বাংলাদেশের রেনেসাঁস

বাংলাদেশের রেনেসাঁস

ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছিলুম যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় তথা ভারতে একটা নবজন্ম ঘটে গেছে, ফরাসিতে যাকে বলে রেনেসাঁস। কী জানি কেন ওই ফরাসি প্রতিশব্দটাই লোকে পছন্দ করে। যাঁদের বিদেশিতে আপত্তি তাঁরা বলেন নবজাগরণ। কিন্তু তাঁরাও স্বীকার করেন যে, গত শতাব্দীতে একটা নবজাগরণ ঘটে গেছে।

সম্প্রতি এক সেমিনারে গিয়ে শুনলুম রেনেসাঁস বা নবজন্ম বা নবজাগরণ বলে যাকে চিহ্নিত করা যায় তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ, দেশটা ছিল পরাধীন ও জনগণ ছিল শোষিত ও নিরক্ষর। সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের আওতায় মুষ্টিমেয় অভিজাত বা ভদ্রলোক শ্রেণির সাহিত্যিক বা শিল্পী বা মনীষী কি রেনেসাঁসের মতো অত বড়ো একটা ব্যাপার ঘটাতে পারতেন? পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর ফ্রান্স বা ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে তার কি কোনো সাদৃশ্য ছিল? যেটা রেনেসাঁস নয় সেটাকে রেনেসাঁস বলে ভ্রম করা হয়েছে।

আবার এমন কথাও শোনা গেল যে বাংলার রেনেসাঁস তো চৈতন্যদেবের সময়েই ঘটেছিল। বৈষ্ণব পদাবলি যার সাক্ষী। অমন অপূর্ব জাগরণ যে-দেশে ঘটেছিল, সে-দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এমন কী ঘটল যে তাকেই বলতে হবে রেনেসাঁস? যেটা রেনেসাঁস নয় সেটাকে রেনেসাঁস বলে ভ্রম করা হচ্ছে।

বুঝতে পারা যাচ্ছে দেশে দুই দল ভাবুক আছেন। যাঁরা দেশাভিমানী তাঁরা বলবেন, দেশের রেনেসাঁস দেশের অতীত থেকে বা দেশের মাটি থেকেই জন্মায়। ইউরোপে যেমন জন্মেছিল। রেনেসাঁসের বীজ বাইরে থেকে উড়ে আসে না সমসাময়িক কালের হাওয়ায়। আর যাঁরা সমাজবাদী, তাঁরা বলেন, সত্যিকার রেনেসাঁস কখনো উপরের স্তর থেকে হতে পারে না, হতে পারে নীচের স্তর থেকে। সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি-বিদেশি ধনতন্ত্র মিলে রেনেসাঁস ঘটাতে পারে না, পারে জাগ্রত জনগণ।

এই নেতিবাদী মনোভাব আমার ছেলেবেলায় ছিল না। স্বদেশি যুগের নেতারাও স্বীকার করতেন যে বিদেশি শাসন যতই মন্দ হোক-না কেন, সেই অন্ধকারের ভিতরেও আলোর দেওয়ালি জ্বলেছিল। জ্ঞানের আলো এসে অজ্ঞানের আঁধার দূর করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে।

তবে ইউরোপেও আজকাল রেনেসাঁসের সংজ্ঞা ও সময় নিয়ে নানা মত। কারো কারো মতে রেনেসাঁস শুরু হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে তুর্কদের কনস্টান্টিনোপল অধিকার ও গ্রিক পন্ডিতদের ইটালিতে আশ্রয়লাভের সময় থেকে নয়; আরও আগে থেকে। যখন আরবরা স্পেন অধিকার করে ও তাদের সঙ্গে গ্রিক গ্রন্থের আরবি তর্জমা ইউরোপের নজরে পড়ে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তো তখন থেকেই প্রতিষ্ঠিত। এঁদের মত মেনে নিলে মহাকবি দান্তেও রেনেসাঁসের সন্তান। এটা কিন্তু অধিকাংশের মত নয়। অথচ এটার পক্ষে প্রবল যুক্তি হল দান্তের যুগে ল্যাটিন থেকে ইটালিয়ান ভাষার উত্তরণ, অবজ্ঞাত লোকভাষায় নিখুঁত ছন্দ নিখুঁত মিল বিদগ্ধ চিন্তা গভীর অনুভূতি।

সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উত্তরণ, হিন্দি ভাষার উত্তরণ; অন্যান্য লোকভাষার উত্তরণও কি অনুরূপ ঘটনা নয়? সেটা যদি রেনেসাঁসের লক্ষণ না হয়, তবে কীসের লক্ষণ? সেইজন্যে রেনেসাঁসের সংজ্ঞা সম্বন্ধে একমত হওয়া শক্ত। অধিকাংশের মতে রেনেসাঁসের প্রধান লক্ষণ হল দিব্যচেতনার পরিবর্তে মানবিক চেতনা, ব্রহ্মজ্ঞানের পরিবর্তে বস্তুজ্ঞান, পারলৌকিক বা অলৌকিক কার্যকারণ পরম্পরার পরিবর্তে ঐহিক বা প্রাকৃতিক কার্যকারণ পরম্পরা, ভক্তির পরিবর্তে যুক্তি, আপ্তবাক্যের পরিবর্তে প্রমাণসিদ্ধ বাক্য, অথরিটির পরিবর্তে লিবার্টি। প্রাচীন গ্রিসে এসব ছিল। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের ফলে এসব রহিত হয়। সব কিছুর জন্যে বাইবেলে যেতে হয়। বাইবেলই ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন। তাহলে মানবমনের বিকাশ হবে কী করে? মানুষের কি কেবল আত্মা আছে? মন নেই, দেহ নেই? দেহ থাকলে শারীরতত্ত্বও জানতে হয়। শারীরতত্ত্ব জেনে মানুষের ছবি আঁকতে হয়, মূর্তি গড়তে হয়। শারীরতত্ত্ব জানতে হলে শবব্যবচ্ছেদ করতে হয়। এসব যে নিষিদ্ধ।

প্রাচীন গ্রিসের সঙ্গে একটা ছেদ বা ডিসকন্টিনিউইটি ঘটেছিল। তার ফলে এনেছিল একপ্রকার অন্ধকার, সেটা মনের রাজ্যে। তেমনি একপ্রকার অবদমন, সেটা দেহের রাজ্যে। মানবমনকে বিশ্বপ্রকৃতিকে শৃঙ্খলিত করে যে শৃঙ্খলা, তার থেকে মুক্তির জন্যেও আকুলতা জেগেছিল। আবশ্যক হয়েছিল আরও একটা ছেদ, আরও একটা ডিসকন্টিনিউইটি। এবার প্রাচীন গ্রিসের সঙ্গে নয়, মধ্যযুগের শাস্ত্রনিবদ্ধ চার্চশাসিত বিদ্যার সঙ্গে। তাই পুরাতন বিদ্যার জায়গায় এল নতুন বিদ্যা—ওল্ড লার্নিং-এর জায়গায় নিউ লার্নিং। এটা একটা নতুন ধর্ম নয়, একটা নতুন মনোভাব। এটা ধর্মের সঙ্গে মেলে না বলে এর নাম দেওয়া হয় মানবিকবাদ বা হিউম্যানিজম। মানুষই সব কিছুর মাপকাঠি। পৃথিবী স্থির না অস্থির এই নিয়ে যে বাদবিসংবাদ ঘটে, সেটা আসলে খ্রিস্টীয় বা ধর্মীয় বিশ্ববীক্ষার পক্ষে জীবন-মরণের প্রশ্ন। পৃথিবী অস্থির হলে তো সব কিছুই অস্থির।

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আরও একটা দিক ছিল। শিল্পের দিক। ধর্মের আঁচল ধরা জ্ঞানের মতো ধর্মের আঁচল ধরা সৌন্দর্য কয়েকটি ধর্মীয় বিষয়ে নিবদ্ধ ছিল। তার বাইরে গেলেই আধ্যাত্মিক বা নৈতিক অর্থে পতন। রেনেসাঁস দিল শিল্পীকে মুক্তি। গ্রিক রোমক দেবদেবীর অস্তিত্বে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না থাকলেও তাদের পৌরাণিক কাহিনিকে চিত্রভাস্কর্যে রূপায়িত করা হল। আঁকা হল, গড়া হল নগ্নকায় ভেনাস। এক এক করে নিষেধের গন্ডি লঙ্ঘন করা হল। যে গন্ডি প্রাচীন ঐতিহ্যের নয়, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের। এক্ষেত্রে প্রাচীন আধুনিক পরস্পরের বন্ধু। আধুনিকদের প্রেরণার উৎস প্রাচীন ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য ও শিল্প। এক-একটি প্রাচীন কীর্তি আবিষ্কৃত হয় আর সাহিত্যিক বা শিল্পীরা নতুন প্রেরণা পেয়ে সৃষ্টিতৎপর হন। তাতে হয়তো খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে অসঙ্গতি বা বিচ্ছেদ হল, কিন্তু তার জন্যে কেউ দ্বিধান্বিত নন।

অতীতের পুনরাবিষ্কারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে বহির্বিশ্ব আবিষ্কার। আকাশের গ্রহনক্ষত্রের মতো পৃথিবীর সাগর-মহাসাগর দেশ-মহাদেশ। আগেকার দিনে লোকের ধারণা ছিল স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল পরস্পরসংলগ্ন। তার চিত্র আঁকা হত। কোথাও তার কোনো সমর্থন পাওয়া গেল না। ভূগর্ভে আর যা-ই থাক পাতাল নেই। আকাশে আর যা-ই থাক স্বর্গ নেই। বাইবেলের জগৎ বিজ্ঞানের জগতের সঙ্গে মেলে না। মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে? ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগৎকেই স্বীকার করে নিল। বাইবেলের জগৎ যে সহজে পথ ছেড়ে দিল তা নয়। রেনেসাঁসের পর এল কাউন্টার রেনেসাঁস। সাহিত্যের উপরে, বিজ্ঞানের উপরে এমন উপদ্রব শুরু হল যে, ইটালির রেনেসাঁস এক শতাব্দীর মধ্যেই স্তব্ধ। তারপরের শতাব্দীটা তার তুলনায় বন্ধ্যা। অন্যান্য দেশেও এর অনুরূপ দেখা যায়। তবে যেসব দেশে খ্রিস্টধর্মের রিফর্মেশন ঘটে সেই প্রোটেস্টান্ট দেশগুলিতে কাউন্টার রেনেসাঁস তেমন অত্যাচার করতে পারে না। আর ফ্রান্স যদিও ক্যাথলিক দেশ তবু সেইখানেই দেখা দেয় অষ্টাদশ শতাব্দীর এনলাইটেনমেন্ট। যার মানসসন্তান ফরাসি বিপ্লব। এই চারটি যুগান্তকারী পর্যায় এক শতাব্দী কালের মধ্যে উপস্থিত হয়নি। মোটামুটি চার শতাব্দী সময় নিয়েছে। এই চার শতাব্দীর ঐতিহাসিক বিবর্তন একসঙ্গে এসে সমাগত হয় আটলান্টিক ও ভারতমহাসাগর পার হয়ে বাংলার উপকূলে। তথা ভারতবর্ষের উপকূলে। তাদের স্বাগত জানান সর্বপ্রথম রামমোহন রায়। তিনি যেন তাদেরই অপেক্ষায় অন্ধকার রাত্রে জাগ্রত ছিলেন। বিদেশি বিধর্মী ও বিজেতার সঙ্গে তিনি তাদের ঘুলিয়ে ফেলেন না। পৃথিবীর একপ্রান্তের ঐতিহাসিক পরিবর্তন অপর প্রান্তের ঐতিহাসিক পরিবর্তন উদবোধন করতে পারে। রামমোহন বিশ্বাস করতেন যে, বাংলায় তথা ভারতে অনুরূপ পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। সূচনা যাঁরা করেন, তাঁরা সব দেশেই মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ব্যক্তি। কেউ-বা অভিজাত কেউ-বা মধ্যবিত্ত। জনগণ হঠাৎ একদিন জেগে উঠে রেনেসাঁসও করেনি, রিফর্মেশনও না, এনলাইটেনমেন্ট তো নয়ই। এক ফরাসি বিপ্লবেই জনগণকে রঙ্গমঞ্চে দেখা গেল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফরাসি বিপ্লবের পুনরাবৃত্তির লেশমাত্র সম্ভাবনা ছিল না এদেশের মাটিতে। প্রথম তিনটির অনুবৃত্তির সম্ভাবনা যে ছিল এটা রামমোহনের চোখে পড়ে।

আমাদের রেনেসাঁস ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঘটেছে, কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে ধারাবাহিকতার সূত্রে আসেনি। ইউরোপের ইতিহাস থেকে আবির্ভূত হয়েছে। কিছুকালের জন্য ভারতের ইতিহাস ইউরোপের ইতিহাসের সামিল। গোড়ায় অর্থনৈতিক অর্থে, পরে রাজনৈতিক অর্থে, শেষে সাংস্কৃতিক অর্থে। ইচ্ছা করলে তৃতীয়টাকে প্রতিরোধ করতে পারা যেত। বলতে পারা যেত চাইনে রেনেসাঁস, চাইনে রিফর্মেশন, চাইনে এনলাইটেনমেন্ট। পরবর্তীকালে বলাও হল। কিন্তু রামমোহন ও তাঁর সহযোগীরা বহিরাগত ভাবধারাকে সাদরে আবাহন করেন। দেশজ না হলেও কালোপযোগী বলে। সেনা এলে আধুনিক যুগটাই আসত না। নতুন ভোরের আলোর রেখাও আসত না।

আমাদের রেনেসাঁস ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মতো মধ্যযুগের অন্ধকার থেকে আধুনিক যুগের আলোকে উত্তরণ। আমাদের রিফর্মেশন অর্থাৎ ধর্মসংস্কার তথা সমাজসংস্কার আমাদের রেনেসাঁসের সমকালীন, যদিও স্বতন্ত্র। আমাদের এনলাইটেনমেন্ট স্বতন্ত্র নয়, যদিও সমকালীন। রামমোহনের মধ্যে তিনটেই একসূত্রে গ্রথিত। ফরাসি বিপ্লবের সঞ্চালিকা ভাবধারাও তাঁর মধ্যে কাজ করছিল, তিনিও ভালোবাসতেন সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা। তবে বিপ্লবটার অনূরূপ তাঁর স্বকালে ও তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। আপাতত রেনেসাঁস নিয়েই আমাদের আলোচনা। রিফর্মেশন আমাদের আলোচ্য নয়। এনলাইটেনমেন্ট অর্থাৎ রুশো ভলতেয়ার দিদেরো প্রভৃতিকে রেনেসাঁসের কোটায় ফেলা যায় না। অথচ আমাদের ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী এঁদের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত যে, এনলাইটেনমেন্টকে বাদ দিলে ইয়ংবেঙ্গলকেও বাদ দিতে হয়। আর ইয়ংবেঙ্গলকে বাদ দিলে আমাদের রেনেসাঁস অঙ্গহীন হয়। আসলে আমাদের রেনেসাঁস ইউরোপের চার শতাব্দীর বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ও বিমিশ্র অনুবর্তন। অথচ অনুকরণ নয়। আমরা কতক নিয়েছি কতক বাদ দিয়েছি। আমাদের প্রেরণার উৎস খ্রিস্টপূর্ব গ্রিস নয়। ইসলামপূর্ব ভারত নয়। প্রতীচ্যের নতুন বিদ্যা, নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান।

খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য তার পূর্ববর্তী গ্রিক ঐতিহ্যকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করত। আর আপনাকে করত আলোকের সঙ্গে। রেনেসাঁসের পর হিউম্যানিস্টদের একভাগ খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যকেই অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেন, আর পুনরুদিত গ্রিক ঐতিহ্যকে আলোকের সঙ্গে। মধ্যযুগের অন্য নামই হল অন্ধকার যুগ। অথচ সেই যুগটাই ছিল খ্রিস্টীয় ঐতিহ্যের একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগ। আমাদের এদেশে যাঁরা রেনেসাঁসের দীক্ষা নিলেন তাঁদের মধ্যে একভাগ বলতে আরম্ভ করলেন যে আমাদের মধ্যযুগটাও ছিল অন্ধকার যুগ। কিন্তু সেকথা বললে কেবল যে ইসলাম প্রভাবিত আরব্য ও পারসিক ঐতিহ্যকে খর্ব করা হয় তাই নয়, নানক কবীর চৈতন্য প্রবাহকেও উপেক্ষা করা হয়। মধ্যযুগ নিয়ে এই যেমন সমস্যা, তার পূর্ববর্তী যুগ নিয়েও তেমনি আরেক। ইসলামি ধর্ম প্রচারকরা হয়তো তাকে অন্ধকার যুগ বলে শ্রদ্ধা করে থাকবেন, কিন্তু প্রাচীন আরবরা প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রাচীন পারসিকরাও। ইসলাম এতে দেশসুদ্ধ মানুষকে মুসলমানও করেনি, খ্রিস্টধর্ম যেমন করেছিল ইউরোপের মানুষকে। তেমন কোনো ছেদ বা ডিসকন্টিনিউইটি ইউরোপের মতো ভারতের পূর্বতন ঐতিহ্যের সঙ্গে ঘটেনি। সেটা ঘটে থাকলে পরে আবার পূর্বতন ঐতিহ্যকে পুনরাবিষ্কার করে মধ্যযুগের অন্ধতার সঙ্গে ছেদ বা ডিসকন্টিনিউইটির প্রশ্ন উঠত।

এদেশে প্রাচীন ভারতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতি প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতির মতো আচ্ছন্ন বা বিলুপ্ত হয়নি। মধ্যযুগের ইসলামি বা আরব্য পারসিক সংস্কৃতি তাকে আচ্ছন্ন বা বিলুপ্ত করতে চায়নি বা পারেনি। যেকোনো দেশে যেকোনো যুগে নবজাগরণ ঘটতে পারে, কিন্তু যেকোনো নবজাগরণই রেনেসাঁস নামের যোগ্য নয়। যেখানে ছেদ নেই, ডিসকন্টিনিউইটি নেই, সেখানে অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরণের প্রশ্ন ওঠে না। তা সেখ্রিস্টীয় আলোকই হোক আর গ্রিক আলোকই হোক। অবিকল ইউরোপীয় অর্থে রেনেসাঁস এদেশে ঘটবার কথা নয়। কিন্তু একথা তো অস্বীকার করা যায় না যে বস্তুজগৎ সম্বন্ধে অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতীয়দের যে জ্ঞান ছিল সেজ্ঞান অজ্ঞান। অজ্ঞানের পরিণাম জ্ঞানের হাতে পরাজয়। অন্ধকারের পরিণাম আলোকের কাছে পরাভব। আরও আগে ইসলামধর্মী আরব, তুর্ক ও মোগলদেরও বস্তুজগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান খুব বেশি না হলেও তুলনায় বেশি ছিল। দেশ-বিদেশ ঘুরে ভূগোলটা তারা আরও ভালো জানত। আর সমুদ্রযাত্রা তথা স্থলপথে বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করে ভারতের মধ্যযুগের হিন্দুরা স্বেচ্ছায় কূপমন্ডূক হয়েছিল। একই কালে তাদেরই মতো কূপমন্ডূক হয়েছিল চীনারা, জাপানিরাও।

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেবল ভারত নয়, চীন-জাপান-তিব্বতও তাদের ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে পর্দানশিন বনে। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে ইউরোপের অভিযাত্রীরা এসে তাদের ঘোমটা খুলে দেয়। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঘটে লাসার অবগুন্ঠন উন্মোচন। যাঁর দ্বারা তাঁর নামটিও তেমনি। ইয়ং হাজব্যাণ্ড। জাপানিরা রাতারাতি ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সাদরে বরণ করে নেয়। চীনারা তাদের অহংকার ছাড়ে না। দীর্ঘসূত্রিতা করে। তবু তারাও ওর মূল্য বোঝে। অবুঝ কেবল তিব্বতিরা। চীন কমিউনিস্ট হবার পর তিব্বত থেকে যাঁরা পালিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন পন্ডিত। একখানি পুথি দেখিয়ে আমাকে বলেন, ‘আমার হাতে প্রমাণ আছে। আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে পৃথিবীটা গোল নয়।’

আমাদের এদেশেই অনবগুন্ঠন সকলের আগে ঘটে। এদেশে রেনেসাঁস হয়নি বলা যেমন কঠিন, হয়েছে বলাও তেমনি। কারণ বিস্তর পন্ডিত আছেন যাঁদের হাতে প্রমাণ রয়েছে যে রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি শুক্র শনি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। তা ছাড়া রেনেসাঁস তো একটা সাধারণ শব্দ নয়, একটা বিশেষ শব্দ। যেটা ইটালির বেলা প্রয়োগ করা হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে একটি বিশেষ অবস্থায়, সেটা যত্রতত্র যেকোনো শতাব্দীতে যেকোনো অবস্থায় প্রয়োগ করলে তার অর্থ বদলে যায়। রেনেসাঁস সেইখানেই আর তখনই হয় যেখানে ও যখন শাস্ত্র আর বিজ্ঞান ফারাক হয়ে যায়, থিয়োলজি আর ফিলসফি ফারাক হয়ে যায়, পুরাণ আর ইতিহাস ফারাক হয়ে যায়, ল্যাটিন আর ইটালিয়ান, সংস্কৃত আর বাংলা ফারাক হয়ে যায়। জার্মানির মারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন থিয়োলজির চেয়ার ছাড়া আরও একটা চেয়ার সৃষ্টি হয়। তার নাম ফিলসফির চেয়ার। ফিলসফি তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরে ন্যাচারাল ফিলসফি বলে নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়। যার অপর নাম বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞান থেকে এখন আলাদা হয়ে গেছে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান। প্রত্যেকেই স্বাধীন। এটা শুধু মারবুর্গে নয়, ইউরোপের সর্বত্র। এখন তো পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে।

রামমোহন রায়ই প্রথমে উপলব্ধি করেন যে এদেশে থিয়োলজি শিক্ষার নতুন কোনো দরকার নেই, দরকার ফিলসফি তথা বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থার। তিনি স্বয়ং ছিলেন জবরদস্ত মৌলবি, প্রচন্ড বৈদান্তিক, প্রগাঢ় খ্রিস্টভক্ত। কিন্তু দেশবাসীর জন্যে যে-শিক্ষা তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে প্রবর্তন করেন সেটা মারবুর্গের তিন শতাব্দী পূর্বের সেই স্বাধীন মানবিক বিদ্যার অনুবর্তন। ততদিনে সেটার আরও ভাগ-বিভাগ হয়েছে। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে থিয়োলজি তখনও সহ-অবস্থান করছিল। কিন্তু ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব সম্পূর্ণ বাদ যায়।

ইউরোপের সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অন্তরের সঙ্গে অভ্যর্থনা করলেও প্রাচীন গ্রিসকে প্রেরণার উৎস বলে মেনে নিতে রামমোহন বা তাঁর সমকালীন কেউ ইচ্ছুক ছিলেন না। প্রাচীন গ্রিসের স্থানে তাঁরা অভিষেক করেছিলেন প্রাচীন ভারতকে। এক্ষেত্রে রামমোহনের সঙ্গে তাঁর প্রতিপক্ষদের বিবাদ যা ছিল তা ধর্ম বা সমাজনিবদ্ধ। তাঁদেরই মতো রামমোহনেরও প্রতিষ্ঠাভূমি ছিল সংস্কৃত ভাষা ও আর্য সংস্কৃতি। খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞানলাভের জন্যে গ্রিক ভাষা শিক্ষা করলেও তিনি ইলিয়াড ওডিসি বা গ্রিক ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে কৌতূহলী ছিলেন কি না সন্দেহ। সম্ভবত গ্রিকদর্শন অধ্যয়ন করেছিলেন মাদ্রাসায় আরবি ভাষায়। গ্রিক সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা আসে রামমোহন-পরবর্তী কালে। মধুসূদন হোমার পড়ে প্রভাবিত হন। ইলিয়াডের আলোয় রামায়ণের ইন্টারপ্রিটেশন দেন। সেটা কিন্তু একটা ব্যতিক্রম। বাংলার রেনেসাঁস গ্রিসের দিকে তাকায়নি, তাকিয়েছে ইংল্যাণ্ডের দিকে; সেও আধুনিক ইংল্যাণ্ড। ইউরোপের রেনেসাঁসের যেটা প্রতিষ্ঠাভূমি বাংলার বা ভারতের রেনেসাঁস তার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়নি, হয়েছে আধুনিক ইউরোপের প্রতি। আধুনিক ইউরোপই এক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিসের ভূমিকা নিয়েছে।

রেনেসাঁসের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে সর্ববিষয়ে কৌতূহল বা অনুসন্ধিৎসা। আর একটা মানবজীবনকে সর্বপ্রকারে ভরিয়ে নেওয়া ও বিকশিত করা। এ দুটি লক্ষণ ইউরোপের মতো বাংলায় তথা ভারতেও দেখা দিল। তেমনি আরও একটি লক্ষণ হল মানবিক ব্যাপারে অতিপ্রাকৃতের হস্তক্ষেপ স্বীকার না করা। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে দেব-দেবীর পদক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ। দেব-দেবীর কোপে মানুষের সর্বনাশ, দেব-দেবীর বরে মানুষের সর্বসিদ্ধি—এই যে সাহিত্যের নিয়ম তা সংস্কৃতে লেখা না হয়ে বাংলায় লেখা হয়েছে বলেই কি রেনেসাঁসের সূচক? কিন্তু ইংরেজি ভাষায় নতুন বিদ্যা প্রবর্তনের পর যে সাহিত্যের উদয় হল তার আলোয় অতিপ্রাকৃতের ছায়া সরে গেল। কদাচিৎ একজন সাধু বা সন্ন্যাসী এসে পরিস্থিতি বঁাচান, কিন্তু চন্ডী বা কালী বা ধর্মঠাকুর আর আসেন না। নব্যশিক্ষিত পাঠক অমন নভেল পড়বেন না, অমন নাটক দেখবেন না।

এই যে নতুন শিক্ষা, এটাই ইউরোপের নিউ লার্নিং; যা মধ্যযুগকে অপসারণ করে আধুনিক যুগের পত্তন করেছিল সেখানে। এখানেও তার একই ভূমিকা। তফাতের মধ্যে এই যে এদেশের পড়ুয়াদের গ্রিক ল্যাটিন পড়তে হয় না, তার বদলে পড়তে হয় ইংরেজি। কিন্তু সেই ইংরেজির ভিতর লুকিয়ে থাকে গ্রিক ল্যাটিন শেখা মন। প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষভাবে। প্রাচীন গ্রিস রোম আমাদের ইংরেজি শিক্ষিতদের মনের উপর কাজ করে। আর তাঁরাই হন বাংলার নতুন সাহিত্যের প্রবর্তক।

দেখতে দেখতে গড়ে ওঠে বাংলা পদ্য, গোড়ার দিকে সংস্কৃত বা পারসিক ভাষায় শিক্ষিত পন্ডিত বা মুনশিদের হাতে। পরে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত সাহিত্যিক বা সাংবাদিকদের হাতে। এঁদের সামনে ছিল ইংরেজি মডেল। ইংরেজি পত্রিকা পড়ে এঁরা বাংলা পত্রিকা লেখেন। ইংরেজি কাব্য উপন্যাস পড়ে বাংলা কাব্য উপন্যাস। সংস্কৃত মডেল সামনে রেখে যাঁরা লিখতেন তাঁরাও ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট হন। যেমন সংস্কৃত রীতির কাব্যনাটকের সঙ্গে তেমনি গৌড়ীয় রীতির মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলির সঙ্গে ছেদ পড়ে যায়। এটাও একপ্রকার ডিসকন্টিনিউইটি। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে না। এক পুরুষ কি দু-পুরুষ পূর্বের ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গেই পা মিলিয়ে নেয়। তবে প্রাচীন সংস্কৃতের সঙ্গেও যোগসূত্র রাখতে চায়। এইখানে বাংলার বা ভারতের রেনেসাঁস ইউরোপীয় রেনেসাঁসের থেকে ভিন্ন।

ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে গ্রিক ল্যাটিনের চর্চা হত তার কোনো ধর্মীয় ঝোঁক ছিল না। তার প্রবণতাটাই ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার। গ্রিক বা রোমক দেব-দেবীদের কেউ দেবতাজ্ঞান করত না, তাদের পায়ে মাথা ঠেকাত না। তারা যেন দেবতাই নয়, মানবমনের কল্পনা। আর এখানে মানুষ দেবতা হয়ে বসে আছেন। তাঁর মানবিক বিচার করে সাধ্য কার! দেবতারাও জাগ্রত! সংস্কৃতচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যা ছিল তা সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের নয়, প্রধানত হিন্দুশাস্ত্রের ও শাস্ত্রানুমোদিত সাহিত্যের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যেটুকু ছিল সেটুকু সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের ভগ্নাংশ। জার্মানিতে বা জাপানে গেলে তার চেয়ে অনেক বেশি সংস্কৃত পুথিপত্রের সন্ধান পাওয়া যেত। ইউরোপের লোকের ইলিয়াড ওডিসি পড়া আর ভারতের লোকের রামায়ণ মহাভারত পড়া দুই বিভিন্ন ধরনের পড়া। ওদের পড়া বিশুদ্ধ সাহিত্য হিসাবে পড়া। এদের পড়া সাহিত্যচ্ছলে ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পড়া। এ পড়ার মধ্যে বিচার নেই, বিশ্লেষণ নেই, লৌকিক অলৌকিক সব সমান সত্য। কেউ তর্ক করলে একটা রূপক ব্যাখ্যা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের বিরাট একটা সেকুলার দিকও ছিল। কিন্তু সেটা বিলুপ্ত বা অনাবিষ্কৃত। অশোকের শিলালিপি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মানসারের শিল্পসূত্র, ভরতের নাট্যশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র ইত্যাদি সংস্কৃত কলেজ বা হিন্দু কলেজ বা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের বা তাদের অধ্যাপকদের বিদ্যার চতু:সীমার মধ্যে ছিল না। টোল চতুষ্পাঠীর বিদ্যার্থী ও পন্ডিতদের বিদ্যার বিস্তারও সীমাবদ্ধ। রেনেসাঁসের প্রেরণা তার থেকে আসে না, আসে পূর্ববর্তী চার শতাব্দীর ইউরোপীয় বিবর্তন থেকে।

পূর্ববর্তী চার শতাব্দীতে ইউরোপ যদি এইভাবে বিবর্তিত না হত তাহলে এদেশেও রেনেসাঁস ঘটত না। শুধুমাত্র সংস্কৃতচর্চা করেই যে কেউ প্রাচীন ভারতের স্বাধীন চিন্তা স্বাধীন পরীক্ষণ স্বাধীন জীবনকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবাহন করে নিয়ে আসতে পারতেন তা নয়। প্রাচীন গ্রিকবিদ্যার মতো প্রাচীন সংস্কৃতবিদ্যা মধ্যযুগে অচলিত ছিল না। আধুনিক যুগের বীজ নিহিত থাকলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু পূর্বেই ভারতে নবজাগরণ ঘটতে পারত। যে কারণেই হোক সংস্কৃতচর্চা থেকে ভারতে নবজাগরণ আসেনি, পারসিক চর্চা থেকেও না, বাংলা পদাবলি কীর্তন থেকেও না। এসেছে ইংরেজিচর্চা থেকে, ইংরেজিসূত্রে দর্শন-বিজ্ঞান ইতিহাস-ভূগোল ও নীতিচর্চা থেকে। অচলায়তনের নিষিদ্ধ দুয়ার খুলে গেছে। সেই দুয়ার দিয়ে এসেছে চার শতাব্দীর ইউরোপীয় বিবর্তন।

ইটালির বেলা যেমন গ্রিস, বাংলার বেলা তেমনি ইংল্যাণ্ড। ইটালির বেলা যেমন প্রাচীন যুগ বাংলার বেলা তেমনি পূর্ববর্তী চার শতাব্দী। উভয়ক্ষেত্রেই পুরাতন বিদ্যার স্থান অধিকার করে নূতন বিদ্যা। নতুন ধরনের স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি। তবে রেনেসাঁস কেবল বিদ্বানদের ব্যাপার নয়। শিল্পীদেরও ব্যাপার। ইউরোপের রেনেসাঁসের নায়কদের মধ্যে ছিলেন একদিকে যেমন কোপারনিকাস, গালিলিয়ো, ব্রুনো, ইরাসমাস প্রমুখ জ্ঞানী তেমনি অপরদিকে লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফেল, বতিচেলি প্রমুখ শিল্পী। জ্ঞানীদের উপর নির্যাতন যতখানি হয় শিল্পীদের উপর ততখানি নয়। কারণ তাঁরা খ্রিস্টীয় বিষয়েও ছবি আঁকতেন, মূর্তি গড়তেন, আবার পেগান বিষয়েও। রেনেসাঁসের জ্ঞানের দিকটা খ্রিস্টীয় চার্চের কোপদৃষ্টিতে পড়লেও শিল্পের দিকটা নীতির নামে পুনরায় অর্গলবদ্ধ হয় না। তবে লেওনার্দোকেও ভয়ে ভয়ে শবব্যবচ্ছেদ করে শারীরতত্ত্ব শিখতে হত একান্ত গোপনে। না শিখলে নতুন যুগ আনতে পারতেন না চিত্রকলায় বা ভাস্কর্যে।

নীতিনিপুণদের বিষদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বা তার থেকে বঁাচিয়ে থিয়েটার, অপেরা ও ব্যালে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তেমনি নগরে নগরে যাদুঘর, আর্ট গ্যালারি ও কনসার্ট হল তৈরি হয়। রেনেসাঁসের পূর্বে ধর্মীয় সংগীত ও ধর্মীয় শিল্পের চর্চা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হল সেকুলার সংগীত ও শিল্প। যা-কিছু মানবিক তার মর্যাদা ও মূল্য অকস্মাৎ বেড়ে গেল। ধর্মের সঙ্গে পাল্লা দিল মানবিকবাদ। বিষয় সংগ্রহ করা হল কতক প্রাচীন গ্রিক রোমক উৎস থেকে, কতক দেশ-বিদেশের ইতিহাস বা কিংবদন্তি বা রূপকথার ভান্ডার থেকে, কতক-বা পরিচিত জনজীবন থেকে। শেক্সপিয়রের নাটক এই তিনটি সূত্র থেকে বিষয় আহরণ করে থিয়েটারের গতিনির্দেশ করে দেয়। এরপরে আর পিছুটান থাকে না। ধর্মনাট্য তার জনপ্রিয়তা হারায়। শেক্সপিয়রের যুগে অভিনেত্রীর যোগদান নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে নারীর ভূমিকায় নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়।

কলকাতার পত্তনের পর থেকে স্থানীয় ইংরেজ সম্প্রদায় নিজেদের জন্যেও বইপত্র ও শিল্পকর্ম আমদানি করার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য নাটক প্রভৃতিরও আয়োজন করে। বাঙালিরা ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হয়। প্রথমে তাদের বড়োলোকদের নজরে পড়ে গাড়ি বাড়ি আর আসবাবের উপর। ঔপনিবেশিক বাস্তুরীতির অনুসরণ করতে বাধে না। তারপর খানা বাদ দিয়ে পিনার উপর। স্বয়ং জাহাঙ্গির বাদশাহ সেটার সূত্রপাত করে দিয়ে যান কলকাতার পত্তনের পূর্বে। ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যাও প্রবেশ পায় মোগল অন্তঃপুরে। অস্ত্রশস্ত্রও আদৃত হয়। পলাশির আগেই ভারতের মাটিতে পাশ্চাত্য মিশাল জীবনযাত্রা শুরু হয়ে যায় ইউরোপীয় সমাজে তো নিশ্চয়ই, ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম সমাজেরও উপরতলায়। খ্রিস্টধর্মে আগ্রহ আকবর বাদশাহের ছিল, কিন্তু আর কারও ছিল না। অপরপক্ষে পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার প্রতি ঔৎসুক্য আরও অনেকের ছিল। তা বলে তাঁরা কেউ পরাধীন হতে চাননি।

ইউরোপীয় আগন্তুকরাও জাহাজ বোঝাই করে এদেশের মরিচ-মশলা শালদোশালা ভোগ্যপণ্য ওদেশে নিয়ে যেতেন। কেউ কেউ নিয়ে যেতেন এদেশের পুরাকীর্তি ও পুথিপত্র। একদা পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের যোগাযোগ ছিল, আদান-প্রদানও চলত। গ্রিস ভারতের কাছে নতুন নয়, ভারতও গ্রিসের কাছে নতুন নয়। তেমনি রোমও ভারতের কাছে নতুন নয়, ভারতও রোমের কাছে নতুন নয়। মাঝখানে হাজার খানেক বছর পুরোনো পথঘাট বন্ধ হয়ে যায় আরবদের দাপটে। আরবরা হয়ে যায় মুসলিম আর গ্রিক-রোমানরা খ্রিস্টান। কতকটা ধর্মীয় কারণে, কতকটা অর্থনৈতিক কারণে দুই পক্ষের মধ্যে এমন রেষারেষি হয় যে গ্রিস-রোমের লোক ভারতে আসার পথ খুঁজে পায় না, ভারতের লোক গ্রিস-রোমে যাবার পথ ফিরে পায় না। বাণিজ্যটা আরবদের হাত দিয়ে হয়, ওরাও মুনাফা লোটে। শেষকালে পোর্তুগালের নাবিকরা আফ্রিকার দক্ষিণ দিয়ে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আসতে সমর্থ হয়। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ভারতীয় নাবিকরাই আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে। কী করে তারা জানবে যে খাল কেটে কুমির ডেকে আনছে!

পোর্তুগাল অবশ্য রোম নয়, ইংল্যাণ্ডও নয় গ্রিস। এবারকার যোগাযোগটা ইউরোপের পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে নয়, পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে। কিন্তু রেনেসাঁসের কল্যাণে পূর্ব-পশ্চিম দুই প্রান্তই এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। আর পোর্তুগাল ও ইংল্যাণ্ড থেকে যারা এসে হাজির হয় তারাও ভারতের পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে পূর্ব প্রান্তকে সমুদ্রপথে সংযুক্ত করে। মাঝখানে সে-সংযোগও আরবদের দ্বারা ছিন্নপ্রায় হয়েছিল। স্থলপথের যোগসূত্রও ছিল ক্ষীণ। ভারতবর্ষ বলতে যা বোঝাত তা ইউরোপের মতোই একটা মহাদেশ বা উপমহাদেশ। যেখানে এক রাষ্ট্র বা এক নেশন কোনোদিন গড়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝে চক্রবর্তী রাজারা স্থাপন করেছেন সাম্রাজ্য। যেমন ইউরোপেও। সকলেই হিন্দু, এটা তেমনি একটা তথ্য যেমন ইউরোপের সকলেই খ্রিস্টান। খ্রিস্টান হলেই একজাতি হয় না, হিন্দু হলেও একজাতি হয় না। খ্রিস্টানরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তুর্কদের প্রশ্রয় দিয়েছে। হিন্দুরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে পাঠান বা তুর্কদের প্রশ্রয় দিয়েছে। তুর্করা আরবদের পদানত করে। মুসলমান বলে তুর্ক আর আরব একজাতি হয় না। পরে তো খ্রিস্টধর্মী ইউরোপীয়রাই তুর্কদের হাত থেকে আরবদের উদ্ধার করে। অবশ্য নিজেদের স্বার্থে। এখন আর কেউ আরব তুর্ক ভাই ভাই বলে না।

ইউরোপের রেনেসাঁস বাণিজ্যসূত্রে সমুদ্রপথে ভারতের উপকূলে পৌঁছোয়। কিন্তু পোর্তুগালের ধর্মান্ধতা তাকে রেনেসাঁসের বাহক করে না; করে ইংল্যাণ্ডকে, ফ্রান্সকে। তাই রেনেসাঁসের প্রধান পীঠ হয় কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই, সেইসঙ্গে পন্ডিচেরি। ফরাসিরা ইংরেজদের কাছে হেরে যাবার পর পন্ডিচেরির প্রাধান্য হ্রাস পায়। কলকাতা ইংরেজদের রাজধানী হবার পর থেকে কলকাতার প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। বাঙালিরা এই আকস্মিকতার সুযোগ লাভ করে। এটা দৈবলব্ধ। এর জন্যে তাদের আত্মপ্রসাদ সাজে না। তাদের কৃতিত্ব এইখানে যে তারাই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করে সাগরপারের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের রূপকথার রাজপুত্রদের স্বপ্ন সার্থক করবে। তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে দেশ-দেশান্তরে যাবে। যেমন যেত জাভায় সুমাত্রায় সিংহলে। কে জানে কতকাল আগে!

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বাংলাতেই যে রেনেসাঁস সবচেয়ে বেশি জমল তার কারণ ওই সাগরপারের স্বপ্ন। রামমোহনকে, দ্বারকানাথকে যা অস্থির করে তুলল। মধুসূদনকে তো খ্রিস্টান করে ছাড়ল। সাগরপারের আকর্ষণ এত তীব্র না হলে এঁরা সাগরপারের চিন্তার ও বিদ্যার প্রতি এত সহজে আকৃষ্ট হতেন না। এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে স্বাদেশিকতা প্রবল ছিল। এঁরা কেউ ঘরের থেকে বিযুক্ত হতে চাননি। অথচ বাইরের সঙ্গে যুক্ত হতে ব্যাকুল হয়েছিলেন এঁরা ও এঁদের মতো আরও অনেকে।

গ্রহণ করার ইচ্ছা না থাকলে, লোক না থাকলে ইউরোপীয়রা যা বহন করে নিয়ে এল তা কলকাতা শহরের সাহেবপাড়ার তাদেরই কাজে লাগত। তাদের দীপশিখা থেকে আর কারও দীপসলিতায় সঞ্চারিত হত না। দেশের মন প্রস্তুত না থাকলে বহিরাগত জ্ঞান বা শিল্পরস কোথাও ফুল ফোটায় না, ফল ধরায় না। ইউরোপেও এক দেশ থেকে অপর দেশে সঞ্চারিত হতে অনেক সময় লেগেছে। রাশিয়ার রেনেসাঁস ভারতের রেনেসাঁসের সমকালীন। জাপানের রেনেসাঁস আরও পরবর্তীকালের।

নতুন আইডিয়ার জন্যে বাংলার মন প্রস্তুত ছিল। পুরুষানুক্রমিক সংস্কৃত ও পারসিক প্রস্তুতির কাজ করে রেখেছিল। বহুকালের কর্ষিত ক্ষেত্রে নতুন বীজ বপন করতে না করতেই তা অঙ্কুরিত হল। সাত সমুদ্র পারের অচেনা ভাষা অচেনা ভাব আত্মসাৎ করতে এক পুরুষও লাগল না। দেখা গেল ডিরোজিয়োর শিষ্যরা ইংরেজিতে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখছেন সহজাত প্রতিভার সঙ্গে। অথচ স্বদেশপ্রেম বিসর্জন না দিয়ে। টমাস পেইনের যুক্তির যুগ বইখানি প্রথমে একটাকা দামে, তারপর পাঁচ টাকা দামে বিকোয়। পাঠকদের কাছে দেশ যেমন প্রিয় যুগও তেমনি। দেশকে বাদ দিয়ে যুগ নয়, যুগকে বাদ দিয়ে দেশ নয়। হিন্দু কলেজের ছাত্ররা যুগের সঙ্গে মন মিলিয়ে নেয়। মানুষের মন দেশের বেড়া মানে না। সমকালীন মনের সঙ্গে সাযুজ্য অন্বেষণ করে। তার জন্য যে পারে সশরীরে সাগর পাড়ি দেয়। যে পারে না সেঘরে বসেই সাগরপারের হাওয়া খায়। এর নিট ফল একপ্রকার ‘সি চেঞ্জ’।

আমাদের যে রেনেসাঁস সেটা একপ্রকার ‘সি চেঞ্জ’। সামুদ্রিক পরিবর্তন। একে কয়েক জন উচ্ছৃঙ্খল অনাচারী তরুণের অপকর্ম বলে উড়িয়ে দেওয়া বা বাড়িয়ে দেখা কোনোটাই যথার্থ নয়। যে মদ এদের মাতাল করেছিল সেটা নতুন বিদ্যা, নতুন ভাব, নতুন আইডিয়া, নতুন প্রকাশভঙ্গি, নতুন জীবনযাপনের ধারা। কয়েক শতক আগে ইটালিতে বা ইংল্যাণ্ডেও অনুরূপ দেখা গেছে। সময়কালে রাশিয়াতেও লক্ষিত হয়েছে। সেই মুহূর্তে উৎসাহীদের খেয়াল ছিল না যে দেশটা পরাধীন বা সমাজটা জমিদারদের অধীন। রেনেসাঁসের উদয়লগ্নে কোথাও কারও খেয়াল থাকে না। পরবর্তীকালে উন্মাদনা কেটে যায়। যেটা থেকে যায় সেটা ওই সি চেঞ্জ’। রূপান্তর একবার ঘটলে আর অঘটিত হয় না। পালটা যেটা ঘটে সেটা একপ্রকার কাউন্টার-রেনেসাঁস। এদেশে সেটা রিভাইভালের আকার নেয়। দেশের লোক স্বদেশসচেতন, অতীতসচেতন, অধীনতাসচেতন, শোষণসচেতন হয়। কিন্তু ওই সামুদ্রিক পরিবর্তনটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। ওটা অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।

আমাদের রেনেসাঁসের দুর্বলতা এখানে নয় যে ওটাতে জনগণের যোগ ছিল না। কোন দেশের রেনেসাঁসেই-বা ছিল? আমাদের রেনেসাঁসের অপরাধ এখানেও নয় যে ওটা পরাধীন দেশের ও ফিউডাল সমাজের ফসল। একই অপরাধ অন্যত্রও দেখা যায়। কেউ কি বলতে পারেন যে স্বাধীন ভারতে ও শ্রেণিশূন্য রাশিয়ায় নতুন এক রেনেসাঁস ঘটেছে? গণচীনের খবর কি কেউ রাখেন?

তা নয়। আমাদের রেনেসাঁসের দুর্বলতা এইখানে যে ওর কোনো ক্ল্যাসিকাল বনেদ ছিল না। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ছিল। সেটা প্রাচীন গ্রিসে বনেদ। রামমোহন প্রাচীন ভারতের সঙ্গে অন্বয় রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ধর্মে। বিদ্যাসাগর প্রাচীন ভারতের সঙ্গে অন্বয় রক্ষা করতে চেয়েছিলেন সমাজে। বাংলা গদ্যের পথিকৃৎরা অন্বয় রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ভাষায়। সংস্কৃতানুসারী ভাষায়। কিন্তু কলেজে গিয়ে যাঁরা নতুন বিদ্যার পাঠ নিতেন তাঁদের সকলের আদর্শ ছিল ইংরেজি কাব্য নাটক উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তাঁদের আদর্শ ছিল ইউরোপীয় থিয়েটার, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, বাস্তুরীতি, উদারনীতি। পরবর্তীকালে এর বিরুদ্ধে একটা স্বদেশি বিদ্রোহ দেখা দেয়। কিন্তু বিদ্রোহীরাও ক্ল্যাসিকাল বনেদ খুঁজে পেলেন না। কতকগুলি ছবি আঁকা হল পৌরাণিক বিষয়ে, কিন্তু যে ধারায় আঁকা হল সেটা কি দু-হাজার বছরের পুরাতন ধারা? পুরাণ যে যুগের সেযুগের? ভাগ্যক্রমে অজন্তা আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু অজন্তার আদর্শে যা আঁকা হল তার বিষয় কি বৌদ্ধ জাতক? একালের চিত্রকররা আবার আধুনিক ইউরোপের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। যাঁরা লোকচিত্র বা পটচিত্র নিয়ে আছেন তাঁদের সেটা ক্ল্যাসিকাল বনেদ নয়।

আমাদের রেনেসাঁসের দুর্বলতা এখানেও নয় যে তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ পশ্চিমের তুলনায় বিলম্বিত ও খর্বাঙ্গ। এই দেড় শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এদেশে প্রচুর কাজ হয়েছে। আমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। তেমনি সাহিত্যেও কাজ যা হয়েছে তার চেয়ে বেশি এত কম সময়ের মধ্যে হত না। বঙ্কিম মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের মতো সৃষ্টি যেকোনো দেশের আধুনিক সাহিত্যে বিরল। আমাদের রেনেসাঁসের দুর্বলতা এইখানে যে তার শিল্পের দিকটা কাঁচা। যা নিয়ে আমরা গর্ব করি তা হয় প্রাচীনের হুবহু অনুকরণ বা অনুসরণ, যেমন কথাকলি বা ভারতনাট্যম বা মার্গসংগীত। আর নয়তো লোকনৃত্য বা লোকগীতি বা লোকনাট্য। তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক অতি নিবিড় ও অতি পুরাতন। মধ্যযুগের মতোই। শিল্পে নতুন যুগ এসেছে, যেমন বিদ্যায় ও সাহিত্যে নতুন যুগ এসেছে, একথা বলতে পারি কি আমরা! যেটুকু এসেছে সেটুকু পশ্চিমি প্রকৃতির ও পদ্ধতির।

তা ছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে যে মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ইউরোপে যেসব বিষয় ও যেসব রীতি শিল্পীর পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল মধ্যযুগের ইউরোপে সেসব নিষিদ্ধ ছিল না। মন্দিরচিত্র বা মন্দির ভাস্কর্যেও শিল্পীরা নর-নারীর বর্ণনা করেছে। গোপীদের বস্ত্রহরণের দৃশ্যে নগ্নতার কতটুকু বাকি ছিল! রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও প্রেমের অভিব্যক্তি শিল্পীদের যে অসীম স্বাধীনতা দিয়েছিল সেস্বাধীনতা সমসাময়িক ইউরোপে অকল্পনীয়। তাই রেনেসাঁসের বন্ধ মুক্তির প্রশ্নই ওঠেনি হিন্দু-শাসিত ভারতে। মুসলিম-শাসিত ভারতেও রাজপুত সামন্তরা তাঁদের শিল্পীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। তবে যেখানে মন্দিরনির্মাণ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানে মন্দির ভাস্কর্য বা মন্দিরচিত্রও বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা ইউরোপের মতো ব্যাপক ক্ষেত্রে নয়। দক্ষিণ ভারত ছিল হিন্দু শাসনে। আর মুসলিম শাসনও সর্বত্র অনুদার ছিল না।

শিল্পের মুক্তির জন্যে রেনেসাঁসের প্রয়োজন এদেশের ইতিহাসে ছিল না, যেমন ছিল ইউরোপের ইতিহাসে। তাহলে কি রেনেসাঁস বলতে যা বোঝায় তা এদেশের শিল্পের ক্ষেত্রে একেবারেই ঘটেনি বা ঘটবে না? না, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে আমাদের আধুনিক শিল্পীরা কেউ দশানন বা পঞ্চানন আঁকেন না। দশভুজা বা চতুর্ভুজা গড়েন না যা পূজার সময় ফরমাশ দিয়ে গড়িয়ে নেওয়া হয়। ওকে ভাস্কর্যের নমুনা বলা হয় না। আর্ট থেকে অতিপ্রাকৃত অন্তর্হিত হয়েছে। প্রকৃতির হুবহু অনুকরণ কেউ চায় না, কিন্তু প্রকৃতিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। এই পরিবর্তনটা এদেশে ইউরোপের রেনেসাঁসের ধারা বেয়ে এসেছে, প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা বেয়ে নয়।

জীবনের সমূহ বিভাগে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ কোথাও কোনোকালে একসঙ্গে ঘটেনি। সামগ্রিক পরিবর্তনও এক-আধ শতাব্দীর ব্যাপার নয়। পাঁচ শতাব্দীকালও ইউরোপের পক্ষে যথেষ্ট হয়নি। আমাদের নতুন বিদ্যার প্রবর্তনের পর তো দেড় শতাব্দীও কাটেনি। একে যদি তিন ভাগে বিভক্ত করি তো এর প্রথম পর্বটা আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে জ্ঞানবুদ্ধি মিলিয়ে নেওয়ায়। দ্বিতীয় পর্বটা প্রাচীন ভারতের সঙ্গে চেতনা মিলিয়ে নেওয়ায়। তৃতীয় পর্বটা অভূতপূর্ব গণজাগরণের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নেওয়ায়। প্রথমটার অস্তিত্ব এখনও অনুভব করা যায়। সেটা এখনও অতিক্রান্ত হয়নি। দ্বিতীয়টাও যে সমাপ্ত হয়েছে তা নয়। প্রাচীনের চেয়ে আরও প্রাচীনের আবিষ্কার প্রতিনিয়ত চলেছে। তৃতীয়টার তো সবে সূত্রপাত। তিনটি পর্ব যেন তিনটি স্রোত। পাশাপাশি প্রবহমান। একটির সঙ্গে আরেকটির সংযোগও ঘটছে, সংঘর্ষও। গতি ও প্রতিক্রিয়া উভয়ই সজীব।

রেনেসাঁসের মহত্ত্ব এইখানে যে স্বর্গ ও নরক, পরলোক ও পরকালের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানুষ রিয়্যালিটির সন্ধানে লেগে যায়। ইহলোকে ও ইহকালে পরিপূর্ণ জীবনই হয় তার আদর্শ। সেটা যেমন ব্যক্তির বেলা তেমনি সমষ্টির বেলা। পরিপূর্ণ জীবনের মধ্যে দেহেরও অংশ আছে, মনেরও আছে, হৃদয়েরও আছে, বিবেকেরও আছে। কিন্তু কেবলমাত্র আত্মার পরিত্রাণের উপর জোর দিতে গিয়ে এদের যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হত না। রেনেসাঁস এদেরও গুরুত্ব দেয়। এদের গুরুত্ব দিতে গিয়ে হয়তো আত্মার পরিত্রাণের প্রশ্নটাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয় না। এতকাল যাঁরা গুরুজন ছিলেন তাঁদের গুরুত্ব হ্রাস পায়। তবে রেনেসাঁস রেভোলিউশন নয় যে ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরের পুত্রকে বা তাঁর চার্চকে বা প্রতিনিধিকে সরাসরি অস্বীকার করবে। রেনেসাঁস রিফর্মেশনও নয় যে ঈশ্বরকে ও তাঁর পুত্রকে রেখে রোমান ক্যাথলিক চার্চকে ও পোপকে সরাসরি অস্বীকার করবে। এসব পরবর্তীকালে বিবর্তন। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের আদিপর্ব বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেছিল।

রেনেসাঁসের সময় থেকে ইউরোপে যা হিউম্যানিজম বা মানবিকবাদ বলে অভিহিত হয় তারও পরবর্তীকালে বিবর্তন ঘটেছে। সেকালের মানবিকবাদীরা মানবের পরিপূর্ণ বিকাশে উৎসাহী হলেও মানবসত্যের সঙ্গে সঙ্গে ঐশ সত্যেও বিশ্বাস করতেন। একালের মানবিকবাদীদের মধ্যে তাঁরাও যেমন আছেন তেমনি আরও আছেন একদল যাঁরা ঐশকে মানবের জ্ঞানবুদ্ধির অতীত বা প্রমাণাতীত বলে মানবিক ব্যাপারের বাইরে রাখতে চান বা স্রেফ অস্বীকার করেন। এঁদের মতে মানুষের কাজ মানুষকে নিয়েই থাকা আর মানুষের বাইরের ও ভিতরের প্রকৃতিকে। ভাগবত সত্তাকে নিয়ামক বলে স্বীকার করলে মানুষের আত্মশক্তির বিকাশই মানুষকে একদিন সর্বশক্তিমান করবে। জীবনকে করবে জরাব্যাধিমুক্ত। সংসারকে অভাবশূন্য।

