৩
পার্ক স্ট্রিট থেকে চলুন ক্লাইভ রো। ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের প্রকাণ্ড সৌধ। তারই তিনতলায় জেনারেল ম্যানেজারের অফিস—ঘর। কথা হচ্ছিল সেইখানেই। ম্যানেজার মিঃ আয়ার বলছিলেন, হ্যাঁ, খবরের কাগজে দেখেছি জানকীনাথের মৃত্যুসংবাদ। বড় দুঃখিত হলাম খবরটা পড়ে। এখন বলুন, আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?
প্রৌঢ় লোকটি গলায কম্ফর্টার জড়িয়ে রুপো—বাঁধানো লাঠির ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে বসেছিলেন। বার দুই কেশে তিনি বললেন, আগে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি জমিদার সাহেবের একমাত্র কন্যা অপর্ণা দেবী।
আর আপনি?
কাশি সামলে প্রৌঢ় লোকটি বললেন, আমি ভূজঙ্গধর হাজারিকা। জানকীনাথ চৌধুরির এস্টেটে তেইশ বচ্ছর ম্যানেজারি করছি।…. হ্যাঁ, বলছিলাম কি, এই অপর্ণা মায়ের নামেই বছর তিনেক আগে জমিদার সাহেব আপনাদের কোম্পানিতে পনেরো হাজার টাকার ইন্সিওর করে যান। অপর্ণা—মা সেই টাকাটার জন্যেই আপনার দ্বারস্থ হলেন।…
মিঃ আয়ার বললেন, ও! আশা করি, মৃত জানকীনাথের ডেথ সার্টিফিকেটখানা এনেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, এনেছি বইকি!
কোটের বুক পকেট হাতড়ে ভুজঙ্গধর একটা লম্বা পুরু খাম বার করে মিঃ আয়ারের হাতে দিলেন। মিঃ আয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, আর পলিসি?
ভূজঙ্গধর বললেন, এতেই আছে, দেখুন।
মিঃ আয়ার খামের ভেতরকার কাগজপত্রে মন দিলেন।
ভূজঙ্গধর সামনের দিকে ঝুঁকে বলতে লাগলেন, গোড়ার কথাটা খুলে বলি আপনাকে মিঃ আয়ার। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় অপর্ণা—মায়ের জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে। জমিদার সাহেবের জামাই ছিলেন দেখতে যেমন রাজপুত্রের মতন, তেমনি কৃতী ছেলে। যাক সে—কথা, বলতে গেলে মায়ের আমার চোখের জল বাধা মানবে না।
পাশের চেয়ারে অপর্ণা তার অশ্রুভারাক্রান্ত বিষণ্ণ চোখ দুটি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।
হ্যাঁ, কি বলছিলাম,—একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভূজঙ্গধর আবার শুরু করলেন, জমিদার সাহেব ছিলেন অত্যন্ত খেয়ালি প্রকৃতির লোক। সারা জীবন শিকার আর আমোদ—প্রমোদের পেছনে বহু টাকা ব্যয় করে শেষ জীবনে ফতুর হয়ে পড়েছিলেন। মেয়ের ভবিষ্যতের ভাবনা আগে কখনও ভাবেননি; তাই শেষ জীবনে মেয়ের নামে এই টাকাটা তিনি ইন্সিওর করে যান। এখন এই টাকাটাই অপর্ণা—মায়ের একমাত্র সম্বল।
তারপর গলা নামিয়ে ভূজঙ্গধর বললেন, বাকি সমস্ত সম্পত্তি দেনার দায়ে নিলাম হতে বসেছে কিনা। এখন ইন্সিওরেন্সের এই টাকাটা শিগগির না পেলে মাকে আমার পথে দাঁড়াতে হয়—অত বড় ঘরের মেয়ে—
ভূজঙ্গধরের গলা ধরে এল। বার দুই কেশে গলা সাফ করে তিনি আবার বললেন, তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি মিঃ আয়ার। এখন আপনি ছাড়া আর গতি কি!… কি বল মা?
সমর্থনের জন্যে ভূজঙ্গধর একবার অপর্ণার দিকে তাকালেন।
ম্লান বিষণ্ণ চোখ দুটি আয়ারের মুখের দিকে তুলে অপর্ণা ধীরে ধীবে বললে, আমার এ বিপদে আপনার সাহায্য আশা করতে পারি কি মিঃ আয়ার?
সুন্দরী নারীর কালো চোখের দৃষ্টিবাণ ব্যর্থ হবার নয়। মাদ্রাজি যুবকের মর্মস্থলে বিদ্ধ হতে দেরি হল না। মিঃ আয়ার নরম গলায় বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই পারেন। টাকাটা যাতে ঠিকমতো পান, সে—বিষয়ে আমি চেষ্টার ত্রুটি করব না।
কবে নাগাদ আশা করতে পারা যায়?—ভূজঙ্গধর প্রশ্ন করলেন।
নিয়ম অনুসারে অন্তত মাসখানেক লাগবার কথা।
কালো চোখের সকরুণ মিনতি মিঃ আয়ারের মুখের পানে আবার তুলে ধরে অপর্ণা বললে, এক মাস!… অতদিন দেরি হলে আমাকে সত্যিই পথে দাঁড়াতে হবে মিঃ আয়ার। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই স্বামী হারিয়েছি বলে শ্বশুরবাড়িতে আমার ঢোকবার অধিকার নেই। বাপের আশ্রয়ও ভেঙে গেল। এই টাকাটা শিগগির না পেলে এখন আমি কি করব—কোথায় গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারেন?
