বহুরূপী – ৪

ট্যাংরা থেকে দৃশ্যপট বদলে গেল এন্টালির ডিহি শ্রীরামপুর রোডের একটা ছোট ঘরের মধ্যে।

চলুন ওই ঘরে।

নিতান্ত নিরাভরণ দরিদ্র ঘর। একখানা চার—পায়ার ওপরে বুক অবধি খদ্দরের চাদরে ঢেকে বছর বাইশ—তেইশের একটি যুবক শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছিল। শীর্ণ গালভাঙা মুখে চোয়ালের হাড় দুটো ঠেলে উঠেছে। রঙটা হয়তো এককালে টকটকে সোনার মতো ছিল, এখন কাগজের মতো সাদা। ফুল শুকিয়ে যাবার পরেও পাপড়িগুলি বোঁটায় লেগে থাকলে যেমন দেখতে হয়, রুক্ষ্ন ছেলেটির চেহারা ঠিক তাই। শুধু কোটরে—বসা চোখের তারায় অনির্বাণ প্রাণশক্তি এখনও জলজল করছে।

রুগ্ন ছেলেটির পাশে একটা মোড়ায় বসে আছে সাদা খদ্দরের থানপরা একটি যুবতী। শীর্ণ একহারা দেহ। কাঁচা হলুদের মতো রঙ। হোমের আগুন যেন নিভে এসেছে, মুখে তেমনি সকরুণ তপঃশুদ্ধ ভাব।

ছেলেটির বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়েটি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বড্ড কষ্ট হচ্ছে শামু?

শামু তখনও হাঁপাচ্ছিল। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললে, কই, না তো। আমার কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না। আজ তো কাশির সঙ্গে আর রক্ত পড়েনি। তুই এত ভাবনা করছিস কেন দিদি?

একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর শামু।

শামু বললে, ঘুম আসছে না। তার চেয়ে দু’জন গল্প করি আয়। আচ্ছা, বিয়াল্লিশের সেই আগস্ট—আন্দোলনের কথা তোর মনে আছে দিদি? মেদিনীপুর যাবার আগে তুই আমার কপালে সেই রক্ত—চন্দনের ফোঁটা—

এখন আর কখা বলিসনে শামু। আবার কাশি আসবে।

শামু বলে যেতে লাগল, যাবার আগে তুই বলেছিলি, ‘তুই যদি আর ফিরে না আসিস শামু, তবু আমি দুঃখ করব না। ভাবব, ভাইয়া আমার তীর্থে গেছে।’ তোর সে কথা আমি আজও ভুলিনি দিদি।… তারপর সেই ছাত্র—আন্দোলনের সময় নিজের শাড়ি ছিঁড়ে আমার মাথায় পটি বেঁধে দিয়ে সারাটা রাত খোলা রাস্তার ওপর আমাদের সঙ্গে জেগে বসেছিলি। তোর মনে আছে দিদি?

একটু চুপ কর শামু। ঘুমোবার চেষ্টা কর।

শান্ত শিশুর মত শামু বললে, আচ্ছা!

একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে একটু দুধ ঢাকা ছিল। শামুর দিদি কাগজে জ্বেলে সেটুকু গরম করে এনে বললে, এটুকু আগে খেয়ে নাও।

শামু বললে, এখন তো আমার ওষুধ খাবার সময়। ওষুধটা আগে দাও।

পলকে দিদির মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। পয়সার অভাবে আজ ওষুধ কেনা হয়নি। তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে টেবিলের কাছে গিয়ে বলে উঠল, ইস। শিশিটা কাত হয়ে সব ওষুধটুকু পড়ে গেছে দেখছি! আমারই রাখার দোষ।

অল্প একটু হেসে শামু বললে, ভালই হয়েছে। তুই আর মিথ্যে ওষুধ কিনিস নে দিদি। আমি অমনিই সেরে উঠব।

দিদি বললে, দুধটুকু জুড়িয়ে যাচ্ছে শামু।

আমি তো দুধ খাব, কিন্তু তুই—তুই খাবি কি?

আমার আজ খেতে নেই, ব্রত আছে।

দিদির মুখের দিকে শামু কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, রোজই তোর ব্রত? তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝিনে? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তুই কি নিজে মরবি দিদি?

নীরবে দিদি দুধটুকু ফিডিং কাপে ঢালতে লাগল।

জানালার ধারে রাখা ল্যাম্পের শিখাটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল। তেল বোধ হয় ফুরিয়ে এসেছে।

সেইদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শামু কতকটা আপন মনেই বললে, একদিন শুধু বাঁচবার জন্যেই আমরা দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য, দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন আমরা মরতে বসেছি!… ওকি! আবার কাঁদছিস দিদি?

ধরা গলায় দিদি বললে, আর কাঁদব না শামু! দুধটুকু খেয়ে ফেলো।

দুধ খেয়ে শামু আস্তে আস্তে চোখ বুজল। আর তার রুক্ষ চুলে আঙুল চালাতে চালাতে দিদি কস্তুরি প্রাণপণে কান্না রোধ করতে লাগল। বড় সত্যি কথা বলেছে শামু! সারা জীবন বাঁচবার সাধনা করে মিলেছে শুধু মৃত্যুর অভিশাপ! পনেরো বছর আগে কস্তুরির বাবা প্রাণ দিয়ে গেছেন কংগ্রেসের সেবার। শামু তখন শিশু। স্বামী মারা গেছেন ‘কাকোরি ষড়যন্ত্র—মামলার’ আসামি হয়ে জেলের মধ্যে। আর আজ দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, তখন মরতে বসেছে তার ছোট ভাই—শামু। কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্স্মি শ্যামলাল ক্ষেত্রী।

টস টস করে জল গড়িয়ে এল কস্তুরীর গাল বেয়ে। পারে না— আর সে পারে না। সারাটা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে, অভাবের সঙ্গে যুঝে কস্তুরীর সে মনের জোর আর নেই।

ল্যাম্পের শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখন নিভে যায়, কে জানে।