রেনেসাঁসের পূর্বেও শোনা গেছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও শোনা গেছে যে, ‘এই মানুষে আছে সেই মানুষ’। তার মানে ভগবানকে মানুষ বলে গণ্য করা হয়েছে। মানবিকবাদ মানুষকে বরাবরই উচ্চস্থান দিয়ে এসেছে, কিন্তু রেনেসাঁসের পর যে প্রকৃষ্ট স্থান দেয় তা সাধুসন্ত আউল-বাউল সুফি মিস্টিকদের দেওয়া স্থান নয়, ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক দার্শনিক সাহিত্যিক শিল্পীদের দেওয়া। বাইবেল বর্ণিত বিষয়ে ছবি আঁকা মূর্তি গড়া ধীরে ধীরে অচলিত হয়ে যায়। আমাদের দেশেও পৌরাণিক বিষয়ে ছবি আঁকা মূর্তি গড়া ধীরে ধীরে কমে আসছে। অবশ্য ওটা যাঁদের চিরাচরিত বৃত্তি তাদের কথা আলাদা।

রেনেসাঁসের পরেই মানুষ ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করে। এমন এক রাজ্যের যেখানে সকলেই স্বাধীন, সকলেই সুখী, জীবনের সম্পদ সকলের ভাগ্যে, কেউ বঞ্চিত নয়। যেখানে আইন নিখুঁত, রাজনীতি নিখুঁত, অর্থনীতি নিখুঁত, কেউ কাউকে ফাঁকি দেয় না, শোষণ বা শাসন করেন না। যেখানে অপরাধ ঘটে না, অন্যায় ঘটে না, মানুষের সঙ্গে মানুষেও সম্বন্ধ স্বাভাবিক সৌহার্দ্যের। যেসব আদর্শ এতকাল স্বর্গের জন্যে তোলা ছিল এখন মর্ত্যের জন্যেও প্রত্যাশা করা হল। প্রত্যাশাটা স্বর্গের দেবতাদের কাছে নয়, মর্ত্যের প্রভুদের কাছে। স্বর্গের দেবতাদের সরানো যায় না, মর্ত্যের প্রভুদের উপর হতাশ হলে তাদের সরানো যায়। পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে পালটানো যায়। পুরাতন বলে সেসনাতন নয়। মানুষের জন্যেই তার স্থিতি, তার জন্যে মানুষের স্থিতি নয়।

রেনেসাঁসের সময় থেকে ইউটোপিয়ার স্বপ্ন একভাবে-না-একভাবে মানুষকে প্রবৃত্ত করেছে এমনসব কর্মে যা পরলোকে বা পরকালে কাজে লাগবে না। যা এই জগৎটাকেই ও এই জীবনকেই আর একটু উপভোগ্য করবে, অন্তত আর একটু কষ্টশূন্য। ধর্মের মধ্যেও সমাজকল্যাণের নির্দেশ ছিল, কিন্তু মানবিকবাদে যে নির্দেশ ছিল তা আত্মার পুণ্যের জন্যে নয়, তা ঈশ্বরের প্রীতির জন্যে নয়, তা মানবিক পূর্ণতার জন্যে। পারফেকশন তার লক্ষ্য। মানুষ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করল যে প্রকৃতিকে বশ করতে পারলে এই জগতেই লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব। ধর্ম বলে আসছিল অন্তঃপ্রকৃতিকে বশ করতে। বিজ্ঞানের কাছে তাঁদের অসীম প্রত্যাশা।

রেনেসাঁসের মানুষ বলতে বোঝায় সাধুসন্ত বা মিস্টিক নয়, সবজান্তা ও সব্যসাচী মানুষ যাঁরা এই পৃথিবীকে প্রতিদিন বদলে দিচ্ছেন আরও সুন্দর ও আরও উপভোগ্য পৃথিবীর জন্যে। সফল হয়তো হচ্ছেন না, কিন্তু বিফলতাও সফলতার সোপান। তাঁদের বিশ্বাস একালে যা হল না ভাবীকালে তা হবে। ভাবীকাল মানে পরকাল নয়। তেমনি এ পুরুষে যা হল না পরবর্তী পুরুষে তা হবে। পরবর্তী মানে পরজন্ম নয়। রেনেসাঁস যে-দেশে ঘটে সে-দেশের মানুষকে ইহলোকের উপরেই সমস্ত শক্তি নিয়োগ করতে প্রবর্তনা দেয়।

ঠিক এই অর্থে রেনেসাঁস ভারতের মাটিতে হয়েছে না মাটির গুণে অন্য রূপ নিয়েছে সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এমন কয়েক জন মানুষ এদেশে জন্মেছেন যাঁদের বলা যেতে পারে রেনেসাঁস যুগের মানুষ। এঁরা না হলে রেনেসাঁস হত না, রেনেসাঁস না হলে এঁরা হতেন না। রেনেসাঁস স্বীকার না করলে এঁদের জীবনের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, মনে হয় এঁরা প্রক্ষিপ্ত। স্বীকার করলে ব্যাখ্যা মেলে, লক্ষণ মিলে যায়।

রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বহমান যে ধারা সেধারা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার বা ভারতের সঙ্গে ধারাবাহিক নয়। তার ধারাবাহিকতা খুঁজতে হলে যেতে হয় পশ্চিম মুখে আধুনিক ইউরোপে ও অতীত মুখে প্রাচীন ভারতে। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন যুগের দিক থেকে আধুনিক আর দেশের দিক থেকে বাঙালি বা ভারতীয়। ভারতচন্দ্র বা রামপ্রসাদ তো আধুনিক ছিলেন না। কার কাছ থেকে তাঁরা তাঁদের আধুনিক ধারা পেতেন, যদি ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান কাব্য উপন্যাসকে বিদেশি বা সাম্রাজ্যবাদী বা ধনতন্ত্রী বলে বর্জন করতেন? ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান কাব্য উপন্যাস বলতে যা ছিল তা মান্ধাতার আমলের। সেই মজা নদী থেকে যা পাবার তা ভারতচন্দ্র রামপ্রসাদরাও পেয়েছিলেন। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যদি তার বেশি ও তার থেকে ভিন্ন কিছু না পেতেন তাহলে তাঁরাও হতেন মধ্যযুগের সামিল। তাঁদের কীর্তিও হত সেই ধরনের ও সেই মাপের।

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তাঁরা গতানুগতিকের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি। আর সেস্রোতও তো মজা নদীর স্রোত। গা ভাসাতে চাইলেও গা ভাসে না। যেমন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা। দু-কূল ভাসানো এক প্লাবনের প্রয়োজন ছিল। সেটা স্বদেশ থেকে নয়, অতীত থেকে নয়, বিদেশ থেকে ও আধুনিক যুগ থেকেই আসতে পারত। দেশ মোগল-শাসিত হলেও আসত। মারাঠা-শাসিত হলেও আসত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বর্জন করে কোনো দেশই নতুন কিছুই করতে পারত না। গতানুগতিকে লোকের অরুচি জন্মাত। রাজনৈতিক অর্থে স্বাধীন ও অর্থনৈতিক অর্থে স্বাবলম্বী হলেও সংস্কৃতির রূপান্তরের জন্যে ভারতের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ও ঔপন্যাসিকরা দেশেও চারদিকের জানালা-দরজা খুলে বাইরের আলো হাওয়াকে আমন্ত্রণ জানাতেন ও নিজেরাই তার খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন। যেটা আবশ্যক সেটা কেমন করে হয়েছে তার চেয়ে বড়ো কথা সেটা যথাকালে হয়েছে। নইলে রামমোহনের নাম কে জানত, বিদ্যাসাগরের কথা সেশুনত! মাইকেল বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাও রামপ্রসাদ ভারতচন্দ্রের প্রতিভার মতো গৃহকোণের হত। হত অষ্টাদশ শতাব্দীর মতো সেকেলে।

ঘটনাচক্রে গ্রিক পন্ডিতদের কনস্টান্টিনোপল থেকে ইটালিতে শরণার্থী হয়ে আগমন যেমন সে-দেশে রেনেসাঁসের সূচনা করে তেমনি ঘটনাচক্রে ইংরেজ বণিকদের বাংলার শাসনভার গ্রহণ ও তাদের নতুন বিদ্যার প্রতি এদেশের ভদ্রলোক শ্রেণির আকর্ষণ এদেশে রেনেসাঁসের সূত্রপাত করে। আপাতদৃষ্টিতে যা ঘটনাচক্র, ইতিহাসের বিচারে সেটা যুগপরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা। মধ্যযুগ মানুষকে নিশ্চয়ই অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিল, ইউরোপের গথিক ক্যাথিড্রাল ও ভারতের দেবমন্দির তার সাক্ষী। কিন্তু মানবের অগ্রগতি সেইখানেই রুদ্ধগতি হত, যদি সেআধুনিক যুগে পদার্পণ না করত। ইউরোপের রেনেসাঁস তাকে আধুনিক যুগে রূপান্তরিত করে। তেমনি ভারতের রেনেসাঁস ভারতকে করে আধুনিক যুগে যুগান্তরিত। যুগান্তরিত যে হয় সেধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়। রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট প্রভৃতি পর্যায়ের ভিতর দিয়ে যায়। তবে একইরকমভাবে নয়, একই অর্থে নয়।

যে রেনেসাঁস চার শতাব্দীকাল সময় পেয়েছে ও যে রেনেসাঁস সবে আরম্ভ হয়েছে তাদের একটির সঙ্গে অপরটির তুলনা করলে দ্বিতীয়টিকে নিষ্প্রভ মনে হবেই। তা ছাড়া ইউরোপের পরিমন্ডল ও ভারতের পরিমন্ডল তো এক নয়। ইতিহাস ও ভূগোল, সমাজ ও ধর্ম, জাতি ও বর্ণ তাদের বিভিন্ন করেছে। তবে কিছু প্রচ্ছন্ন মিলও ছিল। সংস্কৃত ও ল্যাটিন ভাষা সুদূর অতীতে এক পরিবারের ভাষা ছিল। আর সেই পরিবারটির আদিভূমি ছিল সম্ভবত একই। আদিভূমি যেখানেই হোক সেটার স্মৃতি কোনো পক্ষেরই নেই। ভারতীয়দের বিশ্বাস ভারতই সেই আদিভূমি। তাই যদি হয়ে থাকে তবে ইংরেজরা আমাদের ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। যা নিয়ে এসেছে সেটা সম্পূর্ণ পরকীয় নয়। বেশ চেনাচেনা ঠেকছে।

রামমোহন রায় বা স্যার উইলিয়াম জোন্স অনাত্মীয়তা বোধ করেননি। একজন প্রাচ্যের প্রতি ও অপরজন পাশ্চাত্যের প্রতি জ্ঞাতিসুলভ মনোভাব পোষণ করেছিলেন। একজনের কৌতূহল প্রাচীনের প্রতি, অপরজনের আধুনিকের প্রতি। অবশ্য এটাও ঠিক যে একজন হলেন স্বাধীন দেশের লোক ও অপরজন পরাধীন দেশের। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র গণনা? রামমোহনও তো ভাবতে পারতেন যে তিনি অতি প্রাচীন দেশের সন্তান, তাঁর উত্তরাধিকার পরাধীনতার দ্বারা আচ্ছন্ন হবার নয়। আর পরাধীনতাও তাঁর দেশের পক্ষে মঙ্গলের হতে পারে। বিধাতা কতভাবেই-না নিজের কাজ করে যান। আর যে ব্যক্তি বর্ণে ব্রাহ্মণ সে-ব্যক্তি যদি বর্ণে শ্বেত না হন তো কী আসে-যায়! বা বর্ণও তো একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ।

রামমোহনের মধ্যে, দ্বারকানাথের মধ্যে, বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে মর্যাদাবোধ ছিল তা সমকক্ষের। তাঁরা মাথা উঁচু রেখেই করমর্দন করেছিলেন। তবে অযথা শ্রেষ্ঠতার বড়াই করেননি। ভারত সব বিষয়েই বড়ো এটা তাঁদের বক্তব্য ছিল না। সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইংরেজদের ব্যবহার বদলে যায়। তারা ভারতীয়দের মর্যাদাবোধে আঘাত করে। যে ব্যক্তি বর্ণে ব্রাহ্মণ সেব্যক্তিও তাদের চোখে কৃষ্ণবর্ণ। যে ব্যক্তি মোগল ঘরানা বা রাজপুত ঘরানা সেব্যক্তিও তাদের চোখে নিম্নবর্ণ। ‘হোয়াইট ম্যানস ব্যার্ডন’ বা ‘লেসার ব্রিডস’ শুনলে কার-না রক্ত গরম হয়ে ওঠে! অসহযোগই তখন মর্যাদারক্ষার স্বাভাবিক নীতি। নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে কেউ কাছে যেতেও চায় না, সেলাম করতেও চায় না, শিখতেও চায় না, শেখবার কিছু আছে এটা স্বীকার করতেও চায় না। এমনি করে দেশাভিমান ও জাত্যাভিমান জন্মায়। বর্ণবিদ্বেষ দেখা দেয়। যাঁরা ইংরেজ শাসনকে বিধাতার বিধান বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁদের পৌত্ররাই তাকে শয়তানের শাসন বলে বর্জনের সংকল্প নেন।

পরবর্তী কালকে পূর্ববর্তী কালের উপর আরোপ করা উচিত নয়। সকাল বেলা যেটা নিয়ে উৎসাহ বিকেল বেলা সেটা নিয়ে অবসাদ। সকাল বেলা জোয়ার বিকেল বেলা ভাটা। দেশের ইতিহাসেও একই ব্যাপার। রেনেসাঁসের জোয়ার নেমে যাবার পর ভাঁটার সময় আসে। তখন তার সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। যারা তার কাছে আরও অনেক কিছু আশা করেছিল তারা হতাশ হয়। যাদের বদ্ধ ধারণাগুলো তার কাছ থেকে ধাক্কা খেয়েছে তারা তাকে ক্ষমা করে না। রেনেসাঁস মানুষকে দেবতাও করে না, দানবও করে না। সেদেবতাও মানে না। তার অধ্যয়নের বিষয় হচ্ছে মানুষ আর বিশ্বপ্রকৃতি, ইহলোক আর ইহকাল। পারে তো এইখানেই সেআদর্শ জগৎ গড়ে তুলবে। না পারে তো বাস্তবকে নিয়েই ঘর করবে। সমালোচকরা এতে সন্তুষ্ট নন। তাই দুই দিক থেকে কথা শুনতে হয়।

পূর্ববর্তী কালে ইংরেজ শাসন ছিল এক জিনিস, রেনেসাঁস ছিল আরেক। ব্রিটিশ অধিকৃত সব অঞ্চলে রেনেসাঁস হয়নি, হয়েছিল যেখানে একদল অগ্রদূত ছিলেন। পরবর্তী কাল একথা ভুলে যায়। তার দৃষ্টিতে রেনেসাঁস ও ইংরেজ শাসন একাকার। আরও পরবর্তী কালের চোখে ইংরেজ ও বুর্জোয়ার পিন্ডি রেনেসাঁসের ঘাড়ে চাপানো হয়। তখন সেআর রেনেসাঁসের বলে স্বীকৃতি পায় না। সেটা তাহলে কী? একটা বিভ্রম? ইংরেজ আর বুর্জোয়া তো আরও অনেক অঞ্চলে ছিল। কোথায় তাদের রেনেসাঁস? মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বড়োলোকের অভাব তো ছিল না। ওরাও বাস করত ইংরেজ শাসনে। কোথায় ওদের রেনেসাঁস? আসলে ইংরেজ শাসন ও রেনেসাঁস এক জিনিস নয়, বুর্জোয়া প্রাধান্য ও রেনেসাঁস নয় এক জিনিস।

যে-দেশ যত প্রাচীন নবীনত্বের প্রয়োজন তারই তত বেশি। তাকেই যুগে যুগে নবীন হয়ে উঠতে হয়। সেনবীনত্ব বাইরের সাজবদল বা খোলসবদল নয়। অন্তরে যদি রং ধরে তাহলেই তা নবীনত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার তথা ভারতের অন্তরেও রং ধরেছিল, শুধু অফিসে আদালতে বা দোকানে বাজারে নয়। বাইরে থেকে কত বার কত বিদেশি এসেছিল, কেউ-বা লুটপাট করতে, কেউ বাণিজ্য করতে, কেউ রাজত্ব করতে। বাইরে থেকে এলেও তারা একই যুগের মানুষ। তারা সমকালীন। কিন্তু এই প্রথম দেখা গেল তারা ভিন্ন যুগে বাস করছে, তারা আধুনিক যুগের মানুষ। আর তাদের তুলনায় ভারতের লোক তিন-চার শতাব্দী পেছিয়ে রয়েছে। আধুনিক যুগে পৌঁছোয়নি। এই যে কালগত ব্যবধান এটা দেশগত ব্যবধানের চেয়ে দুরতিক্রম্য। একে অতিক্রম করার একমাত্র উপায় কালোপযোগী শিক্ষা ও সম্ভব হলে সমুদ্রযাত্রা। কালোপযোগী শিক্ষাই অন্তরে রং ধরায় ও সমুদ্রযাত্রা সেই রংকে আরও উজ্জ্বল করে।

যাঁরা কালোপযোগী শিক্ষাও গ্রহণ করেননি, সমুদ্র পার হয়ে দেশভ্রমণও করেননি তাঁরা আধুনিক যুগের মানুষই নন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেহধারণ করলেও তাঁদের মন মধ্যযুগীয়। এঁরাও বই কাগজ লেখেন। সাহিত্যের ইতিহাসে এঁদেরও স্থান আছে। কিন্তু রেনেসাঁসের প্রবাহ এঁদের নিয়ে নয়। যাঁরা মনেপ্রাণ আধুনিক তাঁরাই রেনেসাঁসের পথিকৃৎ পথিক। রামমোহনের ঘরোয়া পড়াশোনা ছিল কালোপযোগী ও অতি সহজেই তিনি বহু শতাব্দী অতিক্রম করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে উপনীত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়েরও ঘরোয়া পড়াশোনা ছিল ইংরেজি। সমুদ্রযাত্রা অবশ্য তাঁর বেলা ঘটেনি। তবে ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিল। সেটাই সমুদ্রযাত্রার কাজ করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই নবীনত্ব আসে যা দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কদের সঙ্গে আসেনি। সেসময় এসেছিল আরবি ফরাসি শিক্ষা। সেশিক্ষা বিদেশি হলেও আধুনিক ছিল না। ছিল মধ্যযুগীয়। কয়েকটা বিষয়ে কিছু উনিশ-বিশ ছিল। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষার মতো সব বিষয়ে অগ্রসর নয়। আরবি ফরাসি শিক্ষাও ছিল থিয়োলজি কবলিত। কারও সাধ্য ছিল না স্বাধীনভাবে চিন্তা করে বা প্রকাশ করে। আবিষ্কার, উদ্ভাবন, পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োগ থিয়োলজির সঙ্গে বিরোধ ডেকে আনত। সেবিরোধে পুরাতন বিশ্বাসের জিত নিশ্চিত। আর নতুন চিন্তার শাস্তি ভয়ংকর। আরবভাষী জগতে যেটুকু এসেছিল সেটুকু তুর্কদের ভারতে প্রবেশ করার পূর্বেই থেমে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নতুন চিন্তা জয়ী হয়, পুরাতন বিশ্বাস হেরে গিয়ে পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখে।

রুমানিয়া থেকে একজন লেখক এসেছিলেন। বললেন, ‘চার হাজার বছরের বহমান সভ্যতা আপনাদের। এর কোনোখানেই ছেদ পড়েনি। ধারাভঙ্গ হয়নি। আমাদের কিন্তু বার বার তিন বার ডিসকন্টিনিউইটি ঘটেছে। একবার যখন প্রাচীন গ্রিস রোম যায়, খ্রিস্টধর্ম আসে। আবার, যখন রেনেসাঁস হয়। শেষ বার, যখন মার্কসবাদী এসে ওলটপালট করে। এইসব ডিসকন্টিনিউইটি নিয়ে ইউরোপের সভ্যতা।’

পূর্ব ইউরোপের সভ্যতা বলুন। পশ্চিম ইউরোপের লোক ওই তিন বারেরটা মানে না। তাদের বেলা এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো ওলটপালট সফল হয়নি। তাহলে ওদের চোখে ডিসকন্টিনিউইটি যা তা রেনেসাঁসের সময়ই দ্বিতীয় ও শেষ বার ঘটেছে।

আর আমাদের বেলা? একথা যদি সত্য হয় যে আমাদের সভ্যতার ধারাভঙ্গ এক বারও ঘটেনি তবে বাংলার রেনেসাঁস একটা কথার কথা। যার মৃত্যু নেই তার নবজন্মও নেই। যার নিদ্রা নেই তার নবজাগরণও নেই। এদেশে কত বার গ্রিক শক কুষাণ হূন এসেছে, তেমনি তুর্ক মোগল পোর্তুগিজ ইংরেজ এসেছে। সাময়িক এক-একটা তরঙ্গ উঠে আবার মিলিয়ে গেছে। এই যাকে রেনেসাঁস বলা হচ্ছে এও তেমনি একটা তরঙ্গ।

রুমানিয়ান লেখক আমাকে ভাবিয়ে তোলেন। ভেবে দেখি এদেশেও মাঝে মাঝে ছেদ পড়েছে। ধারাভঙ্গ হয়েছে। নয়তো মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা মরুপথে হারিয়ে গেল কী করে? সেই নাগরিক যুগের সঙ্গে বৈদিক আরণ্যক যুগের ধারাবাহিকতা কোথায়? সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীনতর সভ্যতার অস্তিত্ব পর্যন্ত পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের জানা ছিল না। পঞ্চনদের বৈদিককেই আমরা আদি বলে বিশ্বাস করতুম। কারণ ঋগবেদের চেয়ে পুরাতন শাস্ত্র পৃথিবীতেই নেই। কিন্তু পাষাণের সাক্ষ্য শাস্ত্রের চেয়েও প্রামাণিক। একদিন স্বীকার করতেই হবে যে সিন্ধু সভ্যতার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেদ পড়ে। ছেদের পর পুনরারম্ভ। বৈদিক আর্যদের আবির্ভাব। সম্ভবত বহিরাগত আক্রমণকারী রূপে।

এই ছেদটার কথা খননকার্যের পূর্বে আমাদের অজ্ঞাত ছিল। এটা এত পুরাতন যে লোকমানসেও কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি। সেইজন্যে মনে হয়েছে আমাদের সভ্যতা চিরপ্রবহমাণ। যা গ্রিস রোম মিশরের নয়। কিন্তু একথা আমরা সবাই জানতুম যে বৌদ্ধ ধর্ম একদিন অস্তমিত হয়, ইসলাম একদিন উদিত হয়। প্রায় একই ঐতিহাসিক লগ্নে। বৌদ্ধদের যখন গৌরবের দিন ছিল তখন সেগৌরব মুসলিমদের চেয়ে কোনো অংশে খাটো ছিল না। আর মুসলিমদের যখন গৌরবের দিন ছিল তখন সেগৌরব বেদানুগ হিন্দুদের চেয়ে কোনো অংশে খর্ব ছিল না। ভারতের ইতিহাসে বেদানুগ হিন্দুর পাশাপাশি রয়েছে আর-একটি প্রতিবাদী শক্তি। সেটি এককালে বৌদ্ধ, পরে মুসলিম। এদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায় না। একটি যে অপরটির উচ্ছেদের হেতু তাও নয়। কিন্তু একটির শূন্যতা অপরটি পূরণ করে। একের প্রস্থান, সঙ্গে সঙ্গে অপরের উত্থান।

তাই যদি হয় তবে আমাদের ইতিহাসেও বার দুই ডিসকন্টিনিউইটি ঘটেছিল। ইতিহাস লেখার অভ্যাস নেই বলে কেউ লিপিবদ্ধ করেনি। লোকে ভুলে গেছে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাকে; তেমনি অশোক কনিষ্ক হর্ষবর্ধন ও ধর্মপালকে। যদিও বাণভট্টের হর্ষচরিত ছিল সাক্ষী দিতে।

অন্য একদিক থেকেও বিবেচনা করতে পারি। সংস্কৃত ভাষার গৌরবের দিন যখন গেল তখন দেখা গেল রাজকর্মে তার স্থান নিয়েছে পারসিক আর জনজীবনে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, তামিল প্রভৃতি অসংস্কৃত ভাষা। এদের অধিকাংশই সংস্কৃতের সন্তান বলে গণ্য করা হয়, কিন্তু জয়দেবের ভাষা ও চন্ডীমঙ্গলের ভাষার মাঝখানে নিশ্চয়ই একটা ধারাভঙ্গ ঘটেছিল। মহারাষ্ট্রের একজন সংস্কৃতজ্ঞ পাঠক জয়দেব পাঠ করার পর চন্ডীদাস পড়তে বসলেই তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করবেন যে পরম্পরাটা ধারাবাহিক নয়। মাঝখানে একপ্রকার ডিসকন্টিইনিউইটি। এটা না হলে বাংলা হিন্দি প্রভৃতি ভাষার উদ্ভবই হত না। সংস্কৃত ভাষা সাধারণ লোকের হৃদয়াবেগ প্রকাশের বাহন ছিল না। যাত্রায়, পাঁচালিতে, কীর্তনে, গীতিকায় কেউ সংস্কৃত শুনতেও চায় না, বুঝতেও পারে না। তাঁদের মনের আনন্দ জোগায় তাদেরই মুখের ভাষা।

এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে সংস্কৃতের পর বাংলা ও বৌদ্ধ ধর্মের পর ইসলাম অবিকল সমকালীন না হলেও মোটামুটি একই যুগের ঘটনা। সম্পর্কটা কাকতালীয়। আমাদের মধ্যযুগকে দুই ভাগে বিভক্ত করলে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। ইসলামের ও বাংলার পূর্ব ছিল মধ্যযুগের প্রথমার্ধ। পরে এল দ্বিতীয়ার্ধ। জয়দেব প্রথমার্ধের কবি। চন্ডীদাস দ্বিতীয়ার্ধের কবি। মাঝখানে একটা ছেদ। মধ্যযুগের তাতে অবসান হল না। যুগটা অবিচ্ছিন্নই রয়ে গেল। তবু যে পরিবর্তনটা ঘটল সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের দিক থেকে, ভাষার দিক থেকে লোকে আরও গণতান্ত্রিক হল। ধর্ম বলতে শুধু ইসলাম নয়, মঙ্গলকাব্য ও পদাবলির ধর্মও বোঝায়।

সংস্কৃতের স্থান নেয় রাজকর্মে পারসিক, জনজীবনে বাংলা হিন্দি প্রভৃতি ভাষা। কিন্তু পুরাতন জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাষা সংস্কৃতই রয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরবি ফারসি। সেকালের শিক্ষিত শ্রেণি বলতে বোঝাত টোল চতুষ্পাঠী মাদ্রাসায় শিক্ষিত হিন্দু- মুসলিম উচ্চতর বর্ণ বা উচ্চতর শ্রেণি। যে পদ্ধতিতে এঁরা শিক্ষালাভ করতেন সেটাকে পশ্চিমে বলা হত স্কলাস্টিক পদ্ধতি। ইউরোপে যখন নতুন বিদ্যা প্রবর্তিত হয় তখন পদ্ধতিটাই যায় পালটে। স্বাধীন চিন্তাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। শিষ্যরা গুরুদের সঙ্গে তর্ক করতে সাহস পায়, গুরুর মত খন্ডন করতে পারলে গুরু রুষ্ট হন না। গুরুবাদ জিনিসটাই উঠে যায়। তবে মনে রাখতে হবে যে এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে; চার্চে নয়। কিংবা চার্চ-শাসিত বিভাগে নয়। যেমন থিয়োলজিতে নয়। নতুন বিদ্যা নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন অনুসন্ধান, স্বাধীন গবেষণা সম্ভব হয়।

