বহুরূপী – ৭

চৌরঙ্গি। মহানগরীর সেরা রাজপথ।

দিনের আলোয় শহরের হৃৎপিণ্ড এখানে স্পন্দিত হতে থাকে। সন্ধের পর বদলে যায় এর রূপ। কুহকিনী জাদুকরীর মতো বিভ্রান্ত করে দেয় পথিককে।

মেট্রো সিনেমার সামনেটা আলোয় আলোয় দিন হয়ে গেছে।

একখানা ট্যাক্সি এসে ফুটপাথের সামনে হঠাৎ থেমে গেল। ভেতরে আন্দ্রে আর জোহরা।

গ্রেট ওয়ালজ!… আ, অপরূপ ছবি! কী মিউজিক! চলো মাদাম, এই ছবিটাই দেখা যাক।

সাহেব আর সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখে দরোয়ান শশব্যস্তে গাড়ির দরজা খুলে দিল।

আন্দ্রে বললে, সিট আমার রিজার্ভ করাই আছে, ভাবনা নেই।

দু’জনে যখন হলের মধ্যে ঢুকল, তখন একখানা কাটুন ছবি শুরু হয়ে গেছে। হল অন্ধকার।

কার্টুন ছবির পর নিউজ মুভিটোন।

মিনিট পনেরো পরে ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলে উঠল। আন্দ্রে বললে, ‘গ্রেট ওয়ালজ’ ছবিটা আমার দেখা। কিন্তু একবার কেন, দশবার দেখলেও আমার কাছে পুরানো হবে না মাদাম। আমেরিকায় এই ছবি চলেছিল—আরে! লালজি না?

জোহরা চকিত হয়ে উঠল।

সত্যিই লালজি! পেছন থেকে চিনতে আর যে—ই ভুল করুক, জোহরার ভুল হবে না। লালজির ছায়া দেখলে সে চিনতে পারে। তাদেরই সামনে দুটো সারি আগে বসে আছে। কিন্তু পাশে তার কে? বাসন্তী রঙের শাড়িপরা মাজা—মাজা রঙ, দীর্ঘচ্ছন্দ চেহারার কে ওই মেয়েটি তার পাশে বসে গল্প করছে?

ঠাহর করে দেখে আন্দ্রে বললে, তাইতো, লালজিই বটে! কিন্তু পাশে গার্ল ফ্রেন্ডটি কে?… ওহো, দ্যাট শিলা!

কৌতুকের একটু সূক্ষ্ম হাসি আন্দ্রের মুখে দেখা দিল : সিনেমায় হোক, হোটেলে হোক, ‘বার’ এ হোক, লালজিকে দেখতে পেলে কোনো গার্ল ফ্রেন্ড তার সঙ্গে থাকবেই। কিন্তু এই শিলাকে নিয়ে আজকাল একটু বাড়াবাড়ি করছে।… লালজিকে চেনো তো মাদাম?

জোহরার কাছ থেকে ছোট্ট জবাব এল : না।

ঘাড় বাঁকিয়ে আন্দ্রে একবার তাকাল তার দিকে। কেমন যেন ভাববেশহীন জোহরার মুখ। মর্মর পাথরের মতো মসৃণ অথচ কঠিন।

আন্দ্রে আবার বলতে লাগল, লালজিকে চেনো না? আশ্চর্য! অর্ধেক শহর ওকে চেনে। হোটেলে, ক্লাবে, ‘বার’—এ, সিনেমায়, খেলার মাঠে কে না চেনে লালজিকে? বিশেষ করে মেয়ে—মহলে সে ডার্লিং। কেনই বা হবে না বলো? চমৎকার স্বাস্থ্যবান ছেলে, অগাধ টাকা, মেজাজও ভারি শৌখিন। আর কী চাই? সুতরাং ওকে নিয়ে মেয়ে—মহলে রেষারেষি তো লাগবেই! প্রকৃতির নিয়ম।

আন্দ্রে সকৌতুকে হেসে উঠল।

কিন্তু সম্প্রতি লালজির পক্ষপাতিত্ব শিলার ওপরই একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। সেদিন সিক্সটি সিক্স ক্লাবে লালজি বলছিল, শিলাকে নাকি ও ভালবেসেছে।

