৮
আলো আঁধারিতে ঠিক চেনা যাচ্ছিল না মেয়েটি কে। লবির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে মেয়েটি চাপা গলায় কথা বলছিল।
হ্যালো… পার্ক স্ট্রিট থানা? … কে, বিশুদা? হ্যাঁ, শুনুন, এখুনি আপনারা হোটেলে চলে আসুন… যত শিগগির পারেন… আমি রমলা কথা বলছি। লালজির ঘরে দু’জনেই আছে… আপনার কথামতো দরজার বাইরে থেকে সবই শুনতে পেয়েছি… কী হল? হ্যালো… হ্যালো…. শুনুন…. শুনছেন…
হঠাৎ পেছন থেকে কে বলে উঠল, কেউ শুনতে পাবে না।
চকিতে শিলা ঘুরে দাঁড়াল। অস্পষ্ট অন্ধকারে লালজির চোখ দুটো হায়েনার মতো জ্বলছে।
শব্দ করে হেসে লালজি বললে, কেন বৃথা পরিশ্রম করছ শিলা দেবী—ওরফে রমলা? টেলিফোনের তার আমি কেটে দিয়েছি।
কলের পুতুলের মতোই রমলা রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। পিছনের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লালজি! সিঁড়ির মুখের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে ওর দুই চোখের ওপর। রমলা তাকিয়ে দেখলে, অন্ধকারে যেন দু’টুকরো ফসফরাস জ্বলছে!
দু’জনে দু’জনের দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। বাইরে ঝড়ের বেগ বাড়ছে।
গলায় বিষ—মাখানো ব্যঙ্গ নিয়ে লালজি বললে, বাঃ! চমৎকার তোমার অভিনয়। বাস্তবিক, আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাংলার মাতাহারি, তোমার জয় হোক!… উঁহু, এক পা নাড়ো না।
চকচকে উজ্জ্বল একটা বস্তু লালজির পকেট থেকে ডান হাতে এল।
আমার এই অটোমেটিক পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো আছে। তোমাকে যদি এখন গুলি করি, কেউ জানবে না—কেউ শুনবে না। নিঃশব্দে কাজ হয়ে যাবে।
রমলা যেন পাথর।
পিস্তলটা লালজি পকেটে পুরলে। তারপর বললে, না, গুলি এখন তোমায় করব না। তোমার আমার শেষ বোঝাপড়া এখনও বাকি। তার আগে তোমাকে মারা ঠিক হবে না।
এক পা এগিয়ে লালজি রমলার দুই কাঁধ মুঠো করে ধরলে। তারপর সাপের হিসহিস আওয়াজের মতো চাপা অথচ তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, কেন—কেন একাজ করলে? বলো, কেন? কিসের লোভে?
লালজির বলিষ্ঠ হাতের শক্ত থাবার চাপে রমলার মুখ যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠল। প্রাণপণ চেষ্টায় সে জবাব দিলে, একটা জোচ্চেচার—একটা জালিয়াতকে ধরিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।
ও! একটা জোচ্চেচার, একটা জালিয়াত!
লালজির হাতের মুঠি খসে এল রমলার কাঁধ থেকে।
কিন্তু আজকের দুনিয়ার কে জোচ্চেচার নয় বলতে পারো? ভাই ঠকাচ্ছে ভাইকে, ধনী ঠকাচ্ছে গরিবকে, মনিব ঠকাচ্ছে চাকরকে, ধর্মযাজক ঠকাচ্ছে ধর্মভীরুকে, দেশের মন্ত্রী ঠকাচ্ছে প্রজাসাধারণকে। তোমার কর্তব্য কি শুধু একা আমার জন্যে রমলা?
