বহুরূপী – ৬

থানা—পুলিশ বাদ দিয়ে কোনো গোয়েন্দা—গল্প তৈরি হয় না। সুতরাং আমার সঙ্গে আপনাদেরও আর একবার পার্ক স্ট্রিট থানায় যেতে হবে।

অফিসার গুপ্ত পড়ছিলেন :

গত সোমবার ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স কোম্পানিতে এক বিচিত্রি প্রতারণার কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে। প্রায় মাসখানেক পূর্বে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটি অল্পবয়স্কা বিধবা মহিলাকে সঙ্গে করিয়া উক্ত কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মিঃ আয়ারের সহিত দেখা করে। ভদ্রলোকটি নিজেকে আসামের মৃত জমিদার জানকীনাথ চৌধুরির এস্টেটের ম্যানেজার ভূজঙ্গধর হাজারিকা বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বলে যে, বিধবা তরুণীটি জমিদারের একমাত্র কন্যা অপর্ণা দেবী। মৃত জানকীনাথ চৌধুরির মৃত্যুর তিন বৎসর পূর্বে কন্যা অপর্ণার নামে উক্ত বিমা কোম্পানিতে পনেরো হাজার টাকা জীবনবিমা করিয়া যান। ভূজঙ্গধর ও অপর্ণা নামে পরিচিত সেই প্রৌঢ় লোকটি এবং বিধবা মহিলাটি যথারীতি বিমার পলিসি ও মৃত জানকীনাথের ডেথ—সার্টিফিকেট ম্যানেজারের নিকট দাখিল করিয়া বিমার দরুণ পনেরো হাজার টাকা দাবি করে। তাহারা গত সোমবার দিন কোম্পানির নিকট হইতে পনেরো হাজার টাকার চেক লইয়া সরিয়া পড়ে। ইহার অব্যবহিত পরে আর এক ব্যক্তি একটি বিধবা বয়স্কা মহিলাকে সঙ্গে লইয়া ম্যানজারের ঘরে প্রবেশ করে। তাহারও আপনাদিগকে ভূজঙ্গধর ও অপর্ণ দেবা বলিয়া পরিচয় দিয়া উক্ত টাকার দাবি জানায়।

পড়া থামিয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, শুনছ বিশু? টেবিলের ওপর দেশলাইয়ের কাঠি সাজিয়ে বিশু নাড়াচাড়া করছিল। মুখ না তুলেই বললে বইকি, তারপর?

অফিসার গুপ্ত আবার শুরু করলেন :

তাহারা আরও বলে যে, মৃত জমিদারের ডেথ—সার্টিফিকেট

ও বিমার পলিশি জমিদারির একজন পুরাতন কর্মচারী

গোপীকান্ত আচার্যের মারফত ইতোপূর্বে পাঠাইয়া দিয়াছে

এবং সেই মর্মে কোম্পানির নিকট হইতে প্রাপ্ত একখানা

চিঠিও দেখায়। এই ব্যাপারে জেনারেল ম্যানেজার মিঃ

আয়ার বিভ্রান্ত হইয়া পড়েন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে ও

পুলিশে ফোন করিয়া সমস্ত ঘটনা জানান।

দেশলাইয়ের কাঠির দিকে চোখ রেখেই বিশু বললে, যাক, টাকাটা তাহলে মারা যায়নি।

অফিসার গুপ্ত পড়ে যেতে লাগলেন :

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, তাঁহারাই প্রকৃত ভূজঙ্গধর ও

অপর্ণা দেবী। কিন্তু প্রথম ব্যক্তিদ্বয় কে বা কি, তাহার

সঠিক বিবরণ এখনো পাওয়া যায় নাই। ম্যানেজারের বর্ণনা

হইতে জানা গিয়াছে যে, প্রথমোক্ত প্রৌঢ় ব্যক্তির চোখে

চশমা, মুখে ছাঁটা গোঁফ, গলায় কম্ফর্টার এবং হাতে রূপা

বাঁধানো একগাছা লাঠি ছিল। বয়স অনুমান পঞ্চাশের

উপরে। তরুণী মহিলাটি অসামান্য রূপসী এবং সম্ভ্রান্ত

দর্শনা। জোর তদন্ত—

রমলা হঠাৎ স্বগত বলে উঠল, চোখে চশমা, মুখে ছাঁটা গোঁফ, গলায় কম্ফর্টার আর হাতে রূপা—বাঁধানো লাঠি!… লোকটিকে আমার দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে বিশুদা।

বিশু এবার মুখ তুলে সোজা হয়ে বসল : কোথায়?

