বহুরূপী – ৫

মটকার পাঞ্জাবি পরা মোটাসোটা থলথলে চেহারার শ্যামবর্ণ এক ব্যক্তি কুইন মেরি হোটেলে ন’নম্বর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে সোনার চেন দেওয়া পকেট ঘড়ি বার করে দেখলেন, হ্যাঁ, ঠিক সাতটাই বেজেছে।

ভদ্রলোকের মাথার মাঝখানে মাঝারি সাইজের একটি টাক। ডান পাশের চুলগুলি আঁচড়ে বাঁ দিকে ফেলে সেটি সযত্নে ক্যামোফ্লেজ করা। আলগোছে তার ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক দরজায় ঘা দিলেন।

একটু পরে দরজা খুলে গেল। মুখ বাড়াল লালমোহন মুখুয্যের স্ত্রী রঞ্জনা দেবী। গোপালের পাপড়ির মত গোলাপি ঠোঁট দুটি হাসিতে খুলে গেল।

ও, কুঞ্জবাবু! আসুন, ভেতরে আসুন।

জরির ধাক্কা—দেওয়া লুটিয়ে পড়া কোঁচাটি সযত্নে বাঁ—হাতে তুলে কুঞ্জ বিশ্বাস প্রবেশ করলেন। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে রঞ্জনা হাত দুটি জোড় করে বললে নমস্কার বসুন।

হেঁ—হেঁ—নমস্কার, নমস্কার।—কুঞ্জবাবু একটা কৌচে বসলেন: ভালো আছেন তো রঞ্জনা দেবী? কর্তাকে দেখছি না যে—মানে লালমোহন বাবু?

কুন্দদস্তে নিচের ঠোঁটটা একবার চেপে রঞ্জনা বলে উঠল, ওহো, আপনাকে বলতেই ভুলে গেছি, আজ দুপুরে একখানা জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে ওকে এই সন্ধের গাড়িতে কানপুর যেতে হল। ফ্যাক্টরিতে কি যেন একটা গণ্ডগোল বেধেছে।

কুঞ্জবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।

বলেন কি! কলকাতা থেকে একেবারে কানপুর? আজকের এই মধুযামিনী ছেড়ে—হেঁ—হেঁ—

রঞ্জনা বললে, হঠাৎ চলে যেতে হল বলে উনি খুবই দুঃখিত। বার বার করে আমাকে বলে গেলেন, ‘রঞ্জনা, তুমি কুঞ্জবাবুকে বোলো যেন মনে কিছু না করেন। ভাল করে না খাইয়ে ছেড়ো না কিন্তু।’

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কুঞ্জবাবু বললেন, আর খাওয়া! এ যে শিবহীন যজ্ঞ হল দেখছি!

মধুর হেসে রঞ্জনা বললে, আমি তো আছি, আপনার যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না।

সে কি কথা! আমি তা বলিনি—মানে—

লজ্জিত অপ্রতিভ কুঞ্জবাবু বাকিটুকু হেঁ—হেঁ দিয়ে শেষ করলেন।

রঞ্জনা বললে, খাবার আনতে বলব?

এই তো মোটে সাতটা।

তবে চা? কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্ক?

না, না, ওসব কিছু দরকার নেই। লালমোহনবাবু কবে ফিরবেন?

ফুলদানিতে একগোছা মরশুমি ফুল সাজাতে সাজাতে রঞ্জনা বললে, বলে গেছেন দিন কয়েকের মধ্যেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

ফুলের স্তবকের পাশে রঞ্জনাকে একটা বড় ফুলের মতোই দেখাচ্ছিল। কাঠ—গোলাপ রঙের বেনারসি শাড়িখানা রঞ্জনার সুঠাম দেহ জুড়ে আগুনের মতোই জ্বলছে। সেইদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কুঞ্জ বিশ্বাস সিগারেট টানছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আপনাদের দু’টিকে বেশ মানায়!

রঞ্জনা একবার বাঁকা চোখে তাকাল। তারপর হেসে বললে, আপনাদেরই বা কম কি? আপনার স্ত্রী তো শুনেছি, খুব সুন্দরী।

কেমন যেন একটু তাচ্ছিল্যের সুরে কুঞ্জবাবু বললেন, নাঃ, আপনার মতো নয়।

কালো চোখ দুটি কৌতুকে ঝিলমিলিয়ে উঠল।

আমি আবার সুন্দরী নাকি?

গলায় অস্বাভাবিক জোর দিয়ে কুঞ্জবাবু বলে ফেললেন, আলবাত!

সত্যি?

রঞ্জনা কৌচের কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে মৃদু হাসি। এ সেই হাসি, যে হাসির শিখায় ট্রয় নগর ধ্বংস হয়েছিল, ছারখার হয়েছিল স্বর্ণলঙ্কা।

রঞ্জনা আবার বললে, বলুন না, সত্যি—?

কুঞ্জ বিশ্বাস বোকা—বোকা চোখে তাকিয়ে শুধু বললে, হেঁ—হেঁ—

রঞ্জনা গিয়ে রাস্তার দিকের জানলার পর্দটা সরিয়ে দিলে। বললে, আজ ভারি গরম পড়েছে, নয়?

ভয়নাক।

সিল্কের রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড় মুছতে লাগলেন কুঞ্জবাবু। পাখার রেগুলেটর একটু ঘুরিয়ে দিয়ে রঞ্জনা বললে, ওকি, অমন আড়ষ্ট হয়ে বসেছেন কেন! ভাল করে বসুন না!

হেঁ—হেঁ— মানে আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন!

