আট
দেবনারায়ণের মহল হইতে শকুন্তলার মহলে যাইবার পথে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী হঠাৎ আমাদের নিকট বিদায় লইলেন। পুত্র লীলাধর সম্পর্কে তাঁহার মন বোধহয় বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, নহিলে এত সহজে আমাদের ছাড়িয়া যাইতেন না। বলিলেন, ‘আমার সন্ধ্যা আহ্নিকের সময় হল, আমি এবার যাই। আপনারা কাজ করুন।’
তিনি সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন। আমরা শকুন্তলা দেবীর মহলে প্রবেশ করিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইতে আরম্ভ করিয়াছে, রতিকান্ত সুইচ টিপিয়া আলো জ্বালিতে জ্বালিতে আমাদের আগে আগে চলিল।
প্রথমে একটি মাঝারি গোছের ঘর। দেশী প্রথায় চৌকির উপর ফরাসের বিছানা, কয়েকটি গদি-মোড়া নীচু কেদারা, ঘরের কোণে উঁচু টিপাইয়ের মাথায় রূপার পাত্রে ফুল সাজানো। দেয়ালে যামিনী রায়ের আঁকা একটি ছবি। এখানে বাড়ির লোকেরা বসিয়া গল্প-গুজবে সন্ধ্যা কাটাইতে পারে, আবার অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধব আসিলেও বসানো যায়।
ঘরে কেহ নাই। আমরা এ-ঘর উত্তীর্ণ হইয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি বেশ বড় ঘর, দুটি পালঙ্ক দু’পাশের দেয়ালে সংলগ্ন হইয়া আছে। একটি বড় ওআর্ডরোব রহিয়াছে, একটি আয়না-দার টেবিলে কয়েকটি ওষুধের শিশি। মনে হয় এটি দীপনারায়ণের শয়নকক্ষ ছিল। বর্তমানে শয্যা দুটির উপর সুজনি ঢাকা রহিয়াছে। এ ঘরটিও শূন্য। ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল,—‘এটি বোধ হচ্ছে দীপনারায়ণবাবুর শোবার ঘর ছিল। দুটো খাট কেন?’
রতিকান্ত একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—‘দীপনারায়ণজির অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছিল তখন একজন নার্স রাত্রে থাকত।’
‘ঠিক ঠিক, আমার বোঝা উচিত ছিল।’
অতঃপর আমরা তৃতীয় কক্ষে প্রবেশ করিলাম এবং চারিদিকে চাহিয়া চমৎকৃত হইয়া গেলাম। এ ঘরটি আরও বড় এবং নীলাভ নিওন-লাইট দ্বারা আলোকিত। পিছনের দিকের দেয়ালে সম-ব্যবধানে তিনটি জানালা, জানালার ব্যবধানস্থলে সুচিত্রিত মহার্ঘ মিশরী গালিচা ঝুলিতেছে। ঘরের এক পাশে একটি অর্গান এবং তাহার আশেপাশে দেয়ালে টাঙানো নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র। ঘরের অপর পাশে ছবি আঁকার বিবিধ সরঞ্জাম, দেয়ালের গায়ে আঁকা একটি প্রশস্ত তৈলচিত্র। মেঝের উপর পুরু মখমলের আস্তরণ বিছানো, তাহার মাঝখানে গুরু নিতম্বিনী রাজকন্যার মত একটি তানপুরা শুইয়া আছে। বুঝিতে বিলম্ব হয় না কলা-কুশলী শকুন্তলার এটি শিল্পনিকেতন। দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। একই বাড়ির দুই অংশে রুচিনৈপুণ্য ও সৌন্দর্য-বোধের কতখানি তফাৎ, চোখে না দেখিলে বিশ্বাস হয় না।
ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রথমেই দেয়ালে আঁকা তৈলচিত্রটির প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। সে কোনও দিকে না চাহিয়া ছবির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। ছবিটির খাড়াই তিন ফুট, পাশাপাশি পাঁচ ফুট। বিষয়বস্তু নূতন নয়, বল্কলধারিণী শকুন্তলা তরুআলবালে জল-সেচন করিতেছে এবং দুষ্মন্ত পিছনের একটি বৃক্ষকাণ্ডের আড়াল হইতে চুরি করিয়া শকুন্তলাকে দেখিতেছেন। ছবিখানির অঙ্কন-শৈলী ভাল, শকুন্তলার হাত পা খ্যাংরা কাটির মত নয়, দুষ্মন্তকে দেখিয়াও যাত্রাদলের দুঃশাসন বলিয়া ভ্রম হয় না। চিত্রের বাতাবরণ পুরাতন, কিন্তু মানুষ দুটি সর্বকালের। ছবি দেখিয়া মন তৃপ্ত হয়।
ব্যোমকেশের দিকে চোখ ফিরাইয়া দেখিলাম সে তন্ময় হইয়া ছবি দেখিতেছে। তাহার দেখাদেখি রতিকান্ত ও পাণ্ডেজি আমাদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ তখন তাঁহাদের দিকে ফিরিয়া উৎসাহ ভরে বলিল, ‘চমৎকার ছবি। কে এঁকেছে?’
