বহুরূপী – ২

আর সেই রাত্রে ঠিক সেই মুহূর্তে ছাই রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানা এসে থামল বড় বাজারে কটন স্ট্রিটের মুখে।

গাড়ি থেকে নামল চোখে নীল গগলস—আঁটা হাতে ছোটো এ্যাটাচি কেস সমেত কফি হাউসে দেখা লালজির সেই পরিচিত মূর্তি। রাত সাড়ে দশটার পর কটন স্টিটের অঞ্চল জনবিরল হয়ে এসেছে। এদিক—ওদিক তাকিয়ে লালজি গাড়ির কাচ তুলে দরজা লক করে দিল। তারপর কিছুদূর এগিয়ে বাঁ—দিকে ইঁট—বাঁধানো একটা সরু গলিপথ ধরলে। কাশীতে বাঙালিটোলার গলি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কটন স্টিটের এই বাই—লেনটির চেহারা খানিকটা বুঝতে পারবেন। দু’পাশে তেমনি উঁচু উঁচু বাড়ি। সেই অন্ধকার গলিপথে গ্যাসবাতির কোনো চিহ্নই নেই, কিন্তু আশ্চর্য, লালজি অত্যন্ত সহজভাবে হেঁটে যেতে লাগল।

বাই—লেনটা যেখানে একটা অত্যন্ত পুরানো তিনতলা বাড়ির দরজায় এসে শেষ হয়েছে, সেইখানে পৌঁছে লালজি ওপর দিকে তাকিয়ে দু’বার শিস দিলে। মিনিটখানেক পরে তেতলার একটা খড়খড়ি—জানলা খুলে গেল। অন্ধকারে আবছা একটা মুখ উঁকি দিয়ে খনখনে গলায় উর্দু ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে কে ডাকে?

নিচ থেকেও চোস্ত উর্দুতে জবাব হল, মারিজ! অর্থাৎ রোগী। ডাক্তারকে চাই।

কেসটা কি?

ডেলিভারি।

খড়খড়ি—দেওয়া জানলাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

একটু পরেই লোহার পাত—মারা সদর দরজার ভারী কাঠের পাল্লা দুটো বিশ্রী আওয়াজ করে একটু ফাঁক হল। আর সেই দ্বারপথে দেখা দিল চর্বি—বাতির একটুকরো হলদে আলো, আর অদ্ভুত একটা মুখ। বিলিতি থিয়েটারে ‘সাইলক ইহুদি’র ভূমিকায় অভিনেতাদের যে রূপসজ্জায় দেখা যায়, অবিকল তেমনি। সরু ছুঁচলো মুখে পাতলা কটা রঙের দাড়ি—গোঁফ, মাথায় কালো ভেলভেটের গোল টুপি, নাকটা কাকাতুয়ার ঠোঁটের মতো বাঁকা, আর দুই চোখে ধূর্ত শেয়ালের মতো লোভ, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বাসা।

চর্বি—বাতির আলোয় আরও একটা জিনিস দেখা গেল। দরজার ডান দিকের কপাটে আঁটা একটা কাঠের ফলকে হিন্দিতে লেখা :

পার্শি ডাক্তার

ফিরদৌস ইরাণি

স্ত্রী ও শিশুরোগে বিশেষ পারদর্শী

বাতিটা লালজির মুখের সামনে তুলে ধরে টুপিওলা লোকটি খনখনে গলায় বললে, এত রাত্রে যে!

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি জবাব দিলে, তোমার মতো ডাক্তারের কাছে রোগীদের এই তো আসার সময়।

কেসটা কি খুব জরুরি?

নিশ্চয়ই! খুবই জরুরি ইরানি সাহেব।

ইরানি সাহেব হাসলে। লোকটার সামনের দুটো দাঁত নেই। দন্তহীন মুখে হেসে ডাঃ ফিরদৌস ইরানি বললে, তাহলে এসো—ভেতরেই এসো লালজি।

লালজি ইরানি সাহেবকে অনুসরণ করলে।

তেতলায় নিজের ঘুরে ঢুকে ইরানি সাহেব আগে দরজার খিল বন্ধ করলে। তারপর বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে লালজিকে বললে, বসো!

ঘরখানা ডাক্তারের ঘরই বটে। গোটা তিন—চার আলমারি মোটা মোটা ডাক্তারি বইয়ে ঠাসা। একপাশে একটা বড় কাঠের র্যাকের ওপর নানারঙের ওষুধের শিশি—বোতল, খল, মেজার—গ্লাস, মাঝখানে বনাতমোড়া একটা টেবিল আর গোটা দুই—তিন চেয়ার। ঘরের বাকি অর্ধেকটা লম্বা পর্দা খাটিয়ে শয়নকক্ষ করা হয়েছে। সেদিকটায় আছে কম্বলপাতা একটা নেয়ারের খাট আর তার শিয়রে একটা রঙচটা লোহার সিন্দুক! সিন্দুকের ঠিক ওপরেই দেয়ালে ঝুলছে একটি আস্ত নরকঙ্কাল। সিন্দুকের ও একটা পিতলের ধূপদানী থেকে অল্প অল্প সুগন্ধ ধোঁয়া বেরোচ্ছিল! পর্দাটা সরিয়ে ইরানি সাহেব বললে, এইখানে বসো। লালজি এসে খাটের ওপর বসল। জপের মালা হাতে কালো আলখাল্লাপরা ইরানি সাহেব কাছে এসে দাঁড়াল সিন্দুকটায় হেলান দিয়ে। একটা সিগারেট ধরিয়ে লালজি বললে, তোমার এখানে আগেও কয়েক বার এসেছি ইরানি সাহেব, কিন্তু একটা কথা জানা হয়নি। ওই কঙ্কালটিকে মাথার শিয়রে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?