শুকনো গলায় রমলা বললে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। সমাজের কাছে, আইনের কাছে তোমার মতো ক্রিমিনালের শাস্তি পাওয়া উচিত।
তিক্ত কণ্ঠে লালজি বলে উঠল, সমাজ! কোন সমাজ? যে সমাজ গরিবকে অন্ন দেয় না, মানুষকে সৎপথে চলতে দেয় না, ভদ্রভাবে বেঁচে থাকবার অধিকার দেয় না,সেই সমাজের মুখ চেয়ে তুমি বলছ, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না? চমৎকার যুক্তি!… শোনো রমলা, আমার মতো ক্রিমিনাল যারা তোমাদের সমাজকে তোমাদের আইনকে তারা থোড়াই কেয়ার করে! কিন্তু সত্যি করে বলো তো রমলা, তোমাদের সমাজে—তোমাদের আইনে কোনো উপয়াই কি ছিল না, অসৎ পথ থেকে আমাকে সরিয়ে আনার—আমার জীবনকে ভদ্র সুন্দর করে তোলার?
রমলা স্তব্ধ।
লালজি বলে চলল, যে সমাজে শুধু শাসন আছে, স্নেহ নেই—ঘৃণা আছে, ভালোবাসা নেই—সে সমাজের কথা মুখে আনার আগে লজ্জায় তোমার মাথা হেঁট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল রমলা। আগুন ধরিয়ে দাও সে সমাজে—ছাই হয়ে যাক পুড়ে।
স্থির কণ্ঠে রমলা বললে, সমাজকে চিরদিন কঠোর হতে হয়। নইলে শৃঙ্খলা থাকে না—শান্তি থাকে না।
বন্ধ করো—বন্ধ করো তোমার ওই শান্তি আর শৃঙ্খলার ধাপ্পাবাজি। আমার চেয়েও ধাপ্পাবাজ তোমাদের সমাজ! যেখানে সততার দাম নেই, মনুষ্যত্বের দাম নেই, লাখো গরিবের জীবন নিয়ে যেখানে জুয়া খেলা হচ্ছে, সেখানে শান্তিই বা কি, আর শৃঙ্খলাই বা কিসের?
লালজির চাপা বিদ্রূপের হাসিতে ঝড়ের বাতাস যেন কেঁপে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে অত্যন্ত শান্ত সহজ গলায় বললে, থাক এসব কথা। আজ তোমারও সময় নেই, আমারও নেই! এখুনি পুলিশ এসে পড়বে। জীবনে ঠিক এমনি করে দু’জনে মুখোমুখি দেখা হয়তো আর হবে না। তাই আজ শুধু একটা কথাই তোমায় জিজ্ঞাসা করি, তুমি জবাব দাও, মৌসুমি।
ঝড়ে বাঁশপাতার মতোই থরথর করে কেঁপে উঠল রমলা। যন্ত্রণাবিদ্ধ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ও নামে আর ডেকো না লাল—মিনতি করছি। মরে যাক—মৌসুমি মরে যাক—
ম্লান মধু একটু হাসির রেখা দেখা দিল লালজির ঠোঁটের প্রান্তে। মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, না। রমলারা মরে যায়—শিলারা মরে যায়, আমার মৌসুমি মরে না—কোনোদিন মরতে পারে না। কিন্তু জবাব দাও আমার প্রশ্নের। জানো, সমাজের আজ সবটাই মেকি। আমিও মেকি— তুমিও মেকি। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় ঝড়ের আকাশের তলায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে সেই একটি ঘণ্টা?
বৃষ্টিসিক্ত একটা মস্ত বড় ফুলের মতোই রমলার অশ্রুধোয়া মুখখানা দুই হাতে তুলে ধরে অবরুদ্ধ আবেগে লালজি বললে, সেও কি মিথ্যে, মৌসুমি? সেও কি শুধু খেলা? এতটুকু সত্য কি ছিল না তার মধ্যে? বলো মৌসুমি—জবাব তোমায় দিতেই হবে, বলো—
রমলার ঠোঁট দুটি স্ফুরিত হয়ে উঠল : একথা জানতে চেয়ো না, আজও সময় হয়নি!
রমলার মুখখানা ছেড়ে দিয়ে লালজি বললে, বেশ জানতে চাইব না। আমার প্রশ্ন চিরদিন প্রশ্নই থেকে যাক। কিন্তু আমার কথাটা জেনে রাখো মৌসুমি, ভালোবাসা কি, আমি জানতাম না। জীবনে প্রথম তুমিই আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছ একথা বলতে কোনো লজ্জা, কোনো কুণ্ঠা আমার নেই। আমার অন্ধকার ক্রিমিনাল—জীবন আজই সন্ধ্যায় মাত্র একটি ঘণ্টার জন্যে তুমি প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিলে। সে প্রদীপ ঝড়ে নিভে গেল। তবু তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞা মৌসুমি। … ওকি!
