পরিশিষ্ট

বহ্নি-পতঙ্গ – ৬

ছয়

ডাক্তারখানা হইতে দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি মোটরে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এই পাঁচ মিনিট আমাদের মধ্যে একটিও কথা হইল না। সকলেই অন্তর্নিবিষ্ট হইয়া রহিলাম।

ফটকের বাহিরে গাড়ি থামাইয়া অবতরণ করিলাম। দেউড়িতে টুলের উপর একটা কনস্টেবল বসিয়া ছিল, তড়াক করিয়া উঠিয়া পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিল।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন, কম্পাউণ্ডের বাইরেটা ঘুরে দেখা যাক।’

পর্বে বলিয়াছি বাড়ির চারিদিকে জেলখানার মত উঁচু পাঁচিল। আমরা পাঁচিলে ধার ঘেঁষিয়া একবার প্রদক্ষিণ করিলাম। সামনের দিকে সদর রাস্তা; দুই পাশে ও পিছনে আম-কাঁঠালের বাগান। এই অঞ্চলে আম-কাঁঠালের বাগানই বেশি এবং সব বাগানই দীপনারায়ণের সম্পত্তি। পূর্বকালে এদিকে বোধহয় লোকবসতি ছিল, কিন্তু দীপনারায়ণের পূর্বপুরুষেরা সমস্ত পাড়াটা ক্রমে ক্রমে আত্মসাৎ করিয়া ফলের বাগানে পরিণত করিয়াছেন। পাড়ায় এখন একমাত্র বাড়ি দীপনারায়ণের বাড়ি। তবু আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সুখ-সুবিধার ত্রুটি নাই; ইলেকট্রিক ও টেলিফোনের তার পাঁচিল ডিঙাইয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছে। এমন কি একটি ডাক-বাক্স লাল কুর্তা-পরা সিপাহীর মত পাঁচিলের এক কোণে দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে। চিঠিপত্র ডাকে দিতে হইলে বেশি দূরে যাইতে হইবে না।

প্রাচীর প্রদক্ষিণ করিয়া ব্যোমকেশ কী দেখিল জানি না; দ্রষ্টব্য বস্তু কিছুই নাই। পাশে ও পিছনে আম-কাঁঠালের গাছ দেয়াল পর্যন্ত ভিড় করিয়া আসিয়াছে, দেয়াল ঘেঁষিয়া মাঠের উপর একটি পায়ে হাঁটা সরু রাস্তা। ডাক-বাক্সের দিক হইতে পাশের দিকে যাইলে একটি খিড়কি দরজা পড়ে, বোধকরি চাকর-বাকরদের যাতায়াতের পথ। এটি ছাড়া পাশের বা পিছনের দেয়ালে যাতায়াতের অন্য পথ নাই।

খিড়কি দরজা খোলা ছিল, আমরা সেই পথেই ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশ প্রবেশ করিবার সময় দরজাটিকে একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। সেকেল ধরনের খর্বকায় মজবুত কবাট, কবাটের পুরু তক্তার উপর মোটা মোটা পেরেক দিয়া গুল বসানো; কিন্তু তা সত্ত্বেও কবাট দুটি নড়বড়ে হইয়া গিয়াছে। কবাটের মাথার কাছে শিকল ঝুলিতেছে, বোধহয় রাত্রিকালে শিকল লাগাইয়া দ্বার বন্ধ করা হয়।

খিড়কি দরজা সম্বন্ধে ব্যোমকেশের অনুসন্ধিৎসা একটু আশ্চর্য মনে হইল; তাহার মন কোন্ পথে চলিয়াছে ঠিক ধরিতে পারিতেছি না। যাহোক, ভিতরে প্রবেশ করিয়া পাশেই পাঁচিলের লাগাও একসারি ঘর চোখে পড়িল। ঘরগুলি দপ্তরখানা, জমিদারীর কেরানিরা এখানে বসিয়া সেরেস্তার কাজকর্ম করে। আমাদের দেখিতে পাইয়া একটি লোক সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। লোকটিকে কাল রাত্রে দেখিয়াছি, মাথায় পাগড়ি-বাঁধা ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী।