জোহরার মুখের দিকে আন্দ্রে চোখ ফেরাল। পলকের জন্যে সে—মুখ আগুনের মতো রাঙা হয়ে উঠেই কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

আন্দ্রে বলতে লাগল, লালজির মুখে কথাটা অবশ্য খুবই আশ্চর্য! কেননা, যতদূর জানি মেয়েদের নিয়ে ও বরাবব খেলাই করে এসেছে, মন দেওয়া—নেওয়া ব্যাপারে নিজেকে কখনও জড়ায়নি। কিন্তু সেদিন ক্লাবে বললে, এতদিনে সে নাকি তার রাইট গার্ল—মনের মতো সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে। শীলাকে লালজি নাকি শিগগিরই বিয়ে করবে।

আন্দ্রে ফিরে তাকাল। জোহরার মুখ অন্য দিকে।

লালজি—শিলার প্রেমের কথা আজকাল শহরের মুখে মুখে। শুনলাম, বিয়ের পর ওরা দুজনে কাশ্মীরে গিয়ে—

আঃ, চুপ করুন! ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে।

জোহরার কণ্ঠ যেমন নীরস তেমনি কঠিন শোনালো।

.

শো—ভাঙবার পর বাইরের লরিতে বেরিয়ে এল আন্দ্রে আর জোহরা। জন—জটলার মাঝে জোহরার চোখ দুটি কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ কিসে আটকে গেল তার দৃষ্টি।

কিছুটা তফাতে জনস্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলেছে লালজি, আর তার বাহু আশ্রয় করে বাসন্তী রঙের শাড়িপরা সেই মেয়েটি—লালজির নতুন আবিষ্কার শিলা যার নাম।

আন্দ্রে বললে, এসো মাদাম, লালজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। নাইস চ্যাপ! খুশি হবে। এসো—

জবাব এল, না।

পশ্চিম দিগন্তে ঝড়ের ভ্রূকুটি। এলিয়ে পড়েছে কালবৈশাখীর জটা। আন্দ্রে তাকিয়ে দেখলে, তারই আভাস জোহরার মুখে।

ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়াল খালি ট্যাক্সি। শিলার হাত ধরে উঠল লালজি। আর সঙ্গে সঙ্গে মিটার ডাউন করে বেরিয়ে গেল গাড়ি আলো ঝলমল চৌরঙ্গির বুকের ওপর দিয়ে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোহরা দেখলে। চোখ দুটো তারাজ্বালা করছে জ্বোরো রুগির মতো। কপালের রগ দুটে অসহ্য উত্তাপে যেন ফেটে পড়বে।

হোয়াইট ওয়ের ঘড়িটা দেখে নিয়ে আন্দ্রে বললে, তোমার নাচের এখনো বহুত দেরি মাদাম। চলো না একবার গ্র্যান্ড ঘুরে যাই।

শুকনো গলার জোরহা বললে, তুমি একাই যাও আন্দ্রে, শরীরটা আমার খারাপ লাগছে।

আন্দ্রে ব্যস্ত হয়ে উঠল, শরীর খারাপ লাগছে! তাহলে কাজ নেই আর কোথাও গিয়ে। তোমায় কফি—হাউসেই পৌঁছে দিই চলো।

কফি—হাউসে পৌঁছতে আমার দেরি হবে আন্দ্রে। পথে একটু কাজ আছে।

একখানা খালি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল জোহরা।

মুখে বিচিত্র হাসি নিয়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রইল আন্দ্রে পল।

.

চৌরঙ্গি থেকে ট্যাক্সিখানা ময়দানের রাস্তা ধরতেই শিলা জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল। অর্থাৎ এদিকে কোথায়?

কুশনে হেলান দিয়ে বসে লালজি একটা সিগারেট ধরিয়েছিল আরাম করে। গম্ভীর মুখে বললে, আপনাকে নিয়ে ইলোপ করার ইচ্ছে হয়েছে।

ততোধিক গম্ভীর মুখে শিলা বললে, ও! তাই নাকি! কিন্তু শুধু একা আপনার ইচ্ছা হলেই তো হবে না, আমারও ইচ্ছে হওয়া চাই যে!