শামু হঠাৎ চোখ মেলে বলে উঠল, একদিন কিন্তু পৃথিবীতে এ—দুঃখ থাকবে না—থাকবে না এত অভাব, এত কষ্ট, একমুঠো খাবার, এক ফোঁটা নিঃশ্বাসে জন্যে এত আকুলি—বিকুলি! দেশ, স্বাধীনতা, সব কিছুর চাইতে বেঁচে থাকার দাম যে বড়, একথা মানুষ বুঝতে পারবে।—জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে শামু বলে যেতে লাগল, সেদিন আকাশ আরও নীল হবে, মাটিতে ফলবে আরও সোনার ফসল… সেদিন হয়তো আমি থাকব না, তবু বলে যাচ্ছি…

খক খক করে আবার কাশি শুরু হল। ভাইটির বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে দিতে সজল ব্যাকুল কণ্ঠে কস্তুরী বললে, সেদিনও তুই থাকবি শামু, সেদিনও তুই থাকবি। তোকে আমি সারিয়ে তুলব—স্যানাটোরিয়ামে পাঠাব—

একঝলক রক্ত তুলে শামু তখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ক্ষীণ স্বরে বললে, তুই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস দিদি? টাকা পাবি কোথায়? কে দেবে?

ধীর স্বরে কস্তুরী বললে, গরিবের বন্ধু!

একটু তিক্ত হাসি শামুর পাণ্ডুর ঠোঁটে দেখা দিল। বললে, গরিবের বন্ধু দুনিয়ার কেউ আছে নাকি? একথা তুই আজও বিশ্বাস করিস?

বিশ্বাস করি বইকি ভাইয়া। ডক্টর সাহেবের চেম্বারে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। শুনলাম মস্ত বড়লোক। ডক্টর সাহেবের সঙ্গে তাঁর দোস্তি আছে। প্রায়ই আসেন রোগীদের খোঁজখবর দিতে। আমার মুখে তোর অবস্থার কথা শুনে বললেন, কোনো চিন্তা নেই, টাকার জন্যে আপনার ভাইয়ার চিকিৎসা আটকাবে না। টাকা আপনি পৌঁছে যাবে। সেই থেকে আমি রোজ দিন গুনছি শামু।

তোর দিন গোনা ফুরোবার আগে আমিই ফুরিয়ে যাব দিদি।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কস্তুরী কান্না সামলে নিল। বললে, ছিঃ! অমন কথা মুখে আনিসনি ভাইয়া। একটু ঘুমো, রাত অনেক হল।

পাশের ভাড়াটেদের ঘাড়িতে তখন বারোটা বাজার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কস্তুরির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কই, আজও তো সে এল না! তবে কি তার দিন গোনা সত্যিই ফুরোবে না? তার আগেই ফুরিয়ে যাবে এই নির্মল, নিষ্পাপ, তরুণ শামুর শেষ নিঃশ্বাস?

নিবস্ত ল্যাম্পের শিখাটা কেঁপে উঠল।

টপ করে একখানা লম্বা—চওড়া খাম এসে পড়ল শামুর বিছানার ওপর….

চমকে উঠে কস্তুরী তাকিয়ে দেখল, কালো একখানা হাত জানলার বাইরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খামটা খুলতেই দেখা গেল একরাশ নোট আর একখানা চিঠি। কস্তুরীর হাত তখন ঠক ঠক করে কাঁপছে। চিঠিখানা কুড়িয়ে নিয়ে সে পড়ল :

আপনার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য দুই হাজার টাকা

পাঠাইলাম। কোন পাহাড়ি জায়গায় ভাল স্যানা

টোরিয়ামে তাহাকে পাঠাইয়া দিন। প্রয়োজন মতো

আরও টাকা ঠিক সময়ে পৌঁছিবে। আশা করি,

আপনার ভাইটি সত্বর নিরাময় হইয়া উঠুক।

 মোহিতমোহন

শামু অভিভূতের মতো প্রশ্ন করলে, এত টাকা কোত্থেকে এল দিদি? কে দিল?

হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে কস্তুরী শুধু বললে, গরিবের বন্ধু!

.

কুইন মেরি হোটেলের ছ’নম্বর কামরায় আজ সপ্তাহখানেক হল বছর পঁচিশ—ছাব্বিশের একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। নাম শীলা রক্ষিত। ফুল হাতা ব্লাউজ গায়ে, চুলগুলি কপালের ওপর আঁট করে তুলে বাঁধা, চোখে পাতলা ফ্রেমের। নিতান্ত সাধাসিধে চেহারা! তবু ভিড়ের মধ্যে মিশিয়ে যাবার মতো নয়।

শিলা প্রৌঢ়া লেডি মুখার্জির নতুন গভর্নেস। মেয়েটি এসেছিল তাঁর যৌবনকালের বন্ধু ব্যারিস্টার এস.এন. গুহর চিঠি নিয়ে। সুতরাং তাকে ফিরিয়ে দেওয়া গেল না। কাজে—কর্মে মেয়েটি মন্দ নয়। শুধু একটু একগুঁয়ে। তা হোক, শিলাকে লেডি মুখার্জির মোটামুটি পছন্দই হয়েছে।

বিধবা হবার পর থেকে লেজি মুখার্জি ময়ূরভঞ্জে তাঁর জমিদারিতেই বাস করছিলেন। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করাতে। রোগটা তাঁর কি—ডাক্তারেরা আজও ধরতে পারেননি। তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। কিন্তু আমরা জানি। নিঃসন্তান ধনী মহিলাদের সময় কাটাবার মতো যখন কিছুই থাকে না—বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পার্টি—পিকনিকে হুল্লোড় করে বেড়াবার মতো বয়স আর যৌবনের গরিমা যখন পার হয়ে যায়, তখন তাঁদের এই রোগাটই দেখা দেয়। মাঝে মাঝে চোখ কপালে তুলে মুর্ছার ভাব হয়—আর কিছুই নয়।

সুতরাং সদাসর্বদা দেখাশুনো করার জন্যে একজন ভদ্র পরিচারিকা দরকার। শিলা তাই চাকরি পেলে গেল।

দু’খানা কামরা বাদ দিয়েই লালজির ন’নম্বর কামরা। আসতে—যেতে প্রায়ই শিলার সঙ্গে দেখা হয়। দ্বিতীয় দিন দেখা হতে বলেছিল, আমার ঘরের নাম্বার—প্লেটটা সোজা করে লাগিয়ে দিয়েছি। আশা করি, আর ভুল হবে না।

অল্প ভুরু কুঁচকে শিলা বলেছিল, অর্থাৎ আপনার ঘরে যেতে মানা করছেন?