পরশুদিন আমাদের হোটেলের ন’নম্বর কামরায়—মানে, লালজির ঘরে। ভদ্রলোক বললেন, তিনি লালজির জ্যাঠামশাই।

বিশু বললে, জ্যাঠামশাই?

হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, মিনিট দশ পনেরো বাদে আবার ঘরে গিয়ে দেখা গেল, জ্যাঠামশাই কর্পূরের মতো উবে গেছেন আর তার বদলে বেরিয়ে যাচ্ছে স্বয়ং লালজি!

বিশু হেসে উঠল : লালজি তাহলে জ্যাঠা—ভাইপো দুই পুরুষের ভূমিকায় একসঙ্গে নেমেছে। বাহাদুর বলতে হবে। সত্যিই বহুরূপী বটে! কিন্তু জাল অপর্ণা দেবীটি কে? লালজির পার্টনার সেই রহস্যময়ী… আচ্ছা গুপ্ত, শুনেছি তোমাদের অপরাধ—তত্ত্বে বলে, অপরাধী পুরুষের প্রতি অপরাধ—প্রবণ মেয়েদের আকর্ষণ একটু বেশিই হয়ে থাকে। বহু ক্ষেত্রে গভীর ভালবাসাও জন্মায়। তা যদি হয়, তাহলে লালজির প্রতি সেই সুন্দরী রহস্যময়ীর গভীর আসক্তি থাকা স্বাভাবিক। নয় কি?

বিরক্ত হয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে তুমি কি এবার প্রেমের গল্প লিখবে—

অফিসারের কথা শেষ হল না! তার আগেই মোটাসোটা গলদঘর্ম এক ব্যক্তির ঝড়ের মতো প্রবেশ।

নমস্কার দারোগাবাবু! দয়া করে একটা কেস লিখে নিন তো।

ভুরু কুঁচকে অফিসার গুপ্ত বললেন, কে আপনি?

পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড় মুছতে মুছতে লোকটি বললে, আমার নাম শ্রীকুঞ্জবিহারী বিশ্বাস। কারবারি লোক, চিৎপুরে আমার তিসির আড়ত আছে। আমাকে ঠকিয়েছে মশাই! গালে চড় মেয়ে দশটি হাজার টাকা ঠকিয়ে নিয়েছে। যাকে বলে, ব্ল্যাকমেল!

ব্যাপারটা কি? কে ঠকিয়েছে?

লালামোহন মুখুজ্জে মশাই, কানপুরের গালার কারবারি। হারামজাদা এত বড় শয়তান, নিজের সুন্দরী বউটাকে লেলিয়ে দিয়ে—সে কি কেলেঙ্কারি মশাই! কি কুক্ষণেই যে গিয়েছিলাম তাদের বিয়ের তারিখে নেমন্তন্ন খেতে। এমন জানলে কোন সম্বন্ধি—

অফিসার গুপ্ত ধমকিয়ে উঠলেন, থামুন। সমস্ত ব্যপারটা খুলে বলুন আগে।

দশ হাজার টাকার মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কুঞ্জ বিশ্বাস তার আক্কেলসেলামির সমস্ত বিবরণটি বলে গেল।

অফিসার গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, লালমোহন মুখুর্জ্জের সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?

তা প্রায় মাস আষ্টেক হবে।

আপনার সঙ্গে কখনো কোনো বিবাদ হয়েছিল তার?

কক্ষনো না। উল্টে দহরম—মহরম! মাঝে মাঝে একসঙ্গে একটু আধটু ইয়েও চলত।

লালমোহন মুখুর্জ্জের স্ত্রীর সঙ্গে কতদিনের আলাপ?

এক—আধ দিন মাত্তর! আমি মশাই মেয়েছেলের কারবারে নেই। তবে হ্যাঁ, মুখুর্জ্জের স্ত্রী রঞ্জনা দেখতে যেন ডানাকাটা পরি! কিন্তু কে জানত মশাই, ভেতরে ভেতরে মিছরির ছুরি!

রমলা অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

অফিসার গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, লালমোহন মুখুজ্জে থাকে কোথায়?