তিনি ত্বরিতে অগ্রসর হইয়া আসিলেন, খিড়কি দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আলাপ হইল। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখছি।’

ম্যানেজারের অভিজ্ঞ চোখে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিলেও তিনি মুখে বলিলেন, ‘বেশ তো, বেশ তো, আসুন না আমি দেখাচ্ছি।’

ব্যোমকেশ খিড়কি দরজার দিকে আঙুল দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, এ দরজাটা কি সব সময়েই খোলা থাকে?’

ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন, ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন, ‘এঁ—ঠিক বলতে পারছি না, বোধহয় রাত্রে বন্ধ থাকে। কেন বলুন দেখি?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘নিছক কৌতূহল।’

এই সময় একজন ভৃত্যকে বাড়ির পিছন দিকে দেখা গেল। ম্যানেজার হাত তুলিয়া তাহাকে ডাকিলেন। ভৃত্য আসিলে বলিলেন, ‘বিষুণ, রাত্রে খিড়কি দরজা বন্ধ থাকে?’

বিষুণও ঘাড় চুলকাইল, ‘তা তো ঠিক জানি না হুজুর। বোধহয় শিকল তোলা থাকে। চৌকিদার বলতে পারবে।’

‘ডাক চৌকিদারকে।’ বিষুণ চৌকিদারকে ডাকিতে গেল।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘রাত্রে চৌকিদার বাড়ি পাহারা দেয়?’

ম্যানেজার বলিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। দেউড়িতে দারোয়ান থাকে, আর দু’জন চৌকিদার পালা করে পাহারা দেয়।’

অল্পক্ষণ মধ্যে বিষুণ একটি চৌকিদারকে আনিয়া উপস্থিত করিল। চৌকিদার দেখিতে তালপাতার সেপাই, কিন্তু বিপুল গোঁফ ও গালপাট্টার দ্বারা কঙ্কালসার মুখে চৌকিদার সুলভ ভীষণতা আরোপ করিবার চেষ্টা আছে, চোখ দুটি রাত্রিজাগরণ কিম্বা গঞ্জিকার প্রসাদে করমচার মত লাল। ম্যানেজার তাহাকে প্রশ্ন করিলেন, ‘গজাধর সিং, রাত্রে খিড়কির দরজা খোলা থাকে, না বন্ধ থাকে?’

গজাধর ভাঙা গলায় বলিল, ‘ধর্মাবতার, কখনও খোলা থাকে, কখনও জিঞ্জির লাগানো থাকে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘তালা লাগানো থাকে না?’

গজাধর বলিল, ‘না হুজুর, অনেকদিন আগে তালা ছিল, এখন ভুৎলা গিয়া। কিন্তু তাতে ভয়ের কিছু নেই, আমরা দু’ভাই এমন পাহার দিই যে, একটা চুহা পর্যন্ত হাতায় ঢুকতে পারে না।’

‘বটে! কি ভাবে পাহারা দাও?’

‘রাত্রি দশটা থেকে পাহারা শুরু হয় হুজুর। দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত একজন পাহারা দিই, আর দুটো থেকে ছ’টা পর্যন্ত আর একজন। দেউড়িতে ঘণ্টা বাজে আর আমরা উঠে একবার চক্কর দিই, আবার ঘণ্টা বাজে আবার চক্কর দিই। এইভাবে সারা রাত চক্কর লাগাই ধর্মাবতার।

‘তাহলে ঘণ্টা বাজার মাঝখানে কেউ যদি ভিতর থেকে বাইরে যায় কিম্বা বাইরে থেকে ভিতরে আসে তোমরা জানতে পার না?’

‘বাইরে থেকে কে আসবে হুজুর, কার ঘাড়ে দশটা মাথা?’