ইরানি সাহেব একবার ফিরে তাকাল। তারপর জপের মালার সাদা কালো কাচের গুটিগুলো নাড়তে নাড়তে বললে, লোহার সিন্দুকটা সারারাত পাহারা দেয় যে! ধূপ—ধুনো জ্বালিয়ে সারারাত ওকে জাগিয়ে রাখতে হয়।

লালজির মুখে কৌতুকের একটু হাসি দেখা দিল। বললে, ওঃ! ওইটি তাহলে তোমার পাহারাদার? আমি ভেবেছিলাম, তোমার পূর্ব্বপুরুষদের কেউ।

অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে ইরানি সাহেব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, আমার পূর্ব্বপুরুষরা সাধু ব্যক্তি ছিলেন।

বটে! সে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। আচ্ছা ইরানি সাহেব, তোমার তো তিনকুলে কেউ নেই বলেই শুনেছি। এই লোহার সিন্দুকটাকে যকের মত আগলে থাকো কেন বলতো? কার জন্যে?

ইরানি সাহেব অন্য দিকে তাকিয়ে রইল, জবাব দিল না। হাতের মালা দ্রুত ঘুরতে লাগল।

কই, জবাব দিলে না? তুমি মরলে কে ভোগ করবে তোমার এত টাকা?

এবার ইরানি সাহেব মুখ ফিরিয়ে বললে, সে—কথা আর একদিন তোমায় বলব লালজি। আজ থাক। কাজের কথা বলো।

কিছু মাল এনেছি বেচতে। নগদ টাকা চাই—আজই—এখুনি—

দন্তহীন মুখে ইরানি সাহেব হাসলে! বললে, বেশ, আগে মাল দেখাও, দরদস্তুর হোক—

লালজি অ্যাটাচি—কেসটা খুলে ফেললে। চুনি—পান্না—হীরে—মুক্তোগুলো চর্বিবাতির আলোয় রঙিন ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করল। ইরানি সাহেবের ধূর্ত চোখ দুটো চকচক করে উঠল। ছিলাছেঁড়া ধনুকের মতো সিধে হয়ে গেল আলখাল্লাপরা শীর্ণ ন্যুব্জদেহ। হাতের মালা গেল থেমে।

এগিয়ে এসে অলঙ্কারগুলো বাতির আলোয় নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ইরানি সাহেব বলছে, হুঁ, জিনিসগুলো মন্দ নয়, নিতে পারি। কি দামে ছাড়বে?

তুমিই বলো।

নিতান্ত নির্লিপ্তের মতো মুখ ঘুরিয়ে ইরানি সাহেব জবাব দিলে, সব মিলিয়ে হাজার দশেক।

বিশ হাজারের এক পয়সা কম নয়,—লালজি বললে।

দন্তহীন মুখে ইরানি সাহেব আবার হাসলে : বিশ হাজার? বিশ হাজার কত টাকা জান?

একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে লালজি বললে, জানি। বড় লোকের এক সপ্তাহের খরচ, আর গরিবের সারা জীবনের স্বপ্ন। যাক সে—কথা তুমি দেবে কিনা বলো।

ইরানি সাহেব ঘুরে গিয়ে আবার সিন্দুকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ঘুরতে লাগল হাতের মালা। উদাসীন কণ্ঠে শধু বললে, দশ হাজারের এক পাই বেশি না।

ও, আচ্ছা।

অ্যাটাচি—কেসটা বন্ধ করে লালজি উঠে দাঁড়াল। বললে, তোমার মতো ডাক্তার শহরে আরও দু’দশজন আছে। তাদের কাছেই যাই তাহলে।

এগিয়ে গিয়ে দরজার খিলটা খোলবার জন্যে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে খনখনে গলায় ডাক এল: শোনো, শোনো!

ফিরে না তাকিয়ে লালজি বললে, আমার সয়ম বড় কম।

শুনেই যাও না।

লালজি ঘুরে দাঁড়াল : বলো।

দেখো, নেকলেসের হীরেগুলো ঠিক খাঁটি নয়, আর মুক্তোগুলো ঝুটো—

লালজি বললে, চোখে তোমার ছানি পড়েছে ইরানি সাহেব।

যাকগে, দশের ওপর না হয় আরও পাঁচ দিচ্ছি—জিনিসগুলো রেখে যাও। হাতের টাকা ছাড়তে নেই লালজি।

সিগারেটের টুকরোটা পা দিয়ে ঘষে লালজি জবাব দিলে, হাতে টাকা এলে লালজি ছেড়েই দিয়ে থাকে, তোমার মতো সিন্দুকে ধরে রেখে ভৃতের পাহারা বসায় না।… সময় আমার বড় কম ইরানি সাহেব। পঞ্চাশ হাজার টাকার মাল মাত্র বিশ হাজারে দিতে চাইছি, আজ টাকার নিতান্ত দরকার বলে। নইলে পঁচিশ—তিরিশ হাজারে অনায়াসেই বেচতে পারতাম। কিন্তু আর দেরি করতে পারব না, লেন—দেন মিটিয়ে ফেলতে হয় তো এখুনি মিটিয়ে ফেলো।

আলখাল্লার পকেট থেকেই ইরানি সাহেব চাবি বের করে সিন্দুক খুললে। তারপর অ্যাটাচি—কেস থেকে অলঙ্কারগুলো ভেতরে রেখে কতকগুলো নোটের তাড়া খাটের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বিড় বিড় করে বকতে লাগল: বিশ হাজারে কিনলে আমার কি থাকবে বলো? ডাহা লোকসান হয়ে যাবে দেখছি!…

ক্ষিপ্রহাতে নোটের তাড়াগুলো খালি অ্যাটাচি—কেসে পুরতে পুরতে লালজি শুধু বললে, ঠিক আছে তো? গুনে নিলাম না কিন্তু! তুমি আবার সাধু পূর্বপুরুষদের বংশধর কিনা!

