বাংলার গুণ না জর্মন গুণী
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-করিডরে দু পিরিয়ডের মাঝখানে লেগে যায় গোরু-হাটের ভিড়, কিংবা বলতে পারেন আমাদের সিনেমা-হলের সামনের জনারণ্য। তফাত শুধু এইটুকু যে, জর্মনরা আইনকানুন মেনে চলতে ভালোবাসে বলে ধাক্কাধাক্কি-চেঁচামেচি বড় একটা হয় না, করিডরে তো রীতিমতো উজান-ভাঁটা দুটো স্রোতের মতো ছেলেমেয়েরা চলে এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসের দিকে, কিংবা ইউনিভার্সিটি-রেস্তোরাঁর দিকে অথবা কমন-রুম পানে।
তার মাঝখানে মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখতে পেতুম বুড়ো আইনস্টাইন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছেন ক্লাস নিতে। আলুথালু কেশ, লজ্ঝড় বেশ। কোন খেয়ালে মগ্ন ছিলেন খোদয় মালুম। শেষ মুহূর্তে টনক নড়েছে সেদিন তাঁর ক্লাস আছে–রুম নম্বর গিয়েছেন ভুলে, কী পড়াতে হবে তারও খেয়াল নেই। ছেলেরা সমীহভরে পথ করে দিত আর বুড়ো আইনস্টাইন ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল বেগে তাবৎ ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং চষে বেড়াতেন আপন রুমের সন্ধানে। মুখে শুধু। ‘পারদোঁ, পারদোঁ’ (মাফ করুন, মাফ করুন), কারণ জানেন, কলিসন লাগলে দোষ তাঁরই।
অথবা দেখতে পেতুম, অর্থশাস্ত্রের বাঘা কৌটিল্য সমবার্ট চলেছেন হেলেদুলে। বগলে একগাদা কেতাব, তারই ধাক্কায় টাইটা একটু বেঁকে গিয়েছে, সঙ্গে গোটা দশেক শিষ্য শিষ্যা। চলতে চলতেই পড়ানো চলছে। সমবার্ট আর কতদিন বাঁচবেন কে জানে, তাই—
ছেলেরা সব সমবার্টেরে ঘেরে
মাছি যেমন পাকা আমের চতুর্দিকে ফিরে—
তাঁর শেষ জ্ঞানবিন্দুটুকু শুষে নিতে চায়।
কিংবা দেখতুম কাঁচাপাকা চুল, একচোখ কানা সংস্কৃতের অধ্যাপক ল্যুডার্সকে। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য বেদে। মোন-জো-দড়ো সভ্যতা, আর্য, অনার্য, না প্রাক-আর্য, তাই নিয়ে যখন ইয়োরোপীয় পণ্ডিতেরা খুন-খারাপি করার মতো অবস্থায় এসে পড়েছেন, তখন সবাই বললেন, ‘মোন-জো-দড় বৈদিক, না প্রাক-বৈদিক, সেকথা ঠাহর করার মতো এলেম মার্শালের পেটে নেই। সেখানে পাঠাও ল্যুডার্সকে। চতুর্বেদ আর সে সময়কার আহার-বিহার, ক্ষেত-খামার, হাতিয়ার-তলোয়ার সর্ববিষয় তাঁর নখদর্পণে! মোন-জো-দড়ো সভ্যতার গোপনতম কোণেও বৈদিক সভ্যতার কণামাত্র প্রভাব গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকে, তবু সে লডার্সকে ফাঁকি দিতে পারবে না–
‘করাচি বন্দরে নেমেই ল্যুডার্স তার গন্ধ পাবেন, ওই একটি চোখ দিয়েই তাকে খুঁজে নেবেন আর ক্যাঁক করে ধরে নিয়ে বিশ্বজনকে দেখিয়ে দেবেন, বেদের ইন্দ্রদেব কোন ময়ূরের পেখম পরে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে আছেন।
‘আর ল্যুডার্স যদি বলেন, “না, বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে মোন-জো-দোর কোনও প্রকারের যোগসূত্র নেই” তা হলে নাককান বুজে সেই রায় মেনে নিয়ে তাবৎ ঝগড়া-কাজিয়ার উপর ধামাচাপা দিয়ে দাও।’
আইনস্টাইন, সমবাট, ল্যুডার্স এঁরা সব ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তম্ভ, তোরণ, শিখর বিশেষ। তাছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো শুষে নেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীরে কত যে নাম-না-জানা ঘুলঘুলি গবাক্ষ ছিলেন তার হিসেব রাখবে কে?
এঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়-যজ্ঞশালার প্রত্যন্ত প্রদেশে অনাদৃত উপেক্ষিত ছিলেন তা নয়, কিন্তু এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে সময় লাগত একটু বেশি। এদেরই একজন ছিলেন, অধ্যাপক ভাগনার, ইনি পড়াতেন বাংলা ভাষা।
জর্মন ভাষা বিশ্ববরেণ্য ভাষা। সে ভাষা পড়াবার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থা আছে কি না জানিনে, কিন্তু বাংলার মতো অর্বাচীন ভাষা পড়বার ব্যবস্থা সে সুদূর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, এ সংবাদ শুনে পুলকিত হয়েছিলুম।
ভাগনারের সঙ্গে আলাপ হতেই তিনি তাঁর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন। যথেষ্ট বঙ্গভাষাভাষীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়নি বলে তিনি কথা কইলেন জর্মন ভাষায়, মাঝে মাঝে বাংলা মসলার ফোড়ন দিয়ে। অদ্ভুত শোনাল, কিন্তু সেই নির্বান্ধব পাণ্ডববর্জিত দেশে বিদেশির মুখে বাংলা শুনে জানটা যে তর হয়ে গেল, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই!
ভাগনারের বাড়ি গিয়ে দেখি, ভদ্রলোক একখানা বাংলা বই নিয়ে ধস্তাধস্তি করছেন। ডাইনে-বাঁয়ে বিস্তর বাংলা অভিধান, ব্যাকরণ- এক পাশে ব্যোটলিঙ্ক-রোটের পর্বতপ্রমাণ সংস্কৃত-জর্মন অভিধান।
বাংলা অভিধানে হদিস না মিললে সংস্কৃত দিক-সুন্দরীর (ডিক্সনারি) নিকট দিগদর্শন যাচঞা করবেন বলে।
ভূমিকা না করেই বললেন, ‘আমায় একটু সাহায্য করুন।’
এতদিন পর আজ আর ঠিক মনে নেই কিন্তু খুব সম্ভব গল্পটা ছিল শরৎ চাটুয্যের ‘আঁধারে আলো’! ‘হাবুবাবু ছোরা চালাতে শিখেছে’ এইরকম ধারা কী জানি কী একটা ছিল। যোগরূঢ়ার্থে ‘নীলকণ্ঠ’ শিব এ কথা ভাগনার জানতেন কিন্তু ‘হাবুবাবু’ যোগরূঢ়ার্থে যে শান্ত-শিষ্ট গোবেচারি– নিনকমপুপ– সে কথাটার সন্ধান ভাগনার কোথাও পাননি, অবশ্য আভাসে আন্দাজে শব্দটার খানিকটে মানে আন্দাজ করে নিতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ভাগনার দেখলুম তাঁর ওয়াটার্লতে এসে ঠেকেছেন, সেই গল্পের মধ্যে বিদ্যাপতির এক উদ্ধৃতিতে :
“আজু রজনী হম ভাগে পোহাইনু,
পেখনু পিয়া-মুখ চন্দা
জীবনযৌবন সফল করি মাননু
দশদিশ ভেল নিরানন্দা–”
আজু-ফাজু, পেখনু-টেখনু খাঁটি বাংলা কথা নয়, কিন্তু হুঁশিয়ার ভাগনার কেঁদে-কঁকিয়ে এসব মানে বেশ কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছেন, কিন্তু ‘নিরানন্দা’ কথায় এসে যে মানে তিনি করেছেন, সেটা মন মেনে নিলেও হৃদয় ‘নিরানন্দা’ই থেকে যায়।
ভাগনার বললেন, ‘তবে কি এই বুঝতে হবে, প্রিয়মুখচন্দ্র দর্শন করাতে আমার এতই আনন্দ হল যে, মনে হচ্ছে দশদিশ নিরানন্দ হয়ে গিয়েছে, কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল আনন্দ আমাতে এসে ঠাঁই নেওয়ায় ‘দশদিশ নিরানন্দ’ হয়ে গিয়েছে?
অভিনবগুপ্তের না হোক, অভিনব টীকা তো বটেই।
সবিনয়ে বললুম, বিদ্যাপতি বিনা টীকায় পড়ার মতো বিদ্যা আমার নেই তবে যতদূর মনে পড়ছে, কথাটা এখানে নিরানন্দ নয়, আসলে আছে বোধহয় ‘নিরদ্বন্দ্বা’। আমাতে প্রিয়াতে মিলন হয়েছে ঐক্য হয়েছে, দশদিশে আমি আর কোনও দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছিনে। যেখানে যত দ্বন্দ্ব অর্থাৎ বিরহ ছিল সেখানেই মিলন এসে গিয়েছে– দশদিশে এখন শান্তি।
আর বেদেও তো ঋষি প্রার্থনা করেছেন, ‘সর্বপ্রকারের দ্বন্দ্বের সমাধান হোক।’
ভাগনার বললেন, উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু ছাপার ভুল হতে যাবে কেন?
এর কোনও সদুত্তর আমি দিতে পারিনি। আপনারা যদি বাতলে দেন। ঘটনাটি যে এত সবিস্তর বয়ান করলুম তার ‘মরাল’ কী?
সুকুমারী ভাষায় বলি :
‘হাসতে হাসতে যারা হচ্ছে কেবল সারা
রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা
বুঝছে না কি তারা?’
প্রকাশক আর ছাপাখানা যে ‘নিরাদ্বন্দ্বা’ হয়ে ছাপার ভুল করেই যাচ্ছেন, ‘ভাগনারেরই লাগছে ব্যথা, বুঝছে না কি তারা??’