হোটেলে মশাই, হোটেলে। কি যে নাম—কুইন ভিক্টোরিয়া—

বিশু প্রশ্ন করলে, কুইন ভিক্টোরিয়া, না কুইন মেরি হোটেল?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই হোটেল। তারই ন’নম্বর কামরায় থাকে।

কুঞ্জ বিশ্বাস বাদে বাকি তিনজন নিঃশব্দে পরস্পরে দৃষ্টি বিনিময় করল।

অফিসার গুপ্ত বললেন, কিন্তু আপনি এখানে কেস লেখাতে এসেছেন কেন? কেসটা তো এ—থানার এলাকায় নয়।

কুঞ্জ বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে উঠল : এ—থানা ও—থানা জানি না মশাই, আমার দুঃখের কথা কলকাতার সব থানাতেই জানিয়েছি। এর একটা বিহিত আপনাদের করতেই হবে। ওই ছুঁচো লালমোহন মুখুর্জ্জেটাকে ধরে তাকে দিয়ে ঘানি টানাব, তবে আমার শান্তি। দশ হাজার গেছে, না হয় আরও দশ হাজার যাবে। কুচ পরওয়া নেই… আচ্ছা নমস্কার। এবার মুচিপাড়া থানায় যাই—ওইটাই এখনো বাকি।

সিল্কের রুমাল দিয়ে কপাল আর ঘাড় মুছতে মুছতে মোটাসোটা গলদঘর্ম কুঞ্জ বিশ্বাসের প্রস্থান।

তিনজনেই নীরব। শুধু ওয়াল—ক্লকটার বুকে সময়ের হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে।

তারপর নীরবতা ভেঙে বিশু বললে, বহুরূপী লালজির এও আর একটি রূপ।

‘বিশ্ববার্তা’ কাগজখানা হাতের মুঠোয় পাকাতে পাকাতে অফিসার গুপ্ত অবরুদ্ধ রাগে বলে উঠলেন, লালজি, লালজি! লালজি! সারা শহরে লোকটা যেন ভেলকি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। লালজি—রহস্যের একটা কিনারা করতেই হবে বিশু—যত শিগগির হয়।

দেশলাইয়ের কাঠির খেলায় বিশু আমার মন দিয়েছিল। মুখ না তুলেই বললে, ধীরে বন্ধু, ধীরে। উতলা হওয়া পুলিশ—অফিসারের কাজ নয়।

কিন্তু এদিকে যে চাকরি রাখা দায় হয়ে পড়েছে! একে রাজারামের কেসটার কোনো কিনারা এখনও হয়নি, তার ওপর আজ ‘বিশ্ববার্তা’ কাগজে এই রিপোর্টটা বেরোবার পর উপরওয়ালা কড়া নোট পাঠিয়েছেন, তা জানো? ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি গিয়ে লালজিকে—

গ্রেপ্তার করবে? কিন্তু তার আগে আট—ঘাট বেঁধে কাজ করাই ভাল নয় কি?

রমলা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার বললে, এখন তাহলে আমার প্রতি কি নির্দেশ আপনাদের?

সে—কথার কোনো জবাব না দিয়ে বিশু বললে, আচ্ছা রমলা, কাজ আর কাজ করে তুমি কি পাগল হবে? মেট্রোতে একটা নতুন ছবি এসেছে—’গ্রেট ওয়ালজ’। চমৎকার ছবি, দেখে এসো না একদিন।

রমলা যেন নেচে উঠল : চলুন না দেখে আসি।

বেশ তো! দু’খানা টিকিট কেটে রেখো একদিন। ধরো, আসছে রবিবার—ছ’টার শোতে। পরের টিকিটে সিনেমা দেখতে আমি ভয়ানক ভালোবাসি। তবে একটা কথা বলে রাখি ভাই, হঠাৎ কোথাও আটকা পড়ে যদি সেদিন যেতে না পারি, তবে রাগ কোরো না যেন।

বা রে! একখানা টিকিট নষ্ট হবে যে।

নষ্ট হবে কেন, আমার বদলে নাহয় আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেও।

কোথায় আবার সঙ্গী খুঁজে পাব?

চোখে একটি ইসারা নিয়ে বিশু বললে, পাবে পাবে। হোটেলে আশেপাশে খুঁজলেই নতুন সঙ্গী পেয়ে যাবে’খন…. বুঝতে পারছ না?

পেরেছি!