লালজি এবার হাসলে।

ভুল হল আপনার। দু’জনের ইচ্ছে হলে সেটা তো হরণ হবে না, সেটা বরণ হয়ে দাঁড়াবে। তাতে কোনো থ্রিল নেই—সুতরাং আমার আগ্রহও নেই।

আচ্ছা, ইলোপ না হয় করলেন, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবেন কোথায় শুনি?

ধরুন, মঙ্গলগ্রহে। সেখানে লাল অরণ্য—ছায়ায়—

শিলা আঁতকে উঠল।

ওরে বাবা! সঙ্গে মশারি নেই, ফ্লিট নেই, সেই জঙ্গলে থাকব কি করে? এত জায়গা থাকতে শেষে কিনা মঙ্গলগ্রহের জঙ্গলে? না মিস্টার, আপনার সঙ্গে ইলোপ করা আমার পোষাবে না।

তবে কোথায় যেতে চান বলুন? ভেনিস? মন্টিকার্লো? ক্যালিফোর্নিয়া, কাশ্মীর—

বড় জোর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

সশব্দে হেসে উঠল লালজি।

আচ্ছা, তাই সই।

লালজির কথামতো ট্যাক্সি ড্রাইভার মেমোরিয়ালের পাশে গাড়ি বাঁধল। দু’জনে নেমে এগিয়ে গেল ঝিলের ধার অবধি।

পশ্চিমে বৈশাখী মেঘের সমারোহ। এলোমেলো হাওয়ার ফুৎকারে নিভে গেছে অনেকগুলি তারার বাতি। আসন্ন ঝড়ের সম্ভাবনা। মেমোরিয়ালের আশেপাশে লোকের জটলা অনেকটা পাতলা।

বাঁ কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে লালজি ঘাসের ওপর আড় হয়ে পড়ল। তারপর শিলাকে বলল, বসুন।

উড়ন্ত আঁচল সামনে নিয়ে শিলা বসে পড়ল। বললে, এরপর সিনেমার হিরোইনদের মতো গান গাইতে বলবেন না তো?

বললেই বা আপত্তি কিসের?

নাটক আমি পছন্দ করি শুধু স্টেজে, প্রতিদিনকার জীবনে নয়।

লালজি একটা নতুন সিগারেট ধরাল। বলল, আপনার বয়স অল্প, তাই এ—কথা বলছেন। বয়স বাড়লে, অভিজ্ঞতা বাড়লে বুঝতে পারবেন, জীবনের চেয়ে বড় নাটক আর নেই। জীবনে এক একটি মুহূর্ত আসে, যা সমস্ত হিসেবে—নিকেশের বাইরে। তাই নিয়েই তো স্টেজের জন্যে নাটক লেখা হয়।

সেটা স্টেজেই ভাল লাগে। তার বাইরে সেটা ন্যাকামি বলেই মনে হয়।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে লালজি বললে, আমারও তাই মনে হত। কিন্তু নাটক আমরা মানি আর না মানি, নিয়তি বলে এক অদৃশ্য নাট্যকার আছেন, তাকে মানতেই হবে। ধরুন, আপনার—আমার আলাপটা—এও খানিকটা নাটকীয় নয় কী? আর এই নাটকের পরিণতি কোথায় সেই অদৃশ্য নাট্যকার ছাড়া আর কে বলতে পারে?

এবার শিলার কাছ থেকে কোনো জবাব এল না।

লালজির কণ্ঠ কেমন যেন উদাস। ঠিক এভাবে লালজিকে কথা কইতে আগে সে শোনেনি। কিন্তু লালজি—শিলার আলাপটা নাটকীয় নয়, নাটকীয় হয়ে দাঁড়াবে হয়তো এর পরিণতি। সে—পরিণতি কি অদৃশ্য নাট্যকার ছাড়া আর কেউ সত্যিই জানে না?