‘বুঝেছি। তুমি এখন যেতে পার।’

গজাধর প্রস্থান করিলে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী সাফাইয়ের সুরে বলিলেন, ‘এ বাড়িতে খুব কড়া পাহারার দরকার হয় না; চোর-ছ্যাঁচড়েরা জানে এখানে দারোয়ান চৌকিদার আছে, ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তাই তারা এদিকে আসে না। আমি আঠারো বছর এই এস্টেটে আছি, কখনো একটা কুটো চুরি যায়নি।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি চুরির কথা ভাবছিলাম না। যাহোক, আসুন এবার ওদিকটা দেখা যাক।’

অতঃপর গঙ্গাধর বংশী আমাদের লইয়া চারিদিক ঘুরিয়া দেখাইলেন। দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে মৃত প্রভুর উদ্দেশে শোক প্রকাশ করিলেন; প্রশ্ন না করিয়া মৃত্যুর কারণ জানিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু আমরা তাঁহার কৌতূহলের প্রশ্রয় দিলাম না, গভীর মনঃসংযোগে সরেজমিনে তদারক করিলাম।

বাড়ির সামনের দিকে ফুলের বাগান, পিছনে শাকসজীর ক্ষেত। বাড়িটি দ্বিতল এবং চক্‌-মেলাননা, প্রায় সাত-আট কাঠা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাড়ির দুই পাশে দ্বিতলে উঠিবার দুইটি লোহার পাকানো সিঁড়ি আছে। এই পথে মেথর ঝাড়দার উপরতলা পরিষ্কার রাখে, কারণ পাটনায় এখনও ড্রেনের প্রতিষ্ঠা হয় নাই।

পরিদর্শন শেষ করিয়া সদরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর রতিকান্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ব্যোমকেশের পানে একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিল, ‘বাগানে কী দেখছিলেন? কিছু পেলেন নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিশেষ কিছু না। কেবল এইটুকু জানা গেল যে রাত্তিরে বাড়ির যে-কেউ খিড়কির দরজা খুলে বাইরের লোককে ভিতরে আনতে পারে।’

রতিকান্ত কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, ‘কিন্তু—বর্তমান ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে। কি?’

‘থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। চলুন, এবার বাড়ির লোকগুলির সঙ্গে আলাপ করা যাক—‘

বাড়িতে প্রবেশ করিবার উপক্রম করিতেছি, ফট্‌ফট্‌ শব্দে ঘাড় ফিরাইয়া দেখি ফটকের দিক হইতে একটি মোটর বাইক আসিতেছে। আরূঢ় ব্যক্তিটি অপরিচিত; চেহারাটা সুশ্রী, বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ। পরিধানে সাদা ফ্ল্যানেলের প্যান্ট, গাঢ় নীল রঙের গরম ক্রিকেট কোট, গলায় লাল পশমের মাফলার, মাথায় রঙচটা ক্রিকেট ক্যাপ। পুরাদস্তুর খেলোয়াড়ের সাজ, দেখিলে মনে হয় এই মাত্র ক্রিকেটের মাঠ হইতে ফিরিতেছেন।

ঝকঝকে নূতন ‘সান-বীম্‌’ আমাদের কাছে আসিয়া থামিল, আরোহী আস্তে-ব্যস্তে অবতরণ করিলেন। পাণ্ডেজি ও রতিকান্তের ললাটে গভীর ভ্রূকুটি দেখিয়া অনুমান করিলাম, ইনি যতবড় খেলোয়াড়ই হোন, পুলিসের প্রীতিভাজন নন। পরক্ষণেই পাণ্ডেজির সম্ভাষণ শুনিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে এই ব্যক্তিই কুখ্যাত নারীহরণকারী নর্মদাশঙ্কর।

পাণ্ডেজি বলিলেন, নর্মদাশঙ্করবাবু, আপনার এখানে কী দরকার?’

নর্মদাশঙ্কর সবিনয়ে নমস্কার করিয়া বলিল, ‘ক্রিকেটের মাঠে খবর পেলাম দীপনারায়ণবাবু হঠাৎ মারা গেছেন। শুনলাম নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। শুনে আর থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম। কী হয়েছিল, মিঃ পাণ্ডে?’