পাণ্ডেজি রতিকান্তের দিকে চাহিলেন, রতিকান্ত দ্বিধাভরে বলিল, ‘বোধহয় শকুন্তলা দেবীর আঁকা। ঠিক বলতে পারি না।’
ব্যোমকেশ আবার ছবির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘তাই হবে। একালের শকুন্তলা সেকালের শকুন্তলার ছবি এঁকেছেন। দেখেছ অজিত, তপোবনকন্যা শকুন্তলার মুখে কী শান্ত সরলতা, দুষ্মন্তের চোখে কী মোহাচ্ছন্ন অনুরাগ, সহকার তরুগুলির কী সজীব শ্যামলতা। সব মিলিয়ে সংসার ও আশ্রমের একটি অপূর্ব সমন্বয় হয়েছে। —যদি সম্ভব হত ছবিটি তুলে নিয়ে যেতাম।’
একটু অবাক হইলাম। ব্যোমকেশের মনে শিল্পরস বোধ থাকিতে পারে কিন্তু তাহা কোনও কালেই উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে দেখি নাই। আমি চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহার পানে তাকাইয়া আছি দেখিয়া সে সামলাইয়া লইল; ছবির দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া ঘরের চারিদিকে চোখ বুলাইল। শকুন্তলা দেবীর বর্তমান অবস্থা স্মরণ করিয়া একটু ব্যথিত স্বরে বলিল, ‘এটা দেখছি শকুন্তলা দেবীর গান-বাজনা ছবি-আঁকার ঘর…সাজানো বাগান…ভুলে থাকার উপকরণ—’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘চলুন।’
অতঃপর আমরা আরও একটা শূন্য ঘর এবং একটা বারান্দা পার হইয়া শকুন্তলার শয়নকক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। দরজা ভেজানো ছিল, রতিকান্ত টোকা দিলে একটি মধ্যবয়স্কা দাসী দ্বার খুলিয়া দিল। রতিকান্ত ঘরের ভিতর গলা বাড়াইয়া কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘আমরা পুলিসের পক্ষ থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।’
কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভিতর হইতে অস্ফুট আওয়াজ আসিল—‘আসুন।’
আমরা সসঙ্কোচে ঘরে প্রবেশ করিলাম। রতিকান্ত দাসীকে মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিত করিল, দাসী বাহিরে গেল।
শকুন্তলা দেবীর শয়নকক্ষের বর্ণনা দিব না। অনবদ্য রুচির সহিত অপরিমিত অর্থবল সংযুক্ত হইলে যাহা সৃষ্টি হয় এ ঘরটি তাহাই। শকুন্তলা পালঙ্কের উপর বসিয়া ছিলেন, আমরা প্রবেশ করিলে একটি ক্রীম রঙের কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়াইয়া লইলেন। কেবল তাঁহার মুখখানি খোলা রহিল। মোমের মত অচ্ছাভ বর্ণ, চোখের কোলে কালি পড়িয়াছে। চুলগুলি শিথিল ও অবিন্যস্ত। যেন হিম-ক্লিন্ন ঝরা শেফালি।
‘বসুন’—শকুন্তলা ক্লান্তি-বিনত চক্ষু দুটি একবার আমাদের পানে তুলিলেন।
ঘরে কয়েকটি চামড়ার গদি-মোড়া নীচু চৌকি ছিল, আমি ও ব্যোমকেশ দুটি চৌকি খাটের কাছে টানিয়া লইয়া বসিলাম। রতিকান্ত ও পাণ্ডেজি খাটের বাজু ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