বাইরের রাস্তায় মোটর থামার আওয়াজ! লবির জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেই লালজির বুঝতে দেরি হল না, জিপ গাড়িতে কারা। নিমেষে অটোমেটিক পিস্তল তার পকেট থেকে আবার বেরিয়ে এল হাতের ওপর। পলকে বদলে গেল লালজির কণ্ঠস্বর। চাপা কঠিন স্বরে বললে, পেছন ফিরে দাঁড়াও রমলা—এক পাও নড়বার চেষ্টা কোরো না। পিস্তলে আমার হাত সহজে ফসকায় না, জেনো।
সিঁড়ির নীচ থেকে ভারী বুটের শব্দ আসছে।
কলের পুতুলের মতো পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল রমলা লালজি বললে, পুলিশ এল বলো, তাদের চা খাওয়াতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। সে ভারট তোমায় দিয়ে গেলুম।
করিডরের আবছা অন্ধকারে লালজির মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর সেই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল অফিসার গুপ্ত আর বিশু। আর জনচারেক সাদা—পোশাকে কনস্টেবল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে দাঁড়িয়ে রমলা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললে, লালজি পালিয়েছে!
থমকে দাঁড়িয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, পালিয়েছে! কেমন করে? কোন দিক দিয়ে?
তা দেখিনি। শুধু জানি, করিডরের দিকে গেছে।
কিন্তু করিডর দিয়ে তো পালাবার কোনো রাস্তা নেই?
বিশু বললে, আগে ন’নম্বর কামরাটা দেখা দরকার।
ন’নম্বর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতেই দেখা গেল, বাথরুমের দরজাটাও খোলা। পাশে মেথর যাতায়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।
সেই দিকে তাকিয়ে অফিসার গুপ্ত বলে উঠলেন, ইস! হাতের মুঠোয় এসে দু’জনেই নাগালের বাইরে চলে গেল।
বিশুর কপালে রেখা দেখা দিল। বললে, নাগালের বাইরে হয়তো এখনও যায়নি। কিন্তু আর এক মুহূর্তও দেরি নয়—এসো গুপ্ত, এসো রমলা—
.
কফি—হাউসে জিপসী—নাচ সুরু হয়েছে।
জোহরার এক হাতে ট্যাম্বুরিন, আর এক হাতে চকচকে ছোরা।
অর্কেস্ট্রার তালে তালে তার সুঠাম দেহ সাপুড়িয়া বাঁশির সুরে বশ—করা বুনো সাপিনীর মতো কখনও বা হেলছে, দুলছে, কখনও বা দ্রুত লয়ে ঘূর্ণির মতো ঘুরছে। আর হলের উজ্বল আলোয় বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠছে তার চোখের তারা, হাতের ছোরা, তার ঘাঘরার জরি।
কফি—হাউসে ভিড় আজ অসম্ভব রকম। উচ্ছ্বসিত তারিফের আর অন্ত নেই। মাতাল হয়ে উঠেছে সকলে নাচের নেশায়।
হঠাৎ জোহরার দৃষ্টি পড়ল দূরে। হলে এসে দাঁড়িয়েছে আন্দ্রে। আন্দ্রে আজ দেরি করে ফেলেছে। কিন্তু তার পেছনে পেছনে এসে ঢুকল ওরা কারা? একজন পুলিশ—অফিসার, আর বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা দীর্ঘচ্ছন্দ চেহারার ওই মেয়েটিকেই আজ সে সিনেমায় লালজির পাশে দেখেছে না? হ্যাঁ, সে—ই—জোহরার জীবনের রাহু শিলা!
জোহরার হৃদস্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। ওরা কেন এখানে? কেন এসেছে আন্দ্রের সঙ্গে? ওরা কে?
