করছে, দেখবে তোমার মন কত খুশি। একদম দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করছে না। মা যা বলছেন, তুমি শুনছ। রাগ করছ না। আসলে তুমি তো দুষ্টু নও। নামটাই তো তোমাকে দুষ্টুমি করাচ্ছে। কিছুতেই লক্ষ্মী হতে দিচ্ছে না। মা-র কথা শুনতে যে ইচ্ছে করে না তোমার, তা তো নয়। আসলে নামটা এমন বদ, কিছুতেই শুনতে দিচ্ছে না। এক্ষুনি ভুলে যাও নামটা, নতুন নামে সবাই ডাকুক, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। সুন্দর নাম মানেই লক্ষ্মী ছেলে!’
কীরকম নতুন নতুন লাগল কথাগুলো বাজনার কানে। তাই তো, এমন কথা তো কেউ তাকে আগে বলেনি! অমন রাগে থমথমে মুখখানা বাজনার ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়ে গেল। ঘোড়াকে ছেড়ে দিল বাজনা। হঠাৎ মাথার মধ্যে ভাবনা ঢুকে গেল। ভাবলে, ‘ঘোড়া ঠিকই বলেছে। হ্যাঁ, নামটাই সব। নইলে ইচ্ছে থাকলেও মায়ের কথা না শুনে, অন্যের কথা কেন শুনি! মন বলছে লক্ষ্মী হই, কিন্তু তবু দুষ্টুমি করে ফেলি! সেই ভালো, নামটাই পালটে ফেলব।’
কিন্তু সুন্দর নাম, নতুন নাম পাবে কোথায় বাজনা বাজনা ভাবল ঘোড়া তো একটা নতুন নাম দিতে পারে! তাই বলে, ‘ও টাট্টু, ও টাট্টু, সেই ভালো, নাম আমি পালটাব। তুমি আমায় একটা সুন্দর নাম দাও! নতুন নামে ডাক!’
ঘোড়া তো হেসেই আকুল।
বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘হাসির কথা কী হল আবার?
ঘোড়া বললে, ‘হাসির কথাই তো। আমি কেমন করে নাম দেব তোমায়? আমি দিলে তো হবে না। আগে অসুখটাকে তো সারাতে হবে!’
অবাক হল বাজনা। জিজ্ঞেস করলে, ‘অসুখ? কীসের অসুখ?’
‘বারে! নামের অসুখ। তোমার দেহের মধ্যে একটা নামের অসুখ ঢুকে গেছে। সেই অসুখটাকে শরীর থেকে দূর না করতে পারলে তুমি তোমার বাজনা নামটা ভুলবে কেমন করে? নামের অসুখটা শরীর থেকে দূর করে, বাজনা নামটা একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। তবেই নতুন নাম। নইলে নতুন যে-নামেই ডাকা হোক, বারবার বাজনা নামটাই মনে পড়ে যাবে!’
ঘোড়ার কথা শুনে বাজনার মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, ‘তাই বুঝি! তা হলে তো মুশকিল!’
‘ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি যদি আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাও তো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অবাক হয়ে ঘোড়াকে জিজ্ঞেস করলে বাজনা, ‘তোমার সঙ্গে? কোথায়?
‘বদ্যির কাছে।’
‘বদ্যি!’
‘হুঁ, হুঁ, এমন বদ্যিকে আমি চিনি যে তোমার নামের অসুখ এক মিনিটে সারিয়ে দিতে পারে।’
খুশি হয়ে উঠল বাজনার চোখ দুটি। জিজ্ঞেস করলে, ‘বদ্যি কতদূরে থাকে?’
ঘোড়া বললে, ‘তা একটু দূরে।’
‘কতক্ষণ লাগবে?’
‘যতক্ষণ যেতে।’
‘মা আসতে আসতে যদি না ফিরতে পারি, মা যে রাগ করবে!
‘তা তো করবেনই।’
‘মা বকবে যে তা হলে।’
‘হ্যাঁ, তাও বকবেন। কিন্তু তোমার বিচ্ছিরি নামটা তো তাতে দূর হবে না।’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’ একটু ভাবল বাজনা। তারপর বললে, ‘সেই ভালো। তাই চল সেই বদ্যির কাছে।’
বাজনা জামা গায়ে দিল। কাপড় পরলে। টাট্টুকে হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
বাজনা ঘরের বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলে, ‘টাট্টু, টাট্টু, কোন রাস্তায় যাবে?’
টাট্টু বললে, ‘এই রাস্তায় সিধে চল।’
বাজনা হাঁটা দিলে।
টাট্টু বললে, ‘পা চালিয়ে হাঁটো। কেউ না দেখে ফেলে।’
‘দেখে ফেললে?’ হাঁটতে হাঁটতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
‘কাউকে কিছু বলবে না।’
বলতে-বলতেই সেই গাবদাগাবুস ব্যাংটা দেখে ফেলেছে। এই রে!