ব্যোমকেশ পাণ্ডেজির দিকে দৃষ্টি তুলিয়া নীরবে অনুমতি চাহিল, পাণ্ডেজি একটু ঘাড় নাড়িলেন। ব্যোমকেশ তখন অত্যন্ত মোলামেয় স্বরে শকুন্তলাকে বলিল, ‘আপনাকে এ সময়ে বিরক্ত করতে এসেছি, আমাদের ক্ষমা করবেন। মানুষের জীবনে কখন যে কী দুর্দৈব ঘটবে কেউ জানে না, তাই আগে থাকতে প্রস্তুত থাকবার উপায় নেই। আপনার স্বামীকে আমি একবার মাত্র দেখেছি, কিন্তু তিনি যে কি রকম সজ্জন ছিলেন তা জানতে বাকি নেই। তাঁর মৃত্যুর জন্যে যে দায়ী সে নিষ্কৃতি পাবে না এ আশ্বাস আপনাকে আমরা দিচ্ছি।’ শকুন্তলা উত্তর দিলেন না, কাতর চোখ দুটি তুলিয়া নীরবে ব্যোমকেশকে ধন্যবাদ জানাইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে দু’একটা প্রশ্ন করব। নেহাত প্রয়োজন বলেই করব, আপনাকে উত্যক্ত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। —কিন্তু আসল প্রশ্ন করার আগে একটা অবান্তর কথা জেনে নিই, ও ঘরের দেয়ালে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার ছবিটি কি আপনার আঁকা?’
শকুন্তলার চোখে চকিত বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল, তিনি কেবল ঘাড় হেলাইয়া জানাইলেন—হ্যাঁ, ছবি তাঁহারই রচনা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চমৎকার ছবি, আপনার সত্যিকার শিল্পপ্রতিভা আছে। কিন্তু ওকথা যাক। দীপনারায়ণবাবু উইল করে গেছেন কিনা আপনি জানেন?’
এবার শকুন্তলা অবুঝের মত চক্ষু তুলিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, তারপর স্তিমিত স্বরে বলিলেন, ‘এসব আমি কিছু জানি না। উনি আমার কাছে বিষয় সম্পত্তির কথা কখনও বলতেন না।’
‘আপনার নিজস্ব কোনও সম্পত্তি আছে কি?’
‘তাও জানি না। তবে—’
‘তবে কি?’
‘বিয়ের পর আমার স্বামী আমার নামে পাঁচ লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছিলেন।’
‘তাই নাকি! সে টাকা এখন কোথায়?’
‘ব্যাঙ্কেই আছে। আমি কোনও দিন সে টাকায় হাত দিইনি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল।
‘তাহলে এই পাঁচ লাখ টাকা আপনার নিজস্ব স্ত্রীধন। তারপর যদি আপনার পুত্রসন্তান জন্মায় তাহলে সে এজমালি সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ পাবে।’
শকুন্তলা চোখ তুলিলেন না, নতনেত্রে রহিলেন। মনে হইল তাঁহার মুখখানা আরও পাণ্ডুর রক্তহীন হইয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভাল কথা, আপনি যে সন্তান-সম্ভবা একথা আপনার স্বামী জানতেন?’
নতনয়না শকুন্তলার ঠোঁট দুটি একটু নড়িল, ‘জানতেন। কাল রাত্রে তাঁকে বলেছিলাম।’
‘কাল রাত্রে! খাওয়া-দাওয়ার আগে, না পরে?’