তাল কেটে গেল জোহরার! দেখলে, আন্দ্রে তাদের সঙ্গে কি যেন কথা কইল, তারপর টেবিলের ধার দিয়ে, হলের থামের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল তিনজনে।
ভিড়ের মধ্যে আর একজন নিঃশব্দে লক্ষ করল তাদের। সে বয় ইয়াসিন।
সাপের চোখের মতো ঝলসে উঠল জোহরার দুই চোখ। তার জ্বলন্ত দৃষ্টি তিরের মতো গিয়ে পড়ল শুধু শিলার ওপর।
শিলা এগিয়ে আসছে আন্দ্রের পাশে।
মিউজিকের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। জিপসি জোহরা হেলছে, দুলছে—
আরও এগিয়ে এল শিলা।
আরও দ্রুত হল মিউজিক। জিপসি জোহরা ছোরা লুফছে—
শিলা আসছে এগিয়ে।
জিপসি মেয়ের ছোরায় খেলছে বিদ্যুৎ—
হঠাৎ আন্দ্রে থেমে গিয়ে ধাক্কা দিল শিলাকে। আর সেই মুহূর্তে শিলার পাশ দিয়ে মৃত্যুর লকলকে জিহ্বার মতো চকচকে ছোরাখানা একটা কাঠের থামের গায়ে গিয়ে বিঁধল।
নাচের নতুন ঢং ভেবে চিৎকার করে তারিফ জানাল জনতা।
আন্দ্রে আবার এগিয়ে যেতেই সজোরে ধাক্কা লাগল কফির ট্রে সমেত বয় ইয়াসিনের সঙ্গে। আন্দ্রে টাল সামলে নেবার আগেই থামের ওপর দিয়ে অফিসার গুপ্ত দ্রুতপায়ে এগোলেন স্টেজের দিকে।
চোখের নিমেষে পকেট থেকে একটা কাচের বাল্ব বের করে ইয়াসিন ফেলে দিলে মেঝের ওপর। বিস্ফোরণের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় কুয়াশার মতো ঘন সাদা ধোঁয়ায়া ঢেকে গেল স্টেজের সামনেটা।
সেই ধোঁয়ার পর্দার দিকে অফিসার গুপ্ত রিভলভার তুলে ধরতেই আন্দ্রে তার হাত চেপে ধরে বললে, আন্দাজে ফায়ার করে নিরীহ লোক মোরো না—এসো আমার সঙ্গে।
রুমালে নাক চেপে তিনজনে ধোঁয়ার পর্দার আড়ালে হারিয়ে গেল।
এই আকস্মিক বিপর্যয়ে হলের মধ্যে তখন প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ভীত—সন্ত্রস্ত জনতা পালাবার অন্ধ চেষ্টায় পরস্পরকে শুধু দলিত পিষ্ট করে ফেলেছে। বেরোবার পথ খোলা নেই। সারা বাড়িটা ঘেরাও করেছে পুলিশ।
কিন্তু লালজি কোথায়—এই প্রলয়—নাট্যের নায়ক যে?
.
ধোঁয়ার পর্দার ওপারে চলুন। রহস্য—যবনিকার অন্তরালে।
রমলার হাত ধরে টানতে টানতে, অফিসার গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে আন্দ্রে যেখানে এসে পড়ল, সেখানে গ্রিণ—রুমে যাওয়ার দরজা। তার পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি।
আন্দ্রে বলল, ওপরে চলো।
কিন্তু দুটো ধাপের বেশি ওঠা গেল না। তার আগেই সিঁড়ির ওপরের বাতিটা গেল নিভে, আর অন্ধকারে নিঃশব্দে একটা গুলি এসে লাগল কাঠের রেলিং—এ আর একটা এসে বিঁধল আন্দ্রের বাঁ—কাঁধে।
ফায়ার! চিৎকার করে উঠল আন্দ্রে। সঙ্গে সঙ্গে অফিসার গুপ্তের হাতের রিভলভার গর্জন করে উঠল ওপরের দিক লক্ষ্য করে।
সিঁড়ির মাথায় উঠলে তখন দেখা যেত, জোহরার ঘরের সামনে কাঠের রেলিং—এর অন্ধকারে বন্য শ্বাপদের মতোই আত্মগোপন করে বসে আছে লালজি। হাতে অটোমেটিক পিস্তল নীচের দিকে লক্ষ্য করা। পেছনে দাঁড়িয়ে জোহরা—পাথরের মূর্তির মতো স্থির।
নীচের থেকে শোনা গেল আন্দ্রের কণ্ঠস্বর : সারেন্ডার, লালাজি! আর কোনো উপায় নেই তোমার!