স্মিত মুখে লালজি জবাব দিয়েছিল, সে—কথা নয়। বলছি যে, যেতে যদি হয়, ঘরটা এবার চিনেই যেতে পারবেন।

ঘর চেনার আগে ঘরের মানুষকে চেনা দরকার, তাই নয় কি?—চলে যাওয়ার আগে মুখ ফিরিয়ে শিলা বলে গিয়েছিল।

চমৎকার কথা বলতে পারে মেয়েটি! লালজি ভাবলে, না, দশের মধ্যে মিশিয়ে যাবার মতো মেয়ে এ নয়!

এরপর দিন সাতেক দু’জনে আর কোনো কথা হয়নি। দেখা হলে লালজি শুধু ঘাড় নাড়ে আর শিলা ঠোট দুটি অল্প খুলে হাসির ভঙ্গি করে।

আট দিনের দিন—

রাত তখন ভারি। দুটো কি আড়াইটে হবে।

লালজি তখন শুয়েছে। ঘন হয়ে এসেছে তন্দ্রা। দরজায় ঘন ঘন আওয়াজে, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েলি গলার ডাক শুনছেন, শুনুন—ও মিস্টার—

ধড়মড় করে লালজি উঠে বসল। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দরজা খুলতেই দেখল, শিলা। তখনও হাঁপাচ্ছে, চোখে—মুখে ব্যাকুল ভয়।

লালজি অবাক হয়ে গেল: আপনি!… ব্যাপার কি?

শিলা বললে, লেডি মুখার্জি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। হাত—পা সব ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরে আসেনি।… কি যে করব, ভেবে পাচ্ছি না।…

ডাক্তারকে খবর দিয়েছেন?

ফোন করেছি। বললেন, আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে! এতক্ষণ একা আমি সামলাই কি করে?… আসবেন একবার দয়া করে?

লালজি বললে, দয়া না করেই যাচ্ছি, চলুন।

দু’জনে যখন ছ’নম্বর কামরায় প্রবেশ করলে, তখন বিছানার ওপর লেডি মুখার্জির মূর্ছিত দেহ পড়ে আছে। ছোটোখাটো একটা মৈনাক পাহাড়! থেকে থেকে অস্পষ্ট ‘উ—আ’ আওয়াজ ছাড়া আর বিশেষ কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

শিলা বললে, আপনি ‘পালস’ দেখতে জানেন? আগে ‘পালস’টা দেখুন!

লেডি মুখার্জির হাতখানা ধরে লালজি বললে, ভয়ের তো কিছু দেখছি না। ঘরে ‘স্মেলিং সল্ট’ আছে?

‘স্মেলিং সল্টে’র শিশিটা এগিয়ে দিয়ে শিলা বললে, এতে কোনো ফল হয়নি। তবু আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন। আমি যাই, দেখি বাবুর্চি—ঘরে যদি খানিকটা বরফ পাওয়া যায়!

তারপর দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, আমি না আসা অবধি রোগী ছেড়ে যাবেন না যেন!

স্মেলিং সল্টের শিশিটা খুলে লালজি লেডি মুখার্জির নাকের কাছে বারকয়েক ধরলে। একটি বিরাট হাঁচি ছাড়া তাতে আর কোনো ফল হল না। হাতের তেলো দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বারকয়েক ঘষলে। তাতেও জ্ঞান ফিরে এল না। লালজি ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছিল। রাত দুপুরে আচ্ছা ঝামেলা!

হঠাৎ কেমন একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেডি মুখার্জি কাতর স্বরে প্রশ্ন করলেন, আমি কোথায়?

লালজি মনে মনে বললে, ‘যমের বাড়ি’! মুখে বললে, আপনার ঘরে। ক্ষীণ স্বরে লেডি মুখার্জি ডাকলেন, শিলা!

লালজি জানালে, শিলা বরফ আনতে গেছে, এখুনি আসবে।

কিন্তু সে—কথা লেডি মুখার্জির কানে গেল কিনা সন্দেহ! আদুরে খুকির মতো নিতান্ত অধীর হয়ে তিনি ডাকতে লাগলেন, শিলা! শিলা!

ঠিক এই সময় দরজা ঠেলে ঢুকে শিলা বললে, বরফ পাওয়া গেল না, ফুরিয়ে গেছে!

লালজি এগিয়ে এসে বললে, এবার আপনার রুগি সামলান। আমি সরে পড়ি।

.

নিজের ঘরে লালজি যখন এসে দাঁড়াল, অস্পষ্ট সুখস্মৃতির মতোই মিষ্টি অথচ হাল্কা একটা সুগন্ধে তার সমস্ত চেতনা তখনো রিমঝিম করছে।

গন্ধটা ফরাসি ল্যাভেন্ডারের।

শিলার সঙ্গে দেখা হলেই এই গন্ধটা সে পায়।

.

পরদিন সকাল। কুইন মেরি হোটেলের লবি।

গোপীকান্ত আচার্য বলছিল, টাকাটা তাহলে তবে আদায় হবে বাবু সাহেব?

সোনার জর্দা—কৌটো খুলে একটু মুখে ফেলে লালজি বললে, তা প্রায় মাস দুয়েক লাগবে।

গোপীকান্তর চোখ কপালে উঠল গৌর! গৌর! বলেন কি ! দু’মাস এই হোটেলের ভাত খেতে হবে? অতদিন তো আমি কলকাতায় থাকতে পারব না বাবু সাহেব!

লালাজি জিজ্ঞাসা করলে, কেন বলুন দিকি?

আমার মন—কেমন করবে।

সকৌতুকে লালজি বললে, মন—কেমন করবে! বলি আচয্যি মশাই, দেশে একটি সেবাদাসী রেখে এসেছেন নাকি?

গৌর! গৌর!—গোপীকান্ত লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেল। তারপর মুখ তুলে আমতা আমতা করে বললে, ইয়ে—ওর নাম কি—দেশে একটি ময়নাপাখি পুষেছি কিনা—

তরল কণ্ঠে লালজি বললে, বুঝেছি! আপনি স্বচ্ছন্দে দেশে ফিরে যান আচায্যি মশাই। কোম্পানির চিঠি এনে দিয়েছি, ইন্সিওরের টাকা অর্পণা দেবীর নামে ঠিক সময়েই পৌঁছে যাব’খন।

তারপর গলা নামিয়ে বললে, কালকের মেলেই আপনি চলে যান আচায্যি মশাই। আর দু’—চারদিন দেরি হলে গিয়ে হয়তো দেখবেন, ময়না পাখি শিকলি কেটেছে।

গৌর! গৌর! তা কি সম্ভব!