সিন্দুকটা আবার চাবিবন্ধ করতে করতে ইরানি সাহেব বললে, চোরে—চোরে কখনও বেইমানি করে না।

লালজি একবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। তারপর দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললে, আবার দেখা হবে।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ ক্রমশ : মিলিয়ে গেল।

আবার সেই রাত্রে—

রাত প্রায় বারোটা বাজে।

মানিকতলা হালসিবাগানের রাস্তা তখন একেবারে নির্জন হয়ে এসেছে। ১৭/১বি, বাড়িটার নিচেকার একটি জানলা তখনও খোলা। ভেতরে হ্যারিকেন লন্ঠনের আলো তখনও জ্বলছে দেখা গেল। গল্পের পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমাদের এই ঘরেই যেতে হবে।

দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ঘরটাকে ছোটই বলতে হবে। নিতান্ত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরের চেহারা যা হয় তাই। সাজানো আছে, তবে সজ্জা তেমন বিশেষ কিছু নেই। অতি পুরাতন একটা ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসেছিলেন হরলাল চাটুয্যে। বয়স পঞ্চাশের ওপর গেছে। বহু ঝড়—ঝাপটা খেয়ে যে—জাহাজ ভাঙা হাল আর ছেঁড়া পাল নিয়ে কোনোরকমে বন্দরে এসে ভিড়েছে, ভদ্রলোকের চেহারাটা তারই অনুরূপ। অদূরে তক্তাপোশের ওপর বসে তাঁর স্ত্রী। শীর্ণ মুখে জ্বলজ্বলে একটি সিঁদূর—টিপ ছাড়া আর কোনো আভরণ তাঁর নেই।

হরলালবাবু গড়গড়ার রবারের নলটা মুখে দিয়ে তামাক টানার নামে মাঝে মাঝে শুধু আওয়াজ করছিলেন। কলকের তামাক বহুক্ষণ আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রাচীন একটা জাপানি ওয়ালক্লক টকটক আওয়াজে সময়ের বুকে দুর্বলভাবে হাতুড়ি পিটে চলেছে। শুধু সময়ের বুকে নয়, হরলালবাবু আর তাঁর স্ত্রী বিরজা দেবীর বুকেও।

বিরজা দেবী বললেন, হ্যাঁগা, এখনও তো এল না?

আসবে, আসবে। হরলালবাবু অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন।

ঠিক আসবে তো?

তাই তো বলেছিল।

মুখ থেকে রবারের নলটা ফেলে, ঘরের অপরিসর জায়গাটুকুতে হরলালবাবু পায়চারি সুরু করলেন। দুই হাত পিছন দিকে পরস্পর—বন্ধ। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।

জাপানি ওয়ালক্লক সময়ের বুকে হাতুড়ি পিটে চলেছে।

বিরজা দেবী আবার প্রশ্ন করলেন, কখন আসবে বলেছিল?

আজ রাত বারোটার মধ্যে।

হ্যাঁগা, কথা সে রাখবে তো?

কি জানি, আশা তো করি!

ঘড়ির নিচে দক্ষিণা—কালিকার একটি পট ঝোলানো। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী একবার হাত দুটি জোড় করলেন। তারপর ঈষৎ উচ্চচকণ্ঠে বললেন, আশা, ঘুমোলি মা?

ঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে দেখা গেল, পাশের ঘরের বিছানায় তিন চারটি ঘুমন্ত বালক—বালিকার পাশে অল্পবয়সি একটি মেয়ে একবার পাশ ফিরল শুধু। বোঝা গেল, আশার চোখে ঘুম নেই। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী আরও কি বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন।

সময়ের বুকে অবিশ্রান্ত হাতুড়ি পেটা চলেছে। চলে যাচ্ছে সেকেন্ডের পর সেকেন্ড মিনিটের পর মিনিট।

কাঁপা গলায় বিরাজ দেবী ডাকলেন, শুনছো, বারোটা যে বাজে, কখন আসবে সে?

হরলালবাবু জবাব দিলেন না। পায়চারি দ্রুততর হয়ে উঠল।

হঠাৎ ব্যাকুল স্বরে বিরজা দেবী বলে উঠলেন, হ্যাঁগা, যদি না আসে—যদি মিথ্যে আশা দিয়ে থাকে? তবে কি আমার আশার কোনো গতি হবে না?

হরলালবাবুর বুকের পাঁজরা ভেদ করে একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল: তারা! তারা!

বিরজা দেবীর গালের ওপর দিয়ে ঝর ঝর করে চোখের জল নেমে এল! হরলালবাবুর কাছে উঠে এসে তিনি বলতে লাগলেন, কাল রাত পোহালেই মেয়ের বিয়ে, অথচ এখনও একটি পয়সা জোগাড় হল না! কি করে কি হবে—আমি যে আর ভাবতে পারছি না!…

গভীর স্বরে হরলালবাবু বললেন, ভাবতে আমিও আর পারছি না বিরজা। দু’দুবার বাঁধা দেওয়া এই বাড়িখানা—এরই বা কি দাম আছে বলো! গরিবের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাটাই ভুল বিরজা।

সজলকণ্ঠে কতকটা আত্মগতভাবেই বিরজা দেবী বললেন, গরিবের কি কেউ নেই?

ভেবেছিলাম একজন অন্তত আছে। তাই তো ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে যেদিন মোহিতমোহনের গাড়িতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সেদিন ভেবেছিলাম এ শুধু ঠাকুরের দয়া! আমার মুখে সব কথা শুনে সে বললে, আপনি কিছু ভাববেন না নিশ্চিন্তে বিয়ের দিন স্থির করুন। টাকা আগের দিন রাত বারোটার মধ্যে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। মোহিতমোহনের কথায় বিশ্বাস করেই তো এতটা এগিয়েছি। নইলে একশ—দশ টাকার কেরাণি আমি, আমার সাধ্য কি, অমন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ভরসা করি?

কিন্তু মোহিতমোহন তো এখনও এল না? কি উপায় হবে কাল সকালে?