হাসিমুখে রমলা যাবার জন্যে উঠে পড়ল।

.

হাতের মুঠোয় এসে ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্সর পনেরো হাজার টাকা পিছলে বেরিয়ে গেল। আফশোসটা সেইজন্য নয়। টাকাটা যে পথে এসেছিল, সেই পথটাই পিছল। সে পথে টাকা আসেও যেমন সহজে, তেমনি বেরিয়েও যায় মুহূর্তে। এই হল নিয়ম। কাজেই লালজি সেজন্য চঞ্চল হয়নি, চঞ্চল তাকে করেছে পনেরো হাজার টাকার চেক ভাঙাতে গিয়ে ফিরদৌস ইরানির যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখেছে, তারই চিন্তাটা।

লালজির মনে পড়ল ইরানি সাহেবের কথা : Crime does not pay, my boy! পাপের দেনা কখনো বাকি থাকে না!

নীতির কথা, ধর্মের কথা!… ফুঃ!

কিন্তু এ সব নিয়ে লালজি মাথা ঘামাচ্ছেই বা কেন? নীতি বলো আর ধর্মই বলো, সে সব তো বহুদিন আগে গঙ্গার জলে সে ভাসিয়ে দিয়েছে! তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে দুনিয়াদারির হাটে এ সবের দাম কানাকড়িও নয়।

সুতরাং ওসব বাজে কথা মুছে ফেলে দাও মন থেকে।

পিটার খবর পাঠিয়েছে, কিছু স্প্যানিশ মদ খিদিরপুরে এসে পৌঁছবে আগামী হপ্তায়। এবারে অবশ্য মহম্মদ রশিদ যাবে না, যাবে অন্য কেউ। কিন্তু তার আগে একবার ওয়াংয়ের আড্ডায় যাওয়া দরকার। কত দর দিতে পারে জানতে হবে। না পোষালে শহরে অন্য খদ্দেরের অভাব হবে না।

ট্যাংরায় সেই কাঠের ফটকের সামনে লালজির গাড়ি এসে যখন থামল, রাত তখন বেশি হয়নি। ঝোলানো চিনে লন্ঠনগুলির তলায় দু’—একটা ঝিমন্ত থ্যাবড়া গোল মুখ যথারীতি বসে। চাপা গলার লালজি বললে, বাজপাখি।

প্রথম লোকটা ছোট ছোট চোখ মেলে একবার তাকাল শুধু। তারপর আবার ঝিমতে শুরু করলে। আশ্চর্য, লোকটা শিস দিতে ভুলে গেল নাকি? না, চণ্ডুর মাত্রাটা আজ অত্যধিক হয়েছে?

লালজি দ্বিতীয় লোকটার কাছে এগিয়ে গেল। একখানা চিনে কাগজের পৃষ্ঠা থেকে একবার মুখ ভুলে লোকটা আবার মুখ নামিয়ে নিল।

কোনো সঙ্কেতের আওয়াজ এবারও হল না। লালজি রীতিমতো অবাক। চায়না টাউনে এ ব্যাপার নতুন বইকি—তবে কি কোনো নতুন সঙ্কেত চালু হয়েছে এখানে?

লালজি একবার ট্রাউজারের পকেটে হাত দিলে! অটোমেটিকটা ঠিকই আছে। তারপর এগিয়ে চলল। বিলের ধারে সেই বাঁহাতি কাঠের বাড়ি। কিন্তু কই—কোথায় সেই শাঁকচুন্নি বুড়ি, আড্ডায় ঢোকবার আগে যে দস্তুরির কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়? যমরাজার কাছে দস্তুরি আদায়ের জন্যে বুড়ি মাটি নিয়েছে নাকি? না, পুলিশের দৃষ্টি পড়েছে ওয়াংয়ের আড্ডার ওপর, তাই গা ঢাকা দিয়েছে?

চায়না টাউনের চেহারাটা আজ গোলমেলে ঠেকছে!

দরজা ঠেলে লালজি ঢুকল। কাঠের খুপরিগুলোর পাশ দিয়ে সেই চোরা গলিপথ লালজির মুখস্থই আছে। তবু গলিপথের শেষে এসে তার ধাঁধা লেগে গেল।

এ কোথায় এল সে? কোথায় সেই জুয়ার টেবিল, সেই অ্যাংলো ছোকরার দল, বন্য বাইসনের মতো বলিষ্ঠ নিষ্ঠুর সেই ওয়াং, আর রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট বনফুলের মতোই ক্রাচে ভরে দিয়ে সেই ছোট্ট মিমি?