লালজি বললে, সম্ভব বইকি! শাস্ত্র পড়েননি? শাস্ত্রে বলেছে, রমণী হচ্ছে মানিব্যাগের মতো, কখন যে পকেট মারা যাবে, কিছু বলা যায় না!

গোপীকান্তর হাসি—হাসি মুখখানি শুকিয়ে এল। বললে, তাহলে চলেই যাই বাবু সাহেব, কি বলেন? ম্যানেজারবাবুও পত্র লিখে জানিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে… ইন্সিওয়ের টাকাটা ঠিক পাওয়া যাবে তো? মানে বলছিলাম কি, রাজধানী শহর, শুনেছি এখানে ঠগ, বাটপাড়—

গলায় জোর দিয়ে লালজি বললে, আমি কোম্পানির অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার, আমি যখন আপনাকে অভয় দিচ্ছি, তখন আপনার ভয়টা কিসের? আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান।

কৃতার্থ হয়ে গোপীকান্ত বলে উঠল, য্যাজ্ঞে। তাহলে বিলম্ব না করে আজকের মেলেই…. গৌর ! গৌর!

গোপীকান্ত ব্যস্ত হয়ে চয়ে গেল। লালজি কৌচে বসে বসে আলস্য ভাঙলে। তারপর উঠে করিডরের মুখে আসতেই দেখা হল শিলার সঙ্গে।

নমস্কার! বেরোচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ। লেডি মুখার্জির জন্যে কয়েকটা জিনিস কিনতে।

লালজি বললে, জানেন, কাল রাত্রে চোর এসেছিল?

চোর!

হ্যাঁ। আমার কামরায়।

শিলা শুধু বললে, ও! তাই নাকি?

একটু সূক্ষ্ম হাসির ছটায় লালজির ঠোঁটের প্রান্ত আর চোখের তারা ঝিকমিক করে উঠল! বললে, ভারি শৌখিন চোর কিন্তু—ফরাসি ল্যাভেন্ডার মাখে!

শিলা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে’ বলে হঠাৎ দ্রুতপায়ে লালজির পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আর ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা—মিষ্টি সুগন্ধে বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লালজি।

.

চলুন একবার পার্ক স্ট্রিট থানায় যাই। অফিসার গুপ্তর খাস—কামরায়।

অনেক খুঁজেও কাল রাত্রে লালজির ঘরে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। শুধু এই শিশিটা।

হাতব্যাগ থেকে ছোট একটা শিশি বের করে রমলা টেবিলের ওপর রাখল।

শিশিটা তুলে নিয়ে বিশু বললে, এটা তো দেখছি স্পিরিট—গাম!

অফিসার গুপ্ত বললেন, মাই গড! স্পিরিট—গাম নিয়ে লালজি করে কি? থিয়েটারের বাতিক আছে নাকি?

অল্প হেসে বিশু জবাব দিলে, আছে বইকি! সেক্সপিয়র বলে গেছেন এই দুনিয়াটাই একটা স্টেজ। আশা করি, খিদিরপুর ডকে মহম্মদ রশিদকে এত শিগগির ভুলে যাওনি গুপ্ত?

না, তা যাইনি। তবে সেই লোকটাই যে লালজি, আরও তো কোনো প্রমাণ পাইনি।

বিশু বললে, কিন্তু লালজি অ্যামেচার অভিনেতা নয়, রীতিমতো পেশাদার তা এই শিশিটা বোঝা যাচ্ছে। কেননা, স্পিরিট—গামের অনেকখানি খরচ হয়ে গেছে।

অফিসার গুপ্ত বললেন, অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, লালজি প্রায়ই ছদ্মবেশে বেরোয়?

উত্তরে বিশু বললে, বিলক্ষণ। তবে কবে কোন রঙ্গমঞ্চে, কোন ভূমিকায়, সেটাই এবার সঠিক জানতে হবে। লোকটা যে বহুরূপী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রমলা এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল। এইবার বললে, এখন তাহলে আমার কর্তব্য কি বিশুদা?

সে—কথার জবাব না দিয়ে বিশু অন্যমনস্কের মতো জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা রমলা, এই ক’দিনের মধ্যে লালজির ঘরে কাউকে আসতে বা যেতে দেখেছ? কোনো পুরুষ বা মেয়ে?

শুধু একটি মেয়েকেই মাঝে মাঝে দেখতে পাই। সেই মেয়েটি, কালো ভেল দিয়ে যার মুখ ঢাকা।

অফিসার গুপ্ত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে একবার বিশুর দিকে তাকালেন। তার অর্থ, কে এই রহস্যময়ী?

বিশু আবার জিজ্ঞাসা করলে, সে কে জানতে পেরেছ?

না।

তোমাকে একটা কাজ করতে হবে রমলা। সেই রহস্যময়ী মেয়েটি এবার যেদিন কুইন মেরি হোটেলে আসবে, তোমার চোখ—কান আরও ভালো করে খুলে রেখো।

অর্থাৎ?

ধরো, মেয়েটি হোটেল থেকে বেরোবে সেই সময় লেডি মুখার্জির খবর নিয়ে তোমাকে ডাক্তারের চেম্বারে ছুটতে হতে পারে। তারপর—হেসে রমলা বললে, বুঝেছি।

.

পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে বেরিয়ে চলুন কাছাকাছি যাই।

জি. মেকেঞ্জির শো—রুম।

কথা বলছিল দু’জন লোক। সারস পাখির মতো অত্যন্ত ঢ্যাঙা এবং অত্যন্ত রোগা লোকটি মেকেঞ্জির সেলসম্যান দত্ত। অপর ব্যক্তি মাথা থেকে পা অবধি নিখুঁত বিলিতি সজ্জায় টিপটাপ সাহেব। গালের দু’পাশে জুলপি দুটো অনেকখানি নেমে এসেছে। গোঁফের দুটি প্রান্ত ‘কসমেটিক’ দিয়ে সুঁচের মতো সরু করে পাকানো। ডান চোখে ‘মনোকল’, সরু কালো ফিতা দিয়ে গলার সঙ্গে আটকানো। রীতিমতো শৌখিন এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।

লোকটি বলছিলেন, একখানা ভাল গাড়ি কিনতে চাই। অবশ্য যদি আমার পছন্দমতো হয়।

নিশ্চয়ই! পছন্দ না হলে আপনি কিনবেন কেন?—প্রবল উৎসাহে হাত নেড়ে দত্ত শুরু করলে তবে যে সমস্ত গাড়ি আপনাকে দেখাব, তা পছন্দ না করে আপনার উপায় নেই। আর খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করাই আমাদের একমাত্র কাজ।… সিগারেট?

ফস করে পকেট থেকে ক্যাপস্টেনের প্যাকেট বের করে দত্ত তাঁর সামনে ধরলে।

ঈষৎ হেসে সাহেবি ভদ্রলোকটি বললেন, নো, থ্যাঙ্কস। আমার ব্র্যান্ড অন্য।

তারপর নিজের সোনার সিগারেট—কেসটা খুলে নিজে একটা নিয়ে দত্তর সামনে ধরলেন।

সিগারেট নিয়ে দত্ত পুনরায় শুরু করলে, গাড়ির কথা যদি বলেন মিষ্টার—

লাইটার জ্বেলে দত্তর মুখের সামনে ধরে ভদ্রলোক বললেন, সেইন।

দত্ত বললে, গাড়ির কথা যদি বলেন মিঃ সেইন, তাহলে প্রথমেই নাম করব ‘ওলডস মোবাইল।’ দেখতে যেমন লাভলি, চড়তেও তেমনি আমার। কি বলব, যেন ঘুম আসে! আর ইঞ্জিনের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব ‘স্টুডিবেকার কম্যান্ডার’ চোখ বুজে চড়লে গাড়ি চলছে কিনা টেরই পাওয়া যায় না। আপনি নিজের হার্ট—বিট এবং শুনতে পাবেন, মিঃ সেইন, কিন্তু স্টুডি—কম্যান্ডারের ইঞ্জিনের শব্দ—

মিঃ সেইন বললেন, আমার কিন্তু মাস্টার বুইকের ওপরই ঝোঁক।

বাঁ—হাত ডান হাতের তেলোয় ঘুঁষি মেরে দত্ত বলে উঠল, মাস্টার বুইক! একখানা গাড়ির মতো গাড়ি বটে! যেমন দেখতে, তেমনি চড়তে, তেমনি চালাতে। গাড়ি তো নয়, যেন একটা রাজহাঁস। লাভলি!

আছে আপনাদের?—খসে—পড়া মনোকলটা চোখে লাগিয়ে মিঃ সেইন প্রশ্ন করলেন।

দত্ত সোৎসাহে বললে, একখানা কেন, দশখানা আছে মিঃ সেইন।

উনিশ শো পঞ্চাশ মডেল?

সিওর!—আসুন আপনাকে দেখাই।

মিঃ সেইনকে নিয়ে দত্ত একখানা ঘন নীল রঙের মোটর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে বললে দেখুন! হাউ ফাইন!

মিঃ সেইন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন, একটু চালিয়ে দেখতে পারি? মানে ইঞ্জিনটা একবার পরখ কর—

নিশ্চয়! নিশ্চয়! দেখুন না চালিয়ে।

দত্তর আদেশে গাড়িতে কিছু পেট্রল ঢালা হল। তারপর তাকে পাশে বসিয়ে মিঃ সেইন নিজেই ড্রাইভ করে বেরোলেন।

পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গি। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে মিঃ সেইন অপর হাতে সোনার সিগারেট—কেসটা দত্তর সামনে খুলে ধরতে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেসটি খালি! লজ্জিত মুখে বললেন, সো সরি। চলুন, একটা দোকান থেকে কিছু সিগারেট নেওয়া যাক।

গাড়ি তখন এম্পায়ার স্টোর্সের কাছে এসে পড়েছে। মিঃ সেইন দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে বললেন, কিছু যদি মনে না করেন মিঃ দত্ত—

দত্ত বিগলিত সৌজন্যের সঙ্গে বললে, কিছু না, কিছু না! আমিই এনে দিচ্ছি। কি ব্র্যান্ড?

থ্রি ক্যাসেলস!

মিঃ সেইন একখানা দশ টাকার নোট তার হাতে দিতেই দত্ত নেমে দোকানে ঢুকল। আর সেই মুহূর্তে চোখের পলক না ফেলতে ফেলতে ঘন নীল রঙের গাড়িখানা যেন হাওয়ায় উড়ে চলে গেল।

.

ঘণ্টাখানেক পরে।

হাওড়ার একটা গ্যারাজে নীল রঙের গাড়িটা এসে ঢুকল। মিঃ সেইন গাড়ি থেকে নেমে রুমালে কপালের ঘাম মুছলেন।

তেল কালিমাখা একজন মিস্ত্রি কাজ করছিল। মিঃ সেইন বললেন, নাম্বার—প্লেটটা বদলে দাও হে পটল—চটপট—আর ইঞ্জিনের নাম্বারটাও।

সেলাম লালজি!—হেসে পটল মিস্ত্রি বললে?

তারপর গাড়িখানার কাছে এসে বললে নতুন গস্ত বুঝি? এও যে দেখছি স্যার আপনারই গাড়ির মতো মাস্টার বুইক—ফিফটি মডেল!

লালজি বললে, তফাত শুধু নম্বরের। সেটাও বদলে BLA 7777 করে দিলে গাড়িটা পুরোপুরি আমারই হয়ে যাবে, আর—

একগাল হেসে পটল মিস্ত্রি বললে, আর তখন সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বলে স্বচ্ছন্দে—

তোমার মগজ খুব সাফ পটল!… নাও, ধরো। হ্যাঁ, মাইল—মিটারের তারটাও কেটে, দিতে হবে।

খানকয়েক নোট লালাজির হাত থেকে পটলের হাতে চালান হয়ে গেল নিঃশব্দে।

.

