বাঙালির ব্যবসাদারি
‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ কথাটা যেমন দিনের মতো সত্য, ‘বাণিজ্যে বসতে মিথ্যা’ কথাটা তেমনই রাতের মতো অন্ধকার। শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি না করিতে পারিলে জাতির পতন যেমন অবশ্যম্ভাবী, সত্যের উপর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত না করিলে বাণিজ্যের পতনও আবার তেমনই অবশ্যম্ভাবী। মদকে মদ বলিয়া খাওয়ানো তত দোষের নয়, যত দোষ হয় মদকে দুধ বলিয়া খাওয়ানোতে। দুধের সঙ্গে জল মিশাইয়া বিক্রি করিলে লাভ হয় যত, প্রবঞ্চনা করার পাপটা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। একটা জাতি ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা যত বড়ো হয় হউক, কিন্তু প্রবঞ্চনা বা মিথ্যার বিনিময়ে যেন তাহার জাতির বিশ্বস্ততা আর সুনাম বিক্রি করিয়া সে ছোটো না হইয়া বসে। ভণ্ড লক্ষপতি অপেক্ষা দরিদ্র তপস্বী ঢের ভালো। হাঁ, এখন কথা হইতেছে – বাণিজ্য দ্বারা আমরা স্বজাতির নাম করিব, স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করিব, না – অন্য বড়ো জাতির নাম দিয়া নিজের নাম ভাঁড়াইয়া বড়ো হইয়া সেই বড়ো জাতিরই তেলা মাথায় তেল ঢালিব? কথাটা একটু খোলসা করিয়া বলি।
আমাদের বাঙালিদের হিন্দু-মুসলমান অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে বেশ একটু ঝোঁক দিয়াছেন, সেটা খুব মঙ্গলের কথা। তবে ইহার মধ্যে অমঙ্গলের কথা হইতেছে এই যে, ইঁহাদের অনেকেই নিজের বা স্বজাতির নাম ভাঁড়াইয়া ইংরাজি নামে নিজের নূতন নামকরণ করিতেছেন! কী সুন্দর মৌলিকতা! যিনি অতটা না করেন, তিনি আবার নিজের পৈতৃক নামটাকে বিপুল গবেষণার সহিত বহু কসরত করিবার পর এমন একটা অস্বাভাবিক অশ্বডিম্বে পরিণত করিয়া বসেন, যাহা আমাদের পূর্বে বা পরপুরুষের কোনো ব্যক্তিই বুঝিতে পারিবেন না, ইনিকিনি? এইরূপে কৃষ্ণকে ক্রিস্টো রূপে বাজারে বসাইয়া কতটা সুবিধা হয় জানি না, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, ইহাতে অসুবিধাটাই হয় বেশি। শুনিয়াছি, এইরকম কালা চামড়ায় সাদা পালিশ বুলাইলে নাকি দুই-একজন শ্বেতদ্বীপবাসী বা বাসিনী ভুলক্রমে ওই দোকানে গিয়া উপস্থিত হন এবং তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা আসল ব্যাপার বুঝিতে পারেন না, তাঁহারা সন্তুষ্টচিত্তেই সওদা করিয়া চলিয়া যান; কিন্তু প্রতারণা ধরা পড়িলে যে আবার অনেকে মুখের উপরেই দোকানদারকে প্রবঞ্চক ভণ্ড বলিয়া মধুর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করেন, এটাও সত্য! অনেকে ভদ্রতার খাতিরে বাহিরে কিছু না বলিলেও মনে মনে দেশীয় দোকানদারের এই ক্ষুদ্রত্বের নিন্দা না করিয়া পারেন না। আর, নাম ভাঁড়াইয়া কোনো কাজ করিবার পর আসল নামটা প্রকাশ হইয়া গেলে কেহ যদি মুখের উপরেও গালাগালি করে, তাহা নির্বিকার চিত্তে হজম করা ভিন্ন কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু, দ্বারে আসল নামটা লেখা থাকিলে অন্তরের বাহিরের এসব কোনো বিড়ম্বনাই আর সহ্য করিতে হয় না। তা ছাড়া, এইরকম কালার গায়ে সাদার দাগ লাগাইয়া লাভও যে খুব বেশি হয় তাহা আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারি না। কারণ ইহাতে এই রকম দোকানদারগণ যেমন দু-একটা বিদেশি খরিদ্দার পান, তেমনই আবার অনেকগুলি স্বদেশি খরিদ্দারও হারান। কেননা আমাদের দেশের শহরের সোজা বা পাড়াগাঁয়ের ভদ্র মাঝারি লোকে সহজে সাহেবের দোকান মাড়াইতে চান না। ইঁহাদের কেহ বা ওসব বিজাতীয় হাঙ্গামের মধ্যে যাইতে চান না, কেহ বা স্বদেশি দোকানেই জিনিস কিনিতে ভালোবাসেন, আবার কেহ বা নানান দিক দিয়া নিজের দীনতা ধরা পড়িবার ভয়েই ওসব দোকানে যান না।
আমাদের অনেক দেশীয় লোকের আবার একটা ধারণা এই যে, সাহেবের দোকানের জিনিসের দাম দেশীয় দোকানের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই বেশি দামে দুই-চারিটা জিনিস সাহেবদের বিক্রি করিতে পারিলেও অন্য দিক দিয়া এসব দোকানের অনেক ক্ষতি। সাহেব খরিদ্দারগণ বেশি দামে দামি জিনিস কিনিলেও তাঁহারা সংখ্যায় কম। সে-অনুপাতে কম-দামি জিনিসের ক্রেতা বহু … দেশীয় লোকের অপেক্ষা বেশি টাকার জিনিসও দোকানে বিক্রি হয় না। অথচ, যদি দোকানদার বাণিজ্যে পসার করিয়া একবার সুনাম অর্জন করিতে পারেন, তাহা হইলে বহু বিদেশি বা সাহেব-খরিদ্দার আপনিই জুটিয়া যাইবে। এই ধরুন, আমাদের বটকৃষ্ণ পালের কথা। ইনি অনায়াসেই নিজের পৈতৃক নাম কাটছাঁট করিয়া অন্তত, মন্টোক্রিস্টো পল’ হইতে পারিতেন। কিন্তু তাহাতে তাঁহার ব্যবসায়ে যদিই বা পসার হইত, কিন্তু সকলের নিকট এত নাম হইত না, এবং আমরাও গর্বের সহিত একজন বাঙলি ব্যবসাভিজ্ঞ লোকের নাম যেখানে-সেখানে উদাহরণস্বরূপ পেশ করিতেও পারিতাম না। বেনামিতে যে দু-একজন বাঙালি ব্যবসাদার বেশ একটু পসার করিয়াছেন, তাঁহাদের আমরা বাঙালি বলিতে সংকোচ করি, লজ্জা হয়। কেননা, তাঁহারা নিজেই সর্বপ্রথমে নিজের বাঙালিত্ব অস্বীকার করিয়াছেন। কাজেই ইঁহারা হইয়া পড়িয়াছেন বাদুরের মতন – না পাখি, না পশু!
তাহা ছাড়া, ইহা আত্মপ্রবঞ্চনা নয় কি? ইহাতে নিজেকে, দেশকে, জাতিকে ছোটো করিয়া দেখা হয় না কি? নিজের কৃতিত্বে দেশের লোকের সুনামে, জাতির আত্মবিশ্বাসে আমাদের নিজের লোকেরাই কত বেশি হেয় ক্ষুদ্র ধারণা পোষণ করে, ইহাই তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেন, আমরা কী জগতের এতই ঘৃণ্য অস্পৃশ্য জীব যে, আমাদিগকে আমাদের নিজ সত্যিকার পরিচয় লুকাইতে হইবে? আমরা কী এতই অমানুষ, এবং যাহাদের নামের দৌলতে এই জঘন্য অর্থ-লাভ তাহারাই কী এত মস্ত মানুষ? দেখিয়াছি, অনেকে তথাকথিত নীচ বংশে জন্ম বলিয়া নিজের পিতৃপুরুষের পরিচয় গোপন করে, কিন্তু তবুও শান্তি পায় কি? লোকে তাহার এই মিথ্যা মুখোশে বরং আরও টিটকারি দেয় না কি? সে নিজের