কালো চোখের শুক্তির ভেতর থেকে টল টল করে কয়েকটা তরল মুক্তো গড়িয়ে পড়ল।
মিঃ আয়ারের গলা আরও নরম হয়ে গেল। বললেন, কি করব বলুন, আমি কোম্পানির চাকর। কেম্পানির আইন ভাঙতে তো পারি না!
ঘাড় নাড়তে নাড়তে ভূজঙ্গধর বললেন, তা তো বটেই। তা তো বটেই! তবু বিধবা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি টাকাটা আরও শিগগির পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন—মানে, আইন তো আপনাদের হাতেই—
কম্পিত ঠোঁট নেড়ে অপর্ণা শুধু বললে, আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব মিঃ আয়ার।
আশ্বাস দিয়ে মিঃ আয়ার বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, স্পেশাল কেস হিসেবে আপনার টাকাটা যত শিগগির পারি তোলবার ব্যবস্থা করে দোব। সপ্তাহ দুই পরে আপনি আমার একখানা চিঠি পাবেন মিঃ হাজারিকা।
আবেগে ভূজঙ্গধর লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন: আপনি মহৎ মিঃ আয়ার, সদাশয় ব্যক্তি! হ্যাঁ, চিঠি আসামে পাঠাবার দরকার নেই, কলকাতার ঠিকানাতেই পাঠাবেন। আচ্ছা, আজ আসি তাহলে— এসো মা—
অপর্ণাকে সঙ্গে নিয়ে কম্ফর্টার—জড়ানো ভূজঙ্গধর লাঠিতে ভর দিয়ে কাশতে কাশতে বিদায় নিলেন।
.
সবে সন্ধে হয়েছে।
ওয়েলেশলির কফি হাউসের দোতলার ফ্ল্যাটে বসে জোহরা অলস ভাবে কেশ—প্রসাধন করছে। পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে পোষা কাবুলি বিড়ালটা পরম আদরে তার পায়ে মুখ ঘষছে। ঘরে আলো জ্বালা হয়নি। সুকোমল স্বপ্নের মতো পাতলা অন্ধকার ঘরটি ছেয়ে আছে। জানলার বাইরে আকাশে শুধু একটি তারা দেখা যাচ্ছে—সন্ধ্যাতারা।
আজকাল প্রতি সন্ধ্যায় এই নিরালা অবসরে জোহরার কি যেন হয়! তার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, দুনিয়াটা শূন্য মনে হয়। কি যেন চেয়েছিল সে জীবনে, কি যেন পায়নি! সেই ব্যর্থতায় মনটা যেন মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তে চায়।
অথচ কিসের অভাব তার? কি দেয়নি তাকে লালজি? দিল্লির পাঁকের তলা থেকে কুড়িয়ে এনে তাকে বাদশাজাদির তখতে বসিয়েছে লাল। আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, অলঙ্কার সজ্জা, বিলাসের উপকরণ, কোনও কিছুরই অভাব নেই তার।
তবু—তবু কেন বিলাসিনী নর্তকী জোহরার মনের ভিতরে এক কাঙালিনী ভিক্ষার অঞ্জলি পেতে বসে বসে কাঁদে? কি চায় সে? কিসের ক্ষুধা তার? কিসের তৃষ্ণা? সন্ধ্যার ওই একক তারার মতো নিজেকে তার মাঝে মাঝে কেন এত একা মনে হয়?
কেন, সে তা জানে। নিজের মনের অগোচর কিছুই নেই। জোহরা জানে যে, সে ভালবেসেছে। আর এই ভালবাসাই তাকে করেছে রিক্ত।
কিন্তু কাকে ভালবাসল জোহরা?
বলবে না—দুনিয়ার কাউকে জোহরা বলবে না তার নাম শুধু বলতে পারে একজনকে, যদি সন্ধ্যার এই নিভৃত অবসরে সুকোমল স্বপ্নের মতো পাতলা অন্ধকারে ছাওয়া এই ঘরে এসে সে দাঁড়ায়।
কে?
দরজায় একটা ছায়া পড়তেই জোহরা চমকে উঠল।
বন্দেগি বাঈজি!
হাসিমুখে লালজি প্রবেশ করলে।
এক মহূর্তের জন্যে জোহরার সারা দেহ—মন যেন অবশ হয়ে গেল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বললে, এসো। এমন অসময়ে যে?