শহরের অফিস—পাড়ায় একবার ঘুরে আসা যাক—

নর্টন হ্যারিসের অফিস। স্ট্র্যান্ড রোডের ওপরেই।

ছোটসাহেব মিঃ কার্টার পাইপ মুখে তখন কাগজপত্রে দস্তখত করছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, ইয়েস লালজি।

সামনের চেয়ারে বসে লালজি বললে, সেই গাড়িখানা এনেছি মিঃ কার্টার। আপনার শোফার ট্রায়াল দিয়ে দেখে নিচ্ছে। সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও গাড়িখানার কন্ডিশন নতুনেরই মতন,—মাত্র বছরখানেক হল কিনেছি।

মিঃ কার্টার মুখ তুললেন, কত মাইল রান করেছে?

সেটা ঠিক বলতে পারব না। গাড়ি কেনার পর থেকেই মাইল—মিটার বিগড়ে আছে—সারানো হয়ে ওঠেনি। তবে আন্দাজ পাঁচ হাজার মাইলের বেশি গাড়িটা চলেনি।

উর্দিপরা একজন পাঞ্জাবি সেলাম করে এসে দাঁড়াল। মিঃ কার্টারের ড্রাইভার। বললে, ইঞ্জিন বহুত আচ্ছা হায় সাব! গাড়ি বিলকুল নয়ি হ্যায়। আপ লে সেঁকতে হেঁ।

মিঃ কার্টারের বুলডগ—মুখে খুশির আভাস দেখা গেল। লালজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইন্সিওরের কাগজপত্র, টোকেন, ওনার—বুক—সব এনেছ তো?

সব এনেছি।

এখন বলো, কত দামে ছাড়বে?

নেট সাত হাজার।

টু মাচ! —মিঃ কার্টার গর্জন করে উঠলেন : নো, নো, মেক ইট সিক্স।

লালজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, আমি পেশাদার সেলসম্যান নই মিঃ কাটার তাই একদর বলেছি। আপনার না পোষায় ছেড়ে দিতে পারেন।

পাইপটা দাঁতে কামড়ে কার্টার সাহেব একটু ভাবলেন।

অলরাইট! একখানা রসিদ লিখে দাও।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে মিঃ কার্টার চেকবই বের করলেন।

.

বৈশাখী রাত্রি। গুমোট ভেঙে ঝিরঝিরে দক্ষিণ হাওয়া দিচ্ছে।

ওয়েলেশলি কফি—হাউসে এইমাত্র জোহরা বাইয়ের জিপসি নাচ শেষ হল।

গ্রিনরুমে বসে জোহরা তখন মেক—আপ তুলছে। মুখে খানিকটা ক্রিম ঘষে, জরির কাজকরা কালো সার্টিনের জামাটা সে খুলে ফেললে। সমুখে বড় আর্শি। সেদিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই, জোহরার দৃষ্টি যেন আটকে গেল।

কেন এত রূপ? কেন এত যৌবন—লাবণ্য? যদি বুকভরা তৃষ্ণা অতৃপ্তই রয়ে গেল জীবনে?… হ্যাঁ, তার দেহ—শতদলে একদা কামনার পাঁক লেগেছিল বটে, কিন্তু সে চিহ্ন কি বহু নিশীথের তপ্ত অশ্রুধারায় আজও ধুয়ে যায়নি? ফুলে যদি কাদা লাগে, গঙ্গাজলে ধুয়ে ফেললে আবার নির্মল হয়ে যায়; আর নারীর দেহ?

আচ্ছা লালজির কি চোখ নেই? না বুকের ভিতরটা পাথর দিয়ে তৈরি? কামনা নেই, অনুভূতিও বোধ করি নেই! এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল জোহরা যদি কুৎসিত হত। ব্যর্থ রূপ—যৌবনের বোঝা বয়ে বয়ে বেড়াতে হত না—পলে পলে পুড়তে হত না উপেক্ষার আগুনে।

কিন্তু না, অনেক সয়েছে সে আর নয়। তার পূর্বপুরুষ ছিল বন্য তাতার। কামনার বস্তু তারা ভিক্ষা করত না, লুঠ করে নিত। আজও রক্তে সেই বিষ রয়েছে! হায় যদি মানতেই হয় তবে দলিত সাপিনীর মতো লালজিকে তার বিষচূম্বন একদিন সে দিয়ে যাবেই!…

টক—টক—টক

গ্রিনরুমের দরজায় টোকা পড়ল।

কে?

বাইরে থেকে ইয়াসিনের চাপা গলা শোনা গেল : সাত নম্বর কেবিন।

জোহরা দ্রুত বেশ—পরিবর্তন করতে লাগল। তারপর মুখের ওপর কালো ভেলটা চাপা দিয়ে যখন সাত নম্বর কেবিনের পর্দা ঠেলে ঢুকল, লালজি তখন সামনে জিনের গ্লাস নিয়ে সিগারেট টানছে।

এসো বাইজি।

কালো ভেলটা মুখ থেকে সরিয়ে জোহরা সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।

লালজি বললে, বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়। অসুখ করেনি তো।

এ প্রশ্ন কেন?

বাঃ! তুমি আমার পার্টনার। কেমন আছো, জানতে চাইব না?

জেনে কি হবে?

অসুখ সারাবার ব্যবস্থা করব!

জোহরা হাসলে। শেষ রাত্রির চাঁদের মতো ফিকে একটু হাসি। বললে, ইলাজ করবে কে? তুমি? শুক্রিয়া! দরকার হবে না।

বাঁ দিকের ভুরু তুলে লালজি সোজা তার মুখের দিকে তাকাল: কি হয়েছে তোমার খুলে বলো তো?

অবরুদ্ধ আবেগে জোহরা বললে, বলেছি—হাজার বার বলেছি। আর বলতে পারি না। পাথরের কানে কানে বুকের দরদ জানিয়ে কোনো লাভ নেই।

এক চুমুকে গেলাসের অর্ধেকটা শেষ করে লালজি বললে, ও! সেই পুরনো কথা! আজো ফুরোয়নি?

তীব্র কণ্ঠে জোহরা বললে, না আজো ফুরোয়নি। এ জীবনে ফুরোবে না।…. যাক, ডেকেছে কেন বলো।

অলস ভঙ্গিতে লালজি ধোঁয়ার একটা রিং ছাড়লে। তারপর বললে, কুঞ্জ বিশ্বাসকে তোমার বোধ করি মনে আছে জোহরা? সেই যে পুজোর সময় কাশী থেকে ফেরবার পথে ট্রেনে আলাপ হয়েছিল? মোটাসোটা থলথলে চেহারা, পাকিস্তানের লোক বলে কথায় বাঙালে টান, তিসির আড়তদার। মনে নেই তোমার?