অন্তরেই নিজে লজ্জাতুর ছোটো হইয়া যায় না কি? তাহার চেয়ে তাহার গৌরব করিবার ছিল, যদি সে বুক ফুলাইয়া তাহার পিতৃপুরুষের পরিচয় দিয়া নিজের কৃতিত্বে আপন মনুষ্যত্বের উপর দাঁড়াইয়া বলিতে পারিত যে, জন্মটা কিছুই নয় – পুরুষকারই হইতেছে আসল জিনিস। তাহাতে তাহার নিজের অন্তরেও সে বল পাইত, আনন্দ পাইত এবং অন্যেও তাহার নির্ভীকতার মনুষ্যত্বের কাছে সসম্মানে মাথা নত করিত। আমরা আজ ভারতে এক অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিতে চলিতেছি, আর আজও যদি আমাদের আত্মসম্মান না জাগে – আজও যদি আমরা আত্মবিশ্বাসে ভর করিয়া নিজের মনুষ্যত্ব ও পুরুষকারের জোরে মাথা উঁচু করিযা বিশ্বের মুক্ত-পথে চলিতে না পারি, তবে আমাদের জাতিগঠন তো দূরের কথা, মুক্ত-দেশের অন্যে এ-কথা শুনিলে মাথায় টোক্কর লাগাইয়া বলিয়া দিবে যে, আগে মাথা উঁচু করে চলতে শেখো।
যাহা হইয়া গিয়াছে তাহা এখন অপরিবর্তনীয়, কিন্তু যাঁহাদের সাহস আছে, আত্মসম্মান আছে, জাতিকে যিনি বড়ো করিয়া দেখিতে পারেন, তাঁহার উচিত এক্ষুনি এ-মিথ্যে মুখোশটাকে দূর করিয়া ফেলিয়া আবার নতুন করিয়া নিজের বিশ্বাসে নিজের কৃতিত্ব, কর্মকুশলতা ও পৌরুষের পুঁজি লইয়া ব্যবসা-ক্ষেত্রে দাঁড়ানো। তাহাতে তাঁহার নাম, তাঁহার দেশের নাম, তাঁহার জাতির নাম। আর সবচেয়ে বড়ো জিনিস তাঁহার নিজের অন্তরের শান্ত পূত মহাতৃপ্তির অপূর্ব আত্মপ্রসাদের বিপুল গৌরব।
এই জাতীয়তার যুগে, এই নিজেকে সত্য বলিয়া জানার সাহসী কালেও ওই পুরোনো বিশ্রী অভিনয়ের হেয় অনুকরণ হইতেছে বলিয়া আমরা এত কথা বলিলাম। ডোম যদি ডোম বলিয়া সসংকোচে পথ ছাড়িয়া আমাকে দীর্ঘ গোলামি সালাম ঠোকে, তাহা হইলে স্বতই তাহার প্রতি আমার একটা উঁচু-নিচুর ভাব আসে, কিন্তু সে যদি ডোম বলিয়া পরিচয় দিয়া সহজ হইয়া আমার পথে মানুষের মতো দাঁড়াইতে পারে, তাহা হইলে বাহিরে আমি অভ্যাসবশত যতই ক্ষুব্ধ হই, অন্তরে তাহার আত্মসম্মান ও মনুষ্যত্বজ্ঞানকে প্রণাম না করিয়া থাকিতে পারি না। সমাজ বা জন্ম লইয়া এই যে বিশ্রী উঁচু-নিচু ভাব, তাহা আমাদিগকে জোর করিয়া ভাঙিয়া দিতে হইবে। আমরা মানুষকে বিচার করিব মনুষ্যত্বের দিক দিয়া, পুরুষকারের দিক দিয়া। এই বিশ্ব-মানবতার যুগে যিনি এমনই করিয়া দাঁড়াইতে পারিবেন, তাঁহাকে আমরা বুক বাড়াইয়া দিতেছি – তাঁহাকে নমস্কার করি!
হাঁ, – ব্যক্তিত্বের দিক ব্যতীত দেশীয় লিমিটেড কোম্পানিগণও তাহাদের ম্যানেজিং এজেন্টের কল্পিত ইংরেজি নাম রাখিয়া লোকের চক্ষে ধূলা দিতেছেন, কী বিশ্রী প্রতারণা! কী ঘৃণ্য অধঃপতন!
আজ আমরা তাঁহাকেই ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিব, তাঁহারই পায়ের ধূলা মাথায় লইব, – তিনি মুচি, ডোম, হাড়ি, যেই হউন, – যিনি মহাবীর কর্ণের মতো উচ্চশিরে সর্বসমক্ষে দাঁড়াইয়া বলিতে পারিবেন, ‘আমি সূতপুত্রই হই, আর যেই হই, আমার পুরুষকার আমার গৌরব, আমার মনুষ্যত্বই আমার ভূষণ!’