নয়
মোটরে যাইতে যাইতে শকুন্তলার শয়নকক্ষের দৃশ্যটাই চোখের সামনে ভাসিতে লাগিল। মনে হইল যেন একটি মর্মস্পর্শী নাটকের নিগূঢ় দৃশ্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করিলাম। শকুন্তলা যদি মূৰ্ছিত হইয়া না পড়িতেন এবং চাঁদনী আসিয়া যদি রসভঙ্গ না করিত—
শকুন্তলা হঠাৎ মূৰ্ছিত হইলেন কেন? অবশ্য এরূপ অবস্থায় যে-কোনও মুহূর্তে মূর্ছা যাওয়া বিচিত্র নয়, তবু শোকের প্রাবল্যই কি তাহার একমাত্র কারণ?
ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম সে চিন্তার অতলে তলাইয়া গিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শকুন্তলার মূর্ছার কথা ভাবছ নাকি?’
সে সচেতন হইয়া বলিল, ‘মুর্ছা! না—আমি ভাবছিলাম ডাক-বাক্সর কথা।’
অবাক হইয়া বলিলাম, ‘ডাক-বাক্সর কথা ভাবছিলে!’
সে বলিল, ‘হ্যাঁ, দীপনারায়ণের বাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্স আছে তারই কথা। ভারি লাগসৈ জায়গায় সেটা আছে। দেখলে মনে হয় লাল কুর্তা-পরা গোলগাল একটি সেপাই রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।’
‘আসলে তবে কি?’
‘আসলে শ্রীরাধিকার দূতী।’
‘বুঝলাম না। ব্যাসকূট ছেড়ে সিধে কথা বল।’
ব্যোমকেশ কিন্তু সিধা কথা বলিল না, মুখে একটা একপেশে হাসি আনিয়া কতকটা নিজ মনেই বলিল, ‘অভিসারের আইডিয়াটি ভারি মিষ্টি, অবশ্য যদি অভিসারিকা পরস্ত্রী হয়। নিজের স্ত্রী অভিসার করলে বোধহয় তত মিষ্টি লাগে না।’
‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ ‘রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্’।’
‘কি আবোল-তাবোল বকছ!’
ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলিল, ‘আবোল-তাবোল নয়, এটা গীতগোবিন্দ। যদি আবোল-তাবোল শুনতে চাও শোনাতে পারি, ছন্দ একই। বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে—’
পাণ্ডেজি মোটর চালাইতে চালাইতে হাসিয়া উঠিলেন। আমি হতাশ হইয়া আপাতত আমার কৌতূহল সম্বরণ করিলাম।
পাণ্ডেজির বাসায় পৌঁছিয়া দেখা গেল চা প্রস্তুত। তার সঙ্গে গরম গরম বেগুনি, পকৌড়ি, ডালের ঝালবড়া। ব্যোমকেশ দ্বিরুক্তি না করিয়া বসিয়া গেল। আমরাও যোগ দিলাম।
বেশ খানিকটা রসদ আত্মসাৎ করিবার পর ব্যোমকেশ তৃপ্তস্বরে বলিল, ‘এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, আমার অন্তরাত্মা এই জিনিসগুলির পথ চেয়ে ছিল।’
পাণ্ডেজি হাসিয়া বলিলেন, ‘এখন তো পথ চাওয়া শেষ হল, এবার বলুন কি দেখলেন শুনলেন।’
ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় লম্বা একটি চুমুক দিয়া সযত্নে পেয়ালা নামাইয়া রাখিল, গড়গড়ার নলে কয়েকটা বুনিয়াদি টান দিল, তারপর চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলিল, ‘দেখলাম শুনলাম অনেক কিছু, কিন্তু এখনও শেষ দেখা যাচ্ছে না।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘তবু?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দুটো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে। এক—টাকা, দুই—স্মরগরল। কোন্দিকের পাল্লা ভারী এখনও বুঝতে পারছি না। হতে পারে, দুটো মোটিভ জড়াজড়ি হয়ে গেছে।’
আমি বলিলাম, ‘মোটিভ যেমনই হোক, লোকটা কে?’