গরিবের ভাগ্যে যা হয়, তাই হবে। কুল—মান সম্ভ্রম সবই যাবে। আর আশার মুখের দিকে চেয়ে কেঁদে কেঁদে তোমার দিন কাটবে!… হরলালবাবুর শুকনো ধরা গলা উত্তেজনায় প্রখর হয়ে উঠল : গরিবের কেউ নেই বিরাজা, কেউ নেই। গরিবের ঠাকুরও নেই, নইলে মোহিতমোহন আসত!… রাত বারোটার মধ্যে নিশ্চয়ই….

হরলালবাবুর মুখের কথা শেষ হল না। পঙ্গু স্থবিরের মতো ক্যাম্বিশের চেয়ারটায় তিনি বসে পড়লেন।

জাপানি ওয়ালক্লকটায় তখন টং টং করে বারোটা বাজছে!

এল না! মোহিতমোহন এল না!

বিরাজা দেবীর দুই চোখ তখন অশ্রুতে অন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষিণা কালিকার পটের তলায় পাগলের মতো তিনি মাথা খুঁড়ছেনঃ মাগো, একি করলি মা—একি করলি?…

ঠিক সেই মুহূর্তে!

বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল না?—আবার শব্দ হল— আবার—

সহসা উদভ্রান্তের মতো হরলালবাবু ‘কে?’ বলে ছুটে গেলেন।

দরজা খুলতেই আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা। একটি মূর্তি লম্বা চওড়া বড় একখানা মোটা খাম হরলালবাবুর হাতে দিল। বিমূঢ় হরলালবাবু তাকে কিছু প্রশ্ন করার আগেই পথের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো সে মিলিয়ে গেল। কম্পিত হাতে হরলালবাবু তাড়াতাড়ি খামটা ছিঁড়তেই বেরোল একশো টাকার একতাড়া নোট আর একখানা চিঠি।

পাগলের মতো হরলালবাবু চিৎকার করে উঠলেন, বিরাজা আমার চশমা—আমার চশমা দাও শিগগির—

চশমা লাগিয়ে লন্বনের কাছে এসে হরলালবাবু চিঠিখানা পড়লেন:

আমার প্রতিশ্রুত টাকা পাঠাইলাম। আপনার মেয়ের বিবাহের জন্য পাঁচ হাজার, আর বন্ধকী বাড়িটা ছাড়াই বার জন্য সাত হাজার। বিবাহের শুভকাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হৌক, এই কামনা করি।

 মোহিতমোহন

চিঠিপড়া যখন শেষ করলেন, তখন চোখের জলে হরলালবাবুর চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে। আর বিরজা দেবী ছুটে গিয়ে আশার মাথায় হাত দিয়ে হেসে—কেঁদে বলতে লাগলেন, আর কত ঘুমোবি পোড়ারমুখী, তোর দুঃখের রাত যে এবার কাটল!…

.

কুইন মেরি হোটেল।

প্রিন্সেপ স্ট্রিটের ওপর গঙ্গামুখী প্রকাণ্ড সৌধ। শহরের সেরা অভিজাত পান্থশালা। এই হোটেলের তেরো নম্বর কামরায় চলুন। আজ দিনের আলোয় গল্পের দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা উঠবে সেখানে।

পুব দিকের এই ঘরে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল লালজির ঘুম ভেঙেছে। সকালের অজস্র রোদে জানলা দরজার ফিকে সবুজ নেটের পর্দাগুলো ঝলমলিয়ে উঠেছে। ধবধবে নরম বিছানায় আড় হয়ে বসে লালজি দিনের সংবাদপত্রে চোখ বুলোচ্ছিল। পাশে তো—পায়া একটা টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম, মিনেকরা রুপোর পানের ডিবে, সিগারেট—কেস আর হাতঘড়ি।

বেয়ারা এসে ফুলদানিতে তাজা ডালিয়ার গোছা সাজিয়ে দিয়ে গেল। সংবাদপত্র রেখে আলস্যভরে লালজি একটা হাই তুললে। তারপর ডিবে থেকে গোটা দুই পান তুলে নিলে। সিগারেট সে কমই খাই।

ঘরে এসে দাঁড়াল খাঁকি উর্দিপরা মাঝারি সাইজের অত্যন্ত বলিষ্ট চেহারার একটি লোক। লোকটার বাঁ—চোখটা কানা, কিন্তু ডান চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ন!

এই লোকটিকেই আমরা দেখেছিলাম রাজারামের দোকানের ফটকে চকোলেট রঙের গাড়ির ড্রাইভারের আসনে। লোকটির নাম মাহাঙ্গু।

মাহাঙ্গু দীর্ঘ সেলাম জানিয়ে দাঁড়াল।

লালজি প্রশ্ন করলে, গাড়ি দুটোর রঙ বদলাতে দিয়েছ মাহাঙ্গু?

লোকটি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লে।

আর নাম্বার প্লেট দুটো?

মাহাঙ্গু জানালে, সে আগেই বদলে দিয়েছে।

ঠিক আছে। রাত্রে কফি হাউসে হাজির থেকো।

আবার সেলাম জানিয়ে মাহাঙ্গু বিদায় নিল।

এইবার জরিদার চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে, ড্রেসিং গাউনটা পায়ে চাপিয়ে লালজি ঘর থেকে বেরিয়ে এল বাইরের লবিতে। প্রভাতী চায়ের বৈঠক সেখানে তখন শেষ হয়ে গেছে। শুধু একধারে একটি প্রাণী তখনও বসে বসে কোঁচার খুঁট দিয়ে চায়ের পেয়ালাটি সযত্নে ধরে তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছিল।

লালজিকে দেখে পরম আপ্যায়নের সঙ্গে লোকটি বলে উঠল। আসতে আজ্ঞা হোক বাবু সাহেব।

লোকটির দিকে লালজি সকৌতুকে ফিরে তাকাল। সেই বিচিত্র মূর্তি! গায়ে গেরুয়া রঙের হাতকাটা বেনিয়ান, গলায় তুলসীর কণ্ঠি, কপালে, নাকে আর কানের দুই ডগায় গেরিমাটির তিলক। দিন দুই হল লোকটা হোটেলে এসে উঠেছে। একরকম গায়ে পড়েই লালজির সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করছিল। নাম গোপীকান্ত আচার্য্য। আসামের এক জমিদারের সেরেস্তায় কাজ করে। সদাহাস্য মুখ বৈষ্ণব—বিনয়ে সদাই বিগলিত।

পেয়ালায় সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে গোপীকান্ত বললে, চা বড় মজার জিনিস, বুঝলেন বাবু সাহেব? খেতে না খেতেই দেহ একেবারে চাঙ্গা! গৌর! গৌর! ইচ্ছে করেন নাকি এক বাটি?