হল ভরর্তি সারি সারি মশারি—ফেলা বিছানা। লালজি লক্ষ করলে, কয়েকটা বিছানার মধ্যে ছোট ছোট শিশুর দল পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। জুয়ার লম্বা টেবিলটা হলের একপাশে সরানো। তার দু’পাশে বেঞ্চির ওপর জন পনেরো কুড়ি ছেলেমেয়ের দল খেতে বসেছে। বয়স পাঁচ থেকে বারোর মধ্যে। চিনে ছাড়া আরও নানা জাত আছে।

একবার চোখ বুজে লালজি আবার তাকিয়ে দেখল। ভুল করে বাচ্চচাদের কোনো বোর্ডিং—এ এসে পড়ল নাকি? কিন্তু না, ভেতরে প্রবেশ করার আগে দরজার বাইরে ড্রাগন—আঁকা ঝোলানো লন্বনটা সে তো বিশেষ লক্ষ করেই দেখেছিল! না, ভুল তার হয়নি।

কিন্তু ওয়াং কোথায়? ডাকবে নাকি একবার ওয়াংয়ের নাম ধরে?

ডাকতে হল না। পাশের একটা খুপরি থেকে ওয়াং বেরিয়ে এল। হাতে তার প্রকাণ্ড একটা পাত্র। ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের গেলাসে খানিকটা করে দুধ ঢেলে দিয়ে বললে, নাও খেয়েদেয়ে যে যার বিছানায় শুয়ে পড়ো। আর শুতে যাওয়ার আগে—মনে আছে তো?

আড়াল থেকে শুনলে বিশ্বাসই হত না, ওয়াংয়ের গলা এত কোমল হতে পারে।

খাওয়া শেষ করে একে একে ছেলেমেয়েরা উঠে পড়ল। তারপর শুতে যাওয়ার আগে ওয়াংকে তারা একটি করে চুম্বন দিয়ে গেল।

সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে ওয়াং নীরবে হাসছিল। নেকড়ের মতো শরীর হিম—করা সেই ভয়ঙ্কর হাসি নয়। স্নেহের উত্তাপে আশ্চর্য মধুর হাসি।

অভিভূতের মতো লালজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, এবার ডাকল ওয়াং।

ওয়াং ফিরে তাকিয়ে সহজ গলায় বললে, এসো লালজি, বসো।

লালজি আস্তে আস্তে বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসল। তার পাশে বসে ওয়াং হাসিমুখে বললে, অবাক হয়ে গেছ নয়?

অবাক হওয়ার কথা নয় কি?

তা বটে!

ওয়াং নীরব হয়ে রইল।

লালজি জিজ্ঞাসা করলে, জুয়ার আড্ডা একেবারে তুলে দিয়েছ নাকি?

হ্যাঁ।

এরা কারা?

আমার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেমেয়েরা।

কিন্তু এদের মধ্যে মিমিকে দেখছি না যে? সে কোথায়? ঘুমিয়েছে?

লালজি পকেট থেকে টফি বার করল।

ওয়াংয়ের মুখের হাসি নিভে এল। অত্যন্ত মৃদু গলায় বললে, মিমি নেই।

নেই! কোথায় গেছে?

স্বর্গে।

টফিগুলো হাতের মুঠোয় ধরে লালজি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল।

ওয়াং বললে, একদিন তাকে খুব বকেছিলাম। বড় অভিমানী মেয়ে ছিল সে, সেদিন আমার সেই কটু সথা সহ্য করতে পারেনি বোধহয়। আমাকে না বলে চুপি চুপি কখন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল টের পাইনি। মেয়েকে খুঁজতে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখি, তাকে তখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। শুনলাম রাস্তা পার হতে গিয়ে খোঁড়া মেয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারেনি। একখানা মোটর তার ওপর এসে পড়ে। হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই সব শেষ। মেয়েকে খুঁজে পেলাম বটে, কিন্তু ঘরে আনা আর হল না!