এদেশে নতুন বিদ্যার বাহন হয় ইউরোপীয় আদর্শের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের পদ্ধতি স্কলাস্টিক নয়। তাদের ভাষা সংস্কৃত বা আরবি ফারসি নয়। আরম্ভটা সম্পূর্ণ আধুনিক। তাই পুরাতনের সঙ্গে একটা ছেদ পড়ে যায়। শিক্ষিত শ্রেণি বললে এখন থেকে বোঝায় ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত শ্রেণি। সংস্কৃত বা আরবি ফারসিতে শিক্ষিতদের ফেলে এরা এগিয়ে যায়।

সংস্কৃত শিক্ষায় যাদের অধিকার ছিল না, পারসিক শিক্ষায় যাদের প্রয়োজন ছিল না, তারাও ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পায় ও তার প্রাঙ্গণে দলে দলে যোগ দেয়। পাঠশালা বাদ দিলে এর মতো গণতান্ত্রিক শিক্ষা ভারতের ইতিহাসে বৌদ্ধ যুগের পূর্বে ও পরে আর কখনো দেখা যায়নি। এর বিপক্ষে ছিলেন গোঁড়া মুসলমান ও গোঁড়া হিন্দুরা। যে কারণে ইউরোপের গোঁড়া খ্রিস্টানরা বিপক্ষে ছিলেন সেই কারণে ভারতের গোঁড়ারাও। তাঁদের আশঙ্কা নতুন বিদ্যা এসে তাঁদের চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে ঘা দেবে। তাঁদের পায়ের তলার মাটি নড়ে গেলে মন্দির মসজিদ সব টলে পড়বে। সমাজ সংসার সব ধ্বংস হবে। ছোটোলোকদের বাড় বাড়বে।

ইউরোপের গোঁড়া খ্রিস্টানরা নতুন বিদ্যার প্রবর্তকদের একদা পুড়িয়ে মেরেছিলেন। তাঁদের মতে ওটা শয়তানি বিদ্যা। কয়েক শতাব্দী পরে ওই শয়তানি বিদ্যাই বয়ে নিয়ে আসেন ইউরোপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা। তার থেকে এদেশের গোঁড়াদের ধারণা জন্মায় যে, ওটা খ্রিস্টানি বিদ্যা, ওর লক্ষ্য খ্রিস্টান বানানো।

ওটা অশাস্ত্রীয়, ওটা ম্লেচ্ছ, ওটা পাশ্চাত্য, ওটা বিজাতীয়, ওটা জড়বাদী ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করা সারা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরেই চলে, তা সত্ত্বেও ওর প্রসার রোধ করা যায় না। যারা কোনো কালেই উচ্চশিক্ষার ধারে-কাছেও আসতে পারত না তারাও নতুন বিদ্যামন্দিরে প্রবেশ পায় ও স্বাধিকার সচেতন হয়।

কিন্তু সংস্কৃত ও আরবি ফারসির মতো ওর মাধ্যমটা ছিল ইংরেজি। সেটা সর্বজনযোগ্য নয়। রামমোহন রায় ও তাঁর সহযোগীরা আশা করেছিলেন অবিলম্বে বাংলা হিন্দি ভাষাতেও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিবেশন করতে পারা যাবে, কিন্তু তাঁদের সেআশা এক শতাব্দীর মধ্যেও পূর্ণ হয় না। প্রবর্তকরা এর জন্যে দায়ী নন। দায়ী আমাদের ভাষাগুলির অবস্থা। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে বাংলা হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় যিনি যা-ই লিখতেন পদ্য আকারে লিখতেন। প্রথম ছেদ পড়ল যখন ফোর্ট উইলিয়ামের পন্ডিত বা মুনশিরা জীবনীগ্রন্থ লিখলেন বাংলা গদ্যে। সংবাদপত্রেও বাংলা গদ্য ব্যবহার করলেন মিশনারিরা। এরপর পাঠ্যপুস্তকও রচিত হয় গদ্যে। ধর্মগ্রন্থও অনুবাদ করা হয় গদ্যে।

বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশ কতক পরিমাণে সংস্কৃত বা পারসিক শিক্ষিত লেখকদের হাতে হলেও বিপুল পরিমাণে হয় ইংরেজি শিক্ষিত লেখকদের হাতে। পদ্যের মতো গদ্যে অশিক্ষিত পটুত্বের স্থান ছিল না। থাকলে সেটা রূপকথায় বা ব্রতকথায়। তবে এটাও লক্ষ করবার মতো যে বাংলা গদ্য গোড়ার দিকে যেমন দুর্বোধ্য সংস্কৃত বা পারসিকবহুল ছিল, পরে তেমন নয়। গদ্য ধীরে ধীরে সহজ ও সরল হয়ে আসে। সাধুরূপ ছেড়ে চলিতরূপ ধরে। ইউরোপের ইতিহাসে, চীনের ইতিহাসেও এর নজির আছে।

স্কুল কলেজ বিদ্যালয়ের মতো ছাপাখানারও ভূমিকা ছিল এই যুগপরিবর্তনে। ছাপাখানা ছড়িয়ে দেয় রাশি রাশি বই কাগজ। এত কম দামে যে সাধারণ লোকও কিনতে পারে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির সম্পর্কটার একটা কারণ তো ছিল বইপত্রের দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্যতা। ছাপাখানা উদ্ভাবনের পর দেখা গেল যারা কোনো কালেই বইপত্র কিনত না তারাও কিনছে, যারা কিনতে পারছে না তারাও অন্যের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ছে। পাবলিক লাইব্রেরিও গড়ে ওঠে।

ইংরেজি শিক্ষিত ধনী বাঙালিদের শখ ছিল সাহেবদের মতো বাড়ি করা, গাড়ি চড়া, আসবাব কেনা। সেইসঙ্গে আরও একটা শখ ছিল বিলিতি বই ও শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করা। তাঁদের লাইব্রেরিতে সমসাময়িক ইংল্যাণ্ডের সবরকম বই দেখতে পাওয়া যেত। তাঁদের শিল্পশালায় সমসাময়িক ইউরোপের চিত্র ও ভাস্কর্যের নমুনা বা নকল।

সরকারি চিড়িয়াখানা ছাড়াও ধনীদের নিজেদের চিড়িয়াখানা ছিল। সরকারি বটানিক গার্ডেন ছাড়াও ধনীদের নিজেদের আমদানি গাছপালার বাগান ছিল। হেন মুলুক ছিল না যেখান থেকে জাহাজে করে ফলটা ফুলটা পাখিটা জন্তুটা না আসত, আর সাহেবদের দেখাদেখি বাবুদের কৌতূহল না জাগাত। রেল টেলিগ্রাফ ট্রাম ইত্যাদিও এমনই করে আসে ও যাদের কৌতূহলী করে তারা কেবল সাহেব নয়, বাবু নয়, সাধারণ লোক। দেখতে দেখতে লোকের অভ্যাস বদলে যায়। তারা রেড়ির তেল ছেড়ে কেরোসিন তেল ধরে। তারপর কেরোসিনের বাতি ছেড়ে গ্যাসের বা বিজলির বাতি। তেমনি ঘুঁটে কিংবা কাঠ ছেড়ে কয়লা জ্বালায়। পুরুষের চুল ছেঁটে সাহেবদের মতো করা হয়। টিকি কাটা যায়। মেয়েদের গায়ে সেমিজ সায়া ওঠে।

দেশটা একটু একটু করে পাশ্চাত্য প্রভাবে পড়ে। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা আধুনিক যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে নেয়। কোনটা পাশ্চাত্য আর কোনটা আধুনিক এটা পরিষ্কার ছিল না। পাশ্চাত্যকে আধুনিক ও আধুনিককে পাশ্চাত্য বলে ভ্রম হত। এখনও হয়। জাতীয়তাবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশীলদের মনে একটা বিরূপ ভাবও জন্মায়। কেন আমাদের কি আপনার বলতে কিছুই নেই যে আমরা পরেরটা নেব?

নির্বিচারে কোনোটাই নেওয়া উচিত নয়। পরেরটাও নয়, পূর্বপুরুষেরটাও নয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে যেমন পরেরটা নেবার সময় আতিশয্য দেখা গেল শেষ পাদে তেমনি পূর্বপুরুষেরটা নেবার বেলা আতিশয্য। এক শতাব্দীর মধ্যেই চাকা ঘুরে গিয়ে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। ‘দাও ফিরে সেঅরণ্য, লহো এ নগর।’ প্রাচীন ভারতের তপোবন না হলে ব্রহ্মচর্যাশ্রম হবে না, ব্রহ্মচর্যাশ্রম না হলে জাতীয় শিক্ষা হবে না। রেখে দাও তোমার হিন্দু কলেজ আর ডিরোজিয়ো।

একটা চোখ প্রাচ্যের উপরে আরেকটা চোখ প্রতীচ্যের উপরে, একটা চোখ প্রাচীনের উপরে একটা চোখ আধুনিকদের উপরে—এই দ্বৈত রামমোহনের মধ্যেও ছিল। কিন্তু তাঁর বিচারবুদ্ধি ছিল একান্ত সক্রিয়। গা-ভাসানো আতিশয্য তাঁর স্বভাবে ছিল না। তিনি আধুনিক ইউরোপকে আহবান করলেও প্রাচীন ভারতের সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মধ্যযুগে সে-সম্পর্ক বিকৃত হয়েছিল। একদিকে তিনি যেমন নতুন বিদ্যার প্রধান প্রবর্তক অপরদিকে তেমনি পুরাতন ধর্ম ও সমাজের মুখ্য সংস্কারক। সংস্কারকের কাজ তিন-চার হাজার বছর আগে ফিরে যাওয়া নয়, তাকে ফিরিয়ে আনাও নয়, তার মূল সত্যকে পুনরাবিষ্কার করা।

আধুনিক ইউরোপ এত বড়ো একটা জাজ্বল্যমান সত্য যে তাকে উপেক্ষা করার সাধ্য কোনো শিক্ষিত ব্যক্তির ছিল না। অপরপক্ষে ভারতও আজকের দেশ নয়, এর ছিল অতি পুরাতন এক সভ্যতা ও নানা বিকৃতি সত্ত্বেও তার যে সারসত্য তাকেও উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল। মিশনারিরা নিজেদের ধর্মকে বড়ো করে দেখানোর জন্যে এদেশের ধর্মকে হেয় করে দেখালেও ভাষাতত্ত্ববিদ বহু ইউরোপীয় ছিলেন যাঁরা প্রাচীন প্রাচ্যবিদ্যাকে ইংরেজি ফরাসি ও জার্মান অনুবাদসূত্রে পশ্চিম ভূখন্ডের সর্বত্র পৌঁছে দেন। রামমোহনের অনুবাদগুলিও পশ্চিমে প্রচারিত হয়। অপরাপর ভাষায় পুনরায় অনূদিত হয়। রাজা যখন ইউরোপে যান তার আগেই যায় তাঁর লেখা, তাঁর নাম।

এই যে ইউরোপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ শুরু হয়ে যায় এর জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হলেও পশ্চিমযাত্রীর অভাব হয় না। যান সংস্কারবিরোধী হিন্দুরাও। ইউরোপবিরোধী ভারতীয়রাও। ম্লেচ্ছ বিদ্বেষে যাঁরা অন্ধ তাঁরাও যান কালাপানির ওপারে। এমনি করে আচার অলক্ষে শিথিল হয়। বিচারও ধীরে ধীরে উদার হয়। ওদের সব কিছু খারাপ আর আমাদের সব কিছু ভালো এ মনোভাব আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে ক্ষয় হয়। কিন্তু ‘ওরা স্বাধীন আর আমরা পরাধীন’ এ অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী অভিমান থেকে আসে ভারত সম্বন্ধে উচ্চতর ধারণা, পশ্চিম সম্বন্ধে নিম্নতর। ওরা জড়বাদী, আমরা অধ্যাত্মবাদী, আমরাই শ্রেষ্ঠ।

পাশ্চাত্য পন্ডিতদের অবিরাম সংস্কৃত ও পালি চর্চা তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে গুহাচিত্র ও শিলালিপি আবিষ্কারের ফলে ভারতের যে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব রচিত হয় তাতে ভারতের প্রাচীন গৌরব বৃদ্ধি পায়। এমন প্রাচীন গৌরব যে-দেশের সে-দেশ আধুনিক ইউরোপের শিষ্য হবে না গুরু হবে! যন্ত্রতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ওদের কাছ থেকে শেখবার নেই, এই ধারণায় উপনীত হন যাঁরা জার্মান পন্ডিতদের দৃষ্টিতে প্রাচীন ভারতকে দেখেন। মোক্ষমূলর বলেছে ‘আর্য’। এই আর্যামিটা রামমোহনের যুগে ছিল না। হঠাৎ শোনা গেল আমরা আর্য জাতি, আমাদের ভাষা আর্য ভাষা, ধর্ম আর্য ধর্ম। আর আর্যই জগতের শ্রেষ্ঠ। একটা পরাধীন জাতির পক্ষে এটা কত বড়ো একটা সান্ত্বনা।

অতীত গৌরবের পুনরাবৃত্তির নাম রেনেসাঁস নয়, রিভাইভাল। রেনেসাঁস অতীতের থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করলেও যা করতে চায় তা নতুন, নিত্যনতুন। যা জানতে চায় তা নতুন, নিত্যনতুন। যাদের বিশ্বাস বেদে বা বাইবেলে বা কোরানে সব কিছু আছে, তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই, তাদের বিশ্বাস রেনেসাঁসের অনুকূল নয়। কারণ রেনেসাঁস নতুন করে জানতে চায়, নতুন করে বিচার করতে চায়। পুনর্বিচার না হলে রেনেসাঁস হয় না। তার ফলে খানিকটা ধারাভঙ্গ হবেই। নয়তো সেটার নাম রেনেসাঁস নয়।

ধর্ম ও সমাজসংস্কারেও খানিকটা ধারাভঙ্গ হয়। সেটা যাদের সহ্য হয় না তারা ধর্ম সমাজ সংস্কারেও রাজি হয় না। বলে, ওসব পরে। আগে তো দেশ স্বাধীন হোক। স্বাধীনতার জন্যে যারা সবচেয়ে অধীর, ধর্মসংস্কারের বেলা সমাজসংস্কারের বেলা তারা সবচেয়ে ধীর। এমনকী একেবারেই বিরূপ। জাতীয়তাবাদ প্রথমে ছিল ধর্মসংস্কারের সঙ্গে অভিন্ন। পরে দেখা গেল জাতীয়তাবাদীদের বৃহত্তর ভাগ ধর্মসংস্কারকে মনে করে জাতীয় ঐক্যবিরোধী। ঐক্যের যদি প্রয়োজন থাকে তবে যেসব প্রশ্নে তীব্র মতভেদ সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হবে। নয়তো জোট ভেঙে যাবে। ভোটেও হারতে হবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদ তার প্রথম পাদের প্রতি বিমুখ। রেনেসাঁসের প্রতি বিমুখ কাউন্টার রেনেসাঁস। রিফর্মেশনের প্রতি বিমুখ কাউন্টার রিফর্মেশন। আধুনিক ইউরোপের প্রতি বিমুখ প্রাচীন ভারতীয় পুনরুজ্জীবন বা রিভাইভাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি বিমুখ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। তা সত্ত্বেও নতুন বিদ্যার প্রসার বন্ধ থাকে না। সেই সূত্রে ইউরোপ থেকে যে ভাবধারা আসে তা সাহিত্যকে ও শিল্পকে নতুন সঞ্জীবনী শক্তি জোগায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের তুলনায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্য একটা নতুন জগৎ। গদ্যবন্ধে লেখা হয় হালকা ও গম্ভীর বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ, উপন্যাস, জীবনী, নাটক। পরে রম্যরচনা ও ছোটোগল্প। পদ্যে একা মাইকেলই লেখেন এপিক, লিরিক, সনেট। বেশিরভাগই পশ্চিমের আদর্শে। বিষয়টা যদিও স্বদেশি। এর পরে আর কেউ ভারতচন্দ্রকে বা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে পূর্বসূরি বলে গ্রহণ করেন না। করেন মাইকেলকে। মাইকেলের প্রদর্শিত পন্থায় চলতে যাঁদের অনাগ্রহ তাঁরা বৈষ্ণব পদাবলি, কালিদাস ও শেলি কিটস ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের পথে চলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি কবিদের সঙ্গে তাঁদের মনের অমিল। নাটক যাঁরা লেখেন তাঁরা শেক্সপিয়রকেই আদর্শ করেন। কালিদাস ভবভূতিকে নয়। বিষয় হয়তো পৌরাণিক হিন্দু, কিন্তু রীতি এলিজাবেথান বা ভিক্টোরীয়।

বাংলার আধুনিক শিক্ষা যেমন প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় শিক্ষার থেকে ভিন্ন, বাংলার আধুনিক সাহিত্যও তেমনি প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে আর অভিন্নতায় পরিণত করা যেত না। সিপাহি বিদ্রোহের ফলাফল অন্যরূপ হলেও রেনেসাঁসের ফসল অন্যরূপ হত না। অমন যে স্বাধীন দেশ জাপান তার আধুনিক যুগ যখন এল তখন মধ্যযুগের ঐতিহ্য ধীরে ধীরে অপগত হল। নতুন বিদ্যা সে-দেশেও প্রবর্তিত হয় ইংরেজি ফরাসি জার্মান ইটালিয়ান ভাষায়। এক-একটা বিষয় এক-একটা ভাষায় পড়ানো হত। সাহিত্য যারা পড়ত তারা ফরাসিতে। চিকিৎসাবিদ্যা যারা পড়ত তারা পড়ত জার্মান ভাষায়। আইন ও রাজনীতি যারা পড়ত তারা পড়ত ইংরেজিতে। ইটালিয়ান ভাষায় কী পড়ত জানিনে, বোধ হয় আর্ট।

আলো হাওয়ার যেমন দেশ-দেশান্তর নেই জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও তেমনি দেশ-দেশান্তর নেই। সাহিত্যের বেলাও সেই কথা খাটে। বাংলা সাহিত্যের পুরাতন যুগেও আরবি ফারসি থেকে বড়ো কম নেওয়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণায় সেই লুপ্ত অধ্যায়টির উদ্ধার হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্যই পুরাতন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র উৎস ছিল না। সুতরাং ইংরেজি সাহিত্য যদি পরে অন্যতম উৎস হয়ে থাকে তার জন্যে লজ্জিত হবার কারণ নেই। ইংরেজিও তো বিভিন্ন উৎস থেকে রস সংগ্রহ করে নবীন হয়েছে। এর জন্যে ইংরেজরা কেউ লজ্জিত নয়।

রাজা রামমোহনই যে আমাদের রেনেসাঁসের সূত্রধার এ বিষয়ে রেনেসাঁস বিশ্বাসীরা একমত। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তাঁর নাম না থাকলেও নতুন বিদ্যার তিনিই যে প্রধান প্রবক্তা লর্ড আমহার্স্টকে লিখিত তাঁর পত্রই এর প্রমাণ।

রামমোহনের বক্তব্য:

It had been intended to keep the British nation in ignorance of real knowledge, the Baconian Philosophy would not have been allowed to displace the system which was the best calculated to perpetuate ignorance. In the same manner the Sanskrit system of education would be the best calculated to keep this country in darkness, if such had been the policy of the British legislature. But as the improvement of the native population is the object of the Government, it will consequently promote a liberal and enlightened system of instruction embracing Mathematics, Natural Philosophy, Chemistry, Anatomy, with other useful sciences, which may be accomplished with the sums proposed by employing a few gentlemen of talent and learning, educated in Europe and providing a college furnished with necessary books, implements and other apparatus.

পূর্ব প্রচলিত সিস্টেমটাই তাঁর মতে অজ্ঞতাকে অক্ষয় করার জন্যে কল্পিত। তার পরিবর্তে চাই একটি উদার আলোকিত সিস্টেম। তাতে থাকবে গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর শরীর ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা, তা ছাড়া অন্যান্য আবশ্যক বিজ্ঞান। রামমোহন একে উপরের দিকে নিবদ্ধ রাখতে চাননি। ইংরেজিতেও না। একে বাংলার সহায়তায় জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া চলে।

শিক্ষার সিস্টেম পরিবর্তন না করলে সমাজের বা রাষ্ট্রের পরিবর্তন করা যেত না। তা বলে এমন কথা বলা চলে না যে শিক্ষার সিস্টেম পালটালেই আর সব সিস্টেম পালটাবে। একটি অতি পুরাতন দেশের হাজার হাজার বছরের বদ্ধমূল ধর্মের সিস্টেম, সমাজের সিস্টেম, রাষ্ট্রের সিস্টেম, উৎপাদনের সিস্টেম অত সহজে উৎপাটিত হতে পারে না। ইউরোপেও যাঁরা নতুন বিদ্যার প্রবর্তক তাঁরাও অতদূর যাবার কথা ভাবতে পারেননি। আমাদের রেনেসাঁসের নায়করাও আমূল পরিবর্তনের বিধান দেননি। কিন্তু যেখানে পরিবর্তন মাত্রেই নিষিদ্ধ সেখানে যদি পরিবর্তনের পথ সুগম হয় তবে সেই পথ দিয়ে একটার পর একটা পরিবর্তন আসে। কালে সেটা বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে। রেনেসাঁস যদি ইটালিতে না হত রিফর্মেশন জার্মানিতে হত না, পার্লামেন্টের কাছে রাজশক্তির পরাজয় ইংল্যাণ্ডে হত না। রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব ফ্রান্সে হত না।

পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের ভিতরেই সর্বাঙ্গীণ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিহিত ছিল। মানুষ ইচ্ছা করলে এই জগৎকে ও এই জীবনকে সর্বতোভাবে পরিবর্তিত করতে পারে। মানুষের অসাধ্য কী আছে? মানুষ সর্বশক্তিমান। মানুষ সম্বন্ধে, জগৎ সম্বন্ধে, জীবন সম্বন্ধে এই যে অভিনব চেতনা এটাই নতুন বিদ্যার মহত্তম দান। পাশ্চাত্য রেনেসাঁস থেকে এটা প্রাচ্য রেনেসাঁসেও সঞ্চারিত হয়। হত না যদি রামমোহনের মতো মনীষীরা অগ্রণী না হতেন। ইংরেজদের মধ্যেও দুই দল ছিলেন। একদল মনে করতেন প্রাচ্যদেশের লোকের পক্ষে প্রাচ্য বিদ্যাই শ্রেয়। বেশ তো শান্তিতে আছে ওরা। কেন বৃথা পাশ্চাত্য বিদ্যা শিখিয়ে ওদের অশান্ত করে তোলা? ওরা চাইবে চাঁদ পেড়ে আনতে। পারবে কেন? আরেক দল ভাবতেন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রাচ্যের পক্ষেও শ্রেয়। সেই আলোর ছোঁয়া লেগে যাদের ঘুম ভাঙবে তারাই আর সবাইকে জাগাবে। একটি পুরাতন, পশ্চাৎপদ দরিদ্র জনসমষ্টি অমনি করেই আপনার ভাগ্য পরিবর্তন করবে। সেকাজ ইংরেজদের দিয়ে হবার নয়। সেদায়িত্ব ইংরেজদের নয়। এই যে দ্বিতীয় দলটি এঁরাই নতুন বিদ্যা প্রবর্তনে উৎসাহী ভারতীয়দের পক্ষ নেন। মেকলের কাস্টিং ভোট এঁদের জিতিয়ে দেয়।

ইংরেজদের মধ্যে যাঁদের আপত্তি ছিল তাঁদের আপত্তির একটা কারণ ছিল এই যে, স্কুল কলেজের পড়া সেরে যারা জীবিকার সন্ধানে বেরোবে তাদের জন্যে সরকার এত চাকরি পাবেন কোথায়? তার জন্যে যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন চাই তার সম্ভাবনা কতদূর? ইংল্যাণ্ডে ততদিনে শিল্পবিপ্লব জোরকদমে চলেছিল, কিন্তু ভারতেও যদি শিল্পবিপ্লব চলে তবে ভারত হবে ইংল্যাণ্ডের ঘোর প্রতিযোগী। তাকে কাঁচামালের জোগানদার ও তৈরি মালের বাজার করে রাখাই যদি ব্রিটিশ পলিসি হয় তবে শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। কিন্তু দেখতে দেখতে রেল স্টিমার ডাকঘর টেলিগ্রাফ এদেশেও এসে হাজির হয়। এখানেও নতুন কর্মের সুযোগ মেলে। যারা সরকারি চাকরি পায় না তারা ওকালতি করে। কিংবা মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে ডাক্তারি। জমিদার ঘরের ছেলেরা জমিদারি থেকে অনর্জিত আয় পায়। কারণ রেললাইন ও শহর বিস্তারের দরুন জমির দাম বেড়ে যায়। তারাও স্কুল বসায়, ডাক্তারখানা বসায়। স্কুলমাস্টার ও ডাক্তারকে কাজ দেয়। জেলা ও মহকুমা নিয়ে যে নতুন প্রশাসনের প্রবর্তন হয় তার উপরের দিকে ইংরেজ থাকলেও বাকিটা দেশীয়দের জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ইউরোপের মতো এদেশেও রেনেসাঁসের স্তম্ভ বলতে বোঝায় জমিদার, বার্গার বা বণিক, উকিল, ডাক্তার, সরকারি আমলা। ওদেশের ক্লার্জির একাংশ রেনেসাঁসের পক্ষপাতী ছিল, এদেশেও ব্রাহ্মণদের একভাগ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিক আর নাই দিক রেনেসাঁসের পক্ষপাতী হয়। সর্বপ্রথমেই মনে আসে যাঁর নাম তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সংস্কৃত কলেজের ভার পেয়ে সেখানে পাশ্চাত্য দর্শন পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। যেমন জন স্টুয়ার্ট মিলের রচনাবলি। একখানি চিঠিতে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন এই বলে :

For certain reasons, which it is needless to state here, we are obliged to continue the teaching of the Vedanta and Sankhya in the Sanskrit College. That the Vedanta and Sankhya are false systems of philosophy is no more a matter of dispute. While teaching these in the Sanskrit course we should oppose them by sound philosophy in the English course to counteract their influence.