লালজি ঘাড় নেড়ে জানাল, না।

অতি সন্তর্পণে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে গোপীকান্ত পুনরায় বললে, একটা কথা শুধোই বাবু সাহেব। চায়ের এই বাটি—টাটিগুলো এরা গঙ্গাজলে ধোয় তো?

হাসি চেপে লালজি বললে, তা আর বলতে!

গোপীকান্ত অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে উঠল, গৌর! গৌর! তারপর একটা বিড়ি বের করে ধরিয়ে প্রশ্ন করলে, আচ্ছা বাবু সাহেব, ক্লাইভ রো ইস্টিশানটা কোন দিকে পড়বে বলতে পারেন?

ইস্টিশান!

আজ্ঞে, যেমন হাওড়া, শেয়ালদা ইস্টিশান।

এবার লালজি ব্যাপারটা বুঝতে পারল। অতি কষ্টে হাসি সম্বরণ করে বললে, ক্লাইভ রো ইস্টিশান নয় আচায্যি মশায়, ওটা একটা রাস্তার নাম! তা, কোথায় যাবেন?

যাব আপনার গিয়ে ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্স কোম্পানির আপিসে।

কি কাজে? লাইফ ইন্সিওর করেছেন নাকি?

আজ্ঞে না, আমি ছাপোষা মানুষ। জমিদারির কাজ করি আর গৌর নাম গাই।

তবে কি কাজে যাবেন সেখানে? সেখানে তো গৌর নাম হয় না!

বলি তাহলে শুনুন।—সোফার ওপর দুই পা তুলে গোপীকান্ত আরাম করে বসল। তারপর শুরু করলে, আমাদের জমিদার বাহাদুর জানকীনাথ চৌধুরি মশায়ের শিকারের বাতিক ছিল। দিন নেই, রাত নেই, খালি হাতির পিঠে বন্ধুক হাতে জঙ্গলে জঙ্গলে দুমদাম করে বেড়াতেন। কিন্তু কৃষ্ণের জীব—হত্যা ধর্মে সইবে কেন? মাসখানেক আগে একদিন হাতির পিঠ থেকে পড়ে—ব্যাস খতম। মরবার বছর দুই—তিন আগে জমিদার বাহাদুর মেয়ে অপর্ণার নামে পনেরো হাজার টাকার ইনসিওর করে যান। ওই একটিমাত্র মেয়ে কিনা—তায় বিধবা! হাজারিকা মশাই—মানে আমাদের ম্যানেজার ভূজঙ্গধর বাবু আমায় ডেকে বললেন, গোপীকান্ত, তুমি একবার কলকাতায় যাও। জমিদারির দু’টো—একটা কাজ সেরে এসো, আর সেই সঙ্গে অপর্ণা—মায়ের নামের পলিসিখানাও নিয়ে যাও। ইনসিওর কোম্পানি থেকে টাকাটা তোলার ব্যবস্থা করে এসো।

লালজির দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করল, কোন কোম্পানি বললেন?

ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানি। ৩২।১ ক্লাইভ রো।

স্মিত হাসিতে লালজির মুখ ভরে গেল। বলে উঠল, আরে, এ তো আমাদেরই কোম্পানি! আমি যে ওখানকার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।

গৌর! গৌর!—গোপীকাস্তের মুখ থেকে বিড়িটা খসে পড়ে গেল। লালজির একখানা হাত চেপে ধরে বললে, তাহলে আমার এই কাজটুকু আপনাকে করে দিতে হবে বাবু সাহেব। বিদেশি লোক আমি, জানা—চেনা নেই—

পরম আশ্বাসের সুরে লালজি বললে, এ আর অধিক কথা কি! যা করবার আমিই সব করে দেব।

তাহাকে আপনার সঙ্গেই কোম্পানির অফিসে যাই, কি বলেন?

লালজি বললে, আপনি আর কেন কষ্ট করবেন আচায্যি মশাই? পলিসিখানা আমাকে এনে দিন, সব ব্যবস্থা আমিই করব’খন। আপনি বরং নির্জনে বসে গৌর নাম করুন।… হ্যাঁ, জমিদার সাহেবের ডেথ সার্টিফিকেটটাও এনেছেন তো?

গোপীকান্ত বললে, তা তো বলতে পারি নে। কাগজপত্রগুলো এনে দিই, আপনি দেখুন।

গোপীকান্ত একরকম ছুটেই চলে গেল। লালজি এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখল, দু’—একটা বেয়ারা ছাড়া আর কেউ আনাগোনা করছে না। লবির কোণে রাখা ফোনের রিসিভারটা লালজি তুলে নিল: হ্যালো….সিটি ১০০১… ওয়েলেশলি কফি হাউস?… একবার দোতলায় কানেকশনটা দিল তো!… জোহরা?… হ্যাঁ, আমি…এখুনি একবার আসতে হবে।… হ্যাঁ, এখখুনি।…এই ধরো সাড়ে দশটার মধ্যে। আর শোনো, কি পোশাকে আসবে বলে দিই… সরু জরিপাড় সাদা মলমলের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, গলায় সরু একগাছি হার ছাড়া আর কোন অলঙ্কার থাকবে না। চোখের কাজল তুলে ফেলবে, বুঝলে?…ব্যাপার সবই জানতে পারবে এখানে এলে… রাস্তায় একখানা ট্যাক্সি ধরে…