একটু নীরব থেকে ওয়াং আবার বলতে লাগল, মিমিকে মাটি চাপা দিয়ে এসে যখন এই ঘরে ফিরলাম, তখন হঠাৎ মনে হল আমি পাগল হয়ে যাব। এত বড় শূন্য ঘরে আমার দম আটকে আসতে লাগল। মা—মরা মেয়েটা আমার জীবন কতখানি জুড়ে ছিল, আগে তা বুঝিনি। জুয়ার আড্ডা তুলে দিলাম। পথে অনাথ ছেলেমেয়ে দেখলেই কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসি। এই করে আজ একত্রিশটি ছেলেমেয়ে আমার ঘর ভরে তুলেছে। কিন্তু আরও জায়গা আছে—আরও অনেক ছেলেমেয়ের জায়গা আছে আমার এই ঘরে।

একটা মশারির ভেতর থেকে একটা কচি বাচ্চচা কেঁদে উঠল।

ওয়াং বলল, বসো, আসছি।

তাড়াতাড়ি গিয়ে সে মশারির মধ্যে ঢুকল। লালজি অবাক হয়ে শুনল গুন গুন করে ওয়াং ঘুমপাড়ানি ছড়া গাইছে।

সেই ওয়াং!

বাচ্চচাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে আবার ফিরে এল। বললে, মিমি যায়নি, এদের মধ্যেই আছে। এদের আমি নিজের হাতে খাওয়াই, পরাই, ঘুম পাড়াই। সঙ্গে করে রোজ স্কুলে নিয়ে যাই। আর বাকি সময়টুকু চামড়ার কাজ করি। কোনো দুঃখ নেই আমার। কেন জানো? শাস্তি তো আমার হয়েই গেছে।

শাস্তি! কিসের?

পাপের। পাপের দেনা বাকি থাকে না—একদিন না একদিন মানুষকে শোধ করতেই হয়। মিমিকে হারিয়ে একথা জেনেছি।

ইরানি সাহেবও ওই কথা বলেছিল। লালজি হঠাৎ কেমন যেন অস্থির বোধ করতে লাগল। এসব কথা সে শুনতে চায় না—মানতেও চায় না। পাপ—পুণ্যের বিচার বহুদিন আগেই সে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।

হাতের টফিগুলো টেবিলের ওপর রেখে লালজি বললে, চলি ওয়াং।

মাঝে মাঝে এসো। আর কোনো অনাথ ছেলেমেয়ের সন্ধান পেলে তাকে দিয়ে যেও এখানে।

চোরা গলিপথ দিয়ে চলতে চলতে অন্ধকারে লালজি শুনতে পেল, কচি কোমল গলায় কে যেন বলছে : ‘আমায় তুমি ভুলে যাবে না লাল?’

লালজি মনে মনে বললে, তোমায় ভুলব না মিমি।

.

মস্ত একটা ব্ল্যাক প্রিন্সের তোড়া হাতে নিয়ে আন্দ্রে গ্রিন—রুমে প্রবেশ করল।

মেক—আপ শেষ করে জোহরা চোখের কোলে পেন্সিলের রেখা টানছিল। আরশিতে আন্দ্রের ছায়া দেখে হেসে বললে, রোজ ফুল কেন?

ফুলের তোড়াটা টেবিলের ওপর রেখে আন্দ্রে জবাব দিলে, পারস্য দেশের এক কবি বলেছেন, দুটি মাত্র পয়সা যদি জোটে, তাহলে একটি পয়সার খাদ্য কিনো, আর বাকি পয়সাটি দিয়ে কিনো ফুল…! আ, গ্রেট! কবির মতো কবি বটে।

তরল কণ্ঠে জোহরা বললে, তোমার কাঁধে কাব্যের ভূত চেপেছে আন্দ্রে সাহেব।

মাথা নাড়তে নাড়তে আন্দ্রে বললে, সে—কথা ঠিক। কিন্তু আজ থেকে নয়, অনেকদিন থেকেই। মাদাম, পথে আসতে আসতে দেখলাম, আকাশে চাঁদ হাসছে, আর তারাদের চোখে জাদু। চলো না, খানিকটা বেড়িয়ে আসি।

আজ? নাচ রয়েছে যে।

বেশ, তবে কাল?

কাল রবিবার, কালও তো নাচ আছে।

সে তো রাজ দশটায়। আমি শুধু তোমার সন্ধেবেলাটা চাইছি। কাল আমরা বেরিয়ে, ধরো, একটা ভাল ছবি দেখতে পারি। তারপর গঙ্গার ধারে খানিকটা বেড়িয়ে, দশটার আগেই আবার এখানে ফিরে আসা যাবে, কেমন?