একটু দরকার আছে বাঈজি।
জোহরার মুখে ছায়া পড়ল: দরকার না হলে তুমি আসো না, তা জানি। দরকারের জন্যেই দিল্লির পথ থেকে আমাকে কুড়িয়ে এনেছিল। দরকার যেদিন মিটে যাবে, সেদিন আবার আমায় পথে ফেলে যেতে তোমার দেরি হবে না, তাও জানি। একবার পেছন ফিরে তাকাবারও সময় হবে না হয়তো।
একটা কৌচে ধপ করে বসে পড়ে লালজি অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার? থিয়েটারের পার্ট মুখস্থ করছ নাকি? স্টেজে চাকরি নেবে বুঝি?
জোহরার চোখ দুটো দপ করে একবার জ্বলে উঠেই স্তিমিত হয়ে গেল।
আমি তাচ্ছিল্য সইতে পারি, কিন্তু ঠাট্টা সইতে পারি না লাল।…
লালজি বললে, ঠাট্টা আমি করিনি জোহরা, আজ ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সের ম্যানেজারের ঘরে যে নিখুত অভিনয় তুমি করে এসেছ, তাতে তোমার নাট্যসম্রাজ্ঞী উপাধি পাওয়াই উচিত।
বাঁকা চোখে চেয়ে জোহরা বললে, অভিনয়ে তুমিও কম যাও না লাল। তোমার আগাগোড়াই অভিনয়!
হয়তো তাই। কিন্তু মাদ্রাজি ম্যানেজার আজ সারারাত সুন্দরী অপর্ণার স্বপ্ন দেখবে নিশ্চয়ই! সুতরাং আশা হয়, টাকাটা পাওয়া যাবে নির্ঘাৎ।
জোহরা ধীরে ধীরে লালজির কাছে এসে বসল। বললে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব লাল?
এত ভণিতা কেন?
কথাটা তোমায় কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিনি কি না!
তাহলে আডও জিজ্ঞাসা না করলে পারতে। যাকগে, কি জানতে চাও, বলো।
এত টাকা নিয়ে তুমি কি কর?
লালজি এক মুহূর্ত জোহরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, খেলা করি। টাকা আমার খেলনা।
সশব্দে হেসে উঠল লালজি।
জোহরা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। লালজিকে আজও সে বুঝতে পারে না—না পারে নিজেকে বোঝাতে।
লালজি উঠে আলমারি থেকে একটি’জিনে’র বোতল আর একটা গেলাস বার করে আনল। তারপর জোহরাকে বলল, নিচে থেতে বয় ইয়াসিনকে একবার ডাক দাও তো জোহরা।
একটু পরেই ইয়াসিন এসে দাঁড়াল। এই লোকটিকে আমরা দেখেছিলাম, কফি হাউসে জোহরার কানে কানে ‘সাত নম্বর কেবিন’ বলতে।
লালজি বললে, তোমার একটা পুরনো লুঙ্গি, একটা ময়লা গেঞ্জি আর একটা তোয়ালে এখুনি চাই ইয়াসিন।… হ্যাঁ, এক প্যাকেট কাঁচি সিগারেট এনো।
জী আচ্ছা।
ইয়াসিন বেরিয়ে গেল।
জোহরা প্রশ্ন করল, ওসব জিনিস দিয়ে কি হবে?
লালজি জবাব দিলে, দুনিয়াদারির নাটকে নতুন ভূমিকায় নামতে হবে। আমি যে বহুরূপী!
.
আজ রাত দশটায় আমার সঙ্গে চলুন খিদিরপুরের কিং জর্জেস ডকের ফটকে। লক্ষ করুন, সবুজ—চেক লুঙ্গিপরা আধময়লা গেঞ্জি গায়ে, তৈলাক্ত চুলে পরিপাটি করে টেরি—কাটা যে মুসলমান জাহাজি মাল্লাটি এইমাত্র এল। ডান হাতের তর্জনি আর মধ্যমার ফাঁকে একটা সিগারেট চেপে ধরে ঘন ঘন টানছে আর শিস দিয়ে একটা গজলের সুর ভাঁজছে। ভেতরে যেতেই ফটকে মোতায়েন কনস্টেবল হেঁকে উঠল, কৌন হ্যায়?
জড়িত কণ্ঠে জবাব এল, মহম্মদ রশিদ।
কাঁহা যাতা?
ইস্টিমারমে—এস, এস, স্যাভেজ গার্ল।
কাঁহা গিয়া থা?
লোকটা তার পাতলা নুর চুমরে একটু হাসল। তারপর বললে, থোড়া পিনে কো লিয়ে সিপাহিজি—ইয়ে চাঁদনি, ইয়ে আশকভ্যরি বাহার… মওজ উড়াও সিপাহিজি—জওয়ানি বীত যায়েগী!