‘পরে। উনি তখন শুয়ে পড়েছিলেন।’
‘খবর শুনে উনি নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছিলেন!’
‘খুব খুশি হয়েছিলেন, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন—’
এই পর্যন্ত বলিয়া শকুন্তলার ভাব হঠাৎ পরিবর্তিত হইল। এতক্ষণ তিনি ক্লান্ত ম্রিয়মাণভাবে কথা বলিতেছিলেন, এখন ভয়ার্ত বিহ্বলতায় একে একে আমাদের মুখের পানে চাহিলেন, তারপর একটি অবরুদ্ধ কাতরোক্তি করিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলেন।
আমরা ক্ষণকালের জন্য বিমূঢ় হইয়া গেলাম। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, দ্বারের কাছে চাঁদনী কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এখন সে ছুটিয়া আসিয়া শকুন্তলার মাথা কোলে লইয়া বসিল, আমাদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, আপনারা কি রকম মানুষ, মেরে ফেলতে চান ওঁকে? যান, শীগ্গির যান এ ঘর থেকে। শরীরে একটু দয়ামায়া কি নেই আপনাদের? এখুনি মিস্ মান্নাকে খবর পাঠান।’
আমরা পালাইবার পথ পাইলাম না। নীচে নামিতে নামিতে শুনিতে পাইলাম চাঁদনী উচ্চকণ্ঠে দাসীকে ডাকিতেছে—‘সোমরিয়া, কোথায় গেলি তুই—শীগ্গির জল আন—’
নীচে নামিয়া পাণ্ডেজি প্রথমেই মিস্ মান্নাকে টেলিফোন করিলেন—‘শীগ্গির চলে আসুন, আপনি না আসা পর্যন্ত আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।’
তারপর আমরা হল-ঘরে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। রাত্রি হইয়া গিয়াছে, ঘড়িতে সাতটা বাজিয়া গেল।
পাণ্ডেজি বিললেন, ‘রতিকান্ত, দেখে এস শকুন্তলা দেবীর জ্ঞান হল কিনা।’
রতিকান্ত চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ বিমর্ষ মুখে বসিয়াছিল, চোখ তুলিয়া বলিল, ‘পাণ্ডেজি, মিস্ মান্নাকে এখন কিছুদিন শকুন্তলা দেবীর কাছে রাখা দরকার, তার ব্যবস্থা করুন। তিনি সর্বদা শকুন্তলার কাছে থাকবেন, একদণ্ডও তাঁর কাছ-ছাড়া হবেন না।’
‘বেশ।’
ম্যানেজার গঙ্গাধর এই সময় ফিরিয়া আসিলেন এবং শকুন্তলার মূর্ছার কথা শুনিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিলেন। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘মিস্ মান্নাকে এখানে কিছুদিন রাখার ব্যবস্থা করুন। শকুন্তলা দেবী অন্তঃসত্ত্বা, তার ওপর এই দুর্দৈব। ওঁর কাছে অষ্টপ্রহর ডাক্তার থাকা দরকার।’
ম্যানেজারের মুখখানা কেমন একরকম হইয়া গেল। তারপর তিনি সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’
মিস্ মান্না আসিলেন, হাতে ওষুধের ব্যাগ। তাঁহাকে সংক্ষেপে সব কথা বলা হইলে তিনি বলিলেন, ‘বেশ, আমি থাকব। আমার কিছু জিনিসপত্র আনিয়ে নিলেই হবে।’
তিনি দ্রুতপদে উপরে চলিয়া গেলেন।
দশ মিনিট পরে রতিকান্ত নামিয়া আসিয়া বলিল, ‘জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার মান্না বললেন ভয়ের কোনও কারণ নেই।’
পাণ্ডেজি গাত্রোত্থান করিলেন।
‘আমরা এখন উঠলাম। রতিকান্ত, তুমি এখানকার কাজ সেরে একবার আমার বাসায় যেও।’ আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘চলুন, আমার ওখানে চা খাবেন।’