জানে বইকি, শিলা জানে। কি আসে যায় তার, যদি সেই পরিণতি ভয়ঙ্কর বিয়োগান্ত হয়? শিলা কি জানে না, লালজি কে? সে কি জানে না লালজি একজন ভদ্রবেশী প্রতারক—সমাজের শত্রু—চারশো বিশ ধারার আসামি!

সুতরাং কি আসে যায় শিলার?

কিন্তু কিছুই কি আসে যায় না? কে যেন তার কানে কানে বলল, মিথ্যা বলো না শিলা। আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তোমার নিজের আঁচলেও আগুন ধরেছে, একথা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? অস্বীকার করতে পারো কি, লালজির জীবন—নাটকের পরিণতির সঙ্গে তোমারও হাসি—কান্না, আনন্দ—বেদনা অনেকখানি জড়িয়ে গেছে?

শিলার ভাবনা সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে মনে বারবার সে জপ করতে লাগল, সেন্টিমেন্টের চেয়ে কর্তব্য বড়, হৃদয়াবেগের চেয়ে বড় কর্তব্যনিষ্ঠা

মিনিট পনেরো চুপচাপ কাটান।

অন্ধকারেব মুখ দেখা যায় না। তবু বৈশাখী—সন্ধ্যার ঝোড়ো আকাশের তলায় দু’জনে দু’জনের উপস্থিতি সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করছে।

এক সময় লালজি কথা বললে, আচ্ছা কী নামে আপনাকে ডাকা যায় বলুন তো?

কেন, বাপ—মা কি আমার কোনো নাম রাখেননি?

সে তো আমারও বাপ—মা রেখেছেন, কিন্তু আপনি ডাকেন কেন মিস্টার বলে?

যে—কোনো ভদ্রলোককে মিস্টার বলেই ডাকা হয়, তাই।

সে তো সকলের জন্যে। শুধু একজনের জন্যে যে নাম, আমি তার কথাই বলছি।

বেশ তো, সে—নাম তাহলে একজনই ঠিক করুন।

লালজি সোজা হয়ে উঠে বসল। শিলার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললে, আমি তোমাকে ডাকব মৌসুমি বলে।

শিলা আস্তে আস্তে বললে, মানে যাই হোক, নামটা অদ্ভুত বটে।

লালজি বলতে লাগল, মৌসুমি বাতাস আনে রুক্ষ মাটির বুকে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত—নবীন ফসলের আশা।

তারপর কানে কানে বলার মতো আবছা গলায় লালজি উচ্চারণ করলে, আমার জীবনে তাই তুমি মৌসুমি।

আকাশে নতুন মেঘ উঠলে তৃণে তৃণে যেমন শিহরণ লাগে, তেমনি করে শিলার দেহের প্রত্যেকটি স্নায়ু শিহরিত হতে লাগল। একটু আগে কে জানত, মেঘছায়াঘন সন্ধ্যার আকাশের তলায় বসে পুরুষের মুখ থেকে মধুর কপোত—কূজনের মতো প্রিয় নামের ডাকটি শোনার লগ্ন তার জীবনে আজই আসবে! জীবনটা সত্যিই নাটক নয় কি?

সমস্ত মনের জোর দিয়ে শিলা বার বার নিজেকে বলতে লাগল, সেন্টিমেন্টের চেয়ে কর্তব্য বড়, হৃদয়াবেগের চেয়ে বড় কর্তব্যনিষ্ঠা।

লালজি বললে, আচ্ছা মৌসুমি, পাপ—পুণ্য, স্বর্গ—নরক—এ সবে তুমি বিশ্বাস কর?

করি বইকি। শতকরা নিরানব্বই জন বিশ্বাস করে।

পাপ কাকে বল তোমরা?

পরের ক্ষতি করাটাই পাপ।

কিন্তু সে ক্ষতি দিয়ে যদি আরেকজনের উপকার হয়?