পুরাতন বিদ্যার পাশাপাশি নতুন বিদ্যাও চলবে এই ছিল বিদ্যাসাগরের নীতি। তিনি যেমন সংস্কৃতশিক্ষাকে সাধারণের পক্ষে সহজ করতে ব্যাকরণ কৌমুদী প্রভৃতি বই লিখেছিলেন তেমনি ইংরেজি শিক্ষাকে সুলভ করতে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংস্কৃত ছিল ব্রাহ্মণদের একচেটে, হল নতুন বিদ্যালয়গুলিতে শূদ্রদেরও অবশ্যপাঠ্য। এমনকী মুসলমানরাও ইচ্ছা করলে সংস্কৃত পড়তে পারত। আর ইংরেজি তো সর্বজনপাঠ্য হলই। বাংলাও।

সমসাময়িক ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় আমাদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সেকুলার ছিল। এর জন্যে ধন্যবাদ দিতে হয় একদিকে যেমন রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কারমুক্ত ভারতীয়দের, অন্যদিকে ডেভিড হেয়ার ও মেকলে প্রমুখ সংস্কারমুক্ত ইউরোপীয়দের। ইতিহাসে দৈবাৎ এরূপ মণিকাঞ্চনযোগ ঘটে। বলা বাহুল্য এর মধ্যে একটা বিদ্যা বেচাকেনার ব্যাপার ছিল। পাঠ্যপুস্তক লিখে বিদ্যাসাগরও যে অর্থোপার্জন করেননি তা নয়। রেনেসাঁস অর্থোপার্জনের যেসব নতুন পন্থা খুলে দেয় এটাও তার একটা। সংবাদপত্র সম্পাদনা করে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অর্থোপার্জন করেন। কাব্য লিখে মাইকেল ও উপন্যাস লিখে বঙ্কিমচন্দ্রও অর্থলাভ করেন। স্বাধীনভাবে বাস করতে হলে স্বাধীন জীবিকা চাই। সরকারের বা জমিদারদের বা ধনিকের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করলে স্বাধীনভাবে বঁাচতেও পারা যায় না, লিখতেও পারা যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ আমলেই এটা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সম্ভব হয়। ছাপাখানা ও শিক্ষাবিস্তার এটাকে সম্ভব করে।

তা ছাড়া স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। মুঘল বা মারাঠা রাজত্বে স্বাধীন জীবিকা কারও ভাগ্যে জুটলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কারও নাগরিক অধিকারের অঙ্গ ছিল না। সিভিল লিবার্টির জন্যে স্বদেশে রক্তপাত করে ইংরেজরা বুঝত ওর কী মূল্য। এদেশেও হিকি প্রভৃতি সাংবাদিক তার জন্যে সংগ্রাম করেন। রামমোহনকেও তার জন্য সজাগ থাকতে হয়। এদেশে যেসব ইংরেজ রাজপুরুষ আসতেন গোড়া থেকেই তাঁদের একভাগ ছিলেন রক্ষণশীল ও আরেক ভাগ উদারনীতিক। রবীন্দ্রনাথ যাঁদের বলতেন ছোটো ইংরেজ ও বড়ো ইংরেজ। প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরেই এঁদের দেখা যেত। উচ্চতর আদালতে উদারনীতিকদেরই ছিল প্রাধান্য। বিলেতের বিচার ব্যবস্থা এদেশে প্রবর্তিত হওয়ায় সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা আইনত স্বীকৃত হয়। কার্যত হতে বহু বাধা। উদারনীতিক ইংরেজ ও উদারনীতিক ভারতীয় এই এক জায়গায় মিলিত হন।

ইংরেজরা তাদের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র এদেশে প্রবর্তন করতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের স্বদেশেই তার ব্যাপ্তি হয়নি। এদেশের জনসাধারণ যে তার জন্যে প্রস্তুত ছিল তা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে উদারনীতিক ইউরোপীয় ও উদারনীতিক ভারতীয় মিলে যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তার কিছুদিন আগে থেকেই পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের জন্যে একটা আকাঙ্ক্ষা জাগে। এটা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার সমান্তরাল ও পরিপূরক। সারা ইউরোপ জুড়ে একই আকাঙ্ক্ষা। এর দক্ষিণে ছিল স্বৈরাচার ও বামে বিপ্লববাদ। এসব তরঙ্গ ভারতের মাটিতেও আছড়ে পড়ে। বিশেষত বাংলার মৃত্তিকায়। রেনেসাঁস যেখানে সবচেয়ে সক্রিয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সর্বত্র বৈশ্যদের ধনবল ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল ও শূদ্রদের শ্রমবল তার প্রতিপক্ষরূপে তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্যে ক্রমে ক্রমে তৈরি হচ্ছিল। ভারতও এর বাইরে ছিল না। কিন্তু ভারতের পরাধীনতা এটাকে আড়াল করেছিল। তা সত্ত্বেও স্বামী বিবেকানন্দের মতো দূরদর্শী পুরুষ সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতে পেরেছিলেন। যদিও সেটা ধর্মনিরপেক্ষও নয়, নিরীশ্বরও নয়, মার্কসবাদীও নয় তবু সেটা সামাজিক ন্যায়। যা না হলে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র অপরিপূর্ণ থাকবে। সাম্যের চিন্তা বঙ্কিমচন্দ্রও করেছিলেন। শ্রমজীবীদের জন্যে কেশবচন্দ্রেরও দরদ ছিল। জমিদারের প্রজাদের জন্যে রামমোহনও ব্যথা বোধ করতেন।

নারী ও শূদ্র সমাজের এই দুটি উপেক্ষিত ও উপেক্ষিতার মধ্যে নারীর জন্যেই কাজ হয় বেশি। সতীদাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ প্রচলন তো রামমোহন বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। নারীকে ব্রাহ্মমন্দিরের বেদিতে আচার্যের আসনে বসানো তেমনি কেশবচন্দ্রের। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের কন্যারা পুরুষের সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন। ইউরোপেও সহশিক্ষা তখনও বেশিদূরে যায়নি। নতুন বিদ্যালয়ে নর-নারী উভয়ের জন্যে এটুকু স্বীকার করতেই চার শতাব্দী লেগে যায়। অবশ্য মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ঘরোয়া ব্যবস্থা ধনাঢ্য পরিবারে ছিল, কিন্তু তাদের কলেজে পড়তে পাঠানো—বিশেষ করে ছেলেদের কলেজে—গত শতাব্দীর মধ্যভাগেও ছিল রক্ষণশীলদের কাছে দৃষ্টিকটু। ঘরোয়া ব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষিতা মহিলাদের প্রসঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ডক্টর জনসন মন্তব্য করেছিলেন, ‘কুকুর হাঁটছে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে এটা যেমন বিচিত্র ওটাও তেমনি।’

বাঙালির মেয়েরা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হবার পরে এক মার্কিন মেয়ে স্বদেশে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ না পেয়ে জার্মানিতে যান ও সেখানেও কেউ তাঁকে পড়তে দেয় না। শেষকালে একটি কলেজ তাঁর জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতে রাজি হয়, কিন্তু একটি কি দুটি বিষয় নারীর পক্ষে নিষিদ্ধ। এসব কথা যখন শুনি তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজসংস্কারকদের শতবার সাধুবাদ দিই। বেথুন বলে পরিচিত বিটন সাহেবের মতো ইউরোপীয় শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও বহু ধন্যবাদ। নর-নারীর সাম্যবিধানের সাধনায় জাতিধর্মনির্বিশেষে যাঁরাই কাজে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরাই আমাদের নমস্য। এককভাবে এ সাধনা এত কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধ হত না। পরবর্তীকালে ইংল্যাণ্ডের সাফ্রাজেটরা সংগ্রাম করে যে অধিকার লাভ করেন সেঅধিকার বিনা সংগ্রামে এদেশের মেয়েরাও পান।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যে পুরাতন বিদ্যার পরিবর্তে নতুন বিদ্যার প্রবর্তন চেয়েছিলেন এর তাৎপর্য তাঁরা স্থিতাবস্থায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। যাঁরা ছিলেন তাঁরা সমাজের প্রবল ও সুবিধাভোগী অংশ। জনগণের তখন নিজের স্বার্থ বুঝে নেবার মতো বিদ্যাবুদ্ধি নেই। বিদ্যাবুদ্ধি আসতে পারত টোল চতুষ্পাঠী মক্তব মাদ্রাসা থেকে নয়, স্কুল কলেজ থেকেই। তবে এটাও তাঁদের কাম্য ছিল যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ইংরেজির সহায়তায় যুগোপযোগী হয়ে জনশিক্ষার বাহন হয়। তার জন্যে তাঁরাও পাঠ্য প্রণয়ন করেছিলেন। বাংলা এর আগে পাঠশালার উপরে উঠতে পারেনি। তাকে মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করাই ছিল তৎকালীন কর্তব্য। সেস্তরে বাংলা হল অবশ্য শিক্ষণীয়। নীচের দিকে শিক্ষার মাধ্যম। লোকে যাকে ইংরেজি বিদ্যালয় বলত তাতে বাংলারও স্থান ছিল। বাংলার মতো অন্যান্য ভারতীয় ভাষাও অন্যত্র স্থান পায়। এসব ভাষাকে বলা হত দ্বিতীয় ভাষা। মর্যাদার দিক থেকে এরা ইংরেজির চেয়ে খাটো। পরে এটা অসহ্য হয়।

অসহ্য হবার কারণ বাংলার অভূতপূর্ব উন্নতি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক-খানাই বা পুথি লেখা হয়েছিল। আর কীই-বা ছিল তার মান। সংস্কৃত পন্ডিতরাও তাকে অবজ্ঞা করতেন। তার নিজের কোনো নাম পর্যন্ত ছিল না। শুধু ‘ভাষা’ বলে উল্লেখ করা হত। বিদেশিরাই নাম রাখে ‘বেঙ্গলি’। তার থেকে আসে ‘গৌড়ীয়’। পরে ‘বাঙ্গলা’। অষ্টাদশ শতাব্দীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ঊনবিংশ শতাব্দীই বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। সোনার কাঠির পরশ লেগে রাজকন্যার ঘুম ভাঙে। ছুঁইয়ে দেয় ভিনদেশি রাজপুত্র। সেই যে জাগরণ, তার চিহ্ন জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগে—ধর্মে, সমাজে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, নগরবিন্যাসে, প্রাসাদনির্মাণে, থিয়েটারে, যানবাহনে। দেশটা হয়ে ওঠে কলকাতাকেন্দ্রিক। আর কলকাতা নিজে লণ্ডনকেন্দ্রিক।

এর নাম ঔপনিবেশিকতা। আমাদের সভ্যতা হয় কলোনিয়াল সভ্যতা। আমাদের সংস্কৃতিও কলোনিয়াল ধারায় চলেছে দেখে আমাদের মনীষীরা বিদ্রোহী হন। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন এই বিদ্রোহের সংকেত। গোড়ায় এটা সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ। পরে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও সঞ্চারিত হয়। এরই চূড়ান্ত পরিণতি ‘কুইট ইন্ডিয়া’। সঙ্গে সঙ্গে ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড কুইট’। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ভিতরেই উভয়ের বীজ নিহিত ছিল।

ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে ভারতের সম্বন্ধটা ছিল এই যে এপার থেকে জাহাজ ভরতি করে কাঁচামাল যেত ওপারে। আর ওপার থেকে জাহাজ ভরতি করে তৈরি মাল আসত এপারে। তেমনি এপার থেকে পুরাতত্ত্ব যেত ওপারে। আর ওপার থেকে আধুনিক বিদ্যা, আধুনিক চিন্তা, আধুনিক বিচার, আধুনিক নিয়মকানুন, আধুনিক কলাকৌশল, আধুনিক সংস্কার বা বিপ্লব আসত এপারে। পশ্চিম থেকে আসত বলেই তার সঙ্গে একটা পশ্চিমা পোশাক ছিল। সেটা যাঁদের ভালো লাগত তাঁরা পোশাকটাতেই মুগ্ধ। আধুনিকতা তাদের চোখে নিছক সাহেবিয়ানা। আবার সেটা যাঁদের খারাপ লাগত তাঁরা পোশাক দেখেই রুষ্ট। আধুনিকতা তাদের চোখে সাহেবিয়ানা ছাড়া আর কিছু নয়। কোনটা যে পাশ্চাত্য আর কোনটা যে আধুনিক, কোনটা যে বিদেশি আর কোনটা যে স্বযুগী, এটা প্রথম দৃষ্টিতে পরিষ্কার ছিল না।

বিদেশির বিরুদ্ধে স্বদেশি খাড়া করতে গিয়ে যেটা হল সেটা স্বযুগীর বিরুদ্ধে বিযুগী। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতাব্দী। যাঁরা মুসলিমবিরোধী তাঁরা পারসিকবিরোধী হওয়ায় তাঁদের বেলা অষ্টাদশ শতাব্দীই যথেষ্ট বিযুগ নয়। তাঁরা আরও উজানে গিয়ে হাজির হন দ্বাদশ শতাব্দীতে। সংস্কৃত যখন ছিল একচ্ছত্র। তাঁদের অনেকে আরও উজিয়ে যান কালিদাসের কালে। কেউ কেউ আরও দূরে উজিয়ে যান মুনিঋষিদের কালে। ইসলাম এঁদের বাঞ্ছিত সংস্কৃতির ত্রিসীমানায় ছিল না। খ্রিস্টধর্মও না। তা বলে যে এঁরা বৌদ্ধ ধর্মের উপর সদয় ছিলেন তা নয়। বুদ্ধ সম্বন্ধে এঁদের ধারণা জয়দেবের মতোই। বুদ্ধ নাকি বিষ্ণুরই একটি অবতার। যদিও বৌদ্ধদের মতে বুদ্ধই সব দেবতার উপরে। প্রাচীন বিদ্যা সম্বন্ধে যতখানি মুক্ত মন চাই ততখানি এঁদের ছিল না। নতুন বিদ্যা সম্বন্ধে তো নয়ই। অথচ প্রেরণা আসছে যেখান থেকে সেটা হচ্ছে স্বদেশবোধ ও স্বদেশের স্বাধীনতাকামনা।

অথচ ওদিকে টেলিগ্রাফ উদ্ভাবিত হয়েছে। রোজ তার আসছে বিদেশ থেকে। ছাপা হয়ে যাচ্ছে খবরের কাগজে। জাহাজের খবরের জন্যে কেউ সবুর করবে না। দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে পা ফেলে। প্রাচ্যের প্রাচীনতার সঙ্গে পা ফেলবে কে? দেশের লোকও পাশ্চাত্য না হোক আধুনিক হতে চায়। বাহ্যত আধুনিক। অন্তর থেকে আধুনিক হওয়া অত সহজ নয়। তেমন একজন মানুষ ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তেমন একজন মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। এঁরা এঁদের পরবর্তীদের চেয়েও অগ্রগামী ছিলেন কারণ রেনেসাঁস তখনও তার গতিবেগ হারিয়ে রিভাইভালের মরুপথে ক্ষীণধারায় প্রবাহিত হয়নি।

দেশাভিমানীদের মতে ভারতীয় সাহিত্যের, দর্শনের, শিল্পের বিচার হবে ঐতিহ্যবাহিত স্বকীয় স্ট্যাণ্ডার্ডে। আন্তর্জাতিক স্ট্যাণ্ডার্ডে নয়। আন্তর্জাতিক স্ট্যাণ্ডার্ড তো প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় স্ট্যাণ্ডার্ড। তাকেই যদি প্রামাণিক বলে মেনে নেয় তবে ভারত তার আপনাকে হারাবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য, গ্রামীণ কারুশিল্প সব একে একে গেছে। এক সভ্যতার বাসগৃহে অপর এক সভ্যতা এসে জবরদখল নিয়ে বসেছে। থাকবার মধ্যে আছে ভারতীয় সংস্কৃতি। সেও কি তার নিজ বাসগৃহে পরমুখাপেক্ষী হবে? না, আমাদের দুর্গ আমরা পরকে ছেড়ে দেব না। সাংস্কৃতিক বিজয় ঘটতে দেব না। ভারতের আত্মা অপরাজিত। ধর্মেই এর সমধিক প্রকাশ। ধর্মের পরেই সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে যারা ফেরঙ্গ সংস্কৃতিতে পরিণত করতে চায় তারা স্বদেশের শত্রু।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে প্রতিরোধ দেখা দিয়েছিল সেটা হিন্দু নামক একটি ধর্ম বা সমাজের তরফ থেকে। শেষের দিকে যেটা দেখা দিল সেটা ভারত নামক একটি দেশের তরফ থেকে। নামে ভারত, কার্যত হিন্দু ভারত। দেশের আত্মাকে বিজিত হতে দিলে এদেশ কোনোদিন স্বাধীন হতে পারবে না। সাংস্কৃতিক বিজয় সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, সকলেই এ বিষয়ে একমত। দিকে দিকে স্বদেশি চারুশিল্প ও কারুশিল্পের পুনরুজ্জীবন হয়, জাতীয় শিক্ষার আত্মরক্ষা করে ও পরবর্তী কালে রাজনৈতিক বল পরীক্ষার জন্যে শক্তি সংগ্রহ করে। নৈতিক ও মানসিক শক্তি। সামনে একটা সংগ্রাম রয়েছে একথা যদি মনে রাখি তা হলে পুনরুজ্জীবনবাদী প্রযত্ন দেখে আশ্চর্য হব না। দুর্বল দেশ এমনি করে প্রবল দেশের সঙ্গে লড়তে সাহস পায়।

রেনেসাঁস এসেছিল মানুষকে সর্বদেশে সর্বপ্রকারে মুক্ত করতে। শাস্ত্রের হাত থেকে, দেবতার হাত থেকে, গুরুর হাত থেকে, পুরোহিতের হাত থেকে, রাজার হাত থেকে, সামন্তের হাত থেকে। কুসংস্কারের হাত থেকে, কুপ্রথার হাত থেকে, অসাম্যের হাত থেকে। এক দিনে বা এক শতাব্দীতে নয়। ধাপে ধাপে। সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে। সেই হচ্ছে বিদ্যা যা মুক্তি দেয়। রেনেসাঁস এসেছিল তেমন বিদ্যা নিয়ে। আমাদের বহু ভাগ্য যে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কতক লোকের মন তার জন্যে উন্মুখ ছিল। মহাসৌভাগ্য যে কলকাতা ছিল রাজধানী ও সমুদ্রপথে ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত। সেই সূত্রে তথ্য ও আইডিয়ার চলাচল ছিল অবধারিত। কিন্তু জনগণ তার অংশীদার ছিল না ও প্রাচীনপন্থীরা ছিল বিরূপ। পরে দেশাভিমানীরাও হয় বিমুখ।

আমাদের রেনেসাঁসের পরাকাষ্ঠা রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার। তাতে করে প্রমাণিত হয় যে আন্তর্জাতিক স্ট্যাণ্ডার্ড বলে একটা-কিছু আছে আর বাংলা সাহিত্য সেই স্ট্যাণ্ডার্ডে উপনীত হয়েছে। অধিকন্তু এটাও প্রমাণিত হয় যে, ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি বিজিত দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নয়। ভারত সেক্ষেত্রে অপরাজিত। এতে আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যায়। আমরাও পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দেবার সামর্থ্য রাখি। ‘জগৎ কবিসভায় মোরা তোমার করি গর্ব। বাঙালি আজ গানের রাজা বাঙালি নহে খর্ব।’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই উক্তি সব গ্লানি ভুলিয়ে দেয়।

তখনও কারও জানা ছিল না যে প্রথম মহাযুদ্ধ আসছে, তার পিঠ পিঠ রুশবিপ্লব ও তার শেষে ভারতের গণজাগরণ। যেমন পশ্চিম ইউরোপে তেমনি ভারতেও একটা যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আরও বিশটা বছর টেনে আনলে বলতে পারা যায় ওটা ঊনবিংশ শতাব্দীরও শেষ। সব দেশের লিবারলরা অস্তংগমিতমহিমা। এমনতরো মোহভঙ্গ এর পূর্বে আর কখনো ঘটেনি। সভ্যতার স্বরূপ দেখে সভ্য মানুষ বর্বরের দিকে ঈর্ষার সঙ্গে তাকায়। কতক সভ্য মানুষ বর্বর বনে যায়ও। ইটালিতে ও জার্মানিতে। তাদের চেহারা দেখে কে বিশ্বাস করবে যে তাদের দেশে একটা রেনেসাঁস ও রিফর্মেশন হয়েছিল? প্রমাণ কোথায় যে মানবিকবাদ বিকশিত হয়েছিল?

ইউরোপের উপর মোহভঙ্গ আমাদের আপনার দেশের দিকে ফিরে তাকাতে উদবুদ্ধ করে। মোহভঙ্গটা শুধু পশ্চিমের উপর নয়, আধুনিকের উপরও। নাগরিকের উপরও। আমরা গ্রামে যাই। জনগণের সঙ্গে অভিন্ন হতে চেষ্টা করি। আমরা মনেপ্রাণে স্বদেশি হতে গিয়ে স্বদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যেই আমাদের চিৎপ্রকর্ষের, আমাদের বৈশিষ্ট্যের ও আমাদের সৃজনীশক্তির উৎস আবিষ্কার করি। আমাদের সত্যিকার শিকড় যেমন গ্রামে, গ্রামীণ শিল্পে ও কৃষিকর্মে, তেমনি লোকসংস্কৃতিতে ও তারই উপর ভিত্তি করে রচিত বা গ্রথিত রামায়ণে মহাভারতে। রামায়ণ মহাভারতই আমাদের ভিতরকার ইতিহাস।

সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাকে বাদ দিলে ভারতীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এসেছে রামায়ণ ও মহাভারত। এই দুই মহাকাব্য অবলম্বন করে হাজার হাজার বছর ধরে লেখা হয়েছে হাজার হাজার খন্ডকাব্য, আঁকা হয়েছে হাজার হাজার ছবি, গড়া হয়েছে হাজার হাজার মূর্তি। নাচা হয়েছে হাজার হাজার নাচ, গাওয়া হয়েছে হাজার হাজার গান, শোনানো হয়েছে হাজার হাজার কথকতা, অভিনীত হয়েছে হাজার হাজার নাটক বা যাত্রা। কোথায় তার ছেদ বা ডিসকন্টিনিউইটি!

রামায়ণ বা মহাভারত একজন লেখকের একজীবনে লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়ে থাকলে বহুযুগ ধরে প্রচলিত বহুজনের গাওয়া লোকগীতি বা গাথা অবলম্বন করে হয়েছে। মূল কাহিনির সঙ্গে শাখা-প্রশাখা জুড়ে জুড়ে কাব্যকে যে বিশাল আয়তন দেওয়া হয়েছে তা কোষগ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি এইভাবে আপনাকে দুটি কোষগ্রন্থে সংহত ও সংক্ষিপ্ত করে ভাবীকালের জনসাধারণের জন্যে রেখে যায়। মধ্যযুগের ভারত এই দুটির অঙ্গে আর কিছু সংযোজন করেনি। তবে সংস্কৃত থেকে বাংলা প্রভৃতি ভাষার ভাবানুবাদ যাঁরা করেন তাঁরা যেমন কতক অংশ বাদ দেন তেমনি কতক অংশ জুড়ে দেন আর চরিত্রগুলিকেও এমনভাবে রূপান্তরিত করেন যে তারা হয়ে ওঠে স্বকালের ও স্বপ্রদেশের নর-নারী। তার থেকে বিষয় নিয়ে যখন যাত্রা অভিনয় হয় তখন দর্শকদের রুচি অনুসারে নতুন নতুন চরিত্রের উদ্ভাবন হয়। রামায়ণ ও মহাভারত জনতার অনুরোধে গ্রামে গ্রামে সৃষ্ট হয়ে চলেছে। কেবল ভারতে নয়, ইন্দোনেশিয়ায় ও ইন্দোচীনে। তথা সিংহলে।

একদা যা ছিল ক্ষত্রিয়দের বীরগাথা ও রাজসভাতেই গীত বা অভিনীত হত তা এখন সর্বজনপ্রিয়। তার সঙ্গে মিশে গেছে ধর্ম আর দর্শন, পুরাতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব, ধনুর্বিদ্যা ও রাজনীতি, অর্থশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র। জনতা এর সবটা চায় না ও পায় না। তারা বোঝে বীরত্ব ও যুদ্ধ, সেইসঙ্গে কয়েকটি মূলনীতি। পিতৃসত্যের জন্যে রাম বনে গেলেন, পত্নী উদ্ধারের জন্যে তিনি যুদ্ধ করলেন, প্রজারঞ্জনের জন্যে তিনি পত্নীকে বনবাসে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির সর্ব অবস্থায় সত্যনিষ্ঠ, সেইজন্যে স্বর্গের পথে তার পতন ও মৃত্যু হল না, তিনি সশরীরে স্বর্গে গেলেন, কিন্তু একবার একটি অর্ধসত্য ও অর্ধ অসত্য উচ্চারণের কর্মফল হল নরক দর্শন। সত্যের উপর এই পরিমাণ জোর আর কোনো দেশের মহাকাব্যে আছে কি না বলতে পারব না। তবে কয়েকটা মূলনীতি ইলিয়াডেও আছে, ওডিসিতেও আছে। আছে জার্মানদের নিবেলুঙ্গেনলিড নামক প্রাচীন কাব্যে। কার কাছে কোনটা বড়ো সেটাই সার কথা।

রামায়ণ মহাভারত যতদিন বহমান থাকবে ততদিন জনমানসে ধারাভঙ্গ ঘটবে না। কিন্তু সেটা কতদিন তা কেউ ভবিষ্যদবাণী করতে পারবে না। শিল্পবিপ্লব ভারতেও সক্রিয়। সমাজবিপ্লব না হোক সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন ভারতীয়দেরও অন্বিষ্ট। কালক্রমে রামায়ণ মহাভারতের মহিমাও অস্তংগমিত হবে। সেক্ষত্রিয়সমাজ তো আর নেই। রাজারাজড়াদের যুগ গেছে। পরে বীরগাথার পাত্ররা হবে অনভিজাত। অতিপ্রাকৃতেও লোকের বিশ্বাস শিথিল হবে। সূর্য যে কী তা একবার জানবার পর তাকে বগলদাবা করা বীর হনুমানেরও অসাধ্য হবে। গন্ধমাদন বয়ে আনাও অবিশ্বাসের উদ্রেক করবে। তেমনি কুন্তীর ও গান্ধারীর পুত্রলাভের প্রক্রিয়াও সন্দেহজনক হবে। তা বলে রামায়ণ ও মহাভারতের আবেদন ব্যর্থ হবে না। রামায়ণ মহাভারত নতুন করে লেখা হবে। যতদিন না জননায়করা ফতোয়া দিচ্ছেন যে, ওই দুটি মহাকাব্য ফিউডাল সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক। সুতরাং পরিত্যজ্য। যেমন পরিত্যজ্য চীন দেশে কনফিউসিয়াসের শিক্ষা।

ভবিষ্যতে ধারাভঙ্গ হবে না এমন কথা কেউ বলতে পারে না। আমিও বলব না। জীবন কখনো একই খাতে প্রবাহিত হয় না। বড়ো বড়ো নদীকেও মাঝে মাঝে খাত বদল করতে দেখা যায়। বড়ো বড়ো সভ্যতাও যদি তাই করে তবে আশ্চর্য হবার কী আছে? ভারত অনেককাল ধরে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে এতদিন হয়তো একটা ব্যতিক্রম ছিল। এখন আর তা নয়। জলপথে জাহাজ এসে তার বিচ্ছিন্নতা দূর করছে। আকাশপথে বিমান এসে তাকে অবিচ্ছেদ্য করছে। ব্যতিক্রমের মোহভঙ্গ হলে অতীতের সঙ্গে ধারাভঙ্গও হতে পারে। তবে সেটা আমাদের কাম্য নয়। আমরা চাই অতীতের সঙ্গে অন্বয় রক্ষা করে অগ্রসর হতে। অন্বয়রক্ষা মানে কিন্তু অতীতরক্ষা নয়। অতীতের স্থান যাদুঘরে। সেখানেই তাকে রক্ষা করতে হবে। জীবনে স্থান দিতে হবে বর্তমানকে ও তার পরে ভবিষ্যৎকে। জীবনেও যারা অতীতরক্ষা করতে চায় তাদের সঙ্গে অগ্রসর দলের ছাড়াছাড়ি ঘটবেই।