ব্যোমকেশ একটু অধীরভাবে বলিল, ‘তা কি করে বলব? যে-ব্যক্তি ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়েছিল সে ভাড়াটে লোক হতে পারে। যে তাকে নিয়োগ করেছিল তাকেই আমরা খুঁজছি।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আমরা যাদের চিনি তাদের মধ্যে এমন কে আছে যে নিয়োগ করতে পারে। এক আছে দেবনারায়ণ। কিন্তু সে কি—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ, প্রথমে দেবনারায়ণকে ধরুন। দেবারায়ণকে দেখলে মনে হয় নিরেট আহাম্মক; কিন্তু এটা তার ছদ্মবেশ হতে পারে। সেই হয়তো লোক লাগিয়ে খুড়োকে মেরেছে। তার আজ্ঞাবহ মোসাহেবের অভাব নেই, লীলাধর বংশী বা বেণীপ্রসাদ যে-কেউ পুরস্কারের আশ্বাস পেলে খুন করবে। এখানে মোটিভ হল, সম্পত্তির একাধিপত্য।’
আমি বলিলাম, ‘কিন্তু—’
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া আমাকে নিবারণ করিল—‘তারপর ধরা যাক—চাঁদনী।’
‘চাঁদনী!’
‘হ্যাঁ, চাঁদনী। শকুন্তলার প্রতি তার এত দরদ স্বাভাবিক মনে হয় না, যেন একটু বাড়াবাড়ি। সে হয়তো মনে মনে তাঁকে হিংসে করে, তাঁর প্রাধান্য খর্ব করতে চায়। দীপনারায়ণের মৃত্যুর পর শকুন্তলা আর সংসারের কর্ত্রী থাকবেন না, কর্ত্রী হবে চাঁদনী। দেবনারায়ণ যদি সত্যি সত্যিই ন্যালা-ক্যাবলা হয়, সে চাঁদনীর মুঠোর মধ্যে থাকবে, চাঁদনী হবে বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র অধীশ্বরী—’
‘কিন্তু—’
ব্যোমকেশ আবার হাত তুলিয়া আমাকে নিবৃত্ত করিল।
‘তারপর ধরুন—ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী। ডাক্তার পালিতের মতে ইনি গভীর জলের মাছ। সেটা এমন কিছু আশ্চর্য নয়, গভীর জলের মাছ না হলে এতবড় স্টেটের ম্যানেজার হওয়া যায় না। কিন্তু উনি যদি কুমীর হন তবেই ভাবনার কথা। ভেবে দেখুন দীপনারায়ণ সিং বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, বিষয় সম্পত্তির ওপর নজর রাখতেন। তিনি বেঁচে থাক্তে পুকুর চুরি সম্ভব নয়, অল্পসল্প চুরি হয়তো চলে। কিন্তু তিনি যদি মারা যান তাহলে সমস্ত সম্পত্তি অর্শাবে দেবানারায়ণকে। তখন দু’হাতে চুরি করা চলবে। সুতরাং ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীরও মোটিভ স্বীকার করতে হবে।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গড়গড়া টানিল, আমরা নীরব রহিলাম। তারপর সে গড়গড়ার নল আমার হাতে দিয়া বলিল, ‘সর্বশেষে ধরুন—শকুন্তলা দেবী।’
এইটুকু বলিয়া সে চুপ করিল। আমরা প্রতীক্ষা করিয়া রহিলাম। সে একবার নড়িয়া চড়িয়া বসিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘কোনও মহিলার চরিত্র নিয়ে আলোচনা করা ভদ্রলোকের কাজ নয়, কিন্তু যেখানে একটা খুন হয়ে গেছে, সেখানে আলোচনা না করেও উপায়, নেই। শকুন্তলা দেবী তিন মাস অন্তঃস্বত্ত্বা, অথচ তিন মাস আগে দীপনারায়ণ সিং শয্যাগত ছিলেন, সে সময়ে তাঁর দীর্ঘ রোগের একটা ক্রাইসিস যাচ্ছিল।…শকুন্তলা আজ আমাদের বললেন, কাল রাত্রে তিনি স্বামীকে সন্তান সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, শুনে দীপনারায়ণ সিং আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন।…কথাটা বোধহয় সত্যি নয়।’
প্রশ্ন করিলাম, ‘সত্যি নয় কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দীপনারায়ণ সিং যদি আনন্দে আত্মহারা হয়েই পড়েছিলেন তবে এই মহা আনন্দের সংবাদ কাউকে দিলেন না কেন? রাত্রে না হোক, সকালবেলা ডাক্তার পালিতকে তো বলতে পারতেন, শুভসংবাদ পাকা কিনা জানবার জন্য মিস্ মান্নাকে ডাকতে পারতেন। …শকুন্তলা স্বামীকে বলেননি, কারণ স্বামীকে বলবার মত কথা নয়। দীপনারায়ণ সিং জানতে পারলে শকুন্তলাকে খুন করতেন, নচেৎ বাড়ি থেকে দূর করে দিতেন। তাই জানাজানি হবার আগেই দীপনারায়ণ সিংকে সরানো দরকার হয়েছিল।’
বলিলাম, ‘কিন্তু ধরো, ডাক্তার পালিত যদি ভুল করে থাকেন?’