তবুও সেটা পাপ। তার জন্যে শাস্তি পাওয়াই উচিত।

লালজি চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, তোমার মতের সঙ্গে আমার মত মিলল না মৌসুমি। তবু তোমার কথাই হয়তো সত্যি।

শিলা বললে, চলুন, এবার উঠি।

আরও কিছুক্ষণ বসো মৌসুমি। আজকের পর আরও অনেক সন্ধ্যা আমাদের জীবনে আসবে, —কিন্তু এই সন্ধ্যাটা আর আসবে না। তুমি নিয়তি মান মৌসুমি?

শিলা জবাব দিলে, মানি।

লালজি বললে, আজকের সব কিছুই নিয়মির চক্রান্ত—সেই অদৃশ্য নাট্যকারের খেলা! এতে তোমার আমার কোনো হাত নেই মৌসুমি।

শিলা আবার বললে, রাত হল। এবার যাই।

আর একটু বসো।

পশ্চিমী মেঘের জটলা আরও ঘন হয়ে উঠেছে। নির্জন হয়ে এসেছে মেমোরিয়ালের চারপাশ। অন্ধকার ছায়ামূর্তির মতো দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। অন্ধকারে চেনা যায় না, কিন্তু জানা যায়। জানা যায় যে, দুটি হৃদয় পরস্পরকে স্পর্শ করেছে।

লালজি যেন হঠাৎ স্বপ্নে কথা কয়ে উঠল : মানুষকে কতখানি ঘৃণা করো মৌসুমি?

অনেক।

আর, কতখানি ভালোবাসো?

অনেক?

যাকে ঘৃণা করা উচিত, তাকে ভালোবাসতে পারো না?

কি একটা আবেগেব বাষ্প শিলার বুকের ভেতর ঠেলে উঠছিল। অন্ধকারে বোঝা গেল না তার চোখে জল কিনা। ধরা গলায় জবাব দিলে, কি হবে সে—কথা জেনে?

তারপর চঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, কিন্তু আর নয়। এবার ঝড় উঠবে।

ঝড় সত্যিই উঠল। লালজি উঠে দাঁড়াবার আগেই বেজে উঠল নটরাজের গুরু গুরু ডমরুধ্বনি। অন্তরীক্ষে যেন কোনো উন্মাদিনী ললাটে সোনার কঙ্কণ হেনে হাহাকার করে উঠল। আর তারই কঙ্কগাঘাতে স্বর্ণবর্ণ বিজলী শিখায় ঝলসে গেল দিগদিগন্ত।

তারপর নেমে এল বড় বড় অশ্রুর ফোঁটার মতো বৃষ্টির ধারা।

ঝড়ে বিপর্যস্ত শিলাকে একহাতে জড়িয়ে, বৃষ্টিতে অন্ধ হয়ে হোঁচট খেতে খেতে সিক্তবাসে লালজি যখন গাড়িতে এসে উঠল, ঝড়ের তাণ্ডব তখন একটু কমে এসেছে।

গাড়ি ছেড়ে দিল।

নতুন বৃষ্টি আর ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা অথচ মিষ্টি সুগন্ধে গাড়ির ভেতরকার বাতাস মূছিত হয়ে আছে যেন।

লালজি আস্তে আস্তে ডাকলে, কথা কইছো না যে মৌসুমি?

পিছনের সিটে হেলান দিয়ে শিলা ঝড়ে ছিন্নমূল পুষ্পলতার মতো শ্রান্ত অবসাদে চোখ মুছে বসে ছিল। অস্পষ্ট স্বরে বললে, একটু চুপ করে থাকতে দাও আমাকে।

একখানি হাত বড় স্নেহে, বড় আদরে আর একটি হাতকে ধীরে ধীরে স্পর্শ করলে।

.

ঠিক সেই সময় আন্দ্রেকে পার্ক স্ট্রিট থানায় অফিসার গুপ্তের কামরায় ঢুকতে দেখা গেল।

অফিসার গুপ্ত তখন রিপোর্ট লিখছেন। বিদেশি আগন্তুক দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়েস—হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, জেন্টলম্যান?

আন্দ্রে একটু হেসে সাদা বাংলায় বললে, এক কাপ কড়া চা ফরমাস করো গুপ্ত।

মাই গড! বিশু!

রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিশু বললে, তাহলে পুলিশের চোখেও ধুলো দিতে পেরেছি, কি বলো?

বিলক্ষণ। কিন্তু এই ঝড়—বৃষ্টি মাথায় করে হঠাৎ থানায় যে?

কোটটা খুলে চেয়ারের পিঠে রেখে বিশু বললে, এসে যখন পড়েছি, তখন রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যাক।

গুপ্ত বললেন, বেশ, কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরে ঝড় থেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

একখানা চেয়ারে বসে আরেকটায় আরাম করে পা তুলে দিল বিশু। বললে, ঝড় থামলেও আমাকে এখানেই থাকতে হবে আজ।

দুই চোখে কৌতূহল নিয়ে গুপ্ত প্রশ্ন করলেন, কেন বলো দেখি?

আজ রাতে রমলার কাছ থেকে একটা জরুরি টেলিফোন আশা করছি। অবশ্য আর আগে তাকেই একবার ফোন করার দরকার। বিশু রিসিভারটা তুলে নিলে।

.

হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দু’হাত দিয়ে শিলা এলোমেলো ভিজে চুলগুলি যথাসম্ভব বিন্যস্ত করে নিল।

লালজি নিচু গলায় বললে, লেডি মুখার্জি যদি জিজ্ঞাসা করেন এমন চেহারা হল কেন, কি বলবে শুনি?

বাঁকা চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে শিলা নিচু গলায় বললে, বলব, ডাকাতে ধরেছিল। তারপর লালজিকে পিছনে ফেলে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল ছ’নম্বর কামরার দিকে।

ন’নম্বর ঘরে যেতে হলে ছ’নম্বর কামরা পার হতে হয়। মৃদু শিস দিতে দিতে লালজি এগোল। যদি সে গাইতে পারত! অন্তত একটা দিনের জন্যে তার কণ্ঠে যদি সুরের বন্যা বয়ে যেত, লালজি তাহলে প্রাণের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারত আজ। অন্ধকার রাত্রে জীবনকে সে বহুরূপে দেখেছে, কিন্তু আজকের এই মেঘগহন রাত্রির আকাশের তলায় শিলার সঙ্গে একত্রে জীবনের যে রূপ সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা বিচিত্র, আশ্চর্য অপরূপ!… প্রণাম তোমায় হে অদৃশ্য নাট্যকার, লালজিকে তুমি জীবনের পরমসুন্দর রূপের সন্ধান দিয়েছ বলে।

এলোমেলো ভিজে চুল, অসংযত পদক্ষেপ আর মুখে বিচিত্র হাসি নিয়ে লালজি ন’নম্বর কামরায় ঢুকল।

কিন্তু ও কে? অন্ধকার ঘরে বৃষ্টির ঝাপটা আর হু হু হাওয়া অগ্রাহ্য করে খোলা জানালার পাশে পিছন ফিরে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে?

কে?

লালজি সুইচ টিপে দিল। ভেসে গেল ঘর স্পষ্ট প্রখর আলোর বন্যায়।

আমি। জানালার পাশে মূর্তিটি ঘুরে দাঁড়াল।

লালজির বিস্ময়ের সীমা রইল না।

জোহরা তুমি! হঠাৎ যে?

তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসেছি!

মর্মর পাথরের মতো মসৃণ মুখ পাথরের মতোই কঠিন। দুই চোখে আগুন জ্বলছে!

বোঝাপড়া! কিসের?

কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কার সঙ্গে ছিলে?

লালজির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

কৈফিয়ত চাও নাকি জোহরা?

যদি চাই, সেটা আমার দাবি লাল।

আজ তোমার কি হয়েছে বলো তো?

সে—কথা পরে। আগে বলো, কোথায় ছিলে তুমি—কে ছিল সঙ্গে?