লালজি হঠাৎ রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল। গোপীকান্ত এল লম্বা পুরু একটা খাম হাতে নিয়ে। লালজি খুলে দেখে বললে, ঠিক আছে।… আপনি নিশিন্তে গৌর নাম করুন গে আচায্যি মশাই! টাকাটা সময়মতো আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবে’ খন।

যে আজ্ঞে—গৌর! গৌর!—গোপীকান্ত বিদায় নিল।

লালজিও নিজের ঘরের দিকে ফিরল।

কিন্তু আশ্চর্য! দরজার হাতলে হাত দেওয়ার আগেই ভেতর থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল নিতান্ত অপরিচিত একাটি মেয়ে। বাঙালির মেয়ে হলেও দীর্ঘচ্ছন্দ দেহ, মোটামুটি সুন্দরী। বয়স পঁচিশের ওপর মনে হয়। পরনে ঘন কালো জর্জেটের শাড়ি, গায়ে হাতের কব্জি পর্যন্ত পুরো হাতা ব্লাউজ। চুলগুলি কপালের ওপর আঁট করে তুলে বাঁধা। চোখে সরু সোনার ফ্রেমের চশমা। মেয়েটাকে দেখলে স্কুল মিসট্রেস বলেই মনে হয়।

লালজি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, আপনি?

মেয়েটি একবার লালজির মুখের দিকে তাকাল। তারপর বললে, আমি লেডি মুখার্জির কাছে এসেছি, তাঁর একজন গভর্নেস চাই, তাই—

কিন্তু এ ঘরে তো লেডি মুখার্জি থাকেন না!

তবে কে থাকেন?

লালজি সমুখের দিকে ঈষৎ ঝুঁকি স্মিতমুখে বললে, অধম। লেডি মুখার্জির কামরা ছ’নম্বর!

অপরিচিতা একটু সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ও তাই নাকি?… কিন্তু এটাই তো ছ’ নম্বর কামরা?

আজ্ঞে না, এটা ন’ নম্বর।

সে কি! আপনি বোধহয় ভুল করছেন।

ভুলটা বোধকরি আপনারই হচ্ছে।

কক্ষনো না! এ ঘরের নম্বরটা তাকিয়ে দেখুন তো!

দু’জনে একসঙ্গেই দরজার মাথায় তাকিয়ে দেখল। লালজির মুখে মৃদু হাসি ফুটল। বললে, ভুলটা দেখছি আমাদের কারোর নয়, দৈবের। আমার ঘরের নাম্বার প্লেটটা কেমন করে জানি না উল্টে যাওয়াতে ইংরেজি ‘9’ টা হঠাৎ ‘6’ হয়ে গেছে!

মেয়েটি লজ্জিত অপ্রতিভ মুখে বললে, ও তাই তো!… কিছু মনে করবেন না যেন!

কিছুমাত্র না!—লালজি হাসিমুখে বললে।

ছোট্ট একটা নমস্কার করে অপরিচিতা যাবার জন্যে পা বাড়াতেই দেখা গেল, দূরের লবি থেকে জোহরার সাদা শাড়ি পরা মূর্তিটা এগিয়ে আসছে। মুখে সেই সূক্ষ্মকালো আবরণ।

লালজি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

জোহরা প্রবেশ করে মুখের আবরণ তুলে দিল। তারপর প্রশ্ন করলে, ও মেয়েটি কে লাল?

তরল কণ্ঠে লালজি বলে উঠল, ‘পথভোলা এক পথিক’।

মানে? মানে, চিনি না। নারীকে দেবতারাই চিনতে পারেন না, আমি কি করে চিনব বলো?

এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জোহরা বললে, থাক, বলতে হবে না। প্রশ্ন করাটাই আমার ভুল হয়েছিল।

লালজি সকৌতুকে একবার তার দিকে চাইল। বললে, দেখো জোহরা, তুমি বরং রাগ কোরো, কিন্তু অভিমান করো না। মেয়েরা অভিমান করলে আমার কেমন হাসি পায়।

 আহতকণ্ঠে জোহরা বললে, দুনিয়ায় এক জাতের মানুষ আছে, চোখের জল দেখলেও তাদের হাসি পায়।

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি বললে, আচ্ছা, মাঝে মাঝে তোমার মেজাজ অমন বিগড়ে যায় কেন বলো তো? কি হয় তোমার?

জোহরা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললে, কিছু না।… ওকথা থাক, কেন ডেকেছ বলো।

পথে যেতে যেতে বলব। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

আধ ঘণ্টা বাদে কুইন মেরি হোটেলের ন’নম্বর ঘর থেকে গলাবদ্ধ কোটের ওপর মাফলার জড়ানো, ট্রাউজার পরা, মোটা ফ্রেমের চশমাচোখে মুখে কাঁচা—পাকা ছাঁটা গোঁফ, রুপো—বাঁধানো লাঠি হাতে একটি মধ্যবয়সি প্রৌঢ়কে অবণ্ডণ্ঠনবতী একটি মহিলার সঙ্গে আমরা বেরিয়ে যেতে দেখলাম।

দূরে ক্লক—টাওয়ারে বাজল সাড়ে দশটা।

.

সকাল সাড়ে দশটা বাজল আরেক জায়গায়। পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসার পঙ্কজ গুপ্তের খাস—কামরায়।

জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন অফিসার। বলছিলেন, ব্যাপারটা গুলি—গোলা—খুন—জখমের চেয়েও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। প্রায় ষোলো বছর পুলিশ—লাইনে আছি, চারশো বিশ কেস অনেকরকম দেখেছি, কিনারাও করেছি অনেক, কিন্তু এমন নিখুঁত জুয়াচুরি কখনও দেখিনি হে! ব্যাপারটার কিনারা সহজে হবে বলে মনে হয় না। তোমার কি মনে হয় বিশু?