রেনেসাঁসের সময়ও অতীতরক্ষীদের সঙ্গে অগ্রসর দলের ছাড়াছাড়ি ঘটেছিল। প্রথমে সতীদাহের প্রশ্নে। পরে ইংরেজি শিক্ষার প্রশ্নে। আরও পরে উপবীত ত্যাগের প্রশ্নে, জাতিভেদের প্রশ্নে, নারীর অধিকারের প্রশ্নে, অসবর্ণ বিবাহের প্রশ্নে। আরও পরে বহুবিবাহের প্রশ্নে। ছাড়াছাড়ি বলতে বোঝায় একটা পা-কে পেছনে রেখে আরেকটা পায়ে এগিয়ে যাওয়া। পেছিয়ে থাকা পা চিরদিন পেছনে পড়ে থাকে না। সেও তার নিজের সময়ে এগোয়। হয়তো একশো বছর সময় নেয়। কিংবা আরও বেশি। সংস্কারবদ্ধ মন সহজে সংস্কারমুক্ত হয় না। এই তো সেদিনও আমাদের ধারণা ছিল হিন্দুমতে বিয়ে হয়ে থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ অসম্ভব। এর যাতে পুনর্বিচার হয় তার জন্যে আমি কত কষ্ট করে উপন্যাস লিখলুম। এখন দেখছি হিন্দুরা ক্যাথলিকদেরও হার মানিয়ে দিয়েছে। রক্ষণশীল পরিবারেও বিবাহবিচ্ছেদ চলতি হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও হচ্ছে। এ অসম্ভব সম্ভব হল কী করে? হল এইজন্যে যে মেয়েরাও শিক্ষিত হয়েছে। তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে রাজি নয়, বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে থাকলে নতুন করে আরম্ভ করতে চায়। একই মনোভাব ছেলেদের মধ্যেও।

পুনর্বিচার, পুনর্মূল্যায়ন, পুনরারম্ভ এইসব হল রেনেসাঁসের মর্ম। অগ্রসর অংশটাই ঐতিহ্যের দ্বারা সম্মোহিত না হয়ে তার উপর স্বাধীন বিবেক ও মুক্ত বুদ্ধির প্রয়োগ করে। অহেতুক বর্জনও করে না, অহেতুক সংরক্ষণও করে না। অপরিবর্তনীয় বা সনাতন বলে তাকে নিরস্ত করতে যায় পশ্চাৎপদ অংশ। তার উপর নির্যাতনও করে। তাকে দুর্ভাগ্যের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। ধীরে ধীরে জনমতের গতি হয় অগ্রমুখী। ইতিহাসও তাই চায়। অগ্রসর অংশের কার্যকলাপ ইতিহাসের অভিপ্রায় সিদ্ধ করে। বলতে পারা যায় যে মানুষের ভিতর ইতিহাস কাজ করে যায়। এই প্রাচীন দেশের ইতিহাসের এটাও একটা পটপরিবর্তন। এই যাকে বলা হচ্ছে রেনেসাঁস। রেনেসাঁস সম্পূর্ণ হলে প্রাচীন আর প্রাচীন থাকে না। সেহয় নবীন। ভারতকে আমরা নবীন ভারত বলতে পারব যখন দেখব পশ্চাৎপদ অংশও অগ্রসর অংশের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিয়েছে।

বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা মানুষকে পুড়িয়ে মারত এই ভেবে যে তার দেহ ভস্মীভূত হলেও তার আত্মার কল্যাণ হবে। বিশ্বাসী হিন্দুরাও সদ্যবিধবাকে পুড়িয়ে মারত এই মনে করে যে সাধ্বী স্ত্রীর যথার্থ স্থান হল স্বামীর সঙ্গে, যেমন ইহলোকে তেমনি পরলোকে। নয়তো সেসাধ্বী নয়। তার সতীত্ব অপরীক্ষিত। রামমোহন ও তাঁর সমসাময়িক অগ্রবর্তীরা এর পুনর্বিচার ও পুনর্মূল্যায়ন করেন। যে স্বামীর চিতায় পুড়ে মরল ও যে তা করল না তাদের একজন কি সাধ্বী, অপরজন অসতী? এটা পুরাতন বিচার। নতুন বিচার এ নয়। বেঁচে থেকেও যদি সাধ্বী হওয়া যায়, অগ্নিপরীক্ষা না দিয়েও যদি সতী হওয়া যায় তবে কেন ওই অনাবশ্যক মৃত্যু? যা কখনো আত্মহত্যা, কখনো প্রথাসিদ্ধ হত্যা। অসভ্য মানুষের নরবলির সভ্য সংস্করণ। শিক্ষিত ভদ্র হিন্দুরাও এই প্রশ্নে রামমোহনের বিপক্ষে দাঁড়ান ও প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত ধাওয়া করেন। আইন করে সতীদাহ নিবারণ সম্বন্ধে রামমোহনেরও দ্বিধা ছিল। বেন্টিঙ্কের ছিল না। ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট বেন্টিঙ্কের মধ্যেই মূর্ত হয়েছিল। জনমতের জন্যে তিনি অপেক্ষা করেননি। ক্ষমতার সুপ্রয়োগ করে অমানবিককে রহিত করেন। জানতেন না যে তাতে করে সিপাহি বিদ্রোহকে ইন্ধন জোগানো হবে। সিপাহিরা ছিল পশ্চাৎপদ অংশ। অগ্রসর অংশ তাদের সমর্থন করে না। করে ইংরেজ রাজেরই সমর্থন।

বিধবাবিবাহের প্রবর্তনের পেছনেও ছিল পুনর্বিচার ও পুনর্মূল্যায়ন। যে নারী দশ ও বারো বছর বয়সে বিধবা হয়েছে সেতার স্বামীসঙ্গ থেকে ও মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলেই কি তার সেই বঞ্চিত থাকাটাই হবে সতীত্ব? সারাজীবন মৃত স্বামীর ধ্যান ও অমানুষিক কৃচ্ছ্র সাধনই হবে সতীত্বের পরীক্ষা? তাই যদি হয় তবে সেটা হোক ঐচ্ছিক। কিন্তু সবাইকে বাধ্য করা কেন? যখন দেখা যাচ্ছে যে অনেকেরই জীবনে ঘটছে স্খলন পতন ও সেটা প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে। নতুন করে ঘরসংসার পাতার সুযোগ পেলে তারাও হত সুচরিতা পত্নী ও জননী। তারাও সতী, যদি সতীত্বের সংজ্ঞাকে উদার করি।

সতীদাহের পেছনে ছিল সতীত্ব সম্বন্ধে বহুকালের সংস্কার। তাকে টলিয়ে দিয়ে যান রামমোহন। সেটা না টললে সতী নারীর বৈধব্যের পর পুনর্বিবাহ বিরোধী সংস্কার টলত না। এটাকে টলিয়ে দেন বিদ্যাসাগর। এর পরের ধারা হল বহুবিবাহ নিরোধ। বিদ্যাসাগর এর জন্যেও একটা আইন পাস করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের পর সরকার হয়েছিলেন বিষম সতর্ক। আইন পাস না হলেও জনমত ধীরে ধীরে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে যায়। এখানেও সেই পুনর্বিচার ও পুনর্মূল্যায়ন চলছিল। একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী এতকাল কারও চোখে বিসদৃশ ঠেকেনি। লোকে এই ভেবে সমর্থন করত যে পিন্ডের জন্যে পুত্রের প্রয়োজন ও পুত্রের জন্যে ভার্যার। একটি ভার্ষার যদি পুত্র না হয় তবে আরেকটি বিবাহ করাই তো সঙ্গত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মানবিকবাদ নারীর মূল্য বাড়িয়ে দেয়। পুত্র যার হয়নি সেও তো একটি নারী। সেবেঁচে থাকতে আর একটি নারী গ্রহণ করা কি অন্যায় নয়? এই যে অন্যায়বোধ এটা নতুন। বংশরক্ষা যদি নাও হয়, পিন্ডদান যদি নাও হয় তা হলেও এক স্ত্রী থাকতে আর এক স্ত্রী গ্রহণ করা চলবে না। পরিশেষে এটা আইন পাশ করে নিষিদ্ধ হল স্বাধীনতার পরে।

সাহিত্যে এই নূতন মূল্যবোধের প্রতিফলন হয়। ভার্যার মূল্য তো বেড়ে যায়ই, নারী মাত্রেরই মূল্য যায় বেড়ে। তাই বিধবা পায় পুনর্বিবাহের অধিকার, কুমারী পায় নিজের পতি মনোনয়নের অধিকার, সধবা পায় বিবাহবিচ্ছেদের শর্তাধীন অধিকার, পতিতা পায় সংশোধনের পর সম্মানিত জীবনের অধিকার। সব ক-টি অধিকারের মূলে সাম্য ও স্ব-স্বাধীনতা, যেমন পুরুষের বেলা তেমনি নারীর বেলা। রেনেসাঁস না হলে এ কি কখনো হত? রেনেসাঁস যে হয়েছে এই তার মোক্ষম প্রমাণ।

তবে এটাও ঠিক যে দেশের লোক কোনোরকম পরিবর্তনই কেবলমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য বলে বা ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিত না। সেইজন্যে পদে পদে সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে বচন উদ্ধার করে বোঝাতে হত যে শাস্ত্রেও এর অনুমোদন আছে। তেমনি মহাভারত থেকে দৃষ্টান্ত চয়ন করে প্রাচীন ভারতের নজির দেখাতে হত। সেইভাবেই ঐতিহ্যের অন্বয় রক্ষা করতে হয়। ডিসকন্টিনিউইটি এড়াতে হয়।

ওদের রেনেসাঁস আর আমাদের রেনেসাঁস এই দুই রেনেসাঁসের মধ্যে মৌল প্রভেদ ছিল একটি জায়গায়। ওদের রেনেসাঁস এসেছিল প্রাচীন গ্রিস রোমের সঙ্গে ছিন্ন যোগসূত্র পুনরুদ্ধার করতে। আমাদের বেলা প্রাচীন ভারতের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি, সুতরাং পুনরুদ্ধারের কথা ওঠে না। আমাদের রেনেসাঁস এসেছিল আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে নতুন করে যোগসূত্র স্থাপন করতে। মাঝখানে ছিল বহু সমুদ্রের তথা বহু শতাব্দীর ব্যবধান। সমুদ্র লঙ্ঘন করা তত কঠিন নয় শতাব্দী লঙ্ঘন করা যত কঠিন। একটা পেছিয়ে-পড়া দেশকে এগিয়ে যাওয়া কালের সঙ্গে পা ফেলে চলতে হবে, এই ছিল আমাদের রেনেসাঁসের আহবান। তার জন্যে রাখতে হবে অগ্রসর যাত্রীদের উপর দৃষ্টি।

আমাদের রেনেসাঁসের নায়কদের দৃষ্টি ছিল অগ্রসর যাত্রীদের উপরে। তাই ভারতও দিন দিন আধুনিক হয়ে ওঠে। আধুনিক ভারত আর মধ্যযুগের ভারত নয়। যদি মধ্যযুগের ভারত হয়ে থাকে তবে আধুনিক ভারত নয়। কিন্তু কালের সঙ্গে পা মিলিয়ে নিলেও এদেশের প্রাচীনের সঙ্গে এদেশের আধুনিকের একটা যোগসূত্র ছিল। সেটার সম্বন্ধে সচেতন না হয়ে অগ্রসর হলে ঐতিহ্যবোধ হারিয়ে যেত। ঐতিহ্যের সঙ্গে অন্বয়রক্ষাও ছিল আমাদের অন্যতম অবশ্য কর্তব্য। আমাদের রেনেসাঁসের নায়করা প্রাচীন ভারতের সঙ্গে অন্বয়রক্ষা করতে যত্নবান ছিলেন। কেমন করে প্রাচীন ভারতের সঙ্গে আধুনিক ইউরোপের সমন্বয় ঘটানো যায় এটা ছিল তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন।

পরবর্তীকালের চিন্তানায়কদের কাছে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হল কেমন করে পরাধীন ভারতকে স্বাধীন ভারতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়। যেমনটি পলাশির পূর্বে ছিল বা পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের পূর্বে ছিল। কারও মতে পরাধীনতা হয় পলাশির পর থেকে। কারও মতে পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের পর থেকে। যাঁদের মত মুসলিম-শাসিত ভারতও ছিল পরাধীন ভারত, তাঁরা স্বাধীন ভারত বলতে বুঝতেন প্রাচীন ভারত। সেই প্রাচীন ভারতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বা সেইখানে ফিরে যাওয়াই ছিল তাঁদের মতে স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এর নাম রেনেসাঁস নয় রিভাইভাল। রিভাইভালের নায়করা আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা ভাবতেন না। বরং ভাবতেন কেমন করে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ঝগড়াটা শুধু ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে নয়। ইংল্যাণ্ড যাকে বয়ে নিয়ে এসেছে সেই আধুনিক তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গেও। পুনরুজ্জীবনবাদীরা প্রাচ্যের দেশরক্ষী ও কালরক্ষী।

পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্ব যদি না মেলে রেনেসাঁসপন্থীরা বলবেন বৈজ্ঞানিকটাই সত্য আর রিভাইভালপন্থীরা বলবেন পৌরাণিকটা সত্য। পুরাণের সঙ্গে ইতিহাসের বিবরণ যদি না মেলে রেনেসাঁসপন্থীরা বলবেন ইতিহাসের বিবরণটাই প্রামাণিক আর রিভাইভালপন্থীরা বলবেন পুরাণের বিবরণটাই প্রামাণিক। দুই পক্ষই ইংরেজি শিক্ষিত, দুই পক্ষই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার ফসল। অথচ রিভাইভালপন্থীদের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে তাঁরা স্কুল-কলেজ থেকে কিছুই শেখেননি কিংবা যা শিখেছেন সব ভুল। তা বলে যে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের টোল চতুষ্পাঠীতে পাঠাবেন তা নয়। যাবে তারা ওইসব স্কুল-কলেজেই কিংবা নবপ্রতিষ্ঠিত গুরুকুলে বা ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। যুগটাকে তাঁরা সরাসরি অস্বীকারও করতে পারেন না। নবপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়েও মাতৃভাষায় একালের ভূগোল ইতিহাস পড়ানো হয়। অথচ মনটা পড়ে আছে সুদূর অতীতে। যখন চারিদিকের আবহাওয়া ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইটালিয়ানরাও তো দু-হাজার বছর পূর্বের গ্রিসের পুনর্জন্ম কল্পনা করেছিল। হোমরের গ্রিস, পেরিক্লিসের অ্যাথেন্স ছিল তাদের কল্পলোক। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালিরাও যদি বেদ উপনিষদের তপোবন তথা রামায়ণ মহাভারতের রাজসভার বা রণাঙ্গনের কল্পনা করে কেনই-বা তার নাম হবে পুনরুজ্জীবন? পুনর্জন্মের জন্যে কেনই-বা তাদের স্বদেশের বাইরে তাকাতে হবে? আধুনিক ইউরোপের কাছে পাঠ নিতে হবে? তাহলে তো ইউরোপকেই ভারতের উপর জিতিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে কি ভারত তার স্বাধীনতা ফিরে পাবে? হেরে যাওয়া দেশের মানসিক বল নির্ভর করে বিজেতার দান প্রত্যাখ্যানের উপর। নতুন বিদ্যাও তো সেইরূপ একটা দান।

রিভাইভালের সঙ্গে রেনেসাঁসের তফাতটা হচ্ছে ভক্তির সঙ্গে যুক্তির, বিশ্বাসের সঙ্গে বিচারের, পূর্বপুরুষ পূজার সঙ্গে আত্ম-স্বাধীনতার। শাস্ত্রজ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবজ্ঞানের, আপ্তবাক্যের সঙ্গে পরীক্ষানিরীক্ষার, স্থিরসিদ্ধান্তের সঙ্গে কৌতূহলী জিজ্ঞাসার, সংস্কারের সঙ্গে সংস্কারমুক্তির, আচারের সঙ্গে আচার লঙ্ঘনে, স্থিতাবস্থার সঙ্গে অভিনবত্বের। বর্ণাশ্রমের সঙ্গে বর্ণাশ্রম বর্জনের, যজ্ঞের সঙ্গে যজ্ঞত্যাগের, মন্ত্রের সঙ্গে খোলা মনের। রিভাইভালপন্থীদের কথা হল সেকালে যা হয়নি একালে তা হবে না, সেকালের মতো হবে। রেনেসাঁসপন্থীদের কথা হল পুনর্জন্ম মানে পূর্বজন্ম নয়, দেশ তার পূর্বজন্মে ফিরে যেতে পারে না। দেশকে বঁাচাতে হবে কালের সঙ্গে তাল রেখে। কালকে বদলে দিতে পারা যাবে না দু-হাজার বা দু-শো বছর বাদে।

অশনে বসনে স্বদেশি, শিক্ষায় দীক্ষায় স্বদেশি হতে গিয়ে সত্যযুগের মতো যোগী ঋষি ও বর্ণাশ্রমী, এই যে বিবর্তন এটা স্বদেশের দুর্গরক্ষার জন্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে জাতীয়তাবাদ ছিল না, তাই পুনরুজ্জীবনবাদও ছিল না। নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদই পুনরুজ্জীবনের উত্থানের কারণ। আনন্দমঠ থেকে গোরা পর্যন্ত সময়টা ছিল রিভাইভালবাদের মধ্যাহ্নকাল। রবীন্দ্রনাথ প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন। ‘সবুজপত্রে’ যাঁকে পাই তিনি রেনেসাঁসের রবীন্দ্রনাথ।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর দেখা গেল রেনেসাঁসের পাল থেকে হাওয়া সরে গেছে। কারণ খাস ইউরোপেই একটা হাওয়াবদল হয়েছে। জীবনের মূল প্রত্যয়গুলোই মার খেয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। কবিদের কেউ কেউ নিশ্চিত অন্বেষণে ক্যাথলিক ডগমার আশ্রয় নিয়েছেন। রেনেসাঁস মানুষকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার পরিণতি কমিউনিজম ও ফ্যাসিজম? না রেনেসাঁসের আদর্শের ভিতরেই বিনাশের বীজ নিহিত ছিল? দুই মহাযুদ্ধের মাঝখানে একটা হিসাবনিকাশের পালা চলে। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এসে আরেক দফা মার দেয় ও আরও বিধ্বংস ঘটায়। বাইরের ভাঙন পুনর্গঠিত হয়। কিন্তু ভিতরের ভাঙন চায় নতুন নিশ্চিতি, নতুন বিশ্বাস, নতুন স্বপ্ন, নতুন কল্পনা। কেউ কেউ তার জন্যে রাশিয়ার বা চীনের দিকে চেয়ে আছেন। কেউ কেউ-বা আমেরিকার দিকে। ইউরোপের নিজের বলতে যেটা ছিল সেটা আত্মরক্ষায় ব্যাপৃত। সেও করছে তার দুর্গরক্ষা। তারও স্বাধীনতা বিপন্ন। যদিও ঠিক আক্ষরিক অর্থে নয়। ইউরোপ যাকে রক্ষা করতে চায় তা দু-হাজার বছর আগেকার ইউরোপ নয়, গত তিন-চার শতকের ইউরোপ।

এই যখন খাস ইউরোপের অবস্থা তখন তার কাছে থেকে যাঁরা প্রেরণা পেতেন তাঁদের অবস্থা করুণ। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পুনরুজ্জীবনবাদের পুরোনো অজুহাত আর নেই, তবু পরাধীন ভারতের মতো স্বাধীন ভারতেও পুনরুজ্জীবনবাদ নতুন অজুহাতে কাজ করে যাচ্ছে। ইসলাম তার শত্রু, কমিউনিজম তার শত্রু। কিংবা তারাও নয়, প্রগতিশীল মতবাদ তার শত্রু। দেশের একভাগই অপরভাগের শত্রু। নূতনই পুরাতনের শত্রু। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় হতে পারে, কারণ একটার অস্তিত্ব অপরটার নাস্তিত্ব নয়। কিন্তু নূতন ও পুরাতনের সঙ্গে সমন্বয় কেমন করে সম্ভব? একটার অস্তিত্ব যে অপরটার নাস্তিত্ব। নূতন থাকলে পুরাতন থাকে না, পুরাতন থাকলে নূতন থাকে না। তাদের মধ্যে সম্ভব যেটা, সেটা অন্বয়রক্ষা। তার বেশি রক্ষা করতে গেলে নূতনের বাড় বাধা পায়। বিদেশের হাত থেকে মুক্তি মিলবে কবে? যে যুগ পৃথ্বীরাজেরও পূর্বের?

রেনেসাঁস মানুষকে ধর্ম নির্বিশেষে জাতি নির্বিশেষে, বর্ণ নির্বিশেষে ও শ্রেণি নির্বিশেষে যে মহত্ত্ব দিয়েছে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তা দেয়নি। জাতীয়তাবাদও না, পুনরুজ্জীবনবাদও না, কমিউনিজমও না। আরও পুরাতন হিন্দু ধর্মও না, ইসলামও না। সেইজন্যে মানব-ইতিহাসে রেনেসাঁসের একটি মহৎ স্থান নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে ও থাকবে। তার আয়ুকাল যতই ক্ষীণ হোক-না কেন। রেনেসাঁসের দরুন মানুষের মহত্ত্ব যদি বেড়ে গিয়ে থাকে তবে সেমহত্ত্ব স্বীকার করেছেন যাঁরা তাঁদেরও মহত্ত্ব বেড়ে গেছে। ধর্মযাজকদের চেয়ে বৈজ্ঞানিকদের মহত্ত্ব বেশি, দার্শনিকদের মহত্ত্ব বেশি, কবি ও নাট্যকারদের মহত্ত্ব বেশি, ভাস্কর ও চিত্রকরদের মহত্ত্ব বেশি, এটা গত চার-পাঁচ শতাব্দীর লাভ। এই চার-পাঁচ শতাব্দীর বেশিরভাগ ভারতের বাইরে ছিল বলে ভারত তার থেকে কম লাভবান হয়নি। ভারত যদি নেপালের মতো পুরোপুরি তার বাইরে থাকত তা হলে সেই লাভ থেকে বঞ্চিত হত। কূপমন্ডূকের মতো স্বাধীন থেকে আফগানিস্তান যা পেয়েছে বাংলাও তাই পেত। তাতে তার অষ্টাদশ শতাব্দী প্রলম্বিত হত। ঊনবিংশ শতাব্দী বন্ধ্যা যেত।

একথা সত্য যে রেনেসাঁস জনগণের মধ্যে ছড়ায়নি। ধর্মই সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ধর্মকে স্থানচ্যুত করে কমিউনিজম তার জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে বসতে চায়, যেমন বসেছে রাশিয়ায় ও চীনে। এটা নাকি ইতিহাসের লিখন। কিন্তু এখনও এই লিখন সব দেশের মানুষের কপালে লেখা হয়নি। লেখা হয়ে থাকলে পড়া যাচ্ছে না। ভারতের ভাগ্য অনিশ্চিত। ভারতের সাধারণ লোক ধর্মের কাছ থেকে যা পেয়েছে তাকে ভবিষ্যতের আশায় হাতছাড়া করতে চায় না। তেমনি শিক্ষিত মহল রেনেসাঁসের কাছ থেকে যেটুকু পেয়েছে সেইটুকুর মূল্য বোঝে। তার থেকে বঞ্চিত হলে তাদের চেহারা হত টোলের পন্ডিত ও মাদ্রাসার মৌলবির মতো। তা দেখে জনগণ পায়ে লুটিয়ে পড়ত। কিন্তু জনগণের তাতে মাথা উঁচু হত না। যেটুকু হয়েছে সেটাও রেনেসাঁসের হাওয়া লেগে রয়েছে। এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে। গত শতাব্দীর নবজাগরণ ও বর্তমান গণজাগরণ তাদের উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। একটির অগ্রপথিক রামমোহন, অপরটির গান্ধী।

রামমোহন কেবল রেনেসাঁসের নন, রিফর্মেশনেরও অগ্রণী। যদি রেফরমেশন শব্দটা প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত হয়। রেনেসাঁসও কি যুক্তিযুক্ত নাকি? রামমোহনের যেমন দ্বৈত ভূমিকা গান্ধীজিরও তেমনি। তিনি ভারতের মুক্তি চেয়েছিলেন যেমন ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে তেমনি আধুনিক সভ্যতার হাত থেকেও। এই দ্বিতীয় ভূমিকায় তাঁকে মনে হতে পারে পুনরুজ্জীবনবাদীর মতো। কিন্তু তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার স্বাধীনতা অবিকল বৈজ্ঞানিকদের মতো। সেস্বাধীনতা তিনি গুরু পুরোহিত বা পন্ডিতদের পায়ে সঁপে দেননি। করুণার অনুরোধে গোবৎস বধের বিধান দিয়েছেন। সাম্যের অনুরোধে হরিজন পাত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ পাত্রীর বিবাহ দিয়েছেন। জন্মত দ্বিজ হয়েও উপবীত ধারণ করেননি। পেশা কী জানতে চাইলে বলেছেন চাষি ও তাঁতি। যে রামরাজ্যের স্বপ্ন তিনি দেখেছেন তা ত্রেতাযুগের রাজা রামের রাজ্য নয়, যিশু যাকে বলতেন ভগবানের রাজ্য। সেটাও একপ্রকার ইউটোপিয়া।

তবে এটাও ঠিক যে আধুনিক সভ্যতা বলতে ইউরোপে যা বোঝায় তা তিনি ইউরোপের পক্ষেও অহিতকর মনে করতেন। তাঁর মতে সেটা একটা রোগ। ইউরোপ থেকে সেটা ভারতেও সংক্রামিত হচ্ছে। তার আগে যে ইউরোপ ছিল তার সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল না। পুঁজিবাদ ও শিল্পায়ন মিলে তাকে বিপথগামী করে। বিপথগামিতাকেই সেসভ্যতা বলে ভুল করে। একই ভুল করবে ভারত, যদি একইভাবে বিপথগামী হয়! আবহমানকালের পাশ্চাত্য সভ্যতার কতটুকু অংশ এই আধুনিক সভ্যতা! শুধু এই অংশটুকুর সঙ্গেই তাঁর কলহ, সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে নয়। দেশ স্বাধীন হয়ে যদি এই বিপথ ধরে তা হলে দেশের সঙ্গেও তাঁর কলহ বাধবে। আধুনিকতার সংজ্ঞা তাঁর কাছে ছিল নেহাত সংকীর্ণ। আরও প্রশস্ত হলে তাঁর বিচার অন্যরূপ হত। সব দিক দেখার সুযোগ তিনি পাননি। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বা পরাধীন ভারত থেকে সব দিক দেখা যায় না। তা ছাড়া সমকালীন ইউরোপীয়দের অনেকে আধুনিক সভ্যতার বিরূপ সমালোচক ছিলেন। নীতির দৃষ্টিতেই তাঁরা দেখতেন। গান্ধীজির দৃষ্টিও নীতির দৃষ্টি। টলস্টয়ের মতো, রাস্কিনের মতো।

‘দেশকে স্বাধীন করতে সকলেই পারে। আমি চাই জনগণকে জাগাতে।’ গান্ধীজি বলেছিলেন আগস্ট আন্দোলনের প্রাক্কালে। স্বাধীনতার সংগ্রাম তাঁর আগেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু জনগণের জাগরণ তাঁর অপেক্ষায় ছিল। কোনো পুনরুজ্জীবনবাদী নেতা এই কাজটি পারতেন না। জনগণকে বিভ্রান্ত করা সহজ, কিন্তু তাদের আস্থা অর্জন করা সহজ নয়। প্রাচীন ভারতে জনগণ বলতে বোঝাত শূদ্র বা ছোটোলোক। শূদ্র মানেই ক্ষুদ্র। কোনো অধিকারই তাদের ছিল না। প্রাচীন ভারতকে ফিরিয়ে আনা বা সেখানে ফিরে যাওয়া তাদের দিক থেকে প্রতিক্রিয়া। কেনই-বা তারা তেমন এক আদর্শের জন্যে লড়বে। পুনরায় শৃঙ্খলিত হতে কে চায়!