অধিকারের বাইরে যেও না জোহরা। আমি জবাব দেব না।

জানালার পাশ থেকে সোজা এগিয়ে এল জোহরা। দাঁড়াল লালজির মুখোমুখি। বললে, তুমি জবাব না দিলেও ক্ষতি নেই। আমি জানি, সন্ধেবেলা থেকে তুমি কার সঙ্গে বিহার করছিলে। সে তোমার নতুন প্রিয়তমা, দিল কি রানি, জাদুকরী শিলা জোহরা নিঃশব্দে হাসলে। ধারালো ছুরির ফলার মতো ধারালো ব্যঙ্গের হাসি।

এক মুহূর্ত লালজি স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বললে, জানো যদি তবে প্রশ্ন করেছিলে কেন?

দেখছিলুম কতটা লুকোচুরি তুমি খেলতে পারো।

লুকোচুরি কিসের?

তোমার প্রেমের লালজি—তোমার প্রেমের!

জোহরার চোখদুটি ধারালো ছুরির ফলার মতো আবার ঝিকমিকিয়ে উঠল।

আমি জানি, শিলার সঙ্গে তোমার প্রেমের লুকোচুরি চলছে অনেক দিন থেকেই। সেই যেদিন হোটলের এই কামরা থেকে শিলাকে বেরিযে যেতে দেখেছিলাম, সেইদিন থেকেই। অথচ সেদিন তোমায় জিজ্ঞাসা করেও পরিষ্কার জবাব পাইনি। কিন্তু আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেছে— দিনের আলোর মতো।

দুই হাত পিছন দিকে একত্র করে লালজি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জোহরা লক্ষ করলে দেখতে পেত তার চোয়ালের হাড় দৃঢ় রেখায় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। দুই চোখ বজ্রগর্ভ।

জোহরার দৃষ্টি সেদিকে ছিল না। বিষাক্ত হাসি ছড়িয়ে সে তখন বলে চলেছে, তারপর, প্রেমিক সাজাহান, কবে শাদি করছ তোমার মমতাজকে? কবে যাচ্ছ কাশ্মীর? চাঁদনি রাতে তোমার বেগমকে বুকে নিয়ে নীল দরিয়ার জলে ভাসতে ভাসতে প্রেমের খোয়াব দেখতে কবে যাচ্ছ শুনি?

শান্ত গম্ভীর গলায় অত্যন্ত ধীরে ধীরে লালজি বললে, তুমি যদি পুরুষ হতে জোহরা আর একটি কথা বলবার আগেই তোমাকে আমি চাবুক মারতাম।

আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল জোহরা। দুই হাতে শাড়ির আঁচল বুকের ওপর থেকে সরিয়ে উন্মত্তের মতো সে বলে উঠল, বেশ, মারো—মারো চাবুক আমার বুকে, মিটে যাক আমার বুকের দরদ। একেবারে শেষ করে দাও আমাকে!… কিন্তু তোমাকেও আমি শান্তিতে বাঁচতে দেব না লাল। ভুলে যেও না, আমার শরীরে বিষাক্ত তাতারি খুন আছে। প্রাণ থাকতে আমি অন্য কোনো আওরাতের হাতে তোমাকে তুলে দিতে পারব না।

চকিতে টেবিলের ওপর থেকে জোহরা চায়না গ্লাসের প্রকাণ্ড ফুলদানিটা তুলে নিলে।

আমি মরবার আগে, জেনে রাখো লাল, তোমাদের দু’জনের মহব্বত এমনি টুকরো টুকরো করে দিয়ে যাব—

ঝন ঝন শব্দে চায়না গ্লাসের ফুলদানিটা মেঝের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

আর জানলার শার্সিতে আছড়ে পড়ল ঝড়ের হাহাকার।

জোহরার দুই কাঁধ দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে লালজি বলে উঠল, কী করছ তুমি জোহরা? থামো—চুপ করো—

চুপ আমি করব না।

বলছি চুপ করো!