গ্রিন—রুমের বাতিগুলো এই সময় বার কয়েক দপ দপ করে উঠল।

জোহরা ব্যস্ত হয়ে বললে, নাচের সময় হয়েছে। যেতে হবে।

গ্রীণ—রুম থেকে বেরোবার আগে আন্দ্রে বললে, তাহলে কালকের সন্ধ্যের প্রোগ্রাম ঠিক রইল মাদাম?

যেতে যেতে জোহরা বলে গেল, আচ্ছা।

আন্দ্রে আস্তে আস্তে হলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। জোহরার জিপসি নাচ তখন শুরু হয়ে গেছে!

নিজের রিজার্ভ করা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আন্দ্রে দেখলে, তিন গেলাস ‘বিয়ার’ নিয়ে তিন ব্যক্তি পরমানন্দে টেবিলটা দখল করে বসে আছে। একজন পাঞ্জাবি ছোকরা, আর একজন স্থূলাকার বেঁটে বার্মিজ এবং তৃতীয়জন তুর্কি—ফেজ মাথায় দিয়ে বসে বসে সিল্কের রুমালে কপাল আর ঘাড় মুছছে।

আন্দ্রে সবিনয়ে বলল, মাপ করবেন, আপনাদের বোধ হয় টেবিল চিনতে ভুল হয়েছে।

আশ্চর্য! পাঞ্জাবি ছোকরাটি ইংরাজিতে মান্দ্রাজি টান দিয়ে বলল, না, চিনতে ভুল আমাদের হয়নি।

সঙ্গে সঙ্গে মোটা বেঁটে বার্মিজ পরিষ্কার হিন্দিতে বলে উঠল, রামজি কসম—কোনো ভুল হয়নি।

আর ফেজ মাথায় তুর্কি মুসলমানটি সাদা বাংলায় বললে, ভুল আমাদের হতেই পারে না স্যার।

চাপা গলায় আন্দ্রে বললে, ভাল করে দেখেছেন তো মিঃ আয়ার? রাজারামবাবু, আপনিও দেখছেন তো? কি কুঞ্জবাবু?

তিনজনেই একত্রে স্টেজের দিকে তাকাল, তারপর একই সঙ্গে তিনটি জবাব এল:

এই সেই অপর্ণা দেবী!

এই হচ্ছে রুকমিণী!

এই তো রঞ্জনা!

এবার আন্দ্রে বললে, এখন তাহলে আপনারা যেতে পারেন।

তারা চলে যেতেই আন্দ্রে তাদের তিনটে গেলাস জলতরঙ্গের বাটির মতো পাশাপাশি সাজিয়ে নাচের সঙ্গে তাল দিতে শুরু করলে।

স্টেজের ওপর একহাতে চকচকে একখানা ছোরা, আরেক হাতে ট্যাম্বু, রিন নিয়ে জিপসি জোহরা তখন মিউজিকের তালে তালে বুনো সাপিনীর মতো হেলছে দুলছে…

.

দু’দিন ধরে কি যেন হয়েছে লালজির।

মনের কোথায় যেন একটু বিকল হয়েছে। হঠাৎ যেন অবসাদ এসেছে দেহে—মনে। ছুটি চাই।

এই দু’দিন সে হোটেল ছেড়ে বিশেষ কোথাও বেরোয়নি। কৌচে গা এলিয়ে আলস্যভরে শুধু সিগারেটের পর সিগারেট টেনেছে। যায়নি নতুন শিকারের সন্ধানে। দেখাও করেনি জোহরার সঙ্গে। ফোনে বলে দিয়েছে, ভয়ানক ব্যস্ত।

কিন্তু কেন?