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ওরফে বিশুকে চিনতে আপনাদের দেরি হবে না নিশ্চয়ই। ‘রোমাঞ্চ’ যাঁরা নিয়মিত পড়েন, তাঁরা বিশুকে ‘রোমাঞ্চ’র জন্ম থেকেই গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ীর সঙ্গেই দেখে আসছেন। বিশু অফিসার পঙ্কজ গুপ্তের বিশেষ বন্ধু।

একটা চেয়ারে বসে বিশু টেবিলের ওপর কতকগুলো দেশলাইয়ের কাঠি সাজিয়ে কি একটা অদ্ভুত খেলায় মেতেছিল। সেইদিকে দৃষ্টি রেখেই সে জবাব দিলে, মনে কিছুই হয় না, কেননা, মনে হবার মতো কোনো সূত্রই এখনও পাওয়া যায়নি।

অফিসার গুপ্ত একটু হেসে বললেন, তবে কি এতদিন বৃথাই প্রতুল লাহিড়ীর সাগরেদি করেছ?

বিশু এবার মুখ তুলে শান্ত গলায় বললে, ধীরে বন্ধু ধীরে! আমি তো পি.সি. সরকার নই যে, ম্যাজিকে রহস্যের কিনারা করে ফেলব?

অফিসার গুপ্ত কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় টেলিফোন উঠল বেজে। গুপ্ত রিসিভারটা তুলে নিলেন: হ্যালো… পার্ক স্টিট থানা… হ্যাঁ, আমি গুপ্ত। কে?… রাজারামবাবু… না, এখনও কোনো কিনারা হয়নি। কেসটা খুব সহজ নয়—কিনারা করতে সময় নেবে…চকোলেট রঙের গাড়িটার নম্বর পাওয়া গেছে? মানে, রুক্মিণীর গাড়ির? … হ্যাঁ, বলুন… GK 3399?… নম্বর নিয়েছিল কে? আপনার পাঠান দরোয়ান?… আচ্ছা দেখি, নম্বরটা কোনো কাজে লাগে কিনা… হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খবর নেবেন… দরকার হলে আমিও ফোন করব।… আচ্ছা …

রিসিভারটা রেখে দিয়ে অফিসার গুপ্ত তাড়াতাড়ি তাঁর নোট—বইয়ের পাতা উল্টোতে লাগলেন। স্যার জগদীশপ্রসাদের কন্যা রুক্মিণীর গাড়ির বর্ণনা ও নম্বর এতে লেখা আছে। কিন্তু দেখা গেল, রাজারামের দেওয়া নম্বরের সঙ্গে তার আকাশ—পাতাল প্রভেদ। রুক্মিণীর গাড়ি হল টকটকে লাল রঙের ‘মার্সিডিজ’, নম্বর WBC 1001!

নোটবই ফেলে অফিসার গুপ্ত হতাশ হয়ে বলে উঠলেন, নাঃ!

বিশু জিজ্ঞাসা করল, কাল তুমি আসল রুক্মিণীর খবরের জন্যে বেঙ্গল ক্লাবে গিয়েছিলে না?

অফিসার বললেন, হ্যাঁ। সেখান থেকে জানতে পারলাম, রাজারামের দোকানে যখন ঘটনা ঘটে, সে—সময় রুক্মিণী একজন চেক—মহিলার সঙ্গে টেনিস খেলছিল। তারপর ক্লাব থেকে তারা সদলে নিউ এম্পায়ারে যায়। তাছাড়া ক্লাবে যে ‘বার’ আছে,সেখানে রুক্মিণীর সই করা অনেক পুরোনো বিল রয়েছে। তার সেই সইয়ের সঙ্গে রাজারামের চেকের সই মিলিয়ে দেখলাম কোথাও এতটুকু মিল নেই—যদিও ওই ব্যাঙ্কেই রুক্মিণীর অ্যাকাউন্ট রবাবর খোলা আছে।

পকেট থেকে চেকটা বার করতে করতে অফিসার গুপ্ত বললেন, তুমি তো হ্যান্ডরাইটিং—এক্সপার্ট বিশু, এটা একবার দেখো দিকি!

চেকটা হাতে নিয়ে বিশু খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, লেখাটা নিতান্ত কাঁচা হাতের, রুক্মিণীর মতো বিলাত—ফেরত মেয়েদের এমন লেখা হতে পারে না! যে কলমে এই চেক লেখা হয়েছে, লেখক সে—কলম আগে বড় একটা ব্যবহার করেনি। তাই সই করতে গিয়ে এক জায়গায় অল্প খোঁচা লেগে গেছে। কলমটা যে নিয়মিত ব্যবহার করে, বাঁ—দিকে চেপে লেখাই তার অভ্যাস; আর সেই অভ্যাসের ফলে নিবের বাঁ—দিকটা ঈষৎ ক্ষয়ে গেছে। এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারব না, গুপ্ত।

চেকটা আবার পকেটে রাখতে রাখতে অফিসার গুপ্ত বললেন, কিন্তু এইটুকু সূত্র থেকে ছদ্ম রুক্মিণীকে খুঁজে বের করা কি সম্ভব হবে বিশু?

বিশু বললে, কিসের থেকে কি যে সম্ভব হয়, তা কে বলতে পারে গুপ্ত? তবে আমার মনে হয়, রুক্মিণী—রহস্য ভেদ করার আগে লালজি রহস্য ভেদ করতে পারলেই সব কিছুর কিনারা হয়ে যাবে।

অফিসার গুপ্ত বললেন, ঠিক কথা। কিন্তু লালজি নিজেকে এমন ভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে যে তার বিরুদ্ধে কোনো চার্জই দাঁড় করানো যাচ্ছে না। ধরো, লালজি যদি স্বীকারই করে যে, সে রাজারামের দোকানে গিয়েছিল, তাহলেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, পঁচিশ হাজার টাকার অলঙ্কার সে কেনেনি, ঠকিয়ে নিয়েছে। পঁচিশ হাজার টাকার বিল দেখিয়ে বলতে পারে যে, নগদ টাকায় সে অলঙ্কার কিনেছে। কেননা বিলটা ছদ্ম রুক্মিণীর হাত থেকে দরকার মতো তার হাতে নিশ্চয়ই আসবে। সুতরাং আইনকে সে অনায়াসেই বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে। অথচ পঞ্চাশ হাজার টাকার শোকে রাজারাম পাগল হয়ে উঠেছে, তাকেই বা ঠেকাই কি করে?… আমার একটা অনুরোধ রাখবে বিশু?