উন্মাদিনীর মতো জোহরা চীৎকার করে উঠল, না—না—না! আমাকে আর চুপ করাতে পারবে না লাল।

দাঁতে দাঁত চেপে লালজি বললে, তোমার স্পর্ধার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে জোহরা।

তোমারও নিষ্ঠুরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে লাল।

একটা ঝাঁকানি দিয়ে জোহরা লালজির হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। বলতে লাগল, কোনোদিন আমাকে তুমি ভালবাসতে পারোনি, তা জানি। কিন্তু তাই বলে অন্য মেয়ের সঙ্গে তুমি ভালবাসার খেলা খেলবে, আর দিনের পর দিন আমি চোখ মেলে তাই দেখব—এ তুমি স্বপ্নেও ভেব না লাল। আমি যা পাইনি, খোদা কসম, অপরকেও তা পেতে দেব না—কিছুতেই না। তোমার শিলা, তোমার পেয়ারের রাণির কাছে তোমার মুখোশ আমি খুলে দেব… জানিয়ে দেব, তুমি কত বড় ঠগ, ধাপ্পাবাজ, জুয়াচোর—

তুমি কি বলছ, তুমি জানো না জোহরা!

জোহরা তবু বলে চলল, তোমার কীর্তির কথা একে একে সব বলব তাকে! বলব, তুমি রাজারামের দোকান থেকে গহনা ঠকিয়ে নিয়েছ—

সচকিত হয় লালজি বলে উঠল, চুপ!

জোহরার গলা আর এক পর্দা চড়াল : আমাকে জাল অপর্ণা সাজিয়ে তুমি ফাঁকি দিয়ে ইন্সিওর কোম্পানির পনেরো হাজার টাকা মেরেছ—

জোহরা!

আমাকে দিয়ে ফন্দি করে এই সেদিন কুঞ্জ বিশ্বাসের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা আদায় করে নিয়েছ—

লালজির ডান হাতখানা সাপের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল জোহরার নরম গলার দিকে, কিন্তু তার আগেই নিমেষে সজাগ হয়ে উঠল তার ষষ্ঠ ইন্দিয়।

দরজার বাইরে কার লঘু পদশব্দ মিলিয়ে গেল না?

লালজি হতচেতনের মতো দাঁড়িয়ে রইল এক সেকেন্ড। হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চাপা উদ্বেগের স্বরে বললে, এখানে আর এক মুহূর্তও থেকো না জোহরা। বাথরুমের পাশে মেথর যাবার ঘোরানো সিঁড়ি— এখুনি পালিয়ে যাও।

লালজির মুখের দিকে তাকিয়ে জোহরার সর্বাঙ্গ হিম হয়ে এল। লালজির একখানা হাত আঁকড়ে ধরে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, তোমায় ছেড়ে আমি পালাব না লাল।

কথা শোনো জোহরা—বিপদ বাড়িয়ো না।

চাপা কান্নায় জোহরার ঠোঁট দুটি থর থর করে কেঁপে উঠল। ব্যাকুল হয়ে বললে, আসুক বিপদ, তোমায় একা ফেলে যাব না—

আঃ জোহরা—যাও বলছি।

জোহরাকে বাথরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে লালজি শুধু বললে, দশটায় তোমার নাচের প্রোগ্রাম। আবার দেখা হবে।

খোলা জানালা পথে হু হু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেল ঝড়ের হাওয়া।

ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে জোহরা নেমে যেতেই খাটের গদির তলা থেকে কি—একটা বস্তু নিয়ে লালজি পকেটে পুরল। তারপর দ্রুতপদে গিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে ফেললে একটানে।

রাত দশটার পর হোটেলের করিডরে সবগুলি বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। শুধু লবির মুখে একটিমাত্র বাতি জ্বলে।

সেই আবছা অন্ধকারে এদিক—ওদিক তাকিয়ে লালজি ভাবলে, তবে কি সে ভুল করেছে? সে যা শুনেছে, তা কি পায়ের আওয়াজ নয়? ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ?

সহসা তার সমস্ত চেতনা রিমঝিম করে উঠল হালকা অথচ মিষ্টি একটা সুগন্ধে।

গন্ধটা ফরাসি ল্যাভেন্ডারের। আর সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কুকুর যেমন শত্রুর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলে, করিডরের আবছা অন্ধকারে লালজিও তেমনি করে নিঃশব্দে এগোতে লাগল।

.