আছে। কিন্তু হঠাৎ কুঞ্জ বিশ্বাসের কথা কেন?

এ ক’মাসের মধ্যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুলোককে একদিন আদর করে ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়ানো উচিত, কি বল?

জোহরা বললে, বেশ তো!

কাল আমার বিয়ের তারিখ। তাই ভাবছি, কুঞ্জবাবুকে কালই সন্ধ্যাবেলা খেতে বলব।

বিয়ের তারিখ! তোমার?

জোহরার চোখ দুটি আরও দীর্ঘায়ত হয়ে উঠল।

লালজি গেলাসে আর একটা চুমুক দিলে : তুমি অবাক হলে কি হবে, কাশী থেকে ফেরবার ট্রেনে কুঞ্জবাবু আমার সুন্দরী বউ রঞ্জনা দেবীকে দেখেছেন এবং দেখে অতিশয় মুগ্ধ হয়েছেন। মনে নেই?

জোহরার মুখ হঠাৎ রাঙা হয়ে উঠল।

কি তোমার মতলব বলো তো লাল?

গেলাসটা শেষ করে লালজি বললে, শিকার জালে পড়েছে, শুধু টেনে তোলাটাই বাকি!… যাক, কাল পাঁচটায় হোটেলে এসো।… হ্যাঁ, কাল বিকেল পাঁচটার পর থেকে তুমি হচ্ছ কানপুর গালা ফ্যাক্টরির সিনিয়র পার্টনার লালমোহন মুখুয্যের স্ত্রী রঞ্জনা দেবী। ভুলো না।

হাতঘড়িটা পানে একবার তাকিয়ে লালজি উঠে পড়ল। তারপর কেবিনের ভারী পর্দা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল। আর সেই দুলন্ত পর্দার দিকে তাকিয়ে একাকিনী জোহরা দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হলে।

.

টিটাগড় চটকুলিদের বস্তি। আজ রাতে চলুন সেখানে।

মধ্যরাত্রির অন্ধকার পাখা মেলে নেমেছে বস্তির ওপরে। কি যেন একটা দুঃস্বপ্নের আতঙ্কে ঘুম নেই সমস্ত মহল্লাটার চোখে। এখানে—ওখানে ছোটখাটো জটলা, ফিসফিস করা অন্ধকার ছায়ামূর্তির আনাগোনা।

বস্তির ভেতর দিয়ে চলুন শেষপ্রান্তে—খাপরা ছাওয়া শেষ খরখানায়, যেখানে ঝমরু সর্দারের বাস।

ছোট জানলার পাশে কেরোসিনের ডিবে জ্বলছে। রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে বসে ঝমরু সর্দার, লোকটার মাথায় কাঁচা—পাকা চুলের মধ্যে থেকে রক্তের ধারা নেমে এসে গায়ের ফতুয়া পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া পুড়িয়ে তার মাথায় পটি বেঁধে দিচ্ছিল বউ মোতিয়া।

ধর্মঘট আর কতদিন চলবে?

যতদিন না মিলের মালিকরা আমাদের কথায় রাজি হয়।

এক মাস কেটে গেল, আরও কতদিন এইভাবে কাটবে?

একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওপর দিকে হাত তুলে ঝমরু বললে, মালিক জানে।

মোতিয়া বললে, কিন্তু এ ধর্মঘট চালিয়ে লাভ কি হবে বলতে পারিস? এতে দুঃখী—মজুরদের কষ্ট তো খালি বেড়েই যাচ্ছে। আমার কথা শোন সর্দার। ধর্মঘট বন্ধ করে দে।

তা হয় না।

এই ধর্মঘটের জন্যে তোর জান যেতে বসেছে তবু জিদ ছাড়বি না?

মজদুর ভাইরা ভাবছে, তাদের কলে যাওয়ার রাস্তা তুই আটকে রেখেছিস। তাই তো আঁধারে তোর মাথায় লাঠি পড়ল খুন বইল তোর কপাল বেয়ে—

ঝর ঝর করে মোতিয়া কেঁদে ফেলল।

ঝমরু বললে, ইউনিয়নের কথা ঠেলি কি করে?

তিক্ত কণ্ঠে মোতিয়া বলে উঠল, তবে ইউনিয়ন চুপ করে আছে কেন? খেতে দিক আমাদের?

ফান্ডের টাকা ফুরিয়ে এসেছে, তাই। নইলে খেতে দিত বইকি! এতদিন তো চালিয়ে এসেছে!

কিন্তু আজ—আজ চলবে কি করে? তিনদিন পেটে দানা—পানি নেই, বুকে নেই একফোঁটা দুধ।—দুটো ঘুমন্ত শিশুর দিকে হাত দেখিয়ে মোতিয়া বলতে লাগল, ওই দুটো বাচ্চচার মুখে কি দেব? মায়ের চোখের সামনে ছেলে শুকিয়ে মারা যাবে এই কি তুই চাস?

ক্লান্ত কণ্ঠে ঝমরু ধমকে উঠল, চুপ কর মোতিয়া!

তারপর গভীর আশ্বাসের সঙ্গে বললে, এ কষ্ট আমাদের থাকবে না রে—টাকা আসবেই—আজই আসবে!

ঝুট বলিসনে সর্দার!

ঝুট নয়, সত্যিই টাকা আসবে দেখিস।

ওকথা বলে আমাকে আর ভুলিয়ে রাখিসনে সর্দার—তোর পায়ে ধরি, ধরমঘট—

মোতিয়ার কথা বাইরের হল্লার আওয়াজে ডুবে গেল। বাইরে কারা যেন জড়ো হয়েছে। কারা যেন ডাকছে, বেরিয়ে এসো ঝমরু সর্দার! নিকল আও!

