ভোরবেলা আমার প্রসন্নতার সঙ্গী
রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’, কিছুক্ষনের মধ্যেই
বই ঘরময় পাখির কণ্ঠস্বর,
ঘরের চতুঃসীমায় সুরের সোনালি পাড়
আর সুরের ভাঁজে ভাঁজে
বাংলা শব্দের রহস্য তন্বীর মতো
দেয় গড়াগড়ি। আমার সত্তায় হঠাৎ
মার্কোপোলের জাগরণ।
একেকটি বাংলা শব্দ আমাকে কী এক সম্মোহনে
কখনো অকূল সমুদ্রে,
কখনো দুর্গম অরণ্যে, কখনো মরুভূমি,
কখনো-বা মেরু প্রদেশের তুষার ঝড়ে আহ্বান করে আবার সেই আহ্বান
বিশাল জলচর প্রাণীর পিঠের মতো
পদ্মার চরে অথবা বিবাদরহিত মাছের গন্ধ লেপ্টে-থাকা
জেলেপাড়ায়, ঢাকার ঘিঞ্জি বস্তিতে
মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধ নোঙর-করা জাহাজের মতো কলোনীতে
আমার আমন্ত্রণের রেশমি নিশান।
যখন অভিভুত আওড়াই আনন্দ, আমার দৃষ্টিকে
আপ্লুত ক’রে উদ্ভাসিত
এক মধ্যবিত্ত ঘর, যেখানে ভর দুপুরে
আয়নার সামনে আঁচড়াও তুমি দীর্ঘ চুল,
গান গাও গুনগুনিয়ে;
সেই মুহুর্তে ইলিশের চকচকে মিছিল
ডাগর নদীতে কম্পমান ঝালর,
প্রজাপতির পিছনে
ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি।
যখন আমার নিঃশ্বাস সুন্দরের
ধ্বনির ধারক, মনে পড়ে
বারান্দায় তোমার দাঁড়ানো, হাতের রুলিতে
বিকেলের স্তব্ধ অসীমতা এবং
স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর মুখোশ-খশানো মিছিলে
অগনিত মুখ, শাড়ির আঁচল আর মুষ্টিবদ্ধ হাত।
যখন বিশালতা আমার ওষ্ঠে দপ দপ করে,
বাংলাদেশ সন্তান-হারা প্রসূতির মতো বুক খুলে
দেখায় আমাকে, আমি দু’চোখ ঢেকে ফেলি
আবহমানকালের অসংখ্য কাটা মুন্ডুসমেত রক্তপ্রবাহ দেখে।
চোখ খুলে দেখি, রবীন্দ্রনাথ
আমার হাত থেকে তুলে নিচ্ছেন ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’
এবং তাঁর সৌম্য হাতে একরাশ ফুল;
পুস্পগুচ্ছ শান্তিনিকেতনের না শহীদ মিনারের
ঠাহর করতে পারিনি।
শব্দের কাঙাল আমি, অন্ধের মতো আমার পথ হাতড়ানো।
২৫।১১।৯০