ব্যাং ডাকলে ঘ্যাং-ঘ্যাং, ‘ও বাজনা, বাজনা, কোথা যাচ্ছ?’
বাজনা চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
ব্যাং বললে, ‘ও বাজনা, চুপ কেন? হাতে তোমার কী ওটা?
বাজনা চট করে ঘোড়ার মুখের দিকে চাইল আড়চোখে। ঘোড়া চোখ টিপলে। বাজনা বললে, ‘আমার হাতে কাঠের ঘোড়া। খেলতে যাচ্ছি।’
ব্যাং জিজ্ঞেস করলে, ‘আমি তোমার সঙ্গে যাব। খেলতে নেবে?’
‘না। তুমি না বলেছ আমার নাম বিচ্ছিরি!’
হেসে উঠল ব্যাং ঘ্যাং-ঘ্যাং করে। হাসতে হাসতে থুপ থুপ করে নাচতে লাগল, ‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’
রাগে মুখখানা লাল হয়ে গেল বাজনার। ঝট করে একটা ইট তুলে নিল। ছুঁড়ে দিল।
থপ করে সরে গেল ব্যাংটা। লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যাং ডাকলে, ‘বিচ্ছিরি! বিচ্ছিরি!’ ডাকতে ডাকতে বাজনার পিছু তাড়া লাগিয়ে দিলে। বাজনা তিরের মতো ছুটতে লাগল।
যখন আর ব্যাঙের ডাক শোনা গেল না, তখন বাজনা পেছন ফিরে দেখল। দেখল ব্যাংও নেই, কেউ-ই নেই। তারপর সামনে তাকালে। চমকে উঠল।
টাট্টু জিজ্ঞেস করলে, ‘চমকাও কেন?
‘সামনে নদী।’ চেঁচিয়ে উঠল বাজনা। ‘সরু নদী তিতির।’
‘নদীর ওপর?’ জিজ্ঞেস করল টাট্টু।
‘বাঁশের সাঁকো।’
‘চল যাই নদীর ওপার। পারবে না সাঁকোর ওপর দিয়ে যেতে?’ টাট্টু জিজ্ঞেস করলে।
বাজনা বলল, ‘হ্যাঁ পারব।’ বলে সাঁকো হেঁটে নদী পার হল।
নদী পেরিয়েই বাজনা থ। দেখতে লাগল অবাক হয়ে। অচেনা-অচেনা রাস্তাটা! অজানা আজানা জায়গাটা।
বাজনা বললে, ‘ও টাট্টু, ও টাট্টু গাছ আছে পাখি নেই, দেখেছ?
‘তাই বুঝি!’
‘ফুল আছে রং নেই দেখছ?’
‘নেই বুঝি!’
‘মাঠ আছে ঘাট নেই দেখেছ?’
‘এই বুঝি!’
বাজনা বললে, ‘কী বুঝি?’
টাট্টু বললে, ‘এই বুঝি বদ্যির দেশ।’
‘এইটা বদ্যির দেশ?’ খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করল বাজনার। জিজ্ঞেস করলে, ‘কোনদিকে বদ্যির বাড়ি?’
টাট্টু বললে, ‘এইবারেই মুশকিল।’
‘কেন? মুশকিল কেন?’ জিজ্ঞেস করলে বাজনা।
‘আমি তো বাড়িটা ঠিক চিনি না। চল এগিয়ে যাই।’
বাজনা বললে, ‘তাই চল। যখন এসে পড়েছি, তখন ঠিক খুঁজে বার করব।’
একটু যেতেই বাজনা একটা বুড়িকে দেখতে পেল। বুড়িটা ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। সামনে উঠোন। উঠোন ভরতি ধান ছড়ানো। রোদ পড়েছে। ধান শুকুচ্ছে। বুড়ির হাতে ঠেঙা। ঠেঙা ঠুকছে। পাখি তাড়াচ্ছে।
বাজনা টাট্টুকে বললে, ‘টাট্টু, টাট্টু, বুড়িকে বদ্যির কথা জিজ্ঞেস করব!’
টাট্টু বললে, ‘কর।’
বাজনা বুড়ির কাছে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে, ‘ও বুড়ি, ও বুড়ি, বদ্যির বাড়ি কোনদিকে গো জান? খুঁজে পাচ্ছি না।’
বুড়ি আড়চোখে চাইল বাজনার দিকে। বাজনা বুঝলে না বুড়ির চাউনি বাঁকা-বাঁকা! বুড়ি বাঁকা চোখে বললে, ‘জানি বইকি!’
বাজনার মুখখানা খুশিতে হেসে উঠল, ‘জান? কোনদিকে?’