ঝমরু উঠে দরজা খুলতে যেতেই মোতিয়া পাগলিনীর মতোই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যাসনে সর্দার, উপোস করে ওরা খেপে আছে—ওরা তোকে মেরে ফেলবে—কেটে ফেলবে—

এক ঝটকার তার হাত ছাড়িয়ে ঝমরু দরজাটা খুলে ফেলল।

ঘরের সামনে খানিকটা খোলা জমি—সেখানে প্রায় শ’খানেক স্ত্রী, পুরুষ জড়ো হয়েছে। কয়েকজনের হাতে জলন্ত মশাল, তারই রক্তাভ আলোয় জনতার মুখের ভাব দেখে ঝমরু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিজেকে সামনে নিয়ে বললে, কি চাস তোরা?

জনতা চিৎকার করে উঠল : ধরমঘট বন্দ কর দো!

ঝমরু বলতে গেল, তোমদেরই ভালোর জন্যে—

কথা শেষ করতে দিল না ক্ষিপ্ত মজুরের দল।

ভালো আমরা চাই না, আমরা খাবার চাই—ভুখা পেটে দানাপানি চাই। হুকুম দে, কাল থেকে আমরা কলে যাব।

ঝমরু বললে, এতদিন সবুর করেছিস, আর ক’টা দিন—

জনতা আবার চিৎকার করে উঠল : ধরমঘট বন্ধ কর দো! নইলে জ্বালিয়ে দেব তোর ঘর!

ভাই সব !—ঝমরু হাত তুলে তাদের থামতে বললে।

ভাইয়োঁ, ইউনিয়নের কথা তোরা ভুলিস নে। ইউনিয়নের কথা অমান্য করলে আখেরে পস্তাতে হবে—

জাহান্নমে যাক ইউনিয়ন!—ঝমরুর কথা আবার ডুবে গেল জন কলরবে।

ইউনিয়নের কথা আর মানব না! হয় কাল থেকে কলে যাবার হুকুম দে সর্দার—নয় চাল দে—আটা দে—

ককিয়ে—ওঠা একটা রুগ্ন শিশুকে দুই হাতে তুলে ধরে ঝমরুর সামনে এগিয়ে এল রুগ্ন মলিন চেহরার এক কুলি—মেয়ে। গলা চিরে চিৎকার করে উঠল, আমার বাচ্চচার মুখে দুধ দে—

তারপর নিজের শীর্ণ শুষ্ক স্তন দেখিয়ে বললে, এই দ্যাখ কিচ্ছু নেই—এক ফোঁটা খুনও আর বেরোয় না—

মধ্যরাত্রির স্তব্ধতাকে যেন নখ দিয়ে দীর্ণ করে জনতা হল্লা করে উঠল, বন্ধ কর দো ধরমঘট! নয়তো টাকা দে!

হল্লা ছাপিয়ে সহসা ঝমরু গলা চড়িয়ে বলে উঠল, তাই দেব ভাইসব, টাকাই দেব। টাকা আমাদের আসবে—আজ রাতেই আসবে—ঘাবরাও মত ভাইয়োঁ!

নিমেষে ঝড় শান্ত হয়ে গেল।

তারপর পাঁচ সাতজন একসঙ্গে প্রশ্ন করলে, টাকা আসবে! ইউনিয়নের টাকা তো ফুরিয়ে গেছে।… তবে টাকা আসবে কোত্থেকে? আসমান ফুঁড়ে, কে দেবে, নাম বল?

ঝমরু বললে, যে দেবে, তার নাম আমি জানি নে, তবে টাকা সে দেবে বলেছে—কসম খেয়েছে—

ঝড় আবার উত্তাল হয়ে উঠল : ঝুট বাত! ঝুট বাত!

প্রাণপণে ঝমরু চিৎকার করে বললে, বিশ্বাস কর তোরা, ঝুট বাত নয়। ইউনিয়নের অফিসে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কাল। রাজার মতো চেহারা, বাদশার মতো দরাজ দিল। আমাকে সে বললে, ‘ধরমঘট’ কিছুতেই বন্ধ হতে দিও না সর্দার, তোমাদের দিন গুজরানের টাকা আমি দেব—ভরসা রেখো তোমরা।’ ভাই সব আজ তার টাকা আসবে— বিশ্বাস কর তোরা, আজই রাত বারোটার সময়—

সহসা ঝমরু বোবা হয়ে গেল।

চটকলের পেটা—ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে!

হো হো করে ক্ষিপ্ত জনতা অট্টহাস্য করে উঠল : আজই রাত বারোটার মধ্যে টাকা আসবে, না সর্দার?… ঝুটে কঁহিকে! ভেবেছিস, তোর ধোঁকাবাজি আমরা ধরতে পারব না? কই তোর রাজাবাবু?

ঝমরুর মাথার ভেতরে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কপালটা দপ দপ করছে। কি করবে সে এখন? বারোটা বেজে গেল তবু এল না তো’ সে! সেই রাজার মতো চেহারা, সুন্দর মুখ! সেও বেইমানি করলে গরিবদের সঙ্গে?

কোনোরকমে সে বললে, এই রাতটা আমায় ভাবতে দে তোরা।

তারপর কপালটা টিপে ধরে টলতে টলতে ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়ল। মোতিয়া ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কি হল? কি হল তোর সর্দার?

গভীর ক্লান্তিতে চোখ বুজে ঝমরু শুধু বললে, হায় গরিবের ভগবান!…

ঝুপ করে একটা শব্দ।

চমকে উঠে ঝমরু দেখলে খোলা জানলা—পথে একখানা কালো হাত ছায়ার মতো নিঃশব্দে সরে গেল, আর তার সমুখে পড়ে আছে লম্বা—চওড়া একখানা পুরু খাম। খুলতেই বেরুল একরাশ নোট, আর পরিষ্কার হিন্দিতে লেখা একটুকরো চিঠি :

ধর্মঘট বন্ধ করো না কিছুতেই। পাঁচ হাজার টাকা পাঠালাম তিনশো মজদুরের জন্যে। সবাইকে ভাগ করে দিও। দরকার হলে আরও টাকা পাবে। গরিবদের টাকা নিয়ে যারা বেইমানি করে, তাদের সঙ্গে আপসা কোরো না—পুরো পাওনা আদায় করে নাও।

মোহিতমোহন

ভয়ে বিস্ময়ে উত্তেজনায় মোতিয়ার মুখে তখন কথা হারিয়ে গেছে। আর চিঠিখানা বুকে চেপে ঝমরু পাগলের মতো বলছে, গরিবের মা—বাপ! ভগবান তোকে রাজা করুক!

.