মাথার ঘোমটা সরিয়ে রঞ্জনা এসে ক্লান্ত অলস ভঙ্গিতে কুঞ্জবাবুর পাশে বসে পড়ল। তারপর কৌচের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ দুটি বুজে অস্ফুটে বলে উঠল, ইস, মাথাধরাটা এখনও ছাড়ল না!

ব্যস্ত হয়ে কুঞ্জবাবু বলে উঠলেন, মাথা ধরেছে নাকি?

কোনো জবাব এল না। মন্থর আলস্যে মুদিতনয়না রঞ্জনা কৌচে এলিয়ে শুয়ে আছে।

কি একটা বলতে গিয়ে কুঞ্জবাবু ঢোঁক গিললেন।

কাঠ—গোলাপ রঙের শাড়ি রঞ্জনার দেহবঙ্কিমা ঘিরে অগ্নিশিখার মতোই মুগ্ধ পতঙ্গের মরণ—শয্যা পেতেছে। রঞ্জনার কেশে সুরভি, বেশে সুরভি, নিঃশ্বাসে সুরভি।

সিল্কের রুমালে কুঞ্জবাবু আর একবার কপাল আর ঘাড় মুছে নিলেন। তারপর একটু কেশে জিজ্ঞাসা করলেন, মাথা ধরাটা ছাড়ল কি?

সরু আভুলগুলো নিজের কপালে বোলাতে বোলাতে রঞ্জনা শুধু বললে, উঁহু।

বারদুয়েক কেশে কুঞ্জ বিশ্বাস গলাটা সাফ করে নিলেন। তারপর বললেন, কিছু যদি মনে না করেন, কপালটা নাহয় আমিই—

রঞ্জনা ক্ষীণ আপত্তি জানালে: না, না, আপনি কেন কষ্ট করবেন… উঃ!—

একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করে উঠল রঞ্জনা।

ততোধিক কাতর হয়ে সরলপ্রকৃতি কুঞ্জবাবু বললেন, বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, না? এখুনি কমে যাবে।

তারপর—

কখন যে তন্দ্রার ঘোরে রঞ্জনার মাথাটা কুঞ্জবাবুর বুকের কাছে ঢলে পড়েছে, আর কখন যে শুভ্রনিটোল একখানা হাত ঘুমন্ত শ্বেত—গোখরোর মতো তাঁর কোলের ওপর এলিয়ে পড়েছে, কুঞ্জবাবু তা লক্ষ করেননি।

হঠাৎ একঝলক বিদ্যুতের আলো। আর ক্লিক করে একটা শব্দ!

কুঞ্জবাবু চমকে উঠলেন। শ্বেত—গোখরো বুঝি সত্যিই দংশন করেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছিলা—ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে সরে গেল রঞ্জনা।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্বয়ং লালমোহন। হাতে ফ্ল্যাশলাইট লাগানো একটা ক্যামেরা।

বাঃ দৃশ্যটা সত্যিই অপূর্ব কুঞ্জবাবু, তাই ক্যামেরায় তুলে রাখলাম।

কুঞ্জ বিশ্বাস যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গেলেন।

বিদ্রূপের হাসিতে ঠোঁটের প্রান্ত বেঁকিয়ে লালমোহন আবার বললে, আপনার স্বর্গসুখে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত কুঞ্জবাবু! ট্রেনটা নেহাত ফেল করলাম বলেই আমাকে ফিরে আসতে হল, নইলে… কিন্তু ভাবছি, আজকের বিয়ের তারিখটা আমার না আপনার?

হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে ফেলে রঞ্জনা লালমোহনের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠল, মাথার যন্ত্রণায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর সেই সুযোগে এই লোকটা আমায়—এতখানি ইতর—এতখানি নীচ—

রঞ্জনা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

কুঞ্জবাবু একবার কথা বলবার চেষ্টা করলেন, কোনো আওয়াজ বেরোল না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবু জিভটাকে শুকনো ঠোঁটে বুলিয়ে নিয়ে কোনোরকমে বললেন, বিশ্বাস করুন, কোনো কুমতলবে আমি— ওঁর বড্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল—

তীক্ষ্ন বিদ্রূপের হাসিতে ঘর ভরে গেল : তাই পরকীয়া সেবা করছিলেন? বেশ তো, আদালতে এই কথাই বলবেন।

কুঞ্জবাবুর বুকে একটা মুগুরের ঘা পড়ল।

আদালত! আপনি আমার নামে মামলা করবেন?

দাঁতে দাঁত ঘষে লালমোহন বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, তা করব বইকি। আপনি কি আশা করেন যে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনি প্রেম করবেন, আর আমি আপনাকে ফুলের তোড়া কিনে এনে দেব?

কিন্তু ভগবান সাক্ষী—

নির্বোধ অভিমানী শিশুর মতো কুঞ্জবাবুর ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল শুধু।

সেইদিকে একবার তাকিয়ে লালমোহন গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, আপনাকে আমি বন্ধু বলেই জেনেছিলাম কুঞ্জবাবু। সেই হিসেবে অবশ্য আদালতের কেলেঙ্কারি থেকে আপনাকে বাঁচানোই আমার উচিত।

তীক্ষ্ম কণ্ঠে রঞ্জনা বলে উঠল, কিছুতেই না, ওই ইতর পাজি শয়তানটাকে কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

কুঞ্জ বিশ্বাস পকেট থেকে আবার সিল্কের রুমাল বের করলেন। কপালে আর ঘাড়ে বিন বিন করে ঘাম দেখা দিয়েছে। জালে—পড়া শিকারের প্রতি শিকারি যেমন পরম পরিতৃপ্তির চোখে তাকায়, লালমোহন তেমনি করে কুঞ্জ বিশ্বাসের অবস্থাটা একবার লক্ষ করলে। তারপর বললে, যা হবার তা হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারি এখন চেপে যাওয়াই ভাল নয় কি কুঞ্জবাবু? আমি বলি কি, আপনি এক কাজ করুন। আপনার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রমাণ এই ক্যামেরায় তোলা ছবিটা। এই আপনি কিনে ফেলুন। দামও বেশি নয়—দশ হাজার মাত্র।

কুঞ্জবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন : দশ হাজার টাকা!