উত্তরে লালজির পিস্তলের মুখ থেকে আরেকবার আগুন বেরোল!
সঙ্গে সঙ্গে নীচের থেকে প্রত্যুত্তর দিলে অফিসার গুপ্তের রিভলভার। ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল জোহরার জানলার শার্সি!
আবার আন্দ্রের গলা শোনা গেল : এখনও সময় দিচ্ছি সারেন্ডার!
ড্যাম ইট!—অটোমেটিকের মুখ দিয়ে আবার আগুন বেরোল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল গুপ্তর রিভলভার।
চাপা গলায় লালজি বললে, পিস্তলে আর দুটো গুলি আছে মাত্র—এই বেলা তুমি ছাদ দিয়ে পালবার চেষ্টা করো জোহরা।
জোহরা শুধু বললে, তোমায় ছেড়ে পালাব না।
কথা শোনো জোহরা, এখনও সময় আছে।
না।
সিঁড়ির তলা থেকে একটা গুলি এসে বিঁধল কাঠের রেলিং—এ। সঙ্গে সঙ্গে অটোমেটিকের মুখেও আগুন দেখা দিল।
নীচ থেকে আন্দ্রে বললে, আর দু’মিনিট সময় দিচ্ছি লালজি—সারেন্ডার!
দাঁতে দাঁত চেপে লালজি কুৎসিত একটা গালাগালি দিল।
অফিসার গুপ্তর রিভলভার আবার গর্জন করে উঠল।
আন্দ্রে বললে, সার্জেন্ট জোনসের কাছে টর্চ আছে রমলা—শিগগির—
লালজির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। ক্লান্ত পশুর মতো হাঁফাতে হাঁফাতে সে বললে, আরও গুলি আনা উচিত ছিল—কুকুরগুলো যে এখানেও পিছু নেবে ভাবতে পারিনি।
নীচ থেকে আন্দ্রে আবার চিৎকার করে উঠল, শেষবার বলছি, লালজি সরেন্ডার! ওয়ান—টু—
তিনের আগেই লালজির অটোমেটিক শেষবার আগুন উদগার করলে। তারপর বিদ্যুৎবেগে দাঁড়িয়ে উঠে, জোহরার হাত ধরে টেনে বললে, চলো—
দোতলায় সিঁড়ির মুখ পার হয়ে ছাদে যাবার রাস্তা। অন্ধকারে দুজনে নিঃশব্দে সেদিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ টর্চের এক ঝলক আলো এসে পড়ল তাদের ওপর।
চিৎকার করে উঠল আন্দ্রে, ফায়ার!
পলাতক আসামিকে লক্ষ্য করে গুপ্তর রিভলভার গর্জে উঠল। কিন্তু তার আগেই চোখের নিমেষে লালজিকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে জোহরা।
মর্মন্তিক যন্ত্রণায় সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে পড়ে গেল সে। টকটকে লাল তাতারি রক্তে ভিজে গেল জিপসি মেয়ের বুকের কাঁচুলি। সেইদিকে একবার তাকিয়ে হাতের পিস্তল ফেলে লালজি বলে উঠল, স্টপ অফিসার! আমি ধরা দিচ্ছি।
তারপর হাঁটু গেড়ে বসে জোহরার মাথা নিজের বাহুর ওপর তুলে নিয়ে বললে, এ কী করলে জোহরা? কেন এমনি করে নিজেকে জখম করলে?
ধীরে ধীরে চোখ মেলল জোহরা। আস্তে আস্তে বললে, দিল তো আমার জখম হয়েই ছিল। জখমি দিল কি নতুন করে জখম হয়? কিন্তু তুমি কেন পালালে না লাল?