ব্যোমকেশ শুষ্ক স্বরে বলিল, ‘ডাক্তার পালিত এবং মিস্ মান্না দু’জনেই যদি ভুল করে থাকেন, যদি শকুন্তলা নিষ্কলঙ্ক হন, তাহলে দীপনারায়ণকে খুন করার তাঁর কোনও মোটিভ নেই। কিন্তু ডাক্তার পালিত বা মিস্ মান্না দায়িত্বহীন ছেলেমানুষ নয়, তাঁরা ভুল করেননি। ইচ্ছে করেও মিছে কথাও বলেননি, যে মিছে কথা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবে তেমন মিথ্যে কথা বলবার লোক ওঁরা নন।’
বলিলাম, ‘আমি ওকথা বলছি না। শকুন্তলা যে অন্তঃস্বত্ত্বা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দীপনারায়ণ যে—’
‘তুমি যা বলতে চাও আমি বুঝেছি। কিন্তু সে দিকেও বাড়িসুদ্ধ লোক সাক্ষী আছে, ডাক্তার পালিত মিছে কথা বলে পার পাবেন না।’ ব্যোমকেশ আমার হাত হইতে গড়গড়ার নল লইয়া আবার টানিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, ‘বেশ, তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে শকুন্তলার একটি দুষ্মন্ত আছে। কিন্তু সে লোকটা কে?’
ব্যোমকেশ একটু চকিতভাবে আমার পানে চাহিল, অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল, শকুন্তলার দুষ্মন্ত! বেশ বলেছ। —ওই দুষ্মন্তকেই আমরা খুঁজছি। ডাক্তার পালিতের ব্যাগে যে ওষুধের বদলে বিষ রেখে গিয়েছিল সে ওই দুষ্মন্ত ছাড়া আর কে হতে পারে?’
‘দুষ্মন্তটি তবে কে?’
‘সেটা শকুন্তলার রুচির ওপর নির্ভর করে। তিনি মার্জিত রুচির আধুনিকা মহিলা, সুতরাং দুষ্মন্তও আধুনিক শিক্ষিত লোক হওয়া সম্ভব। নর্মদাশঙ্কর বা তাদের দলের কেউ হতে পারে। আবার এমন লোক হতে পারে যার প্রকাশ্যভাবে ও বাড়িতে যাতায়াত নেই।’
পাণ্ডেজি কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন, বলিলেন, ‘কিম্বা মনে করুন, যদি এমন কেউ হয় যে শকুন্তলাকে বিপদে ফেলে সরে পড়েছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দুষ্মন্তদের পক্ষে সেটা খুবই স্বাভাবিক। তখন শকুন্তলাকে অন্য চেষ্টা করতে হবে, অর্থাৎ অন্য সহকারী যোগাড় করতে হবে।’
‘সে-রকম সহকারী তিনি পাবেন কোথায়?’
‘কেন সহকারীর অভাব কিসের? স্বয়ং গঙ্গাধর বংশী রয়েছেন, তস্য পুত্র লীলাধর আছে, বেণীপ্রসাদ আছে, উপযুক্ত দক্ষিণা পেলে সকলেই রাজী হবে। এমন কি ডাক্তার পালিত আর মিস্ মান্নাকেও বাদ দেওয়া যায় না। ঠক বাছতে গাঁ উজোড়।’ আমরা নির্বাক হইয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের গড়গড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই। তারপর সে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলিল, ‘দেয়ালে আঁকা ছবিটার কথা বার বার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে ওটা শুধু ছবি নয়, ওর মধ্যে শিল্পীর অন্তরতম কথাটি লুকিয়ে আছে। ছবিটি দিনের আলোয় আর একবার ভাল করে দেখতে হবে।’
ভৃত্য আসিয়া জানাইল, ইন্সপেক্টর চৌধুরী আসিয়াছেন।