ঈষৎ হেসে লালামোহন বললে, ইজ্জতের দাম আরো বেশি। নেহাত আপনি বন্ধুলোক বলেই—অবশ্য দশ হাজার টাকা আপনি আমাকে না দিয়ে কেস লড়তে পারেন। যা আপনার অভিরুচি।

কিন্তু টাকা তো কাছে নেই!—নিতান্ত অসহায়ের মতো কুঞ্জবাবু বললেন।

কাছে নাই—বা থাকল, চিঠি লিখে দিন, আপনার গদি থেকে আনিয়ে নিচ্ছি। চিৎপুরে আপনার গদি না? ঠিকানাটা আমার জানা আছে। আমার প্যাড আর পেনটা দাও তো রঞ্জনা… নিন, লিখুন—

কলের পুতুলের মত কুঞ্জবাবু লিখে গেলেন :

আমার চিঠি পাওয়ামাত্র এই পত্রবাহকের হাতে নগদ দশ

হাজার টাকা পাঠাইবে। আমার বিশেষ প্রয়োজন। পত্র

বাহক বিশ্বস্ত, কোনোরূপ সন্দেহের কারণ নাই। ইতি—

কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস

চিঠিখানা লিখে দিয়ে কুঞ্জবাবু করুণভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার যেতে পারি?

অত্যন্ত অমায়িকভাবে হেসে লালমোহন বললে, তাও কি হয়? আপনি অতিথি, না খাইয়ে কি ছাড়তে পারি? আপনি খেতে বসুন, টাকাটা ততক্ষণে গদি থেকে এসে যাক। মাহাঙ্গু!

দরজা ঠেলে কানা মাহাঙ্গু সেলাম করে দাঁড়াল।

লালমোহন বললে, এই চিঠিখানা নিয়ে চিৎপুরে কুঞ্জবাবুর গদিতে যাও। দশ হাজার টাকা নিয়ে এসো। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বোলো, বাবু একখানা দামি ছবি কিনেছেন।

.

ঘণ্টাখানেক পরে কুঞ্জ বিশ্বাসকে ন’নম্বর কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেল। ছবিটা লালমোহন দেয়নি। বলেছে, এনলার্জ করে বাঁধিয়ে তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।

ন’নম্বর ঘরের মধ্যে লালমোহন তখন হাসিমুখে বলছে, সাবাস বাইজি! আজ তোমার অভিনয় দেখে পুরো দশ হাজার টাকাই ইনাম দিতে হচ্ছে করছে!

জোহরা, আর্শির সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিচ্ছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে,অভাব আমার টাকার নয়, লাল।

তবে?

তুমি পুরুষ—তুমি বুঝবে না।

জোহরা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললে : কিন্তু বুঝতে একদিন হবেই তোমাকে।…চলি। রাত দশটায় আমার নাচ আছে।

কালো ভেলটা মুখের ওপর ফেলে দিয়ে জোহরা বেরিয়ে গেল।

হোটেল থেকে বেরিয়ে জোহরা অপেক্ষামাণ একখানা কালো রঙের মোটরে উঠে বললে, চলো মাহাঙ্গু—

জোহরা যদি একবার উপরপানে তাকাত, তাহলে দেখতে পেত, দোতলায় লবির জানলার ফাঁকে আরেকটি কৌতূহলী মুখ উঁকি দিচ্ছে।

সে মুখখানা শিলার।

কালো গাড়িটা স্টার্ট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিলা নীচে নেমে গেল। ওদিকের ফুটপাথে ট্যাক্সি—স্ট্যান্ড। একখানা হলদে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বললে, চালাও জলদি—

কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানা এসে থামল ওয়েলেশলি কফি হাউসের সম্মুখে। জোহরা নেমে ভেতরে ঢুকে গেল।

কিছুদূরে ট্যাক্সির ভেতরে বসে শিলা বললে, এবার পার্ট স্ট্রিট থানা।

.

জেনারেল পোস্টাপিসের ঘড়িতে এগারোটা বাজল।

আমাদের আর একমাত্র ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের অফিসে যেতে হবে। জেনারেল ম্যানেজার মিঃ আয়ারের ঘরে।

মিঃ আয়ার বললেন, টাকাটা আপনি আজই পেয়ে যাবেন অপর্ণা দেবী। মাসখানেক দেরি হল বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এর চেয়ে কম সময়ে পেমেন্ট করা সম্ভব হয় না।

উত্তরে অপর্ণা স্নিগ্ধ সকরুণ চোখ দুটো তুলে নীরবে কৃতজ্ঞতা জানালা বার দুই কেশে কম্ফটার—জড়ানো ভূজঙ্গধর জিজ্ঞাসা করলেন, চেকটা রেডি হয়েছে?