আমাদের রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটেনমেন্ট ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছিল। বাকি ছিল ফরাসি বিপ্লব। তারই সঙ্গে তুলনীয় এই গণজারণ। এটা একদিনে ঘটেনি। এর জন্যে মানসিক প্রস্তুতি চলেছিল শতখানেক বছর ধরে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা তিনটি বনিয়াদি আদর্শ ছিল এর পশ্চাতে। মৈত্রীরই অন্য নাম অহিংসা। আমাদের রেনেসাঁস যেমন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের হুবহু নকল নয় তেমনি আমাদের ফরাসি বিপ্লবও ইউরোপের ফরাসি বিপ্লবের নির্বিচার অনুকরণ নয়। দেশ অনুসারে কাল অনুসারে পাত্র অনুসারে ভিন্ন। একই স্পিরিট কাজ করছিল এদেশেও, সেইজন্যে এদেশেও রাজতন্ত্র তথা সামন্ততন্ত্রের পতন হল। তবে পুরোহিততন্ত্রের পতন হয়নি, তার বদলে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রবর্তন আমাদের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম। ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে গান্ধীজিকেই বলতে শোনা যায় আমাদের রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার। ইতিমধ্যেই তিনি নিরীশ্বরবাদীদের কোল দিতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সত্যই ভগবান। নিরীশ্বরবাদীও সত্যের সাক্ষাৎকার পেতে পারেন। এক শিষ্যকে এই মর্মে লিখেছিলেন, ‘কে জানে তোমার নিরীশ্বরবাদ হয়তো আমার ঈশ্বরবাদের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। হয়তো উৎকৃষ্ট।’ সেই ব্রাহ্মণ শিষ্যের কন্যার বিবাহ হরিজন পাত্রের সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে তাঁরই আশ্রমে ও তাঁরই উপস্থিতিতে, এই অনুরোধে সম্মত হবার পরেই তিনি নিহত হন। হত্যাকারীরা বর্ণাশ্রমবাদী হিন্দু।

ফরাসি বিপ্লব রুশ বিপ্লব নয়। ধনতন্ত্রের উচ্ছেদ তার অন্বিষ্ট নয়। সুতরাং ভারতের গণজাগরণ ততদূর যায়নি বলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। গান্ধীজিকেও দোষী করা যায় না। মার্কসবাদ ভারতে এসে পৌঁছোয় প্রথম মহাযুদ্ধের পরে। মার্কসবাদী চিন্তার প্রসার হয় আরও দুই দশক বাদে। মার্কসবাদীরা যখন কোনো বিপ্লবের উদ্যোগ করেন তার আগেই দেশ হয়েছে স্বাধীন। জনগণ নতুন কোনো অগ্নিপরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত নয়। গান্ধীজি তাঁদের বার বার তিন বার অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে তাদের শক্তির সঞ্চয় নি:শেষিত করেছিলেন। বাকি যেটুকু ছিল সেটুকু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় লক্ষ্যভ্রষ্ট। লক্ষ্যে ফিরিয়ে না এনে নতুন কোনো পরীক্ষায় নিযুক্ত করা ছিল গান্ধীজিরও অসাধ্য। তাই তিনি অসহায়ভাবে দেশভাগ মেনে নেন। মার্কসবাদীরাও যে ব্যর্থ হবেন এটা বিচিত্র নয়। বিচিত্র এই যে তাঁরা রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে একনিশ্বাসে ধনতন্ত্রের পতনও প্রত্যাশা করেছিলেন। যেখানে সাম্প্রদায়িকতার আগুন গান্ধীজিকেই দগ্ধ করেছে সেখানে মার্কসকেও কি করত না?

মার্কসবাদের উদ্ভবও পশ্চিম ইউরোপে। সেযখন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়ায় তখন সেটা অসঙ্গত মনে হয় না। অসঙ্গতির কথা ওঠে রেনেসাঁসের বেলা। আসলে বৌদ্ধ ধর্মের মতো, খ্রিস্টধর্মের মতো, ইসলামের মতো আধুনিক যুগের বড়ো বড়ো মুভমেন্টগুলিও সর্বত্রসঞ্চারী। আজকের দিনে আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশ কে দেশ ন্যাশনালিজম, ডেমোক্রেসি আর সোশ্যাল জাস্টিস এই তিনটি সত্ত্ব স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক মেনে নিচ্ছে। তিনটির উৎপত্তি পশ্চিম ইউরোপে। যে পশ্চিম ইউরোপ আরও আগে রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটমেন্টের ভিতর দিয়ে গেছে। এইসব পর্যায় মানুষের মনের দুয়ার একটু একটু করে খুলে দিয়েছে। দুয়ার খোলা পেয়ে ওইসব আইডিয়া বা আইডিয়াল ক্রমে ক্রমে প্রবেশ করেছে। তবে সব দেশের বিবর্তন একইরকম নয়। আফ্রিকার দেশগুলিতে রেনেসাঁসের পূর্বেই ন্যাশনালিজম গিয়ে হাজির হয়েছে। তেমনি আরব দেশগুলির কয়েকটিতে ডেমোক্রেসির পূর্বেই সোশ্যাল জাস্টিস।

জব চার্নক কলকাতা বন্দর প্রতিষ্ঠা করার পর পিটার দ্য গ্রেট করেন পিটার্সবুর্গ বন্দর প্রতিষ্ঠা। সমুদ্রপথে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়াকে যুক্ত করে দেন। জার্মানির এক রাজকুমারী পরে হন রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী। ক্যাথরিন দ্য গ্রেট অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মানির মতো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। গড়ে ওঠে একটি বিদ্বৎসমাজ। এর পূর্বে রাশিয়াকে কেউ ইউরোপের অঙ্গ মনে করত না। রাশিয়ানরাও না। এরপরেও উভয়পক্ষেরই দ্বিধা যায় না। ইউরোপ সম্বন্ধে বঙ্কিমের যে মনোভাব টলস্টয় ও ডস্টয়েভস্কিরও সেই মনোভাব। অপরপক্ষে মাইকেলের যে মনোভাব টুর্গেনিভেরও সেই মনোভাব। লেনিন ছিলেন ইউরোপমনস্ক, স্টালিন ছিলেন রুশমনস্ক। রাশিয়া এখনও এ দোটানা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বোধ হয় চায়ও না।

রাশিয়ার বরাত ভালো যে সে-দেশে পিটার দ্য গ্রেট ও ক্যাথরিন দ্য গ্রেট গোড়াপত্তন করেছিলেন। চীনে তো এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও দরজা জুড়ে বসেছিলেন মাঞ্চুসম্রাজ্ঞী। সাংহাই প্রভৃতি কয়েকটি জানালা দিয়ে ঢুকেছিল বাইরের আলো-হাওয়া। তার ফলে যেটা হয়েছিল সেটা হয়তো একপ্রকার রেনেসাঁস, কিন্তু যেমন বিলম্বিত তেমনি দুর্বল। এরকম দেশ মার্কসবাদী হতে পারে, বিপ্লবের ভিতর দিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ‘একশোটি ফুল’ ফোটাতে চাইলে কী হবে, একটিও ফুল ফোটাতে পারে না। রাশিয়ায় ও-কাজটি বিপ্লবের পূর্বে এগিয়ে রয়েছিল, পরে এগিয়েছে, কিন্তু সাহিত্যে নয়, বিজ্ঞানে। রাশিয়ার লোক সাবেক আমলের ব্যালেকে চক্ষের মণির মতো রক্ষা করেছে, যদিও তা অভিজাতকুলের।

রেনেসাঁস যেখানে ঘটে সেখানে ধর্মযাজক বা মান্দারিন বা ব্রাহ্মণ বা উলেমার চেয়ে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বা নাট্যকার বা ভাস্করের মহত্ত্ব বৃদ্ধি পায়। রেনেসাঁসের পূর্বে কেউ ভাবতেই পারত না লিওনার্দো বা শেক্সপিয়ার বা গ্যালিলিয়ো বা বেকনের কী মহত্ত্ব। মানুষকে এঁরা কত বড়ো উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সেসব এভারেস্ট বা কাঞ্চনজঙ্ঘায় আরোহণের জন্যে শত শত মানুষ জীবন পণ করেন। কেড-বা পৌঁছোন, কেউ-বা পথে মারা যান। পৃথিবীকে দেশ অনুসারে ভাগ না করে যুগ অনুসারে ভাগ করলে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগ কোথাও আগে এসেছে, কোথাও পরে, কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এটা একটাই যুগ। এ যুগে যেখানেই যিনি কাজ করে থাকুন-না কেন সকলের জন্যেই করেছেন, সকলের হয়ে করেছেন। সেইজন্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালিরা এত সহজে শেক্সপিয়ারকেও রোমান্টিক কবিদের আপনার করে নেন। দেশ কিংবা ভাষা সেখানে অন্তরায় হয় না। পরাধীনতা কিংবা পুঁজিবাদী শোষণ সেখানে রসভঙ্গ করে না। লোকে যেমন কবিরাজ ছেড়ে ডাক্তার ডাকে তেমনি মঙ্গলকাব্য ছেড়ে স্কট ডিকেন্স পড়ে। এই যে রুচিবদল এর থেকে আসে পালাবদল। সাহিত্যে নবযুগ। পুরাতনের সঙ্গে যার ভাষার মিল, কিন্তু ভাবের মিল পরদেশির সঙ্গে। পরদেশি হলেও সেস্বকালের। কালগত ব্যবধান না থাকায় শেলি, কিটস, বায়রন নিকটতর; রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র দূরতর।

কিন্তু নিজের দেশেও যখন বায়রন ও স্কট জন্মালেন তখন বিদেশের বায়রন ও স্কট হলেন দূরতর। দেশগত ব্যবধান না থাকায় মাইকেল ও বঙ্কিম হলেন নিকটতর। স্বদেশীয়রা পৃষ্ঠপোষকতা না করলে স্বদেশি কারুশিল্প দাঁড়াতে পারবে না এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য স্বদেশীয়রা পৃষ্ঠপোষকতা না করলে স্বদেশি চারুকলাও দাঁড়াতে পারবে না। চারুকলার মধ্যে পড়ে কাব্য উপন্যাস নাটক। এই স্বদেশি মনোভাব থেকে আসে শেক্সপিয়ার ছেড়ে কালিদাসের দিকে দৃষ্টিপাত। বায়রন ছেড়ে মহাভারতের দিকে দৃষ্টিপাত। হারিয়ে যাওয়া খেই ফিরে পেতে আকাঙ্ক্ষা জাগে। অজন্তার খেই ফিরে পেয়ে চিত্রকরদের হাত খুলে যায়। পুরাণের খেই ফিরে পেয়ে নাট্যকারদের। এরই নাম রিভাইভাল। কিন্তু উপন্যাসের বা ছোটোগল্পের বা প্রবন্ধের কোনো প্রাচীন আদর্শ পাওয়া গেল না, অগত্যা আধুনিক ইউরোপের দিকেই দৃষ্টিপাত করতে হল। বিষয়টা রইল স্বদেশি, কিন্তু আঙ্গিকটা হল আধুনিক, আধুনিকতর, অত্যাধুনিক। বিদেশের সঙ্গে তাল রেখে। প্লট চুরি করে বা ধার করে বিদেশিকেও স্বদেশি বলে চালিয়ে দেওয়া গেল।

প্রথম মহাযুদ্ধের পরে আসে গান্ধী উদবোধিত গণজাগরণ। গত শতাব্দীর নবজাগরণের মতো এই শতাব্দীর গণজাগরণও জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গণসত্যাগ্রহও একপ্রকার বিপ্লব। এতে নীচের মানুষকে উপরে তুলে দেওয়া হয়, উপরের মানুষকে নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়। রেনেসাঁসের সময় যেমন বৈজ্ঞানিক দার্শনিক প্রভৃতির মহত্ত্ব বেড়ে যায়, রেভোলিউশনের সময় তেমনি সাধারণ লোকের, বিশেষ করে চাষি মজুরের। গণসত্যাগ্রহের দিন এরাই গণ। বিপ্লবের দিন এরাই বরযাত্রী।

সাহিত্যের আসরে কিন্তু এদের হাজির করা শক্ত। ক-জন সাহিত্যিক আছেন যাঁরা এঁদের সঙ্গে জুটে মাঠেময়দানে রাজদ্বারে শ্মশানে গেছেন। আন্দোলনের ভিতর থেকে এঁদের দেখেছেন? পারতেন যাঁরা তাঁরাও রাজদ্রোহের ভয়ে পারেননি। তার চেয়েও ভয় নেতারা কী মনে করবেন। বাস্তবানুগ ছবি আঁকলে নেতাদের তো দেবতার মতো করে দেখানো যাবে না। দোষে-গুণে মানুষের মতো করে আঁকতে হবে। দোষগুলো সাহিত্যে অমর হলে কোন নেতা সেটা ক্ষমা করবেন? কাজগুলোও সবসময় বীরোচিত নয়। অথচ তাকে যদি মানুষের মতো করে আঁকা হয় তো আপত্তি উঠবে, আঁকতে হবে তাকে শয়তানের মতো করে।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথা গণজাগরণের বাস্তবানুগ কাহিনি অল্পই লেখা হয়েছে। একদিন হয়তো তা নিয়ে একটা মহাভারত লেখা হবে। যিনি লিখবেন তাঁকে দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী তাঁদের পক্ষে এটা শক্ত। আর যাঁরা পাঁচজনের মুখে শুনেছেন তাঁদের বিবরণ হয়তো ঘটনার দিক থেকে শুষ্ক শীতল নিষ্প্রাণ।

ত্রিশের দশকের আগেই বস্তিবাসীকে সাহিত্যে আনা হয়েছিল, এর পরে আনা হল চাষাভুসা জেলে মাঝিদের। এরা হয়তো সংগ্রামরত নয়। পরে যাদের আনা হল তারা সংগ্রামী জনতা। কিন্তু তাদের সংগ্রাম দেশের জন্যে নয়, শ্রেণির জন্যে। এটা জাতীয়তাবাদী লেখকদের পক্ষে অসম্ভব। সাম্যবাদী বা প্রগতিবাদী লেখকদের পক্ষেই সম্ভব। দেশ স্বাধীন হবার পূর্বেই শ্রেণিসংগ্রাম সাহিত্যের আসরে জায়গা করে নেয়। স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদকে কোণঠাসা করে, যদি-না সেটা হয় সন্ত্রাসবাদ।

কিন্তু গণজাগরণ থেকে যে জিনিসটি আশা করে গেছিল সেই জিনিসটি হল না। শিক্ষিত স্তরের সঙ্গে অশিক্ষিত স্তরের ব্যবধান লোপ। বামপন্থী কবির রচনাও শিক্ষিত ভিন্ন আর কেউ পড়ে না। আর কেউ বোঝে না। কেমন করে বলব ইনি জনগণের সভাকবি!

নবজাগরণের যুগেও যে প্রশ্ন উঠেছিল সেই একই প্রশ্ন গণজাগরণের যুগেও অন্যভাবে উঠেছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের নায়করা ছিলেন ল্যাটিন ভাষায় শিক্ষিত, ল্যাটিন রচনায় নিপুণ। তা সত্ত্বেও তাঁরা ইচ্ছে করেই লিখলেন ইটালিয়ান ফরাসি ইংরেজি প্রভৃতি লোকভাষায়। যাতে দেশের লোকের সঙ্গে মানসিক ব্যবধান না থাকে। এদেশেও তেমনি রামমোহন ও বিদ্যাসাগর ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষিত, বিদ্যাসাগর তো সংস্কৃত রচনায় নিপুণ। তবু ইচ্ছা করেই তাঁরা লিখতেন বাংলা ভাষায়। যাতে দেশের লোকের সঙ্গে মানসিক ব্যবধান দূর হয়। ইউরোপে যেমন ল্যাটিন, তেমনি সংস্কৃত। ইউরোপে যেমন ইটালিয়ান ফরাসি ইংরেজি তেমনি ভারতে বাংলা হিন্দি মারাঠি। তা ছাড়া পারসিক শিক্ষিতমহলও ছিলেন পারসিক রচনায় সিদ্ধহস্ত। রামমোহনও তাঁদের একজন। কিন্তু নবজাগরণের সময় স্থির হয়ে যায় যে লোকভাষায় লিখতে হবে। পরবর্তীকালের ইংরেজি শিক্ষিতরাও ইংরেজি রচনায় নৈপুণ্য সত্ত্বেও বাংলায় লেখার সিদ্ধান্ত নেন। যেমন মাইকেল ও বঙ্কিম। যাতে দেশের লোকের সঙ্গে মানসিক ব্যবধান না থাকে।

রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরি প্রমুখ বাংলা ভাষার লেখকরা ক্রমে উপলব্ধি করেন যে এও যথেষ্ট নয়। সাধু ছেড়ে চলতি বাংলায় লিখতে হবে। এরূপ উপলব্ধি চীনের লেখকদেরও হয়েছিল। প্রমথ চৌধুরি মহাশয়ের প্রচেষ্টা এতদিনে সফল হয়েছে। চলতি বাংলার প্রচলন বেশি। যদিও এ রীতি পূর্ব বাংলার নয় তবু পূর্ব বাংলার সাহিত্যিকরাও একে উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এতদূর আসার পরও দেখা যাচ্ছে এ ভাষা শিক্ষিত মহলেরই ভাষা। ইংরেজি শিক্ষিত না হয়ে বাংলা শিক্ষিত হলেও তাঁরা শিক্ষিত। তাঁরা সংস্কৃতিমান। কালচারের মধ্যে দিয়ে একটা কর্ষণের ভাব আছে। তাঁরা কর্ষণ করেছেন। লাঙল দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে, বিদ্যা দিয়ে। তাঁদের ভাষা ঠিক জনগণের ভাষা নয়, যদিও লেখেন কথ্যরীতিতে।

এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরি মহাশয় একবার আমাকে বলেছিলেন এই মর্মে, ‘যে ভাষায় আমি লিখি সেটা কথ্যভাষা, কিন্তু সাধারণ লোকের মুখের ভাষা নয়। তাদের কাছে এখনও পৌঁছোতে পারিনি।’ এর জন্যে তাঁর মনে আফশোস ছিল।

সেআফশোস তাঁর একার নয়। বিদগ্ধ নাগরিকদের মার্জিত ভাষা যেন ভিটামিনবর্জিত ছাঁটা সিদ্ধ চালের ফ্যানগালা ভাত। তাতে না থাকে স্বাদ, না হয় পুষ্টি। তা ছাড়া তাঁর মননও তাঁকে দূরের মানুষ করে। কথ্যরীতির দরুন ব্যবধান কমতে পারে কিন্তু উচ্চচিন্তার দরুন দূরত্ব থেকে যায়।

গণজাগরণের পূর্বেই বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরির কথ্যরীতিতে লেখা আরম্ভ হয়ে যায়। গণজাগরণের পরে এটা আরও ব্যাপক হয়। কিন্তু প্রশ্নটা ব্যাপ্তির প্রশ্ন নয়। ব্যবধানলোপের প্রশ্ন। আমাদের বামপন্থী লেখকরা গণজাগরণের পরে এসেছেন। এঁদেরই তো লোকমুখের ভাষার সঙ্গে লেখনীরূপ ভাষার কোনোরূপ ব্যবধান না রাখা। কিন্তু লেখেন যাঁরা তাঁরা ভদ্রলোক। পড়েন যাঁরা তাঁরাও ভদ্রলোক, ভদ্রলোকদের পালিশ করা ভাষাতেই লেখা হয়। আঙ্গিক তো আরও সোফিস্টিকেটেড। এর জন্যে যে নাগরিকত্বের দরকার সেজিনিস জনগণের নাগালের বাইরে। যে নাগরিকত্বের দরকার সেটাও বহুপুরুষার্জিত। মতবাদ হয়তো অভিন্ন, কিন্তু মনের গড়ন যে ভিন্ন। একইরকম ইউনিফর্ম পরিয়েও একজন ভদ্রলোককে একজন শ্রমিকের সঙ্গে একাকার করতে পারা যাবে না। শ্রমিককে ভদ্রলোক করলেও করতে পারা যায়, কিন্তু ভদ্রলোককে শ্রমিক করা কারও সাধ্য নয়। যদি-না তাঁকে জেলে পাঠিয়ে ঘানি ঘোরাতে বাধ্য করা হয়। কিংবা সমস্ত দেশটাকে একটা কারাগারে পরিণত করা হয়। তার মানে প্রোলেতারিয়েতের ডিকটেটরশিপ।

আমাদের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কী না ঘটেছে! এটাই-বা না-ঘটবে কেন? গণতন্ত্রকে অন্তহীন সুযোগ কেউ দেবে না। যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তার সদব্যবহার না করলে রাজতন্ত্রের মতো গণতন্ত্রও একদিন যাবে। তখন ডিকটেটরশিপ ব্যতীত আর কী বিকল্প। ডিকটেটরশিপ মাত্রেই প্রোলেতারিন নয়। দৃষ্টান্ত স্পেন। দৃষ্টান্ত গ্রিস। তা ছাড়া দেশটা বৃহৎ ও বহুভাষী। সুতরাং আবার ভাগ হয়ে যেতে পারে। তারপরে কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও একনায়কত্ব, কোথাও শ্রমিকের রাজত্ব, কোথাও সৈনিকের রাজত্ব। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে। ধর্ম নির্বিশেষে। ভাষা নির্বিশেষে। শ্রেণি নির্বিশেষে। মতবাদ নির্বিশেষে। এটা শুধু গণতন্ত্রেই সম্ভব। গণতন্ত্র যদি সকলের শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা পায়।

গণজাগরণের পর থেকে জনগণের গুরুত্ব বেড়ে গেছে, অথচ নবজাগরণ যাদের গুরুত্ব দিয়েছিল সেই ভদ্রলোকশ্রেণির গুরুত্ব কমেনি। কেনই-বা কমবে? ভদ্রলোকরা কি সংস্কৃতির দায়িত্ব পালন করেননি? সাহিত্যকে বিজ্ঞানকে সংগীতকে নাট্যকে ললিতকলাকে এগিয়ে দেননি? এই দেড়শো বছরের ইতিহাস কি অগ্রগতির ইতিহাস নয়? অগ্রগতি সবসময় সরলরেখায় হয় না, নদীর মতো আঁকাবঁাকা গতিও অগ্রগতি, স্পাইরালের মতো উঁচু-নীচু গতিও অগ্রগতি। যেখানে রিভাইভালবাদ পেছনে টানছে সেখানে রেনেসাঁসবাদ সামনে টেনে নিয়ে যেতে বাধা পায়। তা সত্ত্বেও যদি আমাদের সংস্কৃতি চার-পাঁচ শতাব্দীর পথ দেড় শতাব্দীতেই অতিক্রম করে থাকে তবে আমি তো বলব অসাধ্যসাধন করেছে। এদেশ শুধু যে পরাধীন ছিল তা-ই নয়। ছিল জগতের কালপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন মরা গাং। এখানে যে আবার প্রবাহ ফিরে এসেছে, জোয়ার-ভাটা খেলছে, জাহাজ চলাচল করছে, এর জন্যে আমাদের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মুক্তমনা সাহিত্যিকদের ধন্যবাদ দিতে হয়।

তাঁদের প্রেরণা আসত প্রধানত দুটি উৎস থেকে। একটি তো প্রাচীন ভারত, অপরটি আধুনিক ভারত। ক্রমে ক্রমে দুটি উৎসই শুকিয়ে আসে। সংস্কৃত কাব্য ও নাটক থেকে নতুন কিছু পাওয়া যায় না। রামায়ণ মহাভারত থেকে পাওয়া যায়, কিন্তু নতূন রূপ দিতে সাধ্যে কুলায় না। রবীন্দ্রনাথ একবার আমাকে বলেছিলেন অর্জুনের চোখের উপর কৃষ্ণের পরিবারের নারীদের হরণ করে নিয়ে যায় দস্যুরা, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় হৃত হয়, যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল যে তাদের প্রেমিকরা তাদের হরণ করে নিয়ে যাবে দস্যু সেজে। কেমন চমৎকার একটি বিষয় যা নিয়ে নাটক লেখা যায়। কিন্তু লিখবে কে? কবির বয়স গেছে, সাহস হয় না। লিখব আমরাই। কিন্তু আমরাও লিখিনে। কারণ লিখলে সেটা হবে ধর্মদ্রোহ। ভাগ্যিস মহাভারত লেখা হয়ে গেছল কৃষ্ণের অবতারত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বে। রামায়ণও রামের অবতারত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বে। এসব গ্রন্থ থেকে বিষয় নিয়ে তাকে নতুন রূপ দিলে ভক্তরা প্রকাশ বন্ধ করে দেবেন।

তার চেয়ে সোজা ইউরোপ থেকে ভাব সংগ্রহ করা ও তাকে নূতন রূপ দেওয়া। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পর পশ্চিম ইউরোপের মহিমা ক্রমেই অস্তাচলমুখী হয় ও আমাদের লেখকদের দৃষ্টি পড়ে রাশিয়ার উদয়াচলের উপর। পরে সেদিক থেকেও প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। বিনা বিচারে বা নামমাত্র বিচারে বা স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শত শত ব্যক্তির প্রাণদন্ড মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ইনকুইজিশনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পোপ যদি অভ্রান্ত না হয়ে থাকেন স্টালিনও কি অভ্রান্ত? সেই যে খটকা বঁাধে সেটা পরে আরও দৃঢ় হয়। পশ্চিম ইউরোপের মতো রাশিয়ার মহিমাও হ্রাস পায়। বাইরের দিকে তাকানো ছেড়ে আমরা ঘরের দিকে তাকাই, কিন্তু পুরাণের দিকে নয়। লোকসংস্কৃতির বহমান ধারার দিকে। এর থেকে রস আহরণ করি। কিন্তু আলো পাইনে। রূপও কি পাই? লোকসংগীত যেমন মার্গসংগীতের অভাব পূরণ করতে পারে না লোকসাহিত্যও তেমনি মার্গসাহিত্যের।

তবে প্রাণশক্তির অভাব হলে জনগণের জীবন সেঅভাব পূরণ করতে পারে। যদি তারা থাকে মাটির কাছাকাছি। কিন্তু তারা যদি শহরে চলে আসে ও মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে তবে তাদেরও প্রাণশক্তিতে টান পড়বে। সব ক-টি উৎস শুকিয়ে এলে সাহিত্য রচনাও অবক্ষয়ী হবে। মাটির সঙ্গে সংযোগ থেকেই প্রাণশক্তি। বিয়োগ থেকেই অবক্ষয়।

সাহিত্যকে ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর দায়িত্ব যদি ভদ্রলোকদের হাত থেকে আর কোনো শ্রেণির হাতে যায় আমি একটুও দুঃখিত হব না। এই সম্প্রতি কারো কারো ভাগ্যে ধনসম্পদ জুটছে, নয়তো সরস্বতীর সেবকরা লক্ষ্মীর কৃপা থেকে চিরদিন বঞ্চিত। যে গাধাখাটুনি তাঁদের খাটতে হয় তার অনুপাতে পারিশ্রমিক তাঁদের অকিঞ্চিৎকর। শ্রমিক হলে তাঁরা পর্যাপ্ত মজুরির দাবিতে ধর্মঘট করতেন, ওভারটাইমের জন্য বাড়তি মজুরি চাইতেন, নিয়মিত ছুটি চাইতেন। শ্রমিকদের অবস্থার যখন আরও উন্নতি হবে তখন দেখা যাবে শ্রমিক হওয়াই অধিকতর লাভজনক। দুটি-একটি বিভাগ বাদ দিলে সাহিত্যকর্মী অর্থকরী নয়। আর সেই দুটি-একটি বিভাগে এত বেশি কর্মী যে অধিকাংশের বরাতেই লাভের ঘরে শূন্য। জীবিকার জন্যে অন্য কিছু করতে হয় বলেই সাহিত্যকর্মে শ্রমদান পোষায়। কিন্তু এমনও হয় যে সেই অন্য কিছুর পেছনে সমস্ত শক্তি যায়, সাহিত্যকর্মের জন্যে উদবৃত্ত যেটুকু থাকে সেটুকু অতি সামান্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ এর একটা সামাধান করেছিল। লেখকদের অনেকের ছিল বাপ-খুড়োর পিসি-মাসির রেখে যাওয়া টাকা বা সম্পত্তি। এদেশে তার উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীতে করবৃদ্ধির ফলে লেখকদের সেই প্রাইভেট আয়ের স্বর্গসুখ গেছে। তবে পাঁচ রকমের উপার্জনের পন্থা খোলা আছে। এদেশে সেটারও অভাব।