কেন, তা সে নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ ভালোও লাগছে না এই নিষ্ক্রিয় জড়তা! নিজের সম্বন্ধে লালজি আজ চিন্তিত। বিরক্তও বটে।

চড়া পর্দায় সেতার বেজে চলেছিল দ্রুত লয়ে। কোথায় গিয়ে কোন সমে শেষ হবে সে জানত না। জানবার প্রয়োজনও ছিল না বিশেষ, হোক না শেষ যেখানে খুশি! কিন্তু তার আগেই আজ দু’দিন ধরে একটি তার গেছে আলগা হয়ে। বেসুর আওয়াজ দিচ্ছে।

উঠে গিয়ে লালজি জানলার পর্দা সরিয়ে দিল।

পশ্চিমে সূর্যাস্ত হচ্ছে।

দাঁড়িয়ে রইল লালজি। সূর্যাস্ত দেখার এমন অবকাশ বহুদিন তার মেলেনি। সে শুধু দেখেছে, রাত্রির আকাশের তলায় নিশাচর জীবনের সর্পিল গতি—কফি—হাউসে,ফিরদৌস, ইরানির ঘরে, ওয়াংয়ের আড্ডায়।

সেই ইরানি সাহেব বদলে গেছে। বদলে গেছে ওয়াং। জীবনের অন্ধকার চোরাপথে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী দু’জন!…

কিন্তু গেলই বা বদলে, তাতে লালজির কি আসে—যায়? নাঃ, কিছুই আসে—যায় না। আরেক ইরানি সাহেব জুটবে, জুটে যাবে আরেক ওয়াং। লালজি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সোজা পথে সঙ্গী খুঁজতে হয়, অভাব হয় না চোরা পথে।

তবু—

তবু এটা সত্যি যে, তারা বদলে গেল। কেন বদলে গেল? কে দিল তাদের বদলে? অন্ধ রুমার দুঃখ? মিমির মৃত্যুর বেদনা? না, বিবেকের নির্দয় চাবুক?

Crime does not pay! পাপের দেনা শোধ করতেই হয়!…

রাবিশ!

পোড়া সিগারেটের টুকরোটা লালজি চটির তলায় পিষে ফেলল।

না, ও সব লালজি বিশ্বাস করে না। তার কোনো দুঃখ নেই—বেদনা নেই—নেই দুর্বলচিত্ত ফিরদৌস ইরানি আর ওয়াংয়ের মতো পারে চিন্তা, পরিণামের ভয়! আর, বিকেব? গ্রাহ্য করে না সে। ওটা চিত্তের দুর্বলতা—বয়সের লক্ষণ!

দূর করো ও—সব ভাবনা।

এখন খানিকট জিন পেলে হত। কপালের রগ দুটো দপ দপ করছে।

দরজায় আওয়াজ হল—টক টক টক।

শুনছেন—ও মিস্টার—ঘরে আছেন?

লালজি চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। লিলার গলা! বললে, আসতে পারেন।

দরজা ঠেলে দ্রুতপায়ে ঢুকল শিলা। সঙ্গে সঙ্গে গত রজনীর সুখস্মৃতির মতো ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা মিষ্টি সুগন্ধে লালজির মাথাধরা কমে গেল।

দেখুন দেখি কি মুশকিল পড়েছি—

লালজি তৎক্ষণাৎ স্মেলিং সল্টের শিশিটা এগিয়ে দিলে।

হেসে ফেললে শিলা। বললে, না, লেডি মুখার্জি আজ ভালোই আছেন।

তবে মুশকিলটা কি?

দেখুন না কাণ্ড! সকালে লেডি মুখার্জি বললেন, যাও মেট্রো থেকে সন্ধের জন্যে দু’খানা টিকিট কিনে আনো। রোদে পুড়ে টিকিট করে আনলুম, আর এখন বলছেন কিনা ব্যারিস্টার গুহ সাহেবের আসার কথা আছে, ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি একাই যাও।…. আচ্ছা বলুন তো একা একা কখনো সিনেমা দেখা যায়?

লালজি বললে, নিশ্চয়ই না!

নিতান্ত অসহায়ের মতো শিলা বললে, এখন কী করি আমি? সকাল থেকে আশা করে বসে আছি সিনেমায় যাব, অথচ…. এখন কোনো কাজ আছে নাকি আপনার?

কেন বলুন তো?

বলছিলাম, বিশেষ কাজ যদি না থাকে, চলুন না ছবি দেখে আসি। টিকিট তো করাই রয়েছে। যাবেন?

হেসে লালজি বললে, দ্বিতীয়বার অনুরোধের প্রয়োজন হবে না। আমিও এইমাত্র ভাবছিলাম, যেখানে হোক কোথাও গেলে হয়।

শিলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, তাহলে চটপট—ছ’টা বাজতে পনেরো মিনিটও বাকি নেই—

বালিশের তলা থেকে পার্সটা পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে লালজি বললে, চলুন—

.