হ্যাঁ, রেডি করেই রেখেছি।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে মিঃ আয়ার রসিদের কাগজপত্র সমেত চেকখানা বের করলেন। তারপর বললেন, অপর্ণা দেবীকে একটা সই দিতে হবে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!—ব্যস্ত হয়ে ভূজঙ্গধর কেশে ফেললেন।

আর সাক্ষী হিসেবে আপনারও একটা সই চাই মিঃ হাজারিকা।

যথারীতি সই হবার পর মিঃ আয়ার চেকখানা অপর্ণার দিকে এগিয়ে বললেন, ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের তরফ থেকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমি আপনাকে পনেরো হাজার টাকা দিচ্ছি।

কালো দিঘি জলের মতো অপর্ণার চোখদুটি টলটলিয়ে উঠল। চেকখানা নিয়ে নিয়ে সে নীরবে ভূজঙ্গধরের হাতে দিল। সেখানা মুড়ে পকেটে রাখতে রাখতে প্রৌঢ় ভূজঙ্গধর আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ বার দুই কেশে সাফ করে নিলেন, তারপর বললেন, কি উপকার যে করলেন মিঃ আয়ার…

সস্মিত মুখে মিঃ আয়ার বললেন, উপকার নয় কর্তব্য।

ভূজঙ্গধর বলতে লাগলেন, কত বড় ঘরের মেয়ে হয়ে অপর্ণা—মাকে পথে দাঁড়াতে হয়েছিল… এই টাকা দিয়ে মেয়েটা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ আপনাদের কোম্পানিকে। আচ্ছা আজ তাহলে আসি মিঃ আয়ার। আজ রাত্রের মেলেই আসাম যাব ভাবছি।… চলো মা—

ধীর ভঙ্গিতে অপর্ণা উঠে দাঁড়াল। তারপর শুভ্র সুডৌল ডান হাতখানি আয়ারের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বললে, কি বলে আপানাকে কৃতজ্ঞতা জানাব—

সেই শঙ্খের মতো শুভ্র, মোমের মতো নরম করতল সসম্ভ্রমে নিজের দুই মুঠির মধ্যে ধরে তরুণ মাদ্রাজি ম্যানেজার মুহূর্তের জন্যে যেন সন্বিৎ হারিয়ে ফেলল।

দরজার দিকে এগিয়ে ভূজঙ্গধর বললেন, নমস্কার মিঃ আয়ার!

অপর্ণার হাতখানা মিঃ আয়ার ছেড়ে দিলেন।

সুইং—ডোয়ের বাইরে ভূজঙ্গধরের কাশি আর দুজনের পায়ের শব্দ ক্রমশ দূরে চলে গেল।

চেয়ারে বসে পড়ে মিঃ আয়ার একটা সিগারেট ধরালেন। শঙ্কের মতো শুভ্র, মোমের মতো নরম সেই করতলের স্পর্শ নিজের কালো মুঠির মধ্যে এখনও তিনি অনুভব করতে পারছেন।

বেয়ারা ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা স্লিপ রাখল। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়েই অন্যমনস্কের মতো মিঃ আয়ার বললেন, সেলাম দো।

বেয়ারা চলে গেল।

একটু পরেই ঘরে ঢুকল দুটি প্রাণী। লংক্লথের পাঞ্জাবির ওপর এন্ডির চাদর গায়ে দাঁড়ি গোঁফ কামানো শীর্ণ একটি ভদ্রলোক, আর গরদের থানা পরা রীতিমতো কালো মধ্যবয়সী একটি মহিলা।

মিঃ আয়ার বললেন, ইয়েস?

কথায় পুরোদস্তুর আসামি টান দিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন নমস্কার। আমি হচ্ছি আসামের জমিদার মৃত জানকীনাথ চৌধুরির এস্টেটের ম্যানেজার ভূজঙ্গধর হাজারিকা, আর ইনি জমিদার সাহেবের একমাত্র কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবী।

নিমেষে মিঃ আয়ার তিরের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন: হোয়াট!

ভদ্রলোক বললেন, আমরা এসেছি, জমিদার সাহেব তাঁর মেয়ের নামে পনেরো হাজার টাকার যে ইন্সিওরটা করে গেছেন, তারই জন্যে।

বিমূঢ় বিস্ময়ে মিঃ আয়ার বললেন, দুনিয়ায় আর ক’টা ভূজঙ্গধর এবং অপর্ণা দেবী আছেন, বলতে পারেন?

অবাক হয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কেন বলুন তো?

এইমাত্র একজন ভূজঙ্গধর এবং একজন অপর্ণা দেবী মৃত জানকীনাথের ইন্সিওর করা পনেরো হাজার টাকা নিয়ে চলে গেলেন।

বলেন কি!

দ্বিতীয় ভূজঙ্গধর ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন এবং দ্বিতীয় অপর্ণা দেবী তারস্বরে ক্রন্দন জুড়ে দিলেন: ওগো, আমার কি হবে গো…

.

কুইন মেরি হোটেলের ছ’নম্বর কামরা থেকে বেরিয়ে শিলা ব্যস্ত হয়ে ডাক দিল, বয়! বয়!

বয় ছুটে এল।

জলদি বরফ লাও, মেমসাহেব বেহোঁশ হো গ্যয়ী!

বয় বরফ আনতে ছুটল, আর রাগে বিরক্তিতে মুখ অন্ধকার করে শিলা দাঁড়িয়ে রইল করিডরে। নাঃ আর পারা যায় না! ওই ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়া বাতিকগ্রস্ত মুটকি মহিলাকে নিয়ে সত্যিই আর পারা যায় না! শিলা এবার নিশ্চয় চাকরি ছেড়ে দেবে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

কিন্তু উপস্থিত তো একটা উপায় করতে হবে লেডি মুখার্জির মূর্চ্ছা ভাঙানোর জন্যে! কি জানি, যদি মরেই যায়? শেষ অবধি খুনের দায় চাপবে নাকি ঘাড়ে?