‘দিক-টিক কেউ জানে না।’ বুড়ি ড্যাবড়া-ড্যাবড়া চোখ দুটো এত্তো বড়ো বড়ো করে বললে, ‘সে ভয়ানক রাস্তা। শুধু ঘোর-প্যাঁচ। প্যাঁচ আর প্যাঁচ। সিধে রাস্তা যাবে, পাবে না। বেঁকা রাস্তায় হাঁটো, পাবে না। ঘুর রাস্তায় ছোট, সিধে রাস্তায় পড়বে। সিধে রাস্তায় পড়লেই, ঘুর রাস্তায় ছুটবে। মানে এই আছে, এই নাই। হাত বাড়ালে পাই না।’
বাজনার মাথা গুলিয়ে গেল। ভ্যাবলার মতো বললে, ‘এমন রাস্তা তো কখনো দেখিনি।’
বুড়ি বললে, ‘দেখার তো সবে শুরু হয়েছে। বয়েস হোক, তখন দেখতে দেখতে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।’ বলে বুড়ি মুচকি মুচকি হাসলে।
‘তো তুমি আমায় একটু পথটা দেখিয়ে দাও না।’
‘ওরে ছেলে! পথ দেখাব মাগনা-মাগনা!’
‘তবে?’
‘এ দুনিয়ায় মাগনায় কে কাজ করে র্যা? কী দরকার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে!’
বাজনা বললে, ‘বুড়ি, বুড়ি, আমার কাছে তো একটি কানাকড়িও নেই যে তোমায় দেব।’
‘কড়ি নেই তো কী হয়েছে! কাজ করার গতর তো আছে!’
‘তা আছে।’
‘তবে আমার কাজ করে দে।’
বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘কী কাজ?’
বুড়ি বললে, ‘ঘুঘু খেদানো।’
বাজনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘সেটা আবার কী কাজ?’
‘এই যে আমি বসে বসে যা করছি। ঘুঘু এসে ধান খাচ্ছে, তাড়াচ্ছি।’ বলে বুড়ি ঠেঙাটা তুলে ঠুকলে দুবার। দুটো পাখি উড়ে গেল।
বাজনা হাঁপ ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও-ও! এই কাজ! এ তো সহজ কাজ! এ আমি খুব করতে পারি। আমি বলে একাজ কত করেছি।’
‘পার তো বসে পড়। আমি একটু জিরিয়ে নিই। বসে বসে কোমর কনকন করছে।’
বাজনা বললে, ‘এক্ষুনি বসি কেমন করে? আগে তুমি বদ্যির বাড়িটা দেখিয়ে দাও। আগে বদ্যির সঙ্গে দেখা করে আসি, তারপর তোমার কাজ করে দেবো।’
‘ওরে ছেলে!’ বলে বুড়িটা কেমন সন্দেহে চোখ বেঁকাল। ‘উঁহু! সেটি হচ্ছে না বাছা! ওই বলে নিজের কাজ সেরে পালাবার ধান্ধা! আগে আমার কাজ, তারপর বদ্যির খোঁজ।’
বাজনা বুঝতে পেরেছে বুড়ি তার কথা শুনবে না। তাই বুড়িকে আড়াল করে লুকিয়ে লুকিয়ে টাট্টুর চোখের দিকে চাইল। টাট্টু ইশারা করলে। বাজনা বুঝল টাট্টু রাজি।
সঙ্গে সঙ্গে বাজনা বললে, ‘আচ্ছা বেশ, তাই করছি। তো কতক্ষণ করতে হবে?’
বুড়ি বললে, ‘সাঁঝের বাতি জ্বলবে, পাখি ঘরে চলবে, তারপর ছুটি।’
‘বাবা সে যে অনেকক্ষণ!’
বুড়ি ধমকে উঠল, ‘অনেকক্ষণই তো। আজকালকার ছেলেদের ওইটাই তো দোষ। খাটব না, কষ্ট করব না, অমনি অমনি সব দুঃখু ঘুচে যাবে। কেষ্ট পেতে গেলে কষ্ট করতে হয়।’
বাজনা বললে, ‘কষ্ট আমি খুব করতে পারি।’
‘তো কর।’
‘তারপর বলে দেবে তো বদ্যির বাড়িটা?’
বুড়ি কেমন খ্যান-খ্যান করে হেসে উঠল। বললে, ‘বলে কী, একেবারে বদ্যির ঘরে পৌঁছে দেব। তবে দেখো বাছা, যেন একটিও ধান পাখির পেটে না যায়! তা হলে বলা দূরে থাক, গলা যাবে। আমায় চেন না।’
বাজনা বললে, ‘না, না, একটি কুটোও তোমার নষ্ট হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে জিরুতে পার। একাজে আমার খুব অভ্যেস আছে।’
‘বেশ, তবে আমি একটু গড়িয়ে নিই,’ বলে বুড়ি উঠে, দোর ঠেলে ঘরে ঢুকল। আর বাজনা বুড়ির লাঠি হাতে নিয়ে ঘুঘু তাড়াতে লেগে পড়ল।