ধরা গলায় লালজি বললে, একতাল তুমি বলে এসেছ, এবার আমি বলছি, তোমায় ছেড়ে পালাব না।
পৃথিবীর বাতাস ফুরিয়ে আসছে জোহরার কাছে। প্রাণপণে নিঃশ্বাস টেনে জোহরা ডাকলে, লাল—
আরও কাছে লালজি তার মুখটা নামিয়ে আনলে। জোহরার মুখ নীল হয়ে উঠেছে যন্ত্রণায়। অতি কষ্টে দম নিয়ে, থেমে থেমে সে বললে :
কোই হামে ব্যতা দে কেয়া কসুর থা দিলকা?
লব তক তো যাম আয়া, আতেহি ম্যগর ছলকা!
(বলে দাও, আজ আমাকে বলে দাও, কি দোষ করেছিল এ হৃদয়)? ওষ্ঠের প্রান্ত অবধি এসে কেন ছলকে পড়ে গেল পাত্রভরা সুধা?
লালজির মুখ আরও নেমে এল মৃত্যুপথযাত্রিণী জোহরার ওপর! তার পাণ্ডুর অধরে পরম স্নেহে দিলে চুম্বন—প্রথম ও শেষ চুম্বন!
রাত্রিশেষের ফুল ঝরে যাওয়ার আগে যে হাসি হাসে, সেই হাসিতে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোহরার মুখ। অস্ফুট স্বরে বললে, আলবিদা! (বিদায়)
তারপরই হঠাৎ বুজে এল চোখ দুটি। মাথাটা হেসে পড়ল কাত হয়ে।
বাইরে হু—হু শব্দে বিলাপ করে উঠল বৈশাখী ঝড়।
অতি সন্তর্পণে লালজি জোহরাকে শুইয়ে দিল মেঝের ওপর। যেন ঘুম না ভাঙে! অতি আদরে গুছিয়ে দিল তার চুলগুলো! তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, চলুন অফিসার, আমি তৈরি।
পুলিশ—প্রহরী বেষ্টিত হয়ে চলে গেল লালজি। আর লালজির শেষ স্মৃতি নিয়ে অনন্ত ঘুম ঘুমিয়ে রইল একা জোহরা।
বাইরে তখনও হাহাকার করছে উন্মাদ ঝড়। আর, বড় বড় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির অশ্রুধারা।
.
আসামি, তোমার কিছু বলবার আছে?
কাঠগড়ার রেলিং ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল লালজি। কোর্ট—রুমে লোকারণ্য। চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে বললে, আছে। কিন্তু আমার যা বক্তব্য, তা বলার আগে একটা কাহিনি বলি শুনুন। বিচারসভার কাছে এইটুকু অনুমতি আমি চাই।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন বিচারপতি।
লালজি শুরু করলে, আজ থেকে সাত বছর আগে তেইশ বছরের একটি যুবক তার রুগ্না মায়ের শিয়রে বসে বসে ভাবছিল, কেমন করে তার মাকে বাঁচাবে। ছেলেটির স্বাস্থ্য ছিল শক্তি ছিল, বুদ্ধি ছিল—বি—এ ডিগ্রিও ছিল, তবু কাজ জোটেনি কোথাও—জোটেনি একটাও চাকরি। বিধবা মায়ের শেষ অলঙ্কারটুকুও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ছেলের পড়ার খরচ চালাতে। আর যা কিছু ঘরের দামি আসবাব তাও একে একে গেছে মায়ের অসুখে। তারপর কোঠাবাড়ি থেকে খোলার ঘর, ভদ্র—পাড়া নোংরা বস্তি। ক্রমে দিন আর চলে না। কিন্তু দিন না চলুক, মায়ের চিকিৎসা তো চালাতে হবে! যেমন করে হোক চালাতেই হবে। বিকারের ঘোরে ভুল বকছিল মা, সেই দেখে কেঁদে উঠল সাত বছরের ছোট বোনটি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করল : ‘মা কি আর বাঁচবে না দাদা?’ বাঁচবে না? দুনিয়ার এত লোকের মা বেঁচে আছে, তাদের মা বাঁচবে না? গরিবের মায়ের বাঁচার কি অধিকার নেই? পাগলের মতো ছুটলো ছেলেটি ডাক্তারের বাড়ি। কিন্তু এল না ডাক্তার, দিলে না ওষুধ। ভিজিটের টাকা বাকি, ওষুধের দাম বাকি, আগের সে—টাকা চুকিয়ে না দিলে, গরিবের বাড়ি রুগি দেখতে যাওয়ার সময় ডাক্তারবাবুর হবে না! সেখান থেকে গেল ছেলেটি আত্মীয়—স্বজনের বাড়ি বন্ধু—বান্ধবের কাছে—দোরে দোরে ঘুরে ভিখিরির মতো হাত পেতে চাইল কয়েকটা টাকা। তবু কেউ দিল না। পথের কুকুরের মত তাড়া খেয়ে খেয়ে সে এসে দাঁড়াল শিয়ালদা স্টেশনের সামনে। সারাদিন মোট বয়ে সন্ধ্যার সময় পেল তিন টাকা সাড়ে এগারো আনা। সেই টাকায় ওষুধ কিনে সে যখন ঘরে ফিরল, তখন ওষুধের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে মায়ের! কিন্তু দুর্ভাগ্যের শেষ এখানেই নয়। ভোর—রাতে মাকে দাহ করে ফিরে এসে দেখা গেল, ছোট বোনটির ভেদবমি হচ্ছে। খিদের জালায় গত দু’দিনের বাসি ভাত—তরকারি খেয়েছিল সে। বড় আদরের ছিল তার বোনটি, সাত—আট ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল তার চোখের সামনেই! যাক, ভালই হল, আর কোনো বাঁধন রইল না! বোনটিকে দাহ করে সে আর ঘরে ঢুকল না, ঘুরে বেড়াতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়। তখন সন্ধ্যা নেমেছে শহরের ওপরে। চৌরঙ্গি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখছিল, কত আলো, কত হাসি কত ঐশ্বর্য! সিনেমায়, হোটেলে, বড় বড় দোকানে, ধনীদের দামি মোটরে কত বিলাস, কত প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি! সেইদিন রাত্রে মহানগরীর আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে মনে মনে ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করেই হোক, বড়লোক সে হবেই। ছেলেটির নাম ছিল সুশান্ত। সুশান্ত সেদিন বুঝল, দুনিয়ার হাটে শিক্ষার দাম নেই, সভ্যতার দাম নেই, সততারও দাম নেই। মাটির পুতুল—তাও চার আনা দামে বিকোয়, গরিবের প্রাণের দাম চার পয়সাও নয়। এ দুনিয়ার নীতি মিথ্যে, ধর্ম মিথ্যে, পাপ—পুণ্যের বিচার মিথ্যে—সত্য শুধু বড়লোক হয়ে বেঁচে থাকা। একটা রাতের মধ্যেই বদলে গেল সুশান্তর জীবন—দর্শন। আর, পরের দিন থেকেই সুশান্ত মরে গিয়ে জন্মাল লালজি।
সমস্ত কোর্ট—রুম স্তব্ধ।
লালজি বলে চলল: আজকের সমাজ সততার সঙ্কীর্ণ পথের মুখে লিখে দিয়েছে—No thoroughfare সে—পথে চলা যায় না। কিন্তু অসৎ পথ চৌরঙ্গির মতোই বড়, সে—পথ সকলের জন্যেই খোলা। সেই পথেই আমার যাত্রা শুরু হল। আর, বছর খানেকের মধ্যেই ভদ্র সন্তান থেকে পুরোদস্তুর চারশো বিশ ধারার আসামি হয়ে গেলাম আমি। জুয়াচুরির পথে, জালিয়াতির পথে, চোরা—কারবারের পথে রাশি রাশি টাকা আসতে লাগল আমার হাতে। জুয়াচুরির ব্যবতে আরও সুবিধে হবে বলে দিল্লির বাইজি—মহল্লা সবজিমণ্ডী থেকে একদিন নিয়ে এলাম জোহরা বাইকে। কিছু কিছু লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে চলনে—বলনে রীতিমতো কেতাদুরস্ত করে তুললাম। জোহরার সাহায্যে আমার চারশো বিশের কারবার ফলাও হয়ে উঠল। পুলিশ আমার নাগাল পাবে কি করে? শিক্ষিত ভদ্রসন্তান যখন জোচ্চেচার হয়, তখন সে সাধারণ অপরাধীর বাইরে চলে যায়। সুতরাং টাকা নামক রুপোর খেলনা নিয়ে খেলা করতে করতে পরম নিশ্চিন্তে আমার দিন কাটতে লাগল। একটা দু’টো দিন নয়, সাত—সাতটা বছর। শহরের মুখে মুখে গল্পকথার মতো রটে গেল লালজির অগাধ টাকার কথা। কিন্তু—