স্মেলিং সল্টের শিশিটা যে কোথায় গেল… একবার দেখবে নাকি ন’নম্বর কামরায় স্মেলিং সল্ট আছে কিনা?

শুনছেন, ও মিস্টার—আপনার ঘরে স্মেলিং সল্ট—

হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ঢুকতেই শিলার মুখের কথা হারিয়ে গেল। ঘরে লালজি নেই। তার বদলে বসে বসে পানের সাথে জর্দা মুখে দিচ্ছেন সৌম্যদর্শন মধ্যবয়সী একজন প্রৌঢ়, মাথায় কাঁচা—পাকা চুল, চোখে চশমা, গলায় এই গরমের দিনেও কস্ফর্টার জড়ানো। হয়ত ঠাণ্ডা লাগার বাতিক আছে।

অপ্রস্তুত হয়ে শিলা বললে, মিঃ লালজি—

কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোক কেশে ফেললেন! কাশতে কাশতে জবাব দিলেন, লালজি তো নেই বেরিয়ে গেছে। আমি তার জ্যাঠামশাই।

ওঃ!—শীলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ছুটল লবির দিকে ডাঃ ঘোষকে টেলিফোন করতে। কিন্তু রিসিভার তুলে যখন সে কথা কইছে, তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ল সিঁড়ির দিকে। পাজামা আর পাঞ্জাবি পরা লম্বাটে চেহারার একটি লোক সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে… লালজি না?

তবে যে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বললেন, লালজি বেরিয়ে গেছে?

ডাক্তারের সঙ্গে কথা অসমাপ্ত রেখেই শীলা ফের ছুটে গেল ন’নম্বর কামরার দিকে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই, আশ্চর্য জ্যাঠামশাইয়ের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শুধু রুপো—বাঁধানো লাঠিটা পড়ে আছে।

.

রাত দশটায় জিপসি—নাচ শুরু হল ওয়েলেশলি কফি—হাউসে।

জোহরা বাইয়ের এই নতুন জিপসি—নাচ আজকাল কফি—হাউসে লোক টানছে খুব বেশি। রাত দশটা থেকে টেবিল খালি পাওয়া কঠিন। কফির কাটতি খুব বেশি নয়। আঠারোটা বয়ের হাত ব্যথা হয়ে যায় ক্রমাগত সোডার বোতল খুলে খুলে।

নাচের আগে জোহরা এসে স্টেজে দাঁড়ালেই বিপুল হর্ষধ্বনিতে হল যেন ফেটে পড়ে। বিশেষ করে স্টেজের একেবারে সামনের টেবিলগুলো থেকে উচ্ছ্বাস একটু বেশি পরিমাণেই প্রকাশ পায়। সেখানে যারা বসে, তারা নাচের সময় কখন ক’বার করতালি দেবে, কী ভঙ্গিতে তারিফ করবে, জোহরার মুখস্থ হয়ে গেছে। এমনকি প্রতিদিন দেখে দেখে তাদের মুখগুলি পর্যন্ত জোহরার বিশেষ চেনা। কিন্তু আজ তাদেরই মধ্যে একটি নতুন মুখ দেখা গেল। লোকটির বয়স হয়েছে, কিন্তু চেহারা দেখে চট করে ধরবার উপায় নেই। শুধু দু’পাশে রগের কাছে সাদা ছোপ তার বয়সটাকে ধরিয়ে দেয় নইলে তাকে অনায়াসেই যুবক বলা যেত। এককালে লোকটি সুপুরুষ ছিল সেটা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু অপরিমিত অত্যাচারের ইতিহাস তার সেই সৌন্দর্যের স্মৃতিকে কলঙ্কিত করে ফেলেছে। মাথার সামনের দিকে কটা রঙের চুলগুলি পাতলা হয়ে গেছে, চোখের কোলে রাত্রি—জাগরণের কালি প্রসাধনের প্রলেপেও বিশেষ ঢাকা পড়েনি।

লোকটির পরনে কড়া ইস্ত্রিকরা ডিনার স্যুট। কালো কোটের বাটনহোলে টকটকে লাল একটা ফুল আটকানো। মুখে সরু গোঁফ আর ফরাসি ধরনের ছাঁটা দাড়ি। সব মিলিয়ে একটা বিদেশি ছাপ।

জোহরা লক্ষ করেছে, নতুন লোকটির মদ খেতে যত উৎসাহ, খাওয়াতে উৎসাহ তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং তার টেবিলেই মধুমক্ষিকাদের ভিড়।

অনেকগুলি গেলাস জল—তরঙ্গের বাটির মতো সাজিয়ে, দু’হাতে দুটো চামচ নিয়ে সে নাচের সঙ্গে সঙ্গে তাল দিচ্ছিল। জোহরা যতবার তাকে লক্ষ করেছে, একবারও তাকে বেতালা হতে দেখেনি। লোকটা শুধু শৌখিন স্ফূর্তিবাজ নয়, মিউজিকও জানে ভাল।

নাচ শেষ হতেই নতুন বিদেশি লোকটি সবার আগে দাঁড়িয়ে উঠে করতালি দিতে শুরু করলে। লীলায়িত ভঙ্গিতে হাত দুটি দু’পাশে প্রসারিত করে জোহরা দর্শকদের প্রতি একবার মাথা নোয়ালে, তারপর স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল।

.