মোট কথা সাহিত্যের কাজ হচ্ছে প্রেমের শ্রম। যে প্রেমিক সে-ই শ্রমিক। পারিশ্রমিক কেউ পায় কেউ পায় না। যে পায় সেপাওনার চেয়ে কম পায়। এইভাবেই এতদিন কাজের লোক পাওয়া গেছে। এরপরে যদি না পাওয়া যায় তবে সাহিত্যের অনেকগুলি বিভাগ অপুষ্ট থাকবে। উপন্যাসের অতিস্ফীতিই সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ নয়। যাঁর উপন্যাস লেখার কথা নয়, তিনিও বছরে চারখানা উপন্যাস লিখছেন। কবিতার হাত হারাচ্ছেন, প্রবন্ধের জন্যে সময় করে উঠতে পারছেন না। সেকালে অভিজাত শ্রেণির পক্ষে কতকগুলি অবশ্যকরণীয় কৃত্য ছিল, যার বিনিময়ে তাঁরা পেতেন সম্মান। তাঁদের সেই কৃত্যকে বলা হত নোবলেস অবলিজ। তেমনি ভদ্রলোক শ্রেণির পক্ষে অবশ্যকরণীয় একটি কৃত্য হচ্ছে সংস্কৃতির জন্যে শ্রম। এটাও একরকম নোবলেস অবলিজ।

একদা অভিজাত শ্রেণির যে সাংস্কৃতিক দায় ছিল সেদায় এখন ভদ্রলোক শ্রেণির উপর বর্তেছে। এই শ্রেণি যদি সংস্কৃতিকে কেনা-বেচার একটা ব্যাপার করে তোলে ও তাই নিয়ে ব্যাবসাদারি করে তবে তার শেষ ফল হবে লোভে পাপ ও পাপে মৃত্যু। কতক সাহিত্যিককে মনে মনে বেছে নিতে হবে এমন এক পথ যেটা বিত্তময়ী সৃঙ্কা নয়। অথবা নয় সাহিত্যকে দিয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির পন্থা। সাহিত্যিকদের সত্যিকার কমিটমেন্ট সত্যের কাছে, সৌন্দর্যের কাছে, প্রেমের কাছে। প্রথমটা বৈজ্ঞানিকের মতো, দ্বিতীয়টা শিল্পীর মতো, তৃতীয়টা ধার্মিকের মতো। এর কোনোটিই রাজনীতিকের মতো বা সৈনিকের মতো নয়। তবে কোনো সাহিত্যিক যদি অন্তরে তেমন কোনো বিপদ অনুভব করেন সেস্বাধীনতা তার আছে। তখন সেটাই তাঁর কর্তব্য। এর জন্যে তাঁর হয়তো বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ঝাঁপ দিতে গেছিলেন কয়েক জন ইংরেজ লেখক। আরও এক শতক আগে গ্রিসের যুদ্ধে বায়রন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানেরও নজির আছে।

সংস্কৃতিকে এগিয়ে দেওয়া এক কথা। সমাজকে পালটে দেওয়া আরেক। এই দ্বিতীয় কৃত্যটি স্বেচ্ছায় ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন রুশো, ভলতেয়ার ও দিদেরো। তা বলে সেটি লেখক মাত্রেরই ঘাড়ে তাঁর অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সমাজকে পালটানোর ভার নিলে সাহিত্যসৃষ্টির উপর লক্ষ রাখা শক্ত। লক্ষ্যভ্রষ্ট রচনা সামাজিক পরিবর্তন ঘটালেও সাহিত্যে উচ্চ স্থান পায় না। সাহিত্যিককে সেইজন্যে ফরমাশ করতে নেই, করলে সেটা হবে লক্ষ্যভ্রষ্টতার নির্দেশ। যাঁরা ভিতর থেকে অনুশাসন পান তাঁরা তাকে প্রতিরোধ করতে পারেন না। সেটাও একপ্রকার নোবলেস অবলিজ। মানুষের আরও পাঁচটা দিক আছে। একজন সাহিত্যসৃষ্টি করেন বলে সমাজসংস্কারও করেন না তা নয়। একই লেখনী দুই কাজে নিযুক্ত হয়। যাঁর কাজ সমাজসংস্কার তিনিও করেন সাহিত্যসৃষ্টি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকের ছিল একাধিক সত্তা। বঙ্কিমচন্দ্রেরও ছিল, কিন্তু তিনি সমাজসংস্কার না সমাজসংস্করণ কোনটার সহায়তা করেছিলেন বলা কঠিন। শরৎচন্দ্র তাঁর বিধবা নায়িকাদের বিয়ে দেননি। একথা তিনি নিজেই লিখেছিলেন আমাদের এক বিখ্যাত মহিলা কবিকে।

রেনেসাঁসের মূল্যগুলি ইউরোপের যেসব দেশে অনেক দুঃখে অর্জিত হয়েছে সেসব দেশ সামাজিক ন্যায়ের অনুরোধেও পাঁচ শতাব্দীর পথ পিছু হটতে রাজি নন। যখন ছিল কর্তার ইচ্ছায় কর্ম তা তিনি যিনিই হোন—রাজা অথবা পোপ। একালে তার প্রতিরূপ রাষ্ট্রের অধিনায়ক ও পার্টির পরিচালক। আমাদের এখনও দেড় শতাব্দী যায়নি। অর্জনের জন্যে তেমন কিছু দুঃখও পোহাতে হয়নি। চিন্তার স্বাধীনতা, বচনের স্বাধীনতা, ছাপার হরফের স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমিতির স্বাধীনতা, আন্দোলনের স্বাধীনতা যখনই বাধা পেয়েছে তখনই বিলেতের লিবারল বন্ধুরা তার জন্যে লজ্জিত হয়ে সেখানকার কর্তাদের কাছে আপিল করেছেন ও তাঁরা হস্তক্ষেপ করেছেন। দেশের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া যেমন দুঃসাধ্য হয়নি, তেমনি ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করাও সহজ হয়নি। সরকারেরও জবাবদিহির দায় ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও জনমতের কাছে। ব্রিটিশ শাসন বাদশাহি শাসন ছিল না। ব্যক্তিস্বাধীনতা অনায়াসলভ্য ছিল বলেই সরকারি চাকুরিতে থাকার সময় বিদ্যাসাগর, মাইকেল, দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল অমন অবাধে অজস্র লিখতে পেরেছিলেন। কিন্তু সরকারি চাকুরি করলেও এঁরা কেউ কর্তার ইচ্ছায় লেখনী ব্যবহার করেননি। প্রশস্তি রচনা করেননি। সভাকবি বা দরবারি সাহিত্যিক হননি। ব্রিটিশভারত দেশীয় রাজ্য ছিল না। তার পাশেই ছিল অপর এক ঐতিহ্য। কিন্তু আমাদের রেনেসাঁস সেঐতিহ্য অনুসরণ করেনি। তাই আমাদের লেখকরা ছিলেন স্বাধীন লেখক। স্বাধীন দেশের লেখক না হয়েও স্বাধীন লেখক হওয়া যেত। এটা ছিল ব্রিটিশ রুদ্রের দক্ষিণ মুখ।

দেশ এখন স্বাধীন হয়েছে। এখন তো সবাই আমরা স্বাধীন লেখক। ব্যক্তিস্বাধীনতা আমাদের সংবিধানসম্মত অধিকার। একে প্রাণপণ রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় সদব্যবহার করা। যারা স্বাধীনতার সদব্যবহার করে না তারা তার যোগ্য নয়। সেটা আপনি হারিয়ে যায় বা অপহৃত হয়। লেখকের স্বাধীন লেখনীই তার সেরা সম্পদ। স্বাধীনতার বিনিময়ে আর কোনো সম্পদ কখনো সেরা সম্পদ হতে পারে না। আজকের দিনে যে প্রলোভন আমাদের সামনে ঝুলছে তেমন কোনো প্রলোভন আগেকার দিনে ছিল না। প্রলোভন মানুষকে পরীক্ষা করে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই মনুষ্যত্ব। নির্যাতনের পরীক্ষাও অন্তর্হিত হয়েছে তা নয়। ক্ষুরধার পন্থা। একধারে হেললে প্রলোভন, আরেক ধারে হেললে নির্যাতন। অপ্রমত্ত হতে হবে।

যে-দেশ যে সরকারের যোগ্য সে-দেশ সেই সরকার পায়। তেমনি যে জাতি যে সভ্যতার বা যে সংস্কৃতির যোগ্য সেজাতি সেই সভ্যতা বা সেই সংস্কৃতি পায়। আমরাও পেয়েছি। আমি এর জন্যে গৌরব বোধ করি। এই দেড় শতকের মধ্যে আমরা স্বাধীনতাহীনতার হীনতা কাটিয়ে উঠেছি। তেমনি আধুনিকতাহীনতার দীনতা। আমাদের সাহিত্য এখন স্থিতিশীলতা নয়, গতিশীল তথা প্রগতিশীল। তবে সব অঙ্গ সমান পুষ্ট নয়। সামনের দেড়শো বছর হয়তো অপুষ্ট অঙ্গের পুষ্টি হবে। সাংস্কৃতিক যেসব বিভাগ সাহিত্যের তুলনায় পশ্চাৎপদ তারাও অগ্রসর হয়ে সাহিত্যের সঙ্গে পা মেলাবে। ফ্রান্সে যেমন সাহিত্য ও চিত্রকলা পরস্পরের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে।

ভারতকে একটা উপদ্বীপ বলা হয়। আসলে কিন্তু এটা একটা মহাদ্বীপ। হিমালয়ও এককালে একটা সমুদ্র ছিল। এখনও সমুদ্রের মতো পথ রোধ করে রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের লোক দ্বৈপায়ন। তাদের মনটাও ইনসিউলার। চার যুগ, চার বর্ণ, চার আশ্রম তাদের মনের চার দেওয়াল। সেই চার প্রাচীরের অন্তরালে জনমানস অবরুদ্ধ। ইংরেজি শিক্ষার পন্ডিতরাও সংস্কৃত শিক্ষার পন্ডিতদের ভাষায় কথা বলেন। এরপরে যখন বাংলা শিক্ষার পন্ডিতরা সমাসীন হবেন তাঁদের কথাবার্তাও হয়তো একইরকম হবে। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের শিক্ষা যদি নতুন মোড় না নিত আমাদের সাহিত্যও নতুন মোড় নিত না। প্রাচীন কালের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সংস্কৃতিভিত্তিক। ব্রাহ্মণরাই তার সুযোগ পেতেন। তাই সাহিত্যও ছিল ব্রাহ্মণদের হাতে-গড়া। আধুনিক কালের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে ইংরেজিভিত্তিক। ভদ্রলোকরাই তার সুযোগ পান। তাই সাহিত্যও ভদ্রলোকদের হাতে-গড়া। প্রাচীন কালের সাহিত্যের মতো আধুনিক কালের সাহিত্যেরও পায়ের তলার মাটি সংকীর্ণ। শিক্ষা যদি বাংলাভিত্তিক হয় ও জনগণ তার সুযোগ পায় তাহলে শিক্ষার মোড় থেকে আসবে নতুন সাহিত্য। এটা যেমন একটা প্রিয় সম্ভাবনা আর একটা তেমনি হচ্ছে বিশেষ মুখ্য স্রোতের সঙ্গে ভারতের অন্তঃস্রোতের সংযোগ যেটুকু ঘটেছিল সেটুকু ছিন্ন করে দ্বৈপায়নত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এবার জনগণের কতৃত্বে।

নবজাগরণ থেকে আধুনিক সাহিত্য ও আধুনিক সংস্কৃতি, এর মধ্যে একটা পারম্পর্য আছে। তেমনি গণজাগরণ থেকে গণসাহিত্য ও গণসংস্কৃতি, এর মধ্যেও আর একটা পারম্পর্য। দুই পারম্পর্যের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে হবে আমাদের উপর এই ভার পড়েছে, যেমন আমাদের পূর্বসূরিদের উপর পড়েছিল প্রাচীন ভারত ও আধুনিক ইউরোপ দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়সাধনের ভার। নবজাগরণের লাভগুলিকে ত্যাগ করলে জনগণেরও ক্ষতি হবে। সেটা বুঝতে ওদের সময় লাগবে। যারা বোঝে তাদের কর্তব্য হবে লাভগুলিকে হাতছাড়া না করা। উপরন্তু গণজাগরণ থেকে যা লাভ করা গেছে ও যাবে সেসব লাভকেও হাত পেতে নেওয়া। জনগণের মধ্যে নতুন একটা জগৎ নিহিত রয়েছে। বীজের মধ্যে যেমন বনস্পতি। তাকে সাদরে বরণ করতে হবে। তেমনি তার কাছেও আশা করতে হবে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি।

গণজাগরণ যখন খুশি যেখানে খুশি ঘটানো যায় না। তার আগে নবজাগরণ ঘটে থাকা চাই। ইউরোপের ইতিহাসে দেখা যায় আগে রেনেসাঁস, তার পরে রিফর্মেশন, তারপরে এনলাইটেনমেন্ট, তারপরে ফরাসি বিপ্লব। মোটামুটি এই পরম্পরা রাশিয়াতেও অনুসৃত হয়েছে। ভারতেও। যদিও আমাদের গণজাগরণকে বিপ্লব বলে গণ্য করা হয় না। বিপ্লব হয়তো ভবিষ্যতে আসবে। কিন্তু তার আগে যেসব পর্যায় পার হওয়া গেছে সেগুলিকে অস্বীকার করে নয়। রেনেসাঁস যেখানে ঘটেনি রেভোলিউশন সেখানে ঘটে না। ঘটলে ধোপে টেকে না।

মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বিপ্লব যে কখনো কোথাও ঘটেনি তা নয়, কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের আগে কোনো দাগ রেখে যায়নি। ফরাসি বিপ্লব একসঙ্গে চার্চকে ও রাষ্ট্রকে, পোপকে ও রাজাকে, শাস্ত্রকে ও শস্ত্রকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল। আমাদের গণজাগরণ ততদূর যায়নি, যেতে সাহস পায়নি। শাস্ত্র সম্বন্ধে আমাদের নেতাদের মনোভাব ছিল সংস্কারের। বিপ্লবীর নয়। শাস্ত্র সম্বন্ধে মহাত্মাজির মনোভাব অহিংস অর্থে বৈপ্লবিক, কিন্তু অন্যান্য নেতাদের মনোভাব জাতীয়তাবাদী। চার্চ তো আমাদের ছিলই না, পোপের মতো যাঁরা ছিলেন তাঁরা ক্ষমতাহীন। রাষ্ট্র আর রাজার বিরুদ্ধেই আমাদের গণজাগরণ। সঙ্গে সঙ্গে রাজন্য ও জমিদারদেরও বিরুদ্ধে। তবু এর মধ্যে একটা mystique ছিল। সেটা সঞ্চার করেছিলেন আমাদের মহান নেতা গান্ধীজি। তিনি ছিলেন নৈরাজ্যবাদী। রাষ্ট্র তাঁর হাতে পড়লে তার বিকেন্দ্রীকরণ হত। প্রত্যেকটি গ্রামই হত স্বাধীন ও স্বাবলম্বী। সঙ্গে সঙ্গে শিল্পবাণিজ্যেরও হত বিকেন্দ্রীকরণ। সৈন্যদল থাকত না। থাকলে অতি ক্ষুদ্র আকারে। দেশ বিপন্ন হলে প্রত্যেকটি নাগরিক নিরস্ত্রভাবে লড়ত। কেমন করে লড়তে হয় গান্ধীজিই সেটা শেখাতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু গান্ধীজির পেছনে ভারতের কোনো ভাবুক পরম্পরা ছিল না। পরম্পরা যেটা ছিল সেটা পশ্চিমে। থোরো, রাস্কিন, টলস্টয় ও তাঁদেরই মতো কয়েক জন ভাবুক তাঁর পূর্বসূরি। ভারতীয়দের মধ্যে যাঁদের তিনি মানতেন তাঁরা রেনেসাঁসের নায়ক নন রিভাইভালের নায়ক। এক গোখলে বাদে। প্রাচীন ভারতে নৈরাজ্যবাদের মূল সন্ধান করা বৃথা। সে-ভারত ছিল ঘোরতর রাজতন্ত্রী ও পুরোহিততন্ত্রী। তাকে পুনরুজ্জীবিত করলে তার বিরুদ্ধে নতুন করে লড়তে হত। গৃহযুদ্ধের ভিতর দিয়ে যেতে হত। গান্ধীজি স্বয়ং রিভাইভালের ঊর্ধ্বে উঠলেও তাঁর শিষ্যরা এখনও তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এঁরা টলস্টয়, থোরো, রাসকিনের নামও করেন না। এঁদের পেছনে তেমন কোনো ভাবুক পরম্পরা নেই। আছেন যাঁরা তাঁরা প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাধক ও সাধু। রেনেসাঁস থেকে এঁরা শতহস্ত দূরে। শুধুমাত্র নৈতিক প্রভাবের দ্বারা কোথাও কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। ইতিহাস কী চায়, কোন অভিমুখে যাচ্ছে, কেমন করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছোবে, সবচেয়ে কম রক্তপাতে বা কম হিংসায় সবচেয়ে বেশিদূর অগ্রসর হবার উপায় কী, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে নেতৃত্ব তাঁদের হাত থেকে চলে যাবে।

মার্কস শিষ্যদের কাছে হয়তো বিকল্প নেতৃত্ব প্রত্যাশা করা যেত। কিন্তু তাঁদেরও ধারণা ইতিহাস রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটেনমেন্ট নামক ধাপগুলি ডিঙিয়ে একলম্ফে রেভোলিউশনে পৌঁছোতে পারে। এরকম ধারণা স্বয়ং মার্কসের ছিল না। রেভোলিউশনের ভবিষ্যদবাণী তিনি করেছিলেন পশ্চিম ইউরোপের জন্যে। যেখানে ওই ধাপগুলি আগেই পার হওয়া গেছিল। রাশিয়ার বিপ্লবীরা তাকে সে-দেশেও ঘটাতে চাইলেন। পারলেন যে তার অন্যতম কারণ সে-দেশেও কতক পরিমাণে রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট সম্পন্ন হয়েছিল। রিফর্মেশন যদিও হয়নি তবু এনলাইটেনমেন্টের প্রভাবে রুশ দেশের মার্কসপন্থীরা সকলেই ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। ধর্মকে তাঁরা মনে করতেন জনগণের আফিম। এসব কথা চীন সম্বন্ধেও মোটামুটি খাটে। চীনারা বৌদ্ধই হোক আর কনফিউসিয়ানই হোক ঈশ্বরবাদী নয়। মানুষের মন বদলে না দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের অ্যাকশন দিয়ে যা হয় তা বিপ্লব নয়, বিদ্রোহ বা বিক্ষোভ। যেমন সিপাহি বিদ্রোহ।

আমাদের রেনেসাঁসের নায়কদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল দেশের লোককে আধুনিক যুগের লোক করে তোলা। আধুনিকতা নিছক সমকালীনতা নয়। সমকালীন হলেই আধুনিক হয় না। আধুনিক শব্দটির অর্থ আর একটু সূক্ষ্ম। সেঅর্থে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আধুনিক কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নন। মধ্যযুগেও এমন কবি দু-চার জন ছিলেন যাঁরা এই সূক্ষ্মতর অর্থে আধুনিক। প্রাচীন গ্রিসে তেমন কবি বা নাট্যকার দার্শনিক অনেক বেশি ছিলেন। মহাভারত পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় যিনি বা যাঁরা লিখেছিলেন তিনি বা তাঁরা কারও চেয়ে কম আধুনিক ছিলেন না। আসলে যুগটা আধুনিক বলে সব সৃষ্টি আধুনিকতাসম্পন্ন নয়। আবার যুগটা আধুনিক নয় বলে সব সৃষ্টি আধুনিকতাবর্জিতও নয়।

আধুনিকতা তাহলে কী? এর সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। এর লক্ষণ হচ্ছে, সব কিছু জানার জন্যে সব কিছু বোঝার জন্যে সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখার জন্যে স্বাভাবিক কৌতূহল। তার জন্যে অবাধ স্বাধীনতা। বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চার। অবিরত পরীক্ষানিরীক্ষা। শাস্ত্রবাক্য গুরুবাক্যকে শেষ কথা বলে ধরে না নেওয়া। ব্যক্তির বিচার-বিবেকের উপর আত্মকতৃত্ব। দেহের সৌন্দর্যে আনন্দ। ইন্দ্রিয়ের বিচিত্র বোধ। হৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতি। সত্যের জন্যে নিত্য ব্যাকুলতা, নিত্য উদ্যোগ। নিজের মতো করে বঁাচা। জীবনকে ভরিয়ে নেওয়া। মরণকে ভয় না করা। পরকাল বা পরলোক নিয়ে মাথা না ঘামানো। ইহকাল ও ইহলোকের কাজ নিখুঁতভাবে করে যাওয়া। আদর্শকে এই জগতেই ও এই জীবনেই যথাসাধ্য রূপায়িত করা। নূতনের জন্যে মনের দুয়ার সবসময় খোলা রাখা। অতীতকেই ভবিষ্যতের ধ্রুবতারা না করা।

আজকাল সব দেশের উপরের স্তরে দিনযাপন ও নিশিবিহারের ধারা প্রায় একই প্রকার। শিল্পবিপ্লব থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলোও প্রায় একই জাতের। এর নাম সমকালীনতা, আধুনিকতা নয়। সত্যিকার আধুনিকতা আরও গভীর স্তরের ব্যাপার। রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট যেসব দেশে হয়নি সেসব দেশ আধুনিক যন্ত্রপাতির বা অস্ত্রশস্ত্রের দৌলতে ভারতের তুলনায় সম্পদশালী বা শক্তিশালী হতে পারে কিন্তু গভীরতর অর্থে আধুনিক নয়। এই দেড়শো বছরে আমরা তাদের তুলনায় আরও আধুনিক হয়েছি। নবলব্ধ স্বাধীনতা আমাদের আধুনিকতা সহায়ক হবে। তা বলে ইংরেজ আমলও যে সহায়ক ছিল না তা নয়। মনটাকে প্যাশনমুক্ত করে বিচার করলে বোঝা যাবে ইংরেজ আমল নানা দিক দিয়ে পূর্বের চেয়ে প্রগতিশীল ছিল। প্রত্যেক পুরুষেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। সব মিলিয়ে যা ঘটে তা ঐতিহাসিক বিবর্তন। তাতে ভারতীয়দের যেমন হাত ছিল তেমনি ইংরেজদেরও হাত। হাতাহাতি হয়নি তা নয়, কিন্তু হাত ধরাধরিও হয়েছে। যে যুগ চলে গেছে তার ষোলো আনা নিন্দাবাদ করা সত্যভাষণ নয়। আমরা এগিয়েছি ঠিকই। হয়তো আরও বেশি এগোতে পারতুম। বাধা পেয়েছি।

কিন্তু বাধা কেবল বাইরে থেকেই আসেনি। আমাদের অতি পুরাতন ঐতিহ্যও আমাদের বাধা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মনটাকে প্যাশনমুক্ত করে বিচার করতে হবে। এ দেশটা ইংল্যাণ্ড বা আমেরিকা নয়, রাশিয়া বা জার্মানি নয়। এটা ভারত। ভারতেরও একটি মুখ্য স্রোত আছে। সেস্রোত আর্যপূর্ব যুগ থেকে প্রবহমাণ। কত জাতি, কত ভাষা, কত ধর্ম, কত দার্শনিক তত্ত্ব তার সামিল হয়ে তার বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে। তাকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছেও। ভারতের যে ঐতিহ্য তাকে তুলনা করতে পারি গঙ্গার সঙ্গে। গঙ্গার মতো সেআদিকালের গঙ্গোত্রী থেকে নির্গত হয়ে একালের গঙ্গাসাগর সঙ্গমে বহির্জগতের মহত্তর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই যে মহত্তর সাগর, এর জোয়ার এসেছে গঙ্গার বুকে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের মতো।

আর্য ও আর্যপূর্ব, বৌদ্ধ ও বৌদ্ধপূর্ব, মুসলিম ও মুসলিমপূর্ব, আধুনিক ও আধুনিকপূর্ব, ভারতের বিবর্তনের এই চারটি পর্বকেই ইতিহাসের বিধান বলে মেনে নিতে হবে। এক-একটি পর্বের ভালো আর মন্দ দুটি করে দিক। দুই দিকই সত্য। মন্দের জন্যে ভালোকে অস্বীকার করা ভুল। মানবিক ব্যাপারে ভালো-মন্দ একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে। রেনেসাঁসের ভিতরেও প্রচুর কলুষ ছিল, যেমন ইটালিতে তেমনি ইংল্যাণ্ডে। রিফর্মেশনও ছিল রেভোলিউশনের মতো রক্তাক্ত, যেমন জার্মানিতে তেমনি ফ্রান্সে। আর এনলাইটেনমেন্ট সম্বন্ধেও একালের সমালোচকরা তেমন সপ্রশংস নন। তার নায়করা নাকি বিশ্বাস করতেন যে একজন প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী রাজা যতখানি মঙ্গলসাধন করতে পারবেন একটা অনাচারী গণতন্ত্র ততখানি নয়। এতে সাধারণ ভোটদাতার উপর অবিশ্বাস প্রকাশ পায়। আখেরে মানবপ্রকৃতির উপর। পক্ষান্তরে এটাও তো দেখা গেল—জার্মানির সাধারণ ভোটদাতাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েই হিটলার চান্সেলার পদে অধিষ্ঠিত হন ও তারপর সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করে চরম অমঙ্গল সাধন করেন।

ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সামঞ্জস্য এখনও বাকি। ঐতিহ্য যে বাধা দেয় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, অথচ ঐতিহ্য যদি আদৌ না থাকে তবে তার শূন্যতাও অপূরণীয়। ভারত যদি প্রাচীন না হয়ে অর্বাচীন হত সেটাও কি আনন্দের বিষয় হত? তাহলে তো আমাদের আদিম অবস্থা থেকেই আরম্ভ করতে হত। যে উত্তরাধিকার আমরা বিবর্তনসূত্রে লাভ করেছি তার সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও তাও তেমনি অমূল্য। দেশাভিমান বা শ্রেণিসচেতনতা যেন আমাদের পূর্ণ উত্তরাধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত না করে। কিন্তু গ্রহণ করলেও আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করতে বাধ্য নই। পুনর্বিচার ও পুনর্মূল্যায়ন সারাক্ষণ চলবে। রেনেসাঁসের মূল কথাই তাই।

আজকের ভারতে সবচেয়ে রক্ষণশীল শক্তি ঐতিহ্য নয়, ধর্ম। প্রাগৈতিহাসিক কুসংস্কার, প্রাচীন যুগের আচার-অনুষ্ঠান, মধ্যযুগের যুক্তিহীন ভক্তি ও অন্ধবিশ্বাস, এসব বাদ দিলেও এমন কিছু থাকে যার জন্যে হিন্দুদের ধর্ম এখনও প্রাণবান। এখনও সৌন্দর্যসৃষ্টির আকর। এখনও নৃত্যে গীতে কারুশিল্পে অভিনব প্রেরণার উৎস। ধর্মীয়তার অন্তরালে আধ্যাত্মিকতার অন্তঃস্রোত এখনও বহমান। ঐতিহ্যের মুখ্য স্রোতের মতো আধ্যাত্মিকতার অন্তঃস্রোতের সঙ্গেও আধুনিকতার সামঞ্জস্য সন্ধান করতে হবে। মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মধ্যে আধ্যাত্মিক বিকাশও কি পড়ে না? নৈতিক বিকাশও পড়ে। এগুলি বাদ দিলে মানবিকবাদও ধর্মের মতো একপেশে হবে। সব দিক নিয়েই সমগ্র মানবসত্তা। নইলে অপূরণীয় শূন্যতা।