পান্ডেজি নীরস কণ্ঠে বলিলেন, ‘মাফ করবেন, এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কোন আলোচনা হতে পারে না। কিন্তু আপনার কি দরকার তা তো বললেন না?’

নমর্দাশঙ্কর মুখখানিকে বিষণ্ণ করিয়া বলিল, ‘দরকার আর কি, বন্ধুর বিপদে আপদে খোঁজ-খবর নিতে হয়। শকুন্তলা যে কী দারুণ শোক পেয়েছেন তা তো বুঝতেই পারছি। কাল রাত্রে তাঁকে দেখেছিলাম আনন্দের প্রতিমূর্তি! তখন কে ভেবেছিল যে—তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হবে কি?’

‘দেখা করতে চান কেন?’

‘তাঁকে সহানুভূতি জানানো, দুটো সান্ত্বনার কথা বলা, এছাড়া আর কি? আপনারা নিশ্চয় জানেন শকুন্তলার সঙ্গে আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা আছে।’ শকুন্তলার নামোল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে নর্মদাশঙ্করের চোখে যে ঝিলিক খেলিয়া যাইতে লাগিল তাহা কাহারও দৃষ্টি এড়াইল না।

পাণ্ডেজি চাপা বিরক্তির স্বরে বলিলেন, ‘মাফ করবেন, শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে কারুর দেখা সাক্ষাৎ হবে না, এখন ওসব লৌকিকতার সময় নয়। —রতিকান্ত, ফটকের কনস্টেবলকে বলে দাও, আমাদের অনুমতি না নিয়ে যেন কাউকে ভেতরে আসতে না দেয়।’

পাণ্ডেজির ইঙ্গিতটা এতই স্পষ্ট যে নর্মদাশঙ্করের চোখে আর এক ধরনের ঝিলিক খেলিয়া গেল, কুটিল ক্রোধের ঝিলিক। কিন্তু সে বিনীতভাবেই বলিল, ‘বেশ, আপনারাই তাহলে শকুন্তলাকে আমার সমবেদনা জানিয়ে দেবেন। আচ্ছা, আজ চলি। নমস্তে।’

নর্মদাশঙ্করের মোটর বাইক ফট্‌ফট্‌ করিয়া চলিয়া গেল। রতিকান্ত তাহার বিলীয়মান পৃষ্ঠের দিকে বিরাগপূর্ণ নেত্রে চাহিয়া গলার মধ্যে বলিল—‘মিটমিটে শয়তান!’ তারপর ফটকের কনস্টেবলকে হুকুম দিতে গেল।

ব্যোমকেশ ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাল রাত্রে নর্মদাশঙ্করবাবু কখন নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কি?’

ম্যানেজার বলিলেন, ‘উনি কখন এসেছিলেন তা ঠিক বলতে পারি না, কিন্তু সাড়ে ছ’টার সময় এসে দেখলাম, উনি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে বসে গল্প করছেন। তখনও অন্য কোনও অতিথি আসেননি।’

‘মাফ করবেন, আপনি কোথায় থাকেন?’

ম্যানেজার সম্মুখে রাস্তার ওপারে আঙুল দেখাইয়া বলিলেন, ‘ওই আমবাগানের মধ্যে একটা বাড়ি আছে, এস্টেটের বাড়ি, আমি তাতেই থাকি।’

‘আশেপাশের আমবাগানে আরও বাড়ি আছে নাকি?’

‘আজ্ঞে না। এ তল্লাটে আর বাড়ি নেই।’

‘আচ্ছা, আজ সকালে মৃত্যুর পূর্বে দীপনারায়ণবাবুকে আপনি দেখেছিলেন কি?’

ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িলেন—‘আজ্ঞে না, ডাক্তারবাবু আমার আগেই এসেছিলেন। রবিবারে সেরেস্তা বন্ধ থাকে, আমি একটু দেরি করে আসি। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।’