গ্রিনরুমে জোহরার মেক—আপ তোলা সবে শেষ হয়েছে।

দরজার টকটক আওয়াজ!

কে?

ঘরে ঢুকল ইয়াসিন। হাতে একটুকরো কাগজ, তাতে লেখা: আন্দ্রে পল।

ইয়াসিন বললে, সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে।

ভুরু দুটো কুঁচকে জোহরা নামটার দিকে একবার তাকাল।

আসতে বল।

দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল আন্দ্রে পল। হাতে মস্ত একটা ফুলের স্তবক। জোহরা সবিস্ময়ে দেখল, এ সেই লোক—স্টেজের সামনে টেবিলের সেই নতুন বিদেশি আগন্তুক।

অভিবাদনের ভঙ্গিতে আন্দ্রে মাথাটা ঈষৎ নুইয়ে ফুলের তোড়াটি এগিয়ে ধরল। তারপর ভাঙা হিন্দিতে বললে, তোমার নাচ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

ফুলের তোড়াটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে জোহরা শুধু বললে, ধন্যবাদ!

ঈষৎ হেসে আন্দ্রে বললে, ধন্যবাদটা তোমারই পাওয়া উচিত মাদাম— আমার এই সামান্য উপহার তুমি গ্রহণ করেছ। বলে।

জোহরা বসতে বলার আগেই আন্দ্রে একটা চেয়ার দখল করে বসল। বললে, নাচ আমি বড় ভালবাসি। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ না করে থাকতে পারলাম না, মাদাম। প্যারিসে জন্মালে তোমার আরো কদর হত।

আপনি তো দেখছি বিদেশি। দেশ কোথায়?

আমার বাবা ছিলেন ফরাসি, সেই হিসেবে আমার দেশ প্যারিস। কিন্তু আমার মা ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাই আমি মানুষ হয়েছি এই দেশেই। আমার একটা মিউজিক স্কুল আছে। সেখানে আমি পিয়ানো বাজাই। শিখবে তুমি?

কোনোদিন ইচ্ছা হলে বলব আপনাকে।

এখানে রোজই তোমার নাচ থাকে?

না, কেবল শনি আর রবিবার।

আন্দ্রে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিলিতি নাচ জান?

কিছু কিছু।

আমিও কিছু জানি। দিনকতক নাচের একটা ট্যুরিং পার্টিও করেছিলাম। ভাল চলল না বলেই তুলে দিয়েছি। তোমার সঙ্গে একদিন নাচবার ইচ্ছে আছে।

আমার সময় বড় কম।

সে কি! জীবনে আনন্দ করার সময় তোমার নেই!… তোমাকে যদি একদিন গ্র্যান্ড হোটেলে নাচের জন্যে আমন্ত্রণ করি, এই বিদেশি বন্ধুর অনুরোধ তুমি রাখবে কি মাদাম?

একটু ইতস্তত করে জোহরা বললে, এখন ঠিক বলতে পারছি না।

কেন তুমি কি বিবাহিতা?

না।

নাচ ছাড়া তুমি কি অন্য কাজ করো?

না—ঠিক তা নয়—তবে—

আন্দ্রে হঠাৎ আবেগভরে বলে উঠল, তুমি আর্টিস্ট, জীবনটাকে ভোগ করে নাও মাদাম। যৌবন হচ্ছে একরাত্রির উৎসব! এই আছে এই নেই। সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নাও। আমার ধর্ম হচ্ছে Eat drink and be merry। কে জানে, কবে বসন্ত ফুরিয়ে যাবে, তার আগে জীবনের মধু নিংড়ে নাও—শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত। আফশোসের কিছুই থাকবে না। তোমাদের কবি ওমর খৈয়ামই তো বলে গেছেন :

নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও,

বাকির খাতায় শূন্য থাক!

আ!…একটা কবির মতো কবি! মাদাম, তুমি বিরক্ত বোধ করছ বোধ হয়? নাচের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছ নিশ্চয়?… আচ্ছা, আজ গুড নাইট। তোমার নাচের দিন আসব।

আর একবার মাথা নুইয়ে আন্দ্রে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।

জোহরার কানে বাজতে লাগল: জীবনটাকে ভোগ করে নাও মাদাম! যৌবন হচ্ছে একরাত্রির উৎসব!… সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নাও! কে জানে কবে বসন্ত ফুরিয়ে যাবে…

জোহরা জানে, বসন্ত ফুরিয়ে গেলে শুকনো ফুল হাওয়ায় উড়ে যায়! আন্দ্রে ঠিকই বলেছে, সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নিতে হবে। মরণান্ত কাল পর্যন্ত জোহরা আশা ছাড়বে না—একথা তুমি জেনে রেখো লালজি।

.

সেই রাত্রে কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানাকে বড় বাজারের কটন স্ট্রিটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ভেতরে আরোহী নেই। আমরা জানি, কোথায় তাকে এখন পাওয়া যাবে।

বাঁ—দিকে ইট—বাঁধানো সরু গলির মধ্যে সেই যে পার্শি ডাক্তার ফিরদৌস ইরানি, তারাই বাড়ির সামনে লালজিকে খুঁজে পাওয়া গেল। দরজায় আঘাত করতে গিয়ে লালজি আশ্চর্য হয়ে গেল। কপাট দুটো খোলা। এ বাড়িতে আনাগোনা তার বহু দিনের, কিন্তু একটা দিনও সে দরজা খোলা থাকতে দেখেনি। পুলিশের ভয়ে ইরানি সাহেব অষ্টপ্রহর দরজা বন্ধ করে রাখত। আজ তার ব্যতিক্রম কেন? হল কি?