লালজি একবার তাকাল সেইদিকে, যেখানে জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে শুনছিল।
কিন্তু বড়লোক হয়েও আমি ভুলিনি গরিবদের কথা। একটা দিনের জন্যেও মন থেকে মিলিয়ে যায়নি আমার অতীত জীবনে দারিদ্র্যের সেই চাবুকের দাগ! তাই সারাদিন জুয়াচুরি ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আমি সন্ধান নিতাম, টাকার অভাবে কোথায় কোন গরিবের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কোথায় কোন নিঃসম্বল রুগি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে, কোথায় কোন বেকার মজুরের ভুখা পেটে দানাপানি পড়েনি। রাতের অন্ধকারে ‘মোহিতমোহন’ ছদ্মনামে গোপনে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসতাম তাদেরি ঘরে। কোনোদিন পরিচয় দিইনি, পাছে আমার অসৎ পথের টাকা আমার গরিব ভাইবোনেরা গ্রহণ না করে। অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আজ আমি ক্ষমা চাই তাদের কাছে।
লালজি বলতে লাগল, কিন্তু কে জানত আমার এই কাহিনি শেষ পরিচ্ছেদে এসে হঠাৎ উল্টে যাবে! আমার অপরাধের সপক্ষে যত যুক্তি থাক না কেন, যা পাপ, তা পাপ। আজ নিয়তি আমায় শিখিয়েছে, পাপের পথ দিয়ে কখনও ভাল করা যায় না… নিজেরও না, পরেরও না। আমার দুই অসৎ পথের বন্ধু বলেছিল, Crime does not pay! পাপের দেনা একদিন না একদিন মানুষকে শোধ করতেই হয়। পাপের সেই ঋণ অদ্ভুতভাবে তাদের শোধ করতে হয়েছে। ভগবান বলে যদি কেউ থাকে, এ হয়তো তারই বিচার। আমার পাপের ঋণ শোধ করতে আজ আমিও প্রস্তুত। বিচার—সভার কাছে আমার শুধু এই প্রশ্ন—কয়েকজন ধনীকে ঠকাবার অপরাধে যদি আমার বিচার হয়, তবে দেশের যে ধনী—সম্প্রদায় দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ গরিবকে ঠকাচ্ছে, তাদের বিচার হবে কবে? কে করবে তাদের বিচার?
লালজির কথা শেষ হল। তার শেষ প্রশ্নের কথাগুলি স্তব্ধ কোর্ট রুমের দেওয়ালে দেওয়ালে আঘাত করে ফিরতে লাগল।
ধীর—গম্ভীর জজ রায় উচ্চারণ করলেন।
পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড!
হাসিমুখে দণ্ড গ্রহণ করল লালজি। তারপর কাঠগড়া থেকে নেমে পুলিশ—পাহারার সঙ্গে কোর্ট—রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে অপেক্ষা করছিল কয়েদিগাড়ি। আর অপেক্ষা করছিল রমলা। গাড়িতে ওঠবার আগে লালজির কাছে এগিয়ে গেল সে। অশ্রুপ্লাবিত দুই চোখ তুলে বললে, আমি অপেক্ষা করে থাকব।
স্মিতমুখে লালজি হাসলে। বুক—ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে শুধু বললে, চমৎকার তোমার এই ফরাসি ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা!
তারপর গাড়িতে উঠল।
সমাপ্ত