বিশু আবার দেশলাইয়ের কাঠির খেলার মন দিয়েছিল। মুখ না তুলেই বলল, বলো।

এই কেসটায় তুমি আমাকে সাহায্য করো, যেমন করে পারো, খোঁজ নাও, এই লালজি লোকটি কে? কি তার আসল পরিচয়?

আগে জানা দরকার থাকে কোথায়? বিশু বললে।

দরজার কাছে থেকে মেয়েলি গলায় জবাব এলো: কুইন মেরি হোটেল, ন’নম্বর কামরা।

বিশু এবং গুপ্ত দু’জনে একসঙ্গে তাকিয়ে দেখলে, একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। পরনে কালো জর্জেট, চোখে চশমা, চুলগুলি কপালের ওপর আঁট করে তুলে বাঁধা।

বিশু সবিস্ময়ে বলে উঠল, রমলা! তুমি লালজির খবর কেমন করে জানলে?

মৃদু হেসে রমালা জবাব দিলে, আমি সংবাদপত্রের রিপোর্টার। অনেক কিছুই আমাদের জানতে হয় বিশুদা।

গুপ্ত বললেন, ব্যাপারটা খুলে বলি, শোনো বিশু। কাল কলকাতার সমস্ত হোটেলে ফোন করে আমি জানতে পারি যে, আগে লালজি ছিল সাডার স্ট্রিটে ‘ফেয়ার—লন’ হোটেলের স্থায়ী বোর্ডার। আজ সপ্তাহ দুই হল সেখান থেকে হঠাৎ উঠে গেছে। কোথায় গেছে, হোটেলের কর্তৃপক্ষ বলতে পারেনি। বাবুর্চি এবং খানসামাদের কাছে খোঁজ করায় আবদুল বলে একটি খানসামা আমাকে জানায় যে, লালজি বর্তমানে প্রিন্সেপ স্টিটে কুইন মেরি হোটেলে গিয়ে উঠেছে। ভাল করে জেনে আসবার জন্যে রমলাকে আজ সকালে আমিই সেখানে পাঠিয়েছিলাম।

বিশু সহর্ষে বলে উঠল, বটে! কিছু খবর পাওয়া গেল নাকি?

রমলা জবাব দিলে, নিশ্চয়ই! খবর সংগ্রহ করাই যে আমাদের পেশা। লালজির সঙ্গে আলাপ করে, তাঁর চেহারায় এবং তাঁর ঘরে সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না। বরং এই ধারণা নিয়েই ফিরে এসেছি যে, লালজি একজন রুচিবান, ভদ্র, শৌখিন পুরুষ। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফাইন জেন্টলম্যান’। লোকটির মধ্যে আর কিছু থাক আর না থাক, ব্যক্তিত্ব আছে যথেষ্ট—

আর আধুনিক মেয়েদের পক্ষে সেটাই সব চেয়ে বড় আকর্ষণ, তাই নয় কি রমলা? যাক লোকটাকে তোমার কি রকম মনে হল?

রমলা ফোঁস করে একটা কৃত্রিম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললে, মনে হল, এই সে—ই যার জন্যে একদা রাধা হয়ে আমি লাজ—লজ্জা, কুল—মান খুইয়ে বসেছিলাম। সে যে কি, তা কেমন করে বলব? আমার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বিশুদা!

অফিসার গুপ্ত সশব্দে হেসে উঠলেন।

বিশু বললে, তামাসা রাখো রমলা। কুইন মেরি হোটেলে গিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখোনি?

এবার সংযত কণ্ঠে রমলা বললে, দেখেছি। হোটেল থেকে চলে আসার আগে সাদা শাড়ি পরা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত টাইপের একটি মেয়েকে লালজির ঘরে ঢুকতে দেখলাম।

দেখতে কেমন?

দেখতে পাইনি। কালো ‘ভেল’ দিয়ে মুখ ঢাকা ছিল।

আর কিছু দেখতে পেয়েছ?

লালজির মাথার বালিশের তলায় এই চিরকুটটা পাওয়া গেছে।— ব্লাউজের বুকের ভেতর থেকে রমলা বালির কাগজের একটা ভাঁজকরা টুকরো বের করে বিশুর হাতে দিল। তাতে পেন্সিলে লেখা:

কিং জর্জেস ডক (ইস্ট)

এস.এস.স্যাভেজ গার্ল

৫।৩।৫০

কাগজটা পকেটে পুরে বিশু জিজ্ঞাসা করলে, আর কিছু?

রমলা জানালে, উল্লেখযোগ্য আর কিছুই তো চোখে পড়েনি। তার পর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠল, এবার আমাকে উঠতে হবে—অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে।

গুপ্ত দাঁড়িয়ে উঠে বললে, বেশ এসো। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি রমলা, লেডি মুখার্জির গভর্নেসের চাকরিটা দু’—একদিনের মধ্যে যেমন করেই হোক তোমাকে নিতে হবে। চাকরিটা যাতে নিশ্চিত পাওয়া যায়, সেইজন্যে ব্যারিস্টার এস, এন, গুহ—র সার্টিফিকেট আমি এনে দোব।… আচ্ছা, এসো।

চশমাটা হাতব্যাগে ভরে রমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অফিসার গুপ্ত এবার বিশুর পানে তাকিয়ে বললেন, এরপর থেকে কিন্তু তোমার ওপর ভার রইল।

বিশু আবার দেশলাইয়ের কাঠিতে মন দিয়েছিল। বললে, দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। আপাতত রমলার দেওয়া এই কাগজের চিরকুট থেকে কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে।

.