চাপা গলায় লালজি ডাক দিল, ডক্টর সাহেব।

একটু পরে তিনতলার জানলা থেকে চেনা—গলার জবাব এল, ওপরে এসো।

যাই ইরানি সাহেব তাহলে আছে! ধরা পড়েনি।

দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে লালজি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য হতে আরও একটু বাকি ছিল তার। ইরানি সাহেবের ঘরে আলমারি ভর্তি সেই সব ডাক্তারি বই, ওষুধের শিশিপত্তর, এমনকি টেবিল—চেয়ারগুলো পর্যন্ত নেই। রয়েছে শুধু সেই লোহার সিন্দুকটা, আর তার ওপর দেওয়ালে—ঝোলানো সেই আস্ত নরকঙ্কাল। মেঝের ওপর কম্বল বিছিয়ে ইরানি সাহেব বসে বসে মালা ঘোরাচ্ছিল।

লালজি ঘরে ঢুকতে বললে, এসো। কি মনে করে?

কম্বলের একপাশে বসে পড়ে লালজি বললে, যা মনে করে বারবার এসেছি, আজও তাই। একখানা চেক ক্যাশ করে দিতে হবে। ভালো জায়গার চেক—ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানির।

পকেট থেকে লালজি চেকখানা বের করলে।

সামনের দুটো ভাঙা দাঁত বের করে ইরানি সাহেব হাসলে একটুখানি। বললে, টাকা নেই।

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি একবার তাকালে ইরানি সাহেবের দিকে। বললে, টাকা নেই! তোমার? ওসব বাজে কথা রাখো সাহেব। পনেরো হাজারের চেক ক্যাশ করতে কত কমিশন নেবে, সোজা করে বলো দেখি?

মালা ঘোরানো বন্ধ রেখে ইরানি সাহেব উঠল। লোহার সিন্দুকের ডালাটা টেনে খুলে দিলে। ভেতরটা একেবারে ফাঁকা—শূন্যগর্ভ! তারপর বললে, কারবার তুলে দিয়েছি।

লালজির মুখের ভাব বদলে গেল।

পুলিশের নজর পড়েছে নাকি?

ইরানি সাহেব ঘাড় নাড়লে : না। এমনিই তুলে দিলাম। আর ভাল লাগল না।

শাবাশ!—সকৌতুক বিদ্রূপে লালজির চোখ দুটো নেচে উঠল: কথাটা সাধু পূর্বপুরুষদের বংশধরের মতোই বললে বটে, কিন্তু আসলে তুমি যে আমারই মাসতুতো ভাই!… সত্যি কথাটা খুলে বলো দেখি সাহেব। সিন্দুকের মধ্যে তোমার সেই যকের ধন গেল কোথায়? অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছ বুঝি?

অন্ধ হাসপাতালে দিয়ে দিয়েছি। ডাক্তারি বইগুলি পর্যন্ত।

লালজির মুখ গম্ভীর হয়ে এল। লোকটা বলে কি? শাইলক ইহুদির মতো লোভী, অর্থপিশাচ চোরা—কারবারি ফিরদৌস ইরানি তার যথাসর্বস্ব অন্ধদের হাসপাতালে দান করেছে! এও কি সম্ভব?

সত্যি বলছ ইরানি সাহেব?

মিথ্যে বলে লাভ কি লালজি? তুমি হাসপাতালে খবর নিও।

মুহূর্তখানেক লালজি স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বললে, কিন্তু কেন ইরানি সাহেব? হঠাৎ তোমার হল কি?

ইরানি সাহেব নীরবে আবার এসে কম্বলের ওপর বসল। ঘুরতে লাগল। হাতের মালা। চর্বি—বাতির আলো পড়েছে তার মুখে। লালজি ভালো করে তাকিয়ে দেখল। শান্ত সমাহিত মুখভাব। চোখের দৃষ্টি উদাস কোমল। এইরানি সাহেবকে লালজি আগে কখনো দেখেনি।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে ইরানি সাহেব বললে, তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো। একদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে, এত টাকা আমি যকের মতো কার জন্যে আগলে বেড়াই? সেই কথা আজ বলি শোনো লাল।—পঁয়ত্রিশ বছর আগে, আমি তখন পঁচিশ বছরের যুবক। সবে ডাক্তারি পাশ করেছি। প্রাণে তখন নতুন আশা, চোখে নতুন স্বপ্ন! প্র্যাকটিস সুরু করলাম। সেই সময় একটি রুগি দেখতে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়, নাম তার রুমা। ফুলের মতো নরম, শিশিরের মতো পবিত্র মেয়ে। বড় ভালো লাগত তাকে। মুগ্ধ হলাম বিশেষ করে তার চোখ দুটো দেখে। ভোরবেলা সূর্য—ওঠার ঠিক আগেকার আকাশ দেখেছ? ঠিক তেমনি নীলাভ সুন্দর ছিল রুমার চোখ দুটি। একদিনের আলাপ ক্রমশ প্রতিদিনের আকর্ষণে দাঁড়াল। বিয়ে করলাম তাকে। ঘরও বাঁধলাম। কিন্তু আশা আমার মিটল না; আগেই বলেছি, প্রাণে তখন আমার অনেক আশা, অনেক সাধ। সে সাধ মেটাতে হলে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমার মতো ছোকরা ডাক্তারের তেমন পসার কই? রোজগার কি করে হবে? এই সময় পড়ে গেলাম বদসঙ্গে। রোজগারের রাস্তা খুলে গেল। কেমন করে জান? শহরে অনেক পাপ, অনেক জঞ্জাল, আর ভ্রূণহত্যা—লেগে গেলাম সেই গোপন পাপের ব্যবসাতে। দিনের পর দিন ডাক আসত কলঙ্কিনী কুমারী আর ভ্রষ্টা বিধবাদের কাছ থেকে। মোটা মোটা টাকার অঙ্কের বিনিময়ে কত নিষ্পাপ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিইনি—কত অনাগত জীবনকে গোপনে গোপনে শেষ করে দিয়েছি। সাত বছরের মধ্যেই আলাদিনের মতো আমার ভাগ্য ফিরে গেল। কিন্তু সুখী করতে পারলাম না রুমাকে। সাত বছরের দুটি সন্তান হয়েছিল তারাও রইল না। যে সমস্ত সুকুমার জীবন নষ্ট করেছি, তারা যেন আমার শিশুদের ওপর শোধ নিলে।