হা হা করে মহম্মদ রশিদ হেসে উঠল।
কনস্টেবল আবার হেঁকে উঠল, এই হল্লা কর মৎ! চুপচাপসে চলা যাও।
স—স—স!—মহম্মদ রশিদ নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে আওয়াজ করলে। তারপর টলতে টলতে ভেতরে ঢুকে গেল।
ওকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে।
ফাল্গুনের এই জ্যোৎস্না—রাত্রে কিছু তরল পদার্থের গুণে মহম্মদ রশিদের প্রাণে তখন বোধ করি জোয়ার এসেছে। হঠাৎ সে গলা ছেড়ে গান ধরলে:
তু মেরা চাঁদ, ম্যায় তেরি চাঁদনি হো…
গাইতে গাইতে লোকটা স্থiলিত পায়ে এগোতে লাগল, যেখানে একটা স্প্যানিস কার্গো—বোট এসে লেগেছে। জাহাজটা আসছে সিঙ্গাপুর থেকে। তারই সামনে দাঁড়িয়ে মহম্মদ রশিদ গানের নামে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল:
নেহি দিলকা লাগানা কোই দিল্লাগী—কোই দিল্লাগী—
একটু পরেই জাহাজের ওপর থেকে একটা চাপা শিসের আওয়াজ শোনা গেল। যেদিকটার কুলীরা মাথা খালাস করছিল, সেদিকে না গিয়ে মহম্মদ রশিদ অন্য দিকে একটা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে উঠে গেল। জাহাজের এদিকটায় আবছা অন্ধকারে গোল টুপি পরা একটি মুর্তি রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়েছিল। মহম্মদ রশিদ চাপা গলায় ডাকলে, পিটার! মূর্তিটি এগিয়ে এল। একজন স্প্যানিস খালাসি। মহম্মদ রশিদ পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলে, খবর কি? বেবি কোথায়? পিটার জবাব দিলে, বেবি তোমার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। আগে টিকিট দাও।
মহম্মদ রশিদ ট্যাঁক থেকে একটা আংটি বের করে দিলে। হীরের টুকরোটা ঝলসে উঠল। আংটিটা হাতে নিয়ে পিটার লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল আ!
তারপর নিজের কোমর থেকে একটা চওড়া বেল্ট খুলে মহম্মদ রশিদের হাতে দিলে।
রশিদ জিজ্ঞাসা করল, কতটা আছে?
পাউন্ডখানেক হবে।
বেলটটা লুঙ্গির ওপরে নিজের কোমরে আঁটতে আঁটতে রশিদ বললে, আরও বেশি আশা করেছিলাম।
পিটার তার কাঁধ চাপড়ে বললে, বেটার লাক নেকস্ট টাইম।
পুরনো খদ্দেরকে ভুলে যেও না পিটার। পরের বার কিছু স্প্যানিস মদ আমার চাই। তাই হিরের আংটিটা আগাম দিয়ে রাখলাম।
ও. কে ডিয়ার।
মহম্মদ রশিদ আবার দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। তারপর গলা ছেড়ে গান ধরে টলতে টলতে ফটকের রাস্তা ধরল।
কনস্টেবল আবার তাকে রুখলে, ফির কাঁহা যাতা হায়?
চোখের একটা ইসারা করে রশিদ বললে, সচ বাতাউ? তারপর কনস্টেবলের কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বলল।
ক্রুদ্ধ কনস্টেবল তাড়া দিয়ে উঠল হট!… দিল্লাগী মিলা হায়?
তেরি কসম ইয়ার—নেশার ঝোঁকে মহম্মদ রশিদ হেসে গড়িয়ে পড়ল।
কনস্টেবল আবার ধমকে উঠল, কেয়া হায় তেরে পাশ?
কুছ নেহি ইয়ার। স্রিফ ইয়ে দিল—
তারপর পুনরায় জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে গান ধরল:
এক দিলকা টুকড়ে হাজার হুয়ে
কোই ইঁহা গিরা, কোই উঁহা গিরা—
নেশার টলমল রশিদকে দেখে কনস্টেবলের বোধকরি ধারণা হল, লোকটা বেহেড মাতাল ছাড়া সন্দেহজনক কিছু নয়। বিরক্ত হয়ে সে বললে, যা ভাগ!
‘আদাব মেরি রাজা’ বলে এক দীর্ঘ কুর্নিশ জানিয়ে রশিদ স্থলিত পায়ে ফটক থেকে বেরিয়ে গেল। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, লোকটা হোঁচট খেয়ে এখুনি পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য, ডক এলাকা পার হয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই রশিদের চলন গেল বদলে। দ্রুতপায়ে এগিয়ে সে একটা বড় গাছের নিচে কালো রঙের একটা অপেক্ষমাণ মোটরে টপ করে উঠে পড়ল। চালাও মাহাঙ্গু,—খবরদার, হেড লাইট জ্বেলো না যেন।
গাড়িটা অন্ধকারে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।
রাস্তার উলটো দিকে একখানা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে দুটি ছায়ামূর্তি। একজন অপরকে বললে, গাড়িখানার পেছু নাও গুপ্ত। এ লালজি ছাড়া কেউ নয়।
.
খিদিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কালো রঙের গাড়িটা রেসকোর্সের পাশের রাস্তা ধরল।
কানা মাহাঙ্গুর একটা চোখ রাত্রে বেড়ালের মতো জ্বলে। বার দু’য়েক মুখ বাড়িয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে সে বললে, একটা জিপ পিছু নিয়েছে হুজুর। একটা গাড়ি খিদিরপুরে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের থেকে তফাতে দাঁড়িয়েছিল। এ সেই গাড়িটাই মালুম হচ্ছে।
পিছনের সিটে মহম্মদ রশিদ তখন লুঙ্গি আর গেঞ্জির বদলে ট্রাউজার আর হাফ শার্ট পরেছে। মুখে দাড়িরে চিহ্নও নেই। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, বেকুফ! একথা আগে বলোনি কেন?
মাহাঙ্গু জিজ্ঞাসা করলে, স্পিড দেব? তাতে কোনো লাভ হবে না। জিপটাকে এগিয়ে যেতে দাও।
গাড়ি ততক্ষণে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে এসে পড়েছে। অকস্মাৎ মাহাঙ্গু প্রাণপণে ব্রেক কষল। প্রচণ্ড একটা আর্তনাদ করে কালো রঙের গাড়িখানা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পাশ দিয়ে জিপখানা বেরিয়ে গেল তীরের মতো।
চোখের পলকে মাহাঙ্গু স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এক্সেলেটর চেপে ধরল। মেমোরিয়ালের পাশের রাস্তায় গাড়িখানা সবেগে উধাও হয়ে গেল।
জিপের ড্রাইভার এজন্যে একেবারেই তৈরি ছিলেন না। অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়ে তিনি যখন গাড়ি ঘোরালেন, তখন কালো রঙের গাড়িখানার চিহ্নমাত্রও দেখা যায় না।
গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে গুপ্ত বললেন, বেমালুম চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ল হে বিশু! এখন আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলো?
.
অফিসার গুপ্ত খুঁজে না পেলেও কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানাকে আরও আধ ঘণ্টা পরে আমরা কিন্তু খুঁজে পেলাম। বেলেঘাটা ছাড়িয়ে ট্যাংরায় এসে গাড়িখানা থামল একটা কাঠের ফটকের সামনে। ফটকের ভেতরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে সারি সারি কাঠের বাড়ি। কাঁচা মেটে রাস্তার দু’পাশে দূরে দূরে একটা করে চিনে—লন্ঠন ঝোলানো। তাতে অন্ধকার আরও বেশি ঘন হয়েছে। কাঁচা চামড়ার অস্বস্তিকর গন্ধে পাড়াটার হাওয়া ভারী হয়ে আছে। লোকে এই পাড়াটাকে বলে, ‘চায়না টাউন’। চামড়ার কারবারি চিনাদলের আস্তানা এখানে।
সমস্ত পাড়াটা যেন তন্দ্রায় ঝিমিয়ে আছে। শুধু ঝোলানো লন্ঠনগুলির নিচে ছোট ছোট কাঠের টুলের ওপর বসে জেগে আছে কয়েকটি চিনা। থ্যাবড়া, গোল মুখগুলি ভাললেশহীন। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ নেশায় যেন ঢুলছে।
কাঠের ফটক ঠেলে লালজি ভেতরে ঢুকল। দেখা গেল, প্রথম চিনাটির ঝিমানো চোখ দুটো হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠেছে। লালজি তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললে, বাজপাখি।
প্রথম চিনাটি একবার ঘাড় নেড়ে শিস দিয়ে উঠল। তার আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না যেতেই দ্বিতীয় চিনাটির মুখ দিয়ে অনুরূপ শিসের আওয়াজ বেরোল। তারপর তৃতীয়—চতুর্থ—
অন্ধকার রাত্রিকে শিউরে দিয়ে শিসের আওয়াজ ক্রমশ দূরে চলে গেল।
সেই গা—ছমছমে পথে লালজি এগিয়ে যেতে লাগল। থামল গিয়ে কাঁচামাটির রাস্তাটা যেখানে একটা প্রকাণ্ড বিলের ধারে শেষ হয়েছে। বাঁ—দিকে একটা কাঠের বাড়ির দরজায় বসে একজন চিনা বুড়ি। শনের মতো পাকা চুল। মুখের কোঁচকানো চামড়া যেন অতীতের শিলালিপি। পায়ের আওয়াজ পেয়েই খনখনে গলায় বুড়ি বলে উঠল, কে যায়?
লন্ঠনের সামনে এগিয়ে গিয়ে লালজি বললে, তোমার বাজপাখি বুড়ি—মা।
দন্তহীন মুখে বুড়ি একগাল হাসলে। বললে, বেশ, বেশ, ভাত তো? যাও ভেতরে ওয়াং আছে। যাবার সময় আমার দস্তুরিটা দিয়ে যেও।
দেব বইকি বুড়ি—মা।—বলে লালজি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ছোট ছোট কাঠের খুপরির পাশ দিয়ে চোরা গলিপথ। সেই পথ দিয়ে গেলে হলের মতো একটা বড় ফাঁকা জায়গা, অনেকটা ঢাকা বারান্দার মতো। মাঝখানে একটা লম্বা কাঠের টেবিল, দু’পাশে সরু বেঞ্চি। ঘরের চাল থেকে বড় বড় দুটো চিনে—লন্ঠন ঝুলছে। টেবিলের দু’পাশে নানা জাতের সমাবেশ—চিনে, বাঙালি, ভাটিয়া, পাঞ্জাবি, মুসলমান। তবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাই বেশি। বেঞ্চিতে যারা জায়গা পায়নি, তারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
জুয়া চলছিল। তার সঙ্গে চোলাই মদ আর চণ্ডু। টেবিলের এক প্রান্তে একটা উচু কাঠের টুলের ওপর ঘোর তামাটে বর্ণের একজন চিনা বসে। হাতকাটা গেঞ্জির ফাঁকে তার দেহের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, মনে হয় পাথরে কোঁদা। ছোট করে চুল ছাঁটা, মুখে একটা বার্মা চুরুট। লোকটার বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তার সামনে টেবিলের ওপর স্তূপাকার নোট, টাকা আর খুচরো পয়সা। মাথা—বেঁকানো একটা লাঠির সাহায্যে মাঝে মাঝে সে লম্বা টেবিলের মাঝখান থেকে টাকা—পয়সা এনে সামনে জড়ো করছিল। তার মুখের চেহারা আর অত্যন্ত সজাগ লালচে চোখ দুটো দেখলে স্বতঃই মনে হয়, লোকটা শেয়ালের মতো ধূর্ত, সাপের মতো ক্রুর, আর শয়তানের মতোই নিষ্ঠুর।
এই হল ওয়াং। জুয়ার আড্ডার মালিক বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডেন কিপার’।
তারই কোলের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে বছর ন’দশের একটি চিনা মেয়ে একমনে তাসের খেলা দেখছিল। শিশির—স্নিগ্ধ ফুলের মতো তাজা টুলটুলে মুখখানি। মাথায় একরাশ কালো চুলের স্তবক। চোখ দুটি কেমন যেন শান্ত বিষণ্ণ। তার পাশে টেবিলে ঠেস দিয়ে রাখা একটা ‘ক্রাচ’। ওয়াংয়ের বুকের কাছে এই মেয়েটিকে দেখলে মনে হয়, একটা রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে যেন ছোট্ট একটি বনফুল! দু’জনকে দেখতে নিতান্তই বেমানান—তবু ওয়াংয়ের আড্ডার লোকেরা জানে যে, এই মেয়েটিকে ছাড়া ওয়াং কখনও জুয়ার টেবিলে বসে না।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে লালজি ঘরের আবহাওয়াটা লক্ষ করছিল। তাকে দেখতে পেয়ে মেয়েটা ওয়াংয়ের কোল ছেড়ে ক্রাচে ভর দিয়ে খট খট করে কাছে এসে দাঁড়াল। দেখা গেল, মেয়েটার ডান পায়ের হাঁটু থেকে নীচের অংশটা দড়ির মতো সরু লিকলিকে! এক মুখ হেসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, হেল—লো লাল, এতদিন আসোনি কেন? কোথায় ছিলে?
সস্নেহে মেয়েটির গাল দুটি স্পর্শ করে লালজি বললে, আকাশে। তোমার জন্যে কি এনেছি বলো তো মিমি?
সরল চোখদুটি মেলে মিমি শুধু তাকিয়ে রইল।
লালজি বললে, আগে চোখ বন্ধ করো।
চোখ বুজলেই লালজি পকেট থেকে টফি বার করে মেয়েটির হাত ভরে দিল।
তুমি কত ভাল!—আনন্দে আর কৃতজ্ঞতায় লালজির হাতখানা ধরে মেয়েটি নিজের গালের ওপর একবার চেপে ধরল। ঠিক সেই সময় মোটা কর্কশ গলায় ডাক এল, মিমি!
লালজি দেখলে, টেবিল ছেড়ে ওয়াং উঠে আসছে।
তোমার শোবার সময় হয়েছে মিমি।
মাথা ঝাঁকি দিয়ে মিমি বললে, না। আমি এখন লালজির সঙ্গে গল্প করব।
রাত জাগলে অসুখ করবে পাজি মেয়ে!
না, অসুখ করবে না!
ভারি একগুঁয়ে মেয়ে! তারপর লালজির দিকে চেয়ে ওয়াং বললে, খবর কি?
লালজির কাছ থেকে জবাব এল: বাজপাখি শিকার ধরে এনেছে।
কি শিকার?
কোকেন। প্রায় এক পাউন্ড।
কোমর থেকে বেল্টটা খুলে লালজি ওয়াংয়ের হাতে দিল। ওয়াংয়ের মুখে একটিও রেখা পড়ল না। কোমর থেকে একখানা ছুরি বের করে নিঃশব্দে সে বেল্টের খানিকটা চিরে ফেলল। দেখা গেল, ভিতরটা সাদা পাউডারে ভর্তি।
একটু জিভে ঠেকিয়ে দেখলে সে। তারপর লালজিকে জিজ্ঞাসা করল। টাকাটা আজই চাই?
এখুনি।
বেশ। ওয়াং কখনও ধারে কারবার করে না।
টেবিলে ফিরে গিয়ে ওয়াং কতকগুলো নোট গুনে গুনে লালজির হাতে দিল। তারপর বললে, অল রাইট?
লালজি হেসে বললে, আল রাইট ওয়াং। গুড নাইট!
টেবিলে বসবে না?—ওয়াং প্রশ্ন করল। আজ বোর্ড খুব ভারী।
লালজি এক মুহূর্ত ভাবলে। তারপর টেবিলের একপাশে বসে পড়ে বললে, আচ্ছা, তাস দাও। টাকাটা খানিকটা বাড়িয়ে নিয়েই যাই।
লালজি জুয়ার টেবিলে বসাতে চারপাশে উৎসাহের লক্ষণ দেখা দিল। জনকয়েক অ্যাংলো ছোকরা বলে উঠল, উইশ ইউ লাক, লাল।
কেউ কেউ বিদ্রূপের হাসি হেসে বললে, দেখাই যাক!
খেলা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ভাগ্য কারো একচেটে নয়। গোড়া থেকেই লালজি হারতে শুরু করল।
চারপাশে গুঞ্জন উঠল : এ তো জানা কথা! ওয়াংয়ের টেবিল থেকে কেউ কখনও জিতে ফিরে যেতে পারে না—তা সে যে—ই হোক।
পরের বাজির তাস দেওয়া হল। লালজি দান তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তার কানের গোড়ায় ফিস ফিস করে কে যেন বললে, বাবার তাসগুলো দাগি!
মিমি যে কখন এসে লালজির কোলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউই তা লক্ষ করেনি।
মোটা কর্কশ গলায় ওয়াং বললে, বাজি ধরো লাল—
সোজা ওয়াংয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লালজি ধীরে ধীরে বললে, ধরব। কিন্তু তার আগে এই পুরনো তাসের বদলে নতুন তাস আনো।
ওয়াং যেন একটু চমকে উঠল: তোমার একথায়র মানে?
তেমনি শান্ত গলায় লালজি বললে, তোমার কার্ডগুলো চিহ্ন দেওয়া। হয় নতুন কার্ড আনো, নাহয় তো আমার টাকা ফিরিয়ে দাও।
টেবিলের চারপাশে প্রবল চাঞ্চল্য দেখা দিল। একদল লালজির পক্ষ নিয়ে, আর একদল ওয়াংয়ের পক্ষ নিয়ে শোরগোল শুরু করলে। উত্তেজিত অ্যাংলো ছোকরার দল চিৎকার করে উঠল : এমন জুয়াচুরির কারবার ক’দিন চালাচ্ছ ওয়াং? আমাদের অনেক টাকা খেয়ে তোমার পেট মোটা হয়েছে! এবার নতুন করে তাস আনাও, নয়তো এখুনি টাকা ফেবত দাও—
ওয়াংয়ের লালচে চোখ দুটো একবার দপ করে জ্বলে উঠল, তারপর সোনা—বাঁধানো দাঁতগুলো বের করে নেকড়ের মতো নিঃশব্দে হাসল।
সমস্ত ঘরখানা এক নিমেষে চুপ! ওয়াংয়ের এ—হাসির অর্থ সকলেই জানে। জানে যে, এই হাসির পর অন্তত বিশখানা চিনে ছুরি বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
চারপাশে একবার তাকিয়ে ওয়াং থেকে থেকে চিবিয়ে বলতে লাগল, এই ইদুরগুলোর কথা আমি ধরি না। কিন্তু তুমিও এদের দলে যোগ দাও লাল, তাহলে তোমাকেও—
ওয়াংয়ের মুখের কথা শেষ হল না। ট্রাউজারের পকেট থেকে ছোট একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করে, খেলনার মতো লুফতে লুফতে লালজি বললে, এটা সম্প্রতি কিনেছি, ভারি সুন্দর, না ওয়াং?
ওয়াংয়ের দুই চোখ যেন জ্বলন্ত দু’টুকরো কয়লা।
ঘরে সুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়।
পিস্তলটা আবার পকেটে পুরে সহজ গলায় লালজি বললে, কি করবে বলো ওয়াং? টাকা ফেরত দেবে, না নতুন তাস আনবে? আর বেশিক্ষণ বসতে পারব না।
ওয়াংয়ের ইসারায় একজন চিনা এক প্যাকেট নতুন তাস নিয়ে এল।
আবার শুরু হল খেলা। দেওয়া হল চারখানা করে কার্ড। রাগে উত্তেজনায় ওয়াং মোটা বাজি ধরলে। তারপর জিজ্ঞাসা করলে, লাল না কালো?
টেবিলের ওপর আঙুলের টোকা মারতে মারতে লালজি বললে, লাল।
ওয়াং বললো, শো।
তাস তোলবার আগেই লালজির ডান হাতখানা ধরে নিজের গালের ওপর মিমি একবার চেপে ধরল।
কর্কশ গলার ওয়াং আবার হেঁকে উঠল, শো।
লালজি চারখানা তাস একে একে চিৎ করে দিল। চারখানা তাসই লাল রঙের!
উচ্ছ্বাসে অ্যাংলো ছোকরার দল চিৎকার করে উঠল—যেন জিৎ তাদেরই।
জ্বলন্ত চোখে মিমির দিকে চেয়ে ওয়াং ডাকলে, এদিকে এসো মিমি!
লালজির পাশ থেকে মিমি কিন্তু নড়ল না।
ওয়াং আবার গর্জন করে উঠল, এদিকে আয় বলছি, শয়তানের বাচ্চচা!
ক্রাচে ভর দিয়ে মিমি সোজা হয়ে দাঁড়াল। দুই চোখে উপচে—পড়া ঘৃণা নিয়ে তাকাল বাপের দিকে। তারপর ‘আমার ঘুম পেয়েছে, আমি শুতে যাই’ বলে খট খট করে চলে গেল।
ওয়াংয়ের সামনে হাত মেলে লালজি হেসে বললে, শুনেছি, ওয়াং কখনও ধার রাখে না। সুতরাং—
চাপা রাগে ওয়াং পিচ করে মেঝের ওপর খানিকটা থুতু ফেললে। তারপর অনেকগুলো নোট লালজির হাতের ওপর ছুড়ে দিলে।
নোটগুলো পকেটে পুরো লালজি দাঁড়িয়ে উঠে বললে, গুড নাইট ওয়াং। আবার দেখা হবে।
ওয়াং পিচ করে আবার থুতু ফেলল। তারপরে চারপাশে একবার তাকিয়ে বলে উঠল, দেখো, দেখো, পেনটুলেন—পরা মেয়েটা টাকা জিতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে!
ওয়াংয়ের দল হো হো করে হেসে উঠল। চুপ করে বসে রইল শুধু অ্যাংলো ছোকরার দল। লালজি একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজতে সতেরো মিনিট।
আরক্ত মুখে লালজি আবার টেবিলে বসে বললে, বেশ, আর একটা চান্স তোমায় দিচ্ছি ওয়াং। নাও, তাস দাও।
চারখানা করে তাস দেওয়া হল। এবার লালজি বললে, লাল কালোর জোড়া।
গুণে গুণে হাজার টাকার নোট টেবিলের ওপর রেখে ওয়াং চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, আর একবার ভেবে বলো লাল। হারলে তোমার দু’হাজার বেরিয়ে যাবে। তখন কান্নাকাটি কোরো না যেন! আবার ভেবে বলো।
শান্তগলায় জবাব এল : লালজি কখনও দু’বার ভাবে না ওয়াং। তুমিই বরং আবার শুনে রাখ—লাল—কালোর জোড়া।
শো।
তাস চারখানা লালজি উলটে দিল। সত্যিই লাল—কালোর জোড়া।
তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে গেল। আনন্দে অ্যাংলো ছোকবার দল মদের গেলাস ছুঁড়তে লাগল। হাজার টাকার তাড়াটা পকেটে ভরে লালজি ওয়াংয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, আশা করি, এর পর তোমার আর কিছু বলবার নেই ওয়াং?
সোনা—বাঁধানো দাঁত বের করে আর একবার নেকড়ের মতো শুধু হাসলে ওয়াং।
গুড নাইট।
লালজি দরজার দিকে এগোল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের দু’জন চিনার সঙ্গে ওয়াংয়ের কি ইসারা হয়ে গেল, কে জানে! টেবিলের পাশ থেকে লোক দু’টো নিঃশব্দে সরে গেল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার গোড়ায় ঘুরে দাঁড়াল লালজি। সেখান থেকেই বললে, একটা কথা জানিয়ে যাই ওয়াং। লালজির মাথার পেছন দিকেও দুটো চোখ আছে। অন্ধকারে সে—দুটো বাঘের চোখের মতোই জ্বলে।
দরজার বাইরে চোরা গলিপথে লালজির মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল।
হঠাৎ সেই অন্ধকার চোরা গলিপথে কে যেন অত্যন্ত কোমল গলায় বলে উঠল, তুমি চলে যাচ্ছ?
লালজি ভাল করে তাকিয়ে দেখল, ক্রাচে ভর দিয়ে মিমি দাঁড়িয়ে। মেয়েটা বিছানা ছেড়ে চুপি চুপি কখন উঠে এসেছে, কে জানে! সরল বিষণ্ণ দুটি চোখ মেলে বললে, আমার কথা তুমি ভুলে যাবে না লাল?
নিচু হয়ে মিমির কপালে একটা চুম্বন দিয়ে লালজি বললে, তোমায় কখনও ভুলব না মিমি। এইবার শুতে যাও, লক্ষ্মী মেয়ে! তোমার বাবা জানতে পারলে রাগ করবে।
মিমি চলে গেল। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লালজি সদর দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিল।
দরজার বাইরে সেই শাঁকচুন্নি বুড়ি বসে। একখানা নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে লালজি বললে, তোমার দস্তুরি বুড়ি—মা!
দন্তহীন মুখে বুড়ি হাসলে : বেশ, বেশ, আবার এসো।
চলতে চলতে লালজি হাতঘড়িটার দেখলে, বারোটা বাজতে সাত।
.