একটু থেমে ইরানি সাহেব আবাক শুরু করলে, আমার গোপন ব্যবসার কথা রুমা প্রথমে জানতে পারেনি। কিন্তু জানতে পারল যেদিন, সেদিন আর তাকে ধরে রাখা গেল না। আমার প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় একদিন রাতে আমাকে ছেড়ে চলে গেল নিঃশব্দে। টাকার মোহ, বিলাসিতার আকর্ষণ, আমার প্রতি ভালবাসা—কিছুই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। মনে একটা ধাক্কা লাগল। ভাবলাম, তাকে ফিরিয়ে এনে জীবনটাকে বদলে ফেলি। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমান এসে বাধা দিল। সাত বছরের ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে সে যদি এমনি করে চলে যেতে পারে, তবে যাক সে। রুমাকে আমি আর ডাকব না। তারপর দিন গেল, বছর গেল, যৌবন গিয়ে বার্ধক্য এল। কিন্তু পাপের পিছল পথ থেকে আমি আর ফিরতে পারলাম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার গোপন ব্যবসা ছেড়ে চোরাই কারবার ধরলাম। তাতে আরও টাকা—টাকার নেশা যেন আমাকে পেয়ে বসেছিল। রুমাকে আর ফিরে ডাকিনি। পঁয়ত্রিশটি বছর ধরে ক্রমে ক্রমে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবু একেবারে ভুলতে পারিনি, মাঝে মাঝে মনে পড়ত। মনের মধ্যে কোথায় যেন আশা জেগেছিল— একদিন সে ফিরে আসবে। ভেবেছিলাম যৌবন গেছে বটে, টাকা তো আছে—অনেক টাকা, প্রচুর টাকা দিয়ে আবার সুখের ঘর গড়ব। পঁয়ত্রিশটা বছর এমনি করেই গেল কেটে।

লালজি প্রশ্ন করলে, তারপর?

দিনসাতেক আগে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম কিছু ফল কিনতে। দোকানে দাঁড়িয়ে ফল কিনছি, এমন সময় পেছন থেকে কে একজন কাতর গলায় বলে উঠল, কিছু ভিক্ষে দাও, ভগবান তোমার ভাল করবেন। পকেট থেকে একটা আনি বার করে ফিরে তাকে দিতে যাব, হাতখানা আমার অবশ হয়ে গেল। পঁয়ত্রিশ বছর পরেও চিনতে আমার ভুল হয়নি। ভিক্ষা যে চাইছে, সে আর কেউ নয়, রুমা! ফুলের মতো নরম, শিশিরের মতো পবিত্র সেই রুমা অনাহারে শুকনো পাতার মতোই কালো কুৎসিত শ্রীহীন হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়েই সে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার মুখের ভাব বুঝতে পারলাম, আমাকে সে চিনতে পারেনি। অথবা চিনতে পেরেও চেনা দিচ্ছে না। আনিটা নিয়ে বললাম, নাও। কিন্তু হাত সে বাড়াল অন্য দিকে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তার সেই চোখ দুটি—ভোরবেলার সূর্য ওঠার ঠিক আগেকার আকাশের মতো নীলাভ—সুন্দর দুটি চোখের তারা সাদা!

লালজির গলা দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বেরোল : রুমা অন্ধ?

চোখ বুজে ইরানি সাহেব বসে রইল, কোনো জবাব দিল। ঘুরতে লাগল হাতের মালা। তারপর একসময় মৃদু গভীর স্বরে ধীরে ধীরে আবার বলতে লাগল : এ আমারই পাপ, লাল। আমরাই পাপে রুমা অন্ধ হয়ে গেল। Crime does not pay, my boy! পাপের দেনা শোধ করতেই হয়!… রুমাকে পরিচয় দিইনি। তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই দিনই অন্ধ হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম, আর পরের দিনই আমার সঞ্চিত সমস্ত টাকাকড়ি হাসপাতালে দিয়ে এলাম—যদি ভালো করে চিকিৎসার ফলে রুমার চোখের দৃষ্টি কোনোদিন ফিরে আসে।

চুপ করে বসে লালজি শুনছিল! বললে, নিজের জন্যে কিছুই রাখলে না ইরানি সাহেব? তোমার দিন চলবে কি করে?

প্রশান্ত মুখে ইরানি সাহেব জবাব দিলে, চালাবার যিনি মালিক, তিনিই জানেন। তারপর দেয়ালে—ঝোলানো নরকঙ্কালটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই তো পরিণাম! তবে আর ভাবনা কিসের?

লালজি নিঃশব্